ত্রিভুজ
সাথী দাস
চতুর্থ পর্ব
সন্ধ্যে তখন হয়-হয়।আজ আর মেয়েটাকে পড়াতে বসবে না নীলিমা।মায়ের আগমনে সারা শহর আনন্দে মেতেছে।কিন্তু নীলিমাকে ঘিরে রয়েছে এক অনন্ত বিষাদ।কোনোদিনই রণ-র ছবিতে মালা দেয় না ও,পারে না দিতে।মানতেই পারে না ও নেই।আজ একটু পায়েস করেছিলো নীলিমা।সেই সঙ্গে কোনোবার যা করে না,তাই করেছিলো ও।ছোট্ট একটা কেক এনেছিলো,আর এক প্যাকেট বেলুন!দিয়া সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই বেলুনগুলো ফুলিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলো দরজায়-জানলায়,ঘরের আনাচে-কানাচে....ঘুম থেকে ওঠার পর শারদীয়ার আনন্দে উজ্জ্বল চোখ-মুখ দেখে নীলিমা বুঝতে পারলো,শুধুমাত্র নিজের কষ্টের কথা ভেবে,এতদিন খুব বড় একটা আনন্দ থেকে মেয়েটাকে বঞ্চিত করে রেখেছিলো ও।ভেবেছিলো,আজ রমাকে আসতে বলবে,কিন্তু শেষ মুহূর্তে পারেনি।ভালো লাগেনি আর...কেকটা এনে সরিয়ে রেখেছিলো দিয়ার চোখের আড়ালে,ভেবেছিলো সন্ধ্যের পর আজ আর ঠাকুর দেখতে বেরোবে না,কেক কাটবে,মেয়েকে পায়েস খাওয়াবে,আর মেয়ের সঙ্গে অনেক-অনেক গল্প করবে।কিন্তু সন্ধ্যের ঠিক পরেই সজোরে বেলটা বেজে উঠলো।শারদীয়া তখন পায়েসের গন্ধে ঘুরঘুর করছিলো নীলিমার আশেপাশেই....
দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো ঋক-ঋদ্ধি আর রমা,ওদের পিছনেই সৈকত বাবু।ঋক আর ঋদ্ধির হাতে বেশ অনেকগুলো বেলুন।ওরা সোজা দৌড়োলো দিয়ার দিকে।আর রমার হাতে বেশ বড় একটা বাক্স।সৈকতের হাত ফাঁকা....সেই সূত্রে ঘরে ঢুকেই সৈকত হেসে বলে উঠলো,
-এবারও কিন্তু আমি কিছু আনিনি।সবই গিন্নি...
সৈকতের সঙ্গে সজোরে হেসে উঠলো নীলিমাও।রমা হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,
-তুমি তো আর দিয়ার জন্মদিনে আমাদের ডাকবে না,তাই কিছুটা অধিকারবশত বিনা নিমন্ত্রনেই চলে এলাম নীলিমা...রমা বললো।
নীলিমার গলার কাছে একদলা কান্না এসে জমা হয়েছিল।কথা বলতে পারছিলো না ও।তিনটে ছেলে-মেয়ের হুল্লোড়ে নীলিমার ছোট্ট ঘরে কান পাতা যাচ্ছে না!দিয়াকে এত খুশি হতে,এর আগে আর কোনোদিন দেখেনি নীলিমা।রমাকে জড়িয়ে ধরলো ও।কিন্তু আর কথা বলতে পারলো না।বেলুন তো নীলিমা লাগিয়েই রেখেছিলো ঘরে,আবারও সৈকত আর রমা ওদের আনা বেশ কতগুলো বেলুন দিয়ে সাজিয়ে ফেললো ঘরের বাকি ফাঁকা জায়গাগুলোয়...আনন্দে দিয়া হাততালি দিয়ে কি ভীষণ লাফাচ্ছে!!নীলিমার চোখদুটো জলে ভরে গেলো....
-নীলিমা,একটা প্লেট দাও,আর ছুরি...
যদিও রমার আনা সুবিশাল কেকের সামনে,নীলিমা নিজের আনা কেকটা বের করতে লজ্জা পাচ্ছিলো,তবু ওর বড্ড সাধ ছিল,আজ দিয়ার হাত ধরে ও কেক কাটবে!তাই একটু ইতস্তত করে ও বলেই ফেললো,
-রমা!মানে আমিও একটা ছোট্ট কেক এনেছিলাম...
চমকে উঠলো দিয়া!
-মা,তুমি আমার জন্য কেক এনেছিলো?আমি কাটবো?
-আরে!আগে বের করো নীলিমা!আজ দিয়া জোড়া কেক কাটবে!!
-আমি কেক কাটবো না?ঋদ্ধি চেঁচিয়ে উঠলো!
-আরে দাঁড়া না,আজ দিয়ার জন্মদিন তো!উফফ!!
-না!আমিও কাটবো!দিয়ার সঙ্গে আমিও কেক কাটবো!!
-আচ্ছা বাবা কাটবি!কাটুক,কাটুক রমা!ছেলেমানুষ!ওরা দুজনে একসঙ্গে হাত ধরেই কেক কাটুক!!
খুব আড়ম্বর করে কেক কাটা হলো!রমা আর সৈকত দিয়ার হাতে তুলে দিল সুবিশাল একটা পুতুল আর নতুন একটা জামা।ঋক আর ঋদ্ধি দিলো একবাক্স চকলেট!তারপর তিনজনেই একসঙ্গে খেলায় মেতে উঠলো।তখন রমা আর সৈকত নিজের আনা খাবারের সঙ্গে নীলিমার ঘরে বানানো পায়েস চেটেপুটে খেতে ব্যস্ত!
-কি বলে যে তোমায় ধন্যবাদ দেবো রমা..দিয়ার আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকা মুখটার দিকে একভাবে চেয়ে নীলিমা বললো।
-এই তো!এসব ধন্যবাদের কথা বলে আমায় অনেকটা পর করে দিলে তো!রমা বলে উঠলো।
-না,সত্যিই....
ওদের কথার মধ্যেই ওদিকে দিয়া আর ঋদ্ধির মধ্যে মারামারি বেঁধে গেছে!সৈকত ওদের সঙ্গে মেঝেতেই বসেছিলো,তাড়াতাড়ি করে ঋক আর সৈকত ওদের দুজনকে টেনে ছাড়ালো!
রমা বললো,
-আর বোলো না নীলিমা,যেখানে আমার ছোট ছেলেটা থাকবে,সেখানে কিছু না কিছু একটা অঘটন ঘটাবেই।সবসময় আমি এটাকে নিয়ে ভয়ে-ভয়ে থাকি!কখন যে কার মাথা ফাটাবে!কার হাত-পা ভেঙে বাড়ি আসবে...
সৈকত হাতের ফাঁকা প্লেটটা নিয়ে উঠে পড়লো মেঝে থেকে।নীলিমা এগিয়ে এসে বললো,
-আমায় দিন,এদিকে আসুন!বেসিন এখানে...
নীলিমার সঙ্গে সৈকত রান্নাঘরের দিকে হাত ধুতে গেলো।রমার চোখ তখন একভাবে দিয়ার ওপরেই আবদ্ধ..
রান্নাঘর থেকে সৈকত হাত ধুয়ে রুমালে হাত মুছে বসলো রমার পাশে।তিনটে ছেলেমেয়ে তখন পাশের ঘরে চলে গেছে খেলা করতে!ওরাও নিজেদের মধ্যে গল্প করতে ব্যস্ত।একটু চা করে নীলিমা সবে কাপে করে সৈকত আর রমার সামনে দিতে যাবে,ও ঘর থেকে দিয়ার চিৎকার ভেসে এলো।কাপ-প্লেট সব ফেলে রেখে নীলিমা ছুটলো ভিতরের ঘরে,সেই সঙ্গে রমা-সৈকতও...
ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে হেসে ফেললো সৈকত।ও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।রমা হাসবে কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না!নীলিমাও হেসে উঠলো সজোরে..
ব্যাপারটা হচ্ছে,রমার আনা নতুন পুতুলটা নিয়ে ঋদ্ধি আর দিয়ার মধ্যে সাংঘাতিক মারামারি চলছে!পুতুলটা ঋদ্ধিরও চাই,দিয়ারও!ঋক কিছুতেই ওর ভাইকে বোঝাতেই পারছে না,যে ওটা দিয়ার জন্মদিনের উপহার!ওকে দিয়ে যেতো হবে।ঋদ্ধি চকমকে জামা পড়া আকর্ষণীয় পুতুলটাকে বগলদাবা করে জাপটে ধরেছে,কিছুতেই ছাড়বে না,দিয়াকেও দেবে না!সঙ্গে নিয়ে বাড়ি যাবেই!এই টানাটানির চোটে ঋদ্ধির হাতে পুতুলের দেহ,আর দিয়ার হাতে পুতুলের মুন্ডু!!চুল এলোমেলো হয়ে,জামাকাপড় ছিঁড়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে রয়েছে নতুন পুতুলটা!উলঙ্গ দেহে পায়ে একজোড়া লাল জুতো!সৈকত দেখেই হেসে বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে!আর নিজের জন্মদিনের উপহারের এ হেন দুর্দশা দেখে গলা ছেড়ে কেঁদেই যাচ্ছে দিয়া!তেড়ে চুল ধরে বারবার মারতে যাচ্ছে ঋদ্ধিকে,ঋক টেনে ধরেছে দিয়াকে!একহাতে চেপে ধরে রেখেছে দিয়াকে,অন্যহাতে ঋদ্ধিকে ঠেকাচ্ছে...এই দশ বছর বয়সেই বড় ভাই হওয়ার কর্তব্য পালন করতে শুরু করেছে ঋক!রমা গিয়ে টেনে ধরলো ছোট ছেলেকে!তখনও দিয়া পুতুলের মুণ্ডটুকু হাতে নিয়ে গলা ছেড়ে কেঁদেই যাচ্ছে..পুতুলের চুল সরে গিয়ে চকচকে টাক বেরিয়ে এসেছে,একটা চোখও খুবলে গেছে..
পিঠে দুমদাম পড়ার আগেই,পিঠ বাঁচানোর তাগিদে ঋদ্ধি দৌড়ে পালিয়ে গেলো বাবার কাছে।রমা তাও তেড়ে আসছিলো,কিন্তু ওকে টেনে ধরলো নীলিমা,
-এই রমা,কি করছো?মারবে নাকি ওকে?
-নাগো নীলিমা!দাঁড়াও,ওর বাঁদরামি...
-থাক,করে ফেলেছে,বেশ করেছে!ওরা করবে নাতো কি আমরা বুড়ো-বুড়িরা মারামারি-ধরাধরি করবো!তুমি কিন্তু ঋদ্ধিকে একটাও কথা বলবে না বলে দিলাম...একটুও বকবে না ওকে...
সৈকত ততক্ষণে ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে আবার গিয়ে আসছিলো ঘরের দিকেই,রমা দিয়াকে একটু আদর করার জন্য সবে পিছন ফিরেছে,সেই সময়েই ওর চোখে পড়লো মন ভালো করা একটা দৃশ্য!
ঋদ্ধির ওপর খেপে থাকায়,আর ওর দিকেই সম্পূর্ণ মনোযোগটা থাকায় রমা-নীলিমা আর সৈকত কেউই খেয়াল করেনি,যে দিয়ার কান্না থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই।আর তার কারণটা হলো ঋক!দিয়াকে দুহাতে করে কোলে তুলে খাটের কোণায় বসালো ঋক,তারপর ওর হাত থেকে পুতুলের ভাঙা মুন্ডুটা নিয়ে পাশে রাখলো,দিয়ার দুটো চোখ মুছিয়ে দিয়ে ঋক তখন দিয়াকে বোঝাচ্ছে,
-আমার ভাই ওইরকমই,আমার মা তোমায় আবার নতুন পুতুল কিনে দেবে!তুমি কেঁদো না,ওকে?
দিয়ার গলার সুর তখনও সপ্তমে চড়ে রয়েছে,মাথা খুব গরম,চেঁচিয়ে উঠলো ও,
-ও আমার পুতুল ভেঙে দিয়েছে!আবারও কেঁদে ফেললো দিয়া...
-চুপ-চুপ!একদম চুপ!আচ্ছা,আমি ভাইকে বকে দেব।খুব করে বকে দেবো,তুমি চুপ করো!আমি ওকে বকবো,ওকে...
-প্রমিস?
-হুম,প্রমিস!
-পিঙ্কি প্রমিস?
-পিঙ্কি প্রমিস!
এবার মুখে হাসি ফুটলো মিষ্টি দিয়ার।মারামারিতে মাথার রাবার-ব্যান্ড খুলে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছিলো দিয়ার।ঋক ওর এলোমেলো ঝুঁটিটা ধরে একটু নেড়ে,গাল টিপে দিয়ে বললো,
-গুড গার্ল!
নীলিমাও হেসে বললো,
-দেখলে রমা,ওই জন্যই বলি,বাচ্চাদের ঝামেলা, বাচ্চাদেরই মিটিয়ে নিতে দাও না বাবা!কেন বড়দের নাক গলানো ওতে!ঋক কি সুন্দর সব সামলে নিলো দেখো তো,আর তুমি এই দুর্গাষষ্ঠীর দিনে মাথা গরম করে ছেলেটার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছিলে...
-হুম,দেখলাম!দেখলাম তো...থেমে-থেমে রমা বললো।
-নাও,চলো-চলো!ওদিকে চা বোধহয় জুড়িয়ে গেলো!
-এই তোরা এ ঘরে আয়,সবকটা চোখের সামনে থাক তো,একটু চোখের আড়াল হলেই খুনোখুনি করে ফেলবি সব!উফফ!এক-একটা যন্ত্র সব,বিশেষ করে এইটা!
নিজের ছোট ছেলের দিকে চাইলো রমা...
ঋকের হাত ধরে ডাইনিংয়ে এসে বসলো দিয়া।এখন তার ঋদ্ধির সঙ্গে আড়ি চলছে,জন্মের মতো আড়ি!!তাই ঋকের সঙ্গেই তার সবটুকু খেলা!ষষ্ঠ-বর্ষীয়া দিয়ার সঙ্গে বছর দশেকের ঋক বেশ মেতে রয়েছে শিশুসুলভ খেলায়।একটু অবাকই হলো রমা!ঋক সাধারণত এইরকমভাবে খেলাধুলো কম করে,বাড়িতে ওই কম্পিউটার আর বই নিয়েই পড়ে থাকে বেশি!কিন্তু আজ দিয়ার সঙ্গে ওকে মেতে থাকতে দেখে বেশ লাগছে রমার।চায়ে চুমুক দিতে-দিতে একভাবে ওদেরই দেখছিলো ও...দিয়া খেলনা নিয়ে খেলতে-খেলতে প্রায় ঋকের কোলে উঠে বসেছে...
-আর একটা বিস্কুট নাও রমা....নীলিমা বললো।
-হুম?হুম দাও!নীলিমার কথায় ঘোর কাটলো রমার...
-তোমায় আজ একটা কথা বলবো নীলিমা!
-হ্যাঁ বলো না,কি বলবে?
-আবদার নয়,কিছুটা দাবিই বলতে পারো!
-মানে?আমি বুঝলাম না ঠিক!কিরকম দাবি??
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রমা বললো,
-তোমার দিয়াকে তুমি কিন্তু বাইরে কোথাও দিতে পারবে না নীলিমা,বড় হলে ওকে কিন্তু আমিই নিয়ে যাবো,আমার ঋকের জন্য!!
আগের দিন সৈকত কোনোমতে সামলে নিয়েছিলো,বিষম খেতে-খেতে বেঁচে গিয়েছিলো।আজ আর বাঁচতে পারলো না!সজোরে কেশে উঠলো!চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখলো পাশে...নীলিমা কাঁপা-কাঁপা হাতে একটা জলের বোতল এগিয়ে দিলো সৈকতের দিকে!সৈকত যতটা না চমকে উঠেছে,তার থেকে সহস্র গুণ বেশি চমকে উঠেছে নীলিমা।এসব কি বলছে রমা!!সৈকত একটাও কথা বলতে পারলো না আর,ও ভয়ে-ভয়ে নীলিমার দিকে তাকালো,উনি কিভাবে নেবেন কথাটা...কিন্তু সৈকতের দুশ্চিন্তাকে বেশ কিছুটা লাঘব করে নীলিমা বললো,
-কি বলছো একটু ভেবে বলো রমা!এইসব ব্যাপার অনেক বড় ব্যাপার,আর সত্যি বলতে আমাদের মতো ঘরে এইসব নিয়ে মজা বা ছেলেখেলা....
-আমি কিন্তু মন থেকেই বলছি নীলিমা!এটাকে তুমি মজা বা ছেলেখেলা মনে কোরো না!তুমি জানো না,একটা মেয়ের জন্য আমি মরে গেছিলাম একদিন!আমার দুই ছেলেকেই আমি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি,কিন্তু কোথাও যেন একটা দিয়ার মতো মিষ্টি মেয়ের অভাব বোধ করি ভীষণ!দিয়াকে তুমি আমায় দাও...
এবার নীলিমা বুঝতে পারলো,রমার কিসের এতটা টান দিয়ার প্রতি!রমা মাতৃ-স্নেহ উজাড় করে দিতে চায় একটা কন্যাসন্তানের কাছে,সেইজন্যই প্রথমদিন দিয়াকে আদর করতে গিয়ে,রমার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।কিন্তু রমার থেকে নীলিমা এই পৃথিবীটাকে বেশি চেনে।বড্ড কঠিন এই সমাজ!ও মাতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে আজ যেটা বলে ফেলেছে,ভবিষ্যতে সেটার কোনো ভিত্তিই থাকবে না।হয়তো ওরা অভিভাবকরা এই সিদ্ধান্তেই অনড় থাকবেন,কিন্তু ছেলেমেয়েরা??ওদের জীবন,সিদ্ধান্তটাও তো ওদেরই হবে!এভাবে বসে,খেলাচ্ছলে ওদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নেওয়া সম্ভব নাকি!!কিন্তু রমাও অবুঝ,বড্ড সরল মনটা,ভীষণ স্বচ্ছ!মনে যা ভাবে,মুখেও তাই বলে বসে!কোন কথাটা কিভাবে উল্টোদিকের মানুষটা নেবে,সেসব বড় বেশি একটা ভাবে না ও...সৈকত বাবুর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলো নীলিমা।রমার মতো তিনিও নীলিমার মুখের দিকেই চেয়ে আছেন,তবে রমার আজকের কথায় তিনি বেশ চিন্তিত এবং অপ্রস্তুত,সেটা বোঝাই যাচ্ছে ওনার মুখ দেখে...
পরিস্থিতি এবং আবেগী রমাকে সামলাতে কোনোরকমে নীলিমা বলে,
-দেখো রমা,ওরা ওদের মতো বড় হোক তো আগে,তারপর সময়মতো সব ভেবে দেখা যাবে!বড় হয়ে কে কোথায় যাবে,কোথায় থাকবে,কেউ আলাদা ভাবে কোনো সম্পর্কে জড়াবে কিনা,তা কি এখন কেউ বলতে পারে!এখনই এইসব ভেবে অহেতুক সম্পর্কে জটিলতা এনে লাভ কি বলো!আমাদের সিদ্ধান্ত তো আমরা জোর করে ওদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না!!আসলে বুঝতেই পারছো,আমি মেয়ের মা তো,তাই আমার চিন্তাটা...
-তোমার দিয়াকে নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না রমা!আমি বলছি তো...এই কদিনে তোমাকে আমি যতটুকু চিনেছি,তুমি দিয়াকে তোমার মনের মতো করে তৈরী করো,আর আমি ঋককে দিয়ার উপযুক্ত করে তৈরী করবো!এখন আমি কিচ্ছু চাই না,শুধু আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা এইরকমই রেখো তুমি,যাতে ভবিষ্যতে সেটাকে আরও পাকাপাকি করে তোলা যায়!!
হঠাৎ হাসির শব্দে ছেদ পড়লো রমার কথায়,রমা আর নীলিমা দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো কলকল করে হাসছে দিয়া,আর সেই সঙ্গে ঋকও...দিয়া নিজের খেলনাবাটির বালতি উপুড় করে দিয়েছে,সব খেলনা নিয়ে ঋকের সঙ্গে খেলছে!!আর একটু দূরে গোঁজ হয়ে বসে রয়েছে ঋদ্ধি!ওর সঙ্গে এখনও দিয়া ভাব করেনি কিনা...
দিয়ার একটা ভাঙা খেলনা নিয়ে নাড়ানাড়ি করতে-করতে সেটাকে আবার আগের মতো জুড়ে দিলো ঋক!দিয়া লাফিয়ে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,"থ্যাঙ্কু-থ্যাঙ্কু"! আবার ঋদ্ধির দিকে মুখ ভেঙচে,ওকে জিভ দেখিয়ে ঋকের সঙ্গে খেলায় মন দিলো!!দিয়া আর ঋদ্ধির ছেলেমানুষিতে ঋক হেসেই যাচ্ছে!দিয়ার গাল টিপে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলো ঋক...রমার চোখে জল এসে গেছিলো,ও তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-ছেলে তো আমার নিজেই দেখেশুনে নিচ্ছে নীলিমা!তুমি আমায় কথা দাও,দিয়াকে আমার ঋকের জন্য দেবে?
রমার আন্তরিক অনুরোধের কাছে নিজেকে অসহায় লাগছে নীলিমার!তবু ও বললো,
-আচ্ছা রমা,এখন তো এভাবে কিছু বলা যায় না!ওরা ওদের মতো পড়াশোনা শিখুক,বড় হোক!তখনও যদি ওদের মধ্যে সবকিছু ঠিক থাকে,তারপর না হয় সবাই মিলে ভেবে দেখা যাবে!
নীলিমার কথায় একটু যেন আশ্বস্ত হলো রমা!উঠে গিয়ে দিয়াকে কোলে নিয়ে আদরে-আদরে ভরিয়ে দিলো ও।তারপর বললো,
-ঋদ্ধি তোর পুতুল ভেঙে দিয়েছে,না মা?আমি তোর জন্য পরদিন আবার একটা নতুন পুতুল নিয়ে আসবো!
-সত্যি আন্টি?
-একদম!সত্যি!!
দিয়া রমার গালে চকাস করে চুমু খেয়ে বললো,
-তুমি খুব ভালো আন্টি!ঋদ্ধি পচা!
-হুম,একদম!আমি ওকে খুব করে বকে দেবো!আর ও ভাঙবে না তোর পুতুল!আচ্ছা,এবার তো ওর সঙ্গে একটু ভাব করে নে মা!একা-একা বসে আছে ও,একটু খেলতে নিবি না মা ওকে?
-আচ্ছা!
রমার কোল থেকে নেমে ঋদ্ধির দিকে এগোলো দিয়া...
কিছুক্ষণ পরই দেখা গেলো তিনটে মুন্ডু এক জায়গায় বসে খেলা করছে...
সেদিন রাতের খাবার না খাইয়ে ওদের ছাড়েনি নীলিমা।রমাও কিছু খাবার এনেছিলো,নীলিমাও ঘরে বানিয়েছিল,সব মিলিয়ে হয়ে গেছে!সারা সন্ধ্যা হুড়োহুড়ির ফলে ওরা খেয়ে উঠতে-উঠতে ঋক-দিয়া-ঋদ্ধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো,সৈকত আর রমা বেরিয়ে গেলো,সৈকতের কোলে ঘুমন্ত ঋদ্ধি,আর পাশে ঋক!রাত তখন বেশ অনেকটাই হয়ে গেছে...
ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর সারাটা শরীর অবশ হয়ে এলো নীলিমার।আজ নয় কাল দিয়া চলে যাবে ঠিকই,নীলিমাকেই হাতে ধরে বিদায় করতে হবে ওর একমাত্র মেয়েকে।কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি ওকে কেউ নিতে আসতে পারে,সেটা ওর কল্পনারও অতীত!হাঁ করে ঘুমিয়ে রয়েছে ক্লান্ত মেয়েটা,চুলগুলো এলোমেলো!সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে,শরীরটাও আগের তুলনায় একটু ভারী হয়েছে!জামাটা হাঁটুর অনেকটা ওপরে উঠে গেছে,পাশেই ভেঙে উল্টে পড়ে রয়েছে রমার আনা পুতুলটা!!ওটাকে তুলে নিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো নীলিমা...সব খেলনাবাটি,এই সব পুতুল,এই সব ছোট্ট-ছোট্ট জামাকাপড়,সব পিছনে ফেলে রেখে একদিন চলে যাবে শারদীয়া,রমা যেন নীলিমাকে ওর অদূর ভবিষ্যৎটাই,চোখে আঙুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দিয়ে গেলো...নীলিমা ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলো আজ রণ-র মৃত্যুবার্ষিকী,দিয়ার খেলার জিনিসগুলো আঁকড়ে নিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠলো ও...
সেই মুহূর্তেই বেলটা বেজে উঠলো আবার...
তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছে দরজার দিকে এগোলো নীলিমা।বোধহয় সামনের বাড়ির বৌদি এলো,শাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়লে প্রায়ই আসে!দরজা খুলতেই নীলিমা দেখলো,সৈকত দাঁড়িয়ে রয়েছে...একা...
-আপনি?মানে,বলুন...
হেসে ফেললো সৈকত।
-ভয় পাবেন না নীলিমা দেবী!দিয়াকে এখনই নিতে আসিনি,গাড়ির চাবিটা নিতে ভুলে গেছি।আপনার ডাইনিং টেবিলে ওপরে আছে...
-ওহ!
সৈকতের কথায় চোখে জল এসে গেছে নীলিমার।কোনোরকমে গিয়ে ও চাবিটা এনে সৈকতের হাতে দিলো।সৈকত কিছুক্ষণ একভাবে নীলিমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো,চোখদুটো একটু ফোলা।মাথা তুলছে না।বোধহয় কাঁদছিলো।তাই এখন নিজেকে আড়াল করতে চোখদুটো নামিয়েই কথা বলছে!কয়েক মুহূর্ত পরে সৈকত বললো,
-আমি জানি না নীলিমা দেবী,আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি!হয়তো রমা একটু বেশিই আশা করে ফেলেছে,ইনফ্যাক্ট অনেকটাই তাড়াতাড়ি বলে ফেলেছে নিজের মনের কথাটা!তবে আমি জানতাম,ও দিয়ার জন্যই এতটা করছে!একটা মেয়ের জন্য একসময় কি না করেছে ও,কিন্তু ভগবান যখন ওকে দুটো ছেলের মা করেছিলো,সেদিন ও আমায় কি বলেছিলো জানেন,"আমার দুই ছেলের বউকে আমি দুই মেয়ে করে রাখবো!উনি আমাকে মেয়ে না দিয়ে জিতে যাবেন ভেবেছেন!"আমি জানি,এখনও ওর আলমারীর কোনো এক কোণায় সযত্নে রাখা আছে,মেয়ের বালা-নূপুর-আর কানের দুল!আমাকে দিয়ে আনিয়ে রেখেছিলো,ঋদ্ধি হওয়ার আগে।সেবার একটা মেয়ের জন্য খুব আশা করেছিলো তো ও।ভেবেছিলো মেয়ে হলে ওগুলো উপহার দেবে!কিন্তু সে তো আর...আপনাকে একটা কথা বলি নীলিমা দেবী,দিয়ার নিশ্চয়ই বিয়ে দেবেন আপনি,তাই রমার ছেলেমানুষির কথাটা,একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে না ফেলে,একটু মাথায় রাখবেন।ঋক আর ঋদ্ধির মতো,আমরা দিয়াকেও মাথায় করেই রাখবো!
-একটু ভুল বললেন সৈকত বাবু,আমিই যে দিয়ার বিয়ে দেবো,এর নিশ্চয়তা কোথায় বলুন?বিয়ে দেওয়া আর বিয়ে করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।আমি ওর বিয়ে দিতে চাই না,আমি চাই ও বিয়ে করুক!সত্যিই তো,ভবিষ্যৎ কে দেখেছে!!কাল যদি ঋক বা দিয়া,আমাদের কথার পরোয়া না করে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়ায়,তখন?ওদেরকে ওদের মতোই বড় হতে দিন,আর কিছুদিন নিশ্চিন্তে ওই মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে,আমায় বাঁচতে দিন না সৈকত বাবু!ওকে ছাড়া তো আমি মরে যাবো!আমার আর কি আছে বলুন তো!!
শেষের কথাগুলো বলার সময় গলাটা কেঁপে গেলো নীলিমার।আর পারলো না নিজেকে সামলাতে,গলা পর্যন্ত চেপে রাখা কান্নার দলাটা হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো!আঁচলে মুখ গুঁজলো ও।ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সৈকত!রমার আবদারের কথাটা,নীলিমার যে বুকের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গায় গিয়ে এভাবে আঘাত করবে,এটা বুঝতে পারেনি সৈকত।ও অন্য কিছুই ভেবেছিলো,হয়তো দিয়াকে নিয়ে নীলিমা চিন্তিত!কিন্তু আসল ব্যাপারটা তা নয়,দিয়াকে তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার মানুষই নয় নীলিমা!তেমন মা-ই নন উনি।বরং ও বড় হবে,স্বাধীন হবে,নিজস্ব মতামত তৈরি হবে,নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে,শিরদাঁড়া শক্ত হবে,এটুকুই কাম্য নীলিমা দেবীর!!সত্যিই তো!ওই মেয়েটা ছাড়া ওনার আর কে আছে বাঁচার অবলম্বন!!
এতটা লড়াইয়ের মধ্যে,এতটা প্রতিকূলতার মধ্যেও দিয়াকে নিয়ে কত স্বপ্ন নীলিমার!ভীষণ ভালো লাগলো সৈকতের।কিন্তু একজন একাকী নারীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সৈকতের জানা নেই।রমা থাকলে হয়তো নীলিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারতো।তাতে ব্যথিত হৃদয় হয়তো সাময়িক শান্ত হতো।কিন্তু সৈকত সেসব স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।এই নারীকে স্পর্শ করার সামান্যতম অধিকার বা সাহসটুকুও ওর নেই।কোনোরকমে সৈকত বললো,
-আমি বুঝতে পারছি নীলিমা দেবী!আপনি দয়া করে...
-আমি ঠিক আছি সৈকত বাবু,আপনি আসুন!রমা বোধহয় ঋদ্ধিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে...
-হুম!আসছি...
বেরিয়ে এলো সৈকত।এককথায় বেরিয়ে এলো নীলিমা দেবীর ঘর থেকে।আর একটাও কথা বলতে পারলো না।কারণ,ওনার সামনে কোনো কথা চলে না!সত্যিই সৈকতের জানা নেই,কাল ঋক বা দিয়া অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াবে কিনা,বা আদৌ বিয়ে করবে কিনা!কিন্তু একটু আগে রমা যে কথাটা বলেছিলো,এখন সৈকতও তাই চায়।ও এখন দিয়াকেই বি.কে.ম্যানসনের বড় বউ হিসেবে,ঋকের বউ হিসেবে দেখতে চায়!তার একটাই কারণ,ওকে নিজের হাতে তৈরী করবে নীলিমা দেবী...নীলিমা দেবীর শিক্ষা থাকবে ওই মেয়ের মধ্যে...আজ আরও একবার ওর রমা প্রমাণ করে দিলো,ও মানুষ চিনতে একটুও ভুল করেনি।শহরের স্বনামধন্য বি.কে.চৌধুরী পরিবারের সামনেও মাথা নত করেননি নীলিমা দেবী!এককথায় রাজি হয়ে যাননি,বর্তে যাননি দিয়াকে ওদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভেবে!অপার বৈভব-অর্থ-প্রাচুর্য স্পর্শ করতে পারেনি ওনাকে।বরং বারংবার মিনতি করেছেন,দিয়াকে ওর মত করে একটু বাঁচতে দেওয়ার জন্য।বাঁচুক,দিয়া আর নীলিমা দেবী নিজের মতো করেই বাঁচুক।সৈকতও এখন রমার মতোই নিজের ঋককে তৈরী করবে,ওই মেয়ের উপযুক্ত করে।কারণ,নীলিমা দেবীর অংশ ওই মেয়ে।সৈকতের সাহস নেই,স্পর্ধাও নেই ওনার প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ানোর,বা ওনার মুখের ওপরে কিছু বলার।ওনাকে শুধু অপার শ্রদ্ধা করতে পারে ও।কিন্তু ঋককে সৈকত একটু-একটু করে তৈরী করবে,যাতে ও শারদীয়ার সামনে গিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে!ততদিন পর্যন্ত নীলিমা দেবী দিয়াকে আঁকড়েই বেঁচে থাকুক...সুখে থাকুক...
ভিড়কে পাশ কাটিয়ে-কাটিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো সৈকত।পিছনে ঋক আর ঋদ্ধি ঘুমিয়ে কাদা।মায়ের আগমনে সারা শহর নিয়ন আলোয় সেজে উঠেছে।রমা সৈকতের পাশের সিটে বসে আছে সৈকতের একটা হাত জড়িয়ে ধরে।সৈকতের বাঁ হাতের ওপর রমা চুমু খেয়ে বললো,
-আমি কোনো ভুল করিনি তো গো?
-না!
সৈকতের কণ্ঠের দৃঢ়তায় চমকে উঠলো রমা।
-কিসের কথা বলছি বলো তো?
-দিয়ার কথা!
-হুম!
-এর থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারে না রমা।
সৈকত রমার দিকে নিজের ঠোঁট দুটো এগিয়ে নিয়ে গেলো,তারপর আস্তে করে ওর কপালে চুমু খেলো।রমা গলে গেলো সৈকতের সামান্য আদরেই।আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরলো ওর হাতটা।মাথা রাখলো ওর কাঁধে...
রাস্তার গানের অতর্কিত শব্দে একটু আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো প্রান্তিকের।মা-বাবার সামান্য অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে গাড়ির কাঁচের বাইরের দিকে চোখ রাখলো ও।দশ বছর বয়স অতিক্রান্ত ঋকের,ওকে এখন আর নিতান্তই শিশু বলা যায় না!!কিন্তু ও বুঝতে পারলো না,দিয়ার ব্যাপারে কিসের কথা মা-বাবা বলছে?!জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো ঋক।সারা শহরের বুকে তখন উৎসবের আমেজ...রাস্তার জ্বলতে-নিভতে থাকা আলোগুলোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ঋক!তারপর ওর দু-চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।ধীরে-ধীরে ঘুমিয়ে পড়লো ও..
রাত তখন তিনটে।পাড়ার পুজোমণ্ডপেও গান বেজে-বেজে বন্ধ হয়ে গেছে।সারা শহর হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুম নেই একমাত্র নীলিমার চোখে।ঘুমন্ত দিয়ার মুখের দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে ও।দুটো চোখ বেয়ে জল পড়ছে!একেই একদিন তোয়ালে মুড়ে,কোলে নিয়ে,সাদা শাড়ি পরে,ফাঁকা সিঁথিতে,হাতের শাঁখা ভেঙে এ ঘরে ঢুকেছিলো নীলিমা।পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-স্বজন নীলিমার ভাগ্য দেখে,ডাক ছেড়ে সুর করে কেঁদে উঠেছিলো সেদিন!তারা আজ আর কেউ পাশে নেই।এমনকি মা-ও না!আছে শুধু সেই তোয়ালে মোড়া ছোট্ট প্রাণটা...ওইটুকু ছাড়া ওর জীবনে আর কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই!
রূপোর নূপুর পরা ছোট্ট দুটো পায়ে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো নীলিমা।দেওয়াল থেকে টেনে-হেঁচড়ে নামালো রণ-র ফটোটা।রণ-কে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো ও...
অন্যদিকে,সৈকতের চওড়া বুকে মাথা রেখে,এলোচুলে ঘুমিয়ে পড়লো রমাও...
নীলিমা সেদিনই ঠিক করেছিল,দিয়াকে ওর মতো বড় হতে দেবে!রণ আর নীলিমার বিয়ের সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল ওদের অর্থনৈতিক বৈষম্য!যেটা এখনও শারদীয়া আর ঋকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য!নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে নীলিমা,তাই দিয়াকে কিছুতেই অপমানিত হতে দেবে না ও,এই একটা ব্যাপারে নীলিমা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ!গোটা জীবনে নীলিমা চাইলেও সৈকত বাবুর সমকক্ষ হতে পারবে না!!তাই বরাবরই নীলিমা চাইতো,ওদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলতে...
বছর কয়েক পর....
কিন্তু মানুষ যেমনটা ভাবে,তেমনটা আর কবেই বা হয়েছে!নীলিমা দেখলো,সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আরও গভীর হচ্ছে ওদের বন্ধন!নীলিমা গত কয়েক-বছরে নিজের কাজের সময়টাও অনেকখানি বাড়িয়ে নিয়েছে!চোখের ওপর দেখতে-দেখতে দিয়াও বড় হয়ে যাচ্ছে!এখন তো বেশিরভাগ সময় ও স্কুল থেকে রমা আন্টির বাড়িতেই চলে যায়,ওখান থেকে অফিস ফেরার পথে নীলিমা গিয়ে ওকে নিয়ে আসে।একটা সময় পর নীলিমা বেশ ভালোভাবেই বুঝে গেলো,রমা আর সৈকতের আন্তরিকতার অভাব নেই,ওরা আজও ওদের কথা ভোলেনি!দিয়া নিজেও তো রমা আন্টি বলতে একেবারে অজ্ঞান!আজকাল নীলিমাও রমাকে অনেকখানি ভরসাই করে...দিয়া ভালো থাকে ওদের সঙ্গে।নীলিমাই বরং ওকে সময় দিতে পারে না একদম।মাঝে-মাঝে খুব খারাপ লাগে নীলিমার।কিন্তু সবটুকু তো ওর জন্যই করা।তাই দিনশেষে ঘুমন্ত মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে,সারাদিনের সমস্ত আদরটুকু উজাড় করে দেয় নীলিমা...
বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে চেহারায়ও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে নীলিমার।চোখের কোলে কালি পড়েছে,মুখের বলিরেখাগুলোও আজকাল বেশ চোখে পড়ে।চোখেও কয়েক মাস ধরে একটু আবছা দেখছিলো ও।ডাক্তার দেখিয়ে এখন চোখে চশমা নিতে হয়েছে।সেদিন অফিস থেকে ফিরে নীলিমা দেখলো,মেয়ে সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসেনি।এমনিতে খুব একটা দিয়াকে পড়তে বসার কথা বলতে হয়না,নিজেরটা নিজেই করে নেয়।সারাদিনে তো ভীষণই কথা বলে,কিন্তু সেদিন একেবারে চুপ করে পাশ ফিরে বিছানায় শুয়েছিল ও।শাড়ির আঁচলে নিজের চশমার কাঁচটা মুছে মেয়ের দিকে এগোলো নীলিমা,
-কিরে মা?শুয়ে আছিস?পড়তে বসবি না?
ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখলো ও।তারপর মা-কে জড়িয়ে মুখ গুঁজে শুলো।আজকাল নীলিমা খুব বুঝে-শুনে কথা বলে মেয়ের সঙ্গে,মেয়ে বড় হচ্ছে তো!এই বয়সেই তো আবেগ-অনুভূতিগুলোকে একটু-একটু করে তৈরি হতে দিতে হবে!নীলিমা কোনদিনও ওকে যন্ত্র তৈরি করতে চায়নি,তাই একেবারে বন্ধুর মতো মেশার চেষ্টা করে।
-কিরে?বলবি না আমায়?কি হয়েছে?
-আচ্ছা মা?আজ আমার বাপি থাকলে আমায় ভাত মেখে খাইয়ে দিতো?একই থালায় বসে?
অল্প হাসলো নীলিমা।তারপর বলল,
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-আজ জানো তো,ঋক আর ঋদ্ধিকে আঙ্কেল ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছিলো,একই থালায় বসে!ওরা এতবড় হয়ে গেছে,তাও এখনও আঙ্কেল বা আন্টি ওদের খাইয়ে দেয়...
হেসে ফেললো নীলিমা!তারপর বললো,
-তোর বাপির যে তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল রে মা,একবার যদি জানতে পারতিস!!
-বলো না মা,আমায় একটু বাপির কথা বলো!আমার খুব ভালো লাগে শুনতে...
-এই পড়ার সময় কিন্তু কোনো গল্প নয়।রাতে খাওয়ার সময় বলবো...
অল্প হাসে দিয়া।ও জানে,সেই একই গল্প মা বলবে!ওর জন্মের আগের সব ঘটনা,তার পরে তো আর বলার মতো কিছু নেই!মায়ের মুখে বাপির গল্প এর আগে অনেকবার শুনেছে ও,কিন্তু তাও যেন পুরোনো হয় না।আসলে ওই গল্পটুকুর মাধ্যমেই তো বাপির সঙ্গে দিয়ার পরিচয়!তাই ওইটুকু না হলে দিয়ার ভীষণ ফাঁকা লাগে..
উঠে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো নীলিমা।রাতের রান্না চাপাতে হবে,আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
-আর শোন!আজ রাতে আমি তোকে খাইয়ে দেবো বুঝলি!নিজের হাতে!!ভাত মেখে....
ছুটে এসে মা-কে জড়িয়ে ধরলো দিয়া।মায়ের বুকের এই গন্ধটা কি ভালোলাগে ওর।কেমন যেন একটা মা-মা গন্ধ!!নীলিমা দিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু চুমু খেলো।সেই সময়ই ডোরবেলটা বেজে উঠলো সজোরে...
-এখন আবার কে এলো?
দিয়াকে ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো নীলিমা...
(চলবে)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন