অসমাপ্ত
চতুর্থ পর্ব
সাথী দাস
-কি দেখছিস ওইরকম হাঁ করে?আমি যাবোই না...ও মরে গেলেও যাবো না!আর তুই আমায় যেতে বললে,তোকেও আমার চোখের সামনে থেকে দূর করবো!!
চেঁচিয়ে উঠে সৌর বললো।অস্থির হয়ে সাইকেলের দিকে এগোলো ও।ভয়ে হাত-পা মৃদু কাঁপছে...ওর সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়োতে-দৌড়োতে সমুদ্র বললো,
-একদম ঠিক বলেছিস ভাই!যে যেমন মানুষ,তার সঙ্গে সেইরকমই হওয়া উচিত।তুই এত করে বললি,পাত্তাই দিলো না তোর কথাটা!?সেই ছুটলো!!নিজে তো মরলোই,ওর সঙ্গে আবার বোকার মতো রূপটাও ছুটলো।ফ্রিতে ওটাকেও না কেলিয়ে দেয়...তবু তুই যাবি না!আমিও যাবো না!
-আমার গায়ে হাত তুলছে!!এত সাহস!আর জীবনেও কথা বলবো না ওর সঙ্গে!
সৌরর গলাটা একটু কেঁপে গেলো।শার্টের হাতা দিয়ে নিজের চোখটা ও মুছে নিলো।বকবক করতে-করতে উঠতে গেলো সাইকেলে...
-ওদের সঙ্গে আর কোনো কথা না।সোজা বাড়ি যাবো আমরা।ওরা মরলে মরুক,যা খুশি হোক গে যাক,আমরা উঁকি মেরেও দেখতে যাবো না।ভুলে যাবি না সৌর,ও কিন্তু তোর গায়ে হাত তুলেছে!এবার দিক ওরা ওর হাত-পা ভেঙে।হ্যাঁ,সামনেই পরীক্ষা,হাত ভেঙে গেলে হারামিগুলো পরীক্ষাটা আর দিতে পারবে না,একটা বছর নষ্ট হবে,এই যা...
সাইকেলে উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর...
-চল!ওঠ...কিরে সৌর?সাইকেলে ওঠ...আমরা যাবোই না!মরুক ওগুলো!নিজেদের বিপদ নিজে ডেকে এনে,এখন আমাদের আরও ঝামেলায় ফেলা!আমরা আমাদের মতো পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাবো।ওরা হাত ভেঙে,ঠ্যাং ভেঙে,মাথা ফাটিয়ে,পড়ে থাকুক বিছানায়।আমাদের কি?!আমরা যাবোই না....
সৌর সন্ধিহান চোখে সমুদ্রর দিকে চাইলো...
-এই ভাই!!তুই কি চাইছিস,পরিষ্কার করে বল তো!!তুই আমাকে যেতে বারণ করছিস,না যেতে বলছিস সমুদ্র?!
অবাক হয়ে সৌর সমুদ্রকে প্রশ্ন করে...
-নানা!আমি তো তোকে যেতে বারণই করছি।তুইও যাবি না!আমিও যাবো না।আমি তোকে জাস্ট সম্ভবনাগুলো বলছি,আমরা না গেলে কি-কি হতে পারে!!ঋষির মাথা বিশাল গরম হয়ে রয়েছে।ও তোর ওপরে হাত চালাতে পারলে,সমর্পণকে কি আর ছেড়ে দেবে ভাবছিস!ওর গায়েও হাত তুলবে।আর ও তো ছাড়বেই না।সবকটা মিলে ওদের পাইকারি দরে কেলিয়ে দেবে।কিন্তু তাতে আমাদের কি?!চল আমরা বেরিয়ে যাই....
মাথা নামিয়ে নিলো সৌর।চোখে জল এসে গেছে ওর...মনে পড়ে যাচ্ছে একসঙ্গে ঋষির বাড়িতে কাটানো রাতগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত।ক্যারাম পেটানো,সেই সঙ্গে ওকেও ধরে পেটানো,ওর লাফালাফি,মাঠে ফুটবল খেলা,সর্বোপরি,ওর লজ্জায় অবনত লাজুক সরল মুখটা।ছেলেটা কিছুতেই বলতে পারতো না রঞ্জাকে....মাথা নীচু করে থাকতো।তারপর সৌরদের কাছে এসে বলতো,
"ও সামনে এসে দাঁড়ালেই সব কেমন ঘেঁটে যায় রে...সব ভুলে যাই!তখন মাথা আর একদম কাজ করে না...."
সৌরর চোখটা জ্বালা করে উঠলো....শরীরটা অস্থির লাগছে....
-কিরে সৌর,চল!!
যখন মাথা তুললো সৌর,সমুদ্র চেয়ে দেখলো,ওর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বেরিয়ে এলো।সমুদ্রর দিকে একবার মাত্র চেয়ে,ও রাস্তার কোণে চাইলো।পাশেই সুবিশাল বাঁশবাগান।ছোট-বড় সারি-সারি হলদেটে বাঁশ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে রাস্তার ওপরেই।ওইদিকে মাত্র একবার চেয়ে,সৌর চাইলো সমুদ্রর দিকে....
-ছেলে আমার হিরো হতে এসেছে!!মেরে ড্রেনের মধ্যে মুখটা একেবারে গুঁজে দেবো।রঞ্জা-রঞ্জা করা বের হয়ে যাবে।তুই আর তোর এই বন্ধু,দুটোকেই গায়েব করে দেবো।আমার বাবা কে জানিস তো?!পুলিশ অফিসার!!কেউ আমার কিচ্ছু বিগড়াতে পারবে না....
নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে ঋষির।রুমালটা ভিজে গেছে।রূপের ডান হাতটা হিমাদ্রি এমনভাবে মুচড়ে ধরে রেখেছে,ও যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো।
-আজ আমি ফার্স্ট আর লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম।আজকের পর আমার সামনে....
সমর্পনের কথা মাঝপথেই থেমে গেলো।বাঁশবাগানের শেষপ্রান্তে একটা ছায়াঘেরা নির্জন গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলো ওরা।পাশেই সুবিশাল শ্যাওলাধরা এক-মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল।সমর্পণের দৃষ্টি অনুসরণ করে,কোনোক্রমে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে দেখলো রূপ।মাঝারি আকারের একটা হলদেটে বাঁশ রয়েছে সমুদ্রের হাতে।ওটাকেই মাটিতে ঠেকিয়ে টানতে-টানতে আনছে ও।আর ওর পাশে যে রয়েছে,সে আর কেউ নয়,সৌর!!ঋষির সঙ্গে মারপিট করে কিছুক্ষণ আগেই ওর জামার বোতাম ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।তাই বুকের জামাটা এখনও খানিকটা খোলাই রয়েছে।মাথা নীচু করে ডান-হাত দিয়ে বাঁ-হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়িটা খুলতে-খুলতে আসছে ও।হাতঘড়িটা পকেটে ঢুকিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো সৌরদীপ সাহা।সমুদ্রর হাতে বাঁশের জমকালো আয়োজন দেখে,বাঁশপেটা খাওয়ার ভয়ে হিমাদ্রি তাড়াতাড়ি রূপের হাতটা ছেড়ে দিলো।এসেই জামার কলার ধরে ঋষিকে মাটি থেকে টেনে তুললো সৌর।নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে ওর,কেঁদে ফেলেছে যন্ত্রণায়।তবে যন্ত্রণাটা শারীরিক না মানসিক,এখনই বোঝা যাচ্ছে না।ভীষণ অসহায় লাগছে ওকে।ওর মুখটা একবার দেখে,সৌর ওকে ছেড়ে দিলো।ওকে পিছনে রেখে,সৌর এগোলো সমর্পণের দিকে...
-ওই প্রতি ফোঁটা রক্তের হিসেব,তোকে আজ দিতে হবে...
-সমর্পণ কাউকে হিসেব দেয় না!
-তাই নাকি!!
-আমাদের মধ্যে আসিস না সৌর।তোর সঙ্গে আমার কোনো ঝামেলা নেই।
-ঠিক আছে।আমি সরে যাবো।তাহলে তোর সাথে যারা আছে,তাদেরও সরতে বল।ঋষি তো শুধু তোর একার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলো,তোকে তো পুরো ব্যাটেলিয়ান নিয়ে আসতে বলেনি।কেন?একা আসতে ভয় লাগে?সঙ্গে করে....
-ওরা আমার বন্ধু!
-ওকে...ওরা তোর বন্ধু!!বেশ।আর এরা তিনজন আমার ভাই!কানে ঢুকলো কথাটা?ভাই!!ব্রাদার্স ফ্রম ডিফারেন্ট মাদার্স!!ব্রাদার্স ফর লাইফ!!
চমকে উঠে সৌরর মুখের দিকে চাইলো রূপ আর ঋষি...
-তাই একেবারে অনাথ মনে করিস না ওকে....সরি বল!আমিও সব ভুলে যাবো!এসব মারামারি-ধরাধরি চলতেই থাকে।ওটা কোনো ব্যাপার না...তুই ঋষিকে সরি বলে দে।এখানেই সব ঝামেলা শেষ কর!!
-আমি সরি বলবো?!ওকে?!
বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে ফেললো সমর্পণ।
-সরি বল!
-এ বাল সর তো...
সমর্পণ সৌরকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরাতে যায় নিজের সামনে থেকে।কিন্তু ওকে নিজের জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারে না।সৌর যেন ওইখানেই সেঁটে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোন এক মন্ত্রবলে।কিন্তু ধাক্কাটা খেয়ে সৌর সেই মুহূর্তেই হাত চালিয়ে দেয় সমর্পণের মুখের ওপর...সৌরর ব্যায়াম করা শক্ত পোড় খাওয়া হাতের,একটা ঘুষিতেই মাথা ঝনঝন করে ওঠে সমর্পণের।কঁকিয়ে উঠলো ও....
-আয়!তোরা না ওর বন্ধু!তোরা পিছনে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?তোরাও আয়!!
চিৎকার করে উঠলো সৌর...
সৌরর রাগ দেখে ওরা আর এগোতে সাহসই পেলো না।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দূরেই।ঘরের বাইরে ওরা কি করে বেড়ায়,তার খবর ওদের অভিভাবকরা জানে না।কিন্তু সৌর যেরকম এলোপাথাড়িভাবে হাত চালাতে শুরু করেছে,কেটে-ফেটে গেলে বাড়িতে খবর আছে।তাই সর্বদা সমর্পণের সঙ্গে সেঁটে থাকা বন্ধুরাও,এই মুহূর্তে আর সামনে এগোবার মতো সাহস পেলো না।
-ওই দেখ!দেখ তোর বন্ধুদের!কেউ এগোচ্ছে না।আগে ভালো করে নিজের বন্ধুদের চেন,ওদের স্বরূপটা জেনে নে।তারপর আমার ভাইয়ের সঙ্গে হিসেব মেটাতে আসবি।যেদিন আমি ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন হলাম,সবাই আমায় অভিনন্দন জানিয়েছে,তোর ওই বন্ধুরাও।একমাত্র তুই জানাসনি।কেন?না,তুই নেহাত জলে নামিসনা,তাই সাঁতার পারিস না!!জলে নামলে,ওইরকম চ্যাম্পিয়নের ট্রফি-মেডেল-সার্টিফিকেট তোর ঘরে নাকি রাখার জায়গাই হবে না।মনে আছে তোর?!তুই সেদিন ঠিক এটাই বলেছিলি!!তোর কথা শুনে আমি শুধু হেসেছিলাম।কিন্তু তুই কি ভুল করেছিলি বল তো?!একজন ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়নের সামনে বলে দিয়েছিলি,যে তুই সাঁতার জানিস না!!জলে নেমে কি করবি,সেটা পরের কথা!!কিন্তু এখন তুই সাঁতার জানিস না,এটাই আসল কথা!!আমার কাজের কথা।ওই দেখ!তাকা ওদিকে....
সমর্পণকে ঠেলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাঁশবাগানের মাঝে সবুজ সুগভীর ডোবাটার দিকে,এগিয়ে নিয়ে গেলো সৌর....
-ওইখানে ফেলে জলের মধ্যে চুবিয়ে,ততক্ষণ পর্যন্ত তোর পা টেনে ধরে রাখবো,যতক্ষণ তোর শেষ নিঃশ্বাসটা না বেরোয়!!তারপর আমি ছেড়ে দিলে,আস্তে-আস্তে ভেসে উঠবি জলে।বাবার ক্ষমতা দেখাস তো সবজায়গায়?!তোর ওই বাবা এসে তোকে দেখে দিশেহারা হয়ে যাবে।নিজেই ঠিক করতে পারবে না,ছেলেকে আগে হসপিটালে নেবে,না সোজা কাটাপুকুরে....সিধে হয়ে যা সমর্পণ!আমার ভাইয়ের সঙ্গে কিন্তু লাগতে আসিস না!!সরি বল....বল সরি!!
কলার ধরে সমর্পণকে ঋষির সামনে এনে দাঁড় করালো সৌর।সৌরর একটা ঘুষিতে সমর্পণের বাঁ-দিকের গালটা কালশিটে হয়ে গেছে।চোখটা ফুলে প্রায় বন্ধ....
-সরি ঋষি!!
-সার্কাস হচ্ছে এখানে?!ফ্রি-তে ইন্টারনেট পাচ্ছিস?কোনোটাই নয় তো?তাহলে তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?গেলি তোরা এখান থেকে?
সমর্পণের বন্ধুদের দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর...একবার সমর্পণের দিকে চেয়ে সাইকেলে উঠে বেরিয়ে গেলো ওরা...
সৌর সমর্পণের জামার কলার ছেড়ে দিলো।সমুদ্র হাতের বাঁশটা রাস্তার পাশে দড়াম করে ফেলে দিলো।
-চল!!
সমর্পণের হাত ধরে টানলো সৌর...
-কোথায়?
-গেলেই দেখতে পাবি!চুপচাপ আমার সাইকেলের পিছনে-পিছনে আয়।পালাবি না কিন্তু...সবকটা আসবি....সমুদ্র?
-বল?
-ওই দুটো উজবুককে সামলে নিয়ে আয়!!সূর্পণখাকে সাইকেল চালাতে হবে না।পরে এসে সাইকেলগুলো আমি নিয়ে যাবো।লক করে ফেলে রাখ!!চাবি আমাকে দে।ওকে তোর সাইকেলের পিছনে তোল...সমর্পণের সাইকেলেই রূপ উঠবে....ওঠ!যা....
ওষুধের দোকানের এক কোণে একটা টুলের ওপর,গালে আইস ব্যাগ চাপা দিয়ে,মাথা নীচু করে চুপ করে বসেছিলো সমর্পণ।রূপের ডানহাতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ বাঁধা।সৌরর কথামতো সূর্পণখা,অর্থাৎ ঋষির নাকের সেবা-শুশ্রূষা চলছে।সমুদ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে ঋষির পাশেই....পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ক্যাশ-কাউন্টারের দিকে এগোলো সৌরদীপ।
-ব্যান্ড-এইডটা লাগিয়ে নে।বুঝতে পারিনি,আমার আঙুলে আংটি ছিলো।ওই আংটিতে লেগে তোর গালটা চিরে গেছে।সরি!!
-থাক!ওসব লাগবে না!!আমি ঠিক আছি....
সৌর চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে,নিজের হাতে ব্যান্ড-এইডটা লাগিয়ে দিলো সমর্পণের ক্ষতস্থানে...সমর্পণ আর বাধা দিলো না...
-সমর্পণ?যেতে পারবি?না বাড়িতে ছেড়ে আসবো?
-পারবো!!
-হুম!!কি বলবি বাড়িতে গিয়ে?শত্রুপক্ষের সঙ্গে ক্যালাকেলি করেছি?!
মাথা নামিয়ে হেসে ফেললো সমর্পণ।গালটা কালশিটে হয়ে ফুলে গেছে।একটু হাসতে গিয়েই মাথা পর্যন্ত ছিঁড়ে পড়লো যন্ত্রণায়....চোখে আসা জলটা চেপে ও বললো,
-শত্রুপক্ষ!?হুহ!!গত এক ঘন্টায় এতদিনের জানা বন্ধু-শত্রুর সব সংজ্ঞা বদলে গেছে রে!!শত্রু-বন্ধু-বন্ধুত্বের আড়ালে আত্মগোপন করে বসে থাকা শত্রু,সব চিনে গেছি এক মুহূর্তেই....তোর চিন্তা নেই!আমার তো একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে।সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়ে গেছিলাম রাস্তায়।তাই একটু আঘাত পেয়েছি।ওটা দেখা যাচ্ছে,তাই ওর কারণটা সবাইকে বলতে হবে,সবাইকে কিছু একটা তো জানাতেই হবে।কিন্তু আমিই একমাত্র জানবো,যখন আমার এক্সিডেন্টটা হলো,যখন আমার বন্ধুদের প্রয়োজন হলো,কোনো বন্ধুই কাজে আসেনি!!শত্রুপক্ষের এক ধমকে সব আমাকে ফেলে রেখে নিজের-নিজের রাস্তায় পালিয়েছে....আমাকে টেনে তুলেছে আমার শত্রুই।আমি এটা মনে রাখবো!!আজীবন...
-সরি ভাই!!
সমর্পণের কাঁধে হাত রেখে সৌর বললো...
-নাঃ!থ্যাঙ্কু ভাই!মানুষ চেনানোর জন্য।দরকার ছিলো...আসছি আমি!!
-দাঁড়া!তোর নম্বরটা দিয়ে যা!বল,আমি সেভ করে নিচ্ছি...
সমর্পণ আর সৌর একে-অপরের নম্বর বিনিময় করে নিলো।বেরিয়ে যাওয়ার আগে সমর্পণ জিজ্ঞেস করলো,
-কি করবি আমার নম্বর দিয়ে?
-বিকেলে তোর একটু খবর নেবো ভাই!জ্যান্ত আছিস,না টেসে গেছিস!!
সমর্পণ আর সৌর দুজনেই হেসে উঠলো...একবার মাত্র ঋষির দিকে চাইলো সমর্পণ।কিন্তু ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো,সাহস পেলো না আর।ব্যাগটা পিঠে ফেলে,কাঁচের দরজা ঠেলে সমর্পণ বেরিয়ে এলো,ওষুধের দোকানের বাইরে....
-সমু?
-বল!
-একটা অটো ডাকছি।এদের দুটোকে বাড়িতে নিয়ে যা।আমি সাইকেলগুলো পরে দিয়ে আসবো।
-তুই আসবি না সৌর?
সমর্পণের নম্বরটা সেভ করার সময়ও একবার ফোনটা দেখলো সৌর।করেনি সে ফোন,করবেনা সে ফোন!!দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো ও....
-না!আমি যাবো না!কাজ আছে একটু...
মাথা নীচু করে একটা টুলে বসে রয়েছে ঋষি।সৌরর সামনে এসে দাঁড়ানোর মতো মুখ,ওর আর নেই।হাতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় পড়িমরি করে দৌড়ে উঠে এলো রূপ।
-সৌর!এদিকে আয়.... ঋষির সঙ্গে...
-তোদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই!!সমু?
-হুম?
-অটো ডেকে দিচ্ছি!বাইরে আয় আমার সঙ্গে....
ব্যাগটা দুহাত দিয়ে গলিয়ে পিঠে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলো সৌর...ঋষি একবার মাত্র চেয়ে দেখলো ওর চলে যাওয়ার দিকে।কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূপ একা দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো....
খাওয়া হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ আগে।অলস দুপুরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিলো সৌর।হাতে একটা রুবিক্স কিউব নিয়ে লড়াই করছে অনেকক্ষণ ধরেই।অন্যদিন মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই মিলে যায়।আজ আর কিছুতেই মেলাতে পারছে না সৌর।প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেলো।সৌরর মস্তিষ্ক কম,মনের দাপট বেশি আজ।মন কর্তৃত্ব করছে সর্বশরীর জুড়ে।বেশ কিছুক্ষণ একভাবে ওটার সঙ্গে যুদ্ধ করে,বিছানায় শুয়েই সৌর ওটাকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।আলমারীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঢং করে একটা শব্দ তুলে,ওটা পড়ে রইলো ঘরের এককোণে।বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে দিলো সৌর।চোখে জল এসে গেছে।একটু আগেই সমর্পণের সঙ্গে ওর কথা হয়েছে।ভালোই আছে ছেলেটা,ঘুমোচ্ছিলো।কিন্তু সৌরর চোখে কাল রাত থেকেই ঘুম নেই।তারপর আবার এক রাস্তায় একাধিকবার সাইকেলিং করে যাতায়াতের ফলে গা-হাত-পাও ব্যথা করছে প্রচন্ড।একহাতে নিজের সাইকেল চালিয়ে,অন্যহাতে ওদের সাইকেলদুটো দুবারে বয়ে আনতে হয়েছে।ঋষি আর রূপের বাড়ির বাইরে সাইকেলগুলো দাঁড় করিয়ে রেখে,ও চলে এসেছে।বাড়ির ভিতরে ঢোকেনি আর।সমুকে ফোন করে বলেছে, ওগুলোর কথা।কারণ,সাইকেলের চাবি দিতেও বাড়ির ভিতরে যায়নি সৌর,সাইকেলের সঙ্গেই ঝুলছে।দুদিন ধরে শরীরচর্চার সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়েছে।নিয়ম-নিষ্ঠা-রুটিন সব মাথায় উঠেছে।রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায়,সকালে সময়মতো উঠতেই পারেনি।গা ব্যথা করছে ভীষণ।ঘড়িতে দুটো বাজলো।ফোনটা হাতে তুলে নিলো সৌর।একবার মনে হলো,স্যার অর্থাৎ সিনিয়র কোচকে ফোন করে বলে দেয়,আজ ও যাবে না।কিন্তু তারপরই আবার ফোনটা নামিয়ে রাখলো হাত থেকে।ব্যক্তিগত কারণে কর্তব্যে অবহেলা করা,ওর নীতিবিরুদ্ধ।একটু আড়মোড়া ভেঙে,সৌর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।জলে নামার জন্য নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে নিয়ে,বেরোনোর প্রস্তুতি নিলো....
গাড়ি থেকে নেমেই অনুসন্ধানের দিকে এগোলো তিলোত্তমা আর ওর বাবাই।বাবাই ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো সুইমিং পুলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে।কৌতূহলবশত পায়ে-পায়ে হেঁটে তিলোত্তমা ঢুকলো ভিতর দিকে।একটুখানি জায়গা জুড়ে নুড়ি-পাথর বসানো সরু রাস্তা।তার দুপাশে রকমারি পাতাবাহারি গাছ লাগানো রয়েছে।জলের ওপর শেষ বেলায় রোদ পড়ে, চিকচিক করছে স্বচ্ছ জলের উপরিভাগ।তিলোত্তমার মাথার চুলগুলো একেবারে ওপর দিকে টেনে খোঁপা করে রাখা।একটা হাতকাটা টপের সঙ্গে হটপ্যান্ট পরে রয়েছে ও।দুটো হাতের সঙ্গে-সঙ্গে,দুটো উরু প্রায় অনাবৃত।পিঠে একটা ছোট ব্যাগ।সুইমিং পুলের আশেপাশের জায়গাটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিলো তিলোত্তমা।সুবিস্তৃত পুলে টলটলে আকাশী রংয়ের পরিষ্কার জল।হালকা নীল-গাঢ় নীলের সম্মিলিত রঙয়ের টাইলসে ঢাকা পুলের নিম্নভাগ।জলের নীচে কালো রঙয়ের চওড়া দাগ দেওয়া রয়েছে।জলের একেবারে শেষ প্রান্তে উঁচু দেওয়ালে এক-দুই করে দশ পর্যন্ত নম্বর লেখা।ডাইভ দিয়ে একসঙ্গে দশজন নামতে পারবে জলে।পাশেই একটু দূরে ছোট্ট একটা পুল।ওটা বাচ্চাদের জন্য বোধহয়।এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে আর একটু সামনের দিকে এগোলো তিলোত্তমা।সামনেই মহিলাদের ওয়াশরুম-লকার আর জামাকাপড় বদলানোর জায়গা।সেই জায়গাটা পেরিয়ে আরও একটু সামনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলো তিলোত্তমা।ওদিকটা হয়তো পুরুষদের জন্যই হবে।কিন্তু ফাঁকা থাকায় ধীরপায়ে এগোচ্ছিলো ও...কয়েক পা এগিয়েই,ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।একজন সুপুরুষ একটা লোহার রড ধরে নিজেকে টেনে ওপরে তুলছে,নীচে নামাচ্ছে বারংবার।ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত,নিম্নাঙ্গে একটা প্যান্ট পরা।শরীরচর্চার সঙ্গে একটু-আধটু যুক্ত থাকা তিলোত্তমা জানে,এটাকে পুল-আপ বলে।তার পা দুটো একে-অপরের সঙ্গে আটকানো রয়েছে।অবাক হয়ে ওইদিকে চেয়ে রইলো ও।রোদ-চশমাটা চোখ থেকে খুলে,মাথার ওপর তুললো তিলোত্তমা।মুখ দেখা যাচ্ছে না তার।শুধু সেই পুরুষের অনাবৃত পিঠটাই দেখলো তিলোত্তমা।পড়ন্ত বিকেলের কড়া রোদ পড়ে ঘর্মাক্ত সেই পুরুষ চকচক করছিলো।ও আর এগোলো না ওইদিকে...ধীরে-ধীরে সরে আসছিলো আনমনে...পিছন ঘুরে দেখলো,সেই মুহূর্তেই বাবার সঙ্গে জনা-দুয়েক ভদ্রলোক কথা বলতে-বলতে এইদিকেই আসছে।ও ধীরপায়ে এগোলো ওদের দিকেই....সোজা গিয়ে দাঁড়ালো বাবাইয়ের কোলের কাছে....
-এই যে,আমার মেয়ে,তিলোত্তমা সান্যাল!মেয়ের এখন মাথায় ভূত চেপেছে,সাঁতার শিখবে।মেয়ে জলে নামবে শুনে,ওর মা তো ভয়েই অস্থির।কিন্তু আমি বললাম,তোর যা ইচ্ছে হবে,যা মন চাইবে,তুই তাই করবি!!ব্যাস!কেউ তোকে কোনোদিনও বাধা দেবে না!আসলে না শোনার অভ্যাসই নেই আমার মেয়ের।
বাবাইয়ের কোলে ঢুকে একটু হাসলো তিলোত্তমা...
-আমার মেয়ে মুখ ফুটে একটি আবদার করেছে,যেভাবেই হোক,দিতে তো হবেই।তা একটু খোঁজখবর নিয়ে জানলাম আপনাদের এখানকার কথা।খুব ভালো রিভিউ পেলাম।অমনি মেয়েকে বগলদাবা করে নিয়ে,বেরিয়ে পড়লাম বাপ-বেটি!!সোনামা,ইনি তোমার ইন্সট্রাক্টর-ট্রেইনার-কোচ,যা খুশি বলো,ইনিই!!
-হ্যালো স্যার!!
তিলোত্তমা হাত বাড়ালো ওনার দিকে...
মধ্যবয়স্ক একজন সৌমকান্তি পুরুষ হেসে ফেললেন,হাত রাখলেন তিলোত্তমার হাতে....তারপর বললেন,
-একটু ভুল হয়ে গেলো স্যার!!আমি এখনকার সিনিয়র কোচ হলেও,জলে নামে কিন্তু আমার চ্যাম্প!!আমি ওপর থেকেই দেখি।আরও কয়েকজন আছে...এই সবাই এসে পড়বে একটু পরেই....
-ওহ আচ্ছা-আচ্ছা!!চ্যাম্প কে?
-আমার ছেলে!!নট বায়োলজিক্যালি!কিন্তু ওকে আমি নিজের হাতে ধরে তৈরী করেছি।হি ইজ মাই বয়!!
গর্বে ফেটে পড়লেন ভদ্রলোক...
-এই জলেই ওকে তৈরী করেছি,ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন!
-ওহ!!বাঃ!!
-হ্যাঁ!ঢুকলো তো একটু আগেই,এই যে....সৌর....
-স্যার!!
-এদিকে এসো...
সংঘাতিকভাবে চমকে উঠলো তিলোত্তমা।ও একভাবে চেয়ে রইলো একটু আগে ঘুরে আসা সীমানাটার দিকে।কারণ,সাড়াটা ওইখান থেকেই এসেছে...আর নামটা শুনেই তো ওর দম আটকে গেলো...
স্যারের ডাকে রড ছেড়ে একলাফে নেমে পড়লো সৌরদীপ।তোয়ালেটা দিয়ে গা মুছে,ওটাকে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে...এবার অবাক হওয়ার পালা সৌরর।দমবন্ধ হয়ে আসছে ওরও।নিজের বাবাইয়ের কোলের মধ্যে ঢুকে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে তিলোত্তমা।রোদ-চশমাটা মাথার ওপরে তোলা রয়েছে।কপালে ভাঁজ...পাশেই স্যার দাঁড়িয়ে রয়েছেন।জোর করে তিলোত্তমার ওপর থেকে চোখ টেনে সরিয়ে,দৌড়ে স্যারের দিকে এগোলো সৌর...
-স্যার!!
-ইয়েস,মিট সৌরদীপ সাহা!ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন,আমার শিষ্য!আর এখানকার জুনিয়র-কোচ!
-কংগ্রাচুলেশন্স ইয়াং-ম্যান!!ভেরি গুড!!তোমার বয়সটা তো বেশ কম,কিন্তু এর মধ্যেই বেশ অনেক কিছুই এচিভ করে ফেলেছো দেখছি।কোয়াইট ইম্প্রেসিভ!!
তিলোত্তমার বাবা সৌরর দিকে শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়।
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
তিলোত্তমার বাবার হাতে-হাত রাখল সৌর।অবাক হয়ে থাকা তিলোত্তমা একটু হেসে,মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো...
-সৌর?
-বলুন স্যার!
-তোমার নতুন ক্যান্ডিডেট!তিলোত্তমা সান্যাল!!নন-সুইমার!
-ওকে স্যার!আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট স্যার।আমি আমার হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে দেবো।
-গুড!এজ এক্সপেক্টেড!!
-তিলোত্তমা,লেডিজ চেঞ্জিং রুম,ওয়াশরুম....
-আমি দেখে নিয়েছি স্যার!একটু আগেই ঘুরে গেছি এখান থেকে।সবই আমার চোখে পড়েছে।
সৌরর দিকে চেয়ে তিলোত্তমা বললো...
-ওকে দেন!আমার তো তাহলে আর কিছু বলার নেই।রেডি হয়ে এসো।কস্টিউম?
-ব্যাগে আছে স্যার!আমি রেডি হয়েই এসেছি।যদি আজই জলে নামতে পারি,সেই জন্য।কস্টিউম,টুপি,ইয়ারপ্লাগ,গ্লাস,সবই আছে...
-বাঃ!!আপনার মেয়ে তো একদম তৈরি!ভেরি গুড!!
একটু হাসলো তিলোত্তমার বাবা...
-বলছি,আমি কি একটু এখানে দাঁড়াতে পারি?মানে মেয়েটা প্রথম জলে নামবে,ওর মা বাড়িতে থেকেই ভীষণ টেনশন করছিলো,তারপর আমিও যদি সামনে না থাকি...মানে বুঝতেই পারছেন,আমি যদি একটু চোখের সামনে মেয়েটাকে
দেখতে পেতাম....
মেয়েকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তিলোত্তমার বাবাই....
-সরি স্যার।এইখানে একটু পরেই লেডিজ ক্যান্ডিডেটরা আসবেন।তারা শাওয়ার নেবেন,কস্টিউম পরে জলে নামবেন।আমরা কারোর বাড়ির গার্জিয়ান আর কোনোরকম ক্যামেরা,ভিতরে এলাউ করি না।সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য।সবার প্রাইভেসির কথা মাথায় রেখে,এটা করতেই হয়।আপনি আগে এসেছেন,তাই এতটা ভিতরে ঢুকতে পেরেছেন।আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাইরের গেট বন্ধ হয়ে যাবে।আইডেন্টিটি-কার্ড দেখিয়ে তবেই ভিতরে ঢোকা যাবে।সরি স্যার!!
-খুবই ভালো নিয়ম,কিন্তু আমার মেয়েটা একা-একা জলে থাকবে?
-বাবাই প্লিজ....এত চিন্তা কোরো না।তোমার সুগারটা বেড়ে যাবে।পারবো আমি....
-ডোন্ট ওয়ারি স্যার,ইয়োর ডটার ইজ ইন সেফ হ্যান্ড!আজ ওর প্রথম দিন,ওকে অবশ্যই বিশেষভাবে দেখা হবে।সৌর?
-স্যার?
-প্লিজ টেক এ স্পেশাল কেয়ার অফ হার!!
-শিওর স্যার!!আই উইল...
মাথা নামিয়ে নিলো সৌর....
-আপনি প্লিজ বাইরে বসুন।ওখানে গার্জিয়ানদের বসার জায়গা আছে।
সুইমিং পুলের কর্মকর্তা তিলোত্তমার বাবাকে বের করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো...
-তুমি বাইরে একা-একা বসে কি করবে বাবাই?চলে যাও।গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দাও।ইটস ওকে বাবাই, আমি ঠিক থাকবো।তুমি এত চিন্তা কোরো না তো...
-হুম!আচ্ছা,আসি তাহলে...আমি ক্লাবে গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দিচ্ছি...
-ওকে!!বাই...
মেয়ের কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন তিলোত্তমার বাবাই...ওনার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে বেরোলেন সঙ্গের দুজনও...
তিলোত্তমা একভাবে চেয়ে রইলো সৌরর দিকে...গলায় একটা তোয়ালে ঝুলছে,হাত দুটো বুকের কাছে রাখা...মুখে বাঁকা হাসি...চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই....
-হুম!!কে যেন আমাকে বলেছিলো,আমিও ওই সবে-সবেই সাঁতার শিখছি,এবার না হয় দুজনে মিলেই শিখবো।ওখানকার ট্রেইনাররা খুব ভালো,একেবারে হাতে ধরে শেখায়।তুমি এসো,তোমারও খুব ভালো লাগবে।আর স্কিনটোন?ক্লোরিন আর রোদে একটা ট্যান পড়ে ঠিকই,তুমি বিকেলের দিকে জলে নামবে।রোদের তেজ একটু কমে গেলে!!জলে নামার আগে সানস্ক্রিন ইউজ করবে,আর জল থেকে উঠে শাওয়ার নেওয়ার আগে ডি-ট্যান স্ক্রাব।আগে এসে তো দেখো....তারপর অসুবিধে হলে না হয় ছেড়েই দিও!!ব্লা-ব্লা-ব্লা....হুম!!এইজন্য সবকিছুর এত নিখুঁত ইনফরমেশন!ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন?জুনিয়র-কোচ?সেই কারণেই এত্ত বকবক-বকবক...
নিজের চিরকালীন অভ্যাসবশত ডান হাতের তর্জনীটা দিয়ে,সৌর ঘষে নিলো নিজের নাকটা।মৃদু হেসে বললো...
-তোমার প্রশ্নের উত্তরে সে তো আরও কয়েকটা কথাও বলেছিলো!জলের গভীরতার কথা যদি জানতে চাও,তার জন্য জলে নামতে হবে।জলে না নামলে বুঝবে কি করে,জল কতটা গভীর!?তার জন্য তো ট্রেইনারের হাত ধরে,ট্রেইনারকে ভরসা করে,তোমাকে ডুবতেই হবে মিছরি....জলে তো নামতেই হবে....আর এমনিতেও মিছরি,শেখার কি কোনো শেষ আছে নাকি?!এই যেমন আমি,আমাকেই দেখো,জলে এতকিছু এচিভ করার পর,একটা জ্ঞান কালই অর্জন করলাম।যেটা আমার আগে জানা ছিলো না।
-কি?!জল সম্পর্কে তোমারও অজানা কিছু আছে নাকি?!
-হুম!আছে তো!
-কি সেটা?
-এই যে,এতদিন জানতাম,জল শুধু আগুন নেভায়।কিন্তু কালকের পর থেকে জানলাম,ক্ষেত্রবিশেষে জল শুধু আগুন নেভাতেই না,আগুন জ্বালাতেও জানে।আর এটা আমি কালকের পর থেকেই বুঝতে পেরেছি!বরং বলা যায়,হাড়ে-হাড়ে বুঝছি....
তিলোত্তমা একভাবে চেয়ে রইলো সৌরর দিকে....সৌর আবার বললো,
-তুমি এসেছো।আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি।ওয়ার্কআউট-ফিটনেস এগুলো নিয়ে সত্যিই মানুষ ভীষণ কম ভাবে।আর এগুলোই আমার নেশা!তবে....
-তবে?
-ফোনটা করলে ভীষণ ভালো লাগতো!
মাথাটা নামিয়ে নিলো তিলোত্তমা....
-সরি সৌর!আসলে আমি ভেবেছিলাম,তুমি হয়তো আমাকে ছোটখাটো কোনো পুকুর বা ডোবায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে,যেটাকে হয়তো সামান্য পরিষ্কার করে সুইমিং পুল বলে চালানো হচ্ছে,বা হয়তো মিডল-ক্লাস কোনো পুলে।মফস্বলে যেমনটা হয় আর কি!!আর সত্যি বলতে,আমি ওখানে সারভাইভ করতে পারতাম না।আমার স্কিন-ইরাপশন হয়ে যেতো,ইনফেকশন হতো....সো আমি সেজন্য বাবাইকে বলি,এখানকার বেস্ট কোনো জায়গার খোঁজ নিতে।আর সেখানেই যে...
-এই অধম থাকবে,এটা তুমি বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারোনি!!
-ট্রু!!সরি!!সেই কারণেই তোমাকে আর ফোন করে বিব্রত করিনি।
-মিছরি!কল মি এনিটাইম!আমি একেবারেই বিব্রত হবো না।সত্যি?
-ওকে!কোচ বলে কথা!!এবার তো করতেই হবে....স্যার!!
-হাট....স্যার!!
দুজনেই হেসে উঠলো সমস্বরে...
-যাও!চেঞ্জ করে নাও!শাওয়ার নিয়ে এসো!
-জলে নামার আগেই শাওয়ার?
-ইয়েস!জলে নামার আগে একবার!উঠে আরও একবার!
-কালই না জ্বরে পড়ি!
-কিচ্ছু হবে না!শরীরের নাম মহাশয়,যা সহাবে তাই সয়!তুমি নিজেও জানো না,তোমার শরীরের নেওয়ার ক্ষমতা কতখানি!!সহ্যশক্তি বাড়াও,দুদিনে সব অভ্যাস হয়ে যাবে...গো মিছরি!ফাস্ট....জলে নামার পর আমিই তোমার সব।কোনো প্রশ্ন নয়,কোনোরকমে অবাধ্যতা নয়।আমি যা বলবো,তাই করবে।সম্পূর্ণ আমার হাতে নিজেকে ছেড়ে দেবে।কখন সাঁতার শিখে গিয়ে,জলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে প্রতিটা বিন্দুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে,নিজেই বুঝতে পারবে না।তোমাকে আমি তৈরী করে দেব!!
-ওকে!!
সৌরও এগিয়ে যাচ্ছিলো নিজেদের ওয়াশরুমের দিকে।শাওয়ার নিতে...পিছন থেকে ডাকলো তিলোত্তমা...
-সৌর!!ইয়ে মানে,স্যার...
-হাট!তুমি আমায় নাম ধরে ডাকবে!যদিও উচিত না।আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে নেবো....
-বেশ!বলছিলাম যে,আমি আজ এখানে আসার পর দেখলাম একজনকে...
-কাকে?
-দেখলাম...একজনকে,লোহার রডে দুটো হাত রেখে পুল-আপ করছিলো।
চমকে উঠে তিলোত্তমার দিকে চাইলো সৌর....ও তখনও বলে যাচ্ছে...
-ভেবেছিলাম,পরে অভিনন্দন জানাবো।কারণ,আমি যে সময়টুকু তাকে দেখেছি,একবারের জন্যও থামতে দেখিনি।আর পুল-আপ মানে নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ওজন,সম্পূর্ণভাবে টেনে তোলা।আমি দুটো-মেরেকেটে তিনটের পরই উল্টে পড়ি।তাই আমি জানি,এটা কতটা হার্ড!আর,তাকে দেখলাম,একদম নিখুঁত!!তো সেই সময় তাকে দেখে,একটা শব্দই মাথায় এলো....
-সেটা কি?
একটু হাসলো সৌর...
-হি ইজ আ বিস্ট!!
গুছিয়ে আওয়াজ দিলো তিলোত্তমা...
-রিয়েলি?!
চোখদুটো বড় হয়ে গেলো সৌরর...একটু হেসে ও এগিয়ে এলো তিলোত্তমার একেবারে কাছে...ওর কানে-কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-দেন হোয়্যার ইস দা বিউটি?!
তিলোত্তমা ভেবেছিলো সৌর এভাবে একটা মেয়ের থেকে সামনাসামনি কমপ্লিমেন্ট পেয়ে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যাবে।কিন্তু ওর নিজের কথাটা,এইভাবে সঙ্গে-সঙ্গে চাবুকের মতো ওর দিকেই যে ফিরে আসবে,ভাবতেই পারেনি তিলোত্তমা।ঘাবড়ে গিয়ে একদম চুপ করে গেলো ও....
হেসে ফেললো সৌর...
-ভালো হয়েছে,এটা জলে নামার আগে বললে....
-কেন?
-জলে নেমে ফ্লার্ট করা,ইনএপ্রপিয়েট ওয়েতে স্টুডেন্টদের গায়ে হাত দেওয়া,প্রয়োজন ছাড়া টাচ করা,আমার এথিকসের বাইরে পড়ে....
-তার মানে জলের ওপরে সব চলে?!
তিলোত্তমার প্রশ্নের ধরনে হেসে ফেললো সৌর...তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
-ডিপেন্ড করে মিছরি,সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে,তার ওপর।নিজের মনের মতো মানুষ হলে,তার সঙ্গে সবরকম পাগলামিই চলে...যাও!শাওয়ার নিয়ে নাও।এরপর ওয়াশরুমে ভিড় হয়ে যাবে....তোমাকে কিন্তু মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট জলে থাকতে দেবে।তারপর বেল পড়লে উঠে পড়তে হবে।ওই পঁয়তাল্লিশ মিনিট তুমি-আমি-আর জল ছাড়া,জগতের সবকিছু ভুলে যাবে।পুরো সময়টা নিংড়ে নিয়ে কাজে লাগাবে...যাও...
-হুম....
ঠিকই বুঝেছিলো সৌর।জলও আগুন জ্বালাতে পারে।এতদিনের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম কাউকে সুইমিং কস্টিউমে দেখে,কিছুক্ষণের জন্য মাথা নামিয়ে নিলো ও।হলুদ-সবুজ রঙয়ের ছাপা একটা সুইমিং কস্টিউম পরে তিলোত্তমা এগিয়ে এলো জলের দিকে।পা রাখলো সিঁড়িতে....প্রথমেই তিলোত্তমাকে ভুল করতে দেখে জল থেকে এগিয়ে এলো সৌর...
-মিছরি!পিছন ঘুরে...
-মানে?
-এটা বাড়ির সিঁড়ি নয়,যে সোজাসুজি নামবে।পিছন ঘুরে রেলিং ধরে জলে নামো।পা রাখলেই ফ্লোর পেয়ে যাবে....
-আচ্ছা!
তিলোত্তমা জলে নামার পরই সৌর বলতে শুরু করলো,
-আমরা এখন কিডস জোনে দাঁড়িয়ে আছি।তোমার হাঁটু পর্যন্ত জল।এখানে আমাদের কোনো কাজ নেই।আর একটু এগিয়ে স্যালো জোন।আজ তোমার প্রথম দিন,তুমি ওইখানেই থাকবে।তারপর ডিপ জোন।আমি তোমাকে কয়েকদিনের মধ্যেই ওইখানে পৌঁছে দেবো।আর তারপর....
-তারপর?
-সুইমার জোন!যেদিন তুমি ওখানে পৌঁছে যাবে,সেদিন হয়তো আমাকে তোমার আর প্রয়োজন হবে না।ওখানে কোনো ট্রেইনার লাগে না।
হেসে ফেললো সৌর...
-হাসলে যে!
-যেদিন প্রথম ডাইভ দেবো বলে ওখানে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম,ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম।মনে হচ্ছিলো ওখানে ঝাঁপ দিলেই তলিয়ে যাবো অতলে।কিন্তু স্যারকে সেই ভয়ের কথা বলতেও পারছিলাম না।মানে সেদিন নিজের ওপর কোনো কনফিডেন্সই ছিলো না,এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু স্যারের ছিলো।আমার ওপর আমার থেকেও স্যারের বেশি কনফিডেন্স ছিলো।আমার সঙ্গে কথা বলতে-বলতেই,আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো জলে।বুঝতেই পারিনি,কখন সাঁতার কাটতে শুরু করেছিলাম।আসলে কি বলো তো মিছরি!!প্রানের
ভয় এমনই একটা জিনিস,যার কারণে,যে মানুষ সাঁতার জানে না,সেও জলে পড়লে হাত-পা ছুঁড়ে একবার অন্তত বাঁচার চেষ্টা করবেই।আর আমি তো তীরের বেগে বেরিয়ে এসেছিলাম জল কেটে।শুধু ওই ধাক্কাটার প্রয়োজন ছিলো।যেটা সেদিন স্যার আমায় দিয়েছিলেন।নাও,চলো....হাতের মুভমেন্ট গুলো আগে দেখে নাও...
সৌরর সঙ্গে জলের উপরিভাগে ভাসতে লাগলো তিলোত্তমা....এবার অপেক্ষা শুধু অতল গভীরে ডুবে যাওয়ার...
-গুড মর্নিং ম্যাম!!
-মর্নিং সমুদ্র।একি?আজ খালি হাতে?
-সরি ম্যাম!!আজ ফুলের দোকানটা বন্ধ ছিলো।
মিষ্টি একটা হাসি খেলে গেলো রানী ম্যামের মুখে....
-আচ্ছা!!ওসব বাদ দাও!তুমি বলো,পরীক্ষা তো প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে।প্রিপারেশন কেমন?
-চলছে ম্যাম!
-প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?
-চেষ্টা তো করছি ম্যাম!
-হুম!গুড!কিছু ডাউট থাকলে,এক্সট্রা ক্লাসে ক্লিয়ার করে নিতে পারো!
-ওকে ম্যাম!শিওর...
সমুদ্রর সামনে দিয়ে চলে গেলেন রানী ম্যাম....মনটাই ভালো হয়ে গেলো ওর।কাল থেকে কেউ ওকে সেভাবে ফোন করেনি।না সৌর,না ঋষি,না রূপ!একদিনেই সব ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।ও ফোন করলেও কেউ ফোন ধরছে না।এবার তো মনে হচ্ছে,এদের মাঝে ওকেই সেতু হয়ে দাঁড়াতে হবে....
ব্যাগটা নিয়ে ক্লাসে ঢুকলো সমুদ্র।ওরা দুজন এক জায়গায়,সৌর ক্লাসের আর এক কোণে একা বসে আছে।রূপের হাতের কনুইতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ বাঁধা,আর ঋষির নাকের ওপর ব্যান্ড-এইড!নাকটা এখনও একটু ফুলে আছে বোধহয়...সব দেখেশুনে ওদের দুজনের শরীরের খবর নিয়ে,দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমুদ্র এগিয়ে গেলো সৌরর দিকেই....
-কিরে?
-বল!
-এদিকে বসলি কেন?চল,ওদিকে বসি!
-তুই এখানে এলি কেন?ওখানেই তো বসে পড়তে পারতিস!
-সৌর!!কি ভাই?এত ম্যাচুওর তুই!এইরকম করবি?!
-কি বললি তুই!!আমাকে বলছিস?গায়ে হাত কে তুলেছিলো?
-ওর তখন মাথার ঠিক ছিলো না।
-এখন আমার নেই!হিসাব বরাবর!!
-উফফ!!ভাই,মেয়েদের মতো করবি?!
-মেয়েদের মতো?মানে?
-আমার একটা খুড়তুতো দিদি আছে।একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম ফুচকা খেতে।
-তো?
-তো আরও একজন মেয়ে এসে দাঁড়ালো ওখানে....তাকে দেখেই দিদি আমার হাত থেকে পাতাটা নিয়ে রেখে দিলো।বললো,খেতে হবে না ভাই!চল...আমি তো অবাক!এইভাবে মুখের সামনে থেকে খাবার কে সরিয়ে নেয়?!ফুচকাওলার ছাতার তলা থেকে,আমার হাত ধরে টানতে-টানতে,দিদি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।আমি বললাম,ব্যাপারটা কি?!কি বললো জানিস?
-কি?
-কোন ক্লাস দিদির মনেও নেই।ও বলতেই পারলো না।কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে,তখন বুঝিবা দু-একটা ডায়নোসর পৃথিবীর বুকে বেঁচে ছিলো,সেই সময় ওর ওই বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিলো।কি নিয়ে ঝগড়া মনে নেই,কবে ঝগড়া মনে নেই,শুধু ঝগড়া হয়েছিলো,এটুকু মনে আছে...সেটা মনে রেখে আজও দুজন-দুজনকে দেখলেই উল্টোদিকে দৌড় মারে....
সাংঘাতিক হাসি পেয়ে গেলো সৌরর...নিজের হাসিটা চাপতে,মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিলো ও....
-তা তুইও কি ওইরকম করবি?
-জানিনা!!
-উফফ!!এত মহা ঝামেলা....
ক্লাসে স্যার ঢুকে যাওয়ায় আলোচনা তখনকার মতো ওখানেই স্থগিত রইলো...
-একা-একা খাবি?ঋষি কাকিমার হাতের এই তরকারিটা খেতে খুব ভালোবাসে কিন্তু।ওকে না দিয়েই তুই খেয়ে নিবি?
সৌর টিফিনবক্স খোলা মাত্রই,এক নজর ওদিকে চেয়ে বলে উঠলো সমুদ্র...
-এই তুই কার বন্ধু রে সমুদ্র?!আমার বলে তো মনে হয় না।তোর মন এত প্যাঁচালো,আমিই তোকে মাঝে-মধ্যে বুঝে উঠতে পারি না।
চেঁচিয়ে উঠলো সৌর...
-হয়-হয়।ওইরকম হয়।শিল্পী মানুষদের একটু গভীরভাবে বুঝতে গেলে,নিজেকেই ওইরকম ঘেঁটে যেতে হয়।দেখবি,একদিন তোকে সময় নিয়ে গায়ক সমুদ্র বসুর বাড়িতে দেখা করতে আসতে হবে।
-এ ভাই!বাস্তবে ফের ভাই!আগে কাকু-কাকিমাকে বল তুই কি চাস,ওরা মেনে নিক।তারপর অলীক স্বপ্ন দেখবি!!
একদম চুপ করে গেলো সমুদ্র।বেশ কল্পনায় ভাসছিলো ও,নিজের অপূরণীয় স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছিলো।কিন্তু সৌর ওকে একটানে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসলো...একেবারে মুষড়ে পড়লো ও...সৌর বুঝতে পেরে গেলো,ও সমুদ্রকে আঘাত করে ফেলেছে।তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-দিনরাত ওদের হয়ে বলতে গেলে,কাল থেকে ওদের পাশে গিয়ে বসবি।আমার ধারেপারে দেখলে,ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দেবো বলে দিলাম...আমি জানি,তোর মনে ওরাই আছে...আমি নয়...
-সৌর,তুই জানিস না,আমি কি!আমি হলাম সমুদ্র!!সমুদ্রের মতোই গভীর আমার মন।অনেক-অনেক জায়গা আছে।চিন্তা করছিস কেন?ওদের সঙ্গে-সঙ্গে তোকেও একটু এডজাস্ট করে নেবোখন!!তুই তো আমার ভাই...
খেপে উঠে চিৎকার করে,হলুদের হাতটা সমুদ্রর জামায় মুছে দিলো সৌর...কিন্তু খাবারটা আর খেলো না ও।মুখেই দিতে পারলো না ও।টিফিনবক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে গেলো...
-যা!সবে-সবে সকাল হয়েছে,জমি তৈরি করে দিয়েছি,নরম আছে।লাঙল চালিয়ে দে...কাজ হয়ে যাবে।এরপর বেলা বাড়লে,রোদ পড়ে মাটি শক্ত হয়ে শুকিয়ে গেলে,আর কিন্তু পারবি না...
ঋষির সামনে গিয়ে বললো সমুদ্র।মাথা নীচু করে ঋষি বসে আছে বেঞ্চের এককোণে....
-কোন মুখ নিয়ে ওর সামনে যাবো?
-যে মুখ দিয়ে কাল ওকে খিস্তি দিয়েছিলি,সেই মুখ নিয়েই যাবি....
-যা বলছি,নইলে এবার আমিই কিন্তু তোর নাকটা ফাটিয়ে দেবো...কাল থেকে এক কথা বলেই যাচ্ছি।শুনছেই না।যা...
চেঁচিয়ে উঠলো রূপও।ধাক্কা মেরে ঋষিকে বের করলো সমুদ্র আর রূপায়ণ....
-সৌর?
দূরে সমুদ্র আর রূপ দাঁড়িয়ে রয়েছে,আবার দুটোর হাতাহাতি লাগলে,দৌড়ে যেতে হবে।মাঠের কাছে একা বসেছিলো সৌর...ঋষির ডাক ওর কানে পৌঁছলেও ফিরেও তাকালো না ও....সামনের দিকেই চেয়ে রইলো....ঋষি গিয়ে বসলো ওর পাশে....
-ব্রাদার্স ফ্রম ডিফারেন্ট মাদার্স!!ব্রাদার্স ফর লাইফ!!এটাই তো বলেছিলি কাল!!ক্ষমা করবি না ভাই?!ভুল হয়ে গেছে।যাঃ!!না করলে না করবি!আমি কিন্তু তোকে ছাড়বো না।এইভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো....
সৌরকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ঋষি....সৌর মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়েই রইলো....মুখটা কঠিন,কিন্তু চোখের কোণে জল...
-ভাই!ভুল হয়ে গেছে ভাই।বলছি তো...মাথা ঠিক ছিলো না।
কেঁদে ফেললো ঋষি...সৌর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে...দূর থেকে হেসে উঠলো সমুদ্র আর রূপ...ধীরপায়ে এগোতে গেলো ওদের দিকে...
-সূর্পণখার নাকটা দেখি!!
বলেই নাকের ওপর আঙুল রেখে জোরে করে টিপে দিলো সৌর....
-আঃ!এ ভাই ব্যথা আছে রে!পাগলা নাকি তুই?
-ওটাই তো দেখলাম,চিৎকার করে উঠিস কিনা!!
-কি ছোটলোক রে তুই!!
-আরে ব্যথা জায়গায় ব্যথা দিতেই তো বেশি মজা রে!প্রথম দিন ব্যায়াম করবি,গা ব্যথা হবে।দ্বিতীয় দিন ওই ব্যথার ওপরেই আবার ব্যথা দিয়ে দেখবি,কেমন মজা!!
-ও ভাই ট্রেইনার!থাম ভাই...আমি ব্যায়াম করবো না।কিছুতেই করবো না....
-হ্যাঁ,তুই খালি খাবি আর বেলুন হবি!দাঁড়া,পরীক্ষাটা হয়ে যাক।হাতের সামনে পাই!সবকটাকে মাঠে দৌড় করাবো!ঋষি,ঠিক আছিস তো তুই?
সৌরর প্রশ্নে মাথা নাময়ে নিলো ঋষি....কালশিটে নাক নিয়েও বেশ হাসছিলো ও।কিন্তু এটুকু আদরেই আবার চোখে জল এসে গেলো।সৌরকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে বললো,
-ভুল হয়ে গেছে রে ভাই!কাল আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম!ভাবতেই পারিনি রঞ্জা এইরকম একটা মেয়ে।বুঝতেই পারিনি ওকে।ওর জন্য তোর গায়েও হাত তুলেছি।ভুল হয়ে গেছে....
দুহাতে সৌর জড়িয়ে ধরলো ঋষিকে....
-কান্ড দেখো সূর্পণখার।জিজ্ঞেস করলাম,তুই ঠিক আছিস কিনা!হ্যাঁ বা না বলবে তো!রচনা মুখস্ত বলে দিলো!!এ থাম ভাই!
-এই যে!তোমাদের এই পুনর্মিলনে আমাদেরও একটু হাত আছে ভাই!আমরাও একটু গলাগলিতে জায়গা পেতে পারি কি?!
দূর থেকে হেঁটে আসা সমুদ্র বললো....ওর সঙ্গে রয়েছে একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে রূপ....
-দেখ না,কিছুতেই ছাড়ছে না।কিভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে!সবাই দেখলে কি ভাববে বলতো!!এই সূর্পণখা আমার মান-সম্মান আর কিছু রাখলো না....
সৌরর ইশারা বুঝে হো-হো করে হেসে উঠলো সমুদ্র আর রূপ...
-ফালতু কথা বলবি না সৌর!!আমি একদম ঠিকঠাক আছি!সিধে আছি!!
-ভাই,একটু আগে যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলি,আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম।শালা চুমু খেতে বাকি রেখেছিলিস শুধু...আমি তো ভাবলাম,এই না ঠোঁটে-ঠোঁট ঠেকিয়ে দেয়...
সৌরর কথা শুনে ওকে মারতে-মারতে মাঠে শুইয়ে দিলো ঋষি...
-আমাকে মারলে তোর ফেবারিট টিফিন পাবি না কিন্তু।আমি দেবোই না।
-দিবি না মানে?দেখ,তোর আগে গিয়ে,তোর ব্যাগ থেকে বের করে খেয়ে নেবো...
সৌরকে ছেড়ে উঠেই দৌড় দেয় ঋষি...
-আরে আমরা বাদ যাবো নাকি?দাঁড়া....
-সমু,তোর দিদিকে বলে দিস,আমরা মেয়ে নই।যে মুহূর্তে মারপিট করবো,পরের মুহুর্তেই আবার বুকে জড়িয়ে ধরবো।কিন্তু চুমু খাবো না!নো চুমু....
ছুটতে-ছুটতেই চেঁচালো সৌর...
-কে দিদি!কার দিদি?আমার কোনো দিদি নেই।
হেসে উঠলো সমুদ্র...
-শালা ছোটলোক!তোকে একবার ধরতে পারি দাঁড়া...
-আমাকে পরে ধরবি,আগে টিফিনবক্স বাঁচা ভাই...নইলে পেটে দড়ি দিয়ে থাকতে হবে....
চারবন্ধু একসঙ্গে লাফাতে-লাফাতে ছুটে গেলো সৌরর মায়ের হাতে তৈরি,অসমাপ্ত টিফিনটুকু শেষ করার জন্য....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
চেঁচিয়ে উঠে সৌর বললো।অস্থির হয়ে সাইকেলের দিকে এগোলো ও।ভয়ে হাত-পা মৃদু কাঁপছে...ওর সঙ্গে-সঙ্গে দৌড়োতে-দৌড়োতে সমুদ্র বললো,
-একদম ঠিক বলেছিস ভাই!যে যেমন মানুষ,তার সঙ্গে সেইরকমই হওয়া উচিত।তুই এত করে বললি,পাত্তাই দিলো না তোর কথাটা!?সেই ছুটলো!!নিজে তো মরলোই,ওর সঙ্গে আবার বোকার মতো রূপটাও ছুটলো।ফ্রিতে ওটাকেও না কেলিয়ে দেয়...তবু তুই যাবি না!আমিও যাবো না!
-আমার গায়ে হাত তুলছে!!এত সাহস!আর জীবনেও কথা বলবো না ওর সঙ্গে!
সৌরর গলাটা একটু কেঁপে গেলো।শার্টের হাতা দিয়ে নিজের চোখটা ও মুছে নিলো।বকবক করতে-করতে উঠতে গেলো সাইকেলে...
-ওদের সঙ্গে আর কোনো কথা না।সোজা বাড়ি যাবো আমরা।ওরা মরলে মরুক,যা খুশি হোক গে যাক,আমরা উঁকি মেরেও দেখতে যাবো না।ভুলে যাবি না সৌর,ও কিন্তু তোর গায়ে হাত তুলেছে!এবার দিক ওরা ওর হাত-পা ভেঙে।হ্যাঁ,সামনেই পরীক্ষা,হাত ভেঙে গেলে হারামিগুলো পরীক্ষাটা আর দিতে পারবে না,একটা বছর নষ্ট হবে,এই যা...
সাইকেলে উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর...
-চল!ওঠ...কিরে সৌর?সাইকেলে ওঠ...আমরা যাবোই না!মরুক ওগুলো!নিজেদের বিপদ নিজে ডেকে এনে,এখন আমাদের আরও ঝামেলায় ফেলা!আমরা আমাদের মতো পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাবো।ওরা হাত ভেঙে,ঠ্যাং ভেঙে,মাথা ফাটিয়ে,পড়ে থাকুক বিছানায়।আমাদের কি?!আমরা যাবোই না....
সৌর সন্ধিহান চোখে সমুদ্রর দিকে চাইলো...
-এই ভাই!!তুই কি চাইছিস,পরিষ্কার করে বল তো!!তুই আমাকে যেতে বারণ করছিস,না যেতে বলছিস সমুদ্র?!
অবাক হয়ে সৌর সমুদ্রকে প্রশ্ন করে...
-নানা!আমি তো তোকে যেতে বারণই করছি।তুইও যাবি না!আমিও যাবো না।আমি তোকে জাস্ট সম্ভবনাগুলো বলছি,আমরা না গেলে কি-কি হতে পারে!!ঋষির মাথা বিশাল গরম হয়ে রয়েছে।ও তোর ওপরে হাত চালাতে পারলে,সমর্পণকে কি আর ছেড়ে দেবে ভাবছিস!ওর গায়েও হাত তুলবে।আর ও তো ছাড়বেই না।সবকটা মিলে ওদের পাইকারি দরে কেলিয়ে দেবে।কিন্তু তাতে আমাদের কি?!চল আমরা বেরিয়ে যাই....
মাথা নামিয়ে নিলো সৌর।চোখে জল এসে গেছে ওর...মনে পড়ে যাচ্ছে একসঙ্গে ঋষির বাড়িতে কাটানো রাতগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত।ক্যারাম পেটানো,সেই সঙ্গে ওকেও ধরে পেটানো,ওর লাফালাফি,মাঠে ফুটবল খেলা,সর্বোপরি,ওর লজ্জায় অবনত লাজুক সরল মুখটা।ছেলেটা কিছুতেই বলতে পারতো না রঞ্জাকে....মাথা নীচু করে থাকতো।তারপর সৌরদের কাছে এসে বলতো,
"ও সামনে এসে দাঁড়ালেই সব কেমন ঘেঁটে যায় রে...সব ভুলে যাই!তখন মাথা আর একদম কাজ করে না...."
সৌরর চোখটা জ্বালা করে উঠলো....শরীরটা অস্থির লাগছে....
-কিরে সৌর,চল!!
যখন মাথা তুললো সৌর,সমুদ্র চেয়ে দেখলো,ওর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল বেরিয়ে এলো।সমুদ্রর দিকে একবার মাত্র চেয়ে,ও রাস্তার কোণে চাইলো।পাশেই সুবিশাল বাঁশবাগান।ছোট-বড় সারি-সারি হলদেটে বাঁশ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে রাস্তার ওপরেই।ওইদিকে মাত্র একবার চেয়ে,সৌর চাইলো সমুদ্রর দিকে....
-ছেলে আমার হিরো হতে এসেছে!!মেরে ড্রেনের মধ্যে মুখটা একেবারে গুঁজে দেবো।রঞ্জা-রঞ্জা করা বের হয়ে যাবে।তুই আর তোর এই বন্ধু,দুটোকেই গায়েব করে দেবো।আমার বাবা কে জানিস তো?!পুলিশ অফিসার!!কেউ আমার কিচ্ছু বিগড়াতে পারবে না....
নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে ঋষির।রুমালটা ভিজে গেছে।রূপের ডান হাতটা হিমাদ্রি এমনভাবে মুচড়ে ধরে রেখেছে,ও যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো।
-আজ আমি ফার্স্ট আর লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম।আজকের পর আমার সামনে....
সমর্পনের কথা মাঝপথেই থেমে গেলো।বাঁশবাগানের শেষপ্রান্তে একটা ছায়াঘেরা নির্জন গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলো ওরা।পাশেই সুবিশাল শ্যাওলাধরা এক-মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল।সমর্পণের দৃষ্টি অনুসরণ করে,কোনোক্রমে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে দেখলো রূপ।মাঝারি আকারের একটা হলদেটে বাঁশ রয়েছে সমুদ্রের হাতে।ওটাকেই মাটিতে ঠেকিয়ে টানতে-টানতে আনছে ও।আর ওর পাশে যে রয়েছে,সে আর কেউ নয়,সৌর!!ঋষির সঙ্গে মারপিট করে কিছুক্ষণ আগেই ওর জামার বোতাম ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।তাই বুকের জামাটা এখনও খানিকটা খোলাই রয়েছে।মাথা নীচু করে ডান-হাত দিয়ে বাঁ-হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়িটা খুলতে-খুলতে আসছে ও।হাতঘড়িটা পকেটে ঢুকিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো সৌরদীপ সাহা।সমুদ্রর হাতে বাঁশের জমকালো আয়োজন দেখে,বাঁশপেটা খাওয়ার ভয়ে হিমাদ্রি তাড়াতাড়ি রূপের হাতটা ছেড়ে দিলো।এসেই জামার কলার ধরে ঋষিকে মাটি থেকে টেনে তুললো সৌর।নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে ওর,কেঁদে ফেলেছে যন্ত্রণায়।তবে যন্ত্রণাটা শারীরিক না মানসিক,এখনই বোঝা যাচ্ছে না।ভীষণ অসহায় লাগছে ওকে।ওর মুখটা একবার দেখে,সৌর ওকে ছেড়ে দিলো।ওকে পিছনে রেখে,সৌর এগোলো সমর্পণের দিকে...
-ওই প্রতি ফোঁটা রক্তের হিসেব,তোকে আজ দিতে হবে...
-সমর্পণ কাউকে হিসেব দেয় না!
-তাই নাকি!!
-আমাদের মধ্যে আসিস না সৌর।তোর সঙ্গে আমার কোনো ঝামেলা নেই।
-ঠিক আছে।আমি সরে যাবো।তাহলে তোর সাথে যারা আছে,তাদেরও সরতে বল।ঋষি তো শুধু তোর একার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলো,তোকে তো পুরো ব্যাটেলিয়ান নিয়ে আসতে বলেনি।কেন?একা আসতে ভয় লাগে?সঙ্গে করে....
-ওরা আমার বন্ধু!
-ওকে...ওরা তোর বন্ধু!!বেশ।আর এরা তিনজন আমার ভাই!কানে ঢুকলো কথাটা?ভাই!!ব্রাদার্স ফ্রম ডিফারেন্ট মাদার্স!!ব্রাদার্স ফর লাইফ!!
চমকে উঠে সৌরর মুখের দিকে চাইলো রূপ আর ঋষি...
-তাই একেবারে অনাথ মনে করিস না ওকে....সরি বল!আমিও সব ভুলে যাবো!এসব মারামারি-ধরাধরি চলতেই থাকে।ওটা কোনো ব্যাপার না...তুই ঋষিকে সরি বলে দে।এখানেই সব ঝামেলা শেষ কর!!
-আমি সরি বলবো?!ওকে?!
বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে ফেললো সমর্পণ।
-সরি বল!
-এ বাল সর তো...
সমর্পণ সৌরকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরাতে যায় নিজের সামনে থেকে।কিন্তু ওকে নিজের জায়গা থেকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারে না।সৌর যেন ওইখানেই সেঁটে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোন এক মন্ত্রবলে।কিন্তু ধাক্কাটা খেয়ে সৌর সেই মুহূর্তেই হাত চালিয়ে দেয় সমর্পণের মুখের ওপর...সৌরর ব্যায়াম করা শক্ত পোড় খাওয়া হাতের,একটা ঘুষিতেই মাথা ঝনঝন করে ওঠে সমর্পণের।কঁকিয়ে উঠলো ও....
-আয়!তোরা না ওর বন্ধু!তোরা পিছনে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?তোরাও আয়!!
চিৎকার করে উঠলো সৌর...
সৌরর রাগ দেখে ওরা আর এগোতে সাহসই পেলো না।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দূরেই।ঘরের বাইরে ওরা কি করে বেড়ায়,তার খবর ওদের অভিভাবকরা জানে না।কিন্তু সৌর যেরকম এলোপাথাড়িভাবে হাত চালাতে শুরু করেছে,কেটে-ফেটে গেলে বাড়িতে খবর আছে।তাই সর্বদা সমর্পণের সঙ্গে সেঁটে থাকা বন্ধুরাও,এই মুহূর্তে আর সামনে এগোবার মতো সাহস পেলো না।
-ওই দেখ!দেখ তোর বন্ধুদের!কেউ এগোচ্ছে না।আগে ভালো করে নিজের বন্ধুদের চেন,ওদের স্বরূপটা জেনে নে।তারপর আমার ভাইয়ের সঙ্গে হিসেব মেটাতে আসবি।যেদিন আমি ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন হলাম,সবাই আমায় অভিনন্দন জানিয়েছে,তোর ওই বন্ধুরাও।একমাত্র তুই জানাসনি।কেন?না,তুই নেহাত জলে নামিসনা,তাই সাঁতার পারিস না!!জলে নামলে,ওইরকম চ্যাম্পিয়নের ট্রফি-মেডেল-সার্টিফিকেট তোর ঘরে নাকি রাখার জায়গাই হবে না।মনে আছে তোর?!তুই সেদিন ঠিক এটাই বলেছিলি!!তোর কথা শুনে আমি শুধু হেসেছিলাম।কিন্তু তুই কি ভুল করেছিলি বল তো?!একজন ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়নের সামনে বলে দিয়েছিলি,যে তুই সাঁতার জানিস না!!জলে নেমে কি করবি,সেটা পরের কথা!!কিন্তু এখন তুই সাঁতার জানিস না,এটাই আসল কথা!!আমার কাজের কথা।ওই দেখ!তাকা ওদিকে....
সমর্পণকে ঠেলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাঁশবাগানের মাঝে সবুজ সুগভীর ডোবাটার দিকে,এগিয়ে নিয়ে গেলো সৌর....
-ওইখানে ফেলে জলের মধ্যে চুবিয়ে,ততক্ষণ পর্যন্ত তোর পা টেনে ধরে রাখবো,যতক্ষণ তোর শেষ নিঃশ্বাসটা না বেরোয়!!তারপর আমি ছেড়ে দিলে,আস্তে-আস্তে ভেসে উঠবি জলে।বাবার ক্ষমতা দেখাস তো সবজায়গায়?!তোর ওই বাবা এসে তোকে দেখে দিশেহারা হয়ে যাবে।নিজেই ঠিক করতে পারবে না,ছেলেকে আগে হসপিটালে নেবে,না সোজা কাটাপুকুরে....সিধে হয়ে যা সমর্পণ!আমার ভাইয়ের সঙ্গে কিন্তু লাগতে আসিস না!!সরি বল....বল সরি!!
কলার ধরে সমর্পণকে ঋষির সামনে এনে দাঁড় করালো সৌর।সৌরর একটা ঘুষিতে সমর্পণের বাঁ-দিকের গালটা কালশিটে হয়ে গেছে।চোখটা ফুলে প্রায় বন্ধ....
-সরি ঋষি!!
-সার্কাস হচ্ছে এখানে?!ফ্রি-তে ইন্টারনেট পাচ্ছিস?কোনোটাই নয় তো?তাহলে তোরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?গেলি তোরা এখান থেকে?
সমর্পণের বন্ধুদের দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর...একবার সমর্পণের দিকে চেয়ে সাইকেলে উঠে বেরিয়ে গেলো ওরা...
সৌর সমর্পণের জামার কলার ছেড়ে দিলো।সমুদ্র হাতের বাঁশটা রাস্তার পাশে দড়াম করে ফেলে দিলো।
-চল!!
সমর্পণের হাত ধরে টানলো সৌর...
-কোথায়?
-গেলেই দেখতে পাবি!চুপচাপ আমার সাইকেলের পিছনে-পিছনে আয়।পালাবি না কিন্তু...সবকটা আসবি....সমুদ্র?
-বল?
-ওই দুটো উজবুককে সামলে নিয়ে আয়!!সূর্পণখাকে সাইকেল চালাতে হবে না।পরে এসে সাইকেলগুলো আমি নিয়ে যাবো।লক করে ফেলে রাখ!!চাবি আমাকে দে।ওকে তোর সাইকেলের পিছনে তোল...সমর্পণের সাইকেলেই রূপ উঠবে....ওঠ!যা....
ওষুধের দোকানের এক কোণে একটা টুলের ওপর,গালে আইস ব্যাগ চাপা দিয়ে,মাথা নীচু করে চুপ করে বসেছিলো সমর্পণ।রূপের ডানহাতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ বাঁধা।সৌরর কথামতো সূর্পণখা,অর্থাৎ ঋষির নাকের সেবা-শুশ্রূষা চলছে।সমুদ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে ঋষির পাশেই....পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ক্যাশ-কাউন্টারের দিকে এগোলো সৌরদীপ।
-ব্যান্ড-এইডটা লাগিয়ে নে।বুঝতে পারিনি,আমার আঙুলে আংটি ছিলো।ওই আংটিতে লেগে তোর গালটা চিরে গেছে।সরি!!
-থাক!ওসব লাগবে না!!আমি ঠিক আছি....
সৌর চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে,নিজের হাতে ব্যান্ড-এইডটা লাগিয়ে দিলো সমর্পণের ক্ষতস্থানে...সমর্পণ আর বাধা দিলো না...
-সমর্পণ?যেতে পারবি?না বাড়িতে ছেড়ে আসবো?
-পারবো!!
-হুম!!কি বলবি বাড়িতে গিয়ে?শত্রুপক্ষের সঙ্গে ক্যালাকেলি করেছি?!
মাথা নামিয়ে হেসে ফেললো সমর্পণ।গালটা কালশিটে হয়ে ফুলে গেছে।একটু হাসতে গিয়েই মাথা পর্যন্ত ছিঁড়ে পড়লো যন্ত্রণায়....চোখে আসা জলটা চেপে ও বললো,
-শত্রুপক্ষ!?হুহ!!গত এক ঘন্টায় এতদিনের জানা বন্ধু-শত্রুর সব সংজ্ঞা বদলে গেছে রে!!শত্রু-বন্ধু-বন্ধুত্বের আড়ালে আত্মগোপন করে বসে থাকা শত্রু,সব চিনে গেছি এক মুহূর্তেই....তোর চিন্তা নেই!আমার তো একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে।সাইকেল নিয়ে উল্টে পড়ে গেছিলাম রাস্তায়।তাই একটু আঘাত পেয়েছি।ওটা দেখা যাচ্ছে,তাই ওর কারণটা সবাইকে বলতে হবে,সবাইকে কিছু একটা তো জানাতেই হবে।কিন্তু আমিই একমাত্র জানবো,যখন আমার এক্সিডেন্টটা হলো,যখন আমার বন্ধুদের প্রয়োজন হলো,কোনো বন্ধুই কাজে আসেনি!!শত্রুপক্ষের এক ধমকে সব আমাকে ফেলে রেখে নিজের-নিজের রাস্তায় পালিয়েছে....আমাকে টেনে তুলেছে আমার শত্রুই।আমি এটা মনে রাখবো!!আজীবন...
-সরি ভাই!!
সমর্পণের কাঁধে হাত রেখে সৌর বললো...
-নাঃ!থ্যাঙ্কু ভাই!মানুষ চেনানোর জন্য।দরকার ছিলো...আসছি আমি!!
-দাঁড়া!তোর নম্বরটা দিয়ে যা!বল,আমি সেভ করে নিচ্ছি...
সমর্পণ আর সৌর একে-অপরের নম্বর বিনিময় করে নিলো।বেরিয়ে যাওয়ার আগে সমর্পণ জিজ্ঞেস করলো,
-কি করবি আমার নম্বর দিয়ে?
-বিকেলে তোর একটু খবর নেবো ভাই!জ্যান্ত আছিস,না টেসে গেছিস!!
সমর্পণ আর সৌর দুজনেই হেসে উঠলো...একবার মাত্র ঋষির দিকে চাইলো সমর্পণ।কিন্তু ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো,সাহস পেলো না আর।ব্যাগটা পিঠে ফেলে,কাঁচের দরজা ঠেলে সমর্পণ বেরিয়ে এলো,ওষুধের দোকানের বাইরে....
-সমু?
-বল!
-একটা অটো ডাকছি।এদের দুটোকে বাড়িতে নিয়ে যা।আমি সাইকেলগুলো পরে দিয়ে আসবো।
-তুই আসবি না সৌর?
সমর্পণের নম্বরটা সেভ করার সময়ও একবার ফোনটা দেখলো সৌর।করেনি সে ফোন,করবেনা সে ফোন!!দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা পকেটে রেখে দিলো ও....
-না!আমি যাবো না!কাজ আছে একটু...
মাথা নীচু করে একটা টুলে বসে রয়েছে ঋষি।সৌরর সামনে এসে দাঁড়ানোর মতো মুখ,ওর আর নেই।হাতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় পড়িমরি করে দৌড়ে উঠে এলো রূপ।
-সৌর!এদিকে আয়.... ঋষির সঙ্গে...
-তোদের সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই!!সমু?
-হুম?
-অটো ডেকে দিচ্ছি!বাইরে আয় আমার সঙ্গে....
ব্যাগটা দুহাত দিয়ে গলিয়ে পিঠে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলো সৌর...ঋষি একবার মাত্র চেয়ে দেখলো ওর চলে যাওয়ার দিকে।কিংকর্তব্যবিমূঢ় রূপ একা দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো....
খাওয়া হয়ে গেছে বেশ অনেকক্ষণ আগে।অলস দুপুরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিলো সৌর।হাতে একটা রুবিক্স কিউব নিয়ে লড়াই করছে অনেকক্ষণ ধরেই।অন্যদিন মিনিট দশ-পনেরোর মধ্যেই মিলে যায়।আজ আর কিছুতেই মেলাতে পারছে না সৌর।প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেলো।সৌরর মস্তিষ্ক কম,মনের দাপট বেশি আজ।মন কর্তৃত্ব করছে সর্বশরীর জুড়ে।বেশ কিছুক্ষণ একভাবে ওটার সঙ্গে যুদ্ধ করে,বিছানায় শুয়েই সৌর ওটাকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।আলমারীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঢং করে একটা শব্দ তুলে,ওটা পড়ে রইলো ঘরের এককোণে।বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে দিলো সৌর।চোখে জল এসে গেছে।একটু আগেই সমর্পণের সঙ্গে ওর কথা হয়েছে।ভালোই আছে ছেলেটা,ঘুমোচ্ছিলো।কিন্তু সৌরর চোখে কাল রাত থেকেই ঘুম নেই।তারপর আবার এক রাস্তায় একাধিকবার সাইকেলিং করে যাতায়াতের ফলে গা-হাত-পাও ব্যথা করছে প্রচন্ড।একহাতে নিজের সাইকেল চালিয়ে,অন্যহাতে ওদের সাইকেলদুটো দুবারে বয়ে আনতে হয়েছে।ঋষি আর রূপের বাড়ির বাইরে সাইকেলগুলো দাঁড় করিয়ে রেখে,ও চলে এসেছে।বাড়ির ভিতরে ঢোকেনি আর।সমুকে ফোন করে বলেছে, ওগুলোর কথা।কারণ,সাইকেলের চাবি দিতেও বাড়ির ভিতরে যায়নি সৌর,সাইকেলের সঙ্গেই ঝুলছে।দুদিন ধরে শরীরচর্চার সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়েছে।নিয়ম-নিষ্ঠা-রুটিন সব মাথায় উঠেছে।রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায়,সকালে সময়মতো উঠতেই পারেনি।গা ব্যথা করছে ভীষণ।ঘড়িতে দুটো বাজলো।ফোনটা হাতে তুলে নিলো সৌর।একবার মনে হলো,স্যার অর্থাৎ সিনিয়র কোচকে ফোন করে বলে দেয়,আজ ও যাবে না।কিন্তু তারপরই আবার ফোনটা নামিয়ে রাখলো হাত থেকে।ব্যক্তিগত কারণে কর্তব্যে অবহেলা করা,ওর নীতিবিরুদ্ধ।একটু আড়মোড়া ভেঙে,সৌর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।জলে নামার জন্য নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে নিয়ে,বেরোনোর প্রস্তুতি নিলো....
গাড়ি থেকে নেমেই অনুসন্ধানের দিকে এগোলো তিলোত্তমা আর ওর বাবাই।বাবাই ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো সুইমিং পুলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে।কৌতূহলবশত পায়ে-পায়ে হেঁটে তিলোত্তমা ঢুকলো ভিতর দিকে।একটুখানি জায়গা জুড়ে নুড়ি-পাথর বসানো সরু রাস্তা।তার দুপাশে রকমারি পাতাবাহারি গাছ লাগানো রয়েছে।জলের ওপর শেষ বেলায় রোদ পড়ে, চিকচিক করছে স্বচ্ছ জলের উপরিভাগ।তিলোত্তমার মাথার চুলগুলো একেবারে ওপর দিকে টেনে খোঁপা করে রাখা।একটা হাতকাটা টপের সঙ্গে হটপ্যান্ট পরে রয়েছে ও।দুটো হাতের সঙ্গে-সঙ্গে,দুটো উরু প্রায় অনাবৃত।পিঠে একটা ছোট ব্যাগ।সুইমিং পুলের আশেপাশের জায়গাটা ঘুরে-ঘুরে দেখছিলো তিলোত্তমা।সুবিস্তৃত পুলে টলটলে আকাশী রংয়ের পরিষ্কার জল।হালকা নীল-গাঢ় নীলের সম্মিলিত রঙয়ের টাইলসে ঢাকা পুলের নিম্নভাগ।জলের নীচে কালো রঙয়ের চওড়া দাগ দেওয়া রয়েছে।জলের একেবারে শেষ প্রান্তে উঁচু দেওয়ালে এক-দুই করে দশ পর্যন্ত নম্বর লেখা।ডাইভ দিয়ে একসঙ্গে দশজন নামতে পারবে জলে।পাশেই একটু দূরে ছোট্ট একটা পুল।ওটা বাচ্চাদের জন্য বোধহয়।এদিক-ওদিক দেখতে-দেখতে আর একটু সামনের দিকে এগোলো তিলোত্তমা।সামনেই মহিলাদের ওয়াশরুম-লকার আর জামাকাপড় বদলানোর জায়গা।সেই জায়গাটা পেরিয়ে আরও একটু সামনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলো তিলোত্তমা।ওদিকটা হয়তো পুরুষদের জন্যই হবে।কিন্তু ফাঁকা থাকায় ধীরপায়ে এগোচ্ছিলো ও...কয়েক পা এগিয়েই,ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।একজন সুপুরুষ একটা লোহার রড ধরে নিজেকে টেনে ওপরে তুলছে,নীচে নামাচ্ছে বারংবার।ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত,নিম্নাঙ্গে একটা প্যান্ট পরা।শরীরচর্চার সঙ্গে একটু-আধটু যুক্ত থাকা তিলোত্তমা জানে,এটাকে পুল-আপ বলে।তার পা দুটো একে-অপরের সঙ্গে আটকানো রয়েছে।অবাক হয়ে ওইদিকে চেয়ে রইলো ও।রোদ-চশমাটা চোখ থেকে খুলে,মাথার ওপর তুললো তিলোত্তমা।মুখ দেখা যাচ্ছে না তার।শুধু সেই পুরুষের অনাবৃত পিঠটাই দেখলো তিলোত্তমা।পড়ন্ত বিকেলের কড়া রোদ পড়ে ঘর্মাক্ত সেই পুরুষ চকচক করছিলো।ও আর এগোলো না ওইদিকে...ধীরে-ধীরে সরে আসছিলো আনমনে...পিছন ঘুরে দেখলো,সেই মুহূর্তেই বাবার সঙ্গে জনা-দুয়েক ভদ্রলোক কথা বলতে-বলতে এইদিকেই আসছে।ও ধীরপায়ে এগোলো ওদের দিকেই....সোজা গিয়ে দাঁড়ালো বাবাইয়ের কোলের কাছে....
-এই যে,আমার মেয়ে,তিলোত্তমা সান্যাল!মেয়ের এখন মাথায় ভূত চেপেছে,সাঁতার শিখবে।মেয়ে জলে নামবে শুনে,ওর মা তো ভয়েই অস্থির।কিন্তু আমি বললাম,তোর যা ইচ্ছে হবে,যা মন চাইবে,তুই তাই করবি!!ব্যাস!কেউ তোকে কোনোদিনও বাধা দেবে না!আসলে না শোনার অভ্যাসই নেই আমার মেয়ের।
বাবাইয়ের কোলে ঢুকে একটু হাসলো তিলোত্তমা...
-আমার মেয়ে মুখ ফুটে একটি আবদার করেছে,যেভাবেই হোক,দিতে তো হবেই।তা একটু খোঁজখবর নিয়ে জানলাম আপনাদের এখানকার কথা।খুব ভালো রিভিউ পেলাম।অমনি মেয়েকে বগলদাবা করে নিয়ে,বেরিয়ে পড়লাম বাপ-বেটি!!সোনামা,ইনি তোমার ইন্সট্রাক্টর-ট্রেইনার-কোচ,যা খুশি বলো,ইনিই!!
-হ্যালো স্যার!!
তিলোত্তমা হাত বাড়ালো ওনার দিকে...
মধ্যবয়স্ক একজন সৌমকান্তি পুরুষ হেসে ফেললেন,হাত রাখলেন তিলোত্তমার হাতে....তারপর বললেন,
-একটু ভুল হয়ে গেলো স্যার!!আমি এখনকার সিনিয়র কোচ হলেও,জলে নামে কিন্তু আমার চ্যাম্প!!আমি ওপর থেকেই দেখি।আরও কয়েকজন আছে...এই সবাই এসে পড়বে একটু পরেই....
-ওহ আচ্ছা-আচ্ছা!!চ্যাম্প কে?
-আমার ছেলে!!নট বায়োলজিক্যালি!কিন্তু ওকে আমি নিজের হাতে ধরে তৈরী করেছি।হি ইজ মাই বয়!!
গর্বে ফেটে পড়লেন ভদ্রলোক...
-এই জলেই ওকে তৈরী করেছি,ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন!
-ওহ!!বাঃ!!
-হ্যাঁ!ঢুকলো তো একটু আগেই,এই যে....সৌর....
-স্যার!!
-এদিকে এসো...
সংঘাতিকভাবে চমকে উঠলো তিলোত্তমা।ও একভাবে চেয়ে রইলো একটু আগে ঘুরে আসা সীমানাটার দিকে।কারণ,সাড়াটা ওইখান থেকেই এসেছে...আর নামটা শুনেই তো ওর দম আটকে গেলো...
স্যারের ডাকে রড ছেড়ে একলাফে নেমে পড়লো সৌরদীপ।তোয়ালেটা দিয়ে গা মুছে,ওটাকে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে...এবার অবাক হওয়ার পালা সৌরর।দমবন্ধ হয়ে আসছে ওরও।নিজের বাবাইয়ের কোলের মধ্যে ঢুকে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে তিলোত্তমা।রোদ-চশমাটা মাথার ওপরে তোলা রয়েছে।কপালে ভাঁজ...পাশেই স্যার দাঁড়িয়ে রয়েছেন।জোর করে তিলোত্তমার ওপর থেকে চোখ টেনে সরিয়ে,দৌড়ে স্যারের দিকে এগোলো সৌর...
-স্যার!!
-ইয়েস,মিট সৌরদীপ সাহা!ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন,আমার শিষ্য!আর এখানকার জুনিয়র-কোচ!
-কংগ্রাচুলেশন্স ইয়াং-ম্যান!!ভেরি গুড!!তোমার বয়সটা তো বেশ কম,কিন্তু এর মধ্যেই বেশ অনেক কিছুই এচিভ করে ফেলেছো দেখছি।কোয়াইট ইম্প্রেসিভ!!
তিলোত্তমার বাবা সৌরর দিকে শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়।
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
তিলোত্তমার বাবার হাতে-হাত রাখল সৌর।অবাক হয়ে থাকা তিলোত্তমা একটু হেসে,মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো...
-সৌর?
-বলুন স্যার!
-তোমার নতুন ক্যান্ডিডেট!তিলোত্তমা সান্যাল!!নন-সুইমার!
-ওকে স্যার!আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট স্যার।আমি আমার হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে দেবো।
-গুড!এজ এক্সপেক্টেড!!
-তিলোত্তমা,লেডিজ চেঞ্জিং রুম,ওয়াশরুম....
-আমি দেখে নিয়েছি স্যার!একটু আগেই ঘুরে গেছি এখান থেকে।সবই আমার চোখে পড়েছে।
সৌরর দিকে চেয়ে তিলোত্তমা বললো...
-ওকে দেন!আমার তো তাহলে আর কিছু বলার নেই।রেডি হয়ে এসো।কস্টিউম?
-ব্যাগে আছে স্যার!আমি রেডি হয়েই এসেছি।যদি আজই জলে নামতে পারি,সেই জন্য।কস্টিউম,টুপি,ইয়ারপ্লাগ,গ্লাস,সবই আছে...
-বাঃ!!আপনার মেয়ে তো একদম তৈরি!ভেরি গুড!!
একটু হাসলো তিলোত্তমার বাবা...
-বলছি,আমি কি একটু এখানে দাঁড়াতে পারি?মানে মেয়েটা প্রথম জলে নামবে,ওর মা বাড়িতে থেকেই ভীষণ টেনশন করছিলো,তারপর আমিও যদি সামনে না থাকি...মানে বুঝতেই পারছেন,আমি যদি একটু চোখের সামনে মেয়েটাকে
দেখতে পেতাম....
মেয়েকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তিলোত্তমার বাবাই....
-সরি স্যার।এইখানে একটু পরেই লেডিজ ক্যান্ডিডেটরা আসবেন।তারা শাওয়ার নেবেন,কস্টিউম পরে জলে নামবেন।আমরা কারোর বাড়ির গার্জিয়ান আর কোনোরকম ক্যামেরা,ভিতরে এলাউ করি না।সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য।সবার প্রাইভেসির কথা মাথায় রেখে,এটা করতেই হয়।আপনি আগে এসেছেন,তাই এতটা ভিতরে ঢুকতে পেরেছেন।আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাইরের গেট বন্ধ হয়ে যাবে।আইডেন্টিটি-কার্ড দেখিয়ে তবেই ভিতরে ঢোকা যাবে।সরি স্যার!!
-খুবই ভালো নিয়ম,কিন্তু আমার মেয়েটা একা-একা জলে থাকবে?
-বাবাই প্লিজ....এত চিন্তা কোরো না।তোমার সুগারটা বেড়ে যাবে।পারবো আমি....
-ডোন্ট ওয়ারি স্যার,ইয়োর ডটার ইজ ইন সেফ হ্যান্ড!আজ ওর প্রথম দিন,ওকে অবশ্যই বিশেষভাবে দেখা হবে।সৌর?
-স্যার?
-প্লিজ টেক এ স্পেশাল কেয়ার অফ হার!!
-শিওর স্যার!!আই উইল...
মাথা নামিয়ে নিলো সৌর....
-আপনি প্লিজ বাইরে বসুন।ওখানে গার্জিয়ানদের বসার জায়গা আছে।
সুইমিং পুলের কর্মকর্তা তিলোত্তমার বাবাকে বের করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো...
-তুমি বাইরে একা-একা বসে কি করবে বাবাই?চলে যাও।গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দাও।ইটস ওকে বাবাই, আমি ঠিক থাকবো।তুমি এত চিন্তা কোরো না তো...
-হুম!আচ্ছা,আসি তাহলে...আমি ক্লাবে গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দিচ্ছি...
-ওকে!!বাই...
মেয়ের কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন তিলোত্তমার বাবাই...ওনার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে বেরোলেন সঙ্গের দুজনও...
তিলোত্তমা একভাবে চেয়ে রইলো সৌরর দিকে...গলায় একটা তোয়ালে ঝুলছে,হাত দুটো বুকের কাছে রাখা...মুখে বাঁকা হাসি...চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই....
-হুম!!কে যেন আমাকে বলেছিলো,আমিও ওই সবে-সবেই সাঁতার শিখছি,এবার না হয় দুজনে মিলেই শিখবো।ওখানকার ট্রেইনাররা খুব ভালো,একেবারে হাতে ধরে শেখায়।তুমি এসো,তোমারও খুব ভালো লাগবে।আর স্কিনটোন?ক্লোরিন আর রোদে একটা ট্যান পড়ে ঠিকই,তুমি বিকেলের দিকে জলে নামবে।রোদের তেজ একটু কমে গেলে!!জলে নামার আগে সানস্ক্রিন ইউজ করবে,আর জল থেকে উঠে শাওয়ার নেওয়ার আগে ডি-ট্যান স্ক্রাব।আগে এসে তো দেখো....তারপর অসুবিধে হলে না হয় ছেড়েই দিও!!ব্লা-ব্লা-ব্লা....হুম!!এইজন্য সবকিছুর এত নিখুঁত ইনফরমেশন!ডিস্ট্রিক্ট-চ্যাম্পিয়ন?জুনিয়র-কোচ?সেই কারণেই এত্ত বকবক-বকবক...
নিজের চিরকালীন অভ্যাসবশত ডান হাতের তর্জনীটা দিয়ে,সৌর ঘষে নিলো নিজের নাকটা।মৃদু হেসে বললো...
-তোমার প্রশ্নের উত্তরে সে তো আরও কয়েকটা কথাও বলেছিলো!জলের গভীরতার কথা যদি জানতে চাও,তার জন্য জলে নামতে হবে।জলে না নামলে বুঝবে কি করে,জল কতটা গভীর!?তার জন্য তো ট্রেইনারের হাত ধরে,ট্রেইনারকে ভরসা করে,তোমাকে ডুবতেই হবে মিছরি....জলে তো নামতেই হবে....আর এমনিতেও মিছরি,শেখার কি কোনো শেষ আছে নাকি?!এই যেমন আমি,আমাকেই দেখো,জলে এতকিছু এচিভ করার পর,একটা জ্ঞান কালই অর্জন করলাম।যেটা আমার আগে জানা ছিলো না।
-কি?!জল সম্পর্কে তোমারও অজানা কিছু আছে নাকি?!
-হুম!আছে তো!
-কি সেটা?
-এই যে,এতদিন জানতাম,জল শুধু আগুন নেভায়।কিন্তু কালকের পর থেকে জানলাম,ক্ষেত্রবিশেষে জল শুধু আগুন নেভাতেই না,আগুন জ্বালাতেও জানে।আর এটা আমি কালকের পর থেকেই বুঝতে পেরেছি!বরং বলা যায়,হাড়ে-হাড়ে বুঝছি....
তিলোত্তমা একভাবে চেয়ে রইলো সৌরর দিকে....সৌর আবার বললো,
-তুমি এসেছো।আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি।ওয়ার্কআউট-ফিটনেস এগুলো নিয়ে সত্যিই মানুষ ভীষণ কম ভাবে।আর এগুলোই আমার নেশা!তবে....
-তবে?
-ফোনটা করলে ভীষণ ভালো লাগতো!
মাথাটা নামিয়ে নিলো তিলোত্তমা....
-সরি সৌর!আসলে আমি ভেবেছিলাম,তুমি হয়তো আমাকে ছোটখাটো কোনো পুকুর বা ডোবায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে,যেটাকে হয়তো সামান্য পরিষ্কার করে সুইমিং পুল বলে চালানো হচ্ছে,বা হয়তো মিডল-ক্লাস কোনো পুলে।মফস্বলে যেমনটা হয় আর কি!!আর সত্যি বলতে,আমি ওখানে সারভাইভ করতে পারতাম না।আমার স্কিন-ইরাপশন হয়ে যেতো,ইনফেকশন হতো....সো আমি সেজন্য বাবাইকে বলি,এখানকার বেস্ট কোনো জায়গার খোঁজ নিতে।আর সেখানেই যে...
-এই অধম থাকবে,এটা তুমি বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারোনি!!
-ট্রু!!সরি!!সেই কারণেই তোমাকে আর ফোন করে বিব্রত করিনি।
-মিছরি!কল মি এনিটাইম!আমি একেবারেই বিব্রত হবো না।সত্যি?
-ওকে!কোচ বলে কথা!!এবার তো করতেই হবে....স্যার!!
-হাট....স্যার!!
দুজনেই হেসে উঠলো সমস্বরে...
-যাও!চেঞ্জ করে নাও!শাওয়ার নিয়ে এসো!
-জলে নামার আগেই শাওয়ার?
-ইয়েস!জলে নামার আগে একবার!উঠে আরও একবার!
-কালই না জ্বরে পড়ি!
-কিচ্ছু হবে না!শরীরের নাম মহাশয়,যা সহাবে তাই সয়!তুমি নিজেও জানো না,তোমার শরীরের নেওয়ার ক্ষমতা কতখানি!!সহ্যশক্তি বাড়াও,দুদিনে সব অভ্যাস হয়ে যাবে...গো মিছরি!ফাস্ট....জলে নামার পর আমিই তোমার সব।কোনো প্রশ্ন নয়,কোনোরকমে অবাধ্যতা নয়।আমি যা বলবো,তাই করবে।সম্পূর্ণ আমার হাতে নিজেকে ছেড়ে দেবে।কখন সাঁতার শিখে গিয়ে,জলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে প্রতিটা বিন্দুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবে,নিজেই বুঝতে পারবে না।তোমাকে আমি তৈরী করে দেব!!
-ওকে!!
সৌরও এগিয়ে যাচ্ছিলো নিজেদের ওয়াশরুমের দিকে।শাওয়ার নিতে...পিছন থেকে ডাকলো তিলোত্তমা...
-সৌর!!ইয়ে মানে,স্যার...
-হাট!তুমি আমায় নাম ধরে ডাকবে!যদিও উচিত না।আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে নেবো....
-বেশ!বলছিলাম যে,আমি আজ এখানে আসার পর দেখলাম একজনকে...
-কাকে?
-দেখলাম...একজনকে,লোহার রডে দুটো হাত রেখে পুল-আপ করছিলো।
চমকে উঠে তিলোত্তমার দিকে চাইলো সৌর....ও তখনও বলে যাচ্ছে...
-ভেবেছিলাম,পরে অভিনন্দন জানাবো।কারণ,আমি যে সময়টুকু তাকে দেখেছি,একবারের জন্যও থামতে দেখিনি।আর পুল-আপ মানে নিজের শরীরের সম্পূর্ণ ওজন,সম্পূর্ণভাবে টেনে তোলা।আমি দুটো-মেরেকেটে তিনটের পরই উল্টে পড়ি।তাই আমি জানি,এটা কতটা হার্ড!আর,তাকে দেখলাম,একদম নিখুঁত!!তো সেই সময় তাকে দেখে,একটা শব্দই মাথায় এলো....
-সেটা কি?
একটু হাসলো সৌর...
-হি ইজ আ বিস্ট!!
গুছিয়ে আওয়াজ দিলো তিলোত্তমা...
-রিয়েলি?!
চোখদুটো বড় হয়ে গেলো সৌরর...একটু হেসে ও এগিয়ে এলো তিলোত্তমার একেবারে কাছে...ওর কানে-কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-দেন হোয়্যার ইস দা বিউটি?!
তিলোত্তমা ভেবেছিলো সৌর এভাবে একটা মেয়ের থেকে সামনাসামনি কমপ্লিমেন্ট পেয়ে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যাবে।কিন্তু ওর নিজের কথাটা,এইভাবে সঙ্গে-সঙ্গে চাবুকের মতো ওর দিকেই যে ফিরে আসবে,ভাবতেই পারেনি তিলোত্তমা।ঘাবড়ে গিয়ে একদম চুপ করে গেলো ও....
হেসে ফেললো সৌর...
-ভালো হয়েছে,এটা জলে নামার আগে বললে....
-কেন?
-জলে নেমে ফ্লার্ট করা,ইনএপ্রপিয়েট ওয়েতে স্টুডেন্টদের গায়ে হাত দেওয়া,প্রয়োজন ছাড়া টাচ করা,আমার এথিকসের বাইরে পড়ে....
-তার মানে জলের ওপরে সব চলে?!
তিলোত্তমার প্রশ্নের ধরনে হেসে ফেললো সৌর...তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
-ডিপেন্ড করে মিছরি,সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে,তার ওপর।নিজের মনের মতো মানুষ হলে,তার সঙ্গে সবরকম পাগলামিই চলে...যাও!শাওয়ার নিয়ে নাও।এরপর ওয়াশরুমে ভিড় হয়ে যাবে....তোমাকে কিন্তু মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট জলে থাকতে দেবে।তারপর বেল পড়লে উঠে পড়তে হবে।ওই পঁয়তাল্লিশ মিনিট তুমি-আমি-আর জল ছাড়া,জগতের সবকিছু ভুলে যাবে।পুরো সময়টা নিংড়ে নিয়ে কাজে লাগাবে...যাও...
-হুম....
ঠিকই বুঝেছিলো সৌর।জলও আগুন জ্বালাতে পারে।এতদিনের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম কাউকে সুইমিং কস্টিউমে দেখে,কিছুক্ষণের জন্য মাথা নামিয়ে নিলো ও।হলুদ-সবুজ রঙয়ের ছাপা একটা সুইমিং কস্টিউম পরে তিলোত্তমা এগিয়ে এলো জলের দিকে।পা রাখলো সিঁড়িতে....প্রথমেই তিলোত্তমাকে ভুল করতে দেখে জল থেকে এগিয়ে এলো সৌর...
-মিছরি!পিছন ঘুরে...
-মানে?
-এটা বাড়ির সিঁড়ি নয়,যে সোজাসুজি নামবে।পিছন ঘুরে রেলিং ধরে জলে নামো।পা রাখলেই ফ্লোর পেয়ে যাবে....
-আচ্ছা!
তিলোত্তমা জলে নামার পরই সৌর বলতে শুরু করলো,
-আমরা এখন কিডস জোনে দাঁড়িয়ে আছি।তোমার হাঁটু পর্যন্ত জল।এখানে আমাদের কোনো কাজ নেই।আর একটু এগিয়ে স্যালো জোন।আজ তোমার প্রথম দিন,তুমি ওইখানেই থাকবে।তারপর ডিপ জোন।আমি তোমাকে কয়েকদিনের মধ্যেই ওইখানে পৌঁছে দেবো।আর তারপর....
-তারপর?
-সুইমার জোন!যেদিন তুমি ওখানে পৌঁছে যাবে,সেদিন হয়তো আমাকে তোমার আর প্রয়োজন হবে না।ওখানে কোনো ট্রেইনার লাগে না।
হেসে ফেললো সৌর...
-হাসলে যে!
-যেদিন প্রথম ডাইভ দেবো বলে ওখানে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম,ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম।মনে হচ্ছিলো ওখানে ঝাঁপ দিলেই তলিয়ে যাবো অতলে।কিন্তু স্যারকে সেই ভয়ের কথা বলতেও পারছিলাম না।মানে সেদিন নিজের ওপর কোনো কনফিডেন্সই ছিলো না,এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু স্যারের ছিলো।আমার ওপর আমার থেকেও স্যারের বেশি কনফিডেন্স ছিলো।আমার সঙ্গে কথা বলতে-বলতেই,আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো জলে।বুঝতেই পারিনি,কখন সাঁতার কাটতে শুরু করেছিলাম।আসলে কি বলো তো মিছরি!!প্রানের
ভয় এমনই একটা জিনিস,যার কারণে,যে মানুষ সাঁতার জানে না,সেও জলে পড়লে হাত-পা ছুঁড়ে একবার অন্তত বাঁচার চেষ্টা করবেই।আর আমি তো তীরের বেগে বেরিয়ে এসেছিলাম জল কেটে।শুধু ওই ধাক্কাটার প্রয়োজন ছিলো।যেটা সেদিন স্যার আমায় দিয়েছিলেন।নাও,চলো....হাতের মুভমেন্ট গুলো আগে দেখে নাও...
সৌরর সঙ্গে জলের উপরিভাগে ভাসতে লাগলো তিলোত্তমা....এবার অপেক্ষা শুধু অতল গভীরে ডুবে যাওয়ার...
-গুড মর্নিং ম্যাম!!
-মর্নিং সমুদ্র।একি?আজ খালি হাতে?
-সরি ম্যাম!!আজ ফুলের দোকানটা বন্ধ ছিলো।
মিষ্টি একটা হাসি খেলে গেলো রানী ম্যামের মুখে....
-আচ্ছা!!ওসব বাদ দাও!তুমি বলো,পরীক্ষা তো প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে।প্রিপারেশন কেমন?
-চলছে ম্যাম!
-প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?
-চেষ্টা তো করছি ম্যাম!
-হুম!গুড!কিছু ডাউট থাকলে,এক্সট্রা ক্লাসে ক্লিয়ার করে নিতে পারো!
-ওকে ম্যাম!শিওর...
সমুদ্রর সামনে দিয়ে চলে গেলেন রানী ম্যাম....মনটাই ভালো হয়ে গেলো ওর।কাল থেকে কেউ ওকে সেভাবে ফোন করেনি।না সৌর,না ঋষি,না রূপ!একদিনেই সব ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।ও ফোন করলেও কেউ ফোন ধরছে না।এবার তো মনে হচ্ছে,এদের মাঝে ওকেই সেতু হয়ে দাঁড়াতে হবে....
ব্যাগটা নিয়ে ক্লাসে ঢুকলো সমুদ্র।ওরা দুজন এক জায়গায়,সৌর ক্লাসের আর এক কোণে একা বসে আছে।রূপের হাতের কনুইতে ক্রেপ-ব্যান্ডেজ বাঁধা,আর ঋষির নাকের ওপর ব্যান্ড-এইড!নাকটা এখনও একটু ফুলে আছে বোধহয়...সব দেখেশুনে ওদের দুজনের শরীরের খবর নিয়ে,দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমুদ্র এগিয়ে গেলো সৌরর দিকেই....
-কিরে?
-বল!
-এদিকে বসলি কেন?চল,ওদিকে বসি!
-তুই এখানে এলি কেন?ওখানেই তো বসে পড়তে পারতিস!
-সৌর!!কি ভাই?এত ম্যাচুওর তুই!এইরকম করবি?!
-কি বললি তুই!!আমাকে বলছিস?গায়ে হাত কে তুলেছিলো?
-ওর তখন মাথার ঠিক ছিলো না।
-এখন আমার নেই!হিসাব বরাবর!!
-উফফ!!ভাই,মেয়েদের মতো করবি?!
-মেয়েদের মতো?মানে?
-আমার একটা খুড়তুতো দিদি আছে।একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম ফুচকা খেতে।
-তো?
-তো আরও একজন মেয়ে এসে দাঁড়ালো ওখানে....তাকে দেখেই দিদি আমার হাত থেকে পাতাটা নিয়ে রেখে দিলো।বললো,খেতে হবে না ভাই!চল...আমি তো অবাক!এইভাবে মুখের সামনে থেকে খাবার কে সরিয়ে নেয়?!ফুচকাওলার ছাতার তলা থেকে,আমার হাত ধরে টানতে-টানতে,দিদি আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো।আমি বললাম,ব্যাপারটা কি?!কি বললো জানিস?
-কি?
-কোন ক্লাস দিদির মনেও নেই।ও বলতেই পারলো না।কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে,তখন বুঝিবা দু-একটা ডায়নোসর পৃথিবীর বুকে বেঁচে ছিলো,সেই সময় ওর ওই বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিলো।কি নিয়ে ঝগড়া মনে নেই,কবে ঝগড়া মনে নেই,শুধু ঝগড়া হয়েছিলো,এটুকু মনে আছে...সেটা মনে রেখে আজও দুজন-দুজনকে দেখলেই উল্টোদিকে দৌড় মারে....
সাংঘাতিক হাসি পেয়ে গেলো সৌরর...নিজের হাসিটা চাপতে,মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিলো ও....
-তা তুইও কি ওইরকম করবি?
-জানিনা!!
-উফফ!!এত মহা ঝামেলা....
ক্লাসে স্যার ঢুকে যাওয়ায় আলোচনা তখনকার মতো ওখানেই স্থগিত রইলো...
-একা-একা খাবি?ঋষি কাকিমার হাতের এই তরকারিটা খেতে খুব ভালোবাসে কিন্তু।ওকে না দিয়েই তুই খেয়ে নিবি?
সৌর টিফিনবক্স খোলা মাত্রই,এক নজর ওদিকে চেয়ে বলে উঠলো সমুদ্র...
-এই তুই কার বন্ধু রে সমুদ্র?!আমার বলে তো মনে হয় না।তোর মন এত প্যাঁচালো,আমিই তোকে মাঝে-মধ্যে বুঝে উঠতে পারি না।
চেঁচিয়ে উঠলো সৌর...
-হয়-হয়।ওইরকম হয়।শিল্পী মানুষদের একটু গভীরভাবে বুঝতে গেলে,নিজেকেই ওইরকম ঘেঁটে যেতে হয়।দেখবি,একদিন তোকে সময় নিয়ে গায়ক সমুদ্র বসুর বাড়িতে দেখা করতে আসতে হবে।
-এ ভাই!বাস্তবে ফের ভাই!আগে কাকু-কাকিমাকে বল তুই কি চাস,ওরা মেনে নিক।তারপর অলীক স্বপ্ন দেখবি!!
একদম চুপ করে গেলো সমুদ্র।বেশ কল্পনায় ভাসছিলো ও,নিজের অপূরণীয় স্বপ্নের জগতে বিচরণ করছিলো।কিন্তু সৌর ওকে একটানে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসলো...একেবারে মুষড়ে পড়লো ও...সৌর বুঝতে পেরে গেলো,ও সমুদ্রকে আঘাত করে ফেলেছে।তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,
-দিনরাত ওদের হয়ে বলতে গেলে,কাল থেকে ওদের পাশে গিয়ে বসবি।আমার ধারেপারে দেখলে,ধাক্কা মেরে উঠিয়ে দেবো বলে দিলাম...আমি জানি,তোর মনে ওরাই আছে...আমি নয়...
-সৌর,তুই জানিস না,আমি কি!আমি হলাম সমুদ্র!!সমুদ্রের মতোই গভীর আমার মন।অনেক-অনেক জায়গা আছে।চিন্তা করছিস কেন?ওদের সঙ্গে-সঙ্গে তোকেও একটু এডজাস্ট করে নেবোখন!!তুই তো আমার ভাই...
খেপে উঠে চিৎকার করে,হলুদের হাতটা সমুদ্রর জামায় মুছে দিলো সৌর...কিন্তু খাবারটা আর খেলো না ও।মুখেই দিতে পারলো না ও।টিফিনবক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে গেলো...
-যা!সবে-সবে সকাল হয়েছে,জমি তৈরি করে দিয়েছি,নরম আছে।লাঙল চালিয়ে দে...কাজ হয়ে যাবে।এরপর বেলা বাড়লে,রোদ পড়ে মাটি শক্ত হয়ে শুকিয়ে গেলে,আর কিন্তু পারবি না...
ঋষির সামনে গিয়ে বললো সমুদ্র।মাথা নীচু করে ঋষি বসে আছে বেঞ্চের এককোণে....
-কোন মুখ নিয়ে ওর সামনে যাবো?
-যে মুখ দিয়ে কাল ওকে খিস্তি দিয়েছিলি,সেই মুখ নিয়েই যাবি....
-যা বলছি,নইলে এবার আমিই কিন্তু তোর নাকটা ফাটিয়ে দেবো...কাল থেকে এক কথা বলেই যাচ্ছি।শুনছেই না।যা...
চেঁচিয়ে উঠলো রূপও।ধাক্কা মেরে ঋষিকে বের করলো সমুদ্র আর রূপায়ণ....
-সৌর?
দূরে সমুদ্র আর রূপ দাঁড়িয়ে রয়েছে,আবার দুটোর হাতাহাতি লাগলে,দৌড়ে যেতে হবে।মাঠের কাছে একা বসেছিলো সৌর...ঋষির ডাক ওর কানে পৌঁছলেও ফিরেও তাকালো না ও....সামনের দিকেই চেয়ে রইলো....ঋষি গিয়ে বসলো ওর পাশে....
-ব্রাদার্স ফ্রম ডিফারেন্ট মাদার্স!!ব্রাদার্স ফর লাইফ!!এটাই তো বলেছিলি কাল!!ক্ষমা করবি না ভাই?!ভুল হয়ে গেছে।যাঃ!!না করলে না করবি!আমি কিন্তু তোকে ছাড়বো না।এইভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো....
সৌরকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ঋষি....সৌর মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়েই রইলো....মুখটা কঠিন,কিন্তু চোখের কোণে জল...
-ভাই!ভুল হয়ে গেছে ভাই।বলছি তো...মাথা ঠিক ছিলো না।
কেঁদে ফেললো ঋষি...সৌর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে...দূর থেকে হেসে উঠলো সমুদ্র আর রূপ...ধীরপায়ে এগোতে গেলো ওদের দিকে...
-সূর্পণখার নাকটা দেখি!!
বলেই নাকের ওপর আঙুল রেখে জোরে করে টিপে দিলো সৌর....
-আঃ!এ ভাই ব্যথা আছে রে!পাগলা নাকি তুই?
-ওটাই তো দেখলাম,চিৎকার করে উঠিস কিনা!!
-কি ছোটলোক রে তুই!!
-আরে ব্যথা জায়গায় ব্যথা দিতেই তো বেশি মজা রে!প্রথম দিন ব্যায়াম করবি,গা ব্যথা হবে।দ্বিতীয় দিন ওই ব্যথার ওপরেই আবার ব্যথা দিয়ে দেখবি,কেমন মজা!!
-ও ভাই ট্রেইনার!থাম ভাই...আমি ব্যায়াম করবো না।কিছুতেই করবো না....
-হ্যাঁ,তুই খালি খাবি আর বেলুন হবি!দাঁড়া,পরীক্ষাটা হয়ে যাক।হাতের সামনে পাই!সবকটাকে মাঠে দৌড় করাবো!ঋষি,ঠিক আছিস তো তুই?
সৌরর প্রশ্নে মাথা নাময়ে নিলো ঋষি....কালশিটে নাক নিয়েও বেশ হাসছিলো ও।কিন্তু এটুকু আদরেই আবার চোখে জল এসে গেলো।সৌরকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে বললো,
-ভুল হয়ে গেছে রে ভাই!কাল আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম!ভাবতেই পারিনি রঞ্জা এইরকম একটা মেয়ে।বুঝতেই পারিনি ওকে।ওর জন্য তোর গায়েও হাত তুলেছি।ভুল হয়ে গেছে....
দুহাতে সৌর জড়িয়ে ধরলো ঋষিকে....
-কান্ড দেখো সূর্পণখার।জিজ্ঞেস করলাম,তুই ঠিক আছিস কিনা!হ্যাঁ বা না বলবে তো!রচনা মুখস্ত বলে দিলো!!এ থাম ভাই!
-এই যে!তোমাদের এই পুনর্মিলনে আমাদেরও একটু হাত আছে ভাই!আমরাও একটু গলাগলিতে জায়গা পেতে পারি কি?!
দূর থেকে হেঁটে আসা সমুদ্র বললো....ওর সঙ্গে রয়েছে একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে রূপ....
-দেখ না,কিছুতেই ছাড়ছে না।কিভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে!সবাই দেখলে কি ভাববে বলতো!!এই সূর্পণখা আমার মান-সম্মান আর কিছু রাখলো না....
সৌরর ইশারা বুঝে হো-হো করে হেসে উঠলো সমুদ্র আর রূপ...
-ফালতু কথা বলবি না সৌর!!আমি একদম ঠিকঠাক আছি!সিধে আছি!!
-ভাই,একটু আগে যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলি,আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম।শালা চুমু খেতে বাকি রেখেছিলিস শুধু...আমি তো ভাবলাম,এই না ঠোঁটে-ঠোঁট ঠেকিয়ে দেয়...
সৌরর কথা শুনে ওকে মারতে-মারতে মাঠে শুইয়ে দিলো ঋষি...
-আমাকে মারলে তোর ফেবারিট টিফিন পাবি না কিন্তু।আমি দেবোই না।
-দিবি না মানে?দেখ,তোর আগে গিয়ে,তোর ব্যাগ থেকে বের করে খেয়ে নেবো...
সৌরকে ছেড়ে উঠেই দৌড় দেয় ঋষি...
-আরে আমরা বাদ যাবো নাকি?দাঁড়া....
-সমু,তোর দিদিকে বলে দিস,আমরা মেয়ে নই।যে মুহূর্তে মারপিট করবো,পরের মুহুর্তেই আবার বুকে জড়িয়ে ধরবো।কিন্তু চুমু খাবো না!নো চুমু....
ছুটতে-ছুটতেই চেঁচালো সৌর...
-কে দিদি!কার দিদি?আমার কোনো দিদি নেই।
হেসে উঠলো সমুদ্র...
-শালা ছোটলোক!তোকে একবার ধরতে পারি দাঁড়া...
-আমাকে পরে ধরবি,আগে টিফিনবক্স বাঁচা ভাই...নইলে পেটে দড়ি দিয়ে থাকতে হবে....
চারবন্ধু একসঙ্গে লাফাতে-লাফাতে ছুটে গেলো সৌরর মায়ের হাতে তৈরি,অসমাপ্ত টিফিনটুকু শেষ করার জন্য....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন