অনুসরণকারী

বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২২

সপ্তপর্ণী (দ্বিতীয় খণ্ড) (তৃতীয় পর্ব)




সপ্তপর্ণী

সাথী দাস

দ্বিতীয় খণ্ড

তৃতীয় পর্ব




মৃদুহাস্যে পর্ণা বললেন,
-মহাভৈরবীর নিকট পূজার্চনা হেতু এই পথ ধরে মন্দিরে যাওয়ার কালে রথ হতে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলাম, শৈল ও বীরদত্ত প্রশিক্ষণকার্যে ব্যস্ত, চিত্রার অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে...
-মহারানি! অস্ত্রশিক্ষা ও অনুশীলনে রাজকুমারী বড় অমনোযোগী। কোনরূপ অনুশাসনের পরোয়া তিনি করেন না। বড়ই অবাধ্য। তুলনামূলকভাবে শৈল সুনিপুণ তিরন্দাজ। তার তরবারি চালনা, বর্শা নিক্ষেপের কৌশল ও রণকৌশলে আমি যারপরনাই অভিভূত রানি।
পরিশ্রমী শৈলজা হাসিমুখে সামান্য উৎসাহব্যঞ্জক বাক্যের আশায় পর্ণার মুখপানে চাইলেন। কিন্তু চিত্রার অমনোযোগ এবং অনুশীলনকার্যে উদাসীনতার বৃত্তান্ত বীরদত্ত কর্তৃক শ্রবণমাত্র পর্ণা বললেন,
-অমরাবতীর ভবিষ্যৎ রানির এমন অমনোযোগ ক্ষমার অযোগ্য চিত্রা।
মুহূর্তেই শৈলজার মুখমণ্ডল হতে সকল হাসি অদৃশ্য হল। তুমুল গাত্রদাহ সহ্যপূর্বক পর্ণার সম্মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে। আপনাকে রক্ষার্থে রাজকন্যা চিত্রা সোহাগী কণ্ঠে পর্ণাকে আলিঙ্গন করে বললেন,
-মা! বীরদত্ত সঠিক কথা বলছে না! মাত্র আজই নিদ্রাভঙ্গে আমার সামান্য বিলম্ব...
-এক পক্ষকাল পূর্বে আপনি দুইদিন বিলম্ব ছিলেন রাজকুমারী। প্রহরী ও পরিচারিকা কর্তৃক আহ্বানপূর্বক আপনার সুখনিদ্রাভঙ্গ...
-না মা! সকল বাক্য মিথ্যা, মনগড়া!
মৃদুহাস্যে পর্ণা চিত্রার ললাটে স্নেহচুম্বন অঙ্কনপূর্বক বললেন,
-বীরদত্ত তোমার শিক্ষাগুরু চিত্রা। সে কোন অভিপ্রায়ে মিথ্যার আশ্রয় নেবে? যে ক্ষণে তুমি তাকে পরাজিত করতে সমর্থ হবে, সেই ক্ষণে তোমার সকল অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হবে। প্রতিক্ষণে আমার শিক্ষাগুরু রামেশ্বরের স্মৃতি আমার মনকে বড় পীড়া দেয়। আমার সুকোমল দেহের উপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারপূর্বক, চরম মানসিক নিপীড়নের মাধ্যমে একদা সে আমার মন এবং সম্মানকেও ছিন্নভিন্ন করেছিল। এক সামান্য কিশোরী জ্বলন্ত অঙ্গারে পরিণত হয়েছিল শুধুমাত্র তাঁরই শিক্ষায়। তোমাকেও অনুরূপভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে চিত্রা। পৃথিবী বড় রূঢ় ও নির্দয়। সর্বক্ষেত্রে, সবস্থানে অস্ত্র তোমার সহায়তা করবে না। নিজেকেই সর্বাপেক্ষা কঠিনতম অস্ত্ররূপে প্রস্তুত করতে হবে। আর নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর পরিশ্রম এবং অনুশীলন ব্যতীত তা সম্ভব নয়। অযথা বাক্যালাপে কালবিলম্ব অনভিপ্রেত। বীর?
-আজ্ঞা করুন রানি?
-লজ্জা নারীর ভূষণ নয়, অহংকার! সেই অহংকারের উপর সামান্যতম অসন্তোষজনক দৃষ্টিও কাঙ্খিত নয়। চিত্রা প্রয়োজনে ওই অহংকারকেই আপন অস্ত্রজ্ঞানে ব্যবহার করবে। এই শিক্ষা চিত্রাকে সঠিক সময়ে তুমি প্রদান করবে।
-যথা আজ্ঞা রানি।
-চিত্রাকে ভবিষ্যতের পর্ণারূপে প্রস্তুত করো। অগ্নিস্ফুলিঙ্গরূপে সে ধরা দেবে আপন ও বহির্বিশ্বের সকল প্রজার দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টিতে ভীতি ও সম্ভ্রম একই সময়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করবে।
-আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। কেবল রাজকুমারী পাঠাভ্যাস ও অনুশীলনে যদি সামান্য একটু মনোযোগী হয়...
-অবশ্য হবে। চিত্রা?
-মা?
-তুমি কে?
-অমরাবতী, কাঞ্চনগড় এবং মায়াকাননের ভবিষ্যৎ অধিশ্বরী, পৃথ্বীশবর্মন এবং মহারানি সপ্তপর্ণীর একমাত্র কন্যা...
-চিত্রা! আমার রাজ্যে নির্বোধ পথশিশুও আপন পরিচয়ের পূর্বে পিতার নাম স্মরণ ও উচ্চারণ করে না। তুমি এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজ্যেশ্বরী হয়ে এমনতর ভুল...
-ক্ষমাপ্রার্থী মা। আমি মহারানি সপ্তপর্ণীর একমাত্র কন্যাসন্তান চিত্রাঙ্গদা।
-তোমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?
-প্রজার কল্যানসাধন, দুষ্টের দমন এবং রাজ্যবিস্তারপূর্বক একাধিক রাজ্যব্যাপী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
-আর...
-মা?!
পর্ণার অক্ষিকোটর হতে একবিন্দু অবাধ্য লবণাক্ত বারিধারা বিনা বাধায় গন্ডদেশে নেমে এলো। শশব্যস্ত চিত্রা পর্ণাকে বারংবার আহ্বানে উত্যক্ত করে তোলার পূর্বেই কম্পিত স্বরে অবনত দৃষ্টিতে পর্ণা কন্যার উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,
-বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী চিত্রা?
-মৃত্যু মা!
-যথার্থই...
-মা তোমাকে এমনতর বিবর্ণ দেখাচ্ছে কেন? আপন কক্ষে...
-রানি আমি আপনাকে কক্ষে পৌঁছে...
-না বীর! আমি এই ক্ষণে চিত্রার মঙ্গল কামনা হেতু মহাভৈরবীর নিকট প্রার্থনা করতে আগ্রহী। কক্ষে গমন সম্ভব নয়। চিত্রা?
-মা?
-আপন অনুশীলনে মনোযোগী হও। অবিলম্বে তোমার রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করা হবে। প্রজার সম্মুখে সকল ক্ষেত্রে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক। তবেই তোমাকে তিন রাজ্যের রাজসিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারিণীরূপে গণ্য করা হবে। অন্যথায়...
-অন্যথায়?
-অনুশীলনে মনোযোগী হও। আমি পূজার্চনা সমাধাপূর্বক রাজকার্যে কিঞ্চিৎ ব্যস্ত থাকব। আগামী এক পক্ষকাল পশ্চাতে পুনরায় এই প্রশিক্ষণক্ষেত্রে আমি সশরীরে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা আপন মনে পোষণ করি। আশা রাখি, সেই ক্ষণে তুমি বীরদত্তকে অভিযোগের কোনপ্রকার সুযোগ দেবে না! মহাভৈরবী তোমার মঙ্গল করুন রাজকন্যা।
-মায়াকানন, কাঞ্চনগড় ও পবিত্র অমরাবতী শত্রুমুক্ত থাকুক মা!
আপন কন্যাকে আলিঙ্গনপূর্বক, শৈলজার মস্তকে হস্তখানি মাত্র স্পর্শ করলেন পর্ণা। অতঃপর পূজার রৌপ্যনির্মিত রেকাবি, মঙ্গলঘট এবং উপাচারসহ পুনরায় আপন রথে চড়লেন। দুইটি অশ্ব সগৌরবে অমরাবতীর রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন অঞ্চল ও নগর পেরিয়ে মহাভৈরবীর মন্দির পানে অগ্রসর হল। পর্ণার প্রস্থানের পরই চিত্রা অবিলম্বে আপন কোমরবন্ধনী হতে তরবারি মুক্ত করে বীরদত্তকে আক্রমণ করলেন। সহসা ধেয়ে আসা কিশোরীর সেই আক্রমণ আপন তরবারি কর্তৃক অট্টহাস্যে প্রতিরোধ করল বীরদত্ত,
-আরে রাজকুমারী! প্রাণে মারবেন নাকি!
-আমি অমনোযোগী? মায়ের নিকট অভিযোগ জানানো হচ্ছে! এই তুমি আমার পরম মিত্র? মিত্রসুলভ কোন কর্তব্য পালন করলে তুমি?
-আপনি অবশ্যই অমনোযোগী। আপনার শিক্ষাগুরুর দায়িত্বজ্ঞানে সেই সংবাদ আপনার মাকে জানানো আমার অবশ্য কর্তব্য। আর আমি অবশ্যই আপনার পরম বিশ্বস্ত মিত্র! আপনি আমাকে এই ক্ষণে ধন্যবাদ জানাবেন এই মর্মে যে, সারঙ্গীর পৃষ্ঠদেশে চেপে গতরাত্রির তৃতীয় প্রহরে আপনি মায়াকাননের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, সেই কারণে আজ প্রাতকালে আপনার নিদ্রাভঙ্গ সম্ভব হয়নি, আপনার সঙ্গে গভীর সখ্যতা হেতু এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমি মহারানির নিকট গোপন রেখেছি! ধন্যবাদের পরিবর্তে আপনি আমার কন্ঠনালী তরবারি দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করার প্রচেষ্টায় মগ্ন হয়েছেন কন্যা?
-তুমি এ সংবাদ অবগত হলে কীরূপে?
চমৎকৃত চিত্রার হস্ত হতে তরবারি খসে পড়ল। দরাজ হাসি উপহারস্বরূপ আপন ওষ্ঠ ও অধরে অঙ্কনপূর্বক বীরদত্ত ধূলিধূসরিত ভূমি হতে তরবারিটি তুলে চিত্রার হাতে দিয়ে বলল,
-এই অমরাবতী রাজ্যে একটি মৃগশাবকও আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে প্রবেশ বা প্রস্থান করতে অসমর্থ কন্যা। আপনি পারবেন, কোনকালেই এমন আশা করবেন না।
-আমি একদিন তোমার ঐ সতর্ক দৃষ্টিপথ পেরিয়ে মায়াকাননে পাড়ি দেব। মা-ও আমাকে নিষেধ করার সুযোগ পাবে না।
-এই ক্ষণে নিজেকে প্রস্তুত করুন রাজকন্যা। এই অমূল্য সময় হেলায় হারালে রাজসিংহাসন ও রাজ্যভার হতে চিরতরে বঞ্চিত হবেন। আমার শিক্ষা, মহারানির এতকালের আশা-ভরসা সকলই বিফলে যাবে। দেশভ্রমণের হেতু সমগ্র জীবনকালব্যাপী বিস্তর সময় পাবেন। এই ক্ষণে সর্বাগ্রে নিজেকে প্রস্তুত করুন। অস্ত্রশিক্ষার পূর্বে মনসংযোগ অত্যন্ত প্রয়োজন। আসুন, আপনি ওই প্রান্তে যোগাভ্যাস করুন, আমি শৈলকে তির ও ধনুকের... শৈল?
পিতৃসম রাজসেনাধ্যক্ষ তথা পরমপ্রিয় মিত্র বীরদত্তের সঙ্গে অম্লমধুর বাক্যালাপকালে চিত্রা শৈলর অবস্থান বিস্মৃত হয়েছিল। তরবারিটিকে কোমরবন্ধনীর মধ্যে স্থান দিয়ে চিত্রা বললেন,
-শৈল কোথায়?
-আমি দেখছি রাজকন্যা। আপনি আপন কার্যে মনোনিবেশ করুন। যোগাভ্যাস করুন।
-বেশ!
আপন তরবারি কোমরবন্ধনীতে রেখে বীরদত্ত প্রশিক্ষণক্ষেত্র হতে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ঘোড়াশালে পৌঁছল। শৈলজার অশ্ব মহানন্দে সবুজ উদ্যানে ভ্রমণপূর্বক আপন প্রাতরাশ সম্পন্নকার্যে মগ্ন। উদ্যান পেরিয়ে সেনা ছাউনির অগভীর দীঘির কাছে পৌঁছল বীরদত্ত। একেবারে অন্তিম সোপানে অবনত মস্তকে বসে রয়েছে একাকিনী শৈলজা। স্থির জলের উপরিভাগে তার মনমরা প্রতিবিম্ব তাকে রূঢ়ভাবে উপহাস করছে। মৃদুস্বরে আহ্বান করল বীরদত্ত,
-শৈল?
আপনার মাঝে হারিয়ে যাওয়া শৈলজা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পশ্চাতে মুখ ফেরাল।
-বীরদত্ত, আপনি! এই স্থানে?
-তোমাকে অন্বেষণ হেতু...
-কী প্রয়োজন?
-প্রশিক্ষণের সময় বয়ে যায় কন্যা...
স্নেহ ঝরে পড়ল বীরদত্তর দরাজ কন্ঠ হতে। কিন্তু অভিমানী শৈলজা দৃঢ়কন্ঠে বলল,
-যাক!
-এ শিশুসুলভ অভিমান নিতান্তই অযৌক্তিক মা!
-বীরদত্ত, আপনিও এ বিষয় অবগত আছেন, চিত্রা অপেক্ষা আমি অধিকতর জ্ঞানী, পরিশ্রমী ও মনোযোগী। কিন্তু পর্ণা-মা কোনকালেই আমাকে বিন্দুমাত্র স্নেহের যোগ্য মনে করল না! কেন?
অন্তিম সোপানে শৈলজার নিকটে এসে বসল বীরদত্ত। ধীরকণ্ঠে বলল,
-চিত্রা তাঁর আপন গর্ভজাত সন্তান শৈল।
-আর আমি পালিতা কন্যা, সেই কারণে আমার প্রতি এ হেন বিরূপ মনোভাব? সেই ক্ষণে মৃত্যুবরণ করার জন্য, পর্ণা-মা আমাকেও ওই রক্তাক্ত ক্ষেত্রে একাকী রেখে আসতে পারত! কেন কন্যাজ্ঞানে গ্রহণ করল! এই মাতৃতান্ত্রিক রাজ্যের রাজ সংবিধান আমিও অবগত আছি বীরদত্ত! সংবিধান কেবলমাত্র যোগ্য নারীকেই রাজ সিংহাসনে স্থান দেয়। সেইক্ষেত্রে নারীকে রাজ ঘরানার ক্ষত্রিয় কন্যা হতেই হবে, এইরূপ কোন বাধ্যবাধকতা সংবিধানে লিখিত নেই। চিত্রার ন্যায় অবোধ, অমনোযোগী, মূর্খ নারীর স্থান আমার পদতলে, রাজ সিংহাসনে নয়!
-শৈল! তুমি আমারই সম্মুখে অসহনীয় অপশব্দের মাধ্যমে পবিত্র অমরাবতীর মহারানি ও রাজকন্যার অসম্মান করছ। এমন অবমাননার কারণে আমি এই ক্ষণে তোমার দেহ দ্বিখণ্ডিত করলেও, মহারানির নিকট কোনরূপ জবাবদিহি নিষ্প্রয়োজন...
-আপনি তো কেবলমাত্র রাজভৃত্য বীরদত্ত! পর্ণা-মায়ের প্রত্যেকটি অন্যায় আচরণকে আড়াল করার প্রচেষ্টায় প্রাণপাত করেন কোন গোপন উদ্দেশ্যে? আপনি তো প্রতিপদে আমার প্রতি তার উদাসীনতার জ্বলন্ত সাক্ষী! তা সত্ত্বেও তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন? নতমস্তকে কেবলমাত্র ভৃত্যের ন্যায় তার প্রত্যেকটি আদেশ পালনের পূর্বে, তার প্রতিটি অপকর্মের সমালোচনা করুন। আপনি রাজভৃত্য, এ বাক্য সত্য। সেই সঙ্গে আপনি এই মহান অমরাবতী রাজ্যের একজন দায়িত্বশীল প্রজা। অন্তত সেই দায়িত্বের কথা স্মরণপূর্বক মহারানির কর্মকাণ্ডের যথাযথ সমালোচনা করুন। সেই কার্যে যে কিঞ্চিৎ পৌরুষ প্রয়োজন, বোধ করি তা এখনো আপনি আপনার মহামান্য রানির পদতলে বিসর্জন...
-শৈলজা! আমি তোমার শিক্ষাগুরু! এমন তোমার স্পর্ধা! আমার সঙ্গে বার্তালাভকালে তোমার এমন নিম্নরুচিকর বাচনভঙ্গি...
-চিত্রা রানি হওয়ার যোগ্য নয় বীরদত্ত। এ সত্য বাক্য স্বীকার করার সৎ সাহস আপনার নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে এই মহান অমরাবতীর রাজসিংহাসন লাভ করতে পারবে না। আমার সঙ্গে তাকে সম্মুখ সমরে উপনীত হতেই হবে।
-যদি তাও হয়, চিত্রা জয়লাভ করবেই! আমি তোমার শুভাকাঙ্খী শৈল। এ অন্যায় চিন্তা মন হতে পরিত্যাগ করো...
তীক্ষ্ণ হাসি গোপন করে শৈলজা বলল,
-রাজপরিবারের নিকট আপন মস্তক আপনি বহুকাল পূর্বেই বিসর্জন দিয়েছেন, এ বাক্য আমি বহুপূর্বেই অবগত। তবে সেই সঙ্গে আপন মেরুদণ্ডখানিই যে রাজদরবারে গচ্ছিত রেখেছেন, এ সত্য আজ উপলব্ধি করলাম বীরদত্ত! শুভ্রকে শুভ্র এবং ধূসরকে ধূসর চিহ্নিত করার ন্যায় সৎ সাহসও আপনি হারিয়েছেন দেখছি। জীবন হতে ষোল বৎসরকাল হেলায় হারিয়েছে ওই নারী। আমিই এই রাজসিংহাসনের যোগ্য। নিজেকে সেইরূপে এ যাবৎকাল প্রস্তুত করেছি আমি। রাজসিংহাসন লাভের জন্য আমি আপন প্রাণত্যাগ করতে পারি, আবার একইরূপে নৃশংসভাবে মৃত্যুলীলায় মেতে উঠতে পারি। যথাসময়ে আপনিও তার প্রমাণ পাবেন বীরদত্ত। আপনি যথার্থই বলেছেন। আপনি কেবলমাত্র আমার শিক্ষাগুরু। তবে পরম মিত্র এবং হিতৈষী চিত্রার। তাই আমি কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রদানের জন্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আপনি আমার জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের পথপ্রদর্শক হওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেন না। করলেও, আপনার সকল প্রকার প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। এক অবোধ বালিকার ন্যায় সরল চিত্রার মন। তার মনে রাজনীতি, কূটনীতি ও প্রখর রণনীতির কোন স্থান নেই। রাজ অন্দরমহলে সংগীতচর্চা ও নৃত্যকলা পরিবেশনপূর্বক সকলের মনোরঞ্জনের কার্য রূপসী চিত্রা কর্তৃক সম্পন্ন হতে পারে, তবে রাজতন্ত্র পরিচালনা একপ্রকার অসম্ভব! সেইরূপ দূরদৃষ্টিলাভের শিক্ষা ও প্রচেষ্টা, দুটির কোনোটিই তার নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ রাজ্য আমার!
-তোমার মনে মহারানি ও রাজকন্যার প্রতি যে বিদ্বেষ, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এমতাবস্থায় যদি রানি ও রাজকন্যার কোনরূপ বিপদ তোমার দিক হতে ধেয়ে আসে, তবে সর্বাগ্রে আমার তরবারির সঙ্গেই তোমার সাক্ষাৎ ও তীব্র সংঘাত ঘটবে শৈল।
-অসম্ভব নয়, আর আপনিও এ সত্য জানেন বীরদত্ত, প্রশিক্ষণকালে আপনার রণকৌশল সম্পর্কে আমি উত্তমরূপে অবগত হয়েছি। পর্ণা মায়ের বক্তব্য কি আপনি অনুধাবনে অক্ষম? আপনাকে পরাস্তপূর্বক আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে।
-রাজপরিবার তোমাকে নবজীবন প্রদান করেছে শৈল। তোমার অভিধান হতে কি কৃতজ্ঞতা নামক শব্দ চিরতরে অদৃশ্য হয়েছে? আপন মনে এতখানি বিদ্বেষ...
-মৃত্যুর যে করাল থাবা শৈশবেই আমার সুকোমল দেহকে ছিন্নভিন্ন করেছে, যে মরণ যাতনা আমি সহ্য করেছি, পারবে আপনার সুখী রাজকন্যা তেমন যন্ত্রণা সহ্য করতে?
প্রবল তেজে আপন দেহের উপরিভাগ হতে বস্ত্র টেনে নামিয়ে ফেলল শৈল। তার দক্ষিণ হস্তে জ্বলজ্বল করছে তরবারির গভীর আঘাতের চিহ্ন। ক্ষত উপশমের পর দীর্ঘকাল অতীত হলেও, ক্ষতচিহ্ন আজও একইভাবে বিরাজ করছে ওই নারীর দেহে। অবনত মস্তকে শৈলজার দেহ বস্ত্র দ্বারা আবৃতপূর্বক, ওই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হল বীরদত্ত। শৈলজার দুই চক্ষু হতে অবিরাম বারিধারা নিঃসৃত হল। কম্পিত কণ্ঠে শৈলজা বলল,
-কঠিন সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নেবেন বীরদত্ত?
-তোমাকে দর্শনপূর্বক ইতিপূর্বে আমার মনে স্নেহের যে গোপন ফল্গুধারা প্রবাহিত হত, এখন সেই স্থানে ভীতির সঞ্চার হয় শৈল। আমি ভীত মহারানি পর্ণা ও রাজকন্যা চিত্রার কারণে। যে বিষবৃক্ষ মহারানি আপন হস্তে লালন করেছেন, সে তাঁরই পশ্চাতে ও অজান্তে বিষ উদ্গীরণকার্য শুরু করেছে। কিন্তু তোমার প্রতি স্নেহ ও ভরসার কারণে, তিনি আমার একটিও বাক্য বিশ্বাস করবেন না। এ রাজপরিবারের ভাঙ্গন অনভিপ্রেত শৈল, সকল অভিমান মন হতে দূর করো। চিত্রার রাজ্যাভিষেকের জন্য মনের অন্তঃস্থল হতে আনন্দ করো কন্যা!
-চিত্রা রাজপরিবারের যোগ্য উত্তরাধিকারিণী নয়, এই সহজ সত্য আপনিও রানির কর্ণকুহরে প্রবেশপূর্বক, আমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করুন বীরদত্ত। কেবলমাত্র চিত্রা রানির আপন গর্ভজাত সন্তান, সেই কারণে কোন অযোগ্যের ছায়া ও স্পর্শ পবিত্র অমরাবতীর রাজসিংহাসনের উপর কাম্য নয়।
বীরদত্ত কোন কঠিন বাক্য প্রকাশের কারণে আপন ওষ্ঠ ও অধর চালনার পূর্বেই দূর হতে অত্যন্ত সোহাগী ও মধুর কন্ঠ ভেসে এলো,
-শৈল! ও সই লো! বীরদত্ত? এই প্রকাশ্য দিবালোকে কোন স্থানে আত্মগোপন করলে তোমরা?
চিত্রার আন্তরিক আহ্বানে সিক্ত হল বীরদত্তর হৃদয়। মুখাবয়বের ক্রুর হাসি গোপনপূর্বক শৈলজা বলল,
-সই! আমি এই স্থানে! বীরদত্ত আপন অতীতের স্মৃতিচারণায় কিঞ্চিৎ ব্যস্ত ছিলেন সই। তার সঙ্গে আমিও গল্পকথায় মগ্ন হয়ে, এই ক্ষণে বেলা বয়ে যায়। আমাদের স্নানঘরে প্রবেশের সময় হল, আসছি সই!
মুখে মৃদুহাসি অঙ্কনপূর্বক প্রতিটি সোপান দ্রুতগতিতে পেরিয়ে বীরের দৃষ্টিপথ হতে অদৃশ্য হয়ে গেল শৈলজা। দুই অভিন্নহৃদয় সখীর নির্ভেজাল হাস্যরস ও আলাপচারিতা বীরদত্তের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও, মনে বিন্দুমাত্র আনন্দের উদ্রেক করল না। সহজাত ও সদাহস্যময় বীরদত্ত এই ক্ষণে অমরাবতীর ভবিষ্যৎ কল্পনাপূর্বক দুশ্চিন্তা ও গাম্ভীর্যের আবরণে বিলীন হয়ে গেল।
সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আপন কক্ষমধ্যে রক্তিম তরল দ্বারা একাগ্রচিত্তে আপনার পদযুগল রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত ছিলেন চিত্রা। পূর্ব পরিকল্পনানুসারে প্রহরী ও শৈলর গোপন অভিসন্ধি কর্তৃক শৈল আচম্বিতে প্রবেশ করল চিত্রার কক্ষে।
-সই লো?
-মা মহাভৈরবী!! শৈল তুমি? উফ! আমার কম্পিত হস্তের আকস্মিক স্পর্শে পাত্র বুঝি এই ক্ষণে ভূমিতে গড়িয়ে যায়!
-এতখানি একাগ্রতা কোন কার্য হেতু?
-এসো এসো। প্রহরী তোমার আগমনবার্তা জানান দিল না যে! নিদ্রামগ্ন বুঝি?
-তাকে আমিই নিষেধ করেছি। তোমার এই ভীত মুখখানি দেখার বাসনা চরিতার্থ করার স্বার্থেই... বিপদকালে রাজকুমারীর হস্তমধ্যে সর্বাগ্রে অস্ত্র শোভা পায় সই, এইসকল সাধারণ প্রসাধনী নয়!
-তুমি বড়ই দুষ্ট শৈল! তোমার হাতে তো সর্বদা তরবারি প্রস্তুত! তুমি-আমি পৃথক নই। আমরা এক এবং অভিন্ন! তুমি সর্বদা আমাকে সকল বিপদ হতে রক্ষা করবে, এ আমি ঠিক জানি। আমি অন্ধভাবে তোমাকে ভরসা করি। ও... সই লো, আমার রাঙা পা দু'খানি দেখ! সুন্দর?
-অতীব সুন্দর! কোন সুদর্শন রাজপুত্তুরের জন্য সন্ধ্যাকালে এমন শৃঙ্গার সই?
-মা মহাভৈরবীই জানেন, সে কোন রাজ্যের রাজপুত্তুর! কোন শুভলগ্নে এ রাজ্যে পদার্পন করবেন! মন বড় ব্যাকুল তার দর্শন হেতু!
চিত্রার একঢাল অবিন্যস্ত কেশরাশি পরিচর্যাপূর্বক শৈল বলল,
-রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পরই কোন সুদর্শন রাজপুত্তুর এসে তোমাকে বিবাহপূর্বক এ রাজ্যে আশ্রয় নেবে। তোমার এই মনোলোভা রূপের কাহিনি দিকে-দিকে প্রসারিত। সকল রাজপুত্তুর তোমাকে বিবাহের স্বার্থে কেবল আপন রাজ্য-রাজপাটই নয়, আপনার প্রাণও জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হবেন।
-তা হবেন!
-তোমার রূপের বড় অহংকার সই!
-যে মানুষের যা আছে, সে তো তার উপর অহংকার করবেই। এ তো অনায্য কিছু নয়। তুমি এমন রূপের অধিকারিণী হলে, তবে বুঝতে!
রাজকন্যার পদযুগল বড় যত্ন ও আন্তরিকতার সঙ্গে সুসজ্জিত করে দিল শৈল। স্বর্ণনির্মিত নূপুর ও রক্তিম তরলের স্পর্শে ওই দু'খানি চরণ সত্যই মনোলোভা হয়ে উঠেছে। এই চরণে না জানি কতশত রাজপুত্র আপনাকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হবেন! পর্ণা কর্তৃক প্রেরিত যাবতীয় স্বর্ণালংকারের সিংহভাগ আপন দেহে ধারণ করার পর, উচ্ছিষ্টের কিয়দংশ শৈলর পানে এগিয়ে দিলেন চিত্রা। আপন হস্তে প্রাণপ্রিয় সখীকে মনের মতো করে চিত্রা সাজালেন। অতঃপর শৈলজার চিবুক আপন হস্তদ্বারা স্পর্শপূর্বক বললেন,
-কে বলেছে তোমার রূপ নেই? এমন দু'খানি চক্ষু, পেলব গন্ডদেশ...
-আমি কোনকালেই এমন চিন্তা মনে ঠাঁই দিই না চিত্রা, যে আমার রূপ নেই! আমার বাহ্যিক রূপ নেই, আমি শ্রীহীন! এ বাক্য অবশ্যই সত্য! তবে আমার শিক্ষাদীক্ষা প্রতিনিয়ত আমার অন্তরের রূপকে জাগ্রত করে। কেবলমাত্র হৃদয়ের অন্তঃস্থল দর্শন হেতু, সত্য অনুসন্ধানের ন্যায় দৃষ্টি আবশ্যক।
-এ বড় সহজ সত্য কথা! তুমি বড় সুন্দর! আমার মন পূর্বরাত হতে বড় উদাস শৈল! তুমি জানো, আমি পূর্বরাতের তৃতীয় প্রহরে মায়াকাননের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম।
আপন কক্ষ হতে অন্ধকারের আবরণে নিমজ্জিত মায়াকাননের পানে দৃষ্টিপাত করলেন চিত্রা। ভীত শৈল সেই স্থানে পৌঁছে চমৎকৃত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-পর্ণা-মা জানেন এ সংবাদ?
-না। তবে বীরদত্ত সকলই অবগত। আমার মন মায়াকাননের গভীর সৌন্দর্যে বারংবার অবগাহন করতে চায় শৈল। কিন্তু মা আপন রাজ্যে কেন যে আমাকে প্রবেশাধিকার দিতে চরমতম আপত্তি করেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি আজও অসমর্থ। বীরদত্ত হতে কত গল্পকথা শুনেছি। ওই মায়াকাননের শ্বাপদসংকুল চিরহরিৎ বনানীর কথা, অসংখ্য অপরিচিত বৃক্ষরাজির মাঝে জলে পরিপূর্ণ টলটলে চিত্রের ন্যায় সুন্দর এক দীঘির কথা। দীঘির উপরিভাগে অজস্র শতদল কি আজও প্রস্ফুটিত হয় শৈল? আমি ঐ দৃশ্য চর্মচক্ষে অবলোকন করতে ইচ্ছুক! আমার এ সমগ্র জীবনকাল বুঝি অসূর্যম্পশ্যারূপে অতিবাহিত হত। তবে যে কয় বৎসরকাল যাবৎ আমি সূর্যালোক ব্যতীত জীবনযাপন করেছি, সেই সময়কালের কথা সময়ে-অসময়ে স্মৃতিতে ভিড় করে শৈল। বৃন্দা-মা, উত্তরা-মা, ফাল্গুনী-মা, সকলের সঙ্গে পুনর্মিলনের বড় সাধ জাগে মনে। তোমার স্মৃতিপটে মায়াকাননের সৌন্দর্যের ছবি ভেসে ওঠে না শৈল?
-শৈশবের সকল স্মৃতি বড় অস্পষ্ট চিত্রা। সূর্যালোকের ভয়ে ভীত তুমি তখন মায়াকাননের রাজপ্রাসাদে বন্দিনি। আমি উত্তরা-মায়ের কোলে চেপে শম্বর দম্পতি পরিদর্শনে সেনা ছাউনি প্রান্তে পৌঁছে যেতাম। ফাল্গুনী-মা সেই ক্ষণে তোমার ক্রন্দনধ্বনি নিয়ন্ত্রণ হেতু, সুগন্ধী পুষ্পমাল্য দ্বারা তোমাকে নবরূপে সজ্জিত করে তুলতেন। ফাল্গুনী-মা সমস্ত দিবস ব্যাপী আমাদের সঙ্গেই অবসর যাপন করতেন। কাঞ্চনগড় হতে বৃন্দা-মায়ের আগমনে আমরা খেলার সঙ্গী পেয়ে, সীমাহীন আনন্দে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় অন্দরমহলের সবস্থানে অবাধ বিচরণ করতাম।
-যথার্থই শৈল! সই লো, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের সর্বাপেক্ষা সুন্দর সময় ওই দশ বৎসরকাল, যা আমি মায়াকাননে যাপন করেছি। কিন্তু পূর্বশ্রুত মায়াকাননের ওই অপার্থিব সৌন্দর্যে আকণ্ঠ অবগাহন করা হল না যে! এই ক্ষণে আমার নিকট পার্শ্ববর্তী রাজ্য মায়াকাননও যে দুরতিক্রম্য সই...
প্রহরী কর্তৃক বীরদত্তের আগমনের সংবাদ ভেসে এলো চিত্রার কক্ষদ্বার হতে। দুই সখীর সান্ধ্য বার্তালাভ ওই ক্ষণে স্থগিত রইল। তারা পরস্পরের হাত ধরে ফিরলেন কক্ষমধ্যে।
-বলো বীরদত্ত? কী সংবাদ?
-মহারানি পর্ণার নির্দেশ, রাজ্যাভিষেকের পুণ্যলগ্নের পূর্বে আপনি এই ক্ষণে আপনার তরবারি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে পারেন। সেই পুণ্যকার্য হেতু...
-বীরদত্ত?
-বলুন চিত্রা?
-আমি পিতার তরবারিকে আপন ব্যক্তিগত ব্যবহার হেতু গ্রহণ করতে পারি না? ওই যে, মায়ের কক্ষে পিতার সুবৃহৎ তৈলচিত্রের সম্মুখে রক্তিম মখমলের উপর সিঁদুর-চন্দনচর্চিত যে সুবিশাল তরবারি মায়ের কক্ষের শোভা বহুলাংশে বর্ধন করছে, অসংখ্য রাত্রি মা ওই তরবারির পানে চেয়ে বিনিদ্র নিশিযাপন করছে... ওই তরবারিটিকে আমি আপন ললাটে স্পর্শপূর্বক আপনার নিকটে রাখার ইচ্ছা পোষণ করি বীরদত্ত। ওই তরবারিই আমার চাই।
-না কন্যা! আমি যদি মহারানি পর্ণা ও তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অবগত হয়ে থাকি, আর আমার ধারণার মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকে, তবে এই অমরাবতী রাজ্য এবং ওই প্রাণপ্রিয় তরবারিটি, রানি আপন জীবদ্দশায় দান করবেন না। রাজ্যের উত্তরসূরী আপনি। সেই হেতু রাজসিংহাসন ভবিষ্যতে আপনার নিকটেই আসবে। তবে ওই তরবারি?
মৃদুহাস্যে বীরদত্ত বলল,
-না! আপনাকেও না। এমন অসম্ভব ইচ্ছা এই ক্ষণে পরিত্যাগ করুন কন্যা!
কপট অভিমান প্রদর্শনকালে বীরদত্ত হতে মুখ ফেরালেন চিত্রা। বললেন,
-শৈলর ন্যায় তুমিও বড় দুষ্ট বীরদত্ত! তোমার সঙ্গে তিন দিবসকালব্যাপী বার্তালাভ বন্ধ! আমার দৃষ্টির সম্মুখ হতে দূর হয়ে যাও!
-বেশ! এই পরম প্রিয় মিত্রের কিঞ্চিৎ বেয়াদপি মার্জনা করবেন। বার্তালাভের বড় বিশেষ প্রয়োজন নেই, তবে মহারানির নির্দেশ যে পালন করতেই হবে কন্যা!
-কী নির্দেশ?
-এই ক্ষণে আপনি আমার সঙ্গে মায়াকানন ও অমরাবতীর সীমান্তে অস্ত্রাগারের যে বিপুল সম্ভার রয়েছে, সেই স্থান হতে সর্বসেরা তরবারিটি নিজের জন্য পছন্দ করবেন। আর ক্ষত্রিয় কন্যার তরবারি নির্বাচনের ন্যায় সেই পবিত্র কার্যে আমি আপনার সহায়তা করব। এ আমার পরম সৌভাগ্য! আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন কন্যা। আমি কিছু সময় পরে...
-মায়াকাননের সীমান্তে? অর্থাৎ যে স্থানে সকল যাযাবর গোষ্ঠী, স্থানীয় প্রজা, পরিযায়ী শ্রমিক এবং উদ্বাস্তুদের মেলা বসে! ওই সুবিশাল প্রাঙ্গনে?
-আমাদের গন্তব্য ওই প্রাঙ্গন পেরিয়ে। তবে ওই প্রাঙ্গনের মধ্য হতেই আমাদের পথ।
-আমি মৃত্তিকা নির্মিত অলংকার ক্রয়ের ইচ্ছা রাখি। সই চলো...
-না! শৈল যাবে না। কেবল আপনি ও আমি। তরবারি নির্বাচনকালে কেবলমাত্র সেনানায়ক আপনার সঙ্গে থাকবে, মহারানির এমনই ইচ্ছা!
চিত্রার সকল উৎসাহ মুহূর্তে অস্তমিত হল মলিন মুখাবয়বের অন্তরালে। মৃদুস্বরে ও আহ্বান করল,
-সই লো! মায়ের আদেশ!
-তুমি সানন্দে যাও চিত্রা। আমি এই স্থানে তোমার নূতন তরবারি দর্শন হেতু অপেক্ষায় রইলাম। সম্ভব হলে ওই মিলনমেলা প্রাঙ্গন হতে আমার জন্য একখানি ঝুটো গজমোতির অলংকার উপহারস্বরূপ অবশ্যই এনো। আমার বড় ভালো লাগবে।
-কিঞ্চিৎ উপহারেই তুমি সন্তুষ্ট! এই কারণেই তোমাকে আমি এত ভালোবাসি সই।
-তুমি প্রস্তুত হও, আমি এই ক্ষণে আপন কক্ষে প্রস্থান করি।
চিত্রার কক্ষ হতে শৈলজার প্রস্থানের পর বীরদত্ত মৃদুহাস্যে চিত্রাকে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় গ্রহণ করল। দেহ হতে কিছু স্বর্ণালংকারের ভার লাঘবপূর্বক, সামান্য প্রসাধন ও অলংকারে নিজেকে সজ্জিত করে, একটি উত্তরীয় হতে কিছু অংশ ছিন্ন করে আপন মুখমণ্ডলের কিয়দংশ আবৃত করলেন চিত্রা। কেবল দীঘল দুই চক্ষু রইল অবগুণ্ঠনমুক্ত। বীরদত্ত চিত্রার কক্ষ হতে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মৃদু নারীকণ্ঠের আহ্বানে থমকে দাঁড়াল। অন্দরমহলের আলো-ছায়াঘেরা পরিবেশে বীরদত্ত দেখল, শৈলজা একটি প্রস্তরমূর্তির আড়াল হতে বেরিয়ে বীরদত্তর সম্মুখে উপস্থিত হল। প্রবল শ্লেষমিশ্রিত বাক্য নির্গত হল শৈলজার কন্ঠ হতে,
-আপনি মিথ্যা বলছেন বীরদত্ত। পর্ণা-মা আমাকে চিত্রার সহগামিনী হতে কখনোই নিষেধ করেননি। এ সকলই আপনার মনগড়া মিথ্যা বাক্য! আপনি চিত্রা হতে আমার দূরত্ব বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে এই মিথ্যা কথার আশ্রয় নিয়েছেন। এইরূপে আপনি আমার ষড়যন্ত্র হতে চিত্রাকে রক্ষা করবেন!!
-আমরণ!
বীরদত্ত দ্বিতীয় কোন কটু বাক্যের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। আপন মনে অন্দরমহল হতে প্রস্থান করে চিত্রাঙ্গদার প্রাণপ্রিয় অশ্ব সারঙ্গীকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করল।
(ক্রমশ....)
চিত্র : সংগৃহীত



 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট