খিল
সাথী দাস
সপ্তম পর্ব
-তা তোমার বোনের যা মতিগতি, বিয়ে না দিলে ও মেয়েকে ঘরে আটকানো যাবে না। বোনের বিয়ে নিয়ে ভাবলে কিছু?
কিছুক্ষণ আগে বাঁশি বাজিয়ে নাগের বাড়ির দরজা-জানালা কাঁপিয়ে শেষ রেলগাড়িটা চলে গেছে। তারপরই গোটা পাড়া ডুব দিয়েছে অন্ধকারে। অতীতে মাধবীলতাকে প্রদীপের মতো টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বিদ্যুতের আলো ও বিদ্যুৎচালিত পাখার গতিবিধি লক্ষ্য করতে হতো কুপির আলো কিংবা টর্চ হাতে নিয়ে। বর্তমানে পাড়ায় বিদ্যুতের ঘাটতি তেমনভাবে দেখা না গেলেও, বিদ্যুৎ বিভ্রাটজনিত সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া যায়নি। ঘরের দরজা বন্ধ করে গায়ের গয়না ঝনঝনিয়ে পরনের কাপড় আলগা করল তৃণা। চোখে চশমা এঁটে খাতার ওপর মৃগাঙ্ক একমনে ঝুঁকে পড়েছিল। লণ্ঠনের আলোয় ওর মুখের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম জ্বলজ্বল করছিল। ঘামে ভিজে উঠেছিল সর্বাঙ্গ। বিছানায় বসে তৃণা কাপড়ের আঁচলখানা দেহের ওপর থেকে পুরোপুরি সরিয়ে হাতপাখা দিয়ে নিজের মাথায় বাতাস করতে করতে বলল,
-মা গো! ভ্যাপসা গরমে মরলাম আমি। গায়ে কাপড়চোপড় কিছু রাখা যাচ্ছে না।
-তা রাখতে কে বলেছে? খুলে ফেললেই হয়।
ঘাড় ঘুরিয়ে চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে বাঁকা দৃষ্টি মেলে মৃগাঙ্ক একবার চাইল তৃণার দিকে। তারপর হেসে আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ল। হাতপাখার দাপটে তৃণার হাতের সোনার চুড়ি রিনরিন শব্দে বেজে উঠল। মুখ বেঁকিয়ে তৃণা বলল,
-মস্করা রাখো। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভীমরতি। যত বয়স বাড়ছে, বুড়োর যেন ইচ্ছেনদীতে একেবারে বান ডাকছে। ঢেউ একেবারে উথলে উথলে উঠছে। আমি মরছি আমার জ্বালায়। উনি এলেন রঙ্গ-রসিকতা করতে। সারাদিন পর বিছানায় একটু গা দেব, অমনি মরাখেকো কারেন্টটা যমের বাড়ি গেল। কখন আসবে তা ঠিক নেই। বলি কথাটা কি কানে যাচ্ছে না? কী বলছি আমি? দিনরাত ঐ হিসেবপত্তরের খাতায় মুখ গুঁজে থাকো। এদিকে বোন যে নেচে নেচে সাত ঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছে, সেই হিসেব আর কে রাখে! বলেছিলাম টাকা-পয়সা গয়না নিয়ে একদিন পালাবে, ঠিক তাই হয়েছে। বৌয়ের কথা তো বাসি হলে ফলে। এবার কোনদিন পেট বাধিয়ে আসবে, তখন বুঝবে ঠ্যালা! লজ্জায় আমি নিজের বাপেরবাড়িতে যেতে পারি না গো। গেলেই ওর কথা লোকে আগে জিজ্ঞাসা করে। আড়ালে মুখ টিপে হাসে। বলিহারি তোমার মায়ের আক্কেল! শেষ বয়সে একটা বেশ্যা পেটে ধরেছে!
-বাবাই টুবাই ঘুমোল?
-হ্যাঁ। ছেলেদের ঘরের দোর বন্ধ দেখে এলাম।
-কাল অফিস থেকে ফেরার পথে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
-আয়ুর্বেদ নাকি হোমিওপ্যাথি?
-হোমিওপ্যাথি, বসু ডাক্তার গো।
-হ্যাঁ তো কী হয়েছে?
-বলছিল, ছেলেদের দিকে একটু নজর দিতে।
-কেন? আমার ছেলেরা তার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি? তার বাড়ির উঠোনে হালকা হতে গেছে, নাকি তার মেয়ের হাত ধরে রাস্তাঘাটে টানাটানি করেছে? আমার ছেলেদের দিকে লোকের এত নজর কেন বাপু? অমন সোনার টুকরো ছেলে এ তল্লাটে আর কারও আছে?
-আমাদের বড় ছেলে, বাবাই.... কাল বিকেলে নাকি রেল কোয়ার্টারের ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল! বসু ডাক্তার নিজের চোখে দেখেছে। তাই সাবধান করল।
-সে তো আমি ওর বালিশের তলাতেও সিগারেটের বাক্স পেয়েছি। ওর ঘরেও গন্ধ পেয়েছি। ছেলে আমাকে কত মান দেয় জানো? আমাকে দেখেই জানলা দিয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। বাবাই বড় হচ্ছে বুঝলে! ছেলের সব ব্যাপারে এত নাক গলাতে এসো না। ও আর আমাদের ছোট ছেলেটি নেই। পুরুষ মানুষ হয়ে গেছে। এখন সবসময় এত ডাক নিলে চলে না।
-আমাদের কাছে ওরা আজীবন ছোটই থাকবে। দিনরাত আহ্লাদীর কথা না ভেবে, তার সিকিভাগ সময় যদি নিজের ছেলেদের পিছনে দাও, তবে ভালো হয়। ওরা কখন কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে, একটু খোঁজখবর রাখতে পারো তো। এখনো বাইরে পড়তে যায়নি। হোস্টেল লাইফের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। পরিবারের সঙ্গে রয়েছে। এর মধ্যেই এসব নেশা করতে শুরু করেছে। তুমি সব জেনেও আমাকে জানাওনি। এ মোটেও ভালো কথা নয়। ছেলেকে ভালোবাসা একরকম। কিন্তু ওর খারাপ অভ্যাসগুলোকে প্রশ্রয় দিও না। আহ্লাদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ভাবিও না। ওর বিয়ে হলে হবে। না হলে না হবে। এতবড় বাড়ির এককোণে পড়ে থাকবে। আমার সংসারে একটা পেট বেশি হবে না। কিন্তু ছেলেরা আমাদের স্বপ্ন। সেখানে যদি কিছু ভুল হয়ে যায়, ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। ওরা ভালো না থাকলে আমরা ভালো থাকতে পারব বলো তো? ছেলেদের যত আবদার, যত প্রয়োজন, সব তোমার কাছেই জানায়। তুমি একটু বোঝাতে পারো তো। বাবাইয়ের সঙ্গে কথা বলো...
-আসল কথাটা বলো না! বোনের কথা বলতে গায়ে জ্বালা ধরছে। তাই আমার ছেলের কথা তুলেছ। যাও নিজের মা-ভাই-বোনকে গলার মালা করে নিয়ে থাকো। আমি আর আমার ছেলেরা খারাপ তো? থাকতে হবে না আমাদের সঙ্গে। আমি খুব জানি.... তোমার মনে কী চলে.... শুধু আমার মতো মেয়েমানুষ ব'লে সারাজীবন মুখ বুজে ঘর করে গেল.... রাবণের গুষ্টির দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে নিজের সমস্ত শখ-রঙ বিসর্জন দিয়ে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিল। ঐ ছোট'র মতো মেয়েমানুষ হওয়া দরকার ছিল। কত বুদ্ধি! আগেই পাকাপাকিভাবে বাড়ি-হাঁড়ি ভিন্ন করার পথ বাতলে, তবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। নামেই নাগের বাড়ির ছোটবৌ! অথচ দেখো, একটা কাজে-কর্মে দায়িত্বে কর্তব্যে পায় না। শ্বশুরবাড়ির ঘর করা কাকে বলে, সে তো জানলোই না। এত পুজো-আচ্চা যায়, সে অতিথির মতো ঘুরতে আসে, আর সুযোগ পেলেই চুলবুল করে তার মুখের বুলি ছোটে। ও মেয়েমানুষের যুক্তির ঠেলায় জগৎ অন্ধকার। প্রথম থেকেই ভিন্ন হয়ে কেমন সুন্দর বরের কোলে চড়ে চুটিয়ে সংসার করছে দ্যাখো। আর আমি? এখানে হেঁশেল ঠেলে মরছি। গতর পুড়িয়ে সবার জন্য করেও মরো, আবার মানুষের কথা শুনেও মরো। সব কপাল গো! পোড়া কপাল! যতই করো, এদের মন আর পাবে না.... সময় থাকতে থাকতে বেহায়া মেয়েটার একটা গতি করতে চাইছি। তা কেউ আমার কথার মান দিলে তো! এরপর লোকে বলবে, তিন-তিনটে দাদা মাথার ওপর থাকতে বয়সকালে মেয়েটার বিয়ের চেষ্টা কেউ করেনি। মেজজনের সাত চড়ে রা নেই। কোনও মান-অপমান বোধ নেই। ছোটজন শুনতেও আসবে না। যত দায় আমার একার...
তৃণার বুজে আসা কান্নাভেজা কণ্ঠে মৃগাঙ্কর হাত থেকে কলম নেমে গেল। হিসেবের খাতায় অনিচ্ছাকৃত গরমিল হয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বিছানায় বসে অভিমানী তৃণার হাত থেকে হাতপাখা কেড়ে নিয়ে বাতাস করতে করতে মৃগাঙ্ক বলল,
-ঠিক আছে, কাল বাবাইয়ের সঙ্গে না হয় আমিই কথা বলব। তুমি কী বলছিলে বলো?
-থাক, আর শুনে কাজ নেই!
-আমার ঘাড়ে ক'টা মাথা, যে তোমার কথা না শুনে যেচে স্কন্ধকাটা হবো!
-কী বললে?
-বলো বলো।
অতি উৎসাহে মৃগাঙ্কর হাত থেকে পাখা কেড়ে জোরে জোরে বাতাস করতে করতে তৃণা বলল,
-সেই সেবার ছোটকার নাতির অন্নপ্রাশনে বাপেরবাড়ি গেলাম.... তখন বিন্তিপিসির ছোট ছেলেটার জন্য কাকিমা একটা মেয়ে দেখে দেওয়ার কথা বলছিল। কাকিমা বলছিল, শ্বশুর ঘরজামাই রাখলেও তাদের কোনও আপত্তি নেই। সেই তো নিজের বাড়িতে তিনবেলা শুয়ে-বসে অন্ন ধ্বংস করছে। তার চেয়ে শ্বশুরবাড়ির ভাত খাক। তবু ছেলেটার একটা গতি হোক। ছেলে কিংবা বৌ নিয়ে ওদের এত মাথাব্যাথা নেই। আমি ঠিক করেছি, ওর সঙ্গেই আহ্লাদীর বিয়ে দেব।
-ঐ ছেলে? কিন্তু ওর চালচলন তো...
-শোনো, তোমার বোনের জন্য ঐ ঠিক আছে। ও মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিশ্চয়ই আকাশ থেকে টুপ করে রাজপুত্তুর খসে পড়বে না.... ভালো ছেলে যে খুঁজতে চাও, নিজের বোনের গুণ বাইরের লোকের কাছে বলতে পারবে?
-তাই বলে ঘরজামাই? ভালোভাবে ভেবে দেখো, বিয়ের পরেও কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে এখানেই থাকবে। সব ঝামেলা তোমার ওপর এসে পড়বে। তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না!
-এতদিনে তুমি আমাকে এই চিনলে হ্যাঁ? ঘরজামাই কে রাখবে? ও মেয়েকে ঘর থেকে বের করার জন্য আমি কিনা বিয়ের কথা বলছি, তার জামাইকে আবার নাকি ঘরে বসিয়ে জামাই আদর করে পাত পেড়ে খাওয়াব! ওটাই বাকি আছে। আমার বুদ্ধিটা শোনো। আমবাগানের কোণে এক টুকরো জমিতে একটা ছয়-ছোট্ট একতলা ঘর তুলে দাও। আর তোমার দোকানে ছেলেটাকে কাজে নিয়ে নাও। এই বাজারে মাগনায় কাজের লোক আর পাবে তুমি? শশী ঠাকুরপোর মতো ওর হাতেও না হয় মাসের প্রথমে কিছু টাকা গুঁজে দেবে। নিজেদের দোকানে থাকলে ওরা বেশি কথা বলতে পারবে না। এদিকে ঘরের সম্পত্তি ঘরেও রইল, আবার সমাজের পাঁচটা মানুষকে দেখানো হল যে বড়দা দাঁড়িয়ে থেকে জমি বাড়ি দিয়ে শাড়ি-গয়নায় গা সাজিয়ে বোনের বিয়ে দিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করেছে। এতে সবদিক রক্ষা হবে, আর বিয়ে দিলে ঐ মেয়ের গায়ের গরমও মরবে। বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। তারপর ঘরে খিল এঁটে বন্ধ দরজার ওপারে যা খুশি করুক.... এই হপ্তাতেই তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলবে, বুঝলে?
-তোমার এত বুদ্ধি গিন্নি!
-আ মরণ! বুড়োর কথা শুনলে গা জ্বলে যায়। এই আমার বুদ্ধি ছিল বলেই তো এখনো বিষয়-সম্পত্তি সব হাতের মুঠোয় রয়েছে। নইলে কবে সব বারো ভূতে লুটেপুটে খেয়ে নিত। হাওয়া করো হাওয়া করো। গরমে আমার গা একেবারে জ্বলে গেল গো...
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে গ্রামের সীমানা পর্যন্ত অন্ধকারের শিকড় রাজ্যবিস্তার করেছে। আহ্লাদীর মাসিক অসুবিধার কারণে মাধবীলতা আশ্রয় নিয়েছে চিলেকোঠার ঘরে। শেষরাতে ঘরের দরজা খুলে চুপিচুপি বেরিয়ে গেল আহ্লাদী। অন্ধকারের বেড়া ছিঁড়ে মাঠের প্রান্তে পৌঁছনোর পর, আহ্লাদী সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেল। ক্ষেতের পাশের সরু রাস্তার ওপর সাইকেলটা পড়ে রইল। গাছের আড়ালে দুটি দেহ পরস্পরের মধ্যে যেন মিশে যেতে চাইছিল। প্রেমিকের অস্থির হাত আপন যোনির প্রান্ত থেকে টেনে সরিয়ে মৃদু আপত্তি জানাল আহ্লাদী। নিদারুণ অসময়ে নারীর উরুসন্ধিতে প্রবেশাধিকার না পেয়ে আহ্লাদীর কোমল ঠোঁট ও উন্নত স্তনযুগলের নীরব নৈবেদ্য গ্রহণ করল কাঙ্খিত পুরুষ।
নাগের বাড়ির অলিখিত কর্ত্রীর দাপটে দিনকয়েকের মধ্যেই এক গোধূলি বিকেলের আলো গায়ে মেখে পাত্রপক্ষের সঙ্গে স্বয়ং পাত্রের আবির্ভাব ঘটল। সেই রাতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে চাপা স্বরে অঙ্কনের ওপর ক্ষোভ উগড়ে দিল উত্তরা।
-এই ছেলের সঙ্গে আহ্লাদীর বিয়ে হবে? বড়দিভাই আর ছেলে খুঁজে পায়নি? এটা ছেলে? নাকি মেয়ে! অঙ্কন এ বাড়ির কারও পরোয়া আমি করি না। কাউকে বোঝানোর দায়ও আমার নেই। কিন্তু তুমি? তোমাকে নিশ্চয়ই আলাদা করে বোঝাতে হবে না। প্রকৃতির নিয়মে মুখে খানকতক দাড়ি-গোঁফ গজালেই সে পুরুষমানুষ হয়ে যায় না অঙ্কন। ঐ মানুষটা মনেপ্রাণে পুরুষ তো? তার নিজের ভাইপো তাকে হাফ লেডিজ ছোটকা বলে ডাকছে, হাত পা নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে জিভ ভেংচি কেটে ব্যঙ্গ করছে। বাচ্চার আর কী দোষ? এগুলো বাড়িতে দেখছে বলেই তো এতটুকু বাচ্চা ছেলে শিখছে। তার মানে নিজের বাড়িতে ঐ মানুষের জায়গাটা বুঝতে পারছ? যে নিজের জন্যই স্ট্যান্ড নিতে পারে না, তার বৌয়ের কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ? আহ্লাদীর জন্য বড়দাভাই এটা কী ধরে এনেছে? অঙ্কন এই বিয়ে তোমাকে ভাঙতেই হবে।
-বোঝার চেষ্টা করো উত্তরা, এই সম্বন্ধ বড় বৌদি এনেছে। মা নামেই এই বাড়ির অভিভাবক। বড় বৌদির ইচ্ছে ছাড়া এ বাড়ির উঠোনে একটা পাতাও ঝরে পড়ার সাহস দেখাতে পারে না।
-আমাকে বিয়ে করলে কী করে? পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়েই তো? নিজের মায়ের অবাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছ তো? তোমার দুই দাদা বাধ্য হয়েছিল দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিয়েটা দিতে। নিজের ভালো বুঝে জেদ করে নিজে বিয়ে করতে পারলে, ঐরকম জেদ দেখিয়ে লড়াই করে বোনের বিয়েও ভাঙতে পারবে। মানছি আমাদের মেয়ের মধ্যে খুঁত আছে। কিন্তু তাই বলে ঐরকম একটা মানুষের গলায় আহ্লাদীকে ঝুলিয়ে তোমরা দায় সারবে? এ বিয়ে আমি ভেঙেই ছাড়ব। এবার তুমি ঠিক করো, কাল সকালে বড়দাভাইয়ের সঙ্গে তুমি কথা বলবে, নাকি আমি!
-আমি বড়দার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। তাছাড়া তুমি একা ছেলেকে দেখোনি। সবাই দেখেছে। মেজদা তো কিছু বলছে না। তবে তুমি কেন এত ব্যস্ত হয়ে পড়ছ? বিয়েটা হলে হয়ে যাক না! বিয়ের পর বোন যদি একটু স্থির হয়! যদি সংসারে মন বসে...
খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল উত্তরা। বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছে। অঙ্কন পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বলল,
-আমরা এ সবকিছু থেকে অনেক দূরে থাকি উত্তরা। অতিথির মতো বাড়িতে বেড়াতে আসি। কী দরকার সব বিষয়ে কথা বলার? তারা তো আমাদের মধ্যে কথা বলতে আসে না। যেচে কথা শোনার কী দরকার? পরে তোমাকে যদি কেউ বলে বসে, উত্তরার জন্য আহ্লাদীর সংসার করা হল না.... তখন আমার শুনতে ভালো লাগবে? বড়রা যা করছে, করতে দাও না। টাকা-পয়সা, গয়না যা লাগবে, দিয়ে আমরা চলে যাব। তারপর যারা কাছে থাকবে, যারা দেখেশুনে বিয়ে দিচ্ছে, তারা বুঝে নেবে। কাজকর্ম মিটে গেলে আমরা ট্রেন ধরব। এই সবকিছুর থেকে দূরে নিজেদের পৃথিবীতে হারিয়ে যাব। এবার একটু নিজেদের কথাও তো ভাবতে হবে। কতদিন আর তুমি-আমি থাকব? আমরা হতে হবে না? তোমার-আমার মধ্যে একটা ছোট্ট মানুষ আসবে, ছোট্ট ছোট্ট হাত, ছোট্ট ছোট্ট পা.... নিজের তৈরি করা ছোট্ট একটা প্রাণকে কোলে নেওয়ার জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে?
অঙ্কনের হাতে চুমু খেয়ে উত্তরা আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলল,
-আদর করার সময় বারবার জানতে চাও কেন, আমার ভালো লাগছে কিনা! বিয়ের তো কম দিন হল না, এখনো আমাকে খুশি করতে চাও?
-হুম.... যতদিন আমার শরীরে ক্ষমতা থাকবে, ততদিন তাই চাইব।
-কেন? ভয় হয়? তুমি আমাকে খুশি করতে না পারলে, আমি অন্য কোথাও সুখ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করব? নাকি মেল ইগো! পার্টনারকে সুখ না দিতে পারলে বুকের ভিতরে কোথাও অক্ষমতার আগুন দপ করে জ্বলে ওঠে!
-কেন? আমি কি তোমাকে সুখ দিতে পারি না? আগে কোনোদিন বলোনি তো!
-যা জিজ্ঞাসা করছি, তার উত্তর দাও।
-এতশত জানি না উত্তরা। তোমাকে ভালো রাখতে পারলে, আমি আর কিছু চাই না। তোমাকে তৃপ্ত দেখার পর নিজের ক্লান্তি গায়ে লাগে না। শরীরের থেকেও বেশি মন তৃপ্ত হয়।
-সেটাই স্বাভাবিক! আর কারও যদি সেই ক্ষমতাটাই না থাকে! কেউ যদি স্ত্রীকে খুশি করতে না পারে!
-মানে?
-ঐ ছেলেটি অঙ্কন, যার সঙ্গে আহ্লাদীর বিয়ে দেওয়ার জন্য বড়দিভাই উঠে-পড়ে লেগেছে.... ঐ ছেলেটিকে দেখে আমার ভালো লাগেনি। তুমি একটা জিনিস কেন বোঝার চেষ্টা করছ না? সংসার মানে একটা ঘর। ঘরের ভিতর নিজেদের একটা বিছানা, সম্পূর্ণ নিজেদের কিছু মুহূর্ত। আর সেখানে কোনও অতৃপ্তি মন মানে না। ওখানে ফাঁক থাকলে ঘর বলো কিংবা সংসার, সব উচ্ছন্নে যাবে। আহ্লাদীকে যে কারণে তোমরা বিয়ে দিতে চাইছ, সেটাই হবে না অঙ্কন। মিলিয়ে নিও আমার কথা! ঐ ছেলে ওকে ঘরে আটকাতে পারবে না। এখন এ বাড়িতে আছে। তোমরা টাকা-পয়সা লোকবল দিয়ে সবকিছু চাপা দিয়ে দিচ্ছ। বিয়ের পর যদি ঘরে সুখ না পেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে আবার ঘর ছাড়ে, তখন কুৎসা রটবে না? কী করবে তোমরা তখন? ভেবে দেখেছ কিছু?
-দেখো উত্তরা, আমি বড়দার সামনে এসব...
দরজার শব্দ শুনে দাম্পত্য আলাপ মাঝপথেই থেমে গেল। অঙ্কনের আলিঙ্গন থেকে মুক্তিলাভ করে দেওয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে উত্তরা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলে উত্তরা দেখল, বাইরে অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিধি। চাপা কণ্ঠে নিধি বলল,
-ঘুমিয়ে পড়েছিলি ছোট? এত রাতে বিরক্ত করলাম...
-না না মেজদিভাই, এসো এসো। ভিতরে এসো। এখন তো আমাদের সন্ধেরাত। বাড়িতে থাকলে এই সময় তোমার ঠাকুরপো সোফায় বসে পা দুলিয়ে লাস্ট রাউন্ড চায়ের অর্ডার দেয়। আমাদের ডিনার করতে করতে সেই রাত সাড়ে এগারোটা। তুমি এসো, ভিতরে এসে বসো।
-আমাদের এদিকে তখন মাঝরাত রে। সকাল সকাল উঠে তোর মেজদাকে মাঠে যেতে হয় তো। তোর সঙ্গে খুব দরকার ছোট, তাই এত রাতে একটু কথা বলতে এলাম। জানিসই তো সংসারের পরিস্থিতি। সকালে সবার সামনে মুখ খুলে একটা কথা বলার উপায় নেই।
-তোমরা কথা বলো বৌদি। আমি একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। উত্তরা আমি আসছি।
-এই মা ছাদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। সিগারেট ধরাবে না।
নিধি খাটের ওপর গুছিয়ে বসে ব্যস্ত হয়ে বলল,
-ঠাকুরপো, যেও না। তোমার সঙ্গেও কথা আছে। তুমি একটু থাকো।
-কী হয়েছে বৌদি?
-বলছি ছোট.... বিকেলে ছেলেটাকে দেখলি তো। তা কেমন লাগল তোদের? আমার জানি কেমনধারা লাগল। পুরুষ মানুষের অমনধারা মেয়েমানুষের মতো আচরণ কেন রে? হাঁটাচলা দেখলি? কথাবার্তা কেমন মেয়েলি না? শরীরে শক্তপোক্ত না হলে ঠিক পুরুষ মানুষ ব'লে ঠাওর হয় না। কিন্তু বড়দি এই সম্বন্ধ এনেছে। তার কুটুমের মধ্যে সম্বন্ধ, জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারছি না। আমি তোদের মেজদাকে এই কথা বলে তোদের মতামত নিতে এলাম। তোরা কী বলিস ছোট? ছেলে তোদের পছন্দ হয়েছে? এই বিয়েতে তোরা রাজি?
মৃদু হেসে সরাসরি অঙ্কনের দিকে চাইল উত্তরা। স্বামী-স্ত্রীর অর্থপূর্ণ দৃষ্টির বিনিময়ে ঘরের ভারী বাতাস যেন খানিক হালকা হল।
(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন