ত্রিভুজ
সাথী দাস
অষ্টম পর্ব
-সবসময় ট্রুথ আর ট্রুথ!কখনও তো ডেয়ার নে!চিৎকার করে উঠলো দিয়া।
-হ্যাঁ,তারপর তোমরা আমাকে দিয়ে সব উল্টোপাল্টা কাজ করাও।ঋদ্ধি বললো।
-বাব্বা!খুব সাহসী ছেলে তো!
-ওই দিয়া...
-কি ওই!একবারও নিয়েছিস ডেয়ার?
-আচ্ছা,চল ডেয়ার!
-সত্যি!
-হুম,করিয়ে নে কি করাবি!
গুঞ্জা আর দিয়ার দুই মাথা একজায়গায় হয়ে গেলো।সোমদত্ত একটু শোনার চেষ্টা করতে গেলো,ওরা গুজগুজ করে ঠিক কি বলছে,কিন্তু গুঞ্জা ওকে কনুই দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো।অনেক আলোচনার পর দিয়া বললো,
-প্রোপোজ তিতির!
-কি!পাগল নাকি?আমি খেলছি না!তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো ঋদ্ধি।
-ওই যে বললাম,বিশাল সাহসী!
বলেই গুঞ্জা আর দিয়া দাঁত বের করে হাসতে শুরু করে দিলো।
-অসম্ভব!আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পারবো না!
দিয়া একভাবে চেয়ে রইলো ঋদ্ধির দিকে।তারপর বললো,
-তুই তো খুব সাহসী ঋদ্ধি!কোথায় রাখিস রে এত সাহস?
-দেখ,সাহসটা অন্য ব্যাপার!কিন্তু তিতিরকে কি করে আমি...
-এই করলে কর,নইলে ছাড়!
-আররে হ্যাঁ বলে দেবে তো!
-ভালোই তো!অসুবিধা কোথায়!গুঞ্জা বললো।
আবারও দিয়া আর গুঞ্জা মুখ টিপে হেসে ফেললো।
-আরে নানা,হ্যাঁ বলবে না,বুঝে যাবে,খেলা হচ্ছে!নইলে কথা নেই-বার্তা নেই,কেউ এসে ওভাবে বলে নাকি!যা ঋদ্ধি,বলে দে দেখি কেমন পারিস!গুঞ্জা ওকে উৎসাহ দেয়...গো ঋদ্ধি গো!!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেলো ঋদ্ধি।টিফিনের সময় ক্যান্টিনে বসে জলের বোতল ঘুরিয়ে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলছিলো ওরা।একটু দূর থেকে,অনেকক্ষণ ধরেই তিতির মাঝে-মাঝেই দেখছিলো ঋদ্ধিকে।ও বরাবরই তাই করে।ক্লাসের মোটামুটি সবাই জানে,তিতির পছন্দ করে ঋদ্ধিকে।আগে তিতিরের সঙ্গে এক-দুবার খুব প্রয়োজনে কথা হয়েছে ঠিকই,কিন্তু তাই বলে প্রেম-ভালোবাসা ব্যাপারটা ঋদ্ধির ঠিক হজম হয় না।তাই ঋদ্ধি ওকে দেখলেই উল্টোদিকে দৌড় মারে।আজ দিয়ার জন্য এই প্রথম যেচে কথা বলতে যাচ্ছে ওর সঙ্গে।যত্তসব ঝামেলা!!
দিয়া,সোমদত্ত আর গুঞ্জা একভাবে চেয়ে রয়েছে ওদের দিকে।ঋদ্ধি গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো ওর সামনে।তারপর ওর পাশের মেয়েটাকে কিছু একটা বললো,উঠে গেলো মেয়েটা!ঋদ্ধি ওর কাছে যাওয়াতে তিতির যে ভীষণ খুশি হয়েছে,সেটা ওর উজ্জ্বল চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।কিছু একটা এবার বোধহয় বললো ঋদ্ধি।একটু হেসে মাথা নীচু করে নিলো তিতির।ওইটুকু সময়ে অসহায় হয়ে ঋদ্ধি দিয়াদের দিকে তাকালো।ঋদ্ধির করুণ দৃষ্টি দেখে দিয়ার মনে হলো ও বলতে চাইছে,
"এবার কি করবো আমি!!"
এবার সত্যিই হাসি পেয়ে গেলো দিয়ার।মেয়েটা সত্যিই হ্যাঁ বলে দিলো নাকি!এত তাড়াতাড়ি?!যদি তাই হয়,তবে ঋদ্ধি ওকে আজ মেরেই ফেলবে!গুঞ্জার হাত ধরে টেনে চুপচাপ ওখান থেকে সরে গেলো ওরা।একমাত্র সোমদত্তই ঋদ্ধির জন্য ওখানে দাঁড়িয়ে রইলো।একটু দূরে...তিতিরকে তখন প্রাণপণে হাত-পা নেড়ে ঋদ্ধি কিছু একটা বোঝাচ্ছে।ভয়ের চোটে আর ওইদিকে তাকালো না দিয়া।ক্লাসে চলে এলো!আজ ওর কপালে চরম দুঃখ আছে!
একটু পরেই ঋদ্ধি ক্লাসে এসে ঢুকলো।গুঞ্জা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে,যেন ঋদ্ধিকে দেখতেই পায়নি।ঋদ্ধি সোজা দিয়ার সামনে এসে বললো,
-আজকের হিসেবটা তোলা রইলো।যেদিন সুযোগ পাবো,সেদিনই তোকে সুদসমেত ফেরত দেব!
-এই শোন না,হ্যাঁ বলেছে নাকি?
কোনোরকমে ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলো দিয়া।কিন্তু ঋদ্ধি ওর দিকে এমনভাবে তাকালো,যেন ওকে ভস্ম করে দেবে!আর কিছু বলার সাহস হলো না দিয়ার।একটু পরেই তিতির ক্লাসে ঢুকে ওর ডেস্কে গিয়ে বসলো।এই প্রথম দিয়া দেখলো,তিতিরের চোখ দুটো ক্লাসে ঢুকে ঋদ্ধিকে খুঁজলো না।ওর চোখ দুটো একটু লাল।চোখেমুখে জল দিয়ে এসেছে হয়তো!পিছনের ডেস্কের ঋদ্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলো,ও অন্যদিকে চেয়ে রয়েছে,মুখটা গম্ভীর।তার মানে ঝামেলাটা ভালোই বেধেছে।একটু আস্তে-আস্তে ঋদ্ধির দিকে ফিরে দিয়া বললো,
-সরি!
ঋদ্ধি চুপ করে আছে।
-ওই ঋদ্ধি!সরি!আমি বুঝতে পারিনি রে,এত তাড়াতাড়ি...
-আমি তো পেরেছিলাম,ওইজন্য বারবার বলেছিলাম তোদের,হ্যাঁ বলে দেবে,হ্যাঁ বলে দেবে!ওকে বোঝাতে আমার জীবন বেরিয়ে গেছে।দেখ,আমার দ্বারা এসব প্রেম হবে না!কিন্তু তাই বলে অন্য কারোর মন আমি কেন ভাঙবো!তাই আমি ওর থেকে দূরে-দূরে থাকতাম।সেই তোরা,মানে কি আর বলবো...
-আমি কথা বলবো তিতিরের সঙ্গে?
-থাক!তার আর কোনো দরকার নেই!ওকে ওর মতো ছেড়ে দে!
-একটা কথা বলি ঋদ্ধি?
-কি?
-অসুবিধাটা কোথায়?তিতির তো ভালো মেয়ে!মিষ্টি দেখতে...
-তো?
-মানে,তুই আর ও যদি...
-আমার দ্বারা ওসব হবে না রে!আমি একভাবে বেশিদিন কারোর সঙ্গে থাকতে পারবো না।তাই আমাকে নিয়েও কেউ চলতে পারবে না।আমি কারোর মনের মতো হয়েও বাঁচতে পারবো না।ওই গুঞ্জা আর সোমদত্তর মতো মুখোমুখি বসে দিনরাত ন্যাকামি করা তো সম্ভবই না।সেটা যখন আমি জানি,যে আমি কারোর জন্য কিছুই করতে পারবো না,তখন কেন একজনের জীবন নষ্ট করবো বল তো!আমার জন্য ওই কম্পিউটার গেম,সিনেমা,খেলা,আড্ডা আর তোরা আছিস তো!ব্যাস...
-কিন্তু গুঞ্জা সোমদত্তর সঙ্গে ভালো আছে,আনন্দে আছে!দেখ ওদের,কি সুন্দর লাগে দেখতে...
-যত্তসব ন্যাকামি!!
-বুঝলাম!তোর দ্বারা হবে না।অনেক গভীর তুই ঋদ্ধি!আমাদের মতো সাধারণ মানুষ না।তুই তো মহাপুরুষ!সরি রে!
-ঠিক আছে!ঠিক আছে!কিন্তু তার মানে এই নয় যে,আমি সব ভুলে যাবো।সময়-সুযোগ পেলেই তোর সঙ্গে সব হিসেব চুকিয়ে নেবো... একটু হেসে ঋদ্ধি বললো।ঘুরে বসতে গিয়ে দিয়া দেখলো,তিতির দূর থেকে একভাবে ওদেরই দেখছিলো।ওর চোখে দিয়ার চোখ পড়ে যাওয়ায়,মুখটা ফিরিয়ে নিলো মেয়েটা।এবার দিয়ারও একটু খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্য...
-কিরে দিয়া,এবার সরস্বতী পুজোয় কি শাড়ি পরবি?রমা জিজ্ঞেস করলো।
-দেখি আন্টি!মা কি শাড়ি দেয়!প্রথমবার শাড়ি পরবো, সামলাতে পারলে হয়!হালকাই কিছু পরবো।
-চল আমার আলমারীতে দেখ তো,কোনো শাড়ি তোর পছন্দ হয় কিনা!
-না আন্টি,মা বলেছে তো...
-ওঠ-ওঠ!মায়ের শাড়ি একবেলা পরবি,আমার শাড়ি একবেলা!কথা কম বল।ওঠ!
টেনে ডাইনিং টেবিল থেকে দিয়াকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো রমা।সৈকত খবরের কাগজে সেদিন সন্ধ্যেবেলা একটু চোখ বোলাচ্ছিলো।সকালে তাড়াহুড়োয় ভালোভাবে দেখা হয়নি কাগজটা।ঘরে ঢুকে সৈকতকে দেখে দিয়া বললো,
-ভালো আছো আঙ্কেল?
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললো সৈকত।
-হ্যাঁ রে মা ভালো।তুই ভালো তো?
-হ্যাঁ আঙ্কেল!
-পড়াশোনা সব ঠিকঠাক চলছে?
-একদম!
-আচ্ছা-আচ্ছা!
-ওই মেয়ে,এদিকে আয়।
নিজের আলমারী খুলে দিয়াকে ডাক দিলো রমা।গুটি-গুটি পায়ে দিয়া এগিয়ে গেলো ওদিকে।সৈকত দিয়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।নীলিমার কিচ্ছু ফেলেনি মেয়েটা,সেই চোখ-সেই মুখ!এক্কেবারে মায়ের মুখটা যেন কেটে বসানো!দিয়ার মধ্যে সৈকত যেন কিশোরী নীলিমাকে দেখতে পায়।একটু হেসে আবার কাগজে মন দিলো সৈকত।
-আন্টি তুমি তো খাটের ওপর শাড়ির দোকান খুলে দিলে!
-কোনটা নিবি?
-এটা নিই?
একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ির ওপর হাত রাখলো দিয়া।
-নে!আর একটা নে না!
-আর না!বাপরে!তাই পরবো কিনা ঠিক আছে?দেখা গেলো হাঁটতে গিয়ে মাঝ-রাস্তায় শাড়ি খুলে ঘেঁটে গেলো পুরো!
রমা আর দিয়া দুজনেই একসঙ্গে সশব্দে হেসে ফেললো।
টিউশন থেকে বাড়ি ফিরে সবে ওপরে নিজের ঘরে যাচ্ছিলো ঋক।ঋদ্ধি বাড়িতে নেই,সোমদত্তর সঙ্গে বেরিয়েছে পাঞ্জাবী কিনতে!কাল সরস্বতী পুজোয় পরবে বলে।দিয়াকেও যেতে বলেছিলো,কিন্তু মায়ের নিতে আসার সময় হয়ে গেছে বলে ও আর যায়নি।ওপরে ওঠার আগে মায়ের ঘর থেকে দিয়া আর মায়ের হাসির শব্দ পেয়ে,পায়ে-পায়ে মায়ের ঘরের দিকে গেলো ঋক।গিয়ে দেখলো,খাটের ওপর শাড়ির দোকান খুলে বসে আছে মা আর দিয়া।মায়ের আলমারী হাট করে খোলা।হেসে বেরিয়ে আসছিলো ঋক।কিন্তু সেই সময়েই সজোরে ফোনটা বেজে উঠলো।সৈকত উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলো,
-হ্যালো!হ্যাঁ-হ্যাঁ বলুন।সেকি!কি হয়েছে আপনার?আচ্ছা!আচ্ছা!সে আপনাকে কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না!আমি নিজে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসছি!হুম,রাখুন!রাখুন।
-কার কি হয়েছে গো?
রমা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেলো সৈকতের দিকে।সৈকত দিয়ার দিকে চেয়ে বললো,
-দিয়া,তোর মায়ের একটু শরীরটা খারাপ।অফিস থেকে সোজা বাড়ি চলে গেছে।
-সেকি!মায়ের কি হয়েছে আঙ্কেল?
-সেটা তো বুঝতে পারছি নারে মা!
ফোনের দিকে এগিয়ে পাগলের মতো নিজের বাড়ির নম্বর ডায়াল করতে থাকে দিয়া।
-হ্যালো মা,কি হয়েছে তোমার?ও,এখন ঠিক আছো তো?আচ্ছা,আমি এক্ষুণি চলে আসছি।হুম!আচ্ছা।রাখছি।
-কিরে দিয়া?কি বললো নীলিমা?
-বললো তেমন কিছু নয়,একটু প্রেশারটা হাই হয়ে গিয়েছিলো বোধহয়,মাথা ঘুরে গেছিলো।এখন তো ঠিক আছে বলছে।অরণ্য আঙ্কেল ট্যাক্সি করে মাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।
-ও আচ্ছা!যাক বাবা!একটা মানুষ তো তবু সঙ্গে আছে!
-আন্টি,আমি এক্ষুণি বেরোব।
-হ্যাঁ মা,নিশ্চয়ই বেরোবি!তোকে আঙ্কেল....
বলেই দরজার দিকে তাকালো রমা,ঋকের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তোকে ঋক গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবে!
চমকে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকালো ঋক।মা ওর দিকেই চেয়ে আছে।সঙ্গে-সঙ্গেই মাথাটা নামিয়ে নিলো ও।
-কিরে ঋক?কোথাও বেরোবি তুই এখন?
-নাঃ!গলা নামিয়ে ঋক বললো।
-কিন্তু আজ তো গোবিন্দদা ছুটি নিয়েছে!সৈকত বললো।
-তো?ঋক ড্রাইভ করে তোমাকে এ দোকান থেকে ও দোকানে নিয়ে চলে যাচ্ছে,আর এখান থেকে এইটুকু রাস্তা যেতে পারবে না!!খুব পারবে!
গলা চড়লো রমার।
-হ্যাঁ,কিন্তু সেতো দিনের বেলা,এমনিতেই নতুন হাত,বাইক-গাড়ি দুটোই সবে-সবে শিখেছে।এই অন্ধকার রাস্তায় যদি...
-আমি পারবো বাবা!মা,জামাটা বদলে নীচে আসছি আমি।
গলা নামিয়ে ঋক বললো।তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
রমা মুখ টিপে হেসে একবার সৈকতের দিকে তাকালো।তারপর দিয়াকে বললো,
-শাড়িটা ব্যাগে ভরে নে তো দিয়া,তারপর রান্নাঘরে আয় আমার সঙ্গে।তোর আর নীলিমার রাতের খাবারটা গুছিয়ে দিই...অসুস্থ শরীরে রাতে আবার কি রান্না করবে...নে-নে!আয় তাড়াতাড়ি!
খাবারের ব্যাগটা গাড়ির পিছনের সিটে রাখলো ঋক।তারপর নিজে বসলো স্টিয়ারিং ধরে।একটু পরেই দেখলো,দিয়া স্কুলব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসছে।ও গাড়ির একটু কাছে এগিয়ে আসতেই সামনের দরজাটা খুলে দিলো ঋক।উঠে বসে দরজাটা টেনে দিলো দিয়া।ঋকের দিকে চেয়ে একটু হাসলো ও।গাড়ি স্টার্ট দিলো ঋক।বেশ কিছুক্ষণ ওদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা নেই।ঋক নিজেই প্রথম কথা শুরু করলো,
-কাল তো স্কুলে তাড়াতাড়ি অঞ্জলি হবে!সকাল-সকাল চলে এসো।
-হুম!দেখি,মায়ের শরীরটা কেমন থাকে।
-হ্যাঁ,সেতো অবশ্যই।আমি দেখি গিয়ে আন্টি কেমন থাকে,তারপর নইলে ডাক্তার আঙ্কেলকে নিয়ে গিয়ে একবার...
-জানো ঋক,মা আমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করে!সব রোগের ওষুধ আছে বলো,কিন্তু চিন্তা রোগের তো কোনো ওষুধ নেই!বললেও শোনে না গো!আর এ কি কোনো ওষুধ বলো,যে জোর করে একটু খাইয়ে দিলাম!রোগ সেরে গেলো!মাঝে-মাঝে আমার খুব ভয় করে জানো তো!জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখছি,সারাটা জীবন ধরে শুধু যুদ্ধই করে গেলো মা,কবে যে আমি একটু বড় হবো!
-তুমি তো বড় হয়েই গেছ দিয়া!
মৃদু হাসলো শারদীয়া।তারপর ঋকের দিকে তাকালো।
-না,হেসো না।তোমার মাকে তুমি বুঝতে পারছো দিয়া।এটাই তো যথেষ্ট।সত্যিই,কিভাবে মানুষটা সারাটা জীবন একা লড়ে গেলো!আমার মা সবসময় নীলিমা আন্টির কথা বলে!
-হুম,জানি!মা-ও বলে,তোমরা না থাকলে হয়তো এতটা নিশ্চিন্ত হয়ে আমাকে রেখে অফিস যেতে পারতো না।আর একটু বড় হয়ে নিই,আর একটু পড়াশোনা,একটা চাকরি!ব্যাস!!মায়ের ছুটি ঋক!আর কাজ করতে দেবো না মাকে!ততদিন পর্যন্ত একটু কষ্ট...
দিয়ার ডান হাতে ঋক নিজের বাঁ হাতটা রাখলো।তারপর চেপে ধরলো ওর হাতটা...
-সব ঠিক হয়ে যাবে!
-জানি ঋক।কিন্তু সেই সব ঠিক হওয়ার দিনটা যে এখনও বড্ড দূরে!আচ্ছা,এইখানেই দাঁড় করিয়ে দাও।ঘুরিয়ে নাও গাড়ি।তুমি কি ওপরে আসবে?
-তুমি 'না' বললে আর কি করে যাই বলো?
ঋকের কথা শুনে হেসে ফেললো দিয়া।
-এবাবা!আমি কেন না বলতে যাবো?কি আশ্চর্য!সবে টিউশন থেকে ফিরেই আবার আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলে,কিছু খাওনি পর্যন্ত!তাই বলছিলাম।
-ও ঠিক আছে,আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে রেখে আসছি।এখান থেকে ফিরে যেতে পারি?আন্টিকে একটু দেখেই যাই!মৃদু হেসে ঋক বললো।
-আচ্ছা!
বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঋক আর দিয়া।একটু পরেই অরণ্য আঙ্কেল এসে দরজা খুলে দিলো।
-আয় দিয়া।তোর জন্যই বসে ছিলাম।ফাঁকা বাড়িতে তোর মাকে একা রেখে যেতে ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না।নীলিমা বললো,সামনের ফ্ল্যাটের ওনারাও বাইরে বেড়াতে গেছেন।তাই আমি তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।আমি তাহলে এখন আসি?
-আঙ্কেল,একটু চা বা কফি?
-না,থাক!মাকে দেখ তুই।এখন যদিও ভালোই আছে।তবুও..
-একদম আঙ্কেল!
-আসছি তাহলে দিয়া!এলাম প্রান্তিক!টাটা!
-ওকে আঙ্কেল,বাই!
খাবারগুলো টেবিলের ওপর রেখে,স্কুল ব্যাগটা নিজের ঘরের বিছানার ওপর ফেলে,আগে মায়ের ঘরে ঢুকলো দিয়া।পিঠের নীচে বালিশ রেখে আধশোয়া হয়ে ছিল নীলিমা।মেয়েকে আর ঋককে দেখে পুরোপুরি উঠে বসলো।
-উঠছো কেন মা?সকালে প্রেশারের ওষুধটা খাওনি,তাই না?
-আজ ভুলে গেছিলাম রে!
-সেতো বুঝতেই পারছি!
-আন্টি তুমি উঠো না,একটু রেস্ট নাও!ঋক বললো।
-আরে ঠিক আছি রে,কিচ্ছু হয়নি আমার।একটু বসে বিশ্রাম নিলে অফিসে কাজও করতে পারতাম,অরণ্যর সবেতেই বাড়াবাড়ি।স্যার-কে বলে আজ আর কাল ছুটি করিয়ে দিলো।
-ঠিক করেছে আঙ্কেল!তোমার একটু বিশ্রাম দরকার মা!
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো দিয়া।একটা প্লেটে একটু খাবার নিয়ে আবার মায়ের কাছে এলো।
নীলিমা তখনও বলে চলেছে,
-নেবো তো রে!আর তো কয়েকটা বছর!তারপরই তো আমার বিশ্রাম!
-এই নাও,এটা একটু খেয়ে নাও তো!আন্টি পাঠিয়েছে!
-উফফ!রমাও পারে রে,সারাদিন সংসার সামলে আবার এসব...
-খেয়ে নাও আন্টি!তারপর ওষুধ খেয়ে...
-তোমাকে বেশি কথা বলতে হবে না।তুমি নিজে খেয়েছো টিউশন থেকে ফিরে!?এদিকে এসো।টেবিলে এসে বসো!
ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো দিয়া।
-এই না দিয়া,আমি এখন আর কিছু...
-আমার যা বলার বলা হয়ে গেছে কিন্তু ঋক!এক কথা আমি বারবার বলি না...ডাইনিং থেকে চেঁচিয়ে দিয়া বললো।
-যা বাবা!দিয়া কি দিচ্ছে দেখ গিয়ে,একটু কিছু মুখে দিয়ে নে!খালি পেটে থাকিস না।এখন আমাদের তো অসুস্থ হওয়ারই সময়,বয়স হচ্ছে!তোদেরই তো ঠিক থাকতে হবে বল!নইলে আমরা কাদের ওপর ভরসা করবো!
মাথা নীচু করলো ঋক।
-যা,খেয়ে নে!
-ঋক...ডাইনিং থেকে চেঁচালো দিয়া।
-আসছি!
উঠে গেলো ঋক।
-এতসব কি দিয়া?
-রমা আন্টিই পাঠিয়েছে,জানোই তো।আমরা দুজন মানুষ খাবো,চারজনের খাবার পাঠায়।মিষ্টিটা শুধু আমাদের ফ্রিজে ছিল।কথা কম,চুপচাপ খাও!
আর কথা বাড়ালো না ঋক।খিদেও পেয়েছিলো ওর।কিন্তু নিজের জন্য,ঘরের লোক হোক বা বাইরের লোক,ও কোনদিনও কাউকে বিরক্ত করতে চায় না!তাই আর মুখে কিছু বলেনি।
দিয়া দেখলো,অল্প সময়ের মধ্যেই প্লেট ফাঁকা হয়ে গেলো ঋকের।প্লেটটা তুলে রান্নাঘরের বেসিনে নিয়ে যেতে-যেতে ও বললো,
-পেটটা তো আমার ভরলো,তাই না?
হেসে ফেললো ঋক।
-আমি দেখি গিয়ে মা খেলো কিনা!
-হুম চলো,আমিও আন্টির সঙ্গে দেখা করে চলে যাই!রাত তো অনেক হলো!
ঘরে ঢুকে দিয়া আর ঋক দেখলো,নীলিমা খাবার খেয়ে ফাঁকা প্লেটটা বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দিয়েছে,আর ওষুধও খেয়ে নিয়েছে।ওষুধের ফাঁকা বাক্স থালায় পড়ে রয়েছে।আর নীলিমা নিজে বালিশে মাথা দিয়ে কাৎ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখে-মুখে ক্লান্তির চাপ স্পষ্ট!মাকে এভাবে অসহায়ের মতো শুয়ে থাকতে দেখে বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো দিয়ার।আন্টি ঘুমিয়ে পড়েছে দেখেই দরজার সামনে থেকে সরে গেছে ঋক,আর ঘরে ঢোকেনি ও।দিয়া মায়ের পাশ থেকে এঁটো থালাটা তুলে নিয়ে ঘরের ছোট আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে,ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।জন্মাবধি সবসময় মা-কে দৌড়ে বেড়াতে দেখেছে দিয়া,এইভাবে একটু-একটু করে মায়ের শরীর ভেঙে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও।চোখে জল এসে গেছিলো।কোনোরকমে গিলে ফেললো কান্নাটা...
-আসছি আমি।ঋক বললো।
-হুম!নিজেকে সামলাতে গিয়ে একটু কেঁপে গেলো দিয়ার গলাটা।চমকে উঠে ফিরে দাঁড়ালো ঋক।
-কি হয়েছে দিয়া?তুমি ঠিক আছো?
-হ্যাঁ!
-না!তুমিই ঠিক নেই।আমায় বলো কি হয়েছে!
-মা-কে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না ঋক।সকালে উঠে চিৎকার করে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলবে,খাইয়ে দেবে,এভাবেই মায়েদের দেখতে ভালো লাগে।এইরকম বিছানায় শুয়ে পড়লে,মনে হয় পৃথিবীটাই অন্ধকার। যা খুশি হোক, আমার মাকে সবসময় ঠিক থাকতেই হবে ঋক...কেঁদে ফেললো দিয়া।
সদ্য-যৌবনপ্রাপ্ত ঋক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলো দিয়াকে।সব সহ্য হয় ওর,খিদে-তৃষ্ণা-নির্ঘুম রাত-আঘাত-প্রত্যাঘাত সব।সহ্য হয় না কেবল দিয়ার চোখের জল।বড্ড দুর্বল করে দেয় ওকে।বুকের ভিতরটা যেন তোলপাড় হয়ে যায়।দিয়াকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরে ও তাড়াতাড়ি বললো,
-শোনো দিয়া,সব ঠিক হয়ে যাবে।এত ভেঙে পড়লে হয়?আন্টি ভালো আছে।তবে ভীষণ ক্লান্ত!বয়স হচ্ছে তো বলো!একটু বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।কাল সকালেই আবার চিৎকার করে তোমাকে ডেকে বলবে,কিরে ওঠ!
-ঠিক তো?
-একদম ঠিক!তুমি দেখে নিও।
-হুম!
ঋকের দিকে মুখ তুলে চাইলো দিয়া।ওর বড়-বড় কাটা-কাটা চোখদুটো তখনও ভিজে।যে ইচ্ছেটা এর আগে কোনোদিনও হয়নি,আজ সেটাই ভীষণভাবে হল ঋকের।দিয়ার দুটো ভেজা চোখে নিজের ঠোঁটদুটো চেপে ধরতে ইচ্ছে করলো।ওকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করলো,"তোমার কোনো চিন্তা নেই দিয়া,আমি তো আছি,আমি সব ঠিক করে দেবো!" কিন্তু পারলো না,দিয়ার শরীরটা ওর অনুমতি ছাড়া সেভাবে ছোঁয়ার কথা ভাবতেও পারে না ঋক।দিয়া ওর দিকে একভাবে চেয়ে থেকে বলে উঠলো,
-তুমি ঠিকই বলেছিলে ঋক!স্কুলে বিকাশের সঙ্গে ঝামেলাটা যদি আরও বাড়তো,তা হলে মাকেও হয়তো স্কুলে যেতে হতো!মা আরও চিন্তায়-চিন্তায় শেষ হয়ে যেত।তুমি না থাকলে আমি হয়তো সেদিন ওই ভুলটাই করে বসতাম।থ্যাঙ্কু ঋক!আসলে সেই মুহূর্তে আমি অতদূর পর্যন্ত ভাবিই নি।কিন্তু তুমি ভেবেছিলে!থ্যাঙ্কু।
ঋককে তখনও আলগা করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে দিয়া।কিন্তু ঋকের প্রবলভাবে ইচ্ছে করছে,দিয়াকে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিতে।ওর চুলের গন্ধে তখন পাগলের মতো অবস্থা ওর।এরপর তো আর নিজেকে সামলাতেই পারবে না ঋক।ও তাড়াতাড়ি করে দিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
-কোনো ব্যাপার না!সব ঠিক আছে তো,শুধু আমায় ভুল বুঝো না তুমি!আর কিছু চাই না!
-হুম!একটু হেসে দিয়া বললো।
-বাড়ি গিয়ে রাতে ফোন করছি,আন্টি কেমন থাকে একটু...
-দরকার নেই,মা তো ঘুমিয়েই পড়েছে।তুমিও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।কাল সকালে তো আবার স্কুলে অঞ্জলি দিতে যাবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ঋকের বুক নিংড়ে,
-হুম,স্কুলের শেষ বছর!অনেক স্মৃতি পিছনে ফেলে যাওয়ার আগে,শেষ একবার ওদের সঙ্গে বেঁচে নিতে চাই।কাল তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে এসো।আমি কি গোবিন্দ কাকাকে পাঠিয়ে দেবো?
-নানা,আমি একাই চলে যাবো।
-আচ্ছা!আসছি দিয়া!গুড নাইট!
-গুড নাইট!
গাড়িতে বসেও বেশ কিছুক্ষণ আবিষ্ট হয়ে রইলো ঋক।দিয়া আজ প্রথমবার নিজে থেকে ওর এতটা কাছাকাছি এলো।নিজে থেকেই মন খুলে এতগুলো কথা বললো।ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি ছুঁয়ে গেলো ঋকের।ও গাড়িটা স্টার্ট দিলো...
ঋক চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে ঢুকলো দিয়া।নিজে দুটো খেয়ে নিয়ে সিঙ্কের বাসনগুলো মেজে নিলো।তারপর মায়ের ঘরে এলো।আজ রাতটা ও মায়ের কাছেই শোবে।আলো জ্বালাতেই দেখলো,মা একইভাবে ঘুমিয়ে রয়েছে।তবে ঘাড়টা বালিশের ওপরে একেবারে বেঁকে রয়েছে।বালিশটা ঠিক করতে যেতেই ঘুম ভেঙে গেলো নীলিমার।চোখ মেলে তাকালো ও।
-কিরে?ঋক খেয়েছে?
একটু হাসলো দিয়া।
-ঋক অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে মা!
-সেকি!আমাকে না বলে ছেলেটা চলে গেলো যে!এমনটা তো ও করে না!ঘুমজড়ানো গলায় নীলিমা বললো।
-বলতে এসেছিলো,তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে।
-ওহ!আসলে শরীরটা একটু দুর্বল তো...
-শরীরের আর কি দোষ বলো মা!বয়সটা তো কমে না,বাড়ে!এত খাটনি সহ্য হবে কেন!
-থাক,আর আমাকে অত বকতে হবে না!যা দেখি,শুয়ে পড় এবার!কাল তো আবার পুজো আছে,স্কুলে অঞ্জলি দিতে যাবি তো?
-সে সকালে দেখি,তোমার শরীর কেমন থাকে,তারপর...
-আমি ঠিকই আছি।তোমাকে আর বেশি পাকামি করতে হবে না।তুমি যাবে।এমনিতে তো লেখাপড়াতে বিদ্যাসাগর,যাও কাল গিয়ে একটু মায়ের কাছে মাথা ঠুকে এসো,তাতে যদি কিছু হয়!
হেসে ফেললো দিয়া।এমনিতে মা আজকাল আর পড়তে বসতে প্রায় বলেই না।কারণ ওর পরীক্ষার রেজাল্ট একেবারে প্রথম সারিতে রাখার মতো না হলেও,খারাপ কোনোদিনই হয় না।তবে মাঝে-মধ্যে বলতেও ছাড়ে না।তখন মায়ের ওই আদরের শাসনটুকুও বেশ লাগে দিয়ার।উঠে বসে দিয়ার চুলে হাত দিয়ে নীলিমা বললো,
-চিরুনিটা নিয়ে আয় তো রে,তোর চুলটা একটু বেঁধে দিই।কি অবস্থা করেছিস মাথাটার!
-ধুর!থাক তো!তুমি ঘুমোও..
কিছুতেই শুনলো না নীলিমা।একটু ঘুমিয়ে নেওয়াতে এখন শরীরটা বেশ ঝরঝরেই লাগছে ওর।জোর করে বিছানায় বসেই মেয়েটার চুল বেঁধে দিলো ও।তারপর বললো,
-যা,এবার শুয়ে পড়।ভোরবেলা আবার উঠবি তো?
-আজ তোমার কাছে শোব মা!
-আমার কাছে শুবি?আচ্ছা আয়!
মায়ের কোলে মাথা রাখলো দিয়া।নীলিমা মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে-দিতে বললো,
-এবার চোখদুটো বন্ধ কর দেখি,অনেক রাত হয়েছে!
-মা?
-হুম বল!
-তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-বল না!
-আচ্ছা অরণ্য আঙ্কেল...
চুপ করে রইলো নীলিমা।সেই সঙ্গে দিয়াও।
-বল কি বলবি?
-না মানে,অরণ্য আঙ্কেল কি শুধুই তোমার অফিস কলিগ?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
চুপ করে রইলো দিয়া।
-তোর মনে যা চলছে,বলে দে দিয়া।মনের মধ্যে কৌতূহল চেপে রেখে ভুল ধারণা বাড়তে দিস না।তাতে সম্পর্কের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে।তা সে সম্পর্ক,যতই গভীর হোক না কেন!বল আমায়,ঠিক কি জানতে চাস তুই!!
-না,আঙ্কেলকে দেখে আমার মনে হয়,ঠিক যেন তোমার আর পাঁচজন স্বাভাবিক অফিস কলিগের মতো নয়,একটু বিশেষ কেউ!তোমাকে যেন উনি একটু বেশিই প্রাধান্য দেন!
-অরণ্য আমার খুব ভালো বন্ধু দিয়া।বা বলতে পারিস,হয়তো বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু!
চুপ করে গেলো দিয়া।নীলিমা বুঝতে পারলো,উত্তরটা ঠিক মনের মতো হয়নি দিয়ার।মেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে,অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে।এবার ওকে বোধহয় সবকিছু বলাই যায়।দিয়ার থেকে বেশি আপন নীলিমার আর কে আছে!
-দিয়া?
-হুম!
-তোর বাপির মৃত্যুর পর অরণ্য আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলো।আমায় সেই সবকিছু অরণ্য দিতে চেয়েছিলো,যা জীবন তোর বাপিকে,দেওয়ার মতো সময় দেয়নি!
কথাটুকু বলে একভাবে দিয়ার মুখের দিকে চেয়ে রইলো নীলিমা,ওর অভিব্যক্তি দেখার জন্য।কিন্তু নীলিমা বেশ অবাকই হলো দেখে,দিয়া একটুও আশ্চর্য্য হয়নি।বরং ও বললো,
-এটাই আমারও মনে হয়েছিলো।কিন্তু তোমায় কোনোদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি।কিন্তু তুমি কেন..
হেসে ফেললো নীলিমা।
-হাসছ যে?আজও অরণ্য আঙ্কেল বিয়ে করলো না মা,তোমার জন্য!!
-সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।আমি তো তাকে অপেক্ষা করতে বলিনি।কোনোদিনই নয়,বরং সেই সময়ই তাকে বারবার বলেছিলাম,নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে!
-কি পেলে মা?
-মানে?বুঝলাম না!
-বিয়ে না করে,সমাজের চোখে আজীবন বাপির আদর্শ বিধবা হয়ে বেঁচে থেকে,কি পেলে তুমি?মরার সময় ওই সামনের ফ্ল্যাটের বুড়ির ভালোবাসা?
-উমহ!কতদিন না বলেছি,বড়মা বলবে,বুড়ি আবার কি!মেয়েকে মৃদু ধমক দেয় নীলিমা।
-ধুর!উঠতে-বসতে তোমায় কথা শোনাতো!আমি কি সব ভুলে গেছি নাকি!মরার সময় তোমার প্রতি যত ভালোবাসা একেবারে উথলে উঠলো!
-মাসিমা আমায় বরাবরই ভালোবাসতো,তোর বাপিকেও।তাই হয়তো তোর বাপির মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেনি।আর ওইরকম একটা বয়সে আমায় বিধবা হতে দেখে হয়তো দুঃখে..
-অরণ্য আঙ্কেলকে তো আমার ভালোই লাগে মা,তবে তুমি কেন...আচ্ছা,বললে নাতো,কি পেলে সারাটা জীবন একা থেকে?নীলিমার কোলে মাথা রাখলো দিয়া।
-আত্মতৃপ্তি!
-কি?
-জানিস দিয়া,জীবনটা বোধহয় ততটাও জটিল নয় রে,যতটা আমরা তাকে জটিল করে তুলি!আমার কাছে সবসময়ই একদম পরিষ্কার ছিল নিজের জীবনের লক্ষ্য।হয় তোর বাপি,নয়তো কেউ নয়!হ্যাঁ,অরণ্য আজও আমার মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে ঠিকই,কিন্তু তোর বাপির জায়গাটা কেউ কোনোদিনও নিতে পারেনি, পারবেও না,আমিই দিতে পারিনি।কি হতো বল,শুধু-শুধু একজনের জীবন নষ্ট করে,যদি তাকে সম্পূর্ণ ভালোই না বাসতে পারি।না থেকেও আমাদের মধ্যে আজীবন রণ থাকতো।আমিই তো ওকে আমার মধ্যে থেকে সরাতে পারতাম না,হয়তো অরণ্যর মধ্যেও রণ-কেই খুঁজতাম!কতদিন একটা মানুষ এটা মেনে নিতে পারতো বল?কেউ-কারোর মতো কোনদিন হতে পারে না রে!প্রত্যেকটা মানুষের একটা আলাদা সত্তা থাকে!হয়তো জীবন কাল তোকে এমন একটা ত্রিভুজের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে,যার চূড়ায় তুই দাঁড়িয়ে আছিস,আর নীচের দুটো বিন্দুতে তোর দুজন ভালোবাসার মানুষ!ভালো হয়তো জীবনে একাধিকবার বাসা যায় দিয়া,কিন্তু একাধিক ভালোবাসাকে সঙ্গে বহন করে আজীবন চলা যায় না।সেক্ষেত্রে তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হয়,হয়তো জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত!যে তুমি কি চাও!তুমি যা চাও,সেটাই করবে!মনের বিরুদ্ধে গিয়ে,না তুমি নিজেকে খুশি করতে পারবে,না সঙ্গের মানুষটাকে!আজীবন নিজের সঙ্গে-সঙ্গে,অন্য কাউকে ঠকানোর চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো।কারণ,ভালোবাসাহীন,ভিত্তিহীন সম্পর্কের ভাঙন সবসময়ই অবধারিত!তাই আমিও আর জীবনে অযথা জটিলতা বাড়াইনি।আবার শুরু করবো,পারবো না বয়ে বেড়াতে,আবার শেষ,আবার কষ্ট!কি হতো শুধু-শুধু সুন্দর একটা সম্পর্ককে তিক্ত করে!এই তো কেটেই গেলো জীবনটা!থেমে তো আর নেই বল!অরণ্যর জীবনে থেকে নয়,ওর সঙ্গে থেকে বন্ধুর মতো আমি ওকে ভালোবাসি।ভালোবাসা জিনিসটাই ভীষণ আপেক্ষিক দিয়া।যে যেভাবে নেবে,তার কাছে ঠিক সেইরকমই।কেউ হয়তো আমাদের সম্পর্কের মধ্যে নোংরামি খুঁজে পাবে,কেউ পবিত্রতা!কিন্তু প্রকৃত সত্যি তো এটাই দিয়া,যে অরণ্যর মনের সবটুকু জুড়ে যেমন আমি আছি,আমার মনের সবটুকু জুড়ে তোর বাপি আছে।যুগযুগান্ত ধরে,সব সম্পর্কের মধ্যেই একটা অদৃশ্য-অব্যক্ত ত্রিভুজ নিরন্তর কাজ করে চলে দিয়া।হয়তো আমরা সবসময় জানতেও পারি না।অরণ্য বলেছিলো,তাই আমি জেনেছিলাম।আর না বললে!সবসময় কি আমরা সব সম্পর্কের গভীরতা মাপতে পারি,না মাপা যায়!!তাই সেই চেষ্টাও করা উচিত না।কিছু-কিছু ক্ষতকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো রে।একটা সময় পরে,সব ক্ষত ঠিক পূরণ হয়ে যায়।একা হলেও,অরণ্য আজ ভালো আছে।হয়তো পায়নি কিছুই,কিন্তু হারায়ওনি।পেয়ে হারানোর থেকে তো এই ভালো।রণ আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে ভালো আছে।আমিও রণর স্মৃতিটুকু আগলে নিয়ে ভালো আছি।আর অরণ্য!ও-ও তো ওর মতো আমাকে ভালোবেসে ভালোই আছে।একা থাকার সিদ্ধান্তটা তো ওর একান্তই নিজের।সেখানে আমার তো কিছু বলার নেই।দিনের শেষে ও ভালো আছে,এটাই যথেষ্ট!আমরা একে-অপরকে নিয়ে নয়,একে-অপরকে ছাড়া ভালো থাকতে পারি দিয়া।জীবন আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে।একদম নিখুঁত,সুখী একটা ত্রিভুজ!আমাদের শুধু সঠিক সময়ে,সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় দিয়া,আমরা কাকে নিয়ে জীবনে বাঁচতে চাই।জীবনটাই একটা লড়াই রে মা,ভালো থাকার লড়াই।আর সেই লড়াইতে আমরা আমাদের সহযোদ্ধা হিসেবে কাকে পাশে পেতে চাই,এই সিদ্ধান্তটা একান্তই আমাদের!কোনো জোর চলে না,এই একটা জায়গায়।আমি তোর বাপিকেই বেছে নিয়েছিলাম।রণ-ই ছিল লড়াইয়ে,আমার সবটুকু শক্তির উৎস!
মায়ের কোলে শুয়েই মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো দিয়া।নীলিমা টেনে তুললো মেয়েকে,
-কিরে মা?কাঁদছিস কেন!
-আমি বাপিকে একবার দেখতেও পেলাম না মা!একটু বাপির কোলে উঠতেও পারলাম না।নীলিমার বুকের মধ্যে ঠেসে নিজের মুখ গুঁজে দিলো দিয়া।জড়িয়ে ধরলো মাকে...
কতদিন দিয়া ভেবেছে,মায়ের সামনে বাপির জন্য কোনোদিনও কাঁদবে না।কিন্তু আজ আর নিজেকে বাঁধতেই পারলো না ও।হাউহাউ করে কেঁদেই ফেললো।
মেয়েকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো নীলিমা।দিয়াকে ও সব দিতে পারে।আজ সে ক্ষমতা ওর আছে।কিন্তু পিতৃস্নেহ!সেটা দেওয়ার ক্ষমতা যে আজও নীলিমার নেই।সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে,মেয়ের চিন্তায়-চিন্তায় আজকাল আর রণ-কে খুব একটা মনে পড়ে না নীলিমার।সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে রণর মৃত্যুশোকও ম্লান হয়ে এসেছিলো।কিন্তু আজ বহু-বছর পর,দিয়া আবার সেই ক্ষতস্থান উন্মুক্ত করে দিলো।কোথা থেকে যেন একরাশ জল এসে নীলিমার চোখে ভিড় করলো।মেয়েটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে গুমরে কেঁদে উঠলো নীলিমাও।দেওয়ালে তখন ছবির মধ্যে থেকে রণজয় হাসছে...
(চলবে....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন