অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

অসমাপ্ত (দশম পর্ব)




অসমাপ্ত

দশম পর্ব


সাথী দাস



বিচারকমন্ডলীর দিক থেকে ভেসে আসা একের পর এক কথা,প্রশ্নবাণ,সবকিছুর উত্তর দিয়ে যখন বাইরে বেরোলো সমুদ্র,তখন বিকেল চারটে বেজে গেছে।বাইরে বেরিয়ে ভিড়ের মাঝেও চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলো ও।ছোট-ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মায়েরা এসেছে।ওর বয়সী যারা,তাদের সঙ্গে বাবা-দাদা বা বন্ধু রয়েছে।এখানে সমুদ্রই একমাত্র অনাথ।পিঠে ব্যাগটা তুলে নিতে যাচ্ছিলো সমুদ্র।হঠাৎ করেই পিছন থেকে ডাক শুনতে পেয়ে ও ঘুরে তাকালো,

-মিস্টার সমুদ্র বাসু?
-স্যার আপনি?!
-এদিকে এসো!

গ্রীনরুমের দিকে উনি ডেকে নিয়ে গেলেন সমুদ্রকে।কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-জীবন বাজি রেখে দিয়েছো তুমি।অভিভাবকের পরোয়া না করে,নিজের ভবিষ্যতের পরোয়া না করে,এই বয়সে ঝোঁকের মাথায়,অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো।এখান থেকে তোমার কতদূর কি হবে,জানা নেই আমার।তুমি এই রিয়্যালিটি শো-কে কতটা মিথ্যের জালে জড়িয়ে টি-আর-পি পাইয়ে দিতে পারবে,আমি এখনই বলতে পারছি না।এখানে প্রকৃতপক্ষে গুণীর কতটা কদর হয়,তার কোনো নূন্যতম ধারণাও,তোমার নেই সমুদ্র।দু-সপ্তাহের মধ্যেই এরা তোমাকে ফাইনাল কল পাঠাবে।হ্যাঁ কিংবা না,যেটাই হোক।যদি তুমি এই সিজনে আসো,আমার চেয়ে খুশি বোধহয় আর কেউ হবে না।কিন্তু যদি এদের দিক থেকে তুমি পজিটিভ কোনো উত্তর না পাও,এই আমার কার্ড রাখো,আমার সঙ্গে তুমি যোগাযোগ করবে।বাকিটা আমি বুঝে নেবো!সেটা ওয়াইল্ড-কার্ড এন্ট্রি হিসেবেই হোক,বা অন্য যে কোনোভাবে।আমার সাহায্য তুমি পাবে।আসলে জহুরীর চোখ তো,আমার রত্ন চিনতে ভুল হয় না সমুদ্র।কিন্তু বয়স হয়েছে তো,তাই আমার মতামতের গুরুত্ব এখন বড়ই কম।আমাকে শুধুমাত্র রাখা হয়,এককালে অর্জন করা আমার নামটুকুর জন্য।আমাদের সময়ে এতসব স্পনসর,পার্টনার,মার্কেটিং,প্রোমোশন,টি আর পি,এতকিছু আমরা বুঝতামই না।আমরা শুধু গুণের কদর করতাম।তুমি নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ভিতরে যা বলে এলে,তারপর তো....
-আমায় ক্ষমা করবেন স্যার।ওরা বারবার আমার স্ট্রাগল জানতে চাইছিলো।আমি একা কেন,আমার সঙ্গে বাড়ির লোক নেই কেন,পরীক্ষা ছেড়ে এখানে কেন,জানতে চাইছিলো।কি বলতাম আমি?!এখানে আসার জন্য বাবা-মাকে নিয়ে সামান্য একটু মিথ্যে বলতে হয়েছে আমায়,তাও এমন একজনকে,যাকে আমি কোনদিনও মিথ্যে বলি না।কিন্তু ন্যাশনাল টিভিতে অন ক্যামেরা,আমি আমার বাবা-মাকে ছোট করতে পারবো না।কারণ,আমার স্টোরি তো ওইরকম হৃদয়বিদারক কিছু নয় স্যার।না খেতে পাওয়া ঘরের ছেলে নই আমি।আমি যখন যা চেয়েছি,ফোন,কম্পিউটার,এক্সপেন্সিভ হেডফোন,পকেটমানি,জামাকাপড়,নূন্যতম বিলাসিতা,সবই আমার বাবা দিয়েছে আমায়।যেটা পাইনি,সেটা হলো মেন্টাল সাপোর্ট!গানকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য,পড়াশোনা-চাকরি,এইসব গতানুগতিকতার বাইরে বেরোনোর জন্য,যে প্রবল একটা মানসিক শক্তি প্রয়োজন,সেটা আমাকে তারা দেয়নি।তাছাড়া আর সবই দিয়েছে।আমার মাথার ওপর ছাদ আছে,দোতলা বাড়ি আমাদের।পায়ের তলায় জমি আছে,মূল্যবান টাইলস বসানো তাতে,আমার ঘরের মেঝেতে যে মার্বেল বসানো,তাতে আয়না পালিশ করা,হাঁটলে তার ওপর আমার ছায়া পড়ে।পেটে প্রয়োজনের অতিরিক্তই খাদ্য আছে।নিজের জেদের কারণে আমি অভুক্ত থেকেছি হয়তো,তখন মাথা গরম থাকলে অত খিদে-তৃষ্ণা পায় না।কিন্তু খেতে পাইনি,বা অভাবের তাড়নায় মা নিজে না খেয়ে,তার মুখের খাবারটুকু আমাকে খাইয়ে দিয়েছে,বা বিনা বেতনে আমার গানের শিক্ষক আমায় গান শিখিয়েছেন,বা ভাঙা হারমোনিয়ামে আমি গান শিখেছি,শুনে-শুনে শিখেছি,এসব গল্প আমি কোথায় পাবো স্যার?!আমি যা নই,তা নই।আমি সুস্থভাবে-স্বাভাবিকভাবে প্রতিপালিত একজন সুখী সন্তান।আর বাকি যেটুকু সাপোর্ট তারা আমায় করেননি,সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।তারা আমার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছেন,আমাকে জীবনে সুখী দেখতে চেয়েছেন,সফল দেখতে চেয়েছেন,অন্যায় নয়।কিন্তু আমি নিজেই এই লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছি,অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝাঁপ দিয়েছি,সেই দায় সম্পূর্ণ আমার।আমি ওই দশটা-পাঁচটার অফিসে দম আটকে মরে যাবো স্যার!আমার দ্বারা ওইসব হবে যেন।আমি পারবোই না।কিন্তু এটাই আমি আমার বাবা-মাকে,কিছুতেই বোঝাতে পারিনি।তার মানে এই নয়,সেসব পারিবারিক ব্যক্তিগত ব্যাপারকে সামনে রেখে,আমি এই রিয়েলিটি শো-তে আসবো।ন্যাশনাল টিভিতে হোক,বা জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে,বাবা-মাকে ছোট করে,আমি বড় হতে পারবো না স্যার!!তারা যাই হোক,যেমনই হোক,আমারই....তাই আমি তাদের সামনে রেখে,কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে,সমবেদনা কুড়িয়ে, কোনোরকম সাফল্য পেতে চাই না।আমার কাজের কি কোনো মূল্য নেই?!মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদেরও কিন্তু লড়াই থাকে স্যার,শুধু তাদের লড়াইয়ের সংজ্ঞাটা অন্যরকম হয়....আমার কন্ঠ,আমার কাজ,আগামী দিনে আমার পরিচয় তৈরি করুক।কোনো মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে লোককে কাঁদানো,সমবেদনা আদায় করা,আমার দ্বারা সম্ভব নয়....

কিছুক্ষণ একভাবে ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন,একটু আগে বিচারকের আসনে বসে থাকা প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞ মানুষটি।সত্যিই অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও,আয়োজকরা এর মুখ থেকে টি আর পি পাওয়ার মতো একটাও ঘটনাপ্রবাহ বের করতে পারেননি।আর এটাই ওনার ভয়।এই মার্কেটিং-এর যুগে,টি.আর.পির কবলে পড়ে,এইরকম একটা প্রতিভা,হারিয়ে না যায়।কিন্তু বড় জেদী যে এই ছেলে।কিছুতেই নিজের দুর্বলতাকে জনসমকক্ষে বের করবে না।একে বোঝানো যাবে না,যে বর্তমান যুগে শুধুমাত্র প্রতিভার মূল্য কেউ দেয় না।সেই প্রতিভাকে তুলে ধরার নেপথ্যে,অনেকরকম নিম্নমানের বাণিজ্য কাজ করে।উনি ভালোভাবে দেখলেন ছেলেটিকে।একমাথা ঝাঁকড়া চুল,চোখে একটা মূল্যবান ফ্রেমের চশমা,চোখমুখ একটু বসা,হয়তো মানসিক চাপে খাওয়া-ঘুম নেই ছেলেটির।যেখানে কাউকেই পাশে পায়নি,সেখানে একা-একা এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে,ওকে নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।সমুদ্রর কাঁধে হাত রেখে উনি বললেন,
-দিন পনেরো পর আমাকে তুমি একটা ফোন করবে।নানারকম ব্যস্ততায় আমি হয়তো ভুলে যেতে পারি,কিন্তু তুমি আমাকে ফোন করবেই।কেমন?
-করবো স্যার!থ্যাঙ্কু!আমার সত্যিই একটা সুযোগের ভীষণ প্রয়োজন।নইলে বাবা-মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার মতো,আমার আর মুখ থাকবে না।
-বুঝেছি!!গুড লাক ইয়ং ম্যান!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!

দ্রুতপায়ে চলে যাচ্ছিলেন উনি।এই ছেলেটির গভীর-স্বচ্ছ দুটি চোখে কত আশা,কত স্বপ্ন প্রোথিত রয়েছে।উনি দেখতে পেলেন সেই দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্নের আভাস!তাই আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলেন না ওর সামনে।কিভাবে দাঁড়াবেন!!কিভাবে একে বলবেন,যে টপ-থার্টির মধ্যে,টপ টোয়েন্টি-ফাইভ আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।বাকি রয়েছে শুধুমাত্র পাঁচটা আসন।যত লড়াই মাত্র ওই পাঁচটা আসনের জন্যই।যার জীবনে যত বেদনা,যে অনুষ্ঠানকে যত বেশি টি.আর.পি.দিতে পারবে,দর্শককে কাঁদাতে পারবে,যার এলিমিনেশনে যত বিতর্ক তৈরি হবে,তার সুযোগ ততই বেশি।রিয়্যালিটি শো গুণের পাশাপাশি রসদ চায়,চটকদার মশলা চায়,আর চায় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য প্রবল উন্মাদনা তৈরি করতে।চায় প্রতিযোগির প্রবেশমূল্য বাবদ টাকার অঙ্কটা।সেই কারণেই এই প্রতারণা,ছলনা বা সুবর্ণ সুযোগের হাতছানি।আর সেই রকম একটা প্ল্যাটফর্মে,এই ছেলেটি শুধুমাত্র নিজের গগনচুম্বী প্রতিভাকে আশ্রয় করে,যুদ্ধ করতে চাইছে।আবেগী সরল ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভেবে,চোখে জল এসে যাচ্ছিলো ওনার।তাই উনি সমুদ্রর সামনে থেকে সরে যেতে চাইছিলেন তাড়াতাড়ি।কিন্তু আবার ফিরতে হলো তাকে,সমুদ্রেরই ডাকে....

-স্যার...
-বলো?
-যখন ফোন করবো,আমার সমুদ্র নামটা আপনার মনে থাকবে তো?কি বলবো আমি?যা আপনাকে সহজেই আমার কথা মনে করিয়ে দেবে?!

একটু হাসলেন প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞ সেই ব্যক্তি....

-যুগের সঙ্গে তাল মেলাও সমুদ্র।আমি মানুষটা প্রবীণ,কিন্তু আমার মনটা চিরসবুজ।জানো তো,আমাদের মতো শিল্পীদের কোনোদিনও বয়স হয় না।আমরা প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রেমে পড়ি।নিজেদের সৃষ্টির প্রেমে।নইলে সৃষ্টি করতে পারবো না যে।যদি আমাকেই জিজ্ঞেস করো,তবে তোমায় আমি একটা জমকালো নাম দেবো।আশা করবো,একদিন এই নামটা গানের জগতে,নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবে।

হেসে ফেললো সমুদ্র,আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেছে।
-কি নাম স্যার?
-যেদিন ফোন করবে সেদিন বোলো,স্যার,মনে আছে আমাকে?আমি সমুদ্র বলছি!আপনি দিন পনেরো আগে আমায় দেখেছিলেন।আমি ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছিলাম আপনার শিল্পীসত্তার অববাহিকায়।সেদিন কোনো নবীন হয়তো আমাকে বোঝেনি,কিন্তু প্রবীণ আপনি আমাকে বুঝেছিলেন।সমুদ্রের ওপরের উদ্দাম ঢেউয়ের গভীরে যে প্রশান্তি বিরাজ করছিলো,তার অনন্ত নৈঃশব্দ,তার সুর-ছন্দ স্পর্শ করেছিলো আপনাকে।আপনিই আমায় ভেঙে নতুন করে সৃষ্টি করেছিলেন।আপনিই এই পৃথিবীর জন্য নবরূপে সাজিয়েছিলেন আমায়।আমি স্যাম বলছি,
"স্যাম-মেলোডি অফ দা সি.....",আমায় মনে আছে স্যার?!ব্যাস!!এটুকুই বলো।নেহাত আলঝেইমার হয়ে না গেলে,এটুকুই আমায় কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সমুদ্র....

চুপ করে গেলো সমুদ্র।আবেগে ওর গলা বুজে এসেছে।আজকের আগে কেউ কোনোদিনও ওকে এভাবে বলেনি।আর আজ এতবড় গুণী একজন মানুষের কাছ থেকে এটুকু প্রশংসায়,ও দিশেহারা হয়ে গেলো।আনন্দে কান্না পেয়ে গেলো।চশমার কাঁচের ওপর টুপ করে একফোঁটা জল এসে পড়লো।ঝাপসা হয়ে গেলো সবকিছু।চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিলো সমুদ্র।একটু এগিয়ে এসে ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো,
-আরে-আরে করো কি?!
-কিছু না স্যার!একরকম জোর করেই আপনার একটু আশীর্বাদ আদায় করে নিলাম।যদি কোনোদিনও নিজের পরিচয় তৈরী করতে পারি স্যার,তবে এই নামেই আমায় পৃথিবী চিনবে।"স্যাম-মেলোডি অফ দা সি....",থ্যাঙ্কু স্যার!!
-ভালো থেকো।উইশ ইউ অল দা বেস্ট ইয়ং ম্যান!!
-থ্যাঙ্কু!

ধরা গলায় সমুদ্র বললো।ধীরে-ধীরে এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন সেই ভদ্রলোক....পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে,বাইরে বেরিয়ে এলো সমুদ্র বসু....

বাইরে বেরোতেই বিকেলের পড়ন্ত রোদে,আবার সমুদ্রর খিদেটা চনমনিয়ে উঠলো।অটো স্ট্যান্ডের সামনেই ছোটখাটো একটা ভাতের হোটেল দেখে,ওখানেই ঢুকলো ও।ছোট বাটিতে একটু ট্যালটেলে জলের মতো ডাল,আর একটা ডিম দুটো আলু সহযোগে মোটা চালের ভাত,ওর গলা দিয়ে নামছিলো না।কিন্তু খিদের তাড়নায় তাই গলাধঃকরণ করে রাখলো ও।খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে মানিব্যাগ থেকে টাকা দিয়ে,নিজের ব্যাগটা আবার পিঠে তুলে নিলো।তারপর এগোলো স্টেশনের দিকে।মুঠোফোনটা অন করে ওইদিকে একভাবে চেয়ে থাকতে-থাকতে সমুদ্র আর খেয়াল করলো না,যে সেই বিশেষ মানুষটির দেওয়া মূল্যবান কার্ডটা টাকা বের করতে গিয়ে,ব্যাগ থেকে ওর পায়ের কাছে পড়ে গেছে।সৌরর একাধিক মেসেজ পড়তে-পড়তে আনমনে ওই কার্ডের ওপর দিয়েই হেঁটে বেরিয়ে গেলো সমুদ্র....সমুদ্র বেরিয়ে যাওয়ার পর একাধিক পথ চলতি মানুষের পদপিষ্ট হয়ে,পিচঢালা রাস্তায় হারিয়ে গেলো সেই কার্ড....

পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পর থেকে,মনটা এতটাই ভারী হয়ে রয়েছে,যে সৌর আর একবারও ফোন করেনি সমুকে।আজ বিকেলে সব বন্ধুদের একসঙ্গে বেরোনোর কথা ছিলো।পরীক্ষা শেষ,সবাই মিলে অনেক আনন্দ করা হবে,বহুদিন আগে থেকেই ওরা ঠিক করে রেখেছিলো।কিন্তু সৌর,ঋষি আর রূপকে না বলে এসেছে।ঋষি একটু চিন্তিত।ওর বাবা চাকরিসূত্রে পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকেন,অন্ধ্রপ্রদেশ,দক্ষিণ ভারতে।উনি বেশ কয়েকদিন ধরেই একটু অসুস্থ।এবার পরীক্ষা শেষ,ঋষি হয়তো কিছুদিনের জন্য মাকে নিয়ে বাবার কাছে যাবে।সেইসব প্রসঙ্গে অনেক কথাবার্তা বলার ছিলো।রূপ আর নিশার সঙ্গেও বেরোনোর কথা ছিলো।কিন্তু সৌর সবাইকেই না বলে দিয়েছে।সমু প্রথম কারণ,আর দ্বিতীয় কারণ হলো মিছরি।মেয়েটা এত কাটা-কাটা কথা বলে,ওর প্রতিটা কথা ক্ষেত্রবিশেষে সৌরর মনের উন্মুক্ত ক্ষতর ওপরে,যেন একমুঠো নুন ছড়িয়ে দেয়।মাঝে-মাঝে তো সহ্যই করতে পারে না সৌর।সমস্ত সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলে মিছরি।তখন সৌর ওর ওপরে চিৎকারও করে ফেলে।কিন্তু তারপরই মিছরি ফোন না ধরলে,বা ফোন বন্ধ করে রাখলে,সৌর উন্মাদ হয় যায়।তখন আবার মিছরির কাছে যাওয়ার জন্যই,পাগল হয়ে যায় ও।কাল রাতে মিছরির মুখের ওপরে ফোন রেখে দেওয়ার পরও,অনেকবার ফোন করেছিলো মেয়েটা।সৌরই ধরেনি।ভোরবেলা মেসেজ করে পরীক্ষার জন্য শুভকামনা জানিয়েছিলো।মেসেজ দেখে ছেড়ে দিয়েছিলো সৌর।কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি।এবার বাড়ি ফিরে যেই সৌর ওকে ফোন করছে,ফোন বন্ধ!!কেমন মাথাটা গরম হয়!!এই সবকিছু মিলিয়ে সৌরর মনটা এতটাই খারাপ হয়ে রয়েছে,যে ও সেই তখন থেকেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে,বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে।সন্ধ্যে হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই।তাও ওঠেওনি ও,ঘরের আলোটাও জ্বালায়নি।আজকাল প্রায়ই ওর মনে হয়,জীবনে কিছু-কিছু ক্ষেত্রে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াই ভালো।অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে রাখলে,নিজের চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলটুকুও,নিজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়।বালিশ ভিজে গেলেও,যন্ত্রণারা বোধহয় অদৃশ্যই থাকে।অন্ধকারে মনে হয়,আমি আছিও-আবার নেইও!!বা হয়তো থেকেও নেই।অদ্ভুত একটা অনুভূতি।অন্ধকার রাজ্যে নিজের থেকে নিজে পালিয়ে থাকা যায়।নিজের সম্মুখীন হতে হয় না।আজ ভালোবাসার কাছ থেকে ভীষণরকম আহত সৌর,বন্ধুত্বের কাছ থেকেও।তাই নিজের আহত মনকে অন্ধকারেই লুকিয়ে রেখেছিলো ও।বারংবার ফোনের দিকেই হাত চলে যাচ্ছে।কতবার যে ও মিছরিকে ফোন করেছে,তার ইয়ত্তা নেই।প্রতিবারই ফোন বন্ধ আসছে।এর মধ্যেই মা বার দুয়েক এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেছে।উঠছি-উঠছি বলেও ওঠেনি সৌর।বালিশ-বিছানা আঁকড়েই পড়ে রয়েছে।চোখটা বালিশে মুছে নিয়ে,আরও একবার মিছরির নম্বরে ফোন করলো সৌর।এইবার রিং হচ্ছে,দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো ও,অবশেষে সে ধরলো ফোনটা।তার গলার স্বর শোনার জন্য ধড়ফড় করতে লাগলো সৌরর হৃদপিন্ডটা।কিন্তু সে ফোন ধরেও চুপ করেই রইলো।সৌরও আর একটা কথাও বললো না....বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর হার মানলো সৌরই।ফোনের একেবারে কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,
-সরি মিছরি!প্লিজ....
-আর কিছু?
-হুম!বেরোচ্ছি আমি!তোমায় এক্ষুণি দেখতে চাই!এক্ষুণিই....তুমি এসো!
-না....
-প্লিজ!!
-আমার সময় নেই!
-কান ধরে দাঁড়াবো তোমার সামনে,প্রমিস!সেই সেদিনের মতো।প্লিজ,একবার এসো.....

হেসে ফেললো তিলোত্তমা।
-নাচের ক্লাস আছে।সত্যিই আজ আমার সময় নেই সৌর।
-আমার জন্য একটুখানি সময় বের করতে পারবে না মিছরি?!কতদিন তোমায় দেখি না।ভিডিও কলে চোখের দেখা দেখে কি আর,তোমায় ছুঁয়ে দেখার সাধ মেটে?!প্লিজ এসো।আমি তোমার খুব বেশি সময় নেবো না!
-আসছি!কিন্তু বেশি সময় দিতে পারবো না,আগেই বলে দিলাম....
-তুমি যেটুকু সময় দেবে,সেটুকুই অনেক।আমি তার বেশি কিছু চাইবোও না।লাভ ইউ মিছরি!!চলে এসো আমাদের জায়গায়....
-লাভ ইউ টু,চলো বেরোও...আমিও বেরোচ্ছি!!

ফোনটা রেখে উঠে পড়লো সৌর।ঘরের আলো জ্বালিয়ে একটা জামা গায়ে গলিয়ে নিলো।জিন্সের পকেটে মানিব্যাগ আর ফোনটা ঢুকিয়ে নিলো।আজ পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময়,মিছরির জন্য একটা সুগন্ধী আর পছন্দ করে একজোড়া হাল ফ্যাশনের কানের দুল কিনেছিলো সৌর।ওয়ার্ডরোব থেকে ওগুলোকে বের করতে গেলো ও।তখনই ওর চোখ পড়লো ওয়ার্ডরোবের পাল্লার ভিতরকার দেওয়ালের দিকে।একবার হাসিমুখে ওখানে চোখ রাখলো ও।তারপর হাত রাখলো নিজের সাজানো ভবিষ্যতের ওপরে।হাতে লেখা একটা কাগজ আঠা দিয়ে সাঁটানো রয়েছে ওয়ার্ডরোবের দেওয়ালে।যাতে লেখা রয়েছে,

"জীবনের অসমাপ্ত কতগুলো লক্ষ্য।যেগুলো আমাকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে....স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরী,নিজের উপার্জনে একটা গাড়ি,তারপর সুখী.....সম্পূর্ণ জীবন।"

এটা বেশ কিছুদিন আগে লিখে এখানে আটকিয়ে রেখেছিলো সৌর।ওর স্যার বলেন,জীবনে লক্ষ্য স্থির না করলে,লক্ষ্যপূরণ করা যায় না।হয়তো অধরা থেকে যায় অনেক কাঙ্খিত বস্তু,অসমাপ্ত ইচ্ছে।তাই সর্বপ্রথম লক্ষ্যস্থির করতে হয়।সেদিনের পরই বাড়ি ফিরে নিজের লক্ষ্যটা স্থির করে ফেলেছিলো সৌর।জীবনটাকে একেবারে ছকে বেঁধে ফেলেছিলো।তখনও ওর জীবনে মিছরি আসেনি।কিন্তু মিছরি আসার কিছুদিন আগেই,জলে নিজেকে প্রমাণ করলো সৌর।তারপরই ওর জীবনে মিছরির আগমন।তারপরই চাকরির কথা চলছে।পেনটা হাতে তুলে নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় দুটো শব্দ কেটে দিলো সৌর।পড়ে রইলো স্কুল,চাকরি,নিজের গাড়ি,আর সুখী...সম্পূর্ণ জীবন।এই কয়েকটি মাত্র শব্দ।এই চাকরিটা ওকে পেতেই হবে।হাতের ক্ষতর দিকে একবার চাইলো সৌর।পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পরই স্যার ফোন করেছিলেন,সৌর কাল থেকেই প্র্যাকটিস করবে কিনা জানতে চেয়েছিলেন।কিন্তু হাতটা না শুকোলে জলে নামা যাবে না।তাই দিন দুয়েক সময় চেয়ে নিয়েছে সৌর।তারপরই ওর যুদ্ধ শুরু হবে!মিছরিরও ইন্টার-পুল কম্পেটিশনের সময় প্রায় হয়ে এলো,আর ওর তো জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।আর এটা ওকে জিততেই হবে,নিজের জন্য না হোক,অন্তত মিছরিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য!চাকরি আর মিছরি,এই দুটো পেয়ে গেলেই,সৌরর জীবনের কোনো অধ্যায় আর অসমাপ্ত থাকবে না।বাকি গ্রাজুয়েশন...সে চাকরি করতে-করতেই করে নিতে হবে।কিন্তু ওই চাকরিটা ওই চাই!সেই সঙ্গে রাজকন্যাও!!সুখী...সম্পূর্ণ জীবন,এই শব্দটুকুর ওপরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ওয়ার্ডরোব বন্ধ করে দিলো সৌর....দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে নামলো নীচে,

-মা আমি একটু বেরোলাম!
-কোথায় চললি এই সন্ধ্যেবেলা?আমি তোর জন্য মোচার চপ ভাজছি।একটু খাবি না?
-মানে যা খুশি বলো!?প্র্যাকটিসে যাচ্ছি না বলে,যা খুশি খাইয়ে যাবে আমায়?ডায়েটের কোনো ব্যাপারই নেই?!কি চাইছো?বাড়িতে থেকে বেশ একটা ছোটখাটো ভুঁড়ি বাগিয়ে ফেলি!!

রান্নাঘরে ঢুকে পিছন থেকে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরলো সৌর....ওর মা তখন গরম-গরম চপ ভেজে কড়াই থেকে পাশের থালায় তুলে রাখছে...
-ধুর!!সারা বছর তোর এই এক কথা!আজ মিলিটারি ডায়েট,কাল স্ট্রিক্ট-ডায়েট,পরশু সেমি-ডায়েট!ওই ফল আর প্রোটিন গিলেই থাকো তুমি!!একটা মাত্র ছেলে আমার,তাকে এ জীবনে আর রেঁধে-বেড়ে খাইয়ে সুখ পেলাম না!!
-উফফ!মা!এইরকম করে বললে,না খেয়ে পারা যায়!?দাও,একটা খাইয়ে দাও!

একটা মোচার চপ নিয়ে ফুঁ দিয়ে ছেলের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে সৌরর মা বললো,
-তা কোথায় চললি?একটু পরেই তো বাবা এসে যাবে।পরীক্ষার কথা জিজ্ঞেস করবে।এখন একটু বাড়ি থাকলে হতো না?বেরোতেই হবে?
-প্লিজ মা,বাবাকে একটু সামলে নিও।আমার একটু দরকারী কাজ আছে!বেরোতেই হবে।
-কি তোমার দরকারী কাজ আমি কি আর জানি না!?
-তাই?জানো?
-সব জানি!পাড়ায় খবর দেওয়ার লোকের অভাব আছে নাকি!!আমার কানে উড়ো খবর সবই আসে!

মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সৌর।শুধু বললো,
-আসছি মা!!
-বাবাকে কি বলবো?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে হেসে ফেললো সৌর।তারপর ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিয়ে বললো,
-আমি আমার টিকালো নাক কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে গলানো একদম পছন্দ করি না।একজন স্ত্রী তার স্বামীকে একা বাড়িতে কি বলবে,তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই!!ও তোমাদের ব্যাপার,তোমরাই বুঝে নিও!আর বাবা বেশি কথা বলতে চাইলে,তোমার হাতের তৈরি গরম-গরম মোচার চপ তো আছেই।মুখে ঢুকিয়ে দিও,চা করে দিও।ওগুলো নিয়েই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবে,ওগুলো আয়েশ করে খেতে-খেতেই আমি চলে আসবো।আমার আসার আগেই তোমাদের প্রাইভেট কথা সেরে নিও কিন্তু....আমি বাইরে থেকে নক করেই আসবো....

সৌরর বাবা-মা উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে বরাবরই খোলামেলাভাবে,সহজভাবে কথা বলেন।তাই বাবা-মাকে না জানিয়ে,আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি সৌরর।বাবাকে একটু ভয় পেয়ে সমীহ করে চললেও,মা তো সৌরর একেবারে বন্ধুসম।মাকে ওই কথাটুকু বলেই,উড়ন্ত খুন্তি প্রবল বেগে ধেয়ে আসার আগেই,তুরতুর করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে পড়লো সৌর।মা তখন চেঁচাচ্ছে।কিন্তু সৌর ঠিক জানে,মা হাসতে-হাসতেই চিৎকার করছে...

একটু হেসে সাইকেলের লক খুলে মিছরির সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেলো সৌর....

-পছন্দ হয়েছে?
-যদিও দেখতে পাচ্ছি না ঠিকমতো!তবে মনে হচ্ছে খুব সুন্দর!
-পরবে না?
-পরছি....

নিজের খালি কান দুটোতে সৌরর আনা দুলজোড়া পরে নিলো তিলোত্তমা....

-ভালো লাগছে আমায়?
-কি করে বুঝবো?অন্ধকার তো!!তোমায় দেখতেই পাচ্ছি না।তাতে কি!অনুভব তো করতে পারি?

এগিয়ে গিয়ে নিজের ঠোঁট দিয়ে মিছরির কান স্পর্শ করলো সৌর,জড়িয়ে ধরলো ওর কোমর।সৌরর উষ্ণ স্পর্শে তিলোত্তমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো।ও দুহাতে জড়িয়ে ধরলো সৌরর গলা।সেই মুহূর্তেই সৌরর পকেটে রাখা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।ওইরকম একটা উত্তেজক-সংবেদনশীল মুহূর্ত,নিমেষেই সৌরর কাছে প্রবল বিরক্তিকর একটা মুহূর্তে পরিণত হলো।ও তাড়াতাড়ি ফোনটা পকেট থেকে বের করলো,স্ক্রিন জানান দিচ্ছে,সমুদ্র ফোন করছে....

ব্যস্ত হয়ে উঠলো সৌর।মিছরির দুটো হাত ওর গলায় তখনও জড়ানো ছিলো।ও ওই দুটো হাতের মধ্যে থেকে নিজেকে মুক্ত করতে উদ্যত হলো,
-মিছরি,এক মিনিট!!

তিলোত্তমার কাছ থেকে সরে এসে সৌর ফোন ধরে বললো,
-কোথায় তুই?
-স্টেশনে ভাই।সবে ট্রেন থেকে নামলাম!ভাই সরি!!
-জোড়া শিবমন্দিরের পিছনে আছি আমি।চলে আয় এখানে।বাড়িতে একা যাস না!আমি যাবো তোর সঙ্গে....

চমকে উঠলো তিলোত্তমা....গম্ভীর হয়ে গেলো ও।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সৌরর থেকে খানিকটা দূরে....

-না ভাই!বাড়িতে ঢুকলে এখন যা হবে,আমি জানি।আমার বাবা-মা আমার সঙ্গে যা খুশি করুক।বকুক-মারুক-ধরুক,আমি শুনে নেবো।কিন্তু তোর সামনে ওসব সহ্য হবে না।আমি একাই যাবো ওদের সামনে।তোকে ফোন করে জানালাম শুধু।কাল থেকে তুই পাগলের মতো মেসেজ করছিস.... তাই আসার পর....
-কাজটা ঠিক করলি না ভাই?আমি এখনও সহ্য করতে পারছি না!!কোনোদিনও মানতে পারবো না...
-কি জানি সৌর!যদি সত্যিই এই সুযোগটা পেয়ে যাই,তবে এটাই হয়তো আমার জীবনে করা সবচেয়ে সঠিক কাজ হবে....
-হুম!যা,বাড়ি যা!আমি রাতে ফোন করছি!
-ওকে!!

ফোনটা রেখে পিছনে ঘুরলো সৌর।কিন্তু মিছরি দাঁড়িয়ে নেই।ও অবাক হয়ে দৌড়ে বেরোলো রাস্তায়।একটু দূরেই দেখলো,মিছরি হেঁটে চলে যাচ্ছে।সৌর ছুটলো ওইদিকে...ওর কাছে পৌঁছেই টেনে ধরলো ওর হাত,
-ওই!!আমাকে না বলে কোথায় যাচ্ছ?
-তো কি করতাম সৌর?আমি আমার নাচের ক্লাস আধ ঘন্টা পিছিয়ে দিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি,আর তুমি তোমার বন্ধুকে এখানে ডাকছো!!আমি জোড়া-শিবমন্দিরের পিছনে আছি।এখানে চলে আয়!!তাহলে আমাকে ডাকার কি দরকার ছিলো?ওকে নিয়েই থাকতে পারতে!ওর জীবনের সমস্তরকম সমস্যার সমাধান করতে পারতে!!
-ও তো আসছে না মিছরি!!
-সেটা পরের কথা সৌর!ও আসছে না,সেটা পরের কথা।তুমি ওকে আমাদের সময়ের মধ্যে আসতে বলেছো,এটা আমি শুনেছি!আমি আমার নাচের ক্লাস,আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি থেকে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে,তোমার জন্য সময় বের করেছিলাম সৌর....
-উফফ!!উদ্ধার করে দিয়েছো আমায়!!

সকাল থেকেই বড্ড মনখারাপ সৌরর।এই একটা স্বভাব মিছরির ভীষণই খারাপ।ও কিছুতেই মানুষের দুর্বলতা,কষ্ট,ভালো লাগা-খারাপ লাগাটা বোঝে না।
মানুষের মন জুগিয়ে চলতে নাই বা পারুক,কিন্তু জীবনের কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মন বুঝে তো চললেও পারে!!অন্তত সৌরর মনের দিকটা ও বুঝবে না!?কিন্তু ও সবসময় নিজের দিকটাই ভাবে....আর পারলো না সৌর।ধৈর্য হারিয়ে ফেললো....

-হোয়াট!!কি বললে তুমি?তোমায় উদ্ধার করে দিয়েছি!!
-তো কি বলবো মিছরি?!তোমার নাচের ক্লাস,
তোমার জিম,তোমায় যোগা,তোমার টিউশন,তোমার পার্লার,তোমার সব থাকতে পারে,আমার থাকতে পারে না?!আমার বন্ধুবান্ধব,আমার খেলা,আমার আড্ডা,আমার চায়ের দোকানের জমাটি আসর,সব আছে!তুমি ছাড়াও আমার একটা জীবন আছে মিছরি....
-হ্যাঁ তো থাকুক না!!আমি তো তোমার পরিসরের মধ্যে ঢুকছি না সৌর।কিন্তু তুমি যখন আমাকে ডেকেছো,আমি আশা করবো,এই সময়টুকু তুমি আমাকেই দেবে।এই সময়টুকু তুমি সম্পূর্ণ আমার।আমাদের ব্যক্তিগত সময়ের মধ্যে তোমার বন্ধুরা আসবে কেন?ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায়,বন্ধুত্ব বন্ধুত্বের জায়গায়।
-ওরা আমার জীবন মিছরি!সমু একটা ক্রাইসিসের মধ্যে আছে।সেইজন্য আমিও ভালো থাকতে পারছি না।মনটা ভালো নেই আমার।একটু বোঝার চেষ্টা করো আমায়।তোমাকে কি সব বলে-বলে বোঝাতে হবে সোনা?তুমি আমায় বুঝবে না?!আমার জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টে বাবা-মায়ের পরেই ওরা আছে,আমার বন্ধুরা....

গলা কেঁপে গেলো সৌরর....মিছরি এগিয়ে এলো সৌরর কাছে,দৃঢ়কণ্ঠে বললো,
-আমি প্রায়োরিটি লিস্ট খুব ভালোভাবে বুঝি সৌর।আমার জীবনেও অনেক কিছুর প্রায়োরিটি আছে।কিন্তু তাদের আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে দিই না।প্রত্যেকের জায়গা আলাদা।আমার জীবনেও সবকিছুর গুরুত্ব সমান।আমার বাবাই-মা,আমার নাচ,আমার কেরিয়ার,তুমিও....আমি সবকিছুকে একসঙ্গে নিয়ে চললেও,কেউ কারোর পরিসরে ঢুকবে না।কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আমার নাচের ক্লাস থেকে সময় কমিয়ে,টেনে-হিঁচড়ে তোমার জন্য সময় বের করেছিলাম সৌর।তাতেই আমার জীবনে তোমার মূল্য ঠিক কতখানি,এটা তোমার বুঝে যাওয়া উচিত ছিলো!বাই....
-এভাবে যেও না প্লিজ মিছরি!
-এই ছাড়ো তো!!

সৌরর হাতের মধ্যে থেকে নিজের হাতটা টেনে বের করে নিলো মিছরি....

-প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ,এতদিন পর দেখা হলো,শুধু ঝগড়া করেই চলে যাবে!?প্লিজ না....

সৌর ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে টেনে নিয়ে গেলো আবার নিজেদের জায়গায়....
-উফফ!ছাড়ো সৌর!
-উঁহু!
-যেতে হবে আমাকে।আন্টি এসে বসে থাকবে।
-আর একটু....

সৌর মিছরিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো....প্রচন্ড তেজের চোটে কিছুক্ষণ দাপিয়ে স্থির হলো তিলোত্তমা।দুহাতে আঁকড়ে ধরলো সৌরকে....
-তোমায় আমি ভালোবাসি মিছরি!তোমার কাছে এসেই তো আমি সব বলবো বলো!!তুমি এমন কোরো না আমার সঙ্গে।একটু আমাকে বোঝার চেষ্টা করো....প্লিজ...
-আচ্ছা ঠিক আছে।বাদ দাও ওসব।বাইরের ঝামেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে যত্তসব উটকো ঝামেলা!!ছাড়ো!

তিলোত্তমা সৌরকে টেনে তুলে ওর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
-ঠিক আছে?খুশি তো?!এবার আমি যাই?
-হুম।এসো!মিছরি শোনো....
-কি?
-আমার পরীক্ষার পর তুমি আমায় কিছু বলবে বলেছিলে....তোমার স্বপ্নের কথা...
-হুম,বলবো তো।একদিন বাইরে কোথাও মিট করো।সব বলবো...এভাবে অন্ধকারে নিজের হাত-পা দেখতে পাচ্ছি না,তোমায় দেখতে পাচ্ছি না,মশার উৎপাত,এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে বলতে পারবো না....সরি....

হেসে ফেললো সৌর....
-আচ্ছা,আমার বন্ধুরা তো তোমায় সেভাবে সামনাসামনি কখনও দেখেনি মিছরি।ওরা বলছিলো,তোমার সঙ্গে আলাপ করবে।তোমার কি একটু সময় হবে?মানে তুমি যদি আমার সঙ্গে আসো,আমার খুব ভালো লাগতো।
-সময়টা জানিয়ে দিও।আমি ওই সময় ফ্রি থাকলে,ভেবে দেখবো।
-ওকে!
-বাই!

দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো তিলোত্তমা।ওর নাচের ক্লাস আছে।আজ আর পিছন ঘুরে সৌরকে দেখার সময় হলো না ওর।তাই ও জানতেই পারলো না,যে ও গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত,সৌর ওর দিকেই চেয়েছিলো....

দরজা খুলেই কেঁপে উঠলো সমুর মা।দরজার সামনে মাথা নীচু করে ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।একটা কথাও বললেন না উনি।কাল থেকে সমুর বাবার সঙ্গে অশান্তিতে-ঝামেলায় ক্লান্ত উনি।কেঁদে-কেঁদে চোখমুখ ফুলে গেছে।আজ ছেলেকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছেলের বুকে।কেঁদে ফেললেন হু-হু করে....সমু দুহাতে জড়িয়ে ধরলো মাকে,

-তুই কি করলি বাবা?!শেষ পরীক্ষাটা দিলি না!!গোটা বছরটা নষ্ট করে ফেললি?!তোর বাবা তো কাল থেকে আমাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে।দিনরাত বাড়িতে বসে থেকেও আমি নাকি তোকে মানুষ করতে পারিনি।তোকে স্বেচ্ছাচার করতে দিয়েছি।ছেলে কোথায় যাচ্ছে,কি করছে,কোনোদিকে হুঁশ নেই আমার।আমার আর ভালো লাগে না সমু!!এবার তুই গান ছেড়ে দে বাবা!এই গান-গান করে সংসারে এত্ত অশান্তি।রান্না-খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে....

চুপ করে গেলেন সমুর মা।ততক্ষণে সমুর বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন।মাকে ছেড়ে সমুদ্র এগিয়ে গেলো বাবার সামনে।মাথা নীচু করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।একটাও কথা বললো না,মাথা তুলে শুধু একবার বলতে গেলো "সরি বাবা!!" কিন্তু সমুদ্র মুখ খোলার আগেই ওর বাবা সজোরে একটা চড় মেরে বসলেন ছেলের গালে....

-ও কি করছো তুমি?এতবড় ছেলের গায়ে হাত তুলছ?
-অনেক দেরি করে ফেললাম এটা করতে।অনেক আগেই করা উচিত ছিলো।তাহলে আজ নিজের এতবড় ক্ষতিটা করার সাহস ও পেতো না....

চোখের জল পড়ে সমুদ্রর চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে।চুপ করে পড়ে-পড়ে বাবার হাতে মার খেতে থাকলো ও।একটাও কথা বললো না।মা টেনে সরিয়ে নিতে গেলেন ছেলেকে।কিন্তু উনি সামনে পড়ে যাওয়ায়,আঘাতটা ওনার ওপরেই এসে পড়লো।সমুদ্র টেনে সরিয়ে দিলো মাকে।
-মা তুমি সরে যাও...
-হ্যাঁ,সরে যাও তুমি!ওই দেবে আমার সব প্রশ্নের উত্তর।বল,স্কুলের মাইনে,টিউশনের মাইনে,বইপত্র-খাতাপত্র,গোটা একটা বছরের এত খরচ,আমার এত পরিশ্রম,তুই এইভাবে শেষ করে দিলি কেন?!যখন যা চাইছিস তাই,যখন মুখ ফুটে যেটা বলছিস,সেটাই তোর মুখের সামনে এনে হাজির করে দিচ্ছি আমি।তুই শুধু পড়াশোনাটা ঠিকমতো কর।নিজের ভবিষ্যৎটা তৈরি কর।আর কোনো কিছুর চিন্তা তোকে করতে হবে না।বাকি সবটা সামলে নেবো আমি!আর তুমি ছেলে বাপের জমিদারি দেখেছো,তাই না!!দিনরাত এক করে,ওভারটাইম করে সবদিক বজায় রাখার চেষ্টা করছি আমি।পেটেও খাচ্ছি,তোর ভবিষ্যতের জন্যও টাকা রাখছি,নিজেদের বৃদ্ধ বয়সের কথা ভাবছি,যাতে কাল তোর পরিবার হলে,তোর ওপর বেশি চাপ না পড়ে।রোগের চিকিৎসা,লোক-লৌকিকতা,আত্মীয়-স্বজন,দায়িত্ব-কর্তব্য,একজন পুরুষের জীবন সম্পর্কে কি জানিস তুই?কতটুকু জানিস?!নিজের বাড়িতে আছো,মাথার ওপর ছাদ আছে,পায়ের তলায় মাটি!অমনি মনে করছো এটাই বোধহয় নিশ্চিন্ত জীবন!এভাবেই জীবনটা কেটে যাবে।শুধু নিজের বাড়ি থাকলেই হয় না সমু!!ভবিষ্যতে কি বাড়ি কামড়ে খাবি?!তুই যখন তোর বর্তমানে উড়ে-উড়ে বেড়াচ্ছিস,আমি তখন আমার এই মস্তিষ্কে তোর ভবিষ্যৎ তৈরি করছি।আর মনে-মনে ভাবছি,তুই নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে,আমার পাশে এসে দাঁড়াবি।আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবি।মুখ বন্ধ করে সব করে যাচ্ছি বলে,বুঝতেও পারিস না,বাস্তবটা কতটা কঠিন!আরাম করে নরম বিছানায় শুয়ে গায়ক হবো,নায়ক হবো,ওইরকম অনেক দিবাস্বপ্ন দেখা যায়।দুদিন বাবার হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখো,বুঝে যাবে পৃথিবীটা কত কঠিন!!একটা পয়সা রোজগার করতে,কিভাবে মানুষকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়....

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র....
-বুঝেছি তো বাবা!খুব খিদে পাচ্ছিলো আজ।কেউ ডেকেও জিজ্ঞেস করেনি,ফিরেও তাকায়নি আমার দিকে।কেউ ওপর থেকে টেনে এনে খাওয়ার জন্য সাধ্যসাধনাও করেনি।তোমরা দুজন ছাড়া,পৃথিবীতে কেউ যে আমার খবর নেবে না,আমার থাকা না থাকায়,কারোর যে কিচ্ছু যাবে আসবে না,আমি জানি তো বাবা!!কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি না খেতে পেয়ে মরে গেলেও,জীবনে কিচ্ছু করতে না পারলেও,গান কিছুতেই ছাড়তে পারবো না।আমি মরে যাবো বাবা!!গান ছাড়ার থেকে,তুমি বরং আমাকে মারতে-মারতে মেরেই ফেলো....
-তোর লজ্জা নেই,নারে সমু?!এত বলার পরও,এত মার খাওয়ার পরও,ওই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস!!তুই এই দিনটা আর জীবনেও ফিরে পাবি?পরীক্ষাটাই দিলি না?!আমি তো ভাবতেই পারছি না!আমার অফিস কলিগরা,আত্মীয়-স্বজনরা জিজ্ঞেস করলে,কি বলবো আমি?!ছেলে আমার কাল গায়ক হবে,সেইজন্য আজ পরীক্ষা দেয়নি!!

কোনো উত্তর দিতে পারলো না সমুদ্র....চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলো বাবার সামনে।বাবা মারতে-মারতে ওকে দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিয়েছিলো।মা কেঁদেই যাচ্ছে তখন থেকে....

-নাঃ!!তোকে আর কিচ্ছু বলার নেই সমু!ভেবেছিলাম,ছেলেটা আমার বড় হয়ে বাবার কষ্টটা অন্তত বুঝবে।কিন্তু আর কোনো আশা নেই এর কাছে।আমি একটা অকালকুষ্মান্ড জন্ম দিয়েছি....

দৌড়ে ঘরে চলে গেলো সমুর বাবা...কাঁদতে-কাঁদতে সমুদ্র মেঝেতেই বসে পড়লো।বাবার হাতে মার খেতে-খেতে ওর শার্ট ছিঁড়ে গেছে।মা এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।মায়ের কোলে মাথা গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো সমুদ্র...

রাতে মা ওপরে এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে সমুদ্রকে।বাবা নাকি রাতে কিছুই খায়নি।মা-ও হয়তো খাবে না।বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়েছিলো সমুদ্র।বাবা এত মেরেছে,সারা গা ব্যথা করছে ওর।জ্বরও এসে গেছে মনে হয়।মাথা-গা-হাত-পা সব শিরশির করছে।ফোনটা বেজেই যাচ্ছে তখন থেকে।ঋষি-রূপ দুজনের সঙ্গেই কথা হয়েছে।ওদের মিথ্যে বলেছে সমুদ্র।এতসব ঝামেলার কথা আর কিছুই জানায়নি ওদের।কিন্তু এতক্ষণ সৌরই একবারও ফোন করেনি।এবার ফোন বাজতেই সমুদ্র বুঝতে পারলো,ফোনটা সৌরই করছে।ও আর স্ক্রিনের দিকে চাইলোও না।ফোনটা ধরেই বললো,
-বল!
-তুই বল!!
-কি বলবো?
-সব ঠিক আছে?
-হুম!

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৌর বললো,

-কাকু তোর গায়ে হাত তুলেছে,নারে সমু?

আর কোনো উত্তর দিলো না সমুদ্র।ফোনটা মুখের সামনে চেপে ধরে হু-হু করে কেঁদে উঠলো শুধু....সৌরর বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো অজানা যন্ত্রণায়....

দিন তিনেক হয়ে গেছে সমুদ্রর সঙ্গে ওর বাবা কথা বলেন না।খুব প্রয়োজন ছাড়া সমুও খুব একটা নীচে নামে না।বাবা বাড়িতে থাকলে তো একেবারেই না।মা যতটা পারে,সমুকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে।সমু নিজে থেকে চায়নি।কিন্তু মা নিজেই গিটারটা ওপরে দিয়ে গেছে।বাবাকে ঠিক বোঝে না সমুদ্র।বাবা ওকে ক্ষমা করেছে কিনা,সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহসও ওর নেই।সেদিন দুপুরে ও গানের ডায়েরীটা খুলে চুপচাপ শুয়েছিলো বিছানায়।মাথার কাছের জানলাটা খোলা ছিলো।সেইদিকে একভাবে চেয়েছিলো ও।মাথায় ঘুরছিলো একাধিক শব্দের খেলা....হঠাৎ করে সৌর ফোন করলো ওকে,
-হুম?
-বিকেলে বেরোবি!
-নাঃ!
-আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি না সমু,বলছি!বিকেলে তুই বেরোবি!!দিনরাত ঘরের মধ্যে পড়ে আছিস কেন?আমরা কি মরে গেছি!
-আমি বেরোবো না!
-ঠিক আছে।আমি,ঋষি,রূপ তোর বাড়িতে আসছি।আমার সঙ্গে মিছরিও থাকবে।
-আবে তুই পাগল নাকি!!বাড়ির পরিস্থিতি ভালো না....
-তাহলে চুপচাপ বেরিয়ে আয়,সিসিডিতে।ঋষি আর রূপ অনেকদিন ধরেই মিছরির সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে।তুইও তো ওকে সেভাবে দেখিসনি।কাল থেকে আমরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাবো।ওর ইন্টার-পুল কম্পেটিশন,আমার প্র্যাকটিস,আর নিজেদের জন্য,তোদের জন্য খুব একটা সময় থাকবে না।তাই চলে আয় আজ।বিকেল পাঁচটা....না আসলে মনে থাকে যেন,সবশুদ্ধ তোর বাড়িতে গিয়ে উঠবো কিন্তু!
-আসবো-আসবো!!
-গুড!চল বাই!!

-ইয়ে মানে,একটু বেশিই ছোট না মিছরি?!

গাড়ির পিছন দিকের দরজাটা খুলে দিয়েছিলো তিলোত্তমা।গাড়িতে ঢোকার আগেই ওর উন্মুক্ত উরুর দিকে চেয়ে সৌর বলে উঠলো।তিলোত্তমার সাদাকালো রঙের ফিতে দেওয়া টপটায়,ঠিক বুকের ওপরে লেখা রয়েছে,"বি ইয়োরসেলফ!"সেইসঙ্গে ফেডেড-জিন্সের একটা হটপ্যান্ট পরে রয়েছে ও।মানে শরীরের নিম্নাঙ্গে যতটুকু আবরণ একেবারেই না থাকলে নয়,ঠিক ততটুকুই অংশই আবৃত।বাকি উরু সম্পূর্ণই উম্মুক্ত।গাড়িতে ঢুকতে গিয়েই মিছরিকে দেখে থমকে গেলো সৌর....

-হোয়াট?এটা ফ্যাশন সৌর!!কাম ইন!

তিলোত্তমা সৌরর একটা হাত ধরে গাড়ির ভিতর দিকে টানলো।সৌর গাড়িতে বসে বললো,
-শুধু আমার সঙ্গে বেরোলে কোনো ব্যাপার না!কিন্তু আমার বন্ধুগুলো তো,সব এক-একটা জিনিস!মুখ খুললে আর বন্ধ হয় না।তাই বলছিলাম আর কি...

প্রত্যুত্তরে একটু হাসলো তিলোত্তমা।ড্রাইভারকে বলে উঠলো,
-চলো কাকু!
বলেই একটু হেসে সৌরর হাতটা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে গুছিয়ে বসলো তিলোত্তমা...সৌর মিছরির দিকে একবার গভীরভাবে চাইলো।তারপরই হাত রাখলো তিলোত্তমার মসৃণ অনাবৃত উরুতে....

-এ ভাই,এরা কখন আসবে রে ভাই?গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করাবে বলে ডাকলো,এখন নিজেদেরই তো আর পাত্তা নেই।কখন থেকে এসে বসে আছি!

সিসিডিতে বসে বিরক্ত হয়ে রূপ বলে উঠলো।বেশ কিছুক্ষণ আগে ওরা তিনজনই পৌঁছে গেছে...সমুদ্র একভাবে মাথা নীচু করে চেয়ে রয়েছে ফোনের স্ক্রিনের দিকে।মুখটা গম্ভীর....

-দাঁড়া!সঙ্গে মেয়ে থাকবে।তার রেডি হতে-হতে দেখবি,এক ঘন্টা!!লিখে রাখ রূপ,ওই ছটার আগে সৌর ঢুকতেই পারবে না!এখন তো আর ভাই আমাদের সিঙ্গেল নেই....

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ঋষি বলে উঠলো...

-ভাই রঞ্জার সঙ্গে কেসটা সাল্টে গেলে,তুইও সিঙ্গেল থাকতিস না।তখন আমরাও আওয়াজ দিতাম!
-ও বাবা!ছেলের গায়ে লেগে গেলো তো!তা সিঙ্গেলের কথায় মনে পড়লো,নিশা কেমন আছে?
-হ্যাঁ ভালোই আছে!ওর খবরে তোর কি দরকার?
-আরে নিশা তো আমারও বন্ধু নাকি!!বন্ধু হয়ে বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করতে পারবো না?!আশ্চর্য তো!!তুই এত খেপে যাচ্ছিস কেন?ইনসিকিউরিটি?
-এই সমু,ঋষির জন্য একটা মেয়ে দেখ তো ভাই।সিঙ্গেল থেকে-থেকে ওর মাথাটা গেছে....
-ওই ওটা সৌর না?!

ঋষির কথায় বাকি দুজনই একসঙ্গে কাঁচের বাইরে চোখ রাখলো।সৌর নামার পরই গাড়ি থেকে নামলো তিলোত্তমা।ওইদিকে একবার মাত্র দেখেই মাথা নামিয়ে নিলো সমুদ্র।আবার মন দিলো মুঠোফোনে।কিন্তু ঋষি হাঁ করে চেয়ে রয়েছে ওইদিকেই....
-কি দেখতে রে রূপ!একেই কি সেদিন আমরা মাঠে দেখেছিলাম?অন্ধকারে তো বুঝতেই পারিনি রে সেদিন!একে সৌর কোথায় পেলো রে!?এ মেয়ে না ট্রফি?একে নিয়ে এভাবে রাস্তায় বেরিয়েছে কেন?আমি হলে তো শো-কেসে সাজিয়ে রাখতাম,আর দিনরাত শুধু দুচোখ ভরে দেখতাম!!ভাই লেগস দেখ ভাই!
-উউ ঋষি!ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড!

গম্ভীরভাবে বললো সমুদ্র....

-এই তুই থাম তো!!এইরকম পা-ই তো দেখাতে হয়!এই সৌর কই রে?
-মেয়েটার পাশেই আছে ভাই!তোর ফোকাস একজায়গায় আটকে গেছে।একটু ওপর দিকে দেখ,চোখটা ফিরিয়ে দেখলেই বুঝবি,সৌর ওর পাশেই আছে।

বলেই হেসে ফেললো রূপ....

-উফফ!মানে,সত্যি!কেন সৌরর মতো ছেলে পাগলামি করবে না বল?!ভাই ওটা স্কিন না টিউবলাইট,ওইরকম জ্বলছে কেন?
-আবে ঋষি!!

দুম করে একটা উড়ন্ত চাঁটি এসে পড়লো ঋষির মাথায়।ধমকে উঠলো সমুদ্র,
-তখন থেকে বলছি ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড!ঠিকভাবে দেখ,ঠিকভাবে দেখ....
-আরে কি ঠিকভাবে দেখবো ভাই!!আমি তো চোখই সরাতে পারছি না।তুই বল রূপ,আমি সিঙ্গেল তো?
-একদম!!একশো শতাংশ!
-আর ওটা একটা মেয়ে,ভীষণ সুন্দরী মেয়ে।সবাই এগ্রি করবি তো?
-হ্যাঁ,এই ব্যাপারে আমি তোর সঙ্গে সহমত পোষণ করছি ঋষি।সুন্দরকে সুন্দর বলতেই হয়।

রূপ বললো,কিন্তু সমুদ্র চুপ করেই রইলো...

-ওকে,আমি সিঙ্গেল,আর ও সুন্দরী একটা মেয়ে,হোক না সৌরর গার্লফ্রেন্ড।সেটা হয়ে গেছে।ওটাতে তো আর কারোর কিছু করার নেই।কিন্তু সৌরর গার্লফ্রেন্ড বলে কি,দূর থেকে একটু প্রাণভরে দেখতেও পারবো না?!আমি সিঙ্গেল,ও সুন্দরী।সেজন্য আমি দেখবোই।পারফেক্ট লজিক না রূপ?
-কি বালের লজিক রে ভাই!!মানে সিঙ্গেল বলে,বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকেও দেখবো?!

হেসে উঠলো রূপ...

-এই চুপ!সৌর ঢুকছে...

সমুদ্রর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে ঋষি মুখটা বন্ধ করলো ঠিকই,কিন্তু চোখদুটো অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওদের দিকেই...

কাঁচের দরজা ঠেলে সৌর ভিতরে ঢুকলো তিলোত্তমাকে সঙ্গে নিয়ে।ওরা এলে সবাই একসঙ্গে চেয়ারে বসলো।তিলোত্তমার উপস্থিতিতে মাতাল করা একটা সুগন্ধী ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে।ওই সুগন্ধী কিছুদিন আগে সৌরই ওকে উপহারস্বরূপ দিয়েছে।সবাই বসলে সৌরই কথা শুরু করলো,
-ওকে,লেট মি ইন্ট্রোডিউস....রূপায়ণ,সমুদ্র,ঋষভ।অলসো নোন এজ,রূপ,সমু এন্ড ঋষি...এরা সবাই আমার বন্ধু!আর ইনি হচ্ছেন আমার ওয়ান এন্ড অনলি গার্লফ্রেন্ড,তিলোত্তমা সান্যাল!
-হাই....
-হ্যালো!!

বাবা দুপুরবেলা বাড়িতে ভাত খেতে গিয়েছিলো।তাই ওই সময়টা কিছুক্ষণ দোকানে গিয়ে বসেছিলো রূপ।তারপর ওখান থেকেই সোজা এখানে বেরিয়ে এসেছে।এখন ওর গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে।ব্যাগ থেকে ছোট একটা জলের বোতল বের করলো রূপ,একটু জল খাবে বলে।সেই সময়ই টেবিলের ওপর রাখা নিজের আইপ্যাডটা একটু সরিয়ে রেখে গুছিয়ে বসে,তিলোত্তমা আদুরে গলায় বলে উঠলো,
-তোমাদের রূপ-ঋষি-সমুর মতো আমারও কিন্তু একটা সুন্দর নাম আছে।সৌরও আমাকে ভালোবেসে ওই নামেই ডাকে...আমার আর একটা নাম মিছরি!!

হেসে উঠলো ঋষি।তিলোত্তমা ঠিক ওর পাশের চেয়ারেই একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে বসে আছে,ওর ওপাশে সৌর বসে।ঋষি একবার তিলোত্তমার দিকে চেয়ে বলে উঠলো,
-ওয়াও!!
-এক্সকিউজ মি?!

তিলোত্তমার কথায় ঋষি তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-না মানে....ওয়াও!!কি অদ্ভুত মিল না রূপ!?জানো তো মিছরি,আমাকেও তো আমার বন্ধুরা মাঝে-মধ্যে ভালোবেসে পিঁপড়ে বলে ডাকে!!

বোতল খুলে সবে একটুখানি জল মুখে দিয়েছিলো রূপ।বিষম খেয়ে সবার সামনে বিচ্ছিরিভাবে ছড়িয়ে ফেললো।হেঁচে-কেশে সাংঘাতিক অবস্থা ওর।ও তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে,সরে গেলো ওখান থেকে।সমুদ্র ঋষির দিকে এমনভাবে চেয়ে রয়েছে,পারলে ওকে গিলেই খায়,চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছে।সৌর ঠান্ডা দৃষ্টিতে সরাসরি তাকালো ঋষির দিকে।পকেট থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো মিছরির হাতে।হঠাৎ করে রূপ বিষম খাওয়ায়,একটু-আধটু জল ছিটকে আসতে পারে ওর গায়ে।সবার মুখের দিকে একবার মাত্র চেয়ে,প্রাণখোলা হাসি হেসে গড়িয়ে পড়লো তিলোত্তমা....

(চলবে.....)

ছবি: সংগৃহীত

অসমাপ্ত (নবম পর্ব)




 অসমাপ্ত

নবম পর্ব


সাথী দাস


মাঝে আর মাত্র কাল দিনটাই।পরশুদিনই জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা সমুদ্রর।ভয়ে আর উত্তেজনায় ওর মস্তিষ্ক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে।তবু যদি বাবা-মায়ের দিক থেকে একটু উৎসাহ পেতো,তবে ওদের পুরো ব্যাপারটা খুলে বলা যেতো।কিন্তু সেই দিকেও তো অসহায় সমুদ্র।ভয়ের চোটে কেঁদেই ফেললো ও।পরীক্ষা না দিলে জীবনে কি লাভ-ক্ষতি হবে,সেইসব হিসেব জানা নেই সমুদ্রর,কিন্তু বাড়ি যে কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে,এটা অবধারিত।সেটা ভাবলেই ওর সারা শরীর কাঁপছে।আর এতদিন ধরে বুকের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্ন!!সেটাও তো হাতছাড়া হয়ে যাবে।বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো সমুদ্র....কানে বাজছে তারই কণ্ঠস্বর....

"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"

"ভালো করে পরীক্ষাটা দিও সমুদ্র।কিন্তু গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও..."

সমুদ্র বিছানায় উঠে বসলো।সামনে খুলে রাখা ইংরেজি বইটা বন্ধ করে দিলো।আবার সে কানের মধ্যে বলে উঠলো,

"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"

কেঁদে ফেললো সমুদ্র।
-সরি ম্যাম!আসবে না!!সরি!!আই এম সো সরি...

বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো সমুদ্র।নিজের ওয়ার্ডরোব খুলে জমানো টাকার ব্যাগটা নামিয়ে নিলো।হিসেব করে দেখলো,যা টাকা আছে তাতে যাতায়াত হবে,ট্রেনের ভাড়া,আনুষঙ্গিক খরচ,এমনকি খাওয়া খরচটাও হয়ে যাবে।কিন্তু অডিশনের এন্ট্রি-ফির অতগুলো টাকা তো হবে না।সব টাকাগুলো গুছিয়ে একজায়গায় রেখে কাঁপতে-কাঁপতে ফোনটা হাতে তুলে নিলো সমুদ্র...বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।ভালোভাবে চোখ মুছে নিয়ে একটা নম্বরে ফোন করে ফোনটা কানে ধরলো,ওপাশ থেকে ঘুমজড়ানো অবস্থায় ভেসে এলো সৌরর কন্ঠস্বর,

-হুম!বল ভাই!
-ঘুমিয়ে পড়েছিলি সৌর?
-না ভাই,ছেনি-হাতুড়ি-করাত দিয়ে আরশোলার ব্যবচ্ছেদ করছিলাম,চাটনি করে তোকে খাওয়াবো বলে।শালা রাত তিনটের সময় ফোন করে জিজ্ঞেস করছে,ঘুমোচ্ছি কিনা!!বাল আমার গার্লফ্রেন্ডও তো এত রাতে ফোন করে না...
-ভাই....

কান্নারা এসে কথা আটকে দিলো সমুদ্রর...টেনে ঘুমচোখ ছাড়ালো সৌর....
-এই সমু!কি হয়েছে তোর?
-তোর সঙ্গে একটু কথা বলবো!
-হ্যাঁ বল না!!কি হয়েছে?তুই কাঁদছিস কেন?

কান্নারা গলা বুজিয়ে দিচ্ছে দেখে,সমুদ্র বললো,
-আমি একটু পরে ফোন করছি!
-আবে এখনই বল।ফোন রাখলে আমি কিন্তু তোর বাড়িতে চলে আসবো বলে দিলাম!
-নানা!বলছি-বলছি....
-বল!
-তুই একদিন আমাকে গিটার কিনে দিবি বলেছিলি,মনে আছে?!দিবি রে?

কেঁদেই ফেললো সমুদ্র...হতবাক সৌর...

-কি হয়েছে সমু?!
-বাবা আমার গিটার ভেঙে দিয়েছে।ওই গিটারটা আমার জীবন রে!ম্যামকে নিয়ে লেখা,সবকটা গানের সুরের জন্মদাতা ওই গিটারটা।আমি গিটার ছাড়া একটা মুহূর্তও বাঁচতেই পারবো না।বাবার সঙ্গে আজ ঝামেলা হয়েছে।বাবা গিটার আছাড় মেরে ভেঙে দিয়েছে।আমি আবার নতুন গিটার কিনবো।কিছু টাকা দিতে পারবি?পকেটমানি থেকে আস্তে-আস্তে শোধ করে দেবো....
-ওই টাকা শোধ করলে তোকে তোকে রাস্তায় ফেলে মার্ডার করে দেবো!কত টাকা চাই বল?
-আপাতত হাজার চার-পাঁচেক!
-ঠিক আছে।ছ-হাজার দিয়ে দেবো।আমি নিজে কাল তোকে নিয়ে গিয়ে গিটার কিনে দেবো।ওটা আর বাড়িতে ঢোকাতে হবে না।আমার কাছেই রাখবি।এখানে রেখে নিশ্চিন্ত মনে পরশুদিন পরীক্ষা দিতে যাবি।ঠিক আছে?
-নানা!পরীক্ষার পরেই কিনবো,এখন না।আসলে টাকাটা নিজের কাছে রাখতে চাইছিলাম।পরীক্ষা শেষ হলেই কিনতাম।তোর যদি অসুবিধে হয়,তো থাক!দিতে হবে না...
-এই ফালতু কথা কম বল তো!কাল টাকা নিয়ে যাচ্ছি তোর বাড়ি!
-নানা,আমি আসছি!
-আচ্ছা ঠিক আছে,আয়!
-সৌর?
-বল!
-ভাই টাকাটার কথা কিন্তু বাবা-মাকে জানাস না!
-নিশ্চিন্তে থাক ভাই!
-হুম!থ্যাঙ্কু!!
-দেবো না টাকা,নেই!আমি ভিখারি!
-কি হলো আবার?
-থ্যাঙ্কু কিসের?
-আচ্ছা সরি,আর বলবো না!
-আবার সরি?
-উফফ!গুড নাইট!হলো?ঠিক আছে এবার!
-আর গুড নাইট!ঘুম তো ভেঙেই গেছে!তুই রাখ,আমি দেখি,আমার জনের একটু ঘুম ভাঙাই।একই বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা টাইগার আর টাইগ্রেস দুজনেই আজ আমার ফোনের শব্দ পেয়ে জেগে উঠবে।উফফ!রাজকন্যার ঘুমে আবিষ্ট গলাটা শুনতে,আমার না দারুণ লাগে!!আর কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়লে তো আরও ভালো,আলাদাই ভালোলাগা...চল টাটা।চলে আসিস কাল।টাকা নিয়ে এত চিন্তা করিস নাতো!তোর ভাই আছে তো,নাকি!
-হুম!!জানি,তাই তো তোকেই ফোন করলাম।রাখছি...
-বাই!!

ফোনটা রেখে অভিব্যক্তিহীন হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো সমুদ্র।আজ পর্যন্ত জীবনে কোনোদিন ও সৌরকে মিথ্যে কথা বলেনি।বাবা-মাকে নিয়ে তো নয়ই।কিন্তু ওর সামনে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।টাকাটাও লাগবে,আর ব্যাপারটা ওকেও জানানো যাবে না।তা হলেই বাবা-মার কানে খবর পৌঁছে যাবে....উঠে স্কুলব্যাগটা টেনে নামালো সমুদ্র।এক-এক করে ভরে নিতে লাগলো দু-একটা জামাকাপড়,আইডেন্টিটি প্রুফ সহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র....তারপর বসলো ট্রেনের নির্ধারিত সময় দেখতে....চার ঘণ্টার রাস্তা।দিনের দিন পৌঁছতে গেলে যে সময়ে ট্রেন রয়েছে,তাতে গেলে নির্দিষ্ট সময়সীমার একেবারে শেষ মুহূর্তে পৌঁছবে সমুদ্র।আর ট্রেন লেট করলে তো আর কথাই নেই।তাই আগের দিন রাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে,অর্থাৎ কালই।ওখানে যদি থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকে,তো সারারাত প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমেই কাটিয়ে দেবে ও।তারপর সকালে উঠে চলে যাবে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে....গুগল ম্যাপে জায়গাটা ভালোভাবে দেখে রাখলো সমুদ্র....ট্রেন থেকে নেমে আবার হয়তো ট্যাক্সি নিতে হবে,বা যদি বাস বা অটো কিছু যায়।হাতে মোটামুটি সময় থাকলে,যাতায়াতে অহেতুক বেশি টাকাপয়সা খরচ করা যাবে না।কম খরচ করে যতটা টাকা হাতে রাখা যায়।কারণ,রাস্তাঘাটে কোনো বিপদে পড়লে সাহায্য করার মতো,কেউ ওর সঙ্গে থাকবে না...

-আজ রাতে সৌরর বাড়িতে থাকবো বাবা!কাল ওখান থেকেই দুজনে পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে যাবো।ওই বাড়ি থেকে তো আরও কাছেই।একসঙ্গে লাস্ট-মোমেন্ট কয়েকটা জিনিস একটু আলোচনাও করার আছে...

সৌরর বাড়ি থেকে টাকাটা নিয়ে,বাড়ি ফিরেই দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে বাবাকে কথাটা বললো সমুদ্র।ও জানে,সৌরর কাছে যাওয়ার কথায়,বাবা কোনোদিনও না বলবে না।আজও তার অন্যথা হলো না....বাবার অনুমতি নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো সমুদ্র....বুকের ভিতরে এত জোরে ঢিপঢিপ করছে,যে ও নিজেই সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে...হাত-পা হিমশীতল....কম্পিউটারটা অন করে একবার ও চোখ রাখলো ওয়ালপেপারে।টিচার্স ডে-তে এই গ্রুপ ছবিটা তোলা হয়েছিলো।সমস্ত স্যার-ম্যামদের সঙ্গে রানী ম্যামও জ্বলজ্বল করছেন ছবিতে।ওনার কারণেই এই ছবিটা চোখের সামনে রেখেছে সমুদ্র।কম্পিউটার স্ক্রিন তথা ছবিটার ওপর হাত রাখলো ও।তারপর ধীরে-ধীরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো রানী ম্যামের ছবিটুকুর ওপরে।

-সরি!আমি আপনার প্রথম কথাটুকু রাখতে পারলাম না ম্যাম!এ প্লাস আসবে না।তবে আমি আপনার একেবারে অবাধ্য ছাত্র নই।আপনি তো জানতেও পারলেন না,আপনার শিক্ষিকা-জীবনের সবচেয়ে বাধ্য ছাত্র হয়তো আমিই!আপনার এক কথায় একলব্যের মতো শুধু আঙুল নয়,জীবনও দিয়ে দিতে পারতাম।কিন্তু আজ ওই কথাটুকু রাখতে পারলাম না ম্যাম।তবে আপনার পরের কথাটুকু কিন্তু আমি শুনছি।গান আমি ছাড়ছি না।আমি যা মন থেকে চাই,তাই নিয়েই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছি....প্লিজ,কেউ আমায় বুঝবে না ম্যাম।আপনি অন্তত আমায় ক্ষমা করে দেবেন!!

আরও একবার রানী ম্যামের ছবিতে হাত বুলিয়ে,মেইলবক্স খুলে নির্দিষ্ট ই-মেইলটার প্রিন্ট বের করে ব্যাগে ভরে নিলো ও।তারপর কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়ে,গানের ডায়েরীটা একবার খুললো।আজও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে চুরি করা শুষ্ক গন্ধহীন রক্তগোলাপ!!একবার ওটাতে হাত বুলিয়ে,ডায়েরীটা ব্যাগের মধ্যে ফেলে নিলো সমুদ্র....

ব্যাগটা পিঠে নিয়ে একটা হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে,সমুদ্র বাবা-মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো....

-লাস্ট পরীক্ষা,নিজের বাড়ি থেকেই তো যেতে পারতিস!

একটু দইয়ের ফোঁটা ছেলের কপালে ঠেকিয়ে সমুকে ওর মা বললো...
-আরে একই তো ব্যাপার।সৌরর বাড়ি থেকে তো স্কুলটা আরও কাছে হবে।পড়াশোনার কোনো ব্যাপারে কোনোদিনও ছেলেকে বাধা দেবে না।অন্য কেউ হলে আমি ছাড়তাম নাকি!নেহাত সৌরর মতো ছেলে হয়না!!তুই যা বাবা,ভালো করে কাল পরীক্ষাটা দিস।সকালে বেরোনোর আগে একবার আমায় ফোন করে দিস!
-করবো বাবা!!

মাথা নীচু করে বাবা-মায়ের পায়ে হাত রাখলো সমুদ্র....

"সরি!!কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না।একদিন তোমরা সৌরর মতো আমাকে নিয়েও অনেক গর্ব করবে বাবা!আমি তারই প্রথম ধাপে আমি পা রাখতে যাচ্ছি!আমাকে একটু আশীর্বাদ করো তোমরা...."

বাবা-মাকে প্রণাম করে ব্যাগ পিঠে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো সমুদ্র।

-আশীর্বাদ করি,পরীক্ষা খুব ভালো হোক!
-হুম!

মাথা নীচু করে সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্র।সোজা চলে এলো রেলস্টেশনে...সাইকেল একটা দোকানে রেখে বললো,

-ভিতর দিকে রেখে দিন।কাল রাতের দিকে নেবো!!

প্ল্যাটফর্মে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো সমুদ্র।ট্রেনের অপেক্ষায়,সেইসঙ্গে অজানা ভবিষ্যতের অপেক্ষায়....

ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর,ঘুমোতে যাওয়ার আগে সমুদ্রর মা লক্ষ্য করলেন,ওর ঘরের আলো জ্বলছে।অর্থাৎ মনের ভুলে আলো না নিভিয়েই বেরিয়ে গেছে সমু।ওর মা আবার পায়ে-পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন।ছেলের ঘরে ঢুকে দেখেন ঘরদোর লণ্ডভণ্ড।কোনোদিনই সমুদ্র গোছানো নয়।যেখানে যে জিনিসটা পড়ে থাকবে,সারা সপ্তাহ,পারলে সারা জীবনই সেখানেই ফেলে রাখে।তবু সেটা ও হাতে ধরে সরিয়ে দেখবে না।বরাবরই আপনভোলা বেখেয়ালী সমুদ্র।বকবক করতে-করতে ছেলের বিছানার ওপর থেকে জামাকাপড় সরিয়ে,চাদর ঝেড়েঝুরে,ঘরটা একটু গোছাচ্ছিলেন সমুর মা।কিন্তু পড়ার টেবিলের কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি।টেবিলের ওপরেই যে ছেলের এডমিট কার্ডটা পড়ে রয়েছে,বইয়ের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে!!কাল পরীক্ষা,অথচ কার্ড না নিয়েই মনের ভুলে বেরিয়ে গেছে সমুদ্র।ওটা হাতে নিয়ে লাফাতে-লাফাতে নীচে নামলেন উনি....

-শিগগির ছেলেকে ফোন করো।এডমিট বাড়িতেই ফেলে গেছে।ভাগ্যিস আমি ওপরে উঠলাম।নইলে তো কাল পরীক্ষা দিতে বেরিয়ে গেলে,দিশেহারা হয়ে যেতো ছেলে....

উদিগ্ন বাবা-মা তড়িঘড়ি ডায়াল করতে শুরু করলেন সমুর নম্বর....

ট্রেনের বেশ কিছুক্ষণ দেরিই আছে।ট্রেনে চেপে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাবে সমুদ্র,অজানা-অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াবে।মনের জোরটুকু বাড়ানোর মতোও কেউ নেই ওর জীবনে।ওকে সাহস যোগানোর মতোও কেউ নেই....হঠাৎ করেই পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো।টেনে বের করে একবার দেখে নিয়ে ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো সমুদ্র।স্ক্রিন বারংবার পাগলের মতো বলে চললো,
"কলিং বাবা"....

-হ্যালো,সৌর?
-হ্যাঁ কাকু বলুন!
-বলছি সমু ওর এডমিট কার্ড ফেলে গেছে।ওকে ফোনেও পাচ্ছি না।একটু ওর সঙ্গে কথা বলবো,ফোনটা ওকে....
-মানে?!আমি ওকে কোথায় পাবো?এত রাতে ও কোথায় গেছে কাকু?!

বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সমুর বাবা।কিছুক্ষণ আর কোনো কথাই বলতে পারলেন না...ওনাকে হতভম্ব দেখে ওনার কান থেকে ফোনটা টেনে নিলেন সমুর মা....একটুখানি কথা বলেই কান্না জুড়ে দিলেন হাউহাউ করে....গেলো কোথায় ছেলেটা!?

হাতে আর একটুও সময় নেই।সমুর বাবা-মার সঙ্গে কিছুদিন ধরেই গিটার নিয়ে ঝামেলা চলছিলো।এর মধ্যে আবার ওর বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে।কিন্তু এখানে আসেনি।হাউমাউ করে কাঁদতে-কাঁদতে সমুর মা যে কি বলছে,অর্ধেক কথা সৌর বুঝতেই পারলো না।কোথায় যেতে পারে ও?!হাফপ্যান্ট পরেই ছিলো সৌর।একটা গেঞ্জি টেনে গায়ে গলিয়ে নিয়ে,লাফাতে-লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নামলো ও।নীচে নামতে-নামতেই ওর খেয়াল হলো,ফোনটা পকেটে নিয়েছে,কিন্তু সাইকেলের চাবিটাই তো নেয়নি।সিঁড়ি থেকেই চেঁচালো ও,
-মা আমার টেবিল থেকে সাইকেলের চাবিটা ছুঁড়ে নীচে ফেলো!

ছেলেকে এমন দিশেহারা অবস্থায় বেরোতে দেখে,ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন সৌরর বাবা-মা...
-কিরে?কি হয়েছে রে সৌর?!
-মা,চাবিটা দাও আগে!পরে এসে বলছি!

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সৌর....বলেই বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।ওর মা তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে টেবিল থেকে সাইকেলের চাবি নিয়ে,ছেলের ঘরের বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দিলেন নীচে।ছুটতে-ছুটতে চাবিটা লুফে নিয়েই সাইকেলের লক খুলে,চোখের নিমেষেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো সৌর....

-কখন বেরিয়েছে কাকু?
-অনেকক্ষণ বেরিয়েছে রে বাবা!

ভয়ে কেঁদেই ফেললেন সমুর মা...

-কাঁদবেন না কাকিমা!!আমি দেখছি,আমাদের বাকি বন্ধুদের ফোন করে....

সমুর বাবা-মায়ের ঘরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়েই সৌর কথা বলছিলো ওনাদের সঙ্গে।ফোনটা পকেট থেকে বের করতে-করতেই খোলা দরজা দিয়ে ওনাদের ঘরের দিকে চোখ পড়লো সৌরর।দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সশরীরে গিটারটা দাঁড়িয়ে আছে।একদম গোটা....কেঁপে উঠলো ও।সঙ্গে-সঙ্গে কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো সৌরর।টাকাটা তাহলে ওর দরকার হলো কেন?!কোনো খারাপ নেশা নেই,জীবনে কোনো মেয়েও নেই,যে তার জন্য টাকা ওড়াবে,তাহলে?!

"জানিনা রে সৌর,এইসব ব্যাপারে টাকা চাইলে বাবা দেবে কিনা!!"

"দেখ না কি হয়,ওরা যদি মেইল করে,আমাকে বলিস,আমি হেল্প করবো তোকে...."

সমুদ্র বলেছিলো বটে সৌরকে,বহুদিন আগে,একটা অডিশনের ব্যাপারে।আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলো না সৌর।লাফ দিয়ে ওপরে উঠলো,সমুর ঘরে।চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলো ওর কম্পিউটারে।সমুর ভীত বাবা-মাও ওর পিছন-পিছন এসে দাঁড়ালো ওইখানেই।কম্পিউটার অন হতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো সকল স্যার-ম্যামের সঙ্গে-সঙ্গে রানী ম্যামের ছবিও।একবারের জন্য থমকে গেলো সৌর।তারপর সোজা পৌঁছে গেলো সমুর মেইলের ইনবক্সে।সমুর পাসওয়ার্ড "অলওয়েজ রিমেম্বার" করা থাকায়,কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হলো না সৌরকে।দু-তিনটে অপ্রয়োজনীয় মেইল এর পরই ও পেয়ে গেলো সেই মেইলটা।ওটা পড়তে-পড়তে দম আটকে কান্না পেয়ে গেলো সৌরর।এতবড় একটা সিদ্ধান্ত!!অথচ,সমু ওকে একবারও জানালো না পর্যন্ত!!শেষে তারিখ আর সময় দেখলো,মেইল কখন এসেছে,সেটাও দেখলো।আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না ওর।সবটা একেবারে জলের মতো পরিষ্কার...স্থানীয় ট্রেনের সময় দেখতে গিয়ে চমকে উঠলো সৌর।সাড়ে-এগারোটায় ট্রেন!কম্পিউটার-ফোন দুটোর স্ক্রিনই বলছে এগারোটা দশ।অর্থাৎ আর মাত্র কুড়ি মিনিট সময় হাতে আছে।টেবিলের ওপর একটা জোরে করে চড় মেরে নিজের ফোনটা নিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর...খোলা পড়ে রইলো কম্পিউটার-স্ক্রিন....

-কি হলো সৌর?কোথায় যাচ্ছিস বাবা?!পুলিশে কি একটা খবর দেবো?কিছু কি বুঝতে পারলি?!জানতে পারলি কিছু?!আমি তো ওকে বুঝতেই পারি নারে....

হাহাকার করে উঠলেন সমুর মা....

সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতে-নামতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো সৌর,
-কারণ আপনারা ওকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টাই করেননি কাকিমা!শুধু নিজেদের ইচ্ছেগুলো ওর ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।তার জন্যই আজ সবাইকে না জানিয়ে,জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সমু।কোনো অল্টারনেটিভ রাস্তা,বা অন্য কোনো উপায় বলে দেওয়ার মতো,কেউ ছিলোই না ওর সামনে।কাকে বলতো ও?!আমাকেও একবার বললো না।জীবনের একটা গোটা বছর,এত প্রিপারেশন...উফফ!আমি তো আর ভাবতেই পারছি না!!

সৌরর চিৎকারের চোটে কিছু বুঝতে উঠতে না পারা সমুর মা একেবারে চুপ করে গেলেন।ছেলের কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে ই-মেইলটা পড়ে ততক্ষণে কঠিন হয়ে গেছে সমুদ্রর বাবার চোয়াল....

সমুর বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে আধো-অন্ধকার বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।বারান্দার এককোণে মৃতদেহের মতো ঢাকা দেওয়া রয়েছে সমুর বাবার বাইক।বেশ কয়েক মাস আগে এটা নিয়ে অনেক কায়দা করেছিলো ওরা চার বন্ধু।কথা ছিলো,পরীক্ষার পর এটা চালিয়ে হাত পাকা করবে।সমু একেবারেই শিখতে পারেনি।ঋষি মোটামুটি চালাতে পারে।যেটুকু শিখেছিলো,সৌর আর রূপই শিখেছিলো।কিন্তু জনবহুল রাস্তায় বাইক নিয়ে বেরোনোর সাহস,সৌরর এখনও হয়নি।তবে আজ সেই সাহসটুকু দেখাতেই হবে।ফোনের স্ক্রিন বলছে এগারোটা পনেরো...

-বাইকের চাবি আনুন,তাড়াতাড়ি!

একটানে বাইকের ওপরের আবরণ সরিয়ে ফেললো সৌর,বাইকটা টেনে বাইরে বের করলো।সমুর মা ঘর থেকে চাবি এনে দিলে বাইকে উঠে বসলো সৌর....সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে চেঁচিয়ে উঠলো সমুদ্রর বাবা,

-আমিও যাবো সৌর!!
-তার আর কোনো প্রয়োজন নেই কাকু।তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আটকাতে পারলে,একমাত্র আমিই পারবো।আর কেউ পারবে না!!

সশব্দে বাইক স্টার্ট দিয়ে বেরোতে গেলো সৌর।কিন্তু কেঁপে গেলো ওর হাত।বাইক নিয়ে একপাশে কাত হয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো ও।কিন্তু কোনোরকমে পা ফেলে দিয়ে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেলো।তবে বাইকের ধাক্কা লেগে,বাঁধানো উঠোনে দাঁড় করিয়ে রাখা ওর সাইকেলটা পড়ে গেলো।সেই সঙ্গে ওর বাঁ হাতের কনুইটা দেওয়ালে ঘষটে গিয়ে কেটে-ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।হাত কাঁপছে সৌরর,ভয়ও করছে।সমুর কথা ভেবে,সেই মুহূর্তে চরম বাস্তববাদী সৌর ভুলে গেলো,নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা!!ভুলে গেলো এক্সিডেন্ট করলে বা শরীরে কোনো ছোটবড় ক্ষত থাকলেও,সুইমিং পুলের ক্লোরিনমিশ্রিত জলে ও আর নামতেই পারবে না,বন্ধই হয়ে যাবে প্র্যাকটিস।হাতছাড়া হয়ে যাবে চাকরি,তিলোত্তমাকে কাছে পাওয়ার,নিজের করে পাওয়ার অপেক্ষা,আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।সেই মুহূর্তে সবকিছু বেরিয়ে গেলো ওর মাথা থেকে।একটাই চিন্তা,ওই পাগলটাকে আটকাতেই হবে....হাত কাঁপছে সৌরর,বাঁ-হাতের কনুই ছিঁড়ে গিয়ে বেরিয়ে আসছে বিন্দু-বিন্দু রক্ত,জ্বালাও করছে।পরোয়া করলো না সৌর।সমুর বাবা দৌড়ে এসে সৌরর সাইকেলটা তুলে ধরলেন।সশব্দে বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো সৌর....

মাঝ-রাস্তায় তখন সৌর,মনে পড়ে গেলো সমুর সেদিনের বলা কথাটা,

"ওদের সঙ্গে আর কোনো কথা না।সোজা বাড়ি যাবো আমরা।ওরা মরলে মরুক,যা খুশি হোক গে যাক,আমরা উঁকি মেরেও দেখতে যাবো না।ভুলে যাবি না সৌর,ও কিন্তু তোর গায়ে হাত তুলেছে!এবার দিক ওরা ওর হাত-পা ভেঙে।হ্যাঁ,সামনেই পরীক্ষা,হাত ভেঙে গেলে হারামিগুলো পরীক্ষাটা আর দিতে পারবে না,একটা বছর নষ্ট হবে,এই যা..."

সামনের রাস্তাটা ধীরে-ধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে।নিজে এত জ্ঞান দিলো সেদিন।একপ্রকার বাধ্য করলো সৌরকে,ঋষির কাছে যাওয়ার জন্য,নইলে সমর্পণ ওর হাত-পা ভেঙে ওর একটা বছর নষ্ট করে দেবে!আর নিজে এটা কি করলো সমু?!ওরা সবাই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যাবে,আর সমু একা পিছনে পড়ে থাকবে?!আর ভাবতে পারছে না সৌর,কান্না পেয়ে যাচ্ছে।ও বাইকের গতি আরও একটু বাড়িয়ে দিলো...

প্ল্যাটফর্মে ঢুকেই ও পাগলের মতো ফোন করতে শুরু করলো সমুদ্রকে....এটা জংশন।ঢুকেই কোন প্ল্যাটফর্মে কোন ট্রেন ঠিক করতে না পেরে,সৌর দিশেহারা হয়ে গেলো।কিন্তু বেশ খানিকটা রাত হওয়ায় প্ল্যাটফর্ম কিছুটা ফাঁকা।প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল ঘড়ি বলছে,এগারোটা আঠাশ!!

আর থাকতে পারলো না সমুদ্র।তখন থেকে ছেলেটা ফোন করেই যাচ্ছে।চোখ থেকে ওর জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরত।কিন্তু ওর আর কিছু করার ছিলো না।ফোনটা ধরলো সমুদ্র,

-বল ভাই!!
-কোন ট্রেনে তুই?কোন প্ল্যাটফর্ম?আবে বাল নাম ট্রেন থেকে!!সমু নাম,নাম....

কেঁপে উঠলো সমুদ্র।বুঝে গেছে সৌর,ঠিক বুঝে গেছে ও।সমুদ্রকে সৌর বোঝেনি,এটা আজ পর্যন্ত কোনোদিন হয়নি।আজও বুঝে গেছে।ঠিক এসে গেছে ও।ঘড়িতে এগারোটা ঊনত্রিশ....সমুদ্র ব্যাগটা পিঠে নিয়ে উঠলো সিট থেকে....দরজার সামনে এগোলো,কানে ধরে থাকা ফোনে বললো,

-পারবো না ভাই!গান আমি ছাড়তে পারবো না।এই সুযোগটা আমি ছাড়তে পারবোই না।
-এই বাল তুই নামবি কিনা!!আমি অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে,গাড়ি করে তোকে কাল নিয়ে যাবো সমু!আমি যাবো তোর সঙ্গে,প্রমিস!!তুই আগে নাম ভাই!অন্তত বস তো পরীক্ষাটায়...পাশমার্কটুকু....

প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে সৌর আর সমুদ্রর কান-মাথা ঝাঁজিয়ে বেজে উঠলো ট্রেনের হুইসেল...

ছুটতে-ছুটতে সৌর দেখলো,ওর সামনের ট্রেনটাই ধীরে-ধীরে স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে।দূরত্ব বাড়ছে ওদের।পাগলের মতো ওইদিকে ছুটে চিৎকার করে উঠলো সৌর,
-সমু নাম ভাই!

ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্রই ফোন রেখে দিলো সমুদ্র।এগোলো দরজার সামনে।ফোনটা কেটে যেতেই,ছুটতে-ছুটতে সৌর দেখলো,একেবারে সামনের দিকের একটা কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে...সৌরর চিৎকার আর ওই পর্যন্ত পৌঁছবে না।

-দাদা!একটু চেনটা টানুন না....

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটেও আর ওর কাছে পৌঁছনো সম্ভব না।ট্রেনের গতিবেগ বেড়ে গেছে।সমুদ্র ওখান থেকে একভাবে চেয়ে রয়েছে সৌরর দিকেই....নিজের দৌড়োনোর গতিবেগ কমিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌর।স্টেশনে দাঁড়িয়েই নিজের মুখ চেপে কেঁদে ফেললো....

সশব্দে বেরিয়ে গেলো ট্রেন....অদৃশ্য হলো সমুদ্র।পড়ে রইলো শুন্য প্ল্যাটফর্ম....

মাথা চেপে ধরে চেয়ারে বসে পড়লো সৌর....যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।কি ভীষণরকম কান্না পাচ্ছে ওর....

ততক্ষণে একে-অপরকে দোষারোপ করে বাড়িতে তুমুল ঝামেলা বাধিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রর বাবা-মা....

বাঁ-হাতের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ছোট একটা ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়েছে সৌর।বাইকটাকে অক্ষত অবস্থায় নিয়ে ও ঢুকলো সমুর বাড়ি....দৌড়ে বেরোলো সমুর বাবা-মা...কিন্তু সৌরকে একা দেখে একেবারে চুপ করে গেলো তারা....আর একটাও কথা বলার সাহস পেলো না...বাইকের চাবিটা নিয়ে সমুর বাবার দিকে এগোলো সৌর,

-কাল রাতের মধ্যে চলে আসবে আশা করি!চাবিটা নিন!
-দেখা হয়েছে?তাও তাকে ছেড়ে....
-হয়েছে আবার হয়ও নি!সমু ট্রেনে ছিলো।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিলো।আমার আর কিছু করার ছিলো না।হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছিলো!সরি কাকু!আমি আসছি....
-ছেলেটা তবে পরীক্ষাটা দেবেই না সৌর?!

ঘুরে নিজের সাইকেলের দিকে যাচ্ছিলো সৌর।কিন্তু সমুর বাবার এইটুকু কথাতেই ফিরে দাঁড়ালো ও,তেড়ে এসে দাঁড়ালো ওনাদের সামনে,
-এখন কেন এত ভেঙে পড়ছেন কাকু?!এই ক্রাইসিসটা তো আপনাদের নিজের হাতেই তৈরি করা।কি হতো ওর গান গাওয়াটা ভালোভাবে মেনে নিলে?!ভালোভাবে গান শিখতো,সহজভাবে-সুন্দরভাবে একটা ভালো জায়গায় পৌঁছতো।এইরকম সুযোগ কি আর দ্বিতীয়বার আসতো না ওর জীবনে?!অবশ্যই আসতো।কিন্তু ও এত মরিয়া কেন এই সুযোগটার জন্য?জানেন আপনি?নিজেকে প্রমাণ করতে চায় ও।গানের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।কিন্তু ও কোনোদিনও কোনো সাপোর্ট পায়নি আপনাদের কাছ থেকে।সমুর কাছে আপনারা শুনেছেন কিনা জানি না,আমার একটা চাকরির কথা চলছে।আমিও পড়াশোনায় ভালো।কিন্তু সেই পড়াশোনা থেকে চাকরিটা নয় কিন্তু।স্পোর্টস কোটায়,সাঁতার থেকে।আর সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে জানেন?!জল আমার নেশা!জলে নেমে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াটাই আমার নেশা!আর আমার বাবা-মা সেইদিকে আমাকে পুরোপুরি সাপোর্ট করে গেছে।কখন কি খাবো,কি আমার ডায়েট চার্ট,কোন সময়টা আমার ব্যায়ামের জন্য আদর্শ সময়,আমি কখন ঘুমাবো,ঠিক কতক্ষণ ঘুমাবো,প্রতিটা মুহূর্তে আমি তাদের আমার পাশে পেয়েছি বলে,সাঁতারের পাশাপাশি আমি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পেরেছি,নির্ভাবনায়।আমাকে,আমার ইচ্ছেকে কোনোদিনও খুন করা হয়নি কাকিমা,যে চুরি করে আমাকে আমার ইচ্ছের পিছনে,স্বপ্নের পিছনে ছুটতে হবে।আমাকে চুরি করতে হয়নি।যেকোনো সুযোগকে কোনোরকম ক্ষতি ছাড়াই আমি ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি,কারণ আমি জানতাম পিছনে বাবা-মা আছে।আমার সামনে এইরকম কোনো অপশন আসেইনি,হয় এটা,নয় ওটা!!আমি জানতাম,আমার ভুলটুকু,আমার খামতিটুকু ওরা ঠিক সামলে নেবে।আর সমুকে?ওকে জোর করে গিটারের টিউশন,পিয়ানোর টিউশন আদায় করতে হয়েছে।আবার তার জন্য অনেক কথাও শুনতে হয়েছে।ওর একমাত্র ভালোবাসা,ওর গিটারটাকে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে,নিজেদের ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জিনিস ওটা?!আমি আসি না আপনাদের বাড়ি!কারণ সমু বলে,ও আসবে আমার বাড়ি।কারণটা কি আমি কিছুই বুঝি না ভেবেছেন!?আমাদের সুইমিং কম্পিটিশনে কি বলে জানেন,কম্পিটিশন সবসময় সমানে-সমানে হয় কাকু।সেম ক্যাটাগরিতে!ওজন এক,বয়স এক,সুইমিং স্টাইল এক,তবে গিয়ে হয় ফেয়ার-কম্পিটিশন।তুলনাটাও ঠিক তাই।কাজেই তুলনা করার আগে জায়গাটা তৈরি করতে হয়।সবকিছু ঠিকভাবে তার সামনে না দিয়ে,তাকে সাপোর্ট না করে,কোনোরকম তুলনা করা চলে না!!যেমন সমুর গানের সঙ্গে আমার গানের তুলনা করতে গেলে,আপনি নিজেই লজ্জায় মরে যাবেন।সবার সবকিছু সমান থাকে না কাকু,ও ওটা পেরেছে মানেই,তোমাকেও পারতে হবে,ওর থেকে আরও ভালো পারতে হবে,এভাবে হয় না কাকু।সমু কি পারে,সেটা দেখুন!!ও যেটা ভালো পারে,ভালোবেসে করতে চায়,সেটাকে আর একটু ঘষেমেজে নিলে,ও কোথায় চলে যাবে,বা এতোদিনে যেতে পারতো,জানেন আপনি?!মাঝখান থেকে একটা বছরই নষ্ট হয়ে গেলো ওর....আমার আর ভালো লাগে না।লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-দৌড়ে এসেও ঠেকাতে পারলাম না....এগারো বছর একসঙ্গে পড়াশোনা করে,এবার আমি বেরিয়ে যাবো,ও পড়ে থাকবে,ওই একটা মাত্র সাবজেক্টের জন্য!উফফ!!আমি আর ভাবতেই পারছি না....

গলাটা কেঁপে গেলো সৌরর।বাঁ-হাত যন্ত্রণা করছে।কনুইতে লেগেছেও জোর....ও চোখ মুছে নিয়ে উঠে পড়লো সাইকেলে।আর পিছনদিকে ফিরেও চাইলো না।সমুর বাবা-মা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রস্তরমূর্তির মতো...

-একদম ভালো লাগছে না মিছরি!
-তুমি কি করবে বলো?ওর জীবন,ওর সিদ্ধান্ত!
বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না সৌরর।সেই হাফপ্যান্ট পরার সময় থেকে ওরা দুজন বন্ধু।মারামারি-ধরাধরি কি হয়নি ওদের মধ্যে?!তাও ওই দুই মানিকজোড় একসঙ্গে ছিলো আজীবন।স্কুলজীবনের এই শেষ লগ্নে এসে সমু যে আবেগে ভেসে এমন একটা ছেলেমানুষি করে বসবে,ভাবতেই পারেনি সৌর।টাকাটাও সৌর ওকে বোকার মতো দিয়ে দিলো।ওটা না দিলে,ও হয়তো যেতে পারতো না।কিন্তু ও বুঝবে কি করে!!সবকিছুর জন্য এখন ওর নিজেকেই দোষ দিতে ইচ্ছে করছে।বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেলেছিলো সৌর।বারকয়েক ফোন করেছিলো সমুকে।ফোন বন্ধ....অসহায় হয়ে একটু আশ্রয়,একটু উষ্ণতার খোঁজে তিলোত্তমাকেই ফোন করেছিলো ও...

-তোমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড কাঁদতে ইচ্ছে করছে মিছরি!ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!!
-এ আবার কি সৌর?!বি প্র্যাকটিক্যাল!ওর যেটা ঠিক মনে হয়েছে,ও সেটাই করেছে।এখানে তুমি ওকে বলার কে?
-মানে?ও বন্ধু আমার!ওর ভালোমন্দ আমি বুঝবো না?!ও ভুল করলে আমি বাধা দেবো না?!

এমনিতেই মাথা গরম হয়ে রয়েছে সৌরর।তার মধ্যে তিলোত্তমার এমন কাটা-কাটা কথা,ওর মেজাজ আরও বিগড়ে দিলো।ও ভেবেছিলো,তিলোত্তমা হয়তো ওকে বুঝবে....ওর আবেগটুকু বুঝবে....একটু শান্তি পাবে ওর সঙ্গে কথা বলে...

-না বাধা দেবে না।তুমি বাধা দিয়েও কিছু করতে পারবে কি?!ঘাড় ধরে ওকে পরীক্ষায় বসালে,তোমার ওই বন্ধু তোমাকেই আজীবন শোনাতো,যে তোর জন্যই আমার জীবনের অতবড় একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে!তুই-ই দায়ী....

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো সৌর...মাথায় আগুন জ্বলছে ওর...
-শাট আপ মিছরি!মানেটা কি?তুমি যা জানো না,তাই নিয়ে কথা বলতে এসো না!সমুদ্র কোনোদিন কোনোকিছুর জন্য আমাকে দোষারোপ করবে না।ও ভাই আমার....
-আরে রাখো তোমার ভাই!!কত রক্তের সম্পর্ক দেখলাম ওইরকম,আর এ তো বন্ধু!!ওসব ছাড়ো তো,বাদ দাও।কাল তোমার পরীক্ষা,নিজের কথা ভাবো।আর ওর কথা মনে পড়লে,মনকে সান্ত্বনা দাও,যে ও আজ যা করেছে,ঠিকই করেছে।যেটা ভালো বুঝেছে,নিজের দায়িত্বেই করেছে।কাল ও কাউকে দোষ দিতে পারবে না,যে তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা!সো,বি কুল!!সমুদ্রে ডুব না দিয়ে,আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করে নাও।সব ঠিক হয়ে যাবে।মনটা ভালো হয়ে যাবে।তারপর,পড়তে বসো...

তিলোত্তমার মুখের ওপর ফোনটা কেটে দিয়ে,বিছানার ওপর ফোনটা আছাড় মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সৌর....আবারও ঘুরিয়ে ফোন করলো তিলোত্তমা।কিন্তু সৌর আর ফোনটা ধরলো না...বেজেই গেলো...গলা থেকে উগড়ে আসা নিজের কান্নাটা সামলাতে,সৌর চলে গেলো বারান্দার দিকে....বিছানার ওপর ফোনটা নিঃশব্দে বারংবার বলতে লাগলো,সৌরকে ওর ভালোবাসা ডাকছে....

ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে দিক ঠিক করতে পারলো না সমুদ্র।ফোনটা অন করলো আগে।একাধিকবার বাবা আর সৌর ফোন করেছে।সৌরর-ঋষির-রূপের একাধিক মেসেজ।সেসব মেসেজ খুলে দেখলো না ও।দেখলেই কান্না পাবে।আবার ফোনটা বন্ধ করে দিলো।প্রায় চারটে বাজতে যায়।আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যাপার।সকালের আলোটা আর একটু ভালোভাবে ফুটলেই ও বেরিয়ে যাবে নিজের গন্তব্যের দিকে।প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমের দিকে এগোনোর আগে,সারারাত খোলা থাকা,স্টেশন চত্বরের ছোট্ট দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট কেক-বিস্কুট আর একটা জলের বোতল কিনে নিলো সমুদ্র...বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে দেখলো কয়েকজন ওখানে বসে আছে।চেহারা ঠিক সুবিধের মনে হলো না।দেখেই বোঝা যাচ্ছে,প্রত্যেকেই মদ্যপ।আর ওদিকে গেলো না সমুদ্র।হাতে অল্প কিছু টাকা রয়েছে।ওকে মেরেধরে ওটা নিয়ে নিলে,এতকিছু সমস্ত বেকার হয়ে যাবে।এন্ট্রি-ফিটা সামলে রাখতেই হবে।ওখান থেকে সরে আসার আগে সমুদ্র দেখলো,ঝকমকে-খোলামেলা শাড়ি-জামাকাপড় পরা,বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন মেয়ে ওইদিকে গেলো।ওই মদ্যপ লোকগুলোর কাছে....তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে গেলো সমুদ্র।ওয়েটিং রুমে ঢুকে সমুদ্র দেখলো জড়োসড়ো হয়ে দু-একজন ভিখারি এখানে-ওখানে ঘুমিয়ে রয়েছে।সেই ন-টা সাড়ে নটার সময় রাতের খাবার খেয়েছে সমুদ্র।খিদের জ্বালায় পেটের ভিতরে তখন আগুন জ্বলছে।একটা জায়গায় ব্যাগ সামলে নিয়ে বসে,কেকের প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করলো ও।কয়েক টুকরো খাওয়ার পরেই দেখলো,একটু দূরের একটা ভিখারির চাদরের আড়াল থেকে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে উঠে বসেছে।চেয়ে রয়েছে ওর দিকেই...কেকের টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়েও,আর হাত উঠলো না সমুদ্রর।ও ওটাকে এগিয়ে দিলো সেই বাচ্চাটার দিকে।ঘুমন্ত মায়ের হাত সরিয়ে কালোকুলো রোগা-কঙ্কালসার মেয়েটা ছুটে এলো ওর কাছে।জুলজুলে লোভী একজোড়া চোখ।কাঁধ থেকে খুলে নেমে পড়ছে নোংরা জামা।এক্কেবারে হাড়গিলে চেহারা।সরু-সরু হাত-পা আর ফোলা পেটের অদ্ভুতদর্শন এক শিশুকন্যা,ফুটপাতের রাজকন্যা!!কেকের প্যাকেটটা নিয়েই আবার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো মেয়েটা।সমুদ্র অবাক হয়ে দেখলো,পাশে শুয়ে থাকা ছোট্ট কুকুর-ছানাটা মাথা তুললো একটু।তার দিকে একটা কেকের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে,বাকিটা খেতে শুরু করলো ওই অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত ওই হাভাতে বাচ্চা মেয়েটা।বেশ কিছুক্ষণ ওদের পরম তৃপ্তি-সহকারে খাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে রইলো সমুদ্র।তারপর ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে কয়েক ঢোঁক জল খেয়ে নিলো ও....

-কিরে চল?!আর ভেবে কি করবি?আমি এলাম রে...
-হুম!!আয়,গুড লাক!
-তোকেও....

রূপ চলে গেলো পাশের ঘরে।ওর সিট পাশের ঘরে পড়েছে।ঋষি আর সৌর একই ঘরে ঢুকলো।ধীরে-ধীরে সমস্ত জায়গা পূর্ণ হয়ে গেলো।শুন্য রইলো একটা মাত্র জায়গা....সৌরর ঠিক আগের বেঞ্চের জায়গাটা....

পরীক্ষা দিতে বসেও,জানলার দিকে চেয়ে সৌরর চোখে জল এসে গেলো...দূরে একটা নারকেল গাছের পাতা মৃদু কাঁপছে।হীরের মতো উজ্জ্বল রোদ আলোকিত করে রেখেছে সমগ্র পৃথিবীকে।শুধুমাত্র সৌরর সামনের কাঠের বেঞ্চটা অন্ধকারের চাদরে মোড়া.... বুকের ভিতরটা কাঁপিয়ে বাইরে ঘন্টা বাজলো।সৌরর হাতে এসে পড়লো প্রশ্নপত্র।প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে,প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পেলো না সৌর,সব ঝাপসা।নাক টেনে চোখ ভালো করে মুছে নেওয়ার পর ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হলো সবকিছু....ঘড়ির দিকে একবার চেয়ে,পেনটা হাতে তুলে নিলো ও।ব্যস্ততার সঙ্গে নিজের নাম,রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখতে শুরু করলো....

-নাম?
-সমুদ্র বসু!

বিচারকমন্ডলীর পক্ষ থেকে একের পর এক প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসতে শুরু করলো সমুদ্রের দিকে....

-গান কতদিন ধরে শিখছো?
-সেভাবে গানের তালিম নেওয়া হয়নি কখনও।তবে ভালোবেসে গান গাই।
-হুম!এত কনফিডেন্স?ভালোবেসে গান গেয়ে এতবড় একটা প্ল্যাটফর্মে চলে এলে?টাফ কম্পিটিশন কিন্তু....
-আমার নিজের ভালোবাসার ওপর জোর আছে,বিশ্বাস-ভরসাও।তাই আপনারাই ডেকেছেন আমায়।
-বেশ।তবে শোনা যাক একটা গান!কোনো ইন্সট্রুমেন্ট সঙ্গে....
-নেই কিছু।একটা গিটার পেলে ভালো লাগবে!বাকি মিউজিশিয়ান দাদারা তো আছেনই....
-হুম....

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা গিটার চলে এলো সমুদ্রর হাতে।সমুদ্র বললো,

-আমিই লিখেছি,সুরও আমারই করা....
-বাঃ!এটা কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ করেনি।নিজের লেখা গান,নিজের লেখা সুর...দেখা যাক!অল দা বেস্ট!
-হুম,থ্যাঙ্কু...

গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে আর একটু এগিয়ে এসে গান ধরলো সমুদ্র...

-এ কোন প্রেমের মায়ায় ঘেরা এ জগৎ/দেখতে মন চায়,
বিশ্ব আজ আমার দুচোখে নিমগ্ন/দেখি ক্ষুধার্ত খাদ্য না পায়...
প্রেমের আগুনে পুড়ে,অন্ধ বিরহে মৃতপ্রায় আমি/জানিনা ক্ষুধার অনল,
আজ চক্ষু মেলে দেখি/আমার সবুজ পৃথিবী দাবানল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে করবো শীতল....

রক্তাক্ত হৃদয় আমার,প্রেয়সী পরবাস/
এ ভগ্ন-হৃদয় লাগি/তার নেই অবকাশ....
মেনেছিলাম এই মোর পৃথিবী/হেথায় সব ইতি,
অবাক নয়নে দেখি/ক্ষুধার্ত চেয়ে রয়,আমারই মুখের প্রতি...

ফিরে চাইলে না তুমি/আমার কোনো স্থান নেই তোমার মনে,
কিন্তু তোমারে রেখেছি যতনে/আমার ডায়েরীর এক কোণে...
আমি শেষ আজি/তোমার মুখপানে চেয়ে...
চমকে উঠে সহসা/ক্ষুধায় ক্লান্ত একটি সতেজ প্রাণ আসে,আমারই পানে ধেয়ে....
তোমা হতে শুরু আমি/তোমাতেই এই সমুদ্র অতল,
আজ চক্ষু মেলে দেখি/আমার সবুজ পৃথিবী দাবানল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে/করবো শীতল....
আমার ক্ষমতা কি/আমি তারে/করবো....শীতল....

মাথা নামিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সমুদ্র।ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে ও ভেবেছিলো,ওইটুকুই জীবনের সব।গতকালের আগে পর্যন্ত,কোনোদিনও খিদের জ্বালা বোঝেনি ও।কিন্তু কালকের পর থেকে পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে।সকাল থেকে শুধু বিস্কুট খেয়ে রয়েছে।বাস্তবের কাঠিন্য বুঝতোই না ও এতদিন।মনের আর পেটের খিদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।মনের খিদে না মিটলে,সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে অসহ্য জ্বালায়।কিন্তু তার প্রকাশ বাইরে হয় না।তা অপ্রকাশিতই রয়ে যায়।আর পেটের খিদের জন্য মানুষ নাকি মানুষকে খুন করে?!হুম,করতেই পারে!!কাল বাচ্চা মেয়েটার লোভে জুলজুলে ওই দুটো গভীর চোখই ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে,খিদের জ্বালা কতখানি!!ওরা অভ্যস্ত!খিদে পেটে নিয়েও প্রশান্তির ঘুম ঘুমোতেই অভ্যস্ত ওরা।মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে।টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে পড়ছে।দুপুর গড়িয়ে গেছে।প্রায় তিনটে বাজতে যায়।মনের আগুনে জ্বলতে-জ্বলতে,আজ পেটের মধ্যেও আগুন জ্বলছে সমুদ্রর।খিদের চোটে একবার মাথাটা একটু ঘুরে উঠলো।সেই মুহূর্তেই বিচারকের পক্ষ থেকে ভেসে এলো প্রশ্ন,

-অসাধারণ!তোমার বয়স তো বেশি না!কি করো তুমি?
-আমি স্টুডেন্ট!উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী!

অপার নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে ঘরে।আবার প্রশ্ন এলো,
-মানে?!আজ তো লাস্ট পরীক্ষা।একটা বাকি ছিলো না?!কোশ্চেন লিক...
-হুম!আমি পরীক্ষা দিইনি।
-কেন?
-এখানে আসার জন্য!
-হোয়াট!!মানেটা কি?এখানে আসার জন্য পরীক্ষায় বসোনি?এতবড়....

খিদের চোটে সমুদ্রর মাথা ঘুরতে শুরু করেছে।ও মাথা তুলে দরাজ কণ্ঠে বললো কয়েকটা মাত্র কথা,
-বড় স্বপ্নপূরণের জন্য যে,মূল্যটাও অনেক বড় দিতে হয় স্যার!আমাকেও তাই দিতে হলো!

(চলবে.....)

ছবি: সংগৃহীত

অসমাপ্ত (অষ্টম পর্ব)




অসমাপ্ত

অষ্টম পর্ব


সাথী দাস


-কেন আমার সঙ্গে নিজেকে জড়াচ্ছ সৌর?পারবে না।ভেসে যাবে তুমি...

সৌর মিছরিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো।মিছরি টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিজেকে।কিন্তু সৌরর সঙ্গে গায়ের জোরে পারলো না।সৌর ওকে আবার কাছে টেনে ওর মুখের ওপর থেকে অবিন্যস্ত চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,

-হুম!ভাসতেই তো চাই...সাঁতার জানা সত্ত্বেও আমি ডুবতে চাই মিছরি।তোমার সঙ্গে...প্লিজ আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না...

তিলোত্তমার দুটো পেলব গাল-কপাল-ঠোঁট-গলা সৌর নিজের ঠোঁটের স্পর্শে ভরিয়ে দিলো।নিজের ঠোঁট দিয়ে মুছিয়ে দিলো ওর চোখের জল।সৌরকে আর বাধা দিলো না তিলোত্তমা।জড়িয়ে ধরলো সৌরকে।উন্মত্ত সৌর সামান্যতম প্রশ্রয়ে আরও পাগল হয়ে উঠলো....হাঁপাতে-হাঁপাতে বললো,

-বলো মিছরি...
-কি শুনতে চাও বলো?
-আমায় ভালোবাসো তো?
-আমি তোমাকে ভালোবাসি সৌর!!
-তাহলে দূরে ঠেলে দিচ্ছ কেন?
-আমার কতগুলো স্বপ্ন আছে সৌর,আমার কিছু এমবিশন আছে।আর সেখানে ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই!
-মানে?আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো মিছরি।তোমার অধরা-অপূর্ণ স্বপ্নরা আজ থেকে আমারও লক্ষ্য।আমাকে শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটু সময় দাও,আমিই দাঁড়াবো তোমার পাশে।আর তুমি জানো মিছরি,আই এম লিমিটেড এডিশন,আমি যা বলি,ঠিক সেটাই করি!আজ আমি,সৌরদীপ সাহা,তোমাকে কথা দিচ্ছে,সে কোনোদিনও তোমার আর তোমার স্বপ্নের মাঝে আসবে না।শুধু তুমি আমাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দিও না,মাঝে আসতে দিও না,ঠিক আছে।কিন্তু পাশে থাকতে দাও।নইলে মরে যাবো আমি!!প্লিজ....
-কিন্তু সৌর,তুমি তো জানোই না,আমি কি....

আর কথা বলতে পারলো না তিলোত্তমা।সৌর নিজের ঠোঁট দিয়ে ওর মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।জমাট অন্ধকারে তিলোত্তমা নিজেকে এলিয়ে দিলো সৌরর বুকে....
-মিছরি?
-ভালোবাসি সৌর!এটাই জানতে চাও তো?হ্যাঁ,ভালোবাসি।আর ভালোবাসি বলেই দূরে সরে যাচ্ছিলাম....
-জানতাম আমি,তুমিও আমাকে ভালোবাসো।তাই তো এতটা সাহস পেয়েছি।কিন্তু এটা কেমন কথা মিছরি?ভালোবাসলে তো কাছে আসতে হয়।তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছ কেন?

ঘ্যাক করে উঠলো টাইগার।অনেকক্ষণ ধরে মশার কামড় খেয়েও,লক্ষী হয়ে চুপটি করেই ছিলো ও।সৌর আর তিলোত্তমাকে একটুও বিরক্ত করেনি।কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে,বেজায় বিরক্ত হয়ে ঘেউ-ঘেউ করে ডেকে উঠে,লেজ ধরার জন্য বোঁ-বোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো।ওকে দেখে সৌর আর মিছরি দুজনেই হেসে ওঠে সশব্দে....সৌরর বুকে মাথা রেখেই তিলোত্তমা বলে,

-আমি যাই সৌর।টাইগার মশার কামড় একদম সহ্য করতে পারে না।
-আর একটু থাকো প্লিজ!কাল থেকে আর তো দেখাই হবে না!প্লিজ-প্লিজ,আর একটুখানি....
-না!এবার আমি আসি!অনেকক্ষণ বেরিয়েছি।বাবাই চিন্তা করবে।অফিস থেকে ফিরে আমাকে না জড়িয়ে ধরলে,বাবাই থাকতেই পারে না।বলে,বাড়িতে ঢুকেই আগে সোনামাকে দেখতেই হবে....

সৌর দেখলো,তিলোত্তমা চলে যাবেই।কিছুতেই ওকে আর আটকানো যাবে না দেখে,ওকে আরও একবার জড়িয়ে ধরলো সৌর।আগামী কয়েকদিনের জন্য নিজের সবটুকু আদর,তিলোত্তমার ঠোঁটে উজাড় করে দিলো।সৌর ছাড়লে পাগলিনীর মতো এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে,তিলোত্তমা মৃদুস্বরে ডাক দিলো,
-টাইগার?আয়...
সৌর দেখলো তিলোত্তমা আর ঘুরলো না একবারও।ও নিজেই দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তিলোত্তমার কোমর।ওর চুলের সৌরভে মুখ ডুবিয়ে বললো,
-তোমাকে মিস করবো মিছরি।পাগল হয়ে থাকবো!
-কেন পাগল হবে?!আজ তো সবটুকু আদর করেই নিলে!
-তাও পাগল হয়ে যাবো!আমি রোজ ফোন করবো,প্রতিদিন রাতে,দিনের বেলাও।তুমিও করবে,যখন তোমার মন চাইবে।আমি ফোন করলে ধরবে কিন্তু....
-আচ্ছা!আসি....

টাইগার একবার এগিয়ে এসে সৌরর পায়ের কাছে মাথা রেখে ওর গা শুঁকলো।দুহাতে জড়িয়ে ধরে টাইগারকে আদর করলো সৌর....তারপর টাইগার গুটিগুটি পায়ে চলে গেলো তিলোত্তমার সঙ্গে....কয়েক পা এগিয়েই সৌরর ডাকে ঘুরে দাঁড়ালো তিলোত্তমা...

-মিছরি?
-বলো?

জিন্সের প্যান্টের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সৌর ফুরফুরে-খুশি মেজাজে জিজ্ঞেস করলো,

-প্রাণভরে আদর তো হলো,কিন্তু তোমার স্বপ্নটা কি,সেটাই তো জানা হলো না!
-পরীক্ষাটা আগে ভালো করে দাও সৌর।তারপর আমরা এই বিষয়ে কথা বলবো।হ্যাঁ এটা ঠিক,যে আমরা ভালোবাসি একে-অপরকে।আমিও তোমাকে ভীষণই ভালোবাসি।কিন্তু আমার অপূরণীয় স্বপ্নটা জানার পর,তুমি সিদ্ধান্ত নেবে,আমার একসঙ্গে থাকবে কিনা!!কারণ,"ভালোবাসি",এই চারটে অক্ষর বলাটা যতটা সহজ,ভালোবাসাটা কিন্তু ততটাও সহজ না!!
-মানে?
-তোমার পরীক্ষার পর আমরা কথা বলছি।এখন ওইটুকু মাথায় বেশি চাপ নিও না।পড়ায় মন দাও!জেনেই তো গেলে,যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি।আর নিশ্চয়ই পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে কোনো অসুবিধে হবে না।আমি তো আছিই,এবার নিজের ভবিষ্যতের দিকে নজর দাও।তারপর আমার দিকটা শোনার পরও যদি তোমার মনে হয়,তুমি আমার সঙ্গেই থাকতে চাও,বা থাকতে পারবে,আমার ইচ্ছেগুলোকে মানতে পারবে,সম্মান দিতে পারবে,তারপর আমরা দুজনে ভেবে দেখবো।

চমকে উঠে সৌর দৌড়ে এলো মিছরির দিকে...ওর সামনে এসে ওর দুটো হাত ধরে বললো,
-এই এক মিনিট!ভেবে দেখবো মানে?আমরা দুজনেই দুজনকে ভালোবাসি।তাই আমরা একসঙ্গেই থাকবো।এখন যার-যার মতো সে-সে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করবো,তারপর বিয়ে করবো আমরা....এর মধ্যে আবার ভাবাভাবির কথা আসছে কেন মিছরি?আমরা ভালোবাসি,আমরা কমিটেড,আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,তাই তো?!

সৌরর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে ওর কাছে এগিয়ে এলো তিলোত্তমা।সৌরর গালে হাত রাখলো,ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌর,
-প্লিজ মিছরি,এমন কিছু বোলো না,যাতে আমি শেষ হয়ে যাই!মুখ খোলার আগে,কথা বলার আগে ভেবে বলবে... প্লিজ...

সৌর দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তিলোত্তমার কোমর...তিলোত্তমা বলতে শুরু করলো,

-তুমি প্রথম নও সৌর,যে আমাকে নিজের করে পেতে চেয়েছো।আমাকে পাওয়ার জন্য,তোমার চেয়েও বেশি পাগলামি করেছে একাধিকজন।কখনও টিউশন টিচার,কখনও স্কুলের বন্ধুরা,কখনও আবার ফ্যামিলি ফ্রেন্ড তার বা তাদের ছেলেদের জন্য আমাকে এডভান্স বুকিং করে রাখতে চেয়েছে।কিন্তু সেই সমস্ত প্রস্তাব আমি হেলায় সরিয়ে দিয়েছি,বাবাইও আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোদিনই আমায় জোর করবে না।সবাইকে না বলতে-বলতে,না বলাটাই আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে সৌর।তোমাকেও ভেবেছিলাম সরিয়ে রাখবো।কিন্তু বিশ্বাস করো,কিছুতেই পারলাম না।তোমাকে আর সরাতে পারলাম না কিছুতেই।কেন তুমি এত ভালোবাসলে আমায়?কেন আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম?!

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সৌর...তিলোত্তমার গালে গাল রাখলো ও....ভাবলো এটুকুই হয়তো ওর বক্তব্য,যে সৌর ওর কাছে কতখানি বিশেষ!!কিন্তু সৌরর তখনও আরও অনেক কিছু জানতে বাকি ছিলো.... তিলোত্তমা বলছে,

-ভালোবাসা মানেই কিন্তু প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া নয় সৌর,ভালোবাসা মানেই একে-অপরের সঙ্গে থাকতেই হবে,এমনটাও নয়।একসঙ্গে থাকার জন্য হয়তো,আমাদের দুজনকেই অনেক বড় মূল্য দিতে হতে পারে।আর আজ আমি তোমাকে একটা কথা একদম পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি সৌর,আমি জীবনেও কোনোদিন আমার কমফোর্ট-জোনের বাইরে বেরোইনি,ভবিষ্যতেও বেরোবো না।স্যাক্রিফাইজ,স্বার্থত্যাগ,এইসব ভারী-ভারী শব্দগুলোকে,আমি কিন্তু আমার ডিকশনারিতে কোনোদিনই জায়গা দিইনি,আগামী দিনেও দেবও না।আমার যেটা চাই,সেটা যেকোনো মূল্যে চাই-ই চাই।আমি না বলতে অভ্যস্ত,কিন্তু না শুনতে অভ্যস্ত নই।তাই সবার আগে প্রয়োজন আমাদের দুজনের মানসিকতা ম্যাচ করা।ভালোবাসা দিয়ে শুধু ভালোই বাসা যায় সৌর,কিন্তু জীবন চলে না।সবসময় কিন্তু শুধুমাত্র ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে,একসঙ্গে থাকা যায় না!আর আমি নিজেকে খুব ভালোভাবে চিনি।তুমিও আমাকে ভালোভাবে চিনে নাও।আমি কিন্তু আমার ইচ্ছে,আমার স্বপ্নপূরণের জন্য যে কোনো মূল্য দিতে পারি।জীবনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা,এমনকি সমস্ত সীমারেখাও উল্লঙ্ঘন করতে পারি....
-আমি বুঝলাম না মিছরি!!তোমার কি এমন ইচ্ছে,যার জন্য এতগুলো কথা আসছে?!

কোনো উত্তর দিলো না তিলোত্তমা।শুধু দুহাতে সৌরর গলাটা জড়িয়ে ধরলো।তারপর আলতো করে ঠোঁট রাখলো ওর ঠোঁটে...কথার খেই হারিয়ে ফেললো সৌর।ও মিছরির ঠোঁটটাকে নিয়ে আরও একটু খেলা শুরু করলো....কয়েক মুহূর্ত পর তিলোত্তমা নিজের ওষ্ঠ ও অধর মুক্ত করে বললো,
-আজ আসি!বললাম তো সৌর,পরীক্ষার পর প্রথম যেদিন দেখা করবে,সেদিনই সব বলবো তোমায়।আজ আর নষ্ট করার মতো সময়,আমার কাছে একদম নেই।বাই....
-বেশ,তাই হবে।আমি কোনদিন কোনো ব্যাপারেই তোমায় জোর করবো না।মিছরি শোনো,কটাদিন আমি জলে থাকবো না,তুমি কিন্তু সাঁতারটা ভালোভাবে প্র্যাকটিস করবে।আমি চাই ইন্টার-পুল কম্পিটিশনের দিন,তুমি জলে জাস্ট আগুন লাগিয়ে দাও,ঠিক যেমনভাবে আমার মনে আগুন লাগিয়েছো!!

সৌর আর তিলোত্তমা দুজনেই মৃদু স্বরে চাপা হাসি হেসে উঠলো....

-তুমি আমার নিজের হাতে তৈরি মিছরি।স্যারের সামনে অনেক বড় মুখ করে,আমি তোমার নামটা বলেছি।আমার সম্মান কিন্তু রাখতেই হবে।কি?বুঝলে তো?
-বুঝেছি!আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো।আমার দিক থেকে চেষ্টার কোনো খামতি থাকবে না সৌর,প্রমিস!
-হুম!!

একেবারে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্তও সৌরর হাতে মিছরির হাতটা রাখা ছিলো।মিছরির হাতেও আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে সৌর।
-তোমাকে ছাড়তেই তো ইচ্ছে করছে না মিছরি!
-তবু ছাড়তে তো হবেই।
-এভাবে বোলো না প্লিজ!ছাড়তে হবে আবার কি কথা!!বলো,যেতে দিতে হবে....
-যাইহোক,একই তো ব্যাপার!বাই সৌর!
-বাই.....

যতক্ষণ পর্যন্ত মিছরি আর টাইগার গলির বাঁকের অন্ধকার রাস্তায় ধীরে-ধীরে মিলিয়ে না গেলো,ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের দিকেই চেয়ে রইলো সৌর।আজ ফিরে দেখেছে সে।একেবারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে,ঘাড় ঘুরিয়ে একবার হাত নাড়লো তিলোত্তমা....ওর দিকে চেয়ে হাতটা নেড়ে বাই করলো সৌরও।মনটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেলো।আজ নিজেকে পূর্ণ মনে হলো সৌরর।ঋষি আর সমুর মতো,ওর জীবনে আর কোনো অধ্যায় অসমাপ্ত রইলো না,এটা ভেবেই ভালো লাগছে ভীষণ...সেই মুহূর্তেই ওর পকেটের ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো।নিজের কাজের ব্যাপারে বরাবরই যত্নবান সৌর।তাই আজ পর্যন্ত ওর ব্যক্তিগত পরিসরে বাবা-মা প্রবেশ করেনি,কারণ প্রয়োজনই পড়েনি।যখন যে জায়গায় সৌর পা রেখেছে,তা সে সাঁতার হোক,বা পড়াশোনা,শরীরচর্চা হোক বা খেলাধূলা,সাফল্যের সর্বোচ্চ শীর্ষে নিজেকে নিয়ে গিয়ে,তবেই থেমেছে।আজ পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্র বা বিষয়ে ও হাত দিয়েছে,আর সেটা অসমাপ্ত রয়েছে,এমনটা কোনোদিন হয়নি।তিলোত্তমাও তার ব্যতিক্রম নয়!!বছর শেষে ওর দুর্ধর্ষ রেজাল্ট দেখে,বাবা-মায়ের আর কোনো কথা বলার জায়গাই থাকতো না।ও বাড়িতে কখন ফিরলো,কেমন বন্ধুদের সঙ্গে মিশলো,কোথায় গেলো,সেই নিয়ে তাদের বড় বিশেষ মাথাব্যথা নেই।কারণ,দিনের শেষে তাদের সন্তানের দিকে আঙুল তোলার ক্ষমতা কারোর নেই।তাই তারা একপ্রকার নিশ্চিন্তই থাকে।সেই কারণে বাড়ির বাইরে বেরোলে,বাবা-মায়ের ফোন একেবারেই আশা করে না সৌর।বন্ধুরাও সবাই ঠিকই আছে।আর মিছরি তো সবেই গেলো।তবে কার ফোন?তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো সৌর.....অসময়ে অপ্রত্যাশিত এই নম্বরটা দেখে,বেশ অবাকই হলো ও...

-হ্যাঁ স্যার বলুন!
-সৌর?ফ্রি আছো?কথা বলা যাবে একটু?!

হেসেই ফেললো সৌর...

-কি যে বলেন স্যার?!নিজের ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য আবার সময়-অসময়?!প্লিজ বলুন!
-না মানে,সেদিন আমার কথার মাঝেই তুমি যেভাবে ছুটলে,এখন আর কি করে বলি বলো,ইউ আর মাই বয়!!এখন তুমি ভাগ হয়ে গেছো....

স্যারের কথা শুনে লজ্জায় সৌরর কান পর্যন্ত অনুরাগের লালে রক্তিম হয়ে উঠলো।সত্যিই তো,স্যারের অনুমতি ছাড়া ওনার সামনে থেকে,সৌর এক-পা নড়তো না পর্যন্ত!!আর সেদিন বিচ্ছিরিভাবে মিছরির পিছনে ও এক অমোঘ টানে ছুটে গিয়েছিলো।বাঁধতেই পারেনি নিজেকে।ফোনে কথা বললেও,ঘন অন্ধকারের মধ্যেই লজ্জায় অবনত হলো সৌরর মাথা....নিজের ডান হাতের তর্জনীটা নাকে ঘষে নিয়ে লজ্জায় মরে গিয়ে কোনোরকমে বললো,

-এক্সট্রিমলি সরি স্যার!!আসলে সেদিন....
-আরে দূর!আমি কোনো এক্সপ্লেনেশন চেয়েছি নাকি তোমার কাছে?!আমি তো একটু মজাই করছিলাম!ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে....

আর কথা বলতে পারলো না সৌর।ধীরে-ধীরে সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ালো।স্যার তখনও বলে চলেছেন,
-শোনো,কাজের কথায় আসি এবার!
-ইয়েস স্যার,বলুন!
-পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন?
-আমার দিক থেকে এক্সিলেন্ট স্যার!একটা ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট এক্সপেক্ট করছি...
-ভেরি গুড!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!
-একটু আগেই আমি তোমার বাবাকে ফোন করেছিলাম।

এবার বেজায় ঘাবড়ে গেলো সৌর...

-বাবাকে?কেন....বাবাকে কেন স্যার?
-একটা দারুণ সুখবর দেওয়ার জন্য!চেয়েছিলাম,উনিই তোমায় বলুক।কিন্তু উনি বললেন,যেহেতু তোমাকে এই জায়গায় এনে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আমার,তাই আমি যেন নিজের মুখে তোমায় এই খবরটা দিই....কিন্তু উনি ভুল বলেছেন।আমি তোমার ট্রেইনার ঠিকই,পথপ্রদর্শক ঠিকই,কিন্তু তোমার জেদ আর কঠিন অধ্যবসায়ই তোমাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।সেই কৃতিত্ব সম্পূর্ণই তোমার...
-স্যার,আমি না কিচ্ছু বুঝতে পারছি না,কি বিষয়ে কথা হচ্ছে?
-স্পোর্টস কোটা থেকে তোমার একটা চাকরির কথা চলছে সৌর।তোমার নাম এনলিস্টেড!জান লড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু।প্রত্যেকটা মাইক্রো-সেকেন্ডের মূল্য তুমি তো বোঝোই।পরীক্ষাটা আগে ভালো করে দাও,তারপর জল-তুমি-আমি-আমার হাতের স্টপওয়াচ আর ফিনিসিং লাইন,এগুলো ছাড়া পৃথিবীর সব ভুলে যাবে তুমি...সুযোগটাকে যেন হাতছাড়া না হয়....
-অপারচুনিটি একবার সৌরদীপ সাহার কাছে আসুক স্যার,জাস্ট একবারের জন্যই আসুক।বাকিটা সৌরদীপ সাহা বুঝে নেবে!তাকে কিভাবে কাজে লাগাতে হয়,সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না....
-দ্যাটস মাই বয়!
-থ্যাঙ্কু স্যার!
-পরীক্ষা না থাকলে কাল থেকেই জোরকদমে প্র্যাকটিস শুরু করতে বলতাম।কিন্তু পরীক্ষার জন্য আটকে গেলাম।তোমার পরীক্ষার পর,সময়টা কিন্তু আরও কমে যাবে।হাতে আর মাত্র কয়েকটা মাস পাবে তুমি....
-আপনি কিচ্ছু ভাববেন না স্যার,আমি ম্যানেজ করে নেবো!
-টাফ কম্পিটিটর আছে সৌর!!
-ডোন্ট ওয়ারি স্যার!ইফ দে আর পজিটিভ,আই এম সুপারলেটিভ!দা টাফেস্ট ওয়ান!আমার তাদের খবরে কোনো প্রয়োজন নেই স্যার!কারণ,স্থলে তারা কোথায় থাকলো,আমার জানার দরকার নেই।কিন্তু জলে তারা আমার পিছনেই থাকবে।আর আমার কম্পেটিশন আমি নিজেই।আমি নিজে নিজের সময়কে বিট করি।তার জন্য পিছনে কে আসছে,বা পাশে কে আছে,দেখার কোনো প্রয়োজনই মনে করি না।কারণ,পিছনে বা আশেপাশে দেখতে গেলে,ফিনিসিং লাইন মিস হয়ে যাবে স্যার,সামনে এগোতে পারবো না যে....
-ব্রিলিয়ান্ট!এজ এক্সপেক্টেড!!বাড়িতে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজটুকু কোরো।বডি যেন বসে না যায়!বাকিটা জলে তো আমি সঙ্গে আছিই....
-ডেফিনিটলি স্যার!!আমার মনে থাকবে,জল-আমি-আপনি-আপনার স্টপওয়াচ,আর ফিনিসিং লাইন...ব্যাস!!আর কিচ্ছু না!
-তাই?ব্যাস!!ঠিক তো?আর কিছু নাতো?!

স্যারের কথা বলার ধরনে হেসে ফেললো সৌর...সঙ্গে স্যারও...

-ওকে চলো!পরীক্ষার জন্য অল দা বেস্ট সৌর!!
-থ্যাঙ্কু স্যার!!

ফোনটা রেখে দিয়ে সাইকেলে উঠে বসলো সৌর...তারপর মনে-মনে বললো,
"আর কিছু?আর সে!!শুধুই সে....শুধু জলে নয়,মনেও আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যাওয়া,সে....আর কিছুক্ষণ আগে ফোনটা এলে,সেও সামনাসামনি জেনে যেতে পারতো।সে জেনে যেতে পারতো,যে পড়াশোনা শেষ করে সৌরদীপ সাহাকে আর হন্যে হয়ে চাকরীর জন্য বসে থাকতে হবে না।যেভাবেই হোক,এটা তো আমায় জিততেই হবে।তাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার প্রথম সিঁড়ি এটা....সুযোগ যখন নিজে থেকেই যেচে এসেছে,একে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না....জীবন দিয়ে দিতে হবে..."

সাইকেলটা চালিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো সৌর....

-মায়ের হাতটা অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের কাজকর্মও এখন করতে হচ্ছে।নইলে আরও একটু পড়ায় সময় দিতে পারতাম রে....

টিউশন শেষে সমুদ্র আর ঋষি বাড়ি চলে গেছে অনেক আগেই।কিন্তু রূপ দেখা করতে এসেছিলো নিশার সঙ্গে।সাইকেল দুটো রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে,একটু এদিকটায় এসে বসেছিলো রূপ আর নিশা...

-ঠিক হয়ে যাবে মা!চিন্তা করছিস কেন?

অন্ধকার বৃত্তের মাঝে নিশার কাঁধে হাত রেখে,ওকে নিজের বুকের কাছে টেনে রূপ বললো...
-হুম!জানি...
-তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি নিশা?

রূপের পেটে আর কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে,ওর গালের ওপর গাল ছুঁইয়ে দিয়ে নিশা বললো,

-বল না!
-এতদিন ধরে তোকে কাছ থেকে দেখছি।তুই আর মা!মামা আসেন মাঝে-মধ্যে।কিন্তু তোর বোন একদম আসে না,নারে?গত দু-বছরে শুধু শুনেই গেলাম,তোরা দুই বোন।রঞ্জার মুখে,তোর মুখে।কিন্তু তাকে তো দেখলামই না।মানে স্কুলের ছুটিতেও তো বাড়িতে আসা উচিত!

রূপের বুকে মুখ লুকোলো নিশা....

-টিউশনের আজই শেষ দিন।আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই।আজ এই প্রসঙ্গটা না তুললেই হতো না রূপ?!
-কেন?আমি কি তোকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে ফেললাম?সরি....
-না!তা নয়!রূপ?
-বল!
-আমি তোকে বিয়ে করতে চাই!
-এটা হঠাৎ কোথা থেকে এলো?!মানে কোন কথার পিঠে কোন কথা?!
-না,আমার কাছে এইসব প্রেমের জন্য সত্যি সময় ছিলো না রে।তার এটা কারণ নয়,যে আমি ভালোবাসতে পারি না।তার কারণ এটাই,যে প্রেম-ভালোবাসা আমার কাছে বিলাসিতা!আমার খুব ভয় করে রে....যদি আমাকে ছেড়ে সে চলে যায়?!আমার বদনাম,আমার মায়ের অসহায়তা...
-ওই পাগলী?এসব কি বলছিস তুই?
-না,সত্যিই আমি ভয় পেতাম।প্রতি মুহূর্তে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই তো!নতুন করে আর কোনো লড়াইতে নামতে ভয় লাগে রে....সাহসে কুলোয় না!
-আমি সবসময় তোর পাশে আছি নিশা।শক্ত করে তোর হাত ধরে...
-হুম!তুই বলেই এগোতে সাহস পেয়েছি আমি।জানি তুই কোনোদিন আমাকে ছাড়বি না।আমিও তোকে ছাড়বো না....আর সেই কারণেই সবটা তোকে বলবো....
-সবটা মানে?
-আমার পরিবারের কথা!
-আচ্ছা!বল....
-বাজারে আমার বাবার পাইকারি সবজির দোকান ছিলো।মায়ের মুখে শুনেছি,একসময় নাকি খুব রমরমা ছিলো আমাদের,টাকাও ছিলো।যখন জ্যেঠুর কারখানা বন্ধ হয়ে যায়,তখনও ঠাকুমা বেঁচে ছিলো।আমার বাবা-ই নাকি সেই সময় পুরো পরিবারটাকে টানতো।জ্যেঠু-জেম্মা-বড়দা-ঠাম্মি-আর আমার মা।আমরা তখনও হইনি।অমানুষিক পরিশ্রম করতো বাবা।কিন্তু মুখে নাকি সবসময় একটা সুন্দর হাসি লেগেই থাকতো।ধীরে-ধীরে আমরা দুই বোন হলাম,সংসার বড় হলো।তাও বাবা একাই সবাইকে টানছিলো।দাদার পড়াশোনা,সংসার খরচ সবটাই বাবার ওপর।চিন্তা-ভাবনায় ডুবতে শুরু করেছিলো বাবা।ঠিক সেই সময়ই জ্যেঠুর কারখানা খুললো,আর ঠাকুমাও মারা গেলো।কিন্তু ঠাকুমার মৃত্যুর পরই জ্যেঠু সংসার ভাগ করতে বললো।এমনকি জমি-জায়গা,ঠাকুমার হাঁড়ি-বাসন,সবকিছু ভাগ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগলো....মা বলে,এটাই না বাবা আর সহ্যই করতে পারেনি।একেবারে ভিতর থেকে ভেঙে পড়েছিলো।কথাবার্তা আর কারোর সঙ্গে বলতো না বিশেষ।সংসারে অশান্তি,জেম্মার সঙ্গে কারণে-অকারণে মায়ের নিত্যদিন ঝামেলা,এইসব কারণে ভাঙলো সংসার।এক বাড়ির মধ্যেই আলাদা হলো হাঁড়ি।বাবা ছোট হয়েও জ্যেঠুর জন্য অনেক করেছিলো তো,আর বড়দাকেও বড্ড ভালোবাসতো,একেবারে কাকাইয়ের হাতের ওপর ছোটবেলা থেকেই দাদা মানুষ হয়েছে....সেই দাদাকেও আর খেলতে আসতে দিতো না আমাদের ঘরে।বাবা ভিতর-ভিতর ভাঙতে-ভাঙতে একদিন ভোরবেলা পাইকারী বাজার থেকে ভ্যানে করে সবজি আনার সময়,করে বসলো এক্সিডেন্ট।দুটো পা অকেজো হলো,কিন্তু তাও মানুষটা ছিলো।টাকার অভাবে প্লেট বসাতে পারেনি মা।মামারবাড়ি থেকেই বাবার সমস্ত চিকিৎসা করেছে,মানে তাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব হয়েছে আর কি!!তারপর একদিন ধুঁকতে-ধুঁকতে বিছানায় শয্যাশায়ী মানুষটা কাউকে জানতে না দিয়ে,ঘুমের মধ্যেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।শেষদিকে নাকি বেডসোর হয়ে গিয়েছিলো শরীরের নিম্নাঙ্গে।আরও নানারকম কঠিন রোগ।জ্যেঠু আসেনি দেখতে।কাল-অশৌচও মানেনি।ওদের তখন অনেক পয়সা।ছেলে বড় হচ্ছে,আলাদা ঘরের প্রয়োজন।আমাদের আর বাড়িতে রাখা যাবে না।বাবাও মারা গেলো,আমাদেরও বাড়ি ছাড়তে বললো।বেশিরভাগ জমির ওপরে ঠাকুরদাদার তৈরি ওই সম্পূর্ণ বাড়িটা জ্যেঠু নিয়ে নিলো।পাশে যেখানে আমরা এখন থাকি,ওখানে ওই একটা ঘর করে দিলো মাকে,দুই বাড়ির মাঝে উঁচু করে পাঁচিল দিয়ে দিলো।মামা মাকে বলেছিলো,চল!এখানে থাকতে পারবি না,বাড়ি চল।কিন্তু মা ওই ভিটে ছাড়েনি।আগলে আজও বসে আছে।মামা তখন বললো,তুই যখন যাবিই না,এভাবে একা দুটো মেয়েকে মানুষ করবি কি করে?!ছোটটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি!ব্যাস!!সেদিন থেকেই আলাদা হয়ে গেলাম আমরা দুই বোন!আমি মায়ের কাছে,বোন মামার কাছে....মামারা আজও প্রতিমাসে টাকা পাঠায়।বোনকেও ভালো স্কুলে পড়াচ্ছে।আমার চেয়েও ভালো স্কুলে রূপ,অনেক বড় স্কুল।কিন্তু বোন আর এখানে আসে না।মায়ের সঙ্গেও সেভাবে কথা বলে না।আমি ফোন করলেও দায়সারা কথা বলে রেখে দেয়....আসতেই চায় না এখানে।আমার ছুটি থাকলে,মাকে নিয়ে আমি ওখানে যাই...ও এড়িয়ে চলে আমাদের....আমি জানিনা রূপ,ও কেন এমন করে?!

রূপের জামার মধ্যে মুখ গুঁজে নিজের চোখের জলটুকু মুছে নিলো নিশান্তিকা....রূপ ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো বুকে...ও রূপের বুকে মুখ লুকিয়েই বললো,
-জেম্মাদের এখন দোতলা বাড়ি!কিন্তু ওরা ভুলে গেছে,রোদে তেতে-পুড়ে,মাথায় গামছা বেঁধে,মিস্ত্রীদের সঙ্গে হাতে-হাত মিলিয়ে,ওই বাড়ির ভিত আমার বাবা তৈরি করে গেছে।ওরা ভুলে গেছে রে রূপ....
-চুপ কর!!ওসব বেইমানদের জন্য নিজের চোখের এক ফোঁটা জলও,তুই নষ্ট করবি না!
-হুম!আমি কাঁদি নারে একদম!মায়ের সামনে একটুও কাঁদি না!মা কষ্ট পাবে ভেবে!কিন্তু তুই,তুই তো আমার নিজের,আমার আপন,সবচেয়ে কাছের মানুষ।তোর কাছে তো প্রাণখুলে একটু কাঁদতে পারি বল!?
-হুম!!

নিশাকে নিজের বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো রূপ....

-জেম্মাদের ব্যাপারটা আমাকে ততটাও কষ্ট দেয় না,যতটা ছুটকির আচরণ,ওর অবহেলা,আমার প্রতি-মায়ের প্রতি ওর উদাসীনতা,আমাকে কষ্ট দেয়...
-ছুটকি কে?
-আমার বোন!তমিস্রা!!ও তমিস্রা,আমি নিশান্তিকা....ও মিশকালো রাত,আর আমি সেই রাতের অসমাপ্ত অধ্যায়,অন্তিম লগ্ন....
-বাঃ!ভারী সুন্দর নাম তো,তমিস্রা!!
-হুম!!সে দেখতে আরও সুন্দরী!!আজ ওর কথা তোকে বিশেষ কিছু বলবো না,ওর রূপের বর্ণনা দিলে,তুই আমাকেই ভুলে যাবি!আমি মায়ের মতো হয়েছি,ছুটকি বাবার মতো।ব্যস!!আর কিছু বলবো না।এমনিতেই তো শালি,অর্ধেকটা তো তোরই...আর তাকে দেখলে আবার তুই হড়কে,পুরোটাই না তার হয়ে যাস!তোকে বাবা বলবোই না তার কথা!!

মৃদু হাসলো নিশা...

-ঠিক আছে।বলিস না!সে না হয় আমি নিজের চোখেই দেখে নেবোখন!একমাত্র জামাইবাবু বলে কথা,একটু তো শালিকে দেখেশুনে নিতেই হবে....
-একটা চড় মারবো!!

সপাটে রূপের গায়ে হাত চালিয়ে দেয় নিশা...রূপ ওর হাতটা চেপে ধরে ওকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ-চিহ্ন এঁকে দেয় ওর গালে....

-এই আমাকে ছাড়,ওঠ!তুই আবার বাড়াবাড়ি শুরু করবি!!
-বাড়াবাড়ি করবো না নিশা!প্লিজ....একটু....
-না...চল ওঠ-ওঠ!বাড়ি যাবো!!রাত হয়ে যাচ্ছে...
-তুই চলে যা!আমি পরে আসছি!

অভিমান করে মুখ গোঁজ করে বসে রইলো রূপ...

-অমনি বাবুর রাগ হয়ে গেলো...
-তুই কিন্তু আমাকে এখনও বলিসনি নিশা!
-কি?
-ভালোবাসি....

মিথ্যে অভিমান দেখানো রূপকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, দুহাতে ওর দুটো কান টেনে ধরলো নিশা.... তারপর বললো,
-আবার বল,কি বলিনি?
-ভালোবাসি!!

মৃদু হেসে দুটো কান ছেড়ে,একটা হাত দিয়ে রূপের দুটো চোখ চেপে ধরলো নিশা।চোখ বন্ধ অবস্থায় ওর ঠোঁটের ওপর নিজের ঠোঁট মৃদু স্পর্শ করে বললো,
-আমিও....

বলেই উঠে দৌড় দিলো সাইকেলের দিকে।রূপ ওকে ধরতে গিয়েও,একটুর জন্য বেরিয়ে গেলো হাত থেকে।খেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রূপ,
-হবেনা!চিটিং!তোকে আমি ওটা বলতে বলিনি....
-একবারে বলে দিলে তুই পালাবি হতচ্ছাড়া!তাই ইন্সটলমেন্টে বলবো!!টাটা....মন দিয়ে পড়বি...ফেল করে বেকার থাকলে কিন্তু,তোকে বিয়েই করবো না...

হাসতে-হাসতে দৌড়ে এসে নিশার সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরলো রূপ...

-তুই চাকরি করবি,আমি বসে খাবো!
-এখন থেকেই পিঠ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা,তাই না?!যা,বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস!আমিও যাই....
-মন দিয়ে পড়তে পারবো না নিশা!!
-কেন?মন কোন বনে বন্ধক দিয়েছিস তুই?
-তোর কাছে বন্ধক দিয়েছি!কিছু তো দিয়ে যা...এই কদিনের জন্য!!প্লিজ....

আবার সাইকেলের স্ট্যান্ড ফেললো নিশা।এগিয়ে এলো রূপের কাছে।রূপের ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো আলতো করে।তারপর জোরে কামড়ে দিলো...দিশেহারা হয়ে গেলো রূপ।প্রথমবার নিশাকে এতটা পায়নি ও,এভাবে পায়নি...ওর অবস্থা দেখে,নিশা হেসে ছেড়ে দিলো ওকে....

-বাচ্চা ছেলে!!
-ওই....
-কি?কি হয়েছে কি?গলাবাজি করছিস কেন?বাচ্চাকে বাচ্চা বলবো না তো কি বলবো?!গার্লফ্রেন্ড ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে,কি করবি না করবি দিশা পাচ্ছিস না....দেখি....

রূপের হাত ধরলো নিশা।তারপর ওর হাতটা ওর গালেই ঠেকিয়ে দিলো।
-দেখ!কি এটা?তোর হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে!!

মাথা নীচু করে নিলো রূপ....নিশা বললো,

-সামলাতে পারবি না যখন,চাস কেন?
-তাতে কি হয়েছে?তুই-ই তো!!তোর কাছে অক্ষমতায় লজ্জা কিসের?তুই নিজের মতো করে তৈরি করে নিবি আমায়!সেদিনও চেয়েছিলাম,তুই ঠোঁটে একটু ঠোঁট ঠেকিয়েই দৌড় দিলি!ভেবেছিলাম আজও তাই করবি!আজ মহারানী আজ যে এমন ঘ্যাক করে কামড়ে দেবে,বুঝবো কি করে?!
-কি-কি?কি করে কামড়ে দেবে?!
-কিছুনা!সরি!
-তুই আর একদম আমার চোখের সামনে আসবি না হতভাগা!!
-আচ্ছা,ঠোঁটের সামনে এলে চলবে?
-দূর হ!!
-তুই একটু দূরে যা,আমি দূর হয়ে ঘুরে তোর কাছেই আসছি!
-ইডিয়ট!!

সাইকেলে উঠে পড়লো নিশা.... ও চলে যাচ্ছে দেখে রূপ চেঁচালো,
-লাভ ইউ!!

দূরে মিলিয়ে যেতে-যেতে ভেসে এলো নিশার কণ্ঠস্বর,
-আমিও...

হেসে মাথা নামিয়ে নিলো রূপ,
"আবারও চিটিং!তুই কি কোনোদিনও নিজের মুখে বলবি না নিশা!!একবারও কি বলবি না?তোকে ভালোবাসি রূপ!"

সাইকেলে উঠে উল্টোদিকের রাস্তায় বেরিয়ে গেলো রূপায়ণ....

পরবর্তী সময়টুকু সরস্বতী দেবীর শ্রীচরণে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিলো সকলেই,একমাত্র সমুদ্র ছাড়া....ওর তখন অর্ধন্মাদ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!বাবা গিটারটা ফেরত দিলোই না আর।পড়াশোনায়ও সেভাবে মন বসে না।সৌর আসতে চায় সমুর কাছে,পড়াশোনায় সাহায্য করবে বলে,কিন্তু সমুই বারণ করে।এতরকম সাফল্যের চাদরে আবৃত সৌরকে দেখলে,ওর বাবা-মা আরও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।সমুদ্রর ওপরে মানসিক অত্যাচারের পরিমাণটা আরও একটু বেড়ে যায়।সারাদিন কানের সামনে ওই সৌররই গুণকীর্তন চলতে থাকে।তাই প্রয়োজনে সমু চলে যায় ওর কাছে,কিন্তু নিজের বাড়িতে ওকে ডাকে না খুব একটা....

রুটিনমাফিক সমস্ত পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও,গন্ডগোলটা কিন্তু প্রথমেই বেঁধে গেছিলো।আর সেটা ইংরেজি পরীক্ষা নিয়ে।প্রশ্নপত্র বেশ কিছুদিন আগে ফাঁস হয়ে যাওয়ায়,সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পরবর্তীকালে সেই পরীক্ষা পুনরায় নেওয়ার।তাই অন্য সকল পরীক্ষা সুচারুভাবে হয়ে গেলেও,বাকি থেকে যায় রানী ম্যামের বিষয়টাই,ইংরেজি....

ইংরেজি পরীক্ষার দিন দুয়েক আগে একদিন রাত্রিবেলা মন দিয়েই পড়াশোনা করছিলো সমুদ্র।বেশ অনেকক্ষণ একভাবে পড়ার ফলে বিরক্ত লাগছিলো ওর।কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে গান চালিয়ে বালিশের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে তার কথাই ভাবছিলো ও।অনুপ্রেরণা....কি করছে এখন তার অনুপ্রেরণা?!ভীষণ ক্লান্ত কি?তার ভালোবাসার বুকের ওপর নিজের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই।কান থেকে একটানে ঢাউস হেডফোনটা খুলে ফেললো সমুদ্র।রানী ম্যামের কথা ভাবতে গেলেই,আগে তার সিঁথির ওই লালচে সিঁদুরের আভাটুকু মনে পড়ে।তারপরই এইসব উল্টোপাল্টা চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করে,আর পাগল-পাগল লাগে।কান-মাথা একেবারে গরম হয়ে যায়!চোখ বন্ধ করে ওকে বলা ম্যামের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলো সমুদ্র....চোখের সামনে ভাসছিলো শুধুমাত্র তারই মুখ....

"কি ব্যাপার বলো তো সমুদ্র,তুমি কি আমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগিয়ে রেখেছো নাকি!মানে বেশিরভাগ দিনই আমার শাড়ির সঙ্গে তোমার আনা ফুলের রঙ মিলে যায় কি করে?"

"একি?আজ খালি হাতে?"

"তুমি বলো সমুদ্র,পরীক্ষা তো প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে।প্রিপারেশন কেমন?প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?কিছু ডাউট থাকলে,এক্সট্রা ক্লাসে ক্লিয়ার করে নিতে পারো!"

ফোনের যান্ত্রিক শব্দে চোখ মেললো সমুদ্র....তখনও কাজে বাজছে তারই সুমধুর কণ্ঠস্বর।

"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"

ফোনে একটা ই-মেইল ঢুকেছে।তড়াক করে উঠে বসলো সমুদ্র।ওর সারাটা শরীর কাঁপছে....যা ভেবেছিলো,ঠিক তাই।গানের যে অনলাইন অডিশনটা দিয়েছিলো,তারই ডাক পাঠিয়েছে ওরা।সেই বহুকাঙ্খিত ই-মেইল!সম্পূর্ণ মেইলটা পড়তে-পড়তে উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছিলো সমুদ্র।আনন্দে গান বাদ দিয়ে একটু নেচে নিতে ইচ্ছে করছিলো ওর....কিন্তু ওখানে পৌঁছনোর জন্য নির্ধারিত সময় এবং তারিখ দেখে,ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।ওখানে পৌঁছনোর সময় এবং তারিখ,আর ইংরেজি পরীক্ষার সময় এবং তারিখের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য নেই,তারা হুবহু এক....অর্থাৎ জীবনের চরম সিদ্ধান্তের সময় উপস্থিত।হয় পরীক্ষা তথা পড়াশোনা,নয় গান....যেকোনো একটাকে বেছে নেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ আগত....দুটোর মধ্যে যেকোনো একটাকে বেছে নিলেই,চিরকালের মতো অসমাপ্ত রয়ে যাবে অন্যটা।এইখানে গান গেয়ে একবার উত্তীর্ণ হয়ে গেলে,আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে না সমুদ্রকে।আর পিছন ফিরে চাইতে হবে না।প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে একেবারে চুক্তিপত্রে সই করিয়েই নেবে ওরা।জীবন তৈরি হয়ে যাবে।এইরকম একটা সুযোগের জন্যই তো আজীবন নিজেকে তৈরি করেছে সমুদ্র....আর পরীক্ষা দিতে গেলে,হাতছাড়া হয়ে যাবে এই সুবর্ণ সুযোগ।আবার ওই পড়াশোনার যাঁতাকলে,বাবা-মা ওকে একেবারে পিষে মেরে ফেলবে!!কোনদিকে যাবে সমুদ্র।যদি জিততে পারে,তবেই পাবে সমস্ত সুযোগ!কিন্তু হেরে গেলে!?একদম মনের জোর পাচ্ছে না সমুদ্র।অনেক বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে....হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি....মাথায় এইসব চলছে বিন্দুমাত্র আভাস পেলেও,বাবা-মা খুন করে ফেলবে ওকে....আর ভাবতে পারে না সমুদ্র...কাকে বলবে ও?বন্ধুদের এসব কথা বললে,সৌর ওকে যতই ভালোবাসুক,কেটে ফেলে দেবে!ঠিক মাকে জানিয়ে দেবে...কাকে বলবে ও?কি বলবে?কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই সুমধুর শব্দবন্ধ,

"প্রতিটা বিষয় তো বটেই,আমার সাবজেক্টে এ প্লাস আসবে তো?"

বিদ্যুৎচমকের মতো তারই বলা আরও একটা কথা মনে পড়ে গেলো সমুদ্রর,

"ভালো করে পরীক্ষাটা দিও সমুদ্র।কিন্তু গানটা ছেড়ো না।জীবনে যা চাও,তাই নিয়েই সুপ্রতিষ্ঠিত হও..."

আমূল কেঁপে উঠলো সমুদ্র....হেডফোনের পাশে রাখা ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ই-মেইল,সামনে ইংরেজি বই খোলা....ফোন দিচ্ছে অপূরণীয় রঙিন স্বপ্নের হাতছানি,আর বই জানান দিচ্ছে কঠোর বাস্তব!!সমুদ্র ঠিক করে উঠতে পারলো না,কোনটা অসমাপ্ত রাখবে ও?বাস্তব না স্বপ্ন?!

চোখ দুটো প্রচন্ড জ্বালা করে উঠলো।বইয়ের কালো-কালো অক্ষরগুলো ধীরে-ধীরে ঝাপসা হয়ে গেলো....নিশ্চুপে চশমার কাঁচ ভিজিয়ে,সমুদ্রর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো লবণাক্ত জল....

(চলবে.....)

ছবি: সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট