অনুসরণকারী

শনিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২৩

খিল অষ্টম পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
অষ্টম পর্ব



নাগের বাড়ির সর্বকনিষ্ঠা কন্যার বিয়েতে কোনোপ্রকার ত্রুটি রাখা চলে না। সুতরাং রাজকীয় আয়োজনের যাবতীয় প্রস্তুতির জন্য মৃগাঙ্ক সর্বদা নিজের মাথার মধ্যে রাজ্যের হিসেব কষে চলেছে। শশাঙ্ক অসহায় হয়ে একবার তৃণার দিকে আর একবার নিধির মুখের দিকে চাইল। রান্নাঘরের বারান্দায় বারংবার পায়চারি করে সে ফিরে গেল নিজের ঘরে। আহ্লাদীর বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপনের সাহস শশাঙ্ক পাচ্ছে না। রন্ধনকার্যে তৃণার সঙ্গে সহযোগিতা করছিল নিধি। সে আপন পূজনীয় স্বামীর কার্যকলাপ দেখে নিজের কপালে নীরবে করাঘাত করল। এ সংসারে যে পুরুষের মেরুদন্ড নেই, সেই পুরুষের ঘরণী হওয়ার লজ্জায় আগুনের তাপে আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়ার সময় রক্তবর্ণ ধারণ করল নিধির মুখ। এমনকি অঙ্কন পর্যন্ত একতলা থেকে একবার ঘুরে উত্তরাকে খুঁজে না পেয়ে সাহসের অভাবে ফিরে গেছে দোতলায়।
প্রাত্যহিক গতানুগতিক রুটিন মেনে দিন শুরু হয়েছিল। স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে শিবালয়ে গিয়েছিল উত্তরা। শহুরে জীবন থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে এ বাড়িতে আসলে, স্নানের পর পুজোর দায়িত্বটা সে নিজের কাঁধে তুলে নিতে পছন্দ করে। দ্বিতীয়বার চায়ের জন্য তাগাদা দিতে একতলায় নেমে এসেছে মৃগাঙ্ক। রান্নাঘরের গ্যাসের ওপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হাঁড়ি-কড়াই জাঁকিয়ে বসছে। গৃহকর্ম সহায়িকা চাঁপা ঘর মুছতে মুছতে কোমরে কাপড়ের আঁচল পেঁচিয়ে বলল,
-বড়দাবাবু একটু সরে দাঁড়াও গো। সিঁড়ি মুছে উঠোনখানা ধুয়ে বেরিয়ে যাব। সাবধানে পা ফেলো। ভিজে মেঝে!
-হ্যাঁ সেই.... চা খেতে এসে আবার আছাড় খেয়ে কোমর ভেঙে ফেলো না বাপু.... সামনে বোনের বিয়ে বলে কথা!
রান্নাঘরের ভিতর থেকে তৃণার গলা শুনে মৃগাঙ্ক বলল,
-লাস্ট রাউন্ড চা কি পাব না?
পুজোর থালা হাতে নিয়ে মাথার ঘোমটা সামলে মৃগাঙ্কর সামনে এসে দাঁড়াল উত্তরা।
-বড়দাভাই প্রসাদ নিন। আর প্রসাদী ফুল-বেলপাতা। চাইলে সঙ্গে রাখতে পারেন।
অতর্কিতে ভাতৃবধূ একেবারে মুখোমুখি এসে উপস্থিত হওয়ায় খানিক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে অনভ্যস্ত মৃগাঙ্ক বলল,
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। বয়স বাড়ছে। এখন অনেক বুঝে খেতে হয় ছোটবৌ। দায়িত্ব-কর্তব্য মেলা আছে। আরও কিছুদিন বাঁচতে হবে। তুমি বরং সন্দেশটা ভেঙে দাও। গোটা খাব না।
-তাই নিন দাদাভাই। প্রসঙ্গ যখন স্বাস্থ্য, তখন জোর করব না। আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিচ্ছি। দিদিভাইরা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আপনি অফিসে যাবেন। বাচ্চাদের টিউশন-স্কুল আছে। ওরা কতদিকে করবে? আমি ঢুকছি রান্নাঘরে।
একতলায় উত্তরার কন্ঠ শুনে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়িতে নেমে এসেছে অঙ্কন। হাতে দৈনিক মুদি বাজারের ফর্দ আর কলম নিয়ে মৃগাঙ্ক রান্নাঘরের সিঁড়ির সামনে বসে হাঁক দিল,
-শশী, এই শশী।
ঘর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে শশাঙ্ক বলল,
-হ্যাঁ দাদা, বলো।
-থাকিস কোথায় সব? জানিস আমার অফিস আছে। সকালের এই সময়টাতেই একটু ফাঁকা থাকি। সামনে মাথার ওপর এতবড় কাজ। একসঙ্গে বসে একটা আলাপ-আলোচনা সেরে নিতে হবে তো! তা ছেলের বাড়িতে সামনের সপ্তাহেই যাওয়া যাক? ওরা সব দেখেশুনে গেছে। এককথায় রাজি। আমাদের মেয়ে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। আমরাও আর দেরি করতে চাই না। এবার সবাই মিলে গিয়ে পাকাকথা বলে পঞ্জিকা দেখে একটা ভালো দিন ধরে সব ঠিক করে ফেলি। মিস্ত্রী-মজুর লাগিয়ে বাড়ির কাজও তো শুরু করতে হবে। বাড়ি আর বিয়ে, দুটোই বড় কাজ। এই তো, ছোটও এসে গেছে। বোস অঙ্কন। তা বোনের বিয়েতে তোরা কে কোন দায়িত্ব নিবি, আমাকে জানা। সেইমতো আমি এগোব। আমার পক্ষে তো অফিস করে সবটা একার হাতে সামলানো সম্ভব নয়।
ফুটন্ত চায়ের জলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেও উত্তরার মন পড়ে রয়েছে বাইরের বারান্দার দিকে। অঙ্কন এখনো কিছু বলছে না কেন! চায়ের কাপ বের করে উত্তরার হাতে দিয়ে তৃণা বলল,
-শোন ছোট, ভাসুরের থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়। নইলে বৌয়ের নিন্দে হয়। তুই প্রসাদ নিয়ে তার এত সামনে গিয়েছিলি কেন? আর তোর ঘোমটা মাথা থেকে খালি খসে যায় দেখি! আঁচল আর ঘোমটা ঠিক করে সামলে রাখ ভাই। নিজেরা মেয়েমানুষরা থাকলে একরকম। তখন কেউ ডাক নেবে না। এখন ঘরের ভিতর তোর ভাসুর ঠাকুর রয়েছে না!
উত্তরা কোনও উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে ঘোমটা ঠিক করে গায়ে কাপড়ের আঁচল টেনে নিল। নিধি মৃদুস্বরে বলল,
-ছোট'র কি শাড়ি পরার অভ্যাস আছে দিদি? এখানে এলে আমাদের মান রাখতে পরে। তাই ওসব ঘোমটা তেমনভাবে সামলে চলতে পারে না। তা কী আছে! বাড়ির মধ্যেই তো...
-মাছের ঝোলের আলুটা কেটে দে মেজ। পাতলা আর লম্বা করে কাটিস। বেশি ধ্যাবড়া করে কাটলে সহজে সেদ্ধ হতে চায় না, অনেক সময় যায়। বুঝলি!
-বুঝলাম, হাতের কাজটা সেরেই দিচ্ছি।
চায়ের কাপগুলো সাজিয়ে নিয়ে দূর থেকে চোখের ইশারায় অঙ্কনকে ডেকে ট্রে ধরিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে শাসন করল উত্তরা। চায়ে চুমুক দিয়ে অঙ্কন অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
-বড়দা, বলছিলাম যে.... এ বিয়েতে আহ্লাদীর মত আছে কিনা.... একবার কথা বলে নিলে...
মৃগাঙ্ক ভ্রু কুঁচকে হতবাক দৃষ্টিতে অঙ্কনের দিকে চাইল। তারপর মৃদু ভর্ৎসনার স্বরে বলল,
-এটা নাগের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে অঙ্কন, ছেলের বিয়ে নয়। এতদিন ছেলেরাও বিয়ের ব্যাপারে ব্যক্তিগত মতামত জানাতে পারত না। এ বাড়িতে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। সবটাই পারিবারিক। গুরুজনরা যা ঠিক মনে করত, সেই সিদ্ধান্তই সকলে মেনে নিত। এটাই এ বাড়ির ঐতিহ্য, নিয়ম। যদিও আজকাল সেই নিয়মেরও হেরফের হচ্ছে বৈকি! ছেলেরা নিজের ইচ্ছে জানাচ্ছে, ইচ্ছেপূরণ করতে বাধ্য করছে। কিন্তু একজন একবার নিজের ইচ্ছে জাহির করেছে বলে তো বারবার সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। তুমি যার মতামত নিতে চাইছ, সে নিজের এবং পরিবারের অন্যান্যদের ভালোমন্দ বুঝতে পারলে, এই বংশের গায়ে কলঙ্কের কালি লেপে দিতে পারত না। এখন তার বোধ-বুদ্ধির ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে আমাকে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে বলছ?
-ঠিক আছে বড়দা, বুঝেছি। সরাসরি কাজের কথায় আসি। আহ্লাদীর জন্য এই ছেলে আমার পছন্দ নয়। এই বিয়েতে কে কোন দায়িত্ব নেবে, তুমি একটু আগে জানতে চাইছিলে। তাই আমি আমার মতামত জানিয়ে দিলাম। এই ছেলেকে আমি আহ্লাদীর বর হিসাবে মানতে পারছি না। পাত্রপক্ষের পছন্দ শেষ কথা হতে পারে না। মেয়ের বাড়িরও একটা মতামত আছে। এ বিয়েতে আমার মত নেই। মেজদা তোমার ভয়ে কিছু বলবে না। তবে আমার মনে হয়, তারও একই বক্তব্য।
সকাল থেকে একাধিকবার অভ্যাস করা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে উগড়ে মাথা নামিয়ে কম্পিত বুকে মোড়ার ওপর বসে রইল অঙ্কন। জুড়িয়ে যাওয়া চায়ের স্বাদ তখন ফিকে হয়ে গেছে। মৃগাঙ্ক একবার রান্নাঘরের দরজার দিকে চাইল। মাথায় ঘোমটা টেনে চৌকাঠের ওপর চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে উত্তরা। বারান্দায় পিনপতন নীরবতা। রান্নাঘরের ভিতর বাসনপত্রের ঝনঝনানি কোন এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। মৃগাঙ্ক ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-শশী, তুইও একই কথা বলবি?
শশাঙ্ক যেমন নেতিবাচক উত্তর দিল না, তেমন ওর পক্ষ থেকে কোনও ইতিবাচক ইঙ্গিতও মিলল না। চুপ করে বসে রইল ও। হাত থেকে খুন্তি নামিয়ে তৃণা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলে উঠল,
-এ পাত্র যখন পছন্দ না, তা তোমরাই দেখেশুনে ও মেয়ের বিয়ে দাও না ঠাকুরপো। কেউ তো মানা করছে না। বোন তো কারও একার নয়। সবারই। বোনের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও সবার। আমরাও দেখি, ওর জন্য তোমরা কেমন ঘর আলো করা রাজপুত্র ধরে আনো! কার বুদ্ধিতে ছোট ঠাকুরপো এসব কথা বলছে, সে কি আর আমি বুঝি না!
-ভুল বুঝো না বড়দিভাই, তোমাকে একটা কথা বলি। বিয়ে ভালো হওয়া কিংবা মন্দ হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যা ভাগ্যে আছে, তাই হবে। যার হাঁড়িতে আহ্লাদীর জন্য চাল বরাদ্দ আছে, তার ঘরে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু আমরা বড়রা যখন দেখেশুনেই বিয়েটা দিচ্ছি, তখন মেয়েটাকে একেবারে জলে ফেলে দিতে পারি না। বাড়ি-ঘর বিষয়-সম্পত্তির জন্য পাত্রপক্ষ পুরোপুরি আমাদের ওপরেই নির্ভর করছে। সে ঠিক আছে। না হয় সবই আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে দেব। অন্তত মানুষটাকে দেখে তো মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে.... এখানে তো সেই শান্তিটুকুও নেই। ঠিক কী দেখে একে তোমার মনে ধরল দিদি?
-তা তোর আদরের ছোট ননদ যতজনের সঙ্গে শুয়ে এসেছে, তাদের মধ্যেই যদি কাউকে মনে ধরে, তবে ঝুলিয়ে দে তার গলায়। ঐ তো গুণবতী মেয়ে! একজন বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, এই ঢের! আবার মনকে সান্ত্বনাও দেওয়া চাই, কত চাহিদা.... এ পাত্র হাতছাড়া হলে ও মেয়েকে আজীবন আইবুড়ো অবস্থায় ঘরে বসিয়ে রাখতে হবে বলে দিলাম। মনের মতো চাই.... হুহ! এ পৃথিবীতে কোনও কিছু কি মনের মতো পাওয়া যায় রে ছোট?
-তা যায় না ঠিকই! মনের মতো পাওয়া গেলে তো আমিও পেতে পারতাম! সংসার করতে গিয়ে দেখলাম, কত কিছুর অবস্থান মনের ঊর্ধ্বে! মানিয়ে গুছিয়ে চলছি। কী করব? অপছন্দ বলে কাউকে তো আর ফেলে দিতে পারি না। রক্ত দিয়ে গড়া সম্পর্কের শাখা-প্রশাখা সব। হাতের পাঁচটা আঙুল কি আর সমান হয়? এখন এসব নিয়ে বিশেষ ভাবি না। যাকে দিয়ে সম্পর্ক, সে ঠিক থাকলেই হল।
-তুই কি ছোট ঠাকুরপোকে সামনে রেখে আমাকে ঠেস মেরে কথা বললি ছোট?! তোর এতবড় আস্পদ্দা! হ্যাঁ গো, শুনলে তুমি? ছোটবৌয়ের কথাটা শুনলে? দু'দিন হয়েছে এ বাড়িতে এসেছে। ভিন্ন থাকে। ফোন করে ডাকলে কুটুমের মতো বেড়াতে আসে। আমি একা এতবড় সংসারের জোয়াল টেনে মরি। তুমি ঘরে বাইরে গাধার মতো খেটে মরো। তা সত্ত্বেও ওর কথার দৌড় দেখলে? ছোট-বড় কিছু মানে না। মেয়েমানুষের এত তেজ ভালো না ছোট!
-যা পারো করো তোমরা। এ বাড়ির কোনও কিছুতে আমি আর নেই।
মৃগাঙ্ক খাতাপত্র ছুঁড়ে ফেলে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অঙ্কন একছুটে মৃগাঙ্কর পথরোধ করে বলল,
-দাদা প্লিজ তুমি অপরাধ নিও না। উত্তরা, এক্ষুণি দাদা-বৌদির কাছে ক্ষমা চাও। উত্তরা!
রান্নাঘরের চৌকাঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল উত্তরা। নিধি ওর কাছে এগিয়ে উত্তরার খসে পড়া শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-কাল রাতে তোর ঘরে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা চেয়ে নে ছোট। অশান্তি করিস না। আহ্লাদীর কপালে যা আছে, তাই হবে। তুই দাদাভাইয়ের ছোট বোনের মতো। দাদার সামনে মাথা নত করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। যা সোনা, লক্ষ্মী বোন আমার। দাদাভাইয়ের কাছে গিয়ে একবার বল, ভুল হয়ে গেছে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
-উত্তরা...
-দেখলে ঠাকুরপো? মেয়ের তেজ দেখলে! তোমারও ভাই দোষ আছে। আশকারা দিয়ে বৌকে একেবারে মাথায় তুলে দিয়েছ। এখন তোমার কথাকেই মান দেয় না। শ্বশুরবাড়ির ঘর না করলে, তোমার বৌ বুঝবে কিভাবে এখানে কেমনভাবে চলতে হয়! ও থাকে এখানে? কোন অধিকারে এত কথা বলে ও? পেটে তো শুনেছি মেলা বিদ্যে আছে। তা এরপর থেকে তোমার বৌকে একটু বুঝেশুনে বুদ্ধি রেখে মুখ খুলতে ব'লো ভাই। কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, সেটা যেন মাথায় রাখে...
-বুঝেশুনে কথা বলার দায় তো আমার একার নয় বড়দিভাই। বোন যেমন কারও একার নয়, শ্বশুরবাড়িও কারও একার নয়। শ্বশুরবাড়ির ঘর করার সময় মানিয়ে গুছিয়ে বুঝে চলতে গেলে সবাইকেই চলতে হবে। নাগের বাড়ি আমার না হলে, তোমার হবে কী করে? যে সম্পর্কের জোরে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ, আমিও তাই আছি।
হাতের কাজ ফেলে নাগের বাড়ির গৃহকর্ম সহায়িকা চাঁপা কলতলা থেকে হাঁ করে চেয়ে রয়েছে বারান্দার দিকে। অঙ্কন চিৎকার করে উঠল,
-উত্তরা! বড়দার কাছে ক্ষমা চেয়ে এক্ষুণি ওপরে যাও। তুমি আর একটাও কথা বলবে না।
-কেন বলব না অঙ্কন? বড়দিভাইয়ের কথা মেনে চললে মা-ও এ বাড়িকে নিজের ব'লে দাবি করতে পারেন না। কারণ এটা তাঁরও শ্বশুরবাড়ি। ধমকে তুমি বৌকে চুপ করাতে পারবে। কিন্তু এদিকে মায়ের অধিকারকেও যে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, ছেলে হয়ে তার প্রতিবাদ করবে না? যতদূর মনে পড়ে বিয়ের পর তুমি আমাকে বরণ করে একটা কথা বলেছিলে বড়দিভাই। আজ থেকে এটাই তোর বাড়ি ছোট। আমিও হাসিমুখে তাই মেনে মানুষগুলোকে আপন করে নিয়েছিলাম। আমি আমার বাবা-মায়ের একটাই সন্তান। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর অনেকগুলো দিদি-দাদা পেলাম। নিজের বাড়িতে কাজিন দাদা কিংবা ভাইদের দেখে কখনো এক গলা ঘোমটা দিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে হয়নি। বড়দাভাই মেজদাভাইকে আমি নিজের দাদার মতোই সম্মান করতাম। যে মুখে তুমি বলেছিলে এটা আমার বাড়ি, সেই মুখেই এক মুহূর্তে আমাকে পর করে বুঝিয়ে দিলে এটা আমার শ্বশুরবাড়ি, আর তাঁরাও আমার দাদা নয়, ভাসুর ঠাকুর। এ আমি মনে রাখব।
কয়েক পা হেঁটে মৃগাঙ্কর সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে উত্তরা বলল,
-আপনাকে বা বড়দিভাইকে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করার জন্য আমি কিছু বলিনি।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। তুমি নিজের ঘরে যাও ছোটবৌ।
-আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আমি আজ পরিবারের মানুষগুলোর সামনে নিজের মতামত রেখেছি। কারণ আমি নিজেকে এই পরিবারেরই একজন মনে করতাম। এগুলো তো বাইরের কাউকে বলতে যাব না। নিজের জনকেই বলব। এসব কথা বলে কোনও পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা আমি করিনি। এ নেহাৎই মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্যায়ন, বাক স্বাধীনতা আর নিজস্ব মত প্রকাশের সংগ্রাম ছিল, যেখানে আমি হেরে গেলাম। আপনারা রক্ষণশীল গোঁড়া পরিবারের মেকি আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য যে সমস্ত নিয়মকানুন নিজের কাঁধে আজ পর্যন্ত বয়ে চলেছেন, তা সমস্তই সঠিক। কেবল বেঠিক আমিই এই পরিবারের অনুপযুক্ত। আমাকে তো বটেই, একটা ভুল মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পারলে অঙ্কনকেও ক্ষমা করে দেবেন। কথার পৃষ্ঠে কথা বাড়ে। সেই কথা বলতে বলতে আমরা সবাই মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি। দাদা হয়ে বোনের ওপর অধিকার ফলাতে গিয়ে ভুলে যাওয়া হচ্ছে, সেই অধিকার সবার হাতে কে তুলে দিয়েছিল! আহ্লাদী আগে তার মায়ের মেয়ে, তারপর আপনাদের তিন ভাইয়ের বোন। সকলের মাথার ওপরে মা এখনো বেঁচে রয়েছেন। মাকে কি একবারও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, এই বিয়ের ব্যাপারে তাঁর মত কী? তিনি রাজি থাকলে আমি আর একটাও শব্দ খরচ করব না। কিন্তু তাঁর কথা না শুনে শুধু বাড়ির দোতলায় কেন, এ বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে যেতে বললেও বেরোব না। এমনকি যার হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছি, সে বললেও না.... বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। এসব নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না। মা...
অঙ্কনের গলা প্রায় বুজে এলো কান্নায়। ভয়ের গতিপথ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। এতক্ষণ মৃগাঙ্ককে ভয় লাগছিল। এবার নিজের ঘরের ভিতরে পা রাখতে হবে ভেবেই আতঙ্কে অঙ্কনের সর্বশরীর কাঁপছে। বন্ধ দরজার ভিতরে উত্তরা যে ঠিক কতরকমভাবে এর শোধ তুলে অতিষ্ট করে দেবে, তা ভেবেই অঙ্কনের মূর্ছা যেতে ইচ্ছে করল। প্রিয় নারীর মানভঞ্জনের জন্য আজ যে আবারও নিভৃত রাত্রি জাগরণ কালে নাকাল হতে হবে, সে বিষয়ে অঙ্কনের মনে কোনও দ্বিধা রইল না।
-মা, আহ্লাদী কোথায়?
-সে তো আজ পরিষ্কার হয়ে পুকুরঘাটে স্নানে গেছে। জামাকাপড় কেচে মাথা ঘষে ঘরে আসবে। তাকে দিয়ে কী দরকার বাছা?
-দরকারটা তার সঙ্গে নয়, আপনার সঙ্গে। ভালোই হয়েছে ও ঘরে নেই। আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে মা।
-কী হয়েছে? সকাল সকাল গেরস্ত ঘরে এত গোলমাল কিসের? তোমার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম ছোটবৌ। কার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি অমন গলা তুলে কথা বলছিলে?
-বড়দাভাই।
-সেকি! ছোটবৌ! বড় ভাসুরের সামনে তুমি...
-সামনে নয়, সঙ্গে। আমি বড়দাভাইয়ের সঙ্গেই কথা বলছিলাম। আপনি বলুন তো মা, এ বিয়েতে আপনার মত আছে? আহ্লাদীর জন্য আনা পাত্র আপনার পছন্দ হয়েছে তো?
বহু বছর আগের এক দৃশ্য ভেসে উঠল মাধবীলতার স্মৃতিপটে। তার ঠাকুমা ঘরের ভিতর থেকে কেঁদে বলেছিল, "নিজের মেয়ে তো নয়। তাই মেয়েটাকে এমন জলে জঙ্গলে ফেলে দিতে চাইছে। নিজের মেয়ে হলে পারত..."
বিছানার ওপর পরিষ্কার চাদর পেতেছে মাধবীলতা। ঘরের জানলায় ঝুলতে থাকা কাচা-ধোয়া পর্দার আড়াল পেরিয়ে সকালের নরম রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। আজ থেকে আবার আহ্লাদীর সঙ্গে ঘুমোবে সে। মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকবে অপলক দৃষ্টিতে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মেয়ের বিয়ের জন্য দুর্ভাবনার কারণে তার রাতের ঘুম বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু এখন পাকাপাকিভাবে বিয়ের কথা উঠতেই মাধবীলতার বুকের মধ্যে চেপে বসেছে শিরশিরে ভয়। মাধবীলতার বেশি বয়সের সন্তান আহ্লাদী। পড়ন্ত যৌবনের যত স্নেহ, সমস্তই ঐ একজনকে উজাড় করে দিয়েছিল সে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় অকালে মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে সেই অপার্থিব অনুভূতি পুরোপুরি উপভোগ করেছিল সে। কোনোপ্রকার জড়তা অবাঞ্চিত মাতৃত্বের মাঝে বাধা হতে পারেনি। খুদে প্রাণটাকে কোলে নিয়ে মাধবীলতা ভুলে ছিল লোকলজ্জা, সংসারের যত গঞ্জনা...
আহ্লাদীর বিয়ের পর ঐ চিলেকোঠার ঘরের আর প্রয়োজন পড়বে না। কোথাও কোনও মাসিক অসুবিধা থাকবে না। থাকবে না কোনও দৈনিক দুশ্চিন্তা। থাকবে কেবল একরাশ শূন্যতা। ঘর অন্ধকার করে মাতৃজঠরের পিদিম নিভিয়ে, সর্বকনিষ্ঠা সন্তানও নাড়ি ছিঁড়ে ঘরের উঠোনের ওপর দিয়ে আলতা রাঙা পায়ে হেঁটে চিরতরে পর হয়ে যাবে। শয্যাপ্রান্তে বসে ছলছল করে উঠল মাধবীলতার দু'চোখ। কেঁপে উঠল ঠোঁট। মাধবীলতার হাতের ওপর হাত রেখে উত্তরা জিজ্ঞাসা করল,
-মা কাঁদবেন না। আমরা সবাই আছি। আপনি বলুন, আপনার মন কী চায়?
-আমার মেয়ের বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাছা, অথচ আমাকেই কেউ ডাকে-খোঁজে না। একবারও বলে না, যে মা আসুন। দেখুন.... মেয়ের বিয়েতে কী দিয়ে কী হবে! আমি এই বাড়ির জঞ্জাল ছোট বৌ। ঘরের এককোণে পড়ে থাকি। সারাদিন একাই বকবক করি। কে আর শোনে বলো এই বুড়ির কথা! তিনবেলা পেটে ভাত পাচ্ছি, ব্যাটারা ভাত দিচ্ছে.... এই না অনেক! ঐ ছেলেকে আমি চিনি। বড় বৌয়ের কুটুমের মধ্যে সম্বন্ধ এনেছে। অনেক শুনেছি ওর গল্প। মেয়েমানুষের মতো আবভাব ব'লে গ্রামের যাত্রাপালায় মনসার গানে বেউলা সাজত ঐ ছেলে। পরে শুনি ঘরের মধ্যেও নাকি মায়ের বৌদিদিদের শাড়ি বেলাউজ পরে ঠোঁটে রঙ মেখে ঘুরে বেড়াত। নিজেকে ও বাড়ির ব্যাটা নয়, মেয়ে বলত। তারপরই তো ওকে ওর বাড়ির লোক একঘরে করেছে। অমন একটা মানুষকে ধরে এনেছে আমার মেয়ের জন্য। আমি আর কী বলব? মেয়ের হয়ে জোর করে যে চারটে কথা বলব, সে রাস্তা কি খোলা আছে? মুখপুড়ি মেয়ে তার ডাগর গতরের সঙ্গে চরিত্তিরও খেয়ে বসে আছে। কিছু বলতে গেলেই কথা শুনতে হয়। মন করে মা-মেয়ে দড়ি-কলসী নিয়ে মাঝপুকুরে ডুবে মরি! জুড়িয়ে যাক বুকের জ্বালা! আর পারি না ছোট বৌ! বাঁচাও মা, তুমি আহ্লাদীকে বাঁচাও.... আর কেউ পারবে না। পারলে একমাত্র তুমিই রুখে দাঁড়াতে পারবে। নিজের মেয়ে নয়, তাই আহ্লাদীকে ওরা ভাসিয়ে দিচ্ছে। পেটে ধরলে পারত অমন একটা ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে?
অনভ্যাসের শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে ঘেমে অস্থির হয়ে উঠেছিল উত্তরা। কপালের ওপর জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ফোঁটা স্বেদবিন্দুর স্পর্শে ঘেঁটে গিয়েছিল। মাধবীলতা তার কম্পমান হাত দুটো দিয়ে উত্তরার অবিন্যস্ত চুল ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,
-লক্ষ্মীমন্ত বৌ আমার! কিছু একটা করো মা। মেয়েটা আমার মরেই আছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে আর কী লাভ! ওকে সংসারী করতে গিয়ে সবাই এমন একটা ব্যাটার ঘাড়ে ওকে চাপিয়ে দিচ্ছে, এবার বিয়ের পর ও মেয়ে কুলত্যাগী না হয়ে যায়! তখন এ কুলেও ওর ঠাঁই থাকবে না! কী হবে আমার মেয়েটার? যত লড়াই করতে হয় করো মা, শুধু আমার মেয়েটাকে রক্ষে করো।
মৃদু হেসে মাথায় ঘোমটা টেনে মাধবীলতার ঘর ছেড়ে বেরোল উত্তরা।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

খিল সপ্তম পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
সপ্তম পর্ব




-তা তোমার বোনের যা মতিগতি, বিয়ে না দিলে ও মেয়েকে ঘরে আটকানো যাবে না। বোনের বিয়ে নিয়ে ভাবলে কিছু?
কিছুক্ষণ আগে বাঁশি বাজিয়ে নাগের বাড়ির দরজা-জানালা কাঁপিয়ে শেষ রেলগাড়িটা চলে গেছে। তারপরই গোটা পাড়া ডুব দিয়েছে অন্ধকারে। অতীতে মাধবীলতাকে প্রদীপের মতো টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বিদ্যুতের আলো ও বিদ্যুৎচালিত পাখার গতিবিধি লক্ষ্য করতে হতো কুপির আলো কিংবা টর্চ হাতে নিয়ে। বর্তমানে পাড়ায় বিদ্যুতের ঘাটতি তেমনভাবে দেখা না গেলেও, বিদ্যুৎ বিভ্রাটজনিত সমস্যা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া যায়নি। ঘরের দরজা বন্ধ করে গায়ের গয়না ঝনঝনিয়ে পরনের কাপড় আলগা করল তৃণা। চোখে চশমা এঁটে খাতার ওপর মৃগাঙ্ক একমনে ঝুঁকে পড়েছিল। লণ্ঠনের আলোয় ওর মুখের ওপর জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম জ্বলজ্বল করছিল। ঘামে ভিজে উঠেছিল সর্বাঙ্গ। বিছানায় বসে তৃণা কাপড়ের আঁচলখানা দেহের ওপর থেকে পুরোপুরি সরিয়ে হাতপাখা দিয়ে নিজের মাথায় বাতাস করতে করতে বলল,
-মা গো! ভ্যাপসা গরমে মরলাম আমি। গায়ে কাপড়চোপড় কিছু রাখা যাচ্ছে না।
-তা রাখতে কে বলেছে? খুলে ফেললেই হয়।
ঘাড় ঘুরিয়ে চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে বাঁকা দৃষ্টি মেলে মৃগাঙ্ক একবার চাইল তৃণার দিকে। তারপর হেসে আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ল। হাতপাখার দাপটে তৃণার হাতের সোনার চুড়ি রিনরিন শব্দে বেজে উঠল। মুখ বেঁকিয়ে তৃণা বলল,
-মস্করা রাখো। বুড়ো বয়সে যত্তসব ভীমরতি। যত বয়স বাড়ছে, বুড়োর যেন ইচ্ছেনদীতে একেবারে বান ডাকছে। ঢেউ একেবারে উথলে উথলে উঠছে। আমি মরছি আমার জ্বালায়। উনি এলেন রঙ্গ-রসিকতা করতে। সারাদিন পর বিছানায় একটু গা দেব, অমনি মরাখেকো কারেন্টটা যমের বাড়ি গেল। কখন আসবে তা ঠিক নেই। বলি কথাটা কি কানে যাচ্ছে না? কী বলছি আমি? দিনরাত ঐ হিসেবপত্তরের খাতায় মুখ গুঁজে থাকো। এদিকে বোন যে নেচে নেচে সাত ঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছে, সেই হিসেব আর কে রাখে! বলেছিলাম টাকা-পয়সা গয়না নিয়ে একদিন পালাবে, ঠিক তাই হয়েছে। বৌয়ের কথা তো বাসি হলে ফলে। এবার কোনদিন পেট বাধিয়ে আসবে, তখন বুঝবে ঠ্যালা! লজ্জায় আমি নিজের বাপেরবাড়িতে যেতে পারি না গো। গেলেই ওর কথা লোকে আগে জিজ্ঞাসা করে। আড়ালে মুখ টিপে হাসে। বলিহারি তোমার মায়ের আক্কেল! শেষ বয়সে একটা বেশ্যা পেটে ধরেছে!
-বাবাই টুবাই ঘুমোল?
-হ্যাঁ। ছেলেদের ঘরের দোর বন্ধ দেখে এলাম।
-কাল অফিস থেকে ফেরার পথে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
-আয়ুর্বেদ নাকি হোমিওপ্যাথি?
-হোমিওপ্যাথি, বসু ডাক্তার গো।
-হ্যাঁ তো কী হয়েছে?
-বলছিল, ছেলেদের দিকে একটু নজর দিতে।
-কেন? আমার ছেলেরা তার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে শুনি? তার বাড়ির উঠোনে হালকা হতে গেছে, নাকি তার মেয়ের হাত ধরে রাস্তাঘাটে টানাটানি করেছে? আমার ছেলেদের দিকে লোকের এত নজর কেন বাপু? অমন সোনার টুকরো ছেলে এ তল্লাটে আর কারও আছে?
-আমাদের বড় ছেলে, বাবাই.... কাল বিকেলে নাকি রেল কোয়ার্টারের ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল! বসু ডাক্তার নিজের চোখে দেখেছে। তাই সাবধান করল।
-সে তো আমি ওর বালিশের তলাতেও সিগারেটের বাক্স পেয়েছি। ওর ঘরেও গন্ধ পেয়েছি। ছেলে আমাকে কত মান দেয় জানো? আমাকে দেখেই জানলা দিয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। বাবাই বড় হচ্ছে বুঝলে! ছেলের সব ব্যাপারে এত নাক গলাতে এসো না। ও আর আমাদের ছোট ছেলেটি নেই। পুরুষ মানুষ হয়ে গেছে। এখন সবসময় এত ডাক নিলে চলে না।
-আমাদের কাছে ওরা আজীবন ছোটই থাকবে। দিনরাত আহ্লাদীর কথা না ভেবে, তার সিকিভাগ সময় যদি নিজের ছেলেদের পিছনে দাও, তবে ভালো হয়। ওরা কখন কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে, একটু খোঁজখবর রাখতে পারো তো। এখনো বাইরে পড়তে যায়নি। হোস্টেল লাইফের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। পরিবারের সঙ্গে রয়েছে। এর মধ্যেই এসব নেশা করতে শুরু করেছে। তুমি সব জেনেও আমাকে জানাওনি। এ মোটেও ভালো কথা নয়। ছেলেকে ভালোবাসা একরকম। কিন্তু ওর খারাপ অভ্যাসগুলোকে প্রশ্রয় দিও না। আহ্লাদীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ভাবিও না। ওর বিয়ে হলে হবে। না হলে না হবে। এতবড় বাড়ির এককোণে পড়ে থাকবে। আমার সংসারে একটা পেট বেশি হবে না। কিন্তু ছেলেরা আমাদের স্বপ্ন। সেখানে যদি কিছু ভুল হয়ে যায়, ওদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। ওরা ভালো না থাকলে আমরা ভালো থাকতে পারব বলো তো? ছেলেদের যত আবদার, যত প্রয়োজন, সব তোমার কাছেই জানায়। তুমি একটু বোঝাতে পারো তো। বাবাইয়ের সঙ্গে কথা বলো...
-আসল কথাটা বলো না! বোনের কথা বলতে গায়ে জ্বালা ধরছে। তাই আমার ছেলের কথা তুলেছ। যাও নিজের মা-ভাই-বোনকে গলার মালা করে নিয়ে থাকো। আমি আর আমার ছেলেরা খারাপ তো? থাকতে হবে না আমাদের সঙ্গে। আমি খুব জানি.... তোমার মনে কী চলে.... শুধু আমার মতো মেয়েমানুষ ব'লে সারাজীবন মুখ বুজে ঘর করে গেল.... রাবণের গুষ্টির দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে নিজের সমস্ত শখ-রঙ বিসর্জন দিয়ে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দিল। ঐ ছোট'র মতো মেয়েমানুষ হওয়া দরকার ছিল। কত বুদ্ধি! আগেই পাকাপাকিভাবে বাড়ি-হাঁড়ি ভিন্ন করার পথ বাতলে, তবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। নামেই নাগের বাড়ির ছোটবৌ! অথচ দেখো, একটা কাজে-কর্মে দায়িত্বে কর্তব্যে পায় না। শ্বশুরবাড়ির ঘর করা কাকে বলে, সে তো জানলোই না। এত পুজো-আচ্চা যায়, সে অতিথির মতো ঘুরতে আসে, আর সুযোগ পেলেই চুলবুল করে তার মুখের বুলি ছোটে। ও মেয়েমানুষের যুক্তির ঠেলায় জগৎ অন্ধকার। প্রথম থেকেই ভিন্ন হয়ে কেমন সুন্দর বরের কোলে চড়ে চুটিয়ে সংসার করছে দ্যাখো। আর আমি? এখানে হেঁশেল ঠেলে মরছি। গতর পুড়িয়ে সবার জন্য করেও মরো, আবার মানুষের কথা শুনেও মরো। সব কপাল গো! পোড়া কপাল! যতই করো, এদের মন আর পাবে না.... সময় থাকতে থাকতে বেহায়া মেয়েটার একটা গতি করতে চাইছি। তা কেউ আমার কথার মান দিলে তো! এরপর লোকে বলবে, তিন-তিনটে দাদা মাথার ওপর থাকতে বয়সকালে মেয়েটার বিয়ের চেষ্টা কেউ করেনি। মেজজনের সাত চড়ে রা নেই। কোনও মান-অপমান বোধ নেই। ছোটজন শুনতেও আসবে না। যত দায় আমার একার...
তৃণার বুজে আসা কান্নাভেজা কণ্ঠে মৃগাঙ্কর হাত থেকে কলম নেমে গেল। হিসেবের খাতায় অনিচ্ছাকৃত গরমিল হয়ে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বিছানায় বসে অভিমানী তৃণার হাত থেকে হাতপাখা কেড়ে নিয়ে বাতাস করতে করতে মৃগাঙ্ক বলল,
-ঠিক আছে, কাল বাবাইয়ের সঙ্গে না হয় আমিই কথা বলব। তুমি কী বলছিলে বলো?
-থাক, আর শুনে কাজ নেই!
-আমার ঘাড়ে ক'টা মাথা, যে তোমার কথা না শুনে যেচে স্কন্ধকাটা হবো!
-কী বললে?
-বলো বলো।
অতি উৎসাহে মৃগাঙ্কর হাত থেকে পাখা কেড়ে জোরে জোরে বাতাস করতে করতে তৃণা বলল,
-সেই সেবার ছোটকার নাতির অন্নপ্রাশনে বাপেরবাড়ি গেলাম.... তখন বিন্তিপিসির ছোট ছেলেটার জন্য কাকিমা একটা মেয়ে দেখে দেওয়ার কথা বলছিল। কাকিমা বলছিল, শ্বশুর ঘরজামাই রাখলেও তাদের কোনও আপত্তি নেই। সেই তো নিজের বাড়িতে তিনবেলা শুয়ে-বসে অন্ন ধ্বংস করছে। তার চেয়ে শ্বশুরবাড়ির ভাত খাক। তবু ছেলেটার একটা গতি হোক। ছেলে কিংবা বৌ নিয়ে ওদের এত মাথাব্যাথা নেই। আমি ঠিক করেছি, ওর সঙ্গেই আহ্লাদীর বিয়ে দেব।
-ঐ ছেলে? কিন্তু ওর চালচলন তো...
-শোনো, তোমার বোনের জন্য ঐ ঠিক আছে। ও মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিশ্চয়ই আকাশ থেকে টুপ করে রাজপুত্তুর খসে পড়বে না.... ভালো ছেলে যে খুঁজতে চাও, নিজের বোনের গুণ বাইরের লোকের কাছে বলতে পারবে?
-তাই বলে ঘরজামাই? ভালোভাবে ভেবে দেখো, বিয়ের পরেও কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে এখানেই থাকবে। সব ঝামেলা তোমার ওপর এসে পড়বে। তখন কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না!
-এতদিনে তুমি আমাকে এই চিনলে হ্যাঁ? ঘরজামাই কে রাখবে? ও মেয়েকে ঘর থেকে বের করার জন্য আমি কিনা বিয়ের কথা বলছি, তার জামাইকে আবার নাকি ঘরে বসিয়ে জামাই আদর করে পাত পেড়ে খাওয়াব! ওটাই বাকি আছে। আমার বুদ্ধিটা শোনো। আমবাগানের কোণে এক টুকরো জমিতে একটা ছয়-ছোট্ট একতলা ঘর তুলে দাও। আর তোমার দোকানে ছেলেটাকে কাজে নিয়ে নাও। এই বাজারে মাগনায় কাজের লোক আর পাবে তুমি? শশী ঠাকুরপোর মতো ওর হাতেও না হয় মাসের প্রথমে কিছু টাকা গুঁজে দেবে। নিজেদের দোকানে থাকলে ওরা বেশি কথা বলতে পারবে না। এদিকে ঘরের সম্পত্তি ঘরেও রইল, আবার সমাজের পাঁচটা মানুষকে দেখানো হল যে বড়দা দাঁড়িয়ে থেকে জমি বাড়ি দিয়ে শাড়ি-গয়নায় গা সাজিয়ে বোনের বিয়ে দিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করেছে। এতে সবদিক রক্ষা হবে, আর বিয়ে দিলে ঐ মেয়ের গায়ের গরমও মরবে। বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। তারপর ঘরে খিল এঁটে বন্ধ দরজার ওপারে যা খুশি করুক.... এই হপ্তাতেই তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলবে, বুঝলে?
-তোমার এত বুদ্ধি গিন্নি!
-আ মরণ! বুড়োর কথা শুনলে গা জ্বলে যায়। এই আমার বুদ্ধি ছিল বলেই তো এখনো বিষয়-সম্পত্তি সব হাতের মুঠোয় রয়েছে। নইলে কবে সব বারো ভূতে লুটেপুটে খেয়ে নিত। হাওয়া করো হাওয়া করো। গরমে আমার গা একেবারে জ্বলে গেল গো...
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে গ্রামের সীমানা পর্যন্ত অন্ধকারের শিকড় রাজ্যবিস্তার করেছে। আহ্লাদীর মাসিক অসুবিধার কারণে মাধবীলতা আশ্রয় নিয়েছে চিলেকোঠার ঘরে। শেষরাতে ঘরের দরজা খুলে চুপিচুপি বেরিয়ে গেল আহ্লাদী। অন্ধকারের বেড়া ছিঁড়ে মাঠের প্রান্তে পৌঁছনোর পর, আহ্লাদী সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পেল। ক্ষেতের পাশের সরু রাস্তার ওপর সাইকেলটা পড়ে রইল। গাছের আড়ালে দুটি দেহ পরস্পরের মধ্যে যেন মিশে যেতে চাইছিল। প্রেমিকের অস্থির হাত আপন যোনির প্রান্ত থেকে টেনে সরিয়ে মৃদু আপত্তি জানাল আহ্লাদী। নিদারুণ অসময়ে নারীর উরুসন্ধিতে প্রবেশাধিকার না পেয়ে আহ্লাদীর কোমল ঠোঁট ও উন্নত স্তনযুগলের নীরব নৈবেদ্য গ্রহণ করল কাঙ্খিত পুরুষ।
নাগের বাড়ির অলিখিত কর্ত্রীর দাপটে দিনকয়েকের মধ্যেই এক গোধূলি বিকেলের আলো গায়ে মেখে পাত্রপক্ষের সঙ্গে স্বয়ং পাত্রের আবির্ভাব ঘটল। সেই রাতেই ঘরের দরজা বন্ধ করে চাপা স্বরে অঙ্কনের ওপর ক্ষোভ উগড়ে দিল উত্তরা।
-এই ছেলের সঙ্গে আহ্লাদীর বিয়ে হবে? বড়দিভাই আর ছেলে খুঁজে পায়নি? এটা ছেলে? নাকি মেয়ে! অঙ্কন এ বাড়ির কারও পরোয়া আমি করি না। কাউকে বোঝানোর দায়ও আমার নেই। কিন্তু তুমি? তোমাকে নিশ্চয়ই আলাদা করে বোঝাতে হবে না। প্রকৃতির নিয়মে মুখে খানকতক দাড়ি-গোঁফ গজালেই সে পুরুষমানুষ হয়ে যায় না অঙ্কন। ঐ মানুষটা মনেপ্রাণে পুরুষ তো? তার নিজের ভাইপো তাকে হাফ লেডিজ ছোটকা বলে ডাকছে, হাত পা নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে জিভ ভেংচি কেটে ব্যঙ্গ করছে। বাচ্চার আর কী দোষ? এগুলো বাড়িতে দেখছে বলেই তো এতটুকু বাচ্চা ছেলে শিখছে। তার মানে নিজের বাড়িতে ঐ মানুষের জায়গাটা বুঝতে পারছ? যে নিজের জন্যই স্ট্যান্ড নিতে পারে না, তার বৌয়ের কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ? আহ্লাদীর জন্য বড়দাভাই এটা কী ধরে এনেছে? অঙ্কন এই বিয়ে তোমাকে ভাঙতেই হবে।
-বোঝার চেষ্টা করো উত্তরা, এই সম্বন্ধ বড় বৌদি এনেছে। মা নামেই এই বাড়ির অভিভাবক। বড় বৌদির ইচ্ছে ছাড়া এ বাড়ির উঠোনে একটা পাতাও ঝরে পড়ার সাহস দেখাতে পারে না।
-আমাকে বিয়ে করলে কী করে? পরিবারের সবার বিরুদ্ধে গিয়েই তো? নিজের মায়ের অবাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছ তো? তোমার দুই দাদা বাধ্য হয়েছিল দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিয়েটা দিতে। নিজের ভালো বুঝে জেদ করে নিজে বিয়ে করতে পারলে, ঐরকম জেদ দেখিয়ে লড়াই করে বোনের বিয়েও ভাঙতে পারবে। মানছি আমাদের মেয়ের মধ্যে খুঁত আছে। কিন্তু তাই বলে ঐরকম একটা মানুষের গলায় আহ্লাদীকে ঝুলিয়ে তোমরা দায় সারবে? এ বিয়ে আমি ভেঙেই ছাড়ব। এবার তুমি ঠিক করো, কাল সকালে বড়দাভাইয়ের সঙ্গে তুমি কথা বলবে, নাকি আমি!
-আমি বড়দার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। তাছাড়া তুমি একা ছেলেকে দেখোনি। সবাই দেখেছে। মেজদা তো কিছু বলছে না। তবে তুমি কেন এত ব্যস্ত হয়ে পড়ছ? বিয়েটা হলে হয়ে যাক না! বিয়ের পর বোন যদি একটু স্থির হয়! যদি সংসারে মন বসে...
খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল উত্তরা। বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছে। অঙ্কন পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বলল,
-আমরা এ সবকিছু থেকে অনেক দূরে থাকি উত্তরা। অতিথির মতো বাড়িতে বেড়াতে আসি। কী দরকার সব বিষয়ে কথা বলার? তারা তো আমাদের মধ্যে কথা বলতে আসে না। যেচে কথা শোনার কী দরকার? পরে তোমাকে যদি কেউ বলে বসে, উত্তরার জন্য আহ্লাদীর সংসার করা হল না.... তখন আমার শুনতে ভালো লাগবে? বড়রা যা করছে, করতে দাও না। টাকা-পয়সা, গয়না যা লাগবে, দিয়ে আমরা চলে যাব। তারপর যারা কাছে থাকবে, যারা দেখেশুনে বিয়ে দিচ্ছে, তারা বুঝে নেবে। কাজকর্ম মিটে গেলে আমরা ট্রেন ধরব। এই সবকিছুর থেকে দূরে নিজেদের পৃথিবীতে হারিয়ে যাব। এবার একটু নিজেদের কথাও তো ভাবতে হবে। কতদিন আর তুমি-আমি থাকব? আমরা হতে হবে না? তোমার-আমার মধ্যে একটা ছোট্ট মানুষ আসবে, ছোট্ট ছোট্ট হাত, ছোট্ট ছোট্ট পা.... নিজের তৈরি করা ছোট্ট একটা প্রাণকে কোলে নেওয়ার জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমাকে?
অঙ্কনের হাতে চুমু খেয়ে উত্তরা আবেগতাড়িত কণ্ঠে বলল,
-আদর করার সময় বারবার জানতে চাও কেন, আমার ভালো লাগছে কিনা! বিয়ের তো কম দিন হল না, এখনো আমাকে খুশি করতে চাও?
-হুম.... যতদিন আমার শরীরে ক্ষমতা থাকবে, ততদিন তাই চাইব।
-কেন? ভয় হয়? তুমি আমাকে খুশি করতে না পারলে, আমি অন্য কোথাও সুখ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করব? নাকি মেল ইগো! পার্টনারকে সুখ না দিতে পারলে বুকের ভিতরে কোথাও অক্ষমতার আগুন দপ করে জ্বলে ওঠে!
-কেন? আমি কি তোমাকে সুখ দিতে পারি না? আগে কোনোদিন বলোনি তো!
-যা জিজ্ঞাসা করছি, তার উত্তর দাও।
-এতশত জানি না উত্তরা। তোমাকে ভালো রাখতে পারলে, আমি আর কিছু চাই না। তোমাকে তৃপ্ত দেখার পর নিজের ক্লান্তি গায়ে লাগে না। শরীরের থেকেও বেশি মন তৃপ্ত হয়।
-সেটাই স্বাভাবিক! আর কারও যদি সেই ক্ষমতাটাই না থাকে! কেউ যদি স্ত্রীকে খুশি করতে না পারে!
-মানে?
-ঐ ছেলেটি অঙ্কন, যার সঙ্গে আহ্লাদীর বিয়ে দেওয়ার জন্য বড়দিভাই উঠে-পড়ে লেগেছে.... ঐ ছেলেটিকে দেখে আমার ভালো লাগেনি। তুমি একটা জিনিস কেন বোঝার চেষ্টা করছ না? সংসার মানে একটা ঘর। ঘরের ভিতর নিজেদের একটা বিছানা, সম্পূর্ণ নিজেদের কিছু মুহূর্ত। আর সেখানে কোনও অতৃপ্তি মন মানে না। ওখানে ফাঁক থাকলে ঘর বলো কিংবা সংসার, সব উচ্ছন্নে যাবে। আহ্লাদীকে যে কারণে তোমরা বিয়ে দিতে চাইছ, সেটাই হবে না অঙ্কন। মিলিয়ে নিও আমার কথা! ঐ ছেলে ওকে ঘরে আটকাতে পারবে না। এখন এ বাড়িতে আছে। তোমরা টাকা-পয়সা লোকবল দিয়ে সবকিছু চাপা দিয়ে দিচ্ছ। বিয়ের পর যদি ঘরে সুখ না পেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে আবার ঘর ছাড়ে, তখন কুৎসা রটবে না? কী করবে তোমরা তখন? ভেবে দেখেছ কিছু?
-দেখো উত্তরা, আমি বড়দার সামনে এসব...
দরজার শব্দ শুনে দাম্পত্য আলাপ মাঝপথেই থেমে গেল। অঙ্কনের আলিঙ্গন থেকে মুক্তিলাভ করে দেওয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে উত্তরা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলে উত্তরা দেখল, বাইরে অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিধি। চাপা কণ্ঠে নিধি বলল,
-ঘুমিয়ে পড়েছিলি ছোট? এত রাতে বিরক্ত করলাম...
-না না মেজদিভাই, এসো এসো। ভিতরে এসো। এখন তো আমাদের সন্ধেরাত। বাড়িতে থাকলে এই সময় তোমার ঠাকুরপো সোফায় বসে পা দুলিয়ে লাস্ট রাউন্ড চায়ের অর্ডার দেয়। আমাদের ডিনার করতে করতে সেই রাত সাড়ে এগারোটা। তুমি এসো, ভিতরে এসে বসো।
-আমাদের এদিকে তখন মাঝরাত রে। সকাল সকাল উঠে তোর মেজদাকে মাঠে যেতে হয় তো। তোর সঙ্গে খুব দরকার ছোট, তাই এত রাতে একটু কথা বলতে এলাম। জানিসই তো সংসারের পরিস্থিতি। সকালে সবার সামনে মুখ খুলে একটা কথা বলার উপায় নেই।
-তোমরা কথা বলো বৌদি। আমি একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি। উত্তরা আমি আসছি।
-এই মা ছাদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। সিগারেট ধরাবে না।
নিধি খাটের ওপর গুছিয়ে বসে ব্যস্ত হয়ে বলল,
-ঠাকুরপো, যেও না। তোমার সঙ্গেও কথা আছে। তুমি একটু থাকো।
-কী হয়েছে বৌদি?
-বলছি ছোট.... বিকেলে ছেলেটাকে দেখলি তো। তা কেমন লাগল তোদের? আমার জানি কেমনধারা লাগল। পুরুষ মানুষের অমনধারা মেয়েমানুষের মতো আচরণ কেন রে? হাঁটাচলা দেখলি? কথাবার্তা কেমন মেয়েলি না? শরীরে শক্তপোক্ত না হলে ঠিক পুরুষ মানুষ ব'লে ঠাওর হয় না। কিন্তু বড়দি এই সম্বন্ধ এনেছে। তার কুটুমের মধ্যে সম্বন্ধ, জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারছি না। আমি তোদের মেজদাকে এই কথা বলে তোদের মতামত নিতে এলাম। তোরা কী বলিস ছোট? ছেলে তোদের পছন্দ হয়েছে? এই বিয়েতে তোরা রাজি?
মৃদু হেসে সরাসরি অঙ্কনের দিকে চাইল উত্তরা। স্বামী-স্ত্রীর অর্থপূর্ণ দৃষ্টির বিনিময়ে ঘরের ভারী বাতাস যেন খানিক হালকা হল।
(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত

খিল ষষ্ঠ পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
ষষ্ঠ পর্ব




-বুঝলি তো ছোট, আমি আগেই মাকে সাবধান করেছিলাম। বারবার বলেছিলাম যে মা, আপনার গুণবতী মেয়ের যা স্বভাব চরিত্র, ওর চোখের সামনে ঘরের টাকা-পয়সা, সোনাদানা এত ছড়িয়ে রাখবেন না। একটু আড়ালে রাখবেন। তখন উনি ভাবলেন আমি বুঝি ওঁর মেয়েকে চোর বলছি! সে কত কথা আমাকে শুনিয়ে দিলেন! এখন হল তো? মেয়ে সব ঝেঁটিয়ে নিয়ে পালাল তো?
-বড়দিভাই, থাক না এখন এসব কথা!
-কেন? থাকবে কেন? এখনই তো স্পষ্ট কথা বলার সময়। এ বাড়ির লোকের খালি টাকাই আছে রে ছোট। ঘাড়ের ওপর সাজিয়ে রাখা ঐ ঘট পুরো নিরেট। ওতে কোনও বুদ্ধি নেই। এমনিতেই ও মেয়ে একটু ব্যাটাছেলে চাটা। জানিসই তো কেমন ছোঁকছোঁকানি আছে। তার ওপর যদি বাইরের কেউ একবার বুঝে যায় ও এই বাড়ির মেয়ে, বুঝতে পারছিস তো কী হতে পারে? আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, ঠিক তাই হয়েছে। আমি জানতাম, একদিন এমন সেয়ানা লোকের হাতে পড়বে, সে জিনিসের লোভে ঐ মেয়েকে ঘর থেকে টেনে বের করে নিয়ে যাবে! জিনিস তো যাবেই যাবে, সেই সঙ্গে আমাদের মেয়েও যাবে। আইবুড়ো মেয়েদের চোখ খুলে দিতে নেই। ঘরের ভিতরের এতকিছু দেখাতে নেই। তারা ভালো মনে বাইরে গিয়ে গল্প করবে। আমার বাড়ির লোকের এই আছে, ঐ আছে! কিন্তু যে শুনবে, তার ধান্দা তো অন্য কিছু হতেও পারে। ঠিক লোকের হাতে পড়লে যেমন আমাদের মেয়ে ভালো থাকবে, সোনাদানা সম্পত্তি দশগুণ বাড়বে, ভুল লোকের হাতে পড়লে সব একসঙ্গে শেষ হবে। মাকে ঠিক এই কথাগুলোই একদিন বলেছিলাম। তখন তাঁর গায়ে ফোস্কা পড়েছিল। এখন হল তো? সেই আমার কথাই ফলল তো? আমি তোর দাদাভাইয়ের মুখের দিকে চাইতে পারছি না জানিস ছোট! ঘরে-বাইরে লোকটা আর কত করবে বল তো? পুরো সংসারটাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছে। অফিস সামলে ঐ কুলাঙ্গার মেয়ের জন্য থানা-পুলিশ করে লোকটা একেবারে হাঁপিয়ে গেল গো...
তৃণার কন্ঠস্বর বড় কর্কশ হলেও, তার বলা একটা শব্দও উত্তরা অস্বীকার করতে পারে না। মাধবীলতা ঘরের ভিতর মুখ লুকিয়েছে। উত্তরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অঙ্কনকে একটা ফোন করল।
-কী হল ওদিকে? আর কতক্ষণ?
-এখনো থানায় আছি। বসে আছে সামনে।
-সুস্থ আছে তো?
-জানিনা, বেঁচে আছে দেখছি। তবে দেখে ঠিক ভালো লাগছে না। রাখছি। বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে ফোন করছি।
সেই দিনের কথা আজও আহ্লাদীর স্পষ্ট মনে আছে। গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে বেঞ্চের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে ও বসেছিল। ওর থেকে কয়েক হাত দূরে পুলিশের সামনে বসেছিল মৃগাঙ্ক আর শশাঙ্ক। কার সঙ্গে যেন কথা বলে কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে মৃগাঙ্ক আর শশাঙ্কর পাশের চেয়ারে বসেছিল অঙ্কন। পুলিশ অফিসার মৃগাঙ্কর স্বাক্ষরিত ফাইলে চোখ বুলিয়ে বলেছিলেন,
-ঠিক আছে, আপনারা বোনকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে পরেরবার থেকে বোনকে একটু সামলে চলতে বলবেন। সব জায়গায় পুলিশের গাড়ির সামনেই যে বোন জ্ঞান হারাবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তা যারা আপনার বোনের এমন অবস্থা করল, তাদের তো টিকিও পাওয়া যায়নি। আপনার বোনও মুখ খুলছে না। আপনি তাদের বিরুদ্ধে কোনও...
হাতজোড় করে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল মৃগাঙ্ক।
-না স্যার! দয়া করুন। মেয়েটার একটা ভবিষ্যৎ আছে। এ নিয়ে আমরা আর জল ঘোলা করতে চাই না। পাঁক নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে, নিজেদের গায়েও কাদা ছিটবে। সেটা কাম্য নয়। গ্রামে আমাদের মান-সম্মান আছে। ঝামেলায় জড়িয়ে বোনের এসব কেস নিয়ে নাগের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়ালে আমাদের যেটুকু সম্মান অবশিষ্ট আছে, সেটাও আর থাকবে না। এই ক'দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে ওকে পাগলের মতো খুঁজেছি। যেখান থেকে কোনও খবর পেয়েছি, সেখানেই ছুটেছি। আমার এই ভাই অফিস কামাই করে শহর থেকে ছুটে এসেছে বোনের জন্য।নিজের কাজকর্ম ফেলে সেদিন রাত থেকে বৌ নিয়ে এখানেই পড়ে রয়েছে। আমরা আমাদের বোনকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পেয়ে গেছি, এই অনেক স্যার। আর কিচ্ছু চাই না।
-তাই? অক্ষত অবস্থায় পেয়ে গেছেন?
ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ এঁকে পুলিশ অফিসার গলা নামিয়ে বলেছিলেন,
-শুনলাম এলাকায় আপনাদের বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার আপনাদেরই। টাকা দিয়ে বোনের সব ক্ষত ঢেকে অক্ষত সাজিয়ে পার করে দেবেন নাকি! তা ভালোই! টাকা থাকলে ভূতের বাবার শ্রাদ্ধ হয়ে যায়, আর নিজের অক্ষত বোনের বিয়ে হবে না? অসম্ভবকে যদি সম্ভবই না করতে পারে, তবে তো টাকার ওপর থেকে মানুষের ভরসা উঠে যাবে। চাকরি করছি বহু বছর হয়ে গেল মশাই। ট্রান্সফার হয়ে ঘুরে বেড়িয়ে এসব নোংরামি ঘেঁটে চুল পাকিয়ে ফেললাম। কম তো আর দেখলাম না। যত নোংরামি এই উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মধ্যেই। মান-সম্মান খোয়া গেলেও আপনাদের মতো মানুষের টাকায় সব ঢেকে যায়। নিম্নবিত্তদের মধ্যে মান-সম্মান নিয়ে এত মাথাব্যাথা নেই। পেটের ভাত আর টাকার জন্য তারা সব করতে পারে। মরে কেবল মধ্যবিত্তরাই। এদিকে ঘরে টাকা সীমিত, ওদিকে মান সম্মান গেলে টাকা দিয়ে ঢাকতে পারবে না। আপনারাই বেশ আছেন। গোলাভর্তি ধান, সিন্দুক ভর্তি টাকা, আর ঘরে অক্ষত বোন...
অঙ্কন চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়েছিল। মৃগাঙ্কর মাথা হেঁট হয়ে চোখ ভেঙে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। বুকে জ্বলছিল অপমানের লেলিহান শিখা। কেবল শশাঙ্ক বলেছিল,
-স্যার, আমরা আসছি তবে!
পায়ে পায়ে দরজার কাছে পৌঁছেছিল আহ্লাদীর তিন দাদা। আহ্লাদীর কম্বলে জড়ানো দুর্বল দেহটাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বেঞ্চের ওপর থেকে টেনে দাঁড় করিয়েছিল অঙ্কন। বোনের ক্লান্ত মুখের দিকে চেয়ে মৃগাঙ্কর মাথায় যেন রক্ত উঠে গিয়েছিল। নিজের চূড়ান্ত অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে, সেদিন মৃগাঙ্ক জনসমক্ষে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল আহ্লাদীর গালে। মাথা ঘুরে অঙ্কনের বুকের ওপর পড়ে গিয়েছিল আহ্লাদী। মৃগাঙ্ককে টেনে ধরে শশাঙ্ক চাপা গলায় বলে উঠেছিল,
-দাদা! কী করছ তুমি?
-এই! ওখানে হচ্ছে'টা কী? এটা কি আপনার বাড়ির উঠোন পেয়েছেন নাকি মশাই? যা ইচ্ছে তাই করছেন! বোনকে শাসন দেখাতে হলে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে শাসন করুন। আপনার রাজত্ব আপনার নিজের রাজ্যেই চলবে। তার বাইরে নয়। এটা পুলিশ স্টেশন, সেটা মাথায় রাখবেন। বেরোন এখান থেকে...
পুলিশ অফিসারের কাছে যারপরনাই অসম্মানিত হয়ে আহ্লাদীকে টানতে টানতে গাড়িতে বসিয়ে তিরের বেগে বাড়ির উদ্দেশে ছুটেছিল মৃগাঙ্ক। সারাটা রাস্তা গাড়ির মধ্যে কারও মুখে কোনও কথা ছিল না।
নাগের বাড়ির সামনে গাড়ি থামার পর এক অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছিল আহ্লাদী। গ্রামের অজস্র কৌতূহলী মুখ প্রতিমা দর্শনের মতো ওকে দেখতে ভিড় জমিয়েছিল গাড়ির সামনে। পথের ধুলো গায়ে মেখে দু-একটা শিশু গাড়ির পিছনে দৌড়ে এসেছিল অনেকটা পথ। তারা অবাক দৃষ্টিতে আহ্লাদীর দিকে চেয়েছিল। অঙ্কনকে ঢুকতে দেখে মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল উত্তরা।
আহ্লাদীসহ মৃগাঙ্ক বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই তৃণা উচ্চৈঃস্বরে বলেছিল, "এসে গেছ তোমরা? ও মা! হুড়মুড়িয়ে একদম বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লে যে! রাজ্যজয় করে আসা বোনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলে, আমাকে বরণডালা সাজানোর সময়টাও দিলে না?"
বিগত কয়েকদিন একনাগাড়ে জল ঝরিয়ে মাধবীলতার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। শয্যা ত্যাগ করে মাধবীলতা আহ্লাদীর দিকে যেতে চাইলে মৃগাঙ্ক মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন স্পষ্টভাবে বলেছিল, "মা তোমার মনে আছে বড় ঠাকুর্দার কথা? যে নিজে দারোগা ছিল। গ্রামের লোক যার নাম শুনে ভয়ে কাঁপত! আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসত কেবল চা খেতে, বড় ঠাকুর্দার সঙ্গে গল্প করতে। সেই বাড়ির বংশধরকে আজ থানায় দাঁড়িয়ে অপমানিত হতে হয়েছে তোমার এই মেয়ের জন্য। থানা-পুলিশের ঝামেলায় পড়েছি শুনে সময়কালে তোমার মোক্তার জামাই বদনামের ভয়ে মুখ লুকিয়ে সরে গেল। ফেঁসে গেলাম আমি একা। আমার মান-সম্মান সব শেষ হয়ে গেছে মা। এই প্রথম, আর এই যেন শেষ হয়! ওকে একটা কথা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিও। আজকের পর থেকে আমাকে না জানিয়ে এই বাড়ির বাইরে ও পা রাখবে না। যদি বাইরে বেরোয়, ওর দুটো পা আমি ভেঙে পঙ্গু করে ঘরে বসিয়ে রেখে দেব। এরপরেও যদি ও নিজেকে না বদলায়, তুমি যদি নিজের মেয়েকে সামলাতে না পারো, তবে আমাকে জানিও। আমি বুঝে যাব, সভ্য সমাজে ভদ্র মানুষের মধ্যে ভদ্রভাবে থাকার মানুষ তোমার মেয়ে নয়। যেখানে ওর মতো মেয়েকে মানায়, সেখানে আমি নিজে ওকে নামিয়ে রেখে আসব.... তখন যত ইচ্ছে..."
মৃগাঙ্কর কথা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শশাঙ্কর হাত ছাড়িয়ে ওর পাশ দিয়ে কম্বলে আবৃত একটা নারীদেহ জীবন্মৃত অবস্থায় হেঁটে গিয়েছিল মাধবীলতার ঘরের দিকে। উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা সকলের মুখের ওপর ঘরের দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল আহ্লাদীর দেহ।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে আহ্লাদী একা শুয়ে রয়েছে। এত কুকথা শুনেও ওর মন উতলা হয় না। চোখে জল আসে না। ও শেষ কেঁদেছিল হারু কাকার সঙ্গে প্রথম সঙ্গমের সময়ে। সে যে কী অস্বাভাবিক ভীতি, তা প্রকাশ করা আজ আর সম্ভব নয়।
ঘটনাটা ঘটে টুবাইয়ের জন্মদিনের সন্ধেয়। হারু কাকাকে দেখে কোনোদিন ভয় পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি আহ্লাদী। সে ডাকলে বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গেছে। কিন্তু সেদিন তার স্পর্শে মনে হয়েছিল, কোথাও যেন কিছু একটা অসঙ্গতি রয়েছে। যা হওয়া উচিত নয়, সেটাই ওর সঙ্গে হচ্ছে। আহ্লাদী প্রথমে ভয়ে কেঁদে উঠলেও কিছুক্ষণের মধ্যে ওর বুকের মধ্যে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সকল অনুভূতি। আহ্লাদীর উদ্দেশে তৃণা বরাবরই একটা কথা বলে। যে নারীর লজ্জা ঘৃণা ভয়, এই তিন থেকেও নয়, তার জন্য সংসারে কোনও জায়গা বরাদ্দ থাকে না.... আহ্লাদী এই তিনটি অনুভূতি কৌমার্যের সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছে সেই কবেই। সেদিন বাড়িভর্তি আমন্ত্রিত মানুষের চোখ এড়িয়ে ছাদে উঠে এসেছিল ও। উরু বেয়ে গড়িয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল টাটকা রক্ত। রক্তের আঁশটে গন্ধ দেহে মেখে হাঁটু মুড়ে আহ্লাদী দীর্ঘক্ষণ একা বসেছিল ছাদে। জনস্রোত সারি বেঁধে ভোজের উদ্দেশে বাড়ির একতলা থেকে সুসজ্জিত মন্ডপ পর্যন্ত এগিয়ে চলেছিল। কত আলো, কত আনন্দ! তখন আহ্লাদী শারীরিক যন্ত্রণার পথ অতিক্রম করে ভাবছিল, এক খাদকের ক্ষুধা নিবারণ করে ওর নিজের বুকের ভিতরে জন্ম নিয়েছে অযাচিত অগ্নিতৃষ্ণা। যা নিবারণ করার ইচ্ছেয় আবারও সেই মুহূর্তে আগুনে ঝাঁপ দিতে মন চাইছিল। নিজেকে সেঁকে নিতে ইচ্ছে করছিল হারু কাকার দেহের উত্তাপে।
-পিসি, ও সোনাপিসি.... দরজাটা একবার খুলবে না? তুমি দরজা না খুললে আমি কাঁদব। পড়তেও বসব না। সোনাপিসি...
আহ্লাদীর চিন্তার ঘোর কেটে গেল। দরজার ওপারে টুয়ার কন্ঠ। গোটা নাগের বাড়িতে এই একটা মানুষ আহ্লাদীর বড় আপন। সময়ে-অসময়ে মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে আহ্লাদীর বুকের ওপর। কোনও নিষেধ আজ পর্যন্ত আহ্লাদীর কাছে আসা থেকে ওকে বিরত করতে পারেনি। আহ্লাদী রাগ করে না খেলে নিজের ভাগের খাবারটাও লুকিয়ে পিসিকে খাইয়ে দেয় টুয়া। একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দেওয়াল হাতড়ে সুইচটা টিপে দিল আহ্লাদী। অন্ধকার জঠর ছিঁড়ে আশার আলোয় উদ্ভাসিত হল ঘরের চতুর্দিক। একটানে দরজার আগল নামিয়ে আহ্লাদী দেখল টুয়া মুড়ির বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার বাইরে।
-খাবে না পিসি? মা নারকেল আর চিনি দিয়ে মুড়ি মেখে দিয়েছে।
-সারাদিন আসিসনি কেন রে তুই? স্কুলে গিয়েছিলি?
-হ্যাঁ...
টুয়াকে কোলে জড়িয়ে আদরে ভরিয়ে দিল আহ্লাদী। ছাদে আহ্লাদীর কোলে বসে মুড়ির বাটিতে হাত ডুবিয়ে দিয়ে টুয়া বলল,
-ও পিসি, আমি বড় হয়ে গেলে তোমাকে একটা নতুন বাড়িতে নিয়ে যাব। ওখানে কেউ তোমাকে মারবে না। আমরা ঠামকেও নিয়ে যাব না। শুধু তুমি আর আমি থাকব।
-আর তোর মা?
-আচ্ছা মাকেও নিয়ে যাব।
-আর বাবা?
-বাবাকে নেব না।
-কেন রে? বাবা আবার কী করল?
-বাবা পচা। রাতে আমি মায়ের পাশে ঘুমাই। বাবা আমাকে বিছানার একপাশে রেখে মায়ের কাছে চলে যায়। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনোদিনও মাকে কাছে পাই না। শুধু তুমি, আমি আর মা যাব। তোমাদের দু'জনের মাঝে আমি ঘুমাব। বাবা বাদ।
চুপ করে টুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আহ্লাদী। এমন সময়গুলোতে নিজেকে খুব একা লাগে। কেমন একটা বন্য প্রবৃত্তি মনের মধ্যে বিষধর সাপের মতো কিলবিল করে ওঠে। চূড়ান্ত হিংসে বাসা বাধে দেহের গোপনে। টুয়া বলল,
-ও পিসি, সেই ডাকাত আর বড় বাবার গল্পটা বলো না!
-তোর পড়া নেই? এখন পিসির কোলে বসে গল্প শুনবি? মা বকবে তো!
-তুমি বলো না.... একটু শুনেই চলে যাব।
আহ্লাদীর কোলে মাথা রেখে ওর খোলা চুল নিয়ে খেলা করতে শুরু করল টুয়া। অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে আহ্লাদী বলতে শুরু করল নিজের পূর্বপুরুষের গল্প।
-তখন এ বাড়ি ছিল না। আমাদের পুরনো বাড়িতে ছিল সে। তাকে আমিও চোখে দেখিনি। শুধু গল্প শুনেছি। দেখেছে তোর বড় জ্যেঠু। থানার মস্তবড় দারোগা ছিল সে। তার ভয়ে গোটা গ্রাম কাঁপত। কিন্তু আইন যেমন আছে, আইনের রক্ষক আছে, তেমন আইনের ফাঁকও আছে। সেই ফাঁকে ছিল রঘু ডাকাতের বাস। তার দাপটে অস্থির হয়ে যেত আশেপাশের গ্রাম। এদিকে আলোয় যেমন তোর বড় বাবার রাজত্ব ছিল, অন্ধকারে ছিল রঘুডাকাতের রাজত্ব। কিন্তু নাগের বাড়ির দিকে দৃষ্টি দেওয়ার ক্ষমতা তার যে কোনোদিনও হবে না, এই সত্যি গ্রামের সবাই জানত। কিন্তু সমস্ত সত্যিকে মিথ্যে করে এক মধ্যরাতে সেই নাগের বাড়িতে হানা দিল দুঃসাহসী রঘু ডাকাত। একতলার ঘরে তোর বড় বাবা তখন একা ঘুমোত। সে টের পেয়েছিল পিছনের দরজা দিয়ে একে একে ঘরের জিনিস বের করে উঠোনে রাখা হচ্ছে। কিন্তু তবুও সে উপুড় হয়ে চুপ করে বিছানায় পড়েছিল। কারণ ডাকাতের দল ছিল সংখ্যায় বেশি। শেষে যখন কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে রঘু ডাকাত নিজে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন দারোগার রক্ত সেই পরাজয় সহ্য করতে পারল না। মাথা তুলে বলে বসল, রঘু, আজকে যাচ্ছিস যা! কাল এর শোধ তুলব। এটা শুনেই ডাকাত সর্দার ঘুরে এসে ঘরের ভিতর পা রাখল...
সহস্রবার শুনেও এই ডাকাতের গল্প যেন টুয়ার কাছে পুরনো হয় না। ছাদের কোণে জমাট বাঁধা ঝিমঝিম অন্ধকার রাতে রহস্যময়ী আলোর ছটা গায়ে মেখে পিসির কোলের মধ্যে ঢুকে তার অতিনাটকীয় কণ্ঠে এই একই গল্প বারংবার শুনেও টুয়ার মন ভরে না। প্রতিবারই এক নতুন শিহরণ খেলে যায় দেহের রোমকূপে। আহ্লাদীকে জড়িয়ে ধরে টুয়া বলল,
-কুপির আলোয় ঘরের দেওয়ালে ডাকাতের ছায়া পড়েছিল সোনাপিসি?
-পড়েছিল তো! ইয়া লম্বা চওড়া সে। পরনে লাল জামা, কপালে রক্ত তিলক। মেঘের গর্জনের মতো গলার স্বর, তেল চকচকে চেহারা। বড় বড় লাল চোখ...
-তারপর?
-আমাদের এই নাগের বাড়িতে আগে কালীপুজোয় বলি হতো। সেই বলির জন্য ধারালো রামদা রাখা থাকত বড় বাবার ঘরের দেওয়ালের একটা খাপের ভিতর। যেই না তোর বড় বাবা ঐ কথাটা বলেছে, দেওয়ালের খাপ থেকে রামদা টেনে বের করে বড় বাবার পিঠের ওপর একটা কোপ বসিয়ে চড়চড় করে কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত টেনে দিল রঘু ডাকাত। বড় বাবা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল। আর ডাকাতের দলও উঠোনে জড়ো করে রাখা সব জিনিসপত্তর ফেলে পালিয়ে গেল। নাগের বাড়ি থেকে একটা সুতোও তারা সে রাতে বের করে নিয়ে যেতে পারল না।
-তারপর বড় বাবার কী হল পিসি? সেলাইয়ের গল্পটা বলো না...
-কী আবার হবে? এক বছর ধরে পিঠের চিকিৎসা চলল। দগদগে ঘা হয়ে পিঠ প্রায় পচে গিয়েছিল। দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে অনেক কষ্টে সেই ঘা সেরেছে। আমি তোর ঠামের মুখে শুনেছি, বড় বাবা কোনোদিন কারও সামনে গায়ের জামা খুলত না। বাচ্চারা ঐ পিঠ দেখলে নাকি ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে দিত! সেলাই দেখলে মনে হবে কয়েকটা আস্ত তেঁতুলবিছে শুয়ে রয়েছে গোটা পিঠ জুড়ে।
-তারপর ডাকাত সর্দারের কী হল পিসি?
-এরপর কি আর সে এ বাড়িতে আসার সাহস পায়? সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন নাগের বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনও ডাকাত পা রাখেনি। এ বাড়ির সম্পত্তি নষ্ট করে কেউ বেরোতে পারবে না। সেটা সবাই জানে।
-তবে যে বম্মা বলে, তুমি বাড়ির মেয়ে হয়ে এ বাড়ির সম্মান নষ্ট করে দিলে! সবাই তোমাকে এত খারাপ কথা বলে কেন সোনাপিসি? এসব শুনতে আমার একটুও ভালো লাগে না।
-তুই বলিস না তো সোনা?
-কোনোদিন না!
-হ্যাঁ রে টুয়া, সবার মতো তুইও আমাকে ছেড়ে যাবি না তো?
-কক্ষনো না পিসি।
-ব্যস! ব্যস! আমার আর কিছু চাই না। তুই এমনই ছোট থাক টুয়া। একদম বড় হবি না মা। বড় হলে নিজেকে আর চিনতে পারবি না। বড় হওয়া খুব খারাপ জানিস তো! ছোটবেলার খুব মজা রে সোনা। ছোট থাকতে মানুষ যা চায়, তাই পায়। এই দ্যাখ, ছোট থাকতে সবাই বড় হতে চায়। তারপর একদিন বড় হয়েও যায়। কিন্তু একবার বড় হয়ে যাওয়ার পর আর কিছুতেই ছোট হওয়া যায় না রে.... তুই এই ছোট্ট টুয়াই থাক। আমার মতো অসময়ে বড় হয়ে যাস না। বড় হবি না তো মা? আমাকে ছুঁয়ে বল!
-আমি তোমার কোলেই থাকব পিসি। কোনোদিন বড় হবো না। কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না, তুমি ঠিক দেখে নিও...
অন্ধকারে মিশে নিষ্পাপ টুয়ার মধ্যে নিজের নিষ্কলঙ্ক শৈশব হাতড়ে বেড়াতে লাগল আহ্লাদী। ওর বুকের মধ্যে বাষ্প জমে শুকিয়ে গেল। অশ্রু হয়ে চোখ পর্যন্ত পৌঁছল না। আহ্লাদী টুয়াকে আরও শক্ত করে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরল।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

খিল পঞ্চম পর্ব


 


খিল
সাথী দাস
পঞ্চম পর্ব



-মা, সোনাপিসি কোথায়?
স্কুল থেকে ফেরার পর নিধির গলা জড়িয়ে প্রশ্ন করে টুয়া। ছাদ থেকে আনা জামাকাপড়গুলো ব্যস্ত হাতে ভাঁজ করতে করতে নিধি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-সেই তুই স্কুলে যাওয়ার আগে থেকে ছাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে তোর সোনাপিসি। দুপুরে ভাত নিয়ে গেলাম, দরজা খুলল না। আমার হয়েছে যত জ্বালা!
-আমি ওপরে যাব।
-না টুয়া, তোমার আর ওপরে গিয়ে কাজ নেই। যেচে অশান্তি বাড়াস না মা। বম্মা দেখলে রক্ষে রাখবে না। কথা শুনতে আমার আর ভালো লাগে না। দুধ খেয়ে পড়তে বসো।
-সোনাপিসির কাছে একটু যাই না মা.... সকালে ঠাম সোনাপিসিকে কত মারল। সোনাপিসির খুব ব্যাথা লেগেছে। পিসি ওপরে একা কাঁদছে। আমি ডাকলে পিসি ঠিক দরজা খুলবে। সোনাপিসিকে একটু আদর করেই চলে আসব।
শৈশবের ক্ষুদ্র হৃদয় কেবল নির্ভেজাল স্নেহ বোঝে। সে সংসারের এত মান-অভিমান ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। আহ্লাদীর কাছে যাওয়ার জন্য ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল টুয়া। কন্যার বায়নার কাছে পরাস্ত হয়ে নিধি রান্নাঘরে দুধ গরম করতে গেল।
আহ্লাদীদের বাড়ির মতো ছাদটাও খুব সুন্দর। ছাদের মাঝ বরাবর একটা বাহারি দোলনা টাঙানো রয়েছে। দোলনার নরম গদিতে পিঠ রেখে আকাশের দিকে চাইলে এক অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বরাবরই আলোকময় উন্মুক্ত ক্ষেত্রের থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন আড়াল-আবডাল আহ্লাদীর বিশেষ পছন্দ। তাই ছাদের থেকে চিলেকোঠার ঘরটা ওর বেশি প্রিয়।
চিলেকোঠার ঘরে একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। কেমন যেন মনখারাপ করা পুরোনো সোঁদা গন্ধ। যেমন গন্ধ মাধবীলতার বাতিল করা পুরনো শাড়ির ভাঁজে পাওয়া যায়। ঘরের এককোণে একটা ছোট খাট রয়েছে। উল্টোদিকে মোটা কাপড়ের আড়ালে ঢাকা রয়েছে পায়া ভাঙা সোফা। গোটা দুয়েক নকশা করা কাঠের আলমারি, ধুলোর আস্তরণ পড়া বাসনপত্র ঘরের এককোণে অবহেলায় পড়ে থাকে.... ঠিক আহ্লাদীর মতোই নাগের বাড়ির যা কিছু অব্যবহৃত, অনাদরের ও অপ্রয়োজনীয় বস্তু, তাদের স্থান হয় এই ঘরে। সেই কারণেই বোধহয় ঘরের ভিতরে জমে থাকা জড় বস্তুগুলোর সঙ্গে আহ্লাদী এত একাত্ম হতে পারে। এই ঘর মধ্যস্থিত সকল প্রাণী ও বস্তুর প্রয়োজন সংসারের কাছে বহুদিন আগে ফুরিয়েছে।
ঘরের ভিতরের এই চৌপায়া খাটটাকে সংসারের সর্বাধিক পবিত্র ও শুদ্ধ জায়গা মানা হয়। ক্ষার দিয়ে মাধবীলতার জামাকাপড় কেচে ধুয়ে এই বিছানার ওপর রাখার কড়া নিয়ম আছে। পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী তিথি ছাড়াও প্রতি মাসে আহ্লাদীর বিশেষ অসুবিধার দিনগুলোতে ওর স্পর্শ থেকে দূরে থেকে, ওকে একতলার ঘরের বিছানায় একা রেখে শুদ্ধাচারী মাধবীলতা এই ঘরে বাস করে। ঐ দিনগুলোতে বাড়ির বৌদের কিংবা নিজের মেয়ের ছায়াও মাধবীলতা স্পর্শ করে না। স্বপাক ব্যতীত আহার গ্রহণ করে না। চিলেকোঠার ঘরে দরজার এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা শীতলপাটিতে শয়ন করে। তাছাড়া যেকোনো ব্রত ও পুজোর দিনে উপবাস কিংবা ফলাহার উপলক্ষ্যে মাধবীলতার স্থান হয় সংসারবর্জিত এই ঘরে।
সময় এবং সুযোগ পেলে চুরি করে এই ঘরের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে আহ্লাদী। গুটিকয়েক আরশোলা, ইঁদুর আর টিকটিকি হয় ওর একাকীত্বের সঙ্গী। টিকটিকি ও আরশোলার সঙ্গে আহ্লাদীর বেশ বোঝাপড়া আছে। তারা পরস্পরকে ভয় পেয়ে সমীহ করে চলে। কেউ কারও বৃত্তে প্রবেশ করে না। কিন্তু দুঃসাহসী ইঁদুরগুলো রাতের অন্ধকারে ধারালো দাঁত দিয়ে ঘরের ভিতরের খুচরো জিনিসপত্র কেটে নষ্ট করে। তবুও আহ্লাদী তাদের স্পর্শ করে না। মৃগাঙ্ক একাধারে চাকুরিজীবি ও জমি-জিরেতের মালিক হলেও অন্যধারে পরিপক্ক ব্যবসায়ী। আরাধ্য দেবতা গণেশ ঠাকুরের বাহনকে ব্যবসায়ীর গৃহে নিধন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই ইঁদুরের উৎপাত সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে পারস্পরিক সহাবস্থানে নাগের বাড়ির সকলেই কমবেশি অভ্যস্ত।
খাটে শুয়ে ঝুল পড়া ঘুলঘুলির দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল আহ্লাদী। বিছানার আলিঙ্গন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে আসা স্বল্প আলোয় বোঝা যাচ্ছে, দিনের আলো প্রায় নিভে এলো। তবুও আহ্লাদীর খিদে পায়নি। কেমন যেন ঝিম ধরা অনুভূতি ঘিরে রয়েছে ওকে, চোখদুটো আধবোজা অবস্থায় রয়েছে। তিনতলার জানলা ও মেঝে কাঁপিয়ে বাঁশির শব্দ তুলে একটা রেলগাড়ি চলে গেল অফিস ফেরত নিত্যযাত্রীদের নিয়ে। সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে কেবল রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ গুনেছে আহ্লাদী। এক.... দুই.... তিন.... আপ.... ডাউন... একে একে সব গাড়ি স্টেশন ছেড়ে চলে যাবে গন্তব্যে। তবুও জীবনের কাছে আহ্লাদীর ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর হবে না।
রেলগাড়ির বাঁশির শব্দ আজও আহ্লাদীকে তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে কি আহ্লাদীর জীবনের প্রথম প্রেম ছিল? প্রেম কাকে বলে, তার অনুভূতি কেমন.... আহ্লাদী সঠিকভাবে বোঝে না। কিন্তু যে ভালোলাগার আগুন আহ্লাদীর বুকের মধ্যে সর্বক্ষণ দাবানলের মতো জ্বলে, ওর দেহ পুড়িয়ে ছারখার করে, সেই নিভৃত অগ্নুৎপাতের স্রষ্টা ছিল একজনই। হারু কাকা। তার স্পর্শে ছিল বন্য ভালোলাগা। আহ্লাদী না হয় তাকেই প্রথম প্রেমিক বলবে। কিন্তু তা কিভাবে হবে? সেই ভালোলাগার ধরনও তো কিছু সময় পর বড় একঘেয়ে একপেশে ও সবশেষে ফিকে হয়েছিল। তখন আহ্লাদী মানুষটাকে আর সহ্য করতে পারত না। স্কুলের ফিরতি পথের এককোণে তৈরি হয়েছিল আহ্লাদীর নতুন আকর্ষণ। ছেলেটি গ্যারেজে কাজ করত। স্কুলে নিয়মিত যাতায়াতের পথে যার সঙ্গে আহ্লাদীর চোরা দৃষ্টি বিনিময় চলত।
সেই দৃষ্টির টানে শীতের শেষ রাতে নিজের ঘর ছেড়েছিল আহ্লাদী। সবুজ গাছপালায় ঘেরা নাগের বাড়ির উঠোনে সন্ধে নামে বড় তাড়াতাড়ি। উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনায় আহ্লাদীর সেদিন সারারাত ঘুম হয়নি। সেই প্রথম দরজার আগল নামিয়ে আহ্লাদী ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছিল। শীতের রাতে স্টেশনে পৌঁছে চাদর জড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। হঠাৎ সে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে পিছন থেকে এসে কাঁধের ওপর হাত রেখে বলেছিল,
-এসেছ?
-তুমি!
-হ্যাঁ। এনেছ? যা আনতে বলেছিলাম।
-এই যে, এনেছি। এতে মায়ের গয়না আছে। সব হাতের সামনে পাইনি। যতটা পেয়েছি, সুযোগ বুঝে সরিয়ে রেখেছিলাম। আসার আগে ওড়নায় বেঁধে এনেছি।
একটা ছোট সুতির কাপড়ের পুঁটুলি নিজের বিশ্বস্ত প্রেমিকের হাতে তুলে দিয়েছিল আহ্লাদী। তারপর তার হাত ধরে ভোরের প্রথম গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়েছিল অজানা পথে।
নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া আহ্লাদীর খোঁজে যখন থানায় দৌড়ে মৃগাঙ্ক, শশাঙ্ক আর অঙ্কন প্রায় বিধ্বস্ত, ঘরের ভিতর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে মাধবীলতা.... সেই সময় প্রেমিকের সঙ্গে বহুদূরে পাড়ি দিয়েছে আহ্লাদী। একটি নিম্নমানের হোটেলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্যাঁতসেঁতে শয্যায় আশ্রয় নিয়ে কেটে গেছে দুটি নির্ঘুম রাত।
প্রেমিকের তীব্র উন্মাদনা ও নারীদেহ স্পর্শের নবনবীন পন্থায় নিজের দেহের গোপন কোণ ও মনের অনাবিষ্কৃত অনুভূতিগুলোকে আহ্লাদী নতুনভাবে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। মিলনরত অবস্থায় বেশ কিছু সময় আহ্লাদীর যে হারু কাকার কথা একেবারেই মনে পড়েনি, এমনটা নয়। তবে হারু কাকা অন্তিমে কেবল নিজের সুখের কথা চিন্তা করলেও, আহ্লাদীর প্রেমিক দ্বিধাহীনভাবে তাকে সুখী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। এ বিষয়ে কোনোরকম কার্পণ্য সে করেনি।
চতুর্থ দিনে যখন অর্থাভাব দেখা দিল, মাধবীলতার গয়না বিক্রির তাগিদে হোটেলের বাইরে বেরোল আহ্লাদীর প্রেমিক। আহ্লাদী তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। চোখ মেলে চমৎকৃত হয়েছিল সে। ঘরের ভিতরে তার প্রেমিকের সঙ্গে আরও দু'জন অর্ধনগ্ন পুরুষ গল্পে বিভোর হয়ে মদ্যপানে ব্যস্ত। ভয় পেয়ে চাদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে আহ্লাদী নিজের প্রেমিকের নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে উঠেছিল.... প্রত্যুত্তরে আহ্লাদীর প্রেমিক সুমিষ্ট ভাষায় ওকে আশ্বস্ত করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল...
ঘুলঘুলির বাইরে আলো দেখা যাচ্ছে না। সন্ধে নেমেছে বোধহয়। নাগের বাড়ি কাঁপিয়ে সন্ধের ডাউন ট্রেন চলে গেল। চোখ মেলে শূন্যের দিকে চেয়েছিল আহ্লাদী। ওর চোখে জল আসে না, কান্না পায় না। মনে কথা জমে না। অভিমানে ঠোঁট ফুলে ওঠে না। আহ্লাদীর দেহের মধ্যে কেবল একটাই অনুভূতি সচল, অন্তহীন কামনা। যে কামনা প্রতিনিয়ত শীতল দুটি পা হতে নারীর উরুসন্ধি ছুঁয়ে শিরশিরে তলপেট অতিক্রম করে বুকের মধ্যে দিবারাত্র অগ্নিকুন্ড জ্বালিয়ে রাখে...
চিলেকোঠার ঘরের ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আহ্লাদী অন্ধকারে মিশে নিজের কথা ভাবছিল। ও নিজেকে ঠিক বুঝতে পারে না, নাকি ওকে কেউ বুঝতে চায় না! এ বড় জটিল এক ধাঁধাঁ। সাংসারিক প্রবহমানতার স্রোতে গা ভাসিয়ে নিতান্ত স্বাভাবিকের দলে নাম লেখাতে পারেনি বলেই কি ও নিজের পরিবারের কাছে অতিরিক্ত বোঝা? কেন সকলে এত খারাপ কথা বলে? ও কী এমন ভুল করে! নিজের অভ্যাস থেকে কেউ যদি চেয়েও ছুটি না পায়, তবে আহ্লাদী কেন নিজের ভালোলাগার অভ্যাসকে ছুটি দেবে?
সকলে ওকে নির্লজ্জ স্বার্থপর বলে। ও নাকি কারও মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে না। মান সম্মান আহ্লাদী চোখে দেখতে পায় না, অনুভব করতেও পারে না। এসব শব্দের সঙ্গে ও একেবারেই পরিচিত নয়। তবে আহ্লাদী স্বার্থপর, এ অপবাদ সর্বৈব মিথ্যা! নিজের পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের কথা আহ্লাদী মন দিয়ে চিন্তা করে। যা চোখে দেখা যায়, একা থাকলে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণও করে।
এই যে বড়দাদা প্রতিদিন অফিসে যায়, মেজদা মাঠে কিংবা দোকানে, বাবাই-টুবাই, টুয়া মন দিয়ে পড়াশোনা করে, বৌদিদিরা সংসারের কাজে নিজেদের আকন্ঠ ডুবিয়ে দেয়, তারাও তো ক্লান্ত হয়। কিন্তু মন প্রতিদিন একই নিয়ম মানতে না চাইলেও তো প্রাত্যহিক দায়িত্ব কর্তব্য থেকে ছুটি পাওয়া যাবে না। এ এক অভ্যাসও বটে! যেমন টুয়ার ছবি আঁকতে চাওয়াটা একটা অভ্যাস, ঠিক তেমনই.... নিত্য নতুনভাবে সাদা পৃষ্ঠায় আঁকিবুকি কেটে টুয়া আহ্লাদে আটখানা হয়। বৌদিদিরা দাদাদের ভালোবাসার অভ্যাসে নিত্যদিন জড়িয়ে থাকে। সিঁদুর ঘেঁটে যাওয়া এক রাতের শেষে মেজ বৌদিদির কাছে আহ্লাদী শুনেছিল, একবার ভালোবাসলে তখন মানুষ ভালোবাসা ছাড়া আর বাঁচতে পারে না। এ বড় সাংঘাতিক নেশা। এ নেশার অভাবে বুকের ভিতর তৈরি হয় মহাকাশ সমান শূন্যতা। বন্ধ দরজার ওপারে মেজ বৌদিদির অনুভবে মিশে থাকা সেই ভালোবাসার স্বাদ কেমন? এ কি আহ্লাদীর সেই কামনা, যাকে মেজদাদার ভালোবাসার পোশাকি নাম দিয়ে খিল এঁটে ঘরবন্দি করে প্রতিদিন মেজ বৌদিদি ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে? যদি সত্যিই তাই হয়, তবে শব্দের রকমফেরে অর্থের তো কোনোরূপ পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। কেন তবে সকলে কেবল আহ্লাদীকেই কটুকথা বলে? বৌদিদিদের নয়!
সকলেই শান্ত শীতল স্বাভাবিক ভালোবাসায় অভ্যস্ত। আহ্লাদীর বেলায় জোটে গালমন্দ! বহুবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে আহ্লাদী। হারু কাকাই কি ওর অবুঝ বয়সের প্রথম প্রেমিক ছিল? যার কথা আজও মুখ ফুটে কাউকে বলা হয়নি। বালিকার মনের অতলান্তে নিমজ্জিত রয়েছে খড়ের গাদায় কাটানো সেই অপার্থিব সুখের রাত! কিন্তু আহ্লাদীর মনের ভিতর থেকে কোনও উত্তর আসেনি।
ভালোবাসার সঠিক মানুষ নির্বাচন করে তাকে উপলব্ধি করার আগে নিতান্ত অসময়ে যদি কোনও বালিকা নিজের দৈহিক চাহিদার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়, ক্রমে সেই চাহিদাকে নিতান্ত স্বাভাবিক জ্ঞানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে সেই অভ্যাসে এমন বাধা কেন? এত বিধিনিষেধ কেন? কেবল একটি চৌপায়া শয্যাসর্বস্ব ঘর, হাতে লাল সাদা বেড়ি আর কপালে রক্তিম ছাপের সঙ্গে দরজার খিল.... এই অপরিহার্য কয়েকটি বস্তুর অভাবে এত কোলাহল? এই সমস্ত বৌদিদিদের আছে, আহ্লাদীর নেই! তাই বুঝি এত আর্তনাদ...
চাপা আর্তনাদ সেদিন আহ্লাদীর গলা চিরে বেরিয়ে এসেছিল। যখন নিজের প্রেমিকের প্রকৃত স্বরূপ ও জানতে পেরেছিল। কিন্তু সেই আর্তনাদ গাঢ় শীৎকারে পরিবর্তিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। প্রতিক্ষণে ভিন্নরূপে চমৎকৃত হতে চাওয়া নারীর কাছে কোনও চমকই দীর্ঘস্থায়ী নয়। আহ্লাদীর প্রেমিক যখন হোটেলের বাইরে বেরিয়ে একতলায় নেমে এসে টাকা গুনে তুলে দিচ্ছিল হোটেলের ম্যানেজারের হাতে, তখন দু'জন পুরুষের দেহতলে পিষ্ট আহ্লাদীর মৃদু আপত্তি প্রায় তলানিতে ঠেকেছিল। পরবর্তী কয়েকটা দিন সময়ের হিসেব রাখা আহ্লাদীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে নিজের হিসেবের অঙ্ক আহ্লাদীর প্রেমিকের থেকে কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিয়েছিল হোটেলের ম্যানেজার।
সেই কয়েকটি দিনে তিনজন পুরুষের সান্নিধ্যে আহ্লাদী জীবনের খাতায় এমন কিছু সুন্দর মুহূর্ত লিপিবদ্ধ করেছে, যার রেশ আজও কাটেনি। কিন্তু প্রথমদিন অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহল সহ আনন্দের মাত্রা অত্যধিক হলেও, শেষ পর্যন্ত আহ্লাদী মুক্তির জন্য আকুতি জানায়। কারণ আহ্লাদীর মনের তীব্র চাহিদার কাছে শরীর পরাজয় বরণ করে।
সমস্ত দিন পেরিয়ে সন্ধেরাত্রি হয়ে যাওয়ার পরও নারীলোলুপ তিন পুরুষের লালসা থেকে আহ্লাদী মুক্তি না পেয়ে অকথ্য অত্যাচারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রমণকার্যে ব্যস্ত পুরুষটি ভয় পেয়ে সরে এসে বলে, "মাগী মরে গেলি নাকি রে? এত দম ছিল তোর! কোথায় গেল সব?" দ্বিতীয় পুরুষ অশ্রাব্য ভাষায় প্রথম পুরুষটিকে ভূষিত করে বলে, "বলেছিলাম এবার ছেড়ে দে। আর নিতে পারছে না। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মরে গেলে ম্যানেজার ছেড়ে কথা বলবে না এই বলে দিলাম.... থানা-পুলিশের হ্যাপা..."
ম্যানেজারের কাছে চাবি জমা দিয়ে রঙিন পানীয়র সন্ধানে বেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল দু'জন পুরুষ। তারপর আহ্লাদীর তথাকথিত প্রেমিকেরও আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। বকেয়া টাকা পরিশোধ না করে হোটেল ছেড়ে পালানোর জন্য ম্যানেজার তখন অগ্নিশর্মা হয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। কোথাও কেউ নেই। তিনজন পুরুষ তো বটেই, এমনকি সঙ্গের মেয়েটিও যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে...
বাথরুমের দরজা খুলতেই একরাশ জমে থাকা বাতাস যেন নাকে এসে ঝাপটা মেরেছিল। বাতাসে মিশে থাকা উগ্র পানীয়র গন্ধে ম্যানেজারের মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় চাপা গোঙানি কানে যেতেই পিছু ফিরে ম্যানেজার আবিষ্কার করেছিল, ঘর শূন্য। ব্যবহৃত শয্যার ওপর চাদরটা অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। জনপ্রাণীর দেখা নেই। তবে কাঁদে কে! ঝুঁকে মেঝের ওপর মাথা ঠেকিয়ে খাটের তলায় দেখে ম্যানেজারের হৃদস্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসতে চেয়েছিল। খাটের তলায় সম্পূর্ণ নগ্ন আহ্লাদীর হাত-পা-মুখ বাঁধা।
কিছুক্ষণ আগে আহ্লাদীর জ্ঞান ফিরেছে। ঘরে মানুষের আগমন বুঝেই মেঝেতে মাথা ঠুকে তীব্রভাবে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ও। সেই চেষ্টার ফলস্বরূপ ওর চোখদুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ঝুঁকে আহ্লাদীকে টেনে বের করতে গিয়ে ম্যানেজার দেখে খাটের একটা পায়ার সঙ্গে আহ্লাদীর কোমরের দড়িটা শক্ত করে বাঁধা রয়েছে। ফলে ও এক ইঞ্চিও নড়তে বা পাশ ফিরে শুতে পারছে না।
দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায় আহ্লাদীকে উদ্ধারের পর হাত-পায়ের দড়ি কেটে দেখা গিয়েছিল বাঁধার আগে ওর মুখের মধ্যে ঠেসে দেওয়া হয়েছিল কোনও এক পুরুষের ব্যবহৃত নিম্নাঙ্গের আবরণী। মুক্তি পেয়েই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছিল আহ্লাদী। তারপর ছিটকে সরে গিয়েছিল দেওয়ালের এককোণে। দু'হাতে নিজেকে আড়াল করে তীব্র আপত্তি জানিয়ে চিৎকার করে কেঁদে একনাগাড়ে বলেই চলেছিল, "না.... আর না... আর না! আমি আর পারছি না। আর না..."
বিছানা থেকে চাদর টেনে নামিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে নিজেকে আড়াল করতে সচেষ্ট আহ্লাদীকে ঢেকে ম্যানেজার বলে উঠেছিল, "এখানে তো প্রায়ই এমন মেয়েরা আসে। কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হয়, তুমি ভালো ঘরের মেয়ে বোন। এদের পাল্লায় তুমি পড়লে কী করে? এতজনের সঙ্গে তোমাকে একা দেখে আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় বাকি মেয়েদের মতো নিজের ইচ্ছেয়.... কিন্তু তারা তো এভাবে কান্নাকাটি করে না। যেভাবে মাথা উঁচু করে রুমে ঢোকে, সেভাবেই বেরিয়ে যায়.... দুজন রুমে থাকছিল, একজন বেরিয়ে যাচ্ছিল, তিনজন একসঙ্গে তোমার সঙ্গে ছিল, তখন তুমি চুপ করে ছিলে কেন? আরও আগে আমার কাছে আসোনি কেন? সাহায্যের জন্য চিৎকার করোনি কেন?"
জবাবদিহির মতো পরিস্থিতি তখন আহ্লাদীর ছিল না। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো ওর দৃষ্টি! আতঙ্কে কেঁদে ম্যানেজারের কাছ থেকে পালিয়ে ও যেন দেওয়ালের সঙ্গে মিশে যেতে চাইছিল। কান্নাও প্রায় গোঙানিতে পরিণত হয়েছিল। উন্মাদিনীর মতো চিৎকার করে ম্যানেজারের গায়ে এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুষি লাথি ছুঁড়ে আহ্লাদী বলেছিল, " না না.... আর না..."
সেদিন অসহায় ম্যানেজার হোটেলের ঘর হাতড়ে আহ্লাদীর জামাকাপড় এনে ওর হাতে গুঁজে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে বলেছিল, "জামা পরো। আর এই টাকা রাখো। এক্ষুণি আমার হোটেল থেকে বেরিয়ে যাও। কোথা থেকে কী হয়ে যাবে, তারপর ব্যবসা তো যাবেই। জেলের ভাত খেতে হবে। এমনিতেই গত মাসে তিনবার পুলিশের রেডের হাত থেকে কপালজোরে বেঁচেছি। যেচে ওসবের মধ্যে কে পড়তে চায়! বেরোও আমার হোটেল থেকে..."
পরনের মলিন পোশাক, একটা কম্বল আর দুটো পাঁচশো টাকার নোট হাতের মুঠোয় নিয়ে হোটেলের ঘর ছেড়েছিল আহ্লাদী। সূর্যদেব তখন সবেমাত্র আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলছেন। কয়েক পা হেঁটে হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আহ্লাদী টলছিল। বিগত কয়েকদিন ধরে যে মাদকদ্রব্য তারা আহ্লাদীর রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাবে ওর দুটো পা তিরতির করে কাঁপছিল। চোখের সামনে দিয়ে একটা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সহায় সম্বলহীন আহ্লাদী হাত দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে সাহায্য চাইতে পারেনি। ওর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় গাড়ির গতিবিধি মৃদু কম্পনরূপে ওর ঝাপসা দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছিল। হাত তুলতে গিয়ে আহ্লাদী বুঝতে পেরেছিল, দেহ অবশ হয়ে আসছে। কনুই থেকে বগল পর্যন্ত কোনও সাড় নেই। বাঁ হাতে অজানা ইঞ্জেকশনের কারণে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চিনচিনে ব্যাথা। তবুও হাত দেখিয়ে গাড়িটাকে দাঁড় করানোর অন্তিম প্রয়াস করেছিল আহ্লাদী। কিন্তু হঠাৎই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে দড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল আহ্লাদীর অবশ দেহ। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া দেহের নাসারন্ধ্র থেকে উষ্ণ বাতাস বেরিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল রাস্তার ধূলিকণা...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট