অনুসরণকারী

শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২২

সূর্যোদয়ের আগে (পঞ্চম পর্ব)




সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
পঞ্চম পর্ব



-কতবার বলেছি তোকে,বাড়িতে ঢোকার পর আর ফোন করবি না তুই!এতবার ফোন করেছিস কেন?
-কাল দেখা করবি ঝোরা!
-না!
-ওই...আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি না,বলছি,তুই কাল দেখা করবি!ব্যাস!!কারোর ফ্ল্যাটে নয়,কফি শপে!কথা আছে।
-তুই আমার ওপর জোর খাটাতে পারিস না অরি!
-আচ্ছা,রিকুয়েস্ট করি তবে?প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ!!
-কি হয়েছে আগে বল!
-বাড়িতে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে!
-তো আমি কি করবো?
-তোকে বিয়ে করবো ঝোরা!আমি মরে যাবো তোকে ছাড়া...
-অরি!এক কথা-এক কথা-সেই এক কথা!!রাখ ফোন!আর জীবনেও ফোন করবি না!
-প্লিজ ঝোরা!বাড়িতে প্রচন্ড ঝামেলা চলছে!!
-হোয়াট!!কি নিয়ে?আমাকে?
-হুম!আজ তোর সঙ্গে আমায় কে দেখেছে,মাকে এসে লাগিয়েছে।বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই শুধু অশান্তি আর অশান্তি!!
-এই সে কি বললো তোর মাকে!!উমম,লেট মি গেস!একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলে ঘুরছে!তোমার ছেলে কিন্তু শেষ!ও মেয়ে কিন্তু ভীষণ নোংরা...
-ঝোরা!!সব ব্যাপারে মজা করিস না!
-ওকে-ওকে সরি!বুঝতে পারছি!সবদিক থেকেই তোর একসঙ্গে ফাটছে!বল...
-কাল দেখা কর!কথা আছে।বাড়িতে না মানলেও আমি তোকেই বিয়ে করবো!রেজিস্ট্রি করবো...
-টেনে একটা লাথি মারবো গান্ডু!
-মেরেই ফেল ঝোরা!শুধু বিয়ে কর!!
-অরি!!একটা কথা একবার বললে তোর মাথায় ঢোকে না!?আমি বিয়ে করবো না...ব্যাস!!
-আমি তোকে ছাড়া মরে যাবো ঝোরা!
-ওই,ভালোভাবে একটা কথা শুনে নে।তোর সঙ্গে শোওয়ার আগে,আমি কি কোথাও কন্ট্রাক্ট এ সই করেছিলাম,যে আমি তোকে বিয়ে করবোই!!না...করিনি!তাই করবো না তোকে বিয়ে!
-ঝোরা,তোকে আমি খুন করে ফেলবো!শেষ করে দেবো তোকে...
-ফেল না রে!!বেঁচে যাই আমি!!আমিও তো আর পারছি না...
-কেন এমন করছিস ঝোরা?
ফোনের ওপার থেকে কেঁদেই ফেললো অরিত্র।
-এভাবেই যে নিজেকে ভুলে থাকা যায় অরি,তাই!তুই আর কাঁদিস না অরি!তুই যত কাঁদবি,আমি ততই নিজের কাছে জিতে যাবো,আমি জানি।তবুও তুই কাঁদিস না!!আর ফোন করিস না আমায়।মা যাকে বলছে,বিয়ে করে নে...বাই!!
রাতে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে চমকে উঠেছিলো ঝোরা।অরি এতবার ফোন করেছিলো দেখে ও নিজেই ওকে ফোন করে।কিন্তু ও আজ যা বললো,তারপর আর ওর সঙ্গে থাকা যায় না।এবার ওকে ছাড়তেই হবে।ছেলেটা ভীষণ বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।চোখটা মুছে নিলো ঝোরা,একটা অচেনা নম্বর থেকে মিসড কল এসে রয়েছে।ও সেভ করে নিলো নম্বরটা,
"প্রিয়ম"...
-দেখো প্রিয়ম।ফ্রিজ ঠান্ডা হবে কিনা,গিজারে জল গরম হবে কিনা,সেই গ্যারান্টি তো আমি দিতে পারবো না।তবে হ্যাঁ,এটুকু বলতে পারি,এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ঠান্ডা-গরম দুটোই খাওয়াবো।এবার তুমি ঠিক করো,কোনটা আগে খাবে?
-দুটো একসঙ্গে?অসম্ভব!ঠান্ডা চলবে!!আমি খাওয়াচ্ছি,চলো!
-না-না!পরপর তুমিই খাইয়ে যাবে,এটা তো হয় না।এখনও তোমার খাওয়ানো ফুচকা পেটে গজগজ করছে।এবার আইসক্রিমটা আমি খাওয়াবো।
-ওকে!চলো!
প্রিয়ম একটু হেসে বললো।
-ওই এখানে না।আমাদের এপার্টমেন্টের কাছেই একটা পার্ক আছে।ওর বাইরে একজন কাকু আছে,একদম মাই ডিয়ার।ওখানেই চলো।আমাকে কাকু চেনে...চলো...চলো...ফলো মি!
আজও কালকের সবুজ জামা আর সাদা রঙয়ের প্যান্টটাই পরে রয়েছে ঝোরা।একমাথা চুল খোলা,হাওয়ায় উড়ছে,গলায় একটা স্কার্ফ।প্রিয়মের ফ্রিজ আর গিজার বুক করে,ফুচকা খেয়ে ঝালে লাফাচ্ছিলো ঝোরা।তারপরই ওরা ঠিক করে আইসক্রিম খাবে।স্কুটিতে উঠে ঝোরা আগে হুশ করে বেরিয়ে গেলে,প্রিয়ম ওর পিছনেই বাইক নিয়ে এগিয়ে যায়...
-আমি প্রায়ই এখানে আসি,জানো তো?কত ছোট-ছোট বাচ্চারা খেলা করে,দেখতে ভারী ভালো লাগে।তারপর এই কাকুর থেকে আইসক্রিম খেয়ে সোজা বাড়ি...
-হুম!বেশ লাগে শিশুদের সঙ্গে শৈশবে ফিরে যেতে...ঝোরা?
-উম?
-তোমার বাবা-মা?
-মা মারা গেছে বছর তিনেক আগে।
-আর বাবা?
-বাবাও...আমার পৃথিবী বলতে এখন দাদা আর বৌদি..এমনিতে বৌদি আমার থেকে ছোট।কিন্তু যেহেতু আমি দাদার ছোট বোন,তাই ও আমাকে বোন বানিয়েই ছেড়েছে।বেশ ভালোও লাগে।গুরুত্ব পেতে,একটু ভালোবাসা পেতে কার না ভালো লাগে বলো!!বড্ড ভালো আমার বৌদি!
-হুম,বৌদি সত্যিই ভালো।ওইটুকু সময়ে যতটা বুঝলাম আর কি!!আমারও বাবা নেই।বছর বারো আগে মারা গেছে!মাঝে-মাঝে ভীষণ অসহায় লাগে নিজেকে।মনে হয়,মাথার ওপরে একটা বটগাছ থাকলে ভালো হতো!
-হুম!!
-কি হুম?
-ওই যে,মাথার ওপরে বটগাছ থাকলে ভালো হয়।হুম,ভালো তো হয়ই...চলো উঠি!
নিজের আইসক্রিমের কাপটা আর চামচটা ছুঁড়ে একটা ক্যাঙ্গারুর মুখে ঢুকিয়ে দিলো ঝোরা...প্রিয়মের তখনও খাওয়া হয়নি,কিছুটা ইচ্ছাকৃতভাবেই সময় কাটাচ্ছে ও।ঝোরাকে একটু বুঝতে হবে।আর তার জন্য ওর সঙ্গে সময় কাটাতে হবে।ওর সঙ্গে উড়ে বেড়ালে চলবে না।ধরতে হবে ওকে,বাঁধতে হবে।আর তার জন্য ওর একদম শিকড়ে পৌঁছতে হবে।প্রিয়ম ঝোরার দিকে চেয়ে বললো,
-একটু বসো!আমি কমপ্লিট করে নিই!!
-ওকে!!
-ঝোরা?
-হুম?বলো...
-তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি?কিছু মনে করবে না তো?
-হুম,বলো না!!মনে করার মতো হলে মনে করবো,নইলে মন দিয়ে তোমার মনের কথা শুনে,মনে-মনে কিছু একটা ভেবে নিয়ে,মনে করে আবার ভুলেও যাবো!!
ঝোরার কথার অদ্ভুত খেলায় সশব্দে হেসে উঠলো প্রিয়ম।তারপর বললো,
-ভালোবাসতে ভয় পাও?
থরথর করে কেঁপে উঠলো ঝোরা।চমকে উঠে ও চাইলো প্রিয়মের দিকে।প্রিয়ম তখন একমনে আইসক্রিমের বাটির মধ্যে চামচ চালাচ্ছে।মুখাবয়ব একেবারে শান্ত,অভিব্যক্তিহীন।
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-এমনিই!তোমার যে বদ্ধমূল ধারণার কথা কাল বলেছিলে,তার পরিপ্রেক্ষিতেই বলছি।"মেন ডোন্ট ডিসার্ভ লয়ালটি!" আমি জানতে চাইছি না,কেন তোমার এ ধারণা!!যদি কোনোদিন তোমার চোখে সেই জায়গায় উঠতে পারি,তবে সেদিন তুমি হয়তো নিজেই বলবে।আমি শুধু জানতে চাইছি,তুমি এখন ভালোবাসতে ভয় পাও কিনা!!
-আচ্ছা,আমি যদি বলি হ্যাঁ,তাহলে কি তুমি এখন আমায় মোটিভেট করার জন্য লম্বা-চওড়া স্পীচ দিতে বসবে?
হেসে ফেললো প্রিয়ম।শুন্য বাটি আর চামচটা দুজনের মাঝে রেখে হেলান দিয়ে বসলো ও।তারপর ঝোরার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-একেবারেই না।আমি আমার ভাবনাটা তোমার ওপর কেন চাপিয়ে দেবো!আমি তো শুধু তোমার ভাবনাটা জানতে চাইছিলাম মাত্র।
-তোমায় কেন বলবো?
-তাও তো ঠিক!আমায় কেন বলবে?ওকে,সরি!আর জিজ্ঞেস করবো না।ভুল হয়ে গেছে।
চুপ করে রইলো ঝোরা।তারপর বললো,
-তুমি ভালোবেসেছো প্রিয়ম?বিশ্বাস করেছো?
-হুম!জন্ম থেকেই তো ভালোবাসছি!যখন বুঝিনি ভালোবাসা কি,তখনও তো ভালোবেসেছি।মা-কে,বাবাকে...
-হুম!!খুব সুন্দর বলো তোমার পরিবার?
-হ্যাঁ!সে তো তোমার পরিবারও...
-হুম।তা ঠিক!
দুটো বাচ্চা দৌড়ে-দৌড়ে ওদের দিকে আসছিলো।প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে।পার্কের চারিধারে বড়-বড় আলোগুলো এক-এক করে জ্বলে উঠেছে।হঠাৎ করে একটা বাচ্চা পড়ে গিয়েই কাঁদতে শুরু করে দিলো।
-ইস!!
উঠেই ওইদিকে দৌড়োতে যাচ্ছিলো ঝোরা।কিন্তু তার আগেই বাচ্চাটার মা এসে ওকে কোলে তুলে নিলো।কিছুক্ষণ কেঁদে মায়ের কোলে শান্ত হলো সেই শিশু...
-মা-ও তেমন!কোথায় থাকে কে জানে!বাচ্চা ছেড়ে দিয়ে এভাবে...বলতে-বলতে আবার প্রিয়মের পাশে এসে বসলো ঝোরা।
-মা আবার কি করলো?
-দেখলে না?বাচ্চাটা পড়ে গেলো?!
-হ্যাঁ,তো খেলতে গেলে পড়বে না?সেটাও মায়ের দোষ?
-না মানে...আর একটু কেয়ারফুল হলে...
-ভুল!!
বলেই ঝোরার চোখের দিকে চাইলো প্রিয়ম।
-কি?কি ভুল?
-ওর মায়ের ওভাবে দৌড়ে এসে ওকে তোলাই উচিত হয়নি!
-মানে!!বাচ্চাটা পড়ে গেছে,মা হয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখবে!!কোথায় লাগলো-না লাগলো...বলি কটা বাচ্চার বাপ হয়েছো শুনি!!
নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে হেসে ফেললো প্রিয়ম।
-না!সেই সৌভাগ্য এখনও হয়নি।তবে আমার এটুকুই মনে হয়,এই যে ওকে তুলে কোলে করে ওর মা নিয়ে গেলো,এটা একদম ঠিক হলো না।এরপর বৃহত্তর জীবনযুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়লে,ও অপেক্ষা করবে,কেউ এসে ওকে এভাবেই টেনে তুলবে।সেটা তো সবসময় সম্ভব না ঝোরা!নিজের যুদ্ধটা তো নিজেই লড়তে হবে।আজ পড়ে গেছিলো,যদি ওর ওঠার ক্ষমতাই না থাকতো,ও পড়েই থাকতো!তখন সার্ভাইভ করার জন্য,কিছু না কিছু তো করতোই।কিন্তু তুমি কি খেয়াল করেছো ঝোরা,ও নিজে ওঠার বিন্দুমাত্রও চেষ্টা না করে,এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওর মাকেই খুঁজছিলো!মা কখন ওকে দেখবে,দৌড়ে আসবে!এটা না হয় এই বয়সে ঠিক আছে।কিন্তু এরপর?এরপর যখন একটা বয়সের পর মায়ের আঁচলের আড়াল সরে যাবে,বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করবে,তখন?অভ্যেস ঝোরা!অভ্যেস বড় বিষম ব্যাপার!!এটাই ওর অভ্যেস হয়ে গেছে!আজ এই মুহূর্তে যদি কেউ না আসতো,ও একটু পর ঠিকই নিজে-নিজেই উঠে দাঁড়াতো!!ওই দেখো,ওর কিন্তু কিচ্ছু হয়নি,আবার দৌড়োচ্ছে!!
প্রিয়মের কথার গভীরভাবে ডুবে গেছিলো ঝোরা,ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে ঝোরা দেখলো,সত্যিই তো তাই!এবার তো বাচ্চাটা দুটো বাচ্চার সঙ্গে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।আগের মতোই প্রাণোচ্ছল...
-আমার বাবার ওপর একবার আমার খুব রাগ হয়েছিলো জানো!ছোটবেলায় পার্কে বাবার সঙ্গে হাত ধরে-ধরে যেতাম।পড়ে যেতাম,কেটে যেত,ফেটে যেত,বাবা দূর থেকে দেখেও,বেঞ্চে বসে গল্প করতো কাকুদের সঙ্গে।একদিন পড়ে গিয়ে চোয়াল কেটে গিয়েছিলো।সেদিনও উঠে আসেনি।প্রচন্ড অভিমান হয়েছিলো বাবার ওপরে।রক্ত দেখে মাথা ঘুরে,গা গুলিয়ে বমি পেয়ে যায় আমার।বাবা জানতো।তাও আসেনি।সোজা উঠে কাঁদতে-কাঁদতে দৌড়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম।তারপর দেখলাম,বাবাও আড্ডা ফেলে দৌড়ে বাড়ি চলে এসেছে।কিছুতেই বাবার সঙ্গে কথা বলিনি সেদিন।মা-ও বাবাকে খুব বকেছিলো।পরে বাবা অবশ্য নিজের হাতেই ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলো ক্ষতস্থানে।কিন্তু সেদিন বাবা মাকে ঠিক কি বুঝিয়েছিলো জানি না,তারপর দেখতাম,মা-ও আর বাবাকে কিছু বলতো না।কিন্তু আমাকে বলেছিলো মা।সেইদিন বলেছিলো,যেদিন মহাশ্মশান থেকে বাবাকে দাহ করে ফিরেছিলাম।বলেছিলো,
"মনে কর পাপাই,সেই ছোট্টবেলার মতো পার্কে খেলা করতে-করতে তুই মুখ থুবড়ে পড়ে গেছিস।বাবা কিন্তু তোকে তুলবে না।তোকে নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হবে।নিজের দায়িত্ব সেই সময়ও যেমন নিজেই নিয়েছিলি, ছোট-ছোট দুটো পা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলি,আজও আবার উঠে দাঁড়া!বাবা সেদিনও তোকে তোলেনি,আজ তো আর কোনো প্রশ্নই ওঠে না।তুই তৈরীই আছিস পাপাই,সেই তুই এত ভেঙে পড়লে,আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো বাবা!!"
হুম!মা কেঁদে ফেলেছিলো সেদিন।কিন্তু আমি আর কাঁদিনি।বুঝে গেছিলাম,আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হবে,একা!আর মাকেও টেনে তুলতে হবে।একজন সদ্য-বিধবার কাছে সেই সময় উপযুক্ত সন্তানই একমাত্র অবলম্বন!তাই দাঁতে-দাঁত চেপে তৈরী করেছি নিজেকে।কষ্ট হয়েছে।বাবা বাড়িটাও করে রেখে যেতে পারেনি।বাড়িভাড়া,পড়াশোনার খরচ,হোস্টেল খরচ,সংসার খরচ,সব মা টেনেছে।বাবা টাকা রেখে গিয়েছিলো কিছু।এডুকেশন লোনটাও শোধ হয়েই এলো,এবার শুধু ফ্ল্যাটটা।মা দিতে চেয়েছিলো,যত বছর চাকরি করছে,বলেছিলো দুজন মিলে লোনটা টেনে নিই।আমিই আর নিইনি।চাকরি পাওয়ার পর মায়ের থেকে আর একটা টাকাও নিইনি।আর কত করবে!মেরুদন্ড তো বাবা-ই সোজা করে দিয়ে গেছে,একা পথও চলতে শিখিয়েছে।মা পেটে বিদ্যে দিয়েছে,করে খাওয়ার রাস্তা তৈরী করে দিয়েছে।এতটাই বা কজন পায়!!তাই আর নিতে পারিনি কিছু!বাকিটুকু আমি একাই পারবো....
চুপ করে রয়েছে ঝোরা...
-বুঝলে!!
-হুম!
-কি বুঝলে?
-বুঝলাম,তোমার সঙ্গে আর কথা বলা যাবে না!
-সেকি!কেন?অধমের অন্যায়?
-হারিয়ে যাবো!!
-এবার কিন্তু আমি ঠিক বুঝলাম না!
-কিছুনা...চলো উঠি...
-ওকে...চলো।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে বাধ্য হলো প্রিয়ম।নিজের আইসক্রিমের কাপটা ফেলে দিলো।তারপর পার্কের সরু নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তা ধরে ঝোরার পাশে-পাশে হাঁটতে লাগলো।দুজনেই চুপচাপ...
কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতার অবসান ঘটালো প্রিয়মই...
-ঝোরা?
-হুম!
-প্রতিবেশী বলে পায়ে-পা দিয়ে,তাহলে ঝগড়াই করবে!তাই তো?
-নাঃ!!
-তাহলে কথা বলছো না কেন?তোমার ধারণা তো ভুলও হতে পারে!
-মানে?
-মানে,আমার সঙ্গে কথা বললে,তুমি হারিয়ে না গিয়ে,আবার নিজেকে ফিরেও তো পেতে পারো!
কেঁপে উঠলো ঝোরা।ওর সমগ্র শরীর শিরশির করে উঠলো...
-প্রিয়ম!!
-হুম,বলো....
-সালা!!এখানে তো কচি-বাচ্চারা খেলতে আসে বলে জানতাম,বড়ো-বাচ্চারাও যে খেলতে আসে,সেটা জানা ছিলো না তো!!তা কতক্ষণ খেললে মামনি!!
পার্ক ছেড়ে সবে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে ওরা।হঠাৎ করেই ঝোরার প্রায় গায়ের ওপরেই একটা বাইক এসে থামে,
-সে খবরে তোর কি দরকার!!
ভয় পেয়ে গেলো প্রিয়ম।তিনজন রয়েছে ওরা।ওদের একেবারে মুখের সামনেই ঝোরা রয়েছে।
-ঝোরা,চলে এসো এদিকে...
-এই,দাঁড়াও তো!
-হ্যাঁ,বল!!আমি কতক্ষণ খেললাম,সেই হিসেব দিয়ে তুই কি করবি বল!!
-বাবা!!মেয়ের ঝাঁজ তো হেভি!কোনো ক্লান্তি নেই...আজ বোধহয় খেলা জমেনি!দাদা বোধহয় জমিয়ে খেলতে পারেনি।তাই ম্যাডামের মেজাজ-গরম!!
বলেই এমন কিছু অশ্লীল ভাষা সেই স্থানীয় ছেলেগুলো প্রয়োগ করে বসলো,সেসব কানে প্রবেশমাত্র প্রিয়মেরই কানদুটো ঝাঁ-ঝাঁ করে উঠলো।ও ঝোরার হাত ধরে ওকে টেনে আনলো ওখান থেকে...
-কি হয়েছেটা কি?উফফ!!ছাড়ো আমায়!হাতে লাগছে!
-কাদের সঙ্গে মুখ লাগাচ্ছ ঝোরা?যত্তসব ব্লাডি....
-হ্যাঁ,তোমরা ওই পিছনেই বলতে পারবে।গালভরা গালাগালি শুধু পিছনেই দিতে পারবে।তোমাদের মুরোদ,তোমাদের ক্ষমতার দৌড় আমার জানা আছে!সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই।এরাও হয়েছে তেমনি।যত্তসব গান্ডুর দল!সন্ধ্যেটা হলেই এদেরই রাজত্ব,এদের জিপ,এদের বাইকের ঠেলায় রাস্তায় চলা দায়!!সোহিনী এই জন্যই রাতে এদিকে আসতেই চায় না!!সালা আর একটু টাকা ইনভেস্ট করতে পারলে,মরতে এই যমের দক্ষিণ দুয়ারে ফ্ল্যাট কিনতাম!!
-ঠিক আছে,এখন আগে চলো এখান থেকে....
কাঁচা খিস্তি দিতে-দিতে স্কুটিতে গিয়ে বসলো ঝোরা।প্রিয়মও বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিলো....
দুজনেই একসঙ্গে পার্কিংয়ে ঢুকলো...তারপর লিফটে...
ঝোরা একদম চুপ করে গেছে।
-সরি ঝোরা!!
-কেন?
-তখন আমি ওভাবে হঠাৎ করে তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার হাত ধরে...সরি!
-দেখো প্রিয়ম।যেটা হচ্ছে,আমার নিজের কারোর সঙ্গে তো হচ্ছে না,অন্য যার সঙ্গে যা হচ্ছে হোক গে,এই মনোবৃত্তি নিয়ে যতক্ষণ চলবে,ততক্ষণ ওই কুয়োর ব্যাঙ হয়েই বসে থাকবে!তোমার পরিবারের কেউ তো আর নয়,তাই তোমার কোনো দায় নেই।এসব ভেবেই ঘরে গিয়ে বসে থাকো গে যাও!!
-আমি কিন্তু সেভাবে...
-এই যাও তো!বাজে বকো কম!আমার কাউকে দরকার নেই!কোনোদিনই দরকার পড়েনি।তুমি আমার সঙ্গে থেকে কোন মহৎ কাজটা করেছো শুনি!তুমি না থাকলেই বরং আজ ওদের গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিতাম।যাও-বেরোও,তোমার ফ্লোর এসে গেছে...
আর কথা বলার সুযোগ পেলো না প্রিয়ম।লিফটের দরজা খুলে যাওয়ায় বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলো ও...
-বাই!
-হুম!
প্রিয়মের মুখের ওপরে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো।লিফট চলে গেলো ওপরে...
মেজাজটাই বিগড়ে গেলো প্রিয়মের।এত সুন্দর একটা বিকেল,একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে একেবারে নষ্টই হয়ে গেলো...ওর মুখ থেকেই এবার অস্ফুটে একটা গালাগালি বেরিয়ে এলো...
নিজের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগোলো প্রিয়ম...
চুপ করে বিছানায় শুয়েছিলো ঝোরা।ও কি প্রিয়মের ওপর একটু বেশিই চেঁচিয়ে ফেললো!!ও হয়তো নির্ঝঞ্ঝাটে ওর সুরক্ষাই চেয়েছিলো।কিন্তু মাথা গরম হয়ে গেলে,কাউকে রেয়াত করে না ঝোরা।এখন আবার কেমন একটা লাগছে ওর।চুপ করে মাথা নীচু করে ছেলেটা বেরিয়ে গেলো লিফটের বাইরে...ফোনটা হাতে নিলো ঝোরা।দেখলো,অরিত্রর চারটে মিসড কল হয়ে আছে।ওটা রোজকার ব্যাপার!ঝোরার ইচ্ছে হলে ধরে,কথা বলে।নইলে মুখের ওপরেই অরির ফোন কেটে দেয়!আজ বেশ একটু ইতস্তত করে,অরির নম্বর পেরিয়ে প্রিয়মের নম্বরে আঙুল রাখলো ও...কানে ধরলো ফোনটা....
প্রিয়মের রাতের খাওয়া হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ আগেই।আজ তীর্থ টিউশনে আসেনি।ও মামাবাড়িতে রয়েছে।নইলে যে কদিন পাপাই এখানে থাকে,সেই কদিনই ও পাপাইদার সঙ্গে খেয়েই বাড়ি ফেরে।তখন নিজের পছন্দের মাংস ভুলে গিয়ে পনীর কিংবা ধোঁকার ডালনা দিয়েই তৃপ্তি করে ভাত খায় তীর্থ।কিন্তু একবার পাপাইদা চলে যাওয়ার পর,আর তীর্থকে বলে-বলেও একবেলা খাওয়াতে পারবে না অপর্ণা।কিন্তু প্রিয়ম থাকাকালীন ও যেন স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে পড়ে।আজ খাওয়ার টেবিলে বেশিরভাগ সময়ই মায়ের সঙ্গে তীর্থকে নিয়েই কথাই হচ্ছিলো।মা বলছিলো,তীর্থ একদম পড়াশোনা করে না।চুপ করে ছিলো প্রিয়ম।খুব একটা কথা বলছিলো না।প্রিয়ম বাড়ি এলে খুব একটা রাতের খাবারটা,একা খায় না,পাশে তীর্থ থাকে।তাই তীর্থকে আজ ওর বড় মনে পড়ছিলো...তার ওপর অকারণে ঝোরার সঙ্গে একটা ছোটখাটো ঝামেলা হয়ে যাওয়ায়,মনটা ভীষণই ভারাক্রান্ত হয়েছিলো প্রিয়মের।ও খাওয়ার পর বিছানায় বালিশের ওপর পিঠ ঠেকিয়ে ছিলো কোলে ল্যাপটপ নিয়ে।কানে ইয়ারফোন গোঁজা...মেজাজটা এতটাই বিগড়ে ছিলো,যে একটা হাসির সিনেমা দেখে মনটা ভালো করার চেষ্টা করছিলো ও।ফোন পাশেই রাখা...ফোনের আলোটা হঠাৎই জ্বলে উঠলো।নামটা দেখেই দমবন্ধ হয়ে এলো প্রিয়মের...ও কান থেকে একটানে হেডফোন খুলে ফেলে ফোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো...
-হ্যালো?
-হাই!প্রিয়ম!
-হাই!!বলো!
-আমি জাস্ট,আমি জাস্ট সরি বলার জন্য ফোন করলাম!সরি প্রিয়ম!
-কেন?আমায় সরি বলছো কেন ঝোরা?
-এমনিই!মানে হঠাৎ করেই মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো তখন!একটু চেঁচিয়ে ফেলেছি!
-ইটস ওকে!!ওকে!!
-হুম!থ্যাঙ্কস!
আর কোনো কথা খুঁজে পায় না ঝোরা।প্রিয়মও ফোনের ওপারে চুপ করে থাকে।কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলে না!আবার ফোনটাকেও আঁকড়ে ধরে রাখে কানে...
অপার নৈঃশব্দের মধ্যেও প্রিয়মের বুকের ভিতরটা ভালোলাগায় তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে....
-ঝোরা?
-হুম?
মৃদুস্বরে সাড়া দিলো ঝোরা।
-ঘরের মধ্যে সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে না!!
বলেই নিজের পুরু ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো প্রিয়ম।চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো।এক্ষুণি ঝড়ের বেগে গালাগালি ভেসে এলো বলে ওপার থেকে....কিন্তু ওপার থেকে মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এলো,আর সেই সঙ্গে কয়েকটা বাক্যও,
-হুম!বদ্ধ জায়গায় সিগারেট খাওয়া উচিতও না।তার জন্য খোলা জায়গাই ভালো।এই....
-এই?
হৃদপিন্ডটা এত জোরে লাফাচ্ছে প্রিয়মের,মনে হচ্ছে মুখ দিয়ে বেরিয়েই আসবে।
-এই আমিও সবে ভাবছিলাম একটা সিগারেট খাবো....
-ওঃ!আচ্ছা!!
একটু হতাশ হলো প্রিয়ম।তারপরই ওকে অবাক করে,অপর প্রান্ত থেকে দুটো শব্দ ভেসে এলো,
-ছাদে গিয়ে!!
হঠাৎ করেই এখন যদি ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়,ও মারাও পড়ে,প্রিয়ম একটুও অবাক হবে না।ও বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় শুয়েছিলো।তড়াক করে উঠে বসলো,উত্তেজনায় পাগল হয়ে বললো,
-এত রাতে একা-একা ছাদে গেলে কিন্তু ভূতে ধরবে ঝোরা!!
-সেটাই তো স্বাভাবিক!পেত্নীদের ওপরে বরাবরই ভূতের নজর থাকে।এ আর নতুন কি!!
-তাই?
-হুম!তাই তো!!
বলেই ফোনটা কেটে দেয় ঝোরা।একটু হেসে ও উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে।কি অসম্ভব রকম একটা উত্তেজনা হচ্ছে ওর সর্বশরীর জুড়ে....তাড়াতাড়ি করে নিজের পরনের জামাটা গা থেকে টেনে খুলে ফেললো ঝোরা...শুধুমাত্র একটা অন্তর্বাস আর হাঁটু পর্যন্ত একটা প্যান্ট পরা রয়েছে।দুচোখ মেলে আয়নায় ঝোরা নিজেকে একটু ভালো করে দেখলো।উন্নত দুটো স্তনের নীচে,পেটের কাছে বেশ চোখে পড়ার মতোই মেদ জমেছে।সারাদিন গায়ের সঙ্গে লেপ্টে অধোবাস থাকায়, জামার ওপর দিয়ে ওর শরীরের খামতিগুলো ধরা পড়ে না।ওকে দেখতে বেশ মেদহীন লাগে।কিন্তু এখন ঝোরা দেখলো,সেদিন সোহিনী ঠিকই বলেছিলো,
"মদ খাওয়াটা এবার একটু কমা ঝোরা!আলগা একটা এলকোহলিক-ফ্যাট জমে যাচ্ছে কিন্তু শরীরে।এরপর কিন্তু আর কোনো শেপওয়্যার দিয়েও সামলাতে পারবি না।বিশাল ফুলে যাবি!"
নিজের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে,আবার জামাটাই পরে নিলো ঝোরা।আজ ও পরবে না কোনো অধোবাস!থাক না এমনই,একটু অগোছালো....সবসময় নিজেকে আর নিখুঁত করে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না।থাক,ওইটুকু আলগা মেদ না হয় আজ আর ও আড়াল করবে না....চুলটা একটা ব্যান্ড দিয়ে কোনোরকমে আটকে নিলো ঝোরা।মুখটা সামান্যতম প্রসাধনেও ঢাকলো না আজ!বরং মুখটা একটু জল দিয়ে ধুয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।দেখলো,বলিরেখা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে!চোখের তলায় গভীর কালি!ভ্রু-আর চোখটাও যত্ন করে আঁকা না থাকায়,বেশ বিবর্ণই দেখাচ্ছে ওকে।সর্বক্ষণ দ্বিতীয়-ত্বকের মতো একটা আলগা প্রসাধনে নিজেকে ঢেকে রাখা ঝোরা,কিন্তু আজ আর এতটুকু প্রসাধনও ও স্পর্শ করলো না....
একেবারে সাধারণভাবেই নিজের ঘর ছেড়ে বেরোলো....দাদার ঘরের দরজা বন্ধ।চুপচাপ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখলো ঝোরা....
উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছে ও।মাথার ওপরে খোলা আকাশ...যেন কালো চিত্রপটে কয়েকটা মাত্র জোনাকি জ্বলছে!মেঘে ঢাকা আকাশ।অর্ধচন্দ্র তাই একেবারেই ম্লান!
জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়েই পা টিপে-টিপে ঘর থেকে বেরোলো প্রিয়ম।মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ।ও নিজের ঘরের দরজাটাও টেনে ভেজিয়ে দিলো,যাতে মা উঠে পড়লেও মনে করে,ও ঘরেই আছে।নেহাত যদি মায়ের কাছে ধরা পড়েই যায়,তখন যাহোক কিছু একটা বলে দেবে!!এখন আর ওসব ভাবার সময় নেই।সিগারেট আর লাইটারটা পকেটবন্দী করে নিয়েছে ও!ঘড়িতে তখন রাত বারোটা পনেরো...
দরজা বন্ধ করে ফ্ল্যাটের বাইরে এসে দাঁড়ালো প্রিয়ম।উফফ!!ঝোরা একদম ঠিক করে গাল দেয়।কোনোদিনও হাতের সামনে লিফট পাওয়া যাবে না।সেই একতলায় রয়েছে।ও আটতলায় উঠতে-উঠতে প্রিয়ম পৌঁছেও যাবে।আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট না করে,দৌড়ে সিঁড়ির দিকে উঠলো প্রিয়ম...
লোহার ভারী দরজাটার শব্দ পেয়ে আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরালো ঝোরা।প্রিয়ম তখন সবেমাত্র দরজা খুলে ছাদে পা রেখেছে।একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো ঝোরাকে,ও আর কিছুতেই প্রিয়মের দিকে চাইতেই পারলো না।নিজেই অবাক হয়ে গেলো ঝোরা।তাড়াতাড়িই ও মুখটা ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে।প্রিয়ম ওর পাশে এসে দাঁড়ালো।হাঁপাতে-হাঁপাতে বললো,
-সেকি!!এখনও একা?ভূতে ধরেনি এখনও?
-নাঃ!!এই পেত্নীকে ভূতসমাজও রিজেক্ট করেছে।তা তুমি কি মনে করে?ভূতের হাত থেকে আমায় বাঁচাতে নাকি?
-নাঃ ভাবলাম,প্রতিবেশী যখন,একটা তো দায়িত্ব বর্তায়।গিয়ে দেখি ঠিকঠাক ভূতের হাতে পেত্নী পড়লো কিনা...
প্রিয়ম একভাবে চেয়ে রয়েছে ঝোরার দিকেই।ঝোরা আর ফিরতে পারলো না ওদিকে...নিজের পরিবর্তনে ওর নিজেরই অদ্ভুত লাগলো।
-ঝোরা?
-হুম?
-সিগারেট খাবো বলে বেরিয়ে,সিগারেট আনতেই ভুলে গেছি!দাও তো...
এর চেয়ে মরে গেলেও বোধহয় ভালো হতো।এখানে আসার আগে ঝোরা এত বেশি সময় আয়নার সামনে কাটিয়েছে,ও নিজেই তো ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা আনতে ভুলে গেছে।এবার কি বলবে ও!!প্রিয়মের দিকে এবার পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ালো ও,
-প্রিয়ম,না মানে...অনেক রাত হয়ে গেছে।আমি বরং এখন নীচে....
হেসেই ফেললো প্রিয়ম।নিজের ঠোঁটটা নিজেই কামড়ে ধরলো ও।ঝোরার সর্বশরীরে তখন অদ্ভুত একটা ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়েছে,একইসঙ্গে সাংঘাতিক অপ্রস্তুত ও...
-ইটস ওকে!এই নাও!
নিজের পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে ঝোরার হাতে দিলো প্রিয়ম।
ওটা দেখে হেসেই ফেললো ঝোরা...
হালকা আলোয় আজ কোনো প্রসাধন ছাড়া ঝোরাকে দেখলো ও।একটু অগোছালো,একটু অপরিপাটি।যেটা সাধারণত গত দুদিনে ওর মধ্যে দেখেনি প্রিয়ম।সবসময় উগ্র সাজেই দেখেছ ওকে।কিন্তু আজ একইসঙ্গে ওর মুখটা বেশ ম্লান,কিন্তু আবার উজ্জ্বলও,আলগা-মেকি প্রসাধনের আবরণ সরিয়ে প্রকৃত ঝোরা বেরিয়ে এসেছে যেন!শরীরের দিকেও যদি দেখা যায়,আজ যেন হঠাৎ করেই ঢোলা গেঞ্জিটায় ওকে বেশ মিষ্টি-গোলমোলু লাগছে।শরীরে সেই চাবুক ব্যাপারটা একদম নেই আর।অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধতায় নিজেকে আবৃত করেছে ঝোরা।নিজের মাথাটা নামিয়ে নিলো প্রিয়ম।আজ ভীষণ অদ্ভুতভাবে ঝোরা খুব একটা কথা বলছে না।প্রিয়মই বললো,
-ঝোরা?
-হুম,বলো!!
-পরশু আমার ফ্লাইট!ফিরে যাবো!
-হুম!!
-যোগাযোগ রাখবে তো তারপর আমার সঙ্গে?
-নাঃ!
-কেন?
-কি লাভ?প্রতিবেশী,প্রতিবেশীর মতোই থাকা ভালো।
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ঝোরা বললো।
-তাই কি?
-হুম,তাই!
-কেন?আমরা কি আর একটু এগোতে পারি না ঝোরা?
ঝোরা মাথা নামিয়ে নিলো।গত দুদিন ধরে এই ছেলেটার সঙ্গ ওর এত ভালো লাগছে,ওর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ও নিজেকে আটকাতেই পারছে না।বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো ওর,
-না।আমরা আর এগোতে পারি না প্রিয়ম।আমার দিক থেকে সম্ভব না।
-কেন?
-বলেছিলাম তোমায়।হারিয়ে যাবো!
-নিজেকে হারাতে এত ভয় কেন ঝোরা?না হয় হারালেই নিজেকে,যার জন্য হারালে,সেই হয়তো তোমায় আবার আবিষ্কার করবে...
-নাঃ প্রিয়ম।আর না!!তুমি ঠিকই বলেছিলে,আমি ভয় পাই।আমি ভালোবাসতে ভয় পাই।
বলেই মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো ঝোরা।প্রিয়ম বুঝে গেলো,ঝোরা স্ব-ইচ্ছায় যতটুকু বলবে,তার বাইরে আর একটা কথাও ওর পেট থেকে বের করা যাবে না।তার জন্য প্রচুর ধৈর্য্য ধরতে হবে।ওই প্রসঙ্গে আর গেলোই না প্রিয়ম।গভীরকণ্ঠে বললো,
-বেশ।ভালোবাসা তো অনেক বড় ব্যাপার।তবে আপাতত সম্পর্কটা প্রতিবেশী থেকে বন্ধুত্বে তো প্রোমোশন পেতেই পারে!তুমি দেখো,প্রতিবেশী মানেই যে লাঠালাঠি-ফাটাফাটি একটা ব্যাপার,এটা আমরা ভুল প্রমাণিত করেই ছাড়বো!!যুগে-যুগে আমাদের নাম চিরন্তন-প্রতিবেশী হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে....
প্রিয়মের কণ্ঠের অতিনাটকীয়তায় ঝোরা হেসেই খুন!হাসতে-হাসতে চোখে জল এসে গেছে ওর।প্রিয়ম একভাবে চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই।নিজের ঠোঁটটা বাঁধা পড়েছে দাঁতের গভীরে...
-উফফ!!তুমি পারোও সত্যি!
-ইয়েস!আমি তো পারিই...কাল গিজার আর ফ্রিজটা ডেলিভারি দেবে,ও পাড়ায় যাবো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে,তারপর তীর্থ কাল সকালে ফিরবে,আবার বিকেলেই বেরিয়ে যাবে।ওইটুকু সময়ের মধ্যে,একবার ওকে তো দেখে আসতেই হবে।কাল সারাদিনের বিজি শিডিউল!
-হুম!
-আর পরশু টাটা!!
-হুম!
-বন্ধুত্বের অধিকার থেকে একটা দাবী করতে পারি ঝোরা?
-কি?
-কাল রাতে এখানে একবার আসবে?
চুপ করে গেলো ঝোরা।ও ঠিক করছে না ভুল করছে,ওর জানা নেই।এতদিন হিসেব করেই বেঁচে এসেছে ও।কিন্তু আজ আর কোনো হিসেব করতে ইচ্ছে করছে না।হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে,ঠিক-ভুলের হিসেব আর করবে না।ও শুধু এটুকুই জানে,যেটা হচ্ছে ওর ভালো লাগছে।কিন্তু এভাবে তো জড়িয়ে যাবে প্রিয়মও....আর তারপর?ওকে পায়ের তলায় ফেলে,পিষে শেষ করতে ইচ্ছে করছে না ঝোরার।তার চেয়ে ও বরং বন্ধুই থাক,প্রতিবেশীই থাক।কান্নাটা গিলে ফেলে ঝোরা বললো,
-নাঃ!!
-ওকে!বুঝতে পারছি।দাবীটা একটু বেশিই করে ফেলেছি!সরি....
-এবার আমি তোমায় একটা কথা বলি প্রিয়ম?
-হুম,বলো?
-আমার সঙ্গে নিজেকে জড়িও না।তুমি শেষ হয়ে যাবে।আমার কাছে কোনো সম্পর্কের জন্য এতটুকুও সম্মান নেই।আমি সম্পর্ককে সম্মান করি না,সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষটাকেও সম্মান করি না,ভরসা করি না,বিশ্বাস করি না,ভালোও বাসি না।তাই আমার কাছ থেকে কেউ কিছু আশা করলে,তাকে আশাহতই হতে হবে।
-ভুল!!আবারও ভুল!!
-কি ভুল!
-তুমি সম্মান করতে,ভরসা করতে,বিশ্বাস করতে,ভালোবাসতে পারো না,এমনটা নয়।তুমি এগুলো করতে ভয় পাও!
শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় একইসঙ্গে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেলো ঝোরার।
"হ্যাঁ,ও তো ভয়ই পায়!সেই জন্যই তো সমস্ত পুরুষকে পায়ের তলায় পিষে মারতে চায়,যাতে কেউ ভালোবাসার কথা আর মুখেও না আনে!ঝোরা প্রথমে নিজেকে বিলিয়ে দেয় সেই পুরুষের কাছে,তারপর যখন সেই পুরুষ সংঘাতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ওর প্রতি,তখনই ও তাকে ছেড়ে বেরিয়ে আসে।পুরুষের চোখের জলে,মর্মান্তিক হাহাকারে,কি যে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি আসে ওর মনে,সেটা ও কাউকে বোঝাতে পারবে না।কিন্তু কাউকে ভালোবাসবে না ও।কারোর কাছে ধরা দেবে না....ঝোরা আজ আর এতোটাও সহজলভ্য নয়!"
-যাই আমি!অনেক রাত হয়ে গেছে।কাল সকালে আবার অফিস...
-ঝোরা?
-কি?
-জীবনে দুষ্টুর জন্য অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।প্রতিরাতে গা গুলিয়ে ওঠে ওর কথা ভাবলেই।ঘুমের ওষুধ ছাড়া খুব একটা ঘুম আসে না।কিন্তু বিশ্বাস করো,কাল রাতে ঘুমের ওষুধের কথা আমার মনেও ছিলো না।তোমার সঙ্গে কাটানো একটুখানি মুহূর্ত...
-কি চাও প্রিয়ম?
-কাল একবার এসো প্লিজ!
-তুমি কি বলছো,তুমি জানো না প্রিয়ম।ব্যাপারটা বাড়তে-বাড়তে অনেকদূর চলে যাবে,তুমি সামলাতে পারবে না।হয়তো কেউই পারবে না।অনেক দেখেছি আমি।তোমার কি মনে হয়,তুমি আমার জীবনে প্রথম পুরুষ!!প্লিজ,ভালোলাগাটা থাকতে-থাকতেই কিছু সম্পর্ক শেষ হওয়া ভালো।তাতে তিক্ততা জন্ম নেয় না।আমিও ভুল করেছি...সবদিক না ভেবেই মুহূর্তের দুর্বলতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম!আর না!আমি তোমাকে প্রশ্রয় দেবো না।দিতে পারবো না।কারণ,আজ তুমি প্রশ্রয় পেলে,কাল যে তুমি কতটা কষ্ট পাবে,তার নূন্যতম ধারণাও তোমার নেই!
-তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে,আমি যে আরও কষ্ট পাবো!
ঝোরা চুপ করে গেলো।
-প্লিজ ঝোরা!!
প্রিয়মকে ফেরাতে পারছে না ঝোরা,ওর মনও যে চাইছে না।আবারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে,ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে।কম্পিত কণ্ঠে ও বললো,
-আচ্ছা,আসবো!
-থ্যাঙ্কু!!
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।তারপর ঝোরা কলকল করে বলতে শুরু করলো,
-এই প্রিয়ম,তোমার বাড়ি থেকে অফিস কতদূর?মানে কতটা সময় লাগে যেতে?
-এই তাও ধরো....
দীর্ঘ আলাপচারিতার পর প্রিয়মের হাতে হাত রেখে ঝোরা যখন ছাদ থেকে সিঁড়িতে নামলো,তখন রাত সাড়ে-তিনটে....
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে...ওই হঠাৎ বৃষ্টিটুকু না এলে,আজ হয়তো সূর্যোদয়ের আগে পর্যন্ত,ওরা পরস্পরের সঙ্গেই থাকতো....
বিছানায় উল্টে পড়ে বালিশটা তুলে নিয়ে কানের-মাথার ওপর চেপে ধরলো প্রিয়ম।সারা শরীরে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি....
পাতলা চাদরে নিজেকে আবৃত করে নিজের পাশবালিশে মুখ গুঁজে দিলো ঝোরা....
"এসব কেন করছি আমি?আবারও....কিন্তু কি ভীষণ ভালো লাগছে যে!তাই করছি..."
দুজনই দুটো বিছানায় পরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো।দুজনের ঘুমের ওষুধই ড্রয়ারের মধ্যে পড়ে রইলো....আজ আর কেউ তাকে ছুঁয়েও দেখলো না....
দুটো ফ্ল্যাটের কাঁচের জানলা দিয়ে ঘরের ভিতরকার কিছুটা আবছা আলো বাইরে বেরিয়ে জানান দিলো,আজ গভীর ঘুমে নিমগ্ন রয়েছে দুটো হৃদয়...
(চলবে....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট