অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

অসমাপ্ত (দ্বিতীয় পর্ব)



অসমাপ্ত

দ্বিতীয় পর্ব

সাথী দাস


-কিরে?পড়াশোনা কেমন চলছে?দিনরাত তো গিটারটাকে বুকে নিয়ে বসে আছিস!!পড়ছিস কখন?

ভেজিয়ে রাখা দরজা বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে ছেলের ঘরে ঢোকেন সমুদ্রর বাবা।
-পড়ছি তো বাবা!চলছে পড়াশোনা।
কোল থেকে গিটারটা বিছানার ওপর নামিয়ে রাখলো সমুদ্র।
-না শোন,ওসব চলছে-দৌড়চ্ছে বললে কিন্তু হবে না।এই রেজাল্টের ওপরেই তোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে...
-হুম!জানি!
-আমার কিন্তু একটা দুর্দান্ত রেজাল্ট চাই।
-হুম!
মাথা নামিয়ে নিলো সমুদ্র।
বাবা এগিয়ে গিয়ে ছেলের পিঠে হাত রেখে বললো,
-আর এসব শখ-শৌখিনতা এখন পরীক্ষার আগে কটা মাস একদম ছেড়ে দে,বুঝলি!!
-মানে?বুঝলাম না বাবা!
-এই যে গিটার-গিটার,গান-গান করে দিনরাত নেচে বেড়াস,তারপর ওই কি স্প্যানিশ গিটার না পিয়ানো,হাওয়াই না কিসব যেন বলে,ওসব ক্লাসে যাস,ওইসব এখন ছেড়ে দে।এখন শুধু পড়াশোনায় মন দে....কারণ....

আর শুনতে পারছে না ও।হৃদস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো সমুদ্রর।দাঁতে-দাঁত চেপে ঢোঁক গিলে,ও চোখের জলটা আটকানোর প্রবল চেষ্টা করলো।তবু মুখ ফুটে বাবাকে একটাও কথা বললো না।
-কিরে?বুঝলি!!

এবার মুখ খুললো সমুদ্র।ধরা গলায় বললো,
-আর কটাদিন থাক না বাবা!আমি পড়ছি তো,মন দিয়েই পড়ছি।ওগুলো আমার কোনো ক্ষতি করবে না,বরং ওগুলো আমার কাছে একটু অক্সিজেন!পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে সব ছেড়ে দেবো,প্রমিস!এখনও তো পরীক্ষার অনেকটাই দেরি আছে।
-নানা!আমি বেশ কদিন ধরেই দেখছি,তুমি ওগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ সমু।বড় হচ্ছ,জীবনের প্রায়োরিটিগুলো বুঝতে শেখো।ওসব শখ-শৌখিনতা কিন্তু তোমার পেটের ভাত জোগাড় করে দেবে না।তার জন্য বইয়ের মধ্যে মাথা-মুখ গুঁজে পড়তে হবে।
-গানকেও তো অনেকে প্রফেশন হিসেবে....
-শোনো সমু,ওসব আমাদের মতো সাধারণ ঘরে হয় না।আমাদের এসব গান-বাজনার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই।তুমি যেন আবার হঠাৎ করে এসব বেয়াড়া চিন্তাভাবনা মাথায় জায়গা দিয়ে বোসো না।শখ করে গিটার হাতে নিয়ে দিনরাত টিং-টিং করলেই,কেউ কিন্তু গায়ক হয়ে যায় না।সবকিছুর একটা শিকড় লাগে।নিজের জায়গাটা বুঝতে শেখো।শখ আর প্রয়োজনের মধ্যেকার পার্থক্যটা বোঝার চেষ্টা করো।গানবাজনা তোমার শখ,আর রুজি-রোজগার তোমার প্রয়োজন।চুপচাপ পড়াশোনায় মন দাও।আমাকে যেন তোমার প্রতি কঠিন হতে না হয়।এরপর রাত-বিরেতে তোমার ঘর থেকে ওই গিটারের শব্দ পেলে,আমি কিন্তু ওটাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতে বাধ্য হবো।

ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি করে গিটারটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো সমুদ্র।

-হ্যাঁ!মনে থাকে যেন!ওটাকে কাছে রাখতে গেলে,আমার কিন্তু একটা দুর্দান্ত রেজাল্ট চাই!বাঁধিয়ে রাখার মতো রেজাল্ট!এমনিতেই সায়েন্স নিতে বললাম,কিছুতেই নিলে না।জেদ করে কমার্সই নিলে!ঠিক আছে,যেটা তোমার কাছে সাবলীল লাগে,সেটাই তুমি করেছো।কিন্তু এবার যেটা পড়ছো,সেটা মন দিয়ে পড়ো।পড়াশোনার পাশাপাশি গান-বাজনা থাকবে,পড়াশোনার ঊর্ধ্বে কখনোই নয়।তুমি এই সৌরকেই দেখো।তোমারই তো বন্ধু।ওর কতো ডেডিকেশন নিজের প্রত্যেকটা কাজের প্রতি,কত ডিসিপ্লিনড।ও কি এইভাবে দিনরাত ঘরের মধ্যে হাঁ-হাঁ করে গান-বাজনা চালিয়ে বসে থাকে!!কত ব্রাইট ছেলে!!সে যাকগে,অন্যের ছেলেকে আমার দেখার দরকার নেই।আমি তোমাকেই বলছি,এবার কিন্তু একটু উঠেপড়ে লাগো,বুঝলে?
-হুম!!
গিটারটাকে আঁকড়ে ধরে সমুদ্র বললো।বাবা ওর একমাথা কোঁকড়ানো চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলো....অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা চোখের জলটা গাল বেয়ে গড়িয়ে এলো।ফোনটা হাতে নিয়ে একবার দেখলো সমুদ্র।গতকাল রাতেই একটা গানের কথা লিখছিলো ও,কিছুটা সুর দেওয়াও হয়ে গেছে।কিন্তু কয়েকটা জায়গায় বারংবার আটকে যাচ্ছিলো ও।নিজের অসমাপ্ত কাজটার দিকে চেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র।বুকের ভিতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছে।গিটারটা বিছানার ওপর রেখে,ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে,সমুদ্র খোলা ছাদে উঠে গেলো....

মনটা বড্ড ভারী হয়ে রয়েছে সমুদ্রর।পড়াশোনা বিশেষ মাথায় ঢোকে না ওর।দিনরাত কানে বাজতে থাকে,রকমারি গানের অন্তরা-মুখরা....এবার ওই গানটাকে ধরে রাখতে গেলে,ওকে পড়াশোনা করতেই হবে।বাড়িতে কেউ জানে না,এমনকি বন্ধুরাও না....
সবার অজান্তে গতকালই একটা জায়গায় অডিশনের জন্য নিজের খালি গলার গান,রেকর্ড করে পাঠিয়েছে সমুদ্র।স্টুডিও-রেকর্ডিং হলে বেশি ভালো হতো,কিন্তু সেসব ও আর কার কাছে চাইবে!!এই তাই বাবা-মা গান ছাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছে।ভয়েজ-নোটটা পাঠানোর পর থেকেই,প্রতি ঘন্টায় ই-মেইল চেক করছে সমুদ্র।নিশ্চিত জানে হয়তো সুযোগ পাবে না,তবু যদি পায়!!ক্ষীণ একটা আশা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে বারংবার....

অন্যমনস্কভাবে ছাদের ওপর সমুদ্র ঘুরে বেড়াচ্ছিলো।হঠাৎই ওর চোখে পড়ে গেলো,বাবার নিজের হাতে পরিচর্যা করা,সযত্নে প্রতিপালিত রকমারি ফুলের মধ্যে,একমাত্র ওই রক্তগোলাপের গাছটার দিকে।সবুজ-সবুজ পাতার আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করছে, সবুজ বৃন্তের মধ্যে ছোট্ট একটা লালচে কুঁড়ি!আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো সমুদ্র।হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো ওই নির্দিষ্ট টবটার সামনে।বহুযত্নে আদর করে হাত রাখলো গাছটার গায়ে।মনটা নিমেষেই শরতের আকাশের পেঁজা তুলোর মতো,একদম ফুরফুরে হয়ে গেলো।মনখারাপের মেঘগুলো যে কোন রাজ্যে পাড়ি দিলো,জানা নেই সমুদ্রর।বাবা এখন ছাদে উঠবে না,সন্ধ্যের একটু আগে উঠবে,গাছে জল দিতে।একটু এদিক-ওদিক চেয়েই জল দেওয়ার পাইপটা চোখে পড়লো সমুদ্রর।ছাদের এককোণে সাপের মতো এঁকেবেঁকে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।ও ওটাকে হাতে ধরে অপর প্রান্তটা গুঁজে দিলো কলের মুখে।কল খুলে দিয়ে একটু-একটু করে ভিজিয়ে দিলো রক্তগোলাপের গাছটাকে।কোনোদিন বাবার কোনো ফুলগাছে,ভুল করেও হাত দেয়নি সমুদ্র।কিন্তু এটা ও চুরি করবেই...নিজের হাতে যত্ন করবে এই গাছটার।তারপর যখন বৃন্ত থেকে প্রস্ফুটিত হয়ে প্রকাশিত হবে সদ্যফোটা রক্তাক্ত গোলাপ,শিশির-ভেজা গাছের প্রথম এই রক্তগোলাপটা ও রানী ম্যামকে দেবেই।কিনে তো অনেকই ফুল দিলো।কিন্তু যেদিন লাল গোলাপটা দেবে,সেদিন নিজের সবটুকু আদর দিয়ে,পরম যত্নে ফোটানো,বাড়ির গাছের গোলাপই দেবে।অনাগত আগামীর জন্য আজ থেকেই সমুদ্র পরিচর্যা শুরু করলো ফুলগাছটার....

পকেটে ফোনটা বেজে উঠতেই ও দেখলো ফোনের স্ক্রিনে ঋষির নামটা নাচছে।কলটা বন্ধ করে সমুদ্র ধরলো ফোনটা।
-বেরোচ্ছিস ঋষি?
-হ্যাঁ!কিন্তু আকাশের অবস্থা দেখেছিস?

মাথার ওপর আকাশের দিকে চাইলো সমুদ্র।অন্ধকার হয়ে আসছে।লম্বা-লম্বা নারকেল গাছের পাতা,আর সুপারি গাছগুলো এদিক-ওদিক দুলছে।এতক্ষণ গোলাপ গাছটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায়,ওপর দিকে চেয়েই দেখেনি সমুদ্র।এখন দেখলো,আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসছে,সেই সঙ্গে মৃদুমন্দ শীতল বাতাসও বইছে।সমুদ্রের চশমার কাঁচের ওপর কি একফোঁটা বৃষ্টির জল এসে পড়লো!!জানা নেই!কিন্তু ওর মনটা ভিজে গেলো নিদারুণ ভালোলাগায়....একটু হেসে সমুদ্র বললো,

-ভালোই তো ঋষি!আজ কাদার মধ্যে জম্পেশ করে ফুলবল লাথাবো।রেডি হয়েই যাচ্ছি....চল-চল!!বেরো।আমিও বেরোচ্ছি!
-কি ব্যাপার রে সমু?মনে হচ্ছে,বিশাল মুডে আছিস আজ!!কিরে?কি ব্যাপার?
-গান পাচ্ছে ভাই!!
-মানে!?
-মানে ভীষণ গান পাচ্ছে!শুনবি ভাই?!

মৃদু হেসে উঠলো সমুদ্র...ঋষি বুঝতে পারলো,নিশ্চয়ই সমুদ্র নতুন কোনো গান বেঁধেছে।গান পেলে পাগল হয়ে যায় ছেলেটা।তখন ওর মস্তিষ্ক কম কাজ করে,আবেগ-অনুভূতি জোরালো হয়ে ওঠে...গলাখানাও খাসা,একেবারে দরাজ গলা।কত রাত এমন গেছে,পড়ার নামে ওরা চার বন্ধু একজায়গায় হয়েছে,তারপর সমুদ্রর গলায় গান শুনে,সৌরর মতো কঠিন ছেলেরও চোখের পাতা ভিজে উঠেছে অজান্তেই....আর একটাও কথা বলতে পারতো না ওরা।চুপ করে সমুদ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতো,
"তুই গানটা কিন্তু কোনোদিনও ছাড়িস না ভাই!!"

মাথা নীচু করে নিতো সমুদ্র।মুখ লুকোতো সৌর বা ঋষির বুকে....বুঝতে পারলো ঋষি,আজও ছেলেটা গান বেঁধেছে।সমুর বাবা-মা প্রশ্রয় দেয় না ছেলের এসব পাগলামি!বন্ধুরা ছাড়া আর কাকেই বা বলবে ও!?কাকে শোনাবে!!ঋষি বলে উঠলো,
-শোনা ভাই!কি গান শোনাবি?

ছাদে রক্তগোলাপ গাছটার পাশে জোড়াসন করে বসে পড়লো সমুদ্র।কুঁড়িটার গায়ে আলগা করে হাত রাখলো, ওর চোখের কোণে চকচক করছে একটু জল....

গলাটা একটু পরিষ্কার করে ও গাইতে শুরু করলো,

-তোমার হৃদয়ের ঠিকানা/আজ বুঝি কোনো অজানা কারণে নিরুদ্দেশ,
ভয় নাই,ভয় নাই প্রিয়ে.....
কোনো একদিন/জানবেই তুমি,
কারও কাছে/তুমি কতখানি বিশেষ....

সেদিন তোমার হৃদয়ের গলি ছুঁয়ে যাবে/কোনো এক রক্তগোলাপের লাল.....
কাঁটার স্পর্শটুকু আমারই থাক/
অনুরাগের লালে/তোমার ওই কোমল হৃদয়
রক্তিম হয়ে থাকুক/চিরকাল....
তুমি কি সেদিন করবে সমর্পণ,তোমার ওই হৃদয়/তারই কাছে অবশেষ!?

ভয় নাই,ভয় নাই প্রিয়ে....
কোনো একদিন জানবেই তুমি/
কারও কাছে,তুমি কতখানি বিশেষ....

আকাশের অস্তরাগে/কোনোদিনও যদি খুঁজে পাও মোরে...
খোঁপার ওই রক্তগোলাপে হাত রেখে/
একটিবার মনে কোরো তারে....
কালো মেঘের আড়াল সরিয়ে,
সে স্পর্শ করবেই/তোমারে....
ঝরে গেলেও/ওই শুষ্ক ফুল/রেখে দিও সঙ্গোপনে...
ডায়েরীর গোপন ভাঁজে তুমি/লুকিয়ে রেখো গো আমারে...
একান্তে তোমার স্পর্শ ছাড়া,
আর কিছু সে/চায় না শুনিবারে....

তারে ক্ষণিক ভালোবেসে/তুমি করবে কি/নিজেরে সমর্পণ/অবশেষ....
ভয় নাই,ভয় নাই প্রিয়ে....
কোনো একদিন জানবেই তুমি/
কারও কাছে/তুমি কতখানি বিশেষ.....

ভয় নাই,ভয় নাই প্রিয়ে....
কোনো একদিন জানবেই তুমি/
কারও কাছে/তুমি কতখানি বিশেষ....

শেষের দিকে গলাটা ধরে এসেছিলো সমুদ্রর।চোখ থেকে একটু জলও বুঝি বেরিয়ে এলো।বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা দাড়ি,আর ব্রণতে ঢাকা গালের উপত্যকায় হারিয়ে গেলো চোখের একফোঁটা জল....
চশমাটা খুলে চোখ আর গালটা মুছে,নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সমুদ্র বললো,

-বল ভাই?কেমন?ঋষি?কিরে?
-হুম!কি?
সমুদ্রর কণ্ঠের মাদকতায় হারিয়ে গিয়েছিলো ঋষি....ওর ডাকে আবার বাস্তবে ফিরলো....
-তুই শুনিসনি?তাই না!!
-শুনছিলাম বলেই তো হারিয়ে গিয়েছিলাম!
-তাই?শুনলি?কেমন হয়েছে রে?কাল থেকে কতবার মেলানোর চেষ্টা করছিলাম,কিছুতেই পারছিলাম না জানিস!!আজ একটা রক্তগোলাপের কুঁড়ি,আর একটু মেঘে ঢাকা আকাশ যেন,তৈরীই হয়েছিলো আমার অসমাপ্ত কাজটুকু সম্পূর্ণ করার জন্য....ঋষি?কেমন হয়েছে রে?
-দারুণ ভাই!!তবে একটা কথা ভীষণ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু বললেই তো তুই আবার খিস্তি মারবি!
-কি?না-না,কিছু বলবো না!বল না!!
-গানটা কার জন্য ডেডিকেটেড ভাই?

হেসে ফেললো সমুদ্র....

উফফ!!কাল তার ক্লাস নেই।সেই সকালে একবার মাত্র একটুখানি দেখা হবে।তারপর যে চল্লিশ মিনিট তাকে পাওয়া যায়,সেটা কাল আর হবে না।ক্লাসে ম্যাম যখন পড়ান,সমুদ্রর একটা বর্ণও মাথায় ঢোকে না।ও তো শুধু হাঁ করে ওনাকেই দেখে।একবার পড়ানোর জন্য সমুদ্রর ইংরেজি বইটা নিয়েছিলেন রানী ম্যাম।বইতে কয়েকটা জায়গায় পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েও দিয়েছিলেন।এই ব্যাপারটা বড্ড অপছন্দ সমুদ্রর।বইতে দাগ দেওয়া,বইয়ের পাতা মুড়ে রাখা,বইয়ের কোনোরকম অযত্ন ও একদম সহ্য করতে পারে না।তা সেটা পড়ার বই হোক,বা গল্পের বই!কিন্তু ওই ইংরেজি বইয়ের ওই দুটো নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা,সেদিন বাঁধিয়ে ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছিলো।এমনকি সেদিন স্কুল থেকে বাড়িতে এসে,সারাদিন ও শুধু ইংরেজিই পড়েছে,আর গোটা বইয়ের ওই দুটো নির্দিষ্ট পাতাই।বইতে কি লেখা ছিলো,সেসব তো আর ঠিকমতো পড়তেই পারেনি ও।চোখের জলে ছাপার অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে বারংবার।শুধু দাগ দেওয়া জায়গাগুলোতে হাত রেখে চুপ করে বসেছিলো ও।বইটা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো সারারাত....আর আজ ঋষি জিজ্ঞেস করছে,কার জন্য এই গান?!

-কিরে?সমু?বল!কাকে ভেবে লিখেছিস গানটা?
-চল বেরো!আমিও বেরোচ্ছি ঋষি।বৃষ্টিটা আসার আগেই বেরিয়ে পড়ি চল!একবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে,মা বিশাল চিৎকার করবে!আটকে দেবে!আর বেরোতেই পারবো না।চল...চল...বেরো!

লাইনটা কেটে দিলো সমুদ্র।হেসে ফোনটা রেখে দিলো ঋষিও!

"পাগল একটা!ওই ম্যাম-ম্যাম করেই তুই মরবি রে ভাই!তার তো কিছুই হবে না!কিন্তু আজকাল তুই যেরকম পাগলামি শুরু করেছিস,নিজেই শেষ হয়ে যাবি!কিন্তু তোকে বোঝাবে কে?!কেউ কিছু বলতে গেলেই তো,খিস্তির বন্যা বইয়ে দিবি!বলা যায় না,হাত-পাও চালিয়ে দিতে পারিস!যা রাগ তোর!"

বকবক করতে-করতে গা থেকে স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে,আলনা থেকে খেলার গেঞ্জিটা টেনে গায়ে গলিয়ে নিলো ঋষি।ঘরের আলো-পাখা বন্ধ করে,কম্পিউটার টেবিলের ওপর থেকে সাইকেলের চাবিটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে চেঁচালো,
-মা....আমি একটু মাঠে যাচ্ছি!
বলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঋষভ.....

চোখে চশমাটা পরে নিয়ে,একবার খোলা আকাশের দিকে চেয়ে,ছাদ থেকে নেমে পড়লো সমুদ্র...

-থ্যাঙ্কু রূপ!
রংচটা একটা হলদেটে রঙয়ের টপ আর সবুজ স্কার্ট পরে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো নিশান্তিকা।ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে পরনের পোশাকের সঙ্গে-সঙ্গে ওর চুলও ভিজে গেছে।মাথায় তেলতেলে চুলগুলো টেনে একটা সুবৃহৎ খোঁপা করা,গায়ের রং তামাটে।ভ্রূজোড়া বুঝি নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া প্রসাধনের স্পর্শ পায় না।তাই ভীষণ অগোছালো তারা।বড়-বড় চোখদুটোর কোলে গভীর কালি।গালদুটো একটু বসা।কণ্ঠার হাড় একটু উন্নত।নিশা যে মাকে নিয়ে এতক্ষণ ভীষণ চিন্তায় ছিলো,সেটা ওর শুকনো মুখটা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।নইলে নিতান্ত দিশেহারা না হলে,নিশা কিছুতেই রূপের সাহায্য নিতো না।ভীষণই খারাপ লাগলো রূপের....

রূপ সাইকেল নিয়ে মাঠেই যাচ্ছিলো,মাঠের উল্টোদিকের গলিতেই নিশার বাড়ি।হঠাৎই রূপ দেখলো,গলি থেকে বেরিয়ে,রিক্সা করে নিশা ওর মাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।দেখেই ও সাইকেলে ব্রেক মেরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।দৌড়ে গেছে ওদিকে।নিশার মায়ের হাতের দুটো আঙুল,সবজি কাটতে গিয়ে কেটে গেছে অনেকখানি।রক্ত বন্ধই হচ্ছে না।নিশা একটা রিক্সা ডেকে মাকে নিয়ে ওষুধের দোকানে যাচ্ছিলো,টিটেনাস নিয়ে আগে একটা ব্যান্ডেজ করাতেই হবে মায়ের হাতে।নইলে রক্ত বন্ধ হবে না কিছুতেই।মাংসটা সরে গিয়ে অনেকখানি জায়গা হাঁ হয়ে গেছে।রূপ দেখলো,নিশা আজ আর ওকে সেভাবে এড়িয়ে গেলো না।বরং ও কথা বলতে এগিয়ে গেলে,বেশ ভালোভাবেই কথা বললো ওর সঙ্গে।রূপ সঙ্গে আসতে চাইলেও,বারণ করলো না নিশা।ওরা রিক্সা করে বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপের খেয়াল হলো,ওর কাছে তো একটা টাকাও নেই।সঙ্গে গিয়ে কি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে?!মাঠে এসেছে বলে টাকা বা ফোন সঙ্গে আনার কথা মাথাতেও আসেনি!তাড়াতাড়ি করে মাঠের পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানটার পরিচিত কাকুর থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে,সাইকেলে চেপে বসেছিলো রূপ।কাকিমার হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে,ওষুধ কিনে,আবার রিকশা করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে,এখন ও বেরোচ্ছিলো নিশার বাড়ি থেকে।বাড়ি বলতে তেমন কিছুই না।ইঁটের দুটো ছোট-ছোট ঘর।তাও প্লাস্টার করা নেই।ইঁট বেরিয়ে রয়েছে।ঘরের সামনেই একটা টগর ফুলের ঝাঁকড়া গাছ,তার পাশেই তুলসীমঞ্চ আর শ্যাওলাধরা কলতলা।কলতলায় একটা টিউবওয়েল দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রহরীর মতো।ঘরের ভিতরের দরজা-জানালায় গ্রিল বসানো।ভারী পর্দা দেওয়া।মাকে ঘরে শুইয়ে রেখে,নিশা বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো রূপের সঙ্গে।

-শোন নিশা।ওসব থ্যাঙ্কু বাদ দে।একদম যেন না শুনি ওসব।এত ফর্মালিটি কিসের?কোনো অসুবিধে হলেই আমাকে একটা ফোন করবি!মনে থাকবে?
-হুম!তুই একবার দেখেই ছুটে এলি রূপ!আর নিজের মানুষগুলোকে দেখ।বড়দাভাইয়ের বাইক রয়েছে।জ্যেঠুমনিও বাড়িতেই থাকে এই সময়।মাকে কি একটু নিয়ে যেতে পারতো না?!সামনের দরজা দিয়ে গিয়ে,জেম্মাকে কতবার ডাকলাম,দরজাই খুললো না।মা হাত চেপে ধরে বসে রয়েছে রান্নাঘরে।রক্ত বন্ধ হচ্ছে না দেখে,ভয়ের চোটে আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম।কিন্তু ও বাড়ি থেকে একটা মানুষও বেরোয়নি।ওদের ঘরের পাশের সুবিশাল উঁচু পাঁচিলের দিকে চেয়ে নিশা বললো।

রূপ একবার ওদিকে চেয়ে দেখলো।তারপর একবার মাত্র ঘরের দিকে চেয়ে,একটা সিঁড়ির ধাপ ভেঙে ওপরে উঠে,নিশার আরও কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।ওর দুটো হাত চেপে ধরে বললো,
-শোন!ওসব জ্যেঠিমা-কাকিমা ছাড়!তোর নিজের কেউ তোর পাশে থাকুক বা না থাকুক,আমি আছি!!দেখ নিশা,আজ তো আমার সেরকম কোনো ক্ষমতা নেই।তাই আর্থিক দিক থেকে বড়সড় কিছু সাহায্য তো করতে পারবো না।কিন্তু টাকাই কি সব?মানুষের তো জনেরও প্রয়োজন হয়।সেইখানে আমি আছি।যখন দরকার,যেভাবে দরকার,তুই শুধু আমাকে একটা ফোন করে দিবি,আমি চলে আসবো...একদম মন খারাপ করবি না।বুঝলি?ওই মেয়ে...বুঝলি!!
-হুম!!রূপ শোন?সত্যি করে একটা কথা বলবি?
-কি?
-রুমাদির টিউশনে আমার কিছু টাকা বাকি পড়ে গেছিলো,দুমাসের টাকা।রুমাদি মাকে জানাতে বলেছিলো।সেদিন তুইও দাঁড়িয়ে ছিলি ওইখানে।সবাই বেরিয়ে আসার পরও তুই বেরোসনি।দুদিন পর আমি যখন দিদিকে টাকাটা দিতে গেলাম,দিদি আর নিলো না।দিদি বললো,থাক,তোর মায়ের শরীর খারাপ,দিতে হবে না।আমার বিশ্বাস হয় না।মায়ের শরীর তো বরাবরই খারাপ থাকে।তবে দুদিন আগে দিদি মাকে দেখা করতে বলবেই বা কেন?!রূপ?
-হুম?
-টাকাটা তুই দিয়েছিস,তাই না?

চমকে উঠে মাথা নামিয়ে নিলো রূপ....
-কেন করছিস এসব?
-তুই যদি মনে করিস,এসব করে তোকে পেতে চাই,তাহলে তুই কিন্তু ভুল বুঝবি আমায়।বরং ব্যাপারটা একেবারেই উল্টো।আমি তোকে ভালোবাসি,তাই এসব করি।তোকে জানিয়েই হোক,বা তোর অজান্তে,আমি শুধু পাশে থাকতে চাই তোর।ওই দুটো চোখে জল এলে,আমার মাথার ভিতরটা যন্ত্রণায় ফেটে যায়।আমার সাধ্যের বাইরে হলে,আমায় তো দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখতেই হতো নিশা।কিন্তু যেটুকু পেরেছি,সেটুকুই করেছি।আগে বন্ধুদের পিছনে টাকা ওড়াতাম,অকারণে নিজের শখ-শৌখিনতাতেও খরচ করতাম একটু-আধটু।এখন প্রতিমাসে বাবার দেওয়া হাতখরচের টাকা থেকে,যতটা সম্ভব খরচ কম করে কিভাবে হাতে একটু টাকা রাখবো,সেই চিন্তাটা মাথায় সবসময় ঘোরে।যদি তোর কোনো কাজে লাগে...সেই সময়ে আমি যেন,সামান্য কিছু হলেও বের করতে পারি।তুই ওসব একদম ভাবিস না....
-রূপ করিস না এসব!এভাবে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে,কি প্রমাণ করতে চাস তুই?
-ভালোবাসি,এটা টাকা দিয়ে প্রমাণ করা যায় না রে পাগলী।আমি শুধু এটুকু জানি,আমার অবস্থাও তেমন কিছুই না।মা-বাবা-বোন সবার দায়িত্ব কাল আমার মাথার ওপরেই আসতে চলেছে।আমার লড়াইটাও তোর মতোই কঠিন।তাই আমি বুঝি তোকে।নিজের বলতে আজ আমার তেমন কিছুই নেই।তাও আজ তুই ভালোবেসে আমার হাত ধরলে,যেদিন আমার সব থাকবে,সেদিন তোকে বুঝিয়ে দেবো,আমি তোকে কতটা ভালোবাসি!এর মধ্যে দিয়েও সামান্য একটু কিছু তোর জন্য করতে পারলে,আমার ভালো লাগে রে...কিন্তু তার মানে এই নয়,সেই কারণে কুণ্ঠিত হয়ে,তোকে আমায় গ্রহণ করতে হবে!!একদমই সেটা নয়।আমি যতবার তোর সামনে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এসে দাঁড়াবো,ততবার আমি তোর প্রেমিক।বাকি যখন তোর অজান্তে তোকে সাহায্য করবো,তখন কিন্তু তোর বন্ধু।সেখানে কিন্তু কোনো প্রেমের দাবী নেই নিশা।এবার তুই আমাকে আজীবন বন্ধু হিসেবে তোর পাশে রাখবি,না ভালোবেসে তোর জীবনে একটুখানি জায়গা দিবি,সেই সিদ্ধান্ত তোর।তবে আমি এটুকুই বলবো,যতবার তুই আমাকে ফেরাবি,ততবারই আমি আবার তোর সামনে এসে দাঁড়াবো।আর ওই একই কথা বলবো....আমি তোকে ভালোবাসি নিশা!

মাথা নামিয়ে নিলো নিশা।ও চায় না,ওর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলটা,রূপ দেখে ফেলুক।কিন্তু রূপ বুঝতে পারলো,ও আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ালে,নিশা কেঁদে ফেলবে,বা হয়তো কেঁদে ফেলেছেও।নিশার মাথায় একটা হাত রেখে ও বললো,
-যা!ঘরে যা!রাতে মায়ের জ্বর এলে,ওষুধটা খাইয়ে দিস।যা,ভিতরে যা।আমি এলাম।মাঠে ওরা বসে এতক্ষণে আমায় গাল দিয়ে উদ্ধার করে দিচ্ছে।আমার সঙ্গে ফোন নেই।আমি এখন মাঠে আছি।রাতে বাড়ি ফিরে তোকে ফোন করছি.....যা!!

সাইকেল নিয়ে মাঠের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো রূপায়ণ....ওর দিকে একভাবে চেয়ে রইলো দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা নিশান্তিকা....

-কিরে রূপ?বাড়িতে ঘড়ি নেই?আর একটু পরে এলেই পারতিস!এরপর তো ড্রাম নিয়ে প্যারেড শুরু হয়ে যাবে।কোথায় খেলবো তখন?

বৃত্তাকারে সম্পূর্ণ মাঠটাকে প্রদক্ষিণ করে বেশ কয়েক পাক দৌড়াচ্ছিলো সৌর।রূপকে মাঠে ঢুকতে দেখেই,দৌড়োতে-দৌড়োতেই চিৎকার করে উঠলো ও...

-এই সৌর,দাঁড়া তো!মুখটা লটকে আছে কেন ওর!!নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।কি হয়েছে রে রূপ?আমাকে বল!

ঋষি উঠে এলো মাঠের সবুজ ঘাস ছেড়ে....তিন মাথা একজায়গায় হলো।সৌরও ছুটে এসে যোগ দিলো ওদের সঙ্গে....

-হ্যাঁ তো ঠিক আছে।এখন নিশার মা ঠিক আছেন তো?
ঋষি বললো।
-হুম!
-তাহলে তুই এত আপসেট কেন?
-নিশা ভালো নেই ঋষি।আমি চলে আসার আগে ও কাঁদছিলো।
ঋষি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো রূপকে.....
-ঠিক আছে।সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই।সত্যি!!কি অবস্থা!!পাশে নিজের লোক থাকতেও,সময়ে-অসময়ে কোনো কাজে লাগে না।
-ওর জ্যেঠিমাদের সঙ্গে নাকি মুখ দেখাদেখিও বন্ধ!!
মাথা নীচু করে বললো রূপ....
-ঠিক আছে।তুই একদম আপসেট হবি না রূপ।ওর পাশে তুই আছিস,আর তোর পাশে আমরা আছি ভাই।এত ভাবছিস কেন তুই?!নিশা তোর হবু বউ!আর তোর বউ মানে তো আমাদেরও....ইয়ে মানে বন্ধু!!নিশা তো আমাদেরও বন্ধু নাকি!?

-হারামি!!জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেবো তোর!কি বলতে যাচ্ছিলি তুই?!
এক ধাক্কায় ঋষিকে সরিয়ে দিলো রূপ।রূপের কাছে ধাক্কা খেয়ে হাসতে-হাসতে মাঠে শুয়ে পড়লো ঋষি....সৌর আর সমুদ্র হেসেই খুন....

-এই তো!এইবার ঠিক আছে।এই না হলে আমার রূপ!!তুই কোথায় আমাকে মারবি-ধরবি-শাসন করবি-খিস্তি মেরে রঞ্জার কাছে পাঠাবি!!তা না করে মুখ ব্যাজার করে বসে আছিস।আমার রূপকে এমনভাবে ভালোই লাগে না...এই রে!!বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো তো...
-আরে ভালোই তো ভাই!!বৃষ্টিতেই তো খেলতে মজা!চল-চল!ওরা কতবার ডেকে গেছে।রূপের জন্য আমরা যেতেই পারছিলাম না।

সমুদ্র-রূপ আর ঋষি ছুটতে-ছুটতে এগোলো বৃষ্টিভেজা মাঠের অপর প্রান্তে....কুকুরের বীভৎস ডাক শুনে ওদের সঙ্গে দৌড়ে যেতে-যেতেও,দৌড়োনোর গতিবেগ কমে গেলো সৌরর।একবার মাত্র ঘাড় ঘুরিয়ে ও যা দেখলো,তা ওর হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।বাঘের মতো সুবিশাল তেল-চকচকে একটা কুকুর বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে দৌড়ে আসছে।কুকুরটার বুঝি বৃষ্টি অপছন্দ।তাই তার এমন গগনবিদারী চিৎকার।কুকুরটার সঙ্গে-সঙ্গেই মাথায় একটা হাত রেখে ছুটতে-ছুটতে আসছে সে...সেই স্কুল থেকে ফেরার সময়,রাস্তায় দেখা হওয়া সে...কি যেন বলেছিলো নামটা...হ্যাঁ...তিলোত্তমা...

এখানে কি করছে ও...একবার বন্ধুদের দিকে চেয়েই একটু পিছিয়ে গেলো সৌর...
-এ ভাই,তোরা যা।আমি একটু হালকা হয়ে আসছি...

চিৎকার করে ওদের জানিয়ে,দৌড়ে ক্লাবের অপর প্রান্তের দিকে এগোলো সৌর...

ক্লাবের সামনে বড় খোলা বারান্দা।সামনেই বুঝি ক্লাবের বিচিত্রানুষ্ঠান।সেই উপলক্ষ্যে কচিকাঁচা-বাচ্চাদের নাচ-গান-কবিতা-নাটকের জোরদার মহড়া চলছে....সুইমিং না থাকলে এই মাঠেই খেলতে আসে সৌর।আর মাঠে এলে প্রায়দিনই এসব দেখে।ফিরেও তাকায় না!কিন্তু আজ আর থাকতে পারলো না।ও এখানে কি করছে!প্রবল কৌতূহল দমন করতে না পেরে,সৌর চলেই এলো ক্লাবের পিছন দিকটায়....

-এই যে ম্যাডাম!এই আমার মেয়ে,তিলোত্তমা।সেই ছোট্টবেলা থেকে দারুণ নাচে।ভরতনাট্যম!নাচ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না আমার সোনামা।দেখুন দেখি ম্যাডাম,ফাংশনে আপনার কোনো কাজে লাগে কিনা!তোকে ঘুঙুর আনতে বলেছিলাম,এনেছিস মা?
-এই যে বাবাই....
-ঠিক আছে দাদা,ও থাকুক।আমি রিহার্সাল শেষ হলে,নিজে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো।এসো তিলোত্তমা....

তিলোত্তমা ধীরপায়ে এগিয়ে যায় নাচের শিক্ষিকার দিকে।
-আরে নানা ম্যাডাম!আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।ওই যে আমার মেয়ের সঙ্গে রয়েছে ওর অতীন্দ্রিয় প্রহরী,টাইগার!ও একাই একশো।খবরদার ম্যাডাম!!ওর সামনে আমার মেয়ের ওপর কিন্তু একদম চিৎকার করবেন না!একটুও বকবেন না।আমার সোনামার ওপর কেউ চোখ গরম করে তাকালেও,ও কিন্তু তাকে ছিঁড়ে দু-টুকরো করে ফেলবে।

সশব্দে হেসে উঠে টাইগারের দিকে এক নজর চেয়ে দেখলেন ম্যাডাম।তিলোত্তমার পায়ে-পায়ে ঘুরছে বিশালাকার কুকুরটা।লম্বা গোলাপী জিভটা বাইরে ঝুলে রয়েছে অনেকখানি।চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে।তিলোত্তমার পায়ের কাছে এসে গুছিয়ে বসলো টাইগার।তিলোত্তমা নিজের সবুজ ওড়না দিয়ে ওর গায়ের আলগা জলটা মুছিয়ে দিতে লাগলো।টাইগার আরামে চোখ বুজলো...

লাল-নীল-হলুদ-সবুজ জংলী-ছাপার একটা ফুলহাতা চুড়িদার পরেছে তিলোত্তমা।হলুদরঙা প্যান্ট।বুকের ওপর সবুজ ওড়না...পিঠ পর্যন্ত চুল আলগা করে একটা খোঁপা করা...

-আপনি কি বাইরেই আছেন দাদা?
-নাঃ!দেখি।একজনের সঙ্গে আলাপ হলো,বললো আমায় ওদের ক্লাবে নিয়ে যাবে।একটু দাবার আসর না হলে,একটু রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে রক্ত গরম না হলে,আমার আবার বিকেলগুলো ঠিক জমে না,বুঝলেন ম্যাডাম!একজন পার্টনার পেয়েছি মনে হচ্ছে!যাই,দেখি সবার সঙ্গে একটু আলাপ-পরিচয় পর্বটা সেরে আসি।নিজের পাড়াতেও তো আমি একরকম অচেনাই।আমি এলাম রে মা...হয়ে গেলে বাড়ি চলে যাস....টাটা...
-বাবাই!যেখানে খুশি যাও,যা খুশি করো।চিনি দেওয়া চা কিন্তু বাইরে একদম খাবে না।সুগারের কথাটা যেন মাথায় থাকে...
-উফফ!তোর এই শাসনের চোটে,আমি নিজের নামটাই একদিন ভুলে যাবো মনে হয়।

হেসে ফেললো তিলোত্তমা...

বিপুল অবস্থাসম্পন্ন বাবার একমাত্র মেয়ে তিলোত্তমা।প্রায় তুলোয় ওপর সাজিয়ে রেখে,মেয়েকে মানুষ করেছেন বাবা-মা।মেয়ে মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই,তার সামনে এনে হাজির করেছেন কাঙ্খিত বস্তুটি।বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তিলোত্তমার চোখধাঁধানো রূপ,চূড়ান্ত অবাধ্যতা আর সেইসঙ্গে প্রচন্ড জেদ।তবে ওই হাসিমুখটুকু,ওই জ্বালাময়ী চোখের দৃষ্টি,আর ওই আবেদন,কোনো পুরুষের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়াটা একটু কঠিন।মেয়ের শ্বেতপাথরের মত মসৃণ পেলব গালটা আদর করে টিপে দিয়ে ওর বাবা বললো,
-ঠিক আছে সোনামা,আমি বাইরে কিচ্ছু খাবো না!হয়েছে?
-হয়েছে!এবার যাও!সাবধানে এসো।টাটা বাবাই...

পরম আদরের রাজকন্যাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে,বেরিয়ে গেলেন তিলোত্তমার বাবা....গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো টাইগার....

-তুমি কবে থেকে নাচ করো তিলোত্তমা?
-এই চার-সাড়ে চার বছর বয়স থেকে!একদম ছোট্ট থেকেই আন্টি....
-বেশ-বেশ!তুমি ফাংশনে একটা সোলো-পারফর্ম করবে?
-করবো আন্টি!
-তা কোন গানের ওপর করবে একটু দেখাও....

ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করে,ব্লুটুথ স্পিকারের সঙ্গে কানেক্ট করলো তিলোত্তমা....

চুপ করে ক্লাবের জানলার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলো সৌর....হঠাৎ করে ওর একেবারে পাশ দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো কি একটা....কেঁপে উঠলো ও।তারপরই দৌড়ে ওইখানে এলো রূপ!নারকেল গাছের আড়াল থেকে বেরোলো ও।অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে,দেওয়াল ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা সৌরর দিকেই।হাতে ঝোপঝাড় থেকে আবিষ্কার করা ফুটবল।
-ওই সৌর!!তুই মুততে এসে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
বিস্ময় মাখা কন্ঠস্বরে রূপের সটান প্রশ্ন,
-ইসস!!শালা কিভাবে ষাঁড়ের মতো চেলাচ্ছে!!চুপ!!

সৌর রূপের মুখ চেপে ধরে ওকে ওখান থেকে বের করে আনে,সেই সঙ্গে নিজেও বেরিয়ে আসে।ততক্ষণে রূপের হাত থেকে বল গড়িয়ে গেছে মাঠে...বলটায় একটা লাথি মেরে,সৌর দৌড়ে চলে যায় মাঠের দিকে।পিছন-পিছন ছোটে রূপ....
ততক্ষণে ক্লাবের বড় বারান্দায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তিলোত্তমার পছন্দের গান....

দুপায়ে ঘুঙুর বেঁধে নিলো তিলোত্তমা।ওড়নাটা বুকের ওপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে বেঁধে নিলো কোমরের একপাশে।গানের তালে-তালে প্রণাম করলো।মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন ম্যাডাম....

কোনো তাল পিছু ছাড়লো না তিলোত্তমা।দীর্ঘ অধ্যবসায়,কঠিন সাধনা,ও তীব্র ভালোলাগা না থাকলে,এভাবে প্রতিটি তালে,প্রতিটি মুদ্রায় নিখুঁতভাবে নিজেকে বন্দী করা যায় না....

-আরে সৌর মার.....
সমুদ্র চিৎকার করলো,ক্ষীণ একটা আওয়াজ কানে এলো সৌরর।কিন্তু কোথায় বল,কোথায় কি.....সেসব আর মাথায় নেই ওর।অন্যমনস্কভাবে কাদার মধ্যেই পা চালিয়ে দিলো সৌর...বল গোলপোস্টের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ঘাপটি মেরে আত্মগোপন করলো কচুবনে....

দৌড়ে এসে কাদার মধ্যে ফেলেই সৌরকে মারতে শুরু করলো রূপ....গেঞ্জি টেনে প্রায় ছিঁড়ে দিচ্ছে ওরা।কিন্তু ওদের হাত থেকে নিজেকে টেনে বের করে নিয়েও,ঘাড় ঘুরিয়ে কাদায় মাখামাখি সৌর চেয়ে রয়েছে দূরের ওই ক্লাবেঘরের বারান্দার দিকেই....ওর প্রতিটি মুদ্রা,প্রতিটি শরীরী বিভঙ্গ,প্রতিবারের ভ্রু ও চোখের তীব্রতায়,ঠোঁটের কোণের পরিমিত অথচ একচিলতে মৃদু হাসিতে,মুখের ওপরে-ঠোঁটের ওপরে এসে পড়া আলগা চুলের ঝাপটায়,দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সৌর।প্রতিটি তালে-প্রতিটি বিভঙ্গে ও হারিয়ে যাচ্ছে।তিলোত্তমার পায়ের ঘুঙুরের প্রতিটি ঝংকার যেন সৌরর বুকে বেজেই,প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে যাচ্ছে বারংবার।সৌর চোখই ফেরাতে পারছে না ওদিক থেকে,প্রতি মুহূর্তে হারাচ্ছে নিজেকে।ওর আশেপাশেই ঘুরছে বাঘের মতো কুকুরটা।শেষ মুহূর্তে যখন বৃত্তাকারে ঘুরতে-ঘুরতে গানের শেষ মূর্ছনার সঙ্গে থামলো তিলোত্তমা,মাথার আলগা করে বেঁধে রাখা খোঁপাটা ভেঙে পড়লো,ছিটকে বেরিয়ে গেলো ক্লিপটা।
একরাশ চুল ছড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমার বুকে-পিঠে...

ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে উঠে টাইগার ক্লিপের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগলো....

-অসাধারণ তিলোত্তমা!!
-থ্যাঙ্কু আন্টি!!

দুহাতে সবটুকু চুল একজায়গায় করে একটা হাতখোঁপা বেঁধে নিলো তিলোত্তমা...

-দুর্দান্ত!তুমি এটাই করবে সেদিন।অসুবিধে নেই তো?
-নাচে আমার কোনোদিনও কোনো অসুবিধে নেই আন্টি।বরং নাচ না থাকলে,আমি মরেই যাবো....
-বেশ-বেশ!

টাইগার লেজ নাড়তে-নাড়তে মুখে করে তিলোত্তমার ক্লিপটা নিয়ে এলো।সামনের দুটো পা তুলে দিলো ওর গায়ে....
-থ্যাঙ্কু টাইগার!!
টাইগারকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলো তিলোত্তমা...

-আবে শালা!তোর মন কোথায় আজ?গোল হতে-হতেও....ওই সৌর...
-ভাই!এক মিনিট ভাই!আমি আসছি।গেঞ্জিটা ছাড় না একটু...ও বেরিয়ে যাবে....
-কেন?কি?কে বেরিয়ে যাবে?!ওই সৌর!কি ভুলভাল বকছিস পাগলের মতো....ছেলেটার কি হলো বল তো...

রূপ অবাক হয়ে গেলো....

কিন্তু সেসব বিস্তারিত কৈফিয়ৎ দেওয়ার মতো সময়,তখন আর সৌরর হাতে নেই।ও ততক্ষণে ছুটে গিয়ে মাথা রেখেছে মাঠের পাশের রাস্তার কলে।ব্যান্ডটা কপাল থেকে টেনে খুললো সৌর।ভালোভাবে হাত-মুখ থেকে কাদা ধুয়ে নিয়ে,জামাকাপড়ে কাদামাখা অবস্থাতে,ভিজে সপসপে গায়েই,ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো ক্লাবের দিকে....

(চলবে.....)

ছবি: সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট