সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
ছেলেটাকে ওইভাবে থানায় ঢুকতে দেখেই চোখ দাঁড়িয়ে গেছে কনস্টেবলের! ঘুমচোখে ঢুলছিলেন উনি। কিন্তু এক নজর ওইদিকে দেখেই টুল ছেড়ে হাঁ করে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন!চোখ বিস্ফারিত!! চারিদিকে তখন শেষ রাতের অন্ধকার কাটিয়ে সূর্যদেব পুব আকাশে তার প্রথম আভা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন... সূর্যোদয়ের ঠিক প্রাক্কালেই টলতে-টলতে থানা-চত্বরে পা রাখলো সেই ছেলেটি...
-এখানকার অফিসার কে?আমি এর আগে জীবনেও কোনোদিন থানায় আসিনি!
হাঁপাতে-হাঁপাতে মাথা নীচু করে শান্ত স্বরে ছেলেটি বললো।
-স্যার!!
চিৎকার করে ভিতরে দৌড়ে ঢুকলো কনস্টেবল।কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একজন কেতাদুরস্ত পুলিশ অফিসার,সঙ্গে আরও কয়েকজন পুলিশ...
-কি অবস্থা এর!!
ছেলেটিকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন অফিসার...
-আপনাকে কি বললাম স্যার!!
টলতে থাকা ছেলেটি মাথা তুলে পুলিশ অফিসারের চোখে যখন নিজের চোখ রাখলো,সেই মুহূর্তেই রাতের অন্ধকারকে পুরোপুরি সরিয়ে সূর্যদেব তার প্রথম আভা ছড়িয়ে দিলো দিগন্তরেখায়...
বছর দুয়েক আগের কথা....
"....ক্ষুদিরাম হবে পাশের বাড়ির ছেলে।
আমরা তামাকে এবং দুধে,
রসে এবং বশে, সুখে এবং আরামে
দিন কাটাবো।
দেশের মুক্তি, প্রাণের মূল্য কিনে আনবে অন্য কেউ...."
বার্ষিক নবীন-বরণ অনুষ্ঠানে, কবি শুভ দাশগুপ্তর সেই বিখ্যাত প্রতিবাদী জ্বালাময়ী লেখা এমন অগ্নিসম কণ্ঠে আবৃত্তির পর, সমবেত করতালিতে ফেটে পড়লো স্কুলের লাগোয়া ছোট কমিউনিটি হল। একমাথা ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি দু-হাত বুকের কাছে এনে নমস্কার করে নেমে পড়লো মঞ্চ থেকে। তার ভরাট কণ্ঠের আবেশে তখনও পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে রয়েছে অপর্ণা। ওই রকম বজ্রসম-প্রতিবাদী কণ্ঠের ঘোর কাটানো, সত্যিই বড় কঠিন। সবশেষে তিনিও একটু হাততালি দিলেন। ছেলেটি যে অনেকটা আশা নিয়ে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে। ওর সারাটা মুখে ছড়িয়ে রয়েছে সারল্য মাখা হাসি! ছোট বাঁধানো মঞ্চের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা অপর্ণা দেবী। ওর পাশেই এসে দাঁড়ালো ছেলেটি।
অপর্ণা হাসিমুখে ওর মাথায় একটু হাত রাখলেন...
সুতীর্থ সাহা! অপর্ণার মনের ভীষণই কাছের একজন ছাত্র। পড়াশোনায় কোনোদিনই তুখোড় কিছু নয়, বরং একেবারে শেষ থেকে ধরলে, তবেই সে প্রথম স্থান অধিকার করবে। কিন্তু ছেলেটি যখন কথা বলে, মঞ্চে ওঠে, তখন ওর অগ্নিসম দীপ্ত কণ্ঠের কাছে, এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় অপর্ণাও। বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র সুতীর্থ।একেবারে প্রথম শ্রেণী থেকেই এই স্কুলে পড়ছে।সেই সূত্রে অপর্ণা দেবীর সঙ্গে বেশ বহুদিনেরই পরিচয়। অপর্ণার মতো প্রখর ব্যক্তিত্বের শিক্ষিকার কাছে ছাত্র-ছাত্রীরা খুব একটা মাথা তুলে কথা বলতে পারে না। কিন্তু একমাত্র সুতীর্থরই যেন কোনো হেলদোল নেই। পড়াশোনার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার তাগিদ নেই, নেই জীবনের ঘোড়দৌড়ে অংশগ্রহণ করার কোনো সদিচ্ছাও।স্কুলের বাইরেও অপর্ণার কাছে টিউশনে যখন আসে, পড়া না পারলে চুপটি করে মাথা নীচু করে থাকে। কিন্তু ভুলক্রমে একবার পড়া পারলে,সেদিন আর ওকে পায় কে! একেবারে মেরুদন্ড সোজা করে অপর্ণার চোখে-চোখ রেখে কথা বলে সেইদিন। ঢলঢল দু'খানি গভীর চোখ, ঘন অক্ষিপল্লব, একমাথা ঝাঁকড়া চুল আর টিকালো নাক। ঠোঁটের ওপরে আর গালে হালকা দাড়ির আভাস, গায়ের রং শ্যামলা! উচ্চতাও চোখে পড়ার মতো কিছু না। একেবারেই সাধারণত্বের চাদরে মোড়া একটি ছেলে। সব মিলিয়ে সাদামাটা চেহারার সুতীর্থর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। অবশ্য বিশেষত্ব কিছুটা রয়েছে বৈকি! তবে সেটা ওর ব্যক্তিত্বে, স্বভাবে এবং চরিত্রে। অপর্ণা লক্ষ্য করে দেখেছে, মাঝে-মাঝে পড়া বুঝতে-বুঝতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সুতীর্থ! জানলা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে।ওর বয়সী বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরাই যখন বয়ঃসন্ধিকালের স্বাভাবিক চাহিদায় একে-অপরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে, স্মার্টফোনের স্ক্রিনে বন্দী রঙিন জগতের হাতছানিকে আপন করে নিয়েছে, সেই বয়সে সুতীর্থর দু'চোখে যেন কত কল্পনার স্বপ্ন আঁকা! অপর্ণা দেবী বুঝতেন, এ ছেলের পড়াশোনা খুব বেশিদূর হবে না। এই রকম আপনভোলা ছেলের জন্য, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হয়তো অন্য কিছুই ভেবে রেখেছেন!
সুতীর্থকে নিজের সন্তানসম স্নেহ করে অপর্ণা।স্কুলের বাইরে টিউশন পড়ানোর দিনগুলো ছাড়াও, অপর্ণা দিদির বাড়িতে ছিল ওর অবাধ যাতায়াত।সেই যাতায়াত আরও বেড়ে যেতো, যখন পাপাই ছুটিতে বাড়ি আসতো। সেদিন প্রায় সবাই চলে গেছে পড়ার পর, বেরিয়ে গেছিলো সুতীর্থও, কিন্তু আবারও ঘুরে এলো ও। অপর্ণা তখন টিউশন শেষে মেঝেতে কুঁচকে থাকা শতরঞ্চিগুলো ভাঁজ করতে ব্যস্ত! ডাক পড়লো বাইরে থেকে,
-দিদি!!
বয়সে নিজের সন্তানের থেকে ছোট হলেও, স্কুলে সব ছাত্র-ছাত্রীরাই ওকে দিদিমণি বা দিদি ডেকেই অভ্যস্ত। তাই তীর্থ সর্বদাই এই সম্ভোধনেই ডাকে অপর্ণাকে। তীর্থর গলা পেয়ে হাতের কাজ ফেলে রেখে বেরোলো অপর্ণা, বেরিয়ে দেখলো, সাইকেলের ওপরেই তীর্থ বসে আছে!
-কিরে? তুই বাড়ি যাসনি এখনও?
-না, মানে... তুমি বলেছিলে, পাপাইদা এই মাসের শেষে বাড়ি আসবে! কই? এখনও তো এলো না!কবে আসবে গো?
-এটা জানতে আবার ঘুরে এলি তুই?!
মাথা নামিয়ে নিলো তীর্থ।
-আসলে তখন পড়া না পারায় তুমি এত বকলে দিদি, আমি আর ভয়ের চোটে পাপাইদাদার কথা জিজ্ঞেসই করতে পারিনি...
-তা পড়া না পারলে বকবো না! পড়াশোনার নাম নেই। পাপাইয়ের সঙ্গে কিসের এত গল্প রে তোর...
-দাদা বলেছিলো, এবার আমার জন্য বেশ কয়েকটা বাছাই করা গল্পের বই...
-তোর কিন্তু সামনেই পরীক্ষা তীর্থ!! এখন পড়ার বই ছাড়া, অন্য কোনো বই একদম না! আমি ফোন করে পাপাইকে বারণ করে দেবো!
-না প্লিজ দিদি!!
-কি প্লিজ দিদি! পড়াশোনার নাম নেই। রাজ্যের বই নিয়ে দিনরাত মুখ ডুবিয়ে বসে থাকা!!
-আমার পড়ার বই মুখস্ত করতে ভালো লাগে না দিদি! আমি পরীক্ষায় ফেল করবো, তুমি দেখে নিও... বই পড়তে বসলেই এতরকম কথা মনে পড়ে যায়...
-পরীক্ষায় পাশ না করলে, তুমি আর আমার সামনে এসে দাঁড়াবে না!
মাথা তুলে অপর্ণার দিকে একবার চেয়েই, আবার লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো তীর্থ।
-হ্যাঁ রে! তোর লজ্জা করে না? আমার সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে!! পাপাই দাদা দেখ তো কি সুন্দর পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে, তুইও একটু পড় বাবা! না পড়লে হয়!
-আচ্ছা দিদি! আসছি!!
সাইকেলের ওপরেই বসেছিলো সুতীর্থ। সাইকেল ঘুরিয়ে নিলো ও।
-শোন?
-বলো দিদি!
সাইকেলে বসেই মাথা ঘোরালো তীর্থ।
-পাপাই পরশুদিন আসবে!
অপর্ণা স্পষ্টই দেখলো, খুশিতে ঝলসে উঠলো ছেলেটার চোখমুখ। একমুখ হাসি নিয়ে একবার অপর্ণার দিকে চেয়েই সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেলো সুতীর্থ...
-পাগল একটা!!
একটু হেসে ঘরে ঢুকে আবার হাতের কাজ করতে শুরু করলো অপর্ণা। বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেছে। ওকে আবার রাতের রান্না চাপাতে হবে...
আয়নার দিকে আর তাকাতেই পারছে না প্রিয়ম।ট্রিমারটার ওপর একটু জোরেই চাপটা পড়ে গেছিলো। হাতটা ফস্কে গিয়ে বাঁ দিকের গালটা বেশ খানিকটা কেটে গেছে। এবার বিন্দু-বিন্দু রক্ত বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। তাড়াতাড়ি করে চোখ বন্ধ করে সিঙ্কের সামনে মুখ এনে জল দিয়ে মুখ ধুলো ও। সারাটা শরীর গুলিয়ে উঠলো। মাথাটা ধরে গেলো সঙ্গে-সঙ্গেই। গা গুলিয়ে ওঠায় হড়হড় করে খানিকটা বমি করে ফেললো সিঙ্কেই।বেরিয়ে এলো সকালের গিলে রাখা দুধ আর কর্নফ্লেক্স! ভালোভাবে চোখে-মুখে জল দিয়ে তোয়ালেটায় মুখ মুছে নিলো প্রিয়ম। আর আয়নার দিকে ফিরেও চাইলো না ও... এখন আয়না দেখলেই শরীর আরও খারাপ হয়ে যাবে। ফ্লাইটেরও আর খুব বেশি দেরি নেই। জামাকাপড় পড়তে শুরু করলো প্রিয়ম। গালের সূক্ষ ক্ষতস্থান থেকে তখনও বিন্দু-বিন্দু রক্ত চুঁইয়ে বেরোচ্ছে... কিছুক্ষণের মধ্যেই নীল জিন্স আর সবুজ জামা পরিহিত প্রিয়ম এয়ারপোর্টে ঢুকলো...
-মা! এবার রাখছি! টেক-অফের টাইম হয়ে গেছে!
-আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা রাখ!
মায়ের ফোনটা কেটে দিলো প্রিয়ম। ফোন ফ্লাইট-মোডে দিয়ে কানে গুঁজলো হেডফোন।চালিয়ে দিলো গত রাতের শেষ না হওয়া ইংরেজি ছায়াছবিটা... জানলার পাশে বসে মুখ ডোবালো ফোনের স্ক্রিনে...
-হ্যাঁ রে? এবারেই সব শিফটিং করবি?
প্রিয়ম মাথা রেখে শুয়েছিলো অপর্ণার কোলে।
-এবারেই করবো। কি দরকার তোমার এত দূর থেকে স্কুলে যাওয়ার? ফ্ল্যাটে থাকলে বরং স্কুলটা আরও কাছাকাছি হবে, ওয়াকিং ডিস্টেন্স। আর তাছাড়া সব যখন হয়েই গেছে, তখন আর দেরি করে লাভ কি? এবারেই একটু গুছিয়ে দিয়ে যাই তোমাকে!! তীর্থ জানে তো আমি আসছি?
-জানে না আবার!! পাপাই-দা কবে আসবে, পাপাই-দা এখনও এলো না কেন? উফফ! প্রশ্নের শেষ নেই।
হেসে ফেললো প্রিয়ম।
-মনটা বড্ড ভালো ছেলেটার। ওর কিন্তু খুব বেশি পড়াশোনা হবে না, জানো মা!! ওই আগেরবার কাকু বলছিলো, উচ্চ-মাধ্যমিকটা কোনোরকমে টেনেটুনে পাশ করলেই, যাহোক ওনার ওখানেই কোনো কাজে ঢুকিয়ে দেবে!
-ওটাই তো আমি চাই না রে! এটা কি কাজের বয়স?
-কি করবে বলো মা? ও নিজে থেকে না করলে, জোর করে কি আর পড়াশোনা হয়!! কেউ তো ওকে গুলিয়ে খাইয়ে দিতে পারবে না!! তাই না?
-হুম!!
-আমি একটু বেরোলাম মা! যাই, একটু ঘুরে আসি।কাল থেকে তো আর এ পাড়ায় থাকবো না। ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে একবার দেখা-সাক্ষাৎ....
উঠে পড়লো প্রিয়ম।জামাটা গায়ে গলাতে শুরু করলো।
-পাপাই?
-বলো!
-এডুকেশন লোন, পার্সোনাল লোন, সব একা টানতে পারবি তো বাবা? আমি অল্প কিছু দিই না!আমি একা মানুষ, কত আর খরচ লাগে আমার এখানে?
পাপাই এগিয়ে এলো মায়ের কাছে। দুটো হাত ধরে বললো,
-এতদিন তো করলে মা, বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তো করেই যাচ্ছ! আমি উপযুক্ত হয়েছি, এবার আমায় একটু বুঝে নিতে দাও! তাও তো তোমাকে একটা টাকাও পাঠাতে পারি না! ফ্ল্যাটের লোনটা তো লম্বা চলবে এখন, এডুকেশন লোনটা শোধ হয়ে গেলেই তোমায় টাকা পাঠাবো আমি।
-আমার কিচ্ছু লাগবে না। নিজে বাইরে পড়ে থাকিস, নিজের জন্য রাখ! নিজের ভবিষ্যতের জন্য....
-বেশ! আমি পাঠাবো! এবার আমার জন্যই তুমি এখানে জমিয়ে রেখো।
হেসে ফেললো অপর্ণা! সেই সাথে প্রিয়মও। ছেলে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাকে...
-ফ্ল্যাটের চাবিটা দাও। দেখি গিয়ে একবার।সেই গৃহপ্রবেশের পর তো আর বোধহয় পা রাখা হয়নি।তাই না!!
-না রে বাবা!কে যাবে!স্কুল সেরে-টিউশন সেরে...আর শরীর দেয় না আমার!
-হুম,দাও।চাবিটা দাও।একবার ঘুরে আসি!!আর শোনো, তীর্থ এলে বসতে বলবে।এবার অনেক কিছু এনেছি ওর জন্য!
-আমি তাড়িয়ে দিতে চাইলেও,তোর সঙ্গে দেখা না করে,ও যাবেই না!
একগাল হেসে বেরিয়ে বাইকে উঠলো প্রিয়ম...
প্রিয়মের বাবা মারা গেছেন বছর বারো হয়ে গেছে।অপর্ণা বরাবরই একটা ছোট স্কুলের শিক্ষিকার পদে কর্মরতা।তাই বাবার অবর্তমানে খুব একটা সচ্ছলতা না থাকলেও,একেবারে অথৈ জলে পড়তে হয়নি ওদের।মা-ছেলের সংসার মোটামুটি চলে গেছে।এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে,পড়াশোনা শেষ করে,কর্মসূত্রে রাজ্যের বাইরে থাকে প্রিয়ম।ছেলের পড়াশোনার দিকে দু-হাতে খরচ করতে গিয়ে,বসতবাড়ির দিকে আর পয়সা ঢালতে পারেনি অপর্ণা।আজীবন হাতে গোনা কয়েকটা আসবাব নিয়ে ভাড়া বাড়িতেই সংসার করে গেছে।এখন ছেলে উপযুক্ত হওয়ার পর মায়ের অসম্পূর্ণ কাজটা,নিজেই সম্পূর্ণ করছে।গতবারে যখন এসেছিলো,তখনই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ করে রেখে গিয়েছিলো প্রিয়ম।সে সময় হাতে বেশি সময় ছিলো না।কিন্তু এবার ও আর একদম দেরি করতে চায় না।মাকে নতুন ফ্ল্যাটে একেবারে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে তবেই যাবে ও।তাই বেশ কয়েকদিন ছুটি হাতে নিয়েই এসেছে।পুরোনো পাড়ায় বহুপরিচিত মুখগুলোর সঙ্গে একটু আড্ডা মেরে,চা খেয়ে,সিগারেটে একটু সুখটান দিয়ে,বাইক নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটের পথে বেরিয়ে গেলো প্রিয়ম...
আগেরবার কয়েক মাস আগে যখন গৃহপ্রবেশের সময় এসেছিলো,তখন প্রায় বেশিরভাগ ফ্ল্যাটই ফাঁকা পড়েছিলো।এবার একবার মাথা তুলে গগনচুম্বী টাওয়ারের দিকে চেয়ে প্রিয়ম দেখলো,বেশ অনেকগুলো ফ্লোর থেকেই ব্যবহৃত জামাকাপড় ঝুলছে,মৃদুমন্দ হাওয়ায় উড়ছে।বেরিয়ে রয়েছে ব্যালকনিতে সযত্নে রক্ষিত কিছু সবুজ গাছপালার শাখা-প্রশাখাও।মনুষ্য-বসতির চিহ্ন সারাটা বহুতলে বেশ স্পষ্টই।বেশ একটু নিশ্চিন্তই হলো প্রিয়ম।এমনিতেই মা একা থাকে,আশেপাশের লোকের সঙ্গে অপ্রয়োজনে কথাবার্তাও বলে খুবই কম,বরাবরই স্বল্পভাষী অপর্ণা।গতবারেই দেখেছিলো প্রিয়ম,বেশিরভাগ ফ্ল্যাটই ফাঁকা।ওখানে তাও ওপরে বাড়িওয়ালা মাসিমা-মেসোমশাই থাকতেন।মায়েরও বয়স হচ্ছে,রাতবিরেতে সুবিধা-অসুবিধায় ওনাদের ডাকলে তবু পাশে পাওয়া যাবে।এখানে নতুন জায়গায় একেবারে একা এভাবে প্রিয়ম মাকে ফেলে রেখে যেতে,ঠিক ভরসা পাচ্ছিলো না।কিন্তু এবার মনুষ্যবসতির চিহ্ন দেখে,কিছুটা দুশ্চিন্তা দূর হলো।ওয়াচম্যানের দিকে চেয়ে একটু হেসে পার্কিংয়ে বাইকটা ঢুকিয়ে লিফটের দিকে এগোলো প্রিয়ম।যেতে হবে আট-তলায়...
নগ্ন-উলঙ্গ তিন-কামরার ফ্ল্যাট।সব আলোগুলো জ্বালিয়ে,সবকটা কল খুলে দেখলো প্রিয়ম।একবার বাথরুমেও উঁকি মারলো।সবই ঠিক আছে,দীর্ঘদিন দরজা-জানালা সব বন্ধ থাকায় ঘরের ভিতর একটা ভ্যাপসা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে।সারাটা ফ্ল্যাট একবার ঘুরে দেখলো ও।একটু গিয়ে দাঁড়ালো ব্যালকনিতে।দূরে সবুজ গাছগাছালির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য বহুতল।সরু ফিতের মতো রাস্তাটাও চোখে পড়ছে।ওদের কমপ্লেক্সের ভিতরেই একটা ছোট পার্ক আছে,সেখানে খেলা করছে কয়েকটা ছোট-ছোট বাচ্চা।ব্যালকনি থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার ঘরের ভিতরে ঢুকলো প্রিয়ম।মা একদম ঠান্ডা জলে স্নান করতে পারে না,ভীষণ গায়ে ব্যাথা হয়।এমনিতেই হাঁটু-কোমর নিয়ে নড়তে পারে না।আপাতত একটা গিজার নিলেই চলবে,বাকিগুলো এডুকেশন লোনটা শেষ হলেই এক-এক করে কিনে ধীরে-ধীরে ফ্ল্যাট সাজিয়ে ফেলবে প্রিয়ম।আর মাত্র কয়েকটা মাসের অপেক্ষা....তালাবন্ধ করে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে আবার লিফটে গিয়ে উঠলো ও...একেবারে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামবে।বোতাম টেপার সঙ্গে-সঙ্গেই বন্ধ হতে শুরু করেছে ফ্ল্যাটের দরজা।প্রিয়ম ফ্ল্যাট নিয়ে,পরবর্তী খরচ নিয়ে,কিছু হিসেবপত্র নিয়ে অন্যমনস্কভাবে নিজের চিন্তায় মগ্ন।একটা অস্পষ্ট চিৎকার ভেসে এলো প্রিয়মের কানে।নিজের চিন্তা-ভাবনার জাল থেকে বেরিয়ে কোথা থেকে কিসের শব্দ এলো,সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলো ওর।লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার একেবারে শেষ মুহূর্তে ঝড়ের মতো ভিতরে প্রবেশ করলো সেই নারী...
-আচ্ছা উদগান্ডু ছেলে তো!তখন থেকে ডাকছি,শুনতে পাচ্ছেন না নাকি?একটু অপেক্ষা করতে কি হয়!!উফফ!সারাদিন সিঁড়ি ভেঙে-ভেঙে আমার ঠ্যাং দুটো খুলে গেলো একেবারে...সালা বালের সার্ভিস,বালের লিফট!এত্ত মিসম্যানেজমেন্ট!যখন প্রয়োজন,তখনই দাঁড়িয়ে থাকো!লিফট হয় মাথার ওপরে হাওয়া খেতে গেছে,নয় একেবারে গ্রাউন্ড ফ্লোরে মাড়াচ্ছে,নয়তো খারাপ হয়ে কেতরে পড়ে আছে...উফফ!!ডিসগাস্টিং!!
হাঁফাতে-হাঁফাতে কলকল করে ঝর্ণার মতো বলে গেলো মেয়েটি...
অতর্কিতে অচেনা একটি মেয়ের মুখের এইরকম ভাষা শুনে যারপরনাই চমৎকৃত হলো প্রিয়ম।এমনটা না,এসব শুনতে ও অভ্যস্ত নয়।হোস্টেলে থাকাকালীন খিস্তিপিডিয়াতে পি.এইচ.ডি করেছে ও নিজেও।কিন্তু তা বলে অচেনা কারোর সামনে এভাবে খাপ খোলে না ও।নেহাতই চেনাশোনা বন্ধুমহলেই মুখ খোলে।কিন্তু অচেনা একজনের নারীর কাছ থেকে প্রথম দর্শনেই এভাবে গালাগালি খেয়ে ওর যত না রাগ হলো,তার চেয়ে হাসি পেয়ে গেলো সহস্রগুণ বেশি।প্রাণপণে হাসিটা চেপে ও বললো,
-সরি!একচুয়েলি আমি একটু এবসেন্ট-মাইন্ডে...
-আরে বালের কথা বলিস না তো!
চমকে উঠলো প্রিয়ম।অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে...কিন্তু তার কোনো হেলদোল নেই...
-সোহিনী তোকে কতবার বলেছি তুই চার মাথার মোড় থেকে অটো নে,একেবারে আমাদের কমপ্লেক্সের সামনেই নামিয়ে দেবে।কিন্তু তোর তো সালা হেভি পয়সার গরম!ট্যাক্সি নিলি,মর এবার ট্র্যাফিকে আটকে।খসা গুচ্ছের টাকা...এই বাল তোর যদি এতই টাকা বেশি হয় তো...
থেমে গেলো প্রিয়ম।বুঝলো,ওর কথা মেয়েটির কানে আর কিছুই ঢুকবে না...ও হেডফোনে কথা বলছে...
একমাথা চুল একেবারে মাথার ওপরে তুলে একটা বড়সড় খোঁপা করা।কালো চুলের মাঝে-মাঝে কিছুটা গাঢ় বাদামী রঙের ছোঁয়া।বোঝাই যাচ্ছে ওই চুলগুলো আলাদা করে হাইলাইট করা।ছোট একটা ক্লিপ অতগুলো চুলকে একসঙ্গে বেঁধে রাখতে অসমর্থ,খোঁপা প্রায় ভেঙে পড়ে কয়েকটা চুল এদিক-ওদিক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।একটা হাতকাটা গোলাপি রংয়ের জামা পরেছে মেয়েটা,জামার হাতাটা ভীষণ সরু হওয়ায় কাঁধের পাশ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে স্বচ্ছ অন্তর্বাস।নিম্নাঙ্গে জিন্সের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরেছে মেয়েটা।যখন লিফটে উঠেছিলো,তখন একবার মাত্র এক নজরে মেয়েটার মুখ দেখেছিলো প্রিয়ম।তারপর থেকে মেয়েটা পিছন ফিরেই দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়ম একেবারে লিফটের ভিতর দিকে ঢুকে দাঁড়িয়েছে।মেয়েটার গলায়-কানে ব্লুটুথ হেডসেট,সমানে বকেই যাচ্ছে।কারোর সঙ্গে কথা বলছে মনে হয়,না ঠিক কথা বলছে না।কাউকে আপাদমস্তক গালাগালি দিয়ে গুষ্টি উদ্ধার করে দিচ্ছে।কানে একাধিক দুল জ্বলজ্বল করছে।কিছু অগোছালো চুল কানটা অর্ধেকটা আবৃত করে রেখেছে।মেয়েটার গালের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছে প্রিয়ম।অসংখ্য ব্রণ-র দাগ ভর্তি মুখে।অনাবৃত ঘাড়ের কাছে জামার ফাঁক দিয়ে একটুখানি উঁকি মারছে একটা ট্যাটু,কিসের ট্যাটু বোঝা যাচ্ছে না।কারণ অর্ধেকটাই জামার ভিতরে ঢাকা পড়েছে।যখন থেকে মেয়েটা লিফটের ভিতরে ঢুকেছে,তখন থেকেই একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে স্বল্প-পরিসরের বদ্ধ জায়গাটায়...চোখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে লিফটে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়ম...
মেয়েটা অনর্গল বকেই যাচ্ছে!লিফটের দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গেই বকতে-বকতেই মেয়েটা বেরিয়ে গেলো।প্রিয়ম অনুভব করলো,গত কয়েক মুহূর্তে ওর নিজের গালাগালির ভান্ডার আরও একটু উন্নত হয়েছে!এমন কিছু শব্দ ও আজ জানলো,যেগুলো আগে জানতো না।মাথা নীচু করে হেসে ফেললো প্রিয়ম...
বাইকের কাছে যাবে বলে সবে পার্কিংয়ের দিকে এগিয়েছে ও,দেখলো ওই মেয়েটাই একটা স্কুটি নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলো ওর সামনে দিয়েই।এক মুহূর্তের জন্য মেয়েটার মুখটা ও দেখতে পেলো,মুখের আগেও প্রিয়মের চোখ পড়লো মেয়েটার ঠোঁটের দিকে।কারণ,ঠোঁটের ঠিক নীচেই ঝলসে উঠলো একটা পাথরের মত কিছু...ফুটো করা হয়তো ঠোঁটের নীচেও...পকেট থেকে চাবি বের করে বাইকের দিকে এগিয়ে গেলো প্রিয়ম...
-আমরা কাল নাগাদ সমস্ত ফার্নিচার ঢুকিয়ে দেবো বুঝলেন!আর কাল যদি সব গুছিয়ে আসতে না পারি তো,পরশু একেবারে কনফার্ম!
বাইকের ওপরে বসেই গেটের ওয়াচম্যানের সঙ্গে দরকারি কিছু কথা বলছিলো প্রিয়ম।কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হুশ করে সেই স্কুটিটা গেটের ভিতরে ঢুকে গেলো ঠিক ওর পাশ দিয়েই।
-কাকা!!সব ঠিকঠাক তো?
-একদম দিদিমণি!!
হাত তুলে মেয়েটিকে বৃদ্ধ ওয়াচম্যান বললো...
প্রিয়ম চোখ মেলে দেখলো,এবার সেই লিফটের পূর্বপরিচিত মেয়েটির পিছনে,আরও একটি মেয়ে বসে আছে।তাকেই বোধহয় আনতে গিয়েছিলো,ফোনে হয়তো একেই গালাগালি দিচ্ছিলো।স্কুটিটা পার্কিংয়ে রেখে মেয়েদুটো একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে হাসতে-হাসতে দৌড়োলো লিফটের দিকে...
ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়ম একভাবে চেয়েছিলো ওই দিকেই।ওয়াচম্যান একনাগাড়ে কিছু একটা বলছিলো মনে হয়।কিন্তু কি যে বলছিলো,এক মুহূর্তের জন্য খেই হারিয়ে ফেললো প্রিয়ম।যখন আবার ওইদিকে মন দিলো,তখন শুধু এটুকুই শুনতে পেলো,
-আপনার মায়ের এখানে কোনো অসুবিধাই হবে না,আমি আছি তো যেকোনো সুবিধা-অসুবিধায়।যেকোনো প্রয়োজনে একটা ফোন করে দিলেই হবে...শুধু,ওই মানে মাঝে-মাঝে একটু আমাকে দেখলেই হবে।আসলে বউ-ছেলে-নাতি-নাতনি নিয়ে ঘর তো!ছেলে ছোট একটা কারখানায় কাজ করে।অনেক বড় আমার সংসার।সংসারের এত খরচ,যা মাইনে পাই,তাতে আসলে...কমপ্লেক্সের সবাই তাই আমায় মাঝে-মাঝে খুশি হয়ে...
-আপনার কোনো চিন্তা নেই কাকা,আমি আছি তো!শুধু দেখবেন আমার মায়ের যেন কোনো অসুবিধে না হয়।আসলে আমি তো বাইরে থাকি,তাই একটা দুশ্চিন্তা সবসময়...
-আরে না ইয়ে মানে তোমার নামটা,মানে আপনার...
-তুমিটাই থাকুক না কাকা,আমি হয়তো আপনার ছেলের মতোই হবো!
মাথা নামিয়ে বললো প্রিয়ম।
-হে-হে তা বটে!তোমার নামটা...
-প্রিয়ম সমাদ্দার!
-আচ্ছা!তোমার কোনো চিন্তা নেই।ম্যাডাম এখানে নিশ্চিন্তেই থাকবেন।আমি তো আছিই সারাটা সকাল,বাজার-হাটের দরকার হলেও আমাকে একটা ফোন করলেই হবে।আবার সন্ধ্যেবেলা থেকে রাজেশ আসবে,সবসময় কেউ না কেউ থাকবেই।
-ঠিক আছে কাকা,আমি তাহলে কাল আসছি!
-আচ্ছা-আচ্ছা!!
বাইকটা একটু এগিয়েও আবার ধীরে-ধীরে পিছিয়ে এলো প্রিয়ম।
-কাকা?
-হ্যাঁ বলো...
পকেট থেকে একটা বিড়ির প্যাকেট বের করেও আবার ঢুকিয়ে রাখলেন উনি।
-না মানে,আমরা যখন কথা বলছিলাম একটু আগে,আমার পাশ দিয়ে একটা স্কুটি ঢুকলো,একজন আপনাকে ডাকলো।বলছিলাম,ওই মেয়েটি কি এখানেই থাকে?
-কে?ও...ও তো ঝোরা দিদিমণি!হ্যাঁ!এই কমপ্লেক্সেই তো থাকে।বারো তলায়।ভালো নামটা ঠিক জানি না,তবে ওর দাদা-বৌদি ঝোরা বলেই ডাকে,তাই আমিও ঝোরা দিদিমণিই বলি!!
-ওহ!ওকে!!
-কেন?কিছু বলতে হবে?
-হুম?নানা!!এমনিই!আমার জাস্ট মনে হলো,আমি ওনাকে আগে কোথায় দেখেছি,মানে অন্য একজনের মতো দেখতে আর কি...হয় না অনেক সময়...কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করা যায় না,সেইরকমই আর কি...বিশেষ কিছু না...
তাড়াতাড়ি করে কথাটা চাপা দিতে যায় প্রিয়ম।
-ওহ আচ্ছা-আচ্ছা!
-আসছি কাকা!
-একদম!কাল সকালে আমি থাকতে-থাকতে চলে এসো।আমি হাতে-হাতে সব ওপরে তুলে দেবোখন।কত তলা?
-আট!
-আচ্ছা!
আস্তে-আস্তে করে বেরিয়ে এলো প্রিয়ম।মাথায় তখন একটাই নাম ঘুরছে,
"ঝোরা!!ইন্টারেস্টিং!হুম,সার্থক নামকরণ!ঝোরাই বটে!ঝরঝর করে যা কথা বলে!অবশ্য,কথা আর বলে কই!!কথার আগে খিস্তি,পিছনে খিস্তি,আবার মাঝেও খিস্তি!!একটা বাক্যের মধ্যে এতবার এতরকমভাবে অলঙ্কারের এত নিপুণ প্রয়োগ,এর আগে প্রিয়ম আর শুনেছে বলে ওর মনে পড়ে না!!"
হেসেই ফেললো ও।শেষ একবার পিছন ঘুরে কমপ্লেক্সের দিকে চেয়ে বাইকটা চালিয়ে দিলো প্রিয়ম...
ওয়াচম্যান কাকা তখন গুনগুনিয়ে গান করতে-করতে একটা বিড়ি ধরিয়ে,তাতে চোখ বন্ধ করে সুখটান দিচ্ছে...
বারবার ওপর-নীচ করতে-করতে গলদঘর্ম অবস্থা প্রিয়মের।নেহাত তীর্থ সকাল থেকেই জুড়ে রয়েছে ওর সঙ্গে।নইলে একদিনে ওর একার পক্ষে সম্ভবই হতো না সবটা সামলানো।সবশেষে বক্স-খাটটা খোলা হবে।ওটাকে এনে গুছিয়ে পেতে ফেললেই একরকম সব কাজ শেষ হবে।মায়ের নির্দেশের সঙ্গে-সঙ্গে ঘর্মাক্ত কলেবরে ছেলেগুলোর সঙ্গে সোফাটা ধরে জায়গা মতো বসালো প্রিয়ম।ওর ফোনটা বেজে উঠলো সঙ্গে-সঙ্গে।নীচ থেকে তীর্থ ফোন করছে।ওর নিজের ফোন নেই।মায়ের ফোনটা আজকের জন্য ওকে দিয়েছিলো প্রিয়ম।সেটা থেকেই ও ফোন করছে।
-বল!
-দাদা,নীচে আসতে হবে একবার।সব মাল আনা হয়ে গেছে।এদের ভাড়া আর বকশিশ...
-আসছি দাঁড়া!!
-পাপাই,জামাটা বদলে নে।ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে গেছিস একদম!জামাটা গায়ের সঙ্গে একেবারে লেগে রয়েছে!ভেজা জামা পরে থাকিস না!
ভিতরের ঘর থেকে অপর্ণা চেঁচালো।
-না দাঁড়াও,আগে নীচ থেকে ঘুরে আসি।ওরা দাঁড়িয়ে আছে।আর শুধু জামা ছাড়লে হবে না।রাজ্যের ধুলো-ঝুল জামায় লেগে রয়েছে।গা ধুতে হবে।আসছি আমি...
একদৌড়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লিফটের সামনে গিয়ে বোতামটা টিপে দাঁড়ালো প্রিয়ম।ওপর থেকে নামছে লিফটটা...
দরজাটা খোলা মাত্রই পকেটে ফোনটা ঢোকাতে-ঢোকাতেই চমকে উঠলো ও।সেই মুহূর্তেই মেয়েটার মুখের সামনে একটা বড় বেলুন ফুলে উঠেই আবার চুপসে লেগে গেলো ওর দুটো ঠোঁটে...প্রিয়ম অবাক হয়ে চেয়ে রইলো ওর দিকে।
"ঝোরা!!"
মুখটা সমানে নেড়েই যাচ্ছে ও,জাবর কেটেই যাচ্ছে।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকে গেলো মেয়েটার।শিস দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে উঠলো ঝোরা।
-এই যে মিস্টার!যাবেন?নাকি নেমে যাবো?
-না-না!যাবো তো!
একলাফে ভিতরে গিয়ে ঢুকলো প্রিয়ম।
আজ প্রিয়ম নিজেই সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।ঝোরাকে দেখার আজ আর কোনো উপায় নেই।ও পিছনে দাঁড়িয়ে।একবার নিজের হাত দুটোর দিকে দেখলো ও।কালো হয়ে রয়েছে দুটো হাতই।সকাল থেকে ধুলো-বালি-ঝুলপড়া পুরোনো আসবাবপত্র মোছামুছি, তাদের খোলা,আবার লাগানো,সব কাজেই হাত লাগিয়েছে ও।তার চিহ্নই ওর দুহাতে রয়েছে।একবার নিজের জামাটার দিকে দেখলো প্রিয়ম।নিজেকেই এবার খিস্তি মারতে ইচ্ছে করছে।কেন যে মায়ের কথাটা শুনলো না তখন!!জামাটা বদলে নিলেই হতো।সারা গা-মাথা চুলকাচ্ছে....কিচকিচ করছে ধুলোতে...
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ও।ঝোরাকে দেখতে পাচ্ছে না ঠিকই।কিন্তু নাকে ভেসে আসছে,গতকালের সেই পরিচিত সুগন্ধটা!কালকের সেই ছেলেটাই না!!কাল একবার মাত্র দেখেছিলো ঝোরা।কাল তো বেশ নধরকান্তি কার্তিক-কার্তিক লাগছিলো দেখতে!!আজ এমন উদভ্রান্তের মতো অবস্থা কেন!!ছেলেটার জামার দিকে চেয়ে হাসি পেয়ে গেলো ঝোরার।একটা লম্বা ঝুল সেঁটে রয়েছে ওর জামায়।চুলও প্রায় ধুলোতে সাদা হয়ে রয়েছে।কিন্তু ছেলেটা কালও ওকে দেখলো,কথা বললো না।অবশ্য কাল ও নিজেই সোহিনীর ওপর হেব্বি রেগে গিয়েছিলো।ওকে ঝাড়তেই ব্যস্ত ছিলো।সেরকমভাবে খেয়ালও করা হয়নি।কিন্তু আজও ছেলেটা পিছন ফিরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।কি দেমাক রে বাবা!কমপ্লেক্সে নতুন মনে হয়।ওপরে নিজের ঘরের ব্যালকনি থেকে আজ দেখছিলো ঝোরা,জিনিসপত্র সব ঢুকছে গাড়ি করে।আজই এলো হয়তো।কিন্তু একই কমপ্লেক্সের বসবাসকারী হয়ে,একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর পিছনে চুপ করে,আর ছেলেটা কথা বলবে না!!এইরকম ছেলেও হয়!!বরাবরই পুরুষের কাছে গুরুত্ব পেতেই অভ্যস্ত ও।মাথা গরম হয়ে গেলো ঝোরার।ও একটু মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠলো,
-এক্সকিউজ মি!!
-ইয়েস?
চমকে ঘুরে দাঁড়ালো প্রিয়ম।
-হাই!আই এম শ্রীময়ী,ইউ ক্যান কল মি ঝোরা অলসো!দ্যাটস মাই নিকনেম!নিউ ইন দিস বিল্ডিং?
-ইয়েস!এন্ড আই এম প্রিয়ম।নিকনেম পাপাই!!
-ওকে!!আজই এখানে শিফট করছো?সরি,আমি বেশিক্ষণ আপনি-আজ্ঞে চালাতে পারি না,সো প্রথম থেকেই তুমি বলছি!ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম?
-নো-নো!নো প্রবলেম!
-ওকে!এইথ ফ্লোর,রাইট?মানে ওখান থেকেই যেহেতু উঠলে,তাই গেস করলাম।
-হুম!তোমার?
-টুয়েলভ!
-ওকে!!
-ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,আমি...
বলেই প্রিয়মের জামার দিকে ইশারা করলো ঝোরা।
-হোয়াট??
প্রিয়মের জামায় হাত রেখে একটা লম্বা ঝুল টেনে তুললো ঝোরা।দুটো আঙুলে ধরে ওটাকে নাচাতে-নাচাতে নিয়ে এলো সামনে।
কয়েক মুহূর্ত সেদিকে চেয়ে থেকে হেসে উঠলো দুজনেই।
-তোমার মাথায়ও ভর্তি হয়ে আছে!!
মাথাটা একহাত দিয়ে একটু ঝেড়ে নিলো প্রিয়ম।
-হ্যাঁ,আসলে আজ সকাল থেকেই এত...
-হুম,আমি জানি!মাস তিনেক আগে আমাদেরও এই একই অবস্থা গেছে।একটা জায়গায় শিফট করা মানে, সেখানে ঠিকমতো সেটেল করতে,আরও এক সপ্তাহেরও বেশি সময় লেগে যায়।আর তার মধ্যে এদের এই বালের...
একবার মাত্র চোখ তুলেই মাথাটা নামিয়ে নিলো প্রিয়ম।
-সরি!!
ঝোরা বললো।
-নো,ইটস ওকে!
-আসলে এদের ম্যানেজমেন্ট এত খারাপ,না চাইলেও মুখ থেকে খিস্তি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসে।পাকাপাকিভাবে এসেছো তো,এবার বুঝবে!পাওয়ার কাট হলেও ইনভার্টার সার্ভিস বলতে-বলতে...
-কি বলছো গো?
-হুম!আমরা যখন প্রথম এসেছিলাম,দু-ঘন্টা জল ছিলো না,জানো!সে যে কি অবস্থা গেছে ওই দু-ঘন্টা!সবে নতুন এসেছি,ঘরে পা রেখেছি।আর জল ছাড়া একটা মুহূর্তও চলে বলো তো?!গালাগালি করতে তারপর ওরা হুড়োহুড়ি করে ঠিক করে।সেবার বোধহয় পাম্প খারাপ ছিলো আমাদের লাইনটায়।এবার ওই লাইনটায় আমরা একা পড়ছি,আর কোনো ফ্যামিলি তখনও আসেনি।তাই আর ওদের কোনো মাথা ব্যাথাও নেই।বলতে-বলতে তারপর....এই প্রিয়ম,আমি এখন আসি!!
কথা বলতে-বলতে কখন যে ওরা লিফট থেকে বেরিয়ে পার্কিংয়ের কাছে চলে এসেছে,খেয়ালও করেনি প্রিয়ম।
-ওহ,ওকে!!
-পাপাই দা?
-আসছি রে!আমিও যাই ঝোরা!
-ওকে বাই!!
বলেই পকেট থেকে ফোনটা বের করলো ঝোরা।প্রিয়ম এগিয়ে গেলো সুতীর্থর দিকে...
-বেরিয়েছিস অরি?
-হুম!অনেকক্ষণ!বাইকেই তো ছিলাম।তোর ফোন পেয়ে সাইড করলাম।তুই কোথায়?
-এই বেরোচ্ছি!স্কুটি নিয়ে আসছি!বেশিক্ষণ লাগবে না!
-কি দরকার স্কুটি আনার?আমি ড্রপ করে দেবো!
-ও হ্যালো!আমাকে ড্রপ করার কোনো দরকার নেই।তোকে চিনি না আমি?বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নামে,শুধু বাড়িতে আসার ধান্দা,তাই না?সে গুড়ে অন্তত এক কেজি বালি!
ফোনের ওপার থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো।হাসি থামিয়ে ফোনের ওপারের পুরুষ বললো,
-আচ্ছা!তাড়াতাড়ি আয় ঝোরা।সিনেমা শুরু হয়ে যাবে তো!
-ওরে গান্ডু,তুই ফোনটা রাখবি,তবে তো আসবো!
-আচ্ছা-আচ্ছা!রাখছি!ওই শোন?
-কি?
-সিনেমার পর সম্রাটের ফ্ল্যাটে যাবো!চাবি নিয়ে রেখেছি!ওখানেই খাবার অর্ডার করে নেবো।বাইরে খেয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না।
-সালা,তোর মেশিন সবসময় একদম রেডি বল?!
-তাড়াতাড়ি আয়!!লাভ ইউ!!
-উফফ!আবার?আবার সেই এক বস্তাপচা ডায়লগ!!কি দিনরাত লাভিউ-লাভিউ রে?আর একবার এসব বালের কথা শুনলে,টেনে তোর মুখে একটা লাথি মারবো হারামি!!
-আচ্ছা-আচ্ছা,মাথা গরম করিস না।আর বলবো না,আয়!
-চল রাখ!আসছি!!
ফোন রেখে দেয় অরিত্র।একবার ফোনে চুমু খেয়ে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে স্টার্ট দেয় বাইক...
জাবর কাটতে থাকা বিস্বাদ চুইংগামটা মুখ থেকে বের করে ফেলে স্কুটিতে ওঠে ঝোরাও।স্টার্ট দিয়েই এগিয়ে যায় সামনের দিকে।আজ ওর পরনে জিন্সের একটা হটপ্যান্ট আর সাদা কুর্তি।চুলটা পুরো খোলা,ডানহাতে একটা ঘড়ি।পিঠে একটা ছোট ব্যাগ!একটু দূরেই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে প্রিয়ম।স্কুটির শব্দে মাথা তুলে ফিরে তাকায় ও।
-বাই প্রিয়ম!
-বাই ঝোরা!!
-কাকা টাটা!
-টাটা দিদিমণি!
প্রিয়ম কয়েক মুহূর্ত একভাবে ওইদিকে চেয়ে থেকে আবার ওয়ালেটের দিকে মনোযোগ দিলো।টাকা বের করে তুলে দিলো ড্রাইভারের হাতে...
সারাদিনের সমস্ত কাজের শেষে বাথরুমে ঢোকে প্রিয়ম।শাওয়ারটা খুলে দেয়,মনে-মনে ভাবছিলো ঝোরার কথা অনুযায়ী হয়তো জল আসবে না।কিন্তু কলকল করে জল পড়ে ভিজিয়ে দিলো ওর সর্বাঙ্গ!একটু হেসে উঠলো ও।ভেবেছিলো জল না এলে,ঝোরাকেই গিয়ে বলবে...দাও দেখি আবার একটু গালাগালি।নইলে ওরা ঠিক করবে না।কিন্তু সে সুযোগ প্রিয়ম আর পেলো না।ঝোরার অনর্গল কথার মতোই ঝরঝর করে জল পড়তে শুরু করেছে শাওয়ার থেকে।ডান হাতটা বাথরুমের দেওয়ালের টাইলসের ওপরে রেখে,বাঁ-হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো ভালো করে ধুতে থাকে প্রিয়ম...ধুলো-বালিতে সারা শরীর বীভৎস চুলকাচ্ছে...নগ্ন শরীরের আলগা ধুলো ধুয়ে নিয়ে বডি-ওয়াশের দিকে হাত বাড়ালো ও।সেই সময়েই একটা ছোট্ট কালো রংয়ের ঝুল মাথা থেকে নেমে,জলের সঙ্গে নেচে-নেচে নর্দমার দিকে এগিয়ে চললো।এইরকমই একটা ঝুল,আজ লিফটে ওর জামা থেকে টেনে তুলেছিলো ঝোরা।প্রিয়মের মনে পড়ে গেলো,ওর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া ঝোরার প্রথম বাক্যবাণ,
"কি উদগান্ডু ছেলে রে বাবা!!"
জলের তলায় দাঁড়িয়েও নিঃশব্দে মন খুলে হেসে উঠলো প্রিয়ম।
(চলবে....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন