ত্রিভুজ
সাথী দাস
তৃতীয় পর্ব
-জানো রমা,আমার চিন্তায়-চিন্তায় সেই যে আমার মা একটু-একটু করে বিছানা নিলো,আর মা-কে টেনে তুলতে পারলাম না!কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম।শ্রাদ্ধের পর তো কতদিন রণ-র ছবির দিকে একটিবার তাকাতে পর্যন্ত সময় পাইনি!নিজেই অবাক হয়ে যেতাম।একদিকে অসুস্থ মা-কে সামলানো,আর একদিকে একরত্তি মেয়ে,আর সেই সঙ্গে চরম আর্থিক অনটন!দারিদ্র্য মানুষকে পাথর করে দেয় জানো তো!কোনো আবেগ-অনুভূতি তখন আর কাজ করে না!সেই মুহূর্তে রণর মৃত্যু আমায় ততটাও চিন্তায় ফেললো না,যতটা ফেললো মায়ের চিকিৎসা আর মেয়ের ভবিষ্যৎ।কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সব দুঃখ,তার জায়গায় এসে জড়ো হলো একরাশ দুশ্চিন্তা।ওই অসুস্থ মায়ের ওপর ভরসা করেই মেয়েটাকে ফেলে রেখে,পুরোনো চাকরিটা আবার করতে শুরু করলাম।জানো রমা,ঘরে মেয়েটা আমার একটু দুধের জন্য চিৎকার করে দাপিয়ে মরছে,আর অফিসে আমি বুকে ব্যথায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।শাড়ি-ব্লাউজ ভিজে যাচ্ছে।বুক ভারী হয়ে গিয়ে টনটন করছে,তবু মেয়েকে দুধ দেবার উপায় নেই।চাকরি যে আমায় করতেই হবে।বেরোতে আমাকে হবেই।দুটো বছর যে আমার কিভাবে,কোথা দিয়ে কেটেছে রমা,আমি বুঝতেও পারিনি!দু-বছর পর মা আমার অনেকটা খরচ কমিয়ে দিয়ে গেলো।মুক্তি দিয়ে গেলো আমায়!বাড়ি ফিরে যাও বা ওই বুড়িটার সঙ্গে একটু দু-চারটে কথা বলে একটু হালকা হতাম,মা চলে যাওয়ার পর যেন বোবা হয়ে গেলাম!আমার আর এই পৃথিবীতে নিজের বলতে কেউ রইলো না রমা,একমাত্র মেয়েটা ছাড়া!আমি না থাকলে ওর যে কি হবে,ভাবলেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় গো...
-এসব কি বলছো নীলিমা!কিন্তু তোমার দিকের আত্মীয়-স্বজন?
-ওই দু-বছরে আমার সব আত্মীয়-স্বজনকে চেনা হয়ে গেছে রমা,মা যতদিন মাথার ওপর ছিল,টুকটাক খোঁজ-খবর যাও বা নিতো,মা মারা যাবার পর সব এক-এক করে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো!আমি একা একটা বিধবা মেয়ে,কিভাবে মেয়েটাকে নিয়ে বাঁচবো,সেটা আর তলিয়ে ভেবে দেখার মতো অত সময় কারো কাছে নেই গো!প্রথম-প্রথম কড়া নেড়েছি ওদের দরজায়,কেউ হয়তো নিতান্ত অনিচ্ছাসত্বে এগিয়ে এসেছে,কেউ বা নানা অছিলায় এড়িয়ে গেছে।আমার অভাব সহ্য হয় রমা,কিন্তু অপমান নয়!তাই আমিও সরে এসেছি আস্তে-আস্তে!নিজেকে বুঝিয়েছি,মাথা গোঁজার জায়গাটা যখন আছে,মাস গেলে তো আর বাড়িওয়ালা দরজার সামনে এসে দাঁড়াবে না,তখন বাকিটা ঠিক একটু-একটু করে সামলে নেবো!খুব কষ্ট হয়েছে গো রমা,কিন্তু পেরেছিও ওই সময়টা কাটিয়ে উঠতে!সামনের ফ্ল্যাটের দাদা-বৌদি খুব করেছে আমার মেয়ের জন্য,এখনও করে।বৌদির শাশুড়িটা ভীষণ যাতনা দেয় ওকে,কিন্তু তাও ঘরে অশান্তি করে ও আমার মেয়েটাকে রাখে।আমি আগে তো বেশিক্ষণ অফিস করতে পারতাম না মেয়ের জন্য,বাড়িতে যে মেয়েকে দেখাশোনার জন্য একটা লোক রাখবো,সে ক্ষমতা কোথায়!আগে পার্ট-টাইম করতাম,এখন একটু-একটু করে সময় বাড়িয়েছি,টাকাও বেড়েছে!মেয়েটাকে শুধু একটু মানুষ করতে পারলে,আর কিছু চাওয়ার থাকবে নাগো আমার...শুধু এখন মাঝে-মধ্যে বড্ড একা লাগে,আগে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে-করতে অনুভূতিগুলো মরে গিয়েছিলো।এখন রণ-কে ভীষণ মনে পড়ে।আর থাকতে পারি না ওকে ছাড়া!খুব কষ্ট হয় গো....আর থাকতে পারি না গো!!
রমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নীলিমা....
রমা বুঝতে পারলো ফাঁকটা কোথায়!মনে তো অবশ্যই,সেই সঙ্গে শরীরেও।অস্বাভাবিক কিছু না!কিন্তু কি করবে ও,ব্যথিত হৃদয়!আচ্ছা,জীবনটা নতুন করে শুরু করার কথা কি নীলিমা ভাবতে পারে না!কিই বা বয়স ওর!কিন্তু এই মুহূর্তে রমা এ প্রসঙ্গে,আর কোনো কথা বলবে না।ভীষণ ভেঙে পড়েছে নীলিমা!ওকে এর আগে কোনোদিনও এত কথা বলতে দেখেনি রমা।আজ যেন একটু ভালোবাসার,ভরসার আভাস পেয়ে ওর বুকের মধ্যেকার জমে থাকা ব্যথার বাঁধ ভেঙে পড়েছে!কলকল করে বেরিয়ে আসছে এতদিনের বুকের গহীনে চেপে রাখা কথারা!রমাকে এখনও আঁকড়ে ধরে রয়েছে নীলিমা।ওর বুকে মাথা রেখে ও চুপ করে বসে আছে।রমা নিজের শাঁখা-পলা-বালা পড়া হাতটা সযত্নে নীলিমার মাথায় রাখলো।তারপর ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো..
-নীলিমা?
-উম?
-রাতে কি খাবে?
-দেখি!ওবেলা তো মেয়েটার জন্য চাল-ডাল দিয়ে গলাভাত করেছিলাম,তাই একদলা..
-আজ আমি রান্না করবো তোমার বাড়িতে?আমায় ভরসা করে ছাড়বে তোমার রান্নাঘর?
রমার আন্তরিকতায় চমকে উঠলো নীলিমা।ওর কণ্ঠের মধ্যে এমন কিছু ছিল,যে ভিজে গেলো নীলিমার পাথরের মত মন।
-কি রান্না করবে বলো?আমি এক্ষুণি বাজারে যাচ্ছি!
-তুমি!!মৃদু হাসলো রমা..দেখি আমার দিয়া মার কি খেতে ইচ্ছে করে!ও যা বলবে,তাই রান্না হবে আজ!দিয়া..
বার দুয়েক ডাকার পর সৈকত দিয়াকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।দিয়া সৈকতের কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।নীলিমা কোনোরকমে চোখ মুছে,শাড়ির আঁচল সামলে বুকে জড়িয়ে ধরলো দিয়াকে...
-এদিকে আয় তো মা!বল তো,তোর কি খেতে ইচ্ছে করছে এখন?
-মাংস!
-ও বাবা,মাংস খাবে?আচ্ছা দাঁড়া মা...এই শোনো... সৈকতের দিকে এগোয় রমা...
হুড়োহুড়ি করে এগিয়ে আসে নীলিমা।
-এই নানা,ওনাকে বলছো কেন!আমি কাপড়টা বদলে যাচ্ছি!
-চুপ,একটাও কথা না,তোমার রান্নাঘর এখন আমার দখলে..শোনো..একটু মাংস নিয়ে এসো তো,আমি রান্না করবো,তুমি আর আমি এখানেই খেয়ে যাবো।নীলিমা,তোমার ফোন থেকে একটা ফোন...
-হ্যাঁ,হ্যাঁ!করো না!ওই তো ল্যান্ডফোন!
-হুম,বাড়িতে একটু ফোন করে দিই,ঝর্ণাদি আমার ছেলেদুটোকে খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে দেবে।তুমি যাও...
-হুম!নীলিমা দেবী,দরজাটা একটু....সৈকত নীলিমার দিকে চেয়ে বলে...
-হুম,চলুন!
রমা এগিয়ে যায় নীলিমার ল্যান্ডফোনটার দিকে...
-রমা আপনাকে খুব বিপদে ফেললো বুঝতে পারছি।কি যে বলি...নীলিমা সৈকতকে বললো।
-ও আমার অভ্যাস আছে,আমার রমাকে তো আপনি এখনও ঠিকমতো চেনেন না,তাই একথা বলছেন....বলেই চমকে উঠলো সৈকত।ওর মুখ থেকে সবসময় বেরিয়েই যায় এই কথাটা"আমার রমা"!কিন্তু সেটা যে একজন একাকী নারীকে কতটা আঘাত করতে পারে,তা একটু আগেই সৈকত বুঝেছে!একটু থেমে সৈকত আবার বললো,
-আমি অজান্তে যদি আপনাকে কোনোভাবে আঘাত করে থাকি নীলিমাদেবী,আপনি আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দেবেন!
সবটুকু বুঝতে পারলো নীলিমা।ও বললো,
-হ্যাঁ,এটা ঠিক,আপনার ওই কথাটুকু আমাকে রণ-র কথা মনে করিয়ে দেয় বারবার।কিন্তু আপনি না বললে কি আমার ওর কথা মনে পড়বে না সৈকত বাবু!!আমি কি ওকে ভুলে থাকবো,বলুন?তা তো হয় না,হবারও নয়!আমার ভালোবাসাকে আমি এমন একটা সময়ে,এমন একটা বয়সে চিতায় জ্বলতে দেখেছি,সেই আগুনে আমি আজও পর্যন্ত প্রতিনিয়ত জ্বলে শেষ হচ্ছি!এ এমন একটা জ্বালা,যার আমরণ কোনো শেষ নেই।আপনি এ নিয়ে বেশি ভাববেন না সৈকত বাবু,আমি ভালো থাকতে জানি!আগে জানতাম না,এখন শিখেছি!আপনিও আপনার রমাকে নিয়ে খুব ভালো থাকুন....
ভাষা হারিয়ে ফেললো সৈকত।বড় সহজ নয় এ নারী!নীলিমার চোখের দিকে আর চেয়ে থাকতে পারলো না সৈকত।মাথা নামিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
-যদি কিছু মনে না করেন,যদি নিতান্তই অনধিকার চর্চা মনে না করেন,আর যদি অনুমতি দেন,তবে একটা কথা বলতে পারি?
-বলুন না....
-শহরের বুকেই,কাছাকাছির মধ্যে আমাদের অনেকগুলো শো-রুম আছে,আপনি চাইলেই যেকোনো একটায় জয়েন করতে পারেন।না মানে,ঘরের মধ্যে থেকে আপনার আর রমার কিছু-কিছু টুকরো কথা আমার কানে ভেসে এসেছে,তাই বলছিলাম,দিয়াকে ছেড়ে বেশি সময় থাকাটা...
-আপনি বলেছেন,আমার জন্য এতটা ভেবেছেন,এটাই অনেক সৈকত বাবু,যখন সত্যিই ভীষণ প্রয়োজন ছিল,তখন এতটুকুও আমার জন্য কেউ করেনি।আজ নিজেকে বেশ কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছি।আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি সৈকত বাবু,যদি কোনোদিনও তেমন প্রয়োজন পড়ে,আমি সবার আগে বিনা সংকোচে আপনার সামনে গিয়েই দাঁড়াবো,আপনার সামনেই হাত পাতবো!সাবধানে যাবেন,তাড়াতাড়ি ফিরবেন,ততক্ষণ আমি রমার সঙ্গে হাতে-হাতে রান্নার কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখি...আসুন!
দৃপ্ত কণ্ঠের প্রত্যেকটা স্পষ্ট-সাবলীল কথায় বারংবার খেই হারাচ্ছিলো সৈকত।নীলিমার শেষ কথাটুকুতে ঘোর কাটলো ওর।নীলিমা ততক্ষণে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়েছে।শ্যামাঙ্গিনীর উজ্জ্বল মুখাবয়বের ওপর থেকে দৃষ্টি নামিয়ে সৈকত।একটু হেসে বেরিয়ে গেলো ও...পিছনে দরজা বন্ধ হওয়ার মৃদু শব্দ হলো...
নীলিমাকে যত দেখছে,তত অবাক হয়ে যাচ্ছে সৈকত।রমা প্রথম দিনই ওকে বলেছিলো,নীলিমা আর পাঁচজনের থেকে একদম আলাদা!ভুল বলেছিলো রমা!নীলিমার সঙ্গে আর পাঁচজনের কোনো তুলনাই চলে না।ওনার তুলনা উনি নিজেই...নিজের চারদিকে অদ্ভুত একটা গণ্ডী এঁকে রেখেছেন উনি।কারোর সাধ্য নেই সেই গণ্ডী পেরিয়ে ওনাকে স্পর্শ করে!!যদিও কিছুটা কালই বুঝেছিলো ও,বৃথাই সাহায্যের চেষ্টা করছে সৈকত।উনি নিজের লড়াইটা নিজেই লড়তে জানেন,জীবনযুদ্ধে কোনো সহযোদ্ধার প্রয়োজন,ওনার মতো নারীর নেই...
নিজের মনেই বলে উঠলো সৈকত,
"এই কঠিন জীবনযুদ্ধে আপনি জয়ী হোন নীলিমা দেবী!আজ আপনাকে একাকিনী জিততে দেখলে,সমাজের শত-সহস্র নারী একা পথ চলার সাহস পাবে...আপনার অসম সাহসিকতা,অদম্য মনের জোরের কাছে আমি,সৈকত কুমার চৌধুরীও রিক্ত-নিঃস্ব।আমার কাছে কিছুই নেই আপনাকে দেওয়ার মতো,শুধু শুভেচ্ছা বার্তাটুকু ছাড়া...আপনার শারদীয়া অনেক বড় হোক!ওর সাফল্যের মধ্যে দিয়েই পূর্ণতা পাক আপনার কঠোর অধ্যবসায়!"
আজ ভীষণ ভালো লাগছে সৈকতের,এক অসামান্য নারীর সম্মুখীন হতে পেরে।এক সধবা নারীর অফুরন্ত পরিপূর্ণতার সামনে-সুখের সামনে,এক বিধবা নারী,নিজের বুকের মধ্যেকার অপার শুন্যতাকে অনুভব করে,সাময়িক দুর্বলতায় বুকফাটা আর্তনাদে ভেঙে পড়েছিলো।কয়েক মুহূর্তের জন্য বাইরের কঠিন আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলো,ভিতরের প্রতি রাতের একাকিনী নীলিমা।কিন্তু পরক্ষনেই কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত সে।সুন্দর ভাবে আবার ঢেকে নিয়েছে নিজেকে,প্রকৃত নীলিমাকে আবারও আড়াল করে রেখেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে।আজ যদি রমার সঙ্গে সৈকত না আসতো,তবে নীলিমার একাকীত্বকে হয়তো কোনোদিন উপলব্ধিই করতো পারতো না!সবার মতো সৈকতও ভাবতো,নিতান্তই প্রাণহীন-কঠিন নারী সে!কিন্তু সৈকতের ওই একটা কথাই "আমার রমা",এক মুহূর্তেই অনাবৃত করে দিয়েছে নীলিমাকে।মেকি গাম্ভীর্যের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ওনার সংবেদনশীল কোমল মনটা।সৈকত বুঝতে পারলো,এক আকাশ ভালোবাসা প্রোথিত রয়েছে নীলিমার মনের গভীরে....
গাড়িটা মাংসের দোকানের সামনে থামালো সৈকত...সারাটা রাস্তা ওর মন-মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু একটাই নাম বিরাজ করছিলো,"নীলিমা"..
সারাটা সন্ধ্যে কিভাবে কেটে গেলো,ওরা বুঝতেও পারলো না।রমা কোলে করে দিয়াকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে,কাল আবার স্কুল আছে,নীলিমারও অফিস।সৈকত আর রমা খেতে বসেছিলো।নীলিমা পরিবেশন করতে চাইলো,কিন্তু রমা একরকম জোর করেই টেনে বসালো ওকে।তিনজনেই খেতে-খেতে গল্প করছিলো...
-একটা কথা বলবো নীলিমা?রমা জিজ্ঞেস করলো।
-উম,বলো না...খেতে-খেতেই উত্তর দিলো নীলিমা।
-এভাবে গোটা জীবনটা কাটাবে?এভাবে চলে নাকি?নতুন করে শুরু করার কথা ভাবনি?
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো নীলিমার।একবার মুখ তুলে সোজাসুজি সৈকতের দিকে তাকালো ও।সৈকতও তখন একভাবে নীলিমার মুখের দিকেই চেয়ে আছে।রমা বুঝতে পেরে বললো,
-ও,ওর কথা বাদ দাও!তুমি আমার মতো,ওর সামনেও সহজ হতে পারো নীলিমা...
নীলিমা পাতের ভাতের ওপর অন্যমনস্ক ভাবে আঙুল চালাতে-চালাতে বললো,
-একেবারেই ভাবিনি,এমনটা নয় রমা।কিন্তু পারিনি জানো!কিছুতেই পারছি না তো!রণ-কে ভুলতেই পারি না এক মুহূর্তের জন্যও।এবার যাকে আমি নিজের জীবনের সঙ্গে জড়াবো,তার মধ্যে আমি রণ-কেই খুঁজে বেড়াবো।আর সেটা তাকে অসম্মান করা হবে।আর এখন তো দিয়া বড়ো হয়ে যাচ্ছে,আর খুব একটা এসব নিয়ে ভাবি না...
সৈকত আর থাকতে না পেরে,এবার বলেই ফেললো,
-এভাবেই একা থাকবেন তাই বলে?সারাটা জীবন?সেটা সম্ভব নীলিমা দেবী?আচ্ছা রণ-র বাড়ি থেকে ওনার মৃত্যুর পর কেউ একবারও এসে দাঁড়ায়নি?
-হ্যাঁ,ওর বাবা নেই।আমার শাশুড়িমা আমায় অনেকবার নিতে এসেছিলেন।আমিই যাইনি...
-কেন??সৈকত আর রমা দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলো।
-রণ-র দেওয়া সিঁদুর মাথায় নিয়ে,ওর বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে যে বাড়িতে আমার জায়গা হয়নি,ওর বিধবা হয়ে সে বাড়িতে আমি কি করে যেতাম বলো!আমাকে বিয়ে করে ও নিজেই বাড়িছাড়া হয়েছিল,সেই আমি ওকে ছাড়া ড্যাং-ড্যাং করে ওই রাজপ্রাসাদে গিয়ে উঠতে পারিনি।ওর ভালোবাসাকে এতোটাও অপমান,আমি করতে পারিনি গো...প্রথম-প্রথম খুব তোয়াজ করে ওর মা আমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন,কিন্তু যখন পারেননি,তখন সবাইকে বলে বেড়ালেন,বউয়ের চরিত্রদোষ!তাই শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চায় না।একাই থাকবে ওই নষ্টা-কালি মেয়েছেলে!!একা থাকলে নষ্টামি করতে সুবিধে হবে...
মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো সৈকত।মাথাটা গরম হয়ে গেলো ওর।কোনোরকমে নিজের রাগকে সংযত করলো ও....কিন্তু রমা পারলো না,
-নীলিমা!!ছিঃ!!
শিউরে উঠলো রমা..
মৃদু হেসে নীলিমা বললো,
-ভয় পেয়ো না রমা,আমি অনেক সয়েছি।এইজন্য দুঃখ-কষ্ট এই অনুভূতিগুলো আজকাল মরে গেছে গো!এতটা কঠিন ছিলাম না গো,খুব সহজ-সরল ছিলাম,রণ-র "নীলু" ছিলাম।কিন্তু সত্যি বলতে রমা,সেদিন রণ একা চিতায় জ্বলেনি গো,ওর সঙ্গে-সঙ্গে ওর নীলুও জ্বলে গেছে।আজকের নীলিমার সঙ্গে আগের নীলুর কোনো মিল নেই।আজ আমার একটাই পরিচয়,আমি নীলিমা মজুমদার,শারদীয়ার মা...ব্যাস!
সৈকতের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো।ও আর নীলিমার মুখের সামনে বসে থাকতে পারলো না।উঠে সিঙ্কের দিকে যাচ্ছিলো,নীলিমা ব্যস্ত হয়ে উঠলো,
-একি!আপনি উঠলেন?আর এক টুকরো মাংস...
-নাঃ!থ্যাঙ্কু,দরকার নেই...আমার খাওয়া হয়ে গেছে!উঠে গেলো সৈকত।রমাও আর একটাও কথা বলতে পারলো না।চুপচাপ খেতে লাগলো।মনটা বড্ড ভারী হয়ে গেছে...
-নীলিমা,মেয়েকে নিয়ে একদিন এসো নাগো আমাদের বাড়ি...
-যাবো রমা,আমি সত্যিই যাবো গো।আমার মেয়ের তো কোথাও বেড়াবার জায়গা নেই,তোমায় ও বড্ড ভালোবাসে।তুমি তো জানোই,সারাটা সপ্তাহ আমি অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি।শনি-রবিবার দেখে আমি যাবো রমা...
-খুব ভালো লাগলো গো,খুব ভালো কাটালাম আজকের সন্ধ্যেটা...
-আবার এসো,সৈকত বাবু,আপনিও আসবেন রমার সঙ্গে....
-হ্যাঁ,অবশ্যই!তবে এবার থেকে এলে রমার সঙ্গেই আসবো!!নইলে আবার বলা তো যায় না,আপনার অতীন্দ্রিয় প্রহরী আবার ঠিক কোন ভাষায় ভাষণ দিয়ে বসবেন...বলে সৈকত সামনের ফ্ল্যাটের দিকে ইশারা করলো....
রমাকে গতকালই বাড়ি গিয়ে সৈকত বলেছিলো বয়স্ক মাসিমার ব্যাপারটা।আজ সৈকতের কথায় ওরা তিনজনেই হেসে উঠলো...
সৈকত হাসি থামিয়ে বললো,
-না সত্যি নীলিমা দেবী,খুব ভালো লাগলো আপনার বাড়িতে এসে।আমি নেহাতই রমাকে আপনার বাড়িটা চেনাতে সঙ্গে এসেছিলাম,রমা চিনে গেলো।এবার থেকে হয়তো ওই আসবে।আমি হয়তো আর আসবো না,বা আমার আসার তেমন কোনো প্রয়োজনও হয়তো পড়বে না।তাই ভীষণ ইচ্ছে করছে আপনার মতো মানুষকে একটু শুভেচ্ছা জানাতে,আপনি আপনার শারদীয়াকে নিয়ে ভীষণ-ভীষণ ভালো থাকুন নীলিমা দেবী।সবসময় মনে রাখবেন,আপনার যেকোনো প্রয়োজনে রমার মতো আমিও সবসময় আপনার পাশে আছি....
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে সৈকত চেয়ে রইলো নীলিমার দিকে,নীলিমা সোজাসুজি সৈকতের চোখের দিকে চেয়ে বললো,
-আপনিও আপনার রমাকে নিয়ে খুব ভালো থাকুন সৈকত বাবু...
ওপর-নীচে দুবার ঘাড় নেড়ে হেসে বেরিয়ে গেলো সৈকত।রমা ততক্ষণে জড়িয়ে ধরেছে নীলিমাকে,
-আসছি নীলিমা!
-এসো!আবার আসবে কিন্তু...
-ও আমাকে বলতে হবে না,আমি সুযোগ পেলেই দিয়াকে দেখতে চলে আসবো..
-একদম...
রমা হাত নেড়ে,শাড়ির আঁচলটা সামলে এগিয়ে গেলো সৈকতের দিকে।ও একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল।বারান্দার মৃদু আলোয় নীলিমা দেখলো,সিঁড়ি দিয়ে নামার ঠিক আগের মুহূর্তে হাসিমুখে রমার কাঁধে হাত রাখলো সৈকত...
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজাটা বন্ধ করে দিলো নীলিমা।ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ও পারলো না সৈকতের শো-রুমে চাকরি করার প্রস্তাবে রাজি হতে।হয়তো সবদিক থেকেই অনেক সুবিধা হতো।মুখে রক্ত তুলে প্রতিমাসে হয়তো এতটা খাটনি খাটতে হতো না ওনার ওখানে।দিয়াকেও আরও একটু বেশি সময় দেওয়া যেত।সামনের ফ্ল্যাটের বৌদির ওপরে এতটাও নির্ভরশীল হতে হতো না।কিন্তু তাও নীলিমা কিছুতেই পারলো না।কারণ,আজ ও সৈকতের চোখে এক মুহূর্তের জন্য যে ছায়া দেখেছে,তা বহুদিন আগে দেখেছিলো অরণ্যর চোখে।আজও অরণ্য ওর জন্য একাকী অপেক্ষা করে আছে।নীলিমা বারংবার বলা সত্ত্বেও,অরণ্য নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে পারেনি।কিন্তু ও অবিবাহিত,নীলিমা ওর জীবনে থাকলো কি গেল,তাতে অরণ্য ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তির ক্ষতি হবে না।আর বারবার ওকে ফিরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও যদি অরণ্য ওর জেদ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে,সেক্ষেত্রে নীলিমার আর কিছু করার থাকে না।কিন্তু সৈকতের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।কোনোভাবে যদি সৈকত নীলিমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে,রমার সাজানো সংসারটা শেষ হয়ে যাবে।আর সৈকতের দু-চোখে নীলিমা নিজের জন্য অনেকটা শ্রদ্ধা দেখতে পায়,ভবিষ্যতেও ওই শ্রদ্ধার জায়গাটাই নীলিমা ধরে রাখতে চায়।কোনোমতেই চায় না,অপরিসীম শ্রদ্ধাটা ধীরে-ধীরে দুর্বলতায় পরিণত হোক,যেটা অরণ্যর ক্ষেত্রে হয়েছে...
রান্নাঘরে হাতের কাজগুলো সারতে-সারতে নিজের মনেই একটু হেসে উঠলো নীলিমা।রণ চলে যাওয়ার পর এই একটা বড় জ্বালা হয়েছে,বড় সহজেই আজকাল পুরুষের দৃষ্টি পড়তে পারে ও।আগে পারতো না।কিন্তু এখন পারে।কোন দৃষ্টিতে আবেগ,কোন দৃষ্টিতে ভালোবাসা,কোথায় শ্রদ্ধা,আর কোন দৃষ্টিতে ওর শরীরটা ছিঁড়ে খাবার আদিম লালসা কাজ করছে,আজকাল ভীষণ ভালোভাবে বুঝতে পারে নীলিমা।আগে হয়তো ওর হাতের শাঁখা-পলা আর সিঁথির সিঁদুর ওকে সবরকম দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতো।তখন হয়তো কোনো নির্দিষ্ট পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হতো ওকে।আজ সেইসব সধবার চিহ্নগুলো ওকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে বলে,হয়তো কিছু পুরুষের কাছে সহজলভ্য ও।আচ্ছা,এতটাই কি সহজ সবকিছু!!শরীর থেকে ওইটুকু আলগা প্রসাধন ঝেড়ে ফেললেই কি মনটাকে বদলে ফেলা যায়!অন্তত নীলিমা তো পারেনি।আজও ওর মনের সবটুকু জুড়ে কেবল রণজয়ই আছে...
হাতের কাজটুকু সেরে ঘরে এসে দাঁড়ালো নীলিমা।মশারিটা একটু তুলে দিয়ার কপালে হাত দিল ও,নাঃ!আর জ্বরটা আসেনি।কাল মেয়েটাকে স্কুলে পাঠানো যাবে।নীলিমাকেও তো কাল অফিস যেতেই হবে।মাসের শেষে পরপর দুদিন ছুটি করাই যাবে না।সামনেই পুজো,মাইনে-বোনাসের ব্যাপার আছে আবার।রান্নাঘরের কাজ সারতে-সারতে বেশ রাত হয়ে গেছে আজ।জলের কাজ করতে-করতে শাড়িটাও ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গেছে।শাড়িটা ছেড়ে রেখে বাথরুমে গা ধুতে ঢুকলো ও।সারাটা দিন যেমন-তেমন ভাবে কাটে।কিন্তু রাতে শোওয়ার আগে এই জলের কণাগুলো গায়ে পড়লেই যেন কাঁটার মতো বেঁধে ওর শরীরে।সারা শরীরের চরম অতৃপ্তি এসে গ্রাস করে ওকে।আর তখন বেঁধে রাখা যায় না নিজেকে।মনে হয় সারাটা রাত ওই জলের নীচেই দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয়।কার জন্য বিছানায় যাবে ও!!এক-একটা মাস যেন এক-একটা জন্মের সমান দীর্ঘ!আজ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না নীলিমা।সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় ভিজে শরীরেই ডুকরে কেঁদে উঠলো ও।রণ-র শরীরের পুরুষালী গন্ধটা যেন আজও ওকে চারপাশ থেকে আবৃত করে রেখেছে....
বেশ কিছুক্ষণ পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো নীলিমা।ভিজে চুলগুলো ওর পিঠের ওপর এলিয়ে পড়েছে।গায়ে একটা তোয়ালে জড়ানো,দুটো চোখ অনেকটা জল ঝরিয়ে রক্তাভ!সোজা এসে রণ-র ছবির সামনে দাঁড়ালো ও।পরম মমতায় একটা হাত রাখলো ওর মুখের ওপরে।সেই মুহূর্তেই নিজের উরুর দিকে দৃষ্টি নামাতে বাধ্য হলো নীলিমা।প্রতিমাসের কাঙ্খিত উষ্ণ রক্তস্রোত তখন ওর উরু বেয়ে নেমে আসছে...জীবনের আরও একটা দীর্ঘ মাস কাটলো।এভাবে আর কতগুলো মাস যে নিজের কামনার সঙ্গে লড়তে হবে,জানা নেই নীলিমার!শুধু জানে লড়াই-লড়াই...প্রতিটা দিনে বাঁচার লড়াই,দিয়াকে আরও একটু সুন্দর জীবন দেওয়ার লড়াই,আর প্রতিটা রাতে নিজের আদিম ইচ্ছের সঙ্গে লড়াই...
রণ চলে যাওয়ার পর এতগুলো বছর যখন ও পেরে গেছে,আর জীবনের বাকি দিনগুলোও ঠিক পেরে যাবে।চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা জলটুকু বাঁ হাত দিয়ে মুছে নিয়ে একটু হাসলো নীলিমা,তারপর নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসটা নিয়ে আবারও প্রবেশ করলো বাথরুমে...
-উফফ!তাড়াতাড়ি কর ঋক,ভাই কোথায়?
-ঘুমোচ্ছে!
-আমি আর পারি না রে তোদের নিয়ে।কাল কি করছিলি,কখন ঘুমিয়েছিস?
-ভাই কার্টুন দেখছিলো মা!
-হ্যাঁ,সেটা তো এখন তার ঘুমের বহর দেখেই বুঝতে পারছি!উদ্ধার করেছো আমায় তোমরা...এবার তাড়াতাড়ি ব্রাশটা করে খেয়ে আমায় মুক্তি দাও..
ঋক ঘুমচোখে দাঁতে ব্রাশ ঘষতে শুরু করলো...
সকালবেলা দুটো ছেলের সঙ্গে যেন যুদ্ধ করতে হয় রমাকে।বিশেষ করে ছোটটার সঙ্গে!বড়টা তাও যা একটু কথা শোনে,ছোটোটা তো লাটসাহেব!এত জেদ-বায়না-চিৎকার-চেঁচামেচি করে,পাগল হয়ে যায় রমা।কোনোরকমে দুটো ছেলেকে তৈরী করে গোবিন্দদার সঙ্গে বের করে দিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে সোফায় বসে রমা...তারপর হাঁক দেয়,
-ঝর্ণাদি,বাবাকে চা দিয়েছো?
-হ্যাঁ বৌমনি!
-আচ্ছা!আমার আর দাদার জন্য একটু চা বসাও!ছেলেদুটোর সঙ্গে চেঁচাতে-চেঁচাতে মাথা ধরে গেলো গো...
-আচ্ছা বৌমনি!
ট্রে-তে করে দু-কাপ চা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো রমা।তখনও উপুড় হয়ে ঘুমে বেহুঁশ হয়ে রয়েছে সৈকত।রমা একটু এগিয়ে এসে মাথা রাখলো সৈকতের খোলা পিঠে।ওর ভিজে চুলের আগাটা সৈকতের মুখের ওপর গিয়ে পড়লো।ঘুম ভেঙে গেলো সৈকতের।উঠে রমাকে জড়িয়ে ধরলো ও,
-কি মশাই,ঘুম ভাঙলো?
-সারারাত জাগিয়ে এখন সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে,ঘুম ভাঙলো কিনা!জড়ানো গলায় সৈকত বললো।
-উহ!সারারাত কে কাকে জাগিয়ে রেখেছে,খুব জানা আছে আমার...জংলী একটা...ওঠো,চা খাও...
চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে রমা নিজের চায়ে একবার চুমুক দিলো।তখনই রান্নাঘর থেকে ডাক দিলো ঝর্ণাদি,
-বৌমনি!আজ কি রান্না হবে?বড়দাদাবাবু বলে গেছে মাংস খাবে,আর ছোটদাদাবাবু ডিম!কি করবো?
-তোমার ছেলেদের বায়না সামলাতে-সামলাতে আমি শেষ গো!সৈকতের দিকে চেয়ে রমা বললো।
-হুম!ছেলেরা তো আমার একার!ছেলেদের খেয়াল রাখতে-রাখতে ছেলেদের বাবার দিকেই নজর নেই আর...মিথ্যে রাগ দেখিয়ে সৈকত বললো।
-তাই বুঝি!এগিয়ে এসে রমা সৈকতকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে একটা গভীর চুমু খেলো।সৈকতও চায়ের কাপ-টা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রমার কোমর!
-ও বৌমনি....
-আসছি ঝর্ণা দি...
সৈকত ছেড়ে দিলো রমাকে।তবে তার আগে ওর গালে আলতো করে একটু চুমু খেলো।চুমু খাবার সময় একটু দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো রমার ঘাড়ে!কিন্তু ততক্ষণে রমা সৈকতের হাত ছাড়িয়ে রান্নাঘরে ছুটেছে সংসারের ডাকে...
কাল রাতের পর থেকে একটা প্রচ্ছন্ন অপরাধবোধ কাজ করছিল সৈকতের মধ্যে।সেটা নিজের জায়গা থেকে সাময়িক সরে যাওয়ার জন্য কি!!রমাকে ছাড়া ও মরে যাবে,কিন্তু কাল রাতের পর নীলিমা দেবী বেশ অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে,এবার সৈকত বুঝতে পারছে না সেটা মনে না মস্তিষ্কে...সেই অপরাধবোধ থেকেই সৈকত কাল রাতে আদরে-আদরে ভরিয়ে দিয়েছে ওর রমাকে।রমার দুটো লক্ষীমন্ত পা ধরে চুমু খেতে-খেতে,আদর করতে-করতে অস্ফুটে বারংবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে রমার কাছে!রমার সঙ্গে-সঙ্গে নিজের কাছেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো সৈকত,এমন ভুল আর দ্বিতীয়বার করবে না ও!আসলে রমার পর ও আর এমন কোনো নারীর সম্মুখীন কখনও হয়নি,যে ওকে অবাক করতে পারে!নীলিমা দেবীর প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে সাময়িকভাবে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিল সৈকত...চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে টেবিলে রাখা রমার ছবিটা হাতে তুলে নিলো ও।তারপর গভীর ভালোবাসার সঙ্গে চুমু খেলো ছবিটায়...
দিনকয়েক পর....
সেদিন শনিবার হওয়ায় ঋক আর ঋদ্ধির একসঙ্গেই স্কুল ছুটি হয়েছে,নীলিমাও আজকাল প্রায়ই রমার সঙ্গে ফেরে।ওদের মধ্যে বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।কিন্তু স্কুল থেকে সেদিন কাঁদতে-কাঁদতে বেরোলো শারদীয়া।এগিয়ে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো নীলিমা,
-কি হয়েছে দিয়া?
কোনো উত্তর নেই।মেয়ে কেঁদেই যাচ্ছে!
-কিরে দিয়া?কি হয়েছে মা?ব্যস্ত হয়ে উঠলো রমাও...
-এই ঋদ্ধি,তুই আবার দিয়ার সঙ্গে মারামারি করেছিস?
-না মা,আমি তো টিফিন খেয়ে টয়লেটে গিয়েছিলাম,এসে দেখি ও ডেস্কে বসে কাঁদছে...আমি জিজ্ঞেস করলাম,কি হয়েছে!বললোই না...
দিয়া তখনও একটা হাত মুঠো করে রেখেছে,নীলিমা সেটা দেখে বললো,
-তোর হাতে কি রে দিয়া?
হাত খুলে দিয়া দেখালো,তাতে দুটো চকলেট রয়েছে।নীলিমা মাথা ঘামালো না বেশি,স্কুলে কারোর জন্মদিন হয়তো,ম্যাম দিয়েছে।কিন্তু মেয়েটার কি হয়েছে!অনেক কান্নাকাটির পর হেঁচকি তুলতে-তুলতে দিয়া যা বললো,তা কিছুটা এইরকম...
"স্কুলের সবার জন্মদিন হয়,ওর হয়না কেন!ওর মা ওকে খালি পায়েস করে দেয়,কিন্তু ওর জন্মদিনে কোনো ফ্রেন্ডও আসে না গিফ্ট নিয়ে,ঋদ্ধির জন্মদিনেও তো ও গিয়েছিলো,তবে ওর জন্মদিন কেন হবে না!"
নীলিমার বুকের ভিতরটা হু-হু করে উঠলো।আজ ওর আর্থিক অবস্থা এতটাও খারাপ নয় যে,ও দশটা বাচ্চাকে নিমন্ত্রণ করতে পারবে না!খুব ভালোভাবেই পারবে।কিন্তু ও মন থেকে আজও ঠিক মেনে নিতে পারে না!রণ-র চলে যাওয়ার দিনটায় ভীষণ ভেঙে পড়ে ও,সেইদিনে আবার এসব করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না ও...তাই প্রতিবার মেয়ের সামনে একটু পায়েস দিয়েই দায় সারে নীলিমা।কিন্তু আজ মেয়ের অভিমান দেখে নীলিমা বুঝলো,দিয়া এবার বড় হচ্ছে!এবার নিজের আবেগ-অনুভূতিকে লুকিয়ে ওর মতো করে,ওর মন জুগিয়ে বাঁচতে হবে নীলিমাকে....
রমা কিন্তু সবটুকু বুঝতে পারলো,ও শুধু নীলিমার পিঠে হাত রেখে বললো,
-চলো!ওঠো গাড়িতে!মন খারাপ কোরো না নীলিমা,ও তো অবুঝ বলো!ও কি আর অতশত বোঝে!ওর চোখে যা স্বাভাবিক,ও তাই বলেছে...
-হুম!
মুখে একথা বললেও গাড়িতে বসে দিয়ার গলায় ঝোলানো আই-ডি কার্ডটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো রমা।নীলিমা বলেছিলো বটে,পুজোর মধ্যেই ওর জন্ম হয়েছিলো।আগামীকাল পঞ্চমী,আজই স্কুল হয়ে ওদের পুজোর ছুটি পড়ে গেলো,দিয়ার গলার আই-কার্ড বলছে,পরশুদিনই ওর জন্মদিন!অর্থাৎ ষষ্ঠীর দিন।মৃদু হাসলো রমা।এ বছর জন্মদিনের দিন ও আর মেয়েটাকে কাঁদতে দেবে না,এমনকি নীলিমাকেও না...
ততক্ষণে আবার কান্নাকাটি ভুলে ঋক আর ঋদ্ধির সঙ্গে খেলায় মেতেছে শারদীয়া।সত্যি!কত তাড়াতাড়ি এরা দুঃখ ভুলে যায়!কষ্টও পায় ছোট-ছোট কারণে,আবার ঠিক তেমনিভাবে আনন্দও পায়,খুশিও হয় খুব অল্পতেই।একেই হয়তো বলে নিষ্পাপ শিশুমন...রমা এগিয়ে গিয়ে আদর করে দিয়ার গালটা টিপে দিলো একবার...
নীলিমা তখন গাড়ির বাইরের দিকে চেয়ে আছে অন্যমনস্কভাবে...
(চলবে...)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।
বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন