অসমাপ্ত
নবম পর্ব
সাথী দাস
মাঝে আর মাত্র কাল দিনটাই।পরশুদিনই জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা সমুদ্রর।ভয়ে আর উত্তেজনায় ওর মস্তিষ্ক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে।তবু যদি বাবা-মায়ের দিক থেকে একটু উৎসাহ পেতো,তবে ওদের পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা যেতো।কিন্তু সেই দিকেও তো অসহায় সমুদ্র।ভয়ের চোটে কেঁদেই ফেললো ও।পরীক্ষা না দিলে জীবনে কি লাভ-ক্ষতি হবে,সেইসব হিসেব জানা নেই সমুদ্রর,কিন্তু বাড়ি যে কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে,এটা অবধারিত।সেটা ভাবলেই ওর সারা শরীর কাঁপছে।আর এতদিন ধরে বুকের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্ন!!সেটাও তো হাতছাড়া হয়ে যাবে।বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সমুদ্র....কানে বাজছে তারই কণ্ঠস্বর....
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
"ভালো করে পরীক্ষাটা দিও সমুদ্র।কিন্তু গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও..."
সমুদ্র বিছানায় উঠে বসলো।সামনে খুলে রাখা ইংরেজি বইটা বন্ধ করে দিলো।আবার সে কানের মধ্যে বলে উঠলো,
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
কেঁদে ফেললো সমুদ্র।
-সরি ম্যাম!আসবে না!!সরি!!আই এম সো সরি...
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো সমুদ্র।নিজের ওয়ার্ডরোব খুলে জমানো টাকার ব্যাগটা নামিয়ে নিলো।হিসেব করে দেখলো,যা টাকা আছে তাতে যাতায়াত হবে,ট্রেনের ভাড়া,আনুষঙ্গিক খরচ,এমনকি খাওয়া খরচটাও হয়ে যাবে।কিন্তু অডিশনের এন্ট্রি-ফির অতগুলো টাকা তো হবে না।সব টাকাগুলো গুছিয়ে একজায়গায় রেখে কাঁপতে-কাঁপতে ফোনটা হাতে তুলে নিলো সমুদ্র...বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।ভালোভাবে চোখ মুছে নিয়ে একটা নম্বরে ফোন করে ফোনটা কানে ধরলো,ওপাশ থেকে ঘুমজড়ানো অবস্থায় ভেসে এলো সৌরর কন্ঠস্বর,
-হুম!বল ভাই!
-ঘুমিয়ে পড়েছিলি সৌর?
-না ভাই,ছেনি-হাতুড়ি-করাত দিয়ে আরশোলার ব্যবচ্ছেদ করছিলাম,চাটনি করে তোকে খাওয়াবো বলে।শালা রাত তিনটের সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করছে,ঘুমোচ্ছি কিনা!!বাল আমার গার্লফ্রেন্ডও তো এত রাতে ফোন করে না...
-ভাই....
কান্নারা এসে কথা আটকে দিলো সমুদ্রর...টেনে ঘুমচোখ ছাড়ালো সৌর....
-এই সমু!কি হয়েছে তোর?
-তোর সঙ্গে একটু কথা বলবো!
-হ্যাঁ বল না!!কি হয়েছে?তুই কাঁদছিস কেন?
কান্নারা গলা বুজিয়ে দিচ্ছে দেখে,সমুদ্র বললো,
-আমি একটু পরে ফোন করছি!
-আবে এখনই বল।ফোন রাখলে আমি কিন্তু তোর বাড়িতে চলে আসবো বলে দিলাম!
-নানা!বলছি-বলছি....
-বল!
-তুই একদিন আমাকে গিটার কিনে দিবি বলেছিলি,মনে আছে?!দিবি রে?
কেঁদেই ফেললো সমুদ্র...হতবাক সৌর...
-কি হয়েছে সমু?!
-বাবা আমার গিটার ভেঙে দিয়েছে।ওই গিটারটা আমার জীবন রে!ম্যামকে নিয়ে লেখা,সবকটা গানের সুরের জন্মদাতা ওই গিটারটা।আমি গিটার ছাড়া একটা মুহূর্তও বাঁচতেই পারবো না।বাবার সঙ্গে আজ ঝামেলা হয়েছে।বাবা গিটার আছাড় মেরে ভেঙে দিয়েছে।আমি আবার নতুন গিটার কিনবো।কিছু টাকা দিতে পারবি?পকেটমানি থেকে আস্তে-আস্তে শোধ করে দেবো....
-ওই টাকা শোধ করলে তোকে তোকে রাস্তায় ফেলে মার্ডার করে দেবো!কত টাকা চাই বল?
-আপাতত হাজার চার-পাঁচেক!
-ঠিক আছে।ছ-হাজার দিয়ে দেবো।আমি নিজে কাল তোকে নিয়ে গিয়ে গিটার কিনে দেবো।ওটা আর বাড়িতে ঢোকাতে হবে না।আমার কাছেই রাখবি।এখানে রেখে নিশ্চিন্ত মনে পরশুদিন পরীক্ষা দিতে যাবি।ঠিক আছে?
-নানা!পরীক্ষার পরেই কিনবো,এখন না।আসলে টাকাটা নিজের কাছে রাখতে চাইছিলাম।পরীক্ষা শেষ হলেই কিনতাম।তোর যদি অসুবিধে হয়,তো থাক!দিতে হবে না...
-এই ফালতু কথা কম বল তো!কাল টাকা নিয়ে যাচ্ছি তোর বাড়ি!
-নানা,আমি আসছি!
-আচ্ছা ঠিক আছে,আয়!
-সৌর?
-বল!
-ভাই টাকাটার কথা কিন্তু বাবা-মাকে জানাস না!
-নিশ্চিন্তে থাক ভাই!
-হুম!থ্যাঙ্কু!!
-দেবো না টাকা,নেই!আমি ভিখারি!
-কি হলো আবার?
-থ্যাঙ্কু কিসের?
-আচ্ছা সরি,আর বলবো না!
-আবার সরি?
-উফফ!গুড নাইট!হলো?ঠিক আছে এবার!
-আর গুড নাইট!ঘুম তো ভেঙেই গেছে!তুই রাখ,আমি দেখি,আমার জনের একটু ঘুম ভাঙাই।একই বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা টাইগার আর টাইগ্রেস দুজনেই আজ আমার ফোনের শব্দ পেয়ে জেগে উঠবে।উফফ!রাজকন্যার ঘুমে আবিষ্ট গলাটা শুনতে,আমার না দারুণ লাগে!!আর কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়লে তো আরও ভালো,আলাদাই ভালোলাগা...চল টাটা।চলে আসিস কাল।টাকা নিয়ে এত চিন্তা করিস নাতো!তোর ভাই আছে তো,নাকি!
-হুম!!জানি,তাই তো তোকেই ফোন করলাম।রাখছি...
-বাই!!
ফোনটা রেখে অভিব্যক্তিহীন হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো সমুদ্র।আজ পর্যন্ত জীবনে কোনোদিন ও সৌরকে মিথ্যে কথা বলেনি।বাবা-মাকে নিয়ে তো নয়ই।কিন্তু ওর সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।টাকাটাও লাগবে,আর ব্যাপারটা ওকেও জানানো যাবে না।তা হলেই বাবা-মার কানে খবর পৌঁছে যাবে....উঠে স্কুলব্যাগটা টেনে নামালো সমুদ্র।এক-এক করে ভরে নিতে লাগলো দু-একটা জামাকাপড়,আইডেন্টিটি প্রুফ সহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র....তারপর বসলো ট্রেনের নির্ধারিত সময় দেখতে....চার ঘণ্টার রাস্তা।দিনের দিন পৌঁছতে গেলে যে সময়ে ট্রেন রয়েছে,তাতে গেলে নির্দিষ্ট সময়সীমার একেবারে শেষ মুহূর্তে পৌঁছবে সমুদ্র।আর ট্রেন লেট করলে তো আর কথাই নেই।তাই আগের দিন রাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে,অর্থাৎ কালই।ওখানে যদি থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকে,তো সারারাত প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমেই কাটিয়ে দেবে ও।তারপর সকালে উঠে চলে যাবে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে....গুগল ম্যাপে জায়গাটা ভালোভাবে দেখে রাখলো সমুদ্র....ট্রেন থেকে নেমে আবার হয়তো ট্যাক্সি নিতে হবে,বা যদি বাস বা অটো কিছু যায়।হাতে মোটামুটি সময় থাকলে,যাতায়াতে অহেতুক বেশি টাকাপয়সা খরচ করা যাবে না।কম খরচ করে যতটা টাকা হাতে রাখা যায়।কারণ,রাস্তাঘাটে কোনো বিপদে পড়লে সাহায্য করার মতো,কেউ ওর সঙ্গে থাকবে না...
-আজ রাতে সৌরর বাড়িতে থাকবো বাবা!কাল ওখান থেকেই দুজনে পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে যাবো।ওই বাড়ি থেকে তো আরও কাছেই।একসঙ্গে লাস্ট-মোমেন্ট কয়েকটা জিনিস একটু আলোচনাও করার আছে...
সৌরর বাড়ি থেকে টাকাটা নিয়ে,বাড়ি ফিরেই দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবাকে কথাটা বললো সমুদ্র।ও জানে,সৌরর কাছে যাওয়ার কথায়,বাবা কোনোদিনও না বলবে না।আজও তার অন্যথা হলো না....বাবার অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো সমুদ্র....বুকের ভিতরে এত জোরে ঢিপঢিপ করছে,যে ও নিজেই সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে...হাত-পা হিমশীতল....কম্পিউটারটা অন করে একবার ও চোখ রাখলো ওয়ালপেপারে।টিচার্স ডে-তে এই গ্রুপ ছবিটা তোলা হয়েছিলো।সমস্ত স্যার-ম্যামদের সঙ্গে রানী ম্যামও জ্বলজ্বল করছেন ছবিতে।ওনার কারণেই এই ছবিটা চোখের সামনে রেখেছে সমুদ্র।কম্পিউটার স্ক্রিন তথা ছবিটার ওপর হাত রাখলো ও।তারপর ধীরে-ধীরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো রানী ম্যামের ছবিটুকুর ওপরে।
-সরি!আমি আপনার প্রথম কথাটুকু রাখতে পারলাম না ম্যাম!এ প্লাস আসবে না।তবে আমি আপনার একেবারে অবাধ্য ছাত্র নই।আপনি তো জানতেও পারলেন না,আপনার শিক্ষিকা-জীবনের সবচেয়ে বাধ্য ছাত্র হয়তো আমিই!আপনার এক কথায় একলব্যের মতো শুধু আঙুল নয়,জীবনও দিয়ে দিতে পারতাম।কিন্তু আজ ওই কথাটুকু রাখতে পারলাম না ম্যাম।তবে আপনার পরের কথাটুকু কিন্তু আমি শুনছি।গান আমি ছাড়ছি না।আমি যা মন থেকে চাই,তাই নিয়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছি....প্লিজ,কেউ আমায় বুঝবে না ম্যাম।আপনি অন্তত আমায় ক্ষমা করে দেবেন!!
আরও একবার রানী ম্যামের ছবিতে হাত বুলিয়ে,মেইলবক্স খুলে নির্দিষ্ট ই-মেইলটার প্রিন্ট বের করে ব্যাগে ভরে নিলো ও।তারপর কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়ে,গানের ডায়েরীটা একবার খুললো।আজও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে চুরি করা শুষ্ক গন্ধহীন রক্তগোলাপ!!একবার ওটাতে হাত বুলিয়ে,ডায়েরীটা ব্যাগের মধ্যে ফেলে নিলো সমুদ্র....
ব্যাগটা পিঠে নিয়ে একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে,সমুদ্র বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো....
-লাস্ট পরীক্ষা,নিজের বাড়ি থেকেই তো যেতে পারতিস!
একটু দইয়ের ফোঁটা ছেলের কপালে ঠেকিয়ে সমুকে ওর মা বললো...
-আরে একই তো ব্যাপার।সৌরর বাড়ি থেকে তো স্কুলটা আরও কাছে হবে।পড়াশোনার কোনো ব্যাপারে কোনোদিনও ছেলেকে বাধা দেবে না।অন্য কেউ হলে আমি ছাড়তাম নাকি!নেহাত সৌরর মতো ছেলে হয়না!!তুই যা বাবা,ভালো করে কাল পরীক্ষাটা দিস।সকালে বেরোনোর আগে একবার আমায় ফোন করে দিস!
-করবো বাবা!!
মাথা নীচু করে বাবা-মায়ের পায়ে হাত রাখলো সমুদ্র....
"সরি!!কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না।একদিন তোমরা সৌরর মতো আমাকে নিয়েও অনেক গর্ব করবে বাবা!আমি তারই প্রথম ধাপে আমি পা রাখতে যাচ্ছি!আমাকে একটু আশীর্বাদ করো তোমরা...."
বাবা-মাকে প্রণাম করে ব্যাগ পিঠে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো সমুদ্র।
-আশীর্বাদ করি,পরীক্ষা খুব ভালো হোক!
-হুম!
মাথা নীচু করে সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্র।সোজা চলে এলো রেলস্টেশনে...সাইকেল একটা দোকানে রেখে বললো,
-ভিতর দিকে রেখে দিন।কাল রাতের দিকে নেবো!!
প্ল্যাটফর্মে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো সমুদ্র।ট্রেনের অপেক্ষায়,সেইসঙ্গে অজানা ভবিষ্যতের অপেক্ষায়....
ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর,ঘুমোতে যাওয়ার আগে সমুদ্রর মা লক্ষ্য করলেন,ওর ঘরের আলো জ্বলছে।অর্থাৎ মনের ভুলে আলো না নিভিয়েই বেরিয়ে গেছে সমু।ওর মা আবার পায়ে-পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন।ছেলের ঘরে ঢুকে দেখেন ঘরদোর লণ্ডভণ্ড।কোনোদিনই সমুদ্র গোছানো নয়।যেখানে যে জিনিসটা পড়ে থাকবে,সারা সপ্তাহ,পারলে সারা জীবনই সেখানেই ফেলে রাখে।তবু সেটা ও হাতে ধরে সরিয়ে দেখবে না।বরাবরই আপনভোলা বেখেয়ালী সমুদ্র।বকবক করতে-করতে ছেলের বিছানার ওপর থেকে জামাকাপড় সরিয়ে,চাদর ঝেড়েঝুরে,ঘরটা একটু গোছাচ্ছিলেন সমুর মা।কিন্তু পড়ার টেবিলের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি।টেবিলের ওপরেই যে ছেলের এডমিট কার্ডটা পড়ে রয়েছে,বইয়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে!!কাল পরীক্ষা,অথচ কার্ড না নিয়েই মনের ভুলে বেরিয়ে গেছে সমুদ্র।ওটা হাতে নিয়ে লাফাতে-লাফাতে নীচে নামলেন উনি....
-শিগগির ছেলেকে ফোন করো।এডমিট বাড়িতেই ফেলে গেছে।ভাগ্যিস আমি ওপরে উঠলাম।নইলে তো কাল পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে গেলে,দিশেহারা হয়ে যেতো ছেলে....
উদিগ্ন বাবা-মা তড়িঘড়ি ডায়াল করতে শুরু করলেন সমুর নম্বর....
ট্রেনের বেশ কিছুক্ষণ দেরিই আছে।ট্রেনে চেপে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবে সমুদ্র,অজানা-অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াবে।মনের জোরটুকু বাড়ানোর মতোও কেউ নেই ওর জীবনে।ওকে সাহস যোগানোর মতোও কেউ নেই....হঠাৎ করেই পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো।টেনে বের করে একবার দেখে নিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো সমুদ্র।স্ক্রিন বারংবার পাগলের মতো বলে চললো,
"কলিং বাবা"....
-হ্যালো,সৌর?
-হ্যাঁ কাকু বলুন!
-বলছি সমু ওর এডমিট কার্ড ফেলে গেছে।ওকে ফোনেও পাচ্ছি না।একটু ওর সঙ্গে কথা বলবো,ফোনটা ওকে....
-মানে?!আমি ওকে কোথায় পাবো?এত রাতে ও কোথায় গেছে কাকু?!
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সমুর বাবা।কিছুক্ষণ আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না...ওনাকে হতভম্ব দেখে ওনার কান থেকে ফোনটা টেনে নিলেন সমুর মা....একটুখানি কথা বলেই কান্না জুড়ে দিলেন হাউহাউ করে....গেলো কোথায় ছেলেটা!?
হাতে আর একটুও সময় নেই।সমুর বাবা-মার সঙ্গে কিছুদিন ধরেই গিটার নিয়ে ঝামেলা চলছিলো।এর মধ্যে আবার ওর বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে।কিন্তু এখানে আসেনি।হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে সমুর মা যে কি বলছে,অর্ধেক কথা সৌর বুঝতেই পারলো না।কোথায় যেতে পারে ও?!হাফপ্যান্ট পরেই ছিলো সৌর।একটা গেঞ্জি টেনে গায়ে গলিয়ে নিয়ে,লাফাতে-লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো ও।নীচে নামতে-নামতেই ওর খেয়াল হলো,ফোনটা পকেটে নিয়েছে,কিন্তু সাইকেলের চাবিটাই তো নেয়নি।সিঁড়ি থেকেই চেঁচালো ও,
-মা আমার টেবিল থেকে সাইকেলের চাবিটা ছুঁড়ে নীচে ফেলো!
ছেলেকে এমন দিশেহারা অবস্থায় বেরোতে দেখে,ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন সৌরর বাবা-মা...
-কিরে?কি হয়েছে রে সৌর?!
-মা,চাবিটা দাও আগে!পরে এসে বলছি!
গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সৌর....বলেই বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।ওর মা তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে টেবিল থেকে সাইকেলের চাবি নিয়ে,ছেলের ঘরের বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দিলেন নীচে।ছুটতে-ছুটতে চাবিটা লুফে নিয়েই সাইকেলের লক খুলে,চোখের নিমেষেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো সৌর....
-কখন বেরিয়েছে কাকু?
-অনেকক্ষণ বেরিয়েছে রে বাবা!
ভয়ে কেঁদেই ফেললেন সমুর মা...
-কাঁদবেন না কাকিমা!!আমি দেখছি,আমাদের বাকি বন্ধুদের ফোন করে....
সমুর বাবা-মায়ের ঘরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়েই সৌর কথা বলছিলো ওনাদের সঙ্গে।ফোনটা পকেট থেকে বের করতে-করতেই খোলা দরজা দিয়ে ওনাদের ঘরের দিকে চোখ পড়লো সৌরর।দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সশরীরে গিটারটা দাঁড়িয়ে আছে।একদম গোটা....কেঁপে উঠলো ও।সঙ্গে-সঙ্গে কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো সৌরর।টাকাটা তাহলে ওর দরকার হলো কেন?!কোনো খারাপ নেশা নেই,জীবনে কোনো মেয়েও নেই,যে তার জন্য টাকা ওড়াবে,তাহলে?!
"জানিনা রে সৌর,এইসব ব্যাপারে টাকা চাইলে বাবা দেবে কিনা!!"
"দেখ না কি হয়,ওরা যদি মেইল করে,আমাকে বলিস,আমি হেল্প করবো তোকে...."
সমুদ্র বলেছিলো বটে সৌরকে,বহুদিন আগে,একটা অডিশনের ব্যাপারে।আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলো না সৌর।লাফ দিয়ে ওপরে উঠলো,সমুর ঘরে।চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো ওর কম্পিউটারে।সমুর ভীত বাবা-মাও ওর পিছন-পিছন এসে দাঁড়ালো ওইখানেই।কম্পিউটার অন হতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সকল স্যার-ম্যামের সঙ্গে-সঙ্গে রানী ম্যামের ছবিও।একবারের জন্য থমকে গেলো সৌর।তারপর সোজা পৌঁছে গেলো সমুর মেইলের ইনবক্সে।সমুর পাসওয়ার্ড "অলওয়েজ রিমেম্বার" করা থাকায়,কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হলো না সৌরকে।দু-তিনটে অপ্রয়োজনীয় মেইল এর পরই ও পেয়ে গেলো সেই মেইলটা।ওটা পড়তে-পড়তে দম আটকে কান্না পেয়ে গেলো সৌরর।এতবড় একটা সিদ্ধান্ত!!অথচ,সমু ওকে একবারও জানালো না পর্যন্ত!!শেষে তারিখ আর সময় দেখলো,মেইল কখন এসেছে,সেটাও দেখলো।আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না ওর।সবটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার...স্থানীয় ট্রেনের সময় দেখতে গিয়ে চমকে উঠলো সৌর।সাড়ে-এগারোটায় ট্রেন!কম্পিউটার-ফোন দুটোর স্ক্রিনই বলছে এগারোটা দশ।অর্থাৎ আর মাত্র কুড়ি মিনিট সময় হাতে আছে।টেবিলের ওপর একটা জোরে করে চড় মেরে নিজের ফোনটা নিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর...খোলা পড়ে রইলো কম্পিউটার-স্ক্রিন....
-কি হলো সৌর?কোথায় যাচ্ছিস বাবা?!পুলিশে কি একটা খবর দেবো?কিছু কি বুঝতে পারলি?!জানতে পারলি কিছু?!আমি তো ওকে বুঝতেই পারি নারে....
হাহাকার করে উঠলেন সমুর মা....
সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে-নামতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর,
-কারণ আপনারা ওকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টাই করেননি কাকিমা!শুধু নিজেদের ইচ্ছেগুলো ওর ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।তার জন্যই আজ সবাইকে না জানিয়ে,জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সমু।কোনো অল্টারনেটিভ রাস্তা,বা অন্য কোনো উপায় বলে দেওয়ার মতো,কেউ ছিলোই না ওর সামনে।কাকে বলতো ও?!আমাকেও একবার বললো না।জীবনের একটা গোটা বছর,এত প্রিপারেশন...উফফ!আমি তো আর ভাবতেই পারছি না!!
সৌরর চিৎকারের চোটে কিছু বুঝতে উঠতে না পারা সমুর মা একেবারে চুপ করে গেলেন।ছেলের কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে ই-মেইলটা পড়ে ততক্ষণে কঠিন হয়ে গেছে সমুদ্রর বাবার চোয়াল....
সমুর বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে আধো-অন্ধকার বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।বারান্দার এককোণে মৃতদেহের মতো ঢাকা দেওয়া রয়েছে সমুর বাবার বাইক।বেশ কয়েক মাস আগে এটা নিয়ে অনেক কায়দা করেছিলো ওরা চার বন্ধু।কথা ছিলো,পরীক্ষার পর এটা চালিয়ে হাত পাকা করবে।সমু একেবারেই শিখতে পারেনি।ঋষি মোটামুটি চালাতে পারে।যেটুকু শিখেছিলো,সৌর আর রূপই শিখেছিলো।কিন্তু জনবহুল রাস্তায় বাইক নিয়ে বেরোনোর সাহস,সৌরর এখনও হয়নি।তবে আজ সেই সাহসটুকু দেখাতেই হবে।ফোনের স্ক্রিন বলছে এগারোটা পনেরো...
-বাইকের চাবি আনুন,তাড়াতাড়ি!
একটানে বাইকের ওপরের আবরণ সরিয়ে ফেললো সৌর,বাইকটা টেনে বাইরে বের করলো।সমুর মা ঘর থেকে চাবি এনে দিলে বাইকে উঠে বসলো সৌর....সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে চেঁচিয়ে উঠলো সমুদ্রর বাবা,
-আমিও যাবো সৌর!!
-তার আর কোনো প্রয়োজন নেই কাকু।তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আটকাতে পারলে,একমাত্র আমিই পারবো।আর কেউ পারবে না!!
সশব্দে বাইক স্টার্ট দিয়ে বেরোতে গেলো সৌর।কিন্তু কেঁপে গেলো ওর হাত।বাইক নিয়ে একপাশে কাত হয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো ও।কিন্তু কোনোরকমে পা ফেলে দিয়ে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলো।তবে বাইকের ধাক্কা লেগে,বাঁধানো উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখা ওর সাইকেলটা পড়ে গেলো।সেই সঙ্গে ওর বাঁ হাতের কনুইটা দেওয়ালে ঘষটে গিয়ে কেটে-ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।হাত কাঁপছে সৌরর,ভয়ও করছে।সমুর কথা ভেবে,সেই মুহূর্তে চরম বাস্তববাদী সৌর ভুলে গেলো,নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা!!ভুলে গেলো এক্সিডেন্ট করলে বা শরীরে কোনো ছোটবড় ক্ষত থাকলেও,সুইমিং পুলের ক্লোরিনমিশ্রিত জলে ও আর নামতেই পারবে না,বন্ধই হয়ে যাবে প্র্যাকটিস।হাতছাড়া হয়ে যাবে চাকরি,তিলোত্তমাকে কাছে পাওয়ার,নিজের করে পাওয়ার অপেক্ষা,আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।সেই মুহূর্তে সবকিছু বেরিয়ে গেলো ওর মাথা থেকে।একটাই চিন্তা,ওই পাগলটাকে আটকাতেই হবে....হাত কাঁপছে সৌরর,বাঁ-হাতের কনুই ছিঁড়ে গিয়ে বেরিয়ে আসছে বিন্দু-বিন্দু রক্ত,জ্বালাও করছে।পরোয়া করলো না সৌর।সমুর বাবা দৌড়ে এসে সৌরর সাইকেলটা তুলে ধরলেন।সশব্দে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর....
মাঝ-রাস্তায় তখন সৌর,মনে পড়ে গেলো সমুর সেদিনের বলা কথাটা,
"ওদের সঙ্গে আর কোনো কথা না।সোজা বাড়ি যাবো আমরা।ওরা মরলে মরুক,যা খুশি হোক গে যাক,আমরা উঁকি মেরেও দেখতে যাবো না।ভুলে যাবি না সৌর,ও কিন্তু তোর গায়ে হাত তুলেছে!এবার দিক ওরা ওর হাত-পা ভেঙে।হ্যাঁ,সামনেই পরীক্ষা,হাত ভেঙে গেলে হারামিগুলো পরীক্ষাটা আর দিতে পারবে না,একটা বছর নষ্ট হবে,এই যা..."
সামনের রাস্তাটা ধীরে-ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে।নিজে এত জ্ঞান দিলো সেদিন।একপ্রকার বাধ্য করলো সৌরকে,ঋষির কাছে যাওয়ার জন্য,নইলে সমর্পণ ওর হাত-পা ভেঙে ওর একটা বছর নষ্ট করে দেবে!আর নিজে এটা কি করলো সমু?!ওরা সবাই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাবে,আর সমু একা পিছনে পড়ে থাকবে?!আর ভাবতে পারছে না সৌর,কান্না পেয়ে যাচ্ছে।ও বাইকের গতি আরও একটু বাড়িয়ে দিলো...
প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ও পাগলের মতো ফোন করতে শুরু করলো সমুদ্রকে....এটা জংশন।ঢুকেই কোন প্ল্যাটফর্মে কোন ট্রেন ঠিক করতে না পেরে,সৌর দিশেহারা হয়ে গেলো।কিন্তু বেশ খানিকটা রাত হওয়ায় প্ল্যাটফর্ম কিছুটা ফাঁকা।প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল ঘড়ি বলছে,এগারোটা আঠাশ!!
আর থাকতে পারলো না সমুদ্র।তখন থেকে ছেলেটা ফোন করেই যাচ্ছে।চোখ থেকে ওর জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরত।কিন্তু ওর আর কিছু করার ছিলো না।ফোনটা ধরলো সমুদ্র,
-বল ভাই!!
-কোন ট্রেনে তুই?কোন প্ল্যাটফর্ম?আবে বাল নাম ট্রেন থেকে!!সমু নাম,নাম....
কেঁপে উঠলো সমুদ্র।বুঝে গেছে সৌর,ঠিক বুঝে গেছে ও।সমুদ্রকে সৌর বোঝেনি,এটা আজ পর্যন্ত কোনোদিন হয়নি।আজও বুঝে গেছে।ঠিক এসে গেছে ও।ঘড়িতে এগারোটা ঊনত্রিশ....সমুদ্র ব্যাগটা পিঠে নিয়ে উঠলো সিট থেকে....দরজার সামনে এগোলো,কানে ধরে থাকা ফোনে বললো,
-পারবো না ভাই!গান আমি ছাড়তে পারবো না।এই সুযোগটা আমি ছাড়তে পারবোই না।
-এই বাল তুই নামবি কিনা!!আমি অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে,গাড়ি করে তোকে কাল নিয়ে যাবো সমু!আমি যাবো তোর সঙ্গে,প্রমিস!!তুই আগে নাম ভাই!অন্তত বস তো পরীক্ষাটায়...পাশমার্কটুকু....
প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে সৌর আর সমুদ্রর কান-মাথা ঝাঁজিয়ে বেজে উঠলো ট্রেনের হুইসেল...
ছুটতে-ছুটতে সৌর দেখলো,ওর সামনের ট্রেনটাই ধীরে-ধীরে স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে।দূরত্ব বাড়ছে ওদের।পাগলের মতো ওইদিকে ছুটে চিৎকার করে উঠলো সৌর,
-সমু নাম ভাই!
ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্রই ফোন রেখে দিলো সমুদ্র।এগোলো দরজার সামনে।ফোনটা কেটে যেতেই,ছুটতে-ছুটতে সৌর দেখলো,একেবারে সামনের দিকের একটা কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে...সৌরর চিৎকার আর ওই পর্যন্ত পৌঁছবে না।
-দাদা!একটু চেনটা টানুন না....
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটেও আর ওর কাছে পৌঁছনো সম্ভব না।ট্রেনের গতিবেগ বেড়ে গেছে।সমুদ্র ওখান থেকে একভাবে চেয়ে রয়েছে সৌরর দিকেই....নিজের দৌড়োনোর গতিবেগ কমিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।স্টেশনে দাঁড়িয়েই নিজের মুখ চেপে কেঁদে ফেললো....
সশব্দে বেরিয়ে গেলো ট্রেন....অদৃশ্য হলো সমুদ্র।পড়ে রইলো শুন্য প্ল্যাটফর্ম....
মাথা চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়লো সৌর....যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।কি ভীষণরকম কান্না পাচ্ছে ওর....
ততক্ষণে একে-অপরকে দোষারোপ করে বাড়িতে তুমুল ঝামেলা বাধিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রর বাবা-মা....
বাঁ-হাতের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ছোট একটা ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়েছে সৌর।বাইকটাকে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে ও ঢুকলো সমুর বাড়ি....দৌড়ে বেরোলো সমুর বাবা-মা...কিন্তু সৌরকে একা দেখে একেবারে চুপ করে গেলো তারা....আর একটাও কথা বলার সাহস পেলো না...বাইকের চাবিটা নিয়ে সমুর বাবার দিকে এগোলো সৌর,
-কাল রাতের মধ্যে চলে আসবে আশা করি!চাবিটা নিন!
-দেখা হয়েছে?তাও তাকে ছেড়ে....
-হয়েছে আবার হয়ও নি!সমু ট্রেনে ছিলো।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিলো।আমার আর কিছু করার ছিলো না।হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছিলো!সরি কাকু!আমি আসছি....
-ছেলেটা তবে পরীক্ষাটা দেবেই না সৌর?!
ঘুরে নিজের সাইকেলের দিকে যাচ্ছিলো সৌর।কিন্তু সমুর বাবার এইটুকু কথাতেই ফিরে দাঁড়ালো ও,তেড়ে এসে দাঁড়ালো ওনাদের সামনে,
-এখন কেন এত ভেঙে পড়ছেন কাকু?!এই ক্রাইসিসটা তো আপনাদের নিজের হাতেই তৈরি করা।কি হতো ওর গান গাওয়াটা ভালোভাবে মেনে নিলে?!ভালোভাবে গান শিখতো,সহজভাবে-সুন্দরভাবে একটা ভালো জায়গায় পৌঁছতো।এইরকম সুযোগ কি আর দ্বিতীয়বার আসতো না ওর জীবনে?!অবশ্যই আসতো।কিন্তু ও এত মরিয়া কেন এই সুযোগটার জন্য?জানেন আপনি?নিজেকে প্রমাণ করতে চায় ও।গানের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।কিন্তু ও কোনোদিনও কোনো সাপোর্ট পায়নি আপনাদের কাছ থেকে।সমুর কাছে আপনারা শুনেছেন কিনা জানি না,আমার একটা চাকরির কথা চলছে।আমিও পড়াশোনায় ভালো।কিন্তু সেই পড়াশোনা থেকে চাকরিটা নয় কিন্তু।স্পোর্টস কোটায়,সাঁতার থেকে।আর সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে জানেন?!জল আমার নেশা!জলে নেমে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াটাই আমার নেশা!আর আমার বাবা-মা সেইদিকে আমাকে পুরোপুরি সাপোর্ট করে গেছে।কখন কি খাবো,কি আমার ডায়েট চার্ট,কোন সময়টা আমার ব্যায়ামের জন্য আদর্শ সময়,আমি কখন ঘুমাবো,ঠিক কতক্ষণ ঘুমাবো,প্রতিটা মুহূর্তে আমি তাদের আমার পাশে পেয়েছি বলে,সাঁতারের পাশাপাশি আমি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পেরেছি,নির্ভাবনায়।আমাকে,আমার ইচ্ছেকে কোনোদিনও খুন করা হয়নি কাকিমা,যে চুরি করে আমাকে আমার ইচ্ছের পিছনে,স্বপ্নের পিছনে ছুটতে হবে।আমাকে চুরি করতে হয়নি।যেকোনো সুযোগকে কোনোরকম ক্ষতি ছাড়াই আমি ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি,কারণ আমি জানতাম পিছনে বাবা-মা আছে।আমার সামনে এইরকম কোনো অপশন আসেইনি,হয় এটা,নয় ওটা!!আমি জানতাম,আমার ভুলটুকু,আমার খামতিটুকু ওরা ঠিক সামলে নেবে।আর সমুকে?ওকে জোর করে গিটারের টিউশন,পিয়ানোর টিউশন আদায় করতে হয়েছে।আবার তার জন্য অনেক কথাও শুনতে হয়েছে।ওর একমাত্র ভালোবাসা,ওর গিটারটাকে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে,নিজেদের ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জিনিস ওটা?!আমি আসি না আপনাদের বাড়ি!কারণ সমু বলে,ও আসবে আমার বাড়ি।কারণটা কি আমি কিছুই বুঝি না ভেবেছেন!?আমাদের সুইমিং কম্পিটিশনে কি বলে জানেন,কম্পিটিশন সবসময় সমানে-সমানে হয় কাকু।সেম ক্যাটাগরিতে!ওজন এক,বয়স এক,সুইমিং স্টাইল এক,তবে গিয়ে হয় ফেয়ার-কম্পিটিশন।তুলনাটাও ঠিক তাই।কাজেই তুলনা করার আগে জায়গাটা তৈরি করতে হয়।সবকিছু ঠিকভাবে তার সামনে না দিয়ে,তাকে সাপোর্ট না করে,কোনোরকম তুলনা করা চলে না!!যেমন সমুর গানের সঙ্গে আমার গানের তুলনা করতে গেলে,আপনি নিজেই লজ্জায় মরে যাবেন।সবার সবকিছু সমান থাকে না কাকু,ও ওটা পেরেছে মানেই,তোমাকেও পারতে হবে,ওর থেকে আরও ভালো পারতে হবে,এভাবে হয় না কাকু।সমু কি পারে,সেটা দেখুন!!ও যেটা ভালো পারে,ভালোবেসে করতে চায়,সেটাকে আর একটু ঘষেমেজে নিলে,ও কোথায় চলে যাবে,বা এতোদিনে যেতে পারতো,জানেন আপনি?!মাঝখান থেকে একটা বছরই নষ্ট হয়ে গেলো ওর....আমার আর ভালো লাগে না।লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-দৌড়ে এসেও ঠেকাতে পারলাম না....এগারো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করে,এবার আমি বেরিয়ে যাবো,ও পড়ে থাকবে,ওই একটা মাত্র সাবজেক্টের জন্য!উফফ!!আমি আর ভাবতেই পারছি না....
গলাটা কেঁপে গেলো সৌরর।বাঁ-হাত যন্ত্রণা করছে।কনুইতে লেগেছেও জোর....ও চোখ মুছে নিয়ে উঠে পড়লো সাইকেলে।আর পিছনদিকে ফিরেও চাইলো না।সমুর বাবা-মা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রস্তরমূর্তির মতো...
-একদম ভালো লাগছে না মিছরি!
-তুমি কি করবে বলো?ওর জীবন,ওর সিদ্ধান্ত!
বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না সৌরর।সেই হাফপ্যান্ট পরার সময় থেকে ওরা দুজন বন্ধু।মারামারি-ধরাধরি কি হয়নি ওদের মধ্যে?!তাও ওই দুই মানিকজোড় একসঙ্গে ছিলো আজীবন।স্কুলজীবনের এই শেষ লগ্নে এসে সমু যে আবেগে ভেসে এমন একটা ছেলেমানুষি করে বসবে,ভাবতেই পারেনি সৌর।টাকাটাও সৌর ওকে বোকার মতো দিয়ে দিলো।ওটা না দিলে,ও হয়তো যেতে পারতো না।কিন্তু ও বুঝবে কি করে!!সবকিছুর জন্য এখন ওর নিজেকেই দোষ দিতে ইচ্ছে করছে।বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেলেছিলো সৌর।বারকয়েক ফোন করেছিলো সমুকে।ফোন বন্ধ....অসহায় হয়ে একটু আশ্রয়,একটু উষ্ণতার খোঁজে তিলোত্তমাকেই ফোন করেছিলো ও...
-তোমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে মিছরি!ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!!
-এ আবার কি সৌর?!বি প্র্যাকটিক্যাল!ওর যেটা ঠিক মনে হয়েছে,ও সেটাই করেছে।এখানে তুমি ওকে বলার কে?
-মানে?ও বন্ধু আমার!ওর ভালোমন্দ আমি বুঝবো না?!ও ভুল করলে আমি বাধা দেবো না?!
এমনিতেই মাথা গরম হয়ে রয়েছে সৌরর।তার মধ্যে তিলোত্তমার এমন কাটা-কাটা কথা,ওর মেজাজ আরও বিগড়ে দিলো।ও ভেবেছিলো,তিলোত্তমা হয়তো ওকে বুঝবে....ওর আবেগটুকু বুঝবে....একটু শান্তি পাবে ওর সঙ্গে কথা বলে...
-না বাধা দেবে না।তুমি বাধা দিয়েও কিছু করতে পারবে কি?!ঘাড় ধরে ওকে পরীক্ষায় বসালে,তোমার ওই বন্ধু তোমাকেই আজীবন শোনাতো,যে তোর জন্যই আমার জীবনের অতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে!তুই-ই দায়ী....
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো সৌর...মাথায় আগুন জ্বলছে ওর...
-শাট আপ মিছরি!মানেটা কি?তুমি যা জানো না,তাই নিয়ে কথা বলতে এসো না!সমুদ্র কোনোদিন কোনোকিছুর জন্য আমাকে দোষারোপ করবে না।ও ভাই আমার....
-আরে রাখো তোমার ভাই!!কত রক্তের সম্পর্ক দেখলাম ওইরকম,আর এ তো বন্ধু!!ওসব ছাড়ো তো,বাদ দাও।কাল তোমার পরীক্ষা,নিজের কথা ভাবো।আর ওর কথা মনে পড়লে,মনকে সান্ত্বনা দাও,যে ও আজ যা করেছে,ঠিকই করেছে।যেটা ভালো বুঝেছে,নিজের দায়িত্বেই করেছে।কাল ও কাউকে দোষ দিতে পারবে না,যে তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা!সো,বি কুল!!সমুদ্রে ডুব না দিয়ে,আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করে নাও।সব ঠিক হয়ে যাবে।মনটা ভালো হয়ে যাবে।তারপর,পড়তে বসো...
তিলোত্তমার মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিয়ে,বিছানার ওপর ফোনটা আছাড় মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সৌর....আবারও ঘুরিয়ে ফোন করলো তিলোত্তমা।কিন্তু সৌর আর ফোনটা ধরলো না...বেজেই গেলো...গলা থেকে উগড়ে আসা নিজের কান্নাটা সামলাতে,সৌর চলে গেলো বারান্দার দিকে....বিছানার ওপর ফোনটা নিঃশব্দে বারংবার বলতে লাগলো,সৌরকে ওর ভালোবাসা ডাকছে....
ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে দিক ঠিক করতে পারলো না সমুদ্র।ফোনটা অন করলো আগে।একাধিকবার বাবা আর সৌর ফোন করেছে।সৌরর-ঋষির-রূপের একাধিক মেসেজ।সেসব মেসেজ খুলে দেখলো না ও।দেখলেই কান্না পাবে।আবার ফোনটা বন্ধ করে দিলো।প্রায় চারটে বাজতে যায়।আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার।সকালের আলোটা আর একটু ভালোভাবে ফুটলেই ও বেরিয়ে যাবে নিজের গন্তব্যের দিকে।প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমের দিকে এগোনোর আগে,সারারাত খোলা থাকা,স্টেশন চত্বরের ছোট্ট দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট কেক-বিস্কুট আর একটা জলের বোতল কিনে নিলো সমুদ্র...বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে দেখলো কয়েকজন ওখানে বসে আছে।চেহারা ঠিক সুবিধের মনে হলো না।দেখেই বোঝা যাচ্ছে,প্রত্যেকেই মদ্যপ।আর ওদিকে গেলো না সমুদ্র।হাতে অল্প কিছু টাকা রয়েছে।ওকে মেরেধরে ওটা নিয়ে নিলে,এতকিছু সমস্ত বেকার হয়ে যাবে।এন্ট্রি-ফিটা সামলে রাখতেই হবে।ওখান থেকে সরে আসার আগে সমুদ্র দেখলো,ঝকমকে-খোলামেলা শাড়ি-জামাকাপড় পরা,বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন মেয়ে ওইদিকে গেলো।ওই মদ্যপ লোকগুলোর কাছে....তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে গেলো সমুদ্র।ওয়েটিং রুমে ঢুকে সমুদ্র দেখলো জড়োসড়ো হয়ে দু-একজন ভিখারি এখানে-ওখানে ঘুমিয়ে রয়েছে।সেই ন-টা সাড়ে নটার সময় রাতের খাবার খেয়েছে সমুদ্র।খিদের জ্বালায় পেটের ভিতরে তখন আগুন জ্বলছে।একটা জায়গায় ব্যাগ সামলে নিয়ে বসে,কেকের প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করলো ও।কয়েক টুকরো খাওয়ার পরেই দেখলো,একটু দূরের একটা ভিখারির চাদরের আড়াল থেকে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে উঠে বসেছে।চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই...কেকের টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়েও,আর হাত উঠলো না সমুদ্রর।ও ওটাকে এগিয়ে দিলো সেই বাচ্চাটার দিকে।ঘুমন্ত মায়ের হাত সরিয়ে কালোকুলো রোগা-কঙ্কালসার মেয়েটা ছুটে এলো ওর কাছে।জুলজুলে লোভী একজোড়া চোখ।কাঁধ থেকে খুলে নেমে পড়ছে নোংরা জামা।এক্কেবারে হাড়গিলে চেহারা।সরু-সরু হাত-পা আর ফোলা পেটের অদ্ভুতদর্শন এক শিশুকন্যা,ফুটপাতের রাজকন্যা!!কেকের প্যাকেটটা নিয়েই আবার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো মেয়েটা।সমুদ্র অবাক হয়ে দেখলো,পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট কুকুর-ছানাটা মাথা তুললো একটু।তার দিকে একটা কেকের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে,বাকিটা খেতে শুরু করলো ওই অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত ওই হাভাতে বাচ্চা মেয়েটা।বেশ কিছুক্ষণ ওদের পরম তৃপ্তি-সহকারে খাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে রইলো সমুদ্র।তারপর ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে নিলো ও....
-কিরে চল?!আর ভেবে কি করবি?আমি এলাম রে...
-হুম!!আয়,গুড লাক!
-তোকেও....
রূপ চলে গেলো পাশের ঘরে।ওর সিট পাশের ঘরে পড়েছে।ঋষি আর সৌর একই ঘরে ঢুকলো।ধীরে-ধীরে সমস্ত জায়গা পূর্ণ হয়ে গেলো।শুন্য রইলো একটা মাত্র জায়গা....সৌরর ঠিক আগের বেঞ্চের জায়গাটা....
পরীক্ষা দিতে বসেও,জানলার দিকে চেয়ে সৌরর চোখে জল এসে গেলো...দূরে একটা নারকেল গাছের পাতা মৃদু কাঁপছে।হীরের মতো উজ্জ্বল রোদ আলোকিত করে রেখেছে সমগ্র পৃথিবীকে।শুধুমাত্র সৌরর সামনের কাঠের বেঞ্চটা অন্ধকারের চাদরে মোড়া.... বুকের ভিতরটা কাঁপিয়ে বাইরে ঘন্টা বাজলো।সৌরর হাতে এসে পড়লো প্রশ্নপত্র।প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে,প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পেলো না সৌর,সব ঝাপসা।নাক টেনে চোখ ভালো করে মুছে নেওয়ার পর ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হলো সবকিছু....ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে,পেনটা হাতে তুলে নিলো ও।ব্যস্ততার সঙ্গে নিজের নাম,রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে শুরু করলো....
-নাম?
-সমুদ্র বসু!
বিচারকমন্ডলীর পক্ষ থেকে একের পর এক প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসতে শুরু করলো সমুদ্রের দিকে....
-গান কতদিন ধরে শিখছো?
-সেভাবে গানের তালিম নেওয়া হয়নি কখনও।তবে ভালোবেসে গান গাই।
-হুম!এত কনফিডেন্স?ভালোবেসে গান গেয়ে এতবড় একটা প্ল্যাটফর্মে চলে এলে?টাফ কম্পিটিশন কিন্তু....
-আমার নিজের ভালোবাসার ওপর জোর আছে,বিশ্বাস-ভরসাও।তাই আপনারাই ডেকেছেন আমায়।
-বেশ।তবে শোনা যাক একটা গান!কোনো ইন্সট্রুমেন্ট সঙ্গে....
-নেই কিছু।একটা গিটার পেলে ভালো লাগবে!বাকি মিউজিশিয়ান দাদারা তো আছেনই....
-হুম....
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গিটার চলে এলো সমুদ্রর হাতে।সমুদ্র বললো,
-আমিই লিখেছি,সুরও আমারই করা....
-বাঃ!এটা কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ করেনি।নিজের লেখা গান,নিজের লেখা সুর...দেখা যাক!অল দা বেস্ট!
-হুম,থ্যাঙ্কু...
গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে আর একটু এগিয়ে এসে গান ধরলো সমুদ্র...
-এ কোন প্রেমের মায়ায় ঘেরা এ জগৎ/দেখতে মন চায়,
বিশ্ব আজ আমার দুচোখে নিমগ্ন/দেখি ক্ষুধার্ত খাদ্য না পায়...
প্রেমের আগুনে পুড়ে,অন্ধ বিরহে মৃতপ্রায় আমি/জানিনা ক্ষুধার অনল,
আজ চক্ষু মেলে দেখি/আমার সবুজ পৃথিবী দাবানল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে করবো শীতল....
রক্তাক্ত হৃদয় আমার,প্রেয়সী পরবাস/
এ ভগ্ন-হৃদয় লাগি/তার নেই অবকাশ....
মেনেছিলাম এই মোর পৃথিবী/হেথায় সব ইতি,
অবাক নয়নে দেখি/ক্ষুধার্ত চেয়ে রয়,আমারই মুখের প্রতি...
ফিরে চাইলে না তুমি/আমার কোনো স্থান নেই তোমার মনে,
কিন্তু তোমারে রেখেছি যতনে/আমার ডায়েরীর এক কোণে...
আমি শেষ আজি/তোমার মুখপানে চেয়ে...
চমকে উঠে সহসা/ক্ষুধায় ক্লান্ত একটি সতেজ প্রাণ আসে,আমারই পানে ধেয়ে....
তোমা হতে শুরু আমি/তোমাতেই এই সমুদ্র অতল,
আজ চক্ষু মেলে দেখি/আমার সবুজ পৃথিবী দাবানল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে/করবো শীতল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে/করবো....শীতল....
মাথা নামিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সমুদ্র।ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ও ভেবেছিলো,ওইটুকুই জীবনের সব।গতকালের আগে পর্যন্ত,কোনোদিনও খিদের জ্বালা বোঝেনি ও।কিন্তু কালকের পর থেকে পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে।সকাল থেকে শুধু বিস্কুট খেয়ে রয়েছে।বাস্তবের কাঠিন্য বুঝতোই না ও এতদিন।মনের আর পেটের খিদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।মনের খিদে না মিটলে,সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে অসহ্য জ্বালায়।কিন্তু তার প্রকাশ বাইরে হয় না।তা অপ্রকাশিতই রয়ে যায়।আর পেটের খিদের জন্য মানুষ নাকি মানুষকে খুন করে?!হুম,করতেই পারে!!কাল বাচ্চা মেয়েটার লোভে জুলজুলে ওই দুটো গভীর চোখই ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে,খিদের জ্বালা কতখানি!!ওরা অভ্যস্ত!খিদে পেটে নিয়েও প্রশান্তির ঘুম ঘুমোতেই অভ্যস্ত ওরা।মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে পড়ছে।দুপুর গড়িয়ে গেছে।প্রায় তিনটে বাজতে যায়।মনের আগুনে জ্বলতে-জ্বলতে,আজ পেটের মধ্যেও আগুন জ্বলছে সমুদ্রর।খিদের চোটে একবার মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো।সেই মুহূর্তেই বিচারকের পক্ষ থেকে ভেসে এলো প্রশ্ন,
-অসাধারণ!তোমার বয়স তো বেশি না!কি করো তুমি?
-আমি স্টুডেন্ট!উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী!
অপার নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে ঘরে।আবার প্রশ্ন এলো,
-মানে?!আজ তো লাস্ট পরীক্ষা।একটা বাকি ছিলো না?!কোশ্চেন লিক...
-হুম!আমি পরীক্ষা দিইনি।
-কেন?
-এখানে আসার জন্য!
-হোয়াট!!মানেটা কি?এখানে আসার জন্য পরীক্ষায় বসোনি?এতবড়....
খিদের চোটে সমুদ্রর মাথা ঘুরতে শুরু করেছে।ও মাথা তুলে দরাজ কণ্ঠে বললো কয়েকটা মাত্র কথা,
-বড় স্বপ্নপূরণের জন্য যে,মূল্যটাও অনেক বড় দিতে হয় স্যার!আমাকেও তাই দিতে হলো!
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
"ভালো করে পরীক্ষাটা দিও সমুদ্র।কিন্তু গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও..."
সমুদ্র বিছানায় উঠে বসলো।সামনে খুলে রাখা ইংরেজি বইটা বন্ধ করে দিলো।আবার সে কানের মধ্যে বলে উঠলো,
"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"
কেঁদে ফেললো সমুদ্র।
-সরি ম্যাম!আসবে না!!সরি!!আই এম সো সরি...
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো সমুদ্র।নিজের ওয়ার্ডরোব খুলে জমানো টাকার ব্যাগটা নামিয়ে নিলো।হিসেব করে দেখলো,যা টাকা আছে তাতে যাতায়াত হবে,ট্রেনের ভাড়া,আনুষঙ্গিক খরচ,এমনকি খাওয়া খরচটাও হয়ে যাবে।কিন্তু অডিশনের এন্ট্রি-ফির অতগুলো টাকা তো হবে না।সব টাকাগুলো গুছিয়ে একজায়গায় রেখে কাঁপতে-কাঁপতে ফোনটা হাতে তুলে নিলো সমুদ্র...বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।ভালোভাবে চোখ মুছে নিয়ে একটা নম্বরে ফোন করে ফোনটা কানে ধরলো,ওপাশ থেকে ঘুমজড়ানো অবস্থায় ভেসে এলো সৌরর কন্ঠস্বর,
-হুম!বল ভাই!
-ঘুমিয়ে পড়েছিলি সৌর?
-না ভাই,ছেনি-হাতুড়ি-করাত দিয়ে আরশোলার ব্যবচ্ছেদ করছিলাম,চাটনি করে তোকে খাওয়াবো বলে।শালা রাত তিনটের সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করছে,ঘুমোচ্ছি কিনা!!বাল আমার গার্লফ্রেন্ডও তো এত রাতে ফোন করে না...
-ভাই....
কান্নারা এসে কথা আটকে দিলো সমুদ্রর...টেনে ঘুমচোখ ছাড়ালো সৌর....
-এই সমু!কি হয়েছে তোর?
-তোর সঙ্গে একটু কথা বলবো!
-হ্যাঁ বল না!!কি হয়েছে?তুই কাঁদছিস কেন?
কান্নারা গলা বুজিয়ে দিচ্ছে দেখে,সমুদ্র বললো,
-আমি একটু পরে ফোন করছি!
-আবে এখনই বল।ফোন রাখলে আমি কিন্তু তোর বাড়িতে চলে আসবো বলে দিলাম!
-নানা!বলছি-বলছি....
-বল!
-তুই একদিন আমাকে গিটার কিনে দিবি বলেছিলি,মনে আছে?!দিবি রে?
কেঁদেই ফেললো সমুদ্র...হতবাক সৌর...
-কি হয়েছে সমু?!
-বাবা আমার গিটার ভেঙে দিয়েছে।ওই গিটারটা আমার জীবন রে!ম্যামকে নিয়ে লেখা,সবকটা গানের সুরের জন্মদাতা ওই গিটারটা।আমি গিটার ছাড়া একটা মুহূর্তও বাঁচতেই পারবো না।বাবার সঙ্গে আজ ঝামেলা হয়েছে।বাবা গিটার আছাড় মেরে ভেঙে দিয়েছে।আমি আবার নতুন গিটার কিনবো।কিছু টাকা দিতে পারবি?পকেটমানি থেকে আস্তে-আস্তে শোধ করে দেবো....
-ওই টাকা শোধ করলে তোকে তোকে রাস্তায় ফেলে মার্ডার করে দেবো!কত টাকা চাই বল?
-আপাতত হাজার চার-পাঁচেক!
-ঠিক আছে।ছ-হাজার দিয়ে দেবো।আমি নিজে কাল তোকে নিয়ে গিয়ে গিটার কিনে দেবো।ওটা আর বাড়িতে ঢোকাতে হবে না।আমার কাছেই রাখবি।এখানে রেখে নিশ্চিন্ত মনে পরশুদিন পরীক্ষা দিতে যাবি।ঠিক আছে?
-নানা!পরীক্ষার পরেই কিনবো,এখন না।আসলে টাকাটা নিজের কাছে রাখতে চাইছিলাম।পরীক্ষা শেষ হলেই কিনতাম।তোর যদি অসুবিধে হয়,তো থাক!দিতে হবে না...
-এই ফালতু কথা কম বল তো!কাল টাকা নিয়ে যাচ্ছি তোর বাড়ি!
-নানা,আমি আসছি!
-আচ্ছা ঠিক আছে,আয়!
-সৌর?
-বল!
-ভাই টাকাটার কথা কিন্তু বাবা-মাকে জানাস না!
-নিশ্চিন্তে থাক ভাই!
-হুম!থ্যাঙ্কু!!
-দেবো না টাকা,নেই!আমি ভিখারি!
-কি হলো আবার?
-থ্যাঙ্কু কিসের?
-আচ্ছা সরি,আর বলবো না!
-আবার সরি?
-উফফ!গুড নাইট!হলো?ঠিক আছে এবার!
-আর গুড নাইট!ঘুম তো ভেঙেই গেছে!তুই রাখ,আমি দেখি,আমার জনের একটু ঘুম ভাঙাই।একই বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা টাইগার আর টাইগ্রেস দুজনেই আজ আমার ফোনের শব্দ পেয়ে জেগে উঠবে।উফফ!রাজকন্যার ঘুমে আবিষ্ট গলাটা শুনতে,আমার না দারুণ লাগে!!আর কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়লে তো আরও ভালো,আলাদাই ভালোলাগা...চল টাটা।চলে আসিস কাল।টাকা নিয়ে এত চিন্তা করিস নাতো!তোর ভাই আছে তো,নাকি!
-হুম!!জানি,তাই তো তোকেই ফোন করলাম।রাখছি...
-বাই!!
ফোনটা রেখে অভিব্যক্তিহীন হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো সমুদ্র।আজ পর্যন্ত জীবনে কোনোদিন ও সৌরকে মিথ্যে কথা বলেনি।বাবা-মাকে নিয়ে তো নয়ই।কিন্তু ওর সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।টাকাটাও লাগবে,আর ব্যাপারটা ওকেও জানানো যাবে না।তা হলেই বাবা-মার কানে খবর পৌঁছে যাবে....উঠে স্কুলব্যাগটা টেনে নামালো সমুদ্র।এক-এক করে ভরে নিতে লাগলো দু-একটা জামাকাপড়,আইডেন্টিটি প্রুফ সহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র....তারপর বসলো ট্রেনের নির্ধারিত সময় দেখতে....চার ঘণ্টার রাস্তা।দিনের দিন পৌঁছতে গেলে যে সময়ে ট্রেন রয়েছে,তাতে গেলে নির্দিষ্ট সময়সীমার একেবারে শেষ মুহূর্তে পৌঁছবে সমুদ্র।আর ট্রেন লেট করলে তো আর কথাই নেই।তাই আগের দিন রাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে,অর্থাৎ কালই।ওখানে যদি থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকে,তো সারারাত প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমেই কাটিয়ে দেবে ও।তারপর সকালে উঠে চলে যাবে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে....গুগল ম্যাপে জায়গাটা ভালোভাবে দেখে রাখলো সমুদ্র....ট্রেন থেকে নেমে আবার হয়তো ট্যাক্সি নিতে হবে,বা যদি বাস বা অটো কিছু যায়।হাতে মোটামুটি সময় থাকলে,যাতায়াতে অহেতুক বেশি টাকাপয়সা খরচ করা যাবে না।কম খরচ করে যতটা টাকা হাতে রাখা যায়।কারণ,রাস্তাঘাটে কোনো বিপদে পড়লে সাহায্য করার মতো,কেউ ওর সঙ্গে থাকবে না...
-আজ রাতে সৌরর বাড়িতে থাকবো বাবা!কাল ওখান থেকেই দুজনে পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে যাবো।ওই বাড়ি থেকে তো আরও কাছেই।একসঙ্গে লাস্ট-মোমেন্ট কয়েকটা জিনিস একটু আলোচনাও করার আছে...
সৌরর বাড়ি থেকে টাকাটা নিয়ে,বাড়ি ফিরেই দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবাকে কথাটা বললো সমুদ্র।ও জানে,সৌরর কাছে যাওয়ার কথায়,বাবা কোনোদিনও না বলবে না।আজও তার অন্যথা হলো না....বাবার অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো সমুদ্র....বুকের ভিতরে এত জোরে ঢিপঢিপ করছে,যে ও নিজেই সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে...হাত-পা হিমশীতল....কম্পিউটারটা অন করে একবার ও চোখ রাখলো ওয়ালপেপারে।টিচার্স ডে-তে এই গ্রুপ ছবিটা তোলা হয়েছিলো।সমস্ত স্যার-ম্যামদের সঙ্গে রানী ম্যামও জ্বলজ্বল করছেন ছবিতে।ওনার কারণেই এই ছবিটা চোখের সামনে রেখেছে সমুদ্র।কম্পিউটার স্ক্রিন তথা ছবিটার ওপর হাত রাখলো ও।তারপর ধীরে-ধীরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো রানী ম্যামের ছবিটুকুর ওপরে।
-সরি!আমি আপনার প্রথম কথাটুকু রাখতে পারলাম না ম্যাম!এ প্লাস আসবে না।তবে আমি আপনার একেবারে অবাধ্য ছাত্র নই।আপনি তো জানতেও পারলেন না,আপনার শিক্ষিকা-জীবনের সবচেয়ে বাধ্য ছাত্র হয়তো আমিই!আপনার এক কথায় একলব্যের মতো শুধু আঙুল নয়,জীবনও দিয়ে দিতে পারতাম।কিন্তু আজ ওই কথাটুকু রাখতে পারলাম না ম্যাম।তবে আপনার পরের কথাটুকু কিন্তু আমি শুনছি।গান আমি ছাড়ছি না।আমি যা মন থেকে চাই,তাই নিয়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছি....প্লিজ,কেউ আমায় বুঝবে না ম্যাম।আপনি অন্তত আমায় ক্ষমা করে দেবেন!!
আরও একবার রানী ম্যামের ছবিতে হাত বুলিয়ে,মেইলবক্স খুলে নির্দিষ্ট ই-মেইলটার প্রিন্ট বের করে ব্যাগে ভরে নিলো ও।তারপর কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়ে,গানের ডায়েরীটা একবার খুললো।আজও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে চুরি করা শুষ্ক গন্ধহীন রক্তগোলাপ!!একবার ওটাতে হাত বুলিয়ে,ডায়েরীটা ব্যাগের মধ্যে ফেলে নিলো সমুদ্র....
ব্যাগটা পিঠে নিয়ে একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে,সমুদ্র বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো....
-লাস্ট পরীক্ষা,নিজের বাড়ি থেকেই তো যেতে পারতিস!
একটু দইয়ের ফোঁটা ছেলের কপালে ঠেকিয়ে সমুকে ওর মা বললো...
-আরে একই তো ব্যাপার।সৌরর বাড়ি থেকে তো স্কুলটা আরও কাছে হবে।পড়াশোনার কোনো ব্যাপারে কোনোদিনও ছেলেকে বাধা দেবে না।অন্য কেউ হলে আমি ছাড়তাম নাকি!নেহাত সৌরর মতো ছেলে হয়না!!তুই যা বাবা,ভালো করে কাল পরীক্ষাটা দিস।সকালে বেরোনোর আগে একবার আমায় ফোন করে দিস!
-করবো বাবা!!
মাথা নীচু করে বাবা-মায়ের পায়ে হাত রাখলো সমুদ্র....
"সরি!!কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না।একদিন তোমরা সৌরর মতো আমাকে নিয়েও অনেক গর্ব করবে বাবা!আমি তারই প্রথম ধাপে আমি পা রাখতে যাচ্ছি!আমাকে একটু আশীর্বাদ করো তোমরা...."
বাবা-মাকে প্রণাম করে ব্যাগ পিঠে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো সমুদ্র।
-আশীর্বাদ করি,পরীক্ষা খুব ভালো হোক!
-হুম!
মাথা নীচু করে সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্র।সোজা চলে এলো রেলস্টেশনে...সাইকেল একটা দোকানে রেখে বললো,
-ভিতর দিকে রেখে দিন।কাল রাতের দিকে নেবো!!
প্ল্যাটফর্মে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো সমুদ্র।ট্রেনের অপেক্ষায়,সেইসঙ্গে অজানা ভবিষ্যতের অপেক্ষায়....
ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর,ঘুমোতে যাওয়ার আগে সমুদ্রর মা লক্ষ্য করলেন,ওর ঘরের আলো জ্বলছে।অর্থাৎ মনের ভুলে আলো না নিভিয়েই বেরিয়ে গেছে সমু।ওর মা আবার পায়ে-পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন।ছেলের ঘরে ঢুকে দেখেন ঘরদোর লণ্ডভণ্ড।কোনোদিনই সমুদ্র গোছানো নয়।যেখানে যে জিনিসটা পড়ে থাকবে,সারা সপ্তাহ,পারলে সারা জীবনই সেখানেই ফেলে রাখে।তবু সেটা ও হাতে ধরে সরিয়ে দেখবে না।বরাবরই আপনভোলা বেখেয়ালী সমুদ্র।বকবক করতে-করতে ছেলের বিছানার ওপর থেকে জামাকাপড় সরিয়ে,চাদর ঝেড়েঝুরে,ঘরটা একটু গোছাচ্ছিলেন সমুর মা।কিন্তু পড়ার টেবিলের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি।টেবিলের ওপরেই যে ছেলের এডমিট কার্ডটা পড়ে রয়েছে,বইয়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে!!কাল পরীক্ষা,অথচ কার্ড না নিয়েই মনের ভুলে বেরিয়ে গেছে সমুদ্র।ওটা হাতে নিয়ে লাফাতে-লাফাতে নীচে নামলেন উনি....
-শিগগির ছেলেকে ফোন করো।এডমিট বাড়িতেই ফেলে গেছে।ভাগ্যিস আমি ওপরে উঠলাম।নইলে তো কাল পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে গেলে,দিশেহারা হয়ে যেতো ছেলে....
উদিগ্ন বাবা-মা তড়িঘড়ি ডায়াল করতে শুরু করলেন সমুর নম্বর....
ট্রেনের বেশ কিছুক্ষণ দেরিই আছে।ট্রেনে চেপে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবে সমুদ্র,অজানা-অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াবে।মনের জোরটুকু বাড়ানোর মতোও কেউ নেই ওর জীবনে।ওকে সাহস যোগানোর মতোও কেউ নেই....হঠাৎ করেই পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো।টেনে বের করে একবার দেখে নিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো সমুদ্র।স্ক্রিন বারংবার পাগলের মতো বলে চললো,
"কলিং বাবা"....
-হ্যালো,সৌর?
-হ্যাঁ কাকু বলুন!
-বলছি সমু ওর এডমিট কার্ড ফেলে গেছে।ওকে ফোনেও পাচ্ছি না।একটু ওর সঙ্গে কথা বলবো,ফোনটা ওকে....
-মানে?!আমি ওকে কোথায় পাবো?এত রাতে ও কোথায় গেছে কাকু?!
বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সমুর বাবা।কিছুক্ষণ আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না...ওনাকে হতভম্ব দেখে ওনার কান থেকে ফোনটা টেনে নিলেন সমুর মা....একটুখানি কথা বলেই কান্না জুড়ে দিলেন হাউহাউ করে....গেলো কোথায় ছেলেটা!?
হাতে আর একটুও সময় নেই।সমুর বাবা-মার সঙ্গে কিছুদিন ধরেই গিটার নিয়ে ঝামেলা চলছিলো।এর মধ্যে আবার ওর বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে।কিন্তু এখানে আসেনি।হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে সমুর মা যে কি বলছে,অর্ধেক কথা সৌর বুঝতেই পারলো না।কোথায় যেতে পারে ও?!হাফপ্যান্ট পরেই ছিলো সৌর।একটা গেঞ্জি টেনে গায়ে গলিয়ে নিয়ে,লাফাতে-লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো ও।নীচে নামতে-নামতেই ওর খেয়াল হলো,ফোনটা পকেটে নিয়েছে,কিন্তু সাইকেলের চাবিটাই তো নেয়নি।সিঁড়ি থেকেই চেঁচালো ও,
-মা আমার টেবিল থেকে সাইকেলের চাবিটা ছুঁড়ে নীচে ফেলো!
ছেলেকে এমন দিশেহারা অবস্থায় বেরোতে দেখে,ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন সৌরর বাবা-মা...
-কিরে?কি হয়েছে রে সৌর?!
-মা,চাবিটা দাও আগে!পরে এসে বলছি!
গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সৌর....বলেই বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।ওর মা তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে টেবিল থেকে সাইকেলের চাবি নিয়ে,ছেলের ঘরের বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দিলেন নীচে।ছুটতে-ছুটতে চাবিটা লুফে নিয়েই সাইকেলের লক খুলে,চোখের নিমেষেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো সৌর....
-কখন বেরিয়েছে কাকু?
-অনেকক্ষণ বেরিয়েছে রে বাবা!
ভয়ে কেঁদেই ফেললেন সমুর মা...
-কাঁদবেন না কাকিমা!!আমি দেখছি,আমাদের বাকি বন্ধুদের ফোন করে....
সমুর বাবা-মায়ের ঘরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়েই সৌর কথা বলছিলো ওনাদের সঙ্গে।ফোনটা পকেট থেকে বের করতে-করতেই খোলা দরজা দিয়ে ওনাদের ঘরের দিকে চোখ পড়লো সৌরর।দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সশরীরে গিটারটা দাঁড়িয়ে আছে।একদম গোটা....কেঁপে উঠলো ও।সঙ্গে-সঙ্গে কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো সৌরর।টাকাটা তাহলে ওর দরকার হলো কেন?!কোনো খারাপ নেশা নেই,জীবনে কোনো মেয়েও নেই,যে তার জন্য টাকা ওড়াবে,তাহলে?!
"জানিনা রে সৌর,এইসব ব্যাপারে টাকা চাইলে বাবা দেবে কিনা!!"
"দেখ না কি হয়,ওরা যদি মেইল করে,আমাকে বলিস,আমি হেল্প করবো তোকে...."
সমুদ্র বলেছিলো বটে সৌরকে,বহুদিন আগে,একটা অডিশনের ব্যাপারে।আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলো না সৌর।লাফ দিয়ে ওপরে উঠলো,সমুর ঘরে।চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো ওর কম্পিউটারে।সমুর ভীত বাবা-মাও ওর পিছন-পিছন এসে দাঁড়ালো ওইখানেই।কম্পিউটার অন হতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সকল স্যার-ম্যামের সঙ্গে-সঙ্গে রানী ম্যামের ছবিও।একবারের জন্য থমকে গেলো সৌর।তারপর সোজা পৌঁছে গেলো সমুর মেইলের ইনবক্সে।সমুর পাসওয়ার্ড "অলওয়েজ রিমেম্বার" করা থাকায়,কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হলো না সৌরকে।দু-তিনটে অপ্রয়োজনীয় মেইল এর পরই ও পেয়ে গেলো সেই মেইলটা।ওটা পড়তে-পড়তে দম আটকে কান্না পেয়ে গেলো সৌরর।এতবড় একটা সিদ্ধান্ত!!অথচ,সমু ওকে একবারও জানালো না পর্যন্ত!!শেষে তারিখ আর সময় দেখলো,মেইল কখন এসেছে,সেটাও দেখলো।আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না ওর।সবটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার...স্থানীয় ট্রেনের সময় দেখতে গিয়ে চমকে উঠলো সৌর।সাড়ে-এগারোটায় ট্রেন!কম্পিউটার-ফোন দুটোর স্ক্রিনই বলছে এগারোটা দশ।অর্থাৎ আর মাত্র কুড়ি মিনিট সময় হাতে আছে।টেবিলের ওপর একটা জোরে করে চড় মেরে নিজের ফোনটা নিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর...খোলা পড়ে রইলো কম্পিউটার-স্ক্রিন....
-কি হলো সৌর?কোথায় যাচ্ছিস বাবা?!পুলিশে কি একটা খবর দেবো?কিছু কি বুঝতে পারলি?!জানতে পারলি কিছু?!আমি তো ওকে বুঝতেই পারি নারে....
হাহাকার করে উঠলেন সমুর মা....
সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে-নামতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর,
-কারণ আপনারা ওকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টাই করেননি কাকিমা!শুধু নিজেদের ইচ্ছেগুলো ওর ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।তার জন্যই আজ সবাইকে না জানিয়ে,জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সমু।কোনো অল্টারনেটিভ রাস্তা,বা অন্য কোনো উপায় বলে দেওয়ার মতো,কেউ ছিলোই না ওর সামনে।কাকে বলতো ও?!আমাকেও একবার বললো না।জীবনের একটা গোটা বছর,এত প্রিপারেশন...উফফ!আমি তো আর ভাবতেই পারছি না!!
সৌরর চিৎকারের চোটে কিছু বুঝতে উঠতে না পারা সমুর মা একেবারে চুপ করে গেলেন।ছেলের কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে ই-মেইলটা পড়ে ততক্ষণে কঠিন হয়ে গেছে সমুদ্রর বাবার চোয়াল....
সমুর বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে আধো-অন্ধকার বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।বারান্দার এককোণে মৃতদেহের মতো ঢাকা দেওয়া রয়েছে সমুর বাবার বাইক।বেশ কয়েক মাস আগে এটা নিয়ে অনেক কায়দা করেছিলো ওরা চার বন্ধু।কথা ছিলো,পরীক্ষার পর এটা চালিয়ে হাত পাকা করবে।সমু একেবারেই শিখতে পারেনি।ঋষি মোটামুটি চালাতে পারে।যেটুকু শিখেছিলো,সৌর আর রূপই শিখেছিলো।কিন্তু জনবহুল রাস্তায় বাইক নিয়ে বেরোনোর সাহস,সৌরর এখনও হয়নি।তবে আজ সেই সাহসটুকু দেখাতেই হবে।ফোনের স্ক্রিন বলছে এগারোটা পনেরো...
-বাইকের চাবি আনুন,তাড়াতাড়ি!
একটানে বাইকের ওপরের আবরণ সরিয়ে ফেললো সৌর,বাইকটা টেনে বাইরে বের করলো।সমুর মা ঘর থেকে চাবি এনে দিলে বাইকে উঠে বসলো সৌর....সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে চেঁচিয়ে উঠলো সমুদ্রর বাবা,
-আমিও যাবো সৌর!!
-তার আর কোনো প্রয়োজন নেই কাকু।তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আটকাতে পারলে,একমাত্র আমিই পারবো।আর কেউ পারবে না!!
সশব্দে বাইক স্টার্ট দিয়ে বেরোতে গেলো সৌর।কিন্তু কেঁপে গেলো ওর হাত।বাইক নিয়ে একপাশে কাত হয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো ও।কিন্তু কোনোরকমে পা ফেলে দিয়ে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলো।তবে বাইকের ধাক্কা লেগে,বাঁধানো উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখা ওর সাইকেলটা পড়ে গেলো।সেই সঙ্গে ওর বাঁ হাতের কনুইটা দেওয়ালে ঘষটে গিয়ে কেটে-ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।হাত কাঁপছে সৌরর,ভয়ও করছে।সমুর কথা ভেবে,সেই মুহূর্তে চরম বাস্তববাদী সৌর ভুলে গেলো,নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা!!ভুলে গেলো এক্সিডেন্ট করলে বা শরীরে কোনো ছোটবড় ক্ষত থাকলেও,সুইমিং পুলের ক্লোরিনমিশ্রিত জলে ও আর নামতেই পারবে না,বন্ধই হয়ে যাবে প্র্যাকটিস।হাতছাড়া হয়ে যাবে চাকরি,তিলোত্তমাকে কাছে পাওয়ার,নিজের করে পাওয়ার অপেক্ষা,আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।সেই মুহূর্তে সবকিছু বেরিয়ে গেলো ওর মাথা থেকে।একটাই চিন্তা,ওই পাগলটাকে আটকাতেই হবে....হাত কাঁপছে সৌরর,বাঁ-হাতের কনুই ছিঁড়ে গিয়ে বেরিয়ে আসছে বিন্দু-বিন্দু রক্ত,জ্বালাও করছে।পরোয়া করলো না সৌর।সমুর বাবা দৌড়ে এসে সৌরর সাইকেলটা তুলে ধরলেন।সশব্দে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর....
মাঝ-রাস্তায় তখন সৌর,মনে পড়ে গেলো সমুর সেদিনের বলা কথাটা,
"ওদের সঙ্গে আর কোনো কথা না।সোজা বাড়ি যাবো আমরা।ওরা মরলে মরুক,যা খুশি হোক গে যাক,আমরা উঁকি মেরেও দেখতে যাবো না।ভুলে যাবি না সৌর,ও কিন্তু তোর গায়ে হাত তুলেছে!এবার দিক ওরা ওর হাত-পা ভেঙে।হ্যাঁ,সামনেই পরীক্ষা,হাত ভেঙে গেলে হারামিগুলো পরীক্ষাটা আর দিতে পারবে না,একটা বছর নষ্ট হবে,এই যা..."
সামনের রাস্তাটা ধীরে-ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে।নিজে এত জ্ঞান দিলো সেদিন।একপ্রকার বাধ্য করলো সৌরকে,ঋষির কাছে যাওয়ার জন্য,নইলে সমর্পণ ওর হাত-পা ভেঙে ওর একটা বছর নষ্ট করে দেবে!আর নিজে এটা কি করলো সমু?!ওরা সবাই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাবে,আর সমু একা পিছনে পড়ে থাকবে?!আর ভাবতে পারছে না সৌর,কান্না পেয়ে যাচ্ছে।ও বাইকের গতি আরও একটু বাড়িয়ে দিলো...
প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ও পাগলের মতো ফোন করতে শুরু করলো সমুদ্রকে....এটা জংশন।ঢুকেই কোন প্ল্যাটফর্মে কোন ট্রেন ঠিক করতে না পেরে,সৌর দিশেহারা হয়ে গেলো।কিন্তু বেশ খানিকটা রাত হওয়ায় প্ল্যাটফর্ম কিছুটা ফাঁকা।প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল ঘড়ি বলছে,এগারোটা আঠাশ!!
আর থাকতে পারলো না সমুদ্র।তখন থেকে ছেলেটা ফোন করেই যাচ্ছে।চোখ থেকে ওর জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরত।কিন্তু ওর আর কিছু করার ছিলো না।ফোনটা ধরলো সমুদ্র,
-বল ভাই!!
-কোন ট্রেনে তুই?কোন প্ল্যাটফর্ম?আবে বাল নাম ট্রেন থেকে!!সমু নাম,নাম....
কেঁপে উঠলো সমুদ্র।বুঝে গেছে সৌর,ঠিক বুঝে গেছে ও।সমুদ্রকে সৌর বোঝেনি,এটা আজ পর্যন্ত কোনোদিন হয়নি।আজও বুঝে গেছে।ঠিক এসে গেছে ও।ঘড়িতে এগারোটা ঊনত্রিশ....সমুদ্র ব্যাগটা পিঠে নিয়ে উঠলো সিট থেকে....দরজার সামনে এগোলো,কানে ধরে থাকা ফোনে বললো,
-পারবো না ভাই!গান আমি ছাড়তে পারবো না।এই সুযোগটা আমি ছাড়তে পারবোই না।
-এই বাল তুই নামবি কিনা!!আমি অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে,গাড়ি করে তোকে কাল নিয়ে যাবো সমু!আমি যাবো তোর সঙ্গে,প্রমিস!!তুই আগে নাম ভাই!অন্তত বস তো পরীক্ষাটায়...পাশমার্কটুকু....
প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে সৌর আর সমুদ্রর কান-মাথা ঝাঁজিয়ে বেজে উঠলো ট্রেনের হুইসেল...
ছুটতে-ছুটতে সৌর দেখলো,ওর সামনের ট্রেনটাই ধীরে-ধীরে স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে।দূরত্ব বাড়ছে ওদের।পাগলের মতো ওইদিকে ছুটে চিৎকার করে উঠলো সৌর,
-সমু নাম ভাই!
ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্রই ফোন রেখে দিলো সমুদ্র।এগোলো দরজার সামনে।ফোনটা কেটে যেতেই,ছুটতে-ছুটতে সৌর দেখলো,একেবারে সামনের দিকের একটা কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে...সৌরর চিৎকার আর ওই পর্যন্ত পৌঁছবে না।
-দাদা!একটু চেনটা টানুন না....
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটেও আর ওর কাছে পৌঁছনো সম্ভব না।ট্রেনের গতিবেগ বেড়ে গেছে।সমুদ্র ওখান থেকে একভাবে চেয়ে রয়েছে সৌরর দিকেই....নিজের দৌড়োনোর গতিবেগ কমিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।স্টেশনে দাঁড়িয়েই নিজের মুখ চেপে কেঁদে ফেললো....
সশব্দে বেরিয়ে গেলো ট্রেন....অদৃশ্য হলো সমুদ্র।পড়ে রইলো শুন্য প্ল্যাটফর্ম....
মাথা চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়লো সৌর....যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।কি ভীষণরকম কান্না পাচ্ছে ওর....
ততক্ষণে একে-অপরকে দোষারোপ করে বাড়িতে তুমুল ঝামেলা বাধিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রর বাবা-মা....
বাঁ-হাতের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ছোট একটা ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়েছে সৌর।বাইকটাকে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে ও ঢুকলো সমুর বাড়ি....দৌড়ে বেরোলো সমুর বাবা-মা...কিন্তু সৌরকে একা দেখে একেবারে চুপ করে গেলো তারা....আর একটাও কথা বলার সাহস পেলো না...বাইকের চাবিটা নিয়ে সমুর বাবার দিকে এগোলো সৌর,
-কাল রাতের মধ্যে চলে আসবে আশা করি!চাবিটা নিন!
-দেখা হয়েছে?তাও তাকে ছেড়ে....
-হয়েছে আবার হয়ও নি!সমু ট্রেনে ছিলো।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিলো।আমার আর কিছু করার ছিলো না।হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছিলো!সরি কাকু!আমি আসছি....
-ছেলেটা তবে পরীক্ষাটা দেবেই না সৌর?!
ঘুরে নিজের সাইকেলের দিকে যাচ্ছিলো সৌর।কিন্তু সমুর বাবার এইটুকু কথাতেই ফিরে দাঁড়ালো ও,তেড়ে এসে দাঁড়ালো ওনাদের সামনে,
-এখন কেন এত ভেঙে পড়ছেন কাকু?!এই ক্রাইসিসটা তো আপনাদের নিজের হাতেই তৈরি করা।কি হতো ওর গান গাওয়াটা ভালোভাবে মেনে নিলে?!ভালোভাবে গান শিখতো,সহজভাবে-সুন্দরভাবে একটা ভালো জায়গায় পৌঁছতো।এইরকম সুযোগ কি আর দ্বিতীয়বার আসতো না ওর জীবনে?!অবশ্যই আসতো।কিন্তু ও এত মরিয়া কেন এই সুযোগটার জন্য?জানেন আপনি?নিজেকে প্রমাণ করতে চায় ও।গানের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।কিন্তু ও কোনোদিনও কোনো সাপোর্ট পায়নি আপনাদের কাছ থেকে।সমুর কাছে আপনারা শুনেছেন কিনা জানি না,আমার একটা চাকরির কথা চলছে।আমিও পড়াশোনায় ভালো।কিন্তু সেই পড়াশোনা থেকে চাকরিটা নয় কিন্তু।স্পোর্টস কোটায়,সাঁতার থেকে।আর সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে জানেন?!জল আমার নেশা!জলে নেমে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াটাই আমার নেশা!আর আমার বাবা-মা সেইদিকে আমাকে পুরোপুরি সাপোর্ট করে গেছে।কখন কি খাবো,কি আমার ডায়েট চার্ট,কোন সময়টা আমার ব্যায়ামের জন্য আদর্শ সময়,আমি কখন ঘুমাবো,ঠিক কতক্ষণ ঘুমাবো,প্রতিটা মুহূর্তে আমি তাদের আমার পাশে পেয়েছি বলে,সাঁতারের পাশাপাশি আমি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পেরেছি,নির্ভাবনায়।আমাকে,আমার ইচ্ছেকে কোনোদিনও খুন করা হয়নি কাকিমা,যে চুরি করে আমাকে আমার ইচ্ছের পিছনে,স্বপ্নের পিছনে ছুটতে হবে।আমাকে চুরি করতে হয়নি।যেকোনো সুযোগকে কোনোরকম ক্ষতি ছাড়াই আমি ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি,কারণ আমি জানতাম পিছনে বাবা-মা আছে।আমার সামনে এইরকম কোনো অপশন আসেইনি,হয় এটা,নয় ওটা!!আমি জানতাম,আমার ভুলটুকু,আমার খামতিটুকু ওরা ঠিক সামলে নেবে।আর সমুকে?ওকে জোর করে গিটারের টিউশন,পিয়ানোর টিউশন আদায় করতে হয়েছে।আবার তার জন্য অনেক কথাও শুনতে হয়েছে।ওর একমাত্র ভালোবাসা,ওর গিটারটাকে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে,নিজেদের ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জিনিস ওটা?!আমি আসি না আপনাদের বাড়ি!কারণ সমু বলে,ও আসবে আমার বাড়ি।কারণটা কি আমি কিছুই বুঝি না ভেবেছেন!?আমাদের সুইমিং কম্পিটিশনে কি বলে জানেন,কম্পিটিশন সবসময় সমানে-সমানে হয় কাকু।সেম ক্যাটাগরিতে!ওজন এক,বয়স এক,সুইমিং স্টাইল এক,তবে গিয়ে হয় ফেয়ার-কম্পিটিশন।তুলনাটাও ঠিক তাই।কাজেই তুলনা করার আগে জায়গাটা তৈরি করতে হয়।সবকিছু ঠিকভাবে তার সামনে না দিয়ে,তাকে সাপোর্ট না করে,কোনোরকম তুলনা করা চলে না!!যেমন সমুর গানের সঙ্গে আমার গানের তুলনা করতে গেলে,আপনি নিজেই লজ্জায় মরে যাবেন।সবার সবকিছু সমান থাকে না কাকু,ও ওটা পেরেছে মানেই,তোমাকেও পারতে হবে,ওর থেকে আরও ভালো পারতে হবে,এভাবে হয় না কাকু।সমু কি পারে,সেটা দেখুন!!ও যেটা ভালো পারে,ভালোবেসে করতে চায়,সেটাকে আর একটু ঘষেমেজে নিলে,ও কোথায় চলে যাবে,বা এতোদিনে যেতে পারতো,জানেন আপনি?!মাঝখান থেকে একটা বছরই নষ্ট হয়ে গেলো ওর....আমার আর ভালো লাগে না।লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-দৌড়ে এসেও ঠেকাতে পারলাম না....এগারো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করে,এবার আমি বেরিয়ে যাবো,ও পড়ে থাকবে,ওই একটা মাত্র সাবজেক্টের জন্য!উফফ!!আমি আর ভাবতেই পারছি না....
গলাটা কেঁপে গেলো সৌরর।বাঁ-হাত যন্ত্রণা করছে।কনুইতে লেগেছেও জোর....ও চোখ মুছে নিয়ে উঠে পড়লো সাইকেলে।আর পিছনদিকে ফিরেও চাইলো না।সমুর বাবা-মা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রস্তরমূর্তির মতো...
-একদম ভালো লাগছে না মিছরি!
-তুমি কি করবে বলো?ওর জীবন,ওর সিদ্ধান্ত!
বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না সৌরর।সেই হাফপ্যান্ট পরার সময় থেকে ওরা দুজন বন্ধু।মারামারি-ধরাধরি কি হয়নি ওদের মধ্যে?!তাও ওই দুই মানিকজোড় একসঙ্গে ছিলো আজীবন।স্কুলজীবনের এই শেষ লগ্নে এসে সমু যে আবেগে ভেসে এমন একটা ছেলেমানুষি করে বসবে,ভাবতেই পারেনি সৌর।টাকাটাও সৌর ওকে বোকার মতো দিয়ে দিলো।ওটা না দিলে,ও হয়তো যেতে পারতো না।কিন্তু ও বুঝবে কি করে!!সবকিছুর জন্য এখন ওর নিজেকেই দোষ দিতে ইচ্ছে করছে।বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেলেছিলো সৌর।বারকয়েক ফোন করেছিলো সমুকে।ফোন বন্ধ....অসহায় হয়ে একটু আশ্রয়,একটু উষ্ণতার খোঁজে তিলোত্তমাকেই ফোন করেছিলো ও...
-তোমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে মিছরি!ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!!
-এ আবার কি সৌর?!বি প্র্যাকটিক্যাল!ওর যেটা ঠিক মনে হয়েছে,ও সেটাই করেছে।এখানে তুমি ওকে বলার কে?
-মানে?ও বন্ধু আমার!ওর ভালোমন্দ আমি বুঝবো না?!ও ভুল করলে আমি বাধা দেবো না?!
এমনিতেই মাথা গরম হয়ে রয়েছে সৌরর।তার মধ্যে তিলোত্তমার এমন কাটা-কাটা কথা,ওর মেজাজ আরও বিগড়ে দিলো।ও ভেবেছিলো,তিলোত্তমা হয়তো ওকে বুঝবে....ওর আবেগটুকু বুঝবে....একটু শান্তি পাবে ওর সঙ্গে কথা বলে...
-না বাধা দেবে না।তুমি বাধা দিয়েও কিছু করতে পারবে কি?!ঘাড় ধরে ওকে পরীক্ষায় বসালে,তোমার ওই বন্ধু তোমাকেই আজীবন শোনাতো,যে তোর জন্যই আমার জীবনের অতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে!তুই-ই দায়ী....
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো সৌর...মাথায় আগুন জ্বলছে ওর...
-শাট আপ মিছরি!মানেটা কি?তুমি যা জানো না,তাই নিয়ে কথা বলতে এসো না!সমুদ্র কোনোদিন কোনোকিছুর জন্য আমাকে দোষারোপ করবে না।ও ভাই আমার....
-আরে রাখো তোমার ভাই!!কত রক্তের সম্পর্ক দেখলাম ওইরকম,আর এ তো বন্ধু!!ওসব ছাড়ো তো,বাদ দাও।কাল তোমার পরীক্ষা,নিজের কথা ভাবো।আর ওর কথা মনে পড়লে,মনকে সান্ত্বনা দাও,যে ও আজ যা করেছে,ঠিকই করেছে।যেটা ভালো বুঝেছে,নিজের দায়িত্বেই করেছে।কাল ও কাউকে দোষ দিতে পারবে না,যে তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা!সো,বি কুল!!সমুদ্রে ডুব না দিয়ে,আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করে নাও।সব ঠিক হয়ে যাবে।মনটা ভালো হয়ে যাবে।তারপর,পড়তে বসো...
তিলোত্তমার মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিয়ে,বিছানার ওপর ফোনটা আছাড় মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সৌর....আবারও ঘুরিয়ে ফোন করলো তিলোত্তমা।কিন্তু সৌর আর ফোনটা ধরলো না...বেজেই গেলো...গলা থেকে উগড়ে আসা নিজের কান্নাটা সামলাতে,সৌর চলে গেলো বারান্দার দিকে....বিছানার ওপর ফোনটা নিঃশব্দে বারংবার বলতে লাগলো,সৌরকে ওর ভালোবাসা ডাকছে....
ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে দিক ঠিক করতে পারলো না সমুদ্র।ফোনটা অন করলো আগে।একাধিকবার বাবা আর সৌর ফোন করেছে।সৌরর-ঋষির-রূপের একাধিক মেসেজ।সেসব মেসেজ খুলে দেখলো না ও।দেখলেই কান্না পাবে।আবার ফোনটা বন্ধ করে দিলো।প্রায় চারটে বাজতে যায়।আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার।সকালের আলোটা আর একটু ভালোভাবে ফুটলেই ও বেরিয়ে যাবে নিজের গন্তব্যের দিকে।প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমের দিকে এগোনোর আগে,সারারাত খোলা থাকা,স্টেশন চত্বরের ছোট্ট দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট কেক-বিস্কুট আর একটা জলের বোতল কিনে নিলো সমুদ্র...বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে দেখলো কয়েকজন ওখানে বসে আছে।চেহারা ঠিক সুবিধের মনে হলো না।দেখেই বোঝা যাচ্ছে,প্রত্যেকেই মদ্যপ।আর ওদিকে গেলো না সমুদ্র।হাতে অল্প কিছু টাকা রয়েছে।ওকে মেরেধরে ওটা নিয়ে নিলে,এতকিছু সমস্ত বেকার হয়ে যাবে।এন্ট্রি-ফিটা সামলে রাখতেই হবে।ওখান থেকে সরে আসার আগে সমুদ্র দেখলো,ঝকমকে-খোলামেলা শাড়ি-জামাকাপড় পরা,বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন মেয়ে ওইদিকে গেলো।ওই মদ্যপ লোকগুলোর কাছে....তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে গেলো সমুদ্র।ওয়েটিং রুমে ঢুকে সমুদ্র দেখলো জড়োসড়ো হয়ে দু-একজন ভিখারি এখানে-ওখানে ঘুমিয়ে রয়েছে।সেই ন-টা সাড়ে নটার সময় রাতের খাবার খেয়েছে সমুদ্র।খিদের জ্বালায় পেটের ভিতরে তখন আগুন জ্বলছে।একটা জায়গায় ব্যাগ সামলে নিয়ে বসে,কেকের প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করলো ও।কয়েক টুকরো খাওয়ার পরেই দেখলো,একটু দূরের একটা ভিখারির চাদরের আড়াল থেকে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে উঠে বসেছে।চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই...কেকের টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়েও,আর হাত উঠলো না সমুদ্রর।ও ওটাকে এগিয়ে দিলো সেই বাচ্চাটার দিকে।ঘুমন্ত মায়ের হাত সরিয়ে কালোকুলো রোগা-কঙ্কালসার মেয়েটা ছুটে এলো ওর কাছে।জুলজুলে লোভী একজোড়া চোখ।কাঁধ থেকে খুলে নেমে পড়ছে নোংরা জামা।এক্কেবারে হাড়গিলে চেহারা।সরু-সরু হাত-পা আর ফোলা পেটের অদ্ভুতদর্শন এক শিশুকন্যা,ফুটপাতের রাজকন্যা!!কেকের প্যাকেটটা নিয়েই আবার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো মেয়েটা।সমুদ্র অবাক হয়ে দেখলো,পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট কুকুর-ছানাটা মাথা তুললো একটু।তার দিকে একটা কেকের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে,বাকিটা খেতে শুরু করলো ওই অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত ওই হাভাতে বাচ্চা মেয়েটা।বেশ কিছুক্ষণ ওদের পরম তৃপ্তি-সহকারে খাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে রইলো সমুদ্র।তারপর ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে নিলো ও....
-কিরে চল?!আর ভেবে কি করবি?আমি এলাম রে...
-হুম!!আয়,গুড লাক!
-তোকেও....
রূপ চলে গেলো পাশের ঘরে।ওর সিট পাশের ঘরে পড়েছে।ঋষি আর সৌর একই ঘরে ঢুকলো।ধীরে-ধীরে সমস্ত জায়গা পূর্ণ হয়ে গেলো।শুন্য রইলো একটা মাত্র জায়গা....সৌরর ঠিক আগের বেঞ্চের জায়গাটা....
পরীক্ষা দিতে বসেও,জানলার দিকে চেয়ে সৌরর চোখে জল এসে গেলো...দূরে একটা নারকেল গাছের পাতা মৃদু কাঁপছে।হীরের মতো উজ্জ্বল রোদ আলোকিত করে রেখেছে সমগ্র পৃথিবীকে।শুধুমাত্র সৌরর সামনের কাঠের বেঞ্চটা অন্ধকারের চাদরে মোড়া.... বুকের ভিতরটা কাঁপিয়ে বাইরে ঘন্টা বাজলো।সৌরর হাতে এসে পড়লো প্রশ্নপত্র।প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে,প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পেলো না সৌর,সব ঝাপসা।নাক টেনে চোখ ভালো করে মুছে নেওয়ার পর ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হলো সবকিছু....ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে,পেনটা হাতে তুলে নিলো ও।ব্যস্ততার সঙ্গে নিজের নাম,রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে শুরু করলো....
-নাম?
-সমুদ্র বসু!
বিচারকমন্ডলীর পক্ষ থেকে একের পর এক প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসতে শুরু করলো সমুদ্রের দিকে....
-গান কতদিন ধরে শিখছো?
-সেভাবে গানের তালিম নেওয়া হয়নি কখনও।তবে ভালোবেসে গান গাই।
-হুম!এত কনফিডেন্স?ভালোবেসে গান গেয়ে এতবড় একটা প্ল্যাটফর্মে চলে এলে?টাফ কম্পিটিশন কিন্তু....
-আমার নিজের ভালোবাসার ওপর জোর আছে,বিশ্বাস-ভরসাও।তাই আপনারাই ডেকেছেন আমায়।
-বেশ।তবে শোনা যাক একটা গান!কোনো ইন্সট্রুমেন্ট সঙ্গে....
-নেই কিছু।একটা গিটার পেলে ভালো লাগবে!বাকি মিউজিশিয়ান দাদারা তো আছেনই....
-হুম....
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গিটার চলে এলো সমুদ্রর হাতে।সমুদ্র বললো,
-আমিই লিখেছি,সুরও আমারই করা....
-বাঃ!এটা কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ করেনি।নিজের লেখা গান,নিজের লেখা সুর...দেখা যাক!অল দা বেস্ট!
-হুম,থ্যাঙ্কু...
গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে আর একটু এগিয়ে এসে গান ধরলো সমুদ্র...
-এ কোন প্রেমের মায়ায় ঘেরা এ জগৎ/দেখতে মন চায়,
বিশ্ব আজ আমার দুচোখে নিমগ্ন/দেখি ক্ষুধার্ত খাদ্য না পায়...
প্রেমের আগুনে পুড়ে,অন্ধ বিরহে মৃতপ্রায় আমি/জানিনা ক্ষুধার অনল,
আজ চক্ষু মেলে দেখি/আমার সবুজ পৃথিবী দাবানল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে করবো শীতল....
রক্তাক্ত হৃদয় আমার,প্রেয়সী পরবাস/
এ ভগ্ন-হৃদয় লাগি/তার নেই অবকাশ....
মেনেছিলাম এই মোর পৃথিবী/হেথায় সব ইতি,
অবাক নয়নে দেখি/ক্ষুধার্ত চেয়ে রয়,আমারই মুখের প্রতি...
ফিরে চাইলে না তুমি/আমার কোনো স্থান নেই তোমার মনে,
কিন্তু তোমারে রেখেছি যতনে/আমার ডায়েরীর এক কোণে...
আমি শেষ আজি/তোমার মুখপানে চেয়ে...
চমকে উঠে সহসা/ক্ষুধায় ক্লান্ত একটি সতেজ প্রাণ আসে,আমারই পানে ধেয়ে....
তোমা হতে শুরু আমি/তোমাতেই এই সমুদ্র অতল,
আজ চক্ষু মেলে দেখি/আমার সবুজ পৃথিবী দাবানল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে/করবো শীতল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে/করবো....শীতল....
মাথা নামিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সমুদ্র।ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ও ভেবেছিলো,ওইটুকুই জীবনের সব।গতকালের আগে পর্যন্ত,কোনোদিনও খিদের জ্বালা বোঝেনি ও।কিন্তু কালকের পর থেকে পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে।সকাল থেকে শুধু বিস্কুট খেয়ে রয়েছে।বাস্তবের কাঠিন্য বুঝতোই না ও এতদিন।মনের আর পেটের খিদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।মনের খিদে না মিটলে,সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে অসহ্য জ্বালায়।কিন্তু তার প্রকাশ বাইরে হয় না।তা অপ্রকাশিতই রয়ে যায়।আর পেটের খিদের জন্য মানুষ নাকি মানুষকে খুন করে?!হুম,করতেই পারে!!কাল বাচ্চা মেয়েটার লোভে জুলজুলে ওই দুটো গভীর চোখই ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে,খিদের জ্বালা কতখানি!!ওরা অভ্যস্ত!খিদে পেটে নিয়েও প্রশান্তির ঘুম ঘুমোতেই অভ্যস্ত ওরা।মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে পড়ছে।দুপুর গড়িয়ে গেছে।প্রায় তিনটে বাজতে যায়।মনের আগুনে জ্বলতে-জ্বলতে,আজ পেটের মধ্যেও আগুন জ্বলছে সমুদ্রর।খিদের চোটে একবার মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো।সেই মুহূর্তেই বিচারকের পক্ষ থেকে ভেসে এলো প্রশ্ন,
-অসাধারণ!তোমার বয়স তো বেশি না!কি করো তুমি?
-আমি স্টুডেন্ট!উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী!
অপার নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে ঘরে।আবার প্রশ্ন এলো,
-মানে?!আজ তো লাস্ট পরীক্ষা।একটা বাকি ছিলো না?!কোশ্চেন লিক...
-হুম!আমি পরীক্ষা দিইনি।
-কেন?
-এখানে আসার জন্য!
-হোয়াট!!মানেটা কি?এখানে আসার জন্য পরীক্ষায় বসোনি?এতবড়....
খিদের চোটে সমুদ্রর মাথা ঘুরতে শুরু করেছে।ও মাথা তুলে দরাজ কণ্ঠে বললো কয়েকটা মাত্র কথা,
-বড় স্বপ্নপূরণের জন্য যে,মূল্যটাও অনেক বড় দিতে হয় স্যার!আমাকেও তাই দিতে হলো!
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন