অসমাপ্ত
ষষ্ঠ পর্ব
সাথী দাস
তিলোত্তমার সর্বশরীরের কাঁপুনি তখনও পুরোপুরি স্তিমিত হয়নি।সৌরর কণ্ঠলগ্না হয়ে,ও একভাবে চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই।মাথা থেকে শুরু করে চোখ-নাক-ঠোঁট,জলের ওপরে অবস্থিত সৌরর শরীরের সবটুকু অংশ থেকে জল বেয়ে নেমে আসছে।এত জলের মাঝেও,এত সিক্ততার মাঝেও,এত উষ্ণতা কেন!?সৌরর গলার দিকে চেয়েই কুণ্ঠিত হয়ে পড়লো তিলোত্তমা।ওর নিজের দুটো হাত নিজেরই অজান্তে,জড়িয়ে রয়েছে সৌরর গলা।ও তাড়াতাড়ি করে ছেড়ে দিলো সৌরকে।কিন্তু সৌর তখনও তিলোত্তমার সরু কোমরটা আগলে ধরে রেখেছে....সেই মুহূর্তেই নড়ে উঠলো সৌরর দুটো ঠোঁট,
-তুমি পেরেছো মিছরি!
হঠাৎ করে ওরা দুজনেই কেঁপে উঠলো স্যারের ধমকে।
-সৌর!!কি করলে তুমি এটা?!একটা অঘটন ঘটে গেলে,কর্তৃপক্ষ কি জবাব দিতো ওর গার্জিয়ানকে?হাউ ডেয়ার ইউ?!
স্যারের ধমকে সৌর ছেড়ে দিলো তিলোত্তমাকে।তিলোত্তমা সৌরর কাছ থেকে সরে গিয়ে,সাঁতার কেটে উঠে পড়লো জল থেকে....ততক্ষণে সৌরও অন্যদিক দিয়ে জল ছেড়ে উঠে পড়েছে।দাঁড়িয়েছে স্যারের মুখোমুখি।মাথা নীচু করে সৌর বললো,
-সরি স্যার!!
-সরি?!সরির কোনো জায়গা নেই সৌর!তিলোত্তমা প্রচন্ড নার্ভাস ছিলো।জলের মধ্যে তুমি যে ওকে ওভাবে ছুঁড়ে ফেললে,ওর মাসল ক্র্যাম্প হয়ে গেলে,ও পারতো সাঁতার কাটতে?!তলিয়েই যেতো তো...
-আমি ছিলাম স্যার!!ওর কিচ্ছু হতো না...
স্যারের সঙ্গে কথা বললেও সৌরর নজরটা রয়েছে দূরে তিলোত্তমার দিকেই।ও রেলিং ধরে জল ছেড়ে উঠে,একটানে খুলে ফেললো ক্যাপ আর গ্লাস।তারপর ছুটতে শুরু করলো ওয়াশরুমের দিকে....স্যার তখনও বলে যাচ্ছেন,
-তুমি ওপরে ছিলে সৌর!সুইমার জোনে সেই সময় কেউ ছিলো না...এতটা রিস্ক তুমি কি করে নিতে পারো...সৌর!!আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি!
-ইয়েস স্যার!!সরি স্যার!!
-ওদিকে কি দেখছো তুমি?
-স্যার!এক মিনিট....আমি এক্ষুণি আসছি....
ভিজে গায়েই সৌর দৌড় মারলো তিলোত্তমা যেদিকে গেছে,সেদিকে...
-হোয়াট!!আমি কিছু বলছিলাম সৌর!
ততক্ষণে সৌর নাগালের বাইরে....
-উফফ!!নিয়ম-কানুন-ডিসিপ্লিন-ম্যানার্স,সব ভুলে যাচ্ছে ছেলেটা!
-আপনি আর কি করবেন স্যার!!এ হলো বয়সের দোষ!ও আপনি-আমি এই বয়সটা সবাই পেরিয়ে এসেছি।দেখুন মনে করে,এইরকম দু-একটা ঘটনা আপনারও ঠিক মনে পড়ে যাবে....
-বলছেন?!
-একদম!!
-আজই তবে মস্তিষ্কের কলকব্জা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে হবে দেখছি,আসলে সব মরচে পড়ে আছে তো!!তবে একদম চুপিচুপি স্মৃতিচারণ করতে হবে।গৃহিনীকে কিন্তু জানতে দেওয়া যাবে না।কারণ,তিনি প্রথম নন কিনা!!জানলেই সংসার কুরুক্ষেত্র....এই বয়সে বাইরে এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে,আবার ঘরে গিয়ে যুদ্ধ,আর পোষাবে না বাপু....
সশব্দে হেসে ওঠেন দুজন....
-মিছরি!প্লিজ,একটু দাঁড়াও!সরি!আমি জানি লেডিজ বাথরুমের সামনে আসা ঠিক নয়!সরি....কিন্তু তুমি উঠে এলে কেন জল ছেড়ে?এখনও তো মিনিট দশেক সময় হাতে আছে...
কোনো উত্তর দিলো না তিলোত্তমা।একছুটে ঢুকে গেলো বাথরুমের ভিতরে।আর কিছু করার নেই সৌরর।এমনিতেই ও মিছরির পিছনে ছুটতে গিয়ে,নিজের সীমা-পরিসীমা,সবকিছু ভেঙে ফেলেছে বহু আগেই।কিন্তু এবার ওর সীমানা এই পর্যন্তই।এর বেশি আর এগোনোর ক্ষমতা নেই ওর....ওখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিলো সৌর....
-মিছরি!!কথা বলছো না কেন?প্লিজ!আমার সঙ্গে কথা বলো...
পিঠে ব্যাগ নিয়ে সুউচ্চ পাঁচিলের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো সৌর।মিছরি বেরোতেই ওর হাতটা টেনে,ওকে নিয়ে গেলো ওইদিকে...
-সৌর...ছাড়ো!
লাফাতে থাকা তিলোত্তমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে,ওর গালের ওপর দুটো হাত রাখলো সৌর।কোনো বাড়তি প্রসাধন নেই।কিন্তু তাও যেন গালের ওপর মাখনের একটা আলগা প্রলেপ লাগলো,এতটাই উজ্জ্বলতা ত্বকের!!ওর গালের ওপর লেপ্টে থাকা ভেজা চুল থেকে ভেসে আসছে মনমাতানো সুবাস।এতটাই নিখুঁত,এতটাই সযত্নে প্রতিপালিত এই নারী,যে একে ছুঁয়ে দেখতেও ভয় করে সৌরর।ওর কঠিন হাতের স্পর্শে যদি,আঘাত পায় মিছরি।দাগ লেগে যায় নিখুঁত ত্বকে....আলতো করে ওকে ছুঁয়ে সৌর বললো,
-না!তোমায় আজ কিছুতেই ছাড়বো না।আমি আর কাল থেকে আসবো না মিছরি!কদিন পরেই পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।আবার কতদিন দেখতে পাবো না তোমায়।শেষদিনে এমন ঝামেলা কোরো না প্লিজ!আমার পড়াশোনা-পরীক্ষা সব গোল্লায় চলে যাবে...
কেঁপে উঠলো তিলোত্তমা....ভীত দৃষ্টিতে সৌরর দিকে চেয়ে ও বললো,
-মানে?!
মাথা নামিয়ে নিলো সৌর।আরও একটু এগিয়ে গিয়ে, নিজের কপালটা ঠেকিয়ে দিলো তিলোত্তমার কপালের সঙ্গে....তিলোত্তমা তখন ওর হাত থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে....
-আমাকে যেতে দাও!
-না!দেবো না যেতে।আগে বলো,তুমি ভালো করে কথা বলছো না কেন আমার সঙ্গে?তোমাকে জলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছি বলে রেগে গেছো?
চুপ করে রইলো তিলোত্তমা....
-আচ্ছা!বুঝতে পেরেছি।ওই জন্যই রেগে গেছো।তোমাকে প্রথম দিন একটা কথা বলেছিলাম,মনে আছে?একটা ধাক্কা!!সঠিক সময়ে ওই ধাক্কাটা আমাদের জীবনে ভীষণ প্রয়োজন মিছরি।কিন্তু আমি তোমাকে সেই ধাক্কাটুকুও দিতে পারিনি।ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলতে পারিনি।তাই তোমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম।আমি জানতাম,তুমি ঠিক পারবে।কিন্তু তাও কিছুতেই ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।তোমাকে ফেলে দেওয়ার পর,আমিও নেমে পড়েছি জলে।স্যার ভুল বুঝছেন আমায়।উনি ভয় পেয়ে গেছেন,তোমার হঠাৎ কোনো অঘটন হয়ে গেলে,তোমার বাবাইকে কি কৈফিয়ৎ দেবেন!!কিন্তু তোমার বাবাই তো অনেক পরের কথা,আমার হাতে বা আমার হাতের বাইরে,তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে,আমিই মরে যাবো মিছরি....
-সৌর!আমাকে যেতে দাও!
-কেন এমন করছো মিছরি?
-আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে।
আর দাঁড়ায় না তিলোত্তমা।ছিটকে বেরিয়ে আসে সৌরর হাত থেকে...কয়েক পা এগোতেই ওর কানে ভেসে আসে সৌরর ভারাক্রান্ত কন্ঠস্বর...
-আই লাভ ইউ মিছরি!!আমি ভালোবাসি তোমায়...
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমা।চোখে জল এসে গেছে ওর।কিন্তু এ যে অসম্ভব....চোখ মুছে নিয়ে,আবার ও চলতে শুরু করলো...দৌড়ে সৌর এসে আবার টেনে ধরলো ওকে...
-কেন এইরকম করছো?ডোন্ট ইউ লাভ মি?আমি জানি, তুমিও আমাকে ভালোবাসো!!
-আমি পারবো না সৌর!!
-কেন?
-তুমি কোনো কারণ জানতে চেয়ো না।শুধু এটুকুই জেনে রাখো,আমি পারবো না....
সৌরকে কথা বলার আর কোনো সুযোগ দিলো না মিছরি।দৌড়ে উঠে পড়লো গাড়িতে...ছুটে এসেও ওকে আর ধরতে পারলো না সৌর...ওর চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো গাড়িটা...সৌর নিজের সাইকেলের সামনে ফিরে গেলো।সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়েই নিজের ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে,আপ্রাণ চেষ্টা করলো না কাঁদার।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেঁদেই ফেললো ঝরঝর করে।পা তুলে একটা লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো সাইকেলটাকে....গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে পিছনে ফেলে আসা সৌরকে দেখে,গাড়ির সিটে বসেই,দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো মিছরি....
পিঠের ব্যাগে ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে।এতক্ষণে হুঁশ হলো সৌরর।ও তাড়াতাড়ি করে কম্পিত হাতে ফোনটা বের করলো,মিছরি হয়তো....না!!ফোন বলছে,মিছরি নয়।ওকে রূপ ফোন করছে....
-বল!
-কোথায় তুই?খুব ব্যস্ত না থাকলে একবার আসতে পারবি?রুমাদির টিউশনের সামনে!আমরা সবাই আছি...
-কেন?কি হয়েছে?
গলাটা কেঁপে গেলো সৌরর...
-এই দাঁড়া!!এক মিনিট!!তোর কি হয়েছে সৌর?
-কিছুনা!
-লাথ মারবো হারামজাদা!কোথায় তুই?কি হয়েছে বল!আমরা আসছি!তুই শুধু বল,কোথায় আছিস এখন!!
সমুদ্রর হঠাৎ শরীর খারাপের কারণে,ওদের খাওয়া-দাওয়ার পরিকল্পনাটা পিছিয়ে গিয়েছিলো।সেটা পিছোতে-পিছোতে আজ নির্ধারিত হয়েছে।কারণ,এরপর প্রায় সবারই বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ,কাল এডমিট দেওয়ার পর তুমুল পড়াশোনা।তাই আজ ফুচকার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো সবাই।কিন্তু সৌরকে ছাড়া,ওদের বন্ধুবৃত্ত যেন অসম্পূর্ণ লাগছিলো।নিশাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার আনন্দটুকু,সৌরর সঙ্গে ভাগ করে না নিলে,খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো ওদের আনন্দোৎসবের এই আয়োজন।রূপকে চেঁচাতে দেখে চমকে উঠে ওর হাত থেকে,ফোনটা কেড়ে নিলো সমুদ্র....
-সৌর?
-ভাই!!
-কি হয়েছে?কোথায় তুই?
-বড্ড কষ্ট হচ্ছে!
-সব শুনবো!আগে বল,তুই কোথায়!আমি আসছি!
হাতের পাতাটা ফেলে দেয় সমুদ্র।ফোনের ওপার থেকে সৌর বলে,
-নাঃ!আমিই আসছি!মাঠে!
একহাতে সাইকেলটাকে মাটি থেকে টেনে তুললো সৌর....
-আচ্ছা আয়।আমি ওখানেই যাচ্ছি...রূপ!ফোনটা নে।আমি বেরোলাম।সৌর ভালো নেই।কিছু একটা হয়েছে।
-আমিও যাবো!
পাশ থেকে লাফিয়ে উঠলো ঋষি....
-আর আমি কি তোদের মুখ দেখবো?আমি তো যাবোই...
-না ভাই!নিশা আছে!তোদের সুন্দর একটা সময়....আমি আর ঋষি যাচ্ছি তো,আমরা দেখে নিচ্ছি....
-না,আমিও....
নিশার দিকে একবার চাইলো সমু আর ঋষি....মেয়েটার মুখ দেখেই বুঝতে পারলো,ওর মনের গোপন ইচ্ছেটা।প্রথম-প্রথম প্রেম!!একটু তো কাছে চাইবেই রূপকে,আর সেটাই স্বাভাবিক!!পরীক্ষার মধ্যে আর মাঠেও আসা হবে না।আবার কবে দেখা হবে না হবে,তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।তাই নিশার ইচ্ছে নয়,রূপ ওদের সঙ্গে যাক।বন্ধুত্ব আর প্রেমের যাঁতাকলের মধ্যে রূপকে ফেলে,ওকে পিষতে ইচ্ছে করলো না সমুর।ও বলে উঠলো,
-না রূপ!তুই থাক!আমরা যাচ্ছি!
সমু দেখলো ওর এইটুকু কথাতেই নিশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ও এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো রূপের একটা হাত...নিশার আনন্দে ভরা উজ্জ্বল মুখটার দিকে চেয়ে রূপ কোনোক্রমে বললো,
-হুম!!
কিন্তু যে মুহূর্তে ও দেখলো,ঋষি আর সমু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো ওরই চোখের সামনে দিয়ে,আর সহ্য হলো না।জ্বালা করে উঠলো চোখটা।বড্ড অসহায় লাগলো নিজেকে....নিশা ওর জড়িয়ে ধরা হাতটা ছেড়ে দিয়ে,ওর আঙুলের ফাঁকে আটকে দিলো নিজের পাঁচটা আঙুল... শক্ত করে চেপে ধরলো ওর হাত।হাসিমুখে চাইলো ওর দিকে।রূপের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।কি হয়েছে সৌরর?!
নিশার মৃদু টানে রূপ আবার গিয়ে দাঁড়ালো ফুচকার দোকানে।বিস্বাদ লাগলো ও টক-ঝাল মুখরোচক খাবারটাও।মনটাই যে বড্ড ভারী হয়ে গেছে....
-কিসের দায়বদ্ধতা ওর?বলেনি কিছু?
বিধ্বস্ত সৌরকে জিজ্ঞেস করলো সমুদ্র...
-জানিনা!আমি কিচ্ছু জানিনা!আমার সঙ্গে কথা বলছে না।আমার ফোন ধরছে না।আজকের পর কোনোভাবেই আমি আর ওর সঙ্গে,যোগাযোগ করতে পারবো না।পাগল হয়ে যাবো রে আমি....
-এই দাঁড়া তো!তুই আমাদের এত জ্ঞানের গল্প দিস!নিজের বেলায় এত ভেঙে পড়লে হবে?!একটু সময় দে।ওকেও,নিজেকেও।সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আমি পরীক্ষা দেবো কি করে?পড়বো কি করে?
-এই সৌর!!এইরকম পাগলামি করলে থাবড়া মেরে একদম সোজা করে দেবো কিন্তু।দেখ তুই ওকে যা বলার....একি তুই!!তুই চলে এলি!?তোকে তো নিশার কোলে গছিয়ে এলাম!তুই এখানে কোত্থেকে টপকালি?!
সাইকেল থেকে রূপকে নামতে দেখে সমুদ্র বলে উঠলো....সাইকেল লক করে,ওদের ত্রিমূর্তির সামনে এসে দাঁড়ালো রূপায়ণ....
-নিশা আমাকে ভালোবাসে সমু,আর সত্যিই ভালোবাসে।তোরা সবাই এখানে রয়েছিস,সৌর কোনো কারণে আপসেট হয়ে রয়েছে!আর তারপরও তোরা সবাই যদি ভাবিস,আমি এই অবস্থায় নিশার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করবো,ভুল করবি ভাই!!নিশা তো কদিন হয়েছে আমার জীবনে এসেছে।আর আমরা তো ব্রাদার্স ফর লাইফ!ব্রাদার্স ফ্রম ডিফারেন্ট মাদার্স!!সেদিন বলেছিলো সৌর,মনে নেই!!ভাইয়ের কিছু হয়েছে জানার পর থেকে,আমি থাকতেই পারছিলাম না ওর সঙ্গে।আর ও আমাকে দেখেই বুঝেছে,যে আমি মন থেকে ওর সঙ্গে থাকতে পারছি না,জোর করে রয়েছি।তখনই বললো,যা!জোর করে থাকতে হবে না।গিয়ে দেখ,সৌরর কি হলো!রাতে ফোন করবি!!ও মায়ের ওষুধ নিয়ে পরে আসছে...
তারপর চ্যাম্প?!বল ভাই!কি হলো?আমাদের লিডার এইভাবে মুখ লটকে বয়সে থাকলে হবে?!স্পোর্টস-পার্সন তুমি!!ফাইট করো!
সৌরকে জড়িয়ে ধরে ওর পাশে বসলো রূপায়ণ...তারপর বললো,
-ব্যাস!!কিছু না জেনেই অনেক জ্ঞান দিয়ে দিয়েছি।এবার বল তো ভাই!কি হয়েছে?
সমুদ্র আর ঋষি ঘটনার সংক্ষিপ্তসার রূপকে জানিয়ে দিলো...সবটা শুনে রূপ মুখ খুললো...
-দেখ!কিছু তো একটা সমস্যা আছেই।এবার তোকে জানতে হবে ওর সমস্যাটা কি?আগে থেকেই ভালোবাসি-ভালোবাসি বলে লাফাস না।ও জানলো,তুই ওকে ভালোবাসিস।তুই আন্দাজ করছিস,তিলোত্তমাও হয়তো তোকে ভালোবাসে,কিন্তু ও এখনও এডমিট করেনি।এবার তোকে জানতে হবে ওর সমস্যাটা কোথায়?!পারিবারিক কোনো সমস্যা!শারীরিক!!নাকি ব্যক্তিগত?!সেসব জেনে নিয়ে,আগে সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা কর।ওগুলো না করে,ওকে পাওয়ার জন্য অযথা লাফালে,সবার আগে ওকেই হারাবি ভাই।কারণ,দিনরাত কানের ধারে ওই এক কথা বললে,পাগলামি করলে,ও তোর থেকে পালাবেই।আর ধরতে পারবি না ওকে!!এই আমাকেই কম করতে হয়েছে নিশার জন্য!!শেষের দিকে শুধু ওর পাশে থাকার চেষ্টা করতাম,আর কিছুই বলতাম না।বিশ্বাস কর ভাই!নিশার মতো জেদী মেয়েকে,শুধু ভালোবেসেই ভেঙে ফেলেছি আমি।কিন্তু সেটা কাজের মাধ্যমে,ব্যবহারে,চালচলনে....মুখে নয়!ভালোবাসি-ভালোবাসি শুনতে-শুনতে ওরা না বিরক্ত হয়ে যায়।ধৈর্য্য ধর!একটু অপেক্ষা কর।ওকে নিজেকে খুলতে দে।তুই জোরাজুরি করলে,উল্টে ও আরও শামুকের মতো খোলসের ভিতরে গুটিয়ে যাবে।ওকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার সময়টুকু আগে দে।তুই বুঝদার!আশা করি,তোকে বেশি বোঝাতে হবে না....
-ভাই!মাসে কত টাকা টিউশন-ফি নিচ্ছে নিশা!!ভালোই তো ক্লাস নিচ্ছে দেখছি....আমিও যাবো!আমিও বুঝবো!!
সমুদ্র অবাক হয়ে রূপকে বললো....
-আবে চুপ!দেখছিস ভাইয়ের মন খারাপ!!
-হ্যাঁ তো সেটাই ভালো করার চেষ্টা করছি।ভাই আমাদের কি বলছে দেখ!ও বলছে,মিছরি এই রকম করলে,আমি পরীক্ষা দেবো কি করে?!পড়বো কি করে?
চমকে উঠে সৌরর দিকে ফিরে চাইলো রূপ।
-এই ভাই!তোর তো দেখছি সাংঘাতিক অবস্থা রে!এ সৌর!কে যেন আমাদের সবাইকে জ্ঞান দিতো,পড়াশোনা ভালো করে কর।পরীক্ষাটা ভালো করে আগে দে!যখন যেটা করার সময় তখন সেটা কর।এসবের জন্য তো সারাটা জীবন পড়ে আছে।কোথায় সেই চ্যাম্প?!তুই এত তাড়াতাড়ি হেরে গেলি ভাই!!কোথায় সেই লিডার সৌরদীপ সাহা??মেন্টর সৌরদীপ সাহা?!কোথায়??
কেঁদে ফেলে রূপের বুকে মাথা ঠেসে দিলো সৌর....
-আর পারছি না ভাই!আর পারছি না!একটু কথাও তো বলতে পারে!কথাও তো বলছে না!ফোনই ধরছে না।কতবার ফোন করলাম!!পাগলের মতো ফোন করেই যাচ্ছি...
ফুলে-ফুলে উঠছে সৌরর পিঠ।ঋষি মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।মন-ভাঙার যন্ত্রণা খুব ভালোভাবেই জানে ও।সদ্য-সদ্য রঞ্জা ওর হৃদপিন্ডে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।সেই ক্ষত এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি।তার ওপরে সৌরকে এইভাবে ভেঙে-ছড়িয়ে যেতে দেখে,মনটা একদম ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো ঋষির।সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষাও জানা নেই ওর...সমুদ্রও দিশেহারা।একমাত্র হাল ধরে রেখেছে রূপায়ণ।
-চল!!ওঠ!আরে ওঠ সৌর....বলেছিলি আমাদের দৌড় করাবি পরীক্ষার পর।আজকের পর তো আর এই মাঠে দেখা হবে না।কাল একবার মাত্র যাবো স্কুলে এডমিট আনতে....আর সেই বিকেলে টিউশনে।তারপর যে যার বাড়ি...আর তারপর একেবারে পরীক্ষার হল।আজকের সন্ধ্যেটা সবাই মিলে মনে রাখার মতো করে রাখি,চল!!
-আমার কিছু ভালো লাগছে না রূপ।
-ফাইন!ভেবে দেখ!তোর ভাই তোর ভালোবাসার জন্য,নিজের ভালোবাসার সঙ্গে পর্যন্ত সময় কাটায়নি।আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই।তা সত্ত্বেও তুই এমন করবি!?আমি নিশাকে একা রেখে এসেছি সৌর,তোর জন্য...আমারটাও ভালোবাসা,তোরটাও!বুঝি রে আমি....
-ভাই!!
সৌর জড়িয়ে ধরলো রূপকে....
-চল ওঠ-ওঠ-ওঠ!বি আওয়ার ক্যাপ্টেন!
ঘাসের ওপরে বসে থাকা সৌরর দিকে,নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দেয় রূপ.... সেই হাতে হাত রেখে উঠে পড়ে সৌর...
-কি করবো?
-চল!আমরা জীবনযুদ্ধে জেতার জন্য দৌড়োবো।ধর এই মাঠটা আমাদের গোটা জীবনটা।আর যে ছোটখাটো গর্ত,উঁচু-নীচু জায়গাগুলো আছে,সেগুলো যুদ্ধ!!জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই এগুলোর সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে।অর্থাৎ এই মাঠটাই একটা জীবনযুদ্ধ!!পুরো মাঠ একপাক দৌড়ে,জীবনযুদ্ধে জিতে ঠিক এইখানেই আসতে হবে সবাইকে।যে আগে আসবে,সেই জিতবে....যুদ্ধ অসমাপ্ত রাখা যাবে না কিন্তু....শেষ করতেই হবে....
-ডান-ডান!!
উত্তেজনায় লাফাতে লাগলো ঋষি....রূপ নিজেদের জুতোগুলো পাশাপাশি রেখে,টেনে দিলো জীবনযুদ্ধের কাল্পনিক ফিনিসিং লাইন....
-এ ভাই,এ....এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগে সবে উঠেছি।আমি তো এই জীবনের যুদ্ধে হারবোই...দৌড়োনো মাথায় থাক,জোরে হাঁটতে গেলেই তো বুক কাঁপে।শরীর এত্ত দুর্বল!!
-আরে তোকে হারতে দিলে তো!!মাথায় করে নিয়ে যাবো তোকে....তুই যুদ্ধটা শুরু তো কর।তোর ভাইরা আছে না?!ঠিক টেনে তুলবে তোকে....
-চল!ডান ভাই!!
সৌর চোখটা ভালোভাবে মুছে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো রূপকে....সৌরর পিছনেই রূপ আর ঋষি চট করে হাত মিলিয়ে নিলো।সমুদ্রর মুখেও বাঁকা হাসি।ওরা ঠিক জানে,সৌরর যতই মন-খারাপ থাকুক,খেলা-শরীরচর্চা-দৌড়াদৌড়ি পেলে,ও সব কষ্ট সাময়িক ভুলে থাকতে পারে....তাই সেটাই ওকে দিয়ে করাচ্ছে রূপ।সমস্ত মনখারাপ ঝেড়ে ফেলে সৌর নিজেকে প্রস্তুত করলো দৌড়োনোর জন্য।ওরা চারজনই জুতো খুলে এক জায়গায় রাখলো।সমুদ্র এসে দাঁত বের করে দাঁড়ালো জীবনযুদ্ধের ঘোড়দৌড়ের প্রথম সারিতে,তারপর ঋষি,তারপর রূপ!রূপ এসেই তাকালো সৌরর দিকে,সবশেষে সৌর এসে দাঁড়ালো অন্তিম সারিতে।রূপ বেশ অবাক হয়ে দেখলো,কোথায় সেই দুর্বল পুরুষ?!যে একটু আগে ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো!!কঠিন চিবুক,কাটা-কাটা মেদহীন গাল,প্রখর অগ্নিদৃষ্টি....একভাবে সৌর চেয়ে রয়েছে তার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে,জয়ের দিকে।জয়ী হওয়ার জন্য উন্মুখ সে.....জীবনের কোন যুদ্ধই,সে আর অসমাপ্ত রাখবে না।সৌর নিজের সর্বস্ব দিয়ে আজ জয়ী হবে....একবার মাত্র তিনজনের দিকে চেয়ে নিজের জায়গায় আসীন হলো সৌরদীপ সাহা।তারপর "স্টার্ট" বলেই চিতার বেগে ছুটলো সবাইকে পিছনে ফেলে।ওর ওই তীরের গতি দেখে,দৌড়োতে-দৌড়োতেই একবার ঋষির দিকে হাসিমুখে চাইলো রূপ....কিন্তু দুর্বল সমুদ্র ততক্ষণে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে...
ছুটতে-ছুটতে একবার পিছন ফিরে চাইলো সৌর।সব বন্ধুরাই অনেকটা পিছনে পড়ে গেছে।সমুদ্র তো হাঁপিয়ে গিয়ে বসেই পড়েছে মাঠে....উল্টোদিকে ঘুরে দৌড়োনোর গতিবেগ কমিয়ে সৌর চিৎকার করতে শুরু করলো,
-কিরে আয়!!ফাস্ট....
-তুই যা ভাই....আমাদের দম শেষ!আমরা আস্তে-আস্তেই যাবো!দৌড়ে-দৌড়ে মরে গেলেও,তোকে হারাতে পারবো না।তুই এমনিতেও প্রথম হবি!!বেকার দৌড়ে লাভ নেই...
-তার মানে তোরা চেষ্টাও করবি না!?
সৌর নিজের দৌড় ছেড়ে ছুটে এলো ওদের দিকে....সেই মুহূর্তেই ঋষি আর রূপ সৌরকে ঠেলে মাঠের মধ্যে ফেলে দিয়ে,হাসতে-হাসতে ছুটলো ওর আগে....
-শালা চিটিং!!
-এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার!!আর এটা তো জীবনযুদ্ধ!!সবকিছু চলবে ভাই...
সামনের দিকে দৌড়োতে শুরু করলো ঋষি আর রূপ...কিন্তু সৌর আর এগোতে পারলে না।ও পিছিয়ে এলো মাঠে বসে পড়া ক্লান্ত সমুদ্রর দিকে....
-কিরে ভাই?ওঠ!
-পারবো না!সবে-সবে জ্বরটা ছেড়েছে তো!চোখমুখ
অন্ধকার হয়ে আসছে রে....তোরা যা!আমার জন্য থামিস না।আমি হেরেই যাবো!ও ঠিক আছে।
-জিতবো তো তোকে সঙ্গে নিয়েই....নইলে নয়...চল!!ওঠ!!
সৌর একটা হাত এগিয়ে দিলো সমুদ্রর দিকে।টেনে তুললো ওকে...
-পারতেই হবে!চল...
সৌরর কথায় সমুদ্র যেন অন্যরকম একটা উৎসাহ পেলো....
-চল!!
ছুটতে শুরু করলো সমুদ্র।বুকের খাঁচার ভিতরে হৃদপিন্ডটা লাফাচ্ছে ভীষণভাবে।মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবে ও....তাও সৌরকে কিছু না বলে,দাঁতে-দাঁত চেপে ছুটতে শুরু করলো ও...ধীরে-ধীরে কমে গেলো সমুদ্রর গতি।
-ভাই পারছি না!!পড়ে যাবো!মাথা ঘুরছে!কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না রে...
মুখ থুবড়ে পড়লো সমুদ্র...সৌর থেমে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
-ঋষি....
ঋষি আর রূপ মাঠের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে।অর্থাৎ জীবনের অর্ধেক পথ!যতটা দ্রুত ওরা সামনের দিকে এগোচ্ছিলো,ততটাই দ্রুতবেগে সেইখান থেকেই উল্টোদিকে দৌড়ে ফেরত চলে এলো....
-এই সমু!
সমুদ্রকে টেনে তুললো সৌর...
-দাঁড়া সৌর!আমার গলা একদম শুকিয়ে গেছে!
হাঁপাতে-হাঁপাতে সমুদ্র বললো।
-এই ঋষি,আমার ব্যাগে জলের বোতল আছে।আগে ছোট....
ছুটে সৌরর ব্যাগের দিকে এগোলো ঋষি...সমুদ্র তখনও বলছে,
-ও কিছু না!শরীরটা দুর্বল তো তাই...একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে!আসলে কাল রাত থেকে কিছু খাইনি তো!!
-মানে?কেন?
ততক্ষণে ঋষি জলের বোতল নিয়ে এসে গেছে ওর কাছে....একটু জল খেলো সমুদ্র...
-এ ভাই!কি হয়েছে রে তোর?
অস্থির হয়ে পড়লো সৌর...
-কাল রাত থেকে কিছু খায়নি বলছে...
রূপ ঋষিকে বললো।
-কেন?সমু!!কিরে?কেন?
-রূপ আজ খাওয়াবে বলেছিলো,তাই...
-টেনে একটা থাপ্পড় মারবো সমু!কি হয়েছে বল!!
-মা-বাবা আমার গিটারটা নিয়ে নিয়েছে রে ভাই!দিচ্ছেই না।বলেছে পরীক্ষার আগে আর দেবে না!আমি তো ওটা ছাড়া মরেই যাবো রে....ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে,রাগ করে,জেদ করে,কাল রাত থেকে কিছু খাইনি...তবুও দিচ্ছে না আমার গিটারটা...
কাঁদতেই পারে না সমুদ্র,সৌর জানে সেটা।ও দুহাতে সমুদ্রকে চেপে ধরলো নিজের বুকে....
-কাল রাত থেকে,এই বিকেল পর্যন্ত,এখনও তুই না খাওয়া ভাই?!
-না!আমাদের বাড়ির ছাদে গোলাপ ফুল ফুটেছে।কাল রাতে ওর সুন্দর গন্ধ শুঁকেছি।পেট ভরে গেছে....
-উফফ!সমু!কি যে করিস না তুই?!চল!ওঠ!কিছু খাবি চল...
-খিদে নেই ভাই!!
-এ বাল!কথা কম বল!চুপচাপ আসবি আমার সঙ্গে...ওঠ!চল!এই এটাকে টেনে তোল তো!!
সৌর এগোতে গেলো নিজের জুতোর দিকে।পকেটে হাত দিয়ে একবার দেখে নিলো,মানিব্যাগটা ঠিক আছে কিনা!!
-ভাই?
সমুদ্রর ডাকে আবার পিছন ফিরলো সৌর...
-কি?
-আমার জীবনযুদ্ধটা যে অসমাপ্ত রয়ে গেলো....আর আমার জন্য তোদেরটাও....
একবার মাঠের দিকে চাইলো সৌর।অন্ধকার নেমে এসেছে প্রায়।সাদা আলোগুলো একে-একে জ্বলে উঠছে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে....সৌর এগিয়ে গেলো সমুদ্রর কাছে,ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-কিচ্ছু অসমাপ্ত থাকবে না!!আমি আছি না?!তোর ভাই আছে....
-আবে ও!আমরা কি ইনভিজিবল নাকি?!বল,ভাইরা আছে...
রূপ বলে উঠলো।হেসে সমুর কাঁধে হাত রাখলো ঋষিও....
-চল!!তোর যুদ্ধটা আমরা লড়বো....তোকে পিছনে ফেলে নয়।তোকে বহন করে নিয়ে!পারবি না মানে!!চল!
-দ্যাটস আওয়ার ক্যাপ্টেন!!
-চল!!
-ওই কি করছিস তোরা?ওরে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে তো রে?!
-ওরে তোর ভাইরা আছে তো!চিন্তা কি?!
সমুদ্রর দুটো পা ধরে ওকে কাঁধে তুলে নিলো ঋষি আর রূপ....নিজের চশমাটা সামলে নিয়ে,দুজনের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে ওকে জড়িয়ে ধরলো সমু....সৌর দৌড়ে এগিয়ে গেলো ওদের একটু আগে-আগেই....জীবনযুদ্ধের লড়াইতে মাঝপথে থমকে যাওয়া,মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া সমুদ্রকে কাঁধে বহন করে,সৌরর নির্দেশ অনুধাবন করে,ছুটে চললো রূপ আর ঋষি....মুখে হর্ষধ্বনি...সমুদ্রর চোখে চিকচিক করছে জল....
-উই আর অলমোস্ট দেয়ার...
সৌর ওই জুতোর সারির কাছাকাছি পৌঁছে চিৎকার করে কমিয়ে আনলো নিজের গতি....অপেক্ষা করতো লাগলো বন্ধুদের জন্য।সমুদ্রকে নিয়ে ওরা পৌঁছনো মাত্রই,চারজনই একসঙ্গে স্পর্শ করলো ফিনিসিং লাইন....সৌর-ঋষি আর রূপ নিজের পা দিয়ে,সমুদ্র রূপ আর ঋষির কাঁধে চেপে...তারপর চারজনই শুয়ে পড়লো খোলা আকাশের নীচে,সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে...
সমুদ্র হাসতে-হাসতে বললো,
-এটা কি হলো?এর নাম কম্পিটেশন?কে জিতলো?কে হারলো?সবাই তো একসঙ্গেই পৌঁছলাম....
-এটাই তো আসল যুদ্ধজয় রে ভাই!একসঙ্গে জেতার মজাই আলাদা!আমরা সবাই জিতেছি।একে-অপরকে পিছনে ফেলে-পায়ের তলায় পিষে-মেরেকেটে নয়,একে-অপরকে সঙ্গে নিয়ে জিতেছি!সবাই জিতেছি,কেউ হারিনি!কারোর লড়াই অসমাপ্ত নয়!!আমরা সবাই যুদ্ধজয় করেছি,সবাই জয়ী!রাইট?
সৌরর কথা শুনে হেসে মাথাটা নামিয়ে নিলো সমুদ্র....রূপ বললো,
-রাইট!!
ঋষি বললো,
-এ ভাই!পরে কথা বলছি!আগে হালকা হয়ে আসি!জোর হিসি....এরপর প্যান্ট ভিজে যাবে...
সবাই সমস্বরে হেসে উঠলো ওর কথা শুনে....ঋষি উঠেই দৌড়োলো ক্লাবের পিছন দিকের জঙ্গলে....
-চল!খাবি চল!মিন্টুদার এগরোল!সবাই খাবো!
সমুদ্রর সামনে এসে সৌর বললো...
-মিন্টুদা আজকাল ডিম পাড়ে নাকি?!
-ইস!!
রূপের কথা শুনে হেসে ফেললো সৌর...
-ভাই তুই বললি,মিন্টুদার এগের রোল!বলবি তো,মিন্টুদার দোকানের এগরোল!অর্ধেক কথা বললে,বুঝবো কি করে ভাই?!
সৌর এগিয়ে গিয়ে,একটা লাথি মারলো রূপের কোমরে।রূপ মাঠে শুয়েই হেসে উঠলো সশব্দে...
-ছাড় না সৌর...আবার এসব!!
-চুপ!চল!আর আজ রাতে যদি না খাস না,আমি ফোন করবো তোর বাড়িতে।কাকিমার সঙ্গে আমি কথা....
-না সৌর!প্লিজ!এসব করিস না!প্রমিস কর,করবি না...
-আচ্ছা করবো না!তাহলে তুই আগে প্রমিস কর খাবি!!
-গিটারটা বাবা দিচ্ছেই না সৌর!
-তো?তুই গিটারের জন্য আমৃত্যু অনশন করবি?!আমি তোকে গিটার কিনে দেবো।আমার বাড়িতে থাকবে।তুই আমার বাড়িতে এসে যখন ইচ্ছে প্র্যাকটিস করবি!এসব ছেলেমানুষি ছাড় সমু!
-নাঃ!ওটা আমার প্রথম গিটার!অনেক ভালোবাসা-রাতজাগা-অনেক চোখের জল-অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওটার সঙ্গে।ওটা আমার প্রাণ রে ভাই।ওটাকে আমি ছাড়বো না!!
-আচ্ছা বেশ!ছাড়তে হবে না।খাবি তো আজ রাতে?প্রমিস কর!
-খাবো!প্রমিস!!
-গুড বয়!চল এবার!এ ভাই,ঋষি কতদিন ধরে স্টোর করে রেখেছিলো ভাই?এতক্ষণ লাগে হালকা হতে?!
-ওই যে,নাম নিতে-নিতে আসছে...
-ভাই রূপ!চল-চল,ওঠ!একটু খাওয়া-দাওয়া করে বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসতে হবে।রাত জাগতে হবে।অনেক কাজ!আর দেরি করা যাবে না!চল ভাই...
সমুদ্র অবাক হয়ে দেখলো,আবার সৌরর মধ্যে সেই দায়িত্বসুলভ কর্তৃত্ব করার লড়াকু মানসিকতা ফিরে এসেছে।অথচ এই ছেলেই আজ কিছুক্ষণ আগে,পাগলের মতো কাঁদছিলো....ঋষি আসার পর ওরা চারজন নিজের জুতো পরতে শুরু করলো....সমুদ্র আর থাকতে পারলো না,জিজ্ঞেস করেই ফেললো সৌরকে,
-সৌর?
-বল ভাই?
-আজ আমরা সবাই কি কারণে মাঠে এসেছিলাম রে?
ব্যাগটা পিঠে নিয়ে নিলো সৌর।ওর ঠোঁটের কোণে খেলে গেলো একটু হাসি।নিজের বাহুবন্ধনের মধ্যে আগলে-জড়িয়ে ধরে থাকা মিছরির ভেজা শরীরটা মনে পড়ে গেলো....একটু হেসে ও বললো,
-আমার মন খারাপ ছিলো!!
বলেই সৌর এগিয়ে গিয়ে সাইকেলের লক খোলার জন্য নীচু হলো...সমুদ্র এসে দাঁড়ালো ওর পাশে,
-আর এখন?
-বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে অসমাপ্ত জীবনযুদ্ধও জয় করে ফিরে আসা যায়,আর এত সামান্য মনখারাপ!তার সাধ্য কি,সৌরদীপকে ঘিরে রাখে?!তোরা আছিস না?!ঘিরে রাখবি আমাকে...
ঋষি-রূপ আর সমুদ্র হাসিমুখে এগিয়ে দাঁড়ালো সৌরর কাছে।একভাবে চেয়ে রইলো ওর দিকে...
-কি?ওইভাবে কি দেখছিস!
সাইকেলে উঠে বসলো সৌর...বকবক করতেই থাকলো,
-আমার জন্য তোমরা যতই যাই করো না কেন,চুমু-টুমু কিছুতেই খেতে পারবো না।নো চুমু!!চলো,মিন্টুদার রোল খাইয়ে দিচ্ছি...
সবে মুখ খুলতে যাচ্ছিলো রূপ....তার আগেই সৌরই আবার বলে উঠলো,
-হ্যাঁ-হ্যাঁ!মিন্টুদা ডিম পাড়ে না।তাই ওর রোল নয়,ওর দোকানের রোল....ভাইলোগ!ফলো মি!!
সজোরে হেসে সাইকেল নিয়ে সবার প্রথমে বেরিয়ে গেলো সৌর।তারপর একে-একে ঋষি-রূপ ও সমুদ্র....
মনখারাপিয়া মেঘগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো ধীরে-ধীরে....বা হয়তো ভারী হয়ে নেমে এলো ঝিরঝিরে বৃষ্টিরূপে...সেই বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে চারবন্ধু চললো গরম-গরম রোল খেতে।সৌর দোকানে ঢুকেই নিজের রুমালটা বের করে দিলো সমুর হাতে।
-ভিতরে ঢোক-ভিতরে ঢোক!আরে আগে মাথাটা মোছ!ঠান্ডা লেগে গেলে,আবার জ্বরটা ঘুরে আসবে।আর রুমালটা রেখে দে।মাথায় বেঁধেই বাড়ি যাবি।তারপর নিজের হাতে সমুদ্রর সাইকেলটা দোকানের ভিতর দিকে ঢুকিয়ে দিলো সৌর।
-তোরা ভিতরে গিয়ে বেঞ্চে বোস।আমি মিন্টুদাকে অর্ডারটা দিয়ে আসছি!
সৌর ছুটলো দোকানের সামনের দিকে....
বৃষ্টিস্নাত এক সন্ধ্যায় পিঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা কুচি-টমেটো সস-চিলি সস সহযোগে,গরম-গরম নরম রোলে কামড় দিয়ে,ওরা নিজেদের অজানা ভবিষ্যতের কথা নিয়েই মেতে রইলো।সৌর নিজের আধখাওয়া রোলটা ঠেসে ঢুকিয়ে দিলো সমুদ্রর মুখের মধ্যে।ওর মনে ভয়,ছেলেটা যদি আজ রাতেও না খেয়ে থাকে!!তাই ওকে যতটা পারলো,খাইয়ে দিলো...তারপর চারটে চা নিয়ে জমিয়ে গল্প করতে লাগলো....
বাইরে বৃষ্টির গতিবেগ বেড়েই চললো।সমুদ্রের মনে হলো,দোকানের বাইরে টিনের চালে যেন জলতরঙ্গ বাজছে বৃষ্টির তালে-তালে।সেই সঙ্গে ওর মস্তিষ্কেও...
চায়ে বারকয়েক চুমুক দিয়েই সমুদ্র বেঞ্চ বাজিয়ে মৃদু সুরে গান শুরু করলো,
-ওগো আকাশ,ঝোরো না আজ অঝোর ধারায়/
তোমার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যে/অকারণেই মনকেমন বাড়ায়...
সৌরর মনে পড়ে গেলো,মিছরির সঙ্গে প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা,ওর ভিজে চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়া!তারপর পুলের জলে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরা,ওর ভেজা শরীরটাকে নিজের বুকে করে আগলে রাখার মুহূর্তটুকু,ছবির মতো সৌরর চোখের সামনে ভেসে উঠলো....চোখের জলটাকে বাধা দেওয়ার জন্য,সৌর তাড়াতাড়ি করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো....সমুদ্র গেয়েই চলেছে....
-আজ আমার এ প্রেমিক মন/উতলা তার কারণ...
সে কি আসবে না?আমায় ভালোবাসবে না/ভেঙে সকল বারণ....
রূপের বড্ড মনকেমন করছে।যেদিন প্রথম মাঠে নিশা হ্যাঁ বলেছিলো রূপকে,সেদিনই দোকান থেকে ফিরতি পথে ক্লাবঘরের পিছনদিকের আলো-আঁধারিতে,রূপ পেয়েছিলো নিশার নরম ঠোঁটের স্বাদ!!নিশা আর আড়াল করে রাখেনি নিজেকে।পূরণ করেছে রূপের ইচ্ছেকে,সম্মান করছে।সেদিন রূপ দুহাত দিয়ে আঁকড়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো ওর নিশাকে...মাতাল করা গন্ধ ওর শরীরে....মাটির ভাঁড়ে রাখা চায়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো রূপ।নিজেদের সোনালী মুহূর্তের কথা ভেবে আবেগে,নিশার সঙ্গে কাটানো দুর্বল মুহূর্তের স্মৃতিচারণে,ওর চোখেও তখন কয়েক বিন্দু জলের আবির্ভাব....
-তোমার শরীরী-বিভঙ্গে কন্যা/এ কি অপার আমন্ত্রণ,
পুরুষ প্রেমিক কোথায় হারাবে/কিভাবে এড়াবে ওই দুখানি তৃষাতুর চোখের নিমন্ত্রণ....
ছাতা মাথায় দিয়ে ঝোরো হাওয়ায় উড়ে যাওয়া,অবাধ্য শাড়ির আঁচল সামলে রানী ম্যাম যেদিন স্কুলে ঢুকছিলেন,সেদিন সমুদ্র একাদশ শ্রেণীর ছাত্র।বৃষ্টিতে ভিজে একদৌড়ে সমুদ্র ঢুকে গিয়েছিলো স্কুলে।কিন্তু ঢুকেই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো ও।কারণ,চশমার কাঁচে জল লেগে থাকায়,ও কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না।তাই তাড়াতাড়ি করে চশমাটা খুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁচটা মুছছিলো ও।চশমা মুছতে-মুছতেই দূরে আবছা একটা অবয়ব দেখেছিলো সমুদ্র।তাড়াতাড়ি করে চশমাটা চোখে পরে নিয়ে,ভালোভাবে দেখেছিলো তাকে।সেই দিনের পর থেকেই,আজ পর্যন্ত অন্য কোনো নারীর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি সমুদ্র....হারিয়ে গেছে ওই বৃষ্টিভেজা শাড়ির ভাঁজে... বাঁধা পড়েছে ওই সিক্ত শাড়ির কোনো এক অজানা সুতোর বন্ধনে....গলাটা ভারী হয়ে এলো সমুদ্রর।তাও ও দরাজ কণ্ঠে গেয়ে চললো,
-আজ শুন্য হাতে ফিরিও না তারে/সে যে তোমারই প্রেমে সিক্ত...
কন্যা তোমার চরণে সকল হারিয়ে/তোমার পুরুষ আজ রিক্ত...
চা-টা এতটা গরম বুঝতে পারেনি ঋষি।জিভটা বোধহয় একটু পুড়ে গেলো।আর সমুদ্রর গানের শেষ কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করামাত্র,পুড়ে গেলো অন্তরটাও.... সে তো ওকে ফিরিয়েই দিয়েছে,শুন্য হাতে।নিজেকে রিক্ত করে ঋষি শুধু রঞ্জাকে ভালোবেসেই গেছে,আর বিনিময়ে পেয়েছে অপমান আর অসম্মান!!মাথাটা নামিয়ে নিয়ে চোখের জলটুকু আড়াল করে,আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলো ঋষি।জিভটা পুড়ে যাওয়ায়,আর বুঝি কোনো স্বাদের বার্তা গ্রহণ করলো না জিহ্বা....
কম্পিত কণ্ঠে সমুদ্র গেয়ে উঠলো,
-ওগো আকাশ,ঝোরো না আজ অঝোর ধারায়/
তোমার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যে/অকারণেই মনকেমন বাড়ায়...
স্তব্ধ চারজন পুরুষ।কেউই আর কোনো কথা বলতে পারলো না।ভারাক্রান্ত মন....সবার আগে সৌরই উঠলো।মানিব্যাগটা বের করে প্রায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
-এভাবে গানগুলো নষ্ট করিস না ভাই!চায়ের দোকানে,পাড়ার মোড়ে,মাঠেঘাটে নিঃশেষ করিস না নিজেকে।খনি আছে তোর মধ্যে।যত্ন করে রাখ,সাবধানে রাখ!বৃষ্টিটা একটু ধরেছে।চল!বেরিয়ে যাই।আবার নামলে অনেক রাত হয়ে যাবে বাড়ি ঢুকতে।তোরা আয়,আমি টাকাটা....
আর বলতে পারলো না সৌর।গলা চিরে বেরিয়ে আসছে কান্না!বেরিয়ে গেলো ও।সমুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো,সৌর যেতে-যেতে পিছন ফিরে চোখের জলটা মুছে নিলো....
-চল!কাল স্কুলে দেখা হচ্ছে!!বাই!!
মনটা সবারই বেশ ভারী।চোখে অশ্রু-সহযোগে চারটে জীবন সাইকেলে চেপে চলে গেলো চারদিকে।ভেজা পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে প্যাডেল করে,ওরা হারিয়ে গেলো নিজস্ব ঠিকানায়...মিন্টুদার টেবিলের ওপর মাটির শুন্য চারটে ভাঁড় সাক্ষী রইলো আজকের স্মৃতিমেদুর-মনকেমন করা সন্ধ্যার....
সমুদ্র ফেরত পায়নি ওর গিটার।কিন্তু ও সৌরকে কথা দিয়েছিলো,তাই রাতে খেয়ে নিয়েছে।পাগলটা আবার ফোন করে খোঁজও নিয়েছে,সমু খেয়েছে কিনা!!খেয়েছে তো সমু,ডাইনিং টেবিলে বসে চুপচাপ খেয়েছে।যত না খাবার খেয়েছে,তার চারগুণ বেশি বাবার কাছে ঝাড় খেয়েছে।ওতেই ওর অর্ধেক পেট ভরে গেছে।বাবা-মার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারে না সমুদ্র,সেভাবে কাঁদতেও পারে না।তাই কোনোরকমে আধপেট খেয়েই,ও ওপরে চলে এসেছে।তারপর থেকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় চুপটি করে শুয়েছিলো।বুকের ওপর ইংরেজি বইটা খোলা রয়েছে।হাত রেখেছে সেই বিশেষ পৃষ্ঠাটায়,যেখানে রানী ম্যাম পড়াতে-পড়াতে দাগ দিয়ে দিয়েছিলেন বহুদিন আগে....সমুদ্রর মাথার কাছের জানলাটা খোলাই রয়েছে।বইটা বিছানার ওপর নামিয়ে রেখে,ও একটু এগিয়ে গেলো জানলার কাছে।অনাবৃত সমুদ্রর গা!বৃষ্টিভেজা শীতল হাওয়ায় কেমন যেন একটু শীত-শীত করছে।একটা শার্ট টেনে দুটো হাত গলিয়ে নিলো সমুদ্র,বুকটা খোলাই রইলো।চোখ থেকে চশমাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানায় রাখা বইয়ের ওপর।থাক!!একটু ঝাপসাই থাক!!জীবনের কিছু অধ্যায় অস্পষ্ট-অসমাপ্ত থাকাই ভালো!চোখে ভালো মতো দেখতে পাচ্ছে না সমুদ্র।তাই বুঝি ওর ঘ্রানেন্দ্রিয় একটু বেশিই সজাগ হয়ে উঠলো।মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে-সঙ্গে গোলাপফুলের একটা পাগলপারা সৌরভ ভেসে আসছে ওর নাকে....চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো সমুদ্র....কাল তাকে ও দেবে ওই রক্তাক্ত গোলাপ,আর সঙ্গে নিজেকেও....বাবা গিটারটা দেয়নি।তাতে কি হয়েছে?!সুর তো সমুদ্রর মনের গহীনেই বাজছে....সেই সুরকেই কথায় বাঁধলো সমুদ্র...জানলার পাশের পড়ার টেবিলে বসে টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে,আধো-অন্ধকারের মধ্যেই,সাদা কাগজে গোটা-গোটা অক্ষরে লিখে ফেললো কয়েক ছত্র,
যে ছন্দে আমি নেই/সেই কবিতা একদিন লিখো তুমি,
যে সুরে আমি নেই/সেই গান একদিন গেয়ো তুমি,
যে আকাশে আমি নেই/সেই আকাশের মেঘ হয়ো তুমি...
অঙ্গ তোমার হরিদ্রা-পেলব/কালো তোমার কেশ,
তোমার সনে পাড়ি দেবো/অজানা এক দেশ...
লাল গোলাপের শিশিরভেজা পাপড়ি/তোমার গলার ভাঁজে,
আমার উষ্ণ স্পর্শে তুমি/রাঙা হলে লাজে...
যে ছন্দে আমি নেই/সেই কবিতা একদিন লিখো তুমি,
যে সুরে আমি নেই/সেই গান একদিন গেয়ো তুমি,
যে আকাশে আমি নেই/সেই আকাশের মেঘ হয়ো তুমি...
আলোছায়া ঘেরা আমার মনের-আয়নায়/অবিরত দেখি তোমার মুখ,
তোমা বিনা হৃদয়ে মোর মেঘের ঘনঘটা/সকলই অসুখ!
তোমারে রাখিনু যতনে এ বক্ষ মাঝে/
কোনো এক শ্রাবণ-সন্ধ্যায়/তুমি নিজেরে খুঁজে নিও,আমারই বুকের ভাঁজে....
কন্যা/রেখো মোর এটুকু অনুরোধ/আজীবন তোমারেই প্রণমি...
যে ছন্দে আমি নেই/সেই কবিতা একদিন লিখো তুমি,
যে সুরে আমি নেই/সেই গান একদিন গেয়ো তুমি,
যে আকাশে আমি নেই/সেই আকাশের মেঘ হয়ো তুমি...
কাগজটা ছিঁড়ে যত্ন করে ভাঁজ করে,নিজের ঠোঁটে ঠেকালো সমুদ্র।তারপর স্কুলের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।মনটাকে বহুকষ্টে একত্রিত করে ইংরেজি বইটা সরিয়ে,বাংলার নোটসগুলোতে মনঃসংযোগের চেষ্টা করলো সমুদ্র......
জানলার বাইরে আবার বুঝি বৃষ্টি শুরু হলো....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
-তুমি পেরেছো মিছরি!
হঠাৎ করে ওরা দুজনেই কেঁপে উঠলো স্যারের ধমকে।
-সৌর!!কি করলে তুমি এটা?!একটা অঘটন ঘটে গেলে,কর্তৃপক্ষ কি জবাব দিতো ওর গার্জিয়ানকে?হাউ ডেয়ার ইউ?!
স্যারের ধমকে সৌর ছেড়ে দিলো তিলোত্তমাকে।তিলোত্তমা সৌরর কাছ থেকে সরে গিয়ে,সাঁতার কেটে উঠে পড়লো জল থেকে....ততক্ষণে সৌরও অন্যদিক দিয়ে জল ছেড়ে উঠে পড়েছে।দাঁড়িয়েছে স্যারের মুখোমুখি।মাথা নীচু করে সৌর বললো,
-সরি স্যার!!
-সরি?!সরির কোনো জায়গা নেই সৌর!তিলোত্তমা প্রচন্ড নার্ভাস ছিলো।জলের মধ্যে তুমি যে ওকে ওভাবে ছুঁড়ে ফেললে,ওর মাসল ক্র্যাম্প হয়ে গেলে,ও পারতো সাঁতার কাটতে?!তলিয়েই যেতো তো...
-আমি ছিলাম স্যার!!ওর কিচ্ছু হতো না...
স্যারের সঙ্গে কথা বললেও সৌরর নজরটা রয়েছে দূরে তিলোত্তমার দিকেই।ও রেলিং ধরে জল ছেড়ে উঠে,একটানে খুলে ফেললো ক্যাপ আর গ্লাস।তারপর ছুটতে শুরু করলো ওয়াশরুমের দিকে....স্যার তখনও বলে যাচ্ছেন,
-তুমি ওপরে ছিলে সৌর!সুইমার জোনে সেই সময় কেউ ছিলো না...এতটা রিস্ক তুমি কি করে নিতে পারো...সৌর!!আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি!
-ইয়েস স্যার!!সরি স্যার!!
-ওদিকে কি দেখছো তুমি?
-স্যার!এক মিনিট....আমি এক্ষুণি আসছি....
ভিজে গায়েই সৌর দৌড় মারলো তিলোত্তমা যেদিকে গেছে,সেদিকে...
-হোয়াট!!আমি কিছু বলছিলাম সৌর!
ততক্ষণে সৌর নাগালের বাইরে....
-উফফ!!নিয়ম-কানুন-ডিসিপ্লিন-ম্যানার্স,সব ভুলে যাচ্ছে ছেলেটা!
-আপনি আর কি করবেন স্যার!!এ হলো বয়সের দোষ!ও আপনি-আমি এই বয়সটা সবাই পেরিয়ে এসেছি।দেখুন মনে করে,এইরকম দু-একটা ঘটনা আপনারও ঠিক মনে পড়ে যাবে....
-বলছেন?!
-একদম!!
-আজই তবে মস্তিষ্কের কলকব্জা একটু নেড়েচেড়ে দেখতে হবে দেখছি,আসলে সব মরচে পড়ে আছে তো!!তবে একদম চুপিচুপি স্মৃতিচারণ করতে হবে।গৃহিনীকে কিন্তু জানতে দেওয়া যাবে না।কারণ,তিনি প্রথম নন কিনা!!জানলেই সংসার কুরুক্ষেত্র....এই বয়সে বাইরে এই বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ করে,আবার ঘরে গিয়ে যুদ্ধ,আর পোষাবে না বাপু....
সশব্দে হেসে ওঠেন দুজন....
-মিছরি!প্লিজ,একটু দাঁড়াও!সরি!আমি জানি লেডিজ বাথরুমের সামনে আসা ঠিক নয়!সরি....কিন্তু তুমি উঠে এলে কেন জল ছেড়ে?এখনও তো মিনিট দশেক সময় হাতে আছে...
কোনো উত্তর দিলো না তিলোত্তমা।একছুটে ঢুকে গেলো বাথরুমের ভিতরে।আর কিছু করার নেই সৌরর।এমনিতেই ও মিছরির পিছনে ছুটতে গিয়ে,নিজের সীমা-পরিসীমা,সবকিছু ভেঙে ফেলেছে বহু আগেই।কিন্তু এবার ওর সীমানা এই পর্যন্তই।এর বেশি আর এগোনোর ক্ষমতা নেই ওর....ওখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিলো সৌর....
-মিছরি!!কথা বলছো না কেন?প্লিজ!আমার সঙ্গে কথা বলো...
পিঠে ব্যাগ নিয়ে সুউচ্চ পাঁচিলের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো সৌর।মিছরি বেরোতেই ওর হাতটা টেনে,ওকে নিয়ে গেলো ওইদিকে...
-সৌর...ছাড়ো!
লাফাতে থাকা তিলোত্তমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে,ওর গালের ওপর দুটো হাত রাখলো সৌর।কোনো বাড়তি প্রসাধন নেই।কিন্তু তাও যেন গালের ওপর মাখনের একটা আলগা প্রলেপ লাগলো,এতটাই উজ্জ্বলতা ত্বকের!!ওর গালের ওপর লেপ্টে থাকা ভেজা চুল থেকে ভেসে আসছে মনমাতানো সুবাস।এতটাই নিখুঁত,এতটাই সযত্নে প্রতিপালিত এই নারী,যে একে ছুঁয়ে দেখতেও ভয় করে সৌরর।ওর কঠিন হাতের স্পর্শে যদি,আঘাত পায় মিছরি।দাগ লেগে যায় নিখুঁত ত্বকে....আলতো করে ওকে ছুঁয়ে সৌর বললো,
-না!তোমায় আজ কিছুতেই ছাড়বো না।আমি আর কাল থেকে আসবো না মিছরি!কদিন পরেই পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে।আবার কতদিন দেখতে পাবো না তোমায়।শেষদিনে এমন ঝামেলা কোরো না প্লিজ!আমার পড়াশোনা-পরীক্ষা সব গোল্লায় চলে যাবে...
কেঁপে উঠলো তিলোত্তমা....ভীত দৃষ্টিতে সৌরর দিকে চেয়ে ও বললো,
-মানে?!
মাথা নামিয়ে নিলো সৌর।আরও একটু এগিয়ে গিয়ে, নিজের কপালটা ঠেকিয়ে দিলো তিলোত্তমার কপালের সঙ্গে....তিলোত্তমা তখন ওর হাত থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে....
-আমাকে যেতে দাও!
-না!দেবো না যেতে।আগে বলো,তুমি ভালো করে কথা বলছো না কেন আমার সঙ্গে?তোমাকে জলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছি বলে রেগে গেছো?
চুপ করে রইলো তিলোত্তমা....
-আচ্ছা!বুঝতে পেরেছি।ওই জন্যই রেগে গেছো।তোমাকে প্রথম দিন একটা কথা বলেছিলাম,মনে আছে?একটা ধাক্কা!!সঠিক সময়ে ওই ধাক্কাটা আমাদের জীবনে ভীষণ প্রয়োজন মিছরি।কিন্তু আমি তোমাকে সেই ধাক্কাটুকুও দিতে পারিনি।ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলতে পারিনি।তাই তোমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম।আমি জানতাম,তুমি ঠিক পারবে।কিন্তু তাও কিছুতেই ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি।তোমাকে ফেলে দেওয়ার পর,আমিও নেমে পড়েছি জলে।স্যার ভুল বুঝছেন আমায়।উনি ভয় পেয়ে গেছেন,তোমার হঠাৎ কোনো অঘটন হয়ে গেলে,তোমার বাবাইকে কি কৈফিয়ৎ দেবেন!!কিন্তু তোমার বাবাই তো অনেক পরের কথা,আমার হাতে বা আমার হাতের বাইরে,তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে,আমিই মরে যাবো মিছরি....
-সৌর!আমাকে যেতে দাও!
-কেন এমন করছো মিছরি?
-আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে।
আর দাঁড়ায় না তিলোত্তমা।ছিটকে বেরিয়ে আসে সৌরর হাত থেকে...কয়েক পা এগোতেই ওর কানে ভেসে আসে সৌরর ভারাক্রান্ত কন্ঠস্বর...
-আই লাভ ইউ মিছরি!!আমি ভালোবাসি তোমায়...
থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমা।চোখে জল এসে গেছে ওর।কিন্তু এ যে অসম্ভব....চোখ মুছে নিয়ে,আবার ও চলতে শুরু করলো...দৌড়ে সৌর এসে আবার টেনে ধরলো ওকে...
-কেন এইরকম করছো?ডোন্ট ইউ লাভ মি?আমি জানি, তুমিও আমাকে ভালোবাসো!!
-আমি পারবো না সৌর!!
-কেন?
-তুমি কোনো কারণ জানতে চেয়ো না।শুধু এটুকুই জেনে রাখো,আমি পারবো না....
সৌরকে কথা বলার আর কোনো সুযোগ দিলো না মিছরি।দৌড়ে উঠে পড়লো গাড়িতে...ছুটে এসেও ওকে আর ধরতে পারলো না সৌর...ওর চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো গাড়িটা...সৌর নিজের সাইকেলের সামনে ফিরে গেলো।সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়েই নিজের ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে,আপ্রাণ চেষ্টা করলো না কাঁদার।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেঁদেই ফেললো ঝরঝর করে।পা তুলে একটা লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো সাইকেলটাকে....গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে পিছনে ফেলে আসা সৌরকে দেখে,গাড়ির সিটে বসেই,দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো মিছরি....
পিঠের ব্যাগে ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে।এতক্ষণে হুঁশ হলো সৌরর।ও তাড়াতাড়ি করে কম্পিত হাতে ফোনটা বের করলো,মিছরি হয়তো....না!!ফোন বলছে,মিছরি নয়।ওকে রূপ ফোন করছে....
-বল!
-কোথায় তুই?খুব ব্যস্ত না থাকলে একবার আসতে পারবি?রুমাদির টিউশনের সামনে!আমরা সবাই আছি...
-কেন?কি হয়েছে?
গলাটা কেঁপে গেলো সৌরর...
-এই দাঁড়া!!এক মিনিট!!তোর কি হয়েছে সৌর?
-কিছুনা!
-লাথ মারবো হারামজাদা!কোথায় তুই?কি হয়েছে বল!আমরা আসছি!তুই শুধু বল,কোথায় আছিস এখন!!
সমুদ্রর হঠাৎ শরীর খারাপের কারণে,ওদের খাওয়া-দাওয়ার পরিকল্পনাটা পিছিয়ে গিয়েছিলো।সেটা পিছোতে-পিছোতে আজ নির্ধারিত হয়েছে।কারণ,এরপর প্রায় সবারই বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ,কাল এডমিট দেওয়ার পর তুমুল পড়াশোনা।তাই আজ ফুচকার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো সবাই।কিন্তু সৌরকে ছাড়া,ওদের বন্ধুবৃত্ত যেন অসম্পূর্ণ লাগছিলো।নিশাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার আনন্দটুকু,সৌরর সঙ্গে ভাগ করে না নিলে,খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো ওদের আনন্দোৎসবের এই আয়োজন।রূপকে চেঁচাতে দেখে চমকে উঠে ওর হাত থেকে,ফোনটা কেড়ে নিলো সমুদ্র....
-সৌর?
-ভাই!!
-কি হয়েছে?কোথায় তুই?
-বড্ড কষ্ট হচ্ছে!
-সব শুনবো!আগে বল,তুই কোথায়!আমি আসছি!
হাতের পাতাটা ফেলে দেয় সমুদ্র।ফোনের ওপার থেকে সৌর বলে,
-নাঃ!আমিই আসছি!মাঠে!
একহাতে সাইকেলটাকে মাটি থেকে টেনে তুললো সৌর....
-আচ্ছা আয়।আমি ওখানেই যাচ্ছি...রূপ!ফোনটা নে।আমি বেরোলাম।সৌর ভালো নেই।কিছু একটা হয়েছে।
-আমিও যাবো!
পাশ থেকে লাফিয়ে উঠলো ঋষি....
-আর আমি কি তোদের মুখ দেখবো?আমি তো যাবোই...
-না ভাই!নিশা আছে!তোদের সুন্দর একটা সময়....আমি আর ঋষি যাচ্ছি তো,আমরা দেখে নিচ্ছি....
-না,আমিও....
নিশার দিকে একবার চাইলো সমু আর ঋষি....মেয়েটার মুখ দেখেই বুঝতে পারলো,ওর মনের গোপন ইচ্ছেটা।প্রথম-প্রথম প্রেম!!একটু তো কাছে চাইবেই রূপকে,আর সেটাই স্বাভাবিক!!পরীক্ষার মধ্যে আর মাঠেও আসা হবে না।আবার কবে দেখা হবে না হবে,তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।তাই নিশার ইচ্ছে নয়,রূপ ওদের সঙ্গে যাক।বন্ধুত্ব আর প্রেমের যাঁতাকলের মধ্যে রূপকে ফেলে,ওকে পিষতে ইচ্ছে করলো না সমুর।ও বলে উঠলো,
-না রূপ!তুই থাক!আমরা যাচ্ছি!
সমু দেখলো ওর এইটুকু কথাতেই নিশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ও এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো রূপের একটা হাত...নিশার আনন্দে ভরা উজ্জ্বল মুখটার দিকে চেয়ে রূপ কোনোক্রমে বললো,
-হুম!!
কিন্তু যে মুহূর্তে ও দেখলো,ঋষি আর সমু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো ওরই চোখের সামনে দিয়ে,আর সহ্য হলো না।জ্বালা করে উঠলো চোখটা।বড্ড অসহায় লাগলো নিজেকে....নিশা ওর জড়িয়ে ধরা হাতটা ছেড়ে দিয়ে,ওর আঙুলের ফাঁকে আটকে দিলো নিজের পাঁচটা আঙুল... শক্ত করে চেপে ধরলো ওর হাত।হাসিমুখে চাইলো ওর দিকে।রূপের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো।কি হয়েছে সৌরর?!
নিশার মৃদু টানে রূপ আবার গিয়ে দাঁড়ালো ফুচকার দোকানে।বিস্বাদ লাগলো ও টক-ঝাল মুখরোচক খাবারটাও।মনটাই যে বড্ড ভারী হয়ে গেছে....
-কিসের দায়বদ্ধতা ওর?বলেনি কিছু?
বিধ্বস্ত সৌরকে জিজ্ঞেস করলো সমুদ্র...
-জানিনা!আমি কিচ্ছু জানিনা!আমার সঙ্গে কথা বলছে না।আমার ফোন ধরছে না।আজকের পর কোনোভাবেই আমি আর ওর সঙ্গে,যোগাযোগ করতে পারবো না।পাগল হয়ে যাবো রে আমি....
-এই দাঁড়া তো!তুই আমাদের এত জ্ঞানের গল্প দিস!নিজের বেলায় এত ভেঙে পড়লে হবে?!একটু সময় দে।ওকেও,নিজেকেও।সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আমি পরীক্ষা দেবো কি করে?পড়বো কি করে?
-এই সৌর!!এইরকম পাগলামি করলে থাবড়া মেরে একদম সোজা করে দেবো কিন্তু।দেখ তুই ওকে যা বলার....একি তুই!!তুই চলে এলি!?তোকে তো নিশার কোলে গছিয়ে এলাম!তুই এখানে কোত্থেকে টপকালি?!
সাইকেল থেকে রূপকে নামতে দেখে সমুদ্র বলে উঠলো....সাইকেল লক করে,ওদের ত্রিমূর্তির সামনে এসে দাঁড়ালো রূপায়ণ....
-নিশা আমাকে ভালোবাসে সমু,আর সত্যিই ভালোবাসে।তোরা সবাই এখানে রয়েছিস,সৌর কোনো কারণে আপসেট হয়ে রয়েছে!আর তারপরও তোরা সবাই যদি ভাবিস,আমি এই অবস্থায় নিশার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করবো,ভুল করবি ভাই!!নিশা তো কদিন হয়েছে আমার জীবনে এসেছে।আর আমরা তো ব্রাদার্স ফর লাইফ!ব্রাদার্স ফ্রম ডিফারেন্ট মাদার্স!!সেদিন বলেছিলো সৌর,মনে নেই!!ভাইয়ের কিছু হয়েছে জানার পর থেকে,আমি থাকতেই পারছিলাম না ওর সঙ্গে।আর ও আমাকে দেখেই বুঝেছে,যে আমি মন থেকে ওর সঙ্গে থাকতে পারছি না,জোর করে রয়েছি।তখনই বললো,যা!জোর করে থাকতে হবে না।গিয়ে দেখ,সৌরর কি হলো!রাতে ফোন করবি!!ও মায়ের ওষুধ নিয়ে পরে আসছে...
তারপর চ্যাম্প?!বল ভাই!কি হলো?আমাদের লিডার এইভাবে মুখ লটকে বয়সে থাকলে হবে?!স্পোর্টস-পার্সন তুমি!!ফাইট করো!
সৌরকে জড়িয়ে ধরে ওর পাশে বসলো রূপায়ণ...তারপর বললো,
-ব্যাস!!কিছু না জেনেই অনেক জ্ঞান দিয়ে দিয়েছি।এবার বল তো ভাই!কি হয়েছে?
সমুদ্র আর ঋষি ঘটনার সংক্ষিপ্তসার রূপকে জানিয়ে দিলো...সবটা শুনে রূপ মুখ খুললো...
-দেখ!কিছু তো একটা সমস্যা আছেই।এবার তোকে জানতে হবে ওর সমস্যাটা কি?আগে থেকেই ভালোবাসি-ভালোবাসি বলে লাফাস না।ও জানলো,তুই ওকে ভালোবাসিস।তুই আন্দাজ করছিস,তিলোত্তমাও হয়তো তোকে ভালোবাসে,কিন্তু ও এখনও এডমিট করেনি।এবার তোকে জানতে হবে ওর সমস্যাটা কোথায়?!পারিবারিক কোনো সমস্যা!শারীরিক!!নাকি ব্যক্তিগত?!সেসব জেনে নিয়ে,আগে সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা কর।ওগুলো না করে,ওকে পাওয়ার জন্য অযথা লাফালে,সবার আগে ওকেই হারাবি ভাই।কারণ,দিনরাত কানের ধারে ওই এক কথা বললে,পাগলামি করলে,ও তোর থেকে পালাবেই।আর ধরতে পারবি না ওকে!!এই আমাকেই কম করতে হয়েছে নিশার জন্য!!শেষের দিকে শুধু ওর পাশে থাকার চেষ্টা করতাম,আর কিছুই বলতাম না।বিশ্বাস কর ভাই!নিশার মতো জেদী মেয়েকে,শুধু ভালোবেসেই ভেঙে ফেলেছি আমি।কিন্তু সেটা কাজের মাধ্যমে,ব্যবহারে,চালচলনে....মুখে নয়!ভালোবাসি-ভালোবাসি শুনতে-শুনতে ওরা না বিরক্ত হয়ে যায়।ধৈর্য্য ধর!একটু অপেক্ষা কর।ওকে নিজেকে খুলতে দে।তুই জোরাজুরি করলে,উল্টে ও আরও শামুকের মতো খোলসের ভিতরে গুটিয়ে যাবে।ওকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার সময়টুকু আগে দে।তুই বুঝদার!আশা করি,তোকে বেশি বোঝাতে হবে না....
-ভাই!মাসে কত টাকা টিউশন-ফি নিচ্ছে নিশা!!ভালোই তো ক্লাস নিচ্ছে দেখছি....আমিও যাবো!আমিও বুঝবো!!
সমুদ্র অবাক হয়ে রূপকে বললো....
-আবে চুপ!দেখছিস ভাইয়ের মন খারাপ!!
-হ্যাঁ তো সেটাই ভালো করার চেষ্টা করছি।ভাই আমাদের কি বলছে দেখ!ও বলছে,মিছরি এই রকম করলে,আমি পরীক্ষা দেবো কি করে?!পড়বো কি করে?
চমকে উঠে সৌরর দিকে ফিরে চাইলো রূপ।
-এই ভাই!তোর তো দেখছি সাংঘাতিক অবস্থা রে!এ সৌর!কে যেন আমাদের সবাইকে জ্ঞান দিতো,পড়াশোনা ভালো করে কর।পরীক্ষাটা ভালো করে আগে দে!যখন যেটা করার সময় তখন সেটা কর।এসবের জন্য তো সারাটা জীবন পড়ে আছে।কোথায় সেই চ্যাম্প?!তুই এত তাড়াতাড়ি হেরে গেলি ভাই!!কোথায় সেই লিডার সৌরদীপ সাহা??মেন্টর সৌরদীপ সাহা?!কোথায়??
কেঁদে ফেলে রূপের বুকে মাথা ঠেসে দিলো সৌর....
-আর পারছি না ভাই!আর পারছি না!একটু কথাও তো বলতে পারে!কথাও তো বলছে না!ফোনই ধরছে না।কতবার ফোন করলাম!!পাগলের মতো ফোন করেই যাচ্ছি...
ফুলে-ফুলে উঠছে সৌরর পিঠ।ঋষি মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।মন-ভাঙার যন্ত্রণা খুব ভালোভাবেই জানে ও।সদ্য-সদ্য রঞ্জা ওর হৃদপিন্ডে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।সেই ক্ষত এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি।তার ওপরে সৌরকে এইভাবে ভেঙে-ছড়িয়ে যেতে দেখে,মনটা একদম ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো ঋষির।সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষাও জানা নেই ওর...সমুদ্রও দিশেহারা।একমাত্র হাল ধরে রেখেছে রূপায়ণ।
-চল!!ওঠ!আরে ওঠ সৌর....বলেছিলি আমাদের দৌড় করাবি পরীক্ষার পর।আজকের পর তো আর এই মাঠে দেখা হবে না।কাল একবার মাত্র যাবো স্কুলে এডমিট আনতে....আর সেই বিকেলে টিউশনে।তারপর যে যার বাড়ি...আর তারপর একেবারে পরীক্ষার হল।আজকের সন্ধ্যেটা সবাই মিলে মনে রাখার মতো করে রাখি,চল!!
-আমার কিছু ভালো লাগছে না রূপ।
-ফাইন!ভেবে দেখ!তোর ভাই তোর ভালোবাসার জন্য,নিজের ভালোবাসার সঙ্গে পর্যন্ত সময় কাটায়নি।আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই।তা সত্ত্বেও তুই এমন করবি!?আমি নিশাকে একা রেখে এসেছি সৌর,তোর জন্য...আমারটাও ভালোবাসা,তোরটাও!বুঝি রে আমি....
-ভাই!!
সৌর জড়িয়ে ধরলো রূপকে....
-চল ওঠ-ওঠ-ওঠ!বি আওয়ার ক্যাপ্টেন!
ঘাসের ওপরে বসে থাকা সৌরর দিকে,নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দেয় রূপ.... সেই হাতে হাত রেখে উঠে পড়ে সৌর...
-কি করবো?
-চল!আমরা জীবনযুদ্ধে জেতার জন্য দৌড়োবো।ধর এই মাঠটা আমাদের গোটা জীবনটা।আর যে ছোটখাটো গর্ত,উঁচু-নীচু জায়গাগুলো আছে,সেগুলো যুদ্ধ!!জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই এগুলোর সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে।অর্থাৎ এই মাঠটাই একটা জীবনযুদ্ধ!!পুরো মাঠ একপাক দৌড়ে,জীবনযুদ্ধে জিতে ঠিক এইখানেই আসতে হবে সবাইকে।যে আগে আসবে,সেই জিতবে....যুদ্ধ অসমাপ্ত রাখা যাবে না কিন্তু....শেষ করতেই হবে....
-ডান-ডান!!
উত্তেজনায় লাফাতে লাগলো ঋষি....রূপ নিজেদের জুতোগুলো পাশাপাশি রেখে,টেনে দিলো জীবনযুদ্ধের কাল্পনিক ফিনিসিং লাইন....
-এ ভাই,এ....এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগে সবে উঠেছি।আমি তো এই জীবনের যুদ্ধে হারবোই...দৌড়োনো মাথায় থাক,জোরে হাঁটতে গেলেই তো বুক কাঁপে।শরীর এত্ত দুর্বল!!
-আরে তোকে হারতে দিলে তো!!মাথায় করে নিয়ে যাবো তোকে....তুই যুদ্ধটা শুরু তো কর।তোর ভাইরা আছে না?!ঠিক টেনে তুলবে তোকে....
-চল!ডান ভাই!!
সৌর চোখটা ভালোভাবে মুছে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো রূপকে....সৌরর পিছনেই রূপ আর ঋষি চট করে হাত মিলিয়ে নিলো।সমুদ্রর মুখেও বাঁকা হাসি।ওরা ঠিক জানে,সৌরর যতই মন-খারাপ থাকুক,খেলা-শরীরচর্চা-দৌড়াদৌড়ি পেলে,ও সব কষ্ট সাময়িক ভুলে থাকতে পারে....তাই সেটাই ওকে দিয়ে করাচ্ছে রূপ।সমস্ত মনখারাপ ঝেড়ে ফেলে সৌর নিজেকে প্রস্তুত করলো দৌড়োনোর জন্য।ওরা চারজনই জুতো খুলে এক জায়গায় রাখলো।সমুদ্র এসে দাঁত বের করে দাঁড়ালো জীবনযুদ্ধের ঘোড়দৌড়ের প্রথম সারিতে,তারপর ঋষি,তারপর রূপ!রূপ এসেই তাকালো সৌরর দিকে,সবশেষে সৌর এসে দাঁড়ালো অন্তিম সারিতে।রূপ বেশ অবাক হয়ে দেখলো,কোথায় সেই দুর্বল পুরুষ?!যে একটু আগে ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিলো!!কঠিন চিবুক,কাটা-কাটা মেদহীন গাল,প্রখর অগ্নিদৃষ্টি....একভাবে সৌর চেয়ে রয়েছে তার একমাত্র লক্ষ্যের দিকে,জয়ের দিকে।জয়ী হওয়ার জন্য উন্মুখ সে.....জীবনের কোন যুদ্ধই,সে আর অসমাপ্ত রাখবে না।সৌর নিজের সর্বস্ব দিয়ে আজ জয়ী হবে....একবার মাত্র তিনজনের দিকে চেয়ে নিজের জায়গায় আসীন হলো সৌরদীপ সাহা।তারপর "স্টার্ট" বলেই চিতার বেগে ছুটলো সবাইকে পিছনে ফেলে।ওর ওই তীরের গতি দেখে,দৌড়োতে-দৌড়োতেই একবার ঋষির দিকে হাসিমুখে চাইলো রূপ....কিন্তু দুর্বল সমুদ্র ততক্ষণে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে...
ছুটতে-ছুটতে একবার পিছন ফিরে চাইলো সৌর।সব বন্ধুরাই অনেকটা পিছনে পড়ে গেছে।সমুদ্র তো হাঁপিয়ে গিয়ে বসেই পড়েছে মাঠে....উল্টোদিকে ঘুরে দৌড়োনোর গতিবেগ কমিয়ে সৌর চিৎকার করতে শুরু করলো,
-কিরে আয়!!ফাস্ট....
-তুই যা ভাই....আমাদের দম শেষ!আমরা আস্তে-আস্তেই যাবো!দৌড়ে-দৌড়ে মরে গেলেও,তোকে হারাতে পারবো না।তুই এমনিতেও প্রথম হবি!!বেকার দৌড়ে লাভ নেই...
-তার মানে তোরা চেষ্টাও করবি না!?
সৌর নিজের দৌড় ছেড়ে ছুটে এলো ওদের দিকে....সেই মুহূর্তেই ঋষি আর রূপ সৌরকে ঠেলে মাঠের মধ্যে ফেলে দিয়ে,হাসতে-হাসতে ছুটলো ওর আগে....
-শালা চিটিং!!
-এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়্যার!!আর এটা তো জীবনযুদ্ধ!!সবকিছু চলবে ভাই...
সামনের দিকে দৌড়োতে শুরু করলো ঋষি আর রূপ...কিন্তু সৌর আর এগোতে পারলে না।ও পিছিয়ে এলো মাঠে বসে পড়া ক্লান্ত সমুদ্রর দিকে....
-কিরে ভাই?ওঠ!
-পারবো না!সবে-সবে জ্বরটা ছেড়েছে তো!চোখমুখ
অন্ধকার হয়ে আসছে রে....তোরা যা!আমার জন্য থামিস না।আমি হেরেই যাবো!ও ঠিক আছে।
-জিতবো তো তোকে সঙ্গে নিয়েই....নইলে নয়...চল!!ওঠ!!
সৌর একটা হাত এগিয়ে দিলো সমুদ্রর দিকে।টেনে তুললো ওকে...
-পারতেই হবে!চল...
সৌরর কথায় সমুদ্র যেন অন্যরকম একটা উৎসাহ পেলো....
-চল!!
ছুটতে শুরু করলো সমুদ্র।বুকের খাঁচার ভিতরে হৃদপিন্ডটা লাফাচ্ছে ভীষণভাবে।মনে হচ্ছে এক্ষুণি অজ্ঞান হয়ে যাবে ও....তাও সৌরকে কিছু না বলে,দাঁতে-দাঁত চেপে ছুটতে শুরু করলো ও...ধীরে-ধীরে কমে গেলো সমুদ্রর গতি।
-ভাই পারছি না!!পড়ে যাবো!মাথা ঘুরছে!কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না রে...
মুখ থুবড়ে পড়লো সমুদ্র...সৌর থেমে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো,
-ঋষি....
ঋষি আর রূপ মাঠের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে।অর্থাৎ জীবনের অর্ধেক পথ!যতটা দ্রুত ওরা সামনের দিকে এগোচ্ছিলো,ততটাই দ্রুতবেগে সেইখান থেকেই উল্টোদিকে দৌড়ে ফেরত চলে এলো....
-এই সমু!
সমুদ্রকে টেনে তুললো সৌর...
-দাঁড়া সৌর!আমার গলা একদম শুকিয়ে গেছে!
হাঁপাতে-হাঁপাতে সমুদ্র বললো।
-এই ঋষি,আমার ব্যাগে জলের বোতল আছে।আগে ছোট....
ছুটে সৌরর ব্যাগের দিকে এগোলো ঋষি...সমুদ্র তখনও বলছে,
-ও কিছু না!শরীরটা দুর্বল তো তাই...একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে!আসলে কাল রাত থেকে কিছু খাইনি তো!!
-মানে?কেন?
ততক্ষণে ঋষি জলের বোতল নিয়ে এসে গেছে ওর কাছে....একটু জল খেলো সমুদ্র...
-এ ভাই!কি হয়েছে রে তোর?
অস্থির হয়ে পড়লো সৌর...
-কাল রাত থেকে কিছু খায়নি বলছে...
রূপ ঋষিকে বললো।
-কেন?সমু!!কিরে?কেন?
-রূপ আজ খাওয়াবে বলেছিলো,তাই...
-টেনে একটা থাপ্পড় মারবো সমু!কি হয়েছে বল!!
-মা-বাবা আমার গিটারটা নিয়ে নিয়েছে রে ভাই!দিচ্ছেই না।বলেছে পরীক্ষার আগে আর দেবে না!আমি তো ওটা ছাড়া মরেই যাবো রে....ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে,রাগ করে,জেদ করে,কাল রাত থেকে কিছু খাইনি...তবুও দিচ্ছে না আমার গিটারটা...
কাঁদতেই পারে না সমুদ্র,সৌর জানে সেটা।ও দুহাতে সমুদ্রকে চেপে ধরলো নিজের বুকে....
-কাল রাত থেকে,এই বিকেল পর্যন্ত,এখনও তুই না খাওয়া ভাই?!
-না!আমাদের বাড়ির ছাদে গোলাপ ফুল ফুটেছে।কাল রাতে ওর সুন্দর গন্ধ শুঁকেছি।পেট ভরে গেছে....
-উফফ!সমু!কি যে করিস না তুই?!চল!ওঠ!কিছু খাবি চল...
-খিদে নেই ভাই!!
-এ বাল!কথা কম বল!চুপচাপ আসবি আমার সঙ্গে...ওঠ!চল!এই এটাকে টেনে তোল তো!!
সৌর এগোতে গেলো নিজের জুতোর দিকে।পকেটে হাত দিয়ে একবার দেখে নিলো,মানিব্যাগটা ঠিক আছে কিনা!!
-ভাই?
সমুদ্রর ডাকে আবার পিছন ফিরলো সৌর...
-কি?
-আমার জীবনযুদ্ধটা যে অসমাপ্ত রয়ে গেলো....আর আমার জন্য তোদেরটাও....
একবার মাঠের দিকে চাইলো সৌর।অন্ধকার নেমে এসেছে প্রায়।সাদা আলোগুলো একে-একে জ্বলে উঠছে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে....সৌর এগিয়ে গেলো সমুদ্রর কাছে,ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,
-কিচ্ছু অসমাপ্ত থাকবে না!!আমি আছি না?!তোর ভাই আছে....
-আবে ও!আমরা কি ইনভিজিবল নাকি?!বল,ভাইরা আছে...
রূপ বলে উঠলো।হেসে সমুর কাঁধে হাত রাখলো ঋষিও....
-চল!!তোর যুদ্ধটা আমরা লড়বো....তোকে পিছনে ফেলে নয়।তোকে বহন করে নিয়ে!পারবি না মানে!!চল!
-দ্যাটস আওয়ার ক্যাপ্টেন!!
-চল!!
-ওই কি করছিস তোরা?ওরে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে তো রে?!
-ওরে তোর ভাইরা আছে তো!চিন্তা কি?!
সমুদ্রর দুটো পা ধরে ওকে কাঁধে তুলে নিলো ঋষি আর রূপ....নিজের চশমাটা সামলে নিয়ে,দুজনের কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে ওকে জড়িয়ে ধরলো সমু....সৌর দৌড়ে এগিয়ে গেলো ওদের একটু আগে-আগেই....জীবনযুদ্ধের লড়াইতে মাঝপথে থমকে যাওয়া,মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া সমুদ্রকে কাঁধে বহন করে,সৌরর নির্দেশ অনুধাবন করে,ছুটে চললো রূপ আর ঋষি....মুখে হর্ষধ্বনি...সমুদ্রর চোখে চিকচিক করছে জল....
-উই আর অলমোস্ট দেয়ার...
সৌর ওই জুতোর সারির কাছাকাছি পৌঁছে চিৎকার করে কমিয়ে আনলো নিজের গতি....অপেক্ষা করতো লাগলো বন্ধুদের জন্য।সমুদ্রকে নিয়ে ওরা পৌঁছনো মাত্রই,চারজনই একসঙ্গে স্পর্শ করলো ফিনিসিং লাইন....সৌর-ঋষি আর রূপ নিজের পা দিয়ে,সমুদ্র রূপ আর ঋষির কাঁধে চেপে...তারপর চারজনই শুয়ে পড়লো খোলা আকাশের নীচে,সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে...
সমুদ্র হাসতে-হাসতে বললো,
-এটা কি হলো?এর নাম কম্পিটেশন?কে জিতলো?কে হারলো?সবাই তো একসঙ্গেই পৌঁছলাম....
-এটাই তো আসল যুদ্ধজয় রে ভাই!একসঙ্গে জেতার মজাই আলাদা!আমরা সবাই জিতেছি।একে-অপরকে পিছনে ফেলে-পায়ের তলায় পিষে-মেরেকেটে নয়,একে-অপরকে সঙ্গে নিয়ে জিতেছি!সবাই জিতেছি,কেউ হারিনি!কারোর লড়াই অসমাপ্ত নয়!!আমরা সবাই যুদ্ধজয় করেছি,সবাই জয়ী!রাইট?
সৌরর কথা শুনে হেসে মাথাটা নামিয়ে নিলো সমুদ্র....রূপ বললো,
-রাইট!!
ঋষি বললো,
-এ ভাই!পরে কথা বলছি!আগে হালকা হয়ে আসি!জোর হিসি....এরপর প্যান্ট ভিজে যাবে...
সবাই সমস্বরে হেসে উঠলো ওর কথা শুনে....ঋষি উঠেই দৌড়োলো ক্লাবের পিছন দিকের জঙ্গলে....
-চল!খাবি চল!মিন্টুদার এগরোল!সবাই খাবো!
সমুদ্রর সামনে এসে সৌর বললো...
-মিন্টুদা আজকাল ডিম পাড়ে নাকি?!
-ইস!!
রূপের কথা শুনে হেসে ফেললো সৌর...
-ভাই তুই বললি,মিন্টুদার এগের রোল!বলবি তো,মিন্টুদার দোকানের এগরোল!অর্ধেক কথা বললে,বুঝবো কি করে ভাই?!
সৌর এগিয়ে গিয়ে,একটা লাথি মারলো রূপের কোমরে।রূপ মাঠে শুয়েই হেসে উঠলো সশব্দে...
-ছাড় না সৌর...আবার এসব!!
-চুপ!চল!আর আজ রাতে যদি না খাস না,আমি ফোন করবো তোর বাড়িতে।কাকিমার সঙ্গে আমি কথা....
-না সৌর!প্লিজ!এসব করিস না!প্রমিস কর,করবি না...
-আচ্ছা করবো না!তাহলে তুই আগে প্রমিস কর খাবি!!
-গিটারটা বাবা দিচ্ছেই না সৌর!
-তো?তুই গিটারের জন্য আমৃত্যু অনশন করবি?!আমি তোকে গিটার কিনে দেবো।আমার বাড়িতে থাকবে।তুই আমার বাড়িতে এসে যখন ইচ্ছে প্র্যাকটিস করবি!এসব ছেলেমানুষি ছাড় সমু!
-নাঃ!ওটা আমার প্রথম গিটার!অনেক ভালোবাসা-রাতজাগা-অনেক চোখের জল-অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওটার সঙ্গে।ওটা আমার প্রাণ রে ভাই।ওটাকে আমি ছাড়বো না!!
-আচ্ছা বেশ!ছাড়তে হবে না।খাবি তো আজ রাতে?প্রমিস কর!
-খাবো!প্রমিস!!
-গুড বয়!চল এবার!এ ভাই,ঋষি কতদিন ধরে স্টোর করে রেখেছিলো ভাই?এতক্ষণ লাগে হালকা হতে?!
-ওই যে,নাম নিতে-নিতে আসছে...
-ভাই রূপ!চল-চল,ওঠ!একটু খাওয়া-দাওয়া করে বাড়িতে গিয়ে পড়তে বসতে হবে।রাত জাগতে হবে।অনেক কাজ!আর দেরি করা যাবে না!চল ভাই...
সমুদ্র অবাক হয়ে দেখলো,আবার সৌরর মধ্যে সেই দায়িত্বসুলভ কর্তৃত্ব করার লড়াকু মানসিকতা ফিরে এসেছে।অথচ এই ছেলেই আজ কিছুক্ষণ আগে,পাগলের মতো কাঁদছিলো....ঋষি আসার পর ওরা চারজন নিজের জুতো পরতে শুরু করলো....সমুদ্র আর থাকতে পারলো না,জিজ্ঞেস করেই ফেললো সৌরকে,
-সৌর?
-বল ভাই?
-আজ আমরা সবাই কি কারণে মাঠে এসেছিলাম রে?
ব্যাগটা পিঠে নিয়ে নিলো সৌর।ওর ঠোঁটের কোণে খেলে গেলো একটু হাসি।নিজের বাহুবন্ধনের মধ্যে আগলে-জড়িয়ে ধরে থাকা মিছরির ভেজা শরীরটা মনে পড়ে গেলো....একটু হেসে ও বললো,
-আমার মন খারাপ ছিলো!!
বলেই সৌর এগিয়ে গিয়ে সাইকেলের লক খোলার জন্য নীচু হলো...সমুদ্র এসে দাঁড়ালো ওর পাশে,
-আর এখন?
-বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে অসমাপ্ত জীবনযুদ্ধও জয় করে ফিরে আসা যায়,আর এত সামান্য মনখারাপ!তার সাধ্য কি,সৌরদীপকে ঘিরে রাখে?!তোরা আছিস না?!ঘিরে রাখবি আমাকে...
ঋষি-রূপ আর সমুদ্র হাসিমুখে এগিয়ে দাঁড়ালো সৌরর কাছে।একভাবে চেয়ে রইলো ওর দিকে...
-কি?ওইভাবে কি দেখছিস!
সাইকেলে উঠে বসলো সৌর...বকবক করতেই থাকলো,
-আমার জন্য তোমরা যতই যাই করো না কেন,চুমু-টুমু কিছুতেই খেতে পারবো না।নো চুমু!!চলো,মিন্টুদার রোল খাইয়ে দিচ্ছি...
সবে মুখ খুলতে যাচ্ছিলো রূপ....তার আগেই সৌরই আবার বলে উঠলো,
-হ্যাঁ-হ্যাঁ!মিন্টুদা ডিম পাড়ে না।তাই ওর রোল নয়,ওর দোকানের রোল....ভাইলোগ!ফলো মি!!
সজোরে হেসে সাইকেল নিয়ে সবার প্রথমে বেরিয়ে গেলো সৌর।তারপর একে-একে ঋষি-রূপ ও সমুদ্র....
মনখারাপিয়া মেঘগুলো কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো ধীরে-ধীরে....বা হয়তো ভারী হয়ে নেমে এলো ঝিরঝিরে বৃষ্টিরূপে...সেই বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে চারবন্ধু চললো গরম-গরম রোল খেতে।সৌর দোকানে ঢুকেই নিজের রুমালটা বের করে দিলো সমুর হাতে।
-ভিতরে ঢোক-ভিতরে ঢোক!আরে আগে মাথাটা মোছ!ঠান্ডা লেগে গেলে,আবার জ্বরটা ঘুরে আসবে।আর রুমালটা রেখে দে।মাথায় বেঁধেই বাড়ি যাবি।তারপর নিজের হাতে সমুদ্রর সাইকেলটা দোকানের ভিতর দিকে ঢুকিয়ে দিলো সৌর।
-তোরা ভিতরে গিয়ে বেঞ্চে বোস।আমি মিন্টুদাকে অর্ডারটা দিয়ে আসছি!
সৌর ছুটলো দোকানের সামনের দিকে....
বৃষ্টিস্নাত এক সন্ধ্যায় পিঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা কুচি-টমেটো সস-চিলি সস সহযোগে,গরম-গরম নরম রোলে কামড় দিয়ে,ওরা নিজেদের অজানা ভবিষ্যতের কথা নিয়েই মেতে রইলো।সৌর নিজের আধখাওয়া রোলটা ঠেসে ঢুকিয়ে দিলো সমুদ্রর মুখের মধ্যে।ওর মনে ভয়,ছেলেটা যদি আজ রাতেও না খেয়ে থাকে!!তাই ওকে যতটা পারলো,খাইয়ে দিলো...তারপর চারটে চা নিয়ে জমিয়ে গল্প করতে লাগলো....
বাইরে বৃষ্টির গতিবেগ বেড়েই চললো।সমুদ্রের মনে হলো,দোকানের বাইরে টিনের চালে যেন জলতরঙ্গ বাজছে বৃষ্টির তালে-তালে।সেই সঙ্গে ওর মস্তিষ্কেও...
চায়ে বারকয়েক চুমুক দিয়েই সমুদ্র বেঞ্চ বাজিয়ে মৃদু সুরে গান শুরু করলো,
-ওগো আকাশ,ঝোরো না আজ অঝোর ধারায়/
তোমার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যে/অকারণেই মনকেমন বাড়ায়...
সৌরর মনে পড়ে গেলো,মিছরির সঙ্গে প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা,ওর ভিজে চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়া!তারপর পুলের জলে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে একে-অপরকে জড়িয়ে ধরা,ওর ভেজা শরীরটাকে নিজের বুকে করে আগলে রাখার মুহূর্তটুকু,ছবির মতো সৌরর চোখের সামনে ভেসে উঠলো....চোখের জলটাকে বাধা দেওয়ার জন্য,সৌর তাড়াতাড়ি করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো....সমুদ্র গেয়েই চলেছে....
-আজ আমার এ প্রেমিক মন/উতলা তার কারণ...
সে কি আসবে না?আমায় ভালোবাসবে না/ভেঙে সকল বারণ....
রূপের বড্ড মনকেমন করছে।যেদিন প্রথম মাঠে নিশা হ্যাঁ বলেছিলো রূপকে,সেদিনই দোকান থেকে ফিরতি পথে ক্লাবঘরের পিছনদিকের আলো-আঁধারিতে,রূপ পেয়েছিলো নিশার নরম ঠোঁটের স্বাদ!!নিশা আর আড়াল করে রাখেনি নিজেকে।পূরণ করেছে রূপের ইচ্ছেকে,সম্মান করছে।সেদিন রূপ দুহাত দিয়ে আঁকড়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো ওর নিশাকে...মাতাল করা গন্ধ ওর শরীরে....মাটির ভাঁড়ে রাখা চায়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো রূপ।নিজেদের সোনালী মুহূর্তের কথা ভেবে আবেগে,নিশার সঙ্গে কাটানো দুর্বল মুহূর্তের স্মৃতিচারণে,ওর চোখেও তখন কয়েক বিন্দু জলের আবির্ভাব....
-তোমার শরীরী-বিভঙ্গে কন্যা/এ কি অপার আমন্ত্রণ,
পুরুষ প্রেমিক কোথায় হারাবে/কিভাবে এড়াবে ওই দুখানি তৃষাতুর চোখের নিমন্ত্রণ....
ছাতা মাথায় দিয়ে ঝোরো হাওয়ায় উড়ে যাওয়া,অবাধ্য শাড়ির আঁচল সামলে রানী ম্যাম যেদিন স্কুলে ঢুকছিলেন,সেদিন সমুদ্র একাদশ শ্রেণীর ছাত্র।বৃষ্টিতে ভিজে একদৌড়ে সমুদ্র ঢুকে গিয়েছিলো স্কুলে।কিন্তু ঢুকেই দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো ও।কারণ,চশমার কাঁচে জল লেগে থাকায়,ও কিছুই দেখতে পাচ্ছিলো না।তাই তাড়াতাড়ি করে চশমাটা খুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁচটা মুছছিলো ও।চশমা মুছতে-মুছতেই দূরে আবছা একটা অবয়ব দেখেছিলো সমুদ্র।তাড়াতাড়ি করে চশমাটা চোখে পরে নিয়ে,ভালোভাবে দেখেছিলো তাকে।সেই দিনের পর থেকেই,আজ পর্যন্ত অন্য কোনো নারীর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি সমুদ্র....হারিয়ে গেছে ওই বৃষ্টিভেজা শাড়ির ভাঁজে... বাঁধা পড়েছে ওই সিক্ত শাড়ির কোনো এক অজানা সুতোর বন্ধনে....গলাটা ভারী হয়ে এলো সমুদ্রর।তাও ও দরাজ কণ্ঠে গেয়ে চললো,
-আজ শুন্য হাতে ফিরিও না তারে/সে যে তোমারই প্রেমে সিক্ত...
কন্যা তোমার চরণে সকল হারিয়ে/তোমার পুরুষ আজ রিক্ত...
চা-টা এতটা গরম বুঝতে পারেনি ঋষি।জিভটা বোধহয় একটু পুড়ে গেলো।আর সমুদ্রর গানের শেষ কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করামাত্র,পুড়ে গেলো অন্তরটাও.... সে তো ওকে ফিরিয়েই দিয়েছে,শুন্য হাতে।নিজেকে রিক্ত করে ঋষি শুধু রঞ্জাকে ভালোবেসেই গেছে,আর বিনিময়ে পেয়েছে অপমান আর অসম্মান!!মাথাটা নামিয়ে নিয়ে চোখের জলটুকু আড়াল করে,আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলো ঋষি।জিভটা পুড়ে যাওয়ায়,আর বুঝি কোনো স্বাদের বার্তা গ্রহণ করলো না জিহ্বা....
কম্পিত কণ্ঠে সমুদ্র গেয়ে উঠলো,
-ওগো আকাশ,ঝোরো না আজ অঝোর ধারায়/
তোমার বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যে/অকারণেই মনকেমন বাড়ায়...
স্তব্ধ চারজন পুরুষ।কেউই আর কোনো কথা বলতে পারলো না।ভারাক্রান্ত মন....সবার আগে সৌরই উঠলো।মানিব্যাগটা বের করে প্রায় অবরুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
-এভাবে গানগুলো নষ্ট করিস না ভাই!চায়ের দোকানে,পাড়ার মোড়ে,মাঠেঘাটে নিঃশেষ করিস না নিজেকে।খনি আছে তোর মধ্যে।যত্ন করে রাখ,সাবধানে রাখ!বৃষ্টিটা একটু ধরেছে।চল!বেরিয়ে যাই।আবার নামলে অনেক রাত হয়ে যাবে বাড়ি ঢুকতে।তোরা আয়,আমি টাকাটা....
আর বলতে পারলো না সৌর।গলা চিরে বেরিয়ে আসছে কান্না!বেরিয়ে গেলো ও।সমুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো,সৌর যেতে-যেতে পিছন ফিরে চোখের জলটা মুছে নিলো....
-চল!কাল স্কুলে দেখা হচ্ছে!!বাই!!
মনটা সবারই বেশ ভারী।চোখে অশ্রু-সহযোগে চারটে জীবন সাইকেলে চেপে চলে গেলো চারদিকে।ভেজা পিচঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে প্যাডেল করে,ওরা হারিয়ে গেলো নিজস্ব ঠিকানায়...মিন্টুদার টেবিলের ওপর মাটির শুন্য চারটে ভাঁড় সাক্ষী রইলো আজকের স্মৃতিমেদুর-মনকেমন করা সন্ধ্যার....
সমুদ্র ফেরত পায়নি ওর গিটার।কিন্তু ও সৌরকে কথা দিয়েছিলো,তাই রাতে খেয়ে নিয়েছে।পাগলটা আবার ফোন করে খোঁজও নিয়েছে,সমু খেয়েছে কিনা!!খেয়েছে তো সমু,ডাইনিং টেবিলে বসে চুপচাপ খেয়েছে।যত না খাবার খেয়েছে,তার চারগুণ বেশি বাবার কাছে ঝাড় খেয়েছে।ওতেই ওর অর্ধেক পেট ভরে গেছে।বাবা-মার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারে না সমুদ্র,সেভাবে কাঁদতেও পারে না।তাই কোনোরকমে আধপেট খেয়েই,ও ওপরে চলে এসেছে।তারপর থেকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় চুপটি করে শুয়েছিলো।বুকের ওপর ইংরেজি বইটা খোলা রয়েছে।হাত রেখেছে সেই বিশেষ পৃষ্ঠাটায়,যেখানে রানী ম্যাম পড়াতে-পড়াতে দাগ দিয়ে দিয়েছিলেন বহুদিন আগে....সমুদ্রর মাথার কাছের জানলাটা খোলাই রয়েছে।বইটা বিছানার ওপর নামিয়ে রেখে,ও একটু এগিয়ে গেলো জানলার কাছে।অনাবৃত সমুদ্রর গা!বৃষ্টিভেজা শীতল হাওয়ায় কেমন যেন একটু শীত-শীত করছে।একটা শার্ট টেনে দুটো হাত গলিয়ে নিলো সমুদ্র,বুকটা খোলাই রইলো।চোখ থেকে চশমাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানায় রাখা বইয়ের ওপর।থাক!!একটু ঝাপসাই থাক!!জীবনের কিছু অধ্যায় অস্পষ্ট-অসমাপ্ত থাকাই ভালো!চোখে ভালো মতো দেখতে পাচ্ছে না সমুদ্র।তাই বুঝি ওর ঘ্রানেন্দ্রিয় একটু বেশিই সজাগ হয়ে উঠলো।মাটির সোঁদা গন্ধের সঙ্গে-সঙ্গে গোলাপফুলের একটা পাগলপারা সৌরভ ভেসে আসছে ওর নাকে....চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো সমুদ্র....কাল তাকে ও দেবে ওই রক্তাক্ত গোলাপ,আর সঙ্গে নিজেকেও....বাবা গিটারটা দেয়নি।তাতে কি হয়েছে?!সুর তো সমুদ্রর মনের গহীনেই বাজছে....সেই সুরকেই কথায় বাঁধলো সমুদ্র...জানলার পাশের পড়ার টেবিলে বসে টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে,আধো-অন্ধকারের মধ্যেই,সাদা কাগজে গোটা-গোটা অক্ষরে লিখে ফেললো কয়েক ছত্র,
যে ছন্দে আমি নেই/সেই কবিতা একদিন লিখো তুমি,
যে সুরে আমি নেই/সেই গান একদিন গেয়ো তুমি,
যে আকাশে আমি নেই/সেই আকাশের মেঘ হয়ো তুমি...
অঙ্গ তোমার হরিদ্রা-পেলব/কালো তোমার কেশ,
তোমার সনে পাড়ি দেবো/অজানা এক দেশ...
লাল গোলাপের শিশিরভেজা পাপড়ি/তোমার গলার ভাঁজে,
আমার উষ্ণ স্পর্শে তুমি/রাঙা হলে লাজে...
যে ছন্দে আমি নেই/সেই কবিতা একদিন লিখো তুমি,
যে সুরে আমি নেই/সেই গান একদিন গেয়ো তুমি,
যে আকাশে আমি নেই/সেই আকাশের মেঘ হয়ো তুমি...
আলোছায়া ঘেরা আমার মনের-আয়নায়/অবিরত দেখি তোমার মুখ,
তোমা বিনা হৃদয়ে মোর মেঘের ঘনঘটা/সকলই অসুখ!
তোমারে রাখিনু যতনে এ বক্ষ মাঝে/
কোনো এক শ্রাবণ-সন্ধ্যায়/তুমি নিজেরে খুঁজে নিও,আমারই বুকের ভাঁজে....
কন্যা/রেখো মোর এটুকু অনুরোধ/আজীবন তোমারেই প্রণমি...
যে ছন্দে আমি নেই/সেই কবিতা একদিন লিখো তুমি,
যে সুরে আমি নেই/সেই গান একদিন গেয়ো তুমি,
যে আকাশে আমি নেই/সেই আকাশের মেঘ হয়ো তুমি...
কাগজটা ছিঁড়ে যত্ন করে ভাঁজ করে,নিজের ঠোঁটে ঠেকালো সমুদ্র।তারপর স্কুলের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।মনটাকে বহুকষ্টে একত্রিত করে ইংরেজি বইটা সরিয়ে,বাংলার নোটসগুলোতে মনঃসংযোগের চেষ্টা করলো সমুদ্র......
জানলার বাইরে আবার বুঝি বৃষ্টি শুরু হলো....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন