অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

অসমাপ্ত (পঞ্চম পর্ব)




অসমাপ্ত

পঞ্চম পর্ব

সাথী দাস


-আজ মা কেমন আছে রে?ওনার হাতটা....

নিশার বাড়ির সামনে গিয়ে,রূপ সাইকেলের ঘন্টা বাজাতেই ও বেরিয়ে এসেছে বাইরে....ওরা নিশাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো...
-এই তুই আমার মাকে মা বলিস কেন রে?কাকিমা বলতে পারিস না?

নিশার সোজাসুজি প্রশ্নে কেঁপে উঠে মাথাটা নামিয়ে নিলো রূপ...

-না।পারি না....আর কেন পারি না,কারণটা তুই জানিস!

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো নিশা।তারপর বললো,

-তুই নিজেই ভিতরে এসে দেখে যা!মা ঘুমোচ্ছে,আমি ডেকে দিচ্ছি।
-না থাক!ঘুমোচ্ছে যখন আর ডাকতে হবে না।এমনিতেও আমি এখন মাঠে যাবো....ভালো আছেন তো?
-হুম!রূপ শোন?
-বল!
-কিছুনা...
-কিছু তো বটেই।বল....কথা শুরু করলে শেষ করতে হয়!মাঝপথে ছেড়ে দিতে নেই....
-খুব রাত জেগে পড়ছিস বল?চোখের কোলে কালি পরে গেছে।
-হুম,এই কটাদিন তো একটু খাটতেই হবে।এটা কিন্তু তুই বলবি বলে আমায় ডাকিসনি।কথা ঘোরাচ্ছিস কেন?

হেসে ফেললো নিশা...

-তুই কি করে বুঝলি?!
-জানিনা!মনে হলো!বল,কি বলবি?আসল কথাটা বল...ওইভাবে আমায় ডাকলি কেন?
-যা!খেলতে যা!
-যাবো না।আগে তুই বল!
-তুই যাবি?নইলে কিন্তু আমি তোকে তাড়িয়ে দেবো....
-তুই তাড়ালেও আজ আমি যাবো না নিশা।আগে বল...
-রাত জাগছি রূপ।কিন্তু পড়তে পারছি না।

মাথা নামিয়ে নিলো রূপ।এটা তো ওর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই হয়...

-কেন?
-সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না!
-কিসের সিদ্ধান্ত?
-পরদিন সকালে কি রান্না হবে,সেই সিদ্ধান্ত....

অনেকটা আশা নিয়ে হাঁ করে নিশার মুখের দিকে চেয়েছিলো রূপ।কিন্তু ততক্ষণে ওর মুখে একগাল মাছি....

-উফফ!!বল না নিশা!!কেন এভাবে মারছিস আমাকে?
-তোর থেকে তিনহাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছি।তোকে ছুঁইও নি।আর তুই বলছিস,তোকে মারছি?মিথ্যুক কোথাকার!!
-না ছুঁয়েও তো সেই কবে থেকেই মেরে যাচ্ছিস....বল না!আর তো সহ্য হচ্ছে না....
-পাগল একটা,দূর হ!যা...খেলতে যা...
-নিশা প্লিজ...

সাইকেল থেকে নেমে পড়ে রূপ।এগিয়ে যায় নিশার দিকে।ওর একটা হাত চেপে ধরে....

-ওই ছেলে,কি করছিস?তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নাকি?!জেম্মাদের ছাদ থেকে আমাদের উঠোনটা দেখা যায় রে!!কে কোথায় দাঁড়িয়ে থাকবে,কি ভাববে দেখলে...উফফ!!আমার হাতটা ছাড়!!

রূপকে মৃদু শাসন করে ওঠে নিশা...শাসনে মিশ্রিত থাকে প্রশ্রয়মিশ্রিত আদর....

-সেদিন কি ভেবেছিলো ওরা?থেকেছিলো তোর পাশে?যেদিন মায়ের হাত কেটে গিয়েছিলো?একজন মানুষও কি এসে দাঁড়িয়েছিলো তোর পাশে?তাই আজ ওরা কি ভাবলো না ভাবলো,তাতে তোর কি এসে যায়?!তোর হাত ধরেছি,এটা ওরা দেখলে আমার ভারী বয়েই গেলো।আর ওরা দেখবে,কিছু ভাববে,সেই জন্য আমি কিন্তু তোর হাত ছাড়বো না,কিছুতেই ছাড়বো না।দুটো হাত ধরবো,ওদের দেখিয়ে-দেখিয়েই ধরবো।তোকেই জড়িয়ে ধরবো....হ্যাঁ,তুই না চাইলে ছেড়ে দেবো...কিন্তু ওরা দেখবে বলে নয়....
-নিশা?কে এসেছে রে?কার সঙ্গে কথা বলছিস?

ঘরের ভিতর থেকে নিশার মায়ের ডাক শুনেই,নিশার হাতটা ছেড়ে দিলো রূপায়ণ।
-রূপ এসেছে মা!
-তা ওকে ভিতরে আসতে বল।বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন?
-হুম,বলছি....

নিশার কব্জিটা এত জোরে চেপে ধরেছিলো রূপ,ও ছেড়ে দিতেই জায়গাটা টনটন করে উঠলো।নিজের এক হাত দিয়ে অন্য হাতটা ধরে নিশা বললো,
-হয়ে গেলো?সব সাহস শেষ?মায়ের গলা পেয়ে অমনি হাত ছেড়ে দিলি?!ভয় পেয়ে গেলি তো?

রূপ একভাবে চেয়ে রইলো নিশার দিকে।বললো,

-ভয়ে নয়,তাকে সম্মান করে হাত ছেড়েছি।তার সামনে তার মেয়েকে ছুঁতে পারিনি।কিন্তু তুই যদি তাই চাস,তবে তাই হবে....আয়!!

নিশার হাত ধরে ওকে ঘরের ভিতর দিকে টানতে-টানতে নিয়ে যায় রূপ....
-উফফ!!ছাড় রূপ!মায়ের সামনে....

রূপের হাতের মধ্যে থেকে টেনে নিজের হাতটা বের করে নেয় নিশা....
-কেন?এবার কেন?
-উফফ....তুই পারিস সত্যি!!ভিতরে আয়।মা ডাকছে...
-চল!!

নিশার মাকে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ায় ওরা।অদূরেই সুবিস্তৃত খেলার মাঠ দেখা যাচ্ছে...
-বললি নাতো!
-কি বলবো?
-যেটা বলতে গিয়েও থেমে গেলি?!আমাকে ডাকলি বলবি বলে...সেই কথাটা...
-কিছু না!তুই খেলতে যা...
-নিশা!!
-যা!
-আর কত মারবি আমায়?
-যা....

বলেই একদৌড়ে উঠোন পেরিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলো নিশা...সাইকেলের ওপর বসে কিছুক্ষণ ওই দরজার দিকে চেয়ে রইলো রূপ,তারপর বেরিয়ে গেলো মাঠের দিকে....

-ছেলেটা ভালোই।নম্র-সভ্য-ভদ্র!কথাবার্তা কত ভালো!
-হুম!চা-টা খেয়ে নাও মা।

মায়ের সামনে এসে চায়ের কাপটা বিছানায় নামিয়ে রাখলো নিশা।এককাপ কালচে লিকার চায়ের সঙ্গে সস্তা দুটো বিস্কুট।
-ছেলেটা এলো,ওকে একটু কিছু খেতে দিলি না!সেদিন ছেলেটা অত দৌড়াদৌড়ি করলো আমার জন্য।আজ আবার বাড়ি বয়ে খবর নিতে এলো,খালি মুখেই ফিরে গেলো।তখনই তো স্টোভটা ধরাতে পারতিস,একটু চা বসিয়ে দিলে,চা আর বিস্কুট অন্তত....
-ও খেলতে এসেছে মা।চা খেতে,গল্প করতে গেলে সন্ধ্যে নেমে যাবে।তাই বেশিক্ষণ বসেনি।তোমার শরীরের খোঁজটা নিয়েই চলে গেলো।
-পরীক্ষা সামনেই এসে গেলো।এবার টিউশনিগুলো ছেড়ে দে মা।নিজের পড়াশোনার দিকে একটু মন দে।শরীরটার দিকেও তো দেখতে হবে।সকালে পড়তে যাস,তারপর স্কুল,স্কুল থেকে ফিরেই নাকে-মুখে দুটো ভাত গুঁজে বাচ্চাগুলোকে পড়াতে বসিস,তারপর আবার রাত জেগে নিজের পড়া,এত শরীরে দেবে না।পরীক্ষার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়বি।পরীক্ষার পর আবার টিউশনি করিস।এখন ছেড়ে দে...
-ওগুলো ছাড়লে হবে না মা।মামারা আর কত টাকা পাঠাবে?বোনকে ওখানে রেখে মানুষ করে দিচ্ছে,এটাই তো অনেক।আর আমার হাত-খরচ,আমার পড়ার খরচ দিচ্ছে।সংসার চালানোর খরচ দিচ্ছে,আর কত করবে?নিজেদেরও তো হাতে কটা টাকা রাখতে লাগে।সময়ে-অসময়ে কার কাছে হাত পাততে যাবো?!
-আমিও অসাবধানে হাতটা অকেজো করে বসলাম।মেশিনে সেলাইগুলো করতে পারলেও টাকাটা পাওয়া যেতো...কতগুলো অর্ডার পড়ে আছে।কাজ না করলে অর্ডারগুলো হাতছাড়া হয়ে যাবে।টাকাটাও আর পাবো না!
-মা!এত ভেবো না তো!কথা বলতে গিয়ে চা-টা তো জুড়িয়ে জল হয়ে যাচ্ছে।খেয়ে নাও।আমি দোকান থেকে আসছি।রাতের রান্নার জন্য কটা ডিম এনে রাখি...
-ওই তাকে টাকা আছে দেখ...
-আমার কাছে আছে মা!আসছি আমি।চা খেয়ে আবার কাপ-প্লেট ধুতে বসে যেও না যেন।জলে একদম হাত দেবে না।মেঝেতে নামিয়ে রাখবে,আমি এসে মাজবো...
-এই জামাটা পরেই যাচ্ছিস?জামাটা অন্তত বদলে নে...

হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে যাচ্ছিলো নিশা।বাইরে যাওয়ার জন্য ততক্ষণে ওর মনটা,ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছে।কিন্তু মা ডাক নেওয়ায় এবার একটু নিজের দিকে ফিরে চাইলো ও।ঘরের জামাটা বদলে নিয়ে একটা চুড়িদার পড়লো।ছোট আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কাজল-পেন্সিলটা একবার বুলিয়ে নিলো চোখের কোলে।তারপর আয়নায় রাখা কালো টিপটা সযত্নে বসিয়ে দিলো একজোড়া অগোছালো ভ্রু-র একেবারে মাঝখানে।চুলটা আঁচড়ে নিলো,কিন্তু আজ আর বাঁধলো না।খুলেই রাখলো দীর্ঘ চুলের রাশি...তারপর আলনা থেকে ওড়নাটা টেনে নিয়েই নিশান্তিকা ছুটে বেরোলো বাড়ি থেকে।শান্ত-ধীর-স্থির-বুঝদার মেয়েকে এভাবে লাফালাফি করতে,নিশার মা আগে কখনও দেখেননি।তাই উনি কয়েক মুহূর্ত মেয়ের উড়ে বেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে,চুমুক দিলেন উষ্ণতা হারিয়ে যাওয়া চায়ে....

বলটা গড়াতে-গড়াতে মাঠের পাশের সরু গলিটা পেরিয়ে ঝোপের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো।সমুদ্র ওটাকে তুলতে নীচু হওয়ামাত্রই দেখলো,একজোড়া পা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।হাতে বলটা নিয়ে ধীরে-ধীরে মাথা তুলে ও দেখলো,ওর সামনে নিশান্তিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

-কিরে?কাকিমার হাত ঠিক আছে এখন?
-হুম!
-আচ্ছা!বেরোচ্ছিস নাকি কোথাও?এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?
-কোথায় সেজেছি রে আমি?

চেঁচিয়ে উঠলো নিশা....
-বাপরে!!এত চেল্লাচ্ছিস কেন?না মানে,একদমই তো সাজতে দেখি না তোকে।একটু কাজল আর টিপ পরেছিস,তাতেই মনে হচ্ছে যেন কত সেজেছিস!!সুন্দর লাগছে তো বেশ।তাই আমি ভাবলাম,কোথাও যাচ্ছিস হয়তো....একটু জিজ্ঞেস করাও যাবে না নাকি!!গিলে খেতে আসছে যেন!যত্তসব!!
-না মানে তেমন কোথাও না....সমু শোন...

বল হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে যাচ্ছিলো সমুদ্র।নিশার ডাকে আবার থামলো।তখন সন্ধ্যে প্রায় হয়-হয়....

-কি?
-মাঠে.....মাঠে রূপ আছে রে?

চমকে উঠলো সমুদ্র....
-ওই!!কি বললি তুই?আর একবার বল....
-কিছুনা!!

মাথা নামিয়ে নিলো নিশা... সমুদ্রর চোখদুটো রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গেলো।ও বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বললো,
-এ ভাই!!এত রং নাম্বার হয়ে গেলো রে!!
-মানে?!

হাঁ করে রয়েছে নিশা।সমুদ্রের কথার গভীরতা ও কিছুই বুঝতে পারলো না....
-না মানে,এই তোর যেটুকু সাজগোজ,এটা তো সবটাই রং নাম্বারে ডায়াল হয়ে গেলো রে নিশা।মানে আমার চোখে পড়ে গেলো।এটা তো তার জন্য....
-জুতো খুলে মারবো হারামি....

সমুদ্র বলটা মাঠে ছুঁড়ে দিয়ে হাসতে-হাসতে দৌড়ে ছুটলো মাঠের দিকে.....মৃদু হেসে নিশা ওইখানেই দাঁড়িয়ে রইলো,সুবৃহৎ একটা নারকেল গাছের আড়ালে....

-সেদিন আসবে-আসবে বলেও,সে তো আসেনি/
ভালো বাসবে বলেও কি,ভালো বাসেনি/
তবে তোমার আজ কিসের এত অভিমান প্রিয়ে/
একটিবার চেয়ে দেখো ক্লান্ত পথিক/
সে তোমারই জন্য অপেক্ষারত,নিজের সর্বস্বটুকু নিয়ে....

গান গাইতে-গাইতে সমুদ্র ছুটে এলো রূপের দিকে...দাঁত খিঁচিয়ে উঠলো রূপ,
-সবকিছুর একটা সময় থাকে সমু!!বল আনতে গিয়েও কি তোর গান পায়?থেকে-থেকে যে কি ভূত ভর করে তোর মাথায়!!
-ভূত নয় হে প্রেমিক!!ভূত নয়!!অগ্রে উহার লিঙ্গ-পরিবর্তন করো,ভূত নয়,চাইলে তুমি তাকে শাকচুন্নির সম্মানে আখ্যায়িত করতে পারো।তোমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা সেটা।তবে অগ্রে লিঙ্গ-পরিবর্তন করিয়া,পশ্চাৎ-এ আমার গানের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করো....বুঝিয়া যাইবে তুমি,কি মোর ভাবনা....
-এ বাল কি বকছে রে ও?এত শুদ্ধ বাংলা বুঝি না।যখন খিস্তি মেরে সহজ ভাষায় কথা বলবি,তখন আমায় ডাকবি!!

সমুদ্র এগিয়ে এলো রূপের একেবারে কাছে।তারপর নিজের দুহাত রূপের গালে রাখলো,চোখ রাখলো রূপের দু-চোখে....চমকে উঠলো রূপ....
-এই-এই-এই ভাই!!এবার কি আমায় চুমু খাবি নাকি!!
-চোখ মেলে দেখো বালক,তুমি আজ পুরুষ অনন্ত/
তোমার দ্বারে সে আসিয়াছে/নিয়ে একমুঠো বসন্ত....
-মানেটা কি ভাই!?খেপে গেছিস নাকি তুই!
-তুইও আনন্দে খেপে যাবি ভাই!!
-মানে?
-আরে ওদিকে দেখ রে...

দুহাতে রূপের মুখটা দুম করে মাঠের প্রান্তে ঘুরিয়ে দিলো সমুদ্র।রূপ দেখলো,একটা নারকেল গাছের আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশা।ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে একভাবে....অবাক হয়ে গেলো ও।সর্বশরীর কেঁপে উঠলো উত্তেজনায়।শরীরে খেলে গেলো একটা অদ্ভুত শিহরণ...
-এ ভাই?তোকে কি এবার কোলে করে দিয়ে আসবো রে?যা....

রূপ কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলো।সমুদ্রের কথায় হুঁশ ফিরলো ওর।আর মাথা তুলতে পারলো না।একটু হেসে মাথা নীচু করে খেলা ছেড়ে এগিয়ে গেলো ওইদিকে....কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রূপ এসে দাঁড়ালো নিশার মুখোমুখি....

-কিছু বলবি?
-হুম!
-বল!
-মায়ের শরীর ভালো থাকে না।বোন মামাবাড়িতে থাকে।কালেভদ্রে আসে।
-তো?
-ভবিষ্যতে আমার মায়ের দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে না।কিন্তু আমি যখন উপযুক্ত হয়ে আমার মায়ের-বোনের সমস্ত দায়িত্ব বহন করবো,তখন আমার কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে আমার হাতটা ধরে থাকতে হবে....
-কাকে?
-যাকে বলছি,তাকেই!!
-তোর পরিবারটা পরিবার,আমার পরিবারটাও যেন....
-তোর মাকে তো কাকিমা বলে আজ পর্যন্ত ডাকিনি,মা-ই বলেছি!আর তোর বোন,মানে আমার শালি তো অর্ধেকটাই আমার!তোর বোনের বরের আর তোর কোনো অসুবিধে না থাকলে,পুরোটাই না হয় আমার করে নেবো।দুই বোন দুই সতীন হলে ঝামেলাটা কমই হবে...আমার পরিবার পুরো তোর,আর তোর পুরো পরিবার আমার....ঠিক আছে তো?
-ছোটলোক কোথাকার!!কঞ্চি দিয়ে পেটাবো তোকে দাঁড়া....অভদ্র....
-আরে দাঁড়া-দাঁড়া!কঞ্চি পরে খুঁজবি!এদিকে আয়....

নিশার একটা হাত টেনে ধরে রূপ....
-রূপ পাড়ার মধ্যে....হাত ছাড়!!
-তো?তাতে হয়েছেটা কি?আজ তো বেশ সুন্দর করে সেজেছিস!আমার জন্য নাকি?
-দূর হ!
-তাই?দূর হবো?দূরে ঠেলার জন্যই বুঝি কাছে এসেছিস!!

মাথা নীচু করে হেসে ফেললো নিশা....
-আসছি আমি!একটু দোকানে যাবো।হাত ছাড়...
-ওকে!!কাল,বিকেল পাঁচটা!রুমাদির টিউশনের পর ফুচকা খেতে যাবো।তুই আর আমি,আর আমার ভাইগুলো তো আমার সঙ্গে ফ্রি।ওরা থাকবেই।কিন্তু তার মধ্যে দিয়েও,তুই আর আমি....
-এই যে শোন,হ্যাঁ বলেছি!!তার মানে এই নয়,তোর সঙ্গে ট্যাং-ট্যাং করে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে হবে!!এতো দেখি,বসতে বললে একেবারে শুতে চায়...

রূপ আর একটাও কথা বললো না।একভাবে চেয়ে রইলো নিশার দিকে।মুখে মৃদু হাসি....
-শাট আপ!!
-আমি তো কিছু বলিইনি...তুইই বলেছিস!এবার কথাটা তোর নিজের কানেই লেগেছে!আর আমাকে ধমকাচ্ছিস!!যাঃ শালা!!

হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়লো রূপায়ণ....আর কথা খুঁজে পেলো না নিশা...

-চললাম!
-দাঁড়া!
নিশা ঘুরে দাঁড়াতেই ওর পথ আটকে দাঁড়ালো রূপ...
-কি?
-ভালোভাবে বলে যা নিশা...
-কি?
-ভালোবাসিস আমায়!
-আমি অত গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।যেভাবে বলেছি,ওইভাবেই ঠিক আছে।আর তাতে তোর কাজ না চললে,অন্য কাউকে খুঁজে নে...
-আমার তোকেই চাই।আর কেউ গুছিয়ে কথা বলতে পারুক আর না পারুক,নিজের মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে,"ভালোবাসি তোকে" এটুকু তো বলাই যায়।একবার বল না নিশা!তোর মুখ থেকে ওইটুকু শুনবো বলে,কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি বল তো!?একবার বল,ভালোবাসি তোকে...

দুস্টুমির হাসি খেলে গেলো নিশার ঠোঁটে....ও রূপের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
-আমিও...

আর দাঁড়ালো না ওখানে....ছিটকে বেরিয়ে গেলো....
-এটা চিটিং!ফাঁকি মারলি তুই!!তোকে ওটা বলতে বলিনি....
-আমি কিন্তু ফুচকায় বেশি ঝাল খেতে পারি না রূপ...আমার মিষ্টি পছন্দ....

বলতে-বলতেই দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো রূপের ভালোবাসা....মিলিয়ে গেলো মুদিখানা দোকানের অন্তরালে...মাথা নামিয়ে নিলো রূপ....বললো,
-ঠিক আছে নিশা!তোর মুখ মিষ্টি করার দায়িত্ব,আজ থেকে আমিই নিলাম!!

রূপ ছুটে গেলো মাঠের দিকে।তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে....ফুটবল ঢুকে গেছে ক্লাবের ভিতর....

-বাবা!ছেলে তো একেবারে লাল হয়ে গেছে রে....

সমুদ্র চিৎকার করে উঠলো।

-হ্যাঁ,বিশ্বজয় করে এসেছে তো!তাই মাথা তুলতে লজ্জা পাচ্ছে...
ঋষি বলে উঠলো....তারপর দুজনেই দৌড়ে এগিয়ে এলো রূপের কাছে...ঋষি রূপের উজ্জ্বল মুখটা দেখেই ওকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলো,
-ভাই!হ্যাঁ তো?

ঋষিকে জড়িয়ে ধরে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো রূপ।ওর তখন আর কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই।আনন্দে চোখে জল এসে গেছে।গলা বুজে আসছে কান্নায়....

-যাক!কেউ তো ভালোবেসে ভালোবাসা পেলো।আমার তোর জন্য খুব ভালো লাগছে রে ভাই!তোর এতদিনের ভালোবাসা অন্তত মিথ্যে হয়নি,নিশা বুঝেছে....

ঋষির কথার মধ্যেকার অব্যক্ত হাহাকার রূপের বুকে গিয়ে বাজলো....ও তাড়াতাড়ি করে ছেড়ে দিলো ঋষিকে...
-ভাই সরি!!
-না!তুই কেন সরি?আমিই ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম।তাকে ভালোবেসে,তার জন্য নিজের সবটুকু সময় দিয়েছি।দিন নেই-রাত নেই,রঞ্জার মন খারাপ হলে,যতক্ষণ পর্যন্ত না জানতে পেরেছি,ওর কি হয়েছে,আমার যেন দমবন্ধ হয়ে এসেছে।ওর মনখারাপের সময় ওকে একটু হাসাতে না পারলে,আমিই যেন শেষ হয়ে যেতাম।যেদিন বুঝলাম,আমি ওর কাছে শুধুমাত্র একটা জোকার,ওর টাইম-পাসের একটা অবলম্বন মাত্র,অন্য কারোর সামনে আমার কথা উঠলে,আমার দুর্দশায় ওর হাসি পায়,সেদিনের পর থেকেই ভালোবাসার প্রতি,আমার বিশ্বাস উঠে গেছে রে।ভীষণ ভয় লাগে।কিন্তু আজ তোদের আবার একসঙ্গে দেখে খুব ভালো লাগছে....যাক!!তুই অন্তত পেলি!!বল ভাই?!খাওয়াবি কবে?
-কাল....রুমাদির টিউশনের পর সবাই মিলে যাবো!ইস!!সৌরটা থাকবে না।আজও নেই....
-দাঁড়া!বুঝতে পারছি না,ওর কেসটা ঠিক কি!!সুইমিং তো ঘন্টাদুয়েক হয়।অন্যদিন তো তারপর ফিরে এসে খেলুক না খেলুক,একবার অন্তত মাঠে দেখা করতে আসতোই।কিন্তু কতদিন ধরে তো ওর পাত্তাই নেই।কি ব্যাপার বল তো?এই সমু,তুই কিছু জানিস রে?

ঋষি কৌতূহলী হয়ে সমুদ্রের দিকে ফিরলো....রূপও ওর মুখের দিকেই চেয়ে রয়েছে....

সর্বজ্ঞানীর মতো দুচোখ বন্ধ করে সমুদ্র বড় করে একবার শ্বাস নিলো,তারপর বললো,
-তিল-তিল উত্তম দিয়ে তৈরী হয়েছে....
-এই কেউ এটাকে ধরে ক্যালা তো!আজ এর মাথায় শুদ্ধ বাংলা ভর করেছে নাকি বে?
-কথাটা তো শেষ করতে দে ভাই!গুছিয়ে বলতে দিলি কোথায়?
-আচ্ছা বল!!
-তিল-তিল উত্তম দিয়ে তৈরি হয়েছেন যিনি...
আপাতত আমি তাকে,তিলোত্তমা নামেই চিনি...
এর চেয়ে বেশি তোমরা আজ কোরো নাকো জিজ্ঞেস,
যথাসময়েই খবর পারবে,ঘটিলে কিছু বিশেষ....
-তিলোত্তমা?
-হুম!
-মানে সেদিন যে মেয়েটার জন্য সৌর বৃষ্টিতে ভিজছিলো?!
-কি জানি!শুধু কি আর ভিজছিলো?বুঝি ডুবে-ডুবে মরছিলো!!
-সমু বলবি?পরিষ্কার করে বল তো!
-তিলোত্তমার ট্রেইনার সৌর।আমাদের ভাই তাকে হাতে ধরে শেখাচ্ছে...
-কিইইই?
-সাঁতার!!
-সত্যি?!
-হুম!আপাতত এটুকুই জানি!
কিছু হলে পেয়ে যাবি খবর!
রূপ ভাই,কাল তোর আর নিশার অনারে পেটপুরে খাবো,
তারপর এক সপ্তাহ ধরে কাটবো জাবর!!
-ভাই এগুলো তোর গান?
-কেন ভাই?শুনে কি জুড়িয়ে গেছে মন-প্রাণ!?

চেঁচিয়ে উঠলো রূপ...
-এ ভাই,এটাকে কেউ থামা!!আমি পুরো ঘেঁটে গেছি!
-ওই দেখ,ফিরতি পথেও তোর জন্য অপেক্ষারত,তোরই পেঁচি....

সমুদ্রের কথায় পিছন ফিরে রূপ দেখলো,নিশা আবার এসে দাঁড়িয়েছে।ও একটু হেসে এগিয়ে গেলো ওইদিকে....
-গুড লাক ভাই!
চেঁচালো সমুদ্র...রূপও পিছন ফিরেই চেঁচালো,
-কাল তোর খবর আছে!
-এখন আগে যা,তোর তার কাছে....

হেসে মাথা নীচু করে নিশার কাছে ছুটলো রূপ।যেখানে মাঠের পাশের আধো-অন্ধকারে ও দাঁড়িয়ে আছে....সমুদ্রের প্রতিটা কথায় ছন্দ মেলানোর অপরূপ দক্ষতা দেখে ঋষি বলে উঠলো,
-ভাই!তোর হবে!!
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সমুদ্রর বুক চিরে....
-কবে?!
-দেখ সমু....
-কি দেখবো ভাই?বাবা-মা মানবে না রে!পড়াশোনা আমার মাথায় ঢোকে না।আর আমাকে পড়তেই হবে।জানিনা,কতদিন এভাবে চলবে...কতদিন লড়াই করতে পারবো নিজের সঙ্গে।জোর করে কি কিছু হয়!!গান তো আমি গাইবোই।সেখানেও তো নিজের জায়গা তৈরি করার জন্য,আমাকে কিছু কম লড়তে হবে না।কিন্তু লড়াইটা যখন নিজের ঘরে,নিজের মানুষগুলোর সঙ্গে হয়,তখন আরও তাড়াতাড়ি মনের জোর কমে আসে রে।শিরদাঁড়া একেবারে ভেঙে যায়।একটু যদি ওরা আমাকে সাপোর্ট করতো....
-সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই...
-হবে না।পড়াশোনা আর চাকরি!এর দুয়ের বাইরে আমার বাড়ির কেউ কিছু ভাবতেই পারে না...বাদ দে।ছাড় ওসব!আজ রূপের কাছে অনেক বড় একটা দিন...উই...গেলো কোথায় দুটোতে?অন্ধকারে মিশে গেলো নাকি?
-ধুর!!ওসব খোঁজে আমাদের কি?ওদের জগৎ এখন আলাদা।চল!আমরা বাড়ি যাই...
-হুম!চল....

-স্যার!!ইন্টার-পুল কম্পেটিশনে মিছরি.....সরি তিলোত্তমা সান্যাল পার্টিসিপেট করবে স্যার!
-হোয়াট!?সৌর!!আর ইউ ম্যাড!?আমি এখনও ঠিকমতো সাঁতারই পারি না,তুমি আমাকে কম্পেটিশনে...
-মিছরি!আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলছি!তোমার সিনিয়র কোচ এবং জুনিয়র কোচ কথা বলছে।তুমি এর মধ্যে ঢুকবে না....
-হ্যাঁ কিন্তু প্রসঙ্গ তো আমিই....তাই আমাকে তো বলতেই....

সৌর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চাইলো তিলোত্তমার দিকে।ওর ওই আগুন-ঝরা দৃষ্টি দেখে,থমকে গিয়ে একদম চুপ করে গেলো তিলোত্তমা...
-সৌর!আর ইউ শিওর?ও কি পারবে?
-পারবে স্যার!আমার কনফিডেন্স আছে!আপনি ওর নামটা এনলিস্টেড...
-সৌর...
-আমি কথা বলছি তো মিছরি....প্লিজ স্যার!!
-ওকে!দেখো!তোমার ওপরেই সব!সুইমার জোনে গিয়ে যেন দিশেহারা হয়ে না যায়....
-আমি আছি স্যার!হবে না!
-বেশ....

-মিছরি?
কোনো সাড়া নেই....একরাশ ভেজা খোলাচুল লেপ্টে রয়েছে ওর মুখে-কাঁধে-খোলা হাতের ওপরে।
-মিছরি?
তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গাড়ির দিকে যেতে গেলো তিলোত্তমা।সৌর দৌড়ে গিয়ে ওর রাস্তা আটকে দাঁড়ালো।
-কি হলো?কথা বলবে না আমার সঙ্গে?
চোখ থেকে গাল বেয়ে বেরিয়ে আসা জলটা মুছে নিয়ে,মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো তিলোত্তমা....সৌর এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরলো....
-রেগে গেছো আমার ওপর?
-না!
-তাহলে কথা বলছো না কেন?
-আমি তো ভালোভাবে সাঁতারই পারি না সৌর।পায়ের তলা থেকে ফ্লোর সরে গেলেই ভয় লাগে আমার।মনে হয় ডুবে যাবো,তলিয়ে যাবো অতলে...তুমি আমার ট্রেইনার হয়ে,কিভাবে আমাকে এইরকম বিপদে ফেলতে পারো?তুমি জানো না আমার দুর্বলতা?!আমি কিছুতেই পারবো না!
-সত্যিই তুমি পারবে না!
-মানে?
-তুমি যদি ধরেই নাও,তুমি পারবে না,তাহলে সত্যিই তুমি পারবে না!!
-উফফ!!
-কোনো উফফ নয়!আমি তো আছি তোমার সঙ্গে।এতদিন বলতাম,ওই পঁয়তাল্লিশ মিনিট আর কোনোদিকে মন নয়।শুধু তুমি-আমি আর জল!এবার বলবো,তুমি-আমি-জল আমার ইন্সট্রাকশন,আর আমার হাতের স্টপওয়াচ!আমাদের সারা বছর পড়াশোনার পর পরীক্ষা কেন নেওয়া হয় মিছরি!?কি শিখলাম,সেটা যাচাই করার জন্য!আর দেখবে,যতই সারা বছর পড়ি না কেন,পরীক্ষার সময় মনে-মস্তিষ্কে একটা আলাদা চাপ নিজে থেকেই তৈরি হয়ে যায়।আরও ভালো ফলাফল করার চাপ।কিন্তু পরীক্ষা না থাকলে মনে হতো,ও যেমন চলছে চলুক না!!এটাও ঠিক তেমন!এটাই তোমার পরীক্ষা,আমারও....
-তোমার?
-হুম!তুমি জিতলেই যে আমি জিতে যাবো!তোমার সামনে এখন একটাই লক্ষ্য।সামনের দেওয়ালটাকে ছুঁয়ে ফিরে আসা...সবচেয়ে কম সময়ে...
-আমি সুইমার জোনে সারভাইভ করতে পারবো না সৌর...
-আমরা কালই ওইখানে যাবো,সাঁতার কেটে।তুমি তো মাত্র কয়েকদিনেই স্যালো জোন থেকে ডিপ জোনে চলে গেছো মিছরি,ওটুকুও পারবে।তুমি সাঁতার জানোই।একরকম শিখেই গেছো তুমি।এবার দরকার শুধু গতিটা বাড়ানো,আর নিজের কনফিডেন্সটা বুস্ট করা....বুঝলে?ওটুকু আমি করিয়ে দেবো...
-হুম!!
-এবার চলো!!কমলো তো রাগ?

দাঁড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমা....

-আবার কি হলো?
-তুমি আমাকে বকেছো!
-হোয়াট!!কখন বকলাম?
-তুমি আমার দিকে বড়-বড় চোখ করে তাকিয়েছো!

এবার সৌরর চোখদুটো ঠিকড়ে বেরিয়ে এলো...ও অবাক...
-ওটাকে বকা বলে?আমি তোমাকে থামতে বলেছি।আমাদের কথায় মধ্যে এই নাকটা গলাচ্ছিলে বলে...

মিছরির নাকটা আদর করে নেড়ে দিলো সৌর।নিজের নাকটা হাত দিয়ে ঘষে নিয়ে তিলোত্তমা বললো,
-হুম!ওটাকেই বকা বলে....
-হে ভগবান!!

হেসেই ফেললো সৌর...

-আমার নাম মিছরি!!ভগবান না...
-তুমি পুরো পাগল মিছরি....
-আমাকে সরি বলো!
-ওকে সরি...এবার কি কান ধরবো?এই ধরলাম কান!হয়েছে?খুশি তো?

একলাফে দুকান ছেড়ে দিয়ে,সোজা হয়ে দাঁড়ালো সৌর।মুখ থেকে অসাবধানসূচক একটা শব্দ বেরিয়ে এলো।মুখ ফিরিয়ে তিলোত্তমা দেখলো,পাশ দিয়েই সিনিয়র স্যার বেরিয়ে গেলেন....ওদের দিকে একবার একটু দেখলেন,মুখে মৃদু হাসি।আর কিছু বললেন না....
-ইস!
-কি হলো?
-স্যার দেখলেন!
-কি?
-আমি কান ধরে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি!!যেখানে উল্টোটা হওয়া উচিত....

প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়লো তিলোত্তমা....অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললো,
-স্যার ভাবলেন,আমার হাতে তৈরি করা চ্যাম্পিয়ন,তার স্টুডেন্টের সামনেই কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।পানিশমেন্ট!!

হেসে মাথাটা নামিয়ে নিলো সৌর।মিছরির ওই হাসির দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না।বুকের মধ্যেটা ভালোলাগার আগুন জ্বলে যায়....

-কদিন পরেই কিন্তু তোমার প্রথম ডাইভ!
-হুম!সেদিন আসার আগে মাকে-বাবাইকে প্রণাম করে আসবো!
হেসে ফেললো সৌর...
-মিছরি?
-হুম!
-আর কিছুদিন পরেই আমার পরীক্ষা।আমি হয়তো এই সপ্তাহটাই আসবো।তারপর আর আসবো না।ফাঁকি মেরো না প্লিজ।মনে রাখবে,তুমি জিতে গেলেই,আমি জিতে যাবো।আমাকে হেরে যেতে দিও না...তোমার কম্পিটিটির কিন্তু তুমি নিজেই।চোখ মেলে আশপাশে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই।প্রতিবার নিজের অন্তিম সময়সীমাকে বিট করার চেষ্টা করবে,তা হলেই হবে!!
-ইয়েস কোচ!আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট!!

মিছরির মুখের মিষ্টি হাসি দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেলো সৌরর।ও নিজের হাত দিয়ে মিছরির ভেজা চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো....সৌর নিজের সাইকেলে গিয়ে উঠলো।আর মিছরি নিজের সুদৃশ্য গাড়িতে....

জোরকদমে পড়াশোনা চলছে সকলেরই।কিন্তু সেদিন রাত থেকেই সমুদ্রর ধুম জ্বর।বাবা-মা শত-সহস্রবার বারণ করা সত্ত্বেও মাঠে খেলতে গিয়েছিলো সমুদ্র।মাঠ থেকে ঘেমে এসেই গা-হাত-পা ধোয়া,ঠান্ডা জল খাওয়া,সব মিলিয়ে রাত থেকেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর।প্রচন্ড জ্বরের মধ্যেই বাবার কাছে ঝাড় খেয়ে যাচ্ছে অনবরত।ভাগ্য ভালো স্কুলটা নেই।নইলে আরও বেদম ঝাড় খেতে হতো....বিছানায় জ্বরে কাহিল হয়ে,কোঁ-কোঁ করে কাতরাতে লাগলো সমুদ্র....মাথার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা।সেদিন শেষ রাতের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বরটা ছেড়ে গিয়েছিলো।হাত বাড়িয়ে মাথার কাছের জানলাটা খুলে দিয়েছিলো ও।আলগা একটা হাওয়া এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো ওর অনাবৃত শরীরটা।কতদিন স্কুলে যাওয়া হয়নি।কতদিন তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানো হয়নি।কতদিন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়নি,তার শাড়ির রঙয়ের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে আনা কোনো একটা সতেজ গোলাপফুল।চোখদুটো বন্ধ করে,চুপ করে শুয়েছিলো সমুদ্র।শিরশিরে হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসছে খুব সুন্দর একটা গন্ধ।জানলার দিকে একটু এগিয়ে,ওটা কিসের গন্ধ বোঝার চেষ্টা করলো সমুদ্র।এ তো ফুলের গন্ধ।গোলাপের গন্ধ!!তবে কি সে মেলেছে তার নরম-নরম পাপড়ি!সে কি বৃন্তের বাইরে আত্মপ্রকাশ করেছে সমুদ্রের অজান্তে?কয়েকদিন এই ঘরের বাইরেই বেরোতে পারেনি সমুদ্র।ছাদে যাওয়া তো দূরের কথা।সে যদি ফুটে গিয়ে ঝরে পড়ে সমুদ্রর অজান্তে,তবে তো ও পাগল হয়ে যাবে।দুর্বল শরীরেই একটা জামা গায়ে দিয়ে,সমুদ্র ছাদে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখলো....

ছাদের ওইদিকটায় গিয়েই দেখলো,যা ভেবেছে ঠিক তাই।সে এসেছে।সে নিজের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শে মাতোয়ারা করে রেখেছে জ্যোৎস্নাস্নাত ছাদটাকে।গোলাপগাছটার সামনে বসে হু-হু করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র।বুকের ভিতরটা এমন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কেন?!তার থেকে দূরে আর থাকা যাচ্ছে না কেন?!পরশুদিন ওরা স্কুলে এডমিট আনতে যাবে,তারপরই হয়তো তার সঙ্গে,এ জীবনের মতো সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।চোখের কোণ থেকে অনবরত জল বেরিয়েই আসছে।উঠতে গিয়েই মাথাটা একটু ঘুরে গেলো সমুদ্রর।বড় দুর্বল শরীর,কিন্তু তার চেয়েও দুর্বল মন...পরম যত্নে সদ্যফোটা ওই একটা রক্তগোলাপে,আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে দিলো সমুদ্র।পাপড়ির ওপর পড়ে থাকা শেষ রাতের শিশিরবিন্দুতে,ভিজে উঠলো সমুদ্রের দুটো পুরুষালী ঠোঁট....

মনে পড়ে গেলো গোলাপী বা লালচে ওষ্ঠরঞ্জনীতে আবৃত রানী ম্যামের দুটো ঠোঁট।ফুলটাকে ছেড়ে দিয়ে একলাফে উঠে পড়লো সমুদ্র।মন আজ বড্ড অবাধ্য হতে চাইছে।অনেক নিষিদ্ধ-বেপরোয়া আকাঙ্খা পূরণ করে নিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সেসব কল্পনা করার মত দুঃসাহসও নেই সমুদ্রর।নিজের মনের অবাধ্যতাকে গলা টিপে খুন করতে-করতে,চোখ দিয়ে জল এসে যাচ্ছে ওর।বুকে অসহ্য একটা জ্বালা!!সেই জ্বালা থেকেই বারংবার চোখে জল আসছে....আচ্ছা!!একবার তাকে বলতে অসুবিধে কি!!ওর চাওয়াটা কি,খুবই অন্যায় চাওয়া?

মাথাটা নামিয়ে নিলো সমুদ্র।দূরের আকাশে একাকী জ্বলজ্বল করছে গোলাকার চাঁদ।আচ্ছা,ওই চাঁদটা যদি সমুদ্র হয়,তবে রানী ম্যাম কি একবারের জন্য ওই সুবিশাল আকাশ হতে পারেন না?!সমুদ্রর জন্য একটু জায়গা কি বরাদ্দ নয়,মনের ওই সুবিশাল আকাশে?!সমুদ্রর চোখ থেকে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে।শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ছাপিয়ে মাথার মধ্যে সব অগোছালো শব্দগুলো ধীরে-ধীরে সেজেগুজে জাঁকিয়ে বসছে....মাঝে-মধ্যে নিজেরই ভীষণ অবাক লাগে সমুদ্রর।পড়তে বসলে মাথায় পড়াশোনা কিছুই ঢোকে না।কিন্তু একটু শান্ত মস্তিষ্কে দুটো চোখ বন্ধ করলেই,মস্তিষ্কে যেন জলতরঙ্গ বাজতে শুরু করে।শব্দেরা নিজে থেকেই পরিণতি পায় সুমধুর গানে....কয়েক মুহুর্ত চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গাইতে শুরু করলো সমুদ্র....

-কাজল কালো আকাশ কন্যে/কাজল কালো কেশ,
মরমে নয় প্রিয়,প্রাণে ধরেছি/তোমার রক্তিম বেশ....

পায়ে তোমার পৃথিবী আমার/শাড়ির ওই চেনা ভাঁজে লুকোনো মাধবীলতা,
তোমার হৃদি জানবে যেদিন,আমার প্রাণের গোপন কথা...
সেদিনও ওই দূর আকাশে/তোমার লাজুক চাওয়া,
সেই অক্ষিপল্লবের মাঝেই/আমার এক সমুদ্র পাওয়া...
আমার হৃদয় কাঁপে থরথর/তোমার কারণেই জানি,
পৃথিবীর বাইরেও আর এক পৃথিবীতে/আমি তোমারই রানী...

কাজল কালো আকাশ কন্যে/কাজল কালো কেশ,
মরমে নয় প্রিয়,প্রাণে ধরেছি/তোমারই রক্তিম বেশ....

আর দাঁড়াতে পারলো না সমুদ্র।চোখদুটোর ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই ওর।বারংবার চোখের পাতা ভিজে উঠছে জলে।হাতে আর মাত্র কাল দিনটা।তারপরই স্কুলের শেষ দিন।তাও কিছুক্ষণের জন্য।এডমিট নিয়েই বেরিয়ে আসতে হবে....পরশুদিনই ওই রক্তগোলাপকে সমূলে উৎপাটন করে নেবে সমুদ্র.... শেষদিনেই রানী ম্যামের হাতে তুলে দেবে,নিজের রক্তে রাঙা ক্ষতবিক্ষত হৃদপিন্ডস্বরূপ ওই একখানা লাল গোলাপ,আর সেই সঙ্গে নিজের হাতে লেখা,স্বরচিত গানের কয়েকটা পংক্তি....

সদ্যফোটা গোলাপ ফুলটার গায়ে আরও একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে,রেলিং ধরে-ধরে দুর্বল শরীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলো সমুদ্র....

-আজই কিন্তু আমার শেষদিন।কাল থেকে আমি আর আসবো না মিছরি।আজ কিন্তু তোমায় পারতেই হবে....
-আমি সাঁতার কেটে যেতে পারবো সুইমার জোনে।কিন্তু ডাইভ মারতে পারবো না সৌর।ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লে,ডুবে যাবো তো!

জলের মধ্যেই লাফাতে থাকা তিলোত্তমার হাতটা চেপে ধরলো সৌর....
-কিচ্ছু ডুববে না।ভালো করে শোনো আমার কথাটা।ডাইভ দিয়ে তুমি যতটা এগিয়ে থাকবে,ততটাই তাড়াতাড়ি তুমি বেরিয়ে আসতে পারবে।জেতার মূলমন্ত্র কিন্তু ডাইভটা ঠিকঠাক দিয়ে,সঠিক সময়ে জলটা কেটে বেরিয়ে এসে,সাঁতার কাটতে শুরু করা।কিচ্ছু না!জলে পড়েই চলে যাবে নীচে,বেশি নীচে গিয়ে সময় নষ্ট করবে না।দুটো হাতকে ওপরের দিকে তুলে দেবে।ব্যাস!!সঙ্গে-সঙ্গে নিজেই বুঝতে পারবে,জলের চাপ নিজেই তোমাকে ঠেলে ওপরে তুলে দেবে....তারপরই সাঁতার....ব্যাস!সিম্পল...
-আমি ডুবে যাবো সৌর!

ভয়ে-উত্তেজনায় দিশেহারা মিছরি...

সৌর ওর দিকে এগিয়ে জলে ভাসতে-ভাসতে বললো,
-আমি আছি জলে।টেনে তুলবো।যাও...কি হলো?যাও...

সৌরর ধমকে জল ছেড়ে উঠতে বাধ্য হলো মিছরি।ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ওই উঁচু জায়গাটায় দিকে।উঠে দাঁড়ালো ওপরে।সৌর জল কেটে এগিয়ে গেলো ওর একদম কাছাকাছি।যাতে জলে পড়ে দিশেহারা হয়ে গেলেও,ওকে সেই মুহূর্তেই টেনে তুলতে পারে...কিন্তু ও ওপরে দাঁড়িয়েই আছে।মৃদু কাঁপছে.... মিছরির মধ্যে আজ নিজেকেই দেখতে পেলো সৌর।ওইখানে সেই একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে তিরতির করে কাঁপছে একটা ছেলে,যার আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে....

-মিছরি!হাঁটু ভাঁজ করে বসো!মিছরি....

জল থেকেই চিৎকার করছে সৌর।কিন্তু কানে কিছুই ঢুকছে না তিলোত্তমার।ও দেখছে ওর সামনে থইথই করছে সুগভীর জল।যাতে ঝাঁপ দিলেই ওর শরীর ছেড়ে দেবে।ও আর হাত-পা চালানোর মতো পরিস্থিতিতেই থাকবে না।ভয়ের তাড়নায় ভারী হয়ে আসছে তিলোত্তমার সমস্ত শরীর...

সৌর জলের মধ্যে আর অপেক্ষা করলো না।পারবে না তিলোত্তমা।যে জায়গায় সৌর একদিন দাঁড়িয়েছিলো,সেই একই জায়গায় আজ তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে রয়েছে।ওর প্রয়োজন সেই ধাক্কাটার।নইলে ও একা কিছুতেই পারবে না।জল ছেড়ে একলাফে উঠে সৌর উঠে ছুটতে লাগলো ওইদিকে....মিছরির কাছে পৌঁছে গেলো নিমিষেই...
-মিছরি-মিছরি!!
-পারবো না সৌর...ভয় লাগছে তো!

কেঁদেই ফেললো তিলোত্তমা।সৌর একবার সামনের দিকে চেয়ে দেখলো।স্যার অফিসের সামনে বসে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেও,ওনার চোখটা এইদিকেই রয়েছে।অনেক বড় মুখ করে সেদিন ওনাকে বলেছিলো সৌর,মিছরি কম্পিট করবে!!আর এখন ও জলেই নামতে পারছে না।সৌর দেখলো,জলের মধ্যে কিডস আর স্যালো জোনে কয়েকজন ট্রেইনার অন্যান্যদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।কিন্তু সুইমার জোনে কেউ নেই।মানে ওপর থেকে মিছরিকে ফেলে দিলেও,ওকে ধরার কেউ থাকবে না।তিলোত্তমা হেঁটে-হেঁটে নেমে পড়তে যাচ্ছিলো ওইখান থেকে...

-মিছরি,দাঁড়াও...
-আমি পারবো না সৌর।আমার দ্বারা হবে না।
-এদিকে এসো তুমি...

সামনে এসে দাঁড়ালো তিলোত্তমা।চোখটা জলের দিকে...
-যাও!নইলে আমি হেরে যাবো!
-না!
-যাও!স্যার দেখছেন কিন্তু।যাও...
-অসম্ভব!!

তিলোত্তমা যেই মুহূর্তে পিছন ঘুরেছে নেমে আসার জন্য,সেই মুহূর্তেই সৌর ওর একেবারে কাছে গিয়ে ওকে দুহাতে করে কোলে তুলে নিলো।চমকে উঠে অনাবৃত সৌরকেই জাপটে ধরতে যাচ্ছিলো মিছরি।কিন্তু সেই সময়টুকুও সৌর ওকে দিলো না।মিছরি ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই,সৌর ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো জলে....ততক্ষণে স্যারও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।ছুটে আসছেন এইদিকেই...

আর কোনোদিকে ফিরেও চাইলো না সৌর।বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে,ও নিজেও ঝাঁপ দিলো জলে।কিন্তু ও আসার আগেই জল কেটে বেরিয়ে গেছে তিলোত্তমা সান্যাল....

ওর পাশে-পাশে সাঁতার কেটে হাঁপিয়ে যাওয়া মিছরিকে জড়িয়ে ধরে,সুইমার জোন থেকে ডিপ জোনে টেনে নিয়ে এলো সৌর....দুজনেই তখন জলে ভাসছে,হাঁপাতে-হাঁপাতে তিলোত্তমা ভাসছে সৌরর কণ্ঠলগ্না হয়ে...কেঁপে উঠলো তিলোত্তমা...জলের স্বাভাবিক উষ্ণতা কি আজ প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই!!জানা নেই ওর....

(চলবে.....)

ছবি: সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট