অসমাপ্ত
প্রথম পর্ব
সাথী দাস
-আরে বল না!!বুক ঠুকে সোজা গিয়ে বলে দে!
ধাক্কা মেরে ঋষিকে রঞ্জার দিকে ঠেলে দিলো রূপ....
বুকে অনেকখানি সাহস বাগিয়ে নিয়ে,দু-পা গিয়েই ঋষি আবার উল্টোপায়ে দৌড় মেরে ফেরত চলে এলো।
-এ ভাই!যদি না বলে দেয়!!প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ভাই!!
ভয়ার্ত গলায় ঋষি বলে উঠলো।
-এই কেউ এটাকে ধরে,রাস্তায় ফেলে ক্যালা তো!!
পাশ থেকে হেসে উঠলো সৌরদীপ ও সমুদ্র।আবার চেপে ধরে ঋষিকে ফেরানোর চেষ্টা শুরু হলো।রূপ বলেই চললো,
-শালা দু-বছর ধরে শুধু দেখেই যাচ্ছে।ওরে তুই প্রপোজ করতে-করতে তো,তোর রঞ্জার বিয়ে হয়ে দুটো বাচ্চাও হয়ে যাবে।তখন তুই বরং অন্নপ্রাশনে বাচ্চাকে ফিডিং বোতল গিফ্ট করতে যাস।ছোটলোক কোথাকার!!
-এ ভাই,আমি পারবো তো?
-আহা!ছেলের অবস্থা দেখো!যেন জীবনের প্রথম রাত!পারফর্ম করতে যাচ্ছে!!পারবো তো!!ন্যাকা!!আরে আগে বল তো!!তুই তো বলতেই পারছিস না!এবার না বলে ফিরে এলে কিন্তু,জুতো খুলে মারবো বলে দিলাম!!শালা একটা এক নম্বরের....
-যাচ্ছি তো!!মুখ খারাপ করছিস কেন?
-যা!!এবার যদি তুই না বলিস,আমি কিন্তু গিয়ে বলে দেবো!আর বাই এনি চান্স আমাকে যদি হ্যাঁ বলে দেয়,তখন তুই কিন্তু আজীবন রঞ্জাকে বৌদি বলে ডাকবি!
তেড়ে রূপের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়লো ঋষি।দুটো সাইকেল উল্টে পড়লো রাস্তায়....বেধে গেলো দুই বন্ধুর তুমুল মারপিট!ততক্ষণে টিউশন থেকে বেরিয়ে রঞ্জাবতী সমর্পণের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে।অদূরে পাঁচিলের ওপারে এদের মারপিট লেগে গেছে....সৌরদীপ আর সমুদ্র টেনে ছাড়াতে পারে না ওদের....চ্যাংদোলা করে পা ধরে আবার ওরা ঋষিকে তুলে দাঁড় করাতে যায়....আজ ওকে বলতেই হবে....
ঋষভ গুহঠাকুরতা এবং রূপায়ন অধিকারী,ডাকনাম ঋষি ও রূপ।সেই প্রথম শ্রেণী থেকেই তাদের গভীর বন্ধুত্ব।সারাদিন স্কুলে-টিউশনে তো বটেই,এমনকি স্কুল-টিউশন ছাড়াও,দিনরাত ওরা একে-অপরের বাড়িতেই পড়ে থাকে।ওদের বাবা-মায়ের একটা করে পুত্রসন্তান হলেও,ওনারাও এখন জেনে গেছেন,ওনাদের বর্তমানে দুটি ছেলে।ঋষভ ও রূপায়ণ।দুই মানিকজোড় একে-অপরকে ছাড়া একেবারে অন্ধ!!ঋষি মেয়েদের সঙ্গে ঠিক মন খুলে কথা বলতে পারে না।এমনকি মাথা তুলে চাইতে পর্যন্ত পারে না।একটু মুখচোরা স্বভাবের।সেদিক থেকে রূপের মুখে আবার খই ফোটে।কিছুদিন পর দুজনেই উচ্চ-মাধ্যমিক দেবে।স্কুল-জীবন প্রায় অন্তিম পর্যায়ে।প্রাণোচ্ছল রূপ এর মধ্যেই বার দুয়েক নিজের পছন্দের মানুষের কাছে,প্রেম প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো,এবং প্রতিবারই তাকে সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।একজনের কাছেই বার দুয়েক ফিরে এসে এখন রূপের প্রবল উৎসাহে,একটু হলেও ভাঁটা পড়েছে।কিন্তু বন্ধুর জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছে ও....

Buy now at Amazon
অপরদিকে,
সৌরদীপ সাহা ও সমুদ্র বসু,মাধ্যমিকের পর একাদশ শ্রেণীতে স্কুলে এলেও হরিহর আত্মা হয়ে গেছে ওরাও।দিনের বেশিরভাগ সময়ই এদের চারমূর্তিকে একসঙ্গে পাওয়া যায়।তাই এদের প্রত্যেকের বাবা-মা জানে,একজনকে পাওয়া গেলেই,বাকি তিনটের হদিশও পাওয়া যাবে।তাই একপ্রকার নিশ্চিন্তই থাকে।
ঋষভ গুহঠাকুরতা,অর্থাৎ ঋষির বাবার বদলির চাকরি।তাই বছরের বেশিরভাগ সময়টাই ওনার বাইরে-বাইরেই কাটে।এখানে ঋষির মা একাকী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন।স্মৃতিপট ঘেঁটে আবছা মনে পড়ে ঋষির,বার দুয়েক ওরা বাইরে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলো।কিন্তু তারপর স্কুল শুরু হয়ে যাওয়াতে,আর বাবার সঙ্গে-সঙ্গে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানো হয়নি।থিতু হয়ে বসতে হয়েছে নিজস্ব দোতলা বাড়িতে।একতলায় একটা দিকে একটা ছোট পরিবার ভাড়া থাকে।অপর দিকে ঋষির মায়ের ঘর।ঋষি দোতলায় থাকে।পড়াশোনায় একেবারে প্রথম সারির না হলেও,মোটামুটি ভালোই।উচ্চতা চোখে পড়ার মতো কিছু নয়,তবে চলনসই।গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।চুল ডানদিক দিয়ে সিঁথি করা।মুখে সবসময় একটা আলগা হাসি লেগেই রয়েছে।গালের হালকা দাড়ি জানান দিচ্ছে,যুবক সে....পছন্দের পোশাক ফুলহাতা শার্ট,হাতা গুটিয়ে জিন্সের সঙ্গে পরতেই অভ্যস্ত....চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু না থাকলেও,এমন একটা চটকদার আবেদন আছে সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত ঋষির মধ্যে,যে একবার ভালোভাবে ওকে দেখলে,ওর দৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো যায় না বড় বিশেষ।মৃদু হাসির সময় নিজের অজান্তেই ঠোঁটের বাঁ দিকটা একটু বেশিই খেলে যায়।এইরকম একটা ছেলে রীতিমতো ঘোল খেয়ে যাচ্ছে রঞ্জাবতীর মতো ডাকসাইটে সুন্দরীর কাছে।সেই মাধ্যমিকের পর থেকেই রঞ্জাকে দেখে পাগল হয়ে রয়েছে ও।কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি আজও পর্যন্ত....বাবা বাইরে থাকে।আজকাল বাবা ফোন করলে মা বড় দুশ্চিন্তা করে।বাবার শরীরটাও মাঝে-মাঝে একটু খারাপ হয়।বাবার বয়সটাও বাড়ছে,সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঋষির চিন্তাও.....
রূপায়ণ অধিকারী,অর্থাৎ রূপের বাবার আছে ছোটখাটো ব্যবসা,বাজারে একটা নিজস্ব পাইকারি মুদিখানা দোকান আছে।মোটামুটি সচ্ছল অবস্থা।রূপের পরে ওর একটা ছোট বোন আছে,দাদার ভীষণই আদরের।বাবার অনেক আশা-ভরসা রূপ।তাই জীবনে কিছু তো ওকে করতেই হবে।বাবা-মায়ের দায়িত্ব,বোনের দায়িত্ব,সবটাই ওর মাথার ওপর ভবিষ্যতে আসতে চলেছে।অদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই মাঝে-মাঝে,অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে রূপ।লড়াই করার মতো মনের জোরটুকুও হারিয়ে ফেলে।এই বাজারে সামান্য গ্রাজুয়েট একটা ছেলের জন্য কি চাকরী প্রস্তুত থাকে?!জানা নেই রূপের!!বোধহয় না।খুব বেশি পড়ার আশা করেও না ও।বাবা হিসেবে সন্তানকে প্রয়োজনের অতিরিক্তই দেওয়ার চেষ্টা করে ওই 'বাবা' নামক মানুষটা।তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু মুখ ফুটে চাইতে,বরাবরই লজ্জা করে রূপের।সুখী সন্তান ও।শুধু নিশান্তিকা,অর্থাৎ নিশার কাছ থেকে,বরাবরই একটু উষ্ণতা আশা করে রূপ।একাধিকবার ওর কাছে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে,রূপ শুন্যহাতে ফিরেছে।কারোর সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই,সেটাও জানে রূপ।ওর সঙ্গেও তো ভালোভাবেই কথা বলে।তাও কেন বারংবার ওকে প্রত্যাখ্যান করে?কি জানি!!হয়তো মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়।তবে সাহস করে ঠিক ভালোবাসা যায় না বোধহয়....
সৌরদীপ সাহা,অর্থাৎ সৌরর বাবা একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার,ভালোই পসার আছে।সন্ধ্যের পর রুগী সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।এখানে বাসযোগ্য নিজের সুদৃশ্য তিনতলা বাড়ি আছে।এছাড়াও দেশে কিছু জমিজমাও আছে।চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সৌরই পড়াশোনায় তুখোড়,সাঁতারেও জেলা-বিজয়ী,দুর্ধর্ষ রূপ,আর সেই সঙ্গে চোখে পড়ার মতোই উচ্চতা।যেহেতু পড়াশোনায় বরাবরই উজ্জ্বল,তাই পরীক্ষার সময় তিনজনকে পাশ করানোর পুরো চাপটা সৌরর ওপরেই এসে পড়ে।পড়াশোনা-সাঁতার নিয়ে ব্যস্ত থাকা সৌরদীপের মনের দরজায়,এখনও পর্যন্ত বসন্ত কড়া নাড়েনি।রূপের ব্যাকুল হৃদয় দেখে,ওর করুণ অবস্থা দেখে,আর ঋষির ছটফটানি দেখে,চিরকালীন অভ্যাসবশত নিজের তর্জনী দিয়ে টিকালো নাক ঘষে নিয়ে,সৌর সদাসর্বদা একটাই কথা বলে,"আগে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করা উচিত,যাতে কোনো মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে,সে তোকে কোনোরকম অজুহাতেই ফেরাতে না পারে!কোনো খুঁত যেন না পায়!আরে সে তো ছাড়,তার বাবা-মা পর্যন্ত ভাববে,আরে!!এমন ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার!!আপত্তির কোনো জায়গাই খুঁজে পাবে না।তাই বইতে মুখ ডুবিয়ে আগে পড়,নিজেকে একটা রত্ন তৈরী কর।ভাই পকেটের জোর না থাকলে,কোমরের জোর না থাকলে,ভালোবাসা তোকে ছেড়ে দিয়ে,জানলা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালাবে...কারণ,বেশিরভাগ মেয়েরাই জীবনসঙ্গী হিসেবে সফল পুরুষ চায়,ভরসা চায়,নিরাপত্তা চায়।মেয়ের বাড়ির লোকও তাই।তাই যে সময়ে যেটা করার,সেটা আগে কর ভাই।পড়াশোনাটা ঠিকঠাক ভাবে কর!!এসবের জন্য তো সারাটা জীবনই পড়ে আছে!"
চার বন্ধুর মধ্যে অত্যন্ত বাস্তববাদী একমাত্র সৌরদীপ,হয়তো কিছুটা অহংকারীও।কারণ,পড়াশোনা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একমাত্র সৌরই বাকি তিনজনকে টেক্কা দিতে পারে।সেই সঙ্গে পাগলপারা রূপ,আর সর্বোপরি এর মধ্যেই একটা স্থানীয় সুইমিং পুলে সাঁতারুদের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ায়,তিনজনের থেকে সম্মানেও সৌরদীপ অনেকটা ঊর্ধ্বস্থানে রয়েছে।ওর আরও একটা সাংঘাতিক অহংকার,ভাবাবেগের কোনো জায়গা ওর মনে,এখনও পর্যন্ত নেই.....মনের কোনোরকম দুর্বলতাকে ও প্রশ্রয় দেয়না।নিজের পড়াশোনা-ফুটবল-সাঁতার-শরীরচর্চা-কম্পিউটার নিয়েই ব্যস্ত থাকে প্রতিনিয়ত....
গতকাল রাতে ওরা চারজন ঋষির বাড়িতেই ছিলো।ওদের সারারাত জেগে পড়াশোনা করার কথা।কিন্তু কত যে পড়ে উল্টে দিচ্ছে,সে তো স্বয়ং দেবী সরস্বতী আর ওরাই জানে।রূপ বারংবার করে ঋষিকে বুঝিয়েছে,যার কথা তাকেই বলতে হয়।এখনও যদি ঋষি বলতে না পারে,তাহলে কলেজে গেলে আর রঞ্জাকে ছুঁতেও পারা যাবে না।কারণ,এমনিতেই আজকালকার দিনে সুন্দরী মেয়েরা বেশিদিন ফাঁকা থাকে না।কপালজোরে রঞ্জা এখনও আছে।তাই এখনই বুকিং করে না রাখলে,পরে ঋষির কপালে অশেষ দুঃখ নাচছে।এরপর কলেজে গেলে,ওর চোখের সামনেই অন্য কোনো ছেলের হাত ধরে রঞ্জা ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে,তখন ওকে হাঁ করে দেখতে হবে।তাই যেভাবেই হোক,মুখে না বলতে পারলে,প্রয়োজনে হাত-পা নেড়ে,অন্তত অঙ্গভঙ্গী করে হলেও রঞ্জাকে বোঝাতেই হবে।
-দেখ ঋষি!একটা কথা খুব ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে ভাই।এই যে আমরা এখন বাজপড়া শকুনটার মতো দেখতে আছি,গালে দাড়ি উঠবো কি উঠবো না সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না,এইরকম কিন্তু আরও বেশ কয়েক বছর থাকবো।আমাদের এই সময়টা কিন্তু এইরকমই....
সমুদ্র মন দিয়ে বোঝাতে যায় ঋষিকে....
সমুদ্র বসু,অর্থাৎ সমুদ্রর মাথায় একরাশ কাকের বাসার মতো অবিন্যস্ত কোঁকড়ানো চুল।গালে দাড়ি উঠবে নাকি উঠবে না,প্রকৃতির সেই সিদ্ধান্ত এখনও সম্পূর্ণরূপে নেওয়া হয়নি।যত্রতত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যৌবনের স্পর্শ।তবে সমুদ্রর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো,দুটি চোখ।গভীর দুটি চোখ ঢাকা থাকে দীর্ঘ অক্ষিপল্লবে।অত্যন্ত ধীর-স্থির-শান্ত ও প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন।সমুদ্রর বাবা সরকারি চাকুরে,এবং মা গৃহবধূ।স্বভাবতই বাবা-মা চায় ছেলে অনেক পড়াশোনা করুক,চাকরি করুক,তারপর নিয়মমাফিক সংসারী হোক।গতানুগতিকতার মোড়কে বাঁধা হোক সমুদ্র বসুর জীবন।দিনান্তে ওনাদের ছেলে একজন সফল পুরুষ হোক।কিন্তু সমুদ্র মনেপ্রাণে গায়ক হতে চায়।পড়াশোনা ওর মাথায় বিশেষ ঢোকে না।সারাদিন গিটার হাতে নিয়ে টুং-টুং করেই ওর যত আত্মতৃপ্তি,নিজের যত খুশি,যত আনন্দ,ও একমাত্র সুরের মূর্ছনায় খুঁজে পায়।গিটার....এত বছরের জন্মদিনে ওই একটা বস্তুই ও উপহারস্বরূপ নিজের মুখে বাবা-মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।যৌবনের নিয়মানুসারে,সমুদ্রর জীবনে সেইভাবে হয়তো এখনও কোনো নারী বসন্ত নিয়ে পদার্পণ করেনি....বা হয়তো করছে,ধীরে-ধীরে....অত্যন্ত মন্থর গতিতে.....অপরিপক্ক-অনভিজ্ঞ সমুদ্র ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না....
ঋষির বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চোখ বন্ধ করে,খাটে চাপড় মেরে তাল দিচ্ছিলো সমুদ্র।হয়তো মাথায় চলছিলো নতুন কোনো গানের অন্তরা বা মুখরা।গুনগুনানি থামিয়ে,ঝাঁকড়া একরাশ চুল হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে,চোখের চশমাটা নামিয়ে,উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সৌরদীপের পশ্চাৎদেশে পদযুগল তুলে সমুদ্র গুছিয়ে কথা শুরু করতে গেলো।কিন্তু তার আগেই সৌর ওকে দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দিলো,
-এ ভাই!তুই থাম ভাই!আমাদের ঋষির অমন কার্তিক ঠাকুরের মতো চেহারাটার অপমান করিস না।বাজপড়া শকুন তুই হবি!দিন-দিন তো গালে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা গজিয়ে উঠছে!এত ব্রণ কেন ভাই?দিনে কবার?
সৌরর পশ্চাৎদেশে পা-টা তুলেই রেখেছিলো সমুদ্র।বেশ সুবিধেই হলো।ওর কথা শেষ হতে না হতেই সমুদ্র কষিয়ে একটা ধাক্কা মারলো ওকে।খাট থেকে হুমড়ি খেয়ে সৌর মেঝেতে গিয়ে পড়লো...
-আহ!বাবাগো!দিলো আমার কোমরটা ভেঙে!এ আমাকে টেনে তোল রে ভাই...আমার হাল খারাপ করে দিয়েছে...
ইচ্ছাকৃতভাবেই আধশোয়া হয়ে মেঝেতে পড়ে রইলো সৌর।গুছিয়ে শুয়ে পড়লো মেঝেতে...
-এই ভাই!তোরা একটু থাম না রে।দেখছিস আমি ঋষির বল বাড়াচ্ছি....
বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো রূপ।
-কি বাড়াচ্ছিস?ও তুই হাজার চেষ্টা করলেও ওটার সংখ্যা বাড়াতে পারবি না!ওটা ভগবানপ্রদত্ত ভাই.....
মেঝেতে শুয়েই হেসে ফেললো সৌর।
-বল!বল!বল বাড়াচ্ছি!!আরে মনোবল রে...উফফ!!কাল ওকে পারতেই হবে।
রূপ ফিরলো ঋষির দিকে।নিশা ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি তো কি হয়েছে?!তবু ও তো বলতে পেরেছে!!কিন্তু ঋষি তো তাও পারছে না।কাল ঋষিকে পারতেই হবে।যেভাবেই হোক।ওকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করতে যায় রূপ....
-শোন ঋষি!
-আরে ও তো শুনেই যাচ্ছে রে।আমরাও শুনেই যাচ্ছি!!আমরা ইলেভেনে এলাম এই স্কুলে,তখন থেকেই শুনছি,ও কিন্তু তোদের বৌদি-ভাই ও কিন্তু তোদের বৌদি!ওর দিকে কিন্তু একদম তাকাবি না!!আরে ভাই পুরো ক্লাসের,এমনকি পুরো স্কুলের বৌদি হয়ে গেলো রে ভাই!শুধু তোর বউ তো হলো নারে....
সমুদ্র হেসে উঠে খাট থেকে নেমে সৌরর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো....ওর হাত ধরে মেঝে থেকে উঠে এলো সৌর....
-দেখ ভাই!দুদিনের বন্ধুরাও কেমন আওয়াজ দিচ্ছে তোকে।এবার কিন্তু তোকে পারতেই হবে।তুই আমাকে ছুঁয়ে প্রমিস কর,কাল তুই ওকে বলবি!আমি ডেকে দেবো রঞ্জাকে।তুই শুধু হরেকৃষ্ণ নাম নিয়ে দুম করে বলে দিবি।আরে ওইটুকু তো তোকে বলতেই হবে....
-তুই থাকবি তো ভাই আমার সঙ্গে?
-আরে চাপ নিস না,ফুলশয্যাতেও থাকবো তোর সঙ্গে!
রূপের কথায়,ঋষি বাদে দুই বন্ধুই সমস্বরে হেসে উঠলো।
-ওই চুপ কর রে।মা নীচে আছে।না রূপ....ওখানে আমার কাউকে দরকার নেই।
-হ্যাঁ ভাই,বুঝতেই পারছি,তুই একাই একশো।একটা মেয়েকে বলতেই দম বেরিয়ে যাচ্ছে।তুই তো আমার বীরপুরুষ ঋষি!এবার বল,বলবি তো কাল?বল ভাই....প্রমিস কর!ঠিক বলবি তো?আগেবারের মতো তুতলে সব ভুলে যাবি না তো!!
ব্যস্ত হয়ে গেলো রূপ।
-কাল আমি পারবোই রূপ।একদম কাল জান লড়িয়ে দেবো ভাই।
-এই তো।ভেরি গুড।এই এনার্জিটাই কাল চাই কিন্তু!চল,প্রিপারেশন কমপ্লিট।এবার পরীক্ষার আগের রাতের মতো একটু রিল্যাক্স করতে হবে।মনটাকে তুলোর মতো হালকা ফুরফুরে করে ফেলতে যবে।তাহলে এখন একটু ক্যারাম খেলি ভাই!!চল,পাউডার আন ঋষি!
মুখের সামনে বইপত্র নামেই খোলা,নামেই পড়াশোনা হচ্ছে।বই বন্ধ করে একটু হেসে ঋষি বললো,
-নাঃ!আজ তো লুডোই খেলবো!
-আরে ভাই,যেটাই খেলবি,চারজনই তো লাগবে।লুডো তুই মনের আনন্দে কালকের পর খেলিস।এখন ক্যারাম খেলি আয়!
-রানী কিন্তু আমার!
হাত দিয়ে একঝাঁক চুল মুখের সামনে থেকে সরিয়ে সমুদ্র বললো।
-রানী ম্যাম তো?
-আবে চুপ!
লাফিয়ে সৌরদীপের মুখ চেপে ধরলো সমুদ্র।
-এই কি ব্যাপার রে?
সৌরদীপের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ঋষি আর রূপ।টেনে ধরতে গেলো সৌরর মুখে চেপে রাখা সমুদ্রর হাত।মুখ বন্ধ অবস্থাতেই যেটুকু বেরোলো ওর মুখ দিয়ে,তা কিছুটা এইরকম....
-ইংলিশ ম্যাম.....রেণুকা বিশ্বাস।রানী ম্যাম!ছেলে আমাদের ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।
-সৌর!!
চিৎকার করে উঠলো সমুদ্র....
-তোকে খুন করে ফেলবো।জীবনেও আর তোকে কিচ্ছু বলবো না দেখ.....
-আচ্ছা....এই জন্য সকাল থেকে ছেলে গাইছে,
"মেরে সাপনো কি রানী...."
-রূপ....
প্রচন্ড রেগে গিয়ে সমুদ্রর বাঁ-দিকের ভ্রূটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওপরে উঠে গেলো...থমকে গেলো রূপ...
-একদম ফালতু কথা বলবি না!ম্যাম উনি!সম্মান করি!হ্যাঁ,আর পাঁচজনের থেকে একটু বেশিই....
সৌরকে ছেড়ে দিয়ে রূপের দিকে ঘুরে আঙুল তুললো সমুদ্র....রেগে রক্তবর্ণ হয়ে গেছে সমুদ্রর ফর্সা গাল....কপালে ভাঁজ....
-ওকে,সরি ভাই!তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?আমি তো একটু মজাই করলাম!
-এইরকম মজা আর একদম না!রানী ম্যামকে জড়িয়ে একটাও নোংরা কথা,তোদের মাথাতেও যেন না আসে....যেদিন আসবে,সেদিন সব বন্ধুত্ব আমি ভুলে যাবো।কে বন্ধু,কে শত্রু,আমি কিন্তু কিচ্ছু মনে রাখবো না....
-আচ্ছা বাবা...সরি!!
তাও ঠান্ডা হয় না সমুদ্র।রাগে জ্বলতে থাকে।
-সমু!সরি বাবা!ভুল বুঝিস না আমায়।আমি তোকে কোনোভাবে হার্ট করতে চাইনি ভাই,একটু মজা করেই....
-হুম!আর নয়....মজাটা যেন মজার জায়গাতেই থাকে।
-আচ্ছা।আর একদম না।ভুল হয়ে গেছে...
কোনোরকমে পরিস্থিতি সামলে নেয় রূপ।সমুদ্র রাগে না খুব একটা,এমনিতে বেশ হাসিখুশি-প্রাণোচ্ছল।কিন্তু ওই একটা নাম,ওই একটা অবয়ব,ওই শাড়ির চিরপরিচিত ভাঁজ,ওই শরীরী-বিভঙ্গ,ওই হাসিমুখ,ওইভাবে হঠাৎ ফিরে তাকানো,গোলাপী ওষ্ঠরঞ্জনীতে ঢাকা ওষ্ঠ আর অধর,নীচু ক্লাসের বাচ্চাদের দেওয়া রকমারি ফুল গুঁজে রাখা ওই লম্বা বেণী,হাসিমুখে প্রতিদিনকার ওইভাবে "গুড মর্নিং ম্যাম" এর প্রত্যুত্তরে "গুড মর্নিং সমুদ্র" বলার ধরণ,প্রতিনিয়ত পাগল করে দিচ্ছে ওকে।দিবারাত্র ওই একজন নারীই ওর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ওর পুরো পৃথিবীটাই যেন রানী ম্যামকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে।আর সহ্য করতে পারেনি সমুদ্র।সেদিন সৌরকে বলে ফেলেছিলো কথায়-কথায়।সেটাই ও আজ সবার সামনে বলে বসলো....রাগে-দুঃখে চোখে জল এসে গেছে সমুদ্রর।ওই নারীর সম্পর্কে কোনোরকম কোনো কটূক্তি সহ্যই করতে পারে না সমুদ্র...রাগটা সামলাতে মাথা নামিয়ে নিলো ও....
-এই সমু,আরে এই সমুদ্র....তুই কি সত্যি-সত্যি ক্ষেপে গেলি নাকি?!আরে বন্ধু তো রে ভাই।মজা করে না হয় বলেই ফেলেছে,ওসব ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে।চল,আয় ভাই,ক্যারাম খেলি!!
টেনে-জড়িয়ে ধরে সমুদ্রকে মেঝেতে নামালো বাকি তিনজন....বন্ধ দরজার ওপারে চারজন মেতে উঠলো খেলায়....বইপত্র সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রইলো বিছানার ওপর....শেষ রাত্রে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এ-ওর গায়ের ওপর নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে পড়লো....
প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুকে গতকালই কথা দিয়েছে ঋষি,আজ তো ও রঞ্জাকে প্রপোজ করবেই।মরে গেলেও প্রেম নিবেদন করেই মরবে।টিউশন থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে,ওরা অপেক্ষা করছিলো রঞ্জার জন্যই।যাও বা মনের জোরে দু-পা এগোয় ঋষি,আবার ভয়ের চোটে চার-পা পিছিয়ে আসে।
-এই রূপ!ভাই না বলে দেবে না তো রে?
-আরে নারে,না বলবে না!!দেখিস না,তোর দিকে কেমন মিষ্টি করে তাকায়!!সুন্দর করে হাসে....যা না শালা!আমরা তো তোর পিছনেই আছি।তুই যা....
তাও এগোতে পারে না ঋষি।ভয়ে-উত্তেজনায় ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে....
-কিরে?তোরা চার মাথা একজায়গায় হয়ে এখানে কি করছিস?কিসের এত প্ল্যান করছিস বলতো লুকিয়ে-লুকিয়ে?
ওদের হুড়োহুড়ির মধ্যে কখন যে রঞ্জা শ্যাওলা ধরা উঁচু পাঁচিলের আড়াল থেকে গলির মধ্যে চলে এসেছে,ওরা খেয়ালই করেনি।সৌর আর সমুদ্র দুটো সাইকেল তুলে,মুখ একেবারে বন্ধ করে,চুপটি করে অপেক্ষা করতে লাগলো।ঋষি ভয়ে মাথা নামিয়ে নিয়েছে।মেয়েটার দিকে চাইতেই পারে না ও.....
আজ একটা বাসন্তী রঙয়ের চুড়িদার পরে এসেছে রঞ্জাবতী।বুকের ওপর একটা সবুজ ওড়না ঢাকা দেওয়া।মাথার কাঁধ পর্যন্ত ঘন চুলগুলো একটা ছোট্ট ক্লিপ দিয়ে আটকানো।তারা ঘাড় আর পিঠের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।ওই একটা ছোট্ট ক্লিপে সামনের কাটা চুলগুলো আটকায়নি।তারা মৃদু হাওয়ায় রঞ্জার মুখের ওপরে বারংবার আছড়ে পড়ছে।সবার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে বারংবার চোখদুটো বন্ধ করে নিচ্ছে রঞ্জা।হাত দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে চুলগুলো।এর মধ্যেই বারকয়েক দুচোখ ভরে রঞ্জাকে দেখে নিয়েছে ঋষি।ওর মাথাতেই ঢোকে না,এতই যখন বিরক্ত করে ওই ছোটো-ছোটো চুলগুলো,তবে ওগুলোকে ওইভাবে কেটে ছোট করে মুখের সামনে রাখাই বা কেন?ইচ্ছাকৃত কি?ঋষিকে আরও শেষ করার জন্য?!আরও একটু পাগল করে দেওয়ার জন্য?উফফ!!বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না ওর দিকে!অবাধ্য চুলগুলো রঞ্জা যখন হাত দিয়ে নিজের মুখের ওপর থেকে সরালো,ওর মুখের ওপর থেকে চোরাদৃষ্টি সরিয়ে নিলো ঋষি।ওর পিঠে একটা ব্যাগ রয়েছে।বাঁ-হাতে একটা খয়েরি ব্যান্ডের ঘড়ি।হাতে ফোন আর একটা ছোট ব্যাগ রয়েছে,অটোতে উঠবে,সেই জন্য....
-ওকে চল!এলাম আমি!বাড়িতে আজ মামাতো দাদা-বৌদি আসার কথা আছে।
-রঞ্জা শোন,নিশা আমার কথা আর কিছু বলেছে রে?
-নারে রূপ।আসলে ব্যাপারটা কি বল তো?ওর মাথার ওপর বাবা নেই তো।দুই বোন ওরা।একটা বোনকে মামাবাড়িতে রেখে ওর মা মানুষ করছে।এখানে ও ছাড়া ওর মায়ের আর কেউ নেই।তাই ও বলে,এসব প্রেমঘটিত ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই ওর নেই।নিজেকে আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।ওর পড়াশোনার সময় থেকে একটুখানি সময়ও ও অন্য কাউকে দিতে পারবে না।সরি রে,অনেক বলেছি,অনেক বুঝিয়েছি!কিন্তু.....
-বুঝতে পারছি!ঠিক আছে।
মুষড়ে পড়ে রূপায়ন।
-এই এলাম রে।চল,পরশু আবার দেখা হচ্ছে।বাই ঋষি!!
-এই এলাম কি রে?রঞ্জা দাঁড়া....
ব্যস্ত হয়ে ওঠে রূপ।
-কেন রে?কিছু বলবি?
সৌর আর সমুদ্র দেখলো,ঋষির মুখটা ধীরে-ধীরে রক্তশূন্য পাংশুটে হয়ে যাচ্ছে।ভয়ে দিশেহারা হয়ে ছটপট করছে ও....ভাবটা এমন,যেন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে....
-হ্যাঁ,ইয়ে মানে শোন,আমি না।ঋষি তোকে কিছু বলতে চায়!!ও বলবে।
একেবারে চুপ করে গেলো রঞ্জা।তারপর ধীরে-ধীরে ঋষির চোখের দিকে চেয়ে বললো,
-বল ঋষি,কিছু বলবি?
-ভাই তোরা কথা বল।আমি কয়েকটা জিনিস একটু জেরক্স করবো।আমরা পিন্টুদার দোকানে আছি....
আর মাথা তুলতে পারলো না ঋষি।সৌর,সমুদ্র আর রূপ সরে গিয়ে পাঁচিলের অপর প্রান্তে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো....
-বল!ঋষি....
-কি?
-মাথা তোল!!কিরে?বল কি বলবি?
-না মানে স্কুল শেষ হয়ে যাচ্ছে তো,তাই কেমন একটা লাগছে।সব চেনা বন্ধুবান্ধবরা দলছুট হয়ে যাবো,আর প্রতিদিন দেখা হবে না।এটা ভাবলেই বড্ড ভয় লাগছে....
পাঁচিলের অপর প্রান্ত থেকে দাপাতে শুরু করেছে রূপ।
-ওরে লাইনে আয় ভাই!কাজের কথা বল।এত ভূমিকার কি আছে?!
-দাঁড়া না বলবে!!ওইরকম দুম করে বলা যায় নাকি!আগে একটু সইয়ে নিক....
-মনে?!ওর গায়ে গরম জল ঢালবে নাকি,যে সইয়ে নিতে হবে!!
-চুপ!শোন....ঋষি কিছু বলছে....
সমুদ্র দাবিড়ানি দিয়ে থামায় ওকে...পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আবার কান সজাগ করে ওরা তিনজন....
-পার্ট অফ আওয়ার লাইফ ঋষি...জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হবে,আর একটা শুরু...
-হুম!প্রিপারেশন কেমন রঞ্জা?
-চলছে।ইংলিশ টিউশন ইম্পরট্যান্ট!
কেঁপে উঠলো ঋষি...কোনোরকমে বললো,
-কেন?
-ইংলিশেই অনার্স নেওয়ার ইচ্ছে আছে।
-ওহ!!
-এই ভাই!তুই ওর টিচার না রে ভাই!এত পড়াশোনার খবরে তোর কি দরকার!!সোজা কাজের কথাটা আগে বল না...
অধৈর্য্য হয়ে গেলো রূপ।
-আসছি রে....মা ফোন করে বললো,মিষ্টি-সিঙ্গারা সব নিয়ে যেতে হবে।বাড়িতে লোকজন আসবে।আর দেরি করলে হবে না।সন্ধ্যে হয়ে আসছে।বাই ঋষি...
রূপ ঠাসঠাস করে নিজের কপাল চাপড়াতে শুরু করে দিলো।দৌড়ে বেরিয়ে আসছিলো আড়াল থেকে।কিন্তু ওকে টেনে ধরলো সমুদ্র আর সৌর।
-হুম!বাই!রঞ্জা শোন?
-হ্যাঁ বল!
-তোকে এই হলুদ-সবুজ কম্বিনেশনে খুব ভালো লাগে রে।
থমকে গিয়ে একটু চুপ করে রইলো রঞ্জা।তারপর একটু হেসে বললো,
-চার বছরের পুরনো চুড়িদার।অন্তত চারশো বার পরেছি।এমন কমপ্লিমেন্ট তো এতদিন কেউ দেয়নি....
-সেভাবে হয়তো কেউ তোকে দেখেইনি।তাই চোখে পড়েনি।
-কি জানি!হবে হয়তো!ওকে...তুই দেখলি!কমপ্লিমেন্ট দিলি,থ্যাঙ্কু সো মাচ....টাটা....
-টাটা...
রঞ্জা হাঁটতে-হাঁটতে মিলিয়ে গেলো পাঁচিলের আড়ালে,বড় রাস্তার দিকে।একভাবে ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলো ঋষি...সেই মুহূর্তেই সপাটে পিছন থেকে একটা চাঁটি এসে পড়লো ঋষির মাথায়....মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো....
-আঃ!!রূপ!
-প্রেম করবে!!এই সাহস নিয়ে তুমি প্রেম করবে?মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেই ভয়ের চোটে খুলে পড়ে যায়,তুমি এই সাহস নিয়ে প্রেম করবে!!বললি না কেন?বল বললি না কেন?হলুদ-সবুজ কম্বিনেশনে ভালো লাগে!!রঞ্জার ওই সবুজ ওড়না,তোর গলায় পেঁচিয়েই তোকে খুন করে ফেলবো আজ...বল...বললি না কেন?এটাও কি তোর হয়ে বন্ধুরা করে দেবে?!এই ক্যালা তো এটাকে....রাস্তায় ফেলে ক্যালা...
পাঁচিলের সঙ্গে ঋষিকে ঠেসে ধরে দুমদুম করে ঘুষি মারতে লাগলো রূপ আর সমুদ্র।বন্ধুদের চাপাচাপিতে,সুড়সুড়ির চোটে হাসতে-হাসতে প্রায় মাটিতে বসে পড়ার মতো অবস্থা ঋষির।সৌর টেনে আলাদা করলো ওদের....
ঋষি হাঁপাতে-হাঁপাতে পিঠের ব্যাগ সামলে মাটি থেকে উঠলো।দুর্বা ঘাস ঝেড়েঝুড়ে নিয়ে মৃদু হাসলো।গালের বাঁ দিকে ঠোঁটটা একটু বেশিই পরিসর দখল করে বললো,
-ও সামনে এসে দাঁড়ালেই সব কেমন ঘেঁটে যায় রে...সব ভুলে যাই!তখন মাথা আর একদম কাজ করে না....
-উফফ!!কি প্রেম!!তোদেরই হবে ভাই...
আওয়াজ দিলো সৌর!!
চুপ করে হাসিমুখে ওর দিকে চেয়ে রইলো বাকি তিনজন।লজ্জায় মাথা নামিয়ে হেসে উঠলো ঋষি।সেই সঙ্গে বাকি তিনজনও....তারপর বকবক করতে-করতে সাইকেলে উঠে চেনা গলি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ওরা চারমূর্তি....পিছনে পড়ে রইলো এক ছায়াঘেরা সন্ধ্যার সোনালী স্মৃতি....
-গুড মর্নিং ম্যাম!!
-গুড মর্নিং সমুদ্র!
সদাহাস্য মুখশ্রী থেকে সুমধুর ধ্বনি বেরিয়ে এলো।আর মাথাই তুলতে পারলো না সমুদ্র।রানী ম্যামের পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে ও।সমুদ্র জানে,সোজাসুজি ওনার দিকে চাইলে,ও আর কথাই বলতে পারবে না।আজ হালকা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছেন ম্যাম।শাড়ির পাড়টা সবুজ।পায়ের ওপর সবুজ পাড়টা ভাঁজে-ভাঁজে কুঁচি হয়ে পড়ে রয়েছে।সৌভাগ্যবশত আজ আবার একটা হলুদ রঙয়ের গোলাপ ফুলই নিয়ে এসেছে সমুদ্র।এটা প্রায়ই হয় সমুদ্র আর রানী ম্যামের সঙ্গে।বেশিরভাগ দিনই গোলাপী শাড়ির সঙ্গে গোলাপী রঙয়ের গোলাপ ফুল,হলুদের সঙ্গে হলুদ একাত্ম হয়ে যায়।সেদিন হেসে ওঠেন রানী ম্যাম।আজও তাই হলো,
-কি ব্যাপার বলো তো সমুদ্র,তুমি কি আমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছো নাকি!মানে বেশিরভাগ দিনই আমার শাড়ির সঙ্গে তোমার আনা ফুলের রঙ মিলে যায় কি করে?
মাথা নীচু করেই হেসে ফেললো সমুদ্র।
-টেলিপ্যাথি ম্যাম!!
লাজুক হাসির সঙ্গে-সঙ্গে,লজ্জায় অবনত সমুদ্রর বাঁ-দিকের ভ্রুটা একটু খেলে গেলো কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে....
-প্লিজ ম্যাম...এটা নিন...
-থ্যাঙ্কু....
-ওয়েলকাম ম্যাম।
-ওকে সমুদ্র!!সি ইউ ইন ক্লাসরুম!বাই....
-বাই ম্যাম!!
রানী ম্যাম ঘুরে হাতের ব্যাগটা বাগিয়ে নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন টিচার্স রুমের দিকে।এইবার মাথা তুলে সমুদ্র একটু দেখলো ওনাকে।যেতে-যেতেই উনি অন্যমনস্কভাবে হলুদ গোলাপ ফুলটা রেখে দিলেন বিনুনি করা চুলের ভাঁজে....
একটু হেসে ব্যাগটা নিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে এগোলো সমুদ্র।আজকাল প্রায়ই মোড়ের ফুলের দোকানটা থেকে গোলাপ কিনে আনে ও।রকমারি ফুল ম্যামকে উপহার দিয়েছে ও।কিন্তু আজ পর্যন্ত লাল গোলাপ দেওয়ার সাহস হয়নি।বাবা বাড়ির ছাদে একটা রক্তগোলাপের চারা লাগিয়েছে।এমনিতে বাবার ফুলগাছের খুব শখ।ডালিয়া-গাঁদা-দোপাটি-রংবেরঙের গোলাপে ওদের বাড়ির ছাদ পরিপূর্ণ।কিন্তু কোনোভাবেই হাত দেওয়া যাবে না ওসবে।মাঝে-মাঝে তো সমুদ্রর মনে হয়,কোন ফুলের কটা পাপড়ি,বাবা বুঝি সেই হিসেবটুকুও রাখে!তাই ওইসব ফুলের দিকে ফিরেও চায় না ও।রানী ম্যামের জন্য রোজ সমুদ্র ফুল কিনেই আনে।দ্রুতগতিতে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলেন রানী ম্যাম।সমুদ্র ওনার হাসিমুখটাই ভাবতে-ভাবতে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেলো।আজ সেই টিফিনের পর ওনার ক্লাস!!সময় যেন কিছুতেই কাটে না আর.....সময় কেন এত দীর্ঘ!!দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঞ্চে ব্যাগটা রাখলো সমুদ্র....
-আজ বিকেলে মাঠে আসছিস তো?
সৌর বাকি তিনজনকে জিজ্ঞেস করলো।স্কুল শেষে জামার একটা-দুটো বোতাম খুলে গলার টাইটা আলগা করে নামিয়ে নিয়েছে সৌরদীপ...
-তোর আজ সুইমিং নেই?
-না।ওরা পুলের জল বদলাবে।এখন দুদিন বন্ধ।
-আসবো তাহলে....তোরা সবাই আসছিস তো?
-হুম!আসবো।কি করবো বাড়িতে বসে?
-চল,বিকেলে দেখা হবে।বাই....
সৌরর বাড়ি একটু অভিজাত পাড়ায়।ও সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।পাড়ায় ঢোকার মুখেই দেখলো,রাস্তার ওপর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে,বাক্সবন্দী কিছু আসবাবপত্র নামানো হচ্ছে তার থেকে।পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো জায়গাও নেই,সরু গলি।প্রতিবেশী পাড়ার সুবৃহৎ এই বাড়িটা বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা পড়ে থাকতো।দুজন মালী আর একজন দারোয়ানের রাজত্ব ছিলো।হঠাৎ করে সেই বাড়িতে এত হুড়োহুড়ির কারণ বুঝতে পারলো না সৌর।ও বিরক্ত হয়ে সাইকেলের ঘন্টা বাজাতে লাগলো....
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একটা গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা বলছিলো।সাইকেলের ঘন্টা শুনে মুখ বাড়িয়ে এগিয়ে এলো সৌরর কাছে।সৌর প্রায় দমবন্ধ করে চেয়ে রইলো তার দিকে।তার চোখের প্রখর জ্বালাময়ী তেজের সামনে,মুখ পর্যন্ত খুলতে ভুলে গেলো দাপুটে সৌর.....মেয়েটার মাথার দুদিক দিয়ে দুটো লম্বা বিনুনি ঝুলছে।একটা হলুদ টপ আর সবুজ রঙয়ের হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট পরে রয়েছে মেয়েটা।সৌরর সাইকেলের শব্দে বিরক্ত হয়ে সে বললো,
-কি ব্যাপার?এই যে!কি ব্যাপার!?
-না মানে,আমি যেতে পারছি না।এখান দিয়ে যাওয়ার জায়গাই নেই....
থতমত খেয়ে সৌর বললো।
-সাইকেল তো একটু উঠিয়েও নিয়ে যাওয়া যাবে।কিন্তু এই গাড়িটা কি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে?
-না-না!সরি!
-হুম!একটু এডজাস্ট করো।সাইকেলটা একটু সাইড করে নিয়ে বেরিয়ে যাও।
মুখ একদম বন্ধ হয়ে গেলো সৌরর।অন্য সময় হলে কলকল করে মুখ চালিয়ে দিতো।আজ আর পারলোই না।এখন ও একদম চুপ করে সাইকেল থেকে নেমে পড়লো।পাশেই পাঁচিল রয়েছে।কিছুতেই ও ওইটুকু জায়গা দিয়ে সাইকেলটাকে বের করতে পারছে না।কিছুক্ষণ টানা-হেঁচড়া করার পর মেয়েটাই এগিয়ে এলো।পুরো ব্যাপারটা দেখে হাঁক দিলো,
-কাকু?
দরজার সামনে থেকে দারোয়ান একদৌড়ে উঠে এলো।
-বলো দিদিমণি!
-সাইকেলটা বেরোচ্ছে না।একটু দেখো তো।গাড়িটা একটু সামনের দিকে টানতে বলো।
-ফার্নিচার নামছে দিদিমণি,ভারী আলমারীটা অর্ধেক গাড়ির পিছনে,অর্ধেক রাস্তায়।এই অবস্থায় গাড়ি তো সরানো যাবে না।আমি দেখছি,সাইকেলটাকে বের করে দিচ্ছি।
দুদিক থেকে ধরে টেনেটুনে সৌরদীপের সাইকেলটাকে কোনোরকমে বের করা হলো।
-সরি!
এবার মেয়েটাই এগিয়ে এসে বললো।
-নানা!ঠিক আছে।ওটা কোনো ব্যাপার না।এ পাড়ায় নতুন?
হাসিমুখে সৌর বললো....
-নতুন!!
হেসে ফেললো মেয়েটা!
-না।একেবারেই না।বড় ঠাকুরদাদার বাড়ি।আমরাই বাইরে থাকতাম।আজই ফিরলাম।সকালে আমরা এসেছি,এখন এইসব ফার্নিচার নিয়ে যুদ্ধ চলছে।সরি তোমার একটু অসুবিধে হয়ে গেলো।আসলে প্যাসেজটা এত্ত সরু....
-নানা!ইটস ওকে!!এটুকু এডজাস্ট তো করাই যায়।বাই দা ওয়ে,আমি সৌরদীপ।পাড়ার আর একটু ভিতর দিকে আমার বাড়ি।
-ওকে!আমি তিলোত্তমা।স্কুল থেকে ফিরছো?
-হুম!টুয়েলভ!আর খুব বেশিদিন নেই আমার স্কুলজীবন।
কথা বলতে-বলতেই সাইকেলে উঠে বসলো সৌর....
-আমার আরও দুটো বছর।ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিলাম,কিন্তু তারপরই বাবার কলকাতায় ট্রান্সফার।এবার আবার এখানে নতুন করে শুরু করতে হবে।
-আচ্ছা!!পাশাপাশি পাড়া যখন,দেখা তো হবেই!
-এই সোনামা....
একজন ভদ্রমহিলার ডাকে সৌর আর তিলোত্তমা একসঙ্গে ওপরের ঝুলবারান্দার দিকে চাইলো।
-আসছি মা!আমার মা ডাকছে!বাই...
-টাটা....
তিলোত্তমা দৌড়ে ঢুকতে গেলো বাড়ির ভিতরে।সৌর সাইকেলে প্যাডেল করে কিছুটা এগিয়েও,গলির বাঁকের মুখে পৌঁছে আবার ব্রেক মারলো সাইকেলে।একটুখানি ফিরে চাইলো পিছন দিকে।তখন আর রাস্তায় সে দাঁড়িয়ে নেই।শুন্য রাস্তা....
গলার আলগা ফাঁস দেওয়া টাইটা একেবারে খুলে দিলো ও।শার্টের কলারের দুপাশ দিয়ে ওরা ঝুলতে লাগলো....
মৃদু হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপতে থাকা সৌরদীপ,নাকের ওপর দিয়ে তর্জনীটা একবার চালিয়ে নিলো।তারপর প্যাডেল করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো নিজের বাড়ির পথে....
(চলবে....)
ছবি: সংগৃহীত
ধাক্কা মেরে ঋষিকে রঞ্জার দিকে ঠেলে দিলো রূপ....
বুকে অনেকখানি সাহস বাগিয়ে নিয়ে,দু-পা গিয়েই ঋষি আবার উল্টোপায়ে দৌড় মেরে ফেরত চলে এলো।
-এ ভাই!যদি না বলে দেয়!!প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ভাই!!
ভয়ার্ত গলায় ঋষি বলে উঠলো।
-এই কেউ এটাকে ধরে,রাস্তায় ফেলে ক্যালা তো!!
পাশ থেকে হেসে উঠলো সৌরদীপ ও সমুদ্র।আবার চেপে ধরে ঋষিকে ফেরানোর চেষ্টা শুরু হলো।রূপ বলেই চললো,
-শালা দু-বছর ধরে শুধু দেখেই যাচ্ছে।ওরে তুই প্রপোজ করতে-করতে তো,তোর রঞ্জার বিয়ে হয়ে দুটো বাচ্চাও হয়ে যাবে।তখন তুই বরং অন্নপ্রাশনে বাচ্চাকে ফিডিং বোতল গিফ্ট করতে যাস।ছোটলোক কোথাকার!!
-এ ভাই,আমি পারবো তো?
-আহা!ছেলের অবস্থা দেখো!যেন জীবনের প্রথম রাত!পারফর্ম করতে যাচ্ছে!!পারবো তো!!ন্যাকা!!আরে আগে বল তো!!তুই তো বলতেই পারছিস না!এবার না বলে ফিরে এলে কিন্তু,জুতো খুলে মারবো বলে দিলাম!!শালা একটা এক নম্বরের....
-যাচ্ছি তো!!মুখ খারাপ করছিস কেন?
-যা!!এবার যদি তুই না বলিস,আমি কিন্তু গিয়ে বলে দেবো!আর বাই এনি চান্স আমাকে যদি হ্যাঁ বলে দেয়,তখন তুই কিন্তু আজীবন রঞ্জাকে বৌদি বলে ডাকবি!
তেড়ে রূপের ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়লো ঋষি।দুটো সাইকেল উল্টে পড়লো রাস্তায়....বেধে গেলো দুই বন্ধুর তুমুল মারপিট!ততক্ষণে টিউশন থেকে বেরিয়ে রঞ্জাবতী সমর্পণের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে।অদূরে পাঁচিলের ওপারে এদের মারপিট লেগে গেছে....সৌরদীপ আর সমুদ্র টেনে ছাড়াতে পারে না ওদের....চ্যাংদোলা করে পা ধরে আবার ওরা ঋষিকে তুলে দাঁড় করাতে যায়....আজ ওকে বলতেই হবে....
ঋষভ গুহঠাকুরতা এবং রূপায়ন অধিকারী,ডাকনাম ঋষি ও রূপ।সেই প্রথম শ্রেণী থেকেই তাদের গভীর বন্ধুত্ব।সারাদিন স্কুলে-টিউশনে তো বটেই,এমনকি স্কুল-টিউশন ছাড়াও,দিনরাত ওরা একে-অপরের বাড়িতেই পড়ে থাকে।ওদের বাবা-মায়ের একটা করে পুত্রসন্তান হলেও,ওনারাও এখন জেনে গেছেন,ওনাদের বর্তমানে দুটি ছেলে।ঋষভ ও রূপায়ণ।দুই মানিকজোড় একে-অপরকে ছাড়া একেবারে অন্ধ!!ঋষি মেয়েদের সঙ্গে ঠিক মন খুলে কথা বলতে পারে না।এমনকি মাথা তুলে চাইতে পর্যন্ত পারে না।একটু মুখচোরা স্বভাবের।সেদিক থেকে রূপের মুখে আবার খই ফোটে।কিছুদিন পর দুজনেই উচ্চ-মাধ্যমিক দেবে।স্কুল-জীবন প্রায় অন্তিম পর্যায়ে।প্রাণোচ্ছল রূপ এর মধ্যেই বার দুয়েক নিজের পছন্দের মানুষের কাছে,প্রেম প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলো,এবং প্রতিবারই তাকে সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।একজনের কাছেই বার দুয়েক ফিরে এসে এখন রূপের প্রবল উৎসাহে,একটু হলেও ভাঁটা পড়েছে।কিন্তু বন্ধুর জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছে ও....

Buy now at Amazon
অপরদিকে,
সৌরদীপ সাহা ও সমুদ্র বসু,মাধ্যমিকের পর একাদশ শ্রেণীতে স্কুলে এলেও হরিহর আত্মা হয়ে গেছে ওরাও।দিনের বেশিরভাগ সময়ই এদের চারমূর্তিকে একসঙ্গে পাওয়া যায়।তাই এদের প্রত্যেকের বাবা-মা জানে,একজনকে পাওয়া গেলেই,বাকি তিনটের হদিশও পাওয়া যাবে।তাই একপ্রকার নিশ্চিন্তই থাকে।
ঋষভ গুহঠাকুরতা,অর্থাৎ ঋষির বাবার বদলির চাকরি।তাই বছরের বেশিরভাগ সময়টাই ওনার বাইরে-বাইরেই কাটে।এখানে ঋষির মা একাকী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন।স্মৃতিপট ঘেঁটে আবছা মনে পড়ে ঋষির,বার দুয়েক ওরা বাইরে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলো।কিন্তু তারপর স্কুল শুরু হয়ে যাওয়াতে,আর বাবার সঙ্গে-সঙ্গে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানো হয়নি।থিতু হয়ে বসতে হয়েছে নিজস্ব দোতলা বাড়িতে।একতলায় একটা দিকে একটা ছোট পরিবার ভাড়া থাকে।অপর দিকে ঋষির মায়ের ঘর।ঋষি দোতলায় থাকে।পড়াশোনায় একেবারে প্রথম সারির না হলেও,মোটামুটি ভালোই।উচ্চতা চোখে পড়ার মতো কিছু নয়,তবে চলনসই।গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।চুল ডানদিক দিয়ে সিঁথি করা।মুখে সবসময় একটা আলগা হাসি লেগেই রয়েছে।গালের হালকা দাড়ি জানান দিচ্ছে,যুবক সে....পছন্দের পোশাক ফুলহাতা শার্ট,হাতা গুটিয়ে জিন্সের সঙ্গে পরতেই অভ্যস্ত....চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু না থাকলেও,এমন একটা চটকদার আবেদন আছে সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত ঋষির মধ্যে,যে একবার ভালোভাবে ওকে দেখলে,ওর দৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো যায় না বড় বিশেষ।মৃদু হাসির সময় নিজের অজান্তেই ঠোঁটের বাঁ দিকটা একটু বেশিই খেলে যায়।এইরকম একটা ছেলে রীতিমতো ঘোল খেয়ে যাচ্ছে রঞ্জাবতীর মতো ডাকসাইটে সুন্দরীর কাছে।সেই মাধ্যমিকের পর থেকেই রঞ্জাকে দেখে পাগল হয়ে রয়েছে ও।কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারেনি আজও পর্যন্ত....বাবা বাইরে থাকে।আজকাল বাবা ফোন করলে মা বড় দুশ্চিন্তা করে।বাবার শরীরটাও মাঝে-মাঝে একটু খারাপ হয়।বাবার বয়সটাও বাড়ছে,সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঋষির চিন্তাও.....
রূপায়ণ অধিকারী,অর্থাৎ রূপের বাবার আছে ছোটখাটো ব্যবসা,বাজারে একটা নিজস্ব পাইকারি মুদিখানা দোকান আছে।মোটামুটি সচ্ছল অবস্থা।রূপের পরে ওর একটা ছোট বোন আছে,দাদার ভীষণই আদরের।বাবার অনেক আশা-ভরসা রূপ।তাই জীবনে কিছু তো ওকে করতেই হবে।বাবা-মায়ের দায়িত্ব,বোনের দায়িত্ব,সবটাই ওর মাথার ওপর ভবিষ্যতে আসতে চলেছে।অদূর ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই মাঝে-মাঝে,অজানা আতঙ্কে কেঁপে ওঠে রূপ।লড়াই করার মতো মনের জোরটুকুও হারিয়ে ফেলে।এই বাজারে সামান্য গ্রাজুয়েট একটা ছেলের জন্য কি চাকরী প্রস্তুত থাকে?!জানা নেই রূপের!!বোধহয় না।খুব বেশি পড়ার আশা করেও না ও।বাবা হিসেবে সন্তানকে প্রয়োজনের অতিরিক্তই দেওয়ার চেষ্টা করে ওই 'বাবা' নামক মানুষটা।তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু মুখ ফুটে চাইতে,বরাবরই লজ্জা করে রূপের।সুখী সন্তান ও।শুধু নিশান্তিকা,অর্থাৎ নিশার কাছ থেকে,বরাবরই একটু উষ্ণতা আশা করে রূপ।একাধিকবার ওর কাছে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে,রূপ শুন্যহাতে ফিরেছে।কারোর সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই,সেটাও জানে রূপ।ওর সঙ্গেও তো ভালোভাবেই কথা বলে।তাও কেন বারংবার ওকে প্রত্যাখ্যান করে?কি জানি!!হয়তো মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যায়।তবে সাহস করে ঠিক ভালোবাসা যায় না বোধহয়....
সৌরদীপ সাহা,অর্থাৎ সৌরর বাবা একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার,ভালোই পসার আছে।সন্ধ্যের পর রুগী সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।এখানে বাসযোগ্য নিজের সুদৃশ্য তিনতলা বাড়ি আছে।এছাড়াও দেশে কিছু জমিজমাও আছে।চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সৌরই পড়াশোনায় তুখোড়,সাঁতারেও জেলা-বিজয়ী,দুর্ধর্ষ রূপ,আর সেই সঙ্গে চোখে পড়ার মতোই উচ্চতা।যেহেতু পড়াশোনায় বরাবরই উজ্জ্বল,তাই পরীক্ষার সময় তিনজনকে পাশ করানোর পুরো চাপটা সৌরর ওপরেই এসে পড়ে।পড়াশোনা-সাঁতার নিয়ে ব্যস্ত থাকা সৌরদীপের মনের দরজায়,এখনও পর্যন্ত বসন্ত কড়া নাড়েনি।রূপের ব্যাকুল হৃদয় দেখে,ওর করুণ অবস্থা দেখে,আর ঋষির ছটফটানি দেখে,চিরকালীন অভ্যাসবশত নিজের তর্জনী দিয়ে টিকালো নাক ঘষে নিয়ে,সৌর সদাসর্বদা একটাই কথা বলে,"আগে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করা উচিত,যাতে কোনো মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে,সে তোকে কোনোরকম অজুহাতেই ফেরাতে না পারে!কোনো খুঁত যেন না পায়!আরে সে তো ছাড়,তার বাবা-মা পর্যন্ত ভাববে,আরে!!এমন ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার!!আপত্তির কোনো জায়গাই খুঁজে পাবে না।তাই বইতে মুখ ডুবিয়ে আগে পড়,নিজেকে একটা রত্ন তৈরী কর।ভাই পকেটের জোর না থাকলে,কোমরের জোর না থাকলে,ভালোবাসা তোকে ছেড়ে দিয়ে,জানলা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালাবে...কারণ,বেশিরভাগ মেয়েরাই জীবনসঙ্গী হিসেবে সফল পুরুষ চায়,ভরসা চায়,নিরাপত্তা চায়।মেয়ের বাড়ির লোকও তাই।তাই যে সময়ে যেটা করার,সেটা আগে কর ভাই।পড়াশোনাটা ঠিকঠাক ভাবে কর!!এসবের জন্য তো সারাটা জীবনই পড়ে আছে!"
চার বন্ধুর মধ্যে অত্যন্ত বাস্তববাদী একমাত্র সৌরদীপ,হয়তো কিছুটা অহংকারীও।কারণ,পড়াশোনা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একমাত্র সৌরই বাকি তিনজনকে টেক্কা দিতে পারে।সেই সঙ্গে পাগলপারা রূপ,আর সর্বোপরি এর মধ্যেই একটা স্থানীয় সুইমিং পুলে সাঁতারুদের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হওয়ায়,তিনজনের থেকে সম্মানেও সৌরদীপ অনেকটা ঊর্ধ্বস্থানে রয়েছে।ওর আরও একটা সাংঘাতিক অহংকার,ভাবাবেগের কোনো জায়গা ওর মনে,এখনও পর্যন্ত নেই.....মনের কোনোরকম দুর্বলতাকে ও প্রশ্রয় দেয়না।নিজের পড়াশোনা-ফুটবল-সাঁতার-শরীরচর্চা-কম্পিউটার নিয়েই ব্যস্ত থাকে প্রতিনিয়ত....
গতকাল রাতে ওরা চারজন ঋষির বাড়িতেই ছিলো।ওদের সারারাত জেগে পড়াশোনা করার কথা।কিন্তু কত যে পড়ে উল্টে দিচ্ছে,সে তো স্বয়ং দেবী সরস্বতী আর ওরাই জানে।রূপ বারংবার করে ঋষিকে বুঝিয়েছে,যার কথা তাকেই বলতে হয়।এখনও যদি ঋষি বলতে না পারে,তাহলে কলেজে গেলে আর রঞ্জাকে ছুঁতেও পারা যাবে না।কারণ,এমনিতেই আজকালকার দিনে সুন্দরী মেয়েরা বেশিদিন ফাঁকা থাকে না।কপালজোরে রঞ্জা এখনও আছে।তাই এখনই বুকিং করে না রাখলে,পরে ঋষির কপালে অশেষ দুঃখ নাচছে।এরপর কলেজে গেলে,ওর চোখের সামনেই অন্য কোনো ছেলের হাত ধরে রঞ্জা ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াবে,তখন ওকে হাঁ করে দেখতে হবে।তাই যেভাবেই হোক,মুখে না বলতে পারলে,প্রয়োজনে হাত-পা নেড়ে,অন্তত অঙ্গভঙ্গী করে হলেও রঞ্জাকে বোঝাতেই হবে।
-দেখ ঋষি!একটা কথা খুব ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নে ভাই।এই যে আমরা এখন বাজপড়া শকুনটার মতো দেখতে আছি,গালে দাড়ি উঠবো কি উঠবো না সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না,এইরকম কিন্তু আরও বেশ কয়েক বছর থাকবো।আমাদের এই সময়টা কিন্তু এইরকমই....
সমুদ্র মন দিয়ে বোঝাতে যায় ঋষিকে....
সমুদ্র বসু,অর্থাৎ সমুদ্রর মাথায় একরাশ কাকের বাসার মতো অবিন্যস্ত কোঁকড়ানো চুল।গালে দাড়ি উঠবে নাকি উঠবে না,প্রকৃতির সেই সিদ্ধান্ত এখনও সম্পূর্ণরূপে নেওয়া হয়নি।যত্রতত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যৌবনের স্পর্শ।তবে সমুদ্রর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো,দুটি চোখ।গভীর দুটি চোখ ঢাকা থাকে দীর্ঘ অক্ষিপল্লবে।অত্যন্ত ধীর-স্থির-শান্ত ও প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন।সমুদ্রর বাবা সরকারি চাকুরে,এবং মা গৃহবধূ।স্বভাবতই বাবা-মা চায় ছেলে অনেক পড়াশোনা করুক,চাকরি করুক,তারপর নিয়মমাফিক সংসারী হোক।গতানুগতিকতার মোড়কে বাঁধা হোক সমুদ্র বসুর জীবন।দিনান্তে ওনাদের ছেলে একজন সফল পুরুষ হোক।কিন্তু সমুদ্র মনেপ্রাণে গায়ক হতে চায়।পড়াশোনা ওর মাথায় বিশেষ ঢোকে না।সারাদিন গিটার হাতে নিয়ে টুং-টুং করেই ওর যত আত্মতৃপ্তি,নিজের যত খুশি,যত আনন্দ,ও একমাত্র সুরের মূর্ছনায় খুঁজে পায়।গিটার....এত বছরের জন্মদিনে ওই একটা বস্তুই ও উপহারস্বরূপ নিজের মুখে বাবা-মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।যৌবনের নিয়মানুসারে,সমুদ্রর জীবনে সেইভাবে হয়তো এখনও কোনো নারী বসন্ত নিয়ে পদার্পণ করেনি....বা হয়তো করছে,ধীরে-ধীরে....অত্যন্ত মন্থর গতিতে.....অপরিপক্ক-অনভিজ্ঞ সমুদ্র ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছে না....
ঋষির বিছানায় শুয়ে-শুয়ে চোখ বন্ধ করে,খাটে চাপড় মেরে তাল দিচ্ছিলো সমুদ্র।হয়তো মাথায় চলছিলো নতুন কোনো গানের অন্তরা বা মুখরা।গুনগুনানি থামিয়ে,ঝাঁকড়া একরাশ চুল হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে,চোখের চশমাটা নামিয়ে,উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সৌরদীপের পশ্চাৎদেশে পদযুগল তুলে সমুদ্র গুছিয়ে কথা শুরু করতে গেলো।কিন্তু তার আগেই সৌর ওকে দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দিলো,
-এ ভাই!তুই থাম ভাই!আমাদের ঋষির অমন কার্তিক ঠাকুরের মতো চেহারাটার অপমান করিস না।বাজপড়া শকুন তুই হবি!দিন-দিন তো গালে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা গজিয়ে উঠছে!এত ব্রণ কেন ভাই?দিনে কবার?
সৌরর পশ্চাৎদেশে পা-টা তুলেই রেখেছিলো সমুদ্র।বেশ সুবিধেই হলো।ওর কথা শেষ হতে না হতেই সমুদ্র কষিয়ে একটা ধাক্কা মারলো ওকে।খাট থেকে হুমড়ি খেয়ে সৌর মেঝেতে গিয়ে পড়লো...
-আহ!বাবাগো!দিলো আমার কোমরটা ভেঙে!এ আমাকে টেনে তোল রে ভাই...আমার হাল খারাপ করে দিয়েছে...
ইচ্ছাকৃতভাবেই আধশোয়া হয়ে মেঝেতে পড়ে রইলো সৌর।গুছিয়ে শুয়ে পড়লো মেঝেতে...
-এই ভাই!তোরা একটু থাম না রে।দেখছিস আমি ঋষির বল বাড়াচ্ছি....
বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো রূপ।
-কি বাড়াচ্ছিস?ও তুই হাজার চেষ্টা করলেও ওটার সংখ্যা বাড়াতে পারবি না!ওটা ভগবানপ্রদত্ত ভাই.....
মেঝেতে শুয়েই হেসে ফেললো সৌর।
-বল!বল!বল বাড়াচ্ছি!!আরে মনোবল রে...উফফ!!কাল ওকে পারতেই হবে।
রূপ ফিরলো ঋষির দিকে।নিশা ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি তো কি হয়েছে?!তবু ও তো বলতে পেরেছে!!কিন্তু ঋষি তো তাও পারছে না।কাল ঋষিকে পারতেই হবে।যেভাবেই হোক।ওকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করতে যায় রূপ....
-শোন ঋষি!
-আরে ও তো শুনেই যাচ্ছে রে।আমরাও শুনেই যাচ্ছি!!আমরা ইলেভেনে এলাম এই স্কুলে,তখন থেকেই শুনছি,ও কিন্তু তোদের বৌদি-ভাই ও কিন্তু তোদের বৌদি!ওর দিকে কিন্তু একদম তাকাবি না!!আরে ভাই পুরো ক্লাসের,এমনকি পুরো স্কুলের বৌদি হয়ে গেলো রে ভাই!শুধু তোর বউ তো হলো নারে....
সমুদ্র হেসে উঠে খাট থেকে নেমে সৌরর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো....ওর হাত ধরে মেঝে থেকে উঠে এলো সৌর....
-দেখ ভাই!দুদিনের বন্ধুরাও কেমন আওয়াজ দিচ্ছে তোকে।এবার কিন্তু তোকে পারতেই হবে।তুই আমাকে ছুঁয়ে প্রমিস কর,কাল তুই ওকে বলবি!আমি ডেকে দেবো রঞ্জাকে।তুই শুধু হরেকৃষ্ণ নাম নিয়ে দুম করে বলে দিবি।আরে ওইটুকু তো তোকে বলতেই হবে....
-তুই থাকবি তো ভাই আমার সঙ্গে?
-আরে চাপ নিস না,ফুলশয্যাতেও থাকবো তোর সঙ্গে!
রূপের কথায়,ঋষি বাদে দুই বন্ধুই সমস্বরে হেসে উঠলো।
-ওই চুপ কর রে।মা নীচে আছে।না রূপ....ওখানে আমার কাউকে দরকার নেই।
-হ্যাঁ ভাই,বুঝতেই পারছি,তুই একাই একশো।একটা মেয়েকে বলতেই দম বেরিয়ে যাচ্ছে।তুই তো আমার বীরপুরুষ ঋষি!এবার বল,বলবি তো কাল?বল ভাই....প্রমিস কর!ঠিক বলবি তো?আগেবারের মতো তুতলে সব ভুলে যাবি না তো!!
ব্যস্ত হয়ে গেলো রূপ।
-কাল আমি পারবোই রূপ।একদম কাল জান লড়িয়ে দেবো ভাই।
-এই তো।ভেরি গুড।এই এনার্জিটাই কাল চাই কিন্তু!চল,প্রিপারেশন কমপ্লিট।এবার পরীক্ষার আগের রাতের মতো একটু রিল্যাক্স করতে হবে।মনটাকে তুলোর মতো হালকা ফুরফুরে করে ফেলতে যবে।তাহলে এখন একটু ক্যারাম খেলি ভাই!!চল,পাউডার আন ঋষি!
মুখের সামনে বইপত্র নামেই খোলা,নামেই পড়াশোনা হচ্ছে।বই বন্ধ করে একটু হেসে ঋষি বললো,
-নাঃ!আজ তো লুডোই খেলবো!
-আরে ভাই,যেটাই খেলবি,চারজনই তো লাগবে।লুডো তুই মনের আনন্দে কালকের পর খেলিস।এখন ক্যারাম খেলি আয়!
-রানী কিন্তু আমার!
হাত দিয়ে একঝাঁক চুল মুখের সামনে থেকে সরিয়ে সমুদ্র বললো।
-রানী ম্যাম তো?
-আবে চুপ!
লাফিয়ে সৌরদীপের মুখ চেপে ধরলো সমুদ্র।
-এই কি ব্যাপার রে?
সৌরদীপের ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ঋষি আর রূপ।টেনে ধরতে গেলো সৌরর মুখে চেপে রাখা সমুদ্রর হাত।মুখ বন্ধ অবস্থাতেই যেটুকু বেরোলো ওর মুখ দিয়ে,তা কিছুটা এইরকম....
-ইংলিশ ম্যাম.....রেণুকা বিশ্বাস।রানী ম্যাম!ছেলে আমাদের ক্রাশ খেয়ে বসে আছে।
-সৌর!!
চিৎকার করে উঠলো সমুদ্র....
-তোকে খুন করে ফেলবো।জীবনেও আর তোকে কিচ্ছু বলবো না দেখ.....
-আচ্ছা....এই জন্য সকাল থেকে ছেলে গাইছে,
"মেরে সাপনো কি রানী...."
-রূপ....
প্রচন্ড রেগে গিয়ে সমুদ্রর বাঁ-দিকের ভ্রূটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওপরে উঠে গেলো...থমকে গেলো রূপ...
-একদম ফালতু কথা বলবি না!ম্যাম উনি!সম্মান করি!হ্যাঁ,আর পাঁচজনের থেকে একটু বেশিই....
সৌরকে ছেড়ে দিয়ে রূপের দিকে ঘুরে আঙুল তুললো সমুদ্র....রেগে রক্তবর্ণ হয়ে গেছে সমুদ্রর ফর্সা গাল....কপালে ভাঁজ....
-ওকে,সরি ভাই!তুই এত রেগে যাচ্ছিস কেন?আমি তো একটু মজাই করলাম!
-এইরকম মজা আর একদম না!রানী ম্যামকে জড়িয়ে একটাও নোংরা কথা,তোদের মাথাতেও যেন না আসে....যেদিন আসবে,সেদিন সব বন্ধুত্ব আমি ভুলে যাবো।কে বন্ধু,কে শত্রু,আমি কিন্তু কিচ্ছু মনে রাখবো না....
-আচ্ছা বাবা...সরি!!
তাও ঠান্ডা হয় না সমুদ্র।রাগে জ্বলতে থাকে।
-সমু!সরি বাবা!ভুল বুঝিস না আমায়।আমি তোকে কোনোভাবে হার্ট করতে চাইনি ভাই,একটু মজা করেই....
-হুম!আর নয়....মজাটা যেন মজার জায়গাতেই থাকে।
-আচ্ছা।আর একদম না।ভুল হয়ে গেছে...
কোনোরকমে পরিস্থিতি সামলে নেয় রূপ।সমুদ্র রাগে না খুব একটা,এমনিতে বেশ হাসিখুশি-প্রাণোচ্ছল।কিন্তু ওই একটা নাম,ওই একটা অবয়ব,ওই শাড়ির চিরপরিচিত ভাঁজ,ওই শরীরী-বিভঙ্গ,ওই হাসিমুখ,ওইভাবে হঠাৎ ফিরে তাকানো,গোলাপী ওষ্ঠরঞ্জনীতে ঢাকা ওষ্ঠ আর অধর,নীচু ক্লাসের বাচ্চাদের দেওয়া রকমারি ফুল গুঁজে রাখা ওই লম্বা বেণী,হাসিমুখে প্রতিদিনকার ওইভাবে "গুড মর্নিং ম্যাম" এর প্রত্যুত্তরে "গুড মর্নিং সমুদ্র" বলার ধরণ,প্রতিনিয়ত পাগল করে দিচ্ছে ওকে।দিবারাত্র ওই একজন নারীই ওর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ওর পুরো পৃথিবীটাই যেন রানী ম্যামকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে।আর সহ্য করতে পারেনি সমুদ্র।সেদিন সৌরকে বলে ফেলেছিলো কথায়-কথায়।সেটাই ও আজ সবার সামনে বলে বসলো....রাগে-দুঃখে চোখে জল এসে গেছে সমুদ্রর।ওই নারীর সম্পর্কে কোনোরকম কোনো কটূক্তি সহ্যই করতে পারে না সমুদ্র...রাগটা সামলাতে মাথা নামিয়ে নিলো ও....
-এই সমু,আরে এই সমুদ্র....তুই কি সত্যি-সত্যি ক্ষেপে গেলি নাকি?!আরে বন্ধু তো রে ভাই।মজা করে না হয় বলেই ফেলেছে,ওসব ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে।চল,আয় ভাই,ক্যারাম খেলি!!
টেনে-জড়িয়ে ধরে সমুদ্রকে মেঝেতে নামালো বাকি তিনজন....বন্ধ দরজার ওপারে চারজন মেতে উঠলো খেলায়....বইপত্র সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রইলো বিছানার ওপর....শেষ রাত্রে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এ-ওর গায়ের ওপর নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে পড়লো....
প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুকে গতকালই কথা দিয়েছে ঋষি,আজ তো ও রঞ্জাকে প্রপোজ করবেই।মরে গেলেও প্রেম নিবেদন করেই মরবে।টিউশন থেকে বেরিয়ে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে,ওরা অপেক্ষা করছিলো রঞ্জার জন্যই।যাও বা মনের জোরে দু-পা এগোয় ঋষি,আবার ভয়ের চোটে চার-পা পিছিয়ে আসে।
-এই রূপ!ভাই না বলে দেবে না তো রে?
-আরে নারে,না বলবে না!!দেখিস না,তোর দিকে কেমন মিষ্টি করে তাকায়!!সুন্দর করে হাসে....যা না শালা!আমরা তো তোর পিছনেই আছি।তুই যা....
তাও এগোতে পারে না ঋষি।ভয়ে-উত্তেজনায় ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে....
-কিরে?তোরা চার মাথা একজায়গায় হয়ে এখানে কি করছিস?কিসের এত প্ল্যান করছিস বলতো লুকিয়ে-লুকিয়ে?
ওদের হুড়োহুড়ির মধ্যে কখন যে রঞ্জা শ্যাওলা ধরা উঁচু পাঁচিলের আড়াল থেকে গলির মধ্যে চলে এসেছে,ওরা খেয়ালই করেনি।সৌর আর সমুদ্র দুটো সাইকেল তুলে,মুখ একেবারে বন্ধ করে,চুপটি করে অপেক্ষা করতে লাগলো।ঋষি ভয়ে মাথা নামিয়ে নিয়েছে।মেয়েটার দিকে চাইতেই পারে না ও.....
আজ একটা বাসন্তী রঙয়ের চুড়িদার পরে এসেছে রঞ্জাবতী।বুকের ওপর একটা সবুজ ওড়না ঢাকা দেওয়া।মাথার কাঁধ পর্যন্ত ঘন চুলগুলো একটা ছোট্ট ক্লিপ দিয়ে আটকানো।তারা ঘাড় আর পিঠের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।ওই একটা ছোট্ট ক্লিপে সামনের কাটা চুলগুলো আটকায়নি।তারা মৃদু হাওয়ায় রঞ্জার মুখের ওপরে বারংবার আছড়ে পড়ছে।সবার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে বারংবার চোখদুটো বন্ধ করে নিচ্ছে রঞ্জা।হাত দিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে চুলগুলো।এর মধ্যেই বারকয়েক দুচোখ ভরে রঞ্জাকে দেখে নিয়েছে ঋষি।ওর মাথাতেই ঢোকে না,এতই যখন বিরক্ত করে ওই ছোটো-ছোটো চুলগুলো,তবে ওগুলোকে ওইভাবে কেটে ছোট করে মুখের সামনে রাখাই বা কেন?ইচ্ছাকৃত কি?ঋষিকে আরও শেষ করার জন্য?!আরও একটু পাগল করে দেওয়ার জন্য?উফফ!!বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না ওর দিকে!অবাধ্য চুলগুলো রঞ্জা যখন হাত দিয়ে নিজের মুখের ওপর থেকে সরালো,ওর মুখের ওপর থেকে চোরাদৃষ্টি সরিয়ে নিলো ঋষি।ওর পিঠে একটা ব্যাগ রয়েছে।বাঁ-হাতে একটা খয়েরি ব্যান্ডের ঘড়ি।হাতে ফোন আর একটা ছোট ব্যাগ রয়েছে,অটোতে উঠবে,সেই জন্য....
-ওকে চল!এলাম আমি!বাড়িতে আজ মামাতো দাদা-বৌদি আসার কথা আছে।
-রঞ্জা শোন,নিশা আমার কথা আর কিছু বলেছে রে?
-নারে রূপ।আসলে ব্যাপারটা কি বল তো?ওর মাথার ওপর বাবা নেই তো।দুই বোন ওরা।একটা বোনকে মামাবাড়িতে রেখে ওর মা মানুষ করছে।এখানে ও ছাড়া ওর মায়ের আর কেউ নেই।তাই ও বলে,এসব প্রেমঘটিত ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই ওর নেই।নিজেকে আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।ওর পড়াশোনার সময় থেকে একটুখানি সময়ও ও অন্য কাউকে দিতে পারবে না।সরি রে,অনেক বলেছি,অনেক বুঝিয়েছি!কিন্তু.....
-বুঝতে পারছি!ঠিক আছে।
মুষড়ে পড়ে রূপায়ন।
-এই এলাম রে।চল,পরশু আবার দেখা হচ্ছে।বাই ঋষি!!
-এই এলাম কি রে?রঞ্জা দাঁড়া....
ব্যস্ত হয়ে ওঠে রূপ।
-কেন রে?কিছু বলবি?
সৌর আর সমুদ্র দেখলো,ঋষির মুখটা ধীরে-ধীরে রক্তশূন্য পাংশুটে হয়ে যাচ্ছে।ভয়ে দিশেহারা হয়ে ছটপট করছে ও....ভাবটা এমন,যেন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে....
-হ্যাঁ,ইয়ে মানে শোন,আমি না।ঋষি তোকে কিছু বলতে চায়!!ও বলবে।
একেবারে চুপ করে গেলো রঞ্জা।তারপর ধীরে-ধীরে ঋষির চোখের দিকে চেয়ে বললো,
-বল ঋষি,কিছু বলবি?
-ভাই তোরা কথা বল।আমি কয়েকটা জিনিস একটু জেরক্স করবো।আমরা পিন্টুদার দোকানে আছি....
আর মাথা তুলতে পারলো না ঋষি।সৌর,সমুদ্র আর রূপ সরে গিয়ে পাঁচিলের অপর প্রান্তে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো....
-বল!ঋষি....
-কি?
-মাথা তোল!!কিরে?বল কি বলবি?
-না মানে স্কুল শেষ হয়ে যাচ্ছে তো,তাই কেমন একটা লাগছে।সব চেনা বন্ধুবান্ধবরা দলছুট হয়ে যাবো,আর প্রতিদিন দেখা হবে না।এটা ভাবলেই বড্ড ভয় লাগছে....
পাঁচিলের অপর প্রান্ত থেকে দাপাতে শুরু করেছে রূপ।
-ওরে লাইনে আয় ভাই!কাজের কথা বল।এত ভূমিকার কি আছে?!
-দাঁড়া না বলবে!!ওইরকম দুম করে বলা যায় নাকি!আগে একটু সইয়ে নিক....
-মনে?!ওর গায়ে গরম জল ঢালবে নাকি,যে সইয়ে নিতে হবে!!
-চুপ!শোন....ঋষি কিছু বলছে....
সমুদ্র দাবিড়ানি দিয়ে থামায় ওকে...পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আবার কান সজাগ করে ওরা তিনজন....
-পার্ট অফ আওয়ার লাইফ ঋষি...জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হবে,আর একটা শুরু...
-হুম!প্রিপারেশন কেমন রঞ্জা?
-চলছে।ইংলিশ টিউশন ইম্পরট্যান্ট!
কেঁপে উঠলো ঋষি...কোনোরকমে বললো,
-কেন?
-ইংলিশেই অনার্স নেওয়ার ইচ্ছে আছে।
-ওহ!!
-এই ভাই!তুই ওর টিচার না রে ভাই!এত পড়াশোনার খবরে তোর কি দরকার!!সোজা কাজের কথাটা আগে বল না...
অধৈর্য্য হয়ে গেলো রূপ।
-আসছি রে....মা ফোন করে বললো,মিষ্টি-সিঙ্গারা সব নিয়ে যেতে হবে।বাড়িতে লোকজন আসবে।আর দেরি করলে হবে না।সন্ধ্যে হয়ে আসছে।বাই ঋষি...
রূপ ঠাসঠাস করে নিজের কপাল চাপড়াতে শুরু করে দিলো।দৌড়ে বেরিয়ে আসছিলো আড়াল থেকে।কিন্তু ওকে টেনে ধরলো সমুদ্র আর সৌর।
-হুম!বাই!রঞ্জা শোন?
-হ্যাঁ বল!
-তোকে এই হলুদ-সবুজ কম্বিনেশনে খুব ভালো লাগে রে।
থমকে গিয়ে একটু চুপ করে রইলো রঞ্জা।তারপর একটু হেসে বললো,
-চার বছরের পুরনো চুড়িদার।অন্তত চারশো বার পরেছি।এমন কমপ্লিমেন্ট তো এতদিন কেউ দেয়নি....
-সেভাবে হয়তো কেউ তোকে দেখেইনি।তাই চোখে পড়েনি।
-কি জানি!হবে হয়তো!ওকে...তুই দেখলি!কমপ্লিমেন্ট দিলি,থ্যাঙ্কু সো মাচ....টাটা....
-টাটা...
রঞ্জা হাঁটতে-হাঁটতে মিলিয়ে গেলো পাঁচিলের আড়ালে,বড় রাস্তার দিকে।একভাবে ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে ছিলো ঋষি...সেই মুহূর্তেই সপাটে পিছন থেকে একটা চাঁটি এসে পড়লো ঋষির মাথায়....মাথাটা ঝনঝন করে উঠলো....
-আঃ!!রূপ!
-প্রেম করবে!!এই সাহস নিয়ে তুমি প্রেম করবে?মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেই ভয়ের চোটে খুলে পড়ে যায়,তুমি এই সাহস নিয়ে প্রেম করবে!!বললি না কেন?বল বললি না কেন?হলুদ-সবুজ কম্বিনেশনে ভালো লাগে!!রঞ্জার ওই সবুজ ওড়না,তোর গলায় পেঁচিয়েই তোকে খুন করে ফেলবো আজ...বল...বললি না কেন?এটাও কি তোর হয়ে বন্ধুরা করে দেবে?!এই ক্যালা তো এটাকে....রাস্তায় ফেলে ক্যালা...
পাঁচিলের সঙ্গে ঋষিকে ঠেসে ধরে দুমদুম করে ঘুষি মারতে লাগলো রূপ আর সমুদ্র।বন্ধুদের চাপাচাপিতে,সুড়সুড়ির চোটে হাসতে-হাসতে প্রায় মাটিতে বসে পড়ার মতো অবস্থা ঋষির।সৌর টেনে আলাদা করলো ওদের....
ঋষি হাঁপাতে-হাঁপাতে পিঠের ব্যাগ সামলে মাটি থেকে উঠলো।দুর্বা ঘাস ঝেড়েঝুড়ে নিয়ে মৃদু হাসলো।গালের বাঁ দিকে ঠোঁটটা একটু বেশিই পরিসর দখল করে বললো,
-ও সামনে এসে দাঁড়ালেই সব কেমন ঘেঁটে যায় রে...সব ভুলে যাই!তখন মাথা আর একদম কাজ করে না....
-উফফ!!কি প্রেম!!তোদেরই হবে ভাই...
আওয়াজ দিলো সৌর!!
চুপ করে হাসিমুখে ওর দিকে চেয়ে রইলো বাকি তিনজন।লজ্জায় মাথা নামিয়ে হেসে উঠলো ঋষি।সেই সঙ্গে বাকি তিনজনও....তারপর বকবক করতে-করতে সাইকেলে উঠে চেনা গলি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ওরা চারমূর্তি....পিছনে পড়ে রইলো এক ছায়াঘেরা সন্ধ্যার সোনালী স্মৃতি....
-গুড মর্নিং ম্যাম!!
-গুড মর্নিং সমুদ্র!
সদাহাস্য মুখশ্রী থেকে সুমধুর ধ্বনি বেরিয়ে এলো।আর মাথাই তুলতে পারলো না সমুদ্র।রানী ম্যামের পায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে ও।সমুদ্র জানে,সোজাসুজি ওনার দিকে চাইলে,ও আর কথাই বলতে পারবে না।আজ হালকা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছেন ম্যাম।শাড়ির পাড়টা সবুজ।পায়ের ওপর সবুজ পাড়টা ভাঁজে-ভাঁজে কুঁচি হয়ে পড়ে রয়েছে।সৌভাগ্যবশত আজ আবার একটা হলুদ রঙয়ের গোলাপ ফুলই নিয়ে এসেছে সমুদ্র।এটা প্রায়ই হয় সমুদ্র আর রানী ম্যামের সঙ্গে।বেশিরভাগ দিনই গোলাপী শাড়ির সঙ্গে গোলাপী রঙয়ের গোলাপ ফুল,হলুদের সঙ্গে হলুদ একাত্ম হয়ে যায়।সেদিন হেসে ওঠেন রানী ম্যাম।আজও তাই হলো,
-কি ব্যাপার বলো তো সমুদ্র,তুমি কি আমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছো নাকি!মানে বেশিরভাগ দিনই আমার শাড়ির সঙ্গে তোমার আনা ফুলের রঙ মিলে যায় কি করে?
মাথা নীচু করেই হেসে ফেললো সমুদ্র।
-টেলিপ্যাথি ম্যাম!!
লাজুক হাসির সঙ্গে-সঙ্গে,লজ্জায় অবনত সমুদ্রর বাঁ-দিকের ভ্রুটা একটু খেলে গেলো কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে....
-প্লিজ ম্যাম...এটা নিন...
-থ্যাঙ্কু....
-ওয়েলকাম ম্যাম।
-ওকে সমুদ্র!!সি ইউ ইন ক্লাসরুম!বাই....
-বাই ম্যাম!!
রানী ম্যাম ঘুরে হাতের ব্যাগটা বাগিয়ে নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলেন টিচার্স রুমের দিকে।এইবার মাথা তুলে সমুদ্র একটু দেখলো ওনাকে।যেতে-যেতেই উনি অন্যমনস্কভাবে হলুদ গোলাপ ফুলটা রেখে দিলেন বিনুনি করা চুলের ভাঁজে....
একটু হেসে ব্যাগটা নিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে এগোলো সমুদ্র।আজকাল প্রায়ই মোড়ের ফুলের দোকানটা থেকে গোলাপ কিনে আনে ও।রকমারি ফুল ম্যামকে উপহার দিয়েছে ও।কিন্তু আজ পর্যন্ত লাল গোলাপ দেওয়ার সাহস হয়নি।বাবা বাড়ির ছাদে একটা রক্তগোলাপের চারা লাগিয়েছে।এমনিতে বাবার ফুলগাছের খুব শখ।ডালিয়া-গাঁদা-দোপাটি-রংবেরঙের গোলাপে ওদের বাড়ির ছাদ পরিপূর্ণ।কিন্তু কোনোভাবেই হাত দেওয়া যাবে না ওসবে।মাঝে-মাঝে তো সমুদ্রর মনে হয়,কোন ফুলের কটা পাপড়ি,বাবা বুঝি সেই হিসেবটুকুও রাখে!তাই ওইসব ফুলের দিকে ফিরেও চায় না ও।রানী ম্যামের জন্য রোজ সমুদ্র ফুল কিনেই আনে।দ্রুতগতিতে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলেন রানী ম্যাম।সমুদ্র ওনার হাসিমুখটাই ভাবতে-ভাবতে নিজের ক্লাসের দিকে চলে গেলো।আজ সেই টিফিনের পর ওনার ক্লাস!!সময় যেন কিছুতেই কাটে না আর.....সময় কেন এত দীর্ঘ!!দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঞ্চে ব্যাগটা রাখলো সমুদ্র....
-আজ বিকেলে মাঠে আসছিস তো?
সৌর বাকি তিনজনকে জিজ্ঞেস করলো।স্কুল শেষে জামার একটা-দুটো বোতাম খুলে গলার টাইটা আলগা করে নামিয়ে নিয়েছে সৌরদীপ...
-তোর আজ সুইমিং নেই?
-না।ওরা পুলের জল বদলাবে।এখন দুদিন বন্ধ।
-আসবো তাহলে....তোরা সবাই আসছিস তো?
-হুম!আসবো।কি করবো বাড়িতে বসে?
-চল,বিকেলে দেখা হবে।বাই....
সৌরর বাড়ি একটু অভিজাত পাড়ায়।ও সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।পাড়ায় ঢোকার মুখেই দেখলো,রাস্তার ওপর একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে,বাক্সবন্দী কিছু আসবাবপত্র নামানো হচ্ছে তার থেকে।পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো জায়গাও নেই,সরু গলি।প্রতিবেশী পাড়ার সুবৃহৎ এই বাড়িটা বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা পড়ে থাকতো।দুজন মালী আর একজন দারোয়ানের রাজত্ব ছিলো।হঠাৎ করে সেই বাড়িতে এত হুড়োহুড়ির কারণ বুঝতে পারলো না সৌর।ও বিরক্ত হয়ে সাইকেলের ঘন্টা বাজাতে লাগলো....
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একটা গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা বলছিলো।সাইকেলের ঘন্টা শুনে মুখ বাড়িয়ে এগিয়ে এলো সৌরর কাছে।সৌর প্রায় দমবন্ধ করে চেয়ে রইলো তার দিকে।তার চোখের প্রখর জ্বালাময়ী তেজের সামনে,মুখ পর্যন্ত খুলতে ভুলে গেলো দাপুটে সৌর.....মেয়েটার মাথার দুদিক দিয়ে দুটো লম্বা বিনুনি ঝুলছে।একটা হলুদ টপ আর সবুজ রঙয়ের হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট পরে রয়েছে মেয়েটা।সৌরর সাইকেলের শব্দে বিরক্ত হয়ে সে বললো,
-কি ব্যাপার?এই যে!কি ব্যাপার!?
-না মানে,আমি যেতে পারছি না।এখান দিয়ে যাওয়ার জায়গাই নেই....
থতমত খেয়ে সৌর বললো।
-সাইকেল তো একটু উঠিয়েও নিয়ে যাওয়া যাবে।কিন্তু এই গাড়িটা কি উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে?
-না-না!সরি!
-হুম!একটু এডজাস্ট করো।সাইকেলটা একটু সাইড করে নিয়ে বেরিয়ে যাও।
মুখ একদম বন্ধ হয়ে গেলো সৌরর।অন্য সময় হলে কলকল করে মুখ চালিয়ে দিতো।আজ আর পারলোই না।এখন ও একদম চুপ করে সাইকেল থেকে নেমে পড়লো।পাশেই পাঁচিল রয়েছে।কিছুতেই ও ওইটুকু জায়গা দিয়ে সাইকেলটাকে বের করতে পারছে না।কিছুক্ষণ টানা-হেঁচড়া করার পর মেয়েটাই এগিয়ে এলো।পুরো ব্যাপারটা দেখে হাঁক দিলো,
-কাকু?
দরজার সামনে থেকে দারোয়ান একদৌড়ে উঠে এলো।
-বলো দিদিমণি!
-সাইকেলটা বেরোচ্ছে না।একটু দেখো তো।গাড়িটা একটু সামনের দিকে টানতে বলো।
-ফার্নিচার নামছে দিদিমণি,ভারী আলমারীটা অর্ধেক গাড়ির পিছনে,অর্ধেক রাস্তায়।এই অবস্থায় গাড়ি তো সরানো যাবে না।আমি দেখছি,সাইকেলটাকে বের করে দিচ্ছি।
দুদিক থেকে ধরে টেনেটুনে সৌরদীপের সাইকেলটাকে কোনোরকমে বের করা হলো।
-সরি!
এবার মেয়েটাই এগিয়ে এসে বললো।
-নানা!ঠিক আছে।ওটা কোনো ব্যাপার না।এ পাড়ায় নতুন?
হাসিমুখে সৌর বললো....
-নতুন!!
হেসে ফেললো মেয়েটা!
-না।একেবারেই না।বড় ঠাকুরদাদার বাড়ি।আমরাই বাইরে থাকতাম।আজই ফিরলাম।সকালে আমরা এসেছি,এখন এইসব ফার্নিচার নিয়ে যুদ্ধ চলছে।সরি তোমার একটু অসুবিধে হয়ে গেলো।আসলে প্যাসেজটা এত্ত সরু....
-নানা!ইটস ওকে!!এটুকু এডজাস্ট তো করাই যায়।বাই দা ওয়ে,আমি সৌরদীপ।পাড়ার আর একটু ভিতর দিকে আমার বাড়ি।
-ওকে!আমি তিলোত্তমা।স্কুল থেকে ফিরছো?
-হুম!টুয়েলভ!আর খুব বেশিদিন নেই আমার স্কুলজীবন।
কথা বলতে-বলতেই সাইকেলে উঠে বসলো সৌর....
-আমার আরও দুটো বছর।ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিলাম,কিন্তু তারপরই বাবার কলকাতায় ট্রান্সফার।এবার আবার এখানে নতুন করে শুরু করতে হবে।
-আচ্ছা!!পাশাপাশি পাড়া যখন,দেখা তো হবেই!
-এই সোনামা....
একজন ভদ্রমহিলার ডাকে সৌর আর তিলোত্তমা একসঙ্গে ওপরের ঝুলবারান্দার দিকে চাইলো।
-আসছি মা!আমার মা ডাকছে!বাই...
-টাটা....
তিলোত্তমা দৌড়ে ঢুকতে গেলো বাড়ির ভিতরে।সৌর সাইকেলে প্যাডেল করে কিছুটা এগিয়েও,গলির বাঁকের মুখে পৌঁছে আবার ব্রেক মারলো সাইকেলে।একটুখানি ফিরে চাইলো পিছন দিকে।তখন আর রাস্তায় সে দাঁড়িয়ে নেই।শুন্য রাস্তা....
গলার আলগা ফাঁস দেওয়া টাইটা একেবারে খুলে দিলো ও।শার্টের কলারের দুপাশ দিয়ে ওরা ঝুলতে লাগলো....
মৃদু হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপতে থাকা সৌরদীপ,নাকের ওপর দিয়ে তর্জনীটা একবার চালিয়ে নিলো।তারপর প্যাডেল করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো নিজের বাড়ির পথে....
(চলবে....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন