Buy Sathi a coffee
Golper Sathi / গল্পের সাথী / Bengali Story Blog / Bangla Golpo: ত্রিভুজ (দশম পর্ব)

অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২২

ত্রিভুজ (দশম পর্ব)


 


ত্রিভুজ

সাথী দাস

দশম পর্ব




সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে একটু-একটু করে বাহ্যিক দূরত্ব বাড়তে থাকে ঋক আর দিয়ার।বাইরের দূরত্ব যতটা বাড়তে থাকে,অন্তরে ততটাই জ্বলে শেষ হতে থাকে ঋক।পরীক্ষার প্রস্তুতির কারণে ঋক আজকাল আর প্রায়ই স্কুলে যায় না।সকালবেলায় দিয়া আসে রোজই,ঋদ্ধির সঙ্গে গাড়ি করে স্কুলে বেরিয়ে যায়,ওপরে আর ওঠে না।যতক্ষণ পর্যন্ত ওদের গাড়িটা সামনের বড় গেট না পেরোয়,ততক্ষণ পর্যন্ত একভাবে জানলা দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখে ঋক।সারাদিনে এটুকুই তো পাওনা।বাকি সময়টা হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে বই নিয়ে,আর পড়তে-পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে মুখ গুঁজে রাখে কম্পিউটারের সেই বিশেষ ফোল্ডারে,যেখানে ঋক ওর দিয়াকে বন্দী করে রেখেছে বিভিন্ন রঙে-বিভিন্ন রূপে!জলের মতো সময় বয়ে যায় ওই ফোল্ডার খুলে বসলে।আবার শুরু হয় রাত জাগা,আবার চোখ জ্বালা!আবারও চোখের তলায় গভীর কালি!মা-বাবা ভীষণ আশা করে ঋকের ওপর,ঋক জানে মা চায় ও ভবিষ্যতে যা পড়তে চায়,তাই নিয়েই জীবনে এগোক।কিন্তু দাদু আর বাবার মধ্যে পারিবারিক ব্যবসার যে গতানুগতিকতা রয়েছে,বাবা চায় সেই বীজ ঋকের মধ্যেও বপন করতে।অন্যায় আবদার কিছু নয়,ছেলেদের কাছে বাবার আশা করাটাই স্বাভাবিক!কিন্তু বাবা নিজের মুখে কোনোদিনও সেসব কথা ঋককে বলেনি।আসলে ঋদ্ধি ছোট থেকেই বড় বেশি খামখেয়ালি,বড্ড জেদী-রগচটা!ব্যবসার ক্ষেত্রে তাই ঋকের ওপরেই ভরসা করতে চায় বাবা।আপাতত ঋক ওসব নিয়ে কিছু ভাবে না,কিন্তু বাবাকে নিরাশ করার কোনো ইচ্ছেও ওর নেই।ভবিষ্যতে তো ঋক বা ঋদ্ধিকেই ব্যবসার সমস্ত হাল ধরতেই হবে।তবু বরাবরই পড়াশোনা,নতুন বইয়ের গন্ধ যেন বড্ড বেশি টানে ঋককে।সোনার দোকানের টুং-টাং-ঠুক-ঠাক শব্দ আর আগুনের তাপের চেয়ে বইগুলোকে যেন বেশি আপন মনে হয় ওর।সামনেই পরীক্ষা,চোখ-কান বন্ধ করে জীবন দিয়ে ও শুধু পড়ে যাচ্ছে।আর নিজেকে শেষ করে ভালোবেসে যাচ্ছে ওর দিয়াকে...
কয়েক মাস অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যখন বহুকাঙ্খিত ফলাফল হাতে এলো,তখন একটুও নিরাশ হলো না ঋক।স্কুলে প্রথম স্থানাধিকারী প্রান্তিক চৌধুরী,আর তারপরই ঝিনুক সাহা!রেজাল্ট হাতে নিয়ে সবাই একে-অপরের সঙ্গে অল্পবিস্তর কথা বলছে।প্রত্যেকের বুকেই যেন একটা বিদায়ের সুর,বিষাদের কান্না!এই চেনা স্কুলের গেট,চেনা স্কুলমাঠ,চেনা ক্লাসরুম,চেনা লাইব্রেরিতে বইয়ের গন্ধ,বহুপরিচিত স্কুলের চেনা মুখগুলোকে প্রতিদিন সুর করে বলা,"গুড মর্নিং ম্যাম!"....এক নিমেষেই সব শেষ।বুকের বাঁ-দিকটা ফাঁকা করে দিয়ে ঋকের সবটুকু স্কুলজীবন এক নিমেষেই শেষ হয়ে গেলো।হাতের মার্কশিটটাই বলে দিচ্ছে,তুমি চাইলেও কাল আর এখানে আসতে পারবে না।এখন তোমার একটাই পরিচয়,তুমি এই স্কুলের প্রাক্তন।অনেক স্যার,অনেক ম্যাডাম আনন্দে ঋককে জড়িয়ে ধরলেন,অনেক-অনেক আশীর্বাদ করলেন ওর অনাগত ভবিষ্যতের জন্য।ঋক আর আদিত্য হাতে একটা ফাইল নিয়ে দোতলার বারান্দা দিয়ে নীচেই নেমে আসছিলো।হঠাৎ করে পিছন থেকে ডাক পড়লো,
-প্রান্তিক!!
দুজনেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো ঝিনুক আসছে।একরকম ছুটতে-ছুটতেই।ওকে দেখেই আদি বললো,
-ভাই,আমি নীচে আছি!
-না আদি!তুই থাক প্লিজ!
আকুতি ঝরে পড়লো ঋকের গলায়।ঋক যে ঝিনুককে বোঝে,ওর মনটা জানতে,ওকে জানতে,ঋক যে একটুও ভুল করেনি,সেটা ও কিছুতেই ঝিনুককে বুঝতে দিতে চায় না।তবে স্কুলের বন্ধুত্বটা,শুধুমাত্র নির্ভেজাল বন্ধুত্বের মতোই শেষ করতে চায় ও।স্যারদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেশ অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে,বারান্দা প্রায় ফাঁকা!একরকম জোর করেই আদিকে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলো ঋক।
-প্রান্তিক,হাই!কংগ্রাটস!হাঁপাতে-হাঁপাতে ঝিনুক বললো।
-তোকেও!একটু হাসলো ঋক।
-থ্যাঙ্কু!তারপর,কি করবি কিছু ভেবেছিস?এত ব্রাইট রেজাল্ট তোর!
-গ্রাজুয়েশন করবো,তারপর ব্যবসা!
-হোয়াট!?সিরিয়াসলি?
চমকে ওঠে ঝিনুক।এত মেধাবী একজন ছেলের এইরকম ভবিষ্যৎ ও বোধহয় ঠিক মেনে নিতে পারে না।
-হুম!আমার কোনো অসুবিধা নেই।আসলে বাবাও অনেকটা আশা করে।আমার কথা বাদ দে।তুই কি করবি?তোর রেজাল্টও তো সাংঘাতিক!
-মেবি ইঞ্জিনিয়ারিং!ইচ্ছে তো সেইরকমই আছে।লেটস সি!
-ওকে!গুড লাক!ঋক কোনোরকমে কথা শেষ করে এবার বেরোতে চাইছে।কিন্তু ঝিনুকের বুকের ভিতরটা তখন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।ও আজও কি বলতে পারবে না ওকে!আজও কি অব্যক্তই থেকে যাবে গত চার বছরের অপেক্ষা!
-ওকে,চল বাই!
ঝিনুক একটাও কথা বলছে না দেখে ওর দিকে একটা হাত বাড়ায় ঋক।মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো ঝিনুক।হঠাৎ ও এমন একটা কাজ করে বসলো যেটার জন্য ঋক একেবারেই তৈরী ছিল না।মাথাটা তুললো ও,ঋক দেখলো ওর দুটো চোখে টলটল করছে জল।ওকে ধরে একটু নাড়া দিলেই জলের বিন্দুগুলো হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসবে।আদি যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে,ফিরেও দেখলো না ঝিনুক।ঋকের হাতে-হাত না রেখে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে।আদি সঙ্গে-সঙ্গে সিলিংয়ের দিকে তাকালো,পারলে একদৌড়ে ওখান থেকে পালায়।ঋক অসহায়ভাবে ঝিনুকের দু-হাতের মধ্যে থেকে আদির দিকে চেয়ে দেখলো,ও আর ওদের দিকে ফিরেও চাইছে না।বোধহয় কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা।একটু-একটু করে নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছে ঋকের সঙ্গে।উঠছেই না ঋকের বুকের ওপর থেকে,সামনেই স্যারদের ঘর,বেজায় ঝামেলায় পড়ে গেলো ঋক।ঝিনুককে ওইভাবেই টেনে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলো ও।আদি সোজা নীচে নেমে গেলো।আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়ালো না।বোধহয় ভীষণভাবে আহত ঝিনুক!বরাবরই লাজুক স্বভাবের ঋক কোনোদিনই কারোর সঙ্গেই রূঢ়ভাবে কথা বলতে পারে না।এখনও ওর নিজের বুকের মধ্যে মিশে থাকা ঝিনুকের,কাঁধে বা পিঠে হাত রাখার মতো ক্ষমতা বা মনের জোর কোনোটাই ওর নেই।এটা ও শুধুমাত্র একজনের সঙ্গেই করতে পারে বা অন্তত করার কথা ভাবতে পারে।কোনোরকমে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ঝিনুকের মাথায় হাত রেখে ঋক বললো,
-কিরে ঝিনুক?
-উম!
-স্কুল শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে কষ্ট হচ্ছে?
মাথা তুললো ঝিনুক।তখনও দুহাতে আঁকড়ে ধরে রয়েছে ঋককে।দুদিকে মাথা নেড়ে না বললো ও।এবার তো সাংঘাতিক চাপে পড়ে গেলো ঋক।"হ্যাঁ" বললে তবু অনেক কথা বলা যেত।এবার কি বলবে ও!!তবুও বললো,
-তাহলে?কাঁদছিস কেন?
আর কিছু বলে না মেয়েটা।কথাই বলে না।চুপ করে কিছুক্ষণ ঋকের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো ঝিনুক।তারপর মাথা তুলে ঋকের গালে একটা হাত রাখলো ও,শুধু তিনটে কথাই বললো,
-ভালো থাকিস প্রান্তিক!
তারপর নিজের মার্কশিটের ফাইলটা বুকে চেপে ধরে, চোখ মুছতে-মুছতে ধীরে-ধীরে নেমে গেলো সিঁড়ি দিয়ে।ঋক কিছুক্ষণ একভাবে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো সিঁড়ির গোড়াতেই।এক-পাও এগোতে পারলো না।ও জানে,ভালোবাসলে কতটা কষ্ট হয়।কিভাবে মরতে হয় প্রতিরাতে।কিভাবে একটু ভালোবাসার মানুষটাকে দেখার জন্য ও নিজেও প্রতিদিন মরে!কিন্তু কি করবে ঋক!ঝিনুককে তো ও মিথ্যে মরীচিকায় টেনে আনতে পারবে না।যা ও পারবে না,তা পারবেই না।দিয়াকে ছাড়া আর কাউকে কোনোদিন ও ভালোবাসতেই পারবে না।এই প্রথম ঝিনুকের জন্য ঋকের চোখের কোণে জল এসে গেল।কোনোরকমে নাকটা টেনে একবার হাতের ফাইলটার দিকে চেয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নেমে গেলো ঋক...
পারলো না ঝিনুক।আজ অন্তত প্রান্তিককে বলবে ভেবেছিলো।কিন্তু যে মুহূর্তে ও প্রান্তিককে জড়িয়ে ধরেছিলো,সেই মুহূর্তেই ও বুঝে গিয়েছিলো,প্রান্তিক তখনই ওর বাহুবন্ধনের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।ও একবারের জন্যও ঝিনুকের শরীরে হাত পর্যন্ত রাখেনি।প্রান্তিক কোনোদিনই ওই শারদীয়াকে ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসতে পারবে না।জোর করে তো আর কাউকে ভালোবাসতে বাধ্য করা যায় না।তাই ছেড়েই দিলো ওকে।বাঁচুক,ও দিয়ার সঙ্গেই বাঁচুক!আর সেই সঙ্গে বাঁচুক ঝিনুকের মনের গভীরে,মেয়েবেলার অবুঝ,প্রথম প্রেম হয়ে!আবার যখন কোনোদিন এই স্কুলের সামনে দিয়ে যাবে ঝিনুক,তখন না হয় আবার মনে পড়বে ওর প্রান্তিককে।ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গেটের নোটিশ বোর্ডটার সামনে দাঁড়ালো ও।এখানে এক নম্বরে বড়-বড় করে লেখা রয়েছে প্রান্তিকের নাম,আর দু-নম্বরে ঝিনুকের।একসঙ্গে পাশাপাশি দুটো নাম তো আর কোনোদিনও বসবার নয়,এখানে অন্তত ওপর-নীচে পরপর লেখা রয়েছে ওদের দুটো নাম,সেটুকুই শেষবারের মতো প্রাণভরে,দু-চোখ ভরে দেখে নিলো ঝিনুক...
-এবার কি করবি কিছু ভেবেছিস?দুপুরে খাবার টেবিলে বসে খেতে-খেতে ঋককে জিজ্ঞাসা করলো সৈকত।
-না,আমি এখনও সে রকম কিছু ভাবিনি,তবে তুমি বা তোমরা আমাকে নিয়ে কি ভাবছো,সেটাও আমার জানা দরকার।
বরাবরের মতোই গম্ভীর স্বরে একেবারে গুছিয়ে উত্তর দিলো ঋক।এই কারণেই বড় ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারে না সৈকত।কম কথা বলে,কিন্তু এত গুছিয়ে কথা বলে,যে আর দ্বিতীয় কোনো কথা বলার জায়গা রাখে না ও।কোনোরকমে ডাল দিয়ে ভাত নাড়তে-নাড়তে রমার মুখের দিকে করুণভাবে চাইলো সৈকত।মানে,এবার তুমি বাঁচাও!একমাত্র রমাই পারে ঋকের সঙ্গে কথা বলতে।এবার মুখ খুললো রমা।
-দেখ,তুই যেটা ভালো বুঝবি সেটাই করবি!তুই যদি আরও...
-আমি একবার মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চলে গেলে কিন্তু কোনোমতেই আর ফিরতে পারবো না।তখন ব্যবসার পুরো দায়িত্ব কিন্তু ঋদ্ধিকেই নিতে হবে।ওর ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক।দাদুর শরীর খুবই খারাপ,আর সেটাই স্বাভাবিক।বয়স হচ্ছে।এবার বাবা যতদিন দেখতে পারবে ঠিক আছে,তারপর ভাই!কারণ কর্মচারীদের ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিলে আর দেখতে হবে না!ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে।আমি একবার বাইরে বেরিয়ে গেলে তখন কিন্তু আর আশা করবে না,যে আমি পাঁচ-সাত বছর পড়াশোনা করে এসে আবার ব্যবসা দেখবো।সেটা কোনোমতেই সম্ভব নয়।আমার কাছে সবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ।নিজের ভবিষ্যৎটাও,সেই সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসার ভবিষ্যৎও।তাই তোমাদের কি সিদ্ধান্ত,ভেবে বলবে,এখনই বলবে!একবারে সবটুকু বলেই আবার খাওয়ায় মন দিলো ঋক।
-না মানে,ঋদ্ধির ওপর পুরো ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায়!ও এতো অবুঝ,এত মাথা গরম,আর তাছাড়া...মিনমিন করে সৈকত বলতে শুরু করলো।
-বাবা,ওটা কোনো কথাই নয়।দায়িত্ব কাঁধে পড়লে সব শিখবে।আমরাই ওকে ছেড়ে রেখেছি,তাই শেখেনি দায়িত্ব কি!ঠিক আছে,বাড়ির সবার ছোট।আমি চাইও না ওর ওপর সবটা চাপিয়ে দিতে।তুমি বলো,তুমি কি চাও!এবার সৈকতের দিকে সোজাসুজি চেয়ে ঋক বললো।
-না মানে,তুই যদি ব্যবসাটা দেখতিস,মানে তোর পড়াশোনার পাশাপাশিই আর কি...
-ফাইন!আমি কালই কলেজের ফর্ম তুলে নিয়ে আসবো।বি.এস.সি.টা অন্তত করি,তারপর এম.এস.সির কথা পরে ভাবা যাবে।ততদিনে ভাইও অনেকটাই বড় হয়ে যাবে।ও নিশ্চয়ই বুঝে যাবে,ও কি চায়!তখন কথা বলে দেখা যাবে।
ভীষণ নিশ্চিন্ত হলো সৈকত।তবে বুঝতে পারলো না,ছেলে এটা কোনো অভিমান থেকে বললো কিনা!ওর মনের ভিতর একটা আলগা প্রশ্ন রয়েই গেলো।আর একটাও কথা বললো না ঋক।চুপচাপ খেয়ে ওপরে চলে গেল।এবার সৈকত রমাকে বললো,
-রমা,ছেলে খুশি তো?ওর মনে অন্যরকম কিছু ইচ্ছে ছিল নাতো?
-আমি যতটুকু ওকে চিনি,ও সোজা কথার মানুষ,এক কথায় মানুষ।কিছু বলার হলে এখনই বলতো।তবু আমি একবার দেখছি!
-হ্যাঁ,একটু দেখো তো!এত কাটা-কাটা কথা বলে,আমার তো কথা বলতেই ভয় করে ওর সঙ্গে!
-কি যে বলো!নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলবে,তাতে আবার ভয়!রমা হেসেই ফেললো।
রমারও খাওয়া হয়ে এসেছিল।ঝর্ণাদির খাওয়াও তখন প্রায় শেষের দিকে।সৈকত টেবিল ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।রমা বললো,
-ঝর্ণাদি,তোমার খাওয়া হয়ে গেলে টেবিলটা গুছিয়ে-মুছে ফেলো।আমি একটু ওপরে যাচ্ছি!
এক-পা এক-পা করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঋকের ঘরের দিকে এগোলো রমা।ঋদ্ধির ঘর হাট করে খোলা,ও আর দিয়া টিউশন গেছে।ঋকের ঘরের দরজা ভেজানো।রমা গিয়ে দরজাটা ঠেলে খুললো,দরজার দিকে পিছন ঘুরে কম্পিউটারে বসেছিলো ঋক।ঘরে ঢুকে প্রথমেই যেটা রমার চোখে পড়লো,কম্পিউটারের গোটা স্ক্রিন জুড়ে দিয়ার ছবি।দরজার শব্দ পেয়েই তাড়াতাড়ি করে মনিটর বন্ধ করে দিলো ঋক।তারপর পিছন ঘুরে দেখলো ও।রমা ঋকের মুখ দেখেই বুঝলো,বেজায় ঘাবড়ে গেছে ছেলে,আর সেই সঙ্গে বড়ও হয়ে গেছে।এরপর থেকে আর ছেলের ঘরে এভাবে ঢোকা যাবে না।ঋক ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে,
-ও তুমি!এসো!
-তুই কি ভাবলি,বাবা?একটু হেসে রমা বললো।
-নানা,আমি ভাবলাম ভাই!তুমি আর বাবা তো ওপরে আসোই না।বসো-বসো,কিছু বলবে?
নিজে বিছানায় বসে মায়ের হাত টেনে ধরে মাকেও বিছানায় বসালো ঋক।
-একটা কথা আমায় বল তো বাবা,ব্যবসার থেকে পড়াশোনায় তো তোর বেশি আগ্রহ,তাই না?
এক নজরে বিছানার কোণে ছড়িয়ে থাকা বইগুলোর দিকে তাকালো ঋক।পরীক্ষার পড়া পড়তে-পড়তেই প্রস্তুতি নিয়েছিলো পরবর্তী পরীক্ষার।বড্ড ইচ্ছে ছিল গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ডাক্তার হবে!ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে ঋক বললো,
-তা কেন!আমার কাছে সবই সমান।
-মাকেও মিথ্যে বলবি?
চুপ করে গেলো ঋক।একটু পরে বললো,
-মা,এখন আমি এখানেই থাকতে চাই।তোমাদের ছেড়ে বাইরে হোস্টেলে গিয়ে থাকতে পারবো না!আমি কলেজেই ভর্তি হবো।এবার মনের সবটুকু দ্বিধা কাটিয়ে ঋক দৃঢ়ভাবে বলে উঠলো।
হেসেই ফেললো রমা।কাকে ছেড়ে ছেলে থাকতে পারবে না,সেটা আর বুঝতে বাকি নেই ওর।এবার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ও বললো,
-যেটা তুই ভালো বুঝিস!তোর সঙ্গে কোনোদিনও কোনোকিছু নিয়ে চিৎকার করিনি,আজও করবো না!স্কুলের জামাকাপড়গুলো দে দেখি,কাচতে দেবো!
-কেচে আর কি হবে মা?আর তো স্কুলে যাবো না!
তাই তো!সত্যিই প্রতিদিনের অভ্যাসবশত ও বলে ফেলেছিলো কথাটা।শেষ হয়ে গেলো ঋকের স্কুলজীবন।রমা একটু হেসে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে নীচে নেমে এলো।দরজাটা ভেজিয়ে আবার কম্পিউটারের মনিটর অন করলো ঋক।সরস্বতী পুজোয় নীল শাড়ি পরা দিয়ার একটা ছবি বের করলো ও।ছবিটার ওপর হাত রেখে বললো,
-পারবো না!আর একটা দিনও তোমায় না দেখে আমি থাকতে পারবো না।কবে হোস্টেল থেকে আসবো,তবে তোমায় একটু দেখবো,আমি তো পাগল হয়ে যাবো দিয়া...ছোট্টবেলা থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন হেরে গেলো,তুমি জিতে গেলে!আর তোমার সঙ্গে-সঙ্গে আমিও।কারণ,তুমি জিতলেই যে,আমারও জেতা হয়ে যায়..
কম্পিউটার বন্ধ করে নীচে নেমে এলো ঋক।আদিকে একটা ফোন করতে হবে,কলেজে ভর্তির ব্যাপারে...
ঋক ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজের কলেজ জীবনে,ওদিকে ঋদ্ধি আর দিয়া স্কুলের প্রথম বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো।তারপরই স্কুলে ভর্তি হয়ে এলো ময়ূখ,ময়ূখ চ্যাটার্জী!প্রথমবার ওকে দেখেই চোখ দাঁড়িয়ে গেলো গুঞ্জার,ও এসে দিয়াকে বললো,
-ও ভাইই!
-তোর আবার কি হল?
-সায়ন্সে নতুন একটা ছেলে এডমিশন নিয়ে এসেছে,দেখেছিস দিয়া?
-তুই দেখেছিস?গুঞ্জাকেই আবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো দিয়া।
-হুম দেখলাম তো!দারুণ দেখতে রে!উফফ!
-সোম জানে?!একটু হেসে দিয়া বললো।
-এই চুপ কর তো!ওকে ভালোবাসি বলে কি সুন্দর-সুন্দর ছেলেও দেখতে পারবো না নাকি!!ও যখন আমার সামনে মেয়ে দেখে,তখন?
-তোরাই পারিস ভাই!
-আরে মনের দরজা বন্ধ,চোখের দরজা তো আর নয়!সত্যি বলছি,আমার জীবনে সোমদত্ত না থাকলে না,আমি অন্তত একটা চান্স নিতামই।এই তুই তো ফ্রি আছিস,তুই একটু দেখ না!ওই দিয়া...
-আজ তোর হাতে অনেক সময় আছে না?তখন থেকে ফালতু বকেই যাচ্ছিস?
-হুম!আজ আমার তেমন কোনো কাজ নেই!
-সেতো বোঝাই যাচ্ছে!এই ঋদ্ধি কোথায় রে?
-দেখ,কোথায় গিয়ে সোমদত্তর সঙ্গে বসে আছে।একটাকে পেলে আর একটাকেও পাওয়া যাবে!
দিয়া আর গুঞ্জা,দুজনেই লাইব্রেরিতে বসে কথা বলছিল,হঠাৎ করেই দিয়ার পিঠে খুব জোরে একটা থাপ্পড় এসে পড়লো।
-কিরে!কি করছিস তোরা?
ঘাড় ঘুরিয়ে ওরা দেখে সোমদত্ত আর ঋদ্ধি।
-আরে,তোরা তো একশো বছর বাঁচবি,তোদের কথাই বলছিলাম এক্ষুণি!গুঞ্জা বললো।
দিয়ার পিঠে বিরাশি সিক্কার চড়টা ঋদ্ধিই বসিয়েছে।তেড়ে উঠলো দিয়া।
-উফফ ঋদ্ধি,জ্বলে যাচ্ছে পিঠটা!হাত ভেঙে দেবো তোর একদম!
-সরি-সরি!লেগেছে তোর?
বেশ জোরেই লেগেছে দিয়ার।কারণ,ঋদ্ধির নিজের হাতই তখন জ্বলে যাচ্ছিলো।স্কুলের জামার ওপর দিয়েই দিয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় ঋদ্ধি।
-এই সর তো!ছাড়!
-আচ্ছা বাবু,বললাম তো সরি!
-বিকেলে আজ সোজা বাড়ি যাবো বুঝলি?দিয়া বললো।
-কেন?আমাদের বাড়ি যাবি না?
-নাঃ!আজ আর টিউশন যাবো না।শরীরটা ভালো নেই।
-শরীর ভালো নেই তো বাড়িতে গিয়ে একা-একা কি করবি?আমার বাড়িতে মা আছে,তেমন কিছু হলে...আর কি হয়েছে তোর?দেখে তো ঠিকঠাকই লাগছে।দেখি,জ্বর এসেছে নাকি!দিয়ার কপালে হাত রাখতে যায় ঋদ্ধি।
-এই ঋদ্ধি!সবসময় কি হয়েছে-না হয়েছে এত কৈফিয়ৎ তোকে দিতে পারবো না রে!শরীর ভালো লাগছে না,যাবো না ব্যাস!আমার কাছে চাবি আছে,আমি বাড়ি চলে যাবো!তুই গাড়ি নিয়ে তোর বাড়িতে নেমে যাবি,আমি ওইটুকু রাস্তা হেঁটেই চলে যাবো!
বেশ জোরেই বলে উঠলো দিয়া।লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায় গমগম করে উঠলো ওর একক কণ্ঠস্বর।
-চিৎকার করছিস কেন দিয়া?চিৎকার করার মতো আমি কি বললাম?বলছিস শরীর খারাপ লাগছে,তা জিজ্ঞেস করবো না কি হয়েছে,আজব তো!
-আমি উঠলাম!ক্লাসে যাচ্ছি!গুঞ্জা তুই কি আসবি?
বইখাতা গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়লো দিয়া।ঋদ্ধির প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আর প্রয়োজন মনে করলো না ও।
-হুম,তুই যা!আমি আসছি!
সোমদত্তর সঙ্গে তখন কিছু একটা ব্যাপারে গুজগুজ করে কথা বলছিলো গুঞ্জা।
-ওকে!
বলেই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো দিয়া।সত্যিই ভেবে দেখতে গেলে,ঋদ্ধির ওপর চিৎকার করার কোনোই কারণ নেই।অকারণেই চেঁচিয়ে এলো ও।আসলে আজ সকাল থেকে সবকিছুই অসহ্য লাগছে দিয়ার।মাসের এই কটাদিন মেজাজটা এত খিঁচড়ে থাকে,যে বাড়িতে মা পর্যন্ত এই কদিন দিয়ার সঙ্গে একটু বুঝেশুনে কথা বলে।কারণে-অকারণে মেজাজ হারিয়ে ফেলে ও।তলপেটের মধ্যে যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।যন্ত্রণায় হাতদুটো ঠান্ডা হয়ে গেছে ওর,পা-কোমর অবশ।বইখাতা নিয়ে ধপাস করে বেঞ্চে বসে পড়লো দিয়া...
দিয়া বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই গুঞ্জাও লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গেলো।ঋদ্ধি তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ডেস্কের ওপর বসে আছে।বিরক্তিতে দুটো ভ্রু এক-জায়গায় এসে গেছে।মুখটাও থমথমে!গুঞ্জা বেরিয়ে যাওয়ার পর সোমদত্ত এগিয়ে এলো ওর দিকে,
-কিরে!ঋদ্ধি?
-কোনো মানে হয় বলতো এভাবে চেঁচানোর?এমন কি বলেছি সোম আমি?বলছে শরীর খারাপ,তা জিজ্ঞেস করবো না কি হয়েছে!!কি করবে এই শরীর খারাপ নিয়ে ও একা-একা বাড়িতে গিয়ে?নীলিমা আন্টিও বাড়িতে নেই,অফিসে গেছে।আমাদের বাড়িতে তাও মা আছে,তেমন কিছু হলে ডাক্তার আঙ্কেলকে খবর দিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা...যত্তসব সালা!অন্য কেউ হলে না সালা জীবনেও তার মুখের দিকে ফিরেও চাইতাম না,নেহাত দিয়া তাই! ওকে না দেখে...
ঋদ্ধি সাংঘাতিক রেগে গেছে বোঝাই যাচ্ছে,একদমে কথাগুলো বলে এখন হাঁপাচ্ছে ও।গুঞ্জা যাওয়ার আগে ওর থেকে সোমদত্ত জেনে নিয়েছে দিয়ার ঠিক কি হয়েছে!ও একটু হেসে ঋদ্ধির কাঁধে একটা হাত রাখলো,
-শোন ভাই!যদি দেখিস,মাসের কোনো বিশেষ সময় কোনো মেয়ে অকারণেই মেজাজ হারাচ্ছে,তখন আর তাকে ঘাঁটাবি না,হয়তো সেই সময়টা তার কাছে কঠিন একটা সময়!
সোমদত্তর কথায় চমকে উঠলো ঋদ্ধি।এটা তো ওর মাথাতেও আসেনি।আসলে দিয়ার সঙ্গে এসব ব্যাপারে কোনোদিনও সেভাবে কথাই হয় নি।তাই ও এতটা খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে না।হয়তো সোমদত্ত যা বলছে তাই ঠিক!
-তোকে কি গুঞ্জা বলেছে?
-হুম!
চুপ করে গেলো ঋদ্ধি।কয়েক মুহূর্ত পর উঠে দাঁড়ালো ও।সোমদত্তর মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকানোতে ও বললো,
-এই জন্যই বলি,ভাই ভালোবাস কাউকে।বুঝতে পারবি!বেস্টফ্রেন্ডকে দিয়ে কি আর সবকিছু বোঝা যায়!
হেসে ফেললো ঋদ্ধি।পরের ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেলো।এবার নিজের ক্লাসে যেতে হবে।গুঞ্জা আর দিয়া কলা বিভাগ এবং ঋদ্ধি আর সোমদত্ত বিজ্ঞান বিভাগ হওয়ার এখন ক্লাস আলাদা ওদের।একমাত্র ইংরেজি ক্লাস ছাড়া একসঙ্গে আর বসাই হয় না।
-চল!অভ্র স্যারের বোরিং ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।
-আমি একটু দিয়ার ক্লাস থেকে আসছি!
-দেরি হলে কিন্তু ক্লাসের বাইরে,মনে আছে তো কার ক্লাস?
-হুম!থাক,চল!এর পরেই তো টিফিন!তখন দেখা করে নেবো!
-ওটাই ভালো!
দুজনেই নিজেদের ক্লাসে চলে গেলো।
-কিরে পেত্নী?কি টিফিন এনেছিস আজ?
-এই নে!টিফিন বক্সটা ধরেই ঋদ্ধির হাতে দিয়ে দেয় দিয়া।
-তুই খাবি না?
-খাবো,পরে!তুই যা খাবি খা না!
-টিফিনবক্স রাখ!চল ক্যান্টিনে!আজ তোকে আমি খাওয়াবো!তুই যা খেতে চাইবি!
-হঠাৎ?
-এমনিই...বল কি খাবি?আজ আমি তোকে খাওয়ানোর মুডে আছি!বলেই হাসিমুখে দিয়ার কাঁধে একটা হাত রাখে ঋদ্ধি।
-উম!দেখি ভেবে!চল তাহলে!ঋদ্ধি...
-হুম বল রে?
-ক্যান্টিনে যাওয়ার আগে একটু বাথরুমে যাবো!
-ওকে!চল!
ঋদ্ধির হাতের মধ্যে থেকে উঠতে গেলো দিয়া।ঋদ্ধি ওর একটা হাত টেনে ধরে বললো,
-দিয়া সরি!
-সরি কেন?ইনফ্যাক্ট আমি সরি!আমিই লাইব্রেরিতে ওভার-রিয়্যাক্ট করেছিলাম।অকারণেই...সরি!
-না,ঠিক আছে!কোনো ব্যাপার না!
-তুই সরি কেন?
-এমনিই!একটু হেসে ঋদ্ধি বললো।তোকে না বুঝে তোর ওপর হেব্বি রেগে গিয়েছিলাম।
-তো এখন আমায় বুঝতে পেরেছিস?
-হয়তো!
-মানে?
-মানে আমার এখন বিশাল জোর খিদে পেয়েছে,তুই যাবি কিনা!কি খাবি আমায় বলে বাথরুমে যা,আমি ক্যান্টিনে বলে রাখছি!
-ওকে-ওকে!ছাড়,যাচ্ছি তো!
দিয়ার কাঁধে হাত রেখে,ওকে একরকম টানতে-টানতেই ক্লাসের বাইরে নিয়ে যায় ঋদ্ধি।ওদের যাওয়ার দিকে একভাবে চেয়ে থাকে সোমদত্ত আর গুঞ্জা!তারপর সোমদত্ত বলে ওঠে,
-আচ্ছা গুঞ্জা,তুই শিওর যে ওরা শুধুই বন্ধু?
-আররে হ্যাঁরে!দিয়ার মনে ওসব কিছু নেই।আর ঋদ্ধি তো একটা আস্ত গবেট!ও নিজেই বোঝে না ও কি চায়!চাউমিন খেতে-খেতে গুঞ্জা বললো।
-না মানে ওদের মধ্যে কিছু একটা হলে বেশ হতো বল!দুটোকে কিন্তু একসঙ্গে দারুণ লাগে দেখতে...
-ওই,অন্যের কথা পরে ভাববে,আমাদের মধ্যে যেটা হয়েছে,সেটা সামলে রাখো বুঝলে,অন্য মেয়ের দিকে তাকালে একদম তোমার চোখ গেলে দেবো!
-আচ্ছা!আর তুই যে সকালে ময়ূখের দিকে জলহস্তীর মতো হাঁ করে তাকিয়ে ছিলি,সেটা আমি দেখিনি ভেবেছিস?আমি মেয়ে দেখলেই যত দোষ?
চরম বিষম খেলো গুঞ্জা।সোমদত্ত ওর পিঠ থাবড়ে দিয়ে ওর দিকে জলের বোতল এগিয়ে দেয়।কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে গুঞ্জা বললো,
-একটা দেবো না!বলেই সোমদত্তর পিঠে দুম করে ঘুষি মেরে দিলো গুঞ্জা...
-তুই বস,আমি নিয়ে আসছি।
-একা-একাই খাবি?আমাদের দিবি না?ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়া দেখলো সোমদত্ত আর গুঞ্জা।
-আরে বস না,দুটো চেয়ার নিয়ে আয়।
সোমদত্ত দুটো চেয়ার নিয়ে এসে বসলো।ঋদ্ধি খাবারটা নিয়ে এসে দেখলো,টেবিলে ভিড় জমে গেছে।
-কিরে তোরা?
-দিয়া নেমন্তন্ন করলো।তুই তো ছোটলোক,আমাদের খাওয়াবি না,তাই দিয়াই বসতে বললো।গুঞ্জা চোখ নাচিয়ে বলে উঠলো।
-সালা এমন খিস্তি খাবি না...বোস!আমি বলে আসছি!
-এই ঋদ্ধি!নানা!আমি জাস্ট এমনিই বললাম!সবে খেয়ে এসেছি!তোদের থেকেই একটু নিচ্ছি,আর কিছু আনিস না প্লিজ...
গুঞ্জা ঋদ্ধির হাত টেনে ধরে বলল...
-শিওর?
-একদম শিওর ঋদ্ধি!
-ওকে!
চেয়ার টেনে বসলো ঋদ্ধি।একটু খাওয়া-দাওয়া একটু গল্পের পরই দিয়াদের উল্টোদিকের টেবিলে দুটো ছেলের সঙ্গে সে এসে বসলো।তাকে দেখেই দিয়াকে কনুই দিয়ে খোঁচা মারলো গুঞ্জা।
-কিরে!
-এর কথাই বলছিলাম!
ফিসফিস করে গুঞ্জা বললো।বলেই চোখ নাচিয়ে ইশারা করলো ও।এবার দিয়া ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলো,সাংঘাতিক দেখতে একটা ছেলে ওদের টেবিলের উল্টোদিকেই বসে আছে।নতুন মুখ,স্কুলে আগে একে দেখেনি দিয়া।নইলে ওই মুখ একবার দেখলে ভোলার নয়।কি ভীষণ মায়াময় মুখটা।বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইলো দিয়া।ঘোর কাটলো ঋদ্ধির ধাক্কায়।
-কিরে?কোথায় হারিয়ে গেলি দিয়া?খা!
-উম?হুম!
বলে আবার খাওয়ায় মন দিলো দিয়া।কিন্তু চোখদুটো আটকে রইলো ওই টেবিলেই।
-বলেছিলাম না,কাঁপাকাঁপি দেখতে ছেলেটাকে!
-হুম!তা অবশ্য!কাঁপাকাঁপিই বটে!এখানে আসার পর থেকেই কেমন যেন ভূমিকম্প হচ্ছে!!
দিয়া আর গুঞ্জা দুজনেই সশব্দে হেসে উঠলো।একটু খাওয়া-দাওয়ার পরই আবার ওরা মেতে উঠলো ট্রুথ আর ডেয়ারে।একটু অন্যমনস্কভাবেই দিয়া ডেয়ার নিয়ে বসলো।বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দিয়াকে লক্ষ্য করছিলো ঋদ্ধি।ওর চোখ-মন ওদের এখানে কম,দূরের ওই টেবিলেই বেশি।দুজনেরই বিজ্ঞান বিভাগ হওয়ার সূত্রে ময়ূখের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে ঋদ্ধিরও।ডাকাবুকো ছেলে,সুন্দর চেহারা।ওদের ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে বেশ প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে এই কদিনেই।ভালো নম্বর নিয়েই ওদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে।দিয়াও গত বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওর ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না।রাজ্যের দুস্টুমি বুদ্ধি খেলে গেলো ঋদ্ধির মাথায়।সময় এসে গেছে তিতিরের প্রতিশোধের।দিয়াকে দুম করে ও বলে বসলো,
-গো এন্ড প্রোপোজ ময়ূখ!
-হোয়াট!!
দিয়া আর গুঞ্জা দুজনই একসঙ্গে চমকে উঠলো।
-সালা কি জিনিস রে তুই ঋদ্ধি!গুঞ্জা দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো।
-ঋদ্ধি!সবসময় এসব ভালো লাগে না!আমি খেলবো না।
-আমিও তিতিরের সময় বলেছিলাম,শুনেছিলি তোরা?
-কিন্তু তাই বলে তুই এভাবে...
-সেদিন বলেছিলাম,সুদে-আসলে উশুল করবো।আজ নয় কাল!গো!
-ছোটলোক!
-সে যাই হই,তুই যাবি ব্যস!
এমনিতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে রয়েছে যন্ত্রণায়,তার ওপর আবার এই উৎপাত।হৃদস্পন্দন দশগুণ বেড়ে গেছে দিয়ার।
-কিরে যা!
-ছেড়ে দে না ঋদ্ধি!গুঞ্জাও মিনতি করে উঠলো।
-কার জন্য ছাড়বে?তোর জন্য?
সোমদত্ত মাঝখানে ফোড়ন কাটলো।
-এই তুই চুপ করবি!দাঁতে-দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে উঠলো গুঞ্জা।
-না,সেদিন তোরা ছাড়িসনি,আজ আমি কেন ছাড়বো!কিরে দিয়া,যা...
করুণ মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠলো দিয়া।ঋদ্ধি দূর থেকে খোশমেজাজে ওকে দেখছে।তখনও ঋদ্ধি নিজেও ভাবতে পারেনি,আজকের এই ছোট্ট মজাটার কত বড় মূল্য ওকে ভবিষ্যতে দিতে হবে!
ততক্ষণে সামনের টেবিলে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দিয়া।
-হাই!ময়ূখের দিকে চেয়ে দিয়া বললো।
অচেনা একটা মেয়ে এভাবে এসে কথা বলায় প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো ময়ূখ।কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-হাই!
-আমি শারদীয়া।
-ওকে,আমি ময়ূখ!নিজের হাতটা দিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো ময়ূখ।ময়ূখের হাতে-হাত রাখলো দিয়া।
-বসো না!ময়ূখ একটা চেয়ার এগিয়ে দিল দিয়ার দিকে।
-না,ঠিক আছে!মানে তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
ওদিকে গুঞ্জা সোমদত্তর হাত খামচে ধরেছে।যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটবে।ঋদ্ধি দাঁতের দোকান খুলে হাঁ করে চেয়ে রয়েছে দিয়ার দিকেই...
-হ্যাঁ বলো!কি বলবে?
-আই-আই লাইক ইউ,ইনফ্যাক্ট আই লাভ ইউ!
ময়ূখের সঙ্গে বসে থাকা দুটো ছেলের ততক্ষণে চোয়াল ঝুলে গেছে।কথা নেই-বার্তা নেই,সোজা এসে আই লাভ ইউ!!ময়ূখ যদিও বেশ বুদ্ধিমান ছেলে,তবুও ও বেশ অবাকই হলো।ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-এক্সকিউজ মি?!
-ইয়েস!আই লাভ ইউ!
এবার বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে,আর অকারণেই একটু জোরেই দিয়া বললো,যাতে ওইদিকের টেবিলে হাঁ করে বসে থাকা উজবুকটাও শুনতে পায়।আর এখানেই ও ধরা পড়ে গেলো চতুর ময়ূখের কাছে।ঘাড় ঘুরিয়ে ও দেখলো,একটু দূরের টেবিল থেকে তিনজোড়া চোখ যেন গিলে খাচ্ছে ওদের!ও ওদিকে তাকানো মাত্রই সবাই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো,একমাত্র প্রতীক বাদে।তিনজনের মধ্যে প্রতীক আর সোমদত্তকে ও চেনে,ওর ক্লাসেই পড়ে।হেসে ফেললো ময়ূখ!তারপর দিয়ার দিকে ফিরে মিষ্টি করে একটু হেসে বললো,
-ডেয়ার নিয়েছিলে?
দিয়ার বুকের ওপর থেকে থেকে যেন একটা ভারী কিছু নেমে গেলো।এবার ও নিজেও হেসে ফেললো,
-থ্যাংক গড!ইয়েস!রিয়েলি,আই এম সো সরি ময়ূখ!
-নো-নো!ইটস ওকে!নো প্রব্লেম!কোনো ব্যাপারই না এটা।তুমি জয়েন করতে পারো আমাদের সঙ্গে,আমার বন্ধু অগ্নিভ,সাগ্নিক!সায়েন্স!
-হাই!
-হ্যালো!আমি শারদীয়া,আর্টস!থ্যাঙ্কু ফর আস্কিং ময়ূখ,কিন্তু আমার বন্ধুরা আমার জন্য ওই টেবিলে...
-ওহ ওকে!ইন্ট্রোডিউস করাবে না তোমার বন্ধুদের সঙ্গে?দুজনকে অবশ্য আমি চিনি!
-শিওর!প্লিজ কাম!
-ভাই,এক মিনিট!
বন্ধুদের বলে দিয়ার সঙ্গে উঠে এলো ময়ূখ।তারপর দিয়া আলাপ করিয়ে দিলো গুঞ্জার সঙ্গে,ঋদ্ধি আর সোমদত্তকে তো ময়ূখ আগে থেকেই চেনে,তবে শুধুমাত্র মুখ চেনা!আজ দিয়ার দৌলতে আরও একটু ভালোভাবে কথা হলো।কয়েক মুহূর্ত একটু কথা বলার পর ময়ূখ ফিরে গেল নিজের টেবিলে।দিয়া এবার ঋদ্ধিকে বললো,
-কিরে,কেমন দিলাম বল!
-ভাই তোদের মেয়েদের অনেক এডভান্টেজ আছে ভাই।মেনে নিলাম,ঝামেলা তো হলোই না,উল্টে আমাদের সার্কেলে নতুন একজন জুটে গেলো।প্রণাম নিস দিয়া!
ঋদ্ধি হাতজোড় করে বললো।সশব্দে হেসে উঠলো দিয়া।ঋদ্ধি বেশ অবাক হয়েই চেয়ে রইলো দিয়ার হাসিমুখের দিকে।একটু শুকনো দেখাচ্ছে আজ মেয়েটাকে।কিন্তু মুখের সেই সুন্দর,পাগল-করা হাসিটা অমলিন!যাক,মেয়েটা একটু হাসলো তো!!সকাল থেকেই খালি চেঁচাচ্ছে আজ!ও যে দিয়াকে একটু হাসি উপহার দিতে পেরেছে,এটাই ওর কাছে অনেক...
-তবে তিতির কিন্তু তোকে হ্যাঁ বলেছিলো ঋদ্ধি!ঝামেলাটা তোর দিক থেকেই বেঁধেছিলো।গুঞ্জা বলে উঠলো।
-আরে বাপ,আর মনে করাস না ওর কথা,নেহাত কমার্স নিয়ে অন্য স্কুলে বেরিয়ে গেছে,তাই বেঁচে গেছি!নইলে স্কুলের শেষ দুটো বছরও আমায় পালিয়ে-পালিয়েই বেড়াতে হতো!
এই কথাটুকু বলেই আদর করে দিয়ার কাঁধে একটা হাত রেখে প্লেট থেকে একটু স্যালাড তুলে,ওর মুখে গুঁজে দিলো ঋদ্ধি।ওদিকে একটু দূরেই টেবিল ছেড়ে উঠলো ময়ূখ আর তার বন্ধুরা!উঠেই একবার দিয়ার টেবিলের দিকে তাকালো।তখন যুদ্ধজয়ের আনন্দে ঋদ্ধির সঙ্গে প্রাণখোলা হাসি হাসছে দিয়া।কি ভীষণ সুন্দর দিয়ার হাসিটা!কি নিষ্পাপ!উড়ো-উড়ো চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়ছে বারবার।আবার মেয়েটা হাত দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে!একটু হেসে মুখটা ফিরিয়ে নিলো ময়ূখ!ক্যান্টিন ছেড়ে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার পিছন ঘুরে দেখলো ও,এবার ময়ূখের চোখ সরাসরি পড়ে গেলো দিয়ার চোখে।দিয়াও দূর থেকে একদৃষ্টে চেয়েছিলো ময়ূখের দিকেই...
(আপাতত সমাপ্তি)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হল। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট