Buy Sathi a coffee
Golper Sathi / গল্পের সাথী / Bengali Story Blog / Bangla Golpo: খিল তৃতীয় পর্ব

অনুসরণকারী

শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩

খিল তৃতীয় পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
তৃতীয় পর্ব




নাগ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠা কন্যার নাম আহ্লাদী। মৃগাঙ্কর বিবাহের বেশ কয়েক বছর পূর্বে মাধবীলতার অজান্তে তার গর্ভে আশ্রয় নিয়েছিল এই কন্যাভ্রূণ। নারীদেহ থেকে ঋতুচক্র বিদায়গ্রহণের প্রাক্কালে যে স্বাভাবিক পরিবর্তন ও অনিয়ম শুরু হয়, সেই অনিয়মের মধ্যে নিদারুণ অসাবধানতায় ঘটে গিয়েছিল সেই অঘটন। নিজের ও স্বামীর মান-সম্মান রক্ষার্থে সকলের অলক্ষ্যে তাকে গর্ভ থেকে দূর করতে চেয়েছিল মাধবীলতা। কিন্তু অত্যধিক বয়সে গর্ভধারণের জন্য ও নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণে সেই সময় ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত সম্ভব হয়নি। মাধবীলতার পড়ন্ত যৌবনে এমন একটি সংবাদ বিবাহযোগ্য মৃগাঙ্কর কাছে অত্যন্ত বিরক্তির কারণ হয়েছিল। দীর্ঘদিন মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছিল সে। শশাঙ্ক ভাবলেশহীন। এই পৃথিবীতে কারও জীবনের কোনোপ্রকার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার মতো মানসিক দৃঢ়তা ঈশ্বর তাকে প্রদান করেননি। মেধাবী অঙ্কন পড়াশোনার কারণে বহুদিন আগে বাড়ির চৌকাঠ অতিক্রম করে চলে গেছে হোস্টেলে। সে বাড়ি ফেরে অতিথির মতো। নিজস্ব মতপ্রকাশের কোনও প্রয়োজনবোধ সে করে না। তিন পুত্রসন্তানের পর একটি কন্যাসন্তান চূর্ণী। পুরুষসর্বস্ব সংসারে তার মতামতের ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য। সুতরাং অজস্র মানসিক টানাপোড়েন অতিক্রম করে মৃত্যুর দরজায় পা রেখে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে এই কন্যার জন্ম দিয়েছিল মাধবীলতা।
বিনা আমন্ত্রণে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া মেয়েটির পরিবার প্রদত্ত প্রকৃত নাম আজ আর কেউ মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে সে আহ্লাদী নামে পরিচিত। শূন্য বিছানা দেখে মাধবীলতার বুক ভয়ে কেঁপে উঠল।
স্বামী অমৃতলোকে পাড়ি দেওয়ার পর মাধবীলতা আহ্লাদীকে বুকে করে মানুষ করেছে। মৃগাঙ্ক তাকে জন্মের পর থেকে একেবারেই পছন্দ করে না, এ সংবাদ মাধবীলতার অজানা নয়। সর্বোপরি যখন একটি শিশুকন্যার উপস্থিতির কারণে মৃগাঙ্কর জন্য আসা একের পর এক সম্বন্ধ ভেঙে যেতে শুরু করল, তখন মাধবীলতার সঙ্গে সামান্যতম কথাবার্তাও বন্ধ করে দিয়েছিল সে। বেশ কিছু বিবাহযোগ্যা সুন্দরী পাত্রীর পরিবার থেকে তুমুল আপত্তির পর তৃণা এ বাড়িতে বধূরূপে প্রবেশ করে। তৃণার বাড়ি থেকে প্রথমে মৃদু আপত্তি জানালেও, পরবর্তীতে নাগ পরিবারের আভিজাত্য ও রাজ ঐশ্বর্যর কাছে মাথা নত করেছিল কন্যাপক্ষ। এছাড়া চাকুরিজীবি পাত্র মৃগাঙ্ককে তারা হাতছাড়া করতে চায়নি। তবে মৃগাঙ্কর কাছে পূর্বেই তৃণা নিজের চাহিদা প্রকাশ করে ঘোরতর আপত্তি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল। বিবাহ পরবর্তী জীবনে নিজের গর্ভধারণের মতো সুন্দর মুহূর্তে সে মাধবীলতার গর্ভের অনাকাঙ্খিত জঞ্জালের দায়িত্ব কিছুতেই নিতে পারবে না। বিবাহের বহু পূর্ব থেকেই তৃণার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে মৃগাঙ্ক। এক্ষেত্রে আহ্লাদীর ওপর বিরক্তির কারণে মৃগাঙ্ক সহজেই এই প্রস্তাবে সম্মত হয়। বড়দা ও বড় বৌদির চক্ষুশূল হয়ে খেলা করতে করতে আহ্লাদী খানিক অনাদরেই বেড়ে উঠেছে নাগের বাড়ির উঠোনের এক কোণে।
মেয়েকে বাড়ির ভিতর কোথাও খুঁজে না পেয়ে ভয়ে মাধবীলতার পা কাঁপতে শুরু করল। সেদিনও এমনই এক সকাল ছিল। আগের দিন রাতে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে নিরুদ্দেশ হয়েছিল আহ্লাদী। এই মেয়ের ওপর মাধবীলতা ভরসা রাখতে পারে না। পাশাপাশি নিজের বড় ছেলে যে অত্যন্ত রগচটা ও বদমেজাজি, সেই সংবাদ মাধবীলতা বিলক্ষণ জানে। জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিতে হাঁড়ির সঙ্গে সরার ন্যায় তৃণাও সিদ্ধহস্ত। মাধবীলতার যত জোর মেজ ছেলে এবং মেজ বৌমার ওপর চললেও, বড় ছেলে ও বড় বৌকে অত্যন্ত সমীহ করে চলে সে। নিতান্তই ভয়ে এই ভক্তির প্রকাশ, তা মাধবীলতা নিজেও অস্বীকার করতে পারে না।
এই বাড়িতে আহ্লাদীর মাত্র একজনই শুভাকাঙ্খী আছে। নিজের ঘর ছেড়ে ধীর পায়ে তার ঘরের দিকে পা বাড়াল মাধবীলতা। টুয়া সুর করে পড়া মুখস্ত করছিল। হঠাৎ ঠামকে নিজেদের ঘরের সামনে দেখে পড়া বন্ধ করে সে দরজার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। ঘরের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে ভিজে চুল আঁচড়ে সমান করছিল শশাঙ্ক। দোকানে যাওয়ার আগে একবার মাঠে ঘুরে যেতে হবে। মাধবীলতাকে দেখে চিরুনি ফেলে ছুটে এসে শশাঙ্ক বলল,
-মা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? ভিতরে এসো।
শশাঙ্ক মায়ের হাত ধরে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল। কিন্তু মেজ ছেলের এমন আন্তরিক আপ্যায়নের পরও চাপা স্বরে কেঁদে উঠল মাধবীলতা। হতবাক শশাঙ্ক জিজ্ঞাসা করল,
-তুমি কাঁদছ কেন মা?
-চুপ চুপ! আস্তে! বড় খোকা শুনে ফেলবে। দেওয়ালেরও কান আছে।
-কী হয়েছে? দাদা কী শুনবে?
-আহ্লাদী ঘরে নেই রে শশী!
-কী বলছ মা! তবে কী আবার...
-লতা কিভাবে ভিতরে ঢুকল সকালে খেয়ালই করিনি শশী। তখন ওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম। ভাবলাম, মেজ বৌমা ভোরে উঠে বোধহয় সদর দরজার খিল খুলেছে। তাই লতা উঠোনে আসতে পেরেছে। দেওয়াল তোলা বাড়ি। ভিতর থেকে দরজা না খুললে গিরিলের আগল ভেঙে তো কেউ ঢুকতে পারবে না। এখন বুঝতে পারছি আমার ঘরের, সদর দরজার, সব খিল খুলে আহ্লাদী বেরিয়ে গেছে। এখন ভোরে বেরিয়েছে নাকি রাত থাকতেই.... ও মা গো! এই মেয়েকে আমি কী করে আটকাব শশী? তোর দাদা জানতে পারলে কী হবে রে? একটু বাইরে বেরিয়ে দেখবি বাবা? দাদাকে কিছু জানাস না। ও এক্ষুণি আপিসে বেরোবে। ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে যাক।
-আমি দেখছি মা। নিধি আমাকে খেতে ডাকলে বলবে মাঠে কাজ ছিল, তাই হঠাৎ বেড়িয়ে গেছি। আর কিছু ভেঙে বলার দরকার নেই। ঘরে ফিরে কথা হবে...
ঘর থেকে মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল শশাঙ্ক।
আজ সাইকেল নিয়ে আহ্লাদী বেরোয়নি। বেরোনো সম্ভব হয়নি। অন্ধকার থাকতেই ঘর ছেড়ে সে পালিয়ে এসেছে ভালোবাসার টানে। অশ্বত্থ গাছের পাশের জমাট অন্ধকার ভোরের ছোঁয়ায় ক্রমে ফিকে হয়ে আসছিল। সাইকেলটা গাছের পাশে রেখে বেরিয়ে এসেছিল সেই পুরুষ। তার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আহ্লাদী। শিরা ওঠা সমর্থ হাতে সেই পুরুষ স্পর্শ করেছিল আহ্লাদীর দেহ। উত্তেজনার তীব্রতায় গাঢ় হয়েছিল আহ্লাদীর কন্ঠ। ও অস্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞাসা করেছিল,
-তোমার বাড়ির লোক আমাকে মানবে তো?
-না মানলে তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব। লোহার মতো শরীর আমার। খেটে খাব। পারবে না আমার সঙ্গে ঘর ছাড়তে?
-খুব পারব! কিন্তু তোমার কোনোদিন মনে হবে না তো, আমাকে বিয়ে করে তুমি ভুল করেছ!
-এ কথা কেন বলছ?
-সবই তো জানো! প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া, বাড়ির বাইরে রাত কাটিয়ে আসা ঘরছাড়া মেয়েকে কেউ জেনেশুনে ঘরে তুলতে চায়? কেউ চাইবে না। কিন্তু তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও কেন?
কোনও উত্তর দিল না সেই পুরুষ। কিন্তু তার দৃষ্টির গোপন অর্থ আহ্লাদী বিলক্ষণ বোঝে। এই দৃষ্টি সে প্রথম দেখেছিল হারু কাকার চোখে।
চিরচেনা একজন মানুষ হারু কাকা। যার কোলে-পিঠে-কাঁধে চেপে আহ্লাদী ঘুরে বেরিয়েছে নিজেদের চাষের জমিতে, মাঠে-ঘাটে, পুকুর পাড়ে, মাছের আড়তে.... সেই মানুষটা যেদিন ওর হাত ধরে খড়ের গাদার পিছনের অন্ধকারে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন প্রথমে ভয়ে আঁতকে উঠে আহ্লাদী প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা গোয়ালের গরুগুলো এই আকস্মিক অনভিপ্রেত মুহূর্তের সাক্ষী হতে চায়নি। তারা দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যেতে চাইছিল। সেদিন আহ্লাদীর অসহায়তার সাক্ষী ছিল হারু কাকা নিজে। পাহাড়ের মতো একজন পুরুষ চেপে বসেছিল আহ্লাদীর কুসুম কোমল দেহের উপরে। কিন্তু নিজের আসুরিক শক্তি সে আহ্লাদীর কমনীয় দেহের ওপর প্রয়োগ করেনি। দৈহিক অত্যাচারের পরিবর্তে আহ্লাদীকে উপহার দিতে চেয়েছিল অপার সুখানুভূতি। বালিকার প্রাথমিক অসহায়তাকে নারীর অবাক বিস্ময়ে পরিণত করার গোপন মন্ত্র হারু কাকার করায়ত্ত ছিল। হারু কাকার বন্য আদরের হাত থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করেছিল আহ্লাদী। কিন্তু নিষিদ্ধ বেড়াজালটুকু নিতান্ত সাবধানতার হাত ধরে অতিক্রম করার পর, সেই অচেনা স্বর্গীয় অনুভূতি ছিল অবর্ণনীয়। এক মুহূর্তে হঠাৎ বড় হওয়ার যে অশ্লীল অনুভূতি, তার রেশ দীর্ঘদিন আহ্লাদীর মনে গেঁথে ছিল।
বালিকাবেলায় হারু কাকার স্পর্শে নিজের পরিচিত দেহকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিল আহ্লাদী। এ যেন আর তার নিজের দেহ নয়। যে কামনার আগুন ধিকিধিকি জ্বলে নারীর মননের অভ্যন্তরে, আহ্লাদীর দেহে অবস্থিত নরকের সেই অজানা দ্বারের গোপন আগল হারু কাকার স্পর্শে মহাসমারোহে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছিল।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত আহ্লাদীর দেহের সমস্ত অনুভূতি ও যাবতীয় চাহিদার নিয়ন্ত্রক ছিল হারু কাকা। ধীরে ধীরে আহ্লাদীর বুকের ওপর সদ্য প্রস্ফুটিত দুটি কুঁড়ির অবৈধ মালিক ও নিহন্তা হয়ে উঠেছিল সে। মায়ের পাশে শুয়ে কন্যার রাত কেটে যেত চোখ মেলে। মাধবীলতা বালিকার মনের এই পরিবর্তন বুঝতে পারেনি। পাশবালিশটা কেবল জেনেছে আহ্লাদীর মনের তীব্র ইচ্ছের কথা। আয়নার দিকে চেয়ে আহ্লাদী নিজেকে চিনতে পারত না। বালিকার দেহের ভিতর থেকে একজন পূর্ণবয়স্কা কামুক নারী যেন সর্বদা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে ওর বাড়ন্ত দেহটা জরিপ করত। কামাতুর হারু কাকার লালায়িত দৃষ্টির মতোই অনিয়ন্ত্রিত ছিল সেই অনুভূতি।
স্কুল পালিয়ে হারু কাকার জমিতে পৌঁছে যেত আহ্লাদী। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকত চুপটি করে। হারু কাকা মাঠের ধান ফেলে রেখে সকলের চোখ এড়িয়ে সরে আসত তার কাছে। হলদেটে দাঁতের সারি মেলে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করত, "কী রে? আজও স্কুলে যাসনি? পড়ালেখায় মন বসেনা তোর?"
মাথা নেড়ে না বলত আহ্লাদী। হারু কাকা এগিয়ে এসে সবুজ ফিতে দিয়ে সযত্নে সাজানো আহ্লাদীর বেণী করা চুল মুঠি করে টেনে বলত, "তুই কি আমারে কাজ-কাম করতে দিবি না? তোর বড়দা জানতে পারলে আমারে গাঁ ছাড়া করবে..."
আকুল হয়ে হারু কাকার ঘর্মাক্ত হাত চেপে ধরে জানতে চাইত আহ্লাদী, "যেখানেই যাও, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তো?"
ঘামে ভেজা গামছার পাশে দুপুরের পান্তা আর ডাঁটাচচ্চড়ি পড়ে থাকত। এক সুবিশাল বনস্পতিকে পাহারায় রেখে রোদে পুড়ে যাওয়া একটা সুবিশাল দেহ ধীরে ধীরে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মিশিয়ে দিত আহ্লাদীকে। বালিকার স্কুলের শার্টের বোতাম ছিঁড়ে যেত, চুলের বেণী আলগা হতো, তবুও সে পরিণত পুরুষের বন্য আদরের হাত থেকে নিষ্কৃতি চাইত না।
বছর ঘোরে, নতুন ধান গোলায় ওঠে। কিন্তু হারু কাকা আহ্লাদীর কাছে ক্রমে পুরোনো হয়ে যায়। তার আদরের ধরণ, রমণের গতি, শ্বাস ও দেহের উত্থান-পতন, সবই যেন বড় পরিচিত। কোথাও কোনও নতুনত্ব নেই। নিজের গগনচুম্বী চাহিদার সীমারেখা বুঝতে পারত না আহ্লাদী। ওর পুষ্ট দেহের অলিগলি রাস্তার কুকুরের মতো শুঁকে বেড়াত হারু কাকা। কিন্তু আহ্লাদীর কামনার তল সে পেতো না। তার পর যে ওর জীবনে এসেছিল, তার কথা ভাবতে গেলে আহ্লাদীর মন উদাস হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আহ্লাদী বলল,
-আমি আজ যাই। বড়দা একতলায় খেতে নামার আগে বাড়িতে ঢুকতে হবে।
আহ্লাদীর হাত টেনে ধরে সেই পুরুষ বলল,
-আবার কবে আসবে?
-জানি না। খবর পাঠাব। খুব ইচ্ছে করলে নিজেই চলে আসব। তবে এটুকু বলতে পারি, তুমি আমার কাছে না এসে থাকতে পারলেও, আমি খুব বেশিদিন তোমাকে ছাড়া একা থাকতে পারব না। আমি আসব।
বিদায়কালে একটি আকস্মিক চুম্বনের বিনিময়ে প্রেমিক পুরুষের কাছ থেকে প্রগাঢ় স্পর্শ আদায় করে নিল আহ্লাদী। পায়ে পায়ে খানিকটা হেঁটে এসে ধুলোমাখা রাস্তার বাঁকে শশাঙ্ককে দেখে থমকে গেল সে।
-ঐ এসেছে। দ্যাখো তোমার পেয়ারের বোন বাড়িতে পা রেখে বাড়িশুদ্ধু লোকের পিণ্ডদান করে আমাদের উদ্ধার করেছে। এবার আমরা সবাই একসঙ্গে নিশ্চিন্তে স্বর্গবাসী হবো। শশীকে জিজ্ঞাসা করো দেখি, বোনকে ও কোথা থেকে উঠিয়ে আনল!
তৃণার চিৎকারে অস্থির হয়ে কম্পিত কলেবরে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো মাধবীলতা। শশাঙ্কর পাশে মাথা নামিয়ে আহ্লাদী দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিত্য গৃহকর্ম সহায়িকা চাঁপা হাতের কাজ ফেলে রেখে চেয়ে রয়েছে নাগের বাড়ির নতুন কোনও খোরাকের আশায়। নিধি রান্নাঘরের বাইরে বেরিয়ে বাড়িতে ভাসুরের উপস্থিতির কারণে মাথায় কাপড় চাপিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শশাঙ্কর দিকে চাইল। কিন্তু ওর নীরব প্রশ্নের কোনও উত্তর শশাঙ্ক দিল না। মৃগাঙ্ক খাওয়া ফেলে এঁটো হাতে উঠোনে বেরিয়ে এসে বলল,
-আমি ওকে বাড়ির বাইরে পা রাখতে বারণ করেছিলাম। ও কোথায় গিয়েছিল শশী?
-দাদা এভাবে চিৎকার ক'রো না। ও ঘরে যাক। আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি।
-তুমি কী বুঝিয়ে বলবে শশী ঠাকুরপো? এই মেয়ের কেচ্ছা-কারবার তো কারও জানতে বাকি নেই। এবার এর একটা ব্যবস্থা করো। বেহায়াপনারও তো একটা সীমা আছে নাকি! আমার ছেলে দুটো বড় হচ্ছে। বড়টা তো দেখতে দেখতে হাতে-পায়ে বেড়ে সেয়ানা হয়ে গেল। এরপর ওরা বাইরে থেকে কিছু শুনে ঘরে এসে আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলে, আমি মা হয়ে তাদের কী জবাব দেবে শুনি? কোন লজ্জায় উত্তর দেব? বলি ছেলেপিলেরা বড় হচ্ছে না? তোমার ঘরেও তো টুয়া বড় হচ্ছে। ও চোখের সামনে এমন বেলেল্লাপনা দেখলে তো তাই শিখবে।
ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টুয়ার হাত ধরে নিধি দ্রুত প্রবেশ করল ভিতরে। ঘরের মধ্যে মেয়েকে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে আগল তুলে দিল। তৃণার নিরন্তর বাক্যবাণ মাধবীলতার গায়ে যেন জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। তৃণা একনাগাড়ে বলে চলেছে,
-আমরা দুটো বৌ ঘরের মধ্যে উদয়-অস্ত খেটে-খেটে মরে যাচ্ছি। ঘরের একটা কাজে-কম্মে পায় না, নির্লজ্জ গতরখাকি মেয়েমানুষ গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ব্যাটাছেলে ধরার জন্য অন্ধকার থাকতে চোখ খুলে উঠে রাস্তায় চরতে বেরিয়ে যাচ্ছে। জগতে এত মেয়েমানুষ দেখেছি, বাপের জন্মে এমন আক্কেলহীন বেহায়া মেয়েমানুষ দেখিনি বাবা, যার নাকি মদ্দা মানুষ ছাড়া একটা দিনও চলে না.... গর্ভের তো নয়, বংশের কলঙ্ক! কত জন্ম পাপ করলে এমন একটা বেহায়া মেয়েমানুষ পেটে ধরা যায়...
সশব্দে একটা চড় এসে পড়ল আহ্লাদীর গালে। মাধবীলতা গুমরে কেঁদে বলল,
-বল আর কত কথা শুনতে হবে তোর জন্য? বল বল.... এত লোক লাইন পার হতে গিয়ে রেলে কাটা পড়ে মরে, তুই মরিস না কেন? বল তুই মরিস না কেন? কবে তোর মরণের খবর পাব?
মার খেয়ে উঠোনে আছড়ে পড়েছিল আহ্লাদীর দেহ। কোমর পর্যন্ত এলো চুলের মুঠি মাধবীলতার মুঠোর মধ্যে রয়েছে। চুড়িদারের ওড়নাটা উঠোনের ধুলো মেখে গেল। নিধি দৌড়ে এসে মাধবীলতাকে টেনে ধরে বলল,
-ও মা, ছাড়ুন ওকে। এতবড় মেয়ের গায়ে কেউ এভাবে হাত তোলে? আপনি ঘরে চলুন।
-ছাড়ো মেজ বৌ! আমার মরণ হয় না গো! এই মেয়ে নিজেও মরবে না। আমাকেও শান্তিতে বাঁচতে দেবে না। আমি কী পাপ করেছিলাম গো...
মৃগাঙ্ক আর তৃণা মুখ ফিরিয়ে চলে গেছে দোতলায়। এলোপাথাড়ি মারের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে সবে উঠে বসতে যাচ্ছিল আহ্লাদী। শশাঙ্ক ওকে ধরে তুলতে গেল। শশাঙ্কর হাত ছাড়িয়ে একছুটে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখল আহ্লাদী। খোলা জানলার গরাদ ধরে ঘরের ভিতর থেকে টুয়া দু'চোখ মেলে আহ্লাদীর কান্না দেখল। মাধবীলতার ঘর থেকে চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। শশাঙ্ক দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই টুয়া ওর কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-ও বাবা, সোনাপিসিকে ঠাম মারল কেন? ঠাম কাঁদছে কেন?
ঢোঁক গিলে শুষ্ক কণ্ঠে শশাঙ্ক বলল,
-জানি না মা!
-মিথ্যে কথা। তুমি সব জানো। বলো না বাবা...
-তোর সোনাপিসি...
-কী করেছে সোনাপিসি?
টুয়ার নিষ্পাপ কৌতূহলী মুখের দিকে চেয়ে শশাঙ্ক কোনোমতে বলল,
-তোর সোনাপিসি আজ সকালে ঘরের খিল ভেঙে পালিয়ে গিয়েছিল, পুজোর ফুল চুরি করতে। তাই ঠাম রাগ করেছে সোনা। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিস না মা। এর বেশি আমি কিছু জানি না। তোর মা সব জানে। মাকে একটু জিজ্ঞাসা করে আয় দেখি, বল বাবা আড়তে বেরোবে। দুটো ভাত পাওয়া যাবে?
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট