রাখালডিহির রেললাইনে
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
।। ১।।
শহুরে যানজট আর জনসমুদ্র পেরিয়ে দোতলা বাড়িটার সামনে পলাশের হাত ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল মল্লিকা। বাদলদা ততক্ষণে ওই ভদ্রমহিলাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বলেছে। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সন্ধিহান দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে মাসিমা হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন,
-দেখিস বাপু! আমি তোকে চিনি, তাই ঘর দিচ্ছি! পরে আবার উটকো ঝামেলা আমার ঘাড়ে এসে জুটবে না তো? মেয়ে তাহলে আমার ঘাড়ে আর মাথাটি আস্ত রাখবে না!
-কিছু হবে না মাসিমা। এ তো আমারই ভাই আর ভাইয়ের বউ। কোন ঝঞ্ঝাট নেই। ওদের এই শহরে আমিই ডেকে এনেছি, ছেলেটার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।
-মেয়েটা তো একদম কচি খুকি রে বাদল! তা এই কাঁচা বয়সে মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ে দিল?
শক্ত করে পলাশের শার্ট খামচে ধরে ওর পিছনে মুখ লুকোল মল্লিকা। ওর হাতে সদ্য পরা সস্তার শাঁখা-পলা আর নকল সোনালী চুড়ির রিনিরিনি শব্দ, সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর, কাঁধে একটা শতছিন্ন কাপড়ের ব্যাগে সামান্য মুড়কি আর বাতাসা। পলাশের ঘামে ভিজে যাওয়া শার্টটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে মল্লিকা নিজের একমাত্র আশ্রয় খুঁজে নিল। ইতস্তত করে বাদলদা বলল,
-আমাদের গ্রামের দিকে এইরকমই হয় মাসিমা! এই দেখো না, ছেলে ভালো বলে একটা চালচুলোহীন বেকার মানুষের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে দায় সেরেছে ওর বাপ-মা! বিয়ের পর সংসার চলবে কী করে, দুটো পেট কীভাবে ভরবে, তার ঠিক নেই। আমাকে পলাশ বলল, দাদা সদরে একটা কাজকম্মের ব্যবস্থা করে দিতে পারো? যদি অভয় দাও, তবে তোমার ভরসায় আসব। তখন আমিই বললাম, চলে আয়। কিছু একটা ঠিক জুটিয়ে দেব।
গুমোট গরম। কৃষ্ণপক্ষের জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে আকাশে আবার বজ্রগর্ভ মেঘের আনাগোনা। বারকয়েক মেঘের গর্জনমাত্র কপালে একরাশ বক্ররেখা অঙ্কন করে বর্ষীয়ান ভদ্রমহিলা বললেন,
-বলি বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন বউটাকে ঝড়ে-জলে ভেজাবে নাকি গো ছেলে? ওই তো হাড় জিরজিরে চেহারা বাছা। গতরে মাংস বলতে কিছু নাই। হাড় ক'খানাই সার! এরপর ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি বসে গেলে বউকে খাওয়াবে কী, আর বউয়ের চিকিৎসাই বা করাবে কী দিয়ে? এসো, ঘরে ঢোকো। এ বাদল, তুই ওদের ওপরে নিয়ে যা। ওই যে চাবি ঝুলছে। আমি হাঁটুর ব্যথায় আর সিঁড়ি ভাঙতে পারি না বাবা!
দুটো কাপড়ের ব্যাগ আর একটা পুঁটুলি নিয়ে বাদল তড়িঘড়ি বারান্দায় উঠে এসে হাঁক দিল,
-ওই! আয় আয়!
পলাশের পিঠের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে থাকা ভীতু মেয়েটাকে এক নজর দেখে ভদ্রমহিলা বললেন,
-বলি ঝাড়া হাত-পায়ে চলে এসেছ তো! বউ নিয়ে থাকার জন্য খাট-বিছানা আমি কিন্তু কিছু দিতে পারব না ছেলে! ওপরে একটাই ঘর, ছাদের কোণে আধখানা দেওয়াল তোলা আছে, ছাউনি দেওয়া, ওখানেই আপাতত রান্না সারতে হবে। পাশে বাথরুম। ছাদ পুরো ন্যাড়া। জলের লাইন একসাথে। দিনে মাত্র একবারই মোটর চালাব। জল বুঝে খরচ করবে। সাব মিটার আছে। আলো পাখার জন্য যেমন কারেন্ট পোড়াবে, তেমনই টাকা দেবে। চলবে তো? না চললে এই বেলা মানে মানে...
-আরে চলবে মানে? দৌড়বে মাসিমা! এই পলাশ, আয় আয়! ওপরে উঠে আয়!
-যাও বাছা! এ বাদল, একটু শোন এদিকে?
-বলো মাসিমা?
-আমি এখন একটু আরতির বাড়ি যাব। কাল ওদের কালীপুজো গেছে। আজও আমাকে যেতে বলেছে। রাতে ওখানেই খাওয়া দাওয়া! এদিকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসছে। এদের তো রান্নার কোন জোগাড় নেই। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাইরে খেতে যাবেই বা কী করে? তা তোর ভাই আর ভাইয়ের বউ আজ রাতে খাবে কী?
-ওরা দুটো মুড়ি বাতাসা চিবিয়ে...
-ও মা! ছেলের কথা শোনো! একরত্তি মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে একদম দড়ি হয়ে গেছে। সারাটা রাত আমার ঘরে দুটো ছোট মানুষ ওই মুড়ি বাতাসা চিবিয়ে থাকবে? আর আমি লোকের বাড়ি পেটপুরে নেমন্তন্ন খেতে যাব? আমার ভিটেতে এইসব অনাসৃষ্টি কাজকম্ম চলে না। ফ্রিজে দুপুরের ভাত-ডাল, ভোগের একটু খিচুড়ি আর আলুর দম আছে। আরতি দিয়েছিল। তোর নবাবপুত্তুর ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের মুখে রুচবে কিনা দেখ দেখি বাবা!
মাথা চুলকিয়ে একগাল হেসে বাদল বলে উঠল,
-রুচবে মানে? দৌড়বে মাসিমা! মায়ের ভোগ, সে তো অমৃত! ওদের কপালে মায়ের ভোগ খাওয়া লেখা থাকলে, তুমি-আমি আটকাতে পারব মনে করেছ! তুমি রান্নাঘরের ওই মেশিন চালিয়ে গরম করে দাও। আমি ওদের খেতে দিয়েই বেরোই তবে!
একদৌড়ে দুটো থালা নিয়ে ওপরে উঠে এলো বাদল। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি, আলুর দম, সাদা ভাত আর একবাটি ডাল। ঘরে ঢুকে বাদল দেখল মল্লিকা কোমরে কাপড় গুঁজে দ্রুতহাতে একটা কাপড় বিছিয়ে দিয়েছে মেঝের ওপর। গোটা ঘরে একটা আসবাবের চিহ্নমাত্র নেই। থালা দুটো নিয়ে দরজার সামনে বাদলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের কাপড়ের আঁচলটা কোমর থেকে খুলে তাড়াতাড়ি গায়ে টেনে নিল মল্লিকা। তখনই বাথরুম থেকে পলাশ বেরিয়ে এলো। বাদল গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
-এখানে এসব চলে না। আমি পলাশের দাদা, তোমারও দাদাভাই। আমাকে দেখে এক গলা ঘোমটার আড়ালে লুকোতে হবে না। খেতে বসো। সারাদিন তো এক দানা ভাতও পেটে পড়েনি।
-আপনিও বসুন! আমাদের সঙ্গে খাবেন।
-না। এতটুকু খাবার, তোমরাই খাও। এটা কালীপুজোর ভোগ।
-মায়ের ভোগ ভাগ করে খেতে হয় দাদাভাই। একজন পেটপুরে খেলে, আর একজন চেয়ে দেখলে, ঠাকুর পাপ দেয়।
-মলি তো ঠিকই বলেছে বাদলদা। আর ও যখন একবার মুখ থেকে বলেছে, তোমাকে না খাইয়ে ছাড়বে ভেবেছ? বসো বসো। দাদা একটু খেলে ভাইয়ের কম পড়বে না!
খিদে যে শরীরকে এতখানি কাতর করে দেয়, পলাশ প্রায় ভুলতে বসেছিল। তার অভাব থাকলেও, খিদের জ্বালা বহুকাল বোঝেনি সে। দিনরাত গাধার মতো খাটে পলাশ। একটা পেট ভরার মতো অন্নের সংস্থান করা, ওর কাছে কোন বড় ব্যাপারই না। গ্রামে থাকতে ভাতের হোটেলে একবেলা কাজ করত সে। হাত চালাতে চালাতে চুরি করে মুখে পুরে দিত কত কিছুই। আর একবেলা রেললাইনের ধারে একটা গ্যারেজে কাজ করত। গ্যারেজের পাশেই ছাউনি ঢাকা বড় একটা পরিসরে সারাদিন যাবৎ নিত্যযাত্রীদের সাইকেল আর বাইক জমা পড়ত। সেইসবের হিসেব রাখা আর গ্যারেজে কাজের মাঝে জুটে যেত পাউরুটি চা, কিংবা চা বিস্কুট। মেজাজ খুব ভালো থাকলে গ্যারেজের মালিক কোনদিন হয়তো নিরামিষ ভাত খাওয়ার টাকা দিতেন, নিদেনপক্ষে কচুরি সাদা আলুর তরকারি আর আমের আচার। অপূর্ব সে স্বাদ! গতকাল বিকেল থেকে পলাশের পেটে বারকয়েক চা বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। ভাতের পাতে বসে ক্ষুধার্ত পলাশকে সশব্দে খেতে দেখে মল্লিকার চোখ ভিজে গেল। খিদে সহ্য করার ওর ঢের অভ্যাস আছে। খিদে নেই বলে নিজের ভাগের ভাতটুকু পলাশের দিকে এগিয়ে দিতেই ওর খেয়াল হল, এখন পলাশের ওপর আরও একজন মানুষের দায়িত্ব আছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল পলাশ। খানিক জোরাজুরির পর ধমকে উঠল সে,
-তুমি না খেলে আমিও খাব না মলি!
মল্লিকার কথার মান রাখতে একবার মাত্র একটু ভোগের খিচুড়ি মুখে দিয়ে উঠে পড়ল বাদল। বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। যখন বাথরুম থেকে ফিরল, তখন দেখল পলাশ নিজের হাতে তার মল্লিকাকে খাইয়ে দিচ্ছে।
ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল বাদল। ইতস্তত করে বলল,
-একটা মাদুরও নেই। মাসিমার থেকে চেয়ে আনব পলাশ?
-না দাদা। মাসিমা এমনিতেই আমাদের জন্য এত করলেন, তাকে আর বিরক্ত কোরো না।
-এই ঠান্ডা মেঝেতে শুবি তোরা?
-আমার অভ্যাস আছে!
মৃদুস্বরে বলল মল্লিকা। প্রত্যুত্তরে বাদল বলল,
-আজকের দিনটা একটু কষ্ট করে নে ভাই। কালই একটা দড়ির খাটিয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। দুটো বালিশ, চাদর, মশারি, একটা জনতা, কেরোসিন, আর গুটিকয়েক বাসনপত্তর হলেই আপাতত কাজ চালিয়ে নিতে পারবি না?
খাবারটা পুরো খেতে পারল না পলাশ। ও বসে থাকলে মলি কিছুতেই খাবে না। পেট ভরে গেছে বলে উঠে পড়ল ও। বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে বেরিয়ে পকেট হাতড়ে হাজার পাঁচেক টাকা বের করে চার হাজার টাকা বাদলের হাতে ধরিয়ে বলল,
-দুই মালিকের কাছে যা জমা ছিল, আসার আগে সব তুলে নিয়ে এসেছি। সাইকেলটাও বিক্রি করে দিয়েছি। এমনিতেই দুটো মাস বাড়িভাড়াটা তুমি দেবে বললে। তার ওপর এতকিছু কেনাকাটা.... এটা তুমি রাখো দাদা। জানি এতে কিছুই হয় না! কিন্তু এর বেশি আমি আর কোথায় পাব?
-তোকে পাকামি করতে বলেছি আমি?
-না তুমি এটা রাখো।
শূন্য থালাদুটো নিয়ে মাথা নামিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল মল্লিকা। বাদল পলাশের হাত চেপে ধরে গলা নামিয়ে বলল,
-এতদিন একা মানুষ ফাঁকা পকেটে ঘুরেছিস, বেশ করেছিস। কিন্তু এখন বিয়ে করেছিস পলাশ, বউ সঙ্গে রয়েছে। এখন টাকা পয়সা লাগে। মেয়েমানুষের শরীর-স্বাস্থ্য! বিয়ে করেছিস, বুঝবি! কখন কী প্রয়োজন হয়, অচেনা শহর! আমি গাড়ি নিয়ে কোথায় বেরিয়ে যাব, কখন কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। এতবড় শহর! অচেনা অজানা জায়গা, মানুষজন! কোথায় কার কাছে হাত পাততে যাবি? তুই এখন নিজের কাছে টাকা রাখ। আগে তোর একটা কাজ জুটিয়ে দিই, তারপর এই টাকা সুদে আসলে তোর পকেট কেটে বের করে নিয়ে যাব।
হেসে উঠল পলাশ। ওই টাকা আবার পলাশের প্যান্টের পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বাদল বলল,
-রাত হয়েছে। সারাদিন যা ধকল গেছে। নে নে, তোরা শুয়ে পড়। আমি চলি! একটু দাঁড়া! আমি আসছি। আসল জিনিসটাই তো গাড়িতে রয়ে গেছে।
একদৌড়ে রাস্তায় নেমে আবার দোতলায় উঠে এলো বাদল। ওর হাতে একটা কালো পলিথিনের প্যাকেট।
-কী আছে এতে?
-তখন মন্দিরের বাইরে কিনেছিলাম। তোদের মালা বদলের মালাদুটো। আজ তোদের প্রথম রাত। বিশেষ কিছু করতে পারলাম না ভাই। এই রজনীগন্ধার মালাদুটো রাখ। এগুলো কোন কাজে লাগবে তোরা জানিস!
পলাশ লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। পিছু ফিরে দেখল, মল্লিকা বাথরুমের দিকে সেই যে গেল, আর ফিরল না। বাদল বলল,
-ভাই শোন, মাসিমার কাছে এই বিয়ের ব্যাপারটা একদম চেপে যেতে হবে। মনে থাকবে তো? আমি যেটা বলেছি, তোরাও সেটাই বলবি।
-হু!
-মাসিমার মনটা খুব ভালো পলাশ। কিন্তু মুখ ভালো না। কিছু বললে একটু মানিয়ে নিস। কোন কথার উত্তর করবি না। চুপ করে শুনে নিবি। যে স্নেহ করে, সে তো একটু শাসনও করতে পারে বল! মাথা গরম করিস না ভাই!
-সে আর বলতে! মাথার ওপর ছাদ আর পায়ের তলার মাটি দিয়েছে মাসিমা, পেটে ভাত দিয়েছে, নইলে মলিকে নিয়ে আজ সারাটা রাত রাস্তায় কাটাতে হতো। তার জন্য মাসিমা বেগার খাটতে বললেও আমি খেটে দেব। দু'কথা বললেও শুনে নেব। তুমি এই মাসিমার মেয়ের গাড়ি চালাও দাদা?
-হ্যাঁ রে, পিহু দিদি মস্ত বড় কলেজে পড়ায়। কতবড় বিল্ডিং! কত ছাত্রছাত্রী। বাড়িতেও ছাত্র পড়তে আসে। দিদি অনেক পড়ালেখা জানে। খুব রাগী। মাসিমাও দিদিকে খুব ভয় পায়। দিদির বর চোখের ডাক্তার। খুব নামডাক। বাড়ির একতলায় চেম্বার আছে। আবার বাইরেও পেশেন্ট দেখতে যায়। কত লোক আসে। আমিই তো গাড়ি করে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যাই।
-মাসিমা কী এখানে একাই থাকেন?
-হ্যাঁ, মেসোমশাই মারা গেছেন নাকি বহুকাল আগে। তখন পিহু দিদি খুব ছোট। মাসিমা একাই দিদিকে মানুষ করেছে। পিহু দিদি বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর তো একাই থাকে। ওপরটা সবসময় ভাড়া দেওয়া থাকত। তোর কপাল ভালো, আগের ভাড়াটেকে তুলতে বিশাল ঝামেলা হওয়ায় দিদি আর ভাড়া বসাতে দেয়নি। আমিই বলে কয়ে তোর থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। আমি এই দুই বাড়ির ঘরের ছেলে বলতে পারিস। সারাদিন দুই বাড়ি করতে করতেই সময় কেটে যায়। বাজারে যাই, মাসিমাকে নিয়ে মন্দিরে যাই। আর সারাদিন ভাড়ায় খাটি। এই তুই যা, আমি বকতে শুরু করলে তোকে সারারাত এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখব। ওদিকে মল্লিকা অপেক্ষা করছে, আমি পালাই! সংসারটা একটু গুছিয়ে নে। তারপর তোদের একদিন আমার ঘরেও নিয়ে যাব। তোর বৌদি বলেছে।
-অবশ্যই যাব দাদা। এই শহরে তুমি আর বৌদি ছাড়া আমাদের আর আছে'টা কে!
বাদলদা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই বৃষ্টি শুরু হল। আসবাবহীন ঘরে সংসারিক সামগ্রী বলতে শীতল মেঝেতে একটা কাপড় পেতে রেখেছে মল্লিকা। বাথরুমের দরজায় টোকা দিতেই মলি বেরিয়ে এলো বাইরে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল পলাশের বুকে। পলাশ ওর হাতে পলিথিনের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-আজ আমাদের ফুলশয্যা!
লজ্জায় পলাশের বুকের মধ্যে মিশে যেতে চাইল মল্লিকা। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো তখন কাঁচের জানালায় রকমারি অবয়ব সৃষ্টিতে ব্যস্ত। অদূরে আলোর ঝাপসা জলছবি। পলাশ আর মল্লিকার গলায় দুটো রজনীগন্ধার মালা, সেই সৌরভে পরস্পর আবিষ্ট হয়ে রয়েছে। পলাশের বুকের ওপর মাথা রেখে বাইরের আবছা আলোর দিকে চেয়ে মল্লিকা বলল,
-ওই উল্টোদিকের বাড়িতে এত আলো কেন গো?
-মাসিমা বললেন যে কালীপুজো। ওই বাড়িতেই মনে হয়।
-ওহ!
-মন খারাপ মলি? ঘরের জন্য মন কেমন করছে?
-না! ঘরে আমার জন্য কে কাঁদবে? শুধু আমার মেনিটা মনে হয় না খেতে পেয়ে মরে যাবে জানো! মা দিনরাত ওর গায়ে জল ছুঁড়ে মারে। ভাত পুকুরে ফেলে দেয়, তবুও ওকে এক দানা ভাত দেয় না!
-ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতে!
-নিজেদেরই থাকা খাওয়ার ঠিক নেই, ওকে এনে কোথায় রাখতাম?
চুপ করে গেল পলাশ। নিজের অক্ষমতা যেন বড় বেশি করে ওর বুকে বাজল। মল্লিকার প্রিয় পোষ্যর জন্য দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন সংস্থানের ক্ষমতাও কী ওর নেই! কাছে থাকলে তবুও ওদের এঁটো-কাঁটা খেয়েই না হয় বাঁচত! মলি ওকে নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারত। কিন্তু যেখানে নিজেদেরই কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, একটা অবলা জীবকে সঙ্গে নিয়ে কতক্ষণ আর ঘোরা যায়! আবার যদি বিড়াল সঙ্গে থাকলে ঘর না পাওয়া যায়, তখন? পলাশ মৃদুস্বরে বলল,
-প্রথম রাত ঘিরে মেয়েদের অনেক স্বপ্ন থাকে, তাই না? পেট ভরে দুটো ভাত, অন্তত একটা বিছানা, কিছুই পারলাম না.... আমার তো কিছুই নেই মলি। তোমাকে কিছুই দেওয়া হল না।
-কে বলেছে কিছু দাওনি? এই যে!
পলাশের হাতটা নিজের তলপেটের ওপর রাখল মল্লিকা। নতুন প্রাণের আগমনবার্তায় আনন্দিত ওই দম্পতি পরস্পরকে দীর্ঘক্ষণ আলিঙ্গন করে রইল। আবেগতাড়িত কণ্ঠে মল্লিকা বলল,
-কত সুন্দর ছাদ আঁটা বাড়ি, বাড়িটায় কত বড় বড় জানলা, কলঘরে তো কল খুললেই ঝরঝর করে জল পড়ে। পুকুর থেকে বালতি করে জল টেনে শ্যাওলা ধরা পিছল উঠোন পেরিয়ে চানঘরে যেতে হবে না বলো?
-না। কল খুললেই জল। বোতাম টিপলেই আলো জ্বলবে, পাখাও চলবে। আমার গ্যারেজের মতো, হোটেলের মতো।
-তবে তো ওকে পেটে নিয়ে আমায় পুকুর ঘাটে যেতে হবে না। রাস্তার কল থেকে জল বইতেও হবে না। হ্যাঁ গো, মাসিমা আবার উঠিয়ে দেবে না তো? ওকে আমার কোলে আসার সময়টুকু দেবে তো? পরের বাড়ি! যদি হঠাৎ চলে যেতে বলে, কোথায় যাব আমরা?
-ঘর ছাড়ার আগে এসব ভাবতে ইচ্ছে করেনি?
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল মল্লিকা। ওর সর্বাঙ্গে রজনীগন্ধার সুবাস। পলাশের গলায়ও একটা রজনীগন্ধার মালা। অন্যমনস্কভাবে ওই মালা থেকে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে পলাশের মুখের ওপর ছুঁড়ে মল্লিকা বলল,
-না ভাবিনি। আমি জানি, তুমি ঠিক কিছু একটা করে নেবে। তাই ওর কথা ভেবে, তোমার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছি। তোমাকে বিশ্বাস করেছি আমি। ভুল করিনি তো?
শ্যামাঙ্গিনী মল্লিকার শুষ্ক ঠোঁটে আদর এঁকে দিল পলাশ। ওর রুগ্ন শরীরটাকে নিজের বুকে চেপে ধরল। নারীসুলভ কোমলতা স্পর্শ করেনি মল্লিকার দেহ। হৃদয়ের স্থানে কেবল যেন পাঁজরের হাড় ক'খানাই সার। ওই শরীরটাকেই আপন দেহের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে উন্মুখ পলাশ। নবদম্পতির শরীরী উষ্ণতায় পিষ্ট হতে লাগল কোমল রজনীগন্ধা। মল্লিকার সুবৃহৎ খোঁপা ভেঙে পড়েছে বহু আগেই। ওর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে পলাশ বলে উঠল,
-কী মনে হয়?
-জানি না যাও!
রজনীগন্ধার মালার প্রাচীর মুহূর্তেই অদৃশ্য হল। পলাশ দুটো মালা ছিঁড়ে সরিয়ে রাখল মেঝেতে। অজস্র রজনীগন্ধার দ্বারা সজ্জিত শীতল শয্যার মাঝে পলাশের কণ্ঠলগ্না হয়ে নবরূপে প্রস্ফুটিত হল মল্লিকা। সলজ্জে বলে উঠল,
-এত সুন্দর ঘর, এত আরাম, এমন সুখ, আমার মধ্যে বেড়ে ওঠা আমাদের ছোট্ট ছেলে.... সব দিয়েছ তুমি আমায়। তবে কেন বললে, কিছু দিতে পারোনি!
মৃদু হেসে পলাশ মল্লিকার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বলল,
-মেয়ে!
বাড়িটা স্বর্গীয় দেবপ্রসাদ সান্যালের। প্রাচীন বাড়ির একাংশ প্রায় ভগ্নস্তূপ। শহরের মধ্যে থেকেও যেন শহরবর্জিত এই বাড়ি। আশেপাশের হাল ফ্যাশনের কারুকার্যময় রংবেরংয়ের সুউচ্চ বাড়ির পাশে এই ইঁট বেরিয়ে পড়া পলেস্তরা খসে যাওয়া পুরনো বাড়িটা বড় বেমানান। বিঘেখানেক জমির এককোণে ঐতিহ্যবাহী কঙ্কালের মতো কড়িবরগাসহ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বসতবাড়িখানা। একাধিক শরিক থাকা সত্ত্বেও বাড়ির একাংশ আগলে একা পড়ে রয়েছেন মৃণালিনী দেবী। অন্য অংশে কাঠের দরজায় মরচে পড়া তালা ঝুলছে। বাড়ির চতুর্দিকে আম, কাঁঠাল, নারকেল ও একাধিক সুপারি গাছের কারণে জায়গাটা দিনের বেলাও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। অদূরে একটা বুজে আসা ডোবা। প্রতিবেশীর ছুঁড়ে ফেলা আবর্জনা হতে নির্গত দুর্গন্ধ আর মশার অত্যাচার হতে অব্যাহতি পেতে, দিনের বেশিরভাগ সময়ই ঘরের পিছন দিকের জানালাটা বন্ধ রাখেন মৃণালিনী দেবী। নিজের দুই দেওর প্রবাসী। ওই জায়গা তাদের। সুতরাং বাড়ির পিছন দিকে মৃণালিনী দেবীর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শরিকি মতানৈক্যের কারণে এককালে ভাইদের মনের ভিতর ও জমির ওপর দেওয়াল তোলা হলেও, এখন সেই দেওয়াল ডোবার গ্রাসে অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে। একমাত্র মেয়ে পিহুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যক্ষের মতো এই বাড়ি আগলে একা পড়ে রয়েছেন মৃণালিনী দেবী। পিহু সুপারি গাছগুলো লিজে দিয়েছে। ওরা নিজেদের সময়মতো আসে, সুপারি পেড়ে নিয়ে যায়। বারান্দায় বঁটি নিয়ে বসে নারকেল পাতার কাঠি বের করতে করতেই মৃণালিনী দেবীর ক্লান্ত দুপুরগুলো নিঃসঙ্গভাবে কাটে। বিকেলের খানিকটা সময় ধনেপাতার চারা আর লংকাগাছগুলোর জন্য ব্যয় হয়। নিজের হাতে টমেটো গাছগুলোর পরিচর্যা করেন মৃণালিনী দেবী। এবার লেবু গাছটায় অজস্র লেবু ধরেছে। খেয়ে, ঝরে, পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লেবুপাতার গন্ধ মৃণালিনী দেবীর বড্ড প্রিয়। গাছের ফলমূল বিক্রি করে, প্রতিবেশীদের দান করে মনের আনন্দেই তিনি আছেন। তাঁর এই বার্ধক্যবেলার সঙ্গী বলতে উল্টোদিকের বাড়ির আরতি ও তার এক বছরের দুরন্ত এক শিশু, নাম তার গোগোল। আরতির শ্বশুর শাশুড়ি গত হয়েছেন বহুদিন। বাড়ির ছেলেটা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর, আরতি ওই একরত্তি ছেলের দস্যিপনা একা হাতে সামলাতে অস্থির হয়ে যেত। ছেলেটার কান্না যেন মৃণালিনী দেবীর হৃদপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। এ নারীজীবনে মাতৃত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু একটা কুসুমকোমল প্রাণকে বুকে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। অবিলম্বে আরতির সঙ্গে এই বৃদ্ধার ভাব হয় এবং গোগোলের ক্ষুদ্র বৃহৎ যাবতীয় দায়িত্ব মৃণালিনী দেবীর ওপর ছেড়ে একটু নিশ্চিন্ত হয় আরতি। এছাড়াও মৃণালিনী দেবীর অবসর যাপনের আরো একজন সঙ্গী আছে, তার নাম আলো। দুই বেলা ঘড়ির কাঁটা ধরে নিয়ম করে আসে সে। সকালের ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে রান্না করা এবং বিকেলে গোপালের বাসনপত্র তেঁতুল ঘষে ঝকঝকে করে মেজে দেওয়া থেকে শুরু করে, রাতের রুটি করার পর মৃণালিনী দেবীর চুল আঁচড়ে বেঁধে দিয়ে তবে তার ছুটি! পেশায় কেরানি দেবপ্রসাদ সান্যাল বাড়ির ওপর তলায় একটামাত্র ঘর করতে পেরেছিলেন। তারপরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বড় অকালে স্বর্গবাসী হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর পিহুর উচ্চশিক্ষার কারণে বাড়িঘরের কথা আর ভাবেননি মৃণালিনী। একরত্তি মেয়েটাকে বুকে আগলে রেখেছেন। পরবর্তীকালে পিহু এই ধ্বংসস্তুপে অর্থ জলাঞ্জলি দিতে রাজি হয়নি। মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজের কাছে। পিহু নিজে দেখেশুনে পছন্দ করলেও, মৃণালিনীর জামাই একেবারে হিরের টুকরো। সে একাধিকবার শাশুড়ি মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বামীর ভিটে পরিত্যাগ করতে মৃণালিনী দেবী অসম্মত হওয়ায়, পিহু অপেক্ষা করছে দুই কাকার দেশে প্রত্যাবর্তনের শুভ মুহূর্তের জন্য। আগামী বছর সকলের উপস্থিতিতে এই সম্পত্তির একটা গতি করা হবে। প্রোমোটারের হাতে এই আবর্জনা তুলে দিয়ে মাকে সুদৃশ্য ফ্ল্যাটের আরামে না রাখা পর্যন্ত পিহুর মনে স্বস্তি নেই। অপেক্ষা আর মাত্র একটা বছরের।
আরতির বাড়ি থেকে ফিরতে সেদিন বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকা দম্পতির ওপর ভরসা করতে পারেননি তিনি। গোগোলকে নিজের হাতে খাইয়ে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছেন। ঝিরঝির করে অবিরাম বৃষ্টি হয়েই চলেছে। বেশ একটা শীতল অনুভূতি যেন ঘিরে ধরছিল মৃণালিনীকে। বারান্দায় উঠে ওপর দিকে একবার চেয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী। নতুন ভাড়াটের ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দার আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলেন তিনি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় পলাশের। মল্লিকা গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে পলাশের বুকের ভিতরে। ওর গায়ে হাত দিয়ে পলাশ দেখল, একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে মল্লিকার শরীর। গায়ের ওপর ঢাকা দেওয়ার মতো একটা চাদরও ওদের কাছে নেই। মল্লিকাকে নিজের বুকের ওপর থেকে নামিয়ে উঠে পড়ল পলাশ। আলো জ্বেলে তাড়াতাড়ি পাখাটা বন্ধ করে দিল। একটু বৃষ্টি হতেই গুমোট গরমটা একদম কমে গেছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মল্লিকা। ওর অবিন্যস্ত পোশাকের মধ্যে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে রজনীগন্ধার পাপড়ি। মল্লিকার খোলা চুলের মধ্যে থেকে কয়েকটা পাপড়ি তুলে আনলো পলাশ। দীর্ঘক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে। জীবনের সব শান্তি এই মুখটাতেই লুকিয়ে আছে। আঁচল সরিয়ে মল্লিকার উন্মুক্ত নাভিতে নিজের অনাগত সন্তানের জন্য খানিকটা আদর এঁকে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল পলাশ।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি! মল্লিকা জেগে রয়েছে না ঘুমিয়ে পড়েছে, ও বুঝতেই পারল না। কেবল একটা আর্ত গোঙানি ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। চোখের সামনে ঠাকুরথান ভেসে উঠল। দোলপূর্ণিমার পুজো, প্রসাদ বিতরণ.... একমুঠো প্রসাদ নিজের শতছিন্ন কাপড়ের আঁচলে গিঁট পাকিয়ে মল্লিকা ছুটেছিল স্টিমার ঘাটে। প্রেমের লাল আবির দিয়ে সেইদিন মল্লিকার সর্বদেহ রাঙিয়ে দিয়েছিল পলাশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসার পরেও পলাশ বাড়ি ফিরতে দেয়নি ওকে। যখন ঘরের চৌকাঠে পা রেখেছিল, তখন নিজের গর্ভে পলাশেরই ক্ষুদ্র অংশ ধারণ করে ফিরেছিল ও। কিন্তু গত কয়েক মাসে মল্লিকার বিয়ের তাগিদে মায়ের অত্যাচারের পরিমাণ তখন এতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, পলাশের সন্তানের কথা মল্লিকা নিজমুখে বাবাকে জানাতেই পারেনি। সকলের অলক্ষ্যে পলাশের হাত ধরে আঁধার রাতে ঘর ছেড়েছিল সে। নতুন সংসার বাঁধার আশায় পালিয়ে আসতে চেয়েছিল শহরে। পলাশের হাত ধরে রেললাইন বরাবর ছুটছে মল্লিকা। কাঁধে একটা ব্যাগ। তাতে রয়েছে মুড়কি আর বাতাসা। ছুটতে ছুটতে মল্লিকা ক্লান্ত। কিন্তু এই রেললাইনের শেষ কোথায়? হঠাৎ ও দেখল আশেপাশে পলাশ নেই। কেউ নেই। ও একা রেললাইন ধরে বিরামহীনভাবে ছুটেই চলেছে। কান মাথা কেঁপে উঠল রেলগাড়ির আগমনবার্তায়। ব্যাগ রইল লাইনের ওপর পড়ে। মুড়কি বাতাসা ছড়িয়ে পড়ল ধুলোর ওপর। জোরালো এক আলোকরশ্মি! সেই সঙ্গে বুক কাঁপানো তীব্র বাঁশির শব্দ! মল্লিকার মুখ থেকে গ্যাজলা বেরিয়ে এলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে কেবল অস্ফুটে গোঙানি নির্গত হল ওর কন্ঠনালী হতে। হাত পা অসাড়! ছুটতে ছুটতে মুখ ঘুরিয়ে মল্লিকা দেখল, রেলগাড়িটা ওর একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। জোরালো আলোর প্রভাবে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রাণভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল মল্লিকা। ওকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিল পলাশ,
-এই মলি! মলি! এইরকম করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?
আরতির ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা গোগোল হঠাৎই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে তিন মিনিট...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
শহুরে যানজট আর জনসমুদ্র পেরিয়ে দোতলা বাড়িটার সামনে পলাশের হাত ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল মল্লিকা। বাদলদা ততক্ষণে ওই ভদ্রমহিলাকে কিছু একটা বুঝিয়ে বলেছে। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে সন্ধিহান দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে মাসিমা হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন,
-দেখিস বাপু! আমি তোকে চিনি, তাই ঘর দিচ্ছি! পরে আবার উটকো ঝামেলা আমার ঘাড়ে এসে জুটবে না তো? মেয়ে তাহলে আমার ঘাড়ে আর মাথাটি আস্ত রাখবে না!
-কিছু হবে না মাসিমা। এ তো আমারই ভাই আর ভাইয়ের বউ। কোন ঝঞ্ঝাট নেই। ওদের এই শহরে আমিই ডেকে এনেছি, ছেলেটার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।
-মেয়েটা তো একদম কচি খুকি রে বাদল! তা এই কাঁচা বয়সে মেয়ের বাড়ি থেকে বিয়ে দিল?
শক্ত করে পলাশের শার্ট খামচে ধরে ওর পিছনে মুখ লুকোল মল্লিকা। ওর হাতে সদ্য পরা সস্তার শাঁখা-পলা আর নকল সোনালী চুড়ির রিনিরিনি শব্দ, সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর, কাঁধে একটা শতছিন্ন কাপড়ের ব্যাগে সামান্য মুড়কি আর বাতাসা। পলাশের ঘামে ভিজে যাওয়া শার্টটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে মল্লিকা নিজের একমাত্র আশ্রয় খুঁজে নিল। ইতস্তত করে বাদলদা বলল,
-আমাদের গ্রামের দিকে এইরকমই হয় মাসিমা! এই দেখো না, ছেলে ভালো বলে একটা চালচুলোহীন বেকার মানুষের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিয়ে দায় সেরেছে ওর বাপ-মা! বিয়ের পর সংসার চলবে কী করে, দুটো পেট কীভাবে ভরবে, তার ঠিক নেই। আমাকে পলাশ বলল, দাদা সদরে একটা কাজকম্মের ব্যবস্থা করে দিতে পারো? যদি অভয় দাও, তবে তোমার ভরসায় আসব। তখন আমিই বললাম, চলে আয়। কিছু একটা ঠিক জুটিয়ে দেব।
গুমোট গরম। কৃষ্ণপক্ষের জমাট বাঁধা অন্ধকারের মধ্যে আকাশে আবার বজ্রগর্ভ মেঘের আনাগোনা। বারকয়েক মেঘের গর্জনমাত্র কপালে একরাশ বক্ররেখা অঙ্কন করে বর্ষীয়ান ভদ্রমহিলা বললেন,
-বলি বাইরে দাঁড়িয়ে নতুন বউটাকে ঝড়ে-জলে ভেজাবে নাকি গো ছেলে? ওই তো হাড় জিরজিরে চেহারা বাছা। গতরে মাংস বলতে কিছু নাই। হাড় ক'খানাই সার! এরপর ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি বসে গেলে বউকে খাওয়াবে কী, আর বউয়ের চিকিৎসাই বা করাবে কী দিয়ে? এসো, ঘরে ঢোকো। এ বাদল, তুই ওদের ওপরে নিয়ে যা। ওই যে চাবি ঝুলছে। আমি হাঁটুর ব্যথায় আর সিঁড়ি ভাঙতে পারি না বাবা!
দুটো কাপড়ের ব্যাগ আর একটা পুঁটুলি নিয়ে বাদল তড়িঘড়ি বারান্দায় উঠে এসে হাঁক দিল,
-ওই! আয় আয়!
পলাশের পিঠের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে থাকা ভীতু মেয়েটাকে এক নজর দেখে ভদ্রমহিলা বললেন,
-বলি ঝাড়া হাত-পায়ে চলে এসেছ তো! বউ নিয়ে থাকার জন্য খাট-বিছানা আমি কিন্তু কিছু দিতে পারব না ছেলে! ওপরে একটাই ঘর, ছাদের কোণে আধখানা দেওয়াল তোলা আছে, ছাউনি দেওয়া, ওখানেই আপাতত রান্না সারতে হবে। পাশে বাথরুম। ছাদ পুরো ন্যাড়া। জলের লাইন একসাথে। দিনে মাত্র একবারই মোটর চালাব। জল বুঝে খরচ করবে। সাব মিটার আছে। আলো পাখার জন্য যেমন কারেন্ট পোড়াবে, তেমনই টাকা দেবে। চলবে তো? না চললে এই বেলা মানে মানে...
-আরে চলবে মানে? দৌড়বে মাসিমা! এই পলাশ, আয় আয়! ওপরে উঠে আয়!
-যাও বাছা! এ বাদল, একটু শোন এদিকে?
-বলো মাসিমা?
-আমি এখন একটু আরতির বাড়ি যাব। কাল ওদের কালীপুজো গেছে। আজও আমাকে যেতে বলেছে। রাতে ওখানেই খাওয়া দাওয়া! এদিকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসছে। এদের তো রান্নার কোন জোগাড় নেই। ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাইরে খেতে যাবেই বা কী করে? তা তোর ভাই আর ভাইয়ের বউ আজ রাতে খাবে কী?
-ওরা দুটো মুড়ি বাতাসা চিবিয়ে...
-ও মা! ছেলের কথা শোনো! একরত্তি মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে একদম দড়ি হয়ে গেছে। সারাটা রাত আমার ঘরে দুটো ছোট মানুষ ওই মুড়ি বাতাসা চিবিয়ে থাকবে? আর আমি লোকের বাড়ি পেটপুরে নেমন্তন্ন খেতে যাব? আমার ভিটেতে এইসব অনাসৃষ্টি কাজকম্ম চলে না। ফ্রিজে দুপুরের ভাত-ডাল, ভোগের একটু খিচুড়ি আর আলুর দম আছে। আরতি দিয়েছিল। তোর নবাবপুত্তুর ভাই আর ভাইয়ের বউয়ের মুখে রুচবে কিনা দেখ দেখি বাবা!
মাথা চুলকিয়ে একগাল হেসে বাদল বলে উঠল,
-রুচবে মানে? দৌড়বে মাসিমা! মায়ের ভোগ, সে তো অমৃত! ওদের কপালে মায়ের ভোগ খাওয়া লেখা থাকলে, তুমি-আমি আটকাতে পারব মনে করেছ! তুমি রান্নাঘরের ওই মেশিন চালিয়ে গরম করে দাও। আমি ওদের খেতে দিয়েই বেরোই তবে!
একদৌড়ে দুটো থালা নিয়ে ওপরে উঠে এলো বাদল। সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি, আলুর দম, সাদা ভাত আর একবাটি ডাল। ঘরে ঢুকে বাদল দেখল মল্লিকা কোমরে কাপড় গুঁজে দ্রুতহাতে একটা কাপড় বিছিয়ে দিয়েছে মেঝের ওপর। গোটা ঘরে একটা আসবাবের চিহ্নমাত্র নেই। থালা দুটো নিয়ে দরজার সামনে বাদলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের কাপড়ের আঁচলটা কোমর থেকে খুলে তাড়াতাড়ি গায়ে টেনে নিল মল্লিকা। তখনই বাথরুম থেকে পলাশ বেরিয়ে এলো। বাদল গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
-এখানে এসব চলে না। আমি পলাশের দাদা, তোমারও দাদাভাই। আমাকে দেখে এক গলা ঘোমটার আড়ালে লুকোতে হবে না। খেতে বসো। সারাদিন তো এক দানা ভাতও পেটে পড়েনি।
-আপনিও বসুন! আমাদের সঙ্গে খাবেন।
-না। এতটুকু খাবার, তোমরাই খাও। এটা কালীপুজোর ভোগ।
-মায়ের ভোগ ভাগ করে খেতে হয় দাদাভাই। একজন পেটপুরে খেলে, আর একজন চেয়ে দেখলে, ঠাকুর পাপ দেয়।
-মলি তো ঠিকই বলেছে বাদলদা। আর ও যখন একবার মুখ থেকে বলেছে, তোমাকে না খাইয়ে ছাড়বে ভেবেছ? বসো বসো। দাদা একটু খেলে ভাইয়ের কম পড়বে না!
খিদে যে শরীরকে এতখানি কাতর করে দেয়, পলাশ প্রায় ভুলতে বসেছিল। তার অভাব থাকলেও, খিদের জ্বালা বহুকাল বোঝেনি সে। দিনরাত গাধার মতো খাটে পলাশ। একটা পেট ভরার মতো অন্নের সংস্থান করা, ওর কাছে কোন বড় ব্যাপারই না। গ্রামে থাকতে ভাতের হোটেলে একবেলা কাজ করত সে। হাত চালাতে চালাতে চুরি করে মুখে পুরে দিত কত কিছুই। আর একবেলা রেললাইনের ধারে একটা গ্যারেজে কাজ করত। গ্যারেজের পাশেই ছাউনি ঢাকা বড় একটা পরিসরে সারাদিন যাবৎ নিত্যযাত্রীদের সাইকেল আর বাইক জমা পড়ত। সেইসবের হিসেব রাখা আর গ্যারেজে কাজের মাঝে জুটে যেত পাউরুটি চা, কিংবা চা বিস্কুট। মেজাজ খুব ভালো থাকলে গ্যারেজের মালিক কোনদিন হয়তো নিরামিষ ভাত খাওয়ার টাকা দিতেন, নিদেনপক্ষে কচুরি সাদা আলুর তরকারি আর আমের আচার। অপূর্ব সে স্বাদ! গতকাল বিকেল থেকে পলাশের পেটে বারকয়েক চা বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। ভাতের পাতে বসে ক্ষুধার্ত পলাশকে সশব্দে খেতে দেখে মল্লিকার চোখ ভিজে গেল। খিদে সহ্য করার ওর ঢের অভ্যাস আছে। খিদে নেই বলে নিজের ভাগের ভাতটুকু পলাশের দিকে এগিয়ে দিতেই ওর খেয়াল হল, এখন পলাশের ওপর আরও একজন মানুষের দায়িত্ব আছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল পলাশ। খানিক জোরাজুরির পর ধমকে উঠল সে,
-তুমি না খেলে আমিও খাব না মলি!
মল্লিকার কথার মান রাখতে একবার মাত্র একটু ভোগের খিচুড়ি মুখে দিয়ে উঠে পড়ল বাদল। বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। যখন বাথরুম থেকে ফিরল, তখন দেখল পলাশ নিজের হাতে তার মল্লিকাকে খাইয়ে দিচ্ছে।
ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল বাদল। ইতস্তত করে বলল,
-একটা মাদুরও নেই। মাসিমার থেকে চেয়ে আনব পলাশ?
-না দাদা। মাসিমা এমনিতেই আমাদের জন্য এত করলেন, তাকে আর বিরক্ত কোরো না।
-এই ঠান্ডা মেঝেতে শুবি তোরা?
-আমার অভ্যাস আছে!
মৃদুস্বরে বলল মল্লিকা। প্রত্যুত্তরে বাদল বলল,
-আজকের দিনটা একটু কষ্ট করে নে ভাই। কালই একটা দড়ির খাটিয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। দুটো বালিশ, চাদর, মশারি, একটা জনতা, কেরোসিন, আর গুটিকয়েক বাসনপত্তর হলেই আপাতত কাজ চালিয়ে নিতে পারবি না?
খাবারটা পুরো খেতে পারল না পলাশ। ও বসে থাকলে মলি কিছুতেই খাবে না। পেট ভরে গেছে বলে উঠে পড়ল ও। বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে বেরিয়ে পকেট হাতড়ে হাজার পাঁচেক টাকা বের করে চার হাজার টাকা বাদলের হাতে ধরিয়ে বলল,
-দুই মালিকের কাছে যা জমা ছিল, আসার আগে সব তুলে নিয়ে এসেছি। সাইকেলটাও বিক্রি করে দিয়েছি। এমনিতেই দুটো মাস বাড়িভাড়াটা তুমি দেবে বললে। তার ওপর এতকিছু কেনাকাটা.... এটা তুমি রাখো দাদা। জানি এতে কিছুই হয় না! কিন্তু এর বেশি আমি আর কোথায় পাব?
-তোকে পাকামি করতে বলেছি আমি?
-না তুমি এটা রাখো।
শূন্য থালাদুটো নিয়ে মাথা নামিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল মল্লিকা। বাদল পলাশের হাত চেপে ধরে গলা নামিয়ে বলল,
-এতদিন একা মানুষ ফাঁকা পকেটে ঘুরেছিস, বেশ করেছিস। কিন্তু এখন বিয়ে করেছিস পলাশ, বউ সঙ্গে রয়েছে। এখন টাকা পয়সা লাগে। মেয়েমানুষের শরীর-স্বাস্থ্য! বিয়ে করেছিস, বুঝবি! কখন কী প্রয়োজন হয়, অচেনা শহর! আমি গাড়ি নিয়ে কোথায় বেরিয়ে যাব, কখন কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। এতবড় শহর! অচেনা অজানা জায়গা, মানুষজন! কোথায় কার কাছে হাত পাততে যাবি? তুই এখন নিজের কাছে টাকা রাখ। আগে তোর একটা কাজ জুটিয়ে দিই, তারপর এই টাকা সুদে আসলে তোর পকেট কেটে বের করে নিয়ে যাব।
হেসে উঠল পলাশ। ওই টাকা আবার পলাশের প্যান্টের পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বাদল বলল,
-রাত হয়েছে। সারাদিন যা ধকল গেছে। নে নে, তোরা শুয়ে পড়। আমি চলি! একটু দাঁড়া! আমি আসছি। আসল জিনিসটাই তো গাড়িতে রয়ে গেছে।
একদৌড়ে রাস্তায় নেমে আবার দোতলায় উঠে এলো বাদল। ওর হাতে একটা কালো পলিথিনের প্যাকেট।
-কী আছে এতে?
-তখন মন্দিরের বাইরে কিনেছিলাম। তোদের মালা বদলের মালাদুটো। আজ তোদের প্রথম রাত। বিশেষ কিছু করতে পারলাম না ভাই। এই রজনীগন্ধার মালাদুটো রাখ। এগুলো কোন কাজে লাগবে তোরা জানিস!
পলাশ লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। পিছু ফিরে দেখল, মল্লিকা বাথরুমের দিকে সেই যে গেল, আর ফিরল না। বাদল বলল,
-ভাই শোন, মাসিমার কাছে এই বিয়ের ব্যাপারটা একদম চেপে যেতে হবে। মনে থাকবে তো? আমি যেটা বলেছি, তোরাও সেটাই বলবি।
-হু!
-মাসিমার মনটা খুব ভালো পলাশ। কিন্তু মুখ ভালো না। কিছু বললে একটু মানিয়ে নিস। কোন কথার উত্তর করবি না। চুপ করে শুনে নিবি। যে স্নেহ করে, সে তো একটু শাসনও করতে পারে বল! মাথা গরম করিস না ভাই!
-সে আর বলতে! মাথার ওপর ছাদ আর পায়ের তলার মাটি দিয়েছে মাসিমা, পেটে ভাত দিয়েছে, নইলে মলিকে নিয়ে আজ সারাটা রাত রাস্তায় কাটাতে হতো। তার জন্য মাসিমা বেগার খাটতে বললেও আমি খেটে দেব। দু'কথা বললেও শুনে নেব। তুমি এই মাসিমার মেয়ের গাড়ি চালাও দাদা?
-হ্যাঁ রে, পিহু দিদি মস্ত বড় কলেজে পড়ায়। কতবড় বিল্ডিং! কত ছাত্রছাত্রী। বাড়িতেও ছাত্র পড়তে আসে। দিদি অনেক পড়ালেখা জানে। খুব রাগী। মাসিমাও দিদিকে খুব ভয় পায়। দিদির বর চোখের ডাক্তার। খুব নামডাক। বাড়ির একতলায় চেম্বার আছে। আবার বাইরেও পেশেন্ট দেখতে যায়। কত লোক আসে। আমিই তো গাড়ি করে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যাই।
-মাসিমা কী এখানে একাই থাকেন?
-হ্যাঁ, মেসোমশাই মারা গেছেন নাকি বহুকাল আগে। তখন পিহু দিদি খুব ছোট। মাসিমা একাই দিদিকে মানুষ করেছে। পিহু দিদি বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর তো একাই থাকে। ওপরটা সবসময় ভাড়া দেওয়া থাকত। তোর কপাল ভালো, আগের ভাড়াটেকে তুলতে বিশাল ঝামেলা হওয়ায় দিদি আর ভাড়া বসাতে দেয়নি। আমিই বলে কয়ে তোর থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। আমি এই দুই বাড়ির ঘরের ছেলে বলতে পারিস। সারাদিন দুই বাড়ি করতে করতেই সময় কেটে যায়। বাজারে যাই, মাসিমাকে নিয়ে মন্দিরে যাই। আর সারাদিন ভাড়ায় খাটি। এই তুই যা, আমি বকতে শুরু করলে তোকে সারারাত এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখব। ওদিকে মল্লিকা অপেক্ষা করছে, আমি পালাই! সংসারটা একটু গুছিয়ে নে। তারপর তোদের একদিন আমার ঘরেও নিয়ে যাব। তোর বৌদি বলেছে।
-অবশ্যই যাব দাদা। এই শহরে তুমি আর বৌদি ছাড়া আমাদের আর আছে'টা কে!
বাদলদা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই বৃষ্টি শুরু হল। আসবাবহীন ঘরে সংসারিক সামগ্রী বলতে শীতল মেঝেতে একটা কাপড় পেতে রেখেছে মল্লিকা। বাথরুমের দরজায় টোকা দিতেই মলি বেরিয়ে এলো বাইরে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল পলাশের বুকে। পলাশ ওর হাতে পলিথিনের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-আজ আমাদের ফুলশয্যা!
লজ্জায় পলাশের বুকের মধ্যে মিশে যেতে চাইল মল্লিকা। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটাগুলো তখন কাঁচের জানালায় রকমারি অবয়ব সৃষ্টিতে ব্যস্ত। অদূরে আলোর ঝাপসা জলছবি। পলাশ আর মল্লিকার গলায় দুটো রজনীগন্ধার মালা, সেই সৌরভে পরস্পর আবিষ্ট হয়ে রয়েছে। পলাশের বুকের ওপর মাথা রেখে বাইরের আবছা আলোর দিকে চেয়ে মল্লিকা বলল,
-ওই উল্টোদিকের বাড়িতে এত আলো কেন গো?
-মাসিমা বললেন যে কালীপুজো। ওই বাড়িতেই মনে হয়।
-ওহ!
-মন খারাপ মলি? ঘরের জন্য মন কেমন করছে?
-না! ঘরে আমার জন্য কে কাঁদবে? শুধু আমার মেনিটা মনে হয় না খেতে পেয়ে মরে যাবে জানো! মা দিনরাত ওর গায়ে জল ছুঁড়ে মারে। ভাত পুকুরে ফেলে দেয়, তবুও ওকে এক দানা ভাত দেয় না!
-ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতে!
-নিজেদেরই থাকা খাওয়ার ঠিক নেই, ওকে এনে কোথায় রাখতাম?
চুপ করে গেল পলাশ। নিজের অক্ষমতা যেন বড় বেশি করে ওর বুকে বাজল। মল্লিকার প্রিয় পোষ্যর জন্য দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন সংস্থানের ক্ষমতাও কী ওর নেই! কাছে থাকলে তবুও ওদের এঁটো-কাঁটা খেয়েই না হয় বাঁচত! মলি ওকে নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারত। কিন্তু যেখানে নিজেদেরই কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, একটা অবলা জীবকে সঙ্গে নিয়ে কতক্ষণ আর ঘোরা যায়! আবার যদি বিড়াল সঙ্গে থাকলে ঘর না পাওয়া যায়, তখন? পলাশ মৃদুস্বরে বলল,
-প্রথম রাত ঘিরে মেয়েদের অনেক স্বপ্ন থাকে, তাই না? পেট ভরে দুটো ভাত, অন্তত একটা বিছানা, কিছুই পারলাম না.... আমার তো কিছুই নেই মলি। তোমাকে কিছুই দেওয়া হল না।
-কে বলেছে কিছু দাওনি? এই যে!
পলাশের হাতটা নিজের তলপেটের ওপর রাখল মল্লিকা। নতুন প্রাণের আগমনবার্তায় আনন্দিত ওই দম্পতি পরস্পরকে দীর্ঘক্ষণ আলিঙ্গন করে রইল। আবেগতাড়িত কণ্ঠে মল্লিকা বলল,
-কত সুন্দর ছাদ আঁটা বাড়ি, বাড়িটায় কত বড় বড় জানলা, কলঘরে তো কল খুললেই ঝরঝর করে জল পড়ে। পুকুর থেকে বালতি করে জল টেনে শ্যাওলা ধরা পিছল উঠোন পেরিয়ে চানঘরে যেতে হবে না বলো?
-না। কল খুললেই জল। বোতাম টিপলেই আলো জ্বলবে, পাখাও চলবে। আমার গ্যারেজের মতো, হোটেলের মতো।
-তবে তো ওকে পেটে নিয়ে আমায় পুকুর ঘাটে যেতে হবে না। রাস্তার কল থেকে জল বইতেও হবে না। হ্যাঁ গো, মাসিমা আবার উঠিয়ে দেবে না তো? ওকে আমার কোলে আসার সময়টুকু দেবে তো? পরের বাড়ি! যদি হঠাৎ চলে যেতে বলে, কোথায় যাব আমরা?
-ঘর ছাড়ার আগে এসব ভাবতে ইচ্ছে করেনি?
দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল মল্লিকা। ওর সর্বাঙ্গে রজনীগন্ধার সুবাস। পলাশের গলায়ও একটা রজনীগন্ধার মালা। অন্যমনস্কভাবে ওই মালা থেকে কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে পলাশের মুখের ওপর ছুঁড়ে মল্লিকা বলল,
-না ভাবিনি। আমি জানি, তুমি ঠিক কিছু একটা করে নেবে। তাই ওর কথা ভেবে, তোমার হাত ধরে বেরিয়ে এসেছি। তোমাকে বিশ্বাস করেছি আমি। ভুল করিনি তো?
শ্যামাঙ্গিনী মল্লিকার শুষ্ক ঠোঁটে আদর এঁকে দিল পলাশ। ওর রুগ্ন শরীরটাকে নিজের বুকে চেপে ধরল। নারীসুলভ কোমলতা স্পর্শ করেনি মল্লিকার দেহ। হৃদয়ের স্থানে কেবল যেন পাঁজরের হাড় ক'খানাই সার। ওই শরীরটাকেই আপন দেহের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে উন্মুখ পলাশ। নবদম্পতির শরীরী উষ্ণতায় পিষ্ট হতে লাগল কোমল রজনীগন্ধা। মল্লিকার সুবৃহৎ খোঁপা ভেঙে পড়েছে বহু আগেই। ওর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে পলাশ বলে উঠল,
-কী মনে হয়?
-জানি না যাও!
রজনীগন্ধার মালার প্রাচীর মুহূর্তেই অদৃশ্য হল। পলাশ দুটো মালা ছিঁড়ে সরিয়ে রাখল মেঝেতে। অজস্র রজনীগন্ধার দ্বারা সজ্জিত শীতল শয্যার মাঝে পলাশের কণ্ঠলগ্না হয়ে নবরূপে প্রস্ফুটিত হল মল্লিকা। সলজ্জে বলে উঠল,
-এত সুন্দর ঘর, এত আরাম, এমন সুখ, আমার মধ্যে বেড়ে ওঠা আমাদের ছোট্ট ছেলে.... সব দিয়েছ তুমি আমায়। তবে কেন বললে, কিছু দিতে পারোনি!
মৃদু হেসে পলাশ মল্লিকার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে বলল,
-মেয়ে!
বাড়িটা স্বর্গীয় দেবপ্রসাদ সান্যালের। প্রাচীন বাড়ির একাংশ প্রায় ভগ্নস্তূপ। শহরের মধ্যে থেকেও যেন শহরবর্জিত এই বাড়ি। আশেপাশের হাল ফ্যাশনের কারুকার্যময় রংবেরংয়ের সুউচ্চ বাড়ির পাশে এই ইঁট বেরিয়ে পড়া পলেস্তরা খসে যাওয়া পুরনো বাড়িটা বড় বেমানান। বিঘেখানেক জমির এককোণে ঐতিহ্যবাহী কঙ্কালের মতো কড়িবরগাসহ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বসতবাড়িখানা। একাধিক শরিক থাকা সত্ত্বেও বাড়ির একাংশ আগলে একা পড়ে রয়েছেন মৃণালিনী দেবী। অন্য অংশে কাঠের দরজায় মরচে পড়া তালা ঝুলছে। বাড়ির চতুর্দিকে আম, কাঁঠাল, নারকেল ও একাধিক সুপারি গাছের কারণে জায়গাটা দিনের বেলাও বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। অদূরে একটা বুজে আসা ডোবা। প্রতিবেশীর ছুঁড়ে ফেলা আবর্জনা হতে নির্গত দুর্গন্ধ আর মশার অত্যাচার হতে অব্যাহতি পেতে, দিনের বেশিরভাগ সময়ই ঘরের পিছন দিকের জানালাটা বন্ধ রাখেন মৃণালিনী দেবী। নিজের দুই দেওর প্রবাসী। ওই জায়গা তাদের। সুতরাং বাড়ির পিছন দিকে মৃণালিনী দেবীর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। শরিকি মতানৈক্যের কারণে এককালে ভাইদের মনের ভিতর ও জমির ওপর দেওয়াল তোলা হলেও, এখন সেই দেওয়াল ডোবার গ্রাসে অনেকাংশে ভেঙে পড়েছে। একমাত্র মেয়ে পিহুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যক্ষের মতো এই বাড়ি আগলে একা পড়ে রয়েছেন মৃণালিনী দেবী। পিহু সুপারি গাছগুলো লিজে দিয়েছে। ওরা নিজেদের সময়মতো আসে, সুপারি পেড়ে নিয়ে যায়। বারান্দায় বঁটি নিয়ে বসে নারকেল পাতার কাঠি বের করতে করতেই মৃণালিনী দেবীর ক্লান্ত দুপুরগুলো নিঃসঙ্গভাবে কাটে। বিকেলের খানিকটা সময় ধনেপাতার চারা আর লংকাগাছগুলোর জন্য ব্যয় হয়। নিজের হাতে টমেটো গাছগুলোর পরিচর্যা করেন মৃণালিনী দেবী। এবার লেবু গাছটায় অজস্র লেবু ধরেছে। খেয়ে, ঝরে, পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লেবুপাতার গন্ধ মৃণালিনী দেবীর বড্ড প্রিয়। গাছের ফলমূল বিক্রি করে, প্রতিবেশীদের দান করে মনের আনন্দেই তিনি আছেন। তাঁর এই বার্ধক্যবেলার সঙ্গী বলতে উল্টোদিকের বাড়ির আরতি ও তার এক বছরের দুরন্ত এক শিশু, নাম তার গোগোল। আরতির শ্বশুর শাশুড়ি গত হয়েছেন বহুদিন। বাড়ির ছেলেটা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর, আরতি ওই একরত্তি ছেলের দস্যিপনা একা হাতে সামলাতে অস্থির হয়ে যেত। ছেলেটার কান্না যেন মৃণালিনী দেবীর হৃদপিণ্ড ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। এ নারীজীবনে মাতৃত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু একটা কুসুমকোমল প্রাণকে বুকে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। অবিলম্বে আরতির সঙ্গে এই বৃদ্ধার ভাব হয় এবং গোগোলের ক্ষুদ্র বৃহৎ যাবতীয় দায়িত্ব মৃণালিনী দেবীর ওপর ছেড়ে একটু নিশ্চিন্ত হয় আরতি। এছাড়াও মৃণালিনী দেবীর অবসর যাপনের আরো একজন সঙ্গী আছে, তার নাম আলো। দুই বেলা ঘড়ির কাঁটা ধরে নিয়ম করে আসে সে। সকালের ঘর ঝাঁট দেওয়া থেকে রান্না করা এবং বিকেলে গোপালের বাসনপত্র তেঁতুল ঘষে ঝকঝকে করে মেজে দেওয়া থেকে শুরু করে, রাতের রুটি করার পর মৃণালিনী দেবীর চুল আঁচড়ে বেঁধে দিয়ে তবে তার ছুটি! পেশায় কেরানি দেবপ্রসাদ সান্যাল বাড়ির ওপর তলায় একটামাত্র ঘর করতে পেরেছিলেন। তারপরই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বড় অকালে স্বর্গবাসী হয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর পিহুর উচ্চশিক্ষার কারণে বাড়িঘরের কথা আর ভাবেননি মৃণালিনী। একরত্তি মেয়েটাকে বুকে আগলে রেখেছেন। পরবর্তীকালে পিহু এই ধ্বংসস্তুপে অর্থ জলাঞ্জলি দিতে রাজি হয়নি। মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজের কাছে। পিহু নিজে দেখেশুনে পছন্দ করলেও, মৃণালিনীর জামাই একেবারে হিরের টুকরো। সে একাধিকবার শাশুড়ি মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু স্বামীর ভিটে পরিত্যাগ করতে মৃণালিনী দেবী অসম্মত হওয়ায়, পিহু অপেক্ষা করছে দুই কাকার দেশে প্রত্যাবর্তনের শুভ মুহূর্তের জন্য। আগামী বছর সকলের উপস্থিতিতে এই সম্পত্তির একটা গতি করা হবে। প্রোমোটারের হাতে এই আবর্জনা তুলে দিয়ে মাকে সুদৃশ্য ফ্ল্যাটের আরামে না রাখা পর্যন্ত পিহুর মনে স্বস্তি নেই। অপেক্ষা আর মাত্র একটা বছরের।
আরতির বাড়ি থেকে ফিরতে সেদিন বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকা দম্পতির ওপর ভরসা করতে পারেননি তিনি। গোগোলকে নিজের হাতে খাইয়ে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছেন। ঝিরঝির করে অবিরাম বৃষ্টি হয়েই চলেছে। বেশ একটা শীতল অনুভূতি যেন ঘিরে ধরছিল মৃণালিনীকে। বারান্দায় উঠে ওপর দিকে একবার চেয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী। নতুন ভাড়াটের ঘরের দরজা বন্ধ। বারান্দার আলো নিভিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলেন তিনি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় পলাশের। মল্লিকা গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে পলাশের বুকের ভিতরে। ওর গায়ে হাত দিয়ে পলাশ দেখল, একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে মল্লিকার শরীর। গায়ের ওপর ঢাকা দেওয়ার মতো একটা চাদরও ওদের কাছে নেই। মল্লিকাকে নিজের বুকের ওপর থেকে নামিয়ে উঠে পড়ল পলাশ। আলো জ্বেলে তাড়াতাড়ি পাখাটা বন্ধ করে দিল। একটু বৃষ্টি হতেই গুমোট গরমটা একদম কমে গেছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মল্লিকা। ওর অবিন্যস্ত পোশাকের মধ্যে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে রজনীগন্ধার পাপড়ি। মল্লিকার খোলা চুলের মধ্যে থেকে কয়েকটা পাপড়ি তুলে আনলো পলাশ। দীর্ঘক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে। জীবনের সব শান্তি এই মুখটাতেই লুকিয়ে আছে। আঁচল সরিয়ে মল্লিকার উন্মুক্ত নাভিতে নিজের অনাগত সন্তানের জন্য খানিকটা আদর এঁকে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল পলাশ।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি! মল্লিকা জেগে রয়েছে না ঘুমিয়ে পড়েছে, ও বুঝতেই পারল না। কেবল একটা আর্ত গোঙানি ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। চোখের সামনে ঠাকুরথান ভেসে উঠল। দোলপূর্ণিমার পুজো, প্রসাদ বিতরণ.... একমুঠো প্রসাদ নিজের শতছিন্ন কাপড়ের আঁচলে গিঁট পাকিয়ে মল্লিকা ছুটেছিল স্টিমার ঘাটে। প্রেমের লাল আবির দিয়ে সেইদিন মল্লিকার সর্বদেহ রাঙিয়ে দিয়েছিল পলাশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসার পরেও পলাশ বাড়ি ফিরতে দেয়নি ওকে। যখন ঘরের চৌকাঠে পা রেখেছিল, তখন নিজের গর্ভে পলাশেরই ক্ষুদ্র অংশ ধারণ করে ফিরেছিল ও। কিন্তু গত কয়েক মাসে মল্লিকার বিয়ের তাগিদে মায়ের অত্যাচারের পরিমাণ তখন এতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, পলাশের সন্তানের কথা মল্লিকা নিজমুখে বাবাকে জানাতেই পারেনি। সকলের অলক্ষ্যে পলাশের হাত ধরে আঁধার রাতে ঘর ছেড়েছিল সে। নতুন সংসার বাঁধার আশায় পালিয়ে আসতে চেয়েছিল শহরে। পলাশের হাত ধরে রেললাইন বরাবর ছুটছে মল্লিকা। কাঁধে একটা ব্যাগ। তাতে রয়েছে মুড়কি আর বাতাসা। ছুটতে ছুটতে মল্লিকা ক্লান্ত। কিন্তু এই রেললাইনের শেষ কোথায়? হঠাৎ ও দেখল আশেপাশে পলাশ নেই। কেউ নেই। ও একা রেললাইন ধরে বিরামহীনভাবে ছুটেই চলেছে। কান মাথা কেঁপে উঠল রেলগাড়ির আগমনবার্তায়। ব্যাগ রইল লাইনের ওপর পড়ে। মুড়কি বাতাসা ছড়িয়ে পড়ল ধুলোর ওপর। জোরালো এক আলোকরশ্মি! সেই সঙ্গে বুক কাঁপানো তীব্র বাঁশির শব্দ! মল্লিকার মুখ থেকে গ্যাজলা বেরিয়ে এলো। আধো ঘুম আধো জাগরণে কেবল অস্ফুটে গোঙানি নির্গত হল ওর কন্ঠনালী হতে। হাত পা অসাড়! ছুটতে ছুটতে মুখ ঘুরিয়ে মল্লিকা দেখল, রেলগাড়িটা ওর একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। জোরালো আলোর প্রভাবে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। প্রাণভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল মল্লিকা। ওকে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিল পলাশ,
-এই মলি! মলি! এইরকম করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?
আরতির ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা গোগোল হঠাৎই চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে তিন মিনিট...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন