অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২২

ত্রিভুজ (দ্বিতীয় পর্ব)


 


ত্রিভুজ

সাথী দাস

দ্বিতীয় পর্ব


রমা আজ ভীষণ ব্যস্ত বাড়ির সব নামী-দামী অতিথিদের একহাতে সামলাতে।নীলিমার সঙ্গে একটু গল্প করেই,শ্বশুরের ডাকে আবার ওপরে দৌড় দিলো ও।খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ওখানেই কিনা!নীলিমা শারদীয়ার খোঁজে একটু-একটু করে সেই ঘরের দিকে গেলো,যেখানে সৈকত শারদীয়াকে নিয়ে গেছে।গিয়ে দেখলো,ঘরের ভিতরে কচিকাঁচার ভিড়ে চাঁদের হাট বসেছে।বেশ কয়েকটা বাচ্চা আর তাদের মা-কে নীলিমা চেনে,শারদীয়ার সঙ্গে তারা একই স্কুলে পড়ে।বাকি কয়েকটা বাচ্চা রমাদের আত্মীয়-পরিজন বোধহয়।সবার সঙ্গেই বেশ ভাব জমিয়ে নিয়েছে শারদীয়া।ও আরও সব বাচ্চাদের মতো মাথায় একটা সুন্দর টুপি পরেছে,কেক খাচ্ছে।সবার সঙ্গে নীলিমাও গিয়ে বসলো।
-আপনারা সবাই বসে একটু কথা বলুন।আমি একটু ওদিকটা দেখে আসি।কেমন!
সৈকত বললো।কথাটা সবার উদ্দেশ্যে হলেও,ওর চোখজোড়া নিবদ্ধ ছিলো শুধুমাত্র নীলিমার দিকেই।নীলিমাও আরও সবার মতোই বললো,
-হ্যাঁ,অবশ্যই!
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সৈকত।
কিছুক্ষণ গল্প করার পরই যার-যার বাচ্চা নিয়ে তাদের মায়েরা উঠে গেলো।রাতও কম হয়নি।ওরা বলছে,ওরা এসেছেও সেই সন্ধ্যেবেলা।নীলিমাই বেশ অনেকটা দেরি করে ফেলেছে।এবার ওকেও খেতে বসতে হবে।দিয়াকে ও সামান্য একটু খাইয়েই এনেছে।শরীরটা ভালো না তো,বাইরের খাবার খেলে আবার যদি রাতে বমি করতে শুরু করে!সেই ভয়েই নীলিমা ওকে খাইয়ে এনেছে!যার জন্মদিন,সেই প্রতীক অর্থাৎ ঋদ্ধি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।প্রান্তিক,অর্থাৎ ঋক তখনও জেগে ছিল।খাটের ওপর ছড়িয়ে থাকা ছোট ভাইয়ের খেলনাগুলো গোছাচ্ছিলো ও,একটু হেসে শারদীয়ার হাত থেকে একটা গাড়ি নিয়ে বাক্সে ভরে রাখতে গেলো ও,তখনই নীলিমাকে ডাকলো ঋক,
-আন্টি,দিয়ার কি জ্বর হয়েছে?
ঋক দিয়ার একটা হাত নিজের হাতে ধরে রয়েছে।
খাটের অন্য কোণায় বসেছিলো নীলিমা।তাড়াতাড়ি করে মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো ও,দিয়ার গায়ে হাত দিয়েই নীলিমা বুঝতে পারলো,সত্যিই বেশ জ্বর এসে গেছে ওর।এবার বাড়ি ফিরতেই হবে।ঋকের দিকে চেয়ে বললো,
-হ্যাঁ বাবা!দিয়ার তো দেখছি আবার জ্বর আসছে।তোমার মা কোথায় বাবা?একটু ডাকা যাবে কি?
দিয়াকে কোলে নিলো নীলিমা।
-এক্ষুণি ডাকছি আন্টি!তুমি বসো।দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঋক।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সৈকত এসে ঢুকলো,ওর হাতে একটা প্লেট আর রঙিন পানীয়র গ্লাস।
-নিন,আপনি তো আর সন্ধ্যেবেলা এলেন না!একটু কিছু মুখে দিয়ে নিন।তারপর না হয়...একি!আপনি উঠলেন?
-মেয়ের জ্বরটা আবার আসছে সৈকত বাবু।আমি আর বসবো না।রমা কোথায়?
-সেকি!আপনি ওকে খাটে শুইয়ে দিন!আমি বালিশ-চাদর দিচ্ছি!
-নানা!আপনি এত ব্যস্ত হবেন না।আপনি একটু রমাকে ডেকে দিন...
সেই মুহূর্তেই ঘরে ঢুকলো রমা,সঙ্গে ঋক।
-কি ব্যাপার নীলিমা?ঋক বললো,শারদীয়ার জ্বর এসেছে?
-হ্যাঁ গো!তোমায় বললাম না,ওষুধ খাইয়ে এনেছিলাম।আবার জ্বরটা আসছে!আমি বাড়ি চলে যাবো রমা!
হাঁ-হাঁ করে ওঠে রমা,সঙ্গে সৈকতও।
-নানা নীলিমা,এভাবে একটু কিছু মুখে না দিয়ে তুমি কিছুতেই যাবে না।প্রথমবার এলে আমার বাড়ি?আমি ঋদ্ধির জ্বরের ওষুধ ওকে দিই?একই বয়স তো?
-শোনো রমা,তুমি ব্যস্ত হোয়ো না,মেয়েটার শরীরটা ঠিক হোক,আমি আবার আসবো ওকে নিয়ে।
-অবশ্যই আসবে,একশবার আসবে।কিন্তু তাই বলে আজ তো তোমাকে শুধু মুখে ছাড়বোই না...আজ আমার ছেলেটার জন্মদিন!!এভাবে না খেয়ে অতিথি গেলে...
শারদীয়া ততক্ষণে জ্বরে এলিয়ে পড়েছে নীলিমার কাঁধে।অস্থির লাগছে নীলিমার।ও আবারও অনুরোধ করলো রমাকে।এবার সৈকত বলে উঠলো,
-রমা,ঠিক আছে।জোর কোরো না।অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে ওভাবে উনি খেয়েও শান্তি পাবেন না।আমি বরং ওনার খাবারটা প্যাকিং করিয়ে দিচ্ছি।এটাতে অন্তত আপনি না বলবেন না নীলিমা দেবী,প্লিজ!!
এছাড়া আর কোনো উপায় নেই দেখে অগত্যা রাজি হয় নীলিমা।সৈকত বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।রমা শারদীয়ার কপালে আবার হাত রাখলো,
-ইস!মেয়েটার ভালো জ্বর এসে গেছে গো নীলিমা।কোন ডাক্তার দেখাচ্ছ গো ওকে....
খাবার নিয়ে সৈকত যখন ঘরে এসে দাঁড়ালো,তখন দিয়া নীলিমার কোলে ঘুমিয়ে গেছে।ওকে কোলে নিয়ে খাটের এক কোণে বসে ছিলো নীলিমা।সৈকত এসে যাওয়ায় তাড়াতাড়িই উঠতে গেলো ও।
-রমা আমি আসি গো!
-আসি মানে?কোথায় যাবে এত রাতে অসুস্থ মেয়ে কোলে একা-একা?ও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসবে।
এটার জন্য সৈকত বা নীলিমা কেউই তৈরি ছিল না।দুজনেই অবাক হয়ে রমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।নীলিমা গলা নামিয়ে বলে উঠলো,
-তার কোনো দরকার নেই রমা,আমি বেরিয়ে রিক্সা...
-কথা কম বলো।এত রাতে তুমি রিক্সা পাবেও না,আর এভাবে দিয়াকে কোলে নিয়ে কোথায় রিক্সার খোঁজে ঘুরবে তুমি?কিগো,শুনছো?
-হুম!
-গাড়িটা নিয়ে বেরোও...
-গোবিন্দদা?
-ও আমার দিদিকে ছাড়তে গেছে।তুমি আর একটা গাড়ি নিয়ে যাও!
-আচ্ছা!রমা দোকানের কর্মচারীরা খেতে বসেছে।তুমি একটু ওপরে যাও।
-হুম,এক্ষুণি যাচ্ছি।ঋদ্ধিও ঘুমিয়ে পড়েছে।ওকেও তুলে খাওয়াতে হবে।
-হুম!আমি নীচে আছি।আপনি আসুন...নীলিমার দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে সৈকত বললো।তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ও।
-রমা,এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না।আমি কিন্তু...
-একদম কথা না।যাও!মেয়ের খেয়াল রেখো!খেয়ে নিও রাতে কিন্তু।
-হুম!আসছি!
-এসো....
নীলিমা বেরিয়ে যাওয়ার পর ঋককে ডাকলো রমা,
-এই ঋক,ভাইকে ডেকে নিয়ে ওপরে আয় বাবা!খেয়ে যা,তাড়াতাড়ি কর!অনেক রাত হয়ে গেলো....
সৈকত দেখলো এক হাতে খাবারের প্যাকেট,আর কোলে মেয়েকে নিয়ে,শাড়ি সামলে খুব কষ্ট করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে নীলিমা।সৈকত গাড়ির দরজা খুলে দৌড়ে এগিয়ে এলো নীলিমার দিকে।আগে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে ও গাড়িতে রাখলো।তারপর নীলিমার কোল থেকে শারদীয়াকে টেনে নিজের কোলে নিয়ে বললো,
-আপনি আগে গাড়িতে উঠে বসুন।তারপর ওকে কোলে নিন!ইস!প্রচন্ড জ্বর তো মেয়েটার।গা পুড়ে যাচ্ছে...
সৈকত গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিলো।আর কথা বাড়ালো না নীলিমা।তাড়াতাড়ি করে গাড়ির পিছনের সিটে উঠে বসলো ও,সৈকত দিয়াকে আলগা করে নীলিমার কোলে শুইয়ে দিলো।তারপর নিজে গিয়ে বসলো গাড়ির সামনের সিটে।গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে বললো,
-ওকে কি কোনো ডাক্তার দেখাবেন?বলুন তবে,আমি নিয়ে যেতে পারি।তারপর বাড়িতে ছেড়ে দেবো আপনাকে?
-নানা!আপনি সোজা বাড়িই চলুন।বাজারের দিকেই আমার বাড়ি।আমার ঘরে ওষুধ আছে।
-আচ্ছা!!
গাড়িটা স্টার্ট দিলো সৈকত....
মিনিট দশেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেলো নীলিমার ফ্ল্যাটে।গাড়ি থেকে নেমে আবারও সৈকত কোলে নিলো শারদীয়াকে।ওদের ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলো সৈকত।নীলিমা তখন নীচু হয়ে ফ্ল্যাটের তালা খুলছে,আর সৈকত শারদীয়াকে কোলে নিয়ে ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।কমন বারান্দার মৃদু আলোয় সৈকত দেখলো,পাশাপাশি ওই ফ্লোরে আরও দুটো ফ্ল্যাট।একটা দরজায় বাইরে দিয়ে তালা ঝুলছে,জানলাও বন্ধ।আর একটার দরজা ভেজানো,জানলা খোলা,ঘরে ফ্যান চলছে মনে হয়,কারণ পর্দা উড়ছে,ঘরের ছোট আলো জ্বলছে!দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দে পর্দা সরে গেলো,সৈকত সঙ্গে-সঙ্গে মুখটা ফিরিয়ে নিলো।তাই সৈকত খেয়াল করলো না,জানলা দিয়ে উঁকি মারলো একটা মুখ!ততক্ষণে নীলিমা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়েছে,সৈকতও শারদীয়াকে নিয়ে ঘরের ভিতরে পা রাখলো।খাবারের প্যাকেটটা সৈকতের হাত থেকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখলো নীলিমা।তারপর হাত বাড়িয়ে সৈকতের কোল থেকে শারদীয়াকে নিতে যাবে,এমন সময় ওদের দুজনের কানে এমন কয়েকটা বাক্য ভেসে এলো,যে নীলিমা আর সৈকতের দিকে মাথা তুলে পর্যন্ত তাকাতে পারলো না।ওই জানলা থেকে মুখ বের করে একজন মহিলা হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন,
-তাই তো ভাবি,একা-একা একটা বেধবা মেয়েছেলে এত রাত পর্যন্ত কোথায় থাকে...নিজের স্বামীটাকে খেয়ে এখন পরের ব্যাটা নিয়ে...
আর শুনতে পারলো না নীলিমা।সপাটে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো ও।লজ্জায়-অপমানে ওর তখন চোখে জল এসে গেছে।সৈকতেরও অপমানে কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছে,বনেদি পরিবারের ছেলে হওয়ার সূত্রে ও একেবারেই এইরকম ধরনের কথা শুনতে অভ্যস্ত নয়।রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে অনেকরকম কথাই কানে আসে,কিন্তু এমন অশ্রাব্য কোনো কথা যে ওর উদ্দেশ্যে হতে পারে,এটা সৈকত কল্পনাও করতে পারেনি।একছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখান থেকে।কিন্তু নীলিমা ঘরের দরজা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ায় সৈকতও এবার আর বেরোতে পারছে না,তাছাড়া শারদীয়া এখনও ওর কোলেই রয়েছে।দরজা বন্ধ করে দিয়াকে সৈকতের কোল থেকে নিলো নীলিমা।তারপর ওকে নিয়ে গিয়ে ভিতরের ঘরে শুইয়ে দিতে গেলো।সৈকত এবার মাথা তুলে ঘরটা দেখতে লাগলো।খুব সাধারণভাবে সাজানো,কোনো আভিজাত্য নেই।দুটো ঘর,একটা বাথরুম,একটা রান্নাঘর,বেশ পুরোনো ফ্ল্যাট বোঝাই যাচ্ছে।আসবাব সামান্যই,একটা ডাইনিং টেবিলে কটা ফল,কিছু ওষুধ রয়েছে।ভীষণ সাধারণ সবকিছু,কিন্তু কি সুন্দরভাবে গোছানো।কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই সংসারের মধ্যে।চারদিকে দেখতে-দেখতে নীলিমা ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার জন্য এবার ও আর চোখ তুলে সৈকতের দিকে চাইতেই পারছে না।সৈকতই পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কথা শুরু করলো,
-নীলিমা দেবী,আমি আসি তাহলে?
-হুম আসুন।নেহাত অনেকটা রাত হয়ে গেছে,নইলে একটু চা-জলখাবার...
-নানা,আপনি ব্যস্ত হবেন না।দিয়ার যত্ন নিন।আর শুনুন,নিজের পকেট থেকে কলম বের করে নীলিমার দিকে তাকায় সৈকত,
-একটু কাগজ হবে?
-হুম,অবশ্যই!
একটা ডায়েরি এনে সৈকতের দিকে এগিয়ে দেয় নীলিমা।
-এই নিন!
-হুম!
খসখস করে কাগজে কিছু একটা লিখছে সৈকত,লেখা শেষ হয়ে গেলে ডায়েরিটা নীলিমার হাতে ফেরত দিয়ে ও বললো,
-কিছু মনে করবেন না নীলিমা দেবী,অসুস্থ মেয়েটাকে নিয়ে রাতে একা থাকবেন।আর আপনার যা সহানুভূতিশীল-দায়িত্ববান প্রতিবেশী দেখলাম,আমার সত্যিই আর কিছু বলার নেই।আমার বাড়ির নম্বর লিখে দিলাম আপনার ডায়েরিতে,রাতে যদি কোনো প্রয়োজন হয়,একটা টেলিফোন করতে দুবার ভাববেন না!আপনার বাড়িতে ফোন আছে তো?
মাথা নেড়ে ছোট্ট করে "হ্যাঁ" বলে নীলিমা।
-বেশ!অবশ্যই জানাবেন আমাকে।যত রাতই হোক আমি আসবো,একটু থেমে সৈকত নীলিমার দিকে সোজাসুজি চেয়ে আবার বললো,রমাকে সঙ্গে নিয়েই আসবো...চিন্তা নেই আপনার...গাঢ় কণ্ঠেই সৈকত বললো।
নীলিমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।একটা কথাও বলতে পারলো না ও।সৈকতই বললো,
-আমি আসছি নীলিমা দেবী!
-সৈকত বাবু?
চলে যাচ্ছিলো সৈকত।নীলিমার কাতর ডাকে আবার ঘুরে দাঁড়ালো ও।
-কিছু বলবেন?
গলা ধরে এসেছে নীলিমার।কথা বেরোতে চাইছে না।তবু একরকম জোর করেই ও বললো,
-মাসিমার কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না,বয়স্ক মানুষ তো!!সারাদিন ধরে নিজের ছেলের বউকেও বলছে,ওর সয়ে গেছে।আজকাল একটু সুযোগ পেলে আমাকেও আর কি...দাদা-বৌদি,মানে মাসিমার ছেলে-ছেলের বউ খুব ভালো মানুষ,আমার মেয়েকে ওরা খুব ভালোবাসে।আমি আগে যেতাম ওদের বাড়ি,মাসীমাও তখন খুব ভালোবাসতো আমায়।কিন্তু ও আমায় ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সব কেমন যেন বদলে গেলো।বৌদি একদিন জোর করে আমায় ঘর থেকে বের করে ওদের ঘরে নিয়ে যায়,দাদার সামনেই,দাদার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে মাসিমা এমন একটা কথা বলে নিজের ছেলের বউকে সাবধান করেন,তারপর থেকে আমি আর ওদের ঘরে যাই না।ওরা ডাকেও না,তবে বৌদি শাশুড়িকে লুকিয়ে প্রায়ই আমায় মেয়েকে রান্না করা খাবার দিয়ে যায়।ওনাদের ছেলেমেয়ে নেই তো,তাই আমার দিয়াকে ওরা খুব ভালোবাসে।শুধু মাসিমার ভয়ে প্রকাশ করতে..
-যাইহোক,তবু আমার কথাটা খুবই খারাপ লেগেছে!কিন্তু আপনি প্লিজ কষ্ট পাবেন না,বা লজ্জিত..
-নাঃ!ওসব কষ্ট-লজ্জা আমার আর হয় না সৈকত বাবু।আগে হতো!এখন সবকিছু সয়ে গেছে।সমাজে আমাদের মতো একাকী বিধবাদের অনেক লড়াই করে বাঁচতে হয়,অদূর-ভবিষ্যৎ প্রজন্মে কি হবে জানিনা,তবে এখনও নারীকে কোনো পুরুষের ছত্রছায়া ছাড়া সমাজ মানতে পারে না।বাবা-দাদা-স্বামী-ছেলে ছাড়া কোনো নারীসত্তা আজও অপূর্ণ সৈকত বাবু!আমি জানি আমার লড়াইটা খুব কঠিন,কিন্তু দিয়ার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি..
একটু আগে যে চোখদুটো লজ্জায় অবনত হয়ে ছিল,সেই চোখদুটোই এখন একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আসন্ন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত,জ্বলজ্বল করছে কাজল-কালো একজোড়া চোখ!ভীষণ অবাক হয়ে গেলো সৈকত।অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী এই নারী!এনার জন্য সৈকতের করার কিছুই নেই,শুধু এনাকে অনেকটা শ্রদ্ধা করা যায়,আর কিছুই হয়তো ইনি গ্রহণ করবেন না..রমা ঠিকই বলেছিলো,সবার থেকে আলাদা নীলিমা।মৃদু হেসে সৈকত বললো,
-হুম!আপনি সত্যিই সব পারবেন নীলিমা দেবী,দেখবেন আপনি,দিয়া একদিন অনেক বড় হবে।আজ আমি,আপনার এই কথাগুলো না শুনে,এ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে,আপনার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ধারণা নিয়ে যেতাম,হয়তো ভাবতাম,সমাজের চোখরাঙানিতে অসহায় একজন...কিন্তু এই কয়েকটা কথায় আপনি আমার ধারণাটাই বদলে দিলেন।আমি এলাম নীলিমা দেবী...ভালো থাকবেন,দিয়া কেমন থাকে একটু জানাবেন।
-হুম!আসুন!
সৈকত আর দাঁড়ালো না।বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলো।
গাড়িতে ঢুকেও স্টিয়ারিংয়ের ওপর হাত রেখে কয়েক মুহূর্ত থমকে বসে রইলো ও।তখনও চোখের সামনে ভাসছে বেগুনি রঙের ফুলহাতা ব্লাউজ-শাড়ি,একমাথা চুলকে একজায়গায় করে আলগা করে বেঁধে রাখা একটা খোঁপা,কাজল-কালো একজোড়া প্রখর গভীর চোখ!রাস্তা থেকে আর একবার নীলিমার ঘরের দিকে চেয়ে দেখলো ও,ডাইনিংয়ের আলো নিভে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠলো।গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সৈকত..
স্কুল থেকে ঋদ্ধিকে নিয়ে বেরিয়ে অস্থির লাগছে রমার।আজ দিয়া স্কুলে আসেনি,জ্বরটা কমলো কিনা বোঝাও যাচ্ছে না!সৈকত কাল রাতে বাড়ির নম্বরটা দিয়ে এসেছিলো,কিন্তু নীলিমার নম্বরটা নিয়ে আসেনি।আর নীলিমাও ফোন করেনি,তাই কিচ্ছু জানা যাচ্ছে না।একটু অপেক্ষা করে দুই ছেলেকে নিয়েই বাড়ি ফিরলো রমা।কিন্তু বাড়ির কোনো কাজেই মন বসছে না ওর,শুধু দিয়ার মুখটা মনে পড়ছে।তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে প্রায়।ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে।রমা বাড়ির ফোন থেকে অন্যমনস্কভাবে দোকানের নম্বরটা ডায়াল করলো।কেউ একজন ফোন ধরে বললো,
-নমস্কার!বি.কে.চৌধুরী এন্ড সন্স জুয়েলারী হাউজ...
-বৌমনি বলছি,দাদা আছে?
-আরে বৌমনি!একটু ধরুন।দাদা ওপরে কাজ দেখছে,একটা বড় অর্ডার আছে তো।আমি এক্ষুণি ডেকে দিচ্ছি...
-হুম...
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোনের ওপারে সৈকতের গলা,
-বলো রমা,বাবার শরীর ঠিক আছে তো?
-হুম!
-তুমি ঠিক আছো?
কোনো উত্তর নেই।
-রমা?
-দিয়ার জন্য খুব মন কেমন করছে।মেয়েটার ওপর বড়ো মায়া পড়ে গেছে গো!কেমন আছে কে জানে!মনটা খুব খারাপ লাগছে!
-হুম!রমা,তোমায় একটা কথা বলি?দিয়া পরের মেয়ে!এত মায়া বাড়িয়ে কি লাভ বলো!তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও বরং...
-শোনো না!
-বলো...
-কাল তো তুমি ওদের ছেড়ে দিয়ে এসেছিলে,আজ আমায় একবার পৌঁছে দেবে ওদের ফ্ল্যাটে?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৈকত বললো,
-রমা,সন্তান যার,তারই থাকবে কিন্তু!তুমি যত মায়া বাড়াবে,তত তোমারই কষ্ট বাড়বে!না গেলে হতো না?
চুপ করে গেলো রমা!সৈকত কোনোদিনও ওর কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেনি।তাই রমাও কোনোকিছু জোর করে আদায় করতে শেখেনি!কিন্তু সৈকত সবটুকু বুঝতে পারলো,ফোনের ওপাশ থেকে রমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা ওর দ্বিতীয় ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে গেলো।তাড়াতাড়ি সৈকত বলে উঠলো,
-গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।তৈরী হয়ে নাও,দোকানে চলে এসো।আমি তোমায় নিয়ে যাবো!
-আচ্ছা!ভীষণ উচ্ছাসের সঙ্গে রমা বললো।
-শুধু একটা কথা রমা,যা করবে ভেবে করবে,আমি তোমাকে কোনোকিছুর জন্য কোনোদিনই বাধা দিইনি।আজও দেবো না,তবে কোনো কারণে যদি পরে তুমি কষ্ট পাও,আমি কিন্তু সহ্য করতে পারবো না!
-আমি জানি তো গো,তুমি আমার কষ্ট সহ্য করতে পারো না,তাই তো নিয়ে যাচ্ছ আমায়...
-আচ্ছা রাখি,হাতের কয়েকটা কাজ গুছিয়ে নিই,কর্মচারীদের কিছু কাজ বোঝানোর আছে!
-আচ্ছা...
ঘণ্টাখাকের মধ্যেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো নীলিমার ফ্ল্যাটের নীচে।দিয়ার জ্বরটা কমলেও শরীর ভীষণ দুর্বল,বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেনি আজ,তাই স্কুলেও যায়নি।নীলিমাও আজ আর মেয়েকে ছেড়ে অফিস যায়নি,ছুটি করেছে।দিয়া তখনও ঘুমোচ্ছিলো,নীলিমা তখন সবে গা ধুয়ে একটা ধোয়া কাপড় পরেছে,সন্ধ্যে দেবে,হাতে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সবে ঠাকুরের কাছে বসতে যাবে,এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।ধূপকাঠিটা ধূপদানিতে গুঁজে দিয়ে ও দরজা খুললো,দরজা খুলেই বেশ চমকে উঠলো নীলিমা,রমা দাঁড়িয়ে রয়েছে,পিছনে সৈকত...
-তুমি?
-মেয়েটা কেমন আছে,একবার জানালে না নীলিমা?আর থাকতে না পেরে,আমিই চলে এলাম দিয়াকে দেখতে!
-এসো-এসো!ভিতরে এসো।আসুন...না আসলে কাল সারারাত প্রায় জেগেই ছিলাম,জ্বরের জন্য ঘুমোতেই পারেনি দিয়া,সকাল থেকে আর জ্বরটা আসেনি গো!তোমার বাড়িতে কাল সবে একটা কাজ গেলো,আজ আবার ছেলেদের স্কুল,তাই আমি আর তোমায় বিব্রত...
চুপ করে চোখ নামিয়ে নীলিমার কথাগুলো শুনছে সৈকত।কাল যদি ও নীলিমা দেবীকে একটুও বুঝে থাকে,তবে উনি মরে গেলেও ওদের কোনো অসুবিধার কথা জানাবেন না।যতদিন পারবেন,নিজেই লড়বেন!কিন্তু মুখে কিছু বললো না ও,কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে অসহায় অবস্থায় থেকেও এতটা আত্মসম্মান বজায় রাখতে কজন পারে!!এই কারণেই সৈকত মনের অন্তঃস্থল থেকে নীলিমা দেবীকে অনেকটা শ্রদ্ধা করে।
সারা ঘরে বেশ একটা জুঁইফুলের গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে,কোনো ধূপকাঠির গন্ধ হবে মনে হয়।গন্ধটায় ঘরের মধ্যে বেশ একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।হালকা নীল রঙের শাড়ি আর ভেজা চুলে নীলিমা দেবীকেও ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে।রমা নীলিমার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ঘরের ভিতরে ঢুকলো,অগত্যা সৈকতকেও রমার পিছনে-পিছনে যেতে হলো।গতকাল ডাইনিং থেকেই ফিরে গেছিলো সৈকত,এই ঘরে আসার প্রয়োজনই পড়েনি।আজ ঘরে ঢুকে সৈকতের প্রথমেই চোখ চলে গেলো ঘরের দেওয়ালের দিকে।প্রায় প্রতিটা দেওয়ালেই নীলিমা দেবীর ছবি,সঙ্গে একজন ভীষণই সুদর্শন পুরুষ!কোনোটা নীলিমা দেবীর বিয়ের ছবি,সেটায় সিঁথিভর্তি সিঁদুর নীলিমা দেবীর সিঁথিতে,আবার কোনোটা বা পরবর্তীকালের ছবি।প্রতিটা ছবিতেই অসাধারণ সুন্দরী লাগছে নীলিমা দেবীকে।গায়ের রংটা একটু শ্যামলা,কিন্তু মুখে সর্বাগ্রে যেটা চোখে পড়ে সেটা হলো,ভীষণ আকর্ষণীয় একজোড়া চোখ,আর নাক-মুখও একেবারে কাটা-কাটা!এই শ্যামাঙ্গিনীর ঠোঁটের এক চিলতে হাসিই,যেকোনো পুরুষকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট।এই নারীর রূপের বর্ণনা দেওয়া সৈকতের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না।তার জন্য হয়তো কলম নিয়ে কারিকুরি করা কোনো স্বনামধন্য কবি হতে হবে।নীলিমা একাধারে মহীয়সী-মোহময়ী,সেই সঙ্গে ভীষণভাবে আবেদনময়ী এক নারী,অপরদিকে প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী।ওনার প্রখর দৃষ্টির সামনে সরাসরি বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না।মনে হয়,উনি যেন মনের অন্তঃস্থল পর্যন্ত পড়ে ফেলতে পারবেন!এখনও নীলিমা দেবী রমার সঙ্গে কথা বলে চলেছে একনাগাড়ে।ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।সৈকত চোখ ফিরিয়ে নিলো নীলিমার ওপর থেকে।ঘুমন্ত দিয়ার মুখের দিকে চাইলো ও।দুদিনেই মেয়েটা কাহিল হয়ে পড়েছে।চোখের কোলে গভীর কালি!মেয়েটা চোখ-নাক-মুখ পেয়েছে মায়ের মতো,শুধু গায়ের রংটা বাবার!রমাকে আর সৈকতকে বসতে বলে,সৈকতের পাশ দিয়েই নীলিমা একছুটে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে।রমার কোনো বারণই শুনলো না ও।নীলিমা সরে গেলে আস্তে-আস্তে ঘুমন্ত শারদীয়ার মাথায় একটা হাত রাখলো রমা...ততক্ষণে কথাবার্তার শব্দে ওর ঘুমটা ভেঙে গেছে।ও উঠে বসলো,রমা কোলে টেনে নিলো ওকে।তারপরই সৈকতের দিকে ফিরে বলে উঠলো,
-এই শুনছো,মেয়েটার জন্য একটু ফল-মিষ্টি নিয়ে এসেছি।আমার ব্যাগটার মধ্যে রয়েছে,ওই ডাইনিং টেবিলের ওপরে।একটু বের করে প্যাকেটটা নীলিমাকে দিয়ে এসো না গো!
-আচ্ছা!
উঠে ডাইনিংয়ের দিকে গেলো সৈকত।রমা তখন শারদীয়ার ছোট্ট চিরুনি দিয়ে ওর মাথার এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ে দিচ্ছে....
-নীলিমা দেবী?
-বলুন!
-দিয়ার জন্য সামান্য কিছু ফল-মিষ্টি!রমা এনেছে।
-এসবের আবার কি দরকার...
-আমি জানি তো আপনি কি বলবেন,ওই জন্যই আগেই গিন্নির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজের পিঠ বাঁচালাম...
হেসে ফেললো নীলিমা।সঙ্গে সৈকতও...
-নিন ধরুন!এত ফর্মালিটি করবেন না প্লিজ!আমার রমা কিন্তু একবার যাকে ভালোবাসে,প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে,এই কদিনেই ও শারদীয়াকে আর আপনাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে ফেলেছে....
সৈকত কি বলছে,বাকি কথা আর কানে ঢুকছে না নীলিমার।ওর সমস্ত মনটা বাঁধা পড়েছে ওই একটা কথার মধ্যেই,"আমার রমা!"রণজয়ও ওকে আদর করে বলতো,"আমার নীলু!"নীলিমাকে ভালোবেসে নীলু নামেই ডাকতো রণ।আজ এতগুলো বছর পর সৈকতের মুখের ওই "আমার রমা",এই একটা কথাই ওকে এক লহমায় অতীতে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।মুহুর্তেই ছবির মতো স্থির হয়ে গেলো নীলিমা!কতদিন ওকে কেউ "আমার নীলু" বলে ডাকে না!কতদিন ওকে কেউ আদর করে ছোঁয় না,সারা শরীর কেঁপে উঠলো নীলিমার।রণ-র পরে আর কোনো পুরুষ ওর জায়গাটা নিতে পারেনি।অরণ্য ওর মনের অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছেছে ঠিকই,কিন্তু আত্মাকে স্পর্শ করতে পারেনি।প্রতিরাতের মতো হঠাৎই আবার আদিম ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো নীলিমার।রণ-কে ভীষণ মনে পড়ছে...চোখে বোধহয় একটু জলও এসে গিয়েছিলো ওর,গ্যাসে চায়ের জল বসিয়ে ভীষণভাবে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো নীলিমা।ঘোর কাটলো সৈকতের ডাকে,
-নীলিমা দেবী,কি হলো,কি ভাবছেন?আপনার চায়ের জল তো ফুটে শুকিয়ে গেলো প্রায়...আপনি ঠিক আছেন তো?
-হুম!চোখ নামিয়ে ছোট্ট করে নীলিমা বললো।সৈকতের মতো সুপুরুষের চোখের দিকে চাইতে সাহস হচ্ছে না ওর!নীলিমা ভীষণভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখে সমাজের প্রতিটা পুরুষের চোখ থেকে!যদি কেউ ওকে বুঝে যায়,যদি ওর বুকের মধ্যেকার অপূর্ণতাটুকু ধরা পড়ে যায় কোনো পুরুষের চোখে।ও কিছুতেই পারবে না,রণ-র জায়গা অন্য কাউকে দিতে!তাতে যদি আজীবন ওকে লড়াই করে বেড়াতে হয় একাকীত্বের সঙ্গে,তবে তাই হোক....
-দিন সৈকত বাবু,প্যাকেটটা এদিকে দিন!হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা সৈকতের হাত থেকে নিলো নীলিমা,তারপর জিনিসগুলো বের করে গুছিয়ে রাখলো।তখন ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে রমার গলা আর দিয়ার খিলখিল করে প্রাণখোলা হাসি....
-ওরা ভিতরে তো দারুণ গল্প জমিয়ে নিয়েছে।আমি ভিতরে আছি নীলিমা দেবী!
-হ্যাঁ,বসুন।আমিও এক্ষুণিই আসছি....
-আচ্ছা!
সত্যিই চায়ের জল প্রায় শুকিয়ে এসেছে।আবার জল চাপিয়ে দুটো প্লেটে মিষ্টি-কুঁচো নিমকি সাজাতে থাকে নীলিমা।দিয়া নারকেল নাড়ু খেতে বড্ড ভালোবাসে,সেদিন সামনের ফ্ল্যাটের বউদি কতগুলো নাড়ু আর আমিত্তি দিয়ে গিয়েছিলো দিয়াকে,তারপরই মেয়েটার শরীরটা খারাপ হওয়ায় সব ধরে রেখে দিয়েছিলো নীলিমা।আজ সে সবই এক-এক করে প্লেটে সাজিয়ে ফেললো ও।সেই সঙ্গে রমার আনা মিষ্টিও কিছু দিলো।কারণ ওর বাড়িতে তো আর তেমন কিছু মিষ্টি ছিল না।চায়ের জল ফুটে গেছে,সসপ্যানে চা-পাতা দিয়ে দিলো নীলিমা....সব ট্রে-তে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকলো ও....
-আরে বাপরে!আপনি করেছেন কি!আঁৎকে ওঠে সৈকত।
-এ কিন্তু তোমার বড্ড বাড়াবাড়ি নীলিমা,আমি এসেছি অসুস্থ মেয়েটাকে দেখতে,পেটপুজো করতে তো আসিনি!রমা খানিক অভিমান করে বলে।
-আজ প্রথমবার আমার বাড়িতে দিয়াকে দেখতে এলে,এটুকু মুখে না দিলে আমার ভালো লাগবে না রমা।প্লিজ,এটুকু তোমরা খাও...আপনিও নিন না...সৈকতের দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিলো নীলিমা।
গল্পে-গল্পে সেদিনের সন্ধ্যেটা নীলিমার খুব ভালো কাটলো।রমা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর দিকে চেয়েছিলো।ঘরে ঢুকেও চোখে পড়েছে,মনে একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়ে গেছে,কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারেনি অজানা একটা ভয়ে,যদি ওর প্রশ্ন নীলিমাকে আবার কোনো আঘাত দিয়ে ফেলে।রমার কোলে আধশোয়া হয়ে একটা মিষ্টি খাচ্ছিলো দিয়া।সৈকত কয়েকটা নিমকি মুখে দিয়ে সবে চায়ের কাপে একবার চুমুক দিয়েছে,সেই সময়ই নীলিমা রমাকে প্রশ্নটা করে ফেললো,
-তুমি যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও,করতে পারো রমা...
-না মানে...
-অনেকক্ষণ ধরে তুমি ছবিগুলো দেখছো তো,তাই বললাম।আমি বলবো,তুমি কি ভাবছো?
-কি!
-আমাদের দুজনের সঙ্গে দিয়ার কোনো ছবি নেই কেন?
-আমি সত্যিই এটাই ভাবছিলাম নীলিমা।কিন্তু আমি তো ঠিক জানি না,তোমার মনের কোথায় কি আঘাত লুকিয়ে রয়েছে,আমার কথায় আবার নতুন করে তারা জেগে উঠবে কিনা!তাই আর কি...
-আমার আর কষ্ট হয় না রমা।বিশ্বাস করো,প্রথম-প্রথম খুব হতো!আজকাল কম হয়...দিয়া বড়ো হচ্ছে তো!জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো একটু-একটু করে বদলে যাচ্ছে...
-হুম,বুঝতে পারছি!
-তোমার মনে যে প্রশ্নটা ঘোরাফেরা করছে,আমার ঘরে কেউ এলে সেটাই আগে জিজ্ঞেস করে।জানো রমা,আমি আর রণ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।আমায় ওর বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি,আর্থিক দিক থেকে তো আমরা ওদের সমকক্ষ নই!কিন্তু অভিজাত পরিবারের সন্তান রণজয় আমার হাত ছাড়েনি জানো!!আমাকে বিয়ে করে ও ঘর ছাড়ে।ও বড্ড ভালোবাসতো আমায়,সবসময় রণ বলতো,"আমার নীলু"...
আর একটু হলেই বিষম খেতে যাচ্ছিলো সৈকত,রান্নাঘরে নীলিমার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়ার কারণটা এবার ওর কাছে একদম স্পষ্ট হয়ে গেলো,"আমার রমা" কথাটা বলে,সৈকত ওকে অজান্তেই আঘাত করে ফেলেছে!চায়ের কাপে আরও একবার চুমুক দিয়ে নীলিমার মুখের দিকে চাইলো ও।নীলিমা তখনও বলে চলেছে,
-বাবা মারা গিয়েছিলো আমাদের বিয়ের অনেক আগেই।রণ বলেছিলো,বিয়ের পর বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবে,তখন দুজনেরই নতুন চাকরি।মা বললো,আমার ফ্ল্যাটটা তো ফাঁকাই পড়ে রয়েছে,আমি একাই ঘরগুলো আগলে পড়ে থাকি,তোমরা বরং এখানেই থাকো।আমি ভেবেছিলাম,ও হয়তো রাজি হবে না,কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও এককথায় রাজি হয়ে গেছিলো।বাবা এই ফ্ল্যাটটা করে রেখে গিয়েছিলো,আর আমায় পড়াশোনা করানো,নিজেদের চিকিৎসার পর খুব বেশি কিছু রেখে যেতে পারেননি।রণজয় আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালো বিয়ের পর।কোনোদিন ওর মা আর একবারও আমাদের খোঁজ-খবর নেয়নি!!আমিও ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করতাম সবসময়!প্রথম থেকেই একটা মেয়ের জন্য পাগল ছিল রণ!যেদিন প্রথম ও জানতে পারলো,ও বাবা হবে,আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিলো।ডাক্তার হিসেব করে বললো,আমরা পুজোর মধ্যে হয়তো নতুন অতিথিকে আমাদের মধ্যে আশা করতে পারি।তখনই রণ নাম ঠিক করে ফেললো তার,"শারদীয়া!"যেন ও জানতোই,যে মেয়েই হবে...
রমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল।একটু ঝুঁকে দিয়ার কপালে একবার গভীরভাবে চুমু খেলো ও।নীলিমা বলে চলেছে,
-একটু জটিলতা ছিল আমার,রণ বললো,ও সব সামলে নেবে,এই মেয়ের জন্য আমি এককথায় ছেড়ে দিলাম চাকরি!জানো রমা,অপারেশন করে ওর ডেলিভারি হয়েছিলো,যেদিন ওকে আমার কোলে দিলো,আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।সামান্য মনে আছে,মা আমার বেডের পাশে হাসিমুখে বসেছিলো,আর রণ ঝুঁকে পড়েছিলো পাশের ছোট্ট-বিছানাটার ওপর।আজও ওর ওই আবছা-আবছা হাসিমুখটাই মনে আছে আমার।ব্যাস,ওই ওর সঙ্গে শেষ দেখা,তারপর সব শেষ!
-মানে?!
-ডাক্তার কিছু ওষুধ-ইঞ্জেকশন লিখেছিল,হসপিটালের নীচের ওষুধের দোকানে একটা ওষুধ তখন ছিল না।তাই ও হসপিটালের উল্টোদিকের ওষুধের দোকানটায় ওষুধ আনতে গিয়েছিলো।ওষুধ নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা ট্রাক একেবারে....
নীলিমার আর বলার ক্ষমতা নেই।দমবন্ধ হয়ে আসছে সৈকতেরও।চায়ের কাপটা কাঁপা-কাঁপা হাতে বিছানার পাশের ছোট টেবিলটায় নামিয়ে রাখলো ও।বুকের ভিতর ভীষণ একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে।নীলিমা ধরা গলায় বলে উঠলো,
-সেদিন কেন ঘুমিয়ে পড়লাম বলোতো রমা,আর একটু জেগে থাকলে তো রণ-কে আর একটুক্ষণ দেখতে পেতাম বলো!!আর কোনোদিনও পাবো নাগো আমার রণ-কে!জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম,মা হাউহাউ করে কাঁদছে!মা-কে সামলাতে গিয়ে,ছোট্ট তুলোর-দলার মতো মেয়েটাকে সামলাতে গিয়ে,আমি নিজের সবটুকু কান্না গিলে ফেললাম জানো রমা!আমি একটুও কাঁদতে পারিনি গো সেদিন!
এবার আর নিজেকে সামলাতেই পারলো না নীলিমা!কথা বলতে-বলতেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো ও....
-মা কাঁদছে কেন আন্টি!!বাবার কথা বলতে গেলেই মা শুধু কাঁদে!আমার একটুও ভালো লাগে না মা কাঁদলে....
দিয়া উঠে বসলো রমার কোল থেকে!রমা এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো নীলিমাকে।এতদিন বুঝি নীলিমা কোনো বিশ্বাসযোগ্য অবলম্বন পায়নি আঁকড়ে ধরার মতো।আজ সামান্য একটু ভরসার আশ্বাস পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁকড়ে ধরলো রমাকে।নিজের মাথাটা ওর বুকে গুঁজে দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠলো ও....
মৃত্যু সর্বদাই বেদনাদায়ক।কিন্তু মেয়ের জন্মের দিন স্বামীর মৃত্যু!!এত মর্মান্তিক মৃত্যু কি কোনো নারী মেনে নিতে পারে!!মাতৃত্ব আর বৈধব্য যেন একে-অপরের হাত ধরে নীলিমার জীবনে এসেছে।একইসাথে নারীত্বের পূর্ণতা আর শুন্যতা!!এমনটা যেন পৃথিবীর কোনো নারীর সঙ্গে না হয়!সৈকতের আর সহ্য হচ্ছে না নীলিমার এই বুকফাটা আর্তনাদ!ওর নিজের চোখদুটোও জ্বালা করছে।দিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ডাইনিংয়ের দিকে,ও-ঘর থেকে তখনও ভেসে আসছে নীলিমার বুকফাটা হাহাকার....
(চলবে...)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাবে ফ্লিপকার্ট ও আমাজন-এও। ❤️💙

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট