সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
অষ্টম পর্ব
অরিত্র গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ ভালোমতোই বুঝতে পারছে,ঝোরা ওকে এড়িয়ে চলছে।আগে যাও বা শরীর খারাপ বলে,দাদা-বৌদির অজুহাত দিয়ে,পিরিয়ডের অজুহাত দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলো অরিত্রকে,এবার গত কয়েক দিন যাবৎ তো ওর ফোন রিং পর্যন্ত হচ্ছে না।নির্ঘাত ঝোরা ব্লক করেছে ওকে।যোগাযোগের আর কোনো রাস্তাই খোলা রাখেনি মেয়েটা।একদিন মাত্র অফিসের পর ওর ব্যাঙ্কের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো অরিত্র।ও ঠিক জানে,ঝোরা ওকে দেখেছে।কারণ,রাস্তার অন্য দিকেই ও দাঁড়িয়ে ছিলো,ঝোরাকে দেখে হাতও নেড়েছিলো অরিত্র।আর রাস্তা এতোটাও জনবহুল ছিলো না,যে ওকে দেখা যাবে না।কিন্তু ঝোরা ওকে দেখেও না দেখার ভান করে বেরিয়ে গেলো স্কুটি নিয়ে।কতদিন মেয়েটাকে একটু ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি অরিত্র।দেখাই তো করছে না মেয়েটা।ওদিকে বুঝি ওদের একসঙ্গে অনেকদিন রাস্তাঘাটে না দেখে পাশের বাড়ির কাকিমা,মাকে পরিবেশন করার মতো ঈষদুষ্ণ কোনো সংবাদ পায়নি।তাই বাড়ির পরিবেশও বেশ শীতল,বন্ধ হয়েছে মায়ের মুখও!কিন্তু আগুন জ্বলছে অরিত্রর বুকের মধ্যে।প্রায় মাসখানেকেরও বেশি হয়ে গেছে,ঝোরা ওকে জড়িয়ে ধরে অরি বলে ডাকেনি!!ওর উন্মুক্ত বুকে মাথা রাখেনি।অরিত্র নিজেকে ওর শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়নি।ওকে ছাড়া এবার অস্থির লাগছে অরিত্রর।আজ সকালে উঠেই ও মনস্থির করে ফেলেছে,এবার ও দেখবে ঝোরা কি করছে,কোথায় যাচ্ছে!!যা কোনোদিন করেনি,এবার সেটাই করতে হবে।ও যা ব্যবহার শুরু করেছে,এখন ওর মুখের সামনে গেলে রাস্তাঘাট-লোকজন আর কিচ্ছু মানবে না মেয়েটা।ভীষণ রূঢ়ভাবে অপমান করে দেবে।ও মেয়ে সব পারে!তাই আগে একটু ভালো করে খোঁজ-খবর নেবে অরিত্র।তারপর সরাসরি ওর সামনে গিয়ে,অথবা ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে দাঁড়াবে!অন্য কেউ কি এসেছে ওর জীবনে!!তাই যদি হয়,তবে ঝোরা ওকে বলুক!ওকে না বলে যদি ভাবে,ওর থেকে বেরোতে পারবে,তাহলে খুব বড় ভুল করবে ঝোরা!!অরিত্র ওকে কিছুতেই এত সহজে ছাড়বে না!!আর ওকে না বলে যদি সত্যিই অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায় ঝোরা,অরিত্র তাকে দিনে-দুপুরে খুন করে ফেলে দেবে!তার জন্য এবার ওকে একটু ভালোভাবে জানতে হবে...ওকে লুকিয়ে কি করছে মেয়েটা?কেন করছে?
রাতটুকু বাদ দিলে,দিনের এই সময়টুকু বড্ড প্রিয় ঝোরার কাছে।ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে পার্কে ওই নির্দিষ্ট বেঞ্চে বসা,আর প্রিয়মের সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলা।এটুকুই ওর সারা দিনের সমস্ত শক্তি উৎস।মনে হয় যেন সেই মানুষটা ওর পাশেই বসে আছে।সামনের সপ্তাহেই আবার আসছে প্রিয়ম,দোলপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে ওদের ফ্ল্যাটে পুজো করবে আন্টি।ফোনে কথা বলতে-বলতে কখন যে ওরা প্রতিবেশী থেকে ভালো বন্ধু হয়ে গেছে,ঝোরা বুঝতেও পারেনি।আবারও ভরসা করতে শুরু করেছে ও।ঝোরার না বলা কথাগুলোও প্রিয়ম আজকাল বুঝতে পারে।অপর্ণা আন্টির ফ্ল্যাটেও প্রায়ই যায় ঝোরা।অনেক গল্প করে।দুদিন আন্টিকে স্কুটিতে করে নিয়ে বাজারেও গিয়েছিলো।আন্টি বারবার করে ওকে বলে দিয়েছে,পূর্ণিমার নারায়ণ পুজোর সমস্ত আয়োজনের দায়িত্ব ওকেই নিতে হবে।ওর সঙ্গে গিয়েই সমস্ত কেনাকাটা করবে আন্টি।আজ সে কথা প্রিয়মকে বলতেই বেশ একচোট ঝগড়া হয়ে গেলো....
-তাহলে আমার আর এখন যাওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
-মানে?এটা কেমন কথা প্রিয়ম?তোমার বাড়ির পুজো,আর তুমি আসবে না?!
-আমাকে তো আর কোনো কাজে লাগবে না,সব কাজই তো সারা হয়ে যাচ্ছে।আমি তাহলে একেবারে দুমাস পরেই যাই।বন্ধুর বিয়ে আছে।তখনই বরং ছুটিটা একটু বাড়িয়ে নিই!এখন গিয়ে আর কি করবো?মায়ের ওপর তো কর্তৃত্ব তার করা হয়েই গেছে,সিংহাসনের নারায়ণের ওপরও...এবার বুঝি সে সম্পত্তি দাবী করে বসে!!অবশ্য সম্পত্তি বলতে একটাই ফ্ল্যাট।তাও হাতিয়ে লাভ নেই,যে নেবে,তাকেই লোন শোধ করতে হবে!!
একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই প্রিয়ম একটু হেসে নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো।এবার সে সাংঘাতিক চেঁচাবে,আর ও দু-চোখ বন্ধ করে শুনবে।আজকাল ঝোরা প্রিয়মকে আর একদম গালাগালি দেয় না।মেয়েটা খিস্তি দেওয়া ভুলে গেলো নাকি!প্রিয়মই বরং এবার একটু মনে করিয়ে দেবে...
-তোমার সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে আমার ভারী বয়েই গেছে!থাকো তুমি তোমার সম্পত্তি বুকে করে নিয়ে।আমি যাবোও না আর তোমাদের বাড়ি....
লাইনটা সঙ্গে-সঙ্গে কেটে গেলো।অবাক হয়ে গেলো প্রিয়ম।ও ভেবেছিলো ঘন্টায় একশো কিলোমিটার বেগে তেড়ে খিস্তি ভেসে আসবে।কিন্তু এ তো উল্টো হয়ে গেলো।একদম শান্ত হয়ে গেলো ঝোরা।কিরকম হলো ব্যাপারটা!!প্রিয়মের কথায় আঘাত পেলো কি মেয়েটা!!নাকি এটাই অভিমান!!রোজ এই সময়টা মিনিট পনেরো ব্রেক নেয় প্রিয়ম।শুধুমাত্র ঝোরার সঙ্গে কথা বলার জন্য।এই সময়টুকু কান থেকে এক মুহূর্তের জন্যও ফোন সরায় না ও।যতই ঝগড়া হোক,যাই হোক!কিন্তু আজ ঝোরা নিজেই ফোন রেখে দিলো।অস্থির হয়ে গেলো প্রিয়ম।আবার ঘুরিয়ে ফোন করলো।
ফোনটা হাতে নিয়েই বসেছিলো ঝোরা।ঠিক জানতো, আবার সে ফোন করবে।কেমন যেন একটা বিশ্বাস,সে করবেই ফোন।ও যতই রেগে থাকুক না কেন,সে মানিয়েই নেবে ওকে।ইচ্ছে করেই ফোনটা ধরলো না ঝোরা।বেজে-বেজে কেটে গেলো।আবার বাজতে শুরু করলো।পনেরো মিনিট শেষ হতে যায়,নিশ্চয়ই প্রিয়ম ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।আবার গিয়ে কাজ শুরু করতে হবে।এবার ফোনটা ধরলো ঝোরা,কণ্ঠে মেকি-রাগের অভিব্যক্তি এনে বললো,
-কি হয়েছেটা কি?
-রাগ করলে?
-তাতে তোমার কি?
-সরি!!সরি!!আমি একটু মজা করছিলাম ঝোরা!
-আসছো তো?
-আসবো না আবার!পারলে এখনই চলে আসতাম!কিন্তু চাকরির জ্বালা বড় জ্বালা!হাত-পা বাঁধা যে!
-হুম!
-ঝোরা এবার রাখছি!ভিতরে ঢুকবো!রাতে ফোন করছি!
-ওকে!বাই!!
-বাই!!
বেশ কিছুক্ষণ ঝোরা আবিষ্ট হয়ে রইলো প্রিয়মের ভালোবাসার উষ্ণতায়।মাঝে-মাঝে ঝোরা অবাক হয়ে ভাবে,বহুদূরে বসে থেকেও সেই পুরুষ কি সাংঘাতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ওকে!!ওরা কেউই কাউকে নিজের মনের কথা কিছু বলেনি।প্রিয়ম এখনও বলে,যেমন চলছে চলুক না!পরে যা হবে,দেখা যাবে।ঝোরাও ভাসিয়ে দিয়েছে নিজেকে।হোক!যা হচ্ছে হোক!যেটা হচ্ছে,সেটা ভালো লাগছে!প্রিয়ম এখনও জানতে চায়নি ওর অতীত!হয়তো জানতে চাইবে কোনো একদিন।সেদিন ওকে সবটুকুই বলে দেবে ঝোরা।অরিও জানতে চেয়েছিলো।কিন্তু ওকে কিচ্ছু বলেনি ঝোরা,বলার প্রয়োজনই মনে করেনি।কিন্তু প্রিয়ম একবার জানতে চাইলেই,ও সবটুকু বলে দেবে।নিজেকে সে জন্য তৈরীও করেছে ঝোরা।তারপর প্রিয়ম সরে গেলে,সরে যাবে।তাতে ঝোরা আঘাত পাবে না।কারণ,ও আশাও করে না, ওর অতীত সম্পর্কে সবটুকু জানার পর কোনো পুরুষ নিজের জীবনের সঙ্গে ওকে জড়াতে চাইবে!তাই সে জন্য ও তৈরিই আছে।আপাতত যেমন চলছে চলুক,তারপর কোনো একদিন হয়তো এইটুকুও শেষ হয়ে যাবে।অন্তত ততদিন পর্যন্ত একটু ভালোভাবে বাঁচতে চায় ঝোরা।প্রিয়ম ওর জীবনে আসার আগে বাঁচার তাগিদে শুধুমাত্র নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতো ও।কিন্তু প্রিয়ম ওকে একটু-একটু করে বাঁচতে শিখিয়েছে,ভালো থাকতে শিখিয়েছে।তাই যতদিন পর্যন্ত ও পাশে থাকবে,ঝোরা প্রাণভরে বাঁচবে...তারপর যা হবে দেখা যাবে...খুশিমনে ঝোরা লালুর মাথায় হাত বুলোতে লাগলো...প্যাকেট থেকে বের করে দিলো আরও একটা বিস্কুট...
গত দুদিন ধরেই ব্যাপারটা দেখছে অরিত্র।ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েই ঝোরা আগে এই পার্কে এসে নির্দিষ্ট ওই বেঞ্চে বসে।তারপর কার সঙ্গে যেন বেশ কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলে,তারপর বেরিয়ে সোজা রামধনু এপার্টমেন্টেই যায়।আর তো কোথাও যায় না ও।কারোর সঙ্গে দেখাও করে না।তবে?কোথায় নিজেকে জড়িয়েছে ঝোরা!যে তার জন্য ও নিজের অরিকেও এড়িয়ে যাচ্ছে।ফোনে কার সঙ্গে এত মগ্ন হয়ে কথা বলে ও!!
পার্কের বাইরে থেকেই সেদিনের মত বাইকটা ঘুরিয়ে নিলো অরিত্র।আর কিছুদিন দেখবে,তারপর দাঁড়াবে ঝোরার পরিবারের মুখোমুখি...
স্কুটি নিয়ে এপার্টমেন্টে ঢুকলো ঝোরা।পার্কিংয়ের দিকে যাওয়ার আগেই দেখলো,অভ্র-দার বউ কুর্চিকে নিয়ে পার্কে খেলা করছে।সঙ্গে আরও দু-তিনটে বাচ্চাও আছে।তখনও পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি।কুর্চি চিৎকার করে বায়না করছিলো আইসক্রিমের জন্য!
-কাকা!!সব ঠিকঠাক?
-একদম দিদিমণি!
-রাজু দা আসেনি এখনও?
-আজ ওর একটু দেরি হবে দিদিমণি।আমায় বলেছে,গাড়ি নিয়ে দত্তদের দুই ভাইকে নিয়ে কোথায় যাবে....ওর ফিরতে একটু সময় লাগবে!
-ও আচ্ছা!বৌদি ভালো আছো?
স্কুটিটা পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে পার্কের দিকে এগোলো ঝোরা।সন্ধ্যের মুখের এই সময়টা বারান্দায় দাঁড়াতে খুব ভালো লাগে অপর্ণার।ছোট-ছোট বাচ্চাগুলো দৌড়াদৌড়ি করে,খেলা করে,দেখতে ভারী ভালো লাগে ওর।শনি-রবিবার করে মাঝে-মাঝে ঝোরার সঙ্গে বাজারের দিকে না বেরোলে,অপর্ণা গিয়ে পার্কে একটু বসে।সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে।কিন্তু সপ্তাহের মাঝে আর হয় না।স্কুল থেকে ফিরেই একটু কিছু নাকে-মুখে গুঁজেই দুধটা গরম করে ফেলতে হয়,রাতের রুটি করে ফেলতে হয়।ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা চলছে।এখন আর অত ঘড়ির সময় মেপে পড়ালে হয় না।তাই নিজের রাতের খাওয়ার স্বল্প আয়োজনটুকু সন্ধ্যেবেলাতেই সেরে নেয় অপর্ণা।ইচ্ছে থাকলেও আর সময়ের অভাবে পার্কে যাওয়া হয় না।আজও হাতের কাজটুকু সেরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে,বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো অপর্ণা।ওখান থেকেই দেখলো,ঝোরা স্কুটি থেকে নেমে হাসিমুখে এগিয়ে গেলো বাচ্চাগুলোর দিকে...
মেয়েটা বেশ মিষ্টি!!কিন্তু একটু উগ্র,বদমেজাজী,ঠোঁটকাটা ঠিকই,তবে মনটা তো মনে হয় ভালোই।খুব সম্ভবত পাপাইয়ের সঙ্গে মেয়েটার কোনো সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে,বা হয়তো হয়েই গেছে।যাওয়ার দিন ছেলের চোখমুখ দেখেই বুঝে গিয়েছিলো অপর্ণা।পাপাই চলে যাওয়ার পর থেকেই মেয়েটাও যাতায়াত শুরু করেছে অপর্ণার কাছে।প্রত্যেকটা ঘটনাই সাংঘাতিক ইঙ্গিতবহ।দেখা যাক,ওরা কি সিদ্ধান্ত নেয়!পাপাইয়ের পরে তো ওর আর কোনো ভাই-বোনও নেই।অপর্ণা চোখ বুজলে সুবিধা-অসুবিধায়-প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওর পিছনে দাঁড়াবার মতোও কেউ নেই আর।শ্বশুরবাড়িতে যদি মেয়েটার কোনো ভাই-বোন থাকে তো ভালোই হয়।একটু অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।অপর্ণার অবর্তমানে একেবারে একা হয়ে যাবে না ছেলেটা।সেদিক থেকে ঝোরার একটা দাদাও আছে,বৌদিও আছে।বেশ ছোট-সুস্থ একটা পরিবার।কিন্তু ওদের পরিবার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না অপর্ণা।মেয়েটা বড্ড চাপা!তিনজনেই চাকরি করে।কি চাকরি করে,কোথায় চাকরি করে,ওটুকুই জানে ও।ওর বাইরে আর একটা কথাও অপর্ণা ওর মুখ থেকে বের করতে পারেনি।দেখাই যাক,অপেক্ষা করে।পাপাই এবার এলে ছেলের ব্যবহারে কিছু একটু তো জানাই যাবে....
চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে বারান্দা থেকে ঝোরার দিকেই একভাবে চেয়ে রইলো অপর্ণা....
-এত চেঁচাচ্ছে কেন বৌদি?
-আরে দেখো না,কুর্চি এই অবেলায় আইসক্রিম খাবে!
-তা দাও না।বাইরেই তো একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।দাঁড়াও,আমিই নিয়ে আসছি।
-এই ঝোরা!নানা!তুমি বরং ওদের সঙ্গে দাঁড়াও।আমি নিয়ে আসি তিনটে কাপ।নাঃ চারটে।আমিও একটা খাই।এই ঝোরা,তুমি খাবে?
-হোক-হোক!!
-বেশ,দাঁড়াও।আনছি!ওদের একটু দেখো গো।খেলছে বাচ্চাগুলো।
-হ্যাঁ বৌদি!আমি এখানেই বসছি তো!
ব্যাগটা নামিয়ে রেখে একটা বেঞ্চে বসলো ঝোরা।কুর্চির সঙ্গে আরও দুটো বাচ্চা দৌড়াদৌড়ি করছে।তাদের বাবা-মা নেই।এখানে তো কোনো ঝামেলা নেই।গেট দিয়ে বাইরে বেরোবার কোনো প্রশ্নই আসে না।কাকা বা রাজু দা সবসময় গেটে রয়েছে।যা করছে,পার্কের মধ্যেই থেকে করছে বাচ্চাগুলো।ওদের হুড়োহুড়ি দেখতে বেশ লাগছিলো ঝোরার।তিনটে বাচ্চাই স্লিপ থেকে নেমে দৌড়াচ্ছিলো দোলনার দিকে।দুজন চলে গেলো,কিন্তু হুমড়ি খেয়ে অভ্র-দার মেয়ে কুর্চি পড়ে গেলো।ছুটে উঠে আসতে যাচ্ছিলো ঝোরা....সেই মুহূর্তেই ওর কানে বেজে উঠলো,
"ভুল!!"
থমকে দাঁড়িয়ে গেলো ঝোরা।প্রিয়মের মুখটা মনে পড়তেই ঝোরা একটু সরে গেলো ওখান থেকে।চলে গেলো কুর্চির দৃষ্টির আড়ালে।দুটো বাচ্চা দৌড়ে গিয়ে দুটো দোলনায় উঠে বসেছে।বোধহয় বেশ জোরেই পড়েছে কুর্চি।পড়েই এদিক-ওদিক দেখছে।ঝোরা বুঝলো,ও নিজের মা-কে খুঁজছে।কিন্তু মা-কে না দেখে কাঁদছেও না একটু।হয়তো দেখতে পেলেই গলা ছেড়ে কেঁদে উঠবে।দূর থেকে ঝোরা দমবন্ধ করে দেখলো,কুর্চি দুহাতে মাটিতে ভর দিয়ে ধীরে-ধীরে উঠলো।প্রথমে দাঁড়াতে পারছিলো না।কিন্তু তবুও দাঁড়ালো।নীচু হয়ে নিজের হাঁটু দেখলো।দুটো পা ঝাড়লো,জামা ঝাড়লো।কয়েক পা একটু খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো দোলনার দিকে।তারপর আবার দৌড়োতে শুরু করলো।কেউ বলবে,একটু আগেই টেনে একটা জোর আছাড় খেয়েছে!অবাক হয়ে গেলো ঝোরা।নিজের অজান্তেই নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো ও...বুকটা কাঁপছে,
"রাইট!তুমিই ঠিক প্রিয়ম!একাও সার্ভাইভ করা যায়...থ্যাঙ্কু ফর দিস লেসন!থ্যাঙ্কু!!"
-এই নাও।আইসক্রিম!ওই পুঁচকেগুলো,সবাই এদিকে আয় দেখি!চুপ করে এখানে বোস।খেলে এসেই ঠান্ডা খাবি না।একটু পরে খাবি!তারপর ঝোরা,অফিস থেকে ফিরছো?
-হ্যাঁ বৌদি...
অবাক হয়ে গেলো অপর্ণা।ঝোরা তো একেবারে পাপাইয়েরই ছায়া!!হয়তো পাপাই নিজের হাতেই নিজের মনের মতো করে মেয়েটাকে তৈরী করে নিচ্ছে।পাপাইও বাচ্চাদের ওদের মতো থাকতে দিতে পছন্দ করে।পড়ে যাক না!নিজেই উঠবে!ঠিক পারবে।আজ ওপরে দাঁড়িয়ে ঝোরার মধ্যেও সেই ব্যাপারটাই দেখলো অপর্ণা।বাচ্চাটাকে তোলার জন্য মেয়েটা এগিয়েও আবার থমকে গেলো।বোধহয় অনেকদূরই এগিয়েছে পাপাই।নইলে কারোর ওপরে এতটাও প্রভাব বিস্তার করা কি সম্ভব!!একটু হেসে ওখান থেকে সরে গেলো অপর্ণা....গেট দিয়ে একে-একে ওর ছাত্রছাত্রীরা ঢুকছে তখন...
-ঝোরা?
-হুম!
-আজ এতদিন পর আবারও সেই একই কথা জিজ্ঞেস করবো!
-কি?
-ভালোবাসতে ভয় পাও?
ফোনের অপর প্রান্তে অপার নিস্তব্ধতা।
-কি হলো,বলো?
-নাঃ!!ভয়টা আগের থেকে একটু কমেছে।
-সত্যি?
-হুম!
-তবে আজ তুমি কিসে ভয় পাও?
-হারানোর ভয় পাই!ভালোবাসতে নয়,ভালোবাসা হারাতে ভয় পাই!
-এন্ড হোয়াট এবাউট মেন ডোন্ট ডিসার্ভ লয়ালটি?!
-ওটা একশো শতাংশ সত্যি প্রিয়ম!ওটাই আমার জীবন-দর্শন!জীবনেও ওর পরিবর্তন হবে না!
-তাই?
-হুম!!
-বুঝতে পারছি,আরও খাটতে হবে!
-মানে?
-তোমাকে মানুষ করতে,আমায় আরও খাটতে হবে ঝোরা।আরও সময় দিতে হবে...
-ওই,আমি মানুষ নই?জানোয়ার নাকি!মানুষ করতে হবে মানে?
-না!!তা নয়!গায়ে-হাতে-পায়ে মানুষ হলেই তো হবে না।মননে-মস্তিষ্কে-আত্মায় মানুষ হতে হবে।নিজেকেও অন্যের ভরসাযোগ্য করে তুলতে হবে,অপরকেও,সামনের মানুষটাকেও ভরসা করতে হবে।
-নাঃ!আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না প্রিয়ম।আমি চাই না,আমাকেও কেউ চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করুক।আমি কারোর বিশ্বাস-ভরসা-ভালোবাসার যোগ্যই নই!!
-হুম!!বুঝলাম!
-কি বুঝলে?
-এই ঝোরা,চারটে বাজে!ঘুমোবে না আজ?
-না,ঘুমোবো না।তুমি আগে বলো,কি বুঝলে?
-বুঝেছি তো বেশ অনেক কিছুই!বাকিটা নেক্সট উইক গিয়ে সামনাসামনি তোমায় বোঝাবো!
-আচ্ছা!ঠিক তো?ভুলে যাবে নাতো?
-না বাবা,একদম!ঠিক বোঝাবো!প্রমিস!আচ্ছা,তোমার পছন্দের রং কি ঝোরা?
-আমার?সবুজ!কেন?
-না এমনিই...এবার তাহলে সবুজ আবির কিনতে হবে দেখছি!
-আমি রং খেলি না প্রিয়ম!
-কেন?
-আছে কোনো কারণ!ওই দিনটা আমি ঘরের বাইরেও বেরোই না।
-আমাদের পুজো?পুজোয় আসবে না তুমি!!
-হ্যাঁ,পুজোয় আমি যাবো।আন্টিকে কথা দিয়েছি।তারপর আবার ওপরে চলে আসবো।ওসব রং খেলা আমার পোষায় না...
-সেকি!বছরের একটা মাত্র দিন!আমি তো ভাবলাম,এবার তোমায় আমাদের ও-পাড়ায় নিয়ে যাবো।ওইখানেই তো আমি বড় হয়েছি।তাই আমার শিকড়টা ওইখানেই।তোমাকে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।আমার সব বন্ধুবান্ধব তো ওখানেই আছে।যা সব জিনিস এক-একটা।রং খেলা,ড্রাম বাজিয়ে নাচানাচি-হুড়োহুড়ি-ভাঙ-মদ....কিই না হয়...তোমার খুব ভালো লাগবে ঝোরা...
-হ্যাঁ তো যাবে!আমায় এসব বলে লাভ নেই....আমি আমার শরীরে রং ছোঁয়াই না...বাদ দাও ওসব কথা!এই প্রিয়ম জানো তো,আজ না একটা কান্ড হয়েছে...
প্রথমবার ঝোরার সঙ্গে রং খেলবে বলে,বেশ উৎসাহ ছিলো প্রিয়মের।কিন্তু ওর কথা শুনে একেবারে চুপ করে গিয়েছিলো প্রিয়ম।এবার বললো,
-কি হয়েছে?
-আজ আমাদের পার্কে কুর্চি খেলা করছিলো।তোমাদের আট তলার অভ্র-দার মেয়ে,আর বৌদি তখন...
ঝরঝর করে ঝোরা বয়ে যেতে লাগলো।প্রিয়ম ততক্ষণে কানের কাছ থেকে ঠোঁটের কাছে নামিয়ে এনেছে ফোনটা।একবার নিজের বুকে ফোনটা চেপে ধরে একটু আস্তে করে চুমু খেলো ও,একেবারে নিঃশব্দে।শুধু ঠোঁটটুকু ঠেকিয়ে দিলো ফোনের স্ক্রিনে।তারপর আবার কানে ধরলো ফোনটা...
-হ্যাঁ,কি বলছিলে?কি করেছে কুর্চি?আরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু...আর একবার বলো...
-মা!তীর্থর পরীক্ষা কেমন হলো?আমায় তো বললো ভালোই!
-ওর ভালো আমি জানি।সে রেজাল্টেই বোঝা যাবে।আচ্ছা পাপাই,আমি এখন রাখছি।ঝোরা এসেছে মনে হয়।বেল বাজলো।রাতে ফোন করিস।আমরা একটু বাজারের দিকে বেরোবো।তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়িস আজ।কালই তো আবার ফ্লাইট...
-হুম!
একটু হেসে ফোন রেখে দিলো প্রিয়ম।মায়ের ওপর ভালোই আধিপত্য বিস্তার করেছে মেয়েটা...কিন্তু আজ রাতে তো ওর আনন্দের চোটে ঘুমই হবে না।কাল ও আবার শ্রী-কে দেখতে পাবে।আজ সারা রাত বরং ওর সঙ্গে গল্প করেই কাটিয়ে দেবে....
-হাই!!প্রিয়া বৌদি?মানে আপনি ঝোরার বৌদি তো?
-হুম!কিন্তু আপনাকে তো ঠিক...
-কে এসেছে প্রিয়া?
সৌম্য এসে প্রিয়ার পাশে দাঁড়ালো।
-জানিনা গো!ঝোরার পরিচিত কেউ বোধহয়।কিন্তু ও তো এখন বাড়িতে নেই।
-আমি অরিত্র!আমার ঝোরার সঙ্গে নয়,আপনাদের সঙ্গেই একটু কথা আছে।আপনারা ওর দাদা-বৌদি।ওর যেহেতু বাবা-মা নেই,তাই আপনাদের সঙ্গেই একটু কথা বলতে চাই!!
-আসুন!ভিতরে আসুন।কি ব্যাপারে কথা?
-বলছি....
ঝোরার ফ্ল্যাটে ঢুকলো অরিত্র।তখন ঝোরা অফিসের পর প্রিয়মের সঙ্গে বেরিয়েছে...
-উফফ!!আবার এতগুলো ফল এনেছিস পাপাই!ফ্রিজে ঠাসা ফল!কালই তো আমি নিয়ে এসেছি...
-হ্যাঁ!ঠিক আছে।পুজোয় লাগবে তো!!ঝোরা বললো,নিয়ে নাও।তাই আমিও নিয়ে নিলাম।
মুখে আর কিছু বললো না অপর্ণা।মনে-মনে একটু হাসলো শুধু।
"যেমন তুমি,তেমন তোমার ঝোরা!!গোটা ফলের বাজারই উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন দুটিতে মিলে..."
-তা সে কই?এলো না?
-না!টায়ার্ড খুব।ওইজন্যই উঠে গেছিলো ওপরে।এমনিতেও রাত হয়ে গেছে।তাই আর এলো না।ইয়ে,রাতের খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে।আমি একটু ঘুরে আসছি মা!বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি...
হাতের কাজ করতে-করতেই গম্ভীরভাবে অপর্ণা বললো,
-সিগারেট যতক্ষণ তুমি খাচ্ছ,ততক্ষণই ঠিক আছে।সিগারেট যেন তোমায় খেতে শুরু না করে।একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছো!সংখ্যাটা কমাও এবার...
মায়ের সামনে আর মাথা তুলতে পারলো না প্রিয়ম।নিজের নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো ও।তারপর বলল,
-আসছি আমি!
বলেই বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাটের বাইরে...হাফ-প্যান্টের পকেটে রয়েছে সিগারেট-লাইটার আর ফোন।আজ ঝোরা বলেছে,রাতে আর ছাদে উঠবে না।কাল আসবে।কিন্তু প্রিয়মের যে এখনই ওকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।তাই বেরিয়েই এলো ও।ছাদে উঠে একটা ফোন করে ওকে ডেকে নিলেই হবে...
ঘরে পা রাখার পর থেকেই শুরু হয়েছে অশান্তি।আর সহ্য হচ্ছে না।তখন থেকে মুখ বন্ধ করে শুধু শুনেই যাচ্ছে ঝোরা।এবার ও মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো।দাদা সমানে চেঁচিয়েই যাচ্ছে....
-লজ্জা করে না তোমার?বেহায়া মেয়ে!জীবনে কি করে রেখেছো,সেসব ইতিহাস ভুলে গেছো?তোমার জন্য মামাদের কাছে আমাকে-মাকে কম অপমানিত হতে হয়েছে!
-সৌম্য চুপ করো!তুমি ঘরে যাও!এভাবে চিৎকার করো না।আমি দেখছি...যাও তুমি...
-না দাঁড়াও!কি মনে করেছে কি ও!ও বাইরে কি করে বেড়াচ্ছে,আমি কোনোদিনও জানতে পারবো না!!একটা ছেলের জীবন নষ্ট করে দিয়ে,উনি নেচে-নেচে বেড়াচ্ছেন!হ্যাঁ-রে বুনি?তোর লজ্জা করে না!ভুলে গেছিস সবকিছু?আমরা যত চেষ্টা করছি,তোর জীবনটা গুছিয়ে দিতে,তুই তত নিজেকে ছড়িয়ে ফেলছিস!
সোফা থেকে উঠে গিয়ে সোজা ডাইনিংয়ের জানলার সামনে দাঁড়ালো ঝোরা।আজ ও জিন্সের সঙ্গে একটা চেক-শার্ট পরেছিল।প্রিয়ম বলছিলো,ওকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।ভেবেছিলো,নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একটু কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখবে,নিজেকে সময় দেবে!সত্যিই কি খুব সুন্দর লাগছিলো ওকে!!কিন্তু বাড়িতে পা রেখেই যা শুনলো...
-তোমায় অরিত্রকেই বিয়ে করতে হবে।
-কোনোদিনও না!
-সেটা....চুপ করে গেলো সৌম্য।যে কথাটা মস্তিষ্কে এসেছে,সেটা মুখ দিয়ে আর বেরোলো না!অন্তত দাদা হয়ে বোনকে তো ওসব বলাই যায় না!তাই ও বললো,
-সেটা আগে তোমার মনে ছিলো না!বিয়ে যখন করবে না,মেলামেশা করেছিলে কেন?এগিয়েছিলে কেন?
-দাদা,ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে।আমি বুঝে নেবো!
-তুমি বুঝতে পারলে আজ অরিত্রকে মাথা নীচু করে বাড়ি বয়ে এসে,এভাবে আমার পায়ে পড়তে হতো না।যতটুকু বুঝেছি ছেলে ভালো,আর ভালো-মন্দ দিয়ে এখন আর কিই বা হবে!!এগিয়েছো তো তুমিই...এবার ওই ছেলেকেই তোমায় বিয়ে করতে হবে!
চুপ করে বাইরের দিকে চেয়েছিলো ঝোরা।ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-আমি বিয়ে করবো না!
-মেরে মুখ ভেঙে দেবো তোমার...
সৌম্য তেড়ে গেলো ঝোরার দিকে।প্রিয়া ওকে টেনে ধরলো,
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে সৌম্য!!তুমি বুনির গায়ে হাত দেবে?!
অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছে ঝোরা।এইবার চিৎকার করে উঠলো ও,
-ফেল!আমায় মেরেই ফেল দাদা!তোরা আমার ভালো চাস তো?তাহলে আমায় মেরে ফেল!বেঁচে থাকতে এ জীবনে আর আমার কোনো ভালো হবে না।খুব ভালো করতে গেছিলিস তো আমার!!মামার সঙ্গে নেচে-নেচে বোনের বিয়ের আয়োজন করেছিলি!বোনকে সংসারী করবি,বোনের জীবনটা গুছিয়ে দিবি!!কত স্বপ্ন তোর!আশীর্বাদ হয়ে গেছে,আমার আইবুড়ো ভাত খাওয়া হয়ে গেছে,একগাদা লোক নিমন্ত্রণ হয়ে গেছে,প্যান্ডেলের বাঁশ পর্যন্ত বাঁধা হয়ে গেছে,কি হলো দাদা?কি হলো?
চিৎকার করে উঠলো ঝোরা....
মাথা নীচু করে ফেললো সৌম্য!
-কিরে?এবার মাথা নীচু করে ফেললি কেন?বল!আশীর্বাদী ধান-দুর্বা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম,পায়ের আলতা সাবান ঘষে ধুয়ে-মুছে ফেললাম,তত্ত্বের সব ট্রে ছিঁড়ে ফেললাম,টুকটুকে লাল বেনারসী আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম!!হাত থেকে শাঁখা-পলা পর্যন্ত খুলে ফেললাম রে দাদা.....
চিৎকার করে কেঁদে উঠলো ঝোরা...
-আর হাতের মেহেন্দি!সেটা তো আর উঠলোই না রে!!তুই ফেস করেছিস এসব??বল!!করেছিস??একবাড়ি আত্মীয়-স্বজন আমার দিকে করুণার চোখে চেয়ে আছে।আমি তৈরী,মেয়ে একেবারে তৈরী বিয়ের জন্য!!কিন্তু সে আসবে না!সে আর আসবে না আমাকে উদ্ধার করতে!!ভুলে যাবো,সেইসব অপমান?জীবনটা তো তোর নয় দাদা,তাই তোর পক্ষে ভুলে যাওয়া খুব সহজ!কিন্তু মুভ অন করা এতটাও সহজ নয় রে।বাড়িভর্তি এত লোকের সামনে নিজের অপমান,মায়ের অসম্মান,মামাদের-মামীদের উঠতে-বসতে কথা শোনানো,এত সহজ নয় সব ভুলে যাওয়া....
একদম চুপ করে গেছে সৌম্য।
-কিন্তু তা বলে জীবন তো থেমে থাকে না ঝোরা?তোর দাদাকেই দেখ।পৃথিবীর সব পুরুষ সমান নয়...
প্রিয়া এগিয়ে এলো ঝোরার দিকে।হাউহাউ করে তখন কাঁদছে ঝোরা।কাঁদতে-কাঁদতেই ও বললো,
-জানি বৌদি!দাদা তো জানে,আমরা কোন দিন পেরিয়ে এসেছি।একসঙ্গেই তো কাটিয়েছি সেই সব দিনগুলো।তারপরও ও যদি তোমায় বুঝতে না পারে,তাহলে ওকেও আমি পুরুষ বলে গ্রাহ্য করতাম না।ওকে ওই বাপের ছেলেই ভাবতাম,মায়ের ছেলে আর ভাবতাম না!!ও তো সব জানে বৌদি,তাই ও বোঝে!কিন্তু সবাই তো বুঝবে না...সারাজীবন কথা শুনতে-শুনতে বেঁচে থাকার চেয়ে,একা থাকা অনেক ভালো....
-এভাবে চলে না বোন!অরিত্র যখন এত করে বলছে...
-তখন ঝুলে পড়বো ওর গলায়!!ও আমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না বৌদি!জানলে ও নিজেই সরে যাবে!
-তুমি কিছু বলবে না ওকে...
সৌম্য এগিয়ে এলো ঝোরার দিকে...
-আবার সেই একই ভুল,একই ভুল!দাদা,আমি সত্যিই ওকে কিছু বলবো না।কারণ,আমি তো ওকে বিয়েই করবো না,তাই ওর কি লাভ আমায় জেনে,আমার অতীত জেনে!
-এরকম করিস না বুনি!একটু নিজের দিকটাও দেখ!কি পাবি এসব করে?লোকে এসব ভালো বলবে না!
-লোকে-লোকে কি বলবে,তাতে আমার...
চুপ করে গেলো ঝোরা।দাদার সামনে ও গালাগালি দেয় না।
-আর কি পাবো?কি পাবো,সেই হিসেব করছিস তুই দাদা?আগে কি পেয়েছি বল তো?এত ভালোবেসে,এত বিশ্বাস করে,কি পেয়েছি আমি...
চিৎকার করে উঠলো ঝোরা।সৌম্য আর প্রিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।আবারও ঝোরা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,
-আমার কথা না হয় ছেড়েই দে।আমি তো ভুলই করেছিলাম।আর মা?মা-ও কি ভুল করেছিলো?সারাটা জীবন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে,মা কি পেয়েছিলো দাদা?বল!!বাবার এক্সট্রা-ম্যারিটাল এফেয়ার?একদম জ্ঞান দিস না!দূর থেকে জ্ঞান দেওয়া খুব সহজ রে দাদা...যে ফেস করে,সে জানে,কেমন লাগে!!প্লিজ আমাকে আমারটা বুঝে নিতে দে...মায়ের জীবন,নিজের জীবন দিয়ে আমি বুঝেছি দাদা,মেন ডোন্ট ডিসার্ভ লয়ালটি!!বৌদি ভালো,তুইও ভালো।তাই তোরা দুজনে একসঙ্গে ভালো আছিস।বিশ্বাস কর দাদা,তোদের ভালো থাকা নিয়ে আমার মধ্যে কোনো ফ্রাস্ট্রেশন কাজ করে না।আমিও তোদের জন্য হ্যাপি!!নিজেরা নিজেদের মতো করে ভালো থাক না।প্লিজ আমাকে ছেড়ে দে।আমার এত ভালো তোদের করতে হবে না...
হাউহাউ করে কেঁদে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো ঝোরা।সৌম্য সোফায় বসে পড়লো,প্রিয়া দিশেহারা...
প্রিয়ম তখন থেকে ফোন করেই যাচ্ছে ঝোরাকে।ও ধরছেই তো না।কি হলো ব্যাপারটা?!একটু আগেই তো কত হাসিখুশি ছিলো,ওরা একসঙ্গে দুজন ঘুরে-বেড়িয়ে-গল্প করে ফ্ল্যাটে ঢুকলো।এর মধ্যে আবার কি হলো মেয়েটার!!ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা পায়ের তলায় ফেলে নিভিয়ে আবার ফোনটা কানে ধরলো প্রিয়ম।এবার আবার ব্যস্ত বলছে....কি জ্বালা!!
জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা টেনে বের করেই ঝোরা দেখলো,প্রিয়ম তিনবার ফোন করেছে।তিনটে মিসড কল হয়ে আছে।ফোন সাইলেন্ট থাকায় ও বুঝতেও পারেনি।দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে-উঠতেই প্রিয়মের নম্বর পেরিয়ে ঝোরা ঢুকলো ব্লকলিস্টে....আনব্লক করলো অরিত্রকে।তারপর ওকে ফোন করে সোজা ছাদের দিকে ছুটলো...
-হ্যালো,ঝোরা!?
দরজা ঠেলে ছাদে পা রাখলো ঝোরা...ফোনটা কানে ধরেই দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো ও,
-ঝোরা!বের করছি তোর ঝোরা!!সালা গান্ডু!তুই আমার বাড়িতে এসেছিস কেন?কোন সাহসে?রাস্তার তিন-মাথার মোড়ে তোকে মেরে পুঁতে রেখে দেবো হারামি!!
চমকে উঠলো প্রিয়ম।ঝোরা ছাদে এসেই ও অন্ধকারে যেদিকটায় দাঁড়িয়ে আছে,তার উল্টোদিকে চলে গেছে।তাই প্রিয়মকে আর খেয়ালই করেনি ও।কিন্তু কার সঙ্গে ও এভাবে কথা বলছে...অন্য কেউ হলে এই মুহূর্তেই ও ছাদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতো।এভাবে কারোর কথা শোনা একদম উচিত নয়।কিন্তু এখন ও কিছুতেই যাবে না।এটা অন্য কেউ নয়,এটা ঝোরা!!যাকে জানার জন্য,যার অতীতটা জানার জন্য ও মরে যাচ্ছে।কিন্তু সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত,জিজ্ঞেসও করতে পারছে না!!আজ কি জানতে পারবে,কি চায় মেয়েটা!!একেবারে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো প্রিয়ম।ওখান থেকে একটু সরে,জলের ট্যাঙ্কগুলোর পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালো ও....
-তুই আমার কথাটা তো শোন ঝোরা!
-অরি!!তুই শোন!ভালো করে শোন,শেষবারের মতো শোন!তোকে আমি আমার বিছানায় জায়গা দিয়েছি,আমার জীবনে নয়!
কেঁপে উঠলো প্রিয়ম।আর কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছে করছে না ওর।এটুকু শুনেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।চোখে জল এসে গেছে।এটা তো ঝোরার অতীত নয়,এটা তো ওর বর্তমান....চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়ম...
-এরপর যদি কোনোদিনও এই রামধনু এপার্টমেন্টের আশেপাশেও তোকে দেখি,সেদিনই খুন করে ফেলবো!আমি কোনো কমিটমেন্ট করেছি তোকে?বল...কিরে বল?!
চেঁচিয়ে উঠলো ঝোরা...
-না!
-কথা দিয়েছি তোকে বিয়ে করবো?
-না!
-কোনোরকমের কোনো সুযোগ-সুবিধা নিয়েছি তোর থেকে?টাকা-পয়সা কিছু চেয়েছি কোনোদিন?
-না!!
-ব্যাস!!তোকে তো কোনোভাবেই ব্যবহার করিনি আমি।আর তুই বাচ্চাও নোস,যে না জেনেবুঝে সব করেছিস,বা আমি তোকে বাধ্য করেছি!আমাদের একটা ওপেন রিলেশন ছিলো।যার যখন ইচ্ছে হবে,সে বেরিয়ে যাবে।এইরকমই একটা বোঝাপড়া ছিলো আমাদের।আর সেটাও তুই খুব ভালো করেই জানিস অরিত্র।ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে আমি তোকে চিনিও না!!উই আর বেড-পার্টনার অরি,নট লাইফ-পার্টনার!!ব্যাস!প্রথম থেকেই তো সব একেবারে জলের মতো পরিষ্কার ছিলো আমাদের মধ্যে...
প্রিয়ম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।রীতিমতো কাঁপছে...এটা যদি ঝোরার বর্তমান হয়,তবে ওর অতীত কি!!
-কিন্তু আমি যে তোকে ভালোবাসি!
-সেটা তোর সমস্যা অরি!আমার নয়!
-না,আমি জানি!কোথায় আটকাচ্ছে?
-কি জানিস তুই?
-ওই ফোনের ওপার থেকে তুই কি এমন পাচ্ছিস ঝোরা,যা আমি তোকে দিতে পারতাম না?
-মানে!!
-রোজ অফিস থেকে বেরিয়ে পার্কে গিয়ে,কানের মধ্যে যে ফোন গুঁজে বসে থাকিস,কি পাচ্ছিস ওখানে...
-তুই আমার ফলো করছিস অরি!!আনবিলিভেবল!
-ইয়েস!!এটা আমার কাছেও অবিশ্বাস্য,যে তুই আমার নম্বর ব্লক করতে পারিস!!
-আমি রাখছি!
-আবার ব্লক করবি?
-রাখছি!
-ঝোরা আমি তোর জন্য মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি পর্যন্ত....
আর কিচ্ছু শোনে না ঝোরা।অরিত্রর মুখের ওপরেই লাইনটা কেটে দেয়।আবার ব্লক করে ওর নম্বরটা...
নিজেকে একটু সময় দেয় প্রিয়ম।হঠাৎ করে এই ধাক্কাটা নিতে ওর একটু সময় লাগে....
"মা-রে!!আমি জীবনে যে ভুল করেছি,তুই কোনোদিনও সেই ভুলটা করিস না।ক্ষমা করিস না!সব ভুলের ক্ষমা হয় না।লক্ষী মেয়ে হোস না,ভালো বউ হোস না!!জীবনে কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করিস না!!যেখানে অন্যায় দেখবি,সেখানেই মুখ খুলবি!নইলে কিন্তু পড়ে-পড়ে আমার মতো মার খেতে হবে রে..."
মৃত্যুশয্যায় মা ঝোরার দুটো হাত জড়িয়ে ধরে এটুকুই বলতে পেরেছিলো।এটুকুই ছিলো মেয়েকে বলা মায়ের শেষ কথা!!আজ মা-কে যদি একটু জড়িয়ে ধরা যেতো!!দাদা পর্যন্ত আজ ওর গায়ে হাত তুলতে এসেছে!!বৌদি দাদাকে না ধরলে হয়তো মেরেই বসতো!কোথায় গিয়ে একটু কাঁদবে ও!!দূরে রাজু দা গেটের সামনে টুলে বসে,একটা কুকুরকে কিছু খাওয়াচ্ছে....পুরো কমপ্লেক্স নিস্তব্ধ!মাথার ওপরে নক্ষত্রখচিত খোলা আকাশ!!গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদটা জ্বলজ্বল করছে...দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো ঝোরা...
ততক্ষণে প্রিয়ম ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে...
দুটো চোখ ভালোভাবে মুছে নিয়ে নীচে নামার জন্য পিছন ফিরলো ঝোরা...সেই মুহুর্তেই ওর চোখ পড়লো প্রিয়মের চোখে।ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ঝোরা...
-তুমি!!
প্রিয়ম একভাবে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে....
(চলবে....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন