সেই তো এলে ভালোবাসা
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
দু'কামরার ছোট ফ্ল্যাটের প্ৰতিটি কোণে অনুষ্ঠানের ব্যস্ততা। জানালা-দরজায় রং-বেরংয়ের বেলুন ঝুলছে। এই ফ্ল্যাট অরুণাক্ষর নিজস্ব নয়। সে কেবল ভাড়াটে। কয়েক বছর আগে সৌভাগ্যক্রমে এক প্রবাসী বন্ধুর ফ্ল্যাট নামমাত্র ভাড়ার বিনিময়ে অরুণাক্ষ পেয়েছিল। ঠিকানা নিজের নয়, তবুও তাকে আপন করে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় অরুণাক্ষর বিন্দুমাত্র কার্পণ্য নেই। মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে ভূমিষ্ঠ হওয়া দুটি কন্যাসন্তানের আজ জন্মদিন। স্ত্রী সঞ্চারিণী ছাড়া অরুণাক্ষর জীবনের অর্থ মৃত্তিকা ও মিহিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
সৌভাগ্যের সন্ধানে একনাগাড়ে ছুটে চলেছে অরুণাক্ষ। আর্থিকভাবে খানিক সচ্ছল হতেও কেটে গেছে কয়েক বছর। তবু এখনও মাসের শেষে চিন্তার বক্ররেখা ওর কপালের শোভাবর্ধন করে। দীর্ঘকালীন যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে অরুণাক্ষর মনে হয়, ভাগ্যদেবীকে প্রসন্ন করা এত সহজ নয়। পরমুহূর্তেই মৃত্তিকা আর মিহিকা নামক দুই চালিকাশক্তির হাসিমুখের ছবি ভেসে ওঠে ওর মনে। ওদের সঙ্গে যোগদান করে ভালোবাসার প্রতিমূর্তি সঞ্চারিণী। তখন অরুণাক্ষর সকল আক্ষেপ দূর হয়ে যায়। তবে গভীর রাতে স্ত্রী-কন্যা ঘুমিয়ে পড়লে অরুণাক্ষ একাকী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরিবারের থেকে দূরে বসবাস করার কষ্ট ওর মনে সামান্য। শূন্য থেকে শুরু করার যন্ত্রণাও তেমন জোরালোভাবে নেই। নির্বাসন সেই অর্থে বেদনার নয়। কেবল যদি সেদিন মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসা যেত.... অন্তত দূর থেকে মায়ের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যটুকু পালন করার অধিকারও যদি পাওয়া যেত...
এই স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে অরুণাক্ষর মনে খেদ নেই। নিজেদের বৃহৎ পারিবারিক ব্যবসা, মা-বোন সকলের থেকেই দূরত্ব বজায় রেখেছে সে। শহর একই হলেও তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব অনতিক্রম্য। আক্ষরিক অর্থে খাতায়-কলমে ত্যাজ্যপুত্র না হলেও, অরুণাক্ষ জানে সঞ্চারিণীকে জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করার অপরাধে নিজের বাড়িতে কোনোদিন ওর ঠাঁই হবে না। তবুও মনের গোপন কোণে মাঝে মধ্যে ভেসে ওঠে বাড়ির ছাদের ছবি। নাকে ভেসে আসে পেট্রোলের গন্ধ। ভাই-বোনের খুনসুটি বাতাসে ভেসে অরুণাক্ষর কান ছুঁয়ে যায়। ভাতৃদ্বিতীয়া নিজস্ব গতিতে আসে, আবার ফিরেও যায়। ঐ একটি দিনে অরুণাক্ষর বড় কষ্ট হয়। কোমল স্পর্শের অভাবে রুক্ষ কপাল চড়চড় করে। শাড়ির দোকানের দিকে চেয়ে রাস্তার ওপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অরুণাক্ষ ফিরে আসে। একমাত্র বোন রাজন্যার কথা মনে পড়ে।
রংয়ের ডিলারশিপ নিয়ে একটি দোকানের ওপর ভরসা রেখে প্রাথমিকভাবে ব্যবসা শুরু করেছিলেন অরুণাক্ষর ঠাকুর্দা। ভাগ্যদেবী অত্যধিক সুপ্রসন্ন হওয়ায় অরুণাক্ষর বাবার মাধ্যমে সেই ব্যবসার পরিধি বিগত চল্লিশ বছরে আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। ক্রমে স্থানীয় বাজারে রংয়ের দোকান ছাড়াও একটি পেট্রোল পাম্প, একটি উপহার সামগ্রীর দোকান ও বাজার থেকে অদূরবর্তী স্থানে কয়েকটি গোডাউন ভাড়া দেওয়া আছে। তবে সে সকল পিছুটান ছেড়ে বর্তমানে একটি ইলেক্ট্রনিক্সের শোরুমে নির্দিষ্ট অঙ্কের বেতনের বিনিময়ে অরুণাক্ষ শ্রম প্রদান করে। সঞ্চারিণী একাধিকবার শ্বশুরবাড়ি ফিরতে চাইলেও অরুণাক্ষ মাথা নামিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। দূরে সরিয়ে রেখেছে নিজেকে।
মানে-অভিমানে, আদরে-সোহাগে সঞ্চারিণীর সঙ্গে অরুণাক্ষ বড় সুখী ছিল। এই সুখকে চিরস্থায়ী করতে নিজের পরিবার বৃদ্ধির কথা ভেবে দুটি মানুষ কামনার সমুদ্রে একান্তে ভাসিয়েছিল প্রেমের তরী। কিছুদিনের মধ্যে তারা জানতে পারে, নতুন অতিথিরা জোড়ে আসছে। একের অপেক্ষায় দ্বিগুণ প্রাপ্তিতে স্বভাবতই মানুষের মন প্রসন্ন হয়। কিন্তু অরুণাক্ষর চিন্তা বেড়েছিল। সীমিত উপার্জনে এতবড় পরিবার প্রতিপালনের ভয় চেপে বসেছিল ওর মনে। কিন্তু প্রথমবার দুটি শিশুকন্যার মুখ দেখে দারুণ মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিল সে। এমন মায়ার টান প্রত্যেক জন্মদাতা মাত্রই বোঝে। সেদিন থেকে কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তাকে মনে আশ্রয় দেয়নি অরুণাক্ষ। প্রাধান্য দিয়েছে কেবল কঠিন পরিশ্রম আর নিজের কর্মক্ষমতাকে।
এত বছর পরেও প্রতি মুহূর্তে একটা অপরাধবোধ অরুণাক্ষ নিজের মনের ভিতরে বয়ে বেড়ায়। মৃত্তিকা-মিহিকাকে জন্ম দেওয়ার সময় শারীরিক জটিলতার কারণে সঞ্চারিণী প্রায় মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে যায়। মৃত্তিকার ভগ্নস্বাস্থ্য এবং অসুস্থতার কারণে অরুণাক্ষ তখন দিশেহারা। তিনজন মানুষকে সুস্থভাবে বাড়ি ফেরাতে অরুণাক্ষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সেই আর্থিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে লেগেছে দীর্ঘ সময়। ছাত্র পড়ানোর মাধ্যমে সংসারের হাল ধরেছে সঞ্চারিণীও। তবে এর মাঝে বয়ে গেছে কিছু মধুর সময়। দারুণ আর্থিক অনটনের কারণে মৃত্তিকা-মিহিকার প্রথম অন্ন গ্রহণের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হয়নি আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে। উদযাপন করা হয়নি পাঁচ বছরের জন্মদিন। অবশেষে সংসারের টালমাটাল অবস্থা সামলে কন্যাদ্বয়ের আট বছরের জন্মদিন মহাসমারোহে পালিত হতে চলেছে। সেই আনন্দে পূর্বদিন রাত থেকে মুখরিত ছোট্ট ফ্ল্যাটের দুটি কামরা।
হই-হই করে কেটে গেল সমস্ত সন্ধ্যা। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই উৎসব সম্পর্কিত যাবতীয় আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করে ফিরে গেল। অরুণাক্ষর মন তখন কানায়-কানায় পরিপূর্ণ। নতুন জামা জুতো পরে কেক কাটার সময় মৃত্তিকা আর মিহিকার আনন্দ উপচে পড়া দৃষ্টি দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য অরুণাক্ষর দৃষ্টি ঝাপসা হয়েছিল। দুই মেয়ের মাঝে শুয়ে আদর করে ওদের ঘুম পাড়াতে চাইল অরুণাক্ষ। অরুণাক্ষর আদরের ভাগ নিয়ে মৃত্তিকা আর মিহিকার মধ্যে সবসময় এক অদৃশ্য ঠান্ডা লড়াই চলে। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে মিহিকা বলল, "বাবি, তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসো তো?"
"না, বাবি আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই না বাবি?"
দুই মেয়েকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে অরুণাক্ষ বলল, "আমি তোদের দু'জনকেই সমান ভালোবাসি। হ্যাঁ রে, সারা সন্ধ্যা হুড়োহুড়ি করেও তোদের চোখে ঘুম নেই?"
"বাবি আমরা গিফটগুলো কখন দেখব?"
"আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল আমি শোরুম থেকে ফিরে সবাই মিলে একসঙ্গে দেখব। এখন তোরা ঘুমিয়ে পড়। কাল স্কুল আছে। রাত জেগে পটর পটর করছিস, সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইবি না। তখন তোদের মা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। একদম চোখ বন্ধ। আর একটাও কথা নয়।"
"গুড নাইট বাবি!"
"তোমরা দু'জন আর একদম ঝগড়া করবে না। আমি যেন কথার আওয়াজ না পাই। গুড নাইট।"
মেয়েদের ঘরের আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে ফিরল অরুণাক্ষ। ব্যস্ত হাতে ঘরের কাজ শেষ করছে সঞ্চারিণী। বিছানার চাদর বদলে ফেলল নিমেষে। সমস্ত সন্ধ্যায় দেহে জড়িয়ে থাকা প্রিয় শাড়িটা ভাঁজ করে ঝুলিয়ে দিল ঘরের দড়িতে। সঞ্চারিণীর মুখ বেশ থমথমে। ঘরের মধ্যে চাপা অস্বস্তি। অন্তত আজকের দিনে এটা অরুণাক্ষ আশা করেনি। অতর্কিতে সঞ্চারিণীকে জড়িয়ে ধরে অরুণাক্ষ বলল, "মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমার অর্ধেক কাজ কমিয়ে দিলাম।"
"ঠিক আছে ছাড়ো। কাজ করছি।"
"কী হয়েছে সঞ্চারী?"
"দিদির কানপাশাটা দেখেছ? এই বছর দিদির জন্মদিনে দাদাভাই ওটা গিফট করেছে। আর আমি? সারা বছর যেটা কানে পরে থাকি, আজকের দিনেও সেটাই পরতে হল। নেহাৎ নিজে টিউশনি করে দু'পয়সা রোজগার করি, তাই একটা দামি শাড়ি পরতে পারলাম। নইলে সারা বছর যেমন শাড়ি পরি, আজও তেমন পরতে হত। মিলি-মেহুর বন্ধুদের মায়েদের সাজ দেখেছ? আমার এত লজ্জা করছিল ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে! তোমাকে পার্টি করতে বলাটাই আমার ভুল হয়েছে। ভেবেছিলাম আমাকেও একটা ভালো শাড়ি বা একটা দামি গয়না অন্তত কিনে দেবে। সেগুলো পরে সবার সামনে ঘুরে বেড়াতে পারব। সমাজের পাঁচজনের সঙ্গে মিশতে গেলে পাঁচজনের সঙ্গে চলার মতো জিনিস লাগে।
-আমাকে আর একটা বছর সময় দাও সঞ্চারী। আমিও তোমাকে তোমার দিদির চেয়েও ভালো সোনার দুল কিনে দেব। মেয়েদের নতুন স্কুলে এডমিশন, সেশন ফিজ সব মিলিয়ে একটু...
-তুমি কোনোদিনই আমাকে কিছু দিতে পারবে না। সংসারের খরচ তো কমবে না, দিন-দিন বাড়বে। তুমিও আজীবন একই কথা শুনিয়ে যাবে। কী পেলাম আমি এতবড় বাড়ির বউ হয়ে? শখের বয়সে যদি শখ পূরণ করতে না-ই পারি, শেষ বয়সে টাকার বিছানায় শুয়ে কী করব? প্লিজ আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও। তোমার কথা শুনতে আমার একদম ভালো লাগছে না। বাইরে বেরোও। আমি ঘর ঝাঁট দেব। সকালে রেখা এসে এত কাজ করবে না। ঝড়ের বেগে ঘর মুছে বেরিয়ে যাবে। কী হল বেরোও!
ফ্ল্যাটের ঝুলবারান্দাটা অরুণাক্ষর একাকীত্বের সঙ্গী। ওখানে দাঁড়িয়ে কেটে গেল দীর্ঘ সময়। মৃত্তিকা-মিহিকা ঘুমিয়ে পড়ল। ঘর পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে অরুণাক্ষকে কেউ ডাক দিল না। অরুণাক্ষও সে রাতে ঘরে ফিরল না। ছেলে হিসেবে, দাদা হিসেবে অরুণাক্ষ ব্যর্থ। আজ স্বামী হিসেবেও ব্যর্থ হল বুঝি! এক জীবনে কি এত ব্যর্থতার ভার বহন করা সহজ? না বোধহয়...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন