অনুসরণকারী

শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩

খিল চতুর্থ পর্ব


 



খিল
সাথী দাস
চতুর্থ পর্ব




প্রাত্যহিক নিয়ম মেনে নাগের বাড়ির সংসারযাত্রা শুরু হয়েছে। কেবল নিয়ম বহির্ভূত মাধবীলতার গর্ভের কলঙ্ক ঐ আহ্লাদী। জাগতিক কোনও নিয়ম-নিষ্ঠা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। মেয়েটা এতবড় বাড়ির কোন কোণে বসে এখন চোখের জল ফেলছে, কে জানে!
সংসার বড় নির্মম এক জায়গা। বুকের ভিতর মায়া আর স্নেহ বাতাসের অভাবে শ্বাসরোধ হয়ে মরে গেলেও, প্রকাশ্যে তার অস্তিত্ব জানান দেওয়া যায় না। কিন্তু গর্ভধারিণীর কাছ থেকে এমন প্রহার ও গালমন্দ যে কন্যার কতখানি বুকে বাজে, তা মাধবীলতা বেশ বোঝে। মাধবীলতাকেও এককালে অনেকে আড়ালে-আবডালে অপয়া বলত। ওর জন্মের পর মা শয্যা নিয়েছিল। কঠিন অসুখে মা গত হলে কয়েক বছর পর তার যাত্রাপথ নিঃশব্দে অনুসরণ করেছিল বাবা।
বিছানার এককোণে বসে নিজের অতীতের কথা ভাবছিল মাধবীলতা। শৈশবে বাপ-মা হারা মাধবীলতা নিজের ঠাকুমার অন্ধস্নেহ থেকে কখনো বঞ্চিত হয়নি। মাথার ওপর বাবা-মা ছিল না বলেই হয়তো অন্যান্য নাতি-নাতনিদের থেকে তার প্রতি ঠাকুমার স্নেহ ও প্রশ্রয় একটু বেশি ঝরে পড়ত। তখন মাধবীলতা সবেমাত্র ফ্রক ছেড়ে কাপড় পরতে শুরু করেছিল। নিজের বাড়ির উঠোন থেকে শুরু করে সিংহদুয়ারের মধ্যে তার যত দৌরাত্ম্য বজায় ছিল। পরিবারের বাইরে সখী বলতে দু-একজন সমবয়সী সই। তাদের সঙ্গে মাধবীলতা যত প্রাণের কথা বলত।
হঠাৎ একদিন মাধবীলতা শুনল জ্যেঠুমণি তার প্রিয় বন্ধুর গৃহনির্মাণ উপলক্ষ্যে প্রতিদিন ভোরের প্রথম রেলগাড়িতে চেপে পাড়ি দেবে এক অচেনা গণ্ডগ্রামে। বন্ধু তার সমস্ত জীবনের উপার্জন ও সঞ্চয় নিঃসংকোচে পাঠাবে মাধবীলতার জ্যেঠুমণির কাছে। পূর্বে কিনে রাখা একটি জমিতে সেই অর্থ দিয়ে কয়েক মাসের পরিশ্রমে তিলে তিলে নির্মাণ করতে হবে দ্বিতল আবাস। নির্মাণকার্য দেখাশোনার সেই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল মাধবীলতার জ্যেঠুমণির ওপর। দৈনন্দিন রোজনামচায় অভ্যস্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে এমন একটি চমকপ্রদ সংবাদ কানে আসামাত্রই দ্রুতপায়ে সেই সংবাদ নিজের পরম প্রিয় দুই সইয়ের কানে ঘটা করে তুলে এসেছিল মাধবীলতা।
মাধবীলতার বাড়ি একেবারে শহরতলিতে। বাতাসে কলকারখানার ধোঁয়া ওড়া বিষাক্ত শহর না হলেও, এলাকাটাকে একপ্রকার মফঃস্বলে বলা চলে। যদিও আজ তার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। জ্যেঠুমণি ও ঠাকুমা গত হওয়ার পর বারকয়েক ও বাড়িতে গেলেও শৈশবের আন্তরিকতা ও হৃদ্যতা মাধবীলতা আর অনুভব করতে পারেনি। বাড়ির দেওয়ালগুলোও হয়ে গিয়েছিল অচেনা। তবে মাধবীলতার বিবাহপূর্বের দৃশ্য ছিল কিছুটা ভিন্ন।
পিচঢালা চওড়া রাস্তা দেখার জন্য মাধবীলতাকে কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করতে হতো না। জ্যেঠুমণির গ্রাম ভ্রমণকালে প্রত্যেকদিন সন্ধ্যাবেলা সমস্ত ভাইবোনদের একটাই কাজ ছিল। সন্ধের ট্রেনে জ্যেঠুমণি ফিরলে বাটিভর্তি মুড়ি মুড়কি বাতাসা খেতে খেতে তার মুখ থেকে গ্রামের গল্প শোনা। গল্প শুনতে শুনতে নিজের কল্পনায় মাধবীলতা কতবার পৌঁছে যেত সেই গ্রামে। মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনার সময় প্রায়ই তার মনে হতো, গ্রামের সোনালী ধানের শীষ ছুঁয়ে কেমনভাবে সন্ধে নামে, কখনো দেখা হবে না। মাধবীলতার দু'চোখে থাকত অপার বিস্ময়। জ্যেঠুমণিকে অজস্র প্রশ্নে উত্যক্ত করে তুলত মাধবীলতা। জ্যেঠুমণিও মাধবীলতার আনন্দে উজ্জ্বল মুখটা দেখতে দেখতে ধৈর্য নিয়ে সকল প্রশ্নের উত্তর দিত। এমনভাবে একটি বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রজাপতি ও ঋতুচক্রের যৌথ আশীর্বাদে একদিন একটি আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হল মাধবীলতার জ্যেঠুমণি।
বৈশাখের তীব্র দাবদাহে মাধবীলতার ক্লান্ত জ্যেঠুমণি এক-আধদিন নাগের বাড়ির পাশে অস্থায়ী শিবমন্দিরের বাইরের সিঁড়িতে আশ্রয় নিত। গ্রীষ্মকালে অস্বস্তিকর গরমের পাশাপাশি আকাশ ভেঙে আকস্মিক কালবৈশাখীর তান্ডব ছিল নিত্যসঙ্গী। একদিন কালবৈশাখী ঝড়ের প্রকোপে পড়ে ধুলোর বলয়ে ঢেকে গেল গোটা গ্রাম। মিস্ত্রী-মজুররা দুপুর থাকতেই হাতের কাজ ফেলে নিশ্চিন্ত স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে মাধবীলতার জ্যেঠুমণি দেখল, তখনো বাড়ি ফেরার গাড়ির সময় হয়নি। ছাতা খুলে মন্দিরের সিঁড়িতে আশ্রয় নেওয়ার অভিপ্রায়ে সেদিকে এগোতেই এক ভদ্রলোক ডেকে উঠেছিল,
-ও বড়দাদা, বলি রোজ এভাবে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান, মন্দিরের চাতালে বসে থাকেন, পাশে এই যে নাগের বাড়ি রয়েছে, চোখে পড়ে না? গেরস্ত ঘর, চারটি মুড়ি বাতাসা জল খেতে চাইলে, কেউ কি আপনাকে অভুক্ত ফিরিয়ে দেবে নাকি মশাই?
-আজ্ঞে সকালের খাবার তো ঝোলায় পুঁটুলি বেঁধে সঙ্গে নিয়েই আসি। গিন্নি রাত থাকতে উঠে রেঁধে বেড়ে দেয়। দুপুরে দুটো শুকনো মুড়ি চিঁড়ে চিবিয়ে দিব্যি কেটে যায়। আসলে এই গ্রাম আমার কাছে একেবারে অচেনা তো.... হঠাৎ আপর-দুপুরে গেরস্ত বাড়িতে গিয়ে পড়লে বাড়ির মেয়েমানুষরা বিব্রত হতে পারে। তখন তাদের বিশ্রামের সময়...
-আমাদের বাড়ির সম্পর্কে আপনি কিচ্ছুটি জানেন না মশাই। রেলস্টেশনে নেমে একটিবার বলবেন, নাগের বাড়ি যাব। অন্ধ মানুষও আপনাকে পথ দেখিয়ে আমার বাড়ির উঠোনে পৌঁছে দিয়ে যাবে। আর আমার গিন্নি? সে তো লোকজনকে পাত পেড়ে খাওয়াতে পারলে আর কিচ্ছুটি চায় না। সারাদিন আমার হেঁশেলে আগুন জ্বলছে, হাঁড়ি-কড়াই চড়ছে। আমার গিন্নিই তো আজ আমাকে ঠেলে পাঠালে মশাই। বলে বাড়ির বাইরে মানুষটাকে রোজ দেখি, কোনোদিন এসে এক গেলাস জল চেয়ে খেলো না! এত ঝড় বাদল, মানুষটা বাইরে কোথায় ঘুরবে? তুমি ওকে বাড়ির দাবায় এসে বসতে বলো। আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিই।
চায়ের আসরে উষ্ণ পানীয়র অজুহাতে আলাপ পরিচয় বাড়ে। ধীরে ধীরে নাগ পরিবারের সঙ্গে মাধবীলতার জ্যেঠুমণির অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি পায়। তারপর একদিন আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় নাগের বাড়িতে মাধবীলতার জ্যেঠুমণির যাতায়াত। নাগ বাড়ির বড় গৃহকর্তা তার সংবাদ নিতে এলে সে গলবস্ত্র হয়ে জোড়হাতে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণার মতো গৃহকর্ত্রীর সামনে বলে বসে, "আপনার মতো লক্ষ্মীমন্ত মানুষের দেখা আমি আর দুটি পাইনি। একজন অচেনা মানুষকে ঘরে ডেকে এনে আপনি তিনবেলা তার ভরপেট আহারের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এই অন্নের ঋণ দিন-দিন বেড়েই চলেছে ঠাকরুন। আমি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। বাজারে চারটি দোকান আছে। তাতে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মচারী কাজ করে। আপনাদের বাড়ি যেমন বড়, মন তার চেয়েও বড়। এত বড় মনের মানুষের এত ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। কোনও সম্পর্ক ছাড়া রোজ এভাবে পাত পেড়ে খেতে আমার বিবেকে বাধে বৌদিদি। যদি আমাকে দুটো ভাত খাওয়াতেই হয়, তবে আমার ভাইয়ের একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে। আমার ভাই আর তার বৌ মারা গেছে বহুকাল আগে। বাপ-মা মরা অসহায় মেয়েটার আমিই বাপ, আমিই মা। ঐ মেয়ের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ভবিষ্যৎ আর সুখের দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে মা জননী। তবেই আমি নিশ্চিন্ত হয়ে আমার মেয়ের বাড়িতে এসে তিনবেলা পেট পুরে খেয়ে যাব। কত্তা আপনার ছোট ছেলেটিকে আমার বড় পছন্দ হয়েছে। তার সঙ্গে আমাদের মাধুর বিয়ের প্রস্তাব রাখছি। আপনারা একটিবার আমার মাধুকে দেখে আসবেন চলুন। এতদিন তো খেলাম আপনাদের বাড়ি। এবার আপনারা যদি একবার এই গরিবের ভিটেতে পায়ের ধুলো দেন.... অর্থে আমি আপনাদের সমান না হলেও কথা দিচ্ছি, আপ্যায়নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখব না। চাঁদের আলোর মতো রূপ আপনার ছেলের। গুরুজনকে কত ভক্তি শ্রদ্ধা করে, কত মান দিয়ে কথা বলে। এমনটা তো আজকাল দেখাই যায় না। বৌদিদির শিক্ষা ঐ ছেলের মধ্যে আছে। আমার মাধু এখানে খুব ভালো থাকবে। বৌদিদি আর ছোট ছেলেটিকে নিয়ে একটিবার এই গরিবের ঘরে আসুন কত্তা। আপনাদের যাতায়াতের সমস্ত ব্যবস্থা আমি নিজে করব..."
এই ঘটনার কিছুদিন পর মাধবীলতা হঠাৎ আবিষ্কার করেছিল, ঘরের ভিতরে ডাক ছেড়ে কাঁদছে তার ঠাকুমা। দেওয়ালে মাথা ঠুকে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে সে চিৎকার করে বলেছিল, "নিজের মেয়ে তো নয়। তাই মেয়েটাকে এমন জলে জঙ্গলে ফেলে দিতে চাইছে। নিজের মেয়ে হলে পারত বাড়ির কারও সঙ্গে কোনও যুক্তি-বুদ্ধি না করে অমন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ভূতের বাড়িতে মাধুর সম্বন্ধ করে একেবারে পাকাকথা বলে আসতে? আমরা ছেলে দেখলাম না, ছেলের বাড়িঘর দেখলাম না, তারা মেয়ে দেখল না, শুধু একজনের ওপর ভরসা রেখে একেবারে পাকাকথা? বাপ-মা মরা আমার নাতনিটাকে একেবারে জলে ফেলে দিচ্ছে গো.... মেয়েটা তিনবেলা চারটি ভাত খায় বলে তোর ঘরের অন্ন ফুরিয়ে যাচ্ছে নাকি রে? কাল থেকে আমি না খেয়ে ওকে খাওয়াব বাপ! কিন্তু এমন জঙ্গলে মাধুর বিয়ে দিস না। এতদূরের পথ! গ্রাম-গঞ্জ, জলা জমি! মশার কামড়ে জ্বরজ্বালা হয়ে মরে গেলে আমি একটিবার মেয়েটাকে চক্ষের দেখাও দেখতে পাব না বাপ আমার..."
ঠাকুমার কান্না শুনে সেদিন খুব অবাক হয়েছিল মাধবীলতা। ভয়ে ঘরের এককোণে বসেছিল। উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে কোমরে গামছা বেঁধে হাতে নিমের দাঁতন নিয়ে শুরু হয়েছিল জ্যেঠুমণির আস্ফালন। গলা ছেড়ে চিৎকার করে সে বলেছিল, "জলে ফেলে দিচ্ছি? তোমার নাতনিকে আমি জলে ফেলে দিচ্ছি? মা এতবড় কথাটা তুমি বললে আমাকে? মাধু কি আমারও মেয়ে নয়? নিজের বাপ-মাকে ও কতটুকু পেয়েছে? আমার কোলেই তো বড় হল। নেহাৎ আমার চার ছেলে, একটা মেয়ে থাকলে আমি নিজের মেয়ের সম্বন্ধ ওখানেই করে আসতাম! নাগের বাড়ির সম্পত্তির হিসেব তুমি জানো? তারা সাত ভাই। যৌথ পরিবার, যৌথ সম্পত্তি। সর্বমোট আশি বিঘে জমি ছিল, দেখাশোনার লোকের অভাবে গোপনে কত জমি বেচে দিয়েছে। তাও এখনো যা সম্পত্তি আছে, সেই সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা হলেও এক-একজনের ভাগে কত জমি থাকবে বুঝতে পারছ? আমাকে মাধুর খাওয়ার খোঁটা দিচ্ছ তুমি? এমন বাড়িতে তোমার নাতনির বিয়ে দিচ্ছি, ও বাড়িতে যা আছে, সাত পুরুষ বসে খেলেও শেষ হবে না। তাদের চাষ-আবাদ, বাড়িঘর, মেয়ে-বৌদের গা ভর্তি শাড়ি-গয়না, রান্না-খাওয়ার বহর দেখলে রাজার রাজত্বও লজ্জা পাবে। শুধু কী তাই? বৌদিদির কী অমায়িক ব্যবহার! আজ তুমি আমাকে এতবড় কথাটা বললে তো? মাধু বছরখানেক নাগের বাড়িতে থেকে ঘর করে আসুক। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে এই তুমিই সেদিন বলবে, হ্যাঁ হাতে ধরে আমার ব্যাটা একটা বিয়ে দিয়েছিল সত্যি! আমাদের বংশের সেরা জামাই হয়েছে! মাধুর কপাল সোনা দিয়ে বাঁধানো বটে! যেমন ঘর, তেমন হিরের টুকরো বর!"
মানুষ চিনতে নেহাৎ ভুল করেনি মাধবীলতার জ্যেঠুমণি। বৌভাতের রাতে মেয়ের বাড়িতে পাত পেড়ে রাজকীয় নৈশভোজ সেরে ফিরে আসার আগে মাধবীলতার শ্বশুরমশাইয়ের হাত ধরে সে অনুনয়ের সুরে বলে এসেছিল, "মেয়ে আমার ছোট পরিবারে ছোট উঠোনে রান্নাবাটি খেলে মানুষ হয়েছে। এতবড় ঘর, এতবড় পরিবারে ও অভ্যস্ত নয় কর্তা। আমাদের মেয়ে সংসার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না, বোঝে না। কাজকর্মও খুব বেশি পারে না। কিছু ভুকচুক করলে নিজের মেয়ে মনে করে খানিক বকে দেবেন, তবুও একটু শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন।"
মৃদু হেসেছিল মাধবীলতার শ্বশুরমশাই। তবে মাধবীলতার শাশুড়ি এগিয়ে এসে বলেছিল, "এই যে আপনি আজ কথাটা বলে গেলেন আপনাদের মেয়ে কিছু জানে না, কিছু পারে না, বোঝে না.... এটা কেবল আপনি জানেন। আর আমরা এই দুটো মানুষ সদ্য জানলাম। আজকের পর আর কেউ কোনোদিনই জানবে না, যে নাগের বাড়ির বৌ কিছু জানে না, কিছু পারে না। দায়িত্ব নিয়ে আমি আপনাকে এই কথা দিলাম... আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।"
একবুক সুখ সঙ্গে নিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্তিলাভ করে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল মাধবীলতার জ্যেঠুমণি। কিন্তু ভয় বাসা বেঁধেছিল নববধূর বুকের গোপনে। একেবারে ছাদনাতলায় গিয়ে প্রথম দেখা হয়েছিল সেই মানুষটার সঙ্গে। নিয়মরক্ষার খাতিরে শুভদৃষ্টির সময় লাল চেলি, স্বর্ণালংকার আর ফুলের গয়নার ফাঁক দিয়ে একবার মাত্র তার দিকে চেয়েছিল মাধবীলতা। তারপর লজ্জায় আর মাথা তুলতে পারেনি। সেই মানুষটা একটু পর পুষ্পশোভিত ঘরে আসবে। অচেনা ঘর, পুষ্পবেষ্টিত অনভ্যস্ত শয্যা, অজানা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অপরিচিত একটা মানুষের সঙ্গে মাধবীলতা একা...
জানলা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে মাধবীলতা ভাবছিল তার প্রথম স্পর্শের কথা! শাড়ি গয়না আর ঘোমটায় ঢেকে তাকে বিছানার এককোণে সকলে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। ভয়ে মাধবীলতার দমবন্ধ হয়ে আসছিল। সে ঘরে এসেছিল। আগল তুলে শয্যার অপর প্রান্তে দীর্ঘক্ষণ বসেছিল। অতর্কিতে মাধবীলতার ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, "তোমার তো দেখছি ভারি দেমাক! ঘরের মধ্যে এসেছি, তবুও আমার সঙ্গে একটাও কথা বলার প্রয়োজন মনে করো না!"
মাধবীলতা স্বল্প জীবনে যত শব্দ শিখেছিল, তার কাছে বকা খেয়ে সেদিন ভুলে গিয়েছিল সমস্তই। সে বজ্রের মতো কঠিন স্বরে বলেছিল, "বড়দের প্রণাম করতে হয়, তা কি জানোনা? দাদু তোমার কুষ্ঠি দেখেছে। আমি তোমার থেকে পাক্কা আট বছর একুশ দিন এগারো ঘন্টা একত্রিশ সেকেন্ড আগে জন্মেছি। তুমি কি সেই খবর রাখো? আমার সম্পর্কে কিছুই তো জানো না দেখছি। এই অপরাধে তোমাকে কালই তোমার জ্যেঠুর বাড়ি ফেরত পাঠানো হবে।"
ফুঁপিয়ে কেঁদে পালঙ্ক থেকে নেমে স্বামীর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাধবীলতা। কেঁদে বলেছিল, "জ্যেঠুমণি অনেক কষ্ট করে আমার বিয়ে দিয়েছে। আমি এই বাড়ির এককোণে থেকে যাব। মাটিতে শুয়ে থাকব। যেখানে বলবেন, যেভাবে বলবেন, সেখানে সেভাবেই থাকব। দয়া করে আমাকে ফেরত পাঠাবেন না। জ্যেঠুমণি সহ্য করতে পারবে না।"
তড়িঘড়ি নিজের পায়ের ওপর থেকে শাড়ি গয়নার ভারে কুন্ডলী পাকানো ভীত প্রাণীটাকে টেনে তুলেছিল সে। মাধবীলতা তখন আকুল হয়ে কাঁদছিল। চন্দনের নকশা কাটা সাজ বুঝি নষ্ট হয়েছিল চোখের জলে। সিঁদুর গিয়েছিল ঘেঁটে। ফুলের গয়না আলগা হয়েছিল। কিন্তু তবুও সে লণ্ঠনের মৃদু আলোয় মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছিল মাধবীলতার ঢলঢলে মুখটার দিকে। হঠাৎ একহাতে মাধবীলতার ছোট্ট দেহটা ঘিরে ধরে অপর হাতে মাধবীলতার গাল স্পর্শ করে সে বলে উঠেছিল, "এই তো আমার লাল টুকটুকে বৌ কথা বলতে পারে। তবে তুমি বোবা নও! আমি ভাবলাম, সবার সঙ্গে কথা বলে। শুধু আমার সামনে এলেই বৌ বোবা হয়ে যায় কেন? যাক! সব ঠিক আছে। পরশু রাত থেকে কতবার চেয়েছিলাম তোমার দিকে। একবারও আমাকে দেখোনি তুমি! কেন? আমাকে পছন্দ হয়নি? সত্যি বলো মাধু। একটুও পছন্দ হয়নি?"
তার বজ্রকঠিন কণ্ঠের এমনতর আকস্মিক পরিবর্তনে মরমে মরেছিল মাধবীলতা। তার হাত থেকে মুক্তির জন্য উদগ্রীব হয়েছিল। কোনোক্রমে বাহুবন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে শয্যার এককোণে আত্মগোপন করেছিল সে। নবদম্পতির মধ্যে সারারাত নানাপ্রকার হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে খানিক সন্ধিস্থাপন হলেও, প্রথম রাতে সে জোর করে কাছে আসার চেষ্টা করেনি। হয়তো নবদাম্পত্যের সুমিষ্ট ঘ্রাণটুকু সে মুগ্ধতা আর বিহ্বলতায় বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তার হাতের ওপর মাথা রেখে সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মাধবীলতা। পরদিন ভোরবেলা ঘুমের মধ্যেই নিজের আলতা পরা পায়ে মাধবীলতা মৃদু সুড়সুড়ি অনুভব করে। পা-টা কুঁকড়ে শাড়ির পাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেও তার খুনসুটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি। প্রথমে একবার সুড়সুড়ি, তারপর একাধিকবার। সেই ছিল প্রথম গভীর স্পর্শ। সবশেষে সে চেপে ধরেছিল মাধবীলতার আলতা রাঙা দুটি চরণ। নববধূর নূপুর উঠেছিল ঝমঝমিয়ে। ঘুম ভেঙে একলাফে উঠে বসেছিল মাধবীলতা। শাড়ির আঁচল সামলে চোখ মেলে দেখেছিল ঘরের ভিতর কেউ নেই। কেবল বাসি বিছানার ওপর নববধূর আলতা রাঙা পায়ের কাছে গুটিকয়েক টাটকা রক্তগোলাপ পড়ে রয়েছে, সঙ্গে একটি ভাঁজ করা কাগজ।
যে পুরুষ প্রথম রাতে ধমকে-চমকে চোখ রাঙিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদিয়ে প্রণাম আদায় করে, রাত্রিশেষের প্রথম প্রভাতে সেই পুরুষই নতমস্তকে বধূর চরণ স্পর্শ করে! ভাঁজ করা কাগজটা খুলে মাধবীলতা দেখল তাতে লেখা রয়েছে, "নিজের মানুষকে আপনি সম্বোধনে দূরে সরিয়ে রাখতে নেই। শিবঠাকুর পাপ দেয়।"
যারপরনাই বিহ্বল হয়ে গোলাপ ফুলের ঝরে যাওয়া কয়েকটি পাপড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে মাধবীলতা নাক ডুবিয়েছিল অপার্থিব সুগন্ধে। সেই ছিল প্রথম প্রণয়ের সূত্রপাত...
নবদাম্পত্যের আড় ভেঙে প্রিয় পুরুষের কাছে সহজ হয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করতে মাধবীলতার বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। কিন্তু সুখস্বপ্নের মতো সেই স্পর্শকাতর ও স্মৃতিবিজড়িত রাতের পর অপেক্ষা হয়েছিল মাধবীলতার নিত্যসঙ্গী। দিনের সমস্ত সময় কেবল দৃষ্টিবিনিময় হতো তার সঙ্গে। আর মনের ভিতরে গোপনে লালিত হতো রাতে ঘরের দরজায় খিল তোলার অপেক্ষা। মৃগাঙ্ক গর্ভে আসার আগে তার সঙ্গে একান্তে কাটানো সুন্দর দিনগুলোর স্মৃতি আজও মাধবীলতার স্মৃতিতে অমলিন। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে সকলের মধ্যে থেকে প্রকাশ্যে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো কিংবা তাকে স্পর্শ করার মতো দুঃসাহস মাধবীলতার কোনোকালেই ছিল না। তার জন্য ছিল গোপন অবসর, আগলের আড়ালে নির্দিষ্ট পরিসরের নিশ্চিন্ত আড়াল। মাধবীলতার মতো একজন সংযত নারীর গর্ভের সন্তান হয়ে শুধুমাত্র পুরুষসঙ্গ লাভের তাগিদে আহ্লাদী এমন সর্বনাশী হয়ে ওঠে কোন লজ্জায়!
মাধবীলতা আর ভাবতে পারে না। নিধি জলখাবার রেখে গেছে। কিন্তু মাধবীলতা অভুক্ত অবস্থায় বসে একনাগাড়ে চোখের জল ফেলে চলেছে। হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে লতা হাঁক দেয়,
-ও বড়মা, করো কী? চক্কোত্তিদের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় চাঁপার সঙ্গে দেখা হল। তুমি নাকি তাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছ, আমার সঙ্গে তোমার কথা আছে। তা সকালেই তো এলাম বাপু। তখন তো কিছু বললে না। এখন ঝটপট বলো দেখি। ঘরে গিয়ে আমার মেলা কাজ আছে। বেলা তো আর কম হল না...
মাধবীলতা নীরবে কেঁদে ভাসাল। লতা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে মাধবীলতার পায়ের কাছে পিঁড়ি পেতে বসে বলল,
-ও বড়মা, কাঁদো কেন? কী হয়েছে? বড় বৌ আবার খারাপ কথা বলেছে?
-সে তো দিনরাতই উঠতে-বসতে বলছে। চামড়ার মুখ আছে, বলতে পারলেই হল। ও আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আজ...
-কী হয়েছে আজ?
লতার দুটো হাত চেপে ধরে মাধবীলতা আকুল হয়ে বলল,
-কাজের জন্য তুই সাত পাড়া ঘুরে বেড়াস লতা! কত মানুষের সঙ্গে তোর ওঠাবসা। গত বছর মল্লিক বাড়ির মেজ মেয়েটার কত ভালো ঘরে সম্বন্ধ করে দিলি। আমি তোকে ঘটকালি বাবদ এক টুকরো জমি দেব। তুই আমার আহ্লাদীর জন্য একটা ছেলে খুঁজে দে। ওর বিয়েটা দিতেই হবে। নইলে ও বারমুখী মেয়েকে ঘরে আটকানো যাবে না।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মাধবীলতার দিকে চেয়ে লতা হাত ছাড়িয়ে নিল। ভীত কণ্ঠে বলল,
-কী বলছ বড়মা!! সব জেনেশুনে ঐ মেয়ের বিয়ের ঘটকালি করব আমি? তারপর কিছু হলে ছেলের বাড়ির লোক আমাকে ছেড়ে কথা বলবে? আর কিছু মনে ক'রো না.... আহ্লাদীর যা কেচ্ছা, জেনেশুনে ঐ মেয়েকে কে বিয়ে করবে বলো?
-দূর থেকে কোনও সম্বন্ধ নিয়ে আয়। যারা তেমন কিছু জানবে না। তুই আমাকে উদ্ধার কর লতা। এই মেয়ের বিয়ে না দিয়ে আমি শান্তিতে চোখ বুজতে পারব না। বড় বৌ ওকে ছিঁড়ে খাবে। আমি বেঁচে থাকতেই এই, চোখ বুজলে তো.... কোনও শত্তুরও আমার মেয়ের রূপ নিয়ে কুকথা বলতে পারবে না। শাড়ি আর গয়না দিয়ে আমি আহ্লাদীর মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঢেকে দেব। যে ছেলে ওকে বিয়ে করবে, তাকে জমি-জায়গা লিখে দেব। ছেলের বিষয়-সম্পত্তি, বাড়িঘর, টাকাপয়সা, চাকরি-বাকরি কিচ্ছু চাই না। সব আমি দেব। শুধু ছেলেটা যেন একটু ভালো হয়!
মৃদু হাসল লতা। ঘামে ভেজা কাপড়ের আঁচলটা কোমর থেকে খুলে মুখের ঘাম মুছে মৃদু হেসে বলল,
-সম্বন্ধ সবসময় সমানে সমানে হওয়া ভালো বুঝলে! ভালো ছেলে একটা ভালো মেয়েই চাইবে বড়মা। সে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে আসবে কেন? তোমার অনেক টাকা আছে। কিন্তু সত্যি কথা কী জানো? তোমার মেয়ে তো আর বোবা কালা খোঁড়া নয়, যে টাকায় শরীরের খুঁত ঢেকে যাবে। টাকা দিয়ে মানুষের দেহের খুঁত ঢাকা যায়, কিন্তু চরিত্রের খুঁত? তোমার মেয়ের যা চরিত্র, বিয়ের পরেও যে সে এমনধারা কাজ.... ঠিক আছে। এত করে বলছ যখন, তোমার মুখ চেয়ে আমি দেখব, যদি কিছু করা যায়.... এখন চললাম গো। বেলা অনেক হল। কিছু খবর থাকলে তোমাকে জানাব।
চোখের জল চোখে চেপে থমথমে মুখে ঘরের ভিতরে একা বসে রইল মাধবীলতা। চরিত্র সংশোধনের কোনও জাদুকরী পন্থা যদি তার জানা থাকত, হয়তো এক মুহূর্তে বদলে দিতে পারত কন্যার জীবন। কিন্তু যে নারী একবার গোপন সুখের স্বাদ পেয়ে আদ্যোপান্ত পুরুষ খাদক হয়ে উঠেছে, তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে এক পুরুষের ঘরমুখী করা কি সত্যিই সম্ভব? দুশ্চিন্তায় জর্জরিত হয়ে মাধবীলতা আবারও চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট