বৃষ্টিস্নাতা
(প্রথম)
পিয়ালী খাঁ
প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহে কদিন ধরেই ওষ্ঠাগত প্রাণ অবস্থা। টিভিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগামীকাল বৃষ্টির সম্ভাবনা শোনা থেকেই মনে যেন খুশির বাতাস বইছে তৃষার। উঃ,এ বছর এত গরম পড়েছে, আর যেন সহ্য হচ্ছেনা।
আজ সকাল থেকেই মেঘ জমেছে আকাশে। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা হয়েও গেছে। তবে আকাশের গোমড়া মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখানেই শেষ নয়, প্রাপ্তিভাগ্য আজ বেশ ভালোই। গুনগুন করছে তৃষা। 'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান /আমি দিতে এসেছি শ্রাবনের গান '। বড় মিষ্টি গলা তার। প্রথাগতভাবে কোথাও না শিখলেও বরাবরই গান খুব ভালোবাসে সে।
দোতলার জানালা দিয়ে অপলকে চেয়ে আছে তৃষা। নজর স্থির হয়ে আছে বাগানের দিকে। বাগানের গাছেরা তার বড় আপনার জন। যখন বাড়িতে লোকজন তেমন থাকেনা, যখন সে সময় কাটায় নিজের মুখোমুখি বসে, তখন এমনভাবেই নিরীক্ষণ করে গাছেদেরকে। তাদের ডেকে নেয় নিজস্ব আলাপচারিতায়। ওরা যে তার পরম আত্মীয়। তার বৃক্ষপ্রীতির কথা জানে সলিল। তাইতো বাগানে আমদানি হয় একের পর এক জানা -অজানা চেনা -অচেনা হরেকরকম গাছের। কী অপরূপ রূপ তাদের! রঙ-বেরঙের ফুল পাতায় সাজানো অবয়ব। বর্ষার প্রাক্কালেই সেখানে এসে জুটেছে কামিনী, বকুলের দুটি চারা। আর পাঁচিলের পাশের কদম গাছটায় এবছরই প্রথম কুঁড়ি এসেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে দু -একটা ফুলও উঁকি দিচ্ছে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। এবার নামলো ঝমঝমিয়ে। বাগান থেকে একটা মনমাতানো গন্ধ ভেসে আসছে। কদম, জুঁই, বেল, গোলাপের মিষ্টি সুবাস, সাথে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। প্রাণ মন ভরে যাচ্ছে তার। মাঝে মাঝেই আকাশের বুক চিরে-ফেঁড়ে চমকে ওঠা বিদ্যুৎ, এলোপাথারি ঝোড়ো হাওয়া আর ক্রমশ বাড়তে থাকা বৃষ্টির বেগ -- কী মোহময় পরিবেশ! তৃষার যেন ঘোর লেগে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবে এতদিনে বুভুক্ষু মাটির হৃদয় ভরলো, বৃষ্টিধারা তার দগ্ধ দেহে প্রাণ সঞ্চার করলো, আজ অনেকদিন বাদে পিপাসা মিটলো মাটির। তৃষার শরীরও বহুদিন রসদ পায়নি। সেও পিপাসার্ত। মাটি তো বৃষ্টিস্নাতা হলো। সে কবে সিক্ত হবে?
হঠাৎ করে পিছন থেকে কাঁধে দুটো হাত এসে পড়লো। ভরসার হাত। এ স্পর্শ তৃষার চেনা। তাই মুখ না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করলো -"কখন এলে? বৃষ্টিতে ভিজে গেছো?" "না, বৃষ্টি নামার আগেই ফিরে এসেছি। একটা দরকারি কাগজ খুঁজছিলাম। তাই এ ঘরে আসতে একটু দেরি হলো। " জানালো সলিল। তারপর তৃষার এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে মৃদুস্বরে বললো -- "বিয়ের পর এটাই আমাদের প্রথম বর্ষা। তোমাকে ছাড়া বৃষ্টিতে আমি ভিজতে পারি পাগলি? চলো ছাদে যাই।" তৃষা বারণ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছু বলার আগেই সলিল তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে কথা বন্ধ করে দিলো। আর তারপর তৃষার হুইলচেয়ারটা ধীরে ধীরে টেনে দোতলাসংলগ্ন ছাদে নিয়ে গেলো।
ছাদে এখন বৃষ্টিভেজা দুটি দেহ, দুটি মন। তৃষার চোখের জল অবিরল ধারায় ঝরছে, বৃষ্টি অকৃপণ হাতে তা ধুয়ে মুছে দিচ্ছে। তৃষার মনে পড়ছে মাত্র চার মাস আগে ফাল্গুনে নববধূর বেশে এ বাড়িতে প্রবেশ তার। অষ্টমঙ্গলা কাটিয়ে গ্যাংটকে ওরা যায় মধুচন্দ্রিমায়। কত স্বপ্ন তখন মনের আনাচে কানাচে। দুজনে দুজনার হাত ধরে হারিয়ে যাবে অচেনা পাহাড়ি পথের বাঁকে। খুঁজে নেবে জীবন। হঠাৎ এক মুহূর্তের অসাবধানতায় গাড়ির ধাক্কায় ভয়ানকভাবে আহত হয় তৃষা।সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। জীবন থমকে যায় এক লহমায়। সদ্য বিবাহিত জীবনও এক অজানা আশঙ্কায় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তৃষা ভাবেনি সলিল তার সঙ্গ দেবে। কদিন চেনে সে সলিলকে? সম্বন্ধ করে বিয়ে তাদের। একমাসের ফোনালাপ আর কদিনের ঘোরাফেরা, তারপরেই তো ছাদনাতলায় চারিচক্ষুর মিলন আর মালাবদল। তাই ডাক্তার সেন যখন বললেন হুইলচেয়ারে আপাতত বন্দি তৃষার জীবন, কোনোদিন আগের ছন্দে হাঁটতেও পারবেনা সে, উঠে হয়তো দাঁড়াতে পারবে পরে,তবে তা অধীর সময়ের অপেক্ষা। তখন তৃষার পাশাপাশি তার মা বাবাও ভেবেছিলো সলিল-তৃষার দাম্পত্য জীবনের বুঝি এখানেই সমাপ্তি। ভুল ভাঙালো সলিল। গাঁটছড়া বেঁধে সাতপাকে ঘোরা যে শুধু কতগুলো রীতি নয়, তা প্রমাণ করলো সে তার জীবন দিয়ে।
সলিলের দুহাতের বাঁধনে নিজেকে আরও আরও নিবিড় করে নিয়ে তৃষা ভাবে এর চেয়ে ভালো বর্ষাযাপন আর হতেই পারেনা।
আজ সকাল থেকেই মেঘ জমেছে আকাশে। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা হয়েও গেছে। তবে আকাশের গোমড়া মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখানেই শেষ নয়, প্রাপ্তিভাগ্য আজ বেশ ভালোই। গুনগুন করছে তৃষা। 'বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান /আমি দিতে এসেছি শ্রাবনের গান '। বড় মিষ্টি গলা তার। প্রথাগতভাবে কোথাও না শিখলেও বরাবরই গান খুব ভালোবাসে সে।
দোতলার জানালা দিয়ে অপলকে চেয়ে আছে তৃষা। নজর স্থির হয়ে আছে বাগানের দিকে। বাগানের গাছেরা তার বড় আপনার জন। যখন বাড়িতে লোকজন তেমন থাকেনা, যখন সে সময় কাটায় নিজের মুখোমুখি বসে, তখন এমনভাবেই নিরীক্ষণ করে গাছেদেরকে। তাদের ডেকে নেয় নিজস্ব আলাপচারিতায়। ওরা যে তার পরম আত্মীয়। তার বৃক্ষপ্রীতির কথা জানে সলিল। তাইতো বাগানে আমদানি হয় একের পর এক জানা -অজানা চেনা -অচেনা হরেকরকম গাছের। কী অপরূপ রূপ তাদের! রঙ-বেরঙের ফুল পাতায় সাজানো অবয়ব। বর্ষার প্রাক্কালেই সেখানে এসে জুটেছে কামিনী, বকুলের দুটি চারা। আর পাঁচিলের পাশের কদম গাছটায় এবছরই প্রথম কুঁড়ি এসেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে দু -একটা ফুলও উঁকি দিচ্ছে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। এবার নামলো ঝমঝমিয়ে। বাগান থেকে একটা মনমাতানো গন্ধ ভেসে আসছে। কদম, জুঁই, বেল, গোলাপের মিষ্টি সুবাস, সাথে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। প্রাণ মন ভরে যাচ্ছে তার। মাঝে মাঝেই আকাশের বুক চিরে-ফেঁড়ে চমকে ওঠা বিদ্যুৎ, এলোপাথারি ঝোড়ো হাওয়া আর ক্রমশ বাড়তে থাকা বৃষ্টির বেগ -- কী মোহময় পরিবেশ! তৃষার যেন ঘোর লেগে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবে এতদিনে বুভুক্ষু মাটির হৃদয় ভরলো, বৃষ্টিধারা তার দগ্ধ দেহে প্রাণ সঞ্চার করলো, আজ অনেকদিন বাদে পিপাসা মিটলো মাটির। তৃষার শরীরও বহুদিন রসদ পায়নি। সেও পিপাসার্ত। মাটি তো বৃষ্টিস্নাতা হলো। সে কবে সিক্ত হবে?
হঠাৎ করে পিছন থেকে কাঁধে দুটো হাত এসে পড়লো। ভরসার হাত। এ স্পর্শ তৃষার চেনা। তাই মুখ না ঘুরিয়েই জিজ্ঞেস করলো -"কখন এলে? বৃষ্টিতে ভিজে গেছো?" "না, বৃষ্টি নামার আগেই ফিরে এসেছি। একটা দরকারি কাগজ খুঁজছিলাম। তাই এ ঘরে আসতে একটু দেরি হলো। " জানালো সলিল। তারপর তৃষার এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে মৃদুস্বরে বললো -- "বিয়ের পর এটাই আমাদের প্রথম বর্ষা। তোমাকে ছাড়া বৃষ্টিতে আমি ভিজতে পারি পাগলি? চলো ছাদে যাই।" তৃষা বারণ করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছু বলার আগেই সলিল তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে কথা বন্ধ করে দিলো। আর তারপর তৃষার হুইলচেয়ারটা ধীরে ধীরে টেনে দোতলাসংলগ্ন ছাদে নিয়ে গেলো।
ছাদে এখন বৃষ্টিভেজা দুটি দেহ, দুটি মন। তৃষার চোখের জল অবিরল ধারায় ঝরছে, বৃষ্টি অকৃপণ হাতে তা ধুয়ে মুছে দিচ্ছে। তৃষার মনে পড়ছে মাত্র চার মাস আগে ফাল্গুনে নববধূর বেশে এ বাড়িতে প্রবেশ তার। অষ্টমঙ্গলা কাটিয়ে গ্যাংটকে ওরা যায় মধুচন্দ্রিমায়। কত স্বপ্ন তখন মনের আনাচে কানাচে। দুজনে দুজনার হাত ধরে হারিয়ে যাবে অচেনা পাহাড়ি পথের বাঁকে। খুঁজে নেবে জীবন। হঠাৎ এক মুহূর্তের অসাবধানতায় গাড়ির ধাক্কায় ভয়ানকভাবে আহত হয় তৃষা।সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। জীবন থমকে যায় এক লহমায়। সদ্য বিবাহিত জীবনও এক অজানা আশঙ্কায় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তৃষা ভাবেনি সলিল তার সঙ্গ দেবে। কদিন চেনে সে সলিলকে? সম্বন্ধ করে বিয়ে তাদের। একমাসের ফোনালাপ আর কদিনের ঘোরাফেরা, তারপরেই তো ছাদনাতলায় চারিচক্ষুর মিলন আর মালাবদল। তাই ডাক্তার সেন যখন বললেন হুইলচেয়ারে আপাতত বন্দি তৃষার জীবন, কোনোদিন আগের ছন্দে হাঁটতেও পারবেনা সে, উঠে হয়তো দাঁড়াতে পারবে পরে,তবে তা অধীর সময়ের অপেক্ষা। তখন তৃষার পাশাপাশি তার মা বাবাও ভেবেছিলো সলিল-তৃষার দাম্পত্য জীবনের বুঝি এখানেই সমাপ্তি। ভুল ভাঙালো সলিল। গাঁটছড়া বেঁধে সাতপাকে ঘোরা যে শুধু কতগুলো রীতি নয়, তা প্রমাণ করলো সে তার জীবন দিয়ে।
সলিলের দুহাতের বাঁধনে নিজেকে আরও আরও নিবিড় করে নিয়ে তৃষা ভাবে এর চেয়ে ভালো বর্ষাযাপন আর হতেই পারেনা।
**********************************************
চাওয়া পাওয়া
(দ্বিতীয়)
সহেলি হাজরা
সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, এমনি সময় বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয় কিন্তু আজকের দিনটা জীবনের এমনই একটা অদ্ভুত দিন হয়ে গেল, যে কোনো কিছুই আর অনুভব করতে পারছিনা। একটা অনেক বড়ো কিছু হারিয়ে ফেললাম যেটা কখনোই আর পূরণ হবেনা...চার বছর আগে হয়তো এরকমই একটা দিনে,এরকমই একটা মুহূর্তে আমার সাথে ছিল দীপ্ত। তখন বৃষ্টি টাকে অন্যরকম লাগত, হঠাৎ এসে গেলে বিরক্তির বদলে মনে আসত এক অন্যরকম অনুভূতি।দিন গুলো যে কীভাবে কেটে গেল এখনো বুঝতে পারিনা....কলেজে ওঠার পর ই আলাপ হয় দীপ্তর সাথে, এমনিতেই আমি ছিলাম একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপের , সবার সাথে সেভাবে মিশতে পারতাম না। আর দীপ্ত ছিল ঠিক তার উল্টো, হাসিখুশি স্বভাবের চঞ্চল একটা ছেলে। স্পোর্টসে ও খুব ভালো ছিল কিন্তু পড়াশোনা তে একদম মন দিতো না, তাই আমার থেকে নোটস চাইত মাঝে মাঝে। আশ্চর্য হয়ে যেতাম আমি , এত স্টুডেন্ট থাকতে ও আমার কাছ থেকেই বারবার চাইত, কথা বলারও চেষ্টা করত। প্রথম কদিন চুপ থাকার পর আমিও কথা বলতাম ওর সাথে কারণ সেরকম কোনো বন্ধু ছিল না আর আমার..প্রায় দিনই একসাথে ফিরতাম আমরা।কোনোদিন মেট্রো বা কোনোদিন বাস...এভাবেই কবে যেন ধীরে ধীরে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব টা আরো গভীর হয়ে গিয়েছিল। কলেজে যাওয়া থেকে শুরু করে, ক্যান্টিনে একসাথে খাওয়া, তাড়াতাড়ি ক্লাস হয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিট বা ময়দানে যাওয়া..... এসবের মধ্যেই কীভাবে দুটো বছর কেটে গিয়েছিল। কলেজে অনেকে ই আমাদের প্রেমিক প্রেমিকা ভাবত, যদিও আমাদের মধ্যে সেরকম কিছু ছিলনা...তবে তাদের ভাবনাটা যে এরকম ভাবে সত্যি হবে ভাবিনি...দীপ্ত আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল । হয়তো এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু আমার কাছে সেই মুহূর্তে সেইটা খুব অস্বস্তিকর আর অস্বাভাবিক ছিল...সেদিন ক্লাস তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা ময়দানে গিয়েছিলাম,..আকাশে মেঘ সকাল থেকেই ছিল, মিনিট দশেক পর যেন চারিদিক একেবারে মেঘে অন্ধকার করে এল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রবল বেগে বৃষ্টিও এসে গেল....বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে একটা শেডের নীচে দাঁড়ালাম আমরা।সামনে একটা কদম গাছ ছিল, বৃষ্টির সাথে ঝোড়ো হাওয়ায় সেটা এমন দুলছিল যে ভয় হচ্ছিল ভেঙে না যায়।এমন সময় দীপ্ত হঠাৎ আমার ওড়না টা দিয়ে নিজের মাথাটা মুছতে শুরু করল। আমি অবাক হয়ে একটু রাগী চোখে ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও একভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে। বৃষ্টিস্নাত ওর মুখটা দেখে আমার বুকের ভিতরটায় এমন কিছু একটা অনুভূত হচ্ছিল যা প্রকাশ করার মত নয়। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পর দীপ্ত আমার হাতটা ধরে আস্তে আস্তে বলেছিল,
-" শুভ্রা,সারাজীবন তোর সাথে এই বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগ দিবি আমাকে??"ক'দিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম যে এরকম ই কিছু একটা হতে পারে,কিন্তু আজই সেটা সত্যি হবে বুঝতে পারিনি....আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে দীপ্ত আশেপাশে পড়ে থাকা একটা কদম ফুল তুলে এনে আমার হাতে দেয় আর বলে ওঠে,
-"দেখ আমি তোকে ভালোবাসি বলেছি মানেই তোকে হ্যাঁ বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই, এই ফুলটা সাথে রাখিস ,আমরা নাহয় আবার আগের মতই ভালো বন্ধু হয়ে থাকব,আর এটা থাকবে আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষী ...কীরে ,কিছু বল?"
-" শুভ্রা,সারাজীবন তোর সাথে এই বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগ দিবি আমাকে??"ক'দিন ধরেই বুঝতে পারছিলাম যে এরকম ই কিছু একটা হতে পারে,কিন্তু আজই সেটা সত্যি হবে বুঝতে পারিনি....আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে দীপ্ত আশেপাশে পড়ে থাকা একটা কদম ফুল তুলে এনে আমার হাতে দেয় আর বলে ওঠে,
-"দেখ আমি তোকে ভালোবাসি বলেছি মানেই তোকে হ্যাঁ বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই, এই ফুলটা সাথে রাখিস ,আমরা নাহয় আবার আগের মতই ভালো বন্ধু হয়ে থাকব,আর এটা থাকবে আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষী ...কীরে ,কিছু বল?"
নাহ্ , সেদিন আমার আর কিছু বলা হয়েছিল না। সময় নিয়ে ছিলাম আমি....অনেক সময়। কারণ পরিবারের একটু গোঁড়ামি ছিল এই প্রেম করা নিয়ে আর আমারও প্রথমে মনে হত এই ভালোবাসা-প্রেম এসব ক্ষণিকের আবেগ ছাড়া আর কিছু না। তারপর থেকে আমি একটু এড়িয়েই চলতাম দীপ্তকে। ধীরে ধীরে কলেজ শেষে ও ফিরে গেল বর্ধমানে ওর আসল বাড়িতে, আমি একটু জেদের বশেই ওর সাথে যোগাযোগ রাখতাম না, আমার মনে একটা ধারণা ছিল যে ও যদি সত্যি ভালোবেসে থাকে তাহলে সারাজীবন অপেক্ষা করবে যতদিন আমি চাইব। এখন ভাবলে হাসি পাচ্ছে, কী অদ্ভুত ধারণা..কিন্তু অবাধ্য মন...কাছে থাকতে বুঝিনি কিন্তু দূরে যাওয়ার পর থেকেই দীপ্তর শূন্যতা আমাকে বড়ো অস্থির করে তুলেছিল, পরে চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগ করে আবার সেই প্রসঙ্গ তুলতে.....কিন্তু ততদিনে কাজের চাপেই হোক বা অন্য কোনো কারণে ওর দিক থেকে উৎসাহ কমে এসেছিল....আর বলা হয়ে উঠলনা।
অপেক্ষা শব্দটাই বড়ো আপেক্ষিক, সময়ের সাথে সাথে দীপ্ত যোগাযোগ করাও কমিয়ে দিয়েছিল তারপর একেবারে বন্ধ। তাই বলে এত তাড়াতাড়ি এমন কিছু দেখতে হবে আশা করিনি। ফেসবুকে এক বন্ধু দীপ্তর বিয়ের ছবি পোস্ট করেছে দেখলাম, দীপ্ত আর ওর স্ত্রী পাশাপাশি বসে..একে অপরের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে।বুকের ভেতরটা এক অব্যক্ত ব্যথায় চিন চিন করে উঠল...চোখের কোণে একটু জল ও এল কী?? হবে হয়তো...ফেসবুকে ওর প্রোফাইলে টা খুললাম,অনেকদিন আগে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম...এখনো পেন্ডিং পড়ে আছে।বোধহয় খুব ব্যস্ত ছিল, রিকোয়েস্ট টা ক্যানসেল করে জানালার দিকে তাকালাম.. বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে অবিরাম...ডায়েরির পাতায় এখনো কদম ফুল টা আছে জানিস? শুকিয়ে গেছে বলে ভয়ে হাত দিইনা। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা..প্রথম কদম ফুল। আসলে দোষটা আমারই দীপ্ত, তোকে বেঁধে রাখতে পারিনি....আফশোস একটাই বৃষ্টি তে আর একসাথে সারাজীবন ভেজা হল না...সে অধিকার এখন অন্য কারোর..ভালো থাক তুই, জীবনের কিছু চাওয়া পাওয়ার সমীকরণের সমাধান হয়তো এভাবেই হয় ....
অপেক্ষা শব্দটাই বড়ো আপেক্ষিক, সময়ের সাথে সাথে দীপ্ত যোগাযোগ করাও কমিয়ে দিয়েছিল তারপর একেবারে বন্ধ। তাই বলে এত তাড়াতাড়ি এমন কিছু দেখতে হবে আশা করিনি। ফেসবুকে এক বন্ধু দীপ্তর বিয়ের ছবি পোস্ট করেছে দেখলাম, দীপ্ত আর ওর স্ত্রী পাশাপাশি বসে..একে অপরের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে।বুকের ভেতরটা এক অব্যক্ত ব্যথায় চিন চিন করে উঠল...চোখের কোণে একটু জল ও এল কী?? হবে হয়তো...ফেসবুকে ওর প্রোফাইলে টা খুললাম,অনেকদিন আগে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম...এখনো পেন্ডিং পড়ে আছে।বোধহয় খুব ব্যস্ত ছিল, রিকোয়েস্ট টা ক্যানসেল করে জানালার দিকে তাকালাম.. বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে অবিরাম...ডায়েরির পাতায় এখনো কদম ফুল টা আছে জানিস? শুকিয়ে গেছে বলে ভয়ে হাত দিইনা। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা..প্রথম কদম ফুল। আসলে দোষটা আমারই দীপ্ত, তোকে বেঁধে রাখতে পারিনি....আফশোস একটাই বৃষ্টি তে আর একসাথে সারাজীবন ভেজা হল না...সে অধিকার এখন অন্য কারোর..ভালো থাক তুই, জীবনের কিছু চাওয়া পাওয়ার সমীকরণের সমাধান হয়তো এভাবেই হয় ....
******************************************
প্রাণের কদম ফুল
(তৃতীয়)
সোহিনী মঞ্চামিতা
কদম গাছটার নিচে দাঁড়িয়েও বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছিল না টুয়া। ভিজে যাচ্ছিলো টুয়ার সমস্ত শরীর। কিন্তু অদ্ভূত ভাবে টুয়ার সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপই নেই। সে একটা কদম ফুলকে একবার বুকে জড়িয়ে, একবার গন্ধ শুঁকে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করছিল। বারান্দা থেকে দেখতে পাচ্ছিলেন মিত্তির গিন্নি। কিন্তু ঠিক কি করতে চাইছে মেয়েটা, সেটা উনি বুঝতে পারছিলেন না। বেশ কিছুক্ষন উঁকি ঝুঁকি মেরে, দেখে বোঝার চেষ্টা করেও যখন বুঝতে পারলেন না, দুত্তোর বলে চলে গেলেন ঘরে।
টুয়া তখনও ভিজছিল। এতক্ষন হাতে কদম ফুল টাকে নিয়ে গন্ধ শুঁকে, বুকে জড়িয়ে ধরছিল। এখন মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে জড়ো করতে লাগল কদম ফুল গুলো কে। বৃষ্টির জলের সাথে তার কান্না গুলো ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো।
টুয়া তখনও ভিজছিল। এতক্ষন হাতে কদম ফুল টাকে নিয়ে গন্ধ শুঁকে, বুকে জড়িয়ে ধরছিল। এখন মাটিতে বসে পড়ে দুহাতে জড়ো করতে লাগল কদম ফুল গুলো কে। বৃষ্টির জলের সাথে তার কান্না গুলো ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো।
টুয়ার মা রিনা দেবীর সব চেয়ে পছন্দের ফুল ছিল কদম। টুয়ার বাবা, আবির বাবু, যখন রিনা দেবী কে প্রথম দেখতে যান, বাড়ির বড়রা সবাই বলেছিল, তাহলে তোমরা একটু তোমাদের মতন করে কথা বলে নাও। কিছুক্ষন একা ছেড়ে দিয়েছিলেন তাদের দুজনকে। আবির বাবু রিনা দেবীকে তার পছন্দের অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করায় রিনা দেবী বলেছিলেন আমার কদম ফুল ভীষণ পছন্দ। আবির বাবু হেসে বলেছিলেন, আমাদের বাড়ির বাগানে, ঠিক আমার ঘরের জানলার পাশেই আছে একটা কদম গাছ। কিন্তু কেন জানি না, কোনোদিন ফুল হয়নি গাছটায়। ডালপালা মেলে বড় হয়ে উঠেছে কিন্তু ফুল ধরতে দেখিনি কখনও। রিনা দেবী শুধু হেসেছিলেন, লজ্জায় বেশী কথা বলতে পারেননি। এরপর কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায় আবির বাবু এবং রিনা দেবীর। বিয়ের পর থেকেই রিনা দেবী উঠে পড়ে লেগেছিলেন কদম গাছের পরিচর্যায়। বিয়ের দু বছর পরে এক ঘন বর্ষার সকালে রিনা দেবী ঘরে এসে ঘুমন্ত আবির বাবুকে জাগিয়ে কানে কানে বলেন, একটা জিনিস দেখাতে চাই তোমায়। আবির বাবুর দু চোখ টিপে নিয়ে আসেন কদম গাছের তলায়। গাছের তলায় এসে চোখ খুলতেই আবির বাবু দেখতে পান বর্ষার প্রথম কদম ফুল। ঠিক সেই সময়েই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। দুজনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আবির বাবু জড়িয়ে ধরেন রিনা দেবীকে। কানে কানে বলেন, তোমার মধ্যেও কিন্তু কুঁড়ি ফুটেছে। কাল রাতে তোমার রিপোর্ট টা নিয়ে এসেছি, রিপোর্ট পজেটিভ। রিনা দেবী লজ্জায় মুখ লুকোন আবির বাবুর বুকে। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন থাকে নি। ভালো ভাবে ফুল গুলো ফোটার আগেই ঝরে যাচ্ছিলো। রিনা দেবী প্রায় সারাদিনই কাটাতেন গাছতলায়। সহ্য করতে পারতেন না ফুল ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া। দুহাতে কুঁড়ি গুলো কুড়িয়ে বুকে নিয়ে করে গন্ধ শুঁকতেন তিনি। একদিন সেই ঝরে যাওয়া কুঁড়ি কুড়োতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে পড়ে গিয়ে তার জীবন থেকেও অকালে কুঁড়ি ঝরে গেল। আবির বাবু, তার স্ত্রী রিনা দেবীর মধ্যে কদম কুঁড়ি ঝরা নিয়ে যে ব্যাকুলতা দেখেছিলেন তা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনে হওয়ায় বারবার বারণ করতেন এই কাদায় যেন তিনি বাগানে না যান। তিনি যে ভয় টা পেয়েছিলেন সেটাই হল শেষ পর্যন্ত।
রিনাদেবী কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেই ছুটে যান বাগানে। গিয়ে দেখেন তার প্রাণের ধন কদম গাছটা আর নেই। চিৎকার করে ডাকেন আবির বাবুকে। আবির বাবু এসে বিরক্ত স্বরে জানান ওই কদম গাছের জন্যই তিনি হারিয়েছেন তার প্রথম সন্তানকে। তাই গাছটা কেটে ফেলেছেন তিনি। শোকে, দুঃখে হতভম্ব হয়ে যান রিনা দেবী। সেই হাসি খুশি প্রাণবন্ত রিনা দেবী বড্ড চুপচাপ হয়ে যান। আরও একবছর পর আবার জানতে পারেন তিনি সন্তান সম্ভবা। এবার তার কোল আলো করে আসে টুয়া। টুয়াকে যখন দেখতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত আবির বাবু বলেন, তুমি কি চাও বলো রিনা। আজ তুমি আমায় যে উপহার দিয়েছো, তুমি যা চাইবে আজ তাই পাবে। রিনা দেবী আসতে আসতে মুখ তুলে তাকান স্বামীর দিকে। বলেন, আমাদের শোবার ঘরের জানলার পাশে একটা কদম গাছ লাগিয়ে দেবে। আবির বাবু কথা দেন এবং কথা রাখেন ও। টুয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরে রিনা দেবী দেখেন একটা কদম গাছের চারা বসিয়েছেন আবির বাবু। তিনি টুয়ার সাথে সাথে রাতদিন পরিচর্যা করতে থাকেন গাছটির ও। টুয়ার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে গাছটির বেড়ে ওঠাও যেন তাকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। আবার আগের মতন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন রিনা দেবী।
ছোট্ট টুয়া আসতে আসতে বড় হতে থাকে। বড় হতে থাকে কদম গাছটিও। একদিন সকালে, রিনা দেবী বাগানে গিয়ে দেখেন টুয়া একটা ছুরি নিয়ে গাছের গায়ে খোদাই করে কিছু লিখছে। রাগের চোটে টুয়ার গায়ে সেই প্রথম হাত তোলেন রিনা দেবী। প্রচন্ড মারেন টুয়াকে। আবির বাবু চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে কোনোরকমে টুয়াকে ছাড়িয়ে নেন রিনা দেবীর থেকে। সব শুনে তিনি রিনা দেবীর ওপর প্রচন্ড বিরক্ত হন। তারপর থেকেই কেমন বদল দেখা দেয় টুয়ার মধ্যে। মা গাছের পরিচর্যার জন্য গাছের কাছে গেলেই ইচ্ছে করে নানারকম দুস্টুমি করত। গাছের গায়ে ঢিল ছুঁড়ত। যত মার খেত মায়ের থেকে তত যেন জেদ বেড়ে যেতে থাকে টুয়ার। রিনা দেবীও সংসারের কাজ ফেলে সারাদিন গাছের তলায় বসে থাকতেন, পাহারা দিতেন গাছটাকে। বিরক্ত আবির বাবু একদিন গাছ টাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। রিনাদেবী কে বাবা, মেয়ে মিলে জোর করে ঘরে বন্ধ করে গাছ টা কেটে ফেলেন লোক ডাকিয়ে। যতক্ষন গাছ কাটা চলছিল রিনা দেবী চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন বন্ধ ঘরের ভেতর। কেউ একটা সাড়া শব্দ ও দেয়নি। গাছ কাটা শেষে আবির বাবু আর টুয়া ঘরে গিয়ে দেখেন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন রিনা দেবী। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলেন প্যারালাইসিস। আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবেন না রিনা দেবী।
একটি ঘরের খাটে শুয়ে থাকতেন রিনা দেবী। শরীরের কোনো অংশ কাজ করত না। দু চোখ ছিল পাথরের মতন স্থির। আবির বাবু, টুয়া কারুর ডাকেই ওনার চোখের কোনো পরিবর্তন হত না। একদিন অনুতপ্ত আবির বাবু ঠিক করেন আবার একটা কদম গাছ লাগাবেন রিনা দেবীর জানালার পাশে। যেদিন গাছ টা লাগান, রিনা দেবীর কাছে এসে ক্ষমা চান নিজের কৃতকর্মের জন্য এবং জানান আরও একটি গাছ তিনি লাগিয়েছেন। সেদিন প্রথম রিনা দেবীর চোখ থেকে জল গড়াতে থাকে।
এত কিছুর পরেও টুয়া কিন্তু পারেনি মায়ের কাছে এসে ক্ষমা চাইতে। প্রায় সাত বছর বাদে এক বর্ষার দিনে মারা গেলেন রিনা দেবী। রিনা দেবীর শেষ কৃত্য করে এসে টুয়া লক্ষ্য করল গাছে প্রথম কদম ফুল ফুটেছে। কিন্তু থাকেনি সেই ফুল। সব কুঁড়ি ঝরে পড়েছিল। আর কোনোদিন ফুল ফোটে নি সেই গাছে।
আজ সকাল থেকেই আকাশ কালো করে এসেছে। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ খুব বৃষ্টি নামায় একটা কদম গাছের নিচে আশ্রয় নেয় টুয়া। খেয়াল করে নি কি গাছ। হটাৎ কিছু একটা টুপ করে তার মাথায় পড়তেই সে দেখে একটা কদম ফুল। সে হটাৎ খেয়াল করে একটা মিষ্টি গন্ধ ছেয়ে আছে চারিদিকে। হটাৎ সে অনুভব করে এই গন্ধ সে পেতো ছোটবেলায়, মায়ের গায়ে। ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করে সে এই প্রথমবার। টুপটাপ করে কদম ফুল ঝরতে থাকে তার গায়ে। সেগুলো হাতে নিয়ে, বুকে জড়িয়ে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মাটিতে বসে পড়ে সে। মাটির ফুল গুলো জড়িয়ে ধরে গাছের দিকে চেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে ক্ষমা করো মা আমায়। আমায় ক্ষমা করো মা। বৃষ্টির আওয়াজে চাপা পড়ে যায় টুয়ার সেই হাহাকার। আসতে আসতে সব ফুল ঝরতে থাকে টুয়ার মাথায়।
রিনাদেবী কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেই ছুটে যান বাগানে। গিয়ে দেখেন তার প্রাণের ধন কদম গাছটা আর নেই। চিৎকার করে ডাকেন আবির বাবুকে। আবির বাবু এসে বিরক্ত স্বরে জানান ওই কদম গাছের জন্যই তিনি হারিয়েছেন তার প্রথম সন্তানকে। তাই গাছটা কেটে ফেলেছেন তিনি। শোকে, দুঃখে হতভম্ব হয়ে যান রিনা দেবী। সেই হাসি খুশি প্রাণবন্ত রিনা দেবী বড্ড চুপচাপ হয়ে যান। আরও একবছর পর আবার জানতে পারেন তিনি সন্তান সম্ভবা। এবার তার কোল আলো করে আসে টুয়া। টুয়াকে যখন দেখতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত আবির বাবু বলেন, তুমি কি চাও বলো রিনা। আজ তুমি আমায় যে উপহার দিয়েছো, তুমি যা চাইবে আজ তাই পাবে। রিনা দেবী আসতে আসতে মুখ তুলে তাকান স্বামীর দিকে। বলেন, আমাদের শোবার ঘরের জানলার পাশে একটা কদম গাছ লাগিয়ে দেবে। আবির বাবু কথা দেন এবং কথা রাখেন ও। টুয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরে রিনা দেবী দেখেন একটা কদম গাছের চারা বসিয়েছেন আবির বাবু। তিনি টুয়ার সাথে সাথে রাতদিন পরিচর্যা করতে থাকেন গাছটির ও। টুয়ার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে গাছটির বেড়ে ওঠাও যেন তাকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। আবার আগের মতন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন রিনা দেবী।
ছোট্ট টুয়া আসতে আসতে বড় হতে থাকে। বড় হতে থাকে কদম গাছটিও। একদিন সকালে, রিনা দেবী বাগানে গিয়ে দেখেন টুয়া একটা ছুরি নিয়ে গাছের গায়ে খোদাই করে কিছু লিখছে। রাগের চোটে টুয়ার গায়ে সেই প্রথম হাত তোলেন রিনা দেবী। প্রচন্ড মারেন টুয়াকে। আবির বাবু চিৎকার শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে কোনোরকমে টুয়াকে ছাড়িয়ে নেন রিনা দেবীর থেকে। সব শুনে তিনি রিনা দেবীর ওপর প্রচন্ড বিরক্ত হন। তারপর থেকেই কেমন বদল দেখা দেয় টুয়ার মধ্যে। মা গাছের পরিচর্যার জন্য গাছের কাছে গেলেই ইচ্ছে করে নানারকম দুস্টুমি করত। গাছের গায়ে ঢিল ছুঁড়ত। যত মার খেত মায়ের থেকে তত যেন জেদ বেড়ে যেতে থাকে টুয়ার। রিনা দেবীও সংসারের কাজ ফেলে সারাদিন গাছের তলায় বসে থাকতেন, পাহারা দিতেন গাছটাকে। বিরক্ত আবির বাবু একদিন গাছ টাকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। রিনাদেবী কে বাবা, মেয়ে মিলে জোর করে ঘরে বন্ধ করে গাছ টা কেটে ফেলেন লোক ডাকিয়ে। যতক্ষন গাছ কাটা চলছিল রিনা দেবী চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন বন্ধ ঘরের ভেতর। কেউ একটা সাড়া শব্দ ও দেয়নি। গাছ কাটা শেষে আবির বাবু আর টুয়া ঘরে গিয়ে দেখেন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন রিনা দেবী। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলেন প্যারালাইসিস। আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবেন না রিনা দেবী।
একটি ঘরের খাটে শুয়ে থাকতেন রিনা দেবী। শরীরের কোনো অংশ কাজ করত না। দু চোখ ছিল পাথরের মতন স্থির। আবির বাবু, টুয়া কারুর ডাকেই ওনার চোখের কোনো পরিবর্তন হত না। একদিন অনুতপ্ত আবির বাবু ঠিক করেন আবার একটা কদম গাছ লাগাবেন রিনা দেবীর জানালার পাশে। যেদিন গাছ টা লাগান, রিনা দেবীর কাছে এসে ক্ষমা চান নিজের কৃতকর্মের জন্য এবং জানান আরও একটি গাছ তিনি লাগিয়েছেন। সেদিন প্রথম রিনা দেবীর চোখ থেকে জল গড়াতে থাকে।
এত কিছুর পরেও টুয়া কিন্তু পারেনি মায়ের কাছে এসে ক্ষমা চাইতে। প্রায় সাত বছর বাদে এক বর্ষার দিনে মারা গেলেন রিনা দেবী। রিনা দেবীর শেষ কৃত্য করে এসে টুয়া লক্ষ্য করল গাছে প্রথম কদম ফুল ফুটেছে। কিন্তু থাকেনি সেই ফুল। সব কুঁড়ি ঝরে পড়েছিল। আর কোনোদিন ফুল ফোটে নি সেই গাছে।
আজ সকাল থেকেই আকাশ কালো করে এসেছে। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ইন্টারভিউ দিয়ে ফেরার সময় হঠাৎ খুব বৃষ্টি নামায় একটা কদম গাছের নিচে আশ্রয় নেয় টুয়া। খেয়াল করে নি কি গাছ। হটাৎ কিছু একটা টুপ করে তার মাথায় পড়তেই সে দেখে একটা কদম ফুল। সে হটাৎ খেয়াল করে একটা মিষ্টি গন্ধ ছেয়ে আছে চারিদিকে। হটাৎ সে অনুভব করে এই গন্ধ সে পেতো ছোটবেলায়, মায়ের গায়ে। ভীষণ অনুতপ্ত বোধ করে সে এই প্রথমবার। টুপটাপ করে কদম ফুল ঝরতে থাকে তার গায়ে। সেগুলো হাতে নিয়ে, বুকে জড়িয়ে, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মাটিতে বসে পড়ে সে। মাটির ফুল গুলো জড়িয়ে ধরে গাছের দিকে চেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে ক্ষমা করো মা আমায়। আমায় ক্ষমা করো মা। বৃষ্টির আওয়াজে চাপা পড়ে যায় টুয়ার সেই হাহাকার। আসতে আসতে সব ফুল ঝরতে থাকে টুয়ার মাথায়।
**********************************************
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন