প্রজাপতির মৃত্যু
মন প্রজাপতি
প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস
তৃতীয় পর্ব
ঘরে ঢুকে পদ্ম দেখল, দুই ছেলে-মেয়ের জ্বর। পদ্মর সাময়িক অনুপস্থিতিতে বড় ছেলে টুকাই আর ওদের বাবা একেবারে দিশেহারা। দুটো মাত্র ঘর আর একটা বারান্দা সম্বল পদ্মর। কলঘর উঠোনের এককোণে। মাথার ওপর টালির চাল দিয়ে প্রতি বর্ষায় জল পড়ে। যতবার ভেবেছে চালটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, ততবারই সর্বভূক সংসার গিলে খেয়েছে জমানো সব টাকা। দুটো ঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড। ঘরণীর অনুপস্থিতিতে সংসার করতে গিয়ে রান্নার স্টোভ থেকে শুরু করে বালিশ বিছানা, বাসনপত্র সব ছড়িয়ে ফেলেছে দুলাল। ভাঙাচোরা ঘরের একপ্রান্তে ইঁট ঠেকিয়ে রাখা তক্তপোষের ওপর নিজের জন্য একটু জায়গা আদায় করে নিল সুরঞ্জনা। পূর্ণা একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দেহে ভীষণ রকম তাপপ্রবাহের কারণে ছোটুর চোখে ঘুম নেই। একটুকরো কাপড় ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল দুলাল। ও একটু পর উঠে এসে বসল পদ্মর পাশে। ট্রাঙ্ক থেকে কিছু টাকা বের করে পদ্মর হাতে গুঁজে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিয়ে ও বলল,
-এটা দিয়ে ক'দিন টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নিও। এখন কাজের বাড়ি যেতে হবে না।
-কোথায় পেলে টাকা?
-মনসুরের থেকে সুদে ধার নিয়েছি।
-আবার দেনা? বলি শোধ করবে কে শুনি?
ভারী হয়ে এলো পদ্মর গলা। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গালে। মৃদুস্বরে ও বলল,
-না খেয়ে পেটে দড়ি দে থাকলেও আর দেনা করতে মন করে না। দেনার দায়ে আমার গোটা জেবনটাই শেষ হয়ে গেল। এর থেকে টাকা নিয়ে ওরে দাও, ওর থেকে নিয়ে এরে! আমি আর পারি না গো!
-মা রাতে কী রান্না হবে? চাল নেই! ডাল অল্প রয়েছে। চুপড়িতে তিনটে আলু পড়ে রয়েছে। ঠাকমা বলছে খিদা লাগে।
দরজার দিকে চেয়ে পদ্ম দেখল, বড় ছেলে টুকাই এসে হাজির হয়েছে। এই কয়েকদিনে কী বড় বেশি লম্বা হয়ে গেছে টুকাই! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছেলের মাথা প্রায় দরজার ওপর প্রান্তে ঠেকে গেছে। গলা ভাঙতে শুরু করেছে টুকাইয়ের। কোন এক সুনিপুণ চিত্রশিল্পী তুলির নিখুঁত টানে বালকের ঠোঁটের ওপর গোঁফের সূক্ষ্ণ রেখা টেনে ঘোষণা করছেন শৈশবের সমাপ্তি। পদ্ম ঘরে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। দুই ছেলে মেয়ে জ্বরে কাহিল। পিসি শাশুড়িও বিছানা হাতড়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে ছোট মেয়ের গায়ে মাথায় কম্পিত হাত বুলিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছে। দুলাল এখন মেয়েকেই কোলে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু টুকাই একবারও বোনের ধারেকাছে এগোয়নি। উঁকি মেরে বোনের মুখটাও দেখতে আসেনি। পদ্ম বলে উঠল,
-শুধু নেই আর নেই!
-তা না থাকলে কী বলব মা? আছে!
-টুকাই এমনধারা কথা বলছিস কেন তুই? বোনকে একবারও কোলে নিয়েছিস?
-রাতে কী রান্না হবে বলো? ঘরে কিছু খাবার জুটবে নাকি খাবার লোক বেড়ে যাওয়ার জন্য আমরা না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে নতুন মানুষকে খাওয়াব?
ছেলের কথা শুনে বাক্যহারা হল পদ্ম। দুলাল বড় নির্বিবাদী শান্ত স্বভাবের মানুষ। সাংসারিক কোন জটিলতার উত্তর সে দিতে পারে না। সে কেবল জানে এই ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবনটাও শেষ করতে হবে। টুকাই সরকারি স্কুলে পড়ে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেকটাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য কোথা থেকে কার একটা ভাঙা সাইকেল জুটিয়ে নিয়েছে সে। দুলাল নতুন সাইকেল কেনার জন্য ছেলেকে টাকা দিতে পারেনি। ছেলের অনেক প্রয়োজনই মেটাতে অক্ষম সে। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষকের মুখে মুখে ফেরে টুকাইয়ের মেধা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। কত শিক্ষক বেতনের আশা না করেই স্বেচ্ছায় পড়ান টুকাইকে। ছেলেটা বড় কম কথা বলে। সারাদিন কেবল পড়াশোনা করে। প্রাণপণে এই ছেলেটিকে তৈরি করার চেষ্টা করছে দুলাল ও পদ্ম। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো টুকাই। সেই কারণে দুলাল বড় ছেলেকে সমীহ ও অপার শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রত্যেক বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর ওর স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে, তারা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে দুলালের সঙ্গে কত সম্মান দিয়ে কথা বলে। বাবার এই যে বিরাট সম্মান প্রাপ্তি, সকলই তো টুকাইয়ের জন্য। দুলাল প্রায় লেখাপড়া জানে না বললেই চলে। সেই কারণে ছেলের এই উন্নতি দেখে আনন্দে দুলালের দু'চোখ ভাসে। ছেলের এমন কথায় একটু কষ্ট পেলেও দুলাল অস্বীকার করতে পারল না, যে সত্যিই এতবড় পরিবারের অন্ন সংস্থানের ক্ষমতা তার নেই। ছেলের কথায় অক্ষম জন্মদাতা আঘাত পেলেও, চোখে জল নিয়ে চুপ করে রইল। পদ্ম আঁচল থেকে নার্সদিদির দেওয়া টাকা থেকে কিছু টাকা বের করে ছেলের হাতে দিয়ে বলল,
-ডিম, চাল আর আলু নে আয়। ডিমের ঝোল ভাত করে দিচ্ছি। পেটপুরে খাবি তুই। আমি বেঁচে থাকতে তোর ভাগেরটা বোন খেয়ে নেবে না। যতদিন আমার গতর আছে, আমি আমার অক্ত বিককিরি করে তোদের ভরপেট ভাত খাওয়াব।
-মা আমি...
-যা! আর কিছু শুনতে চাই না। দূর হয়ে যা!
টুকাই বেরিয়ে গেলে কাঁদতে কাঁদতে পদ্ম বলল,
-শুনলে ছেলের কথা? এই বয়সে এসে মেয়ে বিয়োলাম! তোমার জন্য নিজের পেটের ব্যাটার কাছে আমাকে এটাও শুনতে হল। এখনো গতর আছে, হাতে পা চলছে। খেটে খাচ্ছি। তাতেই ছেলের মুখের বুলি এই! এই ছেলে আমাদের বুড়ো বয়সে ভাত দেবে, তুমি সেই চিন্তা করো?
-টুকাই কত পড়ালেখা করে! ও বড়মানুষ হবে! সারাদিন খালি পেটে পড়ে। ওকে একটু ভালো কিছু খেতে দিতে পারি না আমরা। ছোটু আর পূর্ণার জন্য কত করল এই ক'দিন। তুমি তো সেটা চোখে দেখোনি! খিদের জন্য এখন ওর মাথা ঠিক নেই পদ্ম। ভুল করে বলে ফেলেছে। ব্যাটার কথা মনে নিয়ে কষ্ট পেতে নেই।
-নিজেদেরই খাওয়া জোটে না। তাও এই আকালের সংসারে রেখে তোমার পিসিরে ভাত দিচ্ছি। ঠাকুর তুমি দেখছ তো সব? একটা পেরানীরেও খালি পেটে ঘুমুতে দিই না! আমি নিজে না খেয়ে সবারে করছি। জেবনের শেষটায় যেন এই দুই বুড়ো বুড়ি খিদার জ্বালায় পথেঘাটে না মরি! দুটো ব্যাটা বিয়েছি। দুই ব্যাটার বউ যেন দু'বেলা দুটো ভাত দেয়।
একদৃষ্টে ঘুমন্ত সুরঞ্জনার দিকে চেয়ে কপাল চাপড়ে পদ্ম বলে উঠল,
-সব এই আবাগির জন্য! এর জন্যই এত কথা শুনতে হল আমারে...
ততক্ষণে বাবার কোলের উষ্ণতায় আবিষ্ট হয়ে গভীর ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে সুরঞ্জনা। মায়ের কুকথা তাকে স্পর্শও করতে পারল না।
সুরঞ্জনার জন্মের পর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। টুকাই ছোট বোনকে পছন্দ না করলেও, ছোটু সারাদিন বোনকে নিয়েই আহ্লাদে আটখানা। পড়াশোনায় একেবারে মন নেই পদ্মর ছোট ছেলের। মেয়েটা সেই তুলনায় লেখাপড়ায় ভালো। টুকাই আর পূর্ণাকে নিয়ে দুলালের অনেক আশা, তারা একদিন অনেক বড় হবে। বড় ছেলের জন্য প্রাণপাত করে সে। পদ্মর শরীরটাও ভাঙছে। এবার হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ঐ লোহার মতো নীরোগ শরীরে একের পর এক রোগ বালাই লেগেই আছে। সুরঞ্জনার জন্মের ধকল এই বয়সে এসে পদ্ম আর নিতে পারেনি। বাবুদের বাড়ির কাজে প্রায়ই কামাই হয়ে যায়। তিনটে বাড়ির কাজ ইতিমধ্যেই চলে গেছে। তারা করিৎকর্মা নতুন লোক পেয়ে গেছে। ফলে পদ্মর সংসার প্রায় অচল বলা চলে। সংসারের ভাবগতিক দেখে বৃদ্ধা পিসি শাশুড়িরও আজকাল আর খিদে লাগে না। বেশ কয়েকদিন বাড়িতে বসে থাকার পর একদিন সকালে দুলাল হন্তদন্ত হয়ে এসে উঠোনে পা রেখে বলে উঠল,
-ও পদ্ম, পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে তাড়াতাড়ি দুটো পষ্টিভাত দাও দিকিনি! একটা কাজের খবর আছে।
এখন পদ্ম সকালে কাজে বেরোয় না। বিকেলে দুটো ফ্ল্যাটে রান্নার কাজে যায়। তারা সবাই অফিস বাবু। খুব সকালে স্বামী-স্ত্রী অফিসে বেরিয়ে যায়। তাই রান্নার যাবতীয় কাজ রাতেই করতে হয়। আর একটা ফ্ল্যাটে রাতের রুটি তরকারি করে সকালের রান্নার জোগাড়টা করে আসতে হয়। দুই ফ্ল্যাটেই সপ্তাহান্তে শনি আর রবিবার গিয়ে ঘর মোছা, সারা সপ্তাহব্যাপী ব্যবহৃত যাবতীয় জামাকাপড় কাচা-ধোয়া করে আসে পদ্ম। বৌদিরা বড় অফিসে চাকরি করে বলে নিজেরা সংসারে তেমন সময় দিতে পারে না। তাই এই ফ্ল্যাট দুটোতে পদ্ম অনেক বাড়তি কাজ পায়। ফলে ওর মাইনে ছাড়াও কিছু উপরি পাওনা আছে। বকশিশও কিছু কম নয়। কিন্তু ওর একার ওপর তো গোটা সংসার আর চলে না। টাকা-পয়সার জন্য দুশ্চিন্তা করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে পদ্ম। খুব ক্লান্ত লাগে আজকাল। দুলালের ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ও বলল,
-কোথায় কাজ গো?
-ওই যে গো, নবীন পল্লীতে ডাক্তারবাবুর যে ইস্কুলবাড়ি আছে, ওখেনে। ইস্কুলের সামনে অনেকটা বাড়তি জমি আছে না? দিদিমণি মনসুরকে ওই জমিটা পরিষ্কার করতে ডেকেছে। বিড়ি টানতে টানতে মনসুর বলল, মন করে দিদিমণি ওই জমিতে নতুন স্কুলঘর করবে। আমি বললাম, আমারেও নে চল ভাই। হাতে একদম টাকা নাই। অত বড়লোক মানুষ। তোরে টাকা দিলে আমাকেও ক'টা টাকা দিতে পারবে। দু'জন যাব। ঝপ করে দুটো ভাত দাও তো। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে যাই। কাজ করলে তবে তো দুটো টাকা আসবে। টুকাইয়ের টেস পেপার না কি বই যেন কিনতে হবে, কতদিন ধরে ছেলেটা বলছে! আজ টাকা পেলে আগে ওর হাতে বই কেনার টাকা দেব।
ভাতগুলো নরম হয়ে বেশ গলে গেছে। ভাতের ওপর একটু লবণ আর কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল ছড়িয়ে ওগুলো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল দুলাল। পিঁড়ির ওপর বসে পদ্ম বলে উঠল,
-হ্যাঁ গো, আমার জন্য ওই ইস্কুলে কোন কাজ পাওয়া যায়? খবর নাও না একটু! অনেক বড় ইস্কুল শুনেছি। দুটো ফেলাটের কাজের টাকা দে তো আর চলছে না।
-মঙ্গলার মাকে সেদিন কাজ দেখে দেওয়ার কথা বললে যে, তার কী হল?
-কেউ নিজে কাজ না করে আমাকে দেবে? খিদে সবার পেটেই আছে তো নাকি! আমি কাউর পেটে লাথি মেরে কাজ ভাঙিয়ে নিজে ঢুকতে চাই না। তারপর বাড়ি বয়ে কোমর বেঁধে কোঁদল করতে আসবে। টুকাই এসব পছন্দ করে না, জানোই তো!
-আমি আজ কাজে যাই। দেখছি। পিসির শরীল এখন কেমন? সকালে শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল তো।
-ঠিক আছে। ও বাড়ি থেকে তোমার দাদা এসেছিল একটু আগে!
-কী বলছে?
-ওই দাওয়ায় বসে মুখ লচানো আলগা পিরিত দেখালো। গলা ছেড়ে ডাক দিল, ও পিসি ভালো আছ? এক বাস্ক সন্দেশ দিয়ে গেছে। নাও আর কী! কাল থেকে পেটে ভাত নাই, খালি পেটে বসে বসে এবার দাদার আনা দামি সন্দেশই গেলো তোমরা!
-ও পিসিই খাক! ধরার দরকার নেই।
-দাদা চলে যাওয়ার পর পিসি ও সন্দেশের বাস্ক ছুঁড়ে ফেলেছে।
-কী বলছ?
-হু! আমিই কুড়িয়ে আনলাম। সন্ধেকালে দেব মুড়ি দে। ক'টাদিন আর বাঁচবে! খাক। আমরা তো আর ভালোমন্দ কিনে দিতে পারি না। তোমাকে আর দুটো ভাত দেব?
-না। টুকাই খেয়ে ইস্কুলে যাবে তো! ওর জন্য ভাত আলাদা করে তুলে রাখো। ছোটু আর পূর্ণা ইস্কুলে খেয়ে নেবে। কিন্তু তুমি আর পিসি কী খাবে?
-আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমরা মেয়েমানুষ, আমাদের আবার খাওয়া! এবেলা কিছু একটু ফুটিয়ে নেব। বিকেলে বৌদির ফেলাট থেকে খাবার আনব তো! ওবেলা খাব।
চোখের জল চেপে দুলাল বলল,
-আমার খিদেটা ঐ একটু মরলেই হবে। বেশি লাগবে না। টুকাইকে আমার ভাগের ভাতটা দিও।
থালাটা তুলে নিয়ে কলঘরে চলে গেল ব্রজদুলাল। সুন্দর একটি সকাল। মনসুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লুঙ্গিটা কোমরে বেঁধে রোদে পুড়ে ঘর্মাক্ত দেহে কাজ করছিল দুলাল। একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় কানে গোঁজা বিড়িটা নামিয়ে মনসুর দুটো সুখটান দিচ্ছিল, এমন সময় একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে একটি ছেলের হাত ধরে স্কুলে এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে প্রবেশদ্বারের দারোয়ান থেকে শুরু করে সকলেই কেমন যেন সমীহ করে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মনসুরের দিকে চাইল দুলাল। মনসুর বলল,
-ইস্কুলের সবচে বড় দিদিমণি আর তার একমাত্তর ছেলে। এ হল ডাক্তারবাবুর নাতি। সবাই একডাকে চেনে এরে। বড় ভালো ছেলে।
-এটাই বড় দিদিমণি?
-হ্যাঁ, দাঁড়াও দুলালদা, তোমার কথা দিদিমণিরে একটু বলে আসি।
জ্বলন্ত বিড়িটা দুলালের হাতে ধরিয়ে মনসুর ছুটল দীপমালার কাছে। বলল,
-দিদিমণি, ভালো আছেন?
-হ্যাঁ মনসুর। তুমি ভালো ভাই?
-হ্যাঁ দিদিমণি। অনেকটা বড় জায়গা তো। তাই একজনরে সঙ্গে নে এসেছি। আমার একটু সুবিধা হবে।
-ওহ আচ্ছা। তা ঠিক আছে, ভালোই তো! কাজ করো তোমরা। কাজ হয়ে গেলে দু'জনেই আমার অফিসে দেখা করে যেও। কেমন!
-আচ্ছা দিদিমণি।
-দিদিমণি?
-হ্যাঁ বলুন?
-আপনের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?
দুলাল এসে দাঁড়িয়েছে মনসুরের পিছনে। ডানহাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চেয়ে দীপমালা বলে উঠল,
-কী ব্যাপারে বলুন তো?
-এই ইস্কুলে মেয়েমানুষের জন্য কোন কাজ, মানে কতরকম তো কাজ থাকে। আমার বউয়ের জন্য...
-এখন আমার একটু তাড়া আছে দাদা। অনির ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আপনি বরং কাজ সেরে নিন। তারপর আমার অফিসে বসে ধীরেসুস্থে কথা হবে।
-আচ্ছা দিদিমণি।
স্কুলের ঘন্টার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ছেলের হাত ধরে চলে গেল দীপমালা। বিকেলে যখন দীপমালা নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল, অনির্ণেয় অফিসের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে বইয়ের পাতা উল্টে রূপকথার জগতে ডুব দিয়েছে। দুলাল আর মনসুর পৌঁছল দীপমালার অফিসে। মনসুর নিজের প্রাপ্য টাকা বুঝে নিয়ে চলে গেলেও, দুলাল বাইরে বসে রইল। অফিস ঘরে তালা দিয়ে কয়েকটা ফাইল সঙ্গে নিয়ে অনির হাত ধরে বেরোল দীপমালা। দুলাল উঠে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে বলল,
-দিদিমণি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন? আপনি তখন কী যেন বলছিলেন!
-আমার বউয়ের জন্য এই ইস্কুলবাড়িতে যদি কোন কাজ থাকে.... ছোট কাজ হলেও চলবে।
-আপনি কী কাজ করেন? কোথায় থাকেন?
-আমার বাড়ি মোছলমান পাড়ার কাছেই। মনসুরের তিনটে বাড়ি পর। আমি আগে চটকলে কাজ করতাম দিদিমণি। ওখেনে কাজের সময় হাতে চোট পেয়েছিলাম। তারপর মালিক কিছু টাকা দে বসিয়ে দিল। পরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে হয়ে কাজ করেছিলাম কয়েক মাস। কিন্তু সিমেন্ট বালির বস্তা চাগাতে পারি নে। হাতটায় কেমন যেন জোর পাই না। ইঁট বইতে গেলে ইঁট পড়ে যায়। এখন মোছলমান পাড়ার মোড়ে যে বাজার আছে, ওখেনে ফল পাকুড় বেচি। আর যদি কেউ এদিক ওদিক কাজে ডাকে, ছুটে যাই। বউটা বাবুর বাড়ি কাজ করত। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর কাজগুলো ছেড়ে যায়। আমার সংসার চলে না দিদিমণি। চারটে ছেলেমেয়ে। একটা বুড়ি পিসি আছে। পেটপুরে সবকটারে দুটো ভাত দিতে পারি না। আপনার ইস্কুলে যদি...
-আমি একটা বিল্ডিং করছি। ঐদিকের মাঠে। যেটা আপনারা পরিষ্কার করছেন। এখন প্রি প্রাইমারি সেকশন থেকে টেন পর্যন্ত আছে। এবার একবারে টুয়েলভ পর্যন্ত করছি। দেখুন দাদা, আপনার নামটা কী?
-দুলাল দিদিমণি! ব্রজদুলাল সর্দার।
-দেখুন দুলাল দা...
-আমাকে আপনি বলবেন না দিদিমণি। আপনি কত বড় মানুষ, আমি খুব ছোট...
-শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে বড় ছোট বিচার করা যায় না। আপনিও খেটে খাচ্ছেন। আমিও। যার যার জীবনযুদ্ধে সেই যোদ্ধা। যাইহোক, আপনি চাইছেন না যখন ঠিক আছে। দেখো দুলাল দা, আমি সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত থাকি। এ আমার ছেলে, অনির্ণেয়। আমি ওকেও ঠিকমতো টাইম দিতে পারি না। কখন ওর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, এখানেই আমার অফিসে ইউনিফর্ম পরে বসে আছে। আমি বেরোব, তারপর আমার সঙ্গে ও বাড়ি যাবে। আমার কাজের লোকটা প্রায়ই কামাই করে। ছেলের জন্য ওকে ভরসা করতে পারি না। তুমি মনসুরের সঙ্গে এসেছ, তাই তোমাকে বা তোমার পরিবারকে বিশ্বাস করতে পারি। এই পুরনো বিল্ডিং হওয়ার আগে থেকে আমি ওকে চিনি। মনসুরের বাবা আমার বাবার পেশেন্ট ছিলেন। তা তোমার বউ কী আমার ছেলেকে একটু দেখাশোনা করতে পারবে? এই ধরো, স্কুল থেকে ফেরার পর অনি একটু ফ্রেশ হলে ওকে কিছু খেতে দেওয়া, আমি বাড়ি ফেরার পর ভীষণ টায়ার্ড হয়ে থাকি। তাই ওর রাতের খাবারটা করে রাখা। আর যদি সকালের রান্নাটাও একটু করে দিত, আমি আর একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আসতে পারতাম। স্কুলের পাশে ওটাই আমার বাড়ি। তোমার বউ রাজি থাকলে আজ সন্ধেবেলা তাকে নিয়ে তুমি আমার বাড়ি এসো। সে কাজকর্ম সব দেখেশুনে বুঝে নেবে। টাকা পয়সা নিয়েও কথা বলে যাক। তারপর কাল থেকেই না হয় শুরু করুক। এই ভাঙা মাসটার জন্য আমি অর্ধেক টাকাই দেব।
দুর্বলদেহী দুলালের একটু আগেও খিদের জন্য পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। এখন ও খিদে তৃষ্ণা সব ভুলে গেল। আনন্দে ওর বুকের মধ্যে শত শত প্রজাপতি উড়তে শুরু করল। কিন্তু ও বাক্যহারা তখন হয়ে গেল, যখন দীপমালা দু'পা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসে বলল,
-দুলাল দা, নতুন বিল্ডিংয়ের ওদিকে আর একটা এক্সিট হবে। ছুটির সময় একটা গেটের ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তোমার হাতে তেমন জোর নেই বলছ, কাজকর্ম করতে পারো না! নতুন গেটে দারোয়ানের কাজটা করতে পারবে তো? ইউনিফর্ম স্কুল থেকেই দেওয়া হবে। যদিও ওটাতে একটু টাইম লাগবে। নতুন বিল্ডিং হবে, তারপর...
পদ্মকে এতগুলো সুসংবাদ দেওয়ার সময় বারংবার দু'চোখ মুছতে শুরু করল দুলাল। ছোট মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
-আমার ছোট মা বড় লোককি পদ্ম। এবার আমাদের দিন ফিরবে। সবাই ভরপেট ভাত খাব। গরম রুটি খাব। সব আমার এই ছোট মায়ের জন্য! ওর জন্যই আমার কপাল খুলল! মন করে এবার টালির চালটা খুলে ঘরটা এলবেসটার দে ছাইতে পারব। দু'জন মিলে খুব খাটব পদ্ম। সংসারটা আবার নতুন করে শুরু করব।
সুরঞ্জনার কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিল দুলাল।
বছর ঘোরে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তৈরি হল দীপমালার নতুন স্কুলবাড়ি। দারোয়ানের পোশাক পরিহিত দুলাল স্কুল ছুটির শেষে অনির্ণেয়কে পৌঁছে দিল তার বাড়িতে। পদ্ম এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল,
-এসো এসো।
অনির্ণেয়র কাঁধ থেকে ভারী স্কুলব্যাগটা খুলে নিল পদ্ম। ঘরে ঢুকেই একটা বাচ্চা মেয়েকে তুরতুর করে ঘুরে বেড়াতে দেখে হতবাক অনি। ও পদ্মকে জিজ্ঞাসা করল,
-এ কে আন্টি?
-ও আমার মেয়ে অনি। রঞ্জা। কাল রাত থেকে মেয়েটার খুব জ্বর গো। আজ কাজে বেরোনোর সময় আমারে ছাড়তেই চাইছিল না। খুব কাঁদছিল, ওর ঠাকমার শরীলটাও ভালো না। আমি ঘরে না থাকলে কোথায় কোথায় কার ঘরে জ্বর গায়ে ঘুরে বেড়াবে! তাই আজ ওরে সঙ্গে নে এলাম।
-ওর জ্বর তো এভাবে খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটছে কেন? ঠান্ডা লেগে আবার জ্বর এসে যাবে তো! জুতো ছাড়া মেঝেতে পা রাখতে মা আমাকে বারণ করে। দাঁড়াও, ঘর থেকে আমার জুতোটা নিয়ে আসি। ওটা পরে ঘুরুক।
অনির্ণেয় একজোড়া বড় বড় জুতো এনে সুরঞ্জনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ওর পায়ের সামনে রাখল। ওটাতে ছোট দুটো পা গলিয়ে সুরঞ্জনা অনির্ণেয়র গলায় বাঁধা টাইটা একটু টেনে দেখল। অনির্ণেয় হেসে ফেলল। একটু আগেই বোধহয় কাঁদছিল রঞ্জা। দু'গালে কাজল লেপ্টে রয়েছে। কপালে বড় একটা কাজলের টিপ ঘেঁটে গেছে। হাড়গিলে চেহারা! গলায় কালো রংয়ের সুতোয় বাঁধা রয়েছে একটা তামার মাদুলি। বড় বড় দুটো চোখে এখনো জল টলটল করছে। অনি হেসে রঞ্জার চোখ মুছিয়ে দু'গাল টিপে আদর করে বলল,
-তুমি খুব সুইট! কাঁদবে না একদম। এটা... এটা টাই রঞ্জা। তুমি পরবে? চাই এটা? আচ্ছা তুমি যখন স্কুলে যাবে, তখন তোমাকেও তো টাই পরতে হবে। তখন আমি আমার মাকে বলব। মা তোমাকে আমার মতো টাই কিনে দেবে!
অনির্ণেয়র টাইটা টেনে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখল রঞ্জা। একমনে ঝুলতে থাকা ওই বস্তুটা দেখতে লাগল সে। অনি বলল,
-এটাই চাই? এক্ষুণি? আচ্ছা দাঁড়াও!
নিজের গলা থেকে টাইটা খুলে সুরঞ্জনার গলায় পরিয়ে দিল অনি। সঙ্গে সঙ্গে ওটার স্বাদ গ্রহণের জন্য মুখের ভিতর চালান করে মনের সুখে চিবোতে শুরু করল রঞ্জা। পদ্ম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অনির খাবারটা টেবিলে রেখে চিৎকার করে উঠল,
-ওরে কাল অনিদাদার স্কুল আছে রে মেয়ে। মুখ থেকে ওটা বের কর। কেচে শুকিয়ে দিই আমি। যা পাচ্ছে, তাই নিয়ে মুখে দিচ্ছে! উফ!
টাই নিয়ে মা-মেয়েতে রীতিমতো দড়ি টানাটানির খেলা শুরু হয়ে গেল। অনিদাদার নিজের গলা থেকে খুলে দেওয়া প্রথম উপহারটা হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেই, পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেয় রঞ্জা। খেতে বসে এই দৃশ্য দেখে অনির্ণেয় হেসেই অস্থির। শেষ পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিল অনির্ণেয়।
***********
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
-এটা দিয়ে ক'দিন টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নিও। এখন কাজের বাড়ি যেতে হবে না।
-কোথায় পেলে টাকা?
-মনসুরের থেকে সুদে ধার নিয়েছি।
-আবার দেনা? বলি শোধ করবে কে শুনি?
ভারী হয়ে এলো পদ্মর গলা। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গালে। মৃদুস্বরে ও বলল,
-না খেয়ে পেটে দড়ি দে থাকলেও আর দেনা করতে মন করে না। দেনার দায়ে আমার গোটা জেবনটাই শেষ হয়ে গেল। এর থেকে টাকা নিয়ে ওরে দাও, ওর থেকে নিয়ে এরে! আমি আর পারি না গো!
-মা রাতে কী রান্না হবে? চাল নেই! ডাল অল্প রয়েছে। চুপড়িতে তিনটে আলু পড়ে রয়েছে। ঠাকমা বলছে খিদা লাগে।
দরজার দিকে চেয়ে পদ্ম দেখল, বড় ছেলে টুকাই এসে হাজির হয়েছে। এই কয়েকদিনে কী বড় বেশি লম্বা হয়ে গেছে টুকাই! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছেলের মাথা প্রায় দরজার ওপর প্রান্তে ঠেকে গেছে। গলা ভাঙতে শুরু করেছে টুকাইয়ের। কোন এক সুনিপুণ চিত্রশিল্পী তুলির নিখুঁত টানে বালকের ঠোঁটের ওপর গোঁফের সূক্ষ্ণ রেখা টেনে ঘোষণা করছেন শৈশবের সমাপ্তি। পদ্ম ঘরে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। দুই ছেলে মেয়ে জ্বরে কাহিল। পিসি শাশুড়িও বিছানা হাতড়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে ছোট মেয়ের গায়ে মাথায় কম্পিত হাত বুলিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছে। দুলাল এখন মেয়েকেই কোলে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু টুকাই একবারও বোনের ধারেকাছে এগোয়নি। উঁকি মেরে বোনের মুখটাও দেখতে আসেনি। পদ্ম বলে উঠল,
-শুধু নেই আর নেই!
-তা না থাকলে কী বলব মা? আছে!
-টুকাই এমনধারা কথা বলছিস কেন তুই? বোনকে একবারও কোলে নিয়েছিস?
-রাতে কী রান্না হবে বলো? ঘরে কিছু খাবার জুটবে নাকি খাবার লোক বেড়ে যাওয়ার জন্য আমরা না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে নতুন মানুষকে খাওয়াব?
ছেলের কথা শুনে বাক্যহারা হল পদ্ম। দুলাল বড় নির্বিবাদী শান্ত স্বভাবের মানুষ। সাংসারিক কোন জটিলতার উত্তর সে দিতে পারে না। সে কেবল জানে এই ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবনটাও শেষ করতে হবে। টুকাই সরকারি স্কুলে পড়ে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেকটাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য কোথা থেকে কার একটা ভাঙা সাইকেল জুটিয়ে নিয়েছে সে। দুলাল নতুন সাইকেল কেনার জন্য ছেলেকে টাকা দিতে পারেনি। ছেলের অনেক প্রয়োজনই মেটাতে অক্ষম সে। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষকের মুখে মুখে ফেরে টুকাইয়ের মেধা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। কত শিক্ষক বেতনের আশা না করেই স্বেচ্ছায় পড়ান টুকাইকে। ছেলেটা বড় কম কথা বলে। সারাদিন কেবল পড়াশোনা করে। প্রাণপণে এই ছেলেটিকে তৈরি করার চেষ্টা করছে দুলাল ও পদ্ম। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো টুকাই। সেই কারণে দুলাল বড় ছেলেকে সমীহ ও অপার শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রত্যেক বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর ওর স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে, তারা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে দুলালের সঙ্গে কত সম্মান দিয়ে কথা বলে। বাবার এই যে বিরাট সম্মান প্রাপ্তি, সকলই তো টুকাইয়ের জন্য। দুলাল প্রায় লেখাপড়া জানে না বললেই চলে। সেই কারণে ছেলের এই উন্নতি দেখে আনন্দে দুলালের দু'চোখ ভাসে। ছেলের এমন কথায় একটু কষ্ট পেলেও দুলাল অস্বীকার করতে পারল না, যে সত্যিই এতবড় পরিবারের অন্ন সংস্থানের ক্ষমতা তার নেই। ছেলের কথায় অক্ষম জন্মদাতা আঘাত পেলেও, চোখে জল নিয়ে চুপ করে রইল। পদ্ম আঁচল থেকে নার্সদিদির দেওয়া টাকা থেকে কিছু টাকা বের করে ছেলের হাতে দিয়ে বলল,
-ডিম, চাল আর আলু নে আয়। ডিমের ঝোল ভাত করে দিচ্ছি। পেটপুরে খাবি তুই। আমি বেঁচে থাকতে তোর ভাগেরটা বোন খেয়ে নেবে না। যতদিন আমার গতর আছে, আমি আমার অক্ত বিককিরি করে তোদের ভরপেট ভাত খাওয়াব।
-মা আমি...
-যা! আর কিছু শুনতে চাই না। দূর হয়ে যা!
টুকাই বেরিয়ে গেলে কাঁদতে কাঁদতে পদ্ম বলল,
-শুনলে ছেলের কথা? এই বয়সে এসে মেয়ে বিয়োলাম! তোমার জন্য নিজের পেটের ব্যাটার কাছে আমাকে এটাও শুনতে হল। এখনো গতর আছে, হাতে পা চলছে। খেটে খাচ্ছি। তাতেই ছেলের মুখের বুলি এই! এই ছেলে আমাদের বুড়ো বয়সে ভাত দেবে, তুমি সেই চিন্তা করো?
-টুকাই কত পড়ালেখা করে! ও বড়মানুষ হবে! সারাদিন খালি পেটে পড়ে। ওকে একটু ভালো কিছু খেতে দিতে পারি না আমরা। ছোটু আর পূর্ণার জন্য কত করল এই ক'দিন। তুমি তো সেটা চোখে দেখোনি! খিদের জন্য এখন ওর মাথা ঠিক নেই পদ্ম। ভুল করে বলে ফেলেছে। ব্যাটার কথা মনে নিয়ে কষ্ট পেতে নেই।
-নিজেদেরই খাওয়া জোটে না। তাও এই আকালের সংসারে রেখে তোমার পিসিরে ভাত দিচ্ছি। ঠাকুর তুমি দেখছ তো সব? একটা পেরানীরেও খালি পেটে ঘুমুতে দিই না! আমি নিজে না খেয়ে সবারে করছি। জেবনের শেষটায় যেন এই দুই বুড়ো বুড়ি খিদার জ্বালায় পথেঘাটে না মরি! দুটো ব্যাটা বিয়েছি। দুই ব্যাটার বউ যেন দু'বেলা দুটো ভাত দেয়।
একদৃষ্টে ঘুমন্ত সুরঞ্জনার দিকে চেয়ে কপাল চাপড়ে পদ্ম বলে উঠল,
-সব এই আবাগির জন্য! এর জন্যই এত কথা শুনতে হল আমারে...
ততক্ষণে বাবার কোলের উষ্ণতায় আবিষ্ট হয়ে গভীর ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে সুরঞ্জনা। মায়ের কুকথা তাকে স্পর্শও করতে পারল না।
সুরঞ্জনার জন্মের পর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। টুকাই ছোট বোনকে পছন্দ না করলেও, ছোটু সারাদিন বোনকে নিয়েই আহ্লাদে আটখানা। পড়াশোনায় একেবারে মন নেই পদ্মর ছোট ছেলের। মেয়েটা সেই তুলনায় লেখাপড়ায় ভালো। টুকাই আর পূর্ণাকে নিয়ে দুলালের অনেক আশা, তারা একদিন অনেক বড় হবে। বড় ছেলের জন্য প্রাণপাত করে সে। পদ্মর শরীরটাও ভাঙছে। এবার হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ঐ লোহার মতো নীরোগ শরীরে একের পর এক রোগ বালাই লেগেই আছে। সুরঞ্জনার জন্মের ধকল এই বয়সে এসে পদ্ম আর নিতে পারেনি। বাবুদের বাড়ির কাজে প্রায়ই কামাই হয়ে যায়। তিনটে বাড়ির কাজ ইতিমধ্যেই চলে গেছে। তারা করিৎকর্মা নতুন লোক পেয়ে গেছে। ফলে পদ্মর সংসার প্রায় অচল বলা চলে। সংসারের ভাবগতিক দেখে বৃদ্ধা পিসি শাশুড়িরও আজকাল আর খিদে লাগে না। বেশ কয়েকদিন বাড়িতে বসে থাকার পর একদিন সকালে দুলাল হন্তদন্ত হয়ে এসে উঠোনে পা রেখে বলে উঠল,
-ও পদ্ম, পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে তাড়াতাড়ি দুটো পষ্টিভাত দাও দিকিনি! একটা কাজের খবর আছে।
এখন পদ্ম সকালে কাজে বেরোয় না। বিকেলে দুটো ফ্ল্যাটে রান্নার কাজে যায়। তারা সবাই অফিস বাবু। খুব সকালে স্বামী-স্ত্রী অফিসে বেরিয়ে যায়। তাই রান্নার যাবতীয় কাজ রাতেই করতে হয়। আর একটা ফ্ল্যাটে রাতের রুটি তরকারি করে সকালের রান্নার জোগাড়টা করে আসতে হয়। দুই ফ্ল্যাটেই সপ্তাহান্তে শনি আর রবিবার গিয়ে ঘর মোছা, সারা সপ্তাহব্যাপী ব্যবহৃত যাবতীয় জামাকাপড় কাচা-ধোয়া করে আসে পদ্ম। বৌদিরা বড় অফিসে চাকরি করে বলে নিজেরা সংসারে তেমন সময় দিতে পারে না। তাই এই ফ্ল্যাট দুটোতে পদ্ম অনেক বাড়তি কাজ পায়। ফলে ওর মাইনে ছাড়াও কিছু উপরি পাওনা আছে। বকশিশও কিছু কম নয়। কিন্তু ওর একার ওপর তো গোটা সংসার আর চলে না। টাকা-পয়সার জন্য দুশ্চিন্তা করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে পদ্ম। খুব ক্লান্ত লাগে আজকাল। দুলালের ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ও বলল,
-কোথায় কাজ গো?
-ওই যে গো, নবীন পল্লীতে ডাক্তারবাবুর যে ইস্কুলবাড়ি আছে, ওখেনে। ইস্কুলের সামনে অনেকটা বাড়তি জমি আছে না? দিদিমণি মনসুরকে ওই জমিটা পরিষ্কার করতে ডেকেছে। বিড়ি টানতে টানতে মনসুর বলল, মন করে দিদিমণি ওই জমিতে নতুন স্কুলঘর করবে। আমি বললাম, আমারেও নে চল ভাই। হাতে একদম টাকা নাই। অত বড়লোক মানুষ। তোরে টাকা দিলে আমাকেও ক'টা টাকা দিতে পারবে। দু'জন যাব। ঝপ করে দুটো ভাত দাও তো। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে যাই। কাজ করলে তবে তো দুটো টাকা আসবে। টুকাইয়ের টেস পেপার না কি বই যেন কিনতে হবে, কতদিন ধরে ছেলেটা বলছে! আজ টাকা পেলে আগে ওর হাতে বই কেনার টাকা দেব।
ভাতগুলো নরম হয়ে বেশ গলে গেছে। ভাতের ওপর একটু লবণ আর কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল ছড়িয়ে ওগুলো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল দুলাল। পিঁড়ির ওপর বসে পদ্ম বলে উঠল,
-হ্যাঁ গো, আমার জন্য ওই ইস্কুলে কোন কাজ পাওয়া যায়? খবর নাও না একটু! অনেক বড় ইস্কুল শুনেছি। দুটো ফেলাটের কাজের টাকা দে তো আর চলছে না।
-মঙ্গলার মাকে সেদিন কাজ দেখে দেওয়ার কথা বললে যে, তার কী হল?
-কেউ নিজে কাজ না করে আমাকে দেবে? খিদে সবার পেটেই আছে তো নাকি! আমি কাউর পেটে লাথি মেরে কাজ ভাঙিয়ে নিজে ঢুকতে চাই না। তারপর বাড়ি বয়ে কোমর বেঁধে কোঁদল করতে আসবে। টুকাই এসব পছন্দ করে না, জানোই তো!
-আমি আজ কাজে যাই। দেখছি। পিসির শরীল এখন কেমন? সকালে শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল তো।
-ঠিক আছে। ও বাড়ি থেকে তোমার দাদা এসেছিল একটু আগে!
-কী বলছে?
-ওই দাওয়ায় বসে মুখ লচানো আলগা পিরিত দেখালো। গলা ছেড়ে ডাক দিল, ও পিসি ভালো আছ? এক বাস্ক সন্দেশ দিয়ে গেছে। নাও আর কী! কাল থেকে পেটে ভাত নাই, খালি পেটে বসে বসে এবার দাদার আনা দামি সন্দেশই গেলো তোমরা!
-ও পিসিই খাক! ধরার দরকার নেই।
-দাদা চলে যাওয়ার পর পিসি ও সন্দেশের বাস্ক ছুঁড়ে ফেলেছে।
-কী বলছ?
-হু! আমিই কুড়িয়ে আনলাম। সন্ধেকালে দেব মুড়ি দে। ক'টাদিন আর বাঁচবে! খাক। আমরা তো আর ভালোমন্দ কিনে দিতে পারি না। তোমাকে আর দুটো ভাত দেব?
-না। টুকাই খেয়ে ইস্কুলে যাবে তো! ওর জন্য ভাত আলাদা করে তুলে রাখো। ছোটু আর পূর্ণা ইস্কুলে খেয়ে নেবে। কিন্তু তুমি আর পিসি কী খাবে?
-আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমরা মেয়েমানুষ, আমাদের আবার খাওয়া! এবেলা কিছু একটু ফুটিয়ে নেব। বিকেলে বৌদির ফেলাট থেকে খাবার আনব তো! ওবেলা খাব।
চোখের জল চেপে দুলাল বলল,
-আমার খিদেটা ঐ একটু মরলেই হবে। বেশি লাগবে না। টুকাইকে আমার ভাগের ভাতটা দিও।
থালাটা তুলে নিয়ে কলঘরে চলে গেল ব্রজদুলাল। সুন্দর একটি সকাল। মনসুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লুঙ্গিটা কোমরে বেঁধে রোদে পুড়ে ঘর্মাক্ত দেহে কাজ করছিল দুলাল। একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় কানে গোঁজা বিড়িটা নামিয়ে মনসুর দুটো সুখটান দিচ্ছিল, এমন সময় একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে একটি ছেলের হাত ধরে স্কুলে এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে প্রবেশদ্বারের দারোয়ান থেকে শুরু করে সকলেই কেমন যেন সমীহ করে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মনসুরের দিকে চাইল দুলাল। মনসুর বলল,
-ইস্কুলের সবচে বড় দিদিমণি আর তার একমাত্তর ছেলে। এ হল ডাক্তারবাবুর নাতি। সবাই একডাকে চেনে এরে। বড় ভালো ছেলে।
-এটাই বড় দিদিমণি?
-হ্যাঁ, দাঁড়াও দুলালদা, তোমার কথা দিদিমণিরে একটু বলে আসি।
জ্বলন্ত বিড়িটা দুলালের হাতে ধরিয়ে মনসুর ছুটল দীপমালার কাছে। বলল,
-দিদিমণি, ভালো আছেন?
-হ্যাঁ মনসুর। তুমি ভালো ভাই?
-হ্যাঁ দিদিমণি। অনেকটা বড় জায়গা তো। তাই একজনরে সঙ্গে নে এসেছি। আমার একটু সুবিধা হবে।
-ওহ আচ্ছা। তা ঠিক আছে, ভালোই তো! কাজ করো তোমরা। কাজ হয়ে গেলে দু'জনেই আমার অফিসে দেখা করে যেও। কেমন!
-আচ্ছা দিদিমণি।
-দিদিমণি?
-হ্যাঁ বলুন?
-আপনের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?
দুলাল এসে দাঁড়িয়েছে মনসুরের পিছনে। ডানহাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চেয়ে দীপমালা বলে উঠল,
-কী ব্যাপারে বলুন তো?
-এই ইস্কুলে মেয়েমানুষের জন্য কোন কাজ, মানে কতরকম তো কাজ থাকে। আমার বউয়ের জন্য...
-এখন আমার একটু তাড়া আছে দাদা। অনির ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আপনি বরং কাজ সেরে নিন। তারপর আমার অফিসে বসে ধীরেসুস্থে কথা হবে।
-আচ্ছা দিদিমণি।
স্কুলের ঘন্টার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ছেলের হাত ধরে চলে গেল দীপমালা। বিকেলে যখন দীপমালা নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল, অনির্ণেয় অফিসের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে বইয়ের পাতা উল্টে রূপকথার জগতে ডুব দিয়েছে। দুলাল আর মনসুর পৌঁছল দীপমালার অফিসে। মনসুর নিজের প্রাপ্য টাকা বুঝে নিয়ে চলে গেলেও, দুলাল বাইরে বসে রইল। অফিস ঘরে তালা দিয়ে কয়েকটা ফাইল সঙ্গে নিয়ে অনির হাত ধরে বেরোল দীপমালা। দুলাল উঠে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে বলল,
-দিদিমণি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন? আপনি তখন কী যেন বলছিলেন!
-আমার বউয়ের জন্য এই ইস্কুলবাড়িতে যদি কোন কাজ থাকে.... ছোট কাজ হলেও চলবে।
-আপনি কী কাজ করেন? কোথায় থাকেন?
-আমার বাড়ি মোছলমান পাড়ার কাছেই। মনসুরের তিনটে বাড়ি পর। আমি আগে চটকলে কাজ করতাম দিদিমণি। ওখেনে কাজের সময় হাতে চোট পেয়েছিলাম। তারপর মালিক কিছু টাকা দে বসিয়ে দিল। পরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে হয়ে কাজ করেছিলাম কয়েক মাস। কিন্তু সিমেন্ট বালির বস্তা চাগাতে পারি নে। হাতটায় কেমন যেন জোর পাই না। ইঁট বইতে গেলে ইঁট পড়ে যায়। এখন মোছলমান পাড়ার মোড়ে যে বাজার আছে, ওখেনে ফল পাকুড় বেচি। আর যদি কেউ এদিক ওদিক কাজে ডাকে, ছুটে যাই। বউটা বাবুর বাড়ি কাজ করত। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর কাজগুলো ছেড়ে যায়। আমার সংসার চলে না দিদিমণি। চারটে ছেলেমেয়ে। একটা বুড়ি পিসি আছে। পেটপুরে সবকটারে দুটো ভাত দিতে পারি না। আপনার ইস্কুলে যদি...
-আমি একটা বিল্ডিং করছি। ঐদিকের মাঠে। যেটা আপনারা পরিষ্কার করছেন। এখন প্রি প্রাইমারি সেকশন থেকে টেন পর্যন্ত আছে। এবার একবারে টুয়েলভ পর্যন্ত করছি। দেখুন দাদা, আপনার নামটা কী?
-দুলাল দিদিমণি! ব্রজদুলাল সর্দার।
-দেখুন দুলাল দা...
-আমাকে আপনি বলবেন না দিদিমণি। আপনি কত বড় মানুষ, আমি খুব ছোট...
-শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে বড় ছোট বিচার করা যায় না। আপনিও খেটে খাচ্ছেন। আমিও। যার যার জীবনযুদ্ধে সেই যোদ্ধা। যাইহোক, আপনি চাইছেন না যখন ঠিক আছে। দেখো দুলাল দা, আমি সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত থাকি। এ আমার ছেলে, অনির্ণেয়। আমি ওকেও ঠিকমতো টাইম দিতে পারি না। কখন ওর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, এখানেই আমার অফিসে ইউনিফর্ম পরে বসে আছে। আমি বেরোব, তারপর আমার সঙ্গে ও বাড়ি যাবে। আমার কাজের লোকটা প্রায়ই কামাই করে। ছেলের জন্য ওকে ভরসা করতে পারি না। তুমি মনসুরের সঙ্গে এসেছ, তাই তোমাকে বা তোমার পরিবারকে বিশ্বাস করতে পারি। এই পুরনো বিল্ডিং হওয়ার আগে থেকে আমি ওকে চিনি। মনসুরের বাবা আমার বাবার পেশেন্ট ছিলেন। তা তোমার বউ কী আমার ছেলেকে একটু দেখাশোনা করতে পারবে? এই ধরো, স্কুল থেকে ফেরার পর অনি একটু ফ্রেশ হলে ওকে কিছু খেতে দেওয়া, আমি বাড়ি ফেরার পর ভীষণ টায়ার্ড হয়ে থাকি। তাই ওর রাতের খাবারটা করে রাখা। আর যদি সকালের রান্নাটাও একটু করে দিত, আমি আর একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আসতে পারতাম। স্কুলের পাশে ওটাই আমার বাড়ি। তোমার বউ রাজি থাকলে আজ সন্ধেবেলা তাকে নিয়ে তুমি আমার বাড়ি এসো। সে কাজকর্ম সব দেখেশুনে বুঝে নেবে। টাকা পয়সা নিয়েও কথা বলে যাক। তারপর কাল থেকেই না হয় শুরু করুক। এই ভাঙা মাসটার জন্য আমি অর্ধেক টাকাই দেব।
দুর্বলদেহী দুলালের একটু আগেও খিদের জন্য পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। এখন ও খিদে তৃষ্ণা সব ভুলে গেল। আনন্দে ওর বুকের মধ্যে শত শত প্রজাপতি উড়তে শুরু করল। কিন্তু ও বাক্যহারা তখন হয়ে গেল, যখন দীপমালা দু'পা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসে বলল,
-দুলাল দা, নতুন বিল্ডিংয়ের ওদিকে আর একটা এক্সিট হবে। ছুটির সময় একটা গেটের ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তোমার হাতে তেমন জোর নেই বলছ, কাজকর্ম করতে পারো না! নতুন গেটে দারোয়ানের কাজটা করতে পারবে তো? ইউনিফর্ম স্কুল থেকেই দেওয়া হবে। যদিও ওটাতে একটু টাইম লাগবে। নতুন বিল্ডিং হবে, তারপর...
পদ্মকে এতগুলো সুসংবাদ দেওয়ার সময় বারংবার দু'চোখ মুছতে শুরু করল দুলাল। ছোট মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
-আমার ছোট মা বড় লোককি পদ্ম। এবার আমাদের দিন ফিরবে। সবাই ভরপেট ভাত খাব। গরম রুটি খাব। সব আমার এই ছোট মায়ের জন্য! ওর জন্যই আমার কপাল খুলল! মন করে এবার টালির চালটা খুলে ঘরটা এলবেসটার দে ছাইতে পারব। দু'জন মিলে খুব খাটব পদ্ম। সংসারটা আবার নতুন করে শুরু করব।
সুরঞ্জনার কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিল দুলাল।
বছর ঘোরে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তৈরি হল দীপমালার নতুন স্কুলবাড়ি। দারোয়ানের পোশাক পরিহিত দুলাল স্কুল ছুটির শেষে অনির্ণেয়কে পৌঁছে দিল তার বাড়িতে। পদ্ম এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল,
-এসো এসো।
অনির্ণেয়র কাঁধ থেকে ভারী স্কুলব্যাগটা খুলে নিল পদ্ম। ঘরে ঢুকেই একটা বাচ্চা মেয়েকে তুরতুর করে ঘুরে বেড়াতে দেখে হতবাক অনি। ও পদ্মকে জিজ্ঞাসা করল,
-এ কে আন্টি?
-ও আমার মেয়ে অনি। রঞ্জা। কাল রাত থেকে মেয়েটার খুব জ্বর গো। আজ কাজে বেরোনোর সময় আমারে ছাড়তেই চাইছিল না। খুব কাঁদছিল, ওর ঠাকমার শরীলটাও ভালো না। আমি ঘরে না থাকলে কোথায় কোথায় কার ঘরে জ্বর গায়ে ঘুরে বেড়াবে! তাই আজ ওরে সঙ্গে নে এলাম।
-ওর জ্বর তো এভাবে খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটছে কেন? ঠান্ডা লেগে আবার জ্বর এসে যাবে তো! জুতো ছাড়া মেঝেতে পা রাখতে মা আমাকে বারণ করে। দাঁড়াও, ঘর থেকে আমার জুতোটা নিয়ে আসি। ওটা পরে ঘুরুক।
অনির্ণেয় একজোড়া বড় বড় জুতো এনে সুরঞ্জনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ওর পায়ের সামনে রাখল। ওটাতে ছোট দুটো পা গলিয়ে সুরঞ্জনা অনির্ণেয়র গলায় বাঁধা টাইটা একটু টেনে দেখল। অনির্ণেয় হেসে ফেলল। একটু আগেই বোধহয় কাঁদছিল রঞ্জা। দু'গালে কাজল লেপ্টে রয়েছে। কপালে বড় একটা কাজলের টিপ ঘেঁটে গেছে। হাড়গিলে চেহারা! গলায় কালো রংয়ের সুতোয় বাঁধা রয়েছে একটা তামার মাদুলি। বড় বড় দুটো চোখে এখনো জল টলটল করছে। অনি হেসে রঞ্জার চোখ মুছিয়ে দু'গাল টিপে আদর করে বলল,
-তুমি খুব সুইট! কাঁদবে না একদম। এটা... এটা টাই রঞ্জা। তুমি পরবে? চাই এটা? আচ্ছা তুমি যখন স্কুলে যাবে, তখন তোমাকেও তো টাই পরতে হবে। তখন আমি আমার মাকে বলব। মা তোমাকে আমার মতো টাই কিনে দেবে!
অনির্ণেয়র টাইটা টেনে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখল রঞ্জা। একমনে ঝুলতে থাকা ওই বস্তুটা দেখতে লাগল সে। অনি বলল,
-এটাই চাই? এক্ষুণি? আচ্ছা দাঁড়াও!
নিজের গলা থেকে টাইটা খুলে সুরঞ্জনার গলায় পরিয়ে দিল অনি। সঙ্গে সঙ্গে ওটার স্বাদ গ্রহণের জন্য মুখের ভিতর চালান করে মনের সুখে চিবোতে শুরু করল রঞ্জা। পদ্ম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অনির খাবারটা টেবিলে রেখে চিৎকার করে উঠল,
-ওরে কাল অনিদাদার স্কুল আছে রে মেয়ে। মুখ থেকে ওটা বের কর। কেচে শুকিয়ে দিই আমি। যা পাচ্ছে, তাই নিয়ে মুখে দিচ্ছে! উফ!
টাই নিয়ে মা-মেয়েতে রীতিমতো দড়ি টানাটানির খেলা শুরু হয়ে গেল। অনিদাদার নিজের গলা থেকে খুলে দেওয়া প্রথম উপহারটা হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেই, পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেয় রঞ্জা। খেতে বসে এই দৃশ্য দেখে অনির্ণেয় হেসেই অস্থির। শেষ পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিল অনির্ণেয়।
***********
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন