সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব
-কর্ণার সিট ম্যাডাম!
বলেই চোখ টিপে ঝোরার কোমর টেনে ধরলো অরিত্র।
-হ্যাঁ!এ আর নতুন কি?তুই সিনেমা দেখতে আসিস নাকি!!
-ধুস!সিনেমা দেখার জন্য তো ল্যাপটপ আছে।আমি তো তোকে দেখবো...
-চল!দেখা!!
আদর করে অরিত্রর দাড়িতে ভরা গাল টিপে দিলো ঝোরা।
-এখানেই!?
-আপদ!টিকিটটা ওনাকে দেখা!!
-ওহ আচ্ছা!সরি...
ফোন নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো অরিত্র।
-ওই ঝোরা,শোন না!আর ভালো লাগছে না!চল না, ইন্টারভ্যালে বেরিয়ে যাই।কি জঘন্য মুভি...
-ভাই তুই কি চাস বল তো?ডাকলি কেন তবে?তোর মাথায় যদি অলরেডি অন্য মুভি ঘুরতে থাকে,তো টাকাটা নষ্ট করলি কেন!
-চল তো!ওসব ছাড়!!ওঠ-ওঠ!বেরো!ইন্টারভ্যালের আগেই পালাই...
-আরে ধুর বাবা!!দাঁড়ানা,এক্ষুণি একশন...
-আরে পরে তোকে আমি ব্লু-রে তে দেখিয়ে দেবো।পেন-ড্রাইভে নিয়ে নিস!এখন চল তো!
-উফফ!!আচ্ছা জ্বালা তো...
বাকি পপকর্নটুকু ঝেড়ে-ঝুড়ে মুখে দিয়ে কাগজটা সিটের পাশে গুঁজে দিলো ঝোরা।তারপর অরিত্রর হাত ধরে উঠে পড়লো,বেরিয়ে এলো বাইরে...
-হুম,এবার বল!কি?
-চল!!
ঝোরার কোমরে হাত রাখলো অরিত্র,জড়িয়ে ধরলো ওকে।হেসে ফেললো ঝোরাও...
দুজনে বেরিয়ে এলো মাল্টিপ্লেক্স থেকে।
-উফফ!কেন যে তুই স্কুটিটা আনতে গেলি?এখন তো আমার বাইকে বসে যেতে পারতিস...তা না,দুজনে আলাদা-আলাদা...
-তারপর যদি মাঝ-রাস্তায় তোকে ছেড়ে পালাতে হয়,তখন কি পায়ে হেঁটে বাড়ি যাবো?নাকি তোকেই বলবো,তোকে ছেড়ে যাবো,কিন্তু তার আগে একটু বাড়ি পর্যন্ত লিফট দে!ওসব বালের গল্প ছাড়!আমার ভাই সবসময় সবকিছুর ব্যাক-আপ থাকে।প্ল্যান-বি!পোষাবে না,ওইখানেই ছেড়ে পালাবো তোকে...সিম্পল!!
-উফফ!তোর সঙ্গে কথায় পারা যায় না রে ঝোরা!!
-এই দাঁড়া তো একটু...মাথা ধরে গেছে!এইজন্যই আমি থ্রি-ডি দেখতে চাই না...ভীষণ চোখে লাগে...
স্কুটির সামনে এসে পিঠের ছোট ব্যাগটা সামনে টেনে এনে,ওর ছোট চেনটায় হাত ঢোকালো ঝোরা...কয়েক মুহূর্ত হাতড়ানোর পর ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর।
-কিরে?কি খুঁজছিস?
-আবার বৌদি বের করে নিয়েছে!উফফ!!কোনো মানে হয়!!
-এই নে!
নিজের পকেট থেকে প্যাকেট বের করে,একটা সিগারেট অরিত্র এগিয়ে দেয় ঝোরার দিকে...
বাইকে হেলান দিয়ে অরিত্র নিজেও একটা ধরায়...
তারপর হাওয়ায় পরপর বেশ অনেকগুলো রিং ছেড়ে বলে,
-ঝোরা?
-হুম?
-আমাকে একদিন নিয়ে চল তোর বাড়ি!
-কোন আনন্দে?কোন উৎসব লেগেছে আমার বাড়িতে?জীবনেও তোকে নিয়ে যাবো না!
সশব্দে হেসে উঠলো অরিত্র।
-তুই না নিয়ে গেলেও,একদিন ঠিক তোর বাড়ি গিয়ে হাজির হবো দেখবি!চিনি তো আমি...
-সেইদিনই লাথি মেরে তোকে ভাগাবো সালা!
-পারবি না!
-কেন?
নিজের সিগারেটটা জুতোর তলায় ফেলে,অরিত্রর হাত থেকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা টেনে নিলো ঝোরা।অরিত্র একটু কেশে বললো,
-আচ্ছা,তুই আগের অফিস ছেড়েছিস কতদিন হয়েছে ঝোরা?
-উম...তাও প্রায় বছর দেড়েক!
-হুম!আর সেই সঙ্গে তার আগের ছ-মাস ধরে নে,মানে যখন থেকে আমাদের আলাপ হয়েছিলো!
-হুম,ধরলাম!
-তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে ছাড়া থেকেছিস তুই?প্রত্যেক উইকএন্ডে তোর আমাকে চাই-ই চাই!!প্রায় দু-বছর!এতটা সময় একসঙ্গে...
-হ্যাঁ,তার তো যথেষ্ট কারণ আছে!
-কি কারণ?
-দেখ,ফার্স্ট রিজন তুই সিঙ্গেল আছিস!তোর লাইফে কেউ নেই।আর সেকেন্ড ওয়ান ইজ,ইউ আর টু গুড ইন বেড অরি!তোর একটা ফিজিক্যাল নিড আছে,আমারও আছে...দ্যাটস হোয়াই!
-শুধু এই দুটো কারণ?ব্যাস!
-অফ-কোর্স!দেখ ভাই!তুই আমার সঙ্গে শুচ্ছিস,তার জন্য তো কাউকে ডিচ করছিস না...তো ইটস ওকে!!
মাথা নামিয়ে নিলো অরিত্র।তারপর বললো,
-মা এবার আমার জন্য মেয়ে দেখতে চাইছে...বিয়ে করতে বলছে!
-হ্যাঁ তো করে নে বিয়ে!আমি বারণ করছি নাকি!বিয়ের পর বউকে নিয়ে থাক!তখন কিন্তু বউকে ঠকিয়ে আমার কাছে এলে,টেনে একটা লাথি মারবো তোর মুখে...
বলেই একগাল হেসে ধোঁয়া ছাড়লো ঝোরা।
অরিত্র কিছুক্ষণ একভাবে চেয়ে রইলো ঝোরার দিকে...
-চল!
-হুম চল!এই সম্রাট কোথায় রে?
-বাড়িতে গেছে!ওর কে অসুস্থ...
-অমনি তুই ফ্ল্যাটের চাবিটা বাগিয়ে ফেললি?দুদিন ছাড়া-ছাড়া তুই যে এইরকম করিস,কিছু বলে না সম্রাট?
-নাঃ!!ওর ওই একটাই কথা,বেরোবার আগে বেডশীট তুলে ওয়াসিং মেশিনে দিয়ে যাবি,ব্যাস!!এটুকুই!!
-মানে একটু সুযোগ পেলেই হলো বল?!
-হুম!!তোর সঙ্গে সময় কাটানোর এতটুকু সুযোগও আমি ছাড়বো না ঝোরা!
-সালা!!এত্ত হট বুঝি আমি?
হেসে অরিত্রর একেবারে গা ঘেঁষে,ওর বাইকে উঠে বসলো ঝোরা....একটা হাত রাখলো ওর কাঁধে...
-উঁহু!
ঝোরার চোখে-চোখ রেখে অরিত্র বললো।
-তবে?
-কিছুনা!!চল যা,স্কুটি স্টার্ট দে...
-বাব্বা!ছেলের আর একটুও ধৈর্য্য নেই দেখছি!
নেমে গেলো ঝোরা...জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললো পাশের গভীর নর্দমায়।এগিয়ে গেলো নিজের স্কুটির দিকে....
বাইকে উঠে বসলো অরিত্রও...
-কন্ট্রিসেপ্টিভ নিয়ে নিস ঝোরা!প্লিজ...আর একবার!!লাস্ট টাইম...টেন টু ফিফটিন মিনটস... আর বলবো না...এটাই শেষবার...
সদ্য-সহবাসের পর নগ্ন অরিত্রর বুকে মাথা রেখে শুয়েছিলো ঝোরা।দুজনের বুকের ওপরই একটা আলগা চাদর দেওয়া।ঘরে হালকা একটা আলো জ্বলছে।উষ্ণ-পানীয় আর সিগারেটের গন্ধে ঘরের বাতাস ভারী...
অরিত্রর আবদার শুনেই চেঁচিয়ে উঠলো ঝোরা...
-একটা ধাক্কা মারবো,সর এখান থেকে!আগের পরপর তিন মাসে দুবার কন্ট্রিসেপ্টিভ নিয়েছি!মোটা হয়ে যাচ্ছি আমি!আমার ফিগার খারাপ হয়ে যাবে!পিরিয়ডস এও প্রবলেম হচ্ছে...তোর আর কি!সাফার করতে হয় তো আমাকেই...আস্তে-আস্তে কেমন মোটা হচ্ছি দেখেছিস?ফিগারটা খারাপ হলে তখন...
-হোক না,তাতে কি হয়েছে ঝোরা!আমিই তো দেখবো!আমার সব চলবে!!
আদর ঝরে পড়লো অরিত্রর গলায়...
একলাফে উঠে বসলো ঝোরা...
ওর একপিঠ স্ট্রেইটনিং করা চুল গিয়ে পড়লো অরিত্রর মুখের ওপরে... অরিত্র হাসিমুখে ওর চুলগুলো নিজের মুখ থেকে সরিয়ে নিলো...তেড়ে উঠলো ঝোরা...
-ওই-ওই-ওই!!ওইরকম বয়ফ্রেন্ড-মার্কা কথা বললে,রাস্তায় ফেলে কেলিয়ে দেবো বলে দিলাম।
হেসে শুয়ে-শুয়েই ঝোরার কোমর জড়িয়ে ধরলো অরিত্র...একটু উঠে মাথা রাখলো ওর কোলে...ঘুম পাচ্ছে ওর।উষ্ণ-পানীয় আর একইসঙ্গে উদ্দাম যৌনতার কারণে ভীষণই ক্লান্ত অরিত্র...
-ওই সর তো!!আমার গলা শুকিয়ে গেছে...
ঝোরা বিছানা হাতড়ে অরিত্রর প্যান্ট বের করে,ছুঁড়ে দিলো ওর দিকে...
-প্যান্ট পর!
অরিত্রর মাথাটা নিজের কোলের ওপর থেকে সরিয়ে,চাদরটা ওর গা থেকে টেনে নিজের বুকে বেঁধে নিলো ঝোরা।তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো..
-তুই কি নিবি একটু?
-নাঃ!!ঘুম পাচ্ছে প্রচন্ড!
নিজেকে ঢেকে নিয়ে আবার বিছানায় শুলো অরিত্র...
-ঘুমো তাহলে..
বলেই ঝোরা গ্লাসের তলানি উষ্ণ-পানীয়টুকু একবারে গলায় ঢেলে নিলো।
-আমি একটু চোখ বুজলাম।প্লিজ আগেরবারের মতো না বলে চলে যাস না ঝোরা!
-নাঃ,আছি!দাদা বৌদিকে নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ি গেছে।আজ বাড়ি ফিরবে না।তাই চাপ নেই...তুই একটু ঘুমিয়ে নে!আমি আছি!সবে তো সন্ধ্যে!
-তুইও এসে একটু শো না আমার সঙ্গে...
-নাঃ!!আমার এখন আর ঘুম আসবে না!তুই ঘুমো..
-একবার আয় না ঝোরা!তোকে জড়িয়ে ধরে একটু..
-কেন বেকার হ্যাজাচ্ছিস অরি?বললাম তো,আমার এখন ঘুম আসবে না!একটা কথা একবার বললে,তোর কি মাথায় ঢোকে না?অত বেশি আদর মাড়াতে হবে না!কাজ হয়ে গেছে,এবার চুপচাপ পড়ে থাক বিছানায়!
ঘর ফাটিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো ঝোরা...টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা তুলে নিয়ে,দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো অন্ধকার ব্যালকনিতে..
চোখে জল এসে গেলো অরিত্রর..মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো ও।ঝোরার দিক থেকে এমন আঘাত এই প্রথম নয়।এর আগেও অরিত্র একাধিকবার এভাবে আহত হয়েছে।কিন্তু তবুও ও কিছুতেই সরতে পারে না।মেয়েটা একবার ফোন করলেই পাগলের মতো দৌড়ে চলে আসে।প্রথম-প্রথম তো সব ঠিকই থাকে,আদরে-আদরে ঝোরা ভরিয়ে দেয় অরিত্রকে।ও নিজের শরীরটাও সেঁকে নেয় ঝোরার শরীরী-উষ্ণতায়।ওদের মধ্যে শরীরী বোঝাপড়া ভীষণই ভালো।ঝোরা ওকে,ও ঝোরাকে ভীষণ ভালোভাবে বোঝে।মেয়েটার কখন কোথায় আদর প্রয়োজন,ওর সবটুকু শরীরী ভাষা,এতদিনে বোঝা হয়ে গেছে অরিত্রর।কিন্তু তৃপ্ত-সহবাসের পরই মেয়েটা একেবারে আমূল বদলে যায়।তখন ভীষণই অচেনা হয়ে যায়।অরিত্র আর বুঝতে পারে না ওকে..কেন যে ও এইরকম করে!!অনেকবার ওকে জানার চেষ্টা করেছে অরিত্র।কিন্তু কিছুতেই মুখ খোলে না ঝোরা।বরাবরই এড়িয়ে যায়!নইলে খিস্তি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দেয়।ওইজন্য আজকাল আর ওকে ঘাঁটায় না অরিত্র।থাক না!!মেয়েটার কোথায় কি গোপন ক্ষত আছে,ও হয়তো বারবার একই কথা ওকে জিজ্ঞেস করলে,আহত হবে মেয়েটা।অরিত্র যে ঝোরার বর্তমানে জড়িয়ে রয়েছে,এতেই খুশি থাকবে ও...
বালিশে নিজেকে ঠেসে দিলো অরিত্র...ঝোরার এইরকম ব্যবহারে ওর প্রচন্ড কষ্ট হয়।কিন্তু তাও গত দু-বছর ধরে এভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে আসছে...বুঝিয়ে নিয়েছে নিজেকে...
আস্তে-আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো ক্লান্ত অরিত্রর...
অন্ধকার ব্যালকনিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে,খোলা আকাশের দিকে চেয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিলো ঝোরা।পার্লার থেকে হেয়ার স্পা-স্ট্রেটনিং-হাইলাইট করা একমাথা সাজানো-গোছানো পরিপাটি চুল ওর পিঠ ভেঙে ছড়িয়ে রয়েছে বুকের আশেপাশে।ম্যানিকিওর করা নিখুঁত বড়-বড় নখগুলো,ঝোরার সরু আঙুলের শোভা শতগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।ওই সুন্দর আঙুলের মধ্যেই,ঝোরা ধরে রয়েছে জ্বলন্ত সিগারেটটা.... একভাবে স্থির-দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দূরের আকাশের দিকেই...দু-চোখ দিয়ে অবিরত জল বেয়ে,ওর ব্রণ-তে ঢাকা গাল ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।চোখের সামনে ভাসছে শুধু রক্তের বন্যা...চোখ বন্ধ করে ফেললো ঝোরা...রক্ত!রক্ত!রক্ত!!কত রক্ত!!আধো জ্ঞান-আধো অজ্ঞান...এই দুইয়ের মাঝামাঝি কেমন যেন অদ্ভুত একটা ঘোর লাগা অনুভূতি,আর সেই সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা!!শারীরিক যন্ত্রণা থেকে ঝোরা মুক্তি পেয়ে গেছে বহু বছর আগেই,কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা!!আজও ঝোরাকে কুরে-কুরে খায়!ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো ও!অরিত্র অনেকবারই জানতে চেয়েছে ওর অতীত!বলেনি ঝোরা!কেন বলবে?অরিত্র ভালো ঘরের ছেলে।আজ ঝোরার সঙ্গে আছে,কাল থাকবে না!বিয়ে হয়ে যাবে!কেন ওকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াবে ঝোরা!!ওর বিয়ের পর আবার কিছুদিনের জন্য একলা হয়ে যাবে ঝোরা!আপাতত একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে কর্মরতা ও!ব্যাঙ্কের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের শান্তনু গত কয়েক দিন ধরেই,ওকে বেশ খেলিয়ে তোলার একটা আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।বুঝেও পাত্তা দেয়নি ঝোরা!ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করে ও।ঝোরার মতোই ছেলেটাও গভীর জলের মাছ!বুঝতে পারে ঝোরা।এখন একটু সাবধানে-বুঝেশুনে এগোয় ও।আগের অফিসের বসের সঙ্গে ব্যাপারটা চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ায়,স্যারের বউ পর্যন্ত জানতে পেরে যায়।নিজের পরোয়া কোনোদিনই করে না ঝোরা।ওকে স্যার বলেছিলেন,যে ওনার ডিভোর্স হয়ে গেছে।তাই এগিয়েছিলো ও।কিন্তু ডিভোর্স যে তখনও পর্যন্ত হয়নি,আর উনি দু-নৌকায় পা দিয়ে চলছেন,সেটা প্রায় মাস দুয়েক পরে ও জানতে পেরেছে।একরকম ঝামেলা এড়াতেই,আর কিছুটা ওই নারীর সংসার বাঁচাতেই,ঝোরা ইস্তফা দিয়েছিলো।কিন্তু ওই অফিস ওকে অরিত্রকে দিয়েছে।ডিপার্টমেন্ট আলাদা হওয়ায়,ওদের শিফটিং আলাদা ছিলো।তাই এসব গল্প অরিত্রর অজানা।শেষের কিছুদিন স্যারকে এড়াতে নিজের অফিসের সময়সীমা পরিবর্তন করেছিলো ঝোরা।তখনই অরিত্রর সঙ্গে ওর আলাপ,পরে সেই স্বল্প আলাপ থেকেই শুরু হয় ঘনিষ্ঠতা।পরবর্তীকালে ঝোরা অফিস ছেড়ে দিলেও,অরিত্র আর ওকে ছাড়েনি।ঝোরাও ওকে একরকম প্রয়োজনেই ধরে রেখেছে।সারা সপ্তাহ কাজের পর,সপ্তাহান্তে ওর নিঃসঙ্গ জীবনে একজন পুরুষ প্রয়োজন হয় বৈকি!দাদা-বৌদি দুজনেই বেরিয়ে যায় নিজেদের কর্মক্ষেত্রে।সপ্তাহ-শেষের ওই দুটো দিন ওরাও একসঙ্গে থাকে।ঝোরা মাঝে-মাঝে বেরিয়ে পড়ে অরিত্রর সঙ্গে,কখনও অরিত্রর বন্ধুদের ফাঁকা ফ্ল্যাটে,কখনও বা সিনেমা-রেস্তোরায়!বাড়িতে বলে সোহিনীর বাড়িতে আছে,বা ওর সঙ্গে বেরোচ্ছে।বৌদি মাঝে-মাঝে হয়তো আন্দাজ করে কিছু একটা,কিন্তু ঝোরার ব্যক্তিগত-পরিসরে খুব একটা ঢোকে না বৌদি।তাই সামনাসামনি কোনো প্রশ্নের মুখে,আজ পর্যন্ত পড়তে হয়নি ঝোরাকে।তবে ও নিজের ব্যক্তিগত উশৃঙ্খল জীবনযাপনের গল্প,বাড়িতে একটু রেখেঢেকেই চলে...
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সিগারেট হাতে নিজের জীবনের কথাই ভাবছিলো ঝোরা।কত পুরুষকে নিয়ে যে এই জীবনে ও পথ চলেছে,তার হিসেব হয়তো,ও নিজেও দিতে পারবে না।কখনও তো একসঙ্গে একাধিক পুরুষকেও সঙ্গ দিয়েছে ও।প্রথম-প্রথম অরিত্রর সঙ্গেই তো অভিরূপও ছিলো।একইসঙ্গে...পোষায়নি অভির।ওর আবার সতী মেয়েছেলে চাই,লক্ষী মেয়ে,যাকে নিয়ে গিয়ে নিজের মায়ের সামনে দাঁড় করাতে পারবে,বিয়ের কথা বলতে পারবে।সংসার করতে পারবে।
নিজের মনেই হেসে ফেললো ঝোরা...
"সংসার!!হুহ!ভারী বালের সংসার সালা!!"
অভিকে একদম প্রথম থেকেই ঝোরা বলে এসেছে,বিয়ে তো দূরের কথা,অভিকে ও নিজের বয়ফ্রেন্ডের জায়গাও দেবে না।তাও তখন ওর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলো অভি।তারপর যখন ঝোরা নিজের ইচ্ছেমতো চলা শুরু করলো,অভি আর থাকতে পারলো না।তাতে ঝোরার ভারী ছেঁড়া গেলো!তারপর থেকে অরিত্রকেই ধরে রেখেছে ও,বরং বলা ভালো অরিত্রই ওকে ধরে রেখেছে।ঝোরার অপছন্দের কাজ একটাও করে না অরি।ছেলেটা আপ্রাণ চেষ্টা করে ওর মন জুগিয়ে চলার।কখনও ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওকে একটা প্রশ্নও করে না।মাঝে-মাঝে অরির ওপরে বড় মায়া হয় ঝোরার।ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে চাইলে,খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ওকে।কিন্তু তারপরই এইসব অবান্তর ইচ্ছেকে,মন থেকে ঝেড়ে ফেলে ও।আবারও নিজের কমনীয় মুখটা ঢেকে নেয় চড়া মেক-আপে,ঠোঁট রাঙিয়ে নেয় গাঢ় ওষ্ঠরঞ্জনীতে।চোখের কোলের কালি ঢেকে নেয়,কাজলসহ আর বাড়তি প্রসাধনে... নিজেকে আবারও ভোগ্যপণ্য করে,ও মেতে ওঠে পুরুষের দুর্বার সর্বনাশের খেলায়।আজ পর্যন্ত ওর আশেপাশের পুরুষরা,ওর আকর্ষণ থেকে খুব একটা নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে বলে,ওর মনে হয় না।রাস্তাঘাটে ওকে দেখে,বিভিন্ন বয়সী পুরুষের সপ্রশংস দৃষ্টি,একবার অন্তত ফিরে দেখবেই,এটুকু আত্মবিশ্বাস ঝোরার নিজের প্রতি আছে।তাই আজকাল এসব নিয়ে ও আর খুব বেশি ভাবে না।প্রাধান্য পেতে-পেতে, আজকাল আর কাউকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেও ইচ্ছে করে না।তবে ওই শান্তনু অনেকদিন ধরে ওর পিছনে ঝুলে রয়েছে।ওর ব্যাপারটা এবার একটু দেখতে হচ্ছে...
-ঝোরা!!
জড়ানো গলায় অরিত্র ঘরের ভিতর থেকে ডাকলো।
-আসছি!
দুটো চোখ ভালো করে মুছে নিলো ঝোরা,তারপর ঘরে ঢুকলো।সিগারেটের আগুনটা নিভিয়ে টেবিলে রাখা এস্ট্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো।
-বল...
-একটু আমার কাছে আসবি?
বিছানা থেকেই হাত বাড়ায় অরিত্র।
-হুম,বল!
বিছানার কোণে বসলো ঝোরা।অরিত্র এগিয়ে গিয়ে মাথা রাখলো ঝোরার বুকে।ঝোরা একহাতে জড়িয়ে ধরলো ওকে।অন্য হাতে পাশের টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসে মদ ঢাললো।
-নিবি?
একবার মাত্র গ্লাসে চুমুক দিয়ে,গ্লাসটা ঝোরার হাতে ফিরিয়ে দিলো অরিত্র।ও চুপ করে জড়িয়ে ধরে রইলো ঝোরাকে...
-বল,কি বলবি?
-বিয়ে কর না রে আমায়?করবি?প্লিজ ঝোরা!!
-গান্ডুর মতো কথা বলিস না অরি!
সবটুকু মদ গলায় ঢেলে দিয়ে গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো ঝোরা।
-কেন?আমি ভালো বর হবো!প্রমিস!!
-আমি ভালো বউ হবো না!
-আমি পচা-বউ নিয়েই ঘর করবো!আমার সব চলবে!
-ওসব বালের কথা বাদ দে।মাকে বল মেয়ে দেখতে,বিয়ে করে এবার সংসার কর।আমাকে টাটা-বাই করে দে!
-উঁহু!!
ঝোরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অরিত্র।
-ওই বাল,ছাড় তো আমায়।একদম ন্যাকামি করবি না।আমি জীবনেও কিন্তু তোকে বিয়ে করবো বলিনি।
-জানি!
-তাহলে এখন এসব কথা উঠছে কিসের জন্য?
-তুই তখন বলেছিলি ঝোরা,তোর জীবনে প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে এসবের কোনো জায়গাই নেই।হ্যাঁ,সব জেনেই আমি এগিয়েছিলাম।কিন্তু মানুষের মন তো পরিবর্তনও হয় ঝোরা।দু-বছরেও কি কিছুই বদলায়নি?
-না!দুশো বছরেও ঝোরা বদলাবে না!বেশি আলবাল বকলে,লাথ মেরে ফুটিয়ে দেবো!!
অরিত্র আরও চেপে ধরলো ঝোরাকে।চাদরের ওপর দিয়েই মুখ গুঁজে দিলো ওর পেটে...
-তুই এইরকম কেন রে ঝোরা?
চুপ করে রইলো ঝোরা।অরিত্রর মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে চুপ করে একভাবে চেয়ে রইলো দেওয়ালের দিকে...একটু পরে ওই আবার বললো,
-চল ওঠ অরি,রাত হয়ে যাচ্ছে।এবার বাড়ি যাবো!
-কাল আসবি তো ঝোরা?
-দেখছি!!রোজ-রোজ কি আর এর সঙ্গে বেরোচ্ছি,ওর সঙ্গে বেরোচ্ছি বলা যায়!!ওয়ার্কিং ডে-তে তাও তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দেখা করা যায়,কিন্তু এভাবে উইকেন্ডে...আজ দাদা-বৌদি নেই,তাই চাপ নেই...
-প্লিজ আয়!!যেভাবে হোক আয়!
-এই বাল,তোর কথামতো আমি চলবো না!অধিকার কম ফলাবি!বললাম তো দেখছি...না পারলে কি করবো?!সারাটা সপ্তাহ দাদা-বৌদির সঙ্গে বসে ঠিকমতো কথাও বলা যায় না,সময়ের এত অভাব!একটা দিন তো ওরা ডিসার্ভ করে নাকি!!
চুপ করে গেলো অরিত্র...
-ঝোরা?
-বল!
-তোর ফ্যামিলিতে আমার একটু জায়গা হবে না?না রে?তোর ওই ডাইনিং-টেবিলে সবার সঙ্গে বসে একটা লাঞ্চ কিংবা ডিনার...
-এই গান্ডু ওঠ-ওঠ-ওঠ!!ওঠ আমার কোল থেকে,নইলে লাথি মেরে তুলবো!
ধাক্কা দিয়ে নিজের কোল থেকে অরিত্রকে সরিয়ে দেয় ঝোরা।অরিত্র অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে...
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ঝোরা,বিছানায় বসে থাকা অরিত্রর দিকে আঙুল তুলে ও চেঁচিয়ে উঠলো,
-তুই শুয়েছিস আমার সঙ্গে,আমিও শুয়েছি।আমরা কিন্তু কেউই কাউকে জোর করিনি।যেটা হয়েছে,দুজনের ইচ্ছেতেই হয়েছে।আর আমরা কেউই দুগ্ধপোষ্য শিশু নই অরি,যে না বুঝে করেছি!!তুই খুব ভালো করেই জানিস,তোকে,ইনফ্যাক্ট কাউকেই আমি বিয়ে করবো না।আমি বিয়েই করবো না।তাও যদি ওই এক কথা রোজ-রোজ হ্যাজাতে হয় তো,ফোট বাল!একদম ফুটে যা!ভুলে যা ঝোরা নামের কেউ তোর জীবনে ছিলো...আজকের পর না তুই আমায় ফোন করবি,না আমি তোকে...
বিছানার কোণা থেকে নিজের অন্তর্বাস-জামাটা হাতড়ে বের করে,একটানে চাদরটা খুলে ফেললো ঝোরা...
মাথা নামিয়ে নিলো অরিত্র...ঝোরার নগ্ন শরীরটা দেখে নয়,নিজের চোখের জল আড়াল করতে...
জামাকাপড় পরে পিঠে ব্যাগটা নিয়ে,অরিত্রর চোখের সামনে দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো ঝোরা।প্রমাদ গুনলো অরিত্র।এক্ষুণি এই মেয়ের মেজাজ ঠান্ডা না করলে,একবার এখান থেকে বেরিয়ে গেলে,অরিত্র ফোন করে-করে মরে গেলেও,ও আর ফোন ধরবে না।তাড়াতাড়ি করে একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে ঝোরাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো অরিত্র,
-এই ছাড় তো!!
এক ধাক্কায় ওকে ঠেলে দেওয়ালের দিকে সরিয়ে দিলো ঝোরা...অরিত্র আবার গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে...
-আর বলবো না!তোকে বিয়ে করতে হবে না!আমি এভাবেই থাকবো!
-মানে?
-কিছুনা!!আর কোনোদিনও তোকে বলবো না বিয়ের কথা!খুশি তো?আর রাগ করিস না ঝোরা!
-উফ!ছাড় অরি!!
-রাগ করে যাস না প্লিজ!
-আচ্ছা ঠিক আছে,ছাড়!
-আসবি তো কাল?আবার তো সেই পরশু থেকে অফিস!কাল একটু আয় প্লিজ!
-দেখছি!!
-আমি কিন্তু আজ সম্রাটের বিছানার চাদর চেঞ্জ করবো না।একেবারে কালই করবো...
হেসে ফেললো ঝোরা।
-আচ্ছা দেখছি!!
-দাঁড়া,তোকে আমি ছেড়ে আসছি!জামাটা পরে নিই...
-লাগবে না!আমি চলে যেতে পারবো!
-শিওর?
-সালা!সারাজীবন যেন কত আমার সঙ্গে সেঁটে থাকবি!!বিয়ে কর-বিয়ে কর!তোর বিয়েতে ডাকবি অরি!গিফ্ট দেবো না কিন্তু,ফ্রি-তে গিলে আসবো!
-দূর হ হতভাগী!!
মন খুলে সশব্দে হেসে উঠলো ঝোরা...
-এই তো,এই না হলে আমার অরি!চল টাটা!!
ঝোরা জড়িয়ে ধরলো অরিত্রকে...ওর ঠোঁটে আলগা করে ঠেকিয়ে দিলো নিজের উষ্ণ-পানীয়তে সিক্ত ঠোঁট।
-বাই অরি!!
-বাই!!
-তোর সিগারেট চুরি করলাম কিন্তু...
-সালা চুরিও করছিস,আবার বলেও নিচ্ছিস?তাহলে আর কি চুরি করলি?
হেসে বেরিয়ে গেলো ঝোরা।ও বেরিয়ে যাওয়ার পর,ফ্ল্যাটের দরজাটা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো।সেদিকে একভাবে চেয়ে থেকে অরিত্র বললো,
"বিয়ে তো আমি তোকেই করবো ঝোরা!যেভাবেই হোক!!তোকে ছেড়ে থাকতেই পারবো না..."
এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে জামাটা তুলে পরে নিলো অরিত্র।বোতাম লাগাতে গিয়ে দেখলো,দুটো বোতাম নেই,শার্ট খোলার সময় টেনে-হিঁচড়ে বোতামগুলো ছিঁড়েই ফেলেছে ঝোরা...
মাথা নীচু করে হেসেই ফেললো অরিত্র...কিন্তু এবার ও বাড়ি যাবে কি করে!দরজা তো মা খুলবে।যার জন্য ও বেশি মদও খায়নি আজ।জামার দুটো বোতাম নেই।বুকের প্রায় অর্ধেকটাই তো খোলা...ভীষণ চিন্তায় পরে গেলো অরিত্র...
ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ঝোরার কানে ভেসে এলো বেশ কয়েকটা নোংরা মন্তব্য।অন্যদিন হলে নেমে সোজা খিস্তি দিয়ে সিধে করে দিতো ছেলেগুলোকে।হাঁটুর বয়সী বাচ্চা-বাচ্চা ছেলে সব,মেয়ে দেখলেই আওয়াজ দেওয়া চাই!ঝোরার ইচ্ছে করছিলো,স্কুটি থেকে নেমে লাগিয়ে দেয় দু-ঘা!কিন্তু আজ ওর নিজের অবস্থাই ঠিক স্থিতিশীল নয়।একটু টলছে ও।তাই বেরিয়েই গেলো স্কুটি নিয়ে।বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ খানিকটা ভিতর দিকেই ওদের কমপ্লেক্স "রামধনু এপার্টমেন্ট"।সদ্য-গজিয়ে ওঠা কংক্রিটের কমপ্লেক্স গুলোর মতোই এটাও একটা কমপ্লেক্স।খুব একটা বিশেষত্ব কিছু নেই।তবে দুদিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা।আর বাজার-হাট-জনবসতি বেশ দূরেই।তাই এখনও এই জায়গাটা মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যেই আছে।নইলে শহরের প্রান্তে এতটা কমে তিন-কামরার ফ্ল্যাট পাওয়া বড় সহজ কথা নয়।দিনরাত পরিশ্রম করছে দাদা-বৌদি আর ঝোরা নিজেও।যেটুকু ওরা করেছে,নিজেরাই খেটে করেছে।কোনোরকমে একটা নিজের মাথা গোঁজার জায়গা,এতদিনে করে উঠতে পেরেছে ওরা।এবার লোনটা কিছুটা শোধ হয়ে গেলেই,সবাই একটু হালকা হতে পারে।ঝোরা না হয় বিয়ে করবে না,ঝামেলা নেই।কিন্তু এরপর দাদার ছেলে-মেয়ে হলে তো খরচ আরও বেড়ে যাবে।তার আগেই যতটা লোনটা টেনে বের করে নেওয়া যায়,সেই চেষ্টাই ও করছে।বৌদি ভীষণ বুঝদার মেয়ে।ভীষণ বোঝে ওদের দুই ভাই-বোনকে।নিজের জন্য একটা ছোট কানের দুল কিনলেও,আগে বোন-বোন করে ওর হাতে তুলে দেয়!কোনো চাহিদা নেই মেয়েটার।দাদা তো সেভাবে ওকে কিছু দিতেও পারে না।তবুও কি সুন্দর হাসিমুখে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।সংসারে যেটুকু অভাব আছে,সেটুকু ভালোবাসা দিয়ে পূরণ করে দেয় বৌদি।ঝোরা নিজেই ভীষণ সাজতে ভালোবাসে,নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিপাটি রাখতে ভালোবাসে।তাই পার্লারের খরচ ওর বরাবরই বেশি।মাসের শেষে যদি দেখে ঝোরা পার্লারে যায়নি,বৌদি নিজে টাকা গুঁজে দেয় ওর হাতে।প্রায় প্রতিনিয়তই ঝোরার ব্যাগ থেকে হাওয়া হয়ে যায় সিগারেটের প্যাকেট।ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো আজ টিম-টিম করে জ্বলছে!আটটা বাজলেই এই জায়গাগুলো এত নিস্তব্ধ হয়ে যায়,মনে হয় যেন জায়গাটা পৃথিবীর বাইরে।দুপাশের ঝোপঝাড়ের মাঝে-মাঝে দূরে উঁকি দিচ্ছে বিশাল বহুতল সব ফ্ল্যাট।বেশিরভাগই অন্ধকার।আবার কোথাও-কোথাও একটু আলো জ্বলছে,প্রাণের স্পন্দন রয়েছে,জীবন রয়েছে সেখানে।তবে বেশিরভাগই ফাঁকা!!হু-হু করে স্কুটি চালাচ্ছে ঝোরা।মাথায় হেলমেট রয়েছে।তবে হাওয়ায় ওর একপিঠ খোলা চুল উড়ছে।নেশার চোটে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিলো ওর।নিজের অতীত জীবনের মর্মান্তিক দিনগুলোর সঙ্গে-সঙ্গে,বর্তমানের ছোট্ট সুখী-সংসারের কথাও ভাবছিলো ঝোরা।দাদার একটা ছোট্ট বাচ্চা হবে,ও পিপি হবে।সারাদিন পর বাড়িতে ফিরে একটা ছোট্ট প্রাণকে নিয়ে বাঁচবে ও।সারা বাড়িতে বেশ ছড়িয়ে থাকবে ভাঙাচোরা খেলনা...পরমুহূর্তেই ঝোরা কেঁপে উঠলো।একইরকম একটা দৃশ্য আবারও ভেসে উঠলো ওর মানসপটে....সারা ঘরে খেলনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে।মেঝেতে বসে রয়েছে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।ছেলেটা মেয়েটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।মেয়েটা থরথর করে কাঁপছে ছেলেটার বুকের ভিতরে...একমাথা চুল মেয়েটার,যত্নের বড়ই অভাব!মুখের ওপরে এসে পড়েছে অবিন্যস্ত চুলগুলো.....আর ভাবতে পারে না ঝোরা!ব্রেক মেরে স্কুটি থামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো ও।আসার সময় অরির সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা উঠিয়ে এনেছিলো।ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে তাতে অগ্নিসংযোগ করলো ঝোরা।প্যাকেট ফাঁকা,একটাই সিগারেট ছিলো ওতে।প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে,চোখ বন্ধ করে স্কুটিতে হেলান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো ঝোরা।সবেমাত্র দু-একটা সুখটান দিয়েছে সিগারেটে,সেই সময়ই একটা জিপ পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো।ঘাড় ঘোরালো ঝোরা,জিপটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে উড়িয়ে গেলো রাস্তার কিছু কুণ্ডলী-পাকানো ধুলো,আর ঝোরার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে গেলো অশ্রাব্য কিছু ভাষা....
-যত্তসব গান্ডু সালা!!
মাথা নামিয়ে সিগারেটটা জুতোর তলায় পিষে ফেললো ঝোরা।তারপর আবার স্কুটিতে উঠলো...
-রাজেশ দা?
-হ্যাঁ দাদা বলো?
-এখন দুধের প্যাকেট কোথায় পাবো গো?দু-প্যাকেট দুধই একসঙ্গে কেটে গেলো।ফ্রিজটার বোধহয় বারোটা বেজে গেছে!
-এই রে!এখন দুধ কোথায় পাবে?তুমি একটু এগিয়ে দেখো তো দাদা,একটা ছোট মুদি দোকান আছে সামনে।ওখানে তো দুধ পাওয়া যায়।কিন্তু এত রাতে খোলা থাকবে কি?
-আচ্ছা,দেখি গিয়ে।নইলে লাস্ট অপশন ঝোলাগুড় তো আছেই...রুটি আর গুড়!ফ্যান্টাস্টিক কম্বিনেশন!
হেসে উঠলো রাজেশ।প্রিয়মও হেসে বেরিয়ে গেলো...
-দাদা দুটো দুধের প্যাকেট দেবেন!আছে তো?
-হুম!
দুধ নিয়ে টাকা বের করার জন্য সবে পকেটে হাত দিয়েছে প্রিয়ম,
-দাদা একটা সিগারেটের প্যাকেট দিন তো!
গলার স্বর শুনে চমকে উঠলো প্রিয়ম।ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ওর পাশেই ঝোরা এসে দাঁড়িয়েছে।মাথা থেকে টেনে হেলমেট খুলছে ও,একটু যেন টলছে!প্রিয়ম বুঝতেই পারলো না,কখন অবলীলায় ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
-হাই!!
-ওহ হাই!প্রিয়ম!!
প্রিয়ম দেখলো ঝোরার চোখদুটো বেশ লাল।কাজল ঘেঁটে গেছে,লিপস্টিকও বেশ হালকা!সিগারেট আর দুধের প্যাকেট,দুটো জিনিসই একসঙ্গে এনে সামনে রাখলো দোকানদার!
-এই নিন!
-খুচরো দিন দিদি!
-খুচরো তো নেই দাদা!
-না,এইটুকু সিগারেটের জন্য এত টাকা তো ভাঙতি হবে না!
-তাহলে কাল দিই টাকা?
-ঠিক আছে দিদি,কালই...
-নো প্রবলেম!আপনি আমার থেকে কাটুন!
-আরে না,ঠিক আছে প্রিয়ম।আমি কাল সকালে এসেই...
-ইটস ওকে ঝোরা!আমার কাছে আছে,তাই দিয়ে দিচ্ছি!নইলে কি দিতে পারতাম?আপনি কেটে নিন দাদা!
-আচ্ছা!!
-হুম,থ্যাঙ্কু প্রিয়ম!
-ওয়েলকাম!
দুজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে এলো দোকানের বাইরে...
-এই নাও!
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে প্রিয়মের দিকে এগিয়ে দেয় ঝোরা।
-নাঃ!এখন আবার...
-আরে নাও-নাও!নেশার আবার এখন-তখন!নিকোটিনে পোড়া তোমার ঠোঁটের রং-ই বলে দিচ্ছে,তুমি দিনে কটা সিগারেট খাও...
ঝোরা এগিয়ে এলো প্রিয়মের বেশ খানিকটা কাছে...একটু আগেই ঝোরার চোখ দেখেছে ও,আর এখন তো প্রিয়ম স্পষ্টই বুঝলো ঝোরা মদ্যপ অবস্থায় রয়েছে।ওর শরীর থেকে উষ্ণ-পানীয়র,আলগা একটা গন্ধ ভেসে আসছে...ততক্ষণে একটা সিগারেট প্রিয়মের হাতে গুঁজে দিয়েছে ঝোরা,সেটার দিকে চেয়ে একটু হেসে প্রিয়ম বললো,
-না আসলে মা ঘরে থাকে তো,বাইরে একা থাকলে তো কোনো ব্যাপারই না।মা স্কুলে থাকলেও একরকম।নইলে এবার থেকে যে কদিন এখানে আছি,রাতে শোবার আগে ওই টেরেসে গিয়ে একটু...চলো,আজ না হয় তোমার জন্য সেটা এখনই হয়ে যাক!!
ঝোরার এগিয়ে দেওয়া লাইটার থেকে সিগারেট জ্বালায় প্রিয়ম।ঝোরা নিজেও প্রিয়মকে সঙ্গ দিতে অগ্নিসংযোগ করে আরও একটা সিগারেটে...
-বাইরে থাকে বললে,কি করো তুমি?
-ইঞ্জিনিয়ার!চেন্নাইতে আছি আপাতত!এই মাসেই কোম্পানি চেঞ্জ করবো,মাইনে পোষাচ্ছে না!!
-ওকে!!
-তুমি?
-আমি ভাই পাতি গ্রাজুয়েট!কমার্স!তাও অনার্স টিকিয়ে রাখতে পারিনি!মাঝপথেই টাটা করেছি!আগে একটা কল-সেন্টারে জব করতাম,ওটা ছেড়ে এখন একটা ছোটখাটো প্রাইভেট-ব্যাংকে আছি!
-ওহ!
মাথা নামিয়ে নিলো প্রিয়ম।
-পোষালো না?স্বাভাবিক!
-মানে?ঠিক বুঝলাম না!কি পোষালো না?
ধোঁয়া ছেড়ে ঝোরার দিকে ঘুরে চাইলো প্রিয়ম...
-তুমি ভাই ইঞ্জিনিয়ার মানুষ,আর আমি সাধারণ একটা ব্যাঙ্ক-এমপ্লয়ী,একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা,না পোষানোই স্বাভাবিক!সারা মাস শুধু টাকা-টাকা আর টাকা!মান্থের এন্ডে টার্গেট আর টার্গেট!!আর ইয়ার-এন্ডিংয়ে তো বাপ রে বাপ!সে কথা আর না বলাই ভালো!চাপের চোটে পুরো ফেটে...
-সব জায়গায় তাই ঝোরা!যেকোনো ফিল্ডেই!ওই নদীর এপার-ওপার আর কি!আমাদেরও নেহাত মুখ দেখে টাকা দেয় না!!বসিয়ে আর কে খাওয়ায় বলো?
-হুম!সরি প্রিয়ম!
-নাঃ!ঠিক আছে!তবে হ্যাঁ,আমার ফিমেল কো-ওয়ার্কার্স গুলো কিন্তু হেব্বি দেখতে!বেশিরভাগই সাউথ-ইন্ডিয়ান!!বাঙালীও আছে কিছু!ওদের দেখতে-দেখতে কাজ করলে ক্লান্তি অনেকটাই কমে যায়!!ইয়ে মানে,বেশ একটা এনার্জি পাওয়া যায়!চারিদিকে মিষ্টি-মিষ্টি দেখতে মেয়ে...
একগাল হেসে ঝোরার দিকে চাইলো প্রিয়ম।
-সালা!!
হেসে ফেললো ঝোরাও...নিজের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে উঠে বসলো স্কুটিতে।হেলমেটটা আর পরলো না ও,হাতেই নিয়ে নিলো...
-নাও,ওঠো!!
-আমি?
-তুমি ছাড়া তো আপাতত আর কেউ নেই এখানে।নাকি আবার মেয়েদের পিছনে বসতে মেল-ইগো হার্ট হবে?
-ইগোটা কি জিনিস ঝোরা?খায় না মাথায় দেয়?
সশব্দে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলো ঝোরা....
-চলো-চলো,ওঠো!
শেষ একটা টান দিয়ে হাতের সিগারেটটা ফেলে,ঝোরার স্কুটির পিছনে উঠে বসলো প্রিয়ম।স্কুটি স্টার্ট দেওয়া মাত্রই ওর একরাশ খোলা চুল হাওয়ায় উড়ে এসে ঝাপটা মারলো ওর নাকে-মুখে।এক হাতে প্লাস্টিকে দুধের প্যাকেট রয়েছে।আর এক হাত দিয়ে নিজের মুখের ওপর থেকে ঝোরার চুলটা সরিয়ে দিলো প্রিয়ম,তারপর মাথা নীচু করে মুখটা ফিরিয়ে নিলো একটু ডানদিকে...এবার চুলগুলো সোজাসুজি ওর মুখে না পড়ে,সুড়সুড়ি দিতে লাগলো ওর কানে আর ঘাড়ে....ঝোরার চুল থেকে ভেসে আসছে মূল্যবান কোনো প্রসাধনীর মনকাড়া সৌরভ...
বেশ অনেকক্ষণ হয়েছে ছেলেটা বেরিয়েছে।ফ্রিজটা থেকে সমানে জল পড়ছে।অনেকদিন ধরেই ভিতরটা একদম ঠান্ডা হচ্ছে না।তার ওপর সারাদিন শিফটিং-এর জন্য বন্ধও ছিলো ফ্রিজ।দুধ কেটে যাওয়াতে অপর্ণা বলেছিলো পাপাইকে,একটু আলু ভেজে দিই,গুড় দিয়ে রুটি খেয়ে নে!সারাদিন এত খাটাখাটনি গেলো,আর বেরোস না এখন!নাঃ!ডাক্তার যেহেতু অপর্ণাকে শোওয়ার আগে একটু দুধ খেতে বলেছে,অমনি ছুটলো ছেলে!ফোনটাও নিয়ে বেরোয়নি পাপাই।অপর্ণা ফোন করে দেখলো,পাপাইয়ের ঘরের মধ্যেই ফোনটা বাজছে।তাই একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে ব্যালকনিতে এসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো অপর্ণা....সেই সময়ই ও দেখলো একটা স্কুটি এসে ঢুকলো কমপ্লেক্সের ভিতরে...হাফপ্যান্ট মতো পরে একটা মেয়ে বসে আছে স্কুটিতে।কিন্তু মেয়েটার পিছনে কে ও?পাপাই না?হ্যাঁ পাপাই তো!!উন্মুখ হয়ে কৌতূহলবশত চেয়ে রইলো অপর্ণা...মেয়েটার সঙ্গে একভাবে হাত নেড়ে কথা বলে যাচ্ছে পাপাই...স্কুটিটা হঠাৎ করেই যেন থেমে গেলো...
-কি হলো ঝোরা?এখানে থামলে কেন?একেবারে পার্কিংয়েই ঢুকিয়ে দাও!
-আরে স্টার্ট নিচ্ছে না তো!কি হলো রে বাবা!!
-দেখি তুমি সরো!আমি দেখছি!এটা ধরো তো...
মেয়েটার স্কুটিতে কিছু একটা হয়েছে মনে হয়।পাপাই ওর হাতে কিছু একটা দিলো।দুধের প্যাকেটই হবে হয়তো।তারপর নিজে উঠে বসলো স্কুটিতে...
বেশ কিছুক্ষণ গুঁতোগুতি করলো প্রিয়ম।কিন্তু কিছুতেই স্টার্ট নিলো না স্কুটিটা।
-বুঝতে পারছি না গো!
-ছেড়ে দাও,কাল দেখছি!সার্ভিসিং করা হয় না বহুত দিন!আমারও দোষ আছে!সব দোষ তো আর ইঞ্জিনকে দিলে হবে না...কাল দেখি,লোক ডেকে...
-দিদিমণি?সব ঠিক আছে তো?
গেট থেকে রাতের ওয়াচম্যান ডাক দেয় ঝোরাকে...
-হ্যাঁ,রাজু দা!দুটো মানুষই ঠিক আছে।মেশিন বিগড়েছে!!ওটাও কাল ঠিক হয়ে যাবে!
গলা ছেড়ে বলে উঠলো ঝোরা...
-আমি টেনে নিয়ে ঢুকিয়ে দিই পার্কিংয়ে?
-দাও!আর তো কোনো উপায় নেই এখন!যা হবে কাল সকালে দেখা যাবে!ইস!!মনে-মনে প্রিয়ম ভাবছে,কি কুক্ষণেই আজ দুধ আনতে বেরিয়েছিলাম!!যত্তসব ঝামেলা...
-এই নানা!!যাঃ!!
হেসে ফেললো প্রিয়ম।
অপর্ণা ওপর থেকে দেখলো মেয়েটার সঙ্গে ওর ছেলেও হাসতে-হাসতে পার্কিংয়ের দিকে ঢুকলো...
ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলো অপর্ণা।
-ওকে বাই প্রিয়ম!
-টাটা!গুড-নাইট!
-গুড-নাইট!
লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ওপরে না গেলো,ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়ম।আয়তাকার বাক্সটা পুরোপুরি ওপরে উঠে যাওয়ার পর,নিজের ফ্ল্যাটের দিকে এগোলো ও।গিয়ে দেখলো ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই রয়েছে।ঘরের মধ্যেকার আলো দরজার ফাঁকা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে...ভিতরে ঢুকলো প্রিয়ম...
-মা,দরজা খোলা কেন?
-তুই আসছিলি তাই...তোর দেরি দেখে...
-হ্যাঁ তো এসে বেল বাজালে,তবেই দরজা খুলবে।এভাবে আগে থেকে....
-আমায় পুরোটা বলতে দে পাপাই!তোর দেরি দেখে একটু বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম।দেখলাম,তুই এলি,তাই দরজাটা খুলে ভেজিয়ে রেখেছিলাম!
একবার মাথা তুলে মায়ের দিকে চেয়েই,আবার মাথা নামিয়ে নিলো প্রিয়ম।
-পেয়েছিস দুধ?
-হুম,এই যে!
-মেয়েটা কে রে পাপাই?
দুধে রুটি ডুবিয়ে সবে একবার মাত্র মুখে দিয়েছিলো প্রিয়ম।কেশে উঠলো মায়ের হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে,গলায় রুটি আটকে গেলো ওর।
-আস্তে-আস্তে!!
ছেলের দিকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলো অপর্ণা।জল খেয়ে নিয়ে আবার গ্লাসের দুধে মন দিলো প্রিয়ম।মৃদুস্বরে বললো,
-কোন মেয়ে?
-ওই,যার স্কুটিতে করে তুই এলি?
-ঝোরা!
-কি!!ঝোরা মানে?
-ঝোরা,মানে শ্রীময়ী ওর নাম!ঝোরা ডাকনাম!বারো তলায় থাকে।
-ও...কি পড়ে মেয়েটা?
-নানা!পড়া কমপ্লিট!জব করে।
-জব করে?বয়স কত?দেখে তো বেশি বয়স মনে হয় না!
-হুম,তা অবশ্য ঠিক!দেখে একদমই বোঝা যায় না...
অন্যমনস্কভাবে দুধের গ্লাসের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ায় প্রিয়ম।অপর্ণা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে একভাবে...তারপর বলে,
-বেশ ভালো মেন্টেইন করেছে নিজেকে!তা তোর সঙ্গে কতদিনের আলাপ?ওর বাড়িতে কে-কে আছে?সবাই তোর কথা...
পরপর মায়ের প্রশ্নবাণে সাংঘাতিক ভাবে চমকে উঠলো প্রিয়ম।আঁতকে উঠে বললো,
-এই এক মিনিট!মানেটা কি মা?আমি তেমন কিচ্ছু জানি না ঝোরার ব্যাপারে।জাস্ট কালকেই ওকে প্রথম দেখলাম,সবে আলাপ হয়েছে।আজ এই একটু আগে রাস্তায় দেখা হলো,দু-মিনিট কথা বলে যেটুকু জানলাম...মানে যা-তা!!সত্যিই তুমি পারো!!উফফ!!
লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে,মাথা নামিয়ে খেতে শুরু করলো প্রিয়ম।হেসে উঠলো অপর্ণা...
-হেসো না মা!খাও!খেয়ে ঘুমাও!একটা দিন তো মাত্র একটু ভালোভাবে ঘুমোতে পারো।কাল স্কুল ছুটি,ঘুমোও একটু।কাল আমি রান্না করবো!তুমি সব গুছিয়ে দিও,কিন্তু রান্নাটা আমিই করবো...তোমার জন্য কাল একটু মাংস নিয়ে আসবো,মাছও কি খাবে বলো,আমি এনে দেবো...
-না,ওসব মাছ-মাংস আমি কিচ্ছু খাবো না।এমনিতেই একার জন্য ওসব করিও না,খাইও না!!আর এখন তুই এসেছিস,এখন আমি আলাদা করে করবো!তুই ভাবলি কি করে?
-আমি খাই না তো কি হয়েছে মা?তা বলে তুমিও ছেড়ে দেবে?
-ঠিক ছেড়ে দেবো না,এখন আর ভালোও লাগে নারে ওসব!বয়স হচ্ছে তো।ছাড় না!রান্না আমিই করবোখন।ধোঁকার ডালনা করবো,পোস্ত করবো,সব্জী দিয়ে ডাল করবো।।সব তোকে করে-করে খাওয়াবো!ওখানে তো সেই হাত পুড়িয়ে করেই খাস পাপাই,এখানে আমার কাছে যে কটা দিন আছিস...
-তোমার ক্ষেত্রেও তো সেই একই কথা খাটে মা।তুমিও তো এখানে একা-একা করেই খাও!আমি এসেছি,যেটুকু পারি,একটু করি না!!তারপর তো সারাবছর তুমিও একা,আমিও একা!যার-যার মতো হাত পুড়িয়ে করেই খেতে হবে!ইচ্ছে করুক না করুক,শরীর চলুক আর নাই চলুক,পেট তো আর শুনবে না...তাই যখন আমরা একসঙ্গে থাকবো,দুজনেই কমবেশি করবো!!কাল আমি রান্না করি,পরশু না হয় তুমি কোরো...
অপর্ণার চোখে জল এসে গেছে।ও তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-করিস!কাল তুই-ই রান্না করিস!
একটু হাসলো পাপাই।
-আচ্ছা শোনো মা,আমি কাল কাকা আর রাজেশ দা-র সঙ্গে কথা বলবো,ওরা একটা খাতায় তোমার স্টুডেন্টদের সব নাম লিখে নেবে!তোমার কাছে পড়তে এলেও,ভিতরে ঢোকার সময় তো সই করেই ঢুকতে হবে।ওই ব্যাপারগুলো কাল আমায় একটু দেখে নিতে হবে।তীর্থকে যদিও ওরা খুব ভালোভাবে চিনে গেছে,ওর কথা আলাদা করে আর কিছু বলতে হবে না।কিন্তু তোমার বাকি সব ছেলেমেয়েদের নাম দিতে হবে।যাওয়ার আগে আমায় সবদিক গুছিয়ে যেতে হবে।
-হুম,আমি কাল দিয়ে দেবো সব!
-আচ্ছা!!
ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বিছানায় গুছিয়ে বসলো প্রিয়ম।কানে হেডফোন গুঁজে দিলো ও।একটা মারাত্মক ছায়াছবি দেখতে-দেখতে দুধ আনতে বেরিয়ে গিয়েছিলো তখন।কিন্তু এবার আর মন বসাতেই পারছে না ল্যাপটপের স্ক্রিনে।একভাবে কিছুক্ষণ স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থেকে,ল্যাপটপ শাট-ডাউন করে দিলো ও।বিছানার একপাশে ল্যাপটপ রেখে,মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো...পাশবালিশটা বুকে চেপে-জড়িয়ে ধরে,বালিশে মুখ গুঁজে ঘুমোনোর চেষ্টা করতে লাগলো...
-উফ!কিভাবে যে মাকে ম্যানেজ করেছি ওই বোতাম-ছেঁড়া শার্ট নিয়ে,সে আমিই জানি!
অরিত্র বলে উঠলো।
-হুম,গুড-নাইট অরি!এবার ঘুমো!!আমি রাখছি!বাই!
জড়ানো গলায় ঝোরা বলে উঠলো।
-ওই ঝোরা,তুই আবার মাল খাচ্ছিস?সারা সন্ধ্যে খেয়েও...
-ধুর সালা!রাখ তো ফোন!!মেলা ফ্যাচফ্যাচ করবি না!
রাখ!
অরিত্রর মুখের ওপরে লাইনটা কেটে দিয়ে,বিছানায় ফোনটা ছুঁড়ে ফেললো ঝোরা।বাড়ি আজ একেবারে ফাঁকা।কেউ কোত্থাও নেই।ঘরে ঢুকেই আগে ফ্রিজ খুলে বেশ কিছুটা মদ্যপান করেছে ও।তারপর বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে,একটা সিগারেট ধরিয়ে,ঝোরা একটু কাৎ হয়ে পড়েছিলো।কিছুতেই ঘুম আসছে না।তখনই অরিত্র ফোন করে ঝোরা ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছেছে কিনা,সেই খবরটা নেয়।তারপর রাজ্যের গল্প বকতে শুরু করে।কিছুক্ষণ ওর বুকনি শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেছে ঝোরার।তাই ও ফোন রেখে দিয়েছে।ঝোরা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।এক হাতে সিগারেট ধরে,আর এক হাতে গ্লাসের শীতল-পানীয়টুকু গলায় ঢেলে নিলো।গলা দিয়ে জ্বলতে-জ্বলতে নামছে...এবার গলা-বুক সব একসঙ্গে জ্বলতে শুরু করেছে।সেই সঙ্গে বীভৎসভাবে গা গুলোচ্ছে...
হাতড়ে-হাতড়ে কাঁচের গ্লাসটা টেবিলে রেখে,দেওয়াল ধরে টলতে-টলতে বাথরুমে গেলো ঝোরা,বাথরুমে ঢুকতে না ঢুকতেই হড়হড় করে বমি করে ফেললো ও।সারা বাথরুম বমিতে একেবারে ভাসাভাসি হয়ে গেলো!হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা কমোডে ছুঁড়ে ফেলে কলটা খুলে দিলো ঝোরা,জলের তোড়ে একটু-একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে বাথরুমের মেঝে...ধুয়ে যাচ্ছে বমি...বাথরুমের এক কোণেই কাঁপতে-কাঁপতে বসে পড়লো ঝোরা...
দুহাতে মুখ চেপে ধরে হু-হু করে কেঁদে উঠলো ও...
(চলবে....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন