খিল
সাথী দাস
পঞ্চম পর্ব
-মা, সোনাপিসি কোথায়?
-সেই তুই স্কুলে যাওয়ার আগে থেকে ছাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে তোর সোনাপিসি। দুপুরে ভাত নিয়ে গেলাম, দরজা খুলল না। আমার হয়েছে যত জ্বালা!
-আমি ওপরে যাব।
-না টুয়া, তোমার আর ওপরে গিয়ে কাজ নেই। যেচে অশান্তি বাড়াস না মা। বম্মা দেখলে রক্ষে রাখবে না। কথা শুনতে আমার আর ভালো লাগে না। দুধ খেয়ে পড়তে বসো।
-সোনাপিসির কাছে একটু যাই না মা.... সকালে ঠাম সোনাপিসিকে কত মারল। সোনাপিসির খুব ব্যাথা লেগেছে। পিসি ওপরে একা কাঁদছে। আমি ডাকলে পিসি ঠিক দরজা খুলবে। সোনাপিসিকে একটু আদর করেই চলে আসব।
শৈশবের ক্ষুদ্র হৃদয় কেবল নির্ভেজাল স্নেহ বোঝে। সে সংসারের এত মান-অভিমান ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। আহ্লাদীর কাছে যাওয়ার জন্য ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল টুয়া। কন্যার বায়নার কাছে পরাস্ত হয়ে নিধি রান্নাঘরে দুধ গরম করতে গেল।
আহ্লাদীদের বাড়ির মতো ছাদটাও খুব সুন্দর। ছাদের মাঝ বরাবর একটা বাহারি দোলনা টাঙানো রয়েছে। দোলনার নরম গদিতে পিঠ রেখে আকাশের দিকে চাইলে এক অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বরাবরই আলোকময় উন্মুক্ত ক্ষেত্রের থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন আড়াল-আবডাল আহ্লাদীর বিশেষ পছন্দ। তাই ছাদের থেকে চিলেকোঠার ঘরটা ওর বেশি প্রিয়।
চিলেকোঠার ঘরে একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। কেমন যেন মনখারাপ করা পুরোনো সোঁদা গন্ধ। যেমন গন্ধ মাধবীলতার বাতিল করা পুরনো শাড়ির ভাঁজে পাওয়া যায়। ঘরের এককোণে একটা ছোট খাট রয়েছে। উল্টোদিকে মোটা কাপড়ের আড়ালে ঢাকা রয়েছে পায়া ভাঙা সোফা। গোটা দুয়েক নকশা করা কাঠের আলমারি, ধুলোর আস্তরণ পড়া বাসনপত্র ঘরের এককোণে অবহেলায় পড়ে থাকে.... ঠিক আহ্লাদীর মতোই নাগের বাড়ির যা কিছু অব্যবহৃত, অনাদরের ও অপ্রয়োজনীয় বস্তু, তাদের স্থান হয় এই ঘরে। সেই কারণেই বোধহয় ঘরের ভিতরে জমে থাকা জড় বস্তুগুলোর সঙ্গে আহ্লাদী এত একাত্ম হতে পারে। এই ঘর মধ্যস্থিত সকল প্রাণী ও বস্তুর প্রয়োজন সংসারের কাছে বহুদিন আগে ফুরিয়েছে।
ঘরের ভিতরের এই চৌপায়া খাটটাকে সংসারের সর্বাধিক পবিত্র ও শুদ্ধ জায়গা মানা হয়। ক্ষার দিয়ে মাধবীলতার জামাকাপড় কেচে ধুয়ে এই বিছানার ওপর রাখার কড়া নিয়ম আছে। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী তিথি ছাড়াও প্রতি মাসে আহ্লাদীর বিশেষ অসুবিধার দিনগুলোতে ওর স্পর্শ থেকে দূরে থেকে, ওকে একতলার ঘরের বিছানায় একা রেখে শুদ্ধাচারী মাধবীলতা এই ঘরে বাস করে। ঐ দিনগুলোতে বাড়ির বৌদের কিংবা নিজের মেয়ের ছায়াও মাধবীলতা স্পর্শ করে না। স্বপাক ব্যতীত আহার গ্রহণ করে না। চিলেকোঠার ঘরে দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা শীতলপাটিতে শয়ন করে। তাছাড়া যেকোনো ব্রত ও পুজোর দিনে উপবাস কিংবা ফলাহার উপলক্ষ্যে মাধবীলতার স্থান হয় সংসারবর্জিত এই ঘরে।
সময় এবং সুযোগ পেলে চুরি করে এই ঘরের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে আহ্লাদী। গুটিকয়েক আরশোলা, ইঁদুর আর টিকটিকি হয় ওর একাকীত্বের সঙ্গী। টিকটিকি ও আরশোলার সঙ্গে আহ্লাদীর বেশ বোঝাপড়া আছে। তারা পরস্পরকে ভয় পেয়ে সমীহ করে চলে। কেউ কারও বৃত্তে প্রবেশ করে না। কিন্তু দুঃসাহসী ইঁদুরগুলো রাতের অন্ধকারে ধারালো দাঁত দিয়ে ঘরের ভিতরের খুচরো জিনিসপত্র কেটে নষ্ট করে। তবুও আহ্লাদী তাদের স্পর্শ করে না। মৃগাঙ্ক একাধারে চাকুরিজীবি ও জমি-জিরেতের মালিক হলেও অন্যধারে পরিপক্ক ব্যবসায়ী। আরাধ্য দেবতা গণেশ ঠাকুরের বাহনকে ব্যবসায়ীর গৃহে নিধন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই ইঁদুরের উৎপাত সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে পারস্পরিক সহাবস্থানে নাগের বাড়ির সকলেই কমবেশি অভ্যস্ত।
খাটে শুয়ে ঝুল পড়া ঘুলঘুলির দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল আহ্লাদী। বিছানার আলিঙ্গন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে আসা স্বল্প আলোয় বোঝা যাচ্ছে, দিনের আলো প্রায় নিভে এলো। তবুও আহ্লাদীর খিদে পায়নি। কেমন যেন ঝিম ধরা অনুভূতি ঘিরে রয়েছে ওকে, চোখদুটো আধবোজা অবস্থায় রয়েছে। তিনতলার জানলা ও মেঝে কাঁপিয়ে বাঁশির শব্দ তুলে একটা রেলগাড়ি চলে গেল অফিস ফেরত নিত্যযাত্রীদের নিয়ে। সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে কেবল রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ গুনেছে আহ্লাদী। এক.... দুই.... তিন.... আপ.... ডাউন... একে একে সব গাড়ি স্টেশন ছেড়ে চলে যাবে গন্তব্যে। তবুও জীবনের কাছে আহ্লাদীর ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হবে না।
রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ আজও আহ্লাদীকে তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে কি আহ্লাদীর জীবনের প্রথম প্রেম ছিল? প্রেম কাকে বলে, তার অনুভূতি কেমন.... আহ্লাদী সঠিকভাবে বোঝে না। কিন্তু যে ভালোলাগার আগুন আহ্লাদীর বুকের মধ্যে সর্বক্ষণ দাবানলের মতো জ্বলে, ওর দেহ পুড়িয়ে ছারখার করে, সেই নিভৃত অগ্নুৎপাতের স্রষ্টা ছিল একজনই। হারু কাকা। তার স্পর্শে ছিল বন্য ভালোলাগা। আহ্লাদী না হয় তাকেই প্রথম প্রেমিক বলবে। কিন্তু তা কিভাবে হবে? সেই ভালোলাগার ধরনও তো কিছু সময় পর বড় একঘেয়ে একপেশে ও সবশেষে ফিকে হয়েছিল। তখন আহ্লাদী মানুষটাকে আর সহ্য করতে পারত না। স্কুলের ফিরতি পথের এককোণে তৈরি হয়েছিল আহ্লাদীর নতুন আকর্ষণ। ছেলেটি গ্যারেজে কাজ করত। স্কুলে নিয়মিত যাতায়াতের পথে যার সঙ্গে আহ্লাদীর চোরা দৃষ্টি বিনিময় চলত।
সেই দৃষ্টির টানে শীতের শেষ রাতে নিজের ঘর ছেড়েছিল আহ্লাদী। সবুজ গাছপালায় ঘেরা নাগের বাড়ির উঠোনে সন্ধে নামে বড় তাড়াতাড়ি। উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনায় আহ্লাদীর সেদিন সারারাত ঘুম হয়নি। সেই প্রথম দরজার আগল নামিয়ে আহ্লাদী ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছিল। শীতের রাতে স্টেশনে পৌঁছে চাদর জড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। হঠাৎ সে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে পিছন থেকে এসে কাঁধের ওপর হাত রেখে বলেছিল,
-এসেছ?
-তুমি!
-হ্যাঁ। এনেছ? যা আনতে বলেছিলাম।
-এই যে, এনেছি। এতে মায়ের গয়না আছে। সব হাতের সামনে পাইনি। যতটা পেয়েছি, সুযোগ বুঝে সরিয়ে রেখেছিলাম। আসার আগে ওড়নায় বেঁধে এনেছি।
একটা ছোট সুতির কাপড়ের পুঁটুলি নিজের বিশ্বস্ত প্রেমিকের হাতে তুলে দিয়েছিল আহ্লাদী। তারপর তার হাত ধরে ভোরের প্রথম গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়েছিল অজানা পথে।
নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া আহ্লাদীর খোঁজে যখন থানায় দৌড়ে মৃগাঙ্ক, শশাঙ্ক আর অঙ্কন প্রায় বিধ্বস্ত, ঘরের ভিতর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে মাধবীলতা.... সেই সময় প্রেমিকের সঙ্গে বহুদূরে পাড়ি দিয়েছে আহ্লাদী। একটি নিম্নমানের হোটেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্যাঁতসেঁতে শয্যায় আশ্রয় নিয়ে কেটে গেছে দুটি নির্ঘুম রাত।
প্রেমিকের তীব্র উন্মাদনা ও নারীদেহ স্পর্শের নবনবীন পন্থায় নিজের দেহের গোপন কোণ ও মনের অনাবিষ্কৃত অনুভূতিগুলোকে আহ্লাদী নতুনভাবে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। মিলনরত অবস্থায় বেশ কিছু সময় আহ্লাদীর যে হারু কাকার কথা একেবারেই মনে পড়েনি, এমনটা নয়। তবে হারু কাকা অন্তিমে কেবল নিজের সুখের কথা চিন্তা করলেও, আহ্লাদীর প্রেমিক দ্বিধাহীনভাবে তাকে সুখী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। এ বিষয়ে কোনোরকম কার্পণ্য সে করেনি।
চতুর্থ দিনে যখন অর্থাভাব দেখা দিল, মাধবীলতার গয়না বিক্রির তাগিদে হোটেলের বাইরে বেরোল আহ্লাদীর প্রেমিক। আহ্লাদী তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। চোখ মেলে চমৎকৃত হয়েছিল সে। ঘরের ভিতরে তার প্রেমিকের সঙ্গে আরও দু'জন অর্ধনগ্ন পুরুষ গল্পে বিভোর হয়ে মদ্যপানে ব্যস্ত। ভয় পেয়ে চাদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে আহ্লাদী নিজের প্রেমিকের নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে উঠেছিল.... প্রত্যুত্তরে আহ্লাদীর প্রেমিক সুমিষ্ট ভাষায় ওকে আশ্বস্ত করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল...
ঘুলঘুলির বাইরে আলো দেখা যাচ্ছে না। সন্ধে নেমেছে বোধহয়। নাগের বাড়ি কাঁপিয়ে সন্ধের ডাউন ট্রেন চলে গেল। চোখ মেলে শূন্যের দিকে চেয়েছিল আহ্লাদী। ওর চোখে জল আসে না, কান্না পায় না। মনে কথা জমে না। অভিমানে ঠোঁট ফুলে ওঠে না। আহ্লাদীর দেহের মধ্যে কেবল একটাই অনুভূতি সচল, অন্তহীন কামনা। যে কামনা প্রতিনিয়ত শীতল দুটি পা হতে নারীর উরুসন্ধি ছুঁয়ে শিরশিরে তলপেট অতিক্রম করে বুকের মধ্যে দিবারাত্র অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে রাখে...
চিলেকোঠার ঘরের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আহ্লাদী অন্ধকারে মিশে নিজের কথা ভাবছিল। ও নিজেকে ঠিক বুঝতে পারে না, নাকি ওকে কেউ বুঝতে চায় না! এ বড় জটিল এক ধাঁধাঁ। সাংসারিক প্রবহমানতার স্রোতে গা ভাসিয়ে নিতান্ত স্বাভাবিকের দলে নাম লেখাতে পারেনি বলেই কি ও নিজের পরিবারের কাছে অতিরিক্ত বোঝা? কেন সকলে এত খারাপ কথা বলে? ও কী এমন ভুল করে! নিজের অভ্যাস থেকে কেউ যদি চেয়েও ছুটি না পায়, তবে আহ্লাদী কেন নিজের ভালোলাগার অভ্যাসকে ছুটি দেবে?
সকলে ওকে নির্লজ্জ স্বার্থপর বলে। ও নাকি কারও মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে না। মান সম্মান আহ্লাদী চোখে দেখতে পায় না, অনুভব করতেও পারে না। এসব শব্দের সঙ্গে ও একেবারেই পরিচিত নয়। তবে আহ্লাদী স্বার্থপর, এ অপবাদ সর্বৈব মিথ্যা! নিজের পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের কথা আহ্লাদী মন দিয়ে চিন্তা করে। যা চোখে দেখা যায়, একা থাকলে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণও করে।
এই যে বড়দাদা প্রতিদিন অফিসে যায়, মেজদা মাঠে কিংবা দোকানে, বাবাই-টুবাই, টুয়া মন দিয়ে পড়াশোনা করে, বৌদিদিরা সংসারের কাজে নিজেদের আকন্ঠ ডুবিয়ে দেয়, তারাও তো ক্লান্ত হয়। কিন্তু মন প্রতিদিন একই নিয়ম মানতে না চাইলেও তো প্রাত্যহিক দায়িত্ব কর্তব্য থেকে ছুটি পাওয়া যাবে না। এ এক অভ্যাসও বটে! যেমন টুয়ার ছবি আঁকতে চাওয়াটা একটা অভ্যাস, ঠিক তেমনই.... নিত্য নতুনভাবে সাদা পৃষ্ঠায় আঁকিবুকি কেটে টুয়া আহ্লাদে আটখানা হয়। বৌদিদিরা দাদাদের ভালোবাসার অভ্যাসে নিত্যদিন জড়িয়ে থাকে। সিঁদুর ঘেঁটে যাওয়া এক রাতের শেষে মেজ বৌদিদির কাছে আহ্লাদী শুনেছিল, একবার ভালোবাসলে তখন মানুষ ভালোবাসা ছাড়া আর বাঁচতে পারে না। এ বড় সাংঘাতিক নেশা। এ নেশার অভাবে বুকের ভিতর তৈরি হয় মহাকাশ সমান শূন্যতা। বন্ধ দরজার ওপারে মেজ বৌদিদির অনুভবে মিশে থাকা সেই ভালোবাসার স্বাদ কেমন? এ কি আহ্লাদীর সেই কামনা, যাকে মেজদাদার ভালোবাসার পোশাকি নাম দিয়ে খিল এঁটে ঘরবন্দি করে প্রতিদিন মেজ বৌদিদি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে? যদি সত্যিই তাই হয়, তবে শব্দের রকমফেরে অর্থের তো কোনোরূপ পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। কেন তবে সকলে কেবল আহ্লাদীকেই কটুকথা বলে? বৌদিদিদের নয়!
সকলেই শান্ত শীতল স্বাভাবিক ভালোবাসায় অভ্যস্ত। আহ্লাদীর বেলায় জোটে গালমন্দ! বহুবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে আহ্লাদী। হারু কাকাই কি ওর অবুঝ বয়সের প্রথম প্রেমিক ছিল? যার কথা আজও মুখ ফুটে কাউকে বলা হয়নি। বালিকার মনের অতলান্তে নিমজ্জিত রয়েছে খড়ের গাদায় কাটানো সেই অপার্থিব সুখের রাত! কিন্তু আহ্লাদীর মনের ভিতর থেকে কোনও উত্তর আসেনি।
ভালোবাসার সঠিক মানুষ নির্বাচন করে তাকে উপলব্ধি করার আগে নিতান্ত অসময়ে যদি কোনও বালিকা নিজের দৈহিক চাহিদার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়, ক্রমে সেই চাহিদাকে নিতান্ত স্বাভাবিক জ্ঞানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে সেই অভ্যাসে এমন বাধা কেন? এত বিধিনিষেধ কেন? কেবল একটি চৌপায়া শয্যাসর্বস্ব ঘর, হাতে লাল সাদা বেড়ি আর কপালে রক্তিম ছাপের সঙ্গে দরজার খিল.... এই অপরিহার্য কয়েকটি বস্তুর অভাবে এত কোলাহল? এই সমস্ত বৌদিদিদের আছে, আহ্লাদীর নেই! তাই বুঝি এত আর্তনাদ...
চাপা আর্তনাদ সেদিন আহ্লাদীর গলা চিরে বেরিয়ে এসেছিল। যখন নিজের প্রেমিকের প্রকৃত স্বরূপ ও জানতে পেরেছিল। কিন্তু সেই আর্তনাদ গাঢ় শীৎকারে পরিবর্তিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রতিক্ষণে ভিন্নরূপে চমৎকৃত হতে চাওয়া নারীর কাছে কোনও চমকই দীর্ঘস্থায়ী নয়। আহ্লাদীর প্রেমিক যখন হোটেলের বাইরে বেরিয়ে একতলায় নেমে এসে টাকা গুনে তুলে দিচ্ছিল হোটেলের ম্যানেজারের হাতে, তখন দু'জন পুরুষের দেহতলে পিষ্ট আহ্লাদীর মৃদু আপত্তি প্রায় তলানিতে ঠেকেছিল। পরবর্তী কয়েকটা দিন সময়ের হিসেব রাখা আহ্লাদীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে নিজের হিসেবের অঙ্ক আহ্লাদীর প্রেমিকের থেকে কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিয়েছিল হোটেলের ম্যানেজার।
সেই কয়েকটি দিনে তিনজন পুরুষের সান্নিধ্যে আহ্লাদী জীবনের খাতায় এমন কিছু সুন্দর মুহূর্ত লিপিবদ্ধ করেছে, যার রেশ আজও কাটেনি। কিন্তু প্রথমদিন অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহল সহ আনন্দের মাত্রা অত্যধিক হলেও, শেষ পর্যন্ত আহ্লাদী মুক্তির জন্য আকুতি জানায়। কারণ আহ্লাদীর মনের তীব্র চাহিদার কাছে শরীর পরাজয় বরণ করে।
সমস্ত দিন পেরিয়ে সন্ধেরাত্রি হয়ে যাওয়ার পরও নারীলোলুপ তিন পুরুষের লালসা থেকে আহ্লাদী মুক্তি না পেয়ে অকথ্য অত্যাচারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রমণকার্যে ব্যস্ত পুরুষটি ভয় পেয়ে সরে এসে বলে, "মাগী মরে গেলি নাকি রে? এত দম ছিল তোর! কোথায় গেল সব?" দ্বিতীয় পুরুষ অশ্রাব্য ভাষায় প্রথম পুরুষটিকে ভূষিত করে বলে, "বলেছিলাম এবার ছেড়ে দে। আর নিতে পারছে না। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মরে গেলে ম্যানেজার ছেড়ে কথা বলবে না এই বলে দিলাম.... থানা-পুলিশের হ্যাপা..."
ম্যানেজারের কাছে চাবি জমা দিয়ে রঙিন পানীয়র সন্ধানে বেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল দু'জন পুরুষ। তারপর আহ্লাদীর তথাকথিত প্রেমিকেরও আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। বকেয়া টাকা পরিশোধ না করে হোটেল ছেড়ে পালানোর জন্য ম্যানেজার তখন অগ্নিশর্মা হয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। কোথাও কেউ নেই। তিনজন পুরুষ তো বটেই, এমনকি সঙ্গের মেয়েটিও যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে...
বাথরুমের দরজা খুলতেই একরাশ জমে থাকা বাতাস যেন নাকে এসে ঝাপটা মেরেছিল। বাতাসে মিশে থাকা উগ্র পানীয়র গন্ধে ম্যানেজারের মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় চাপা গোঙানি কানে যেতেই পিছু ফিরে ম্যানেজার আবিষ্কার করেছিল, ঘর শূন্য। ব্যবহৃত শয্যার ওপর চাদরটা অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। জনপ্রাণীর দেখা নেই। তবে কাঁদে কে! ঝুঁকে মেঝের ওপর মাথা ঠেকিয়ে খাটের তলায় দেখে ম্যানেজারের হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসতে চেয়েছিল। খাটের তলায় সম্পূর্ণ নগ্ন আহ্লাদীর হাত-পা-মুখ বাঁধা।
কিছুক্ষণ আগে আহ্লাদীর জ্ঞান ফিরেছে। ঘরে মানুষের আগমন বুঝেই মেঝেতে মাথা ঠুকে তীব্রভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ও। সেই চেষ্টার ফলস্বরূপ ওর চোখদুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ঝুঁকে আহ্লাদীকে টেনে বের করতে গিয়ে ম্যানেজার দেখে খাটের একটা পায়ার সঙ্গে আহ্লাদীর কোমরের দড়িটা শক্ত করে বাঁধা রয়েছে। ফলে ও এক ইঞ্চিও নড়তে বা পাশ ফিরে শুতে পারছে না।
দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় আহ্লাদীকে উদ্ধারের পর হাত-পায়ের দড়ি কেটে দেখা গিয়েছিল বাঁধার আগে ওর মুখের মধ্যে ঠেসে দেওয়া হয়েছিল কোনও এক পুরুষের ব্যবহৃত নিম্নাঙ্গের আবরণী। মুক্তি পেয়েই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছিল আহ্লাদী। তারপর ছিটকে সরে গিয়েছিল দেওয়ালের এককোণে। দু'হাতে নিজেকে আড়াল করে তীব্র আপত্তি জানিয়ে চিৎকার করে কেঁদে একনাগাড়ে বলেই চলেছিল, "না.... আর না... আর না! আমি আর পারছি না। আর না..."
বিছানা থেকে চাদর টেনে নামিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে নিজেকে আড়াল করতে সচেষ্ট আহ্লাদীকে ঢেকে ম্যানেজার বলে উঠেছিল, "এখানে তো প্রায়ই এমন মেয়েরা আসে। কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হয়, তুমি ভালো ঘরের মেয়ে বোন। এদের পাল্লায় তুমি পড়লে কী করে? এতজনের সঙ্গে তোমাকে একা দেখে আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় বাকি মেয়েদের মতো নিজের ইচ্ছেয়.... কিন্তু তারা তো এভাবে কান্নাকাটি করে না। যেভাবে মাথা উঁচু করে রুমে ঢোকে, সেভাবেই বেরিয়ে যায়.... দুজন রুমে থাকছিল, একজন বেরিয়ে যাচ্ছিল, তিনজন একসঙ্গে তোমার সঙ্গে ছিল, তখন তুমি চুপ করে ছিলে কেন? আরও আগে আমার কাছে আসোনি কেন? সাহায্যের জন্য চিৎকার করোনি কেন?"
জবাবদিহির মতো পরিস্থিতি তখন আহ্লাদীর ছিল না। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো ওর দৃষ্টি! আতঙ্কে কেঁদে ম্যানেজারের কাছ থেকে পালিয়ে ও যেন দেওয়ালের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছিল। কান্নাও প্রায় গোঙানিতে পরিণত হয়েছিল। উন্মাদিনীর মতো চিৎকার করে ম্যানেজারের গায়ে এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুষি লাথি ছুঁড়ে আহ্লাদী বলেছিল, " না না.... আর না..."
সেদিন অসহায় ম্যানেজার হোটেলের ঘর হাতড়ে আহ্লাদীর জামাকাপড় এনে ওর হাতে গুঁজে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে বলেছিল, "জামা পরো। আর এই টাকা রাখো। এক্ষুণি আমার হোটেল থেকে বেরিয়ে যাও। কোথা থেকে কী হয়ে যাবে, তারপর ব্যবসা তো যাবেই। জেলের ভাত খেতে হবে। এমনিতেই গত মাসে তিনবার পুলিশের রেডের হাত থেকে কপালজোরে বেঁচেছি। যেচে ওসবের মধ্যে কে পড়তে চায়! বেরোও আমার হোটেল থেকে..."
পরনের মলিন পোশাক, একটা কম্বল আর দুটো পাঁচশো টাকার নোট হাতের মুঠোয় নিয়ে হোটেলের ঘর ছেড়েছিল আহ্লাদী। সূর্যদেব তখন সবেমাত্র আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলছেন। কয়েক পা হেঁটে হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আহ্লাদী টলছিল। বিগত কয়েকদিন ধরে যে মাদকদ্রব্য তারা আহ্লাদীর রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাবে ওর দুটো পা তিরতির করে কাঁপছিল। চোখের সামনে দিয়ে একটা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সহায় সম্বলহীন আহ্লাদী হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে সাহায্য চাইতে পারেনি। ওর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় গাড়ির গতিবিধি মৃদু কম্পনরূপে ওর ঝাপসা দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছিল। হাত তুলতে গিয়ে আহ্লাদী বুঝতে পেরেছিল, দেহ অবশ হয়ে আসছে। কনুই থেকে বগল পর্যন্ত কোনও সাড় নেই। বাঁ হাতে অজানা ইঞ্জেকশনের কারণে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চিনচিনে ব্যাথা। তবুও হাত দেখিয়ে গাড়িটাকে দাঁড় করানোর অন্তিম প্রয়াস করেছিল আহ্লাদী। কিন্তু হঠাৎই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে দড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল আহ্লাদীর অবশ দেহ। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া দেহের নাসারন্ধ্র থেকে উষ্ণ বাতাস বেরিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল রাস্তার ধূলিকণা...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
Asadharan
উত্তরমুছুন