অসমাপ্ত
দশম পর্ব
সাথী দাস
বিচারকমন্ডলীর দিক থেকে ভেসে আসা একের পর এক কথা,প্রশ্নবাণ,সবকিছুর উত্তর দিয়ে যখন বাইরে বেরোলো সমুদ্র,তখন বিকেল চারটে বেজে গেছে।বাইরে বেরিয়ে ভিড়ের মাঝেও চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলো ও।ছোট-ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মায়েরা এসেছে।ওর বয়সী যারা,তাদের সঙ্গে বাবা-দাদা বা বন্ধু রয়েছে।এখানে সমুদ্রই একমাত্র অনাথ।পিঠে ব্যাগটা তুলে নিতে যাচ্ছিলো সমুদ্র।হঠাৎ করেই পিছন থেকে ডাক শুনতে পেয়ে ও ঘুরে তাকালো,
-মিস্টার সমুদ্র বাসু?
-স্যার আপনি?!
-এদিকে এসো!
গ্রীনরুমের দিকে উনি ডেকে নিয়ে গেলেন সমুদ্রকে।কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-জীবন বাজি রেখে দিয়েছো তুমি।অভিভাবকের পরোয়া না করে,নিজের ভবিষ্যতের পরোয়া না করে,এই বয়সে ঝোঁকের মাথায়,অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো।এখান থেকে তোমার কতদূর কি হবে,জানা নেই আমার।তুমি এই রিয়্যালিটি শো-কে কতটা মিথ্যের জালে জড়িয়ে টি-আর-পি পাইয়ে দিতে পারবে,আমি এখনই বলতে পারছি না।এখানে প্রকৃতপক্ষে গুণীর কতটা কদর হয়,তার কোনো নূন্যতম ধারণাও,তোমার নেই সমুদ্র।দু-সপ্তাহের মধ্যেই এরা তোমাকে ফাইনাল কল পাঠাবে।হ্যাঁ কিংবা না,যেটাই হোক।যদি তুমি এই সিজনে আসো,আমার চেয়ে খুশি বোধহয় আর কেউ হবে না।কিন্তু যদি এদের দিক থেকে তুমি পজিটিভ কোনো উত্তর না পাও,এই আমার কার্ড রাখো,আমার সঙ্গে তুমি যোগাযোগ করবে।বাকিটা আমি বুঝে নেবো!সেটা ওয়াইল্ড-কার্ড এন্ট্রি হিসেবেই হোক,বা অন্য যে কোনোভাবে।আমার সাহায্য তুমি পাবে।আসলে জহুরীর চোখ তো,আমার রত্ন চিনতে ভুল হয় না সমুদ্র।কিন্তু বয়স হয়েছে তো,তাই আমার মতামতের গুরুত্ব এখন বড়ই কম।আমাকে শুধুমাত্র রাখা হয়,এককালে অর্জন করা আমার নামটুকুর জন্য।আমাদের সময়ে এতসব স্পনসর,পার্টনার,মার্কেটিং,প্রোমোশন,টি আর পি,এতকিছু আমরা বুঝতামই না।আমরা শুধু গুণের কদর করতাম।তুমি নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ভিতরে যা বলে এলে,তারপর তো....
-আমায় ক্ষমা করবেন স্যার।ওরা বারবার আমার স্ট্রাগল জানতে চাইছিলো।আমি একা কেন,আমার সঙ্গে বাড়ির লোক নেই কেন,পরীক্ষা ছেড়ে এখানে কেন,জানতে চাইছিলো।কি বলতাম আমি?!এখানে আসার জন্য বাবা-মাকে নিয়ে সামান্য একটু মিথ্যে বলতে হয়েছে আমায়,তাও এমন একজনকে,যাকে আমি কোনদিনও মিথ্যে বলি না।কিন্তু ন্যাশনাল টিভিতে অন ক্যামেরা,আমি আমার বাবা-মাকে ছোট করতে পারবো না।কারণ,আমার স্টোরি তো ওইরকম হৃদয়বিদারক কিছু নয় স্যার।না খেতে পাওয়া ঘরের ছেলে নই আমি।আমি যখন যা চেয়েছি,ফোন,কম্পিউটার,এক্সপেন্সিভ হেডফোন,পকেটমানি,জামাকাপড়,নূন্যতম বিলাসিতা,সবই আমার বাবা দিয়েছে আমায়।যেটা পাইনি,সেটা হলো মেন্টাল সাপোর্ট!গানকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য,পড়াশোনা-চাকরি,এইসব গতানুগতিকতার বাইরে বেরোনোর জন্য,যে প্রবল একটা মানসিক শক্তি প্রয়োজন,সেটা আমাকে তারা দেয়নি।তাছাড়া আর সবই দিয়েছে।আমার মাথার ওপর ছাদ আছে,দোতলা বাড়ি আমাদের।পায়ের তলায় জমি আছে,মূল্যবান টাইলস বসানো তাতে,আমার ঘরের মেঝেতে যে মার্বেল বসানো,তাতে আয়না পালিশ করা,হাঁটলে তার ওপর আমার ছায়া পড়ে।পেটে প্রয়োজনের অতিরিক্তই খাদ্য আছে।নিজের জেদের কারণে আমি অভুক্ত থেকেছি হয়তো,তখন মাথা গরম থাকলে অত খিদে-তৃষ্ণা পায় না।কিন্তু খেতে পাইনি,বা অভাবের তাড়নায় মা নিজে না খেয়ে,তার মুখের খাবারটুকু আমাকে খাইয়ে দিয়েছে,বা বিনা বেতনে আমার গানের শিক্ষক আমায় গান শিখিয়েছেন,বা ভাঙা হারমোনিয়ামে আমি গান শিখেছি,শুনে-শুনে শিখেছি,এসব গল্প আমি কোথায় পাবো স্যার?!আমি যা নই,তা নই।আমি সুস্থভাবে-স্বাভাবিকভাবে প্রতিপালিত একজন সুখী সন্তান।আর বাকি যেটুকু সাপোর্ট তারা আমায় করেননি,সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।তারা আমার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছেন,আমাকে জীবনে সুখী দেখতে চেয়েছেন,সফল দেখতে চেয়েছেন,অন্যায় নয়।কিন্তু আমি নিজেই এই লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছি,অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছি,সেই দায় সম্পূর্ণ আমার।আমি ওই দশটা-পাঁচটার অফিসে দম আটকে মরে যাবো স্যার!আমার দ্বারা ওইসব হবে যেন।আমি পারবোই না।কিন্তু এটাই আমি আমার বাবা-মাকে,কিছুতেই বোঝাতে পারিনি।তার মানে এই নয়,সেসব পারিবারিক ব্যক্তিগত ব্যাপারকে সামনে রেখে,আমি এই রিয়েলিটি শো-তে আসবো।ন্যাশনাল টিভিতে হোক,বা জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে,বাবা-মাকে ছোট করে,আমি বড় হতে পারবো না স্যার!!তারা যাই হোক,যেমনই হোক,আমারই....তাই আমি তাদের সামনে রেখে,কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে,সমবেদনা কুড়িয়ে, কোনোরকম সাফল্য পেতে চাই না।আমার কাজের কি কোনো মূল্য নেই?!মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও কিন্তু লড়াই থাকে স্যার,শুধু তাদের লড়াইয়ের সংজ্ঞাটা অন্যরকম হয়....আমার কন্ঠ,আমার কাজ,আগামী দিনে আমার পরিচয় তৈরি করুক।কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে লোককে কাঁদানো,সমবেদনা আদায় করা,আমার দ্বারা সম্ভব নয়....
কিছুক্ষণ একভাবে ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন,একটু আগে বিচারকের আসনে বসে থাকা প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞ মানুষটি।সত্যিই অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও,আয়োজকরা এর মুখ থেকে টি আর পি পাওয়ার মতো একটাও ঘটনাপ্রবাহ বের করতে পারেননি।আর এটাই ওনার ভয়।এই মার্কেটিং-এর যুগে,টি.আর.পির কবলে পড়ে,এইরকম একটা প্রতিভা,হারিয়ে না যায়।কিন্তু বড় জেদী যে এই ছেলে।কিছুতেই নিজের দুর্বলতাকে জনসমকক্ষে বের করবে না।একে বোঝানো যাবে না,যে বর্তমান যুগে শুধুমাত্র প্রতিভার মূল্য কেউ দেয় না।সেই প্রতিভাকে তুলে ধরার নেপথ্যে,অনেকরকম নিম্নমানের বাণিজ্য কাজ করে।উনি ভালোভাবে দেখলেন ছেলেটিকে।একমাথা ঝাঁকড়া চুল,চোখে একটা মূল্যবান ফ্রেমের চশমা,চোখমুখ একটু বসা,হয়তো মানসিক চাপে খাওয়া-ঘুম নেই ছেলেটির।যেখানে কাউকেই পাশে পায়নি,সেখানে একা-একা এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে,ওকে নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।সমুদ্রর কাঁধে হাত রেখে উনি বললেন,
-দিন পনেরো পর আমাকে তুমি একটা ফোন করবে।নানারকম ব্যস্ততায় আমি হয়তো ভুলে যেতে পারি,কিন্তু তুমি আমাকে ফোন করবেই।কেমন?
-করবো স্যার!থ্যাঙ্কু!আমার সত্যিই একটা সুযোগের ভীষণ প্রয়োজন।নইলে বাবা-মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার মতো,আমার আর মুখ থাকবে না।
-বুঝেছি!!গুড লাক ইয়ং ম্যান!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
দ্রুতপায়ে চলে যাচ্ছিলেন উনি।এই ছেলেটির গভীর-স্বচ্ছ দুটি চোখে কত আশা,কত স্বপ্ন প্রোথিত রয়েছে।উনি দেখতে পেলেন সেই দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্নের আভাস!তাই আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না ওর সামনে।কিভাবে দাঁড়াবেন!!কিভাবে একে বলবেন,যে টপ-থার্টির মধ্যে,টপ টোয়েন্টি-ফাইভ আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।বাকি রয়েছে শুধুমাত্র পাঁচটা আসন।যত লড়াই মাত্র ওই পাঁচটা আসনের জন্যই।যার জীবনে যত বেদনা,যে অনুষ্ঠানকে যত বেশি টি.আর.পি.দিতে পারবে,দর্শককে কাঁদাতে পারবে,যার এলিমিনেশনে যত বিতর্ক তৈরি হবে,তার সুযোগ ততই বেশি।রিয়্যালিটি শো গুণের পাশাপাশি রসদ চায়,চটকদার মশলা চায়,আর চায় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য প্রবল উন্মাদনা তৈরি করতে।চায় প্রতিযোগির প্রবেশমূল্য বাবদ টাকার অঙ্কটা।সেই কারণেই এই প্রতারণা,ছলনা বা সুবর্ণ সুযোগের হাতছানি।আর সেই রকম একটা প্ল্যাটফর্মে,এই ছেলেটি শুধুমাত্র নিজের গগনচুম্বী প্রতিভাকে আশ্রয় করে,যুদ্ধ করতে চাইছে।আবেগী সরল ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভেবে,চোখে জল এসে যাচ্ছিলো ওনার।তাই উনি সমুদ্রর সামনে থেকে সরে যেতে চাইছিলেন তাড়াতাড়ি।কিন্তু আবার ফিরতে হলো তাকে,সমুদ্রেরই ডাকে....
-স্যার...
-বলো?
-যখন ফোন করবো,আমার সমুদ্র নামটা আপনার মনে থাকবে তো?কি বলবো আমি?যা আপনাকে সহজেই আমার কথা মনে করিয়ে দেবে?!
একটু হাসলেন প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞ সেই ব্যক্তি....
-যুগের সঙ্গে তাল মেলাও সমুদ্র।আমি মানুষটা প্রবীণ,কিন্তু আমার মনটা চিরসবুজ।জানো তো,আমাদের মতো শিল্পীদের কোনোদিনও বয়স হয় না।আমরা প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রেমে পড়ি।নিজেদের সৃষ্টির প্রেমে।নইলে সৃষ্টি করতে পারবো না যে।যদি আমাকেই জিজ্ঞেস করো,তবে তোমায় আমি একটা জমকালো নাম দেবো।আশা করবো,একদিন এই নামটা গানের জগতে,নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে।
হেসে ফেললো সমুদ্র,আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেছে।
-কি নাম স্যার?
-যেদিন ফোন করবে সেদিন বোলো,স্যার,মনে আছে আমাকে?আমি সমুদ্র বলছি!আপনি দিন পনেরো আগে আমায় দেখেছিলেন।আমি ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছিলাম আপনার শিল্পীসত্তার অববাহিকায়।সেদিন কোনো নবীন হয়তো আমাকে বোঝেনি,কিন্তু প্রবীণ আপনি আমাকে বুঝেছিলেন।সমুদ্রের ওপরের উদ্দাম ঢেউয়ের গভীরে যে প্রশান্তি বিরাজ করছিলো,তার অনন্ত নৈঃশব্দ,তার সুর-ছন্দ স্পর্শ করেছিলো আপনাকে।আপনিই আমায় ভেঙে নতুন করে সৃষ্টি করেছিলেন।আপনিই এই পৃথিবীর জন্য নবরূপে সাজিয়েছিলেন আমায়।আমি স্যাম বলছি,
"স্যাম-মেলোডি অফ দা সি.....",আমায় মনে আছে স্যার?!ব্যাস!!এটুকুই বলো।নেহাত আলঝেইমার হয়ে না গেলে,এটুকুই আমায় কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সমুদ্র....
চুপ করে গেলো সমুদ্র।আবেগে ওর গলা বুজে এসেছে।আজকের আগে কেউ কোনোদিনও ওকে এভাবে বলেনি।আর আজ এতবড় গুণী একজন মানুষের কাছ থেকে এটুকু প্রশংসায়,ও দিশেহারা হয়ে গেলো।আনন্দে কান্না পেয়ে গেলো।চশমার কাঁচের ওপর টুপ করে একফোঁটা জল এসে পড়লো।ঝাপসা হয়ে গেলো সবকিছু।চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিলো সমুদ্র।একটু এগিয়ে এসে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো,
-আরে-আরে করো কি?!
-কিছু না স্যার!একরকম জোর করেই আপনার একটু আশীর্বাদ আদায় করে নিলাম।যদি কোনোদিনও নিজের পরিচয় তৈরী করতে পারি স্যার,তবে এই নামেই আমায় পৃথিবী চিনবে।"স্যাম-মেলোডি অফ দা সি....",থ্যাঙ্কু স্যার!!
-ভালো থেকো।উইশ ইউ অল দা বেস্ট ইয়ং ম্যান!!
-থ্যাঙ্কু!
ধরা গলায় সমুদ্র বললো।ধীরে-ধীরে এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই ভদ্রলোক....পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে,বাইরে বেরিয়ে এলো সমুদ্র বসু....
বাইরে বেরোতেই বিকেলের পড়ন্ত রোদে,আবার সমুদ্রর খিদেটা চনমনিয়ে উঠলো।অটো স্ট্যান্ডের সামনেই ছোটখাটো একটা ভাতের হোটেল দেখে,ওখানেই ঢুকলো ও।ছোট বাটিতে একটু ট্যালটেলে জলের মতো ডাল,আর একটা ডিম দুটো আলু সহযোগে মোটা চালের ভাত,ওর গলা দিয়ে নামছিলো না।কিন্তু খিদের তাড়নায় তাই গলাধঃকরণ করে রাখলো ও।খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে মানিব্যাগ থেকে টাকা দিয়ে,নিজের ব্যাগটা আবার পিঠে তুলে নিলো।তারপর এগোলো স্টেশনের দিকে।মুঠোফোনটা অন করে ওইদিকে একভাবে চেয়ে থাকতে-থাকতে সমুদ্র আর খেয়াল করলো না,যে সেই বিশেষ মানুষটির দেওয়া মূল্যবান কার্ডটা টাকা বের করতে গিয়ে,ব্যাগ থেকে ওর পায়ের কাছে পড়ে গেছে।সৌরর একাধিক মেসেজ পড়তে-পড়তে আনমনে ওই কার্ডের ওপর দিয়েই হেঁটে বেরিয়ে গেলো সমুদ্র....সমুদ্র বেরিয়ে যাওয়ার পর একাধিক পথ চলতি মানুষের পদপিষ্ট হয়ে,পিচঢালা রাস্তায় হারিয়ে গেলো সেই কার্ড....
পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পর থেকে,মনটা এতটাই ভারী হয়ে রয়েছে,যে সৌর আর একবারও ফোন করেনি সমুকে।আজ বিকেলে সব বন্ধুদের একসঙ্গে বেরোনোর কথা ছিলো।পরীক্ষা শেষ,সবাই মিলে অনেক আনন্দ করা হবে,বহুদিন আগে থেকেই ওরা ঠিক করে রেখেছিলো।কিন্তু সৌর,ঋষি আর রূপকে না বলে এসেছে।ঋষি একটু চিন্তিত।ওর বাবা চাকরিসূত্রে পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকেন,অন্ধ্রপ্রদেশ,দক্ষিণ ভারতে।উনি বেশ কয়েকদিন ধরেই একটু অসুস্থ।এবার পরীক্ষা শেষ,ঋষি হয়তো কিছুদিনের জন্য মাকে নিয়ে বাবার কাছে যাবে।সেইসব প্রসঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলার ছিলো।রূপ আর নিশার সঙ্গেও বেরোনোর কথা ছিলো।কিন্তু সৌর সবাইকেই না বলে দিয়েছে।সমু প্রথম কারণ,আর দ্বিতীয় কারণ হলো মিছরি।মেয়েটা এত কাটা-কাটা কথা বলে,ওর প্রতিটা কথা ক্ষেত্রবিশেষে সৌরর মনের উন্মুক্ত ক্ষতর ওপরে,যেন একমুঠো নুন ছড়িয়ে দেয়।মাঝে-মাঝে তো সহ্যই করতে পারে না সৌর।সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলে মিছরি।তখন সৌর ওর ওপরে চিৎকারও করে ফেলে।কিন্তু তারপরই মিছরি ফোন না ধরলে,বা ফোন বন্ধ করে রাখলে,সৌর উন্মাদ হয় যায়।তখন আবার মিছরির কাছে যাওয়ার জন্যই,পাগল হয়ে যায় ও।কাল রাতে মিছরির মুখের ওপরে ফোন রেখে দেওয়ার পরও,অনেকবার ফোন করেছিলো মেয়েটা।সৌরই ধরেনি।ভোরবেলা মেসেজ করে পরীক্ষার জন্য শুভকামনা জানিয়েছিলো।মেসেজ দেখে ছেড়ে দিয়েছিলো সৌর।কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি।এবার বাড়ি ফিরে যেই সৌর ওকে ফোন করছে,ফোন বন্ধ!!কেমন মাথাটা গরম হয়!!এই সবকিছু মিলিয়ে সৌরর মনটা এতটাই খারাপ হয়ে রয়েছে,যে ও সেই তখন থেকেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে,বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে।সন্ধ্যে হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই।তাও ওঠেওনি ও,ঘরের আলোটাও জ্বালায়নি।আজকাল প্রায়ই ওর মনে হয়,জীবনে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াই ভালো।অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখলে,নিজের চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলটুকুও,নিজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়।বালিশ ভিজে গেলেও,যন্ত্রণারা বোধহয় অদৃশ্যই থাকে।অন্ধকারে মনে হয়,আমি আছিও-আবার নেইও!!বা হয়তো থেকেও নেই।অদ্ভুত একটা অনুভূতি।অন্ধকার রাজ্যে নিজের থেকে নিজে পালিয়ে থাকা যায়।নিজের সম্মুখীন হতে হয় না।আজ ভালোবাসার কাছ থেকে ভীষণরকম আহত সৌর,বন্ধুত্বের কাছ থেকেও।তাই নিজের আহত মনকে অন্ধকারেই লুকিয়ে রেখেছিলো ও।বারংবার ফোনের দিকেই হাত চলে যাচ্ছে।কতবার যে ও মিছরিকে ফোন করেছে,তার ইয়ত্তা নেই।প্রতিবারই ফোন বন্ধ আসছে।এর মধ্যেই মা বার দুয়েক এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেছে।উঠছি-উঠছি বলেও ওঠেনি সৌর।বালিশ-বিছানা আঁকড়েই পড়ে রয়েছে।চোখটা বালিশে মুছে নিয়ে,আরও একবার মিছরির নম্বরে ফোন করলো সৌর।এইবার রিং হচ্ছে,দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো ও,অবশেষে সে ধরলো ফোনটা।তার গলার স্বর শোনার জন্য ধড়ফড় করতে লাগলো সৌরর হৃদপিন্ডটা।কিন্তু সে ফোন ধরেও চুপ করেই রইলো।সৌরও আর একটা কথাও বললো না....বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর হার মানলো সৌরই।ফোনের একেবারে কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,
-সরি মিছরি!প্লিজ....
-আর কিছু?
-হুম!বেরোচ্ছি আমি!তোমায় এক্ষুণি দেখতে চাই!এক্ষুণিই....তুমি এসো!
-না....
-প্লিজ!!
-আমার সময় নেই!
-কান ধরে দাঁড়াবো তোমার সামনে,প্রমিস!সেই সেদিনের মতো।প্লিজ,একবার এসো.....
হেসে ফেললো তিলোত্তমা।
-নাচের ক্লাস আছে।সত্যিই আজ আমার সময় নেই সৌর।
-আমার জন্য একটুখানি সময় বের করতে পারবে না মিছরি?!কতদিন তোমায় দেখি না।ভিডিও কলে চোখের দেখা দেখে কি আর,তোমায় ছুঁয়ে দেখার সাধ মেটে?!প্লিজ এসো।আমি তোমার খুব বেশি সময় নেবো না!
-আসছি!কিন্তু বেশি সময় দিতে পারবো না,আগেই বলে দিলাম....
-তুমি যেটুকু সময় দেবে,সেটুকুই অনেক।আমি তার বেশি কিছু চাইবোও না।লাভ ইউ মিছরি!!চলে এসো আমাদের জায়গায়....
-লাভ ইউ টু,চলো বেরোও...আমিও বেরোচ্ছি!!
ফোনটা রেখে উঠে পড়লো সৌর।ঘরের আলো জ্বালিয়ে একটা জামা গায়ে গলিয়ে নিলো।জিন্সের পকেটে মানিব্যাগ আর ফোনটা ঢুকিয়ে নিলো।আজ পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময়,মিছরির জন্য একটা সুগন্ধী আর পছন্দ করে একজোড়া হাল ফ্যাশনের কানের দুল কিনেছিলো সৌর।ওয়ার্ডরোব থেকে ওগুলোকে বের করতে গেলো ও।তখনই ওর চোখ পড়লো ওয়ার্ডরোবের পাল্লার ভিতরকার দেওয়ালের দিকে।একবার হাসিমুখে ওখানে চোখ রাখলো ও।তারপর হাত রাখলো নিজের সাজানো ভবিষ্যতের ওপরে।হাতে লেখা একটা কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটানো রয়েছে ওয়ার্ডরোবের দেওয়ালে।যাতে লেখা রয়েছে,
"জীবনের অসমাপ্ত কতগুলো লক্ষ্য।যেগুলো আমাকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে....স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরী,নিজের উপার্জনে একটা গাড়ি,তারপর সুখী.....সম্পূর্ণ জীবন।"
এটা বেশ কিছুদিন আগে লিখে এখানে আটকিয়ে রেখেছিলো সৌর।ওর স্যার বলেন,জীবনে লক্ষ্য স্থির না করলে,লক্ষ্যপূরণ করা যায় না।হয়তো অধরা থেকে যায় অনেক কাঙ্খিত বস্তু,অসমাপ্ত ইচ্ছে।তাই সর্বপ্রথম লক্ষ্যস্থির করতে হয়।সেদিনের পরই বাড়ি ফিরে নিজের লক্ষ্যটা স্থির করে ফেলেছিলো সৌর।জীবনটাকে একেবারে ছকে বেঁধে ফেলেছিলো।তখনও ওর জীবনে মিছরি আসেনি।কিন্তু মিছরি আসার কিছুদিন আগেই,জলে নিজেকে প্রমাণ করলো সৌর।তারপরই ওর জীবনে মিছরির আগমন।তারপরই চাকরির কথা চলছে।পেনটা হাতে তুলে নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দুটো শব্দ কেটে দিলো সৌর।পড়ে রইলো স্কুল,চাকরি,নিজের গাড়ি,আর সুখী...সম্পূর্ণ জীবন।এই কয়েকটি মাত্র শব্দ।এই চাকরিটা ওকে পেতেই হবে।হাতের ক্ষতর দিকে একবার চাইলো সৌর।পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পরই স্যার ফোন করেছিলেন,সৌর কাল থেকেই প্র্যাকটিস করবে কিনা জানতে চেয়েছিলেন।কিন্তু হাতটা না শুকোলে জলে নামা যাবে না।তাই দিন দুয়েক সময় চেয়ে নিয়েছে সৌর।তারপরই ওর যুদ্ধ শুরু হবে!মিছরিরও ইন্টার-পুল কম্পেটিশনের সময় প্রায় হয়ে এলো,আর ওর তো জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।আর এটা ওকে জিততেই হবে,নিজের জন্য না হোক,অন্তত মিছরিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য!চাকরি আর মিছরি,এই দুটো পেয়ে গেলেই,সৌরর জীবনের কোনো অধ্যায় আর অসমাপ্ত থাকবে না।বাকি গ্রাজুয়েশন...সে চাকরি করতে-করতেই করে নিতে হবে।কিন্তু ওই চাকরিটা ওই চাই!সেই সঙ্গে রাজকন্যাও!!সুখী...সম্পূর্ণ জীবন,এই শব্দটুকুর ওপরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ওয়ার্ডরোব বন্ধ করে দিলো সৌর....দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে নামলো নীচে,
-মা আমি একটু বেরোলাম!
-কোথায় চললি এই সন্ধ্যেবেলা?আমি তোর জন্য মোচার চপ ভাজছি।একটু খাবি না?
-মানে যা খুশি বলো!?প্র্যাকটিসে যাচ্ছি না বলে,যা খুশি খাইয়ে যাবে আমায়?ডায়েটের কোনো ব্যাপারই নেই?!কি চাইছো?বাড়িতে থেকে বেশ একটা ছোটখাটো ভুঁড়ি বাগিয়ে ফেলি!!
রান্নাঘরে ঢুকে পিছন থেকে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো সৌর....ওর মা তখন গরম-গরম চপ ভেজে কড়াই থেকে পাশের থালায় তুলে রাখছে...
-ধুর!!সারা বছর তোর এই এক কথা!আজ মিলিটারি ডায়েট,কাল স্ট্রিক্ট-ডায়েট,পরশু সেমি-ডায়েট!ওই ফল আর প্রোটিন গিলেই থাকো তুমি!!একটা মাত্র ছেলে আমার,তাকে এ জীবনে আর রেঁধে-বেড়ে খাইয়ে সুখ পেলাম না!!
-উফফ!মা!এইরকম করে বললে,না খেয়ে পারা যায়!?দাও,একটা খাইয়ে দাও!
একটা মোচার চপ নিয়ে ফুঁ দিয়ে ছেলের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে সৌরর মা বললো,
-তা কোথায় চললি?একটু পরেই তো বাবা এসে যাবে।পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করবে।এখন একটু বাড়ি থাকলে হতো না?বেরোতেই হবে?
-প্লিজ মা,বাবাকে একটু সামলে নিও।আমার একটু দরকারী কাজ আছে!বেরোতেই হবে।
-কি তোমার দরকারী কাজ আমি কি আর জানি না!?
-তাই?জানো?
-সব জানি!পাড়ায় খবর দেওয়ার লোকের অভাব আছে নাকি!!আমার কানে উড়ো খবর সবই আসে!
মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সৌর।শুধু বললো,
-আসছি মা!!
-বাবাকে কি বলবো?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে হেসে ফেললো সৌর।তারপর ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিয়ে বললো,
-আমি আমার টিকালো নাক কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে গলানো একদম পছন্দ করি না।একজন স্ত্রী তার স্বামীকে একা বাড়িতে কি বলবে,তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই!!ও তোমাদের ব্যাপার,তোমরাই বুঝে নিও!আর বাবা বেশি কথা বলতে চাইলে,তোমার হাতের তৈরি গরম-গরম মোচার চপ তো আছেই।মুখে ঢুকিয়ে দিও,চা করে দিও।ওগুলো নিয়েই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবে,ওগুলো আয়েশ করে খেতে-খেতেই আমি চলে আসবো।আমার আসার আগেই তোমাদের প্রাইভেট কথা সেরে নিও কিন্তু....আমি বাইরে থেকে নক করেই আসবো....
সৌরর বাবা-মা উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে বরাবরই খোলামেলাভাবে,সহজভাবে কথা বলেন।তাই বাবা-মাকে না জানিয়ে,আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি সৌরর।বাবাকে একটু ভয় পেয়ে সমীহ করে চললেও,মা তো সৌরর একেবারে বন্ধুসম।মাকে ওই কথাটুকু বলেই,উড়ন্ত খুন্তি প্রবল বেগে ধেয়ে আসার আগেই,তুরতুর করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে পড়লো সৌর।মা তখন চেঁচাচ্ছে।কিন্তু সৌর ঠিক জানে,মা হাসতে-হাসতেই চিৎকার করছে...
একটু হেসে সাইকেলের লক খুলে মিছরির সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেলো সৌর....
-পছন্দ হয়েছে?
-যদিও দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো!তবে মনে হচ্ছে খুব সুন্দর!
-পরবে না?
-পরছি....
নিজের খালি কান দুটোতে সৌরর আনা দুলজোড়া পরে নিলো তিলোত্তমা....
-ভালো লাগছে আমায়?
-কি করে বুঝবো?অন্ধকার তো!!তোমায় দেখতেই পাচ্ছি না।তাতে কি!অনুভব তো করতে পারি?
এগিয়ে গিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে মিছরির কান স্পর্শ করলো সৌর,জড়িয়ে ধরলো ওর কোমর।সৌরর উষ্ণ স্পর্শে তিলোত্তমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো।ও দুহাতে জড়িয়ে ধরলো সৌরর গলা।সেই মুহূর্তেই সৌরর পকেটে রাখা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।ওইরকম একটা উত্তেজক-সংবেদনশীল মুহূর্ত,নিমেষেই সৌরর কাছে প্রবল বিরক্তিকর একটা মুহূর্তে পরিণত হলো।ও তাড়াতাড়ি ফোনটা পকেট থেকে বের করলো,স্ক্রিন জানান দিচ্ছে,সমুদ্র ফোন করছে....
ব্যস্ত হয়ে উঠলো সৌর।মিছরির দুটো হাত ওর গলায় তখনও জড়ানো ছিলো।ও ওই দুটো হাতের মধ্যে থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উদ্যত হলো,
-মিছরি,এক মিনিট!!
তিলোত্তমার কাছ থেকে সরে এসে সৌর ফোন ধরে বললো,
-কোথায় তুই?
-স্টেশনে ভাই।সবে ট্রেন থেকে নামলাম!ভাই সরি!!
-জোড়া শিবমন্দিরের পিছনে আছি আমি।চলে আয় এখানে।বাড়িতে একা যাস না!আমি যাবো তোর সঙ্গে....
চমকে উঠলো তিলোত্তমা....গম্ভীর হয়ে গেলো ও।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সৌরর থেকে খানিকটা দূরে....
-না ভাই!বাড়িতে ঢুকলে এখন যা হবে,আমি জানি।আমার বাবা-মা আমার সঙ্গে যা খুশি করুক।বকুক-মারুক-ধরুক,আমি শুনে নেবো।কিন্তু তোর সামনে ওসব সহ্য হবে না।আমি একাই যাবো ওদের সামনে।তোকে ফোন করে জানালাম শুধু।কাল থেকে তুই পাগলের মতো মেসেজ করছিস.... তাই আসার পর....
-কাজটা ঠিক করলি না ভাই?আমি এখনও সহ্য করতে পারছি না!!কোনোদিনও মানতে পারবো না...
-কি জানি সৌর!যদি সত্যিই এই সুযোগটা পেয়ে যাই,তবে এটাই হয়তো আমার জীবনে করা সবচেয়ে সঠিক কাজ হবে....
-হুম!যা,বাড়ি যা!আমি রাতে ফোন করছি!
-ওকে!!
ফোনটা রেখে পিছনে ঘুরলো সৌর।কিন্তু মিছরি দাঁড়িয়ে নেই।ও অবাক হয়ে দৌড়ে বেরোলো রাস্তায়।একটু দূরেই দেখলো,মিছরি হেঁটে চলে যাচ্ছে।সৌর ছুটলো ওইদিকে...ওর কাছে পৌঁছেই টেনে ধরলো ওর হাত,
-ওই!!আমাকে না বলে কোথায় যাচ্ছ?
-তো কি করতাম সৌর?আমি আমার নাচের ক্লাস আধ ঘন্টা পিছিয়ে দিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি,আর তুমি তোমার বন্ধুকে এখানে ডাকছো!!আমি জোড়া-শিবমন্দিরের পিছনে আছি।এখানে চলে আয়!!তাহলে আমাকে ডাকার কি দরকার ছিলো?ওকে নিয়েই থাকতে পারতে!ওর জীবনের সমস্তরকম সমস্যার সমাধান করতে পারতে!!
-ও তো আসছে না মিছরি!!
-সেটা পরের কথা সৌর!ও আসছে না,সেটা পরের কথা।তুমি ওকে আমাদের সময়ের মধ্যে আসতে বলেছো,এটা আমি শুনেছি!আমি আমার নাচের ক্লাস,আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি থেকে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে,তোমার জন্য সময় বের করেছিলাম সৌর....
-উফফ!!উদ্ধার করে দিয়েছো আমায়!!
সকাল থেকেই বড্ড মনখারাপ সৌরর।এই একটা স্বভাব মিছরির ভীষণই খারাপ।ও কিছুতেই মানুষের দুর্বলতা,কষ্ট,ভালো লাগা-খারাপ লাগাটা বোঝে না।
মানুষের মন জুগিয়ে চলতে নাই বা পারুক,কিন্তু জীবনের কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মন বুঝে তো চললেও পারে!!অন্তত সৌরর মনের দিকটা ও বুঝবে না!?কিন্তু ও সবসময় নিজের দিকটাই ভাবে....আর পারলো না সৌর।ধৈর্য হারিয়ে ফেললো....
-হোয়াট!!কি বললে তুমি?তোমায় উদ্ধার করে দিয়েছি!!
-তো কি বলবো মিছরি?!তোমার নাচের ক্লাস,
তোমার জিম,তোমায় যোগা,তোমার টিউশন,তোমার পার্লার,তোমার সব থাকতে পারে,আমার থাকতে পারে না?!আমার বন্ধুবান্ধব,আমার খেলা,আমার আড্ডা,আমার চায়ের দোকানের জমাটি আসর,সব আছে!তুমি ছাড়াও আমার একটা জীবন আছে মিছরি....
-হ্যাঁ তো থাকুক না!!আমি তো তোমার পরিসরের মধ্যে ঢুকছি না সৌর।কিন্তু তুমি যখন আমাকে ডেকেছো,আমি আশা করবো,এই সময়টুকু তুমি আমাকেই দেবে।এই সময়টুকু তুমি সম্পূর্ণ আমার।আমাদের ব্যক্তিগত সময়ের মধ্যে তোমার বন্ধুরা আসবে কেন?ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায়,বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের জায়গায়।
-ওরা আমার জীবন মিছরি!সমু একটা ক্রাইসিসের মধ্যে আছে।সেইজন্য আমিও ভালো থাকতে পারছি না।মনটা ভালো নেই আমার।একটু বোঝার চেষ্টা করো আমায়।তোমাকে কি সব বলে-বলে বোঝাতে হবে সোনা?তুমি আমায় বুঝবে না?!আমার জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টে বাবা-মায়ের পরেই ওরা আছে,আমার বন্ধুরা....
গলা কেঁপে গেলো সৌরর....মিছরি এগিয়ে এলো সৌরর কাছে,দৃঢ়কণ্ঠে বললো,
-আমি প্রায়োরিটি লিস্ট খুব ভালোভাবে বুঝি সৌর।আমার জীবনেও অনেক কিছুর প্রায়োরিটি আছে।কিন্তু তাদের আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে দিই না।প্রত্যেকের জায়গা আলাদা।আমার জীবনেও সবকিছুর গুরুত্ব সমান।আমার বাবাই-মা,আমার নাচ,আমার কেরিয়ার,তুমিও....আমি সবকিছুকে একসঙ্গে নিয়ে চললেও,কেউ কারোর পরিসরে ঢুকবে না।কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার নাচের ক্লাস থেকে সময় কমিয়ে,টেনে-হিঁচড়ে তোমার জন্য সময় বের করেছিলাম সৌর।তাতেই আমার জীবনে তোমার মূল্য ঠিক কতখানি,এটা তোমার বুঝে যাওয়া উচিত ছিলো!বাই....
-এভাবে যেও না প্লিজ মিছরি!
-এই ছাড়ো তো!!
সৌরর হাতের মধ্যে থেকে নিজের হাতটা টেনে বের করে নিলো মিছরি....
-প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ,এতদিন পর দেখা হলো,শুধু ঝগড়া করেই চলে যাবে!?প্লিজ না....
সৌর ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে টেনে নিয়ে গেলো আবার নিজেদের জায়গায়....
-উফফ!ছাড়ো সৌর!
-উঁহু!
-যেতে হবে আমাকে।আন্টি এসে বসে থাকবে।
-আর একটু....
সৌর মিছরিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো....প্রচন্ড তেজের চোটে কিছুক্ষণ দাপিয়ে স্থির হলো তিলোত্তমা।দুহাতে আঁকড়ে ধরলো সৌরকে....
-তোমায় আমি ভালোবাসি মিছরি!তোমার কাছে এসেই তো আমি সব বলবো বলো!!তুমি এমন কোরো না আমার সঙ্গে।একটু আমাকে বোঝার চেষ্টা করো....প্লিজ...
-আচ্ছা ঠিক আছে।বাদ দাও ওসব।বাইরের ঝামেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যত্তসব উটকো ঝামেলা!!ছাড়ো!
তিলোত্তমা সৌরকে টেনে তুলে ওর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
-ঠিক আছে?খুশি তো?!এবার আমি যাই?
-হুম।এসো!মিছরি শোনো....
-কি?
-আমার পরীক্ষার পর তুমি আমায় কিছু বলবে বলেছিলে....তোমার স্বপ্নের কথা...
-হুম,বলবো তো।একদিন বাইরে কোথাও মিট করো।সব বলবো...এভাবে অন্ধকারে নিজের হাত-পা দেখতে পাচ্ছি না,তোমায় দেখতে পাচ্ছি না,মশার উৎপাত,এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বলতে পারবো না....সরি....
হেসে ফেললো সৌর....
-আচ্ছা,আমার বন্ধুরা তো তোমায় সেভাবে সামনাসামনি কখনও দেখেনি মিছরি।ওরা বলছিলো,তোমার সঙ্গে আলাপ করবে।তোমার কি একটু সময় হবে?মানে তুমি যদি আমার সঙ্গে আসো,আমার খুব ভালো লাগতো।
-সময়টা জানিয়ে দিও।আমি ওই সময় ফ্রি থাকলে,ভেবে দেখবো।
-ওকে!
-বাই!
দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো তিলোত্তমা।ওর নাচের ক্লাস আছে।আজ আর পিছন ঘুরে সৌরকে দেখার সময় হলো না ওর।তাই ও জানতেই পারলো না,যে ও গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত,সৌর ওর দিকেই চেয়েছিলো....
দরজা খুলেই কেঁপে উঠলো সমুর মা।দরজার সামনে মাথা নীচু করে ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।একটা কথাও বললেন না উনি।কাল থেকে সমুর বাবার সঙ্গে অশান্তিতে-ঝামেলায় ক্লান্ত উনি।কেঁদে-কেঁদে চোখমুখ ফুলে গেছে।আজ ছেলেকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছেলের বুকে।কেঁদে ফেললেন হু-হু করে....সমু দুহাতে জড়িয়ে ধরলো মাকে,
-তুই কি করলি বাবা?!শেষ পরীক্ষাটা দিলি না!!গোটা বছরটা নষ্ট করে ফেললি?!তোর বাবা তো কাল থেকে আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।দিনরাত বাড়িতে বসে থেকেও আমি নাকি তোকে মানুষ করতে পারিনি।তোকে স্বেচ্ছাচার করতে দিয়েছি।ছেলে কোথায় যাচ্ছে,কি করছে,কোনোদিকে হুঁশ নেই আমার।আমার আর ভালো লাগে না সমু!!এবার তুই গান ছেড়ে দে বাবা!এই গান-গান করে সংসারে এত্ত অশান্তি।রান্না-খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে....
চুপ করে গেলেন সমুর মা।ততক্ষণে সমুর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।মাকে ছেড়ে সমুদ্র এগিয়ে গেলো বাবার সামনে।মাথা নীচু করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।একটাও কথা বললো না,মাথা তুলে শুধু একবার বলতে গেলো "সরি বাবা!!" কিন্তু সমুদ্র মুখ খোলার আগেই ওর বাবা সজোরে একটা চড় মেরে বসলেন ছেলের গালে....
-ও কি করছো তুমি?এতবড় ছেলের গায়ে হাত তুলছ?
-অনেক দেরি করে ফেললাম এটা করতে।অনেক আগেই করা উচিত ছিলো।তাহলে আজ নিজের এতবড় ক্ষতিটা করার সাহস ও পেতো না....
চোখের জল পড়ে সমুদ্রর চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে।চুপ করে পড়ে-পড়ে বাবার হাতে মার খেতে থাকলো ও।একটাও কথা বললো না।মা টেনে সরিয়ে নিতে গেলেন ছেলেকে।কিন্তু উনি সামনে পড়ে যাওয়ায়,আঘাতটা ওনার ওপরেই এসে পড়লো।সমুদ্র টেনে সরিয়ে দিলো মাকে।
-মা তুমি সরে যাও...
-হ্যাঁ,সরে যাও তুমি!ওই দেবে আমার সব প্রশ্নের উত্তর।বল,স্কুলের মাইনে,টিউশনের মাইনে,বইপত্র-খাতাপত্র,গোটা একটা বছরের এত খরচ,আমার এত পরিশ্রম,তুই এইভাবে শেষ করে দিলি কেন?!যখন যা চাইছিস তাই,যখন মুখ ফুটে যেটা বলছিস,সেটাই তোর মুখের সামনে এনে হাজির করে দিচ্ছি আমি।তুই শুধু পড়াশোনাটা ঠিকমতো কর।নিজের ভবিষ্যৎটা তৈরি কর।আর কোনো কিছুর চিন্তা তোকে করতে হবে না।বাকি সবটা সামলে নেবো আমি!আর তুমি ছেলে বাপের জমিদারি দেখেছো,তাই না!!দিনরাত এক করে,ওভারটাইম করে সবদিক বজায় রাখার চেষ্টা করছি আমি।পেটেও খাচ্ছি,তোর ভবিষ্যতের জন্যও টাকা রাখছি,নিজেদের বৃদ্ধ বয়সের কথা ভাবছি,যাতে কাল তোর পরিবার হলে,তোর ওপর বেশি চাপ না পড়ে।রোগের চিকিৎসা,লোক-লৌকিকতা,আত্মীয়-স্বজন,দায়িত্ব-কর্তব্য,একজন পুরুষের জীবন সম্পর্কে কি জানিস তুই?কতটুকু জানিস?!নিজের বাড়িতে আছো,মাথার ওপর ছাদ আছে,পায়ের তলায় মাটি!অমনি মনে করছো এটাই বোধহয় নিশ্চিন্ত জীবন!এভাবেই জীবনটা কেটে যাবে।শুধু নিজের বাড়ি থাকলেই হয় না সমু!!ভবিষ্যতে কি বাড়ি কামড়ে খাবি?!তুই যখন তোর বর্তমানে উড়ে-উড়ে বেড়াচ্ছিস,আমি তখন আমার এই মস্তিষ্কে তোর ভবিষ্যৎ তৈরি করছি।আর মনে-মনে ভাবছি,তুই নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে,আমার পাশে এসে দাঁড়াবি।আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবি।মুখ বন্ধ করে সব করে যাচ্ছি বলে,বুঝতেও পারিস না,বাস্তবটা কতটা কঠিন!আরাম করে নরম বিছানায় শুয়ে গায়ক হবো,নায়ক হবো,ওইরকম অনেক দিবাস্বপ্ন দেখা যায়।দুদিন বাবার হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখো,বুঝে যাবে পৃথিবীটা কত কঠিন!!একটা পয়সা রোজগার করতে,কিভাবে মানুষকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়....
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র....
-বুঝেছি তো বাবা!খুব খিদে পাচ্ছিলো আজ।কেউ ডেকেও জিজ্ঞেস করেনি,ফিরেও তাকায়নি আমার দিকে।কেউ ওপর থেকে টেনে এনে খাওয়ার জন্য সাধ্যসাধনাও করেনি।তোমরা দুজন ছাড়া,পৃথিবীতে কেউ যে আমার খবর নেবে না,আমার থাকা না থাকায়,কারোর যে কিচ্ছু যাবে আসবে না,আমি জানি তো বাবা!!কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি না খেতে পেয়ে মরে গেলেও,জীবনে কিচ্ছু করতে না পারলেও,গান কিছুতেই ছাড়তে পারবো না।আমি মরে যাবো বাবা!!গান ছাড়ার থেকে,তুমি বরং আমাকে মারতে-মারতে মেরেই ফেলো....
-তোর লজ্জা নেই,নারে সমু?!এত বলার পরও,এত মার খাওয়ার পরও,ওই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস!!তুই এই দিনটা আর জীবনেও ফিরে পাবি?পরীক্ষাটাই দিলি না?!আমি তো ভাবতেই পারছি না!আমার অফিস কলিগরা,আত্মীয়-স্বজনরা জিজ্ঞেস করলে,কি বলবো আমি?!ছেলে আমার কাল গায়ক হবে,সেইজন্য আজ পরীক্ষা দেয়নি!!
কোনো উত্তর দিতে পারলো না সমুদ্র....চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো বাবার সামনে।বাবা মারতে-মারতে ওকে দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিয়েছিলো।মা কেঁদেই যাচ্ছে তখন থেকে....
-নাঃ!!তোকে আর কিচ্ছু বলার নেই সমু!ভেবেছিলাম,ছেলেটা আমার বড় হয়ে বাবার কষ্টটা অন্তত বুঝবে।কিন্তু আর কোনো আশা নেই এর কাছে।আমি একটা অকালকুষ্মান্ড জন্ম দিয়েছি....
দৌড়ে ঘরে চলে গেলো সমুর বাবা...কাঁদতে-কাঁদতে সমুদ্র মেঝেতেই বসে পড়লো।বাবার হাতে মার খেতে-খেতে ওর শার্ট ছিঁড়ে গেছে।মা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।মায়ের কোলে মাথা গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র...
রাতে মা ওপরে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে সমুদ্রকে।বাবা নাকি রাতে কিছুই খায়নি।মা-ও হয়তো খাবে না।বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়েছিলো সমুদ্র।বাবা এত মেরেছে,সারা গা ব্যথা করছে ওর।জ্বরও এসে গেছে মনে হয়।মাথা-গা-হাত-পা সব শিরশির করছে।ফোনটা বেজেই যাচ্ছে তখন থেকে।ঋষি-রূপ দুজনের সঙ্গেই কথা হয়েছে।ওদের মিথ্যে বলেছে সমুদ্র।এতসব ঝামেলার কথা আর কিছুই জানায়নি ওদের।কিন্তু এতক্ষণ সৌরই একবারও ফোন করেনি।এবার ফোন বাজতেই সমুদ্র বুঝতে পারলো,ফোনটা সৌরই করছে।ও আর স্ক্রিনের দিকে চাইলোও না।ফোনটা ধরেই বললো,
-বল!
-তুই বল!!
-কি বলবো?
-সব ঠিক আছে?
-হুম!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৌর বললো,
-কাকু তোর গায়ে হাত তুলেছে,নারে সমু?
আর কোনো উত্তর দিলো না সমুদ্র।ফোনটা মুখের সামনে চেপে ধরে হু-হু করে কেঁদে উঠলো শুধু....সৌরর বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো অজানা যন্ত্রণায়....
দিন তিনেক হয়ে গেছে সমুদ্রর সঙ্গে ওর বাবা কথা বলেন না।খুব প্রয়োজন ছাড়া সমুও খুব একটা নীচে নামে না।বাবা বাড়িতে থাকলে তো একেবারেই না।মা যতটা পারে,সমুকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে।সমু নিজে থেকে চায়নি।কিন্তু মা নিজেই গিটারটা ওপরে দিয়ে গেছে।বাবাকে ঠিক বোঝে না সমুদ্র।বাবা ওকে ক্ষমা করেছে কিনা,সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহসও ওর নেই।সেদিন দুপুরে ও গানের ডায়েরীটা খুলে চুপচাপ শুয়েছিলো বিছানায়।মাথার কাছের জানলাটা খোলা ছিলো।সেইদিকে একভাবে চেয়েছিলো ও।মাথায় ঘুরছিলো একাধিক শব্দের খেলা....হঠাৎ করে সৌর ফোন করলো ওকে,
-হুম?
-বিকেলে বেরোবি!
-নাঃ!
-আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি না সমু,বলছি!বিকেলে তুই বেরোবি!!দিনরাত ঘরের মধ্যে পড়ে আছিস কেন?আমরা কি মরে গেছি!
-আমি বেরোবো না!
-ঠিক আছে।আমি,ঋষি,রূপ তোর বাড়িতে আসছি।আমার সঙ্গে মিছরিও থাকবে।
-আবে তুই পাগল নাকি!!বাড়ির পরিস্থিতি ভালো না....
-তাহলে চুপচাপ বেরিয়ে আয়,সিসিডিতে।ঋষি আর রূপ অনেকদিন ধরেই মিছরির সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে।তুইও তো ওকে সেভাবে দেখিসনি।কাল থেকে আমরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাবো।ওর ইন্টার-পুল কম্পেটিশন,আমার প্র্যাকটিস,আর নিজেদের জন্য,তোদের জন্য খুব একটা সময় থাকবে না।তাই চলে আয় আজ।বিকেল পাঁচটা....না আসলে মনে থাকে যেন,সবশুদ্ধ তোর বাড়িতে গিয়ে উঠবো কিন্তু!
-আসবো-আসবো!!
-গুড!চল বাই!!
-ইয়ে মানে,একটু বেশিই ছোট না মিছরি?!
গাড়ির পিছন দিকের দরজাটা খুলে দিয়েছিলো তিলোত্তমা।গাড়িতে ঢোকার আগেই ওর উন্মুক্ত উরুর দিকে চেয়ে সৌর বলে উঠলো।তিলোত্তমার সাদাকালো রঙের ফিতে দেওয়া টপটায়,ঠিক বুকের ওপরে লেখা রয়েছে,"বি ইয়োরসেলফ!"সেইসঙ্গে ফেডেড-জিন্সের একটা হটপ্যান্ট পরে রয়েছে ও।মানে শরীরের নিম্নাঙ্গে যতটুকু আবরণ একেবারেই না থাকলে নয়,ঠিক ততটুকুই অংশই আবৃত।বাকি উরু সম্পূর্ণই উম্মুক্ত।গাড়িতে ঢুকতে গিয়েই মিছরিকে দেখে থমকে গেলো সৌর....
-হোয়াট?এটা ফ্যাশন সৌর!!কাম ইন!
তিলোত্তমা সৌরর একটা হাত ধরে গাড়ির ভিতর দিকে টানলো।সৌর গাড়িতে বসে বললো,
-শুধু আমার সঙ্গে বেরোলে কোনো ব্যাপার না!কিন্তু আমার বন্ধুগুলো তো,সব এক-একটা জিনিস!মুখ খুললে আর বন্ধ হয় না।তাই বলছিলাম আর কি...
প্রত্যুত্তরে একটু হাসলো তিলোত্তমা।ড্রাইভারকে বলে উঠলো,
-চলো কাকু!
বলেই একটু হেসে সৌরর হাতটা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে গুছিয়ে বসলো তিলোত্তমা...সৌর মিছরির দিকে একবার গভীরভাবে চাইলো।তারপরই হাত রাখলো তিলোত্তমার মসৃণ অনাবৃত উরুতে....
-এ ভাই,এরা কখন আসবে রে ভাই?গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করাবে বলে ডাকলো,এখন নিজেদেরই তো আর পাত্তা নেই।কখন থেকে এসে বসে আছি!
সিসিডিতে বসে বিরক্ত হয়ে রূপ বলে উঠলো।বেশ কিছুক্ষণ আগে ওরা তিনজনই পৌঁছে গেছে...সমুদ্র একভাবে মাথা নীচু করে চেয়ে রয়েছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে।মুখটা গম্ভীর....
-দাঁড়া!সঙ্গে মেয়ে থাকবে।তার রেডি হতে-হতে দেখবি,এক ঘন্টা!!লিখে রাখ রূপ,ওই ছটার আগে সৌর ঢুকতেই পারবে না!এখন তো আর ভাই আমাদের সিঙ্গেল নেই....
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঋষি বলে উঠলো...
-ভাই রঞ্জার সঙ্গে কেসটা সাল্টে গেলে,তুইও সিঙ্গেল থাকতিস না।তখন আমরাও আওয়াজ দিতাম!
-ও বাবা!ছেলের গায়ে লেগে গেলো তো!তা সিঙ্গেলের কথায় মনে পড়লো,নিশা কেমন আছে?
-হ্যাঁ ভালোই আছে!ওর খবরে তোর কি দরকার?
-আরে নিশা তো আমারও বন্ধু নাকি!!বন্ধু হয়ে বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করতে পারবো না?!আশ্চর্য তো!!তুই এত খেপে যাচ্ছিস কেন?ইনসিকিউরিটি?
-এই সমু,ঋষির জন্য একটা মেয়ে দেখ তো ভাই।সিঙ্গেল থেকে-থেকে ওর মাথাটা গেছে....
-ওই ওটা সৌর না?!
ঋষির কথায় বাকি দুজনই একসঙ্গে কাঁচের বাইরে চোখ রাখলো।সৌর নামার পরই গাড়ি থেকে নামলো তিলোত্তমা।ওইদিকে একবার মাত্র দেখেই মাথা নামিয়ে নিলো সমুদ্র।আবার মন দিলো মুঠোফোনে।কিন্তু ঋষি হাঁ করে চেয়ে রয়েছে ওইদিকেই....
-কি দেখতে রে রূপ!একেই কি সেদিন আমরা মাঠে দেখেছিলাম?অন্ধকারে তো বুঝতেই পারিনি রে সেদিন!একে সৌর কোথায় পেলো রে!?এ মেয়ে না ট্রফি?একে নিয়ে এভাবে রাস্তায় বেরিয়েছে কেন?আমি হলে তো শো-কেসে সাজিয়ে রাখতাম,আর দিনরাত শুধু দুচোখ ভরে দেখতাম!!ভাই লেগস দেখ ভাই!
-উউ ঋষি!ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড!
গম্ভীরভাবে বললো সমুদ্র....
-এই তুই থাম তো!!এইরকম পা-ই তো দেখাতে হয়!এই সৌর কই রে?
-মেয়েটার পাশেই আছে ভাই!তোর ফোকাস একজায়গায় আটকে গেছে।একটু ওপর দিকে দেখ,চোখটা ফিরিয়ে দেখলেই বুঝবি,সৌর ওর পাশেই আছে।
বলেই হেসে ফেললো রূপ....
-উফফ!মানে,সত্যি!কেন সৌরর মতো ছেলে পাগলামি করবে না বল?!ভাই ওটা স্কিন না টিউবলাইট,ওইরকম জ্বলছে কেন?
-আবে ঋষি!!
দুম করে একটা উড়ন্ত চাঁটি এসে পড়লো ঋষির মাথায়।ধমকে উঠলো সমুদ্র,
-তখন থেকে বলছি ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড!ঠিকভাবে দেখ,ঠিকভাবে দেখ....
-আরে কি ঠিকভাবে দেখবো ভাই!!আমি তো চোখই সরাতে পারছি না।তুই বল রূপ,আমি সিঙ্গেল তো?
-একদম!!একশো শতাংশ!
-আর ওটা একটা মেয়ে,ভীষণ সুন্দরী মেয়ে।সবাই এগ্রি করবি তো?
-হ্যাঁ,এই ব্যাপারে আমি তোর সঙ্গে সহমত পোষণ করছি ঋষি।সুন্দরকে সুন্দর বলতেই হয়।
রূপ বললো,কিন্তু সমুদ্র চুপ করেই রইলো...
-ওকে,আমি সিঙ্গেল,আর ও সুন্দরী একটা মেয়ে,হোক না সৌরর গার্লফ্রেন্ড।সেটা হয়ে গেছে।ওটাতে তো আর কারোর কিছু করার নেই।কিন্তু সৌরর গার্লফ্রেন্ড বলে কি,দূর থেকে একটু প্রাণভরে দেখতেও পারবো না?!আমি সিঙ্গেল,ও সুন্দরী।সেজন্য আমি দেখবোই।পারফেক্ট লজিক না রূপ?
-কি বালের লজিক রে ভাই!!মানে সিঙ্গেল বলে,বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকেও দেখবো?!
হেসে উঠলো রূপ...
-এই চুপ!সৌর ঢুকছে...
সমুদ্রর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে ঋষি মুখটা বন্ধ করলো ঠিকই,কিন্তু চোখদুটো অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওদের দিকেই...
কাঁচের দরজা ঠেলে সৌর ভিতরে ঢুকলো তিলোত্তমাকে সঙ্গে নিয়ে।ওরা এলে সবাই একসঙ্গে চেয়ারে বসলো।তিলোত্তমার উপস্থিতিতে মাতাল করা একটা সুগন্ধী ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে।ওই সুগন্ধী কিছুদিন আগে সৌরই ওকে উপহারস্বরূপ দিয়েছে।সবাই বসলে সৌরই কথা শুরু করলো,
-ওকে,লেট মি ইন্ট্রোডিউস....রূপায়ণ,সমুদ্র,ঋষভ।অলসো নোন এজ,রূপ,সমু এন্ড ঋষি...এরা সবাই আমার বন্ধু!আর ইনি হচ্ছেন আমার ওয়ান এন্ড অনলি গার্লফ্রেন্ড,তিলোত্তমা সান্যাল!
-হাই....
-হ্যালো!!
বাবা দুপুরবেলা বাড়িতে ভাত খেতে গিয়েছিলো।তাই ওই সময়টা কিছুক্ষণ দোকানে গিয়ে বসেছিলো রূপ।তারপর ওখান থেকেই সোজা এখানে বেরিয়ে এসেছে।এখন ওর গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে।ব্যাগ থেকে ছোট একটা জলের বোতল বের করলো রূপ,একটু জল খাবে বলে।সেই সময়ই টেবিলের ওপর রাখা নিজের আইপ্যাডটা একটু সরিয়ে রেখে গুছিয়ে বসে,তিলোত্তমা আদুরে গলায় বলে উঠলো,
-তোমাদের রূপ-ঋষি-সমুর মতো আমারও কিন্তু একটা সুন্দর নাম আছে।সৌরও আমাকে ভালোবেসে ওই নামেই ডাকে...আমার আর একটা নাম মিছরি!!
হেসে উঠলো ঋষি।তিলোত্তমা ঠিক ওর পাশের চেয়ারেই একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে বসে আছে,ওর ওপাশে সৌর বসে।ঋষি একবার তিলোত্তমার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-ওয়াও!!
-এক্সকিউজ মি?!
তিলোত্তমার কথায় ঋষি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-না মানে....ওয়াও!!কি অদ্ভুত মিল না রূপ!?জানো তো মিছরি,আমাকেও তো আমার বন্ধুরা মাঝে-মধ্যে ভালোবেসে পিঁপড়ে বলে ডাকে!!
বোতল খুলে সবে একটুখানি জল মুখে দিয়েছিলো রূপ।বিষম খেয়ে সবার সামনে বিচ্ছিরিভাবে ছড়িয়ে ফেললো।হেঁচে-কেশে সাংঘাতিক অবস্থা ওর।ও তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে,সরে গেলো ওখান থেকে।সমুদ্র ঋষির দিকে এমনভাবে চেয়ে রয়েছে,পারলে ওকে গিলেই খায়,চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে।সৌর ঠান্ডা দৃষ্টিতে সরাসরি তাকালো ঋষির দিকে।পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো মিছরির হাতে।হঠাৎ করে রূপ বিষম খাওয়ায়,একটু-আধটু জল ছিটকে আসতে পারে ওর গায়ে।সবার মুখের দিকে একবার মাত্র চেয়ে,প্রাণখোলা হাসি হেসে গড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমা....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
-মিস্টার সমুদ্র বাসু?
-স্যার আপনি?!
-এদিকে এসো!
গ্রীনরুমের দিকে উনি ডেকে নিয়ে গেলেন সমুদ্রকে।কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-জীবন বাজি রেখে দিয়েছো তুমি।অভিভাবকের পরোয়া না করে,নিজের ভবিষ্যতের পরোয়া না করে,এই বয়সে ঝোঁকের মাথায়,অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো।এখান থেকে তোমার কতদূর কি হবে,জানা নেই আমার।তুমি এই রিয়্যালিটি শো-কে কতটা মিথ্যের জালে জড়িয়ে টি-আর-পি পাইয়ে দিতে পারবে,আমি এখনই বলতে পারছি না।এখানে প্রকৃতপক্ষে গুণীর কতটা কদর হয়,তার কোনো নূন্যতম ধারণাও,তোমার নেই সমুদ্র।দু-সপ্তাহের মধ্যেই এরা তোমাকে ফাইনাল কল পাঠাবে।হ্যাঁ কিংবা না,যেটাই হোক।যদি তুমি এই সিজনে আসো,আমার চেয়ে খুশি বোধহয় আর কেউ হবে না।কিন্তু যদি এদের দিক থেকে তুমি পজিটিভ কোনো উত্তর না পাও,এই আমার কার্ড রাখো,আমার সঙ্গে তুমি যোগাযোগ করবে।বাকিটা আমি বুঝে নেবো!সেটা ওয়াইল্ড-কার্ড এন্ট্রি হিসেবেই হোক,বা অন্য যে কোনোভাবে।আমার সাহায্য তুমি পাবে।আসলে জহুরীর চোখ তো,আমার রত্ন চিনতে ভুল হয় না সমুদ্র।কিন্তু বয়স হয়েছে তো,তাই আমার মতামতের গুরুত্ব এখন বড়ই কম।আমাকে শুধুমাত্র রাখা হয়,এককালে অর্জন করা আমার নামটুকুর জন্য।আমাদের সময়ে এতসব স্পনসর,পার্টনার,মার্কেটিং,প্রোমোশন,টি আর পি,এতকিছু আমরা বুঝতামই না।আমরা শুধু গুণের কদর করতাম।তুমি নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ভিতরে যা বলে এলে,তারপর তো....
-আমায় ক্ষমা করবেন স্যার।ওরা বারবার আমার স্ট্রাগল জানতে চাইছিলো।আমি একা কেন,আমার সঙ্গে বাড়ির লোক নেই কেন,পরীক্ষা ছেড়ে এখানে কেন,জানতে চাইছিলো।কি বলতাম আমি?!এখানে আসার জন্য বাবা-মাকে নিয়ে সামান্য একটু মিথ্যে বলতে হয়েছে আমায়,তাও এমন একজনকে,যাকে আমি কোনদিনও মিথ্যে বলি না।কিন্তু ন্যাশনাল টিভিতে অন ক্যামেরা,আমি আমার বাবা-মাকে ছোট করতে পারবো না।কারণ,আমার স্টোরি তো ওইরকম হৃদয়বিদারক কিছু নয় স্যার।না খেতে পাওয়া ঘরের ছেলে নই আমি।আমি যখন যা চেয়েছি,ফোন,কম্পিউটার,এক্সপেন্সিভ হেডফোন,পকেটমানি,জামাকাপড়,নূন্যতম বিলাসিতা,সবই আমার বাবা দিয়েছে আমায়।যেটা পাইনি,সেটা হলো মেন্টাল সাপোর্ট!গানকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য,পড়াশোনা-চাকরি,এইসব গতানুগতিকতার বাইরে বেরোনোর জন্য,যে প্রবল একটা মানসিক শক্তি প্রয়োজন,সেটা আমাকে তারা দেয়নি।তাছাড়া আর সবই দিয়েছে।আমার মাথার ওপর ছাদ আছে,দোতলা বাড়ি আমাদের।পায়ের তলায় জমি আছে,মূল্যবান টাইলস বসানো তাতে,আমার ঘরের মেঝেতে যে মার্বেল বসানো,তাতে আয়না পালিশ করা,হাঁটলে তার ওপর আমার ছায়া পড়ে।পেটে প্রয়োজনের অতিরিক্তই খাদ্য আছে।নিজের জেদের কারণে আমি অভুক্ত থেকেছি হয়তো,তখন মাথা গরম থাকলে অত খিদে-তৃষ্ণা পায় না।কিন্তু খেতে পাইনি,বা অভাবের তাড়নায় মা নিজে না খেয়ে,তার মুখের খাবারটুকু আমাকে খাইয়ে দিয়েছে,বা বিনা বেতনে আমার গানের শিক্ষক আমায় গান শিখিয়েছেন,বা ভাঙা হারমোনিয়ামে আমি গান শিখেছি,শুনে-শুনে শিখেছি,এসব গল্প আমি কোথায় পাবো স্যার?!আমি যা নই,তা নই।আমি সুস্থভাবে-স্বাভাবিকভাবে প্রতিপালিত একজন সুখী সন্তান।আর বাকি যেটুকু সাপোর্ট তারা আমায় করেননি,সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।তারা আমার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছেন,আমাকে জীবনে সুখী দেখতে চেয়েছেন,সফল দেখতে চেয়েছেন,অন্যায় নয়।কিন্তু আমি নিজেই এই লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছি,অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছি,সেই দায় সম্পূর্ণ আমার।আমি ওই দশটা-পাঁচটার অফিসে দম আটকে মরে যাবো স্যার!আমার দ্বারা ওইসব হবে যেন।আমি পারবোই না।কিন্তু এটাই আমি আমার বাবা-মাকে,কিছুতেই বোঝাতে পারিনি।তার মানে এই নয়,সেসব পারিবারিক ব্যক্তিগত ব্যাপারকে সামনে রেখে,আমি এই রিয়েলিটি শো-তে আসবো।ন্যাশনাল টিভিতে হোক,বা জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে,বাবা-মাকে ছোট করে,আমি বড় হতে পারবো না স্যার!!তারা যাই হোক,যেমনই হোক,আমারই....তাই আমি তাদের সামনে রেখে,কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে,সমবেদনা কুড়িয়ে, কোনোরকম সাফল্য পেতে চাই না।আমার কাজের কি কোনো মূল্য নেই?!মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও কিন্তু লড়াই থাকে স্যার,শুধু তাদের লড়াইয়ের সংজ্ঞাটা অন্যরকম হয়....আমার কন্ঠ,আমার কাজ,আগামী দিনে আমার পরিচয় তৈরি করুক।কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে লোককে কাঁদানো,সমবেদনা আদায় করা,আমার দ্বারা সম্ভব নয়....
কিছুক্ষণ একভাবে ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন,একটু আগে বিচারকের আসনে বসে থাকা প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞ মানুষটি।সত্যিই অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও,আয়োজকরা এর মুখ থেকে টি আর পি পাওয়ার মতো একটাও ঘটনাপ্রবাহ বের করতে পারেননি।আর এটাই ওনার ভয়।এই মার্কেটিং-এর যুগে,টি.আর.পির কবলে পড়ে,এইরকম একটা প্রতিভা,হারিয়ে না যায়।কিন্তু বড় জেদী যে এই ছেলে।কিছুতেই নিজের দুর্বলতাকে জনসমকক্ষে বের করবে না।একে বোঝানো যাবে না,যে বর্তমান যুগে শুধুমাত্র প্রতিভার মূল্য কেউ দেয় না।সেই প্রতিভাকে তুলে ধরার নেপথ্যে,অনেকরকম নিম্নমানের বাণিজ্য কাজ করে।উনি ভালোভাবে দেখলেন ছেলেটিকে।একমাথা ঝাঁকড়া চুল,চোখে একটা মূল্যবান ফ্রেমের চশমা,চোখমুখ একটু বসা,হয়তো মানসিক চাপে খাওয়া-ঘুম নেই ছেলেটির।যেখানে কাউকেই পাশে পায়নি,সেখানে একা-একা এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে,ওকে নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।সমুদ্রর কাঁধে হাত রেখে উনি বললেন,
-দিন পনেরো পর আমাকে তুমি একটা ফোন করবে।নানারকম ব্যস্ততায় আমি হয়তো ভুলে যেতে পারি,কিন্তু তুমি আমাকে ফোন করবেই।কেমন?
-করবো স্যার!থ্যাঙ্কু!আমার সত্যিই একটা সুযোগের ভীষণ প্রয়োজন।নইলে বাবা-মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার মতো,আমার আর মুখ থাকবে না।
-বুঝেছি!!গুড লাক ইয়ং ম্যান!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
দ্রুতপায়ে চলে যাচ্ছিলেন উনি।এই ছেলেটির গভীর-স্বচ্ছ দুটি চোখে কত আশা,কত স্বপ্ন প্রোথিত রয়েছে।উনি দেখতে পেলেন সেই দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্নের আভাস!তাই আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না ওর সামনে।কিভাবে দাঁড়াবেন!!কিভাবে একে বলবেন,যে টপ-থার্টির মধ্যে,টপ টোয়েন্টি-ফাইভ আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।বাকি রয়েছে শুধুমাত্র পাঁচটা আসন।যত লড়াই মাত্র ওই পাঁচটা আসনের জন্যই।যার জীবনে যত বেদনা,যে অনুষ্ঠানকে যত বেশি টি.আর.পি.দিতে পারবে,দর্শককে কাঁদাতে পারবে,যার এলিমিনেশনে যত বিতর্ক তৈরি হবে,তার সুযোগ ততই বেশি।রিয়্যালিটি শো গুণের পাশাপাশি রসদ চায়,চটকদার মশলা চায়,আর চায় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য প্রবল উন্মাদনা তৈরি করতে।চায় প্রতিযোগির প্রবেশমূল্য বাবদ টাকার অঙ্কটা।সেই কারণেই এই প্রতারণা,ছলনা বা সুবর্ণ সুযোগের হাতছানি।আর সেই রকম একটা প্ল্যাটফর্মে,এই ছেলেটি শুধুমাত্র নিজের গগনচুম্বী প্রতিভাকে আশ্রয় করে,যুদ্ধ করতে চাইছে।আবেগী সরল ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভেবে,চোখে জল এসে যাচ্ছিলো ওনার।তাই উনি সমুদ্রর সামনে থেকে সরে যেতে চাইছিলেন তাড়াতাড়ি।কিন্তু আবার ফিরতে হলো তাকে,সমুদ্রেরই ডাকে....
-স্যার...
-বলো?
-যখন ফোন করবো,আমার সমুদ্র নামটা আপনার মনে থাকবে তো?কি বলবো আমি?যা আপনাকে সহজেই আমার কথা মনে করিয়ে দেবে?!
একটু হাসলেন প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞ সেই ব্যক্তি....
-যুগের সঙ্গে তাল মেলাও সমুদ্র।আমি মানুষটা প্রবীণ,কিন্তু আমার মনটা চিরসবুজ।জানো তো,আমাদের মতো শিল্পীদের কোনোদিনও বয়স হয় না।আমরা প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রেমে পড়ি।নিজেদের সৃষ্টির প্রেমে।নইলে সৃষ্টি করতে পারবো না যে।যদি আমাকেই জিজ্ঞেস করো,তবে তোমায় আমি একটা জমকালো নাম দেবো।আশা করবো,একদিন এই নামটা গানের জগতে,নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে।
হেসে ফেললো সমুদ্র,আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেছে।
-কি নাম স্যার?
-যেদিন ফোন করবে সেদিন বোলো,স্যার,মনে আছে আমাকে?আমি সমুদ্র বলছি!আপনি দিন পনেরো আগে আমায় দেখেছিলেন।আমি ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছিলাম আপনার শিল্পীসত্তার অববাহিকায়।সেদিন কোনো নবীন হয়তো আমাকে বোঝেনি,কিন্তু প্রবীণ আপনি আমাকে বুঝেছিলেন।সমুদ্রের ওপরের উদ্দাম ঢেউয়ের গভীরে যে প্রশান্তি বিরাজ করছিলো,তার অনন্ত নৈঃশব্দ,তার সুর-ছন্দ স্পর্শ করেছিলো আপনাকে।আপনিই আমায় ভেঙে নতুন করে সৃষ্টি করেছিলেন।আপনিই এই পৃথিবীর জন্য নবরূপে সাজিয়েছিলেন আমায়।আমি স্যাম বলছি,
"স্যাম-মেলোডি অফ দা সি.....",আমায় মনে আছে স্যার?!ব্যাস!!এটুকুই বলো।নেহাত আলঝেইমার হয়ে না গেলে,এটুকুই আমায় কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সমুদ্র....
চুপ করে গেলো সমুদ্র।আবেগে ওর গলা বুজে এসেছে।আজকের আগে কেউ কোনোদিনও ওকে এভাবে বলেনি।আর আজ এতবড় গুণী একজন মানুষের কাছ থেকে এটুকু প্রশংসায়,ও দিশেহারা হয়ে গেলো।আনন্দে কান্না পেয়ে গেলো।চশমার কাঁচের ওপর টুপ করে একফোঁটা জল এসে পড়লো।ঝাপসা হয়ে গেলো সবকিছু।চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিলো সমুদ্র।একটু এগিয়ে এসে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো,
-আরে-আরে করো কি?!
-কিছু না স্যার!একরকম জোর করেই আপনার একটু আশীর্বাদ আদায় করে নিলাম।যদি কোনোদিনও নিজের পরিচয় তৈরী করতে পারি স্যার,তবে এই নামেই আমায় পৃথিবী চিনবে।"স্যাম-মেলোডি অফ দা সি....",থ্যাঙ্কু স্যার!!
-ভালো থেকো।উইশ ইউ অল দা বেস্ট ইয়ং ম্যান!!
-থ্যাঙ্কু!
ধরা গলায় সমুদ্র বললো।ধীরে-ধীরে এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই ভদ্রলোক....পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে,বাইরে বেরিয়ে এলো সমুদ্র বসু....
বাইরে বেরোতেই বিকেলের পড়ন্ত রোদে,আবার সমুদ্রর খিদেটা চনমনিয়ে উঠলো।অটো স্ট্যান্ডের সামনেই ছোটখাটো একটা ভাতের হোটেল দেখে,ওখানেই ঢুকলো ও।ছোট বাটিতে একটু ট্যালটেলে জলের মতো ডাল,আর একটা ডিম দুটো আলু সহযোগে মোটা চালের ভাত,ওর গলা দিয়ে নামছিলো না।কিন্তু খিদের তাড়নায় তাই গলাধঃকরণ করে রাখলো ও।খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে মানিব্যাগ থেকে টাকা দিয়ে,নিজের ব্যাগটা আবার পিঠে তুলে নিলো।তারপর এগোলো স্টেশনের দিকে।মুঠোফোনটা অন করে ওইদিকে একভাবে চেয়ে থাকতে-থাকতে সমুদ্র আর খেয়াল করলো না,যে সেই বিশেষ মানুষটির দেওয়া মূল্যবান কার্ডটা টাকা বের করতে গিয়ে,ব্যাগ থেকে ওর পায়ের কাছে পড়ে গেছে।সৌরর একাধিক মেসেজ পড়তে-পড়তে আনমনে ওই কার্ডের ওপর দিয়েই হেঁটে বেরিয়ে গেলো সমুদ্র....সমুদ্র বেরিয়ে যাওয়ার পর একাধিক পথ চলতি মানুষের পদপিষ্ট হয়ে,পিচঢালা রাস্তায় হারিয়ে গেলো সেই কার্ড....
পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পর থেকে,মনটা এতটাই ভারী হয়ে রয়েছে,যে সৌর আর একবারও ফোন করেনি সমুকে।আজ বিকেলে সব বন্ধুদের একসঙ্গে বেরোনোর কথা ছিলো।পরীক্ষা শেষ,সবাই মিলে অনেক আনন্দ করা হবে,বহুদিন আগে থেকেই ওরা ঠিক করে রেখেছিলো।কিন্তু সৌর,ঋষি আর রূপকে না বলে এসেছে।ঋষি একটু চিন্তিত।ওর বাবা চাকরিসূত্রে পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকেন,অন্ধ্রপ্রদেশ,দক্ষিণ ভারতে।উনি বেশ কয়েকদিন ধরেই একটু অসুস্থ।এবার পরীক্ষা শেষ,ঋষি হয়তো কিছুদিনের জন্য মাকে নিয়ে বাবার কাছে যাবে।সেইসব প্রসঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলার ছিলো।রূপ আর নিশার সঙ্গেও বেরোনোর কথা ছিলো।কিন্তু সৌর সবাইকেই না বলে দিয়েছে।সমু প্রথম কারণ,আর দ্বিতীয় কারণ হলো মিছরি।মেয়েটা এত কাটা-কাটা কথা বলে,ওর প্রতিটা কথা ক্ষেত্রবিশেষে সৌরর মনের উন্মুক্ত ক্ষতর ওপরে,যেন একমুঠো নুন ছড়িয়ে দেয়।মাঝে-মাঝে তো সহ্যই করতে পারে না সৌর।সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলে মিছরি।তখন সৌর ওর ওপরে চিৎকারও করে ফেলে।কিন্তু তারপরই মিছরি ফোন না ধরলে,বা ফোন বন্ধ করে রাখলে,সৌর উন্মাদ হয় যায়।তখন আবার মিছরির কাছে যাওয়ার জন্যই,পাগল হয়ে যায় ও।কাল রাতে মিছরির মুখের ওপরে ফোন রেখে দেওয়ার পরও,অনেকবার ফোন করেছিলো মেয়েটা।সৌরই ধরেনি।ভোরবেলা মেসেজ করে পরীক্ষার জন্য শুভকামনা জানিয়েছিলো।মেসেজ দেখে ছেড়ে দিয়েছিলো সৌর।কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি।এবার বাড়ি ফিরে যেই সৌর ওকে ফোন করছে,ফোন বন্ধ!!কেমন মাথাটা গরম হয়!!এই সবকিছু মিলিয়ে সৌরর মনটা এতটাই খারাপ হয়ে রয়েছে,যে ও সেই তখন থেকেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে,বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে।সন্ধ্যে হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই।তাও ওঠেওনি ও,ঘরের আলোটাও জ্বালায়নি।আজকাল প্রায়ই ওর মনে হয়,জীবনে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াই ভালো।অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখলে,নিজের চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলটুকুও,নিজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়।বালিশ ভিজে গেলেও,যন্ত্রণারা বোধহয় অদৃশ্যই থাকে।অন্ধকারে মনে হয়,আমি আছিও-আবার নেইও!!বা হয়তো থেকেও নেই।অদ্ভুত একটা অনুভূতি।অন্ধকার রাজ্যে নিজের থেকে নিজে পালিয়ে থাকা যায়।নিজের সম্মুখীন হতে হয় না।আজ ভালোবাসার কাছ থেকে ভীষণরকম আহত সৌর,বন্ধুত্বের কাছ থেকেও।তাই নিজের আহত মনকে অন্ধকারেই লুকিয়ে রেখেছিলো ও।বারংবার ফোনের দিকেই হাত চলে যাচ্ছে।কতবার যে ও মিছরিকে ফোন করেছে,তার ইয়ত্তা নেই।প্রতিবারই ফোন বন্ধ আসছে।এর মধ্যেই মা বার দুয়েক এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেছে।উঠছি-উঠছি বলেও ওঠেনি সৌর।বালিশ-বিছানা আঁকড়েই পড়ে রয়েছে।চোখটা বালিশে মুছে নিয়ে,আরও একবার মিছরির নম্বরে ফোন করলো সৌর।এইবার রিং হচ্ছে,দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো ও,অবশেষে সে ধরলো ফোনটা।তার গলার স্বর শোনার জন্য ধড়ফড় করতে লাগলো সৌরর হৃদপিন্ডটা।কিন্তু সে ফোন ধরেও চুপ করেই রইলো।সৌরও আর একটা কথাও বললো না....বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর হার মানলো সৌরই।ফোনের একেবারে কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,
-সরি মিছরি!প্লিজ....
-আর কিছু?
-হুম!বেরোচ্ছি আমি!তোমায় এক্ষুণি দেখতে চাই!এক্ষুণিই....তুমি এসো!
-না....
-প্লিজ!!
-আমার সময় নেই!
-কান ধরে দাঁড়াবো তোমার সামনে,প্রমিস!সেই সেদিনের মতো।প্লিজ,একবার এসো.....
হেসে ফেললো তিলোত্তমা।
-নাচের ক্লাস আছে।সত্যিই আজ আমার সময় নেই সৌর।
-আমার জন্য একটুখানি সময় বের করতে পারবে না মিছরি?!কতদিন তোমায় দেখি না।ভিডিও কলে চোখের দেখা দেখে কি আর,তোমায় ছুঁয়ে দেখার সাধ মেটে?!প্লিজ এসো।আমি তোমার খুব বেশি সময় নেবো না!
-আসছি!কিন্তু বেশি সময় দিতে পারবো না,আগেই বলে দিলাম....
-তুমি যেটুকু সময় দেবে,সেটুকুই অনেক।আমি তার বেশি কিছু চাইবোও না।লাভ ইউ মিছরি!!চলে এসো আমাদের জায়গায়....
-লাভ ইউ টু,চলো বেরোও...আমিও বেরোচ্ছি!!
ফোনটা রেখে উঠে পড়লো সৌর।ঘরের আলো জ্বালিয়ে একটা জামা গায়ে গলিয়ে নিলো।জিন্সের পকেটে মানিব্যাগ আর ফোনটা ঢুকিয়ে নিলো।আজ পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময়,মিছরির জন্য একটা সুগন্ধী আর পছন্দ করে একজোড়া হাল ফ্যাশনের কানের দুল কিনেছিলো সৌর।ওয়ার্ডরোব থেকে ওগুলোকে বের করতে গেলো ও।তখনই ওর চোখ পড়লো ওয়ার্ডরোবের পাল্লার ভিতরকার দেওয়ালের দিকে।একবার হাসিমুখে ওখানে চোখ রাখলো ও।তারপর হাত রাখলো নিজের সাজানো ভবিষ্যতের ওপরে।হাতে লেখা একটা কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটানো রয়েছে ওয়ার্ডরোবের দেওয়ালে।যাতে লেখা রয়েছে,
"জীবনের অসমাপ্ত কতগুলো লক্ষ্য।যেগুলো আমাকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে....স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরী,নিজের উপার্জনে একটা গাড়ি,তারপর সুখী.....সম্পূর্ণ জীবন।"
এটা বেশ কিছুদিন আগে লিখে এখানে আটকিয়ে রেখেছিলো সৌর।ওর স্যার বলেন,জীবনে লক্ষ্য স্থির না করলে,লক্ষ্যপূরণ করা যায় না।হয়তো অধরা থেকে যায় অনেক কাঙ্খিত বস্তু,অসমাপ্ত ইচ্ছে।তাই সর্বপ্রথম লক্ষ্যস্থির করতে হয়।সেদিনের পরই বাড়ি ফিরে নিজের লক্ষ্যটা স্থির করে ফেলেছিলো সৌর।জীবনটাকে একেবারে ছকে বেঁধে ফেলেছিলো।তখনও ওর জীবনে মিছরি আসেনি।কিন্তু মিছরি আসার কিছুদিন আগেই,জলে নিজেকে প্রমাণ করলো সৌর।তারপরই ওর জীবনে মিছরির আগমন।তারপরই চাকরির কথা চলছে।পেনটা হাতে তুলে নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দুটো শব্দ কেটে দিলো সৌর।পড়ে রইলো স্কুল,চাকরি,নিজের গাড়ি,আর সুখী...সম্পূর্ণ জীবন।এই কয়েকটি মাত্র শব্দ।এই চাকরিটা ওকে পেতেই হবে।হাতের ক্ষতর দিকে একবার চাইলো সৌর।পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পরই স্যার ফোন করেছিলেন,সৌর কাল থেকেই প্র্যাকটিস করবে কিনা জানতে চেয়েছিলেন।কিন্তু হাতটা না শুকোলে জলে নামা যাবে না।তাই দিন দুয়েক সময় চেয়ে নিয়েছে সৌর।তারপরই ওর যুদ্ধ শুরু হবে!মিছরিরও ইন্টার-পুল কম্পেটিশনের সময় প্রায় হয়ে এলো,আর ওর তো জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।আর এটা ওকে জিততেই হবে,নিজের জন্য না হোক,অন্তত মিছরিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য!চাকরি আর মিছরি,এই দুটো পেয়ে গেলেই,সৌরর জীবনের কোনো অধ্যায় আর অসমাপ্ত থাকবে না।বাকি গ্রাজুয়েশন...সে চাকরি করতে-করতেই করে নিতে হবে।কিন্তু ওই চাকরিটা ওই চাই!সেই সঙ্গে রাজকন্যাও!!সুখী...সম্পূর্ণ জীবন,এই শব্দটুকুর ওপরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ওয়ার্ডরোব বন্ধ করে দিলো সৌর....দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে নামলো নীচে,
-মা আমি একটু বেরোলাম!
-কোথায় চললি এই সন্ধ্যেবেলা?আমি তোর জন্য মোচার চপ ভাজছি।একটু খাবি না?
-মানে যা খুশি বলো!?প্র্যাকটিসে যাচ্ছি না বলে,যা খুশি খাইয়ে যাবে আমায়?ডায়েটের কোনো ব্যাপারই নেই?!কি চাইছো?বাড়িতে থেকে বেশ একটা ছোটখাটো ভুঁড়ি বাগিয়ে ফেলি!!
রান্নাঘরে ঢুকে পিছন থেকে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো সৌর....ওর মা তখন গরম-গরম চপ ভেজে কড়াই থেকে পাশের থালায় তুলে রাখছে...
-ধুর!!সারা বছর তোর এই এক কথা!আজ মিলিটারি ডায়েট,কাল স্ট্রিক্ট-ডায়েট,পরশু সেমি-ডায়েট!ওই ফল আর প্রোটিন গিলেই থাকো তুমি!!একটা মাত্র ছেলে আমার,তাকে এ জীবনে আর রেঁধে-বেড়ে খাইয়ে সুখ পেলাম না!!
-উফফ!মা!এইরকম করে বললে,না খেয়ে পারা যায়!?দাও,একটা খাইয়ে দাও!
একটা মোচার চপ নিয়ে ফুঁ দিয়ে ছেলের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে সৌরর মা বললো,
-তা কোথায় চললি?একটু পরেই তো বাবা এসে যাবে।পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করবে।এখন একটু বাড়ি থাকলে হতো না?বেরোতেই হবে?
-প্লিজ মা,বাবাকে একটু সামলে নিও।আমার একটু দরকারী কাজ আছে!বেরোতেই হবে।
-কি তোমার দরকারী কাজ আমি কি আর জানি না!?
-তাই?জানো?
-সব জানি!পাড়ায় খবর দেওয়ার লোকের অভাব আছে নাকি!!আমার কানে উড়ো খবর সবই আসে!
মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সৌর।শুধু বললো,
-আসছি মা!!
-বাবাকে কি বলবো?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে হেসে ফেললো সৌর।তারপর ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিয়ে বললো,
-আমি আমার টিকালো নাক কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে গলানো একদম পছন্দ করি না।একজন স্ত্রী তার স্বামীকে একা বাড়িতে কি বলবে,তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই!!ও তোমাদের ব্যাপার,তোমরাই বুঝে নিও!আর বাবা বেশি কথা বলতে চাইলে,তোমার হাতের তৈরি গরম-গরম মোচার চপ তো আছেই।মুখে ঢুকিয়ে দিও,চা করে দিও।ওগুলো নিয়েই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবে,ওগুলো আয়েশ করে খেতে-খেতেই আমি চলে আসবো।আমার আসার আগেই তোমাদের প্রাইভেট কথা সেরে নিও কিন্তু....আমি বাইরে থেকে নক করেই আসবো....
সৌরর বাবা-মা উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে বরাবরই খোলামেলাভাবে,সহজভাবে কথা বলেন।তাই বাবা-মাকে না জানিয়ে,আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি সৌরর।বাবাকে একটু ভয় পেয়ে সমীহ করে চললেও,মা তো সৌরর একেবারে বন্ধুসম।মাকে ওই কথাটুকু বলেই,উড়ন্ত খুন্তি প্রবল বেগে ধেয়ে আসার আগেই,তুরতুর করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে পড়লো সৌর।মা তখন চেঁচাচ্ছে।কিন্তু সৌর ঠিক জানে,মা হাসতে-হাসতেই চিৎকার করছে...
একটু হেসে সাইকেলের লক খুলে মিছরির সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেলো সৌর....
-পছন্দ হয়েছে?
-যদিও দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো!তবে মনে হচ্ছে খুব সুন্দর!
-পরবে না?
-পরছি....
নিজের খালি কান দুটোতে সৌরর আনা দুলজোড়া পরে নিলো তিলোত্তমা....
-ভালো লাগছে আমায়?
-কি করে বুঝবো?অন্ধকার তো!!তোমায় দেখতেই পাচ্ছি না।তাতে কি!অনুভব তো করতে পারি?
এগিয়ে গিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে মিছরির কান স্পর্শ করলো সৌর,জড়িয়ে ধরলো ওর কোমর।সৌরর উষ্ণ স্পর্শে তিলোত্তমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো।ও দুহাতে জড়িয়ে ধরলো সৌরর গলা।সেই মুহূর্তেই সৌরর পকেটে রাখা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।ওইরকম একটা উত্তেজক-সংবেদনশীল মুহূর্ত,নিমেষেই সৌরর কাছে প্রবল বিরক্তিকর একটা মুহূর্তে পরিণত হলো।ও তাড়াতাড়ি ফোনটা পকেট থেকে বের করলো,স্ক্রিন জানান দিচ্ছে,সমুদ্র ফোন করছে....
ব্যস্ত হয়ে উঠলো সৌর।মিছরির দুটো হাত ওর গলায় তখনও জড়ানো ছিলো।ও ওই দুটো হাতের মধ্যে থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উদ্যত হলো,
-মিছরি,এক মিনিট!!
তিলোত্তমার কাছ থেকে সরে এসে সৌর ফোন ধরে বললো,
-কোথায় তুই?
-স্টেশনে ভাই।সবে ট্রেন থেকে নামলাম!ভাই সরি!!
-জোড়া শিবমন্দিরের পিছনে আছি আমি।চলে আয় এখানে।বাড়িতে একা যাস না!আমি যাবো তোর সঙ্গে....
চমকে উঠলো তিলোত্তমা....গম্ভীর হয়ে গেলো ও।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সৌরর থেকে খানিকটা দূরে....
-না ভাই!বাড়িতে ঢুকলে এখন যা হবে,আমি জানি।আমার বাবা-মা আমার সঙ্গে যা খুশি করুক।বকুক-মারুক-ধরুক,আমি শুনে নেবো।কিন্তু তোর সামনে ওসব সহ্য হবে না।আমি একাই যাবো ওদের সামনে।তোকে ফোন করে জানালাম শুধু।কাল থেকে তুই পাগলের মতো মেসেজ করছিস.... তাই আসার পর....
-কাজটা ঠিক করলি না ভাই?আমি এখনও সহ্য করতে পারছি না!!কোনোদিনও মানতে পারবো না...
-কি জানি সৌর!যদি সত্যিই এই সুযোগটা পেয়ে যাই,তবে এটাই হয়তো আমার জীবনে করা সবচেয়ে সঠিক কাজ হবে....
-হুম!যা,বাড়ি যা!আমি রাতে ফোন করছি!
-ওকে!!
ফোনটা রেখে পিছনে ঘুরলো সৌর।কিন্তু মিছরি দাঁড়িয়ে নেই।ও অবাক হয়ে দৌড়ে বেরোলো রাস্তায়।একটু দূরেই দেখলো,মিছরি হেঁটে চলে যাচ্ছে।সৌর ছুটলো ওইদিকে...ওর কাছে পৌঁছেই টেনে ধরলো ওর হাত,
-ওই!!আমাকে না বলে কোথায় যাচ্ছ?
-তো কি করতাম সৌর?আমি আমার নাচের ক্লাস আধ ঘন্টা পিছিয়ে দিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি,আর তুমি তোমার বন্ধুকে এখানে ডাকছো!!আমি জোড়া-শিবমন্দিরের পিছনে আছি।এখানে চলে আয়!!তাহলে আমাকে ডাকার কি দরকার ছিলো?ওকে নিয়েই থাকতে পারতে!ওর জীবনের সমস্তরকম সমস্যার সমাধান করতে পারতে!!
-ও তো আসছে না মিছরি!!
-সেটা পরের কথা সৌর!ও আসছে না,সেটা পরের কথা।তুমি ওকে আমাদের সময়ের মধ্যে আসতে বলেছো,এটা আমি শুনেছি!আমি আমার নাচের ক্লাস,আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি থেকে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে,তোমার জন্য সময় বের করেছিলাম সৌর....
-উফফ!!উদ্ধার করে দিয়েছো আমায়!!
সকাল থেকেই বড্ড মনখারাপ সৌরর।এই একটা স্বভাব মিছরির ভীষণই খারাপ।ও কিছুতেই মানুষের দুর্বলতা,কষ্ট,ভালো লাগা-খারাপ লাগাটা বোঝে না।
মানুষের মন জুগিয়ে চলতে নাই বা পারুক,কিন্তু জীবনের কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মন বুঝে তো চললেও পারে!!অন্তত সৌরর মনের দিকটা ও বুঝবে না!?কিন্তু ও সবসময় নিজের দিকটাই ভাবে....আর পারলো না সৌর।ধৈর্য হারিয়ে ফেললো....
-হোয়াট!!কি বললে তুমি?তোমায় উদ্ধার করে দিয়েছি!!
-তো কি বলবো মিছরি?!তোমার নাচের ক্লাস,
তোমার জিম,তোমায় যোগা,তোমার টিউশন,তোমার পার্লার,তোমার সব থাকতে পারে,আমার থাকতে পারে না?!আমার বন্ধুবান্ধব,আমার খেলা,আমার আড্ডা,আমার চায়ের দোকানের জমাটি আসর,সব আছে!তুমি ছাড়াও আমার একটা জীবন আছে মিছরি....
-হ্যাঁ তো থাকুক না!!আমি তো তোমার পরিসরের মধ্যে ঢুকছি না সৌর।কিন্তু তুমি যখন আমাকে ডেকেছো,আমি আশা করবো,এই সময়টুকু তুমি আমাকেই দেবে।এই সময়টুকু তুমি সম্পূর্ণ আমার।আমাদের ব্যক্তিগত সময়ের মধ্যে তোমার বন্ধুরা আসবে কেন?ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায়,বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের জায়গায়।
-ওরা আমার জীবন মিছরি!সমু একটা ক্রাইসিসের মধ্যে আছে।সেইজন্য আমিও ভালো থাকতে পারছি না।মনটা ভালো নেই আমার।একটু বোঝার চেষ্টা করো আমায়।তোমাকে কি সব বলে-বলে বোঝাতে হবে সোনা?তুমি আমায় বুঝবে না?!আমার জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টে বাবা-মায়ের পরেই ওরা আছে,আমার বন্ধুরা....
গলা কেঁপে গেলো সৌরর....মিছরি এগিয়ে এলো সৌরর কাছে,দৃঢ়কণ্ঠে বললো,
-আমি প্রায়োরিটি লিস্ট খুব ভালোভাবে বুঝি সৌর।আমার জীবনেও অনেক কিছুর প্রায়োরিটি আছে।কিন্তু তাদের আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে দিই না।প্রত্যেকের জায়গা আলাদা।আমার জীবনেও সবকিছুর গুরুত্ব সমান।আমার বাবাই-মা,আমার নাচ,আমার কেরিয়ার,তুমিও....আমি সবকিছুকে একসঙ্গে নিয়ে চললেও,কেউ কারোর পরিসরে ঢুকবে না।কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার নাচের ক্লাস থেকে সময় কমিয়ে,টেনে-হিঁচড়ে তোমার জন্য সময় বের করেছিলাম সৌর।তাতেই আমার জীবনে তোমার মূল্য ঠিক কতখানি,এটা তোমার বুঝে যাওয়া উচিত ছিলো!বাই....
-এভাবে যেও না প্লিজ মিছরি!
-এই ছাড়ো তো!!
সৌরর হাতের মধ্যে থেকে নিজের হাতটা টেনে বের করে নিলো মিছরি....
-প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ,এতদিন পর দেখা হলো,শুধু ঝগড়া করেই চলে যাবে!?প্লিজ না....
সৌর ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে টেনে নিয়ে গেলো আবার নিজেদের জায়গায়....
-উফফ!ছাড়ো সৌর!
-উঁহু!
-যেতে হবে আমাকে।আন্টি এসে বসে থাকবে।
-আর একটু....
সৌর মিছরিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো....প্রচন্ড তেজের চোটে কিছুক্ষণ দাপিয়ে স্থির হলো তিলোত্তমা।দুহাতে আঁকড়ে ধরলো সৌরকে....
-তোমায় আমি ভালোবাসি মিছরি!তোমার কাছে এসেই তো আমি সব বলবো বলো!!তুমি এমন কোরো না আমার সঙ্গে।একটু আমাকে বোঝার চেষ্টা করো....প্লিজ...
-আচ্ছা ঠিক আছে।বাদ দাও ওসব।বাইরের ঝামেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যত্তসব উটকো ঝামেলা!!ছাড়ো!
তিলোত্তমা সৌরকে টেনে তুলে ওর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
-ঠিক আছে?খুশি তো?!এবার আমি যাই?
-হুম।এসো!মিছরি শোনো....
-কি?
-আমার পরীক্ষার পর তুমি আমায় কিছু বলবে বলেছিলে....তোমার স্বপ্নের কথা...
-হুম,বলবো তো।একদিন বাইরে কোথাও মিট করো।সব বলবো...এভাবে অন্ধকারে নিজের হাত-পা দেখতে পাচ্ছি না,তোমায় দেখতে পাচ্ছি না,মশার উৎপাত,এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বলতে পারবো না....সরি....
হেসে ফেললো সৌর....
-আচ্ছা,আমার বন্ধুরা তো তোমায় সেভাবে সামনাসামনি কখনও দেখেনি মিছরি।ওরা বলছিলো,তোমার সঙ্গে আলাপ করবে।তোমার কি একটু সময় হবে?মানে তুমি যদি আমার সঙ্গে আসো,আমার খুব ভালো লাগতো।
-সময়টা জানিয়ে দিও।আমি ওই সময় ফ্রি থাকলে,ভেবে দেখবো।
-ওকে!
-বাই!
দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো তিলোত্তমা।ওর নাচের ক্লাস আছে।আজ আর পিছন ঘুরে সৌরকে দেখার সময় হলো না ওর।তাই ও জানতেই পারলো না,যে ও গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত,সৌর ওর দিকেই চেয়েছিলো....
দরজা খুলেই কেঁপে উঠলো সমুর মা।দরজার সামনে মাথা নীচু করে ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।একটা কথাও বললেন না উনি।কাল থেকে সমুর বাবার সঙ্গে অশান্তিতে-ঝামেলায় ক্লান্ত উনি।কেঁদে-কেঁদে চোখমুখ ফুলে গেছে।আজ ছেলেকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছেলের বুকে।কেঁদে ফেললেন হু-হু করে....সমু দুহাতে জড়িয়ে ধরলো মাকে,
-তুই কি করলি বাবা?!শেষ পরীক্ষাটা দিলি না!!গোটা বছরটা নষ্ট করে ফেললি?!তোর বাবা তো কাল থেকে আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।দিনরাত বাড়িতে বসে থেকেও আমি নাকি তোকে মানুষ করতে পারিনি।তোকে স্বেচ্ছাচার করতে দিয়েছি।ছেলে কোথায় যাচ্ছে,কি করছে,কোনোদিকে হুঁশ নেই আমার।আমার আর ভালো লাগে না সমু!!এবার তুই গান ছেড়ে দে বাবা!এই গান-গান করে সংসারে এত্ত অশান্তি।রান্না-খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে....
চুপ করে গেলেন সমুর মা।ততক্ষণে সমুর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।মাকে ছেড়ে সমুদ্র এগিয়ে গেলো বাবার সামনে।মাথা নীচু করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।একটাও কথা বললো না,মাথা তুলে শুধু একবার বলতে গেলো "সরি বাবা!!" কিন্তু সমুদ্র মুখ খোলার আগেই ওর বাবা সজোরে একটা চড় মেরে বসলেন ছেলের গালে....
-ও কি করছো তুমি?এতবড় ছেলের গায়ে হাত তুলছ?
-অনেক দেরি করে ফেললাম এটা করতে।অনেক আগেই করা উচিত ছিলো।তাহলে আজ নিজের এতবড় ক্ষতিটা করার সাহস ও পেতো না....
চোখের জল পড়ে সমুদ্রর চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে।চুপ করে পড়ে-পড়ে বাবার হাতে মার খেতে থাকলো ও।একটাও কথা বললো না।মা টেনে সরিয়ে নিতে গেলেন ছেলেকে।কিন্তু উনি সামনে পড়ে যাওয়ায়,আঘাতটা ওনার ওপরেই এসে পড়লো।সমুদ্র টেনে সরিয়ে দিলো মাকে।
-মা তুমি সরে যাও...
-হ্যাঁ,সরে যাও তুমি!ওই দেবে আমার সব প্রশ্নের উত্তর।বল,স্কুলের মাইনে,টিউশনের মাইনে,বইপত্র-খাতাপত্র,গোটা একটা বছরের এত খরচ,আমার এত পরিশ্রম,তুই এইভাবে শেষ করে দিলি কেন?!যখন যা চাইছিস তাই,যখন মুখ ফুটে যেটা বলছিস,সেটাই তোর মুখের সামনে এনে হাজির করে দিচ্ছি আমি।তুই শুধু পড়াশোনাটা ঠিকমতো কর।নিজের ভবিষ্যৎটা তৈরি কর।আর কোনো কিছুর চিন্তা তোকে করতে হবে না।বাকি সবটা সামলে নেবো আমি!আর তুমি ছেলে বাপের জমিদারি দেখেছো,তাই না!!দিনরাত এক করে,ওভারটাইম করে সবদিক বজায় রাখার চেষ্টা করছি আমি।পেটেও খাচ্ছি,তোর ভবিষ্যতের জন্যও টাকা রাখছি,নিজেদের বৃদ্ধ বয়সের কথা ভাবছি,যাতে কাল তোর পরিবার হলে,তোর ওপর বেশি চাপ না পড়ে।রোগের চিকিৎসা,লোক-লৌকিকতা,আত্মীয়-স্বজন,দায়িত্ব-কর্তব্য,একজন পুরুষের জীবন সম্পর্কে কি জানিস তুই?কতটুকু জানিস?!নিজের বাড়িতে আছো,মাথার ওপর ছাদ আছে,পায়ের তলায় মাটি!অমনি মনে করছো এটাই বোধহয় নিশ্চিন্ত জীবন!এভাবেই জীবনটা কেটে যাবে।শুধু নিজের বাড়ি থাকলেই হয় না সমু!!ভবিষ্যতে কি বাড়ি কামড়ে খাবি?!তুই যখন তোর বর্তমানে উড়ে-উড়ে বেড়াচ্ছিস,আমি তখন আমার এই মস্তিষ্কে তোর ভবিষ্যৎ তৈরি করছি।আর মনে-মনে ভাবছি,তুই নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে,আমার পাশে এসে দাঁড়াবি।আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবি।মুখ বন্ধ করে সব করে যাচ্ছি বলে,বুঝতেও পারিস না,বাস্তবটা কতটা কঠিন!আরাম করে নরম বিছানায় শুয়ে গায়ক হবো,নায়ক হবো,ওইরকম অনেক দিবাস্বপ্ন দেখা যায়।দুদিন বাবার হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখো,বুঝে যাবে পৃথিবীটা কত কঠিন!!একটা পয়সা রোজগার করতে,কিভাবে মানুষকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়....
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র....
-বুঝেছি তো বাবা!খুব খিদে পাচ্ছিলো আজ।কেউ ডেকেও জিজ্ঞেস করেনি,ফিরেও তাকায়নি আমার দিকে।কেউ ওপর থেকে টেনে এনে খাওয়ার জন্য সাধ্যসাধনাও করেনি।তোমরা দুজন ছাড়া,পৃথিবীতে কেউ যে আমার খবর নেবে না,আমার থাকা না থাকায়,কারোর যে কিচ্ছু যাবে আসবে না,আমি জানি তো বাবা!!কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি না খেতে পেয়ে মরে গেলেও,জীবনে কিচ্ছু করতে না পারলেও,গান কিছুতেই ছাড়তে পারবো না।আমি মরে যাবো বাবা!!গান ছাড়ার থেকে,তুমি বরং আমাকে মারতে-মারতে মেরেই ফেলো....
-তোর লজ্জা নেই,নারে সমু?!এত বলার পরও,এত মার খাওয়ার পরও,ওই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস!!তুই এই দিনটা আর জীবনেও ফিরে পাবি?পরীক্ষাটাই দিলি না?!আমি তো ভাবতেই পারছি না!আমার অফিস কলিগরা,আত্মীয়-স্বজনরা জিজ্ঞেস করলে,কি বলবো আমি?!ছেলে আমার কাল গায়ক হবে,সেইজন্য আজ পরীক্ষা দেয়নি!!
কোনো উত্তর দিতে পারলো না সমুদ্র....চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো বাবার সামনে।বাবা মারতে-মারতে ওকে দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিয়েছিলো।মা কেঁদেই যাচ্ছে তখন থেকে....
-নাঃ!!তোকে আর কিচ্ছু বলার নেই সমু!ভেবেছিলাম,ছেলেটা আমার বড় হয়ে বাবার কষ্টটা অন্তত বুঝবে।কিন্তু আর কোনো আশা নেই এর কাছে।আমি একটা অকালকুষ্মান্ড জন্ম দিয়েছি....
দৌড়ে ঘরে চলে গেলো সমুর বাবা...কাঁদতে-কাঁদতে সমুদ্র মেঝেতেই বসে পড়লো।বাবার হাতে মার খেতে-খেতে ওর শার্ট ছিঁড়ে গেছে।মা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।মায়ের কোলে মাথা গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র...
রাতে মা ওপরে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে সমুদ্রকে।বাবা নাকি রাতে কিছুই খায়নি।মা-ও হয়তো খাবে না।বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়েছিলো সমুদ্র।বাবা এত মেরেছে,সারা গা ব্যথা করছে ওর।জ্বরও এসে গেছে মনে হয়।মাথা-গা-হাত-পা সব শিরশির করছে।ফোনটা বেজেই যাচ্ছে তখন থেকে।ঋষি-রূপ দুজনের সঙ্গেই কথা হয়েছে।ওদের মিথ্যে বলেছে সমুদ্র।এতসব ঝামেলার কথা আর কিছুই জানায়নি ওদের।কিন্তু এতক্ষণ সৌরই একবারও ফোন করেনি।এবার ফোন বাজতেই সমুদ্র বুঝতে পারলো,ফোনটা সৌরই করছে।ও আর স্ক্রিনের দিকে চাইলোও না।ফোনটা ধরেই বললো,
-বল!
-তুই বল!!
-কি বলবো?
-সব ঠিক আছে?
-হুম!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৌর বললো,
-কাকু তোর গায়ে হাত তুলেছে,নারে সমু?
আর কোনো উত্তর দিলো না সমুদ্র।ফোনটা মুখের সামনে চেপে ধরে হু-হু করে কেঁদে উঠলো শুধু....সৌরর বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো অজানা যন্ত্রণায়....
দিন তিনেক হয়ে গেছে সমুদ্রর সঙ্গে ওর বাবা কথা বলেন না।খুব প্রয়োজন ছাড়া সমুও খুব একটা নীচে নামে না।বাবা বাড়িতে থাকলে তো একেবারেই না।মা যতটা পারে,সমুকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে।সমু নিজে থেকে চায়নি।কিন্তু মা নিজেই গিটারটা ওপরে দিয়ে গেছে।বাবাকে ঠিক বোঝে না সমুদ্র।বাবা ওকে ক্ষমা করেছে কিনা,সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহসও ওর নেই।সেদিন দুপুরে ও গানের ডায়েরীটা খুলে চুপচাপ শুয়েছিলো বিছানায়।মাথার কাছের জানলাটা খোলা ছিলো।সেইদিকে একভাবে চেয়েছিলো ও।মাথায় ঘুরছিলো একাধিক শব্দের খেলা....হঠাৎ করে সৌর ফোন করলো ওকে,
-হুম?
-বিকেলে বেরোবি!
-নাঃ!
-আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি না সমু,বলছি!বিকেলে তুই বেরোবি!!দিনরাত ঘরের মধ্যে পড়ে আছিস কেন?আমরা কি মরে গেছি!
-আমি বেরোবো না!
-ঠিক আছে।আমি,ঋষি,রূপ তোর বাড়িতে আসছি।আমার সঙ্গে মিছরিও থাকবে।
-আবে তুই পাগল নাকি!!বাড়ির পরিস্থিতি ভালো না....
-তাহলে চুপচাপ বেরিয়ে আয়,সিসিডিতে।ঋষি আর রূপ অনেকদিন ধরেই মিছরির সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে।তুইও তো ওকে সেভাবে দেখিসনি।কাল থেকে আমরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাবো।ওর ইন্টার-পুল কম্পেটিশন,আমার প্র্যাকটিস,আর নিজেদের জন্য,তোদের জন্য খুব একটা সময় থাকবে না।তাই চলে আয় আজ।বিকেল পাঁচটা....না আসলে মনে থাকে যেন,সবশুদ্ধ তোর বাড়িতে গিয়ে উঠবো কিন্তু!
-আসবো-আসবো!!
-গুড!চল বাই!!
-ইয়ে মানে,একটু বেশিই ছোট না মিছরি?!
গাড়ির পিছন দিকের দরজাটা খুলে দিয়েছিলো তিলোত্তমা।গাড়িতে ঢোকার আগেই ওর উন্মুক্ত উরুর দিকে চেয়ে সৌর বলে উঠলো।তিলোত্তমার সাদাকালো রঙের ফিতে দেওয়া টপটায়,ঠিক বুকের ওপরে লেখা রয়েছে,"বি ইয়োরসেলফ!"সেইসঙ্গে ফেডেড-জিন্সের একটা হটপ্যান্ট পরে রয়েছে ও।মানে শরীরের নিম্নাঙ্গে যতটুকু আবরণ একেবারেই না থাকলে নয়,ঠিক ততটুকুই অংশই আবৃত।বাকি উরু সম্পূর্ণই উম্মুক্ত।গাড়িতে ঢুকতে গিয়েই মিছরিকে দেখে থমকে গেলো সৌর....
-হোয়াট?এটা ফ্যাশন সৌর!!কাম ইন!
তিলোত্তমা সৌরর একটা হাত ধরে গাড়ির ভিতর দিকে টানলো।সৌর গাড়িতে বসে বললো,
-শুধু আমার সঙ্গে বেরোলে কোনো ব্যাপার না!কিন্তু আমার বন্ধুগুলো তো,সব এক-একটা জিনিস!মুখ খুললে আর বন্ধ হয় না।তাই বলছিলাম আর কি...
প্রত্যুত্তরে একটু হাসলো তিলোত্তমা।ড্রাইভারকে বলে উঠলো,
-চলো কাকু!
বলেই একটু হেসে সৌরর হাতটা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে গুছিয়ে বসলো তিলোত্তমা...সৌর মিছরির দিকে একবার গভীরভাবে চাইলো।তারপরই হাত রাখলো তিলোত্তমার মসৃণ অনাবৃত উরুতে....
-এ ভাই,এরা কখন আসবে রে ভাই?গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করাবে বলে ডাকলো,এখন নিজেদেরই তো আর পাত্তা নেই।কখন থেকে এসে বসে আছি!
সিসিডিতে বসে বিরক্ত হয়ে রূপ বলে উঠলো।বেশ কিছুক্ষণ আগে ওরা তিনজনই পৌঁছে গেছে...সমুদ্র একভাবে মাথা নীচু করে চেয়ে রয়েছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে।মুখটা গম্ভীর....
-দাঁড়া!সঙ্গে মেয়ে থাকবে।তার রেডি হতে-হতে দেখবি,এক ঘন্টা!!লিখে রাখ রূপ,ওই ছটার আগে সৌর ঢুকতেই পারবে না!এখন তো আর ভাই আমাদের সিঙ্গেল নেই....
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঋষি বলে উঠলো...
-ভাই রঞ্জার সঙ্গে কেসটা সাল্টে গেলে,তুইও সিঙ্গেল থাকতিস না।তখন আমরাও আওয়াজ দিতাম!
-ও বাবা!ছেলের গায়ে লেগে গেলো তো!তা সিঙ্গেলের কথায় মনে পড়লো,নিশা কেমন আছে?
-হ্যাঁ ভালোই আছে!ওর খবরে তোর কি দরকার?
-আরে নিশা তো আমারও বন্ধু নাকি!!বন্ধু হয়ে বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করতে পারবো না?!আশ্চর্য তো!!তুই এত খেপে যাচ্ছিস কেন?ইনসিকিউরিটি?
-এই সমু,ঋষির জন্য একটা মেয়ে দেখ তো ভাই।সিঙ্গেল থেকে-থেকে ওর মাথাটা গেছে....
-ওই ওটা সৌর না?!
ঋষির কথায় বাকি দুজনই একসঙ্গে কাঁচের বাইরে চোখ রাখলো।সৌর নামার পরই গাড়ি থেকে নামলো তিলোত্তমা।ওইদিকে একবার মাত্র দেখেই মাথা নামিয়ে নিলো সমুদ্র।আবার মন দিলো মুঠোফোনে।কিন্তু ঋষি হাঁ করে চেয়ে রয়েছে ওইদিকেই....
-কি দেখতে রে রূপ!একেই কি সেদিন আমরা মাঠে দেখেছিলাম?অন্ধকারে তো বুঝতেই পারিনি রে সেদিন!একে সৌর কোথায় পেলো রে!?এ মেয়ে না ট্রফি?একে নিয়ে এভাবে রাস্তায় বেরিয়েছে কেন?আমি হলে তো শো-কেসে সাজিয়ে রাখতাম,আর দিনরাত শুধু দুচোখ ভরে দেখতাম!!ভাই লেগস দেখ ভাই!
-উউ ঋষি!ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড!
গম্ভীরভাবে বললো সমুদ্র....
-এই তুই থাম তো!!এইরকম পা-ই তো দেখাতে হয়!এই সৌর কই রে?
-মেয়েটার পাশেই আছে ভাই!তোর ফোকাস একজায়গায় আটকে গেছে।একটু ওপর দিকে দেখ,চোখটা ফিরিয়ে দেখলেই বুঝবি,সৌর ওর পাশেই আছে।
বলেই হেসে ফেললো রূপ....
-উফফ!মানে,সত্যি!কেন সৌরর মতো ছেলে পাগলামি করবে না বল?!ভাই ওটা স্কিন না টিউবলাইট,ওইরকম জ্বলছে কেন?
-আবে ঋষি!!
দুম করে একটা উড়ন্ত চাঁটি এসে পড়লো ঋষির মাথায়।ধমকে উঠলো সমুদ্র,
-তখন থেকে বলছি ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড!ঠিকভাবে দেখ,ঠিকভাবে দেখ....
-আরে কি ঠিকভাবে দেখবো ভাই!!আমি তো চোখই সরাতে পারছি না।তুই বল রূপ,আমি সিঙ্গেল তো?
-একদম!!একশো শতাংশ!
-আর ওটা একটা মেয়ে,ভীষণ সুন্দরী মেয়ে।সবাই এগ্রি করবি তো?
-হ্যাঁ,এই ব্যাপারে আমি তোর সঙ্গে সহমত পোষণ করছি ঋষি।সুন্দরকে সুন্দর বলতেই হয়।
রূপ বললো,কিন্তু সমুদ্র চুপ করেই রইলো...
-ওকে,আমি সিঙ্গেল,আর ও সুন্দরী একটা মেয়ে,হোক না সৌরর গার্লফ্রেন্ড।সেটা হয়ে গেছে।ওটাতে তো আর কারোর কিছু করার নেই।কিন্তু সৌরর গার্লফ্রেন্ড বলে কি,দূর থেকে একটু প্রাণভরে দেখতেও পারবো না?!আমি সিঙ্গেল,ও সুন্দরী।সেজন্য আমি দেখবোই।পারফেক্ট লজিক না রূপ?
-কি বালের লজিক রে ভাই!!মানে সিঙ্গেল বলে,বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকেও দেখবো?!
হেসে উঠলো রূপ...
-এই চুপ!সৌর ঢুকছে...
সমুদ্রর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে ঋষি মুখটা বন্ধ করলো ঠিকই,কিন্তু চোখদুটো অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওদের দিকেই...
কাঁচের দরজা ঠেলে সৌর ভিতরে ঢুকলো তিলোত্তমাকে সঙ্গে নিয়ে।ওরা এলে সবাই একসঙ্গে চেয়ারে বসলো।তিলোত্তমার উপস্থিতিতে মাতাল করা একটা সুগন্ধী ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে।ওই সুগন্ধী কিছুদিন আগে সৌরই ওকে উপহারস্বরূপ দিয়েছে।সবাই বসলে সৌরই কথা শুরু করলো,
-ওকে,লেট মি ইন্ট্রোডিউস....রূপায়ণ,সমুদ্র,ঋষভ।অলসো নোন এজ,রূপ,সমু এন্ড ঋষি...এরা সবাই আমার বন্ধু!আর ইনি হচ্ছেন আমার ওয়ান এন্ড অনলি গার্লফ্রেন্ড,তিলোত্তমা সান্যাল!
-হাই....
-হ্যালো!!
বাবা দুপুরবেলা বাড়িতে ভাত খেতে গিয়েছিলো।তাই ওই সময়টা কিছুক্ষণ দোকানে গিয়ে বসেছিলো রূপ।তারপর ওখান থেকেই সোজা এখানে বেরিয়ে এসেছে।এখন ওর গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে।ব্যাগ থেকে ছোট একটা জলের বোতল বের করলো রূপ,একটু জল খাবে বলে।সেই সময়ই টেবিলের ওপর রাখা নিজের আইপ্যাডটা একটু সরিয়ে রেখে গুছিয়ে বসে,তিলোত্তমা আদুরে গলায় বলে উঠলো,
-তোমাদের রূপ-ঋষি-সমুর মতো আমারও কিন্তু একটা সুন্দর নাম আছে।সৌরও আমাকে ভালোবেসে ওই নামেই ডাকে...আমার আর একটা নাম মিছরি!!
হেসে উঠলো ঋষি।তিলোত্তমা ঠিক ওর পাশের চেয়ারেই একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে বসে আছে,ওর ওপাশে সৌর বসে।ঋষি একবার তিলোত্তমার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-ওয়াও!!
-এক্সকিউজ মি?!
তিলোত্তমার কথায় ঋষি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-না মানে....ওয়াও!!কি অদ্ভুত মিল না রূপ!?জানো তো মিছরি,আমাকেও তো আমার বন্ধুরা মাঝে-মধ্যে ভালোবেসে পিঁপড়ে বলে ডাকে!!
বোতল খুলে সবে একটুখানি জল মুখে দিয়েছিলো রূপ।বিষম খেয়ে সবার সামনে বিচ্ছিরিভাবে ছড়িয়ে ফেললো।হেঁচে-কেশে সাংঘাতিক অবস্থা ওর।ও তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে,সরে গেলো ওখান থেকে।সমুদ্র ঋষির দিকে এমনভাবে চেয়ে রয়েছে,পারলে ওকে গিলেই খায়,চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে।সৌর ঠান্ডা দৃষ্টিতে সরাসরি তাকালো ঋষির দিকে।পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো মিছরির হাতে।হঠাৎ করে রূপ বিষম খাওয়ায়,একটু-আধটু জল ছিটকে আসতে পারে ওর গায়ে।সবার মুখের দিকে একবার মাত্র চেয়ে,প্রাণখোলা হাসি হেসে গড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমা....
(চলবে.....)
ছবি: সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন