খিল
সাথী দাস
অষ্টম পর্ব
নাগের বাড়ির সর্বকনিষ্ঠা কন্যার বিয়েতে কোনোপ্রকার ত্রুটি রাখা চলে না। সুতরাং রাজকীয় আয়োজনের যাবতীয় প্রস্তুতির জন্য মৃগাঙ্ক সর্বদা নিজের মাথার মধ্যে রাজ্যের হিসেব কষে চলেছে। শশাঙ্ক অসহায় হয়ে একবার তৃণার দিকে আর একবার নিধির মুখের দিকে চাইল। রান্নাঘরের বারান্দায় বারংবার পায়চারি করে সে ফিরে গেল নিজের ঘরে। আহ্লাদীর বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপনের সাহস শশাঙ্ক পাচ্ছে না। রন্ধনকার্যে তৃণার সঙ্গে সহযোগিতা করছিল নিধি। সে আপন পূজনীয় স্বামীর কার্যকলাপ দেখে নিজের কপালে নীরবে করাঘাত করল। এ সংসারে যে পুরুষের মেরুদন্ড নেই, সেই পুরুষের ঘরণী হওয়ার লজ্জায় আগুনের তাপে আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়ার সময় রক্তবর্ণ ধারণ করল নিধির মুখ। এমনকি অঙ্কন পর্যন্ত একতলা থেকে একবার ঘুরে উত্তরাকে খুঁজে না পেয়ে সাহসের অভাবে ফিরে গেছে দোতলায়।
প্রাত্যহিক গতানুগতিক রুটিন মেনে দিন শুরু হয়েছিল। স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে শিবালয়ে গিয়েছিল উত্তরা। শহুরে জীবন থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে এ বাড়িতে আসলে, স্নানের পর পুজোর দায়িত্বটা সে নিজের কাঁধে তুলে নিতে পছন্দ করে। দ্বিতীয়বার চায়ের জন্য তাগাদা দিতে একতলায় নেমে এসেছে মৃগাঙ্ক। রান্নাঘরের গ্যাসের ওপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় হাঁড়ি-কড়াই জাঁকিয়ে বসছে। গৃহকর্ম সহায়িকা চাঁপা ঘর মুছতে মুছতে কোমরে কাপড়ের আঁচল পেঁচিয়ে বলল,
-বড়দাবাবু একটু সরে দাঁড়াও গো। সিঁড়ি মুছে উঠোনখানা ধুয়ে বেরিয়ে যাব। সাবধানে পা ফেলো। ভিজে মেঝে!
-হ্যাঁ সেই.... চা খেতে এসে আবার আছাড় খেয়ে কোমর ভেঙে ফেলো না বাপু.... সামনে বোনের বিয়ে বলে কথা!
রান্নাঘরের ভিতর থেকে তৃণার গলা শুনে মৃগাঙ্ক বলল,
-লাস্ট রাউন্ড চা কি পাব না?
পুজোর থালা হাতে নিয়ে মাথার ঘোমটা সামলে মৃগাঙ্কর সামনে এসে দাঁড়াল উত্তরা।
-বড়দাভাই প্রসাদ নিন। আর প্রসাদী ফুল-বেলপাতা। চাইলে সঙ্গে রাখতে পারেন।
অতর্কিতে ভাতৃবধূ একেবারে মুখোমুখি এসে উপস্থিত হওয়ায় খানিক অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে অনভ্যস্ত মৃগাঙ্ক বলল,
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। বয়স বাড়ছে। এখন অনেক বুঝে খেতে হয় ছোটবৌ। দায়িত্ব-কর্তব্য মেলা আছে। আরও কিছুদিন বাঁচতে হবে। তুমি বরং সন্দেশটা ভেঙে দাও। গোটা খাব না।
-তাই নিন দাদাভাই। প্রসঙ্গ যখন স্বাস্থ্য, তখন জোর করব না। আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিচ্ছি। দিদিভাইরা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আপনি অফিসে যাবেন। বাচ্চাদের টিউশন-স্কুল আছে। ওরা কতদিকে করবে? আমি ঢুকছি রান্নাঘরে।
একতলায় উত্তরার কন্ঠ শুনে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়িতে নেমে এসেছে অঙ্কন। হাতে দৈনিক মুদি বাজারের ফর্দ আর কলম নিয়ে মৃগাঙ্ক রান্নাঘরের সিঁড়ির সামনে বসে হাঁক দিল,
-শশী, এই শশী।
ঘর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে শশাঙ্ক বলল,
-হ্যাঁ দাদা, বলো।
-থাকিস কোথায় সব? জানিস আমার অফিস আছে। সকালের এই সময়টাতেই একটু ফাঁকা থাকি। সামনে মাথার ওপর এতবড় কাজ। একসঙ্গে বসে একটা আলাপ-আলোচনা সেরে নিতে হবে তো! তা ছেলের বাড়িতে সামনের সপ্তাহেই যাওয়া যাক? ওরা সব দেখেশুনে গেছে। এককথায় রাজি। আমাদের মেয়ে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। আমরাও আর দেরি করতে চাই না। এবার সবাই মিলে গিয়ে পাকাকথা বলে পঞ্জিকা দেখে একটা ভালো দিন ধরে সব ঠিক করে ফেলি। মিস্ত্রী-মজুর লাগিয়ে বাড়ির কাজও তো শুরু করতে হবে। বাড়ি আর বিয়ে, দুটোই বড় কাজ। এই তো, ছোটও এসে গেছে। বোস অঙ্কন। তা বোনের বিয়েতে তোরা কে কোন দায়িত্ব নিবি, আমাকে জানা। সেইমতো আমি এগোব। আমার পক্ষে তো অফিস করে সবটা একার হাতে সামলানো সম্ভব নয়।
ফুটন্ত চায়ের জলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেও উত্তরার মন পড়ে রয়েছে বাইরের বারান্দার দিকে। অঙ্কন এখনো কিছু বলছে না কেন! চায়ের কাপ বের করে উত্তরার হাতে দিয়ে তৃণা বলল,
-শোন ছোট, ভাসুরের থেকে একহাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়। নইলে বৌয়ের নিন্দে হয়। তুই প্রসাদ নিয়ে তার এত সামনে গিয়েছিলি কেন? আর তোর ঘোমটা মাথা থেকে খালি খসে যায় দেখি! আঁচল আর ঘোমটা ঠিক করে সামলে রাখ ভাই। নিজেরা মেয়েমানুষরা থাকলে একরকম। তখন কেউ ডাক নেবে না। এখন ঘরের ভিতর তোর ভাসুর ঠাকুর রয়েছে না!
উত্তরা কোনও উত্তর দিল না। মাথা নামিয়ে ঘোমটা ঠিক করে গায়ে কাপড়ের আঁচল টেনে নিল। নিধি মৃদুস্বরে বলল,
-ছোট'র কি শাড়ি পরার অভ্যাস আছে দিদি? এখানে এলে আমাদের মান রাখতে পরে। তাই ওসব ঘোমটা তেমনভাবে সামলে চলতে পারে না। তা কী আছে! বাড়ির মধ্যেই তো...
-মাছের ঝোলের আলুটা কেটে দে মেজ। পাতলা আর লম্বা করে কাটিস। বেশি ধ্যাবড়া করে কাটলে সহজে সেদ্ধ হতে চায় না, অনেক সময় যায়। বুঝলি!
-বুঝলাম, হাতের কাজটা সেরেই দিচ্ছি।
চায়ের কাপগুলো সাজিয়ে নিয়ে দূর থেকে চোখের ইশারায় অঙ্কনকে ডেকে ট্রে ধরিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে শাসন করল উত্তরা। চায়ে চুমুক দিয়ে অঙ্কন অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
-বড়দা, বলছিলাম যে.... এ বিয়েতে আহ্লাদীর মত আছে কিনা.... একবার কথা বলে নিলে...
মৃগাঙ্ক ভ্রু কুঁচকে হতবাক দৃষ্টিতে অঙ্কনের দিকে চাইল। তারপর মৃদু ভর্ৎসনার স্বরে বলল,
-এটা নাগের বাড়ির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে অঙ্কন, ছেলের বিয়ে নয়। এতদিন ছেলেরাও বিয়ের ব্যাপারে ব্যক্তিগত মতামত জানাতে পারত না। এ বাড়িতে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। সবটাই পারিবারিক। গুরুজনরা যা ঠিক মনে করত, সেই সিদ্ধান্তই সকলে মেনে নিত। এটাই এ বাড়ির ঐতিহ্য, নিয়ম। যদিও আজকাল সেই নিয়মেরও হেরফের হচ্ছে বৈকি! ছেলেরা নিজের ইচ্ছে জানাচ্ছে, ইচ্ছেপূরণ করতে বাধ্য করছে। কিন্তু একজন একবার নিজের ইচ্ছে জাহির করেছে বলে তো বারবার সেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। তুমি যার মতামত নিতে চাইছ, সে নিজের এবং পরিবারের অন্যান্যদের ভালোমন্দ বুঝতে পারলে, এই বংশের গায়ে কলঙ্কের কালি লেপে দিতে পারত না। এখন তার বোধ-বুদ্ধির ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখে আমাকে তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে বলছ?
-ঠিক আছে বড়দা, বুঝেছি। সরাসরি কাজের কথায় আসি। আহ্লাদীর জন্য এই ছেলে আমার পছন্দ নয়। এই বিয়েতে কে কোন দায়িত্ব নেবে, তুমি একটু আগে জানতে চাইছিলে। তাই আমি আমার মতামত জানিয়ে দিলাম। এই ছেলেকে আমি আহ্লাদীর বর হিসাবে মানতে পারছি না। পাত্রপক্ষের পছন্দ শেষ কথা হতে পারে না। মেয়ের বাড়িরও একটা মতামত আছে। এ বিয়েতে আমার মত নেই। মেজদা তোমার ভয়ে কিছু বলবে না। তবে আমার মনে হয়, তারও একই বক্তব্য।
সকাল থেকে একাধিকবার অভ্যাস করা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে উগড়ে মাথা নামিয়ে কম্পিত বুকে মোড়ার ওপর বসে রইল অঙ্কন। জুড়িয়ে যাওয়া চায়ের স্বাদ তখন ফিকে হয়ে গেছে। মৃগাঙ্ক একবার রান্নাঘরের দরজার দিকে চাইল। মাথায় ঘোমটা টেনে চৌকাঠের ওপর চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে উত্তরা। বারান্দায় পিনপতন নীরবতা। রান্নাঘরের ভিতর বাসনপত্রের ঝনঝনানি কোন এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। মৃগাঙ্ক ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-শশী, তুইও একই কথা বলবি?
শশাঙ্ক যেমন নেতিবাচক উত্তর দিল না, তেমন ওর পক্ষ থেকে কোনও ইতিবাচক ইঙ্গিতও মিলল না। চুপ করে বসে রইল ও। হাত থেকে খুন্তি নামিয়ে তৃণা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বলে উঠল,
-এ পাত্র যখন পছন্দ না, তা তোমরাই দেখেশুনে ও মেয়ের বিয়ে দাও না ঠাকুরপো। কেউ তো মানা করছে না। বোন তো কারও একার নয়। সবারই। বোনের বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও সবার। আমরাও দেখি, ওর জন্য তোমরা কেমন ঘর আলো করা রাজপুত্র ধরে আনো! কার বুদ্ধিতে ছোট ঠাকুরপো এসব কথা বলছে, সে কি আর আমি বুঝি না!
-ভুল বুঝো না বড়দিভাই, তোমাকে একটা কথা বলি। বিয়ে ভালো হওয়া কিংবা মন্দ হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যা ভাগ্যে আছে, তাই হবে। যার হাঁড়িতে আহ্লাদীর জন্য চাল বরাদ্দ আছে, তার ঘরে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু আমরা বড়রা যখন দেখেশুনেই বিয়েটা দিচ্ছি, তখন মেয়েটাকে একেবারে জলে ফেলে দিতে পারি না। বাড়ি-ঘর বিষয়-সম্পত্তির জন্য পাত্রপক্ষ পুরোপুরি আমাদের ওপরেই নির্ভর করছে। সে ঠিক আছে। না হয় সবই আমরা সাজিয়ে গুছিয়ে দেব। অন্তত মানুষটাকে দেখে তো মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যাবে.... এখানে তো সেই শান্তিটুকুও নেই। ঠিক কী দেখে একে তোমার মনে ধরল দিদি?
-তা তোর আদরের ছোট ননদ যতজনের সঙ্গে শুয়ে এসেছে, তাদের মধ্যেই যদি কাউকে মনে ধরে, তবে ঝুলিয়ে দে তার গলায়। ঐ তো গুণবতী মেয়ে! একজন বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, এই ঢের! আবার মনকে সান্ত্বনাও দেওয়া চাই, কত চাহিদা.... এ পাত্র হাতছাড়া হলে ও মেয়েকে আজীবন আইবুড়ো অবস্থায় ঘরে বসিয়ে রাখতে হবে বলে দিলাম। মনের মতো চাই.... হুহ! এ পৃথিবীতে কোনও কিছু কি মনের মতো পাওয়া যায় রে ছোট?
-তা যায় না ঠিকই! মনের মতো পাওয়া গেলে তো আমিও পেতে পারতাম! সংসার করতে গিয়ে দেখলাম, কত কিছুর অবস্থান মনের ঊর্ধ্বে! মানিয়ে গুছিয়ে চলছি। কী করব? অপছন্দ বলে কাউকে তো আর ফেলে দিতে পারি না। রক্ত দিয়ে গড়া সম্পর্কের শাখা-প্রশাখা সব। হাতের পাঁচটা আঙুল কি আর সমান হয়? এখন এসব নিয়ে বিশেষ ভাবি না। যাকে দিয়ে সম্পর্ক, সে ঠিক থাকলেই হল।
-তুই কি ছোট ঠাকুরপোকে সামনে রেখে আমাকে ঠেস মেরে কথা বললি ছোট?! তোর এতবড় আস্পদ্দা! হ্যাঁ গো, শুনলে তুমি? ছোটবৌয়ের কথাটা শুনলে? দু'দিন হয়েছে এ বাড়িতে এসেছে। ভিন্ন থাকে। ফোন করে ডাকলে কুটুমের মতো বেড়াতে আসে। আমি একা এতবড় সংসারের জোয়াল টেনে মরি। তুমি ঘরে বাইরে গাধার মতো খেটে মরো। তা সত্ত্বেও ওর কথার দৌড় দেখলে? ছোট-বড় কিছু মানে না। মেয়েমানুষের এত তেজ ভালো না ছোট!
-যা পারো করো তোমরা। এ বাড়ির কোনও কিছুতে আমি আর নেই।
মৃগাঙ্ক খাতাপত্র ছুঁড়ে ফেলে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অঙ্কন একছুটে মৃগাঙ্কর পথরোধ করে বলল,
-দাদা প্লিজ তুমি অপরাধ নিও না। উত্তরা, এক্ষুণি দাদা-বৌদির কাছে ক্ষমা চাও। উত্তরা!
রান্নাঘরের চৌকাঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল উত্তরা। নিধি ওর কাছে এগিয়ে উত্তরার খসে পড়া শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-কাল রাতে তোর ঘরে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা চেয়ে নে ছোট। অশান্তি করিস না। আহ্লাদীর কপালে যা আছে, তাই হবে। তুই দাদাভাইয়ের ছোট বোনের মতো। দাদার সামনে মাথা নত করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। যা সোনা, লক্ষ্মী বোন আমার। দাদাভাইয়ের কাছে গিয়ে একবার বল, ভুল হয়ে গেছে। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
-উত্তরা...
-দেখলে ঠাকুরপো? মেয়ের তেজ দেখলে! তোমারও ভাই দোষ আছে। আশকারা দিয়ে বৌকে একেবারে মাথায় তুলে দিয়েছ। এখন তোমার কথাকেই মান দেয় না। শ্বশুরবাড়ির ঘর না করলে, তোমার বৌ বুঝবে কিভাবে এখানে কেমনভাবে চলতে হয়! ও থাকে এখানে? কোন অধিকারে এত কথা বলে ও? পেটে তো শুনেছি মেলা বিদ্যে আছে। তা এরপর থেকে তোমার বৌকে একটু বুঝেশুনে বুদ্ধি রেখে মুখ খুলতে ব'লো ভাই। কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, সেটা যেন মাথায় রাখে...
-বুঝেশুনে কথা বলার দায় তো আমার একার নয় বড়দিভাই। বোন যেমন কারও একার নয়, শ্বশুরবাড়িও কারও একার নয়। শ্বশুরবাড়ির ঘর করার সময় মানিয়ে গুছিয়ে বুঝে চলতে গেলে সবাইকেই চলতে হবে। নাগের বাড়ি আমার না হলে, তোমার হবে কী করে? যে সম্পর্কের জোরে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ, আমিও তাই আছি।
হাতের কাজ ফেলে নাগের বাড়ির গৃহকর্ম সহায়িকা চাঁপা কলতলা থেকে হাঁ করে চেয়ে রয়েছে বারান্দার দিকে। অঙ্কন চিৎকার করে উঠল,
-উত্তরা! বড়দার কাছে ক্ষমা চেয়ে এক্ষুণি ওপরে যাও। তুমি আর একটাও কথা বলবে না।
-কেন বলব না অঙ্কন? বড়দিভাইয়ের কথা মেনে চললে মা-ও এ বাড়িকে নিজের ব'লে দাবি করতে পারেন না। কারণ এটা তাঁরও শ্বশুরবাড়ি। ধমকে তুমি বৌকে চুপ করাতে পারবে। কিন্তু এদিকে মায়ের অধিকারকেও যে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, ছেলে হয়ে তার প্রতিবাদ করবে না? যতদূর মনে পড়ে বিয়ের পর তুমি আমাকে বরণ করে একটা কথা বলেছিলে বড়দিভাই। আজ থেকে এটাই তোর বাড়ি ছোট। আমিও হাসিমুখে তাই মেনে মানুষগুলোকে আপন করে নিয়েছিলাম। আমি আমার বাবা-মায়ের একটাই সন্তান। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর অনেকগুলো দিদি-দাদা পেলাম। নিজের বাড়িতে কাজিন দাদা কিংবা ভাইদের দেখে কখনো এক গলা ঘোমটা দিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে হয়নি। বড়দাভাই মেজদাভাইকে আমি নিজের দাদার মতোই সম্মান করতাম। যে মুখে তুমি বলেছিলে এটা আমার বাড়ি, সেই মুখেই এক মুহূর্তে আমাকে পর করে বুঝিয়ে দিলে এটা আমার শ্বশুরবাড়ি, আর তাঁরাও আমার দাদা নয়, ভাসুর ঠাকুর। এ আমি মনে রাখব।
কয়েক পা হেঁটে মৃগাঙ্কর সামনে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে উত্তরা বলল,
-আপনাকে বা বড়দিভাইকে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করার জন্য আমি কিছু বলিনি।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করিনি। তুমি নিজের ঘরে যাও ছোটবৌ।
-আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আমি আজ পরিবারের মানুষগুলোর সামনে নিজের মতামত রেখেছি। কারণ আমি নিজেকে এই পরিবারেরই একজন মনে করতাম। এগুলো তো বাইরের কাউকে বলতে যাব না। নিজের জনকেই বলব। এসব কথা বলে কোনও পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা আমি করিনি। এ নেহাৎই মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্যায়ন, বাক স্বাধীনতা আর নিজস্ব মত প্রকাশের সংগ্রাম ছিল, যেখানে আমি হেরে গেলাম। আপনারা রক্ষণশীল গোঁড়া পরিবারের মেকি আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য যে সমস্ত নিয়মকানুন নিজের কাঁধে আজ পর্যন্ত বয়ে চলেছেন, তা সমস্তই সঠিক। কেবল বেঠিক আমিই এই পরিবারের অনুপযুক্ত। আমাকে তো বটেই, একটা ভুল মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পারলে অঙ্কনকেও ক্ষমা করে দেবেন। কথার পৃষ্ঠে কথা বাড়ে। সেই কথা বলতে বলতে আমরা সবাই মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি। দাদা হয়ে বোনের ওপর অধিকার ফলাতে গিয়ে ভুলে যাওয়া হচ্ছে, সেই অধিকার সবার হাতে কে তুলে দিয়েছিল! আহ্লাদী আগে তার মায়ের মেয়ে, তারপর আপনাদের তিন ভাইয়ের বোন। সকলের মাথার ওপরে মা এখনো বেঁচে রয়েছেন। মাকে কি একবারও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, এই বিয়ের ব্যাপারে তাঁর মত কী? তিনি রাজি থাকলে আমি আর একটাও শব্দ খরচ করব না। কিন্তু তাঁর কথা না শুনে শুধু বাড়ির দোতলায় কেন, এ বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে যেতে বললেও বেরোব না। এমনকি যার হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছি, সে বললেও না.... বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। এসব নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না। মা...
অঙ্কনের গলা প্রায় বুজে এলো কান্নায়। ভয়ের গতিপথ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। এতক্ষণ মৃগাঙ্ককে ভয় লাগছিল। এবার নিজের ঘরের ভিতরে পা রাখতে হবে ভেবেই আতঙ্কে অঙ্কনের সর্বশরীর কাঁপছে। বন্ধ দরজার ভিতরে উত্তরা যে ঠিক কতরকমভাবে এর শোধ তুলে অতিষ্ট করে দেবে, তা ভেবেই অঙ্কনের মূর্ছা যেতে ইচ্ছে করল। প্রিয় নারীর মানভঞ্জনের জন্য আজ যে আবারও নিভৃত রাত্রি জাগরণ কালে নাকাল হতে হবে, সে বিষয়ে অঙ্কনের মনে কোনও দ্বিধা রইল না।
-মা, আহ্লাদী কোথায়?
-সে তো আজ পরিষ্কার হয়ে পুকুরঘাটে স্নানে গেছে। জামাকাপড় কেচে মাথা ঘষে ঘরে আসবে। তাকে দিয়ে কী দরকার বাছা?
-দরকারটা তার সঙ্গে নয়, আপনার সঙ্গে। ভালোই হয়েছে ও ঘরে নেই। আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে মা।
-কী হয়েছে? সকাল সকাল গেরস্ত ঘরে এত গোলমাল কিসের? তোমার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম ছোটবৌ। কার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি অমন গলা তুলে কথা বলছিলে?
-বড়দাভাই।
-সেকি! ছোটবৌ! বড় ভাসুরের সামনে তুমি...
-সামনে নয়, সঙ্গে। আমি বড়দাভাইয়ের সঙ্গেই কথা বলছিলাম। আপনি বলুন তো মা, এ বিয়েতে আপনার মত আছে? আহ্লাদীর জন্য আনা পাত্র আপনার পছন্দ হয়েছে তো?
বহু বছর আগের এক দৃশ্য ভেসে উঠল মাধবীলতার স্মৃতিপটে। তার ঠাকুমা ঘরের ভিতর থেকে কেঁদে বলেছিল, "নিজের মেয়ে তো নয়। তাই মেয়েটাকে এমন জলে জঙ্গলে ফেলে দিতে চাইছে। নিজের মেয়ে হলে পারত..."
বিছানার ওপর পরিষ্কার চাদর পেতেছে মাধবীলতা। ঘরের জানলায় ঝুলতে থাকা কাচা-ধোয়া পর্দার আড়াল পেরিয়ে সকালের নরম রোদ্দুর উঁকি দিচ্ছে। আজ থেকে আবার আহ্লাদীর সঙ্গে ঘুমোবে সে। মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকবে অপলক দৃষ্টিতে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মেয়ের বিয়ের জন্য দুর্ভাবনার কারণে তার রাতের ঘুম বিদায় নিয়েছিল। কিন্তু এখন পাকাপাকিভাবে বিয়ের কথা উঠতেই মাধবীলতার বুকের মধ্যে চেপে বসেছে শিরশিরে ভয়। মাধবীলতার বেশি বয়সের সন্তান আহ্লাদী। পড়ন্ত যৌবনের যত স্নেহ, সমস্তই ঐ একজনকে উজাড় করে দিয়েছিল সে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় অকালে মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে সেই অপার্থিব অনুভূতি পুরোপুরি উপভোগ করেছিল সে। কোনোপ্রকার জড়তা অবাঞ্চিত মাতৃত্বের মাঝে বাধা হতে পারেনি। খুদে প্রাণটাকে কোলে নিয়ে মাধবীলতা ভুলে ছিল লোকলজ্জা, সংসারের যত গঞ্জনা...
আহ্লাদীর বিয়ের পর ঐ চিলেকোঠার ঘরের আর প্রয়োজন পড়বে না। কোথাও কোনও মাসিক অসুবিধা থাকবে না। থাকবে না কোনও দৈনিক দুশ্চিন্তা। থাকবে কেবল একরাশ শূন্যতা। ঘর অন্ধকার করে মাতৃজঠরের পিদিম নিভিয়ে, সর্বকনিষ্ঠা সন্তানও নাড়ি ছিঁড়ে ঘরের উঠোনের ওপর দিয়ে আলতা রাঙা পায়ে হেঁটে চিরতরে পর হয়ে যাবে। শয্যাপ্রান্তে বসে ছলছল করে উঠল মাধবীলতার দু'চোখ। কেঁপে উঠল ঠোঁট। মাধবীলতার হাতের ওপর হাত রেখে উত্তরা জিজ্ঞাসা করল,
-মা কাঁদবেন না। আমরা সবাই আছি। আপনি বলুন, আপনার মন কী চায়?
-আমার মেয়ের বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাছা, অথচ আমাকেই কেউ ডাকে-খোঁজে না। একবারও বলে না, যে মা আসুন। দেখুন.... মেয়ের বিয়েতে কী দিয়ে কী হবে! আমি এই বাড়ির জঞ্জাল ছোট বৌ। ঘরের এককোণে পড়ে থাকি। সারাদিন একাই বকবক করি। কে আর শোনে বলো এই বুড়ির কথা! তিনবেলা পেটে ভাত পাচ্ছি, ব্যাটারা ভাত দিচ্ছে.... এই না অনেক! ঐ ছেলেকে আমি চিনি। বড় বৌয়ের কুটুমের মধ্যে সম্বন্ধ এনেছে। অনেক শুনেছি ওর গল্প। মেয়েমানুষের মতো আবভাব ব'লে গ্রামের যাত্রাপালায় মনসার গানে বেউলা সাজত ঐ ছেলে। পরে শুনি ঘরের মধ্যেও নাকি মায়ের বৌদিদিদের শাড়ি বেলাউজ পরে ঠোঁটে রঙ মেখে ঘুরে বেড়াত। নিজেকে ও বাড়ির ব্যাটা নয়, মেয়ে বলত। তারপরই তো ওকে ওর বাড়ির লোক একঘরে করেছে। অমন একটা মানুষকে ধরে এনেছে আমার মেয়ের জন্য। আমি আর কী বলব? মেয়ের হয়ে জোর করে যে চারটে কথা বলব, সে রাস্তা কি খোলা আছে? মুখপুড়ি মেয়ে তার ডাগর গতরের সঙ্গে চরিত্তিরও খেয়ে বসে আছে। কিছু বলতে গেলেই কথা শুনতে হয়। মন করে মা-মেয়ে দড়ি-কলসী নিয়ে মাঝপুকুরে ডুবে মরি! জুড়িয়ে যাক বুকের জ্বালা! আর পারি না ছোট বৌ! বাঁচাও মা, তুমি আহ্লাদীকে বাঁচাও.... আর কেউ পারবে না। পারলে একমাত্র তুমিই রুখে দাঁড়াতে পারবে। নিজের মেয়ে নয়, তাই আহ্লাদীকে ওরা ভাসিয়ে দিচ্ছে। পেটে ধরলে পারত অমন একটা ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে?
অনভ্যাসের শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে ঘেমে অস্থির হয়ে উঠেছিল উত্তরা। কপালের ওপর জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ফোঁটা স্বেদবিন্দুর স্পর্শে ঘেঁটে গিয়েছিল। মাধবীলতা তার কম্পমান হাত দুটো দিয়ে উত্তরার অবিন্যস্ত চুল ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,
-লক্ষ্মীমন্ত বৌ আমার! কিছু একটা করো মা। মেয়েটা আমার মরেই আছে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে আর কী লাভ! ওকে সংসারী করতে গিয়ে সবাই এমন একটা ব্যাটার ঘাড়ে ওকে চাপিয়ে দিচ্ছে, এবার বিয়ের পর ও মেয়ে কুলত্যাগী না হয়ে যায়! তখন এ কুলেও ওর ঠাঁই থাকবে না! কী হবে আমার মেয়েটার? যত লড়াই করতে হয় করো মা, শুধু আমার মেয়েটাকে রক্ষে করো।
মৃদু হেসে মাথায় ঘোমটা টেনে মাধবীলতার ঘর ছেড়ে বেরোল উত্তরা।
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত