অনুসরণকারী

শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২২

সূর্যোদয়ের আগে (দশম পর্ব)




সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
দশম পর্ব



-ঝোরা!গতকাল দিদির সঙ্গে চূড়ান্ত অশান্তি করে বাবু মানে অরিত্র,বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।আজ সারাদিন ফোন ধরছিলো না।অনেক খোঁজ করে দুপুরের দিকে ওকে একটা বন্ধুর বাড়িতে পাওয়া গেছে।এখন কিছুতেই বাড়িতে ঢুকবে না।যতক্ষণ না...
-যতক্ষণ না?
-আমার দিদি তোমাদের বাড়িতে এসে,তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে তোমার দাদা-বৌদির সঙ্গে কথা বলছে!তোমায় একটা কথা বলছি ঝোরা,তুমি বুদ্ধিমান মেয়ে,স্বাবলম্বী!খুব বেশী কিছু বোঝাতে হবে না তোমায়।তুমি নিশ্চয়ই মানুষ চেনো!অভিভাবকদের অমতে তাদের বাড়িতে ঢুকে তুমি ভালো থাকতে পারবে না ঝোরা!বিয়েটা শুধুমাত্র দুজনের নয়,একটা গোটা পরিবারের সঙ্গে আর একটা পরিবারের।তাই দু-পক্ষেরই মত থাকাটাও প্রয়োজন।আজ যদি ছেলের চূড়ান্ত জেদের কাছে হার মেনে আমার দিদি তোমায় মেনেও নেয়,আমি কিন্তু ওকে খুব ভালো করে চিনি ঝোরা,ও তোমায় ওই বাড়িতে টিকতে দেবে না...তাই বলছিলাম কি...ছেলেটাকে একটু বুঝিয়ে যদি তোমরা নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা মিটিয়ে...
ঝোরা বুঝতে পারলো,বাড়িতে ঝামেলা করে বেরিয়ে অরি সোজা ওর এখানেই এসেছিলো,দাদার সঙ্গে কথা বলতে।একটু হেসে ঝোরা ওনাকে জিজ্ঞেস করলো,
-আপনাকে এটা কে বললো,যে আমরা বিয়ে করবো?
বলেই ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো ঝোরা।এতক্ষণ ওর বুকের ভিতরটা একটা অজানা ভয়ে কাঁপছিলো।কিছুদিন আগেই অরি বলেছিলো,"তুই রাখ ফোন।আমি সুইসাইড করবো!আর ফোন করেও পাবি না..." তারপর কাল রাতে ঝোরা ফোন করে ওকে সাংঘাতিক ঝেড়েছে।আজ এনাদের এইখানে এমন উদভ্রান্তের মতো দেখে,ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ও নিজেই।যাক বাবা,ছেলেটা বাড়ি ছেড়েছে,পৃথিবী তো ছাড়েনি!এবার ও সামলে নেবে!!এতক্ষণে সবটুকু দুশ্চিন্তা সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে,নিজের আগের মেজাজে ফিরে এলো ও...
সামনে বসে থাকা মহিলাটি এতটাই অবাক হয়ে গেছেন,যে কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা বলতে পারলেন না।সেটা ওর সিগারেট ধরানোর জন্য,নাকি সপাটে বিয়ের ব্যাপারে ব্যঙ্গ করে ওঠার জন্য,ঝোরা ঠিক বুঝতে পারলো না।তবে উনি কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
-তবে যে বাবু তোমাকেই বিয়ে করবে বলে...
-সেটা আপনার বাবুকেই বোঝান গিয়ে।নিজের ছেলেকে সামলে রাখুন!তার ইচ্ছে হয়েছে বলে,যার-তার গলায় মালা দেবো বললেই তো আর,উল্টোদিকের মানুষটা নেচে-নেচে রাজি হয়ে যাবে না!!আপনিই তো এক্ষুণি বললেন,বিয়ের জন্য দু-পক্ষের রাজি হওয়া প্রয়োজন।আরে দু-পক্ষ ছাড়ুন তো,মেয়ে নিজেই রাজি না...এই আপনি চা খান?
-না...মানে... হ্যাঁ!!
-আরে,এত চাপ নেবেন না!আমি এখন আপনাকে চা অফার করছি না,করবোও না!!আমার পয়সা অত সস্তা নয়।আপনি চা খান কিনা জিজ্ঞেস করছি জাস্ট!খান তো?
-হ্যাঁ!!
-ব্যাস!!তবে আর কি!বাড়ি যান!মাথা ঠান্ডা করুন।আগে আপনার ওই দিদির মুখে সেলোটেপ লাগান,দরকার হলে হাত-পা বেঁধে বাড়িতে ফেলে রাখুন।এইরকমভাবে খোলা রাস্তাঘাটে মানুষকে খিস্তি মারলে,যেকোনো দিন মার খেয়ে যাবে কিন্তু!মনে রাখবেন,আগ বাড়িয়ে চড় মারতে গেলে,গাল বাড়িয়ে চড়টাও কিন্তু হজম করতে হবে!আজ প্রথম দিন,তাই আমি ছেড়ে দিলাম।নইলে এই ঝোরা কি জিনিস,সেটা আপনাদের ওই বাবুর থেকেই খোঁজ নিয়ে নেবেন।একদম ডিটেলস দিয়ে দেবে...এখন বাড়ি যাওয়ার সময় রাস্তায় প্রথম যে মন্দির পড়বে,সেই মন্দিরের ভগবানকে শুয়ে পড়ে একটা প্রণাম করে যাবেন,আর ধন্যবাদ বলবেন,যে ঝোরা আপনাদের বাড়ির বউ হচ্ছে না।নইলে সালা দুদিনে এইসব শাশুড়িকে সিধে করে দিতাম!এত মুখ নাড়া বেরিয়ে যেতো।মুখ খোলার আগেও আমার অনুমতি নিতো!বৌমা,আমি কি তোমায় এটা বলতে পারি!?সবাইকে নিজের স্বামী-ছেলে মনে করেছে নাকি!!কে ওনার পয়সায় খায়-পরে?ওনার ছেলে ধোয়া তুলসী-পাতা?নাকি কচি খোকা?!এরপর মুখ নাড়তে এলে...
-ঝোরা...
-এই যান-যান!চা খান বললেন তো!!বাড়ি গিয়ে হালকা করে সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খেয়ে,মোটা করে দুধ দিয়ে চা খান!বেশ একটা আমেজ-আমেজ লাগবে!আরে মাসিমা,বয়স হচ্ছে তো!!কি করছেন,ওই দিদির কথায় বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মধ্যে নাক গলিয়ে...
-দাঁড়াও!তুমি বললে তোমরা বিয়ে করবে না...বাবু জানে এটা?
-অনেককাল ধরেই জানে!প্রথম দিন থেকেই জানে!
-আচ্ছা!এবার আমি তোমায় একটা অনুরোধ করবো ঝোরা?
-না রাখলেই তো আমায় গাল দিতে-দিতে বাড়ি যাবেন!খিস্তি দিয়ে আমার চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে দেবেন!
-নানা!প্লিজ!এভাবে বোলো না!
-বলুন!কি অনুরোধ?
-ছেলেটা একরকম পাগল হয়ে গেছে!বাড়িতে সাংঘাতিক অশান্তি করছে।দেখো ঝোরা,আমার দিদি মানুষ যেরকমই হোক না কেন,ওই স্বামী-সন্তান ছাড়া আর কিচ্ছু বোঝে না গো।তাই সবকিছু থেকে ওই দুজনকে আগলে-আগলে রাখতে চায়!তোমরা যদি বিয়ে করতে,সেখানে আমার বেশি কিছু বলার থাকতো না।কারণ,দুজন ছেলেমেয়ের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে আজকাল আর বাবা-মায়ের কথাই সেভাবে চলে না,আর আমি তো মাসি!!তাই কোনোভাবেই আমার কথা চলে না।কিন্তু তোমরা যখন বিয়ে করবেই না,তখন কি ছেলেটাকে কোনোভাবে ঘরে ফিরিয়ে আনা যায়?মানে তুমি যদি একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে...দেখো,দিদি-আমি বা আমরা কিছু বলতে গেলে ও ভাবছে,আমরা তোমায় মানছি না,তাই ওকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইছি!আরও চরম অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।কিন্তু তুমি যদি ওকে একটু বুঝিয়ে বলো,তাহলে ব্যাপারটা অনেকটা সহজ হয়ে যায় ঝোরা।সেক্ষেত্রে ঘরের অশান্তির আর কোনো জায়গাই থাকে না!!
-আমি কি আপনাদের ছেলের ঠেকা নিয়ে রেখেছি?ও তো মাথামোটা!একটা কথা একবারে মাথায় ঢোকে না!!সে জন্য আমি কি এখন রাজ্যের কাজকম্ম ছেড়ে,ওকে বোঝাতে ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মাঠে নামবো?!আমার দ্বারা ওসব হবে না!আপনি এখন আসুন!দু-মিনিট সময় চেয়েছিলেন না?আপনার দু-মিনিট পেরিয়ে দশ মিনিট হয়ে গেছে...সিগারেটটা পার্কের সবুজ ঘাসের ওপর ফেলে পা দিয়ে চেপে ধরলো ঝোরা...তারপর উঠে দাঁড়ালো...
-প্লিজ ঝোরা!!আমি জানিনা তোমাদের মধ্যে ঠিক কি ধরনের সম্পর্ক ছিলো!কি বোঝাপড়া ছিলো!কিন্তু তোমার সঙ্গে ছেলেটার বেশ অনেকদিনের পরিচয় তো ছিলো...তোমার কারণে সেই ছেলেটা আজ বাড়িছাড়া!!একমাত্র ছেলে কি খাচ্ছে-কিভাবে থাকছে!ও তো মা!চিন্তা তো হয় বলো!মানছি,ও তোমাকে যা বলেছে,যেভাবে অপমান করেছে,একদম উচিত হয়নি করা,কিন্তু তবুও বাবুর জন্য না হোক,বাবুর মায়ের জন্য,আমার দিদির জন্য ওকে একবার ঘরে ফিরিয়ে দাও!তুমি অন্তত প্রমাণ করে দাও,তোমার সম্পর্কে আমার দিদির যা ধারণা,তা সম্পূর্ণ ভুল!তুমিই পারবে ঝোরা...আমরা তো পারছি না...কিছু বলতে গেলেই অশান্তি চরমে পৌঁছে যাচ্ছে...বাবু চিৎকার-চেঁচামেচি করে...
চুপ করে বসেছিলো ঝোরা।কপালে চিন্তার ভাঁজ...এবার মুখ খুললো ও...
-আপনি বাড়ি যান!আমি দেখছি!
-তুমি...
-বললাম তো দেখছি!যান তো...
-বেশ!!
সেই মহিলা উঠে ধীরে-ধীরে এগোতে যাচ্ছিলো গেটের দিকে,ঝোরা আবার পিছন থেকে ডাকলো,
-শুনুন!
-বলো?
-আজ রাতটা আমায় সময় দিন।অরির সঙ্গে আমার অনেকদিন যোগাযোগ নেই তো,তাই ঠিক জানা নেই।ওর এখন অফিসের টাইমিং কি?
-নাইট শিফট চলছে...
-হুম!এখন সাড়ে সাতটা বাজতে যায়।মানে কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসে ঢুকবে।তাই তো?
-হ্যাঁ!তাই তো উচিত!
-ঠিক আছে!আজকের রাতটা আমি আপনার কাছ থেকে চেয়ে নিলাম।কথা দিচ্ছি,কাল সকালে অরি বন্ধুর বাড়ি না গিয়ে,অফিস থেকে সোজা বাড়িই যাবে।আর...আর আজকের পর থেকে আপনাদের ছেলে আমার দিকে ফিরেও চাইবে না।এমনকি রাস্তায় সামনাসামনি দেখা হলেও,আমার মুখে থুতু ছিটিয়ে যাবে!যান এবার!
-তুমি কি করবে ঝোরা?এসবের কোনো...
-আপনাদের ছেলেকে ঘরে ফেরত চাই তো?পেয়ে যাবেন!আদার ব্যাপারী তো আপনারা,নিজেরটুকুই বুঝে নিন না বাবা,অত জাহাজের খবর দিয়ে কি করবেন!আসুন তো...রাস্তা ওইদিকে...যান-যান!চা-মুড়ি খেয়ে জমিয়ে বসে ভালো পাত্রী দেখুন।ছেলের বিয়ে দিতে হবে তো...যান!!
মাথা নীচু করে ঝোরার সামনে থেকে চলে গেলেন অরিত্রর মাসিমনি...
ঝোরা একবার মাত্র ঘড়ির দিকে চাইলো।তারপর ফোন বের করে ফোন করলো বৌদিকে,
-কোথায় তুমি?
-অফিসের পর একটু বাপেরবাড়িতে এলাম।কেন রে?
-দাদা কি তোমার সঙ্গে?
-হ্যাঁ!
-ঠিক আছে!আমার একটা বন্ধুর একটা ছোটখাটো একসিডেন্ট হয়েছে বৌদি,নাথিং সিরিয়াস!ওকে নিয়ে একটু হসপিটালে যাচ্ছি।আমার ফিরতে একটু রাত হবে,প্লিজ দাদাকে একটু সামলে নিও..
-আচ্ছা ঠিক আছে।খুব বেশি রাত করিস না বাবু।জানিসই তো,কাল থেকেই সৌম্য কিরকম খেপে আছে!
-জানি বৌদি!ওই জন্যই তো তোমায় ফোন করে জানালাম।আমি তাড়াতাড়িই চলে আসার চেষ্টা করবো।রাখছি,কেমন!
-আচ্ছা!রাখ!!
ফোনটা রেখেই একদৌড়ে স্কুটিতে গিয়ে উঠলো ঝোরা।গেট থেকে বেরোনোর মুখে আবার থামলো ও।নিজের ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করলো,
-রাজু দা শোনো?
-কি দিদিমণি?
-একটু আগে যেটা হলো,সেটা যেন আমার দাদা-বৌদির কানে না যায়,বুঝলে?যদি আমার আসতে অনেকটা দেরি হয়,আর ওরা আমার ব্যাপারে তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করে,বলবে,আমি অফিস থেকে সময়মতোই এসেছিলাম,কিন্তু একটা বন্ধুর এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে আবার তখনই বেরিয়ে গেছি।প্লিজ,রাজু দা!আর এটা রাখো,চা খেয়ো!কেমন?
-ঠিক আছে দিদিমণি!!আপনার কোনো চিন্তা নেই!
একটু হেসে টাকাটা পকেটে ঢোকালো রাজেশ...
-থ্যাঙ্কু!!আমি এলাম!আর কিছু জিজ্ঞেস করলে তবেই বলবে...আগে বাড়িয়ে মুখস্ত বলার দরকার নেই!বুঝলে?
-হ্যাঁ-হ্যাঁ!!
হেসে ফেললো রাজেশ....
ঝোরা দ্রুতগতিতে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে গেলো...
রামধনু এপার্টমেন্ট ছেড়ে কিছুটা দূরে এসে রাস্তার একপাশে স্কুটি থামালো ঝোরা।উত্তেজনায় ও একটু কাঁপছে।ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করলো তাতে।তারপর ফোন বের করে পৌঁছে গেলো সোজা ব্লকলিস্টে।দ্রুতগতিতে বেশ কয়েকটা নাম পেরিয়ে,একটা নির্দিষ্ট নামে এসে ওর আঙুল থেমে গেলো।কয়েক মুহূর্ত ভেবে আনব্লক করলো নম্বরটা।তারপর কাঁপা-কাঁপা হাতে সেই নম্বরে ফোন করলো...কয়েক মুহূর্ত রিং হওয়ার পর সে ফোনটা ধরলো,কিন্তু সে আর কথা বলে না।চুপ করে আছে ঝোরাও।তারপর ঝোরাই আগে কথা শুরু করলো,
-হাই সিড!
ওদিক থেকে কোনো উত্তর নেই।
-সিড,ওকে সরি!!সরি ফর এভরিথিং!চলো,আমিই সরি বলছি...একটু তো কথা বলো!আই নিড ইয়োর হেল্প!
-সিড নয়,রুবি বলছি!!
থরথর করে কেঁপে উঠলো ঝোরা।
-ম্যাম আপনি?আই এম সো সরি!আমার একটু স্যারের সঙ্গে...
-স্যার নয়,বলো সিডের সঙ্গে!এতক্ষণ তো সিড বলেছিলে...
চুপ করে রইলো ঝোরা।
-ম্যাম,ওনাকে একটু ফোনটা দেওয়া যাবে?প্লিজ!!
-যা বলার আমাকেই বলো,সিড আর রুবি আলাদা নয়।ওকে জানানোর হলে আমিই জানাবো,নইলে জানাবো না।এতদিন পর হঠাৎ কি প্রয়োজন?ওর সঙ্গে কি দরকার তোমার?
-ম্যাম প্লিজ,ওনাকে একটু...
-বলতে হলে বলো ঝোরা,নইলে রাখছি...
-ওকে-ওকে,বলছি!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে রুবির মুখে "ঝোরা" নামটা শুনেই দমবন্ধ হয়ে আসছিলো সিদ্ধার্থর।রুবির কাছ থেকে ফোন নিয়ে ঝোরার সঙ্গে কথা বলার মতো ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই ওর নেই।স্থির হয়ে ও দাঁড়িয়ে রইলো বাথরুমের সামনেই...
সিদ্ধার্থ আচার্য!ঝোরার পূর্ববর্তী কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের মধ্যে একজন।বিবাহিত,রুবি ওনারই স্ত্রী।ঝোরা এই সিদ্ধার্থর কারণেই আগের চাকরিটা ছেড়ে দিলেও,বর্তমানে অরিত্র ওই কোম্পানিতেই কর্মরত।প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেছে,ঝোরার সঙ্গে সিডের আর কোনো যোগাযোগ নেই।সিদ্ধার্থ আর রুবি একে অপরের সঙ্গে কোনোদিনই সুখী ছিলো না।বিয়ের পর থেকেই দাম্পত্য-কলহ বাড়তে-বাড়তে একটা সময় পর চরমসীমা অতিক্রম করে যায়।সিদ্ধার্থ বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করে।ঠিক সেই সময়ই পাহাড়ী ঝর্ণার মতো ঝোরা সিডের জীবনে আসে।ঝোরাকে ধরে রাখার জন্যই মিথ্যে বলেছিলো সিড।ও বলেছিলো,যে ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।কিন্তু রুবি ওকে তখনও কিছুতেই ছাড়ছিলো না।আর সিড সেই মুহূর্তে ঝোরাকেও হাতছাড়া করতে চায়নি।তাই মিথ্যেই বলেছিলো ও।কিন্তু মাস দুয়েকের মধ্যেই ঝোরা রুবির ব্যাপারটা জানতে পেরে যায়,তখনই সিডকে ছেড়ে,এমনকি চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে বেরিয়ে যায়।আজ এতদিন পর ঝোরার নামটা শুনে,তাও আবার রুবির মুখে...যারপরনাই চমকে উঠলো সিদ্ধার্থ।ওর হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।ঝোরা বুঝি একনাগাড়ে কিছু বলেই যাচ্ছে,কারণ রুবির দিকে থেকে কোনো সাড়া নেই।ও শুধু শুনে যাচ্ছে।সেই মুহূর্তেই ফোনটা কানে ধরে সিদ্ধার্থর দিকে ঘুরে দাঁড়ালো রুবি...
তারপর একভাবে ওর দিকে চেয়ে বললো,
-দাঁড়াও!সিডকে দিচ্ছি!
-থ্যাঙ্কু ম্যাম!!
রুবি ফোনটা সিডের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে...
-ঝোরা?
-সিড!ভালো আছো?
-তুমি ভালো আছো?কি হয়েছে?এতদিন পর হঠাৎ...
-আই নিড ইয়োর হেল্প সিড!প্লিজ,না বোলো না...
-কি হয়েছে ঝোরা?
-আমি যাবো তোমার সঙ্গে!
-বাচ্চাদের মতো বিহেভ কোরো না রুবি!
অফিস বেরোনোর জন্য সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে বাঁ-হাতে ঘড়িটা পরছিলো সিদ্ধার্থ।রুবি এসে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো,
-না,আমি যাবোই...প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ!!তুমি ঝোরার কাছে যাচ্ছ,আমি তোমার বউ হয়ে সব জেনেশুনেও তোমায় ছাড়ছি সিড,কিভাবে পারছি,আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে,তুমি বুঝতে পারছো না?প্লিজ সিড!!আমিও যাবো...
-রুবি,প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!ইটস ওভার রুবি!সবকিছুই তো শেষ হয়ে গেছে।আমাদের সাংসারিক অশান্তি-আমাদের ভুল বোঝাবুঝি,ঝোরার সঙ্গে আমার সম্পর্ক....সব শেষ রুবি!কোত্থাও তো আর কিচ্ছু নেই।আমরা দুজন তো আবার নতুন করে শুরু করেছি।আমাদের দুজনের মধ্যে ঝোরা আজ আর কোত্থাও নেই।এত ইনসিকিওর কেন তুমি?
-আমি তোমাকে আর হারাতে পারবো না!
-তুমি আমায় তখন হারাবে,যখন আমি নিজেকে হারাবো!তার তো আজ আর কোনো প্রশ্নই নেই।আমি জীবনের একটা ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম,তোমার সঙ্গে ঝামেলা চলছিলো,জীবনের প্রতি সাংঘাতিক ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলাম,সেই সময় ঝোরা আমার জীবনে এসেছিলো।আমি ওকেই জড়িয়ে সেই মুহূর্তে বেরোতে চেয়েছিলাম রুবি।কিন্তু ও চায়নি।তোমাকে সরিয়ে ও আমার অবলম্বন হতে চায়নি।সরে গেছে।আমিও আর ওর পিছনে সময় নষ্ট করিনি...কেউ থাকতে না চাইলে কি,তাকে জোর করে ধরে রাখা যায়!আজ এতদিন পর ওর যখন আমাকে প্রয়োজন,আমি যাবো না!!ফিরিয়ে দেবো ওকে?
-আমি তো তোমায় যেতে বারণ করছি না সিড!কিন্তু আমার ভয় করছে খুব!
-দেখি!!এইদিকে এসো!!
রুবির দু-চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দিলো সিদ্ধার্থ।ওকে জড়িয়ে ধরলো নিজের বুকের মধ্যে...রুবি সিদ্ধার্থর বুকের মধ্যে মিশতে-মিশতে বললো,
-তবুও আমি যাবো।চাকরি ছেড়ে দিয়েছি বলে কি,আর যেতে নেই!আমি যাবো!
হেসে ফেললো সিদ্ধার্থ।
-কি করবে গিয়ে?আমায় পাহারা দেবে?আমি সত্যিই বাইরে কিছু করতে চাইলে,তুমি আমায় এভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে রুবি?একটু বিশ্বাস রাখো আমার ওপর...এভাবে সঙ্গে থেকে শরীরকে ঠেকিয়ে রাখা যায়,মনকে যায় না।আমি সত্যিই চাইলে,তুমি আটকাতে পারবে না...
-হয়তো পারবো না!তবু...
-আমি তোমারই রুবি...
-তবু আমি যাবো...
-আচ্ছা বেশ,চলো!দুজনকে একসঙ্গে দেখলে,ঝোরা আবার না ঘাবড়ে যায়!
-তবু যাবো!!
রুবির ছেলেমানুষিতে না হেসে পারলো না সিদ্ধার্থ।হয়তো এই সময়টা এইরকমই হয়।ছোট-ছোট কারণে মেয়েরা এইরকম জেদ করে বসে...রুবির পেটে একটা হাত রেখে সিদ্ধার্থ আদর করে বললো,
-বললাম তো চলো,তৈরী হও...আচ্ছা,ঝোরা চলে গেলে,তখন তুমি কি করবে?আমি তো আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবো...
-তখন সবার সঙ্গে দেখা করে,তোমায় একটু চুমু খেয়ে বাড়ি চলে আসবো!
-আচ্ছা-আচ্ছা!চলো!
হেসে রুবিকে আদর করে জড়িয়ে ধরলো সিদ্ধার্থ...
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো সিড আর রুবি।সামনের সরু সোফাটায় ঝোরা চুপ করে বসেছিলো।ওদের ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো।ঝোরাকে দেখেই চমকে উঠলো ওরা দুজনেই...সিড তো বলেই ফেললো,
-একই!!তোমার চুল?
-নেই!
-কেন?
-এমনিই!হ্যালো ম্যাম!
-হাই ঝোরা!
-থ্যাঙ্কু ম্যাম!!
-হুম!
সিড এর মধ্যেই চোরা-দৃষ্টিতে বেশ কয়েকবার ঝোরাকে দেখে নিয়েছে।আমূল পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার মধ্যে।আগের মতো সাজ নেই,আগের মতো শরীর-খোলা পোশাক নেই।এমনকি অত সুন্দর চুলটা পর্যন্ত কেটে ফেলেছে!!ভীষণ অবাক হলেও রুবির সামনে আর সেসব নিয়ে কথা বলতে পারলো না সিদ্ধার্থ।নিজের চেয়ারে বসে মাথা নামিয়ে শুধু এটুকুই বললো,
-অরিত্র তো বাইরে এসে গেছে দেখলাম!!
-এসে গেছে?
আসন্ন পরীক্ষার জন্য তৈরী হলো ঝোরা।
-হুম!আমি ঢোকার সময়ই দেখলাম।তুমি কতক্ষণ এসেছো?
-অনেকক্ষণ!!
-ওই জন্যই দেখতে পাওনি।একটু আগেই এসেছে বোধহয়।ডাকবো ভিতরে?
-হুম!মানে...
রুবির দিকে চাইলো ঝোরা...
-সিড,আমি বাইরে আছি।সবার সঙ্গে একটু দেখা করে যাই।এতদিন পর এলাম!!
-ওকে!!যাও!সাবধানে যাও।সিঁড়িতে উঠবে না।লিফট নেবে...
-হুম...
একটু হেসে একবার ঝোরার দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেলো রুবি...
এবার সোজাসুজি ঝোরার দিকে চাইলো সিদ্ধার্থ...
-তোমার কি হয়েছে ঝোরা?
-কই?কিছু নাতো!
মাথা নামিয়ে বসে রয়েছে ঝোরা...
-এমনভাবে রয়েছো কেন?সেই পরিপাটি সাজ নেই!চুলটা এভাবে কাটালে কেন?
-আমায় দেখতে খুব খারাপ লাগছে,তাই না সিড?
-না,তা নয়!কিন্তু তোমাকে এইভাবে দেখতে তো,আমি অভ্যস্ত নই।এত ম্লান!!
-সত্যি কথা বললে,তুমি কি বিশ্বাস করবে সিড?
সিদ্ধার্থ উঠে পড়লো নিজের চেয়ার থেকে।সোফায় ঝোরার পাশে এসে বসলো,
-বলো!
-আমি না এখন,সত্যিই ভালো আছি গো!আজ বহুদিন পর আবার এই অফিস-পাড়ায় এলাম।খুব ভালো লাগছে।যদিও চেনা মুখগুলো সংখ্যায় কম,অনেক নতুন মুখ দেখলাম বাইরে।তোমার এখানে যখন ঢুকেছিলাম,পুরোনো সবাই আমার দিকে কেমনভাবে যেন চেয়েছিলো....আমি কি তোমার কাছে আসতে পারি না সিড?
-অবশ্যই আসতে পারো!
-তোমার বউ এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়েছে?সবার সঙ্গে দেখা করে আসবে বললো।তোমায় পাহারা দিতে সঙ্গে এসেছে,তাই না!!
মৃদু হাসলো ঝোরা।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সিড।তারপর বললো,
-কয়েক মাস আগেই রুবি কাজটা ছাড়লো ঝোরা।ডাক্তার বলেছে!
-ডাক্তার!!ডাক্তার কেন?কি হয়েছে ওর?
-সি ইজ এক্সপেকটিং!
-ওহ!ওয়াও!!কনগ্রাচুলেসনস সিড!
-হুম,থ্যাঙ্কু!!
-একদম আর্লিয়ার স্টেজ বোধহয়...
-হুম!আগেরটা নেই!কিছু কমপ্লিকেশনে এবর্ট করতে হয়েছে।এখন দেখি খুব আপসেট থাকে।কারণে-অকারণে অহেতুক জেদ করে,রাগ করে,চেঁচামেচি করে,ভয় পায়!!আমাকে পাগলের মতো আঁকড়ে ধরতে চায়।আজ আমি বেরোনোর আগে এমন করছিলো,সঙ্গে না এনে পারলাম না ঝোরা।সরি!
-না-না!সরি কেন বলছো?তোমরা ভালো আছো,এটাই তো অনেক সিড!
-এটাই তো তুমি চেয়েছিলে ঝোরা!সেই জন্যই তো ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিলে সেইদিন।
-তুমি আমায় মিথ্যে বলেছিলে।তোমাদের ডিভোর্স হয়নি।তার আগেই তুমি নিজেকে ডিভোর্সি বলেছিলে।রুবিও শেষের দিকে কোম্পানিতে জয়েন করলো।আগে আমি জানতামও না,ও তোমার বউ...নইলে আমি কখনোই...
-ছাড়ো ওসব কথা!যা হয়ে গেছে,তা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।নিজের যত্ন নিও!তোমায় ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে।এত বিবর্ণ তোমায় মানায় না...
-বিশ্বাস করো সিড,আমি কিন্তু সত্যিই ভালো আছি!এটাই তো সমস্যা গো!সেজেগুজে যখন চোখের কোলের গভীর কালি ঢাকতাম,মুখের খামতিটুকু ঢাকতাম,শেপওয়্যারে শরীরের বাড়তি উত্থান-পতনটুকু ঢাকতাম,একদম নিখুঁত-সুন্দর পরিপাটি হয়ে থাকতাম,তখন তুমি বা তোমরা মনে করতে,আমি খুব ভালো আছি।ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক তার উল্টো সিড!আমি এখন ভীষণ ভালো আছি!এখন আমার আর নিজেকে মেক-আপের আড়ালে লুকোতে ইচ্ছে করে না!!থাক না,মুখের ব্রণর হালকা দাগ,বলিরেখা,গর্ত,অগোছালো ভ্রু!সব থাক!!আমি অগোছালোই ভালো।আর নিজেকে দোকানের মতো সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না!
উত্তেজনায় মৃদু কাঁপতে লাগলো ঝোরা।সিড একটু এগিয়ে এসে ওর হাতে একটা হাত রাখলো...
-সত্যিই এই দিকটা ভেবে দেখিনি ঝোরা।আসলে ভীষণ চোখে লাগছিলো।ঠিকই তো!!ওপরের ভালো লাগাটাকে ভালো থাকা বলে না।তুমি যে মন থেকে ভালো আছো,এতেই আমি খুশি!
-হুম!!
একটু হেসে সিদ্ধার্থর হাতের ওপর ঝোরা একটা হাত রাখলো।
-আর অরিত্রর কেসটা কি?এই কি তোমার ভালো থাকার কারণ?
-বাল!এ আমার মাথা ব্যথার কারণ!এখন দূর করতে পারলে বাঁচি!ভেবেছিলাম ছেলে আপডেটেড!আল্ট্রা-মডার্ন!চলো,এর সঙ্গে কিছুদিন অন্তত থাকা যাবে!এ তো দেখছি,এবার পিছনেই পড়ে গেছে...বিরক্তিকর!!এর বাড়ির লোক পর্যন্ত আমার ফ্ল্যাটে চলে গেছে।ভাবতে পারছো সিড?
-হোয়াট!!
-ইয়েস!আরে ভাই,ইফ আই স্লেপ্ট উইথ হিম,হি টু স্লেপ্ট উইথ মি!!ওদের ছেলেকে তো আমি জোর করিনি!!কি আর বলবো তোমায়!যেহেতু তোমার অফিসেই আছে,আর তোমার সঙ্গে আমার মানে...মানে...
-বুঝেছি!তাই তুমি এখন আমাকে ব্যবহার করবে ওকে সরানোর জন্য!
চুপ করে গেলো ঝোরা।
-সিড সরি!
-না,ঠিক আছে।তবে পিছন যখন ছাড়ছেই না,বিয়েটা করেই নাও!ভালো-টালো বাসে হয়তো...
-নাঃ!আমি ম্যারেজ-মেটিরিয়াল নই!তুমিও জানো সেটা!আর ওকে ঠিক সরাবো না সিড!ওকে জোর করে সরালে,ও ভীষণ কষ্ট পাবে।আর কষ্ট পেলে,ওই জ্বালা থেকেই আমায় মনে রাখবে।পরবর্তীকালে বিয়ের পরও সুখী হতে পারবে না।তাই ওর মন থেকে আমি নিজেই নিজেকে শিকড় সমেত সরাবো,একেবারে উপড়ে ফেলবো নিজেকে।
-মানে?
-মানে!!মানে ওর চোখে আমাকে আজ অনেকটা নামতে হবে সিড!আর সেটা তোমার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েই...জানি তোমার ভালো লাগবে না।তবু তুমি একটু মুখটা বন্ধ রেখো প্লিজ...
-কি করবে বলো তো তুমি?
-অরিকে ডাকো সিড!
-ওকে!
ঝোরার হাত ছেড়ে উঠে গিয়ে টেবিলের ওপর রাখা ফোনটা তুলে কানে ধরলো সিদ্ধার্থ।ঝোরা ধীরে-ধীরে উঠে এসে বসলো সিদ্ধার্থর চেয়ারটায়...দুটো পা তুলে দিলো টেবিলের ওপর...
-বসতে পারি তো?নাকি আবার তোমার পারমিশন নিতে হবে?
ফোনটা রেখে হেসে উঠে ঝোরার ছোট-ছোট চুলগুলো হাত দিয়ে ঘেঁটে এলোমেলো করে দিলো সিদ্ধার্থ।তারপর বললো,
-কি মনে হয়?
হেসে ফেললো ঝোরাও...
তারপর ব্যাগ থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো,আর একটা এগিয়ে দিলো সিদ্ধার্থর দিকে...
সিদ্ধার্থ কাঁচের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে জানলাটা একটু ফাঁকা করে দিলো।তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো,
-দেখি তুমি কি করো!আমি তো বসে-বসে মজা নেবো, আর মনে-মনে হাসবো!!
-হ্যাঁ!সেটা যেন মনে-মনেই হয়।দাঁত যেন বাইরে বেরিয়ে না পড়ে।
এবার বেশ জোরেই হেসে উঠলো সিদ্ধার্থ...
-স্যার!!মে আই...
মাঝপথেই কথা বন্ধ হয়ে গেলো অরিত্রর...
-ইয়েস!ইউ মে!
অরিত্র একভাবে চেয়ে রইলো ঝোরার দিকে।স্যারের টেবিলে পায়ের ওপর পা তুলে ঝোরা বসে রয়েছে।আগে ঝোরা অফিস ছাড়ার পর,ওর অফিস ছাড়ার কারণ সম্পর্কে অনেকের মুখেই অনেকরকম কথা শুনেছিলো অরিত্র।ও কানেও তোলেনি সেসব কথা!কিন্তু আজ এই প্রথমবার ও একটু ধাক্কা খেলো ঝোরার শরীরী বিভঙ্গে...
-হাই অরি!
-হাই!তুই এখানে?
গলা নামিয়ে অরিত্র বললো।
-এমনিই!একটু কাজে এসেছিলাম এইদিকে।তাই ভাবলাম,পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে একটু দেখা করেই যাই!
-ওকে!স্যার আমায় ডেকেছিলেন?
-হুম!বায়োমেট্রিক বলছে,টাইমলি অফিসে ইন করছো না!কি ব্যাপার?রোজ-রোজ এভাবে দেরি করলে...
-সরি স্যার!কাল থেকে আর হবে না!
-সিড!ছেড়ে দাও না,ছেলে হয়তো নতুন-নতুন প্রেম করছে,নতুন জীবন শুরু করছে,নতুন রাত জাগছে।এমনিতেই তুমি নাইট শিফটে আটকে রেখেছো,তার ওপর আবার তাড়াতাড়িও আসতে বলছো!কি যে করো না তুমি!!দেখছো না!ছেলেটার মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে!!
অপমানে বুকের ভিতরটা জ্বলতে শুরু করলো অরিত্রর...
-স্যার!এনিথিং এলস?
-নাথিং!
-ওকে!আমি আসছি!ঝোরা,বেরোবার আগে একবার দেখা করবি!
-কোন আনন্দে?তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার হলে,তোর নম্বর ব্লক করতাম নাকি?
অসহ্য জ্বালায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো অরিত্র।কিন্তু সিদ্ধার্থর দিকে এক নজর দৃষ্টিপাত করেই,ও সামলে নিলো নিজেকে...একদম চুপ করে গেলো...
পা নামিয়ে ঝোরা উঠে এলো সিডের চেয়ার থেকে।একেবারে অরিত্রর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।ঘরের দুটো পুরুষ একইসঙ্গে শুনতে পাবে,সেইরকমভাবে বলে গেলো কয়েকটা মাত্র বাক্য,
-কি হলো অরি?কিছু বলতে যাচ্ছিলি তুই?থেমে গেলি কেন?আরে ডোন্ট ওয়ারি!!এখানে সবাই নিজেদের লোকই তো!এতটাই নিজেদের,এতটাই কাছের,যে তোর কোনো ধারণাই নেই।আমি বুঝিয়ে বলছি,ঠিক কতটা কাছের!ইউ নো হোয়াট অরি,আমায় আদর করার সময় আমার বুকের যে তিলটায় তুই পাগলের মতো চুমু খেতিস,সেটাই সিডের একটা সময় খুব পছন্দ ছিলো...তোর মত সিডও একই কাজ করতো...একদম একইরকমভাবে...ইনফ্যাক্ট তোর আদর করার সময়,তোকে দেখে তো আমার সিডের কথাই মনে পড়তো...
এটুকু বলেই মৃদু হেসে একেবারে চুপ করে গেলো ঝোরা।একটা আলপিন পড়লেও শোনা যাবে,এতটা নৈঃশব্দ পুরো ঘর জুড়ে।ঘরের দুটো পুরুষ আর একে-অপরের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পর্যন্ত পারলো না।এতক্ষণ বেশ হালকাভাবেই ব্যাপারটা নিয়েছিলো সিদ্ধার্থ,দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বেশ মজাই নিচ্ছিলো।কিন্তু ঝোরা যে দুম করে এইরকম একটা কিছু বলে বসবে,সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।লজ্জায় মুখটা জানলার দিকে ফিরিয়ে নিলো সিদ্ধার্থ,পিছন ঘুরে দাঁড়ালো...
রাগে-জ্বালায়-অপমানে অরিত্রর চোখ থেকে জল বেরিয়ে এলো।ও আর সিদ্ধার্থর মতামতের পরোয়া করলো না।হাত ধরে টানতে-টানতে ঝোরাকে ওই ঘরের বাইরে বের করে আনলো!সোজা নিয়ে ঢুকলো জেন্টস-টয়লেটে...
-সালা!কিছু বলি না বলে পেয়ে বসেছিস তুই!!
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ঝোরা বললো,
-কেন?পেয়ে তো তুই আমার বসেছিস!ছাড়তেই পারছিস না আমায়।বাড়ি পর্যন্ত চলে যাচ্ছিস,আমায় বিয়ে করবি বলে...
-তোকে আমি ভালোবাসি ঝোরা!তুই আজ স্যারের সামনে এটা কি করলি?এইভাবে অপমান করলি আমায়?
-কোথায় অপমান করলাম!আমি তো শুধু সত্যিটা বললাম।যে তুই আমায় যখন আদর করতিস,আমার সিডের কথাই মনে পড়তো!ব্যাস!!সিডও আমার বুকের ওই তিলটা নিয়ে তোর মতোই বাড়াবাড়ি করতো,একদম তোর মতোই পাগলামি করতো...একেবারে কামড়ে-চটকে...
ঝোরার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো।অরিত্র সপাটে ওকে এমন একটা চড় মারলো,চুপ করতে বাধ্য হলো ও...গালে একটা হাত রেখে,মাথা নীচু করে একদম চুপ করে গেলো ঝোরা।
-সালি!!আমার মা তোর সম্পর্কে যা বলে,একদম ঠিক বলে!ব্লাডি প্রস্টিটিউট!!শাঁখা-সিঁদুর পরে ভদ্রসমাজে চলার কোনো যোগ্যতাই তোর নেই।তুই সালা শুধু রাতের অন্ধকারেই ছেলেদের গা-গরম করতে পারবি!তুই কি বলতিস আমায়?গান্ডু!!একদম ঠিক বলতিস!আমিই সালা গান্ডু!তোর জন্য বাড়িঘর ছেড়েছি,মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছি,মাসিমনিকে যা মুখে এসেছে বলে গেছি,বাবার সঙ্গেও ঝামেলা করেছি!সব ছেড়ে বসে আছি তোর জন্য।কি ভুল করেছি!!সালা ক্যারেক্টারলেস মেয়েছেলে একটা...ভেবেছিলাম,আগে যা করেছে-করেছে!এবার অন্তত আমায় ভালোবেসে আমার সঙ্গে থাকবে,কিন্তু তুই সালি মরলেও শুধরাবি না!!আগে তো কোনোদিন বলিসনি,আমার সঙ্গে শুয়ে তোর স্যারের...
দরজা ঠেলে একজন ভিতরে আসছিলো,কিন্তু ভিতরে অরিত্রর সঙ্গে একজন মহিলাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো ও।অরিত্র চিৎকার করে উঠলো,
-এ ভাই!দু মিনিট চেপে রাখ না ভাই!নইলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেল!যা,বাইরে যা...আরে বেরো না...
সাংঘাতিক জোরে চেঁচিয়ে উঠলো অরিত্র...
হতভম্ভ হয়ে ছেলেটা বেরিয়ে গেলো বাইরে...
ঝোরা আর একটাও কথা বললো না।যে গালে অরিত্র চড়টা মেরেছে,সেই গালটা বীভৎসভাবে জ্বলছে!হাতটা ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে,আবার একটা সিগারেট ধরালো ও।আগেরটা অরিত্রর মারের চোটে,হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে,দূরে ভেজা মেঝেতে পড়ে নিভে গেছে....
-আগে বলিনি,কারণ তখন বললে তোকে ধরে রাখতে পারতাম না!আর তোকে আগেও বলেছি,ইউ অলসো গুড ইন বেড....সো... তোকে তখন হারাতে চাইনি...
-ব্লাডি হোর!!
হেসে উঠলো ঝোরা।একরাশ ধোঁয়া অরিত্রর মুখের ওপরে ছেড়ে বললো,
-তুই আজ জানলি?নতুন কি?
বলার মতো আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না অরিত্র।ভিতরে-ভিতরে ততক্ষণে ও শেষ হয়ে গেছে ও...সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে!!রাগে-অপমানে বিধ্বস্ত হয়ে,শরীরের অসহ্য জ্বালায় ও বলে উঠলো,
-যা!আবার নতুন কাউকে খুঁজে নে!তোর অভাব হবে না!আবার তার মধ্যে আমাকে খুঁজে পেলে,কোনো একদিন এভাবেই দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলিস!!বিশ্বাস কর,সেদিন আনন্দে আমি একেবারে মরেই যাবো!এটা ভেবেই আমি একেবারে বর্তে যাবো,যে তুই অন্য কারোর বিছানায় গিয়েও,তার মধ্যে আমায় খুঁজে পেয়েছিস!যা,আজ থেকেই খোঁজ শুরু করে দে।ক্যারেক্টারলেস বিচ...
বেরিয়ে গেলো অরিত্র।সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো দরজাটা।আঙুলটা কাঁপছে ঝোরার।দু-একবার হাতটা কাঁপতে-কাঁপতে সিগারেটটা কোনোরকমে মুখের কাছে ধরলো ও।তারপর আর পারলো না।সিগারেটটা কমোডে ছুঁড়ে ফেলে কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে...
দরজা খোলার শব্দে মুখ ফিরিয়ে ও দেখলো,সেই ছেলেটাই আবার এসেছে!
-আয় ভাই!আয়!তুই অনেকক্ষণ ধরে চেপে রেখেছিস।আমিও কান্নাটা অনেকক্ষণ ধরে চেপে রেখেছিলাম রে।তুই আয় ভাই।আমি বেরিয়ে যাচ্ছি!
বলেই কাঁদতে-কাঁদতে ঝোরা জেন্টস-বাথরুম থেকে বেরিয়ে লেডিজ-বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো।ব্যাগের মধ্যে ফোনটা বাজছে।ঝোরা বের করে দেখলো প্রিয়মের ফোন।এতক্ষণে মনে হয় বাইকটা নিয়ে ও এপার্টমেন্টে পৌঁছে গেছে।ওই নামটা দেখে ঝোরার কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেলো।ফোনটা বন্ধ করে দিলো ও...
স্তব্ধ হয়ে সিদ্ধার্থর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রুবি।একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সিদ্ধার্থ ওকে সম্পূর্ণই বলেছে।
-কি দিয়ে তৈরী ওই মেয়ে?কোথায় ঝোরা?
-জানিনা!অরিত্র ওকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলো!
রুবি সেই মুহূর্তেই ছুটে বেরোতে গেলো...চেঁচিয়ে উঠলো সিদ্ধার্থ,
-রুবি!তুমি ওইভাবে ছুটবে না!
ওর কথা কানেই তুললো না রুবি।সোজা বেরিয়ে এলো বাইরে।কাঁচের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলো,ঝোরার স্কুটি এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।কয়েক মুহূর্ত ভেবেই লেডিজ বাথরুমের দিকে ছুটলো ও....
দরজা ঠেলে রুবিকে ভিতরে ঢুকতে দেখেই,নিজের কান্নাটা বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো ঝোরা।কিন্তু আজ আর কিছুতেই পারলো না।সবকিছু ঠেলে নিয়ে বেরিয়ে আসছে কান্নারা...
সিঙ্কের সামনে মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঝোরা।রুবি এগিয়ে এলো ওর দিকে,
-আমার আর সিডের মধ্যে কোনোদিনও কিচ্ছু ঠিক ছিলো না ঝোরা।আমার লেট-নাইট পার্টি,বয়ফ্রেন্ডস,কিছু বলতে এলেই ওর মাকে অসম্মান করা,এসব সিড মেনে নিতে পারেনি কোনোদিন।কি করবো বলো,আমি নিজেকে ভীষণ ওপেন-মাইন্ডেড,লিবারাল ভাবতাম।তাই নিজের শর্তেই বাঁচতে ভালোবাসতাম।তার জন্য কারোর পরোয়া করিনি।ওর মাকেও সম্মান করিনি।এখন বুঝি,এভাবে চলে না।পোশাকে-জীবনযাত্রায় নয়,সবার আগে মনে আধুনিক হতে হবে।এসব নিয়ে বিয়ের পর থেকেই আমাদের ঝামেলা চলতো।তুমি ওর জীবনে না এলে হয়তো,আমাদের ডিভোর্সটা হয়েই যেতো ঝোরা।ও যেই আমাকে ছেড়ে তোমার দিকে ঘুরলো,আমি পাগল হয়ে গেলাম!তোমার ওপর হিংসায় আমি জ্বলে যেতাম।তখনই বুঝলাম,সব ছেড়ে আমি বাঁচতে পারবো,কিন্তু সিডকে ছেড়ে নয়!তুমি আমাদের মধ্যে এসেই আমাদের বিয়েটা বাঁচিয়ে দিয়েছো!নইলে আমি নিজেকে শুধরাতামও না,সিডকেও হয়তো হারাতাম।আজ বুঝতে পারছি,সেদিন তোমায় যে হিংসে করেছি,তা ছিলো ভিত্তিহীন!বাট টুডে....টুডে আই এম রিয়েলি জেলাস অফ ইউ ঝোরা!!তুমি আজ যেটা করলে,আমি পারতাম না!কোনোদিনও না...নিজেকে এতটাও নামানো যায়!!একি!!তোমার গালটা এত লাল কেন?ঘোরো দেখি আমার দিকে,ঝোরা!!
-কিছু না ম্যাম!আমি ঠিক আছি!
কল খুলে চোখে-মুখে ভালো করে জল দিলো ঝোরা...
তারপর রুবির দিকে ফিরে বললো,
-সিড বললো,আই মিন স্যার...
-সিড স্যার নয়,আমিও ম্যাম নই...কল মি রুবি!!
-ওকে!আমি শুনলাম আপনি প্রেগন্যান্ট!!কংগ্রাটস ম্যাম!সরি...রুবি!!
-থ্যাঙ্কু ঝোরা!!
-আসছি আমি!
-সিডের সঙ্গে দেখা করবে না?
-নাঃ!!বাই...
আর কান্না চাপতে পারছিলো না ঝোরা।হুড়মুড় করে ও বেরিয়ে এলো ওখান থেকে।লিফটে উঠে সোজা নেমে এলো নীচে...
স্কুটিতে বসেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো ও,কানে বাজছে ওই কথাটুকু,
"ব্লাডি প্রস্টিটিউট!!ক্যারেক্টারলেস বিচ!!"
তীরের বেগে স্কুটি চালিয়ে দিলো ঝোরা।ওর দুগাল বেয়ে তখন জলের ধারা নামছে...বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে সামনের রাস্তাঘাট...
🙏🙏🙏🙏🙏 🥰 🙏🙏🙏🙏🙏
দশম পর্ব শেষ হলো। আমি জানি অনেকেই ইনবক্সে এবং কমেন্ট বক্সে এই উপন্যাসটি সম্পূর্ণ পড়ার আবদার জানিয়েছেন। কিন্তু এটি পূর্বেই পেজে প্রকাশিত এবং বই আকারেও প্রকাশিত। সেই কারণে প্রোডাকশন কপিরাইট প্রকাশকের কাছে আছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলেই আমি এইটুকু প্রকাশের অনুমতি পাই। এটা আমার নতুন পাঠকদের জন্য ছিল। যাতে তাঁরা আমার লেখার সঙ্গে কিছুটা পরিচিতি লাভ করতে পারেন। এর বেশি প্রকাশ সম্ভব না। প্রকাশকের পক্ষ থেকে প্রোডাকশন কপিরাইট আইন আমাকে আটকাবে। এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের অত্যন্ত ডার্ক একটা উপন্যাস। যদি এরপরে কোনো লেখা সূর্যোদয়ের আগের-র সঙ্গে পাল্লা টানতে পারে, সেটা হবে একমাত্র কুহেলিকায় রাত্রিযাপন। নতুন উপন্যাসটি পড়তে থাকুন, আর কেমন লাগছে অবশ্যই আমাকে জানান। কেউ যদি সূর্যোদয়ের আগে উপন্যাসটি সংগ্রহ করতে চান, তবে যোগাযোগ করতে পারেন পাঠকবন্ধুর সঙ্গে।
পাঠকবন্ধু - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

 

সূর্যোদয়ের আগে (নবম পর্ব)




সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
নবম পর্ব




কয়েক মুহূর্ত আগে অরিত্রর সঙ্গে ফোনালাপের প্রত্যেকটা শব্দ মনে পড়ে গেলো ঝোরার।লজ্জায় ও আর দাঁড়াতে পারলো না প্রিয়মের সামনে।ছিটকে বেরিয়ে যেতে গেলো নীচে।প্রিয়ম একদৌড়ে গিয়ে টেনে ধরলো ঝোরার হাত।তারপর ওকে হিড়হিড় করে টানতে-টানতে নয় গেলো জলের ট্যাঙ্কগুলোর পিছন দিকের অন্ধকার জায়গাটায়....
-প্রিয়ম,ছাড়ো আমায়!
-না!তোমার অনুমতি ছাড়া,তোমার শরীরে তো আমি হাত দিইনি।এতদিনে তোমার হাত ধরার অধিকারটুকু অন্তত আমার আছে...একদম চুপ করে দাঁড়াও এখানে...
-আমার হাত ছাড়ো আগে!লাগছে!!
-ওকে!কার সঙ্গে কথা বলছিলে তুমি?
-আমি তোমাকে কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নই!
-তুমি বাধ্য!!
-না!
-ঝোরা!!কাজের জন্য আমি বাইরে পড়ে থাকি,আমার কোনো উপায় নেই।হাত-পা বাঁধা আমার।কিন্তু তুমি কি করছো এখানে?
-মানে!!
-যাই করো না কেন,আমায় একবার জানাবে না?বলার প্রয়োজন নেই আমায়?ফোনে তুমি কার সঙ্গে কথা বলছিলে?কথা শুনে তো মনে হচ্ছিলো না,সে তোমার অতীত!সে তো তোমার বর্তমান ঝোরা!!
-আমি বলবো না!ব্যাস!!
রাগে সর্বশরীর জ্বলতে শুরু করলো ঝোরার।প্রিয়ম ওর সঙ্গে এইরকম ব্যবহার করতে পারে,এভাবে কথা বলতে পারে,ও স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।দৌড়ে ও চলে আসতে গেলো ওখান থেকে...প্রিয়ম আবার টেনে ধরলো ওকে...
-ঝোরা!!
মাথায় আগুন জ্বলছে প্রিয়মেরও।কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই ও বুঝে গেলো,ঝোরাকে কোনো পরিস্থিতিতেই জোর করা যায় না।ওর জেদও সাংঘাতিক।একবার জেদ চেপে গেলে এই মেয়ে প্রিয়মকেও নিজের জীবন থেকে এই মুহুর্তেই উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে!!আলতো করে ঝোরার দুটো হাত ধরে প্রিয়ম বললো,
-সরি!!সরি ঝোরা!!কিন্তু আমার দিকটাও একটু বোঝার চেষ্টা করো তুমি!তোমার মুখ থেকে ওই কথাগুলো সহ্য করা,আমার পক্ষে সম্ভব ঝোরা?!কোনো পুরুষ কি পারে, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এসব শুনতে!?
প্রিয়ম অবাক হয়ে দেখলো,ওর হাতের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যে ঝোরা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো,ওর ওইটুকু আদরমাখা কথাতেই,তক্ষুণি ঝোরার দুটো হাত শিথিল হয়ে গেলো।ও ওখানেই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেললো ঝরঝর করে...
প্রিয়ম এগিয়ে এলো ওর দিকে...
-ইটস ওকে!ইটস ওকে!!অন্য কেউ তো না!বাইরের কেউ না,অচেনা কেউ না!!আমি ঝোরা!আমিই তো!ইটস মি!!প্রিয়ম...
ঝোরা এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়মকে।প্রথমে একটু চমকে গেলেও প্রিয়ম ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো,
-প্রিয়ম?
-হুম,বলো!কি হয়েছে ঝোরা?কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
-কেউ না!কেউ না...
ঝোরা কেঁদেই যাচ্ছে...
-আচ্ছা,আমাকে না বললে আমি জানবো কি করে ঝোরা!
-আমি বলতে পারবো না প্রিয়ম!এবার আমিও হারাতে ভয় পাই!!তুমি প্লিজ কিছু জানতে চেয়ো না....
-কিন্তু তুমি....
সজোরে প্রিয়মের ফোনটা বেজে ওঠে।ও ঝোরার একটা হাত ধরে,অপর হাতে ফোনটা হাফ-প্যান্টের পকেট থেকে বের করে....
-হ্যাঁ অভ্র দা বলো...
-পাপাই!ঘুমিয়ে পড়েছিলে?এত রাতে বিরক্ত করার জন্য সরি!
-নানা,অভ্র দা!ঘুমাইনি...বলো!
-এখন একটু নীচে আসতে পারবে?আসলে পরশুদিন হোলি নিয়ে আমরা কিছু প্ল্যান করছিলাম।আগেরবার তো কমপ্লেক্সে এত লোক ছিলো না,এবার অনেকেই আছে।তাই সবাই মিলে ওই একটু আনন্দ-ফুর্তি আর কি....
-আসছি!!আমায় একটু সময় দাও।
-হ্যাঁ-হ্যাঁ এসো না ধীরেসুস্থে....
-রাখছি!
ফোনটা পকেটে রেখে প্রিয়ম আবার ঝোরাকে টেনে ধরলো নিজের কাছে।
-কার সঙ্গে কথা বলছিলে?
মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ঝোরা...
-ঝোরা?
-আমি আসছি!!তুমি আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো না প্রিয়ম...আমিও রাখবো না...
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না ঝোরা।প্রিয়মের অসাবধানবশত আলগা হয়ে যাওয়া হাতটা থেকে,নিজের হাতটা ছাড়িয়ে একলাফে নেমে পড়লো সিঁড়িতে...
প্রিয়মের তখন অপমানে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে...কয়েক মুহূর্ত পর ও লিফটে এসে ওঠে।নামে একেবারে একতলায়...
অভ্র দার অর্ধেক কথাই প্রিয়মের মাথার ওপর দিয়ে,দু-কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।এপার্টমেন্টের একতলাতে স্থানীয় পার্টির নেতাগোছের কেউ একজন আছেন,তিনিও ওইদিন সকালবেলা বেশ বড় করেই পুজো করছেন।তারপর এপার্টমেন্টের সবাই মিলে বেলার দিকে গান বাজিয়ে,নাচানাচি হবে-লাফালাফি হবে,রং খেলা হবে।প্রিয়ম এককথায় বলে এসেছে,আয়োজন করতে।যা টাকা লাগে বিনা বাক্যব্যয়ে ও দিয়ে দেবে।অভ্র দা বলছিলো,দুপুরের আর রাতের খাওয়ার আয়োজনও ওখানেই হবে।অর্ধেক কথা শুনে চলে এসেছে প্রিয়ম,আর ওখানে দাঁড়াতেই ইচ্ছে করছিলো না ওর,মনটা পড়ে রয়েছে ফোনের দিকে।কাল নিজের ভাগের টাকা ধরে অভ্র দার হাতে দিয়ে দেবে,ঝামেলা মিটে যাবে।ঘরে ঢুকে মায়ের সঙ্গে আর একটাও কথা বললো না প্রিয়ম।সোজা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।নিজের ঘরে ঢুকেই ঝোরাকে ফোন করলো ও,ফোন বন্ধ!গলা ছেড়ে এবার ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে...বালিশে মুখ গুঁজে দিয়ে একবার কেঁদেই ফেললো প্রিয়ম।আবার উঠে ঝোরাকে ফোন করলো,আবারও বন্ধ...
এখনও ট্রলি খোলা হয়নি।খাটের পাশে ওর ট্রলিটা দাঁড় করানোই রয়েছে।ওটাকে একটানে হেঁচড়ে শুইয়ে,ওর ভিতর থেকে ছোট্ট একটা ব্যাগ বের করলো প্রিয়ম।কয়েকটা ঘুমের ওষুধ মুখে ফেলে দিয়েই,জল দিয়ে ওগুলোকে গিলে রাখলো ও...
আরও একবার ফোন করলো ঝোরাকে।আবারও ফোন বন্ধ!ফোনটা মাথার পাশে রেখেই বালিশে উপুড় হলো ও।যদি মেয়েটা একবার অন্তত ফোন করে....
ওষুধ খেয়েও কিছুতেই ঘুম আসছিলো না প্রিয়মের।দুটো চোখ জ্বালা করছে,অনবরত দুচোখ দিয়ে জল বেরিয়েই যাচ্ছে,আর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,
"উই আর বেড-পার্টনার!নট লাইফ-পার্টনার!!"
কেঁদে বালিশে মুখ গুঁজে দিলো প্রিয়ম।কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ নেই।পুরুষ-মানুষের অব্যক্ত ব্যথার হয়তো কোনো শব্দ হয় না।শুধু নিঃশব্দে ভিজে উঠতে লাগলো মাথার বালিশের একাংশ...
বেশ কিচ্ছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে ওষুধের ঘোরে,ঘুমিয়ে পড়লো প্রিয়ম....
ঝোরাও ততক্ষণে নিজের বিছানায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।পাশেই টেবিলে পড়ে রয়েছে খোলা জলের বোতল,আজ যে জল একটু আগেই ওকেও ঘুমের ওষুধ গিলতে সাহায্য করেছে...
ঝোরা আর প্রিয়ম,দুজনের কেউই আজ আর একে-অপরকে ছাড়া শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে পারলো না।ঘুমের ওষুধের ঘোরে কৃত্রিম স্বপ্নের মায়াজালে নিজেদের জড়িয়ে,চোখ বন্ধ করে দুটো দেহ বিছানায় পড়ে রইলো কেবল...
-পাপাই!!এই পাপাই!!
মা দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।বহুকষ্টে দুটো চোখ টেনে খুললো প্রিয়ম।টলতে-টলতে দরজার দিকে গেলো।চড়া রোদ উঠে গেছে বাইরে।দরজা খুলতেই দেখলো,মা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-কিরে!এত বেলা তোর?আমি স্কুল যাবো তো!
-হুম!যাও...আমার একটু দেরি হয়ে গেলো উঠতে...
-শরীর ঠিক আছে তো?
-হুম,ঠিকই আছে!
-অভ্র এসেছিলো,কিসব টাকা-পয়সার কথা বলছিলো।বললো,সাড়ে দশটা পর্যন্ত ও বাড়িতে আছে।তার মধ্যে গিয়ে ওর হাতে টাকা দিয়ে দিতে।কাল রাতে এই ব্যাপারে তোর সঙ্গে কথাও হয়েছে বললো।কি ব্যাপার রে?কাল তো কিছু বললিও না।ঘরে এসেই ঘুমিয়ে পড়লি...
-ওই কমপ্লেক্সের ভিতরে সবাই মিলে একটা হোলি-পার্টি মতো হবে।দুপুরে-রাতে খাওয়া-দাওয়া হবে...সেই ব্যাপারেই সবাইকে টাকা দিতে হবে...
-ও...কত টাকা?
-জানিনা!দেখছি আমি!ওসব আমার ওপর ছেড়ে দাও!
-আচ্ছা!আমি বেরোলাম।ব্রেকফাস্ট করে নিস কিন্তু!টেবিলে সব ঢাকা আছে!
-হুম!!
অপর্ণা বেরিয়ে গেলে প্রিয়ম ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ছুটলো।ঝাঁপিয়ে বিছানায় পড়ে ফোনটা হাতে নিয়েই ফোন করলো তাকে।রিং হচ্ছে,কিন্তু ধরছে না সে....বেশ কয়েকবার ফোন করলো প্রিয়ম।সে আর কিছুতেই ফোনটা ধরলো না।বেজে-বেজে কেটেই গেলো...
প্রিয়ম ফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেললো।
চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে নেমপ্লেটের শেষ নামটা।
"শ্রীময়ী সেন"!
প্রিয়ম জানতো,এখন কাউকেই পাওয়া যাবে না।কিন্তু তবুও ও একবার না এসে থাকতে পারলো না।সকাল থেকে কিচ্ছু দাঁতে কাটতে পারেনি ও।গলা দিয়ে খাবার নামছেই না।ঝোরাও ফোন ধরছে না!অস্থির হয়ে নীচে নেমে এলো প্রিয়ম।অভ্র দাকে টাকা দেওয়া হয়েই গেছে!আর কোনো কাজ নেই।ঘরে ঢুকে জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো ও...
দুপুরেও আর কিচ্ছু খেলো না প্রিয়ম।বিকেলের কিছু পরেই নীচে নেমে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো ও।মায়ের কাছে একটা চাবি আছেই।মা চলে এলেও কোনো অসুবিধে নেই...বাইক সোজা টেনে নিয়ে গেলো,সেই নির্দিষ্ট পার্কে,যেখানে বসে প্রতিদিন ঝোরা ওর সঙ্গে কথা বলে।ওর মন বলছে,ঝোরা ওখানে আসবেই....একটু এগিয়েই ও দেখলো ঝোরার আকাশী রংয়ের স্কুটিটা পার্কের বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।ঝোরার স্কুটির পাশেই প্রিয়ম নিজের নীল বাইকটা রাখলো...
বাইকটা বাইরে রেখে ভিতরে গিয়ে প্রিয়ম দেখলো,সেই নির্দিষ্ট বেঞ্চে ঝোরা চুপ করে বসে আছে।ওর পায়ের কাছে একটা কুকুর বসে-বসে বিস্কুটের ফাঁকা প্যাকেট নিয়ে একমনে খেলা করছে....
প্রিয়ম চুপচাপ গিয়ে ঝোরার সামনে দাঁড়ালো...
চমকে উঠলো ঝোরা।ও উঠতে যাচ্ছিলো,কিন্তু তখনই প্রিয়ম ওর পাশে গিয়ে বসলো।টেনে ধরে রাখলো ওর একটা হাত....আর উঠতে পারলো না ঝোরা...
-হয় এখান থেকে আমি যেখানে বলবো সেখানে যাবে,নয়তো চুপচাপ এখানেই বসে থাকবে!পালাতে গেলে তোমার পা ভেঙে দেবো...
-প্রিয়ম!!
-আই মীন ইট ঝোরা!
দৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলেই প্রিয়ম ঝোরার মুখের দিকে চাইলো...তখনও ঝোরার একটা হাত ও চেপে ধরে রেখেছে...আর আলগা করবে না ওই বজ্রমুষ্টি...
ভালো করে ঝোরাকে দেখলো প্রিয়ম।ওর দুটো চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে,লাল একেবারে।কান ফাঁকা,নাক ফাঁকা,চোখে কাজলটুকু পর্যন্ত নেই!মুখে অসংখ্য গর্ত-দাগ,ব্রণ ভরা,বলিরেখা স্পষ্ট!!আজ আর কোনো আলগা প্রসাধন নেই ঝোরার মুখে...কি ভীষণ বিবর্ণ দেখাচ্ছে ওকে...
-আজ আমি আর কিচ্ছু জানতে চাইবো না!যদি তোমার কোনোদিন মনে হয়,তবে তুমি আমায় নিজেই জানিও!কিন্তু এভাবে আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিলে,আমি বাঁচবো কি করে!?
-আমরা কাল আলাদা থাকলে,এইরকম সুন্দর সম্পর্ক না থাকলে,তখন তুমি কিভাবে বাঁচবে প্রিয়ম?
-জানি না!!বাঁচতে পারবো না!
-বললাম তো,আর যোগাযোগ রেখো না আমার সঙ্গে...
-আমি মরে যাবো!
-না!মরবে না!আমিও একদিন ভেবেছিলাম মরে যাবো!এত অপমান আর সহ্য হয় না!এবার বুঝি মরেই যাবো!মরিনি!
-অপমান?!
-সে আছে আমার জীবনে অনেক দুর্ঘটনা!ছাড়ো ওসব...
-ছেড়ে দিলাম!সব ছেড়ে দিলাম।শুধু তোমায় বিশ্বাস করে তোমায় ধরে রাখতে চাই!
ঝোরা অবাক হয়ে চাইলো প্রিয়মের দিকে...
-সত্যিই কিচ্ছু জানতে চাও না?
-নাঃ!!আইসক্রিম খাবে ঝোরা?সেই প্রথম দিনের মতো?
একটু হেসে ঝোরার দিকে চাইলো প্রিয়ম।
-খাবো!
-বসো!আমি নিয়ে আসছি!
প্রিয়ম ঝোরার পাশ থেকে উঠে বাইরের দিকে বেরোতে গেলো...ঝোরা বলে উঠলো,
-অরিত্র!!
-কি?!
ঘুরে দাঁড়ালো প্রিয়ম।
-অরিত্র!অরি!কাল ফোনে আমি ওর সঙ্গেই কথা বলছিলাম প্রিয়ম...
চুপ করে গেলো প্রিয়ম।একদম ঠিক বুঝেছে ও ঝোরাকে।চাপ দিয়ে,মাথা গরম করে,ওর ওপরে চিৎকার করে,একটা কথাও বের করা যাবে না ওর মুখ থেকে।যা করার ভালোবেসে করতে হবে।একটু ভালোবাসায়,একটু আদরেই খোলা খাতা হয়ে যাবে মেয়েটা...তখন আর ওকে পড়তে একটুও অসুবিধা হবে না।ঝোরার চোখের দিকে চেয়ে থমকে ও বললো,
-দাঁড়াও,এসে শুনছি!
মাথাটা নামিয়ে নিলো ঝোরা।প্রিয়ম এগিয়ে গেলো আইসক্রিম আনতে....
-তো সে এখন আমায় বিয়ে করবেই।বাড়িতে এসে দাদার সঙ্গে কথা বলে গেছে!তারপর থেকেই বাড়িতে আগুন জ্বলছে...থাকতেই পারছি না আর...সকালে বেরোনোর আগেও একচোট হলো!
-দাদা-বৌদি তোমায় সেটেল্ড দেখতে চায়।ওদের চাওয়াটাও অন্যায় নয়।তবে তুমি কি চাও ঝোরা?ওকে বিয়ে করতে?
-কোনোদিনও না!আমি বিয়েই করবো না!
-বিয়ে করবে না মানে?
-মানে ওসবের ইচ্ছে নেই!!
-হঠাৎ এমন অনিচ্ছের কারণ?
-প্রায় বিয়ের পিঁড়ি থেকে পাত্রপক্ষ আমায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।নেহাত সেজেগুজে বসিনি,তাই আর লগ্নভ্রষ্টা ট্যাগটা লাগেনি....নইলে....
প্রিয়ম একভাবে চেয়ে রয়েছে ঝোরার দিকে...ঝোরার দু-চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা জল গড়িয়েই যাচ্ছে।তবুও হাসছে মেয়েটা।
-ভয় লাগে প্রিয়ম!ভীষণ ভয় লাগে,জানো তো!আবার যদি সে আসবে বলে না আসে!?আবার যদি আমাকে একা ফেলে চলে যায়!!আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারবো না গো।তার চেয়ে এই ভালো!
-অরিত্র?
-নাঃ!তখন কোথায় অরিত্র!ও আর কতদিন!!অন্য কেউ!বাদ দাও ওসব...
-আমি তোমায় কোনোদিনও ছাড়বো না ঝোরা!জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও...
আইসক্রিমের কাপটা ক্যাঙারুর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে প্রিয়মের পাশে এসে বসলো ঝোরা।একটু হেসে বিদ্রুপ করে বললো,
-অনেক শুনেছি বুঝলে প্রিয়ম,এসব বালের কথা অনেক শুনেছি!"আমি তোমায় ছাড়বো না","আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না","তুমিই আমার সব" আরও কত-কত কিছু....তোমার কি মনে হয়,তুমিই সেই পুরুষ,যে এসব আমায় প্রথম বলছো!!
-নাঃ!সেটা আশাও করি না!প্রথম হওয়ার রেসে জীবনে কোনোদিনও দৌড়োইনি।শুধু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে চেয়েছি...সে যখন যা হবে দেখা যাবে।যা হয় হোক,শুধু আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবো।এর শেষ দেখেই ছাড়বো!শুরুটা আমার হাতে না থাকলেও,শেষটা আমিই করতে চাই...ব্যাস!!
অবাক হয়ে ঝোরা চেয়ে রইলো প্রিয়মের দিকে....প্রিয়ম নির্লিপ্তভাবে বলে যাচ্ছে,
-কাল কমপ্লেক্সে একটা পার্টি হবে।শুনেছো নিশ্চয়ই?আসবে তুমি...
-শুনেছি!আসবো না!ওসব রং দিয়ে সং আমি সাজি না!তোমাকে আগেও বলেছি....
শেষ একটুখানি তলানি আইসক্রিম শুদ্ধু কাপটা প্রিয়ম এগিয়ে দিলো ঝোরার দিকে,কাপটা হাতে নিয়ে প্রিয়মের এঁটো চামচটাই নির্দ্বিধায় মুখে ঢোকালো ঝোরা....
প্রিয়ম বলে উঠলো,
-দেখা যাক!!এতদিন নিজে হেরে গিয়ে তোমাকে জিতিয়ে দিয়েছি!ঝগড়ার মধ্যেও বারবার ইচ্ছে করেই হেরেছি তোমার কাছে।তুমি জিতে গিয়ে গালাগালি করেছো,আমি মুখবন্ধ করে শুনে গেছি!তুমি ফোনের এপার থেকে চিৎকার করেছো,সেটাও আমিই শুনে গেছি!কিন্তু এবার তোমার সঙ্গেই আমার লড়াইটা শুরু!একেবারে মুখোমুখি লড়াই!দেখা যাক!!কত মনের জোর তোমার?!এবার তো আর ছাড়বো না তোমায়...
-আমায় ধরে রাখতে পারলে,তবে তো ছাড়ার প্রশ্ন আসবে!!ধরতেই পারবে না...
-দেখাই যাক না!!বললাম তো,শেষটা আমিই করবো!তুমি জানো না,প্রিয়ম সমাদ্দার কি জিনিস!!
-তাই?কি জিনিস!আমিও একটু শুনি!
হেসেই ফেললো ঝোরা...
প্রিয়ম ততক্ষণে হেসে কামড়ে ধরেছে নিজের নীচের ঠোঁটটা...
-সঙ্গে থাকো!বুঝে যাবে!তোমাকে পাগল করে না ছেড়েছি তো,আমি নিজেই নিজের নাম বদলে ফেলবো!
-বাপরে!ওভার-কনফিডেন্স!!
-সেটা সময় বলবে!
-বেশ!সেই সময়ের অপেক্ষা করবো!!
-এখন চলো!
উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো প্রিয়ম।ঝোরার দিকে এগিয়ে দিলো একটা হাত...ঝোরা এগিয়ে গিয়ে ধরলো প্রিয়মের হাতটা...
-ঝোরা?
-হুম!
-আজ তো নিজেই হাতটা বাড়িয়ে দিলে,আমার হাতে-হাত রাখলে,অথচ এই হাতটাই কাল ধরেছিলাম বলে,ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিলে,কেন?তোমার হাত ধরার অধিকারটুকুও কি আমার নেই?
-লজ্জায়!!লজ্জায় প্রিয়ম।আমি কোনদিনও কারোর পরোয়া করি না।কিন্তু কেন জানিনা,সেই মুহূর্তে তোমার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছিলাম না।সাংঘাতিক একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো আমার মধ্যে!আমি জানি প্রিয়ম,আমি নিজের জীবনটাকে যেভাবে চালাই,যেভাবে আমি চলি,সেটা ঠিক না!কিন্তু তাতে তো আমি ভালো আছি,মানে ভালোই ছিলাম....তাই আর কি...তাই আর কোনো কিছুর পরোয়া করতাম না...
-একটা কথা সোজাসুজি জিজ্ঞেস করবো!একদম সোজাসুজি উত্তর দেবে?
-বলো!জানা থাকলে নিশ্চয়ই দেবো!
প্রিয়ম শক্ত করে ঝোরার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে আঁকড়ে ধরলো।তারপর বললো,
-ভালো ছিলাম,পরোয়া করতাম না!!"ছিলাম-করতাম"...হঠাৎ করে সব অতীত হয়ে গেলো!!কেন?একটু আগেই যে বললে,আমি যাওয়ার পর থেকেই অরিত্রর সঙ্গে তুমি আর দেখা করতে পারোনি,ওর সঙ্গে আর....হোয়াটএভার...যাইহোক,করতে পারোনি,এটা কেন হচ্ছে?আমি যাওয়ার পর থেকেই তুমি অরিত্রকে এড়িয়ে চলছো কেন?আমার অবর্তমানে একা থেকে তো,তোমার ওর কাছে আরও বেশি করে যাওয়া উচিত ছিলো!!
-প্রিয়ম!!
এক ঝটকায় প্রিয়মের হাত থেকে নিজের হাতটা বের করে নিলো ঝোরা....বুকের ভিতরটা অসম্ভব রকম কাঁপছে ওর...
প্রিয়ম একভাবে চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই।নীচের ঠোঁটটা হারিয়ে গেছে দাঁতের দংশনে।মুখে মৃদু হাসি...ঝোরা অদ্ভুত উত্তেজনায় কাঁপছে...একটু পর প্রিয়মই বললো,
-হোয়াট!!প্রিয়ম...কি প্রিয়ম?বি প্রাকটিক্যাল ঝোরা!!একাকীত্বেই সঙ্গীর প্রয়োজন হয়।মেন্টাল নিড-ফিজিক্যাল নিড,যেটাই বলো!প্রয়োজন তো হয়ই...আমাদের দুজনের কারোর বয়সই নেহাত কম নয়।আমরা এইসব ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলতেই পারি।আমি জানি না আমরা এখন সম্পর্কের ঠিক কোন স্টেজে আছি!!বা আদৌ কোনো সম্পর্কে আছি কিনা,বা নেই কিনা!কিচ্ছু জানি না আমি...তবে যদি সত্যিই তোমার দিক থেকে কিছু না-ই থাকে,তবে তুমি অরিত্রর কাছে যেতে পারছো না কেন?কোথায় আটকাচ্ছে?প্লিজ ঝোরা,ভাবো একটু!ভালো করে ভাবো!দেখো আমি বাইরে থাকি,প্রচুর দেখেছি এইরকম লং-ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ!!কমিটেড হয়েও অনেকেরই এক্সটার্নাল এফেয়ার থাকে।দিনের পর দিন,মাসের পর মাস একা থাকলে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সঙ্গীর প্রয়োজন হয়,সেটা একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়!সেক্ষেত্রে দুজনের কেউই কিছু জানতেও পারে না,অনেক-অনেক দেখেছি এইরকম....আর সেক্ষেত্রে আমরা তো কমিটেডই নই।তাও তুমি পারছো না কেন?তোমার দিক থেকে যদি আমার জন্য সত্যিই কিছুই না থাকে তো,তুমি কেন অরিত্রর কাছে আগের মতো যাবে না!!
প্রিয়মের মুখ থেকে বেরোনো শব্দমালা কথা নয়,যেন এক-একটা চাবুক!!প্রতিটা শব্দ সপাটে আঘাত করছে ঝোরাকে।বনবন করে মাথাটা ঘুরছে ঝোরার...দমবন্ধ হয়ে আসছে।কিরকম একটা হচ্ছে যেন!কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়লো ও....প্রিয়ম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ওর সামনে,
-কি হলো?
-এই তুমি যাবে এখান থেকে?
-অবশ্যই যাবো!এখানে সারারাত থেকে মশার সঙ্গে অসম বক্সিং করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই আমার...যাবো তো বটেই।তবে তোমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবো!
উঠে দাঁড়ালো ঝোরা।নিজে থেকেই প্রিয়মের কাছে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলো,
-চলো!
শুধু একটু হাসলো প্রিয়ম।তারপর ওর দুজন হাত ধরে হাঁটতে শুরু করলো।ঝোরা একভাবে চেয়ে রয়েছে প্রিয়মের দিকেই...
-কি দেখছো ঝোরা?
-দেখছি কম,ভাবছি বেশি!
-কি ভাবছো?
-কিছুনা...
"ভাবছি,আমাকে পাগল তো তুমিই করে ছাড়বে প্রিয়ম!আর তারপর যখন তুমি আমায় ছেড়ে দেবে,তখন আমি আবার মরে যাবো!এবার আমি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না!আর ওঠার ক্ষমতা থাকবে না আমার!!"
কেঁপে উঠে প্রিয়মের হাতের চেটো ছেড়ে দিয়ে দু-হাত দিয়ে প্রিয়মের একটা গোটা হাতকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো ঝোরা।তারপর হাঁটতে-হাঁটতেই ওর হাতের ওপর মাথা রাখলো...
একটু শুধু হাসলো প্রিয়ম...ঝোরার হাতের মধ্যে থেকে নিজের হাতটা বের করে নিয়ে ঝোরার কাঁধে হাত রাখলো।ওকে টেনে নিলো কাছে....
-ঝোরা?
-হুম!
-তোমাকে আমি শেষ করে দেবো,হ্যাঁ আমিই শেষ করবো!শুরুটা যেই করুক না কেন...আই ডোন্ট কেয়ার!!
-বলাটা খুব সহজ প্রিয়ম!
-করাটাও,প্রকৃত পুরুষ হলে।যদিও জানি লড়াইটা সহজ হবে না...
-এতদিনে তবে একজনও প্রকৃত পুরুষের দেখা পাই নি বলছো?
-সবার সঙ্গে আলাপ করাও,বলে দেবো!!যদিও আমার খুব বেশীদিন ছুটি নেই!সবাইকে কভার করা যাবে তো?লিস্ট খুব বেশি লম্বা হলে না হয়,পাঁচ মিনিট করে সময় দেবো...
ঝোরা বড়-বড় চোখ করে চাইলো প্রিয়মের দিকে,
-আচ্ছা!দু-মিনিট!এক মিনিট!!ওকে-ডান!!থার্টি-সেকেন্ড....এর চেয়ে কম সময়ে গোরু-ছাগলের সঙ্গে মানুষের শারীরিক পার্থক্যটুকুই বোঝা যায়।পুরুষ আর প্রকৃত পুরুষ,আলাদা করে চেনা যায় না!সরি!!
বলেই হেসে ছিটকে দূরে সরে গেলো প্রিয়ম...ঝোরা খামচে প্রিয়মের কালো রংয়ের শার্টটা টেনে ধরলো,
-অভদ্র!!অসভ্য!!
চোখে জল এসে গিয়েছিলো ঝোরার।ওকে কেউ কোনোদিন এত সহজভাবে নেয়নি!কোনোদিনও না!সবসময় ওর বিচার করে গেছে।কিন্তু ও যে কেন এমন,সেই খোঁজ কেউ নেয়নি!সেই শিকড়ে কেউ পৌঁছতেই চায়নি।এটাই কি তবে পুরুষের সঙ্গে প্রকৃত পুরুষের পার্থক্য!!চোখের জলটুকু ঢাকতে তাড়াতাড়ি ঝোরা বলে উঠলো,
-এই প্রিয়ম,ফুচকা খাবে?
-নাঃ!!
-কেন?
-আগে আমায় একটা কথা দাও...
-কি কথা?
-যতই ঝগড়া হোক,যতই অভিমান হোক,যাই হোক না কেন,তুমি আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করবে না!!একটু আমাকে বোঝার চেষ্টা করো ঝোরা,আমি বাইরে পড়ে থাকি,তোমার থেকে-মায়ের থেকে অনেকটা দূরে।হাজারটা টেনশন চলে মাথার মধ্যে!কাল এক রাতেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে,ওষুধ গিলে তবে ঘুমিয়েছি।আজ সকাল থেকে কিচ্ছু খেতে পারিনি।গলা দিয়ে খাবার নামছেই না।এখানে আছি,তাই দৌড়ে চলে এলাম।জানি এই সময়টায় তোমায় এখানেই পেয়ে যাবো!আর ওখানে থাকলে কি করতাম আমি?!দাপিয়ে মরতাম তো!!প্লিজ এইরকম আর কোরো না!ফোন অন রেখো,ঝগড়া করো,মন খুলে গালাগালি দাও,সব চলবে।কিন্তু ফোন বা কথা বন্ধ করবে না প্লিজ,ওসব সহ্য হবে না....প্রমিস মি!!কি হলো?বলো?
-এত কেন ভালোবাসো প্রিয়ম?
-কে বললো ভালোবাসি!?ওসব ভালোবাসাবাসি পরে হবে।আগে প্রমিস করো!
মাথা নীচু করে হেসে ফেললো ঝোরা...
-ওকে!প্রমিস!!আর কোনোদিনও হবে না!
-অবশ্য আমি এবার দাদা-বৌদির নম্বরও নিয়ে যাবো ভাবছি!ব্যাক-আপ!তোমায় না পেলে,ওদের ফোন করে বলবো তোমাকে ফোন দিতে...অসুবিধে নেই তো?
-টেনে একটা থাপ্পড় মারবো হারামি!
হেসে ফেললো প্রিয়ম...
-তাহলে ফোন ধরবে কিন্তু!!
স্কুটিতে উঠে বসতে-বসতে ঝোরা বললো,
-হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেলো,বুঝলে প্রিয়ম!
-কিসের ভুল?
-আগে যদি জানতাম,তুমি আসবে তাহলে আজ আর স্কুটিটা আনতাম না।তোমার বাইকে করেই চলে যেতাম!!আমার পেট্রোলটা বাঁচতো!হিসেবে আমি বরাবরই পাকা প্রিয়ম,কি বুঝলে?
-হুম,সেতো বুঝলাম।কিন্তু এনেই যখন ফেলেছো,কি আর করা যাবে!তবে তুমি চাইলে,আমার বাইকে আসতেই পারো,বা আমি তোমার স্কুটিতে।পরে আমি অটো করে এসে,আর একটা উঠিয়ে নিয়ে যাবো!!
-বাব্বা!!এত খাটবে!!
-ধুস!কিসের খাটনি?ওখানে তো চোখ খুলে উঠেই সেই এক রুটিন!ভালো লাগে মাঝে-মধ্যে একটু পাগলামি করতে....তো বলো!আমি আসবো,না তুমি আসবে?!
-এক্সকিউজ মি!!
ঝোরা স্কুটিতে বসে হেসে গড়িয়ে পড়লো....
কয়েক মুহূর্ত প্রিয়মের সময় লাগলো,ঝোরার হাসির কারণটা বুঝতে...
-ওহ নো!মাই গড!!আই জাস্ট ওয়ানা আস্ক,স্কুটিটা থাকবে না বাইকটা?
-আই নো,হোয়াট ইউ মিন!!এত এমবারাসড হওয়ার কিছু নেই প্রিয়ম।তুমিই স্কুটিতে উঠে এসো!পরে বাইকটা নিয়ে যেও না হয়!!
-ওকে!!
বাইকটা একেবারে একটা কোণায় সরিয়ে রেখে,চাবিটা বের করে হ্যান্ডেল লক করে দিলো প্রিয়ম।তারপর এসে উঠে বসলো ঝোরার স্কুটিতে...
-চলো!!
-প্রিয়ম আমায় ধরে বসো!
-পড়বো না!
-তোমার কথা কে বলেছে?আমিও তো পড়ে যেতে পারি!
মাথা নীচু করে হেসে ফেললো প্রিয়ম।তারপর দুটো হাত রাখলো ঝোরার কাঁধে...
স্কুটি স্টার্ট দিলো ঝোরা...
-ওই,কোথায় যাচ্ছ?এপার্টমেন্ট তো এইদিকে...
-আরে চলো না!!চিন্তা নেই!তোমায় কিডন্যাপ করবো না!!
-কিডন্যাপ করেও লাভ নেই!পকেটে মেরেকেটে পাঁচশো বা সাতশো টাকা পড়ে আছে!কার্ডও বাড়িতে।তাই এ.টি.এমে নিয়ে গিয়ে গান-পয়েন্টে লুঠ করে একাউন্ট ফাঁকা করবে মনে করলে,সেই প্ল্যানও কিন্তু ড্রপ করে দিতে হবে...
-আরে ফাঁকা করবো না,ভর্তি করবো?
-কি ভর্তি করবে?
-পেট-পেট!কে যেন বলছিলো,সকাল থেকে ঠিকমতো খেতেই পারিনি!পেট ফাঁকা!!তার তো আবার নন-ভেজ চলে না।তাই পুরী-তরকারী খাওয়াবো!একদম গরম-গরম!চলোই না!এই প্রিয়ম,ব্রেক মারি বারবার!!
বলতে-বলতেই অতর্কিতে একবার ব্রেক মারলো ঝোরা।কথায় মগ্ন হয়ে থাকা প্রিয়ম একদম তৈরী ছিলো না এই ব্যাপারটার জন্য।ও হুমড়ি খেয়ে পড়লো ঝোরার পিঠের ওপর....
-সরি!!
হেসে ফেললো ঝোরা!!সঙ্গে প্রিয়মও...
-আচ্ছা....তো মেয়েদের ঠিক এইরকম লাগে,হঠাৎ ব্রেক মারলে?!
-হ্যাঁ...একদম! তা তোমার কেমন লাগলো প্রিয়ম?
-আই ফিল ইউজড!!
সশব্দে হেসে উঠলো ঝোরা...প্রিয়ম শুধু একাত্মভাবে ওই মুহূর্তটুকুকে নিজের মননে বন্দী করে নিতে লাগলো....ঝোরাকে ছেড়ে ফিরে গেলেই তো আবার সব শেষ!যতক্ষণ এখানে আছে,ততক্ষণ ওর সবটুকুই প্রিয়মের চাই....ওর হাসি,ওর কান্না,ওর রাগ,ওর অভিমান,ওর গালাগালি,ওর সান্নিধ্য....সবটুকু স্মৃতিপটে এঁকে নেবে প্রিয়ম।তারপর চলে গেলে,ওখানে একাকী বসে-বসে রোমন্থন করবে এই স্মৃতিটুকুই....
-কেমন?
-দারুণ-দারুণ!!
-বললাম না!দারুণ বানায় এখানে!
-গরম-গরম জিলিপি নেবে?তাহলে বলে আসি...
-হ্যাঁ হোক!
ঝোরা উঠে গেলো....
-দাদা....
আবার স্কুটিতে উঠে বসলো ওরা।
-কি?পেট ভরলো?
-মনও ভরে গেছে ঝোরা!
-তোমার মনের খবর দিয়ে আমি কি করবো?পেটের খবর বলো!
-হুম!ভরেছে!
-ব্যাস-ব্যাস!!
-এই ঝোরা,ওই সামনের দোকানটায় একটু দাঁড়াও তো।একবার প্লিজ...
-কেন?কি আছে....ওই না!বাপরে!!পাগল নাকি!!
-আরে দাঁড়াও না...
-না-না!!থালায় রং-বেরংয়ের আবির সাজানো!তোমায় আমি চিনি না!কিনে আগে আমাকেই ভূত করবে!ওসব গল্প ছাড়ো!চুপচাপ বসে থাকো!
বুদ্ধিটা মাঠে মারা গেলো দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো প্রিয়মের।ভেবেছিলো,সবুজ আবির দিয়ে আজ এইখানেই ঢেকে দেবে ঝোরাকে...ওর শরীরের আর একটুও জায়গা ফাঁকা রাখবে না।ঠিক বুঝে গেছে মেয়েটা!উফফ!!জিনিস একটা!!
এপার্টমেন্টের কাছাকাছি এসে যখন ওরা পৌঁছলো,তখন প্রায় সন্ধ্যে সাতটা...
-এখান থেকেই হেঁটে চলে যাও প্রিয়ম।বাইকটা নিয়ে এসো।একটুখানি রাস্তা তো!আর এগিয়ে কি হবে?
-না!তুমি চলো।গেট পর্যন্তই চলো।আমি আবার ঘুরে আসবো!আগে তুমি ঢুকে যাও গেটের ভিতরে,তারপর যাচ্ছি!!
-উফফ!এমন করো না প্রিয়ম।এই আন্টিকেও দেখি বলো,সন্ধ্যের পর বেরিও না।কেন?!সন্ধ্যের পর বেরোলে,আমাদের কি কেউ খেয়ে ফেলবে?
-জায়গাটা এখনও ঠিক...
-ধুর!রাখো তোমার জায়গা...নাও!এবার তো গেট দেখা যাচ্ছে।যাও!
-চলো না ঝোরা!!আর একটুখানিই তো।দেখি একটু....
পিছন থেকে একটু এগিয়ে বসে ঝোরার হাতের ওপরেই হাত রাখলো প্রিয়ম।ওকে ঘিরে ধরলো দুদিকে দিয়ে।তারপর বাকি কয়েক পা রাস্তা প্রিয়মই চালিয়ে নিয়ে এলো স্কুটিটা....
ঝোরার একেবারে ঘাড়ের কাছেই প্রিয়মের থুতনিটা রয়েছে।ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস ঝোরার কর্ণকুহর ছুঁয়ে গেলো দু-এক বার....ঝোরার সারা শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ খেলে গেলো।
-নাও!এবার যাও!!কি হলো?
দম দেওয়া কলের পুতুলের মতো দুদিকে ঘাড় নাড়লো ঝোরা...মৃদুস্বরে বললো,
-কিছু না!!
-নামলাম আমি!তুমি একেবারে পার্কিংয়ে চলে যাও!
-হুম!
আর মাথা তুলতে পারলো না ঝোরা।একরাশ লজ্জা ওকে ঘিরে ধরেছে চারপাশ থেকে।ঝোরার দুকাঁধে হাত রেখে প্রিয়ম নেমে দাঁড়ালো স্কুটি থেকে...
ঝোরা আর ওর দিকে চাইতেই পারছে না।সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে অদ্ভুত একটা ভালোলাগার শিহরণ...
-ইজ এভরিথিং ওকে?
-হুম!
সামনের রাস্তার দিকে চোখ রেখে ঝোরা বললো।
-তাহলে তাকাচ্ছ না কেন আমার দিকে?
-ব্ল্যাক সুটস ইউ!আই মিন,আজ ব্ল্যাক শার্টে তোমায় ভালো লাগছে....তাই...
-ওয়েট!হোয়াট?এতদিন শুনেছি,তোমায় ভালো লাগছে,তাই তোমায় দেখছি!এই প্রথম শুনলাম,তোমায় ভালো লাগছে,তাই তোমাকে দেখছি না।তোমার দিকে তাকাচ্ছি না!!এটার মানেটা কি?
-নাথিং!!
হেসে ফেললো ঝোরা....
-রিয়েলি,ইউ আর ইউনিক ঝোরা!!
-উঁহু!এন্টিক!!
-তা বটে!!লাখে একটা...
-চলো...আমি তা হলে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে অটো-স্টান্ডে যাই!আবার বাইকটা....
-কি বলেছিলাম তোকে!!ওই বেশ্যা মেয়েছেলের একটায় পোষায় না!!দেখ-দেখ!!আমার ছেলেটাকে শেষ করে এখন দেখ,কেমন অন্য একজনের সঙ্গে ঢলাচ্ছে....দেখ তুই!!
রাজু দা দুজন মহিলার নেহাত গায়ে হাত দিতে পারছে না....কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করছে,ওদের আটকানোর...প্রিয়ম আর ঝোরা দুজনেই একসঙ্গে ওইদিকে তাকালো...
-কি ব্যাপার রাজু দা?
-দিদি দেখুন না,সেই বিকেল থেকে এনারা আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে বসে আছেন,যাচ্ছেনই না!আর ইনি তো আপনাকে মুখে যা আসছে,বলেই যাচ্ছে....
-এরা কারা?কি ব্যাপার!আমায় বলুন!
ঝোরা স্কুটি থেকে নেমে এগিয়ে গেলো ওনাদের দিকে...প্রিয়মও সঙ্গে গেলো...
-আমার সংসারটা খেয়ে,আমার ছেলেটাকে খেয়ে কি ভেবেছিস,তুই বেঁচে যাবি!!আমি তোকে ছেড়ে দেবো?বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে না থেকে,এবার তো রাস্তায় গিয়েই দাঁড়াতে পারিস...
-মানে!!কে আপনি?আপনার সাহস কি করে হয়,আমাকে এইসব কথা বলার?রাজু দা,ঘাড়ধাক্কা দিয়ে এক্ষুণি এদের বের করো!থানায় ফোন করো...
ঝোরা চেঁচিয়ে উঠলো।
-ডাক,তোর কত থানা-পুলিশ,কত কে তোর চেনা আছে ডাক!আমি জানি,নীচ থেকে ওপরমহল পর্যন্ত সবাই তোর পায়ের তলায় পড়ে থাকে।থাকবে না কেন!!কীভাবে ব্যাটাছেলেদের মুখ বন্ধ করতে হয়,মাথা ঘুরিয়ে দিতে হয়,সে তো তোর খুব ভালো করেই জানা আছে...
মেজাজ হারিয়ে ফেললো প্রিয়ম।এগিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে,
-এক্সকিউজ মি!!ভদ্রভাবে কথা বলুন!আপনার বয়সের দিকে তাকিয়ে কেউ কিছু বলছে না,তার মানে এই নয় যে,আপনি যা খুশি তাই বলে যাবেন!!কথা বলতে হলে আগে মুখের ভাষা ঠিক করুন!সংযত ভাবে কথা বলুন...
-তুমি নতুন বোধহয়!প্রথম-প্রথম সব ভালো লাগবে বাবা!চেনো না তো,এই মেয়ে কি জিনিস!দাঁড়াও,দুটো দিন যাক!দুদিন পরে তুমি আর তোমার বাড়ির লোকের মুখেও,এই মেয়ে সম্পর্কে কথা বলতে গেলে এইরকম ভাষাই...
-দিদি!!চুপ কর এবার!অনেক হয়েছে!!যা,ওই চেয়ারে গিয়ে চুপ করে বোস তুই!!আমি কথা বলছি...
-কথা!!ওই রাস্তার মেয়েছেলের সঙ্গে আবার কথা...
-তুই যা!!গেলি?
সঙ্গের মহিলার ধমকের চোটে পূর্ববর্তী মহিলাটি গজগজ করতে-করতে রাজু দার দেওয়া চেয়ারে গিয়ে বসলো।খেঁকিয়ে উঠলো ঝোরা,
-আপনার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই!কে আপনি?আপনাকে চিনি না-জানি না!!আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলার সাহস আপনাদের...
-প্লিজ!!দু-মিনিট একটু আমার কথা শোনো!আমি দিচ্ছি তো আমার পরিচয়!সময়টা কোথায় পেলাম বলো?তোমাকে দেখেই দিদি যা শুরু করে দিয়েছে!আমি তোমার থেকে বয়সে-অভিজ্ঞতায় অনেকটা বড় ঝোরা।একটু অন্তত দাঁড়িয়ে আমার কথাটা শোনো।একটু সময় দাও আমায়...
-বলুন কি ব্যাপার?
-তোমার সঙ্গে একটু আলাদাভাবে কথা বলা যাবে?
প্রিয়মের দিকে একবার চেয়ে উনি বললেন।কিন্তু প্রিয়ম নিজের জায়গা থেকে এক-পাও নড়লো না।ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো...ঝোরা খেঁকিয়ে উঠলো,
-না!যা বলার এখানেই বলুন!আমি আর আমার বন্ধু আলাদা কিছু নই।বলার হলে বলুন,নইলে ফুটে যান...
-আচ্ছা-আচ্ছা!!আসলে আমি চাইছিলাম না তোমার বন্ধুর সামনে সবটুকু...
-এই রাজু দা,হটাও তো এদের...যত্তসব ঝামেলা!আমি আসার আগেই সরাও নি কেন?প্রিয়ম,আমি পার্কিংয়ে ঢুকলাম...
-হ্যাঁ ঝোরা,যাও!আমিও বেরিয়ে যাই!ডিসগাস্টিং!!
-দিদি,আপনারা আসুন...রাস্তা এইদিকে...
রাজু দা ওনাকে ঝোরার মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নিতে যায়...গালাগালি দিতে-দিতে উঠে আসে চেয়ারে বসে থাকা মহিলাটিও...
-ঝোরা,একবার প্লিজ আমার কথাটা শোনো!আমি অরিত্রর মাসিমনি!একটু দাঁড়াও...
স্কুটি স্টার্ট দিয়েই একটুখানি এগিয়েই আবার ব্রেক মারে ঝোরা।ওইখানেই স্কুটি ফেলে রেখে দৌড়ে নেমে আসে ও...প্রিয়মও সংঘাতিকভাবে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে...
অরিত্র!!অরি!!এই নামটাই তো একটু আগে ও ঝোরার মুখে শুনলো...
-কে?কে আপনি?
-আমি অরিত্রর মাসি ঝোরা।আর উনি আমার নিজের দিদি,অরিত্রর মা...
-আপনি এইদিকে আসুন দিদি...
-রাজু দা,এক মিনিট-এক মিনিট!দাঁড়াও...ছেড়ে দাও!আমি দেখছি!সরি!!আই এম সো সরি!!কি ব্যাপার?কি হয়েছে?অরি ঠিক আছে তো?আপনারা হঠাৎ এইভাবে...
ততক্ষণে প্রিয়ম একেবারে ঝোরার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।অরিত্রর মাসি এবার ঝোরার হাত ধরে বললো,
-প্লিজ,তোমার সঙ্গে দুটো মিনিট কথা বলা যাবে?একটু আলাদাভাবে?প্লিজ...
-হ্যাঁ....নিশ্চয়ই!প্রিয়ম,প্লিজ এক্সকিউজ আস!তুমি বরং বেরিয়ে যাও।বাইকটা নিয়ে এসো!আপনি প্লিজ আসুন আমার সঙ্গে...
অরিত্রর মাসিকে সঙ্গে নিয়ে ঝোরা এগিয়ে গেলো পার্কের একটা বেঞ্চের দিকে।কয়েক মুহূর্ত প্রিয়ম ওইদিকে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে এলো গেটের বাইরে...
গভীর চিন্তায় তখন ওর কপালে একাধিক ভাঁজ পড়েছে...
রাগে-অপমানে-ঘৃণায় থরথর করে কাঁপছিলেন অরিত্রর মা।এবার একমাত্র ছেলের চিন্তায় শরীরের সবটুকু শক্তি হারিয়ে,কাঁপতে-কাঁপতে চোখ মুছে উনি আবার চেয়ারে গিয়ে চুপ করে বসে রইলেন...
-কি ব্যাপার?প্লিজ বলুন আমায়,কি হয়েছে অরির?
কাতরভাবে জিজ্ঞেস করলো ঝোরা...
(চলবে....)
বইটি সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

 

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট