ত্রিভুজ
সাথী দাস
পঞ্চম পর্ব
-ও তুই?আয়-আয়!
-আন্টি,মা এগুলো পাঠিয়ে দিলো।ও বেলা দিয়া খুব ভালো খেয়েছিলো তো,তাই...
-হ্যাঁ রে ঋক!তোর মায়ের জন্য তো আমি এবার সব রান্নাবান্না ভুলে যাবো রে,দিয়া খেয়ে আসছে,আমার জন্য রান্না করে পাঠাচ্ছে,আমার বাড়িতে তো আর রান্নারই পাট নেই রে....
হেসে উঠলো ঋক!ডান গালে সঙ্গে-সঙ্গে জেগে উঠলো একটা হালকা টোল!আকাশনীল রঙের একটা শার্ট আর কালো রঙের একটা জিন্সের প্যান্ট পরে এসেছে ও।বছর চোদ্দ-পনেরো হয়তো বয়স ওর,কিন্তু কি অদ্ভুত পরিপূর্ণতা মাখানো একটা মুখ!বয়সের তুলনায় যেন একটু বেশিই লম্বা ঋক!উচ্চতাটা তাই বড্ড বেশিই চোখে পড়ে!সবচেয়ে মায়াময় দুটো চোখ,সব সময় যেন তারা হাসছে!চোখের বড়-বড় পাতাগুলোও যেন,ওর হালকা খয়েরী রঙের চোখের মণির উজ্জ্বলতা ঢাকতে অপারগ!তারা ঘন চোখের পাতায় মধ্যে থেকেই নক্ষত্রের মতো দীপ্তমান!গলা সামান্য ভেঙে ধীরে-ধীরে পরিণত হচ্ছে কণ্ঠস্বর!ঠোঁটের ওপরে সামান্য গোঁফের রেখাও দেখা দিয়েছে।একটু ভালো করে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে,ওর ব্যবহারেও হয়তো অনেক পরিবর্তন চোখে পড়বে।একটু-একটু করে যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে ঋক।বয়ঃসন্ধিকালের এই সময়টাতেই হয়তো সব ছেলেরা নিজেদের আবেগ-অনুভূতি একটু-একটু করে গোপন করতে শেখে!ঋকও তার ব্যতিক্রম নয়!ধীরে-ধীরে শৈশবকে বিদায় জানিয়ে যৌবনে পদার্পন করলো রমার বড় ছেলে....
হাতের প্যাকেটটা নীলিমার হাতে ধরিয়ে দিলো ঋক।তারপর মৃদু হেসে একটু আড়চোখে ঘরের দিকে তাকালো ও...
নীলিমা বললো,
-আয় না ঋক,ঘরে বোস!রবিবার একটু কুঁচো-নিমকি ভেজেছিলাম,খাবি?
-দাও!জুতো খুলতে-খুলতে বলে ও।
-আচ্ছা,বোস!যানা,দিয়া ওঘরে আছে,ওর সঙ্গে কথা বল।আমি নিয়ে আসছি...গোবিন্দ দা এসেছে?গাড়ি নিয়ে এসেছিস?না সাইকেল?
-না আন্টি!গাড়ি নিয়ে,গোবিন্দ কাকা নীচে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে...
-আচ্ছা!আচ্ছা!যা...এই দিয়া,ঋক এসেছে!
চেঁচিয়ে মেয়েকে জানিয়ে দিলো নীলিমা।তারপর হাতের প্যাকেট-টা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো ও...
ঘরে ঢুকলো ঋক।ডাইনিং পেরিয়ে দিয়ার ঘরের দিকে গেলো ও।দরজা তখন অর্ধেক ভেজানো ছিলো,ঘরের আলো জ্বলছে,ফ্যানও চলছে।কারণ,ঘরের ভিতরের জানলার পর্দাগুলো অল্প-অল্প দুলছে।সেই আলোয় দরজার ফাঁক দিয়ে ঋক দেখলো,একজোড়া ফর্সা খোলা পা,একটার ওপর আর একটা রাখা,তারা নাচছে!মনে হয় কোনো গানের তালে-তালে...যতটুকু পা দেখা যাচ্ছে,পুরোটাই উন্মুক্ত!চোখ নামিয়ে নিলো ঋক।দরজায় দুবার নক করলো।কোনো সাড়া নেই।আবারও নক করলো ও।তাও দিয়ার কোনো সাড়াশব্দ নেই।এবার দরজা একটু ঠেলে ঘরে ঢুকতে গেলো ও,তখন শুনলো,গুনগুন করে দিয়ে গান করছে!আচ্ছা,এম পি থ্রি প্লেয়ারে-এ গান শুনছে!শুনতে পাবে কি করে!!দরজা পুরোপুরি খুলে যেতেই দিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ঋকের দিকে।উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়েছিলো দিয়া।ওর পিঠ পর্যন্ত খোলা একরাশ চুল মুখের ওপর এসে পড়েছে।তাড়াতাড়ি করে একলাফে উঠে বসলো দিয়া।ওর পরনে হালকা সাদা রঙের পাতলা একটা টপ,আর সবুজ রঙের একটা শর্টস!এর আগেও দিয়াকে এইরকম পোশাকে দেখেছে ঋক,ও যেহেতু প্রায়ই ওদের বাড়িতে যায়,ঋকের মা ওর জন্য একগোছা জামাকাপড় কিনে রেখেছে।স্কুল থেকে ফিরে ও ওইগুলোই পরে কিনা!কিন্তু ওগুলো এত ছোট,আর এতটা স্বচ্ছ পোশাক নয়!দিয়ার শরীরের ছোট-খাটো উত্থানটুকুও ঋকের চোখে ধরা পড়লো।মাথা নামিয়ে ঋক জিজ্ঞেস করলো,
-ঠিকঠাক চলছে প্লেয়ারটা?
-হুম,একদম!
এই বছর পুজোর ছুটিতে সৈকতরা বাড়িতে ছিল না,বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলো,লেহ-লাদাখ!নীলিমাকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও,ওদের সঙ্গে নীলিমা যায়নি।অফিসের কাজের কথা বলে না করে দিয়েছে।দিয়াকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল রমা,কিন্তু কোনোমতেই নীলিমা মেয়েকে ছাড়েনি।সামান্য বাড়িতে যাচ্ছে বলে,ওইভাবে অতদুরে মেয়েকে ওদের হাতে ছাড়তেই পারবে না নীলিমা!দিয়াকে যে ওইভাবে নীলিমা কিছুতেই ছাড়বে না,সৈকত সেটা বুঝতে পেরেছিল।মেয়েকে ছেড়ে রাখার মতো মানুষই নন নীলিমা দেবী।তাই রমাকে বুঝিয়ে নিয়েছিলো সৈকত।ওরা আর জোর করেনি।পুজোর সময় বেরিয়ে যাওয়ার ফলে যেটা হয়েছিলো,দিয়ার দশ বছরের জন্মদিনে ওরা আর এবার থাকতে পারেনি।পরে ঘুরে এসে এই এম পি থ্রি প্লেয়ারটা ওকে গিফ্ট করে ওরা,ঋক নিজেই পছন্দ করে কেনে... সেটাতেই এখন বিভোর হয়ে গান শুনছিলো দিয়া।
-ঋদ্ধি এসেছে?দিয়া জিজ্ঞেস করলো।
-না!ওর কথা আর বোলো না!বাবার সঙ্গে বসে ম্যাচ দেখছে!আসতে বললাম,উঠলোই না!দিয়া টিভিটা একটু চালাবে?স্কোর-টা একবার...
-হুম,চালাও না!ইনফ্যাক্ট আমিই চালাতে যাচ্ছিলাম।তারপর ভাবলাম,ধুর একটু গান শুনি!
-আমি মিউট করে দেখছি,তুমি শোনো না গান!প্রবলেম হবে না...
-নানা,ইটস ওকে!চলো দুজনে মিলেই দেখি...
-ওকে!
বিছানার ওপর প্লেয়ারটাকে ফেলে রেখে টিভির দিকে উঠে গেলো দিয়া।সুইচ দিয়ে টিভিটা চালালো ও।
-এই ঋক,ঋদ্ধিকে একটা কথা বলে দিতে পারবে?
-হুম,বলো না,কি কথা?
ঋক!হ্যাঁ,ঋক নামেই ওকে ডাকে দিয়া।ঋদ্ধি আর দিয়া সমবয়সী,একই ক্লাসে পড়ে।ঋক ঋদ্ধির দাদা।সেইসূত্রে,একেবারে প্রথম দিকে ঋক-দা বা কখনো-কখনো প্রান্তিক-দা বলে ওকে ডাকতে শুরু করেছিল দিয়া।কিন্তু যেদিন রমার কানে গেলো,হাঁ-হাঁ করে চিৎকার করে উঠলো ও,সেদিন রমা বলেছিলো,
"নানা,ওসব দাদা-টাদা ডাকার কোনো দরকার নেই!তুই ওকে নাম ধরে ডাকবি দিয়া!এখন সবাই নাম ধরেই ডাকে।আমার ঋদ্ধিকে দিয়েই আজ পর্যন্ত 'দাদা' ডাকাতে পারলাম না,'ভাই' ডেকেই গেলো আজীবন,আর ও নাকি দাদা ডাকবে!ওসব যেন আমি আর একদম না শুনি!এরপর কোনদিন দেখবো,স্কুলের রাখী-পার্টিতে ঋককে রাখিও পরিয়ে দিয়েছে!একদম দাদা নয় কিন্তু..."
সেদিন দিয়ার শিশুমন রমার কথার এত বিশ্লেষণ,এত গভীরতা বোঝেনি।ওকে রমা আন্টি ঋককে দাদা ডাকতে বারণ করেছে,ও আর ডাকেনি!সেই থেকে আজও পর্যন্ত দিয়া ঋককে নাম ধরেই ডাকে,আর তুমি করেই বলে,এমনকি ঋকও তাই...
ঋক-দিয়া-ঋদ্ধি,তিন বন্ধুর মতোই একসঙ্গে বড়ো হয়েছে...
-ওকে একটু বলবে,কাল যেন চন্দ্রাণী ম্যামের ইংলিশ খাতাটা একবার স্কুলে নিয়ে আসে।আজ সবটুকু লেখা কমপ্লিট করতে পারিনি গো।এসে দেখি,বেল পড়ে গেছে,লাস্ট পিরিয়ড ছিল,আর লেখা হলো না।কাল লিখে নেবো,কাল রুটিনে নেই তো,না বললে ও আনবে না...
-ওকে,আমি বলে দেব!কিন্তু এসে দেখি মানে?ক্লাসের মাঝখানে কোথায় গিয়েছিলে?
-টয়লেট!
-ওকে-ওকে!ডোন্ট ওয়ারি,আমি ভাইকে বলে দেবো!
কথার মধ্যেই "ছয়"!! বলে চেঁচিয়ে উঠলো ঋক!ইন্ডিয়ার ব্যাটিং চলছে তখন...
-ইয়েস!ইয়েস!ইয়েস!রিমোর্ট হাতে খুশিতে লাফাচ্ছে ঋক।কিন্তু ওদিকে মুখ হাঁড়ি করে বসে আছে দিয়া।ওর একদম ভালো লাগে না এইসব খেলাধুলো।ওর কোনো আগ্রহই নেই এতে।ওদিকে অন্য চ্যানেলে ওর প্রিয় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।ওটা দেখার জন্যই একটু আগে টিভি চালাতে যাচ্ছিলো দিয়া।কিন্তু তখনও একটু সময় বাকি ছিলো বলে গান শুনছিলো ও।ওই অনুষ্ঠানটা দেখেই পড়তে বসতো!রোজই তাই করে।
ওর অন্ধকার মুখের দিকে চেয়ে ঋক বললো,
-দিয়া?
-হুম...
-কি হলো?
-না মানে,এই সময় আমি একটা প্রোগ্রাম দেখি তো,তাই আর কি...
সেই মুহূর্তেই টিভির রিমোর্ট দিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো ঋক।
-এই নাও,দেখো...
-সিরিয়াসলি?
-হুম!কি দেখবে দেখো!একটু হেসে ঋক বললো।
-বাপরে!ঋদ্ধি হলে আমায় মেরে খুন করে ফেলতো!ওর খেলা দেখার সময় যদি আমি চ্যানেল চেঞ্জ করতাম...
-দেখো!দেখো!সজোরে হেসে উঠলো ঋক...
মায়ের পরে এই একজনের সামনেই ভীষণভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে ঋক।কেন জানে না,কিন্তু একেবারে ছোটো থেকেই দিয়াকে ওর ভীষণ ভালোলাগে।আগে দিনরাত ঋদ্ধির সঙ্গে মারামারি করতো দিয়া,এখন বড় হওয়াতে সেটা একটু কমেছে।এখন খালি মুখে ঝগড়া হয়।ছোটবেলায় একবার ওদের দুজনকে ছাড়াতে গিয়ে,দিয়ার কাছেই ঝাড় খেয়ে গিয়েছিল ঋক।কি নিয়ে সেবার মারামারি বেঁধেছিল,সেটা এখন আর মনে পড়ে না ঋকের,তবে শুধু এটুকু মনে আছে,টেনে হিঁচড়ে দিয়াকে ধরে রেখেছিলো ঋক।ছাড়লেই ও দৌড়ে গিয়ে ঋদ্ধির চুল ধরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিচ্ছিলো।ঋকের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে,ওর বাঁ-হাতে নিজের ধারালো দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল দিয়া।মাংস খুবলে উঠে এসেছিল,রক্তে ভাসাভাসি হয়ে গিয়েছিল সেবার।মাথা গরম করে দিয়া কামড়ে তো দিয়েছিলো,কিন্তু পরে ঋককে কষ্ট পেতে দেখে,আবার নিজেই কেঁদে খুন হয়েছিল।এখনও সেই গভীর ক্ষতের দাগ ঋকের বাঁ-হাতে আছে।প্রতিবার যখনই ও ঘড়ি পরতে যায়,তখনই ওই দাগটা চোখে পড়ে ওর।আর তখনই ঋক একবার করে নিজের মনেই হেসে ওঠে...
-এই নে,খা।তুইও একটু নিমকি খা দিয়া!আর তাড়াতাড়ি টিভি বন্ধ করে পড়তে বস।রাত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
-মা,প্লিজ একটুখানি!এটা শেষ হয়ে গেলেই বন্ধ করে দিচ্ছি।
-হুম,তাড়াতাড়ি!এই ঋক শোন,রমার জন্য একটু কুঁচো-নিমকি আর মিষ্টি রেখেছি।না বলে বেরিয়ে যাস না যেন আবার।যাবার সময় নিয়ে যাবি,বুঝলি?
-ওকে আন্টি!সেসব তো ঠিক আছে,কিন্তু তুমি নিমকি বলে এতকিছু সাজিয়ে দিয়েছো?এই তোমার নিমকি?আমি এত খেতেই পারবো না আন্টি!
-চটপট খেয়ে নে!একটাও কথা শুনবো না...
-কিন্তু আন্টি...
কথার মাঝখানেই চমকে উঠলো ঋক।বিছানায় বসেছিলো ও,একটু পিছনেই দিয়া।হঠাৎ চমকে ওঠার কারণ,দিয়া সজোরে ওর কোমরে একটা চিমটি কেটেছে,ও একটু ঘুরে দেখলো দিয়ার দিকে।কিন্তু ও তখন হাঁ করে টিভির দিকে চেয়ে আছে।যেন কিছুই জানে না,আর কিছু বললো না ঋক।চুপ করে গেলো।দিয়া কি ওকে চুপ করতেই বললো?!
-ঝটপট খেয়ে নিবি কিন্তু,পুরোটা...
তখনই আবার দরজার বেল বাজলো,নীলিমা চলে গেল দরজা খুলতে।একটু পরেই ভেসে এলো সামনের ফ্ল্যাটের আন্টির গলা।দিয়া নিশ্চিন্ত হলো।এখন মা কিছুক্ষণ মা ওই বৌদির সঙ্গে বকতে থাকবে,এটাই সুযোগ...
ঋক তখন অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে দিয়ার দিকে,ও চিমটি কাটলো কেন!!কিন্তু দিয়া সে সবের পরোয়া না করে ঋকের প্লেট থেকে একটা সিঙ্গাড়া তুলে তাতে চোখ বন্ধ করে কামড় বসালো।তারপর চিবোতে-চিবোতে ঋকের দিকে চাইলো।
-কি?হাঁ করে তাকিয়ে কি দেখছো?
হেসে ফেললো ঋক,বললো,
-কিছু না!
-আররে এত খাবো না-খাবো না করো কেন!তুমি ছাড়া ঘরের আর কোনো খাওয়ার মতো মানুষ নেই নাকি!
-কিন্তু আন্টিকে বললেই তো...
-বলেছিলাম,সন্ধ্যেবেলায় আমার ভাগেরটা খেয়েও নিয়েছি।এমনিতেই পেট ব্যথা করছিলো,পেট চেপে শুয়ে ছিলাম,আজ স্কুলে টিফিনের সময় লুচি-সুজি-মিষ্টি-চাউমিন সব একসঙ্গে গিলেছি।সবাই আজ এত ভালো-ভালো টিফিন এনেছিলো,কোনোটাই ছাড়তে পারছিলাম নাতো!!কি করবো!তার ওপর তোমাদের বাড়িতে আবার লুচি-মাংস,তারপর বাড়ি ঢুকেই সিঙ্গাড়া!হেব্বি পেট ব্যথা করছিলো সন্ধ্যেবেলা।মাকে বলিনি,বললেই তো চেঁচাবে!ওই এর-ওর থেকে গিলে এখন পেট ধরে কোঁকাচ্ছে!এখন যদিও একটু কমেছে,কিন্তু এখন সিঙ্গাড়া চাইলে মা তো আর দেবেই না,উল্টে আরও চেঁচাবে!একটু পরেই তো আবার রাতের খাবার সময় হয়ে যাবে।দিনদিন কেমন মোটা হচ্ছি দেখেছো!লম্বায় বাড়ছি না,কিন্তু চওড়ায় দেখো!!কি করবো বলো!
দিয়ার কথায় একবার দিয়ার দিকে ভালোভাবে তাকালো ঋক।ভীষণই পাতলা একটা জামা পরে রয়েছে ও।ওর শরীরের বিশেষ অংশতে হালকা যৌবনচিহ্ন ফুটে উঠছে।হ্যাঁ,আগের চেয়ে একটু ভারীই লাগে ওকে।মুখ ঘুরিয়ে দিয়ার শরীরের ওপর থেকে চোখটা সরিয়ে নিলো ঋক,
দিয়া তখনও একনাগাড়ে বকেই যাচ্ছে,
-খাবার দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না!তাই তোমার সিঙ্গাড়াটাও সাবড়ে দিলাম।এই তুমি রাগ করলে?
-হুম,বিশাল রাগ করেছি...
-হুহ!তাতে আমার বয়েই গেল!
হেসে উঠলো ঋক।সঙ্গে-সঙ্গেই ওর ডান গালের টোলটা আত্মপ্রকাশ করলো।ঋকের এই টোলটা দিয়ার খুব ভালো লাগে,ও ঋকের প্রায় ডানদিকেই বসেছিলো,সিঙ্গাড়া খেতে-খেতে বলে উঠলো,
-এই তোমার গালের এই টোলটা না আমার হেব্বি লাগে!!
-তাই?
-হুম!
দিয়া এগিয়ে এসে একহাতে ঋকের ডান গালটা টেনে চটকে দিলো।এবার আর মাথা তুলে দিয়ার দিকে তাকাতেই পারছে না ঋক।কোনোরকমে চোখ নামিয়েই বললো,
-আমি কিন্তু বিশাল রেগে গেছি!রাগ ভাঙানোর জন্য কি করবে?
-উমম,ম্যাচ চালিয়ে দিই?
-উঁহু!ওতে হবে না!
-দেন?
-নিমকিটা শেয়ার করো!তা হলেই হবে...
-রিয়েলি!?আররে থ্যাঙ্কু!
এক খাবলা নিমকি নিয়ে মুখে পুরলো দিয়া।ঋক এবার ওর দিকে চেয়ে দেখলো,কি অদ্ভুত ছেলেমানুষি খুশিতে দিয়ার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেছে....মাথা নীচু করে ও এবার প্লেট থেকে তুলে নিলো একমুঠো নিমকি...
সেই মুহূর্তেই নীলিমা ঘরে এসে বললো,
-এই দিয়া,আন্টি খিচুড়ি ভোগ দিয়ে গেছে,খাবি এখন?ঋক,তুই একটু খা বাবা?
-আন্টি প্লিজ,আমি আর খাবো না!
-আচ্ছা!তাহলে আমি প্যাক করে দিচ্ছি,বাড়ি নিয়ে যাস?মাকে বলিস,ওটা ভোগের প্রসাদ!
-আচ্ছা আন্টি!
-কিরে দিয়া,তুই খাবি কিনা বললি নাতো?
দিয়া আর বলবে কি?তখন তো ও মুখের মধ্যে সিঙ্গাড়া আর নিমকির সম্মিলিত দোকান খুলে বসেছে,কথা বলার মতো পরিস্থিতিই নেই।ঋকের পিছনে বসে তাড়াতাড়ি করে মুখ নাড়ছিলো ও।ঋক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নীলিমাকে বললো,
-ছেড়ে দাও আন্টি!একটু পরেই তো ডিনার করবে!দিয়াও না হয় পরেই খাবে,ফ্রিজে রেখে দাও...
-হুম,তাও তো বটে!বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গেছে!আচ্ছা,রেখেই দিচ্ছি তবে!কাল স্কুল থেকে এসে পারলে গরম করে খেয়ে নিস!
-হুম-হুম!
এটুকুই বলতে পারলো দিয়া।
নীলিমা বেরিয়ে গেলো।দিয়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।ঋককে বললো,
-আররে থ্যাঙ্কু!তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে!নইলে এক্ষুণি মা গলা ছেড়ে চেঁচাত!থ্যাঙ্কু-থ্যাঙ্কু!
-ইটস ওকে!এনইটাইম!কোনো ব্যাপার না...
অল্প হাসলো ঋক।তারপর বললো,
-এবার উঠতে হবে।রাত হয়ে গেছে।
-ওহ ওকে!বাড়ি গিয়ে ম্যাচ দেখবে,তাই তো?
-নাঃ!সামনেই এক্সাম।এবার একটু পড়তে বসতে হবে।ও আমি পরে হাইলাইট দেখে নেবো...
-আররে তুমি তো স্কুলের টপার!তোমার আবার চিন্তা কিসের?
-সেই জন্যই তো চিন্তাটা অনেক বেশি দিয়া।মা-বাবা অনেকটা আশা করে আমার থেকে।মুখে কিছু বলে না,কিন্তু আমি জানি!তাই আমাকেও তো এটুকু...
-হুম!বুঝতে পারছি!এক মিনিট ঋক...
-কি?
টিভির রিমোর্টটা হাতে নিয়ে চ্যানেলটা ঘুরিয়ে দিলো দিয়া।ঋক বললো,
-ঘুরিয়ে দিলে?দেখবে না তোমার প্রোগ্রাম?
-তুমি যাবার আগে স্কোরটা দেখে বেরোও,নইলে তো আবার বাড়ি গিয়ে ঋদ্ধিকে বলবে,দিয়া ম্যাচ দেখতেই দেয়নি।আর ও ব্যাটা নেচে-নেচে বলবে,জানি তো,ওই জন্যই তো আমি যাইনি...সেটা হবে না...
এবার বেশ সজোরেই হেসে উঠলো ঋক।
রান্নাঘর থেকে নীলিমা টিফিনবাক্সটা গুছিয়ে ডাইনিংয়ের টেবিলে রাখতে এসেছিলো।দিয়ার ঘরের দরজাটা প্রায় খোলাই ছিল,সেখান থেকে ঋকের প্রাণখোলা হাসি ভেসে আসছে।ছেলেটাকে খারাপ লাগে না নীলিমার,বরং বেশ ভালোই লাগে।বেশ ভদ্র,কথাবার্তা ভালো,পড়াশোনায় তো সাংঘাতিক!রমা ছেলেটাকে রত্ন তৈরী করছে!এখনও পর্যন্ত খুঁত ধরার মতো ঋকের মধ্যে কিছু পায় না নীলিমা।বেশ ভদ্রভাবেই আন্টি-আন্টি করে কথা বলে।খুব একটা চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারে না ঋক,মাথা নামিয়েই কথা বলে।দুই ভাই একেবারে দু-রকম।তবে ঋককেই বেশি ভালোলাগে নীলিমার।ভীষণ শান্ত-ভীষণ স্নিগ্ধ!নীলিমা আগে স্কুলে যাতায়াতের সময় খেয়াল করে দেখেছে,ঋক খুব একটা বেশি সংখ্যক বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও মেশে না।একটা-দুটো মুখচেনা ছেলেমেয়ের সঙ্গেই সবসময় ওকে দেখেছে নীলিমা।তবে দিয়ার সঙ্গে প্রথম থেকেই যেন ওর একটা আলাদা সম্পর্ক!ভীষণ হাসিখুশি থাকে ঋক,যখন দিয়ার সঙ্গে থাকে,এভাবে যদি চলে চলুক।দেখা যাক,ভবিষ্যতে কি হয় ওদের সম্পর্কের সমীকরণ...
আজকাল আর মিটিং ছাড়া নীলিমা স্কুলে একেবারেই যায় না,ওই সময়টায় অফিস থাকে।রমাদের গাড়িতেই ঋক আর ঋদ্ধির সঙ্গে দিয়া যাতায়াত করে এখন।ছেলেগুলো খারাপ তৈরী হয়নি।একেবারে ছোটবেলা থেকেই,খুব কাছ থেকে দুজনকে বড় হতে দেখছে তো নীলিমা।তাই এটুকু ভরসা ওদের করাই যায়,বিশেষ করে ঋকের ওপর,বরাবরই বয়সের চেয়ে যেন একটু বেশিই পরিণত ও।নীলিমা ভীষণই ভালোবাসে ঋককে...
-ওকে দিয়া!আমি উঠি!কাল আবার স্কুল আছে।
-হুম,ওকে!টাটা,এই শোনো,মা কিসব নিয়ে যেতে বলেছিলো,মাকে একটু বলে যেও,না নিয়ে চলে গেলে কিন্তু আবার আমাকেই বকবে...
-হুম!বাকি নিমকিগুলো মুখে পুরে ফাঁকা প্লেটটা ঋকের দিকে এগিয়ে দিলো দিয়া,
-যাবার সময় একটু বেসিনে রেখে যাবে প্লিজ?উঠতে ইচ্ছে করছে না!
-সে রেখে দিচ্ছি!কিন্তু কেন বলো তো?
-মাকে বোলো না,আবার একটু-একটু পেট ব্যথা করছে...
-সেকি?আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে একটা ফোন..
-এই,পাগল নাকি!বাড়ি যাও,আমি বরং জল খাই একটু...আর শোনো,মাকে কিছু বোলো না কিন্তু...
-কিন্তু দিয়া,তুমি বোধহয় এখন এসব না খেলেই পারতে... রাতে যদি শরীর আরও খারাপ হয়,তখন?
-তখন মা রমা আন্টিকে ফোন করবে,তোমরা চলে আসবে...কি!!আসবে না?
মাথা নামিয়ে নিলো ঋক।এর উত্তর ও কি দেবে!!দিয়ার কিছু হলে ও আসবে না আবার!!
-হুম,আসবো!চোখদুটো নামিয়েই ঋক বললো।
-ব্যাস,তবে!!
-চলি!
-হুম,টাটা!গুড নাইট!
ঋক উঠে দাঁড়ালো।বসা অবস্থাতেই একটু এগিয়ে গিয়ে একহাত দিয়ে আলগা করে ঋককে জড়িয়ে ধরলো দিয়া।ঋক নিজের মাথাটা নামিয়ে আনলো দিয়ার মাথার কাছে,তারপর আলতো করে নিজের বাঁ-হাতটা দিয়ার মাথায় বুলিয়ে দিলো...তারপর বেশ গভীর ভাবেই বললো,
-গুড নাইট!
নীলিমা রান্নাঘরে হাতের কাজগুলো সেরে একটা প্লাস্টিকে টিফিনবাক্সটা ভরে,সবে দিয়ার ঘরের দিকেই আসছিলো,ঋকের হাতে ওগুলো ধরিয়ে দেবে বলে।কিন্তু বাইরে থেকে ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে একটু থমকে গেলো ও।ভীষণই স্বাভাবিক আর নিষ্পাপ একটা মুহূর্ত।নীলিমা জানে,ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে ওদের স্কুলেও সব বন্ধুদের সঙ্গেই দিয়া এই জিনিসটা করেই থাকে,এমনকি সবাই তাই করে।এইভাবেই জড়িয়ে ধরে "বাই" বলা,কাঁধে হাত রাখা,বা রাস্তাঘাটে হঠাৎ কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে তাকে জড়িয়ে ধরা,যুগ এখন অনেক পাল্টেছে,এসব নিয়ে কেউ আর আজকাল বেশি মাথা ঘামায় না।আগে নীলিমাদের সময়ে এসব কেউ ভাবতেও পারতো না,কিন্তু এখন দিয়ার কাছে এসব কোনো ব্যাপারই না।খোলামেলাভাবেই মিশে অভ্যস্ত আজকালকার ছেলেমেয়েরা।অন্য কেউ হলে হয়তো নীলিমার ব্যাপারটা এতটা চোখে লাগতো না,কিন্তু ঋকের বুকে দিয়াকে এভাবে দেখে নীলিমার কেমন একটা লাগলো যেন!তার কারণ হয়তো এটাই,রমা বহু বছর আগে থেকেই একটা প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে,তাই হয়তো ঋককে ঠিক দিয়ার বন্ধু হিসেবে আর দেখতে পারে না নীলিমা।চোখ নামিয়ে নিয়ে নীলিমা সরে গেলো ওখান থেকে...
একটু পরেই ঋক রান্নাঘরের দিকে এলো একটা ফাঁকা প্লেট হাতে নিয়ে,
-আন্টি...
-হ্যাঁ বাবা বল!
-এই যে প্লেটটা!
-হ্যাঁ দে!
-আমি আসি আন্টি,কি দেবে বলেছিলে?প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ঋক বললো।
-হুম চল!ওই ডাইনিং টেবিলে গুছিয়েই রেখেছি।আয়...
-হুম,চলো!
-আসছি আন্টি,গুড নাইট!
-হুম সাবধানে যাস বাবা,গুড নাইট!
জুতো পরে বেরিয়ে গেলো ঋক।ডাইনিংয়ের বড় আলোটা নিভিয়ে ছোট আলোটা জ্বালালো নীলিমা।তারপর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নীলিমা দেখলো,একটু পরেই গাড়িতে গিয়ে বসলো ঋক,সামনের চায়ের দোকানটা থেকে গোবিন্দদাও দৌড়ে এসে গাড়িতে বসলো।জানলা থেকে সরে আসছিল নীলিমা,হঠাৎই ওর চোখে পড়লো,ঋক গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে একবার দেখলো দিয়ার ঘরের দিকে,দিয়ার ঘরের জানলা খোলা,কিন্তু পর্দা দেওয়া।হাওয়ায় পর্দাগুলো অল্পবিস্তর উড়ছে।নীলিমা মেয়ের ঘরের দিকে একবার চেয়ে দেখলো,দিয়া বিছানার ওপর উপুড় হয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে টিভি দেখছে,আর হেঁড়ে গলায়,গলা ছেড়ে গান করছে,জানলা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে রয়েছে ও।আবার ঋকের দিকে দেখলো নীলিমা,দিয়ার জানলার দিকে একভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়েছিল ও,হঠাৎ বোধহয় ডাইনিংয়ের আধো-অন্ধকারে নীলিমাকে দেখতে পেয়েছে ঋক,তাড়াতাড়ি করে ও সরে গেলো গাড়ির জানলা থেকে।ভিতরে ঢুকে বসলো...
নীলিমাও জানলা থেকে সরে গেলো।ঠিকই ভেবেছিলো ও,ঋকের দিক থেকে দিয়ার প্রতি ছোটবেলা থেকেই যে বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতিটা ছিল,সেটার পরিবর্তন ঘটে গেছে।দিয়া ওর কাছে আর শুধুমাত্র বন্ধু নয়,তার থেকেও বেশি কিছু!ঋকের আবেগের প্রকাশ খুব কম,ভীষণই চাপা ছেলেটা,কিন্তু আজ দিয়াকে জড়িয়ে ধরার সময় ঋকের অভিব্যক্তি দেখেই নীলিমা কিছুটা বুঝতে পেরেছিল,দিয়া দাঁত বের করতে-করতে,বকতে-বকতে একহাতে ওকে আলগা করে জড়িয়ে ধরেছিলো ঠিকই,কিন্তু ঋক মুখ ডুবিয়ে দিয়েছিলো দিয়ার চুলে।আর এখন যেটা নীলিমা দেখলো,তারপর তো আর সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।কিন্তু এই বয়ঃসন্ধিকাল সময়টা তো ভালো না।এই সময়ের নিষ্পাপ ভালোলাগা কতদিন থাকবে,আদৌ থাকবে কিনা,তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।এই ধরণের সম্পর্ককে সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া,আর অপেক্ষা করা ছাড়া,আর কোনো উপায় তো নীলিমা আপাতত দেখছে না...
-কিরে,পড়তে বোস দিয়া...চেঁচালো নীলিমা।তারপর রান্নাঘরে দৌড়ে ঢুকলো ও,সিটি পড়ছে...
চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসছে দিয়ার।কি প্রচন্ড পেট ব্যথা করছে ওর।উফফ!আজ না খেলেই হতো ওগুলো!!সেই সন্ধ্যে থেকেই উপুড় হয়ে বালিশে পেট চেপে শুয়ে আছে ও।কিন্তু এবার যন্ত্রণায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর।দাঁতে-দাঁত চেপে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো ও,একটু পর ঘুমিয়ে পড়লো...ঘরের টিভিটা তখনও হাঁ-হাঁ করে চলছে...
-কিরে দিয়া?স্কুলের কি হোমওয়ার্ক আছে....
ঘরে ঢুকে নীলিমা দেখলো,বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে হাঁ করে ঘুমিয়ে রয়েছে দিয়া!কি ভীষণ ক্লান্তির ছাপ সারাটা মুখ জুড়ে।খোলা চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে।চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিয়ে,ঘুমন্ত মেয়ের কপালে একটা চুমু খেলো নীলিমা,তারপর মাথায়।গতকালই মেয়েকে শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়েছিলো নীলিমা,সেই গন্ধটা এখনও ওর চুলে মিশে আছে।মেয়ের গায়ে একটা চাদর টেনে দিলো নীলিমা,তারপর ওর কাপবোর্ড খুলে রুটিন দেখে পরদিনের স্কুলব্যাগটা গুছিয়ে দিলো ও...থাক,ঘুমোক!আজ আর পড়ার দরকার নেই।কাল আবার স্কুল,টিউশন,সারাদিনই তো যুদ্ধ চলবে,সেই সন্ধ্যে পর্যন্ত!আজ বরং একটু ঘুমোক...
ফাঁকা ঘরে টিভিটা চলেই যাচ্ছিলো।নীলিমা বন্ধ করে দিলো টিভিটা।
রাত তখন দশটা....
নীলিমা টেনে তুললো ঘুমন্ত মেয়েকে।চোখ টেনে খুলতেই পারছে না দিয়া।কোনোরকমে মায়ের কোলের ওপর শুয়ে-শুয়ে দুটো খেয়ে নিলো।মা-ই ভাত মেখে খাইয়ে দিলো।সেই সঙ্গে অবশ্য মা বকেই যাচ্ছে অনর্গল।কিন্তু ঘুমের চোটে সেইসব আর মাথায় ঢুকছে না দিয়ার।খেয়ে কোনোরকমে বেসিন থেকে মুখটা ধুয়ে এসেই উল্টে পড়লো বিছানায়....ধপাস!
নীলিমা বেসিনের বাসনগুলো মেজে,বাথরুমে গা ধুয়ে রণ-র ছবির সামনে এসে দাঁড়ালো।আজকাল আর একদম কষ্ট হয় না ওর।দিয়ার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে কোথায় যেন সব কষ্টগুলো হারিয়ে গেছে।আর সেটাই স্বাভাবিক,ক্ষতই তো!!সেটা শারীরিক হোক,আর মানসিক,সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ঠিক হয়েই যায়!সারাদিন অফিসে খাটনির পর,সন্ধ্যেবেলা মেয়ের সঙ্গে বকবক করতে-করতেই সময় কেটে যায় নীলিমার।সংসারের সব কাজকর্ম সেরে যখন ও বিছানায় যায়,তখন শরীর আর চলে না ওর!মাথায় তখন ঘুরতে থাকে,দিয়া সকালে উঠে কি টিফিন নেবে,সবার সঙ্গে বসে খাবে,একটু বেশি করেই বানিয়ে দিতে হবে,ঋদ্ধিটাও তো সঙ্গে থাকে!ও আবার নীলিমার হাতের চাউমিনটা খেতে খুব ভালোবাসে!কাল সকালে আবার কাকা দুধ দিতে আসবে না,বেড়াতে গেছে!ওনার ছেলে আসার কথা,ঠিক সময়ে আসবে তো!না এলে মেয়েটা কি খেয়ে স্কুলে যাবে!সংসারের সাতকাহন সামলাতে-সামলাতে নিজের দিকে আর ফিরে তাকানো হয় না আর!তবে প্রতিরাতে গা ধুয়ে ভিজে চুলে একবার রণ-র ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ও,এত বছরে এটাতে একদিনও ভুল হয়না।নীলিমার ছায়াটা একবার গিয়ে পড়ে রণ-র মুখের ওপর।দুজনে একাত্ম হয়ে যায় ওই মুহূর্তটায়।সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে এটুকুই বড় শান্তি দেয় নীলিমাকে।মনে হয় জীবনের সব প্রাপ্তিটুকু ওখানেই।তারপর পরম প্রশান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ও।আজকাল আর শরীরের খিদেটা খুব একটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে না।ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বেশ কেটে যায় রাতগুলো...
রণ-র ছবিতে গভীর ভালোবাসায় একটু চুমু খেয়ে ঘরের ছোটো আলোটা জ্বালিয়ে বিছানায় গেলো নীলিমা...
রাত তখন প্রায় বারোটা।সামনে ইংরেজি বইটা খোলা রয়েছে,কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারছে না ঋক।অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে ওর সদ্য-যৌবনপ্রাপ্ত মন!আজ প্রথম নয়,এর আগে বহুবার-বহুভাবে ওকে জড়িয়ে ধরেছে দিয়া।কখনো ঋদ্ধির সঙ্গে মারপিট করে,এলোমেলো চুলে কাঁদতে-কাঁদতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে সামনে থেকে।আবার কখনও দৌড়ে এসে পিছন থেকে চোখ টিপে ধরেছে,ওর নাম বলতে পারলেই পিছন থেকে ঋকের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়েছে মেয়েটা।আজকাল আর দিয়া খুব একটা গায়ে হাত দেয় না।আসলে বড় হয়ে যাচ্ছে তো!বেশ খানিকটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।অনেকদিন পরেই আজ ঋকের গাল টিপে দিলো দিয়া।সব মিলিয়ে আজকের অনুভূতিটা যেন একদম অন্যরকম!আজ যখন দিয়া ওকে জড়িয়ে ধরলো,ও মুখটা নামিয়ে এনেছিলো ওর মাথার কাছে,ওর চুলের গন্ধটা অদ্ভুত ভালো লাগছিলো ঋকের।মাথাটা ঘুরে গিয়েছিলো যেন।বুকের মধ্যে কিরকম একটা অনুভূতি কাজ করছিল সেই সময়!আর নিজেকে বাঁধতে পারেনি ঋক,আর একটু এগিয়ে নিজের নাকটা ডুবিয়ে দিয়েছিলো ওর ঘন একরাশ খোলা চুলে।প্রাণভরে নিয়েছিলো ওর চুলের গন্ধটা...এখনও যেন ওর সারা শরীরে সেই ভালোলাগার রেশটুকু ছড়িয়ে আছে।বইয়ের ছাপার অক্ষরগুলো চোখের সামনেই যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে,কিছুতেই ওদের এক-জায়গায় করতে পারছে না ঋক!বইয়ের মধ্যে একটা পেন রেখে,ও বন্ধ করে দিলো বইটা।নাঃ!আজ আর হবে না!ভীষণ অস্থির লাগছে মনটা।তার চেয়ে এখন শুয়ে পড়াই ভালো,ভোরবেলা উঠে পড়তে বসবে!নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরোলো ঋক।ডাইনিংয়ের আলোটা জ্বালিয়ে ভাইয়ের ঘরের দরজাটা একটু ঠেলে ঢুকলো ও।অঘোরে ঘুমোচ্ছে ঋদ্ধি।মা বলছিলো,রাতে খাওয়ার পর ভাইয়ের একটু জ্বর এসেছিলো।মা অবশ্য ওষুধ খাইয়েই দিয়েছিল।ঋক একবার ঋদ্ধির কপালে হাত দিয়ে দেখলো,না,এখন আর জ্বর নেই।ভালো করে ভাইয়ের গায়ে মোটা চাদরটা টেনে দিলো ঋক।পুজো চলে গেছে বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে,সারাদিন ফ্যান চালালেও,রাতের দিকে আর ভোরবেলায় বেশ ভালোই ঠান্ডা লাগে।ঘুমন্ত ভাইকে আরও একটু আদর করে,ঋদ্ধির ঘরের দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে এলো ঋক।
তিনতলা বাড়ি ওদের।একদম নীচের তলায় গোবিন্দ কাকা,ঝর্ণা মাসি-এরা থাকে।দোতলায় দাদু আর বাবা-মা থাকে।আর একদম ওপরের দুটো ঘরে ওরা দুই ভাই থাকে।আর পাশের একটা ঘর ফাঁকাই পড়ে আছে।ওটাতে কেউ থাকে না।তিনতলায় একটাই কমন বাথরুম,ডাইনিংয়ে।আর তারপর ছাদ।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো ঋক।দরজাটা ভেজিয়ে দিলো ও।মায়ের কড়া নির্দেশ,কোনো ভাই দরজা বন্ধ করতে পারবে না!তাই ওরা রাতে দরজা ভেজিয়েই ঘুমোয়!কিছুতেই চোখে ঘুম আসছে না,আবার পড়াতেও মন বসাতে পারছে না।এতো মহা জ্বালা!নিজের কম্পিউটারের দিকে এগোলো ঋক,একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো ও।সেই বিশেষ ফোল্ডারটা খুললো।একবার ক্লিক করতেই একে-একে বেরিয়ে এলো দিয়ার শত-শত ছবি।এক্কেবারে প্রথম বছর ওর জন্মদিনে যখন ওরা দিয়াদের বাড়ি গিয়েছিল,সেই সময়কার ছবিও আছে,বাবা তুলেছিল তখন।পরে ঋক বাবার থেকে নিয়ে নিয়েছে।ঋদ্ধি আর দিয়া একসঙ্গে হাত ধরে কেক কাটছে!!একের পর এক দিয়ার ছবি দেখতে লাগলো ঋক,সময়ের কোনো হিসেব রইলো না আর।একটু-একটু করে দিয়ার বড় হয়ে ওঠার প্রত্যেকটা মুহুর্ত বন্দী রয়েছে ঋকের কম্পিউটারের ফোল্ডারে।এক-একটা ছবির পিছনে এক-একটা সোনালী মুহূর্তের গল্প।ছোটবেলার সেইসব অমূল্য স্মৃতিগুলো মনে করে,বারংবার ঋকের ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি এসে জমা হচ্ছিলো।প্রচন্ড ঘুম পেয়ে যখন চোখদুটো জ্বালা করছে,তখন ঋক ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো,রাত দুটো!
"বাআআপরে!হয়ে গেলো ভোরবেলা উঠে পড়াশোনা করা!!" বলে মনিটরটা বন্ধ করে একলাফে চেয়ার ছেড়ে উঠলো ও,ঢকঢক করে একটু জল খেলো।তারপর ধপাস করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো ঋক...
(চলবে)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন