খিল
সাথী দাস
ষষ্ঠ পর্ব
-বুঝলি তো ছোট, আমি আগেই মাকে সাবধান করেছিলাম। বারবার বলেছিলাম যে মা, আপনার গুণবতী মেয়ের যা স্বভাব চরিত্র, ওর চোখের সামনে ঘরের টাকা-পয়সা, সোনাদানা এত ছড়িয়ে রাখবেন না। একটু আড়ালে রাখবেন। তখন উনি ভাবলেন আমি বুঝি ওঁর মেয়েকে চোর বলছি! সে কত কথা আমাকে শুনিয়ে দিলেন! এখন হল তো? মেয়ে সব ঝেঁটিয়ে নিয়ে পালাল তো?
-কেন? থাকবে কেন? এখনই তো স্পষ্ট কথা বলার সময়। এ বাড়ির লোকের খালি টাকাই আছে রে ছোট। ঘাড়ের ওপর সাজিয়ে রাখা ঐ ঘট পুরো নিরেট। ওতে কোনও বুদ্ধি নেই। এমনিতেই ও মেয়ে একটু ব্যাটাছেলে চাটা। জানিসই তো কেমন ছোঁকছোঁকানি আছে। তার ওপর যদি বাইরের কেউ একবার বুঝে যায় ও এই বাড়ির মেয়ে, বুঝতে পারছিস তো কী হতে পারে? আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, ঠিক তাই হয়েছে। আমি জানতাম, একদিন এমন সেয়ানা লোকের হাতে পড়বে, সে জিনিসের লোভে ঐ মেয়েকে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে যাবে! জিনিস তো যাবেই যাবে, সেই সঙ্গে আমাদের মেয়েও যাবে। আইবুড়ো মেয়েদের চোখ খুলে দিতে নেই। ঘরের ভিতরের এতকিছু দেখাতে নেই। তারা ভালো মনে বাইরে গিয়ে গল্প করবে। আমার বাড়ির লোকের এই আছে, ঐ আছে! কিন্তু যে শুনবে, তার ধান্দা তো অন্য কিছু হতেও পারে। ঠিক লোকের হাতে পড়লে যেমন আমাদের মেয়ে ভালো থাকবে, সোনাদানা সম্পত্তি দশগুণ বাড়বে, ভুল লোকের হাতে পড়লে সব একসঙ্গে শেষ হবে। মাকে ঠিক এই কথাগুলোই একদিন বলেছিলাম। তখন তাঁর গায়ে ফোস্কা পড়েছিল। এখন হল তো? সেই আমার কথাই ফলল তো? আমি তোর দাদাভাইয়ের মুখের দিকে চাইতে পারছি না জানিস ছোট! ঘরে-বাইরে লোকটা আর কত করবে বল তো? পুরো সংসারটাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে। অফিস সামলে ঐ কুলাঙ্গার মেয়ের জন্য থানা-পুলিশ করে লোকটা একেবারে হাঁপিয়ে গেল গো...
তৃণার কন্ঠস্বর বড় কর্কশ হলেও, তার বলা একটা শব্দও উত্তরা অস্বীকার করতে পারে না। মাধবীলতা ঘরের ভিতর মুখ লুকিয়েছে। উত্তরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অঙ্কনকে একটা ফোন করল।
-কী হল ওদিকে? আর কতক্ষণ?
-এখনো থানায় আছি। বসে আছে সামনে।
-সুস্থ আছে তো?
-জানিনা, বেঁচে আছে দেখছি। তবে দেখে ঠিক ভালো লাগছে না। রাখছি। বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে ফোন করছি।
সেই দিনের কথা আজও আহ্লাদীর স্পষ্ট মনে আছে। গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে বেঞ্চের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে ও বসেছিল। ওর থেকে কয়েক হাত দূরে পুলিশের সামনে বসেছিল মৃগাঙ্ক আর শশাঙ্ক। কার সঙ্গে যেন কথা বলে কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে মৃগাঙ্ক আর শশাঙ্কর পাশের চেয়ারে বসেছিল অঙ্কন। পুলিশ অফিসার মৃগাঙ্কর স্বাক্ষরিত ফাইলে চোখ বুলিয়ে বলেছিলেন,
-ঠিক আছে, আপনারা বোনকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে পরেরবার থেকে বোনকে একটু সামলে চলতে বলবেন। সব জায়গায় পুলিশের গাড়ির সামনেই যে বোন জ্ঞান হারাবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তা যারা আপনার বোনের এমন অবস্থা করল, তাদের তো টিকিও পাওয়া যায়নি। আপনার বোনও মুখ খুলছে না। আপনি তাদের বিরুদ্ধে কোনও...
হাতজোড় করে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল মৃগাঙ্ক।
-না স্যার! দয়া করুন। মেয়েটার একটা ভবিষ্যৎ আছে। এ নিয়ে আমরা আর জল ঘোলা করতে চাই না। পাঁক নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে, নিজেদের গায়েও কাদা ছিটবে। সেটা কাম্য নয়। গ্রামে আমাদের মান-সম্মান আছে। ঝামেলায় জড়িয়ে বোনের এসব কেস নিয়ে নাগের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়ালে আমাদের যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট আছে, সেটাও আর থাকবে না। এই ক'দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে ওকে পাগলের মতো খুঁজেছি। যেখান থেকে কোনও খবর পেয়েছি, সেখানেই ছুটেছি। আমার এই ভাই অফিস কামাই করে শহর থেকে ছুটে এসেছে বোনের জন্য।নিজের কাজকর্ম ফেলে সেদিন রাত থেকে বৌ নিয়ে এখানেই পড়ে রয়েছে। আমরা আমাদের বোনকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পেয়ে গেছি, এই অনেক স্যার। আর কিচ্ছু চাই না।
-তাই? অক্ষত অবস্থায় পেয়ে গেছেন?
ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ এঁকে পুলিশ অফিসার গলা নামিয়ে বলেছিলেন,
-শুনলাম এলাকায় আপনাদের বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার আপনাদেরই। টাকা দিয়ে বোনের সব ক্ষত ঢেকে অক্ষত সাজিয়ে পার করে দেবেন নাকি! তা ভালোই! টাকা থাকলে ভূতের বাবার শ্রাদ্ধ হয়ে যায়, আর নিজের অক্ষত বোনের বিয়ে হবে না? অসম্ভবকে যদি সম্ভবই না করতে পারে, তবে তো টাকার ওপর থেকে মানুষের ভরসা উঠে যাবে। চাকরি করছি বহু বছর হয়ে গেল মশাই। ট্রান্সফার হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে এসব নোংরামি ঘেঁটে চুল পাকিয়ে ফেললাম। কম তো আর দেখলাম না। যত নোংরামি এই উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মধ্যেই। মান-সম্মান খোয়া গেলেও আপনাদের মতো মানুষের টাকায় সব ঢেকে যায়। নিম্নবিত্তদের মধ্যে মান-সম্মান নিয়ে এত মাথাব্যাথা নেই। পেটের ভাত আর টাকার জন্য তারা সব করতে পারে। মরে কেবল মধ্যবিত্তরাই। এদিকে ঘরে টাকা সীমিত, ওদিকে মান সম্মান গেলে টাকা দিয়ে ঢাকতে পারবে না। আপনারাই বেশ আছেন। গোলাভর্তি ধান, সিন্দুক ভর্তি টাকা, আর ঘরে অক্ষত বোন...
অঙ্কন চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। মৃগাঙ্কর মাথা হেঁট হয়ে চোখ ভেঙে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। বুকে জ্বলছিল অপমানের লেলিহান শিখা। কেবল শশাঙ্ক বলেছিল,
-স্যার, আমরা আসছি তবে!
পায়ে পায়ে দরজার কাছে পৌঁছেছিল আহ্লাদীর তিন দাদা। আহ্লাদীর কম্বলে জড়ানো দুর্বল দেহটাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বেঞ্চের ওপর থেকে টেনে দাঁড় করিয়েছিল অঙ্কন। বোনের ক্লান্ত মুখের দিকে চেয়ে মৃগাঙ্কর মাথায় যেন রক্ত উঠে গিয়েছিল। নিজের চূড়ান্ত অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে, সেদিন মৃগাঙ্ক জনসমক্ষে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল আহ্লাদীর গালে। মাথা ঘুরে অঙ্কনের বুকের ওপর পড়ে গিয়েছিল আহ্লাদী। মৃগাঙ্ককে টেনে ধরে শশাঙ্ক চাপা গলায় বলে উঠেছিল,
-দাদা! কী করছ তুমি?
-এই! ওখানে হচ্ছে'টা কী? এটা কি আপনার বাড়ির উঠোন পেয়েছেন নাকি মশাই? যা ইচ্ছে তাই করছেন! বোনকে শাসন দেখাতে হলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শাসন করুন। আপনার রাজত্ব আপনার নিজের রাজ্যেই চলবে। তার বাইরে নয়। এটা পুলিশ স্টেশন, সেটা মাথায় রাখবেন। বেরোন এখান থেকে...
পুলিশ অফিসারের কাছে যারপরনাই অসম্মানিত হয়ে আহ্লাদীকে টানতে টানতে গাড়িতে বসিয়ে তিরের বেগে বাড়ির উদ্দেশে ছুটেছিল মৃগাঙ্ক। সারাটা রাস্তা গাড়ির মধ্যে কারও মুখে কোনও কথা ছিল না।
নাগের বাড়ির সামনে গাড়ি থামার পর এক অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছিল আহ্লাদী। গ্রামের অজস্র কৌতূহলী মুখ প্রতিমা দর্শনের মতো ওকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিল গাড়ির সামনে। পথের ধুলো গায়ে মেখে দু-একটা শিশু গাড়ির পিছনে দৌড়ে এসেছিল অনেকটা পথ। তারা অবাক দৃষ্টিতে আহ্লাদীর দিকে চেয়েছিল। অঙ্কনকে ঢুকতে দেখে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল উত্তরা।
আহ্লাদীসহ মৃগাঙ্ক বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই তৃণা উচ্চৈঃস্বরে বলেছিল, "এসে গেছ তোমরা? ও মা! হুড়মুড়িয়ে একদম বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লে যে! রাজ্যজয় করে আসা বোনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলে, আমাকে বরণডালা সাজানোর সময়টাও দিলে না?"
বিগত কয়েকদিন একনাগাড়ে জল ঝরিয়ে মাধবীলতার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শয্যা ত্যাগ করে মাধবীলতা আহ্লাদীর দিকে যেতে চাইলে মৃগাঙ্ক মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন স্পষ্টভাবে বলেছিল, "মা তোমার মনে আছে বড় ঠাকুর্দার কথা? যে নিজে দারোগা ছিল। গ্রামের লোক যার নাম শুনে ভয়ে কাঁপত! আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসত কেবল চা খেতে, বড় ঠাকুর্দার সঙ্গে গল্প করতে। সেই বাড়ির বংশধরকে আজ থানায় দাঁড়িয়ে অপমানিত হতে হয়েছে তোমার এই মেয়ের জন্য। থানা-পুলিশের ঝামেলায় পড়েছি শুনে সময়কালে তোমার মোক্তার জামাই বদনামের ভয়ে মুখ লুকিয়ে সরে গেল। ফেঁসে গেলাম আমি একা। আমার মান-সম্মান সব শেষ হয়ে গেছে মা। এই প্রথম, আর এই যেন শেষ হয়! ওকে একটা কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিও। আজকের পর থেকে আমাকে না জানিয়ে এই বাড়ির বাইরে ও পা রাখবে না। যদি বাইরে বেরোয়, ওর দুটো পা আমি ভেঙে পঙ্গু করে ঘরে বসিয়ে রেখে দেব। এরপরেও যদি ও নিজেকে না বদলায়, তুমি যদি নিজের মেয়েকে সামলাতে না পারো, তবে আমাকে জানিও। আমি বুঝে যাব, সভ্য সমাজে ভদ্র মানুষের মধ্যে ভদ্রভাবে থাকার মানুষ তোমার মেয়ে নয়। যেখানে ওর মতো মেয়েকে মানায়, সেখানে আমি নিজে ওকে নামিয়ে রেখে আসব.... তখন যত ইচ্ছে..."
মৃগাঙ্কর কথা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শশাঙ্কর হাত ছাড়িয়ে ওর পাশ দিয়ে কম্বলে আবৃত একটা নারীদেহ জীবন্মৃত অবস্থায় হেঁটে গিয়েছিল মাধবীলতার ঘরের দিকে। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলের মুখের ওপর ঘরের দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল আহ্লাদীর দেহ।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আহ্লাদী একা শুয়ে রয়েছে। এত কুকথা শুনেও ওর মন উতলা হয় না। চোখে জল আসে না। ও শেষ কেঁদেছিল হারু কাকার সঙ্গে প্রথম সঙ্গমের সময়ে। সে যে কী অস্বাভাবিক ভীতি, তা প্রকাশ করা আজ আর সম্ভব নয়।
ঘটনাটা ঘটে টুবাইয়ের জন্মদিনের সন্ধেয়। হারু কাকাকে দেখে কোনোদিন ভয় পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি আহ্লাদী। সে ডাকলে বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গেছে। কিন্তু সেদিন তার স্পর্শে মনে হয়েছিল, কোথাও যেন কিছু একটা অসঙ্গতি রয়েছে। যা হওয়া উচিত নয়, সেটাই ওর সঙ্গে হচ্ছে। আহ্লাদী প্রথমে ভয়ে কেঁদে উঠলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ওর বুকের মধ্যে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সকল অনুভূতি। আহ্লাদীর উদ্দেশে তৃণা বরাবরই একটা কথা বলে। যে নারীর লজ্জা ঘৃণা ভয়, এই তিন থেকেও নয়, তার জন্য সংসারে কোনও জায়গা বরাদ্দ থাকে না.... আহ্লাদী এই তিনটি অনুভূতি কৌমার্যের সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছে সেই কবেই। সেদিন বাড়িভর্তি আমন্ত্রিত মানুষের চোখ এড়িয়ে ছাদে উঠে এসেছিল ও। উরু বেয়ে গড়িয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল টাটকা রক্ত। রক্তের আঁশটে গন্ধ দেহে মেখে হাঁটু মুড়ে আহ্লাদী দীর্ঘক্ষণ একা বসেছিল ছাদে। জনস্রোত সারি বেঁধে ভোজের উদ্দেশে বাড়ির একতলা থেকে সুসজ্জিত মন্ডপ পর্যন্ত এগিয়ে চলেছিল। কত আলো, কত আনন্দ! তখন আহ্লাদী শারীরিক যন্ত্রণার পথ অতিক্রম করে ভাবছিল, এক খাদকের ক্ষুধা নিবারণ করে ওর নিজের বুকের ভিতরে জন্ম নিয়েছে অযাচিত অগ্নিতৃষ্ণা। যা নিবারণ করার ইচ্ছেয় আবারও সেই মুহূর্তে আগুনে ঝাঁপ দিতে মন চাইছিল। নিজেকে সেঁকে নিতে ইচ্ছে করছিল হারু কাকার দেহের উত্তাপে।
-পিসি, ও সোনাপিসি.... দরজাটা একবার খুলবে না? তুমি দরজা না খুললে আমি কাঁদব। পড়তেও বসব না। সোনাপিসি...
আহ্লাদীর চিন্তার ঘোর কেটে গেল। দরজার ওপারে টুয়ার কন্ঠ। গোটা নাগের বাড়িতে এই একটা মানুষ আহ্লাদীর বড় আপন। সময়ে-অসময়ে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে আহ্লাদীর বুকের ওপর। কোনও নিষেধ আজ পর্যন্ত আহ্লাদীর কাছে আসা থেকে ওকে বিরত করতে পারেনি। আহ্লাদী রাগ করে না খেলে নিজের ভাগের খাবারটাও লুকিয়ে পিসিকে খাইয়ে দেয় টুয়া। একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দেওয়াল হাতড়ে সুইচটা টিপে দিল আহ্লাদী। অন্ধকার জঠর ছিঁড়ে আশার আলোয় উদ্ভাসিত হল ঘরের চতুর্দিক। একটানে দরজার আগল নামিয়ে আহ্লাদী দেখল টুয়া মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার বাইরে।
-খাবে না পিসি? মা নারকেল আর চিনি দিয়ে মুড়ি মেখে দিয়েছে।
-সারাদিন আসিসনি কেন রে তুই? স্কুলে গিয়েছিলি?
-হ্যাঁ...
টুয়াকে কোলে জড়িয়ে আদরে ভরিয়ে দিল আহ্লাদী। ছাদে আহ্লাদীর কোলে বসে মুড়ির বাটিতে হাত ডুবিয়ে দিয়ে টুয়া বলল,
-ও পিসি, আমি বড় হয়ে গেলে তোমাকে একটা নতুন বাড়িতে নিয়ে যাব। ওখানে কেউ তোমাকে মারবে না। আমরা ঠামকেও নিয়ে যাব না। শুধু তুমি আর আমি থাকব।
-আর তোর মা?
-আচ্ছা মাকেও নিয়ে যাব।
-আর বাবা?
-বাবাকে নেব না।
-কেন রে? বাবা আবার কী করল?
-বাবা পচা। রাতে আমি মায়ের পাশে ঘুমাই। বাবা আমাকে বিছানার একপাশে রেখে মায়ের কাছে চলে যায়। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনোদিনও মাকে কাছে পাই না। শুধু তুমি, আমি আর মা যাব। তোমাদের দু'জনের মাঝে আমি ঘুমাব। বাবা বাদ।
চুপ করে টুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আহ্লাদী। এমন সময়গুলোতে নিজেকে খুব একা লাগে। কেমন একটা বন্য প্রবৃত্তি মনের মধ্যে বিষধর সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে। চূড়ান্ত হিংসে বাসা বাধে দেহের গোপনে। টুয়া বলল,
-ও পিসি, সেই ডাকাত আর বড় বাবার গল্পটা বলো না!
-তোর পড়া নেই? এখন পিসির কোলে বসে গল্প শুনবি? মা বকবে তো!
-তুমি বলো না.... একটু শুনেই চলে যাব।
আহ্লাদীর কোলে মাথা রেখে ওর খোলা চুল নিয়ে খেলা করতে শুরু করল টুয়া। অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে আহ্লাদী বলতে শুরু করল নিজের পূর্বপুরুষের গল্প।
-তখন এ বাড়ি ছিল না। আমাদের পুরনো বাড়িতে ছিল সে। তাকে আমিও চোখে দেখিনি। শুধু গল্প শুনেছি। দেখেছে তোর বড় জ্যেঠু। থানার মস্তবড় দারোগা ছিল সে। তার ভয়ে গোটা গ্রাম কাঁপত। কিন্তু আইন যেমন আছে, আইনের রক্ষক আছে, তেমন আইনের ফাঁকও আছে। সেই ফাঁকে ছিল রঘু ডাকাতের বাস। তার দাপটে অস্থির হয়ে যেত আশেপাশের গ্রাম। এদিকে আলোয় যেমন তোর বড় বাবার রাজত্ব ছিল, অন্ধকারে ছিল রঘুডাকাতের রাজত্ব। কিন্তু নাগের বাড়ির দিকে দৃষ্টি দেওয়ার ক্ষমতা তার যে কোনোদিনও হবে না, এই সত্যি গ্রামের সবাই জানত। কিন্তু সমস্ত সত্যিকে মিথ্যে করে এক মধ্যরাতে সেই নাগের বাড়িতে হানা দিল দুঃসাহসী রঘু ডাকাত। একতলার ঘরে তোর বড় বাবা তখন একা ঘুমোত। সে টের পেয়েছিল পিছনের দরজা দিয়ে একে একে ঘরের জিনিস বের করে উঠোনে রাখা হচ্ছে। কিন্তু তবুও সে উপুড় হয়ে চুপ করে বিছানায় পড়েছিল। কারণ ডাকাতের দল ছিল সংখ্যায় বেশি। শেষে যখন কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে রঘু ডাকাত নিজে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন দারোগার রক্ত সেই পরাজয় সহ্য করতে পারল না। মাথা তুলে বলে বসল, রঘু, আজকে যাচ্ছিস যা! কাল এর শোধ তুলব। এটা শুনেই ডাকাত সর্দার ঘুরে এসে ঘরের ভিতর পা রাখল...
সহস্রবার শুনেও এই ডাকাতের গল্প যেন টুয়ার কাছে পুরনো হয় না। ছাদের কোণে জমাট বাঁধা ঝিমঝিম অন্ধকার রাতে রহস্যময়ী আলোর ছটা গায়ে মেখে পিসির কোলের মধ্যে ঢুকে তার অতিনাটকীয় কণ্ঠে এই একই গল্প বারংবার শুনেও টুয়ার মন ভরে না। প্রতিবারই এক নতুন শিহরণ খেলে যায় দেহের রোমকূপে। আহ্লাদীকে জড়িয়ে ধরে টুয়া বলল,
-কুপির আলোয় ঘরের দেওয়ালে ডাকাতের ছায়া পড়েছিল সোনাপিসি?
-পড়েছিল তো! ইয়া লম্বা চওড়া সে। পরনে লাল জামা, কপালে রক্ত তিলক। মেঘের গর্জনের মতো গলার স্বর, তেল চকচকে চেহারা। বড় বড় লাল চোখ...
-তারপর?
-আমাদের এই নাগের বাড়িতে আগে কালীপুজোয় বলি হতো। সেই বলির জন্য ধারালো রামদা রাখা থাকত বড় বাবার ঘরের দেওয়ালের একটা খাপের ভিতর। যেই না তোর বড় বাবা ঐ কথাটা বলেছে, দেওয়ালের খাপ থেকে রামদা টেনে বের করে বড় বাবার পিঠের ওপর একটা কোপ বসিয়ে চড়চড় করে কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত টেনে দিল রঘু ডাকাত। বড় বাবা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল। আর ডাকাতের দলও উঠোনে জড়ো করে রাখা সব জিনিসপত্তর ফেলে পালিয়ে গেল। নাগের বাড়ি থেকে একটা সুতোও তারা সে রাতে বের করে নিয়ে যেতে পারল না।
-তারপর বড় বাবার কী হল পিসি? সেলাইয়ের গল্পটা বলো না...
-কী আবার হবে? এক বছর ধরে পিঠের চিকিৎসা চলল। দগদগে ঘা হয়ে পিঠ প্রায় পচে গিয়েছিল। দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে অনেক কষ্টে সেই ঘা সেরেছে। আমি তোর ঠামের মুখে শুনেছি, বড় বাবা কোনোদিন কারও সামনে গায়ের জামা খুলত না। বাচ্চারা ঐ পিঠ দেখলে নাকি ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে দিত! সেলাই দেখলে মনে হবে কয়েকটা আস্ত তেঁতুলবিছে শুয়ে রয়েছে গোটা পিঠ জুড়ে।
-তারপর ডাকাত সর্দারের কী হল পিসি?
-এরপর কি আর সে এ বাড়িতে আসার সাহস পায়? সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন নাগের বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনও ডাকাত পা রাখেনি। এ বাড়ির সম্পত্তি নষ্ট করে কেউ বেরোতে পারবে না। সেটা সবাই জানে।
-তবে যে বম্মা বলে, তুমি বাড়ির মেয়ে হয়ে এ বাড়ির সম্মান নষ্ট করে দিলে! সবাই তোমাকে এত খারাপ কথা বলে কেন সোনাপিসি? এসব শুনতে আমার একটুও ভালো লাগে না।
-তুই বলিস না তো সোনা?
-কোনোদিন না!
-হ্যাঁ রে টুয়া, সবার মতো তুইও আমাকে ছেড়ে যাবি না তো?
-কক্ষনো না পিসি।
-ব্যস! ব্যস! আমার আর কিছু চাই না। তুই এমনই ছোট থাক টুয়া। একদম বড় হবি না মা। বড় হলে নিজেকে আর চিনতে পারবি না। বড় হওয়া খুব খারাপ জানিস তো! ছোটবেলার খুব মজা রে সোনা। ছোট থাকতে মানুষ যা চায়, তাই পায়। এই দ্যাখ, ছোট থাকতে সবাই বড় হতে চায়। তারপর একদিন বড় হয়েও যায়। কিন্তু একবার বড় হয়ে যাওয়ার পর আর কিছুতেই ছোট হওয়া যায় না রে.... তুই এই ছোট্ট টুয়াই থাক। আমার মতো অসময়ে বড় হয়ে যাস না। বড় হবি না তো মা? আমাকে ছুঁয়ে বল!
-আমি তোমার কোলেই থাকব পিসি। কোনোদিন বড় হবো না। কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না, তুমি ঠিক দেখে নিও...
অন্ধকারে মিশে নিষ্পাপ টুয়ার মধ্যে নিজের নিষ্কলঙ্ক শৈশব হাতড়ে বেড়াতে লাগল আহ্লাদী। ওর বুকের মধ্যে বাষ্প জমে শুকিয়ে গেল। অশ্রু হয়ে চোখ পর্যন্ত পৌঁছল না। আহ্লাদী টুয়াকে আরও শক্ত করে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরল।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন