অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২২

ত্রিভুজ (সপ্তম পর্ব)


 


ত্রিভুজ

সাথী দাস

সপ্তম পর্ব



কাঁধে হাত দিয়ে টানতে-টানতে ঋদ্ধি দিয়াকে ডাইনিংয়ে নিয়ে এলো,তারপর রান্নাঘরের সামনে নিয়ে গিয়ে বললো,
-এই যে মা,তোমার মেয়ের ঘুম ভাঙলো!
রান্নাঘরে হাতের কাজ ফেলে দিয়ার দিকে এগিয়ে এলো রমা,সেই সঙ্গে বলতে শুরু করলো,
-সেই তুই টেনে তুললি মেয়েটাকে?তোকে বারণ করলাম না!তারপর দিয়ার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো,
-কিরে মা?ঠিক আছিস এখন?
-হ্যাঁ আন্টি!
-ব্যথাটা কি...
-একটু কমেছে গো!
-হুম,আজকের দিনটা যাক,ঠিক হয়ে যাবে।
ঋদ্ধি বলে উঠলো,
-ব্যথা?কিসের ব্যথা?
-ও তোমার জেনে কাজ নেই!বলেই রমা আবার চলে গেলো রান্নাঘরে।
ঋদ্ধি দিয়ার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো,
-কিসের ব্যথা রে?
দিয়া বললো,
-তেমন কিছু না,একটু পেটব্যথা!
-ও পেটব্যথা!হ্যাঁ,সেতো হবেই!বলেছিলাম না সেদিন,অত গিলিসনা,অত গিলিসনা,শুনেছিলিস আমার একটাও কথা!তোর পেট ব্যথা হবে না তো কার হবে!
-হ্যাঁ!সেই-সেই!!ছাড় দেখি আমায়,বাথরুমে যাবো!
-যা!তাড়াতাড়ি বেরোবি!নইলে তোর ভাগ থেকে দু-একটা লুচি কমে গেলে,আমায় কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারবিনা!
দিয়া কিছু না বলে একটু হেসে বাথরুমের দিকে এগোতে যায়।ও ডাইনিংয়ে বেরিয়ে আসার পরই সোফায় উঠে বসেছিলো ঋক।এবার দিয়া বাথরুমের দিকে যাওয়ার সময় সোফার সামনে এসে একবার দাঁড়ালো,ঋক উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বললো,
-ঠিক আছো এখন?
চোখ নামিয়েই দিয়া বললো,
-হুম!
-ওকে!দিয়া?
-বলো..
-তোমায় একটি কথা বলি!এটা একদম সাধারণ একটা ব্যাপার,তুমি এটার জন্য এতটা লজ্জা...
-ঋক!
মাথা তুলে ঋকের চোখের দিকে তাকালো দিয়া।
-বলো...
-থ্যাঙ্কু ফর এভরিথিং!
-ইটস ওকে!
-আজ তুমি না থাকলে জানিনা আমি কি করতাম!
-আমি ছিলাম তো!
-হুম!একটু হাসলো দিয়া।
-নিজের খেয়াল রেখো!তুমি ঠিক আছো তো?আমি তাহলে বেরোলাম!
-কোথায়?
-টিউশন আছে।মা বললো,আজ তুমি আর ঋদ্ধি টিউশন যাবে না,আমার সায়েন্স টিউশন আছে,আমিও ভেবেছিলাম যাবো না!কিন্তু তুমি যখন ঠিকই আছো...
-আমি একদম ঠিক আছি।তুমি বেরিয়ে যাও!
-ওকে!মা..আমি বেরোলাম!চেঁচালো ঋক।
-কোথায় যাবি?
-সায়েন্স টিউশন!
-আজ যাবি না বললি যে?
-নাঃ,সময় আছে এখনও।চলেই যাই!
-আচ্ছা!দুটো লুচি খেয়ে যা!
-এখন আর কিছু খাবো না মা...ওপরে গেলাম আমি রেডি হতে।বাই দিয়া!
-হুম,বাই!
ঋক রিমোর্টটা সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলে ওপরে চলে গেলো,দিয়া বাথরুমে ঢুকলো,ঋদ্ধি তখন রান্নাঘরে কোন লুচিটা বেশি ফোলা সেই হিসেবেই ব্যস্ত!
যখনই রমার ফোনটা এসেছে,তখন থেকেই আর কাজে মন বসাতে পারছে না নীলিমা।যে দিনটায় নীলিমাকে দিয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন,সেই দিনটাতেই ও দিয়ার সঙ্গে থাকতে পারলো না।আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবে ভেবেছিলো,তাও বেরোতে-বেরোতে সেই বিকেল হয়েই গেলো।ঘড়ির দিকে তাকাতে-তাকাতে হুড়োহুড়ি করে রমার বাড়িতে ঢুকলো নীলিমা।সিঁড়িতেই দেখা হলো ঋকের সঙ্গে।ও ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছিলো।নীলিমাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ও,
-আন্টি!আজ তুমি তাড়াতাড়ি এলে?
-হ্যাঁ,আসলে ওই রমা একটু ফোন করেছিলো....আর কিছু বললো না নীলিমা,চুপ করে গেলো।কিন্তু ঋক ততক্ষণে বুঝে গেছে মা ফোন করে আন্টিকে কি বলেছে!ও পরিস্থিতিটাকে একটু সহজ করার জন্য বললো,
-ও,আচ্ছা আন্টি!যাও,মা ওপরেই আছে।
-তুই কোথায় যাচ্ছিস ঋক?
-টিউশন আন্টি!আমার ফিরতে রাত হবে।গোবিন্দ কাকা তোমাদের বাড়িতে ছেড়ে আসবে।আমি বলে যাচ্ছি।
-নানা!এটুকু রাস্তা আমি আর দিয়া হেঁটেই চলে যেতে পারবো।
-জানি আন্টি!যেও,কিন্তু অন্যদিন।আজ গোবিন্দ কাকাই দিয়ে আসবে তোমাদের।
দৃঢ় কণ্ঠে কথাটুকু বলে মাথাটা নামিয়ে নিলো ঋক।নীলিমা বুঝতে পারলো,ঋক আর কথা বাড়াতে চাইছে না।ছেলেটা এমনিতেই খুব কম কথা বলে,তবে যেটুকু বলে,কাজের কথাই বলে।রমা ফোনে যা বললো,ঋক না থাকলে আজ দিয়া ভীষণ অসুবিধায় পড়ে যেত।এমনকি রমাদের গাড়িও আজ যায়নি,ঋক ট্যাক্সি করে ওকে একেবারে বাড়ির দরজা পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
নীলিমাও আর কথা বাড়ালো না।ও ঠিক করলো,ঋক যখন তাই চায়,তবে তাই হবে।আজ এই ছেলেটা অনেক করেছে দিয়ার জন্য!নীলিমার দিক থেকে অপত্য স্নেহ আর ভালোবাসা তো ঋকের প্রতি বরাবরই ছিল,আজকের পর তার সঙ্গে অনেকটা সম্মান আর অনেকটা শ্রদ্ধাও যুক্ত হলো।ঋক বললো,
-আমি আসছি আন্টি!টাটা!
-হুম,আয় বাবা,সাবধানে যাস!টাটা!
সিঁড়ির কোণা থেকে সাইকেলটা বের করে চালিয়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে গেলো ঋক।নীলিমা ওপরে উঠে এলো।একবুক ভীতি নিয়ে মেয়ের দিকে চাইলো নীলিমা,কিন্তু দিয়া ততক্ষণে টেবিলে বসে ঋদ্ধির সঙ্গে লুচি খেতে মন দিয়েছে।বেশ অবাক হয়ে গেলো নীলিমা,কি সুন্দরভাবে সবটুকু সামলে নিয়েছে রমা।ও দিয়ার গর্ভধারিনী মা হয়েও ওর সবচেয়ে প্রয়োজনের দিনে পাশে থাকতে পারলো না,কিন্তু রমা কত সহজে পুরো ব্যাপারটা গুছিয়ে নিয়েছে।ওকে তো আর প্রয়োজনও পড়লো না!মাকে দেখে উঠে দাঁড়াতে গেলো দিয়া,কিন্তু তার আগেই ওর কাছে এগিয়ে গেলো নীলিমা নিজেই....
কয়েক বছর পরে একদিন বিজ্ঞানের ক্লাসে...
-কেমন ছোটলোকের মতো ঋদ্ধি হাসছে দেখ!মনে হচ্ছে ঘুষি মেরে দাঁতগুলো সবকটা ভেঙে দিই!গুঞ্জা দিয়াকে বললো!
দিয়া চেয়ে দেখলো,সত্যিই ঋদ্ধি সারি-সারি দাঁতের দোকান খুলে ওদের দিকেই চেয়ে আছে।হাসি পেয়ে গেলো দিয়ারও।মুখ টিপে ও একটু হেসে নিলো!
বিষয়টা তেমন কিছুই না,সেদিন ক্লাসে পড়ানো হচ্ছিলো,"রিপ্রোডাকশন এন্ড হেরিডিটি!" অর্থাৎ "জনন ও বংশগতি!" এমনিতেই এই অধ্যায়টা খোলার সঙ্গে-সঙ্গেই ক্লাসে মৃদু গুজগুজ-ফুসফুস শুরু হয়ে গেছে,তার ওপর ঋদ্ধি এখন যেভাবে দাঁত বের করে রয়েছে,দিয়ার প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেলো।কোনোরকমে নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কেটে হাসিটা বন্ধ করলো ও।সেদিন টিফিনের সময় ঋদ্ধি দিয়া আর গুঞ্জাকে জিজ্ঞেস করলো,
-এই শোন,তোরা জানতিস এতকিছু হয়?
কাঁচা গালাগালি দিয়ে টিফিনবক্স নিয়ে সোমদত্তর ডেস্কে উঠে গেলো গুঞ্জা।
-যাহ বাবা!খিস্তি দিয়ে গেলো আমায়!কি এমন বললাম আমি!ঋদ্ধি অবাক হয়ে বললো।
-এই তুই বল তো দিয়া,তুই জানতিস,যে এতকিছু হয়!
-কি এতকিছু?না জানার ভান করে দিয়া বললো।
-এই যে, এক্স-এক্স, ওয়াই-ওয়াই, এক্স-ওয়াই... এইসব ব্যাপারগুলো!আর তাছাড়া...
-না জানার কি আছে?!একমনে টিফিন খেতে-খেতে মাথা নামিয়ে দিয়া বললো।
-জানতিস?কোনোদিন বলিসনি তো আমায়?এই নাকি আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড?তুই সবকিছু শেয়ার করিস আমার সাথে!
হেসে ফেললো দিয়া।তারপর বললো,
-মেয়েরা অনেক কিছুই একটু আগে-আগেই জেনে যায় স্টুপিড!তার জন্য কি গলা ফাটিয়ে বলে বেড়াতে হবে!চাউমিন আর একটু নে,মা তোর জন্য বেশিই পাঠিয়েছে!
-দে!এই তুই কি ডায়েট করছিস নাকি!
-নাতো!কেন?
-নাঃ,এত উদার হস্তে চাউমিন দিয়ে দিলি?আগে তো মারপিট করে কেড়ে নিতে হতো!
-ধুর!এখন আর অত খেতে ভালো লাগে না!
-তাই তো বলি,দিনদিন এত রোগা আর সুন্দর হচ্ছিস কি করে!!স্ট্রিক্ট-ডায়েট!
-সুন্দর!হাঃ!তুই চোখের ডাক্তার দেখা রে!রোগা নয় লম্বা হয়েছি,তাই রোগা লাগছে!আমার খাওয়া হয়ে গেছে,আমি বেসিনে গেলাম।যাবি তুই?নাকি তিতিরের সঙ্গে...
-উফফ!দিনরাত এই তিতির-তিতির করিস না তো!আমার জাস্ট অসহ্য লাগে।
-ওরম বলিসনা!কত্ত ভালোবাসে তোকে!তোর দিক থেকে তো চোখ ফেরাতেই পারে না!স্বাভাবিক!এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে!
-এই ফালতু কথা কম বল!হাত ধুতে যাবি তো?
-হুম,চল!টিফিন-বক্স ব্যাগে রাখতে-রাখতে দিয়া বললো।
-এই দাঁড়া তো,কই দেখি তুই কেমন লম্বা হয়েছিস?
দিয়াকে টেনে নিজের পাশে দাঁড় করালো ঋদ্ধি।তারপর বললো,
-ফু!এখনও তো আমাকেই ছাড়াতে পারলি না!যেদিন পারবি,সেদিন বুঝবো,লম্বা হয়েছিস!
হেসে ফেললো দিয়া।দুজনে বেরোলো ক্লাসের বাইরে।তখন গুঞ্জা আর সোমদত্ত হাসিমুখে একেবারে মুখোমুখি বসে টিফিন খাচ্ছে!ওদের এক নজর দেখে ঋদ্ধি বললো,
-এদের প্রেম দেখলে না আমার কিরম একটা লাগে!
-কিরম লাগে?দিয়া বললো।
-না মানে,এত্ত প্রেম?এই একজনের সঙ্গে কিভাবে সারাটা জীবন কাটাবে ছেলেটা?
-এক্সকিউজ মি,হোয়াট?
-না,সিরিয়াসলি!সারাদিন সেই এক মুখ,আবার পরের দিন,আবার পরের দিন!তারপর সারাটা জীবন!বাপরে!ভেবেই তো দমবন্ধ হয়ে আসে আমার!
-তুই সত্যিই গালাগাল খাওয়ারই কথা বলিস রে।গুঞ্জা তোকে এমনি-এমনি গাল দেয় না!
-না,তুই ভেবে দেখ দিয়া..
-ঋদ্ধি!তুই একবার ভেবে দেখ,রমা আন্টি আর সৈকত আঙ্কেলের কথা,তা হলেই বুঝে যাবি!
-মা-বাবা সুপারম্যান আর সুপারওম্যান!ওরা পেরে গেছে ভাই!কিন্তু তাই বলে...
-সবাই পারে না ঋদ্ধি!ইনফ্যাক্ট যারা একটা মানুষের সঙ্গেই সারাটা জীবন থাকতে চায়,তারা পারে না...আমি জানি তো,তারপর না পারে নতুন করে শুরু করতে,না পারে পুরোনোকে শেষ করতে!শুধু ওই অতীতটা নিয়েই...চুপ করে গেলো দিয়া।
ঋদ্ধি এতক্ষণ বেশ হেসে-হেসে মজা নিয়েই কথা বলছিল।কিন্তু ও বুঝতে পারেনি,মজাটা এতদূর চলে আসবে,আর দিয়াকে ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করবে!ও তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-দিয়া!আই এম সো সরি!আমার তোকে হার্ট করার কোনো ইন্টেনসন...
-আই নো ঋদ্ধি,লিভ ইট!ওয়াশরুমে গেলাম আমি!তুই ততক্ষণে দেখ,তোর তিতির কি করছে!
-ওহ গড!নট এগেইন!
হেসে বেসিনের সামনে থেকে বাথরুমের দিকে চলে এলো দিয়া।বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো,বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ঋক পকেট থেকে রুমাল বের করছে।দিয়া এগিয়ে গেলো ওর দিকে,
-হাই!
-ওহ,হাই!দিয়া!ভাই কোথায়?
-এই তো!আচ্ছা ঋক,ঋদ্ধিকে না পেলেই কি দিয়াকে জিজ্ঞেস করতে হয় সবসময়?এই রমা আন্টিও দেখি তাই করে!ঋককে পাচ্ছে না,দিয়া!ঋক কোথায় গেলো রে!ঋদ্ধিকে পাচ্ছে না!দিয়া!ঋদ্ধি কোথায় রে!কেন গো?!
হেসে ফেললো ঋক।ডান গালের স্বল্প দাড়ির ফাঁক দিয়ে ভেসে উঠলো হালকা টোল।হেসেই বললো ও,
-না মানে,তোমার সঙ্গেই তো সবসময় থাকে!তাই আর কি....
-হ্যাঁ,এতক্ষণ তো আমার সঙ্গেই ছিল,কিন্তু এখন আমি তো আর ওকে,পকেটে নিয়ে লেডিস ওয়াশরুমে ঢুকতে পারি না!তাই বাইরেই রেখে গিয়েছিলাম।এখন বেরিয়ে দেখছি নেই,কি করবো আমি!হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদি এবার!
প্রচন্ড হাসি পেয়ে গেলো ঋকের।মন খুলে হেসে উঠলো ও।মেয়েটা এত্ত কথা বলে,যে ওর মন খারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যায়!প্রজেক্টে কিছু নম্বর কম থাকায় একটু মনখারাপ ছিল ঋকের।কিন্তু দিয়া মনটা ভালো করে দিলো।দিয়া সঙ্গে থাকলে কিভাবে যে হেসে ওঠে ও,নিজেও বুঝতে পারে না!ওরা দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো,আর একটু দূর থেকে ওদের একভাবে দেখছিলো সে।খুব বেশিক্ষণ ঋক আর দিয়াকে একসঙ্গে দেখতে পারলো না ও।তাড়াতাড়ি ঋকের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-প্রান্তিক!তোর প্রজেক্টের কপিটা আমায় একটু দেখাতে পারবি?
-হ্যাঁ,আসছি!এক মিনিট দাঁড়া!আবার দিয়ার দিকে ফিরে কথা বলতে থাকে ঋক।
-মানে এক্ষুণি হলেই ভালো হতো!সে বললো।
-ওকে ঝিনুক!আই এম কামিং!জাস্ট ওয়ান মিনিট!
দিয়া একবার ঝিনুকের মুখের দিকে একবার ঋকের মুখের দিকে তাকায়।তারপর ঝিনুকের দিকে চেয়ে বলে,
-ভালো আছো ঝিনুক দি?
-হ্যাঁরে ভালো!তুই ভালো?
-একদম!ওকে ঋক,তোমরা কথা বলো,আমি আসি!পরের ক্লাসের কিছু হোমওয়ার্ক বাকি আছে,সেটা একটু...
-সালা বাপের পয়সায় ফুটানি করবে,মেয়ে চড়িয়ে বেড়াবে,আবার বললেই গায়ে ঝাল লেগে যায়!তোর মত ওই রকম সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালে,আমিও সালা দেখিয়ে দিতাম মেয়েবাজি কাকে বলে!
-বাপ তুলে কথা বলবি না বলে দিলাম!মেরে তোর মুখ আমি ভেঙে...
দিয়ার কথা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়।
-ঋদ্ধির গলা না?!বলে ঋকের দিকে তাকায় দিয়া,কিন্তু দিয়ার কথা শোনার জন্য তখন আর ঋক ওখানে দাঁড়িয়ে নেই।ও ততক্ষণে ভাইয়ের গলা পেয়েই ছুটেছে একটু দূরের জমায়েতের দিকে।দিয়া আর ঝিনুকও ছুটলো ঋকের পিছন-পিছন।
ওখানে পৌঁছে দিয়া দেখলো,সোমদত্ত আর সঙ্গে আরও একটা ছেলে,দুজনে মিলে টেনে ধরে রাখতে পারছে না ঋদ্ধিকে।ও তেড়ে-তেড়ে মারতে যাচ্ছে একটা ছেলেকে।দুজনেরই সমানভাবে মুখ চলছে!কেউ-কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না!ঋক দৌড়ে গিয়েই আগে ভাইকে ঠেলে সরিয়ে দিল ওখান থেকে।ঋককে সরিয়ে দিয়েও সামনের ছেলেটাকে মারতে গেলো ঋদ্ধি!দিয়া আর ঝিনুক একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে,গুঞ্জা ওদের দেখে ছুটে এসে ওদের পাশে দাঁড়ালো।
-কি হয়েছে রে গুঞ্জা?দিয়া অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করলো গুঞ্জনকে।
-আর বলিস না,জানিসই তো বিকাশকে,সবার পিছনে কাঠি করা স্বভাব!আজ একেবারে ঋদ্ধির মুখের সামনে পড়ে গেছে!তেড়ে গেছে ঋদ্ধি!দিক না,আরও দিক!
-কি হয়েছে প্লিজ বলবি?
কান-মাথা ধরিয়ে দিয়ে তখনই ঘন্টা পড়ে গেলো,টিফিনের সময়সীমা শেষ।ঋক তখনও ভাইকে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে,দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও নিজে।ঋদ্ধি তখনও লাফাচ্ছে,
-তুই জানিস না ভাই ও কি বলেছে!বাপ-বাপ-বাপ!সবসময় আমার বাপ তুলে কথা!তোর বাপের টাকা!আমার বাপের টাকা,আমি যা খুশি করবো!তোর কি!দাঁড়া!তোর ওই জিভ আমি টেনেই ছিঁড়ে ফেলবো আজ!
-ভাই,ক্লাসে যা!চেঁচিয়ে ওঠে ঋক।
-ভাই তুই সরে যা...
-ঋদ্ধি,ক্লাসে যাবি তুই,এক্ষুণি!যা!যা বলছি...
শার্ট কুঁচকে গেছে,ওপরের দুটো বোতাম ছেঁড়া!রাগে ফুঁসতে-ফুঁসতে তেড়ে ক্লাসে ঢুকে গেলো ঋদ্ধি।ওর পিছন-পিছন সোমদত্ত দৌড়োলো।
যে ছেলেটার সঙ্গে মারামারি বেঁধেছিলো,নিজের প্যান্টের দু-পকেটে দুটো হাত রেখে,তার দিকে গিয়ে ধীরভাবে ঋক বললো,
-কি বলেছিলে?
-সে যাই বলি না কেন!বিকাশ বললো।
-কি বলেছিলে?
-আমি বলবো না!
-দেখো,কিছু তো বলেছিলে।কারণ,আমার ভাইকে আমি খুব ভালোমতো চিনি,মাথা গরম একটু!এমন কিছু তো নিশ্চয়ই বলেছিলে,যাতে এতটা খেপে গেছে ও।সেটাই আমাকে বলো!আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলো!
-আমি বলবো না!
-বেশ,তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছিলো,আমাদের বাবার সম্পর্কে তুমি অনেক কিছুই জানো!তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জানবে,তার ক্ষমতা ঠিক কতদূর!তাই আমিও তোমাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করবো,কি বলেছিলে তুমি ভাইকে!
এবার একটু ভয় পেয়ে গেলো ছেলেটা,চুপ করে মাথা নীচু করে নিলো ও।আর ঋদ্ধির দিকে তাকানোর সাহস ওর হলো না।মাথা তুলে বললো,
-সরি প্রান্তিক দা!আর হবে না!আমি প্রতীককেও সরি বলে দেবো!
ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে উঠলো গুঞ্জা।গুজগুজ করে দিয়াকে বললো,
-বেশ হয়েছে,এতদিনে উচিত শিক্ষা হয়েছে!খুব দরকার ছিল এটার!
ছেলেটা এগিয়ে এসে একটু দূরে গুঞ্জার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দিয়াকে বললো,
-সরি দিয়া!
চমকে উঠলো দিয়া।
-হোয়াট?আমাকে কেন?!
কিন্তু তার উত্তর দেওয়ার জন্য আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না ছেলেটি।সোজা চলে গেলো ক্লাসের দিকে।
-ব্যাপারটা কি হলো?!ও আমাকে সরি বললো কেন?গুঞ্জা,তুই আমাকে বলবি কি হয়েছে?
ঋকের দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে রইলো গুঞ্জা।ঋক এবার গুঞ্জাকে বললো,
-দিয়া তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে গুঞ্জা?প্লিজ বলো,কি হয়েছিলো?আমিও জানতে চাই!
-দেখো প্রান্তিকদা,বিকাশ ওইরকমই।সবসময় কারোর না কারোর সঙ্গে ওর ঝামেলা লেগেই আছে।আজ ঋদ্ধিকে বলেছিলো,
"বড়লোকের ছেলে হলে কত কিছু করা যায় বল!"
সত্যি বলতে প্রথমে ঋদ্ধি শুনেও বেরিয়ে গেছিলো,কিছু বলেনি,আমি আর সোমদত্ত তো ছিলাম ওর সঙ্গে,কিন্তু তারপর যা বললো,
-কি বললো?ঋকের দুটো ভ্রু কুঁচকে প্রায় এক জায়গায় চলে এসেছে।
-ও বললো,"মুখে দিনরাত সবাইকে বলে বেড়াবে,শারদীয়া আমার বেস্টফ্রেন্ড-বেস্টফ্রেন্ড!আর এদিকে তো এক্কেবারে ফ্রেন্ড-উইথ-বেনিফিটস!সেটা তো আর কাউকে বলা যায় না!ওটা গোপনই থাকে!!"
-হোয়াট!!চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো ঋকের।কপাল ভালো ছেলেটার,ঋকের সামনে বলেনি!তাহলে যে ও কি করতো,ও নিজেও জানে না!ঋক একবার দিয়ার দিকে তাকালো।দিয়ার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে,সাংঘাতিক আহত ও।চোখ থেকে জল বেরিয়ে এসেছে!এমনকি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝিনুকও পর্যন্ত অবাক হয়ে গেলো এতটা ছোট-মানসিকতার একটা কথা শুনে!দিয়া আর একটা কথাও বললো না,এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়ালো না!সোজা যেতে গেলো ক্লাসের দিকে!সঙ্গে-সঙ্গে একদৌড়ে ওকে নিজের দিকে টেনে ধরলো ঋক,
-এই,কোথায় যাচ্ছ তুমি?
-যেটা করতে তুমি ঋদ্ধিকে আটকেছো,সেটা এবার আমি করবো ঋক!মেরে ওর মুখ আমি ফাটিয়ে দেবো!
-কুল ডাউন দিয়া!গুঞ্জা বললো।
-পারবো না গুঞ্জা!সব সম্পর্কে নোংরামি খুঁজে বেড়ানো যাদের স্বভাব,তাদের একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার রে!ঋক আমায় ছাড়ো!
চোখে জল এসে গেছে ঝিনুকের।প্রান্তিক কিভাবে,কত সহজে দিয়ার হাত ধরে,ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে ধরে রেখেছে।দিয়ার ওপরে কতটা অধিকার ওর!!অথচ ওকে কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি আজ পর্যন্ত।আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না ঝিনুক।চুপ করে সরে গেলো।যাবার আগে একটু দূর থেকে পিছন ঘুরে দেখলো,ও যে ওখানে দাঁড়িয়ে নেই,ঋক সেটা খেয়ালও করলো না।তখনও ও একমনে দিয়াকে কিছু বুঝিয়ে চলেছে...মাথা নীচু করে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেলো ঝিনুক।
-দিয়া!প্রমিস মি,তুমি ওই ছেলেটাকে কিছু বলবে না!ঋক বললো।
-ঋক!তুমি কি বুঝতে পারছো না,"ফ্রেন্ড-উইথ-বেনিফিটস!"এই একটা কথায় আমাকে কতটা ছোট করা হয়!আমার কতবড় অপমান এটা!
-বুঝতে পারছি দিয়া!এটা স্কুল!এভাবে একটা ব্যাপারকে আর টেনে বড় কোরো না।আর ভুলে যেও না,ও সরি বলেছে!
-সো হোয়াট ঋক?সরি বললেই সব শেষ হয়ে গেলো?
-প্লিজ লিভ ইট!ছেড়ে দাও দিয়া!প্লিজ,আমি বলছি!আমি ওর সঙ্গে কথা বলে যতটুকু বুঝেছি,আজকের পর শুধু তোমায় কেন,ও হয়তো কাউকেই আর কিছু বলার সাহস পাবে না!আমি বলছি,আমার কথাটা শোনো তুমি!দিয়ার হাতটা চেপে ধরে ঋক গভীরভাবে বললো।
দিয়া ঋকের দিকে তাকিয়ে দেখলো।ওর কথার মধ্যে কিছু একটা ছিল,যে ও আর ঋকের কথার অবাধ্য হতে পারলো না।চোখ নামিয়ে নিলো দিয়া,ঋক আবারও বললো,
-প্লিজ দিয়া!
-হুম!ওকে!
-গুড!
-প্রান্তিক দা,বিকাশ যদি প্রিন্সিপালকে কিছু বলে,ঋদ্ধির অসুবিধা হয়ে যাবে কিন্তু।কারণ,হাতটা আগে ঋদ্ধিই চালিয়েছিলো।
-ডোন্ট ওয়ারি গুঞ্জা,আমার মনে হয় না,ও এইরকম কিছু করবে,করার হলে দিয়া কিছু জানে না জেনেও,ওকে সরি বলতো না!
-হুম!দেখা যাক!
চারপাশ তখন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে,সবাই যে-যার ক্লাসে চলে গেছে,টিফিনের সময়সীমা অনেক আগেই শেষ।কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে দিয়ার হাতটা ছেড়ে দিলো ঋক।
-একি!কোন ক্লাস তোমরা?এখনও ক্লাসের বাইরে ঘুরছ কেন?একজন স্যার বললেন।
-সরি স্যার!আমরা জাস্ট যাচ্ছিলাম!ঋক বললো।
-গো কুইক!টিফিন টাইম ইজ ওভার!
-ওকে স্যার!
ঋক চলে গেলো ওর ক্লাসের দিকে।দিয়া আর গুঞ্জাও চলে গেলো নিজের ক্লাসে।ঢুকেই দিয়া দেখলো,বিকাশ ঋদ্ধির সঙ্গে কথা বলছে,পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সোমদত্ত।দেখেই আবার দিয়ার মাথাটা গরম হয়ে গেলো।কোনোরকমে নিজেকে সামলালো ও।গুঞ্জা বললো,
-চল!আরে চল না!
ওদের দেখেই মাথা নীচু করে ঋদ্ধির কাছ থেকে সরে গেলো বিকাশ।ঋদ্ধির পিছনের ডেস্কে গিয়ে দিয়া বসলো,আর গুঞ্জা চলে গেলো সোমদত্তর ডেস্কের দিকে।ঋদ্ধি একটাও কথা বললো না দিয়ার সঙ্গে।গুঞ্জা নিশ্চয়ই এতক্ষণে দিয়াকে বলেই দিয়েছে,কি বলেছিলো বিকাশ!ওর এত খারাপ লাগছে ব্যাপারটা,ও দিয়ার চোখের দিকে ঠিকমতো চাইতেও পারছে না।টিফিনের পরের ক্লাসগুলো কোনোরকমে পার করলো ওরা।মাঝে এক-দুবার ঋদ্ধি উঠে দাঁড়ানোতে দিয়া ওর মুখের দিকে তাকিয়েছে।কিন্তু ঋদ্ধির আর দিয়ার সঙ্গে কথা বলার সাহস হয়নি!এমনকি,গাড়িতে সারাটা রাস্তাও তিনজনেই চুপচাপ এসেছে।ঋক মাঝে দু-একবার চেষ্টা করেছিল,একটু কথা বলার,পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার।কিন্তু ঋদ্ধি দিয়ার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি।ঋকেরও কেমন যেন আর সাহস হলো না কথা বলার..
-ঝর্ণা মাসি,মা কোথায়?ঋক জিজ্ঞাসা করলো।ঋদ্ধি বাড়িতে ঢুকে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না,সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো।স্কুল থেকে ফিরে দিয়া কিচ্ছুক্ষণের জন্য তিনতলার ফাঁকা ঘরটায় থাকে।তারপর খেয়ে বেরিয়ে যায় টিউশনে।বাকি দুটো ঘরে থাকে ঋক আর ঋদ্ধি।দিয়া আস্তে-আস্তে করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
-বৌমনি আর দাদাবাবু তো বড়বাবুর রিপোর্ট দেখাতে গেছে,ডাক্তারখানায়!
-দাদুকে নিয়ে?দাদুর শরীরটা কি আবার খারাপ হয়েছিল?
-তোমরা স্কুলে বেরোনোর পর বড়বাবুর একটু বুকে ব্যথা হয়,তারপর ডাক্তার এসেছিলো বাড়িতে।এখন ভালো আছে যদিও,তবে কিসব রক্ত পরীক্ষা..
-ঠিক আছে-ঠিক আছে!আমাদের তিনজনকে কিছু খেতে দাও তুমি!আমরা জামাকাপড় ছেড়ে নীচে নামছি!
-আচ্ছা!
ঋক ওপরে উঠে গেলো।ওর ঘরের দুপাশের দুটো ঘরের দিকে একবার চেয়ে দেখলো ও।দুটো দরজাই বন্ধ!কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে রাখলো ঋক..
স্কুলের জামাকাপড় ছেড়ে জামাপ্যান্ট পরে বিছানার ওপর বসলো ঋদ্ধি।খিদেয় পেট জ্বলছে ওর।যত না পেটে আগুন জ্বলছে,তার চেয়ে অনেক বেশি আগুন জ্বলছে ঋদ্ধির মাথায়।আজ যদি ভাই মাঝখানে চলে না আসতো,তা হলে বিকাশের মাথা ফাটিয়েই দিত ঋদ্ধি।তারপর যা হতো,দেখা যেত!দিয়ার মুখের দিকে পর্যন্ত লজ্জায় চাইতে পারছে না ও এখন।বিছানা থেকে উঠে কম্পিউটার খুলে বসলো ঋদ্ধি।একটু গেম খেলবে,তাতে যদি মনটা একটু অন্যদিকে ঘোরানো যায়..
গোলাপী রঙের একটা টপ আর গাঢ় নীল রঙের একটা পা পর্যন্ত প্যান্ট পরলো দিয়া।একটু জল খেয়ে চুলটা খুলে ছোট্ট বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুলো ও।আজ স্কুলে ঝামেলাটা হওয়ার পর থেকে ঋদ্ধি ওর সঙ্গে কথাই বলছে না।আর ঋকের সামনে গিয়ে তো দিয়ার দাঁড়াতেও ইচ্ছে করছে না!হ্যাঁ,বিকাশের গায়ে হাত তোলা অবশ্যই উচিত হয়নি,কিন্তু তবু ঋদ্ধি ওর অসম্মানের জন্য কিছু তো করেছে।আর ঋক!অবলীলায় ব্যাপারটা হজম করে ফেললো!যেন কিছুই হয়নি।ওকেও বারবার বললো,কিছু না বলতে!ওর অসম্মানটা যেন কোনো ব্যাপারই না।রাগে গা জ্বলছে দিয়ার।চোখে জল এসে গেলো ওর,চোখদুটো মুছে ও বিছানায় উঠে বসলো..
দিয়া ওর ওপর যে সাংঘাতিক অভিমান করেছে,সেটা ঋক বুঝতে পেরেছে।কিন্তু দিয়ার বয়সটা যে অল্প!তাই বোঝার ক্ষমতাও সীমিত!ও তো বুঝতেই পারছে না,ব্যাপারটাকে বাড়তে দিলে,অনেকদূর গড়িয়ে যেতে পারতো।আজ যে ঘটনাটা ক্লাসের হাতেগোনা কয়েকজন জানে,প্রিন্সিপালের ঘর পর্যন্ত পৌঁছলে,সেটা গোটা স্কুল জেনে যেত।তাতে ভাইয়ের থেকেও দিয়ার আরও অনেক বেশি অসম্মান হতো!তখন ঋদ্ধি একটা ছেলে হয়ে যতটা সহজে ব্যাপারটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে,দিয়া আর পারবে না।অপমানে-লজ্জায় আধমরা হয়ে যাবে মেয়েটা!সেটা ঋক মরে গেলেও সহ্য করতে পারতো না।আগামীর বড় অসম্মানের হাত থেকে দিয়াকে বাঁচাতে,আজকের ব্যাপারটা ঋক ওখানেই ছেড়ে দিতে বলেছিলো!কিন্তু মেয়েটা বোধহয় ভুল বুঝলো!সারাটা রাস্তা একটাও কথা বলেনি দিয়া।এমনিতেই আজকাল আর ওকে খুব একটা দেখতে পায় না ঋক।কখনও দিয়া আর ভাই স্কুল থেকে আগে বেরিয়ে আসে,আবার বাড়িতে এসে ঋক দেখে,ওরা টিউশন বেরিয়ে গেছে।আবার নীলিমা আন্টি দিয়াকে যখন নিতে আসে,তখন ঋক হয়তো টিউশনে থাকে।বড্ড কম দেখা হয় দিয়ার সঙ্গে ঋকের।এমনিতেও এই বছরটাই স্কুলের শেষ বছর।তারপর ঋক কলেজে চলে যাবে।এখন গাড়িতে যেটুকু দেখতে পায় দিয়াকে,তখন আর সেটুকুও পাবে না।আজকাল সারাদিনে দিয়াকে একটু না দেখতে পেলে, পাগল-পাগল লাগে ঋকের।যে কোনোভাবেই তখন ও ওদের বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করে।মরে যাচ্ছে ঋক দিয়ার জন্য।সেই মেয়েটাই যদি ঋককে ভুল বুঝে বসে থাকে,ঋক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!!ভাইয়ের সঙ্গেও সারাটা রাস্তা কথা বলেনি দিয়া,আচ্ছা ওর ওপরে না হয় রাগ করেছে,ভাইয়ের সঙ্গে অন্তত কথা বলুক!একটু হাসুক।একটু বকবক করুক!ঋক সেটুকু দেখেও খুশি থাকবে।কিন্তু ও এভাবে চুপ করে থাকলে তো ঋক মরেই যাবে...একটা খয়েরী রঙের স্যান্ডো-গেঞ্জি আর কালো প্যান্ট পরে বাঁ-হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে গেলো ঋক।তখনই চোখে পড়ে গেলো সেই দাগটা!একদিন এখানেই দাঁত বসিয়ে দিয়েছিলো দিয়া।সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকটা হালকা হয়েছে দাগটা,কিন্তু মিলিয়ে যায়নি!ঋক কোনোদিন চায়ও নি,এই দাগটা মিলিয়ে যাক!দাগটার ওপর পরম ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে,একটু চুমু খাবে বলে ঠোঁটটা সবে এগিয়ে নিয়ে গেছে ওইদিকে,ওর ঘরের দরজাটা সশব্দে খুলে গেলো।
-ভাই,দেখ তো!কম্পিউটার-টা হ্যাং হয়ে গেছে!মাউস কোনো কাজ করছে না!ঋদ্ধি ঘরে ঢুকে বললো।
-হুম,চল দেখছি!
নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে ঋদ্ধির সঙ্গে ওর ঘরে ঢুকলো ঋক।
দুই ভাই কম্পিউটারের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।ঋক চেয়ারে বসে আছে,আর ঋদ্ধি পাশে দাঁড়িয়ে।দুজনের চোখই মনিটরের ওপর।এমন সময় পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই একসঙ্গে পিছনে ঘুরে তাকালো।ঘাড় ঘুরিয়ে ওরা দেখলো,দরজার সামনে দিয়া দাঁড়িয়ে আছে।খোলা চুলগুলো এলোমেলোভাবে ওর মুখের ওপর,বুকের ওপর ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে।ঋদ্ধি মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে খাটের ওপর গিয়ে বসলো।ঋক চেয়ার ছেড়ে উঠে দিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়ালো।তারপর ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
-কিছু বলবে দিয়া?
-হুম!
-বলো!
-তোমাকে নয় ঋক,ঋদ্ধিকে...শুকনো গলায় দিয়া বললো।ওর গলার স্বরে ঋকের বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো,তবু ও সৌজন্যের খাতিরে বললো,
-ওকে,আমি চলে যাচ্ছি!
-কেন?তুই থাকলে অসুবিধা কিসের?ঋদ্ধি বললো।
-না মানে...
-তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস না কেন ঋদ্ধি?ঋকের কথাকে অগ্রাহ্য করে দিয়া বললো।
ঋদ্ধি মাথা নীচু করে চুপ করে রইলো।
-তুই কি প্রমাণ করতে চাস,বিকাশ যা বলেছে,সেটাই ঠিক?
-কি বলছিস দিয়া?পাগল হয়ে গেছিস তুই?
মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো ঋদ্ধি।
-তাহলে আমার থেকে তুই পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?কে কি বললো,তাতে আমাদের বন্ধুত্ব এত সহজে ভেঙে যাবে?কেঁপে উঠলো দিয়ার গলা।
ঋদ্ধি বুঝতে পারলো,দিয়া কেঁদে ফেলবে এবার!ঋক তখনও চেয়ারের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়েই আছে।ও মনেপ্রাণে চাইছে,ঋদ্ধি কিছু বলুক,মেয়েটা যেন কেঁদে না ফেলে।তাহলে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না।
ঋদ্ধি উঠে গেলো দিয়ার দিকে।ও তখনও ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।ভিতরে ঢোকেনি!ঋদ্ধি ওর কাছে গিয়ে বললো,
-সরি!আমার এতটা খারাপ লেগেছিলো কথাটা,আমি তোর দিকে তাকাতেই পারছিলাম না।সেই মুহূর্তে তোকে কি করে ফেস করবো,ভেবেই পাচ্ছিলাম না।সরি!সরি রে!আর দিয়া,তুই আবার কবে থেকে আমার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করলি?এমনিতে তুই তো ঢোকার আগেও নক করিস না!এত উন্নতি হঠাৎ?
হেসে ফেললো দিয়া।ঋদ্ধি ওকে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে আলগা করে জড়িয়ে ধরলো।
-সরি দিয়া!আর হবে না!
-এরপর কিছু বললে,বিকাশের নাক ফাটিয়ে দিতে হবে বুঝলি তো!দিয়াও হেসে বললো।
-না,তার আর দরকার নেই।ও আমাকে সরি বলে গেছে।আর গুঞ্জা বললো তোকেও সরি বলেছে।ও আর কিছু বলবে নারে!
-হুম,না বললেই ভালো!নাক টেনে দিয়া বললো।
-কি করছিস তুই?
-ভীষণ অসহ্য লাগছিলো,তাই একটু গেম খেলবো ভাবছিলাম।কিন্তু কম্পিউটারটাই বিগড়ে গেলো।ভাই দেখছে...
-তোমরা খেয়ে যাও...নীচ থেকে ঝর্ণা মাসির গলা পাওয়া গেলো।
-আহা!সারা বাড়ি রান্নার সুগন্ধে ম-ম করছে।ভাই ফেলে রাখ কম্পিউটার!আগে খেয়ে আসি চল!এই পাগলী,চল!দাঁড়া,আমি বাথরুম থেকে আসি আগে...
দিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড়োলো ঋদ্ধি।
ঋদ্ধির পিছন-পিছনই ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো দিয়া।কিন্তু পিছন থেকে ঋক ওকে ডাকলো,
-দিয়া?
দাঁড়িয়ে পড়লো দিয়া।কিন্তু কোনো কথা বললো না।
-আজকের ব্যাপারটা মনে রেখো না!জীবনে এইরকম...
-থ্যাঙ্কু ঋক!
-কে-কেন!অবাক হয়ে যায় ঋক।হঠাৎ করে দিয়া ওকে থ্যাঙ্কু বলছে কেন!
-তুমি বলেছিলে,ব্যাপারটা এখানেই শেষ করতে,আমি করেছিলাম।বিকাশ আমাদের দুজনকেই সরি বলেছে।তুমি যেটা ভেবেছিলে,সেটাই হয়েছে!থ্যাঙ্কু!
-দিয়া...
-ইটস ওকে ঋক!প্লিজ,আমার আর কিছু বলার নেই!
ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো দিয়া।ঋক গিয়ে টেনে ধরলো ওর একটা হাত।
-সরি!আমি জানি তুমি আমার ওপর রেগে গেছো।কিন্তু তুমি কি ভাবতে পারছো,প্রিন্সিপালের ঘর পর্যন্ত রিপোর্ট হলে কতদূর যেত ব্যাপারটা!আমি এখন আর রোজ স্কুল যাই না,কদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা।বিশেষ কোনো ক্লাস থাকলে তবেই যাই।ভাইয়ের ভীষণ মাথা গরম দিয়া।ব্যাপারটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে ও সবটুকু সামলাতে পারতো না।আজ আমি ছিলাম,আমি সামলে নিয়েছি।ও কি আর বিরক্ত করছে তোমায়?আর কিছু বলেছে কি?আমায় বলো!প্লিজ,আমায় বলো।কিন্তু এভাবে...
আর বলতে পারলো না ঋক।অবাক হয়ে গেলো দিয়া।ঋক ওর একটা হাত ধরে কাঁপছে!
-এই ঋক,তোমার কি হয়েছে!এই তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?ব্যস্ত হয়ে গেলো দিয়া।
-নাঃ,কিচ্ছু হয়নি আমার।আমি ঠিক আছি!ঠিক আছি আমি...
একভাবে কিছুক্ষণ ঋকের দিকে চেয়ে রইলো দিয়া,ও তো এতটা ভেবে দেখেনি।তারপর বললো,
-আমি সত্যিই এতদূর ভেবে দেখিনি।রাগের মাথায়...
-আমি জানি দিয়া।তুমি ভেবে দেখোনি।ভাবলে তুমি আমায় ভুল বুঝতে না।
ঋকের গালে একটা হাত রাখলো দিয়া।
-হুম!সরি!
-ডোন্ট!ডোন্ট বি সরি!!দিয়ার হাতটা চেপে ধরে ঋক বললো।
একটু হেসে দিয়া বললো,
-দিনদিন এত লম্বা হয়ে যাচ্ছ কি করে বলো তো?এরপর তো গাল টিপতে গেলে বা কান মুলে দিতে গেলে মই লাগবে!
-আমিই না হয় গাল নামিয়ে আনবো!মৃদু হেসে ঋক বললো।সঙ্গে-সঙ্গে ওর ডান গালের মিষ্টি টোলটা জেগে উঠলো।
-উফফ!তুমি আর তোমার গালের টোল!টেনে ঋকের ডান গালটা ধরে টিপে দিলো দিয়া।
-আমার কিন্তু খুউব খিদে পেয়েছে ঋক।তুমি কি যাবে নীচে?নইলে আমি চললাম!
-যাবো তো!
-ফাইন!তাড়াতাড়ি!
দুজনেই একসঙ্গে ঋদ্ধির ঘর থেকে বেরোলো।ঋদ্ধি তখন বাথরুম থেকে হন্তদন্ত বেরিয়ে দিয়াকে বললো,
-ওই পেঁচি,স্যারের হোমওয়ার্ক করেছিস?
-হুম,আমি তো করেছি!
-খেয়েছে!আমি তো বেমালুম ভুলে গেছি রে!কাল রাতে একটা সিনেমা দেখেই....
-হ্যাঁ,তুই ওই কর!তা এটা তোকে এই মুহূর্তে বাথরুমে কে মনে করিয়ে দিল?
হো-হো করে হেসে উঠলো ঋক।ঋদ্ধি বললো,
-এই বেশি বকিস না তো!তাড়াতাড়ি গিলে আমায় খাতা দেখা,ঝটপট একটু জেরক্স করে দিই...
-আর কতদিন এভাবে ফাঁকি মেরে...
-ওরে মা সরস্বতী,তোর জ্ঞানভান্ডার তোর কাছেই রাখ প্লিজ!আমায় এবারের মতো বাঁচিয়ে দে!
-চল-চল,আগে তো খেয়ে নিই...সব জায়গাতেই ছড়াবি তুই,আর গোছাবো আমি!ছোটবেলা থেকেই তো তাই করে আসছিস!
-পেত্নী আমার!থ্যাঙ্কু-থ্যাঙ্কু!!
তিনজনেই একসঙ্গে দোতলায় নেমে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলো....
(চলবে)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট