খিল
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
-ও বড়মা! সব কোথায় গেলে গো? সকাল হয়ে রোদ উঠে গেল, সাতটার ট্রেন বাঁশি দিয়ে ইস্টিশন ছেড়ে গেল, এখনো সব ঘুমুচ্ছ নাকি? রান্নাঘরের দোর বন্ধ কেন? আপিসবাবুর আপিস নেই আজ? এক কাপ চা কি পাব না? কাল যে নটে শাকের কথা বলেছিলে, আজ এনেছি। কই গো বড় বৌ? দেখেশুনে শাক নিয়ে ঘরে তোলো। এরপর বেলা বাড়লে পাড়া বেরিয়ে এলে তো আবার আমার নামে শাশুড়ির কান ভাঙিয়ে বলবে, লতাদি ঝাড়া বাছা শুকনো শাক গছিয়ে দিয়ে গেছে। সব পটের বিবিরা কোথায় গেলে গো? দেখার বেলা তো দেখে নেবে না, পরে যেন আবার আমার বদনাম ক'রোনা বাপু! এই লতার ক্ষেতের টাটকা কলা, মুলো, মোচা, কুমড়ো, পুঁই, শাকপাতা নেওয়ার জন্য সব বৌ-ঝিরা হত্যে দিয়ে বসে থাকে। আমি বাজার দিয়ে এলে তবে তাদের উনুনে হাঁড়ি-কড়াই চড়ে! বলি কী হল'টা কী? বাড়িশুদ্ধু সব আফিং টেনে নেশাভাঙ করে ঘুমুলে নাকি গো? কোথায় সব?
নাগের বাড়ির পুকুর থেকে গামছা ভিজিয়ে শাকের চুপড়ির ওপর ভিজে গামছাটা ঢাকা দিয়ে রাখে লতা।
নাগের বাড়ির সঙ্গে লতার সম্পর্ক বহুদিনের। লতার বাবার ছিল স্থানীয় বাজারে পাইকারি সবজির ব্যবসা। বাবা বেঁচে থাকাকালীন লতাদের খাওয়া-পরার অভাব মোটেও ছিল না। পাইকারি সবজি বিক্রেতা যেমন দু'হাতে কাঁচা পয়সা উপার্জন করেছে, তেমন স্ত্রী-পুত্রকন্যার জন্য মন খুলে ব্যয় করেছে। ফলস্বরূপ সবজির চুপড়ি নিয়ে লাইন পারাপার করার সময় রেলে কাটা পড়ে সে দেহ রাখার পর তার স্ত্রী-পুত্রকন্যা আবিষ্কার করে, ব্যবসায়ীর সঞ্চয় বলতে স্ত্রী-পুত্রকন্যার সুস্বাস্থ্য আর নিজস্ব জন্মভিটে; এছাড়া তেমন কিছুই নেই। লতা তখনো জংলী ফুলছাপ জামা ছেড়ে কাপড় পরেনি। সেই সময় থেকে সে দাদার সঙ্গে সংসারের বৈঠা শক্ত হাতে ধরেছিল। লতার কুসুমকোমল হাত কায়িক পরিশ্রমে কঠিন হলেও, কাঠিন্যের আড়ালে মেয়েমানুষের কোমল মন স্পর্শ করেছিল এক যুবক। কিন্তু লতার দাম্পত্যজীবন সুখের হয়নি। চেনা প্ৰেমিক স্বামী হওয়ার পর বর্ষার আকাশের মতো রঙ বদলে অচেনা হয়েছিল। মা গত হওয়ার পর এক কন্যাসহ দাদার ঘরে ফিরে আসে লতা।
কুলমর্যাদা কেবলমাত্র মেয়েমানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে, ঠিক যেমন থাকে সুগন্ধি চন্দন গাছের সঙ্গে বিষধর সাপ। কুলরক্ষার দায়ও কেবল মেয়েমানুষের ওপর বর্তায়। কিন্তু স্বামীগৃহ থেকে নিজ বাসভবনে ফিরে লতা প্রথম যে সত্য উপলব্ধি করেছিল তা হল; কুলমর্যাদা, কুলরক্ষার মতো কঠিন কঠিন শব্দ নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ানো মেয়েমানুষ নিজে যখন দু'কুল হারা হয়, তখন এই পৃথিবীতে তার মূল্য কানাকড়িও থাকে না।
একমাত্র মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজের ভাগের জমি-জিরেত বুঝে নিয়ে দাদার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে এক নতুন লড়াই শুরু করে লতা। এখন লতার ঘরের পাশে লকলক করে বেড়ে ওঠা কলাগাছ থেকে সুদৃশ্য মোচা ঝোলে। ঘরের লাগোয়া এক চিলতে জমিতে মহানন্দে মাথা দোলায় রকমারি শাকপাতা। চালের ওপর বাস করা পুঁইশাক, লাউ কিংবা কুমড়ো ফুল লতার দৈনন্দিন যুদ্ধের নিত্যসঙ্গী। মাচার উচ্ছে হলুদ হয়ে পচে ওঠে, বেগুনে পোকা লেগে যায়, কিন্তু লতার জেদ আর জীবনীশক্তির কাছে ওরা বারংবার হেরে যায়। সমস্ত দিন পরিশ্রমের পর লতা রাত জেগে কাগজের ওপর আঠার প্রলেপ দিয়ে তৈরি করে ঠোঙা। সকালে উঠে দড়ি দিয়ে ঠোঙা বেঁধে বাজারের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে মুদিখানার দোকানে বিক্রি করে আসে। ঘরের মেঝেতে, তক্তপোষের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ঠোঙাগুলো যখন লতা গুছিয়ে রাখে, তখন ওর মেয়ে এগিয়ে আসে মাকে সাহায্য করতে। প্রথম প্রথম মেয়ের হাত চেপে ধরত লতা। ওকে কিছুতেই এত কষ্ট করতে দেওয়া যাবে না। ও অনেকদূর পর্যন্ত পড়বে, অনেক বড় মানুষ হবে। কিন্তু মেয়ে রাত জেগে পড়াশোনা করার পর যখন মায়ের পরিশ্রমের ভাগীদার হতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে, লতার চোখের জল বাঁধ মানে না।
পুজোর সময় শাড়ি-চুড়িদারে সুতো আর চুমকির কাজ ছাড়াও শীতে কাঁথা সেলাই করে লতার অতিরিক্ত কিছু টাকা উপার্জন হয়। লতা বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলেছে। নাগের বাড়ির বড়বাবুকে লতা ভয়-ভক্তি করে আপিসবাবু বলেই ডাকে। সেই আপিসবাবু ব্যাঙ্কে মস্ত কাজ করে। সে কথা দিয়েছে ব্যাঙ্ক থেকে লোনের ব্যবস্থা করে দেবে। শাক-সবজির পাশাপাশি দুটো গরু কিনে দুধের ব্যবসা শুরু করতে পারলে খানিক সুখের মুখ দেখবে মাতা-কন্যা।
লতার মেয়ে দু'চোখে অপার বিস্ময় মেখে চেয়ে থাকে দেওয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়িটার দিকে। ওটা তার মামারবাড়ি। কিন্তু মামারবাড়ি থাকলেই যে মামারবাড়ির আবদার থাকবে, তাকে ছুঁয়ে এমন কথা মায়ের দাদা কোনোদিন দেয়নি। সে নিঝুম রাতে পরিশ্রান্ত লতার গলা জড়িয়ে তার যত আবদার জানিয়ে অভিযোগহীনতার চাদরে নিজেকে মুড়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
-বলি ও বড়মা?
-আসছি রে দাঁড়া! কোমরে ব্যাথা, গাঁটে ব্যাথা, হাঁটুতে ব্যাথা.... এই হাড় জিরজিরে গতরখানা নিয়ে রাতে চোখ বুজে ঘুমাই। সকালে চোখ মেলে বুঝতে পারি না খাটে শুয়ে আছি নাকি ঘাটে! আমার গতর তো লোহা দিয়ে তৈরি। আর ব্যাটার বৌদের গতর সব তুলোয় মোড়া বুঝলি লতা.... একটুতেই আহা-উহু! আর বৌ নিয়ে দোর দিয়ে ব্যাটাদের আদিখ্যেতা দেখলে মনে হয় অমন পিরিতের কপালে নুড়ো জ্বেলে দিই। ও মা গো! এতখানি বেলা হয়ে গেল, এখনো বাসি উঠোন রয়েছে! দ্যাখ দেখেছিস, একটা দিন চোখ মেলতে দেরি হয়েছে, আমার সংসারের অবস্থাটা একবার দ্যাখ লতা! কার হাতে সংসার দিয়ে আমি চোখ বুজব বল দেখি.... ও মা, তোমার সোনার সংসার আমি ধরে রাখতে পারলাম না। রাজ্যের সব লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষগুলো এসে ব্যাটার বৌ হয়ে আমার কপালে উঠে বসেছে। তোমার আশীর্বাদে ছেলেপুলে নাতি নাতনি নিয়ে দু'বেলা দুটো ভাত ফুটিয়ে খাচ্ছি। এতখানি বেলা হল, শিবের মাথায় এখনো জল পড়ল না। কোনও অমঙ্গল যেন না হয় মা! বৌগুলোর দোষ নিও না মা গো!
মাধবীলতার কন্ঠ নাগের বাড়ির প্রতিটি ঘরের দেওয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে ফিরে আসছিল। ঐতিহ্যবাহী এই নাগের বাড়ির কাহিনি স্বল্প কথায় লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। যতকাল মাধবীলতার শাশুড়ি সাত ভাই ও তিন বোনকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছিল, ততদিন নাগের বাড়ির দাপট পৌঁছত রেল স্টেশন পর্যন্ত। কিন্তু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার আগে মাধবীলতার দূরদর্শী শাশুড়ি যাবতীয় পৈতৃক সম্পত্তির বন্টন করে সাত ভাইয়ের ভাগের জমি, সংসার ও বসতবাড়ি ভিন্ন করে। মাধবীলতার শ্বশুরকুলের জ্ঞাতিরা পাড়ার আশেপাশে ছড়িয়ে থাকলেও এখনো সকলের মধ্যে যথেষ্ট সদ্ভাব বর্তমান।
মাধবীলতার বাড়ির মস্ত উঠোনের একপাশে স্থাপিত রয়েছে একটি শিবালয়। শিবের আশীর্বাদে তার সংসার ধনে ও জনে পরিপূর্ণ। ঘরে সর্বদা কমলা বাঁধা। ভাঁড়ার ঘরে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণার বাস।
মাধবীলতার জ্যেষ্ঠ পুত্র মৃগাঙ্ক নাগ সরকারি ব্যাঙ্কের একটি শাখায় চাকুরিরত। মা ষষ্ঠীর কৃপাদৃষ্টিতে তার স্ত্রী তৃণার কোল আলো করে দুটি বংশধর জন্ম নিয়েছে। তাদের আদরের নাম বাবাই ও টুবাই। উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরিজীবী পুরুষের স্ত্রী এবং গৃহের কর্ত্রী হওয়ার পর যখন দুটি পুত্রসন্তানের জননী হওয়ার সৌভাগ্য তৃণার হল, তখন তার মনের সহজেই আশ্রয় নিল গোপন দর্প।
দুই বংশধরের প্রতি মাধবীলতার প্রচ্ছন্ন স্নেহ ও ভালোবাসা আরও বৃদ্ধি পেল, যখন দ্বিতীয় পুত্র শশাঙ্ক নাগের স্ত্রী নিধির গর্ভে একটি কন্যাসন্তান জন্ম নিল। মেজ বৌয়ের প্রথম গর্ভে কন্যাসন্তান হওয়ায় মাধবীলতার মুখের হাসি খানিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল। যদিও একমাত্র কন্যা টুয়াকে নিয়ে শশাঙ্ক ও নিধির আনন্দের অন্ত ছিল না। তবে নাগের বাড়িতে নিধির অস্তিত্ব সর্বদাই তৃণার প্ৰভাব ও প্রতিপত্তির কাছে ম্লান হয়ে যেত। সংসার যাত্রার প্রতি পদে নিধি আবিষ্কার করত, স্বামীর অর্থবলের মাপকাঠিতে শ্বশুরগৃহে স্ত্রীর আদরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
দিনের বেশিরভাগ সময় সংসার, রান্নাঘর ও মাধবীলতার মনোরঞ্জনের জন্য কেটে যাওয়ার পর রাতে যখন তৃণার দুর্ব্যবহারে মনোবেদনা তীব্রতর হয়, তখন নিধি শশাঙ্কের বুকের ভিতর মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে। পাশে টুয়া পথ ভুলে পৌঁছে যায় ঘুমের দেশে।
শশাঙ্কের উপার্জন নিয়ে নিধির কোনও অভিযোগ না থাকলেও, যৌথ সংসারে নিজের অবস্থান নিয়ে নিধি অত্যন্ত মর্মাহত। বিবাহকালে শশাঙ্কর অভিভাবকস্বরূপ বরকর্তা হয়ে নিধির পিতৃগৃহে দাঁড়িয়ে মৃগাঙ্ক অনেক প্রকার কথা দিয়ে এসেছিল। সে বলেছিল, বাড়ির সকল পুরুষমানুষ চাকরি করতে বাইরে বেরিয়ে গেলে পৈতৃক জমিজমা ও চাষবাসের বড় ক্ষতি হয়। কর্মচারীর হাতে ছেড়ে দিলে পারিবারিক ব্যবসার অস্তিত্ব থাকে না। তাই মৃগাঙ্কর কথা মান্য করে শশাঙ্ক চাকরির পথে না হেঁটে পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। যেহেতু সে চাকুরিজীবনে প্রবেশ করেনি, সেই কারণে শশাঙ্ক, তার স্ত্রী এবং ভবিষ্যতে এক বা একাধিক সন্তানের যাবতীয় দায়িত্ব মৃগাঙ্ক ও সমগ্র নাগ পরিবার নেবে।
নিধির কন্যাদায়গ্রস্ত হত দরিদ্র পিতা যখন নাগের বাড়ির বিষয়-সম্পত্তির কথা শুনেছিল, তখন বুঝেছিল চাষের জমিই হল পরিবারের আয়ের মূল উৎস। চাকরি তো উপলক্ষ্য মাত্র। কেবল ক্ষার, লবণ ও কেরোসিন তেল ব্যতীত ঐ পরিবারের আর কোনও কিছু কেনার প্রয়োজন পড়ে না। সকলই চাষের জমিতে সোনার মতো ফলে। আর এই বিপুল ফলনের পিছনে রয়েছে মিতভাষী পুরুষ শশাঙ্কর কঠোর পরিশ্রম।
নাগের বাড়ির মতো এতবড় পরিবার থেকে নিধির জন্য সম্বন্ধ আসাটা ছিল চির অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষের পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্রকে স্পর্শ করার স্পর্ধার মতো অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য একটি বিষয়! তবে প্রথম দর্শনে নিধির বাবার শশাঙ্ককে বড় পছন্দ হয়েছিল। লাজুক, সদা হাস্যোজ্জ্বল পুরুষমানুষটিকে দরজার আড়াল থেকে একবার দেখে লজ্জায় পালিয়ে গিয়েছিল নিধি। তবে মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পিতার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। নিধির খাওয়া-পরা, নিশ্চিন্ত জীবন ও সুখের কথা চিন্তা করে নিধিকে শশাঙ্কর হাতে তুলে দিয়ে চিন্তামুক্ত হয়ে নিজের স্বর্গারোহণের পথ প্রশস্ত করে কন্যার পিতা।
সময়ের প্রভাবে সংসারের চাকা ঘোরে। ক্রমে নিধি বুঝতে পারে, সমস্ত ব্যবসার মূল মধ্যমণি মৃগাঙ্ক নিজে। শশাঙ্ক কেবলমাত্র বড়দা'র আজ্ঞাবহ দাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। সমস্ত মাস দেহের ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে রোদে পুড়ে হিমে ভিজে পরিশ্রম করার পর বড়দা'র কাছে ব্যবসার সমস্ত হিসেব দিয়ে তার হাত থেকে অবনত মস্তকে নিজের পারিশ্রমিকটুকু নিয়ে ঘরে ফিরে আসে শশাঙ্ক। উপার্জনের সমস্ত টাকা নিধির কাছে গচ্ছিত রেখে টুয়াকে বুকে আগলে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে মানুষটা। ঘুমন্ত ও পরিশ্রান্ত শশাঙ্কর মুখের দিকে চেয়ে, তার প্রতি মায়ায় জড়িয়ে নিধি ভুলে থাকে সকল অভিযোগ।
দরিদ্র পরিবারের কন্যার সঙ্গে ভাইয়ের বিবাহের সম্বন্ধ করার কারণটাও ক্রমে নিধির কাছে স্পষ্ট হয়। সংসারের জ্যেষ্ঠ পুত্রের মনের মধ্যে নিভৃতে বাস করে কর্তৃত্ব হারানোর ভয়। সংসারের সর্বেসর্বারূপে সকলের মাথার ওপর পূজ্য হয়ে বসে থাকতে চায় সে। শশাঙ্ক বড় দাদাকে দেবতার মতো পুজো করে। সম্মান ও শ্রদ্ধায় সদা আনত হয়ে থাকে। মৃগাঙ্কর অর্থবল ও মাধবীলতার নীরব প্ররোচনায় শশাঙ্ক কিংবা নিধির সঙ্গে যতখানি দুর্ব্যবহার করার স্পর্ধা তৃণা দেখাতে পারে, উত্তরার দিকে সে কিন্তু চোখ মেলেও চাইতে পারে না। তার প্রথম এবং অন্তিম কারণ একাধারে উত্তরার পিতা ও স্বামীর অর্থবল, অন্যধারে উচ্চশিক্ষিতা উত্তরা নিজেও চাকুরিরতা।
আপিসবাবু মৃগাঙ্ক বর্তমানে শশাঙ্ক, নিধি ও টুয়ার প্রতি দায়সারা কর্তব্য পালন করলেও, নাগের বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ পুত্র অঙ্কন নাগ ও তার স্ত্রী উত্তরা যখন বাড়িতে পদার্পণ করে, তখন উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে স্থূলকায় বেতনের বিনিময়ে শ্রম প্রদানকারী অঙ্কন নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সিঁথি যখন রাঙিয়ে দিতে চাইল ভালোবাসার সিঁদুর রঙে, মাধবীলতা এমন বেহায়া সম্পর্ককে সামাজিক মর্যাদা দিতে প্রবলভাবে অস্বীকার করে। বিয়ের উপযুক্ত ছেলের জন্য নিজে দেখেশুনে পাত্রী মনোনয়নের যে উচ্চাশা মায়ের মনে ছিল, তা পূর্বে দুই অগ্রজ পূরণ করেছে। অঙ্কনের ক্ষেত্রেও মাধবীলতার মনে এমনই আশা ছিল। কিন্তু উত্তরার প্রেমে অর্ধন্মাদ অঙ্কন পরিবারে এই প্রথম প্রেমের বিবাহকে কেন্দ্র করে নিজের মায়ের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতেও প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। মাতাপুত্রে যখন তীব্র কলহ শুরু হয়, নাগের বাড়ি ও পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে অবশেষে ছোট ভাইয়ের জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে কোমর বেঁধে বিয়ের আয়োজন করতে মধ্যস্থতায় নামে মৃগাঙ্ক এবং শশাঙ্ক। অতিকষ্টে মাধবীলতাকে রাজি করিয়ে বিবাহের পর অঙ্কন ও উত্তরাকে তারা পাঠিয়ে দেয় শহরে। কর্মসূত্রে শহরেই তাদের বাস। শহরের উপকণ্ঠে উত্তরার বাবার উপহার দেওয়া একটি সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে অঙ্কন ও উত্তরা নিজেদের ছন্দে স্থাপন করে ভালোবাসার নীড়।
বাড়ির ক্ষুদ্র-বৃহৎ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যখন মাধবীলতার জ্যেষ্ঠ কন্যা চূর্ণী হাজির হয়, তখন নামজাদা মোক্তার জামাইয়ের আদরের অন্ত থাকে না। বড় ননদের কোল আলো করে আসা প্রথম পুত্রসন্তান অশোকের আদর ঈর্ষণীয়। কিন্তু প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার কালে নাড়ির ষড়যন্ত্রে দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের ক্ষমতা চিরতরে হারায় চূর্ণী। অবশেষে একটি দরিদ্র কন্যাকে তার বাবা-মায়ের অনুমতিক্রমে দত্তক নিয়ে নিজ কন্যার মতো পালন করে সে। মাধবীলতার কাছে চূর্ণীর পালিতা মেয়েটির তীব্র আবদার ও আদর চোখ মেলে চেয়ে দেখে টুয়া। সকল উপহার ও আনন্দ কেন্দ্রিক যা কিছু সামগ্রী, সকলই সর্বাগ্রে প্রবেশ করে তৃণার ঘরে। কেবল উত্তরার কাছে নিরবচ্ছিন্ন প্রশ্রয় ও আদর পায় টুয়া।
মাধবীলতার কার্যকলাপ দেখে নিধি আপনমনে মৃদু হাসে। যে কনিষ্ঠ পুত্রবধূ এককালে মাধবীলতার চক্ষুশূল হয়েছিল; মূল্যবান উপহার, শাড়ি, অর্থ ও গয়নার ভারে সেই ক্ষণিকের অতিথি কুলবধূ এখন মাধবীলতার সর্বাধিক স্নেহের পাত্রী। উত্তরার হাত ধরে নিধি বুঝতে পারে, অর্থের প্রভাবে মাতৃস্নেহের রঙও কত সহজে বদলায়।
ঐতিহ্যবাহী গগনচুম্বী নাগের বাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ঘুণপোকার বাস, তার দংশনে ক্ষতবিক্ষত নিধি মৃতপ্রায়। সাদাসিধে আপনভোলা শশাঙ্ক সাংসরিক তত্ত্বে তেমন মনোযোগী নয়। চারবেলা স্ত্রী-কন্যাসহ পেট ভরে চারটি ভাত খেতে পেলেই সে নিশ্চিন্ত হয়ে বড়দাদার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত থাকে। সংসারের যুদ্ধক্ষেত্রে নিধির কথাও শশাঙ্কর কাছে মূল্যহীন। সকল বিষয়ে মৃগাঙ্কর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু নিধি বড় সহজেই উপলব্ধি করতে পারে, ভাসুর ঠাকুরের প্রকৃত পরিচালিকা হল দুইটি পুত্রসন্তানের জননী ঐ নারী। সে বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণে সাজিয়ে সর্বদা সকল ক্ষেত্রে নিজেকে উত্তম ও নিধিকে অধম প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর।
একদিকে সুউচ্চ বাড়ির বাইরে মৃগাঙ্কর যাবতীয় ফরমায়েশ দায়িত্ববান বেতনভুক্ত কর্মচারীর মতো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে শশাঙ্ক। অন্যদিকে গৃহমধ্যে নিধি হল তৃণার সর্বক্ষণের আজ্ঞাবহ দাসী। রামধনুর মতো সংসারে থেকে মানুষের নানান রঙ দেখে, নিজের অবহেলিত মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল চোখে চেপে প্রতিরাতে নিজের ঘরে প্রবেশ করে নিধি।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন