ত্রিভুজ
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
-এবার কিন্তু আমার একটা মেয়েই চাই বলে দিলাম!নিজেকে উন্মুক্ত করতে-করতে রমা বললো!
হেসে ফেললো সৈকত।তারপর রমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
-আচ্ছা,এটা কি তোমার-আমার হাতে বলো তো!মেয়ে তো আমিও চাই।প্রথম থেকেই চাই!
-না,আমার মেয়েই চাই,তার জন্য যা করার দরকার তুমি করো,প্লিজ...রমা আদুরে গলায় বলতে-বলতে অনাবৃত নিজেকে মিশিয়ে দিলো সৈকতের বুকে....
সৈকত বললো,
-আচ্ছা দেখা যাক!বলেই নিজেই পুরু ঠোঁটদুটো মিশিয়ে দিলো রমার ঠোঁটে...
বি.কে চৌধুরী অর্থাৎ বসন্ত কুমার চৌধুরীর একমাত্র ছেলে সৈকত।শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ও অভিজাত পরিবারগুলোর নাম যদি নেওয়া হয়,তবে সর্বপ্রথম চৌধুরী পরিবারের নামই আসবে,আর আসবে ঐতিহ্যবাহী বি.কে.ম্যানশনের নাম।বি.কে সন্স এন্ড জুয়েলারী হাউসের একমাত্র উত্তরসূরী সৈকত।বসন্তবাবুর বাবা এই স্বর্ণ-ব্যবসার সূচনা করেছিলেন,পরবর্তীকালে বসন্তবাবুর হাত ধরে ফুলে-ফেঁপে ওঠে সেই ব্যবসা।বাবা মারা গেছেন অনেক বছর হয়ে গেছে।তিনি এখন বাড়ির ড্রইংরুমে এবং শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তিন-চারটে শো-রুমের দেওয়ালে ফটোর মধ্যে ঝুলে থাকেন,আর সেখান থেকেই নিজের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মকে আশীর্বাদ করেন।একমাত্র ছেলের বিয়ে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্যটুকুও বসন্তবাবুর স্ত্রীর হয়নি।ছেলের বিয়ের বছর তিনেক আগেই বসন্তবাবুর স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে।তাই নিজের মনের মতো বৌমা পছন্দ করে,দাঁড়িয়ে থেকে তিনিই ছেলের বিয়ে দিয়ে নিজের কর্তব্য সম্পন্ন করেন।শ্বশুরের মুখে রমা শুনেছে,এ বংশে নাকি কোনো মেয়ে নেই।রমার শ্বশুরও একটিই ছেলে,তবে তার একটি পিসি-শাশুড়ি ছিল,কিন্তু মাত্র ন-বছর বয়সে তিনি কোনো অজ্ঞাত কারণে মারা গেছেন।তারপর থেকে বসন্তবাবু একাই এই পরিবারের উত্তরসূরী,আর ওনার পর এখন সৈকত!
বিয়ের দু-বছর পর রমা আর সৈকতের কোল আলো করে তাদের প্রথম সন্তান আসে,পুত্রসন্তান!অথচ,গর্ভে সন্তান আসার পর থেকেই প্রতিটা দিন রমা ঠাকুরের কাছে মাথা খুঁড়ে মরেছে মেয়ে-সন্তানের জন্য।ও নিজে তো বটেই,সৈকতও পাগল একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্য!কিন্তু বিধি বাম!হসপিটালে ছেলে হয়েছে দেখে প্রথমে চোখে জল এসে গিয়েছিলো রমার।কিন্তু একটু সুস্থ হওয়ায় পর যখন সদ্যজাতটিকে ওরা রমার কোলে দিয়ে গেলো,সে তার গোটা হাতটা দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলো রমার একটা আঙুল!তখন হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিলো রমা,বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো ছেলেটিকে,তার প্রথম সন্তানকে!কি অদ্ভুত মায়াময় মুখটা,সারা পৃথিবীর সব শান্তি,সব সুখ,সব সারল্য,মাতৃত্বের সব অহংকার যেন ওই একরত্তি মুখটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।ওদের দুজনকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরেছিলো সৈকতও,ওর চোখেও তখন আনন্দের অশ্রু,প্রথমবার পিতৃত্বের গর্বে তখন পরিপূর্ণ পুরুষ সে....
প্রথম সন্তান জন্মাবার বছর দুয়েক পর থেকেই আবার দ্বিতীয় সন্তানধারণের জন্য উদগ্রীব হয়েছে রমা।একাধিক প্রচেষ্টার পর,একাধিকবার মিলনের পর, তৃতীয় মাসের শেষে একদিন সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে মাথাটা টলে গেলো রমার।প্রতিমাসের মতো এবার আর রমাকে মাসিক রক্তপাতের সম্মুখীন হতে হলো না।কম্পিত বুকে প্রতীক্ষার একটা-একটা করে দিন কাটছে,আসবে তো!এবার সে আসবে তো!দিন পনেরো কেটে গেলো,তাও রমার জরায়ুপথ বেয়ে ধেয়ে এলো না প্রতিমাসের কাঙ্খিত রক্তস্রোত!আনন্দের সীমা রইলো না রমার।সৈকতকে গিয়ে জানালো ও!পরদিনই সৈকত ক্লিনিকে নিয়ে গেলো রমাকে।কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার সুখবর দিলো ওদের।হ্যাঁ,আবারও মা হতে চলেছে রমা।সৈকতের আর আনন্দের সীমা রইলো না...
দুরু-দুরু বুকে একটা-একটা মাস কাটছে।এমন কোনো জায়গা নেই,যেখানে রমা একটা মেয়ের জন্য মানসিক করে রাখেনি!ওর পাগলামি দেখে সৈকতও মাঝে-মাঝে হেসে ফেলে।তারপর ওকে বলে,
-এত উত্তেজিত হয়ো না রমা,সবকিছুর জন্য নিজেকে তৈরী রাখো।ছেলেমেয়ে বাদ দাও,ঠাকুরকে শুধু এটা বলো যে,যেই আসুক,ছেলে বা মেয়ে,সে যেন সুস্থ থাকে!সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসতে পারে,আর সর্বোপরি আমার তুমি যেন সুস্থ থাকো।প্রথম সন্তানের সময় মেয়ে-মেয়ে করে সৈকতের যে পাগলামিটা ছিল,এবার আর সেটা নেই।সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে অনেকটা পরিণত সে।কিন্তু এবার যেন রমার স্বাস্থ্য একটু বেশিই ভাঙছে!চোখের কোলে গভীর কালি!ভীষণ ক্লান্ত দেখায় ওকে।মাঝে-মাঝে ওর দিকে চেয়ে,সৈকতের বুকের ভিতরটা একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে।একটা মেয়ের জন্য মরে যাচ্ছে রমা।ঠাকুর যেন ওর কোলে এবার একটা মেয়েই দেয়....আদর করে রমাকে কাছে টেনে নেয় সৈকত।ওর দেহের খুব কাছাকাছি আর পৌঁছতে পারে না ও,ওদের মাঝে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে ওদের অনাগত সন্তান!আট মাস অতিক্রান্ত,প্রায়ই মাঝে-মাঝে মাতৃগর্ভ থেকে নড়েচড়ে সে জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্বের কথা....তখন অনেক রাত!একদিকে কাত হয়ে শুয়েছিল রমা।আজকাল আর একদম ঘুম আসে না ওর,দিনরাত পেটের মধ্যেকার প্রাণটা দাপাতে থাকে!সৈকত গত কয়েক মাস ওকে ছুঁয়েও দেখেনি।রমা বুঝতে পারে,ভিতরে-ভিতরে ভীষণ চিন্তিত ও।আজ বেশ অনেকদিন পর সৈকতের বুকের ভিতরে ঢুকে শুয়েছিল রমা।কিন্তু এত কষ্ট হচ্ছিলো,ওর অনাগত সন্তান যেন বুকের ওপরে উঠে আসছিলো,দমবন্ধ হয়ে আসছিলো রমার।কোনোরকমে সৈকতের বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলো রমা।উঠে গিয়ে একটু দাঁড়ালো জানলার কাছে।জানলাটা খুলে দিলো,ঘরের ভ্যাপসা গরমটা যেন একটু কমলো।প্রাণভরে শ্বাস নিলো রমা।
-ঘুমাবে না?বিছানা ফাঁকা দেখে সৈকতও উঠে এলো।
-তুমি ঘুমোওনি?
-হুম,ঘুমিয়েছিলাম।হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো।তুমি এখনও জেগে রয়েছো কেন?
-ঘুম আসছে নাগো!এবার ভীষণ ভয় করছে জানো?
রমার কথা শুনে কেঁপে উঠলো সৈকতের বুকটা।ওকে জড়িয়ে ধরে সৈকত বললো,
-আমি আছি তো,কিসের ভয়?
-শোনো!আমার মেয়ে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসবে তো?
-তোমরা দুজনেই সুস্থ থাকবে রমা!এত ভেবো না,সবসময় ভালো চিন্তা করো!এসো-ঘুমাবে এসো....
সৈকত রমাকে ধরে বিছানায় নিয়ে যায়....
পাশে তখন বছর তিনেকের ছেলেটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন....
বেশিদিন আর অপেক্ষা করতে হলো না ওদের।সপ্তাহ তিনেক পরই সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে পৃথিবীতে এলো।মা ও সন্তান দুজনই সম্পূর্ণ সুস্থ!সৈকত ও রমার প্রথম সন্তান,প্রান্তিকের আর একটি খেলার সঙ্গী হলো,ছোট্ট একটি ভাই,প্রতীক!
নবজাতককে হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলো রমা!সৈকত বুঝতে পারছিল ওর মনের অবস্থাটা,একটা মেয়ের জন্য ও এই কটা মাস কি পাগলামিই না করেছে!কিন্তু এতে তো কারোর করণীয় কিছু নেই!সৈকত নিজেই যখন রমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হাতড়ে বেড়াচ্ছে,সেই সময় ওকে অবাক করে দিয়ে রমা বলে উঠলো,
-ঠিক আছে!ভগবান যখন তাই চায়,তবে তাই হবে।আমিও আমার দুই ছেলের বউকে দুই মেয়ে করে রাখবো!উনি মেয়ে না দিয়ে আমার কাছে জিতে যাবে ভেবেছে!!আর চাইবো না,এবার আমার দুই বউই হবে, আমার দুই মেয়ে!এবার বলো তুমি?ঠিক বলেছি না!!
সাংঘাতিক একটা চিন্তা মাথা থেকে নেমে গেল সৈকতের।রমাকে জড়িয়ে ধরে ও বললো,
-একদম ঠিক বলেছো রমা!!
ততক্ষণে বড়ো নাতিকে কোলে নিয়ে ছোট নাতির মুখ দেখতে চলে এসেছেন ঠাকুরদাদা বসন্ত কুমার চৌধুরীও।আগামী কয়েক দিন চৌধুরী পরিবার মেতে রইলো উৎসবের আমেজে...
বছর চারেক পর....
প্রান্তিক অর্থাৎ ঋক,এবং প্রতীক অর্থাৎ ঋদ্ধি,এই দুই ছেলেকে নিয়ে ভরা সংসার রমার।দিনরাত ছেলেদের পিছনে দৌড়োতে-দৌড়োতে বিধ্বস্ত ও।কিছুদিন ধরে রমার শ্বশুরের শরীরটাও বয়সজনিত কারণে ভালো যাচ্ছে না।সৈকত তাই ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তিত।তাছাড়া এতগুলো শো-রুমের চাপ একসঙ্গে এখন সৈকতের ওপরেই এসে পড়েছে।বাবা আর খুব একটা ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখতে পারেন না।খুব বড় টাকার কোনো লেনদেন থাকলে,তবেই দোকানে যান উনি।বাকিটা সম্পূর্ণ সৈকতই সামলে নেয়।সেই সকালে বেরিয়ে সারাদিন বাইরে কাটায় সৈকত,একেবারে রাতে ঘরে ফেরে।ছেলেদের সব দায়িত্ব রমার ওপরে ফেলে দিয়েই নিশ্চিন্ত ও।সেদিন,সারাটা দিনের শেষে রাতে সৈকত ফেরার পর,বিছানায় ওর বুকে মাথা রেখে রমা বললো,
-বাড়িতে একা-একা আমার আর সময় কাটে না!তুমি যে সেই সকালে বেরিয়ে যাও,আর ফেরো রাতে।বাড়িতেও তেমন কোনো কাজকর্ম নেই।ঝর্ণামাসিই সবটা সামলে নেয়,বাবার জন্যও আলাদা লোক রাখা আছে।আমি কি করি বলো তো,সারাদিন ভূতের মতো ঘরে বসে-বসে?
-তো আমাকে কি করতে বলছো রমা?আমি মানছি,তোমাকে এখন আর একদম সময় দেওয়া হয় না,কিন্তু আমার দিকটাও একটু বোঝার চেষ্টা করো!আমি নিজেও দোকান-কর্মচারীদের ঝামেলায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি....রমার চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে সৈকত বললো।
-হুম!বুঝতে পারছি!একটা কথা বলবো?
-আমার সাথে কথা বলার জন্য আবার আমার অনুমতি নিতে হচ্ছে?এতটা দূরত্ব এসে গেছে আমাদের মধ্যে?
সৈকতের কথায় একটু আঘাত পেলো রমা।সত্যিই বড্ড চাপ পড়ে গেছে মানুষটার ওপর,ব্যবসার কাজ সবে শিখতে শুরু করতে না করতেই বড় বেশিই দায়িত্ব এসে পড়েছে ওর ওপর।তাড়াতাড়ি রমা বললো,
-নানা,মানে তেমন কিছু নয় গো,আসলে ওই সেদিন ঋকের স্কুলে গিয়েছিলাম না,দেখলাম,সব মায়েরা কি সুন্দর ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিয়ে আসে-নিয়ে যায়,কেউ-কেউ তো আবার বসেও থাকে,একটা গাড়ি আমায় ছেড়ে দেবে?আমিও যাবো।স্কুলবাস ছাড়িয়ে দাও।আমিই এখন থেকে যাবো।একটু সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলে আমারও খুব ভালো লাগবে।
-আচ্ছা এই ব্যাপার!কিন্তু ঋক আর ঋদ্ধির তো ছুটি হয় আলাদা-আলাদা সময়ে।তুমি ততক্ষণ বসে থাকবে রমা?
-হুম,থাকবো!আগে যখন ছেলেরা ছোট ছিল,তখন ওদের নিয়েই সময় কেটে যেত।এখন ওরা স্কুলে বেরিয়ে যাবার পর আমার যেন আর সময় কাটতেই চায় না!আমার ওখানে ভালোই লাগবে।বাড়িতে একা-একা বসে থাকার চেয়ে,ওখানে বরং সবার সঙ্গে বসে গল্প করতে আমার বেশ ভালোই লাগবে।দাও না গো একটা গাড়ি...দেবে??
-তুমি কিছু চেয়েছো,আর আমি দিইনি,এটা হয়েছে কোনোদিন?
একটু হেসে সৈকতের বুকে মাথা রাখলো রমা।
-কাল আমি গোবিন্দ দাকে বলে দেবো,গ্যারেজ থেকে বের করে একটা গাড়ি ও রেডি করে রাখবে।আমাকে একটা সপ্তাহ সময় দাও,আমি স্কুলে গিয়ে আগে স্কুলবাসের ব্যাপারটা ক্যান্সেল করি,তারপর সোমবার থেকে দুই ছেলে নিয়ে তুমিই যাবে।ঠিক আছে?খুশি তো?
-খুব-খুব খুশি!
-আচ্ছা!বেশ অনেকদিন পর সৈকতের উষ্ণ আদরে,ওর বুকের মধ্যে মোমের মতো গলতে থাকে রমা...
বড়ো ভাই ঋক,আর ছোট ভাই ঋদ্ধি,দুই ভাই সম্পূর্ণ একে অপরের বিপরীত।দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য মাত্র বছর তিন-চারেক।কিন্তু মারামারি-ধরাধরিতে ছোট ছেলের জুড়ি মেলা ভার।এই চার বছর বয়সেই মাত্র কয়েকদিন স্কুলে গিয়েই,প্রচুর রিপোর্ট এসে গেছে তার নামে।উল্টোদিকে বড় ছেলেটি অর্থাৎ ঋক মাটির দিকে চেয়ে কথা বলে।পড়াশোনায় দুজনেই সমান তুখোড় হলেও,স্বভাবে দুই ভাই-দুই মেরুর বাসিন্দা!বড়ো ছেলেটিকে নিয়ে কোনোদিন রমাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি,কিন্তু এখন এই ছোটটির জন্য দুদিন বাদে-বাদেই স্কুল থেকে ডাক আসছে বাবা-মায়ের।সৈকত আর রমাকে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে প্রিন্সিপালের দরজায়....
সেদিন তো সব সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো।ঋদ্ধি ওর ক্লাসের একটা মেয়ের ব্যাগ নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ক্লাসের বাইরে,আর সেটা গিয়ে পড়েছে খানিকটা জমে থাকা জলের মধ্যে।কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে স্কুলব্যাগ!আর মেয়েটি চিৎকার করে কেঁদে ফাটিয়ে দিচ্ছে।সেইদিন ছুটির পর আবারও রমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হলো ঋদ্ধির ক্লাস-টিচারের সামনে।অনেকগুলো অপ্রিয় কথাই সহ্য করতে হলো রমাকে।যেহেতু ও এখন রোজই স্কুলে আসে,তাই ওর সঙ্গেই কথা বলাটা সহজ!আর সন্তান অন্যায় করলে মাকেই শুনতে হবে!!সৈকত সম্পূর্ণ দায়িত্বটাই এখন ওর ওপর ছেড়ে দিয়ে,নিজে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।রমা দেখছিলো,যখন ও ম্যামের সঙ্গে কথা বলছিল,তখন একটি বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের আঁচল ধরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল।এই ভদ্রমহিলার,অর্থাৎ মেয়েটির মায়ের মুখ চেনা,কিন্তু কখনো কথা হয়নি সামনাসামনি!মহিলাটি রুমাল বোতলের জলে ভিজিয়ে ব্যাগটিতে লেগে থাকা কাদা মুছে-মুছে পরিষ্কার করছিলেন।যদিও মুখে রাগের কোনো অভিব্যক্তি নেই...আলগা কাঠিন্যের চাদরে ঢাকা,বেশ ব্যক্তিত্যময়ী মুখাবয়ব...
রাগে থমথমে হয়ে গিয়েছিল রমার মুখ।ঋদ্ধি মায়ের মুখ দেখে বুঝতেই পেরেছে,আজ বাড়িতে গিয়ে ওর খবর আছে।তাই চুপচাপ দাদার হাত ধরে আসছিল ও।ভুলেও মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলো না।আজ শনিবার হওয়ায় দুই ভাইয়েরই একসঙ্গে স্কুল ছুটি হয়েছে।যাক,তাও দাদা আজ বাঁচিয়ে দেবে!ভয়ে-ভয়ে দাদার দিকে চাইলো ও।জীবনেও দাদাকে "দাদা" বলে ডাকে না ঋদ্ধি,ভাই ডাকে!কারণ,ও নিজেই দাদাগিরি করতে ভীষণ ভালোবাসে যে।রমা বলে-বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে।যে যেটা ডেকে শান্তি পায়,সেটাই ডাকুক গে!দুই ভাইয়ের ব্যাপার,দুই ভাই বুঝে নেবে!ঋদ্ধি ভয়ে-ভয়ে ঋকের হাত চেপে ধরলো,
-এই ভাই?
-ভাই,আজ তো তুই আমায় কিছু বলবিই না,কতদিন বলেছি,এসব করিসনা।মা মারবে।তুই শুনিস?যা পারিস কর তুই...
দুরু-দুরু বুকে মায়ের পিছন-পিছন স্কুলের গেট থেকে বেরোলো দুই ভাই...রমা থমথমে মুখে বললো,
-আজ তুমি একবার বাড়ি চলো ঋদ্ধি!আজ তোমায় আমি এমন শাস্তি দেবো....
ভয়ের চোটে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো ঋদ্ধি!রমা এতক্ষণ খেয়ালই করেনি,ওদের একটু পিছনেই সেই ভদ্রমহিলা মেয়েটির হাত ধরে আসছিলেন।ওর কথার মাঝেই উনি বলে উঠলেন,
-থাক দিদি,ছেড়ে দিন!কিছু বলবেন না!বাচ্চা মানুষ করে ফেলেছে,আর করবে না!আর করবে না তো বাবা?
ঋদ্ধি তখনও ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কেঁদেই চলেছে!নাক দিয়ে সর্দি বেরিয়ে যাচ্ছে কাঁদতে-কাঁদতে!রমা বলে উঠলো,
-না দিদি!আপনি জানেন না,কি সাংঘাতিক যন্ত্র আমার এই ছোট ছেলে!আমার এই বড়ো ছেলেকে নিয়ে কোনোদিনও কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি,কিন্তু এই ছোটটাকে নিয়ে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি!!আজ একবার বাড়ি যাই,তারপর তোমার খবর আছে!চলো তুমি...
মায়ের রক্তচক্ষু দেখে ঋদ্ধির কান্নার শব্দ বিপদসীমা অতিক্রম করে গেলো...গলা ছেড়ে রাস্তার মধ্যেই চিৎকার শুরু করে দিলো ও...
ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে ওদিক থেকে হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে শারদীয়া,অর্থাৎ যে মেয়েটার ব্যাগ ঋদ্ধি জলে ফেলে দিয়েছিলো।ভাইকে এভাবে কাঁদতে দেখে,শারদীয়ার সঙ্গে-সঙ্গে হেসে ফেললো ঋকও...
-থাক!থাক দিদি!আর কিছু বলবেন না।ও বাবু,এদিকে এসো,কি নাম তোমার?
নাক টানতে-টানতে প্রতীক বললো,
-প্রতীক কুমার চৌধুরী!
-ওবাবা!অনেক বড় নাম তো!আমি তো আমার নিজের নামই মনে রাখতে পারি না,তোমার এতবড় নাম কি করে মনে রাখবো?
একটু হেসে ফেললো প্রতীক!
-মা,তুমি ওকে খুব বকো,মারো ওকে,ও আমার ব্যাগ ভিজিয়ে দিয়েছে!
-নানা দিয়া,থাক-থাক!ও না বুঝে ভুল করে ফেলেছে,আর করবে না,তাই না প্রতীক?
-সরি দিয়া!আর হবে না!ফ্রেন্ডস?শারদীয়ার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো প্রতীক।
এক-পা এক-পা করে এগিয়ে এলো শারদীয়াও।
-ওকে!ফ্রেন্ডস!
হাত মেলালো ঋদ্ধি এবং দিয়া...
দুজনে দৌড়াদৌড়ি করে সবে খেলা শুরু করতে যাচ্ছিলো,কিন্তু শারদীয়ার মা ওকে ডেকে নিলো,ওনার দেরি হয়ে যাচ্ছে!
-আপনি কোনদিকে যাবেন দিদি?আমি ছেড়ে দিচ্ছি চলুন...
-নানা!তার কোনো দরকার নেই।আমি অটো নিয়ে নিচ্ছি!
-আচ্ছা,আপনি কোনদিকে যাবেন সেটা তো বলুন?রমা বললো।
-আমি বাজারের দিকেই যাবো।মোড় থেকে আরও একটু ভিতরের দিকে...
-ওমা!আমিও তো তার খানিকটা আগেই নামবো!চলুন,চলুন।আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি।চিন্তা নেই,আমি আমার বাড়িতেই যাবো।ওটুকু আপনি না হয় হেঁটেই চলে যাবেন।নিন-নিন,উঠুন....
ঋদ্ধি আর দিয়া তখন নিজেদের মধ্যে খেলায় মত্ত,ঋকও যোগদান করেছে ওদের সঙ্গে।ওরা হাততালি দিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছে।শারদীয়ার মা তখনও যাবেন কিনা ভাবছেন,আবারও রমা বলে,
-ও দিদি!অত ভাবতে হবে না,উঠে আসুন...বলে নিজে আগে গাড়িতে উঠে ওনাকে জায়গা করে দিলো রমা।
তাও উনি ভাবছেন দেখে প্রান্তিক এগিয়ে এসে এবার বলে উঠলো,
-আন্টি!চলো!
-হ্যাঁ!বাবা!কিরে,তোরা দুটোতে আগে ওঠ!খেলা পেলে আমার মেয়েটা আর কিচ্ছু চায় না গো দিদি...কি বলবো আপনাকে,একটুও পড়ার দিকে মন নেই...আমিও সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে এত ক্লান্ত হয়ে পড়ি...
-ও দিদি,আপনি চাকরি করেন?
-হ্যাঁ দিদি...
-আচ্ছা-আচ্ছা!গোবিন্দদা,চলো!
-হ্যাঁ বৌমনি!দরজা ঠিক করে সব লাগানো তো?
-হ্যাঁ-হ্যাঁ!চলো...
-কোথায় চাকরি করেন দিদি.....
কথায়-কথায় কখন যে ওদের গন্তব্য চলে এলো,ওরা খেয়ালও করতে পারেনি।তার মধ্যে তিনটি ছেলে-মেয়ে গাড়ির ভিতর এমন হুল্লোড় করে চলেছে,যে কান পাতা দায়!ওদের গাড়িটা বাড়ির গেটে ঢুকে যাওয়ার আগে শারদীয়াকে নিয়ে ওর মা নেমে গেলো।রমা মুখ বাড়িয়ে বললো,
-আজ কিন্তু আমার বাড়ির দরজা দিয়ে ফিরে গেলেন দিদি,একদিন কিন্তু ভিতরে এসে চা-জলখাবার খেয়ে যেতেই হবে!
-বেশ-বেশ!সে হবেখন একদিন...আসি দিদি?
-আচ্ছা!আসুন...
-ও দিদি!এতক্ষণ কথা বললাম,আপনার নামটাই তো জানা হলো না!রমা চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো নীলিমাকে।
-নীলিমা!নীলিমা মজুমদার!একটু হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে শারদীয়ার মা বললো।
-আচ্ছা দিদি!এর পরের দিন কিন্তু মেয়ে সমেত আপনাকে বাড়িতে নিয়ে আসবো।তখন কিন্তু কোনো কথা শুনবো না।
-আচ্ছা দিদি!আসবোখন!আজ আসি?
-আচ্ছা....
-টাটা!!
গাড়ির জানলা দিয়ে প্রান্তিক আর প্রতীক হাত নেড়ে শারদীয়াকে বাই করে দিলো...
রমার গাড়িটা বি.কে.ম্যানশনের সিংহদুয়ার পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো।
যতক্ষণ ওদের গাড়ির মধ্যে ছিল,নীলিমার কেমন যেন একটু কুণ্ঠাবোধ হচ্ছিলো,বাধো-বাধো লাগছিলো।আসলে নিজে তো জীবনে অনেক কষ্ট করে,অনেক লড়াই করে একমাত্র মেয়েটাকে বড়ো করে তুলছে,এতটা উচ্চবিত্ত পরিবারের সামনে ও ঠিক খোলামনে দাঁড়াতে পারে না।ভীষণ ছোট মনে হয় নিজেকে।তাই স্কুলেও খুব একটা বেশি কারোর সঙ্গে ও কথা বলে না।সব মায়েদের অনেক বড়-বড় গল্প,নীলিমা ঠিক খাপ খাওয়াতে পারে না ওসবের সঙ্গে।শারদীয়াকে বড়ো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর জন্য নীলিমাকে দিনরাত এক করে খাটতে হয়,ওর জীবনযুদ্ধটা আর সবার থেকে অনেকটাই আলাদা!কিন্তু এই প্রথম রমার সঙ্গে কথা বলে,ওর খুব ভালো লাগলো।এদের যে কতগুলো সোনার দোকান আর বাজারে আরও কতরকম ব্যবসা আছে,তার হিসেব নেই।কিন্তু এতটুকু অহংকার নেই রমার মধ্যে।নীলিমা একবারও ওকে নিজের গল্প করতে দেখলো না।বাচ্চাদের গল্প নিয়েই অস্থির ও,ভীষণ কথা বলে,আর ভীষণ খোলামেলা মনের মানুষ রমা!শারদীয়াকে তো আদর করে-করে চটকে দিলো একেবারে।বারবার আফসোস করছিলো,বাড়ির দরজা থেকে এভাবে খালি মুখে মেয়েটা চলে যাচ্ছে বলে!আন্তরিকতার অভাব নেই রমার মধ্যে!শারদীয়াকে আদর করার সময় চোখে জল এসে গিয়েছিলো রমার, নীলিমার চোখ এড়ায়নি সেটা।কিন্তু এত সুখী একজন নারীর কিসের কষ্ট থাকতে পারে!!ভেবে পায়না নীলিমা!যাইহোক,শারদীয়াকে একটু বলে দিতে হবে,এরপর ছুটির পর ও যেন একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে।নইলে রমা আবার ওদের গাড়িতে তুলবে,বাড়িতে নিয়ে যাবে।ওদের সঙ্গে নীলিমাদের খাপ খায় না মোটেই।তাই তিক্ততা বাড়ার আগে,সম্পর্ক ভালো থাকতে-থাকতেই,দূরত্ব রেখে চলা ভালো।কারণ কোনোদিক থেকেই নীলিমা,রমার সমকক্ষ নয়।আর যেকোনো সম্পর্ক সবসময় সমানে-সমানে হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়,নইলে নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হয়।রাস্তাঘাটে ওদের সঙ্গে বেরিয়ে,ওদের মতো দু-হাত ভরে খরচ করার করার সামর্থ্য নীলিমার নেই।সেক্ষেত্রে ভীষণ সম্মানহানি হয়!আর নীলিমা জীবনে দুটো জিনিসকেই আঁকড়ে বেঁচে রয়েছে,এক শারদীয়া,আর দ্বিতীয়,নিজের আত্মসম্মানটুকু....তবে রমাকে নীলিমার বেশ লেগেছে।প্রথম আলাপেই ভীষণ ভালো মনের মানুষ মনে হয়েছে ওনাকে....রমার কথা ভাবতে-ভাবতেই ছোট্ট একরত্তি ফ্ল্যাটের তালা খুললো নীলিমা...
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নীলিমা একরকম রমাকে এড়িয়েই চলেছে।শারদীয়া বেরোনোর পরই তাড়াতাড়ি করে নীলিমা ওকে নিয়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে।কিন্তু সেদিন আর পালাতে পারলো না।একেবারে খপ করে ওকে চেপে ধরলো রমা।নীলিমা চলেই আসছিল,পিছন থেকে চেঁচালো রমা,
-ও দিদি,দাঁড়ান একটু!আপনার সঙ্গে কথা আছে!
এবার শুনেও না দাঁড়ালে ব্যাপারটা ভীষণ দৃষ্টিকটূ হয়ে যায়।অগত্যা দিয়ার হাত ধরে স্কুলের বাইরে রমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো নীলিমা।
-বাবা!দিদি,কদিন আপনাকে দেখতেই পাইনি।ঋদ্ধিকে আমি প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতাম,হ্যাঁরে আজ শারদীয়া স্কুলে আসেনি?ও তো হ্যাঁ বলতো।কিন্তু আপনাকে আর দেখতেই পেতাম না।কখন যে বেরিয়ে যেতেন!
"কেউ ইচ্ছে করে হারিয়ে থাকলে,ভিড়ে মিশে থাকলে, তাকে খুঁজে পাওয়া তো অত সহজ নয় দিদি!"
মনে-মনে নীলিমা বললো।ওদিকে রমা তখন একনাগাড়ে বলেই চলেছে,
-দিদি,আগামী রবিবার আমার ছোট ছেলে ঋদ্ধির পাঁচ বছরের জন্মদিন,আপনি কিন্তু আপনার কর্তাকে নিয়ে,শারদীয়াকে নিয়ে অবশ্যই আসবেন।আমি আপনার বাড়ি গিয়েই বলতাম,কিন্তু আপনার বাড়ি তো চিনিই না!কি করে....কি ব্যাপার দিদি?আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
-আমি আসি দিদি,পরে কথা হবে!চোখ থেকে জলটা প্রায় বেরিয়েই এসেছিলো,তাই একরকম পালাতেই চাইছিলো নীলিমা!
সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো রমা।
-আপনি আমার সঙ্গে বাড়ি যাবেন!কি হয়েছে দিদি আপনার?
আজ আর কথা বলার ক্ষমতা নেই নীলিমার।সারাটা শরীর অবশ হয়ে গেছে।অন্য সময় নিজেকে ভীষণ কঠিন করে রাখে ও,বাইরের সমাজের কাছে।কিন্তু আজ রমা না জেনেবুঝে এমন একটা জায়গায় আঘাত করে দিয়েছে,ও আর নিজেকে সামলাতেই পারছে না!
রমার সঙ্গে চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে উঠলো নীলিমা।
-কি ব্যাপার দিদি?আমার কোনো কথা কি আপনাকে খুব কষ্ট দিয়েছে?রমা বললো।
সর্বদাই ফুলহাতা ব্লাউজ পরে নীলিমা।তাই চট করে চোখে পড়ে না।কপালটাও আলগা উড়ো চুলে ঢাকা থাকে!হাতদুটো বের করে রমার চোখের সামনে আনলো ও।নীলিমার ডানহাতে একটা ঘড়ি পরা,আর বাঁ-হাতটা খালি!চমকে উঠলো রমা।
-দিদি!!
-আমার কর্তা আসতে পারবে না দিদি।উনি নেই....
স্তব্ধ হয়ে গেলো রমা।আর একটাও কথা বলতে পারলো না ও।চমকে উঠলো গোবিন্দদার কথায়...
-বৌমনি!বড়োদাদাবাবুর জন্য অপেক্ষা করবে তো?
-না গোবিন্দদা!তুমি আজ আমাদের নিয়েই বাড়ি চলো।পরে তুমি গাড়ি নিয়ে এসে ঋককে নিয়ে যেও।ও আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বোলো,আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো,তাই আমি চলে গেছি!
-আচ্ছা বৌমনি!
গাড়ি চলতে শুরু করলো।
রমা অবাক হয়ে শারদীয়ার মুখের দিকে চাইলো।ততক্ষণে ও খেলায় মেতেছে ঋদ্ধির সঙ্গে।এতটুকু মেয়েটার বাবা নেই!!বাবার স্নেহ-ভালোবাসা কি বুঝলোও না!চোখে জল এসে গেলো রমারও...
-আমি আজ আর কিচ্ছু জানতে চাইবো না দিদি,কিভাবে কি হয়েছে!আমি অজান্তে আপনাকে যে আঘাত দিয়ে ফেলেছি,তার জন্য....
-রমা!মানে দিদি,আপনি কেন কষ্ট...
-নামটাই থাক না,আপনিতেও বড্ড পর লাগে,তুমিই চলুক নীলিমা...
-হুম!বেশ!
নীলিমার শুন্য হাতের ওপর নিজের শাঁখা-পলা-বালা পরা একটা হাত রাখলো রমা।ব্যথিত হৃদয়ে যতটুকু সান্ত্বনার প্রলেপ দেওয়া যায় আর কি....
গাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে নেমে যাচ্ছিলো নীলিমা।ওর হাতটা ধরলো রমা,
-নীলিমা,আসবে তো রবিবার সন্ধ্যেবেলায়?শারদীয়া এলে আমার খুব ভালো লাগবে।
-আমি সত্যিই আসবো রমা!আমার মেয়েটার তো তেমন কোথাও যাওয়ারও জায়গা নেই!আমি আসবো ওকে নিয়ে!কথা দিচ্ছি!!
-আমি খুব খুশি হলাম নীলিমা!তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবো...
-আচ্ছা!আসি...
-হুম!
নীলিমা চলে গেল শারদীয়ার হাত ধরে।রমা কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ওদের চলে যাওয়ার দিকে।ওর বুকের ভিতরটা একটা অজানা কষ্টে মুচড়ে উঠলো।সৈকতের মুখটা মনে পড়ে গেলো ওর,সৈকতকে ছাড়া ও তো নিজেকে কল্পনাও করতে পারে না!না জানি নীলিমা কিভাবে এতবড় জীবনটা একা কাটাবে....
সারাটা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে গা ধুয়ে একটা তোয়ালে পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো নীলিমা।বিছানায় অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে দিয়া।চুলটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো ও।ভিজে চুলের আগা থেকে জল বেয়ে পড়ছে,ওর সারাটা শরীরে যেন আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।রাস্তাঘাটে-অফিসে পুরুষের প্রশংসনীয় চোখ বারবার ওকে বলে দিয়েছে,ও যথেষ্ট সুন্দরী!অফিস কলিগ অরণ্য আজও ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে।কিন্তু ও যে কিছুতেই রণজয়ের জায়গায় কাউকে বসাতেই পারে না,অরণ্যকেও না।কোনদিন এমন কোনো পুরুষ কি পাওয়া সম্ভব,যে রণ-কে ভুলিয়ে রাখতে পারবে!ও শেষ হয়ে যাচ্ছে ধীরে-ধীরে...মা চলে যাওয়ার পর আরও একা হয়ে গেছে ও।বুকে আগলে এখন মানুষ করছে শারদীয়াকে।কিন্তু দিনের শেষে ও কি করে ভুলবে,ও অবশ্যই শারদীয়ার মা,কিন্তু সেই সঙ্গে-সঙ্গে একজন অসম্পূর্ণ নারীও...
আয়নায় নিজের অর্ধঅনাবৃত প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো নীলিমা।নিজের দু-হাতে আর খোলা উরুতে একটু ক্রীম মাখতে শুরু করলো ও....
রবিবার সকাল থেকেই শারদীয়ার অল্প-অল্প গা-টা গরম!ঋদ্ধির জন্য শনিবারই উপহার কিনে রেখেছিলো নীলিমা।কিন্তু মেয়েটার যা শরীর খারাপ,যেতে পারলে হয়!কিন্তু বিকেল থেকেই দেখা গেলো নীলিমার থেকে শারদীয়ারই যাওয়ার উৎসাহটা বেশি।জ্বরটা একটু ছেড়েছে দেখে নীলিমাও তৈরি হতে লাগলো।ওকে খাবার খাইয়ে,ওষুধ খাইয়ে নিয়ে বেরোতে বেশ খানিকটা রাতই হয়ে গেলো।রমাকে কথা দিয়েছিলো নীলিমা।তাই না গেলে ও খুব কষ্ট পাবে।বেগুনি রঙের একটা শাড়ি পরেছে নীলিমা,সঙ্গে ফুলহাতা ব্লাউজ,আর ডানহাতে ঘড়ি।দু-চোখে গাঢ় করে কাজল,আর চুলটা একটু আলগা করে খোঁপা,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক!বরাবরই একটু হালকা সাজেই অভ্যস্ত ও।আর রণ চলে যাওয়ার পর তো সাজার ইচ্ছেটুকুও মরে গেছে।এখন সমাজে পাঁচজনের মাঝে চলতে গেলে নিজেকে যেটুকু গুছিয়ে রাখতে হয়,সেটুকুই করা আর কি!একেবারে তৈরী হয়ে বেরোবার সময় একবার আয়নার দিকে তাকালো নীলিমা।নিজেই নিজের রূপ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ও।এই শাড়িটা প্রথম বিবাহ-বার্ষিকীতে রণ নিজের হাতে ওকে পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলো।রণ-কে ছাড়া নিজের রূপ-যৌবন সব যেন বড্ড ফ্যাকাশে,বড্ড ধূসর মনে হয়!কোনোরকমে চোখের জলটা চেপে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ও।রমার বাড়ির সামনে শারদীয়াকে নিয়ে নীলিমা যখন রিক্সা থেকে নামলো, তখন রাত প্রায় ন-টা!
তিনতলা বাড়ির বাইরেটা বেশ সুন্দর করে বেলুন দিয়ে সাজানো।কিন্তু নীচে কোনো লোকজন নেই।সব বোধহয় ওপরে।দরজা খোলা দেখে সিঁড়ি দিয়ে উঠলো নীলিমা।সবে কয়েকটা ধাপ উঠেছে,এমন সময় দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো সৈকত!নীলিমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ও,কয়েক মুহূর্ত অবাক চোখে চেয়ে রইলো।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়িই বলে উঠলো,
-আপনি নিশ্চয়ই নীলিমা দেবী?
-হ্যাঁ,কিন্তু আপনি আমায়...
-আমি সৈকত,প্রান্তিক-প্রতীকের বাবা!রমার মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি।আজ আপনাকে দেখে বুঝলাম,রমার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে!ওপরে আসুন,এসো শারদীয়া!
শারদীয়া লাফাতে-লাফাতে আঙ্কেলের হাত ধরে ওপরে উঠে গেলো।সৈকত ওপরে উঠেই চিৎকার করে ডাকলো,
-রমা....
রমা কাদের সঙ্গে গল্প করছিলো,ঘুরে নীলিমাকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এলো।ওর চোখের পলক পড়ছিলো না নীলিমাকে দেখে।রমা শুধু একবার বললো,
-তোমাকে কি অসাধারণ সুন্দর লাগছে নীলিমা!চোখই তো ফেরানো যাচ্ছে না!
হেসে ফেললো নীলিমা।সৈকত আরও একবার চোখ তুলে নীলিমাকে দেখে সরে গেলো ওখান থেকে,ও শারদীয়ার হাত ধরে এগিয়ে গেলো ঋক আর ঋদ্ধির ঘরের দিকে...ওদের স্কুলের সব বাচ্চারা ওখানেই আছে...
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
সারপ্রাইজ!!!! ত্রিভুজ! ত্রিভুজ! ত্রিভুজ!


ফিরে দেখা ত্রিভুজ। 

উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন