প্রজাপতির মৃত্যু
মন প্রজাপতি
প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস
প্রথম পর্ব
বাবার সামনে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়েছিল দীপমালা। শৈশবেই মাতৃহারা সে। বাবা দিগম্বর চাটুজ্যে বর্তমানে মালার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। এই কন্যার কারণে অকালে স্ত্রীবিয়োগের পর দ্বিতীয়বার নতুনভাবে জীবন শুরু করার কথা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। হাসপাতাল, রোগী, ঘরকন্না সব একা সামলে মালার যাবতীয় স্বপ্নকে স্বহস্তে রূপদান করেছেন ডক্টর দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বড় সাধ ছিল, দুই কামরার ছোট চেম্বারটা ছাড়িয়ে চিকিৎসার পরিধি আরও বৃদ্ধি করবেন। একমাত্র কন্যার হাত ধরে অদূর ভবিষ্যতে বাড়ির পার্শ্ববর্তী জমিতে বড় একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন। যেখানে সপ্তাহে একদিন সমস্ত দুঃস্থ রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবেন বাবা ও মেয়ে। নিখরচায় তাদের রক্ত-মল-মূত্র পরীক্ষা করা হবে। ধীরে ধীরে অনেক বড় হবে সেই হাসপাতাল। একাধিক ডাক্তার ও দরিদ্র রোগীর কোলাহলে মুখরিত হবে পাড়া। নিজের স্ত্রী-র নামে ওই হাসপাতালের নামকরণ করবেন তিনি। আর দিগম্বর চাটুজ্যের পরবর্তী উত্তরসূরী হবে তাঁরই সুযোগ্যা কন্যা ডক্টর দীপমালা চট্টোপাধ্যায়! কিন্তু এই স্বপ্নপূরণের জন্য নূন্যতম উৎসাহটুকুও, মেয়ের মধ্যে কোনদিন দিগম্বর দেখতে পাননি। সাহিত্যকে ভালোবেসে কলা বিভাগে যখন মালা ভর্তি হতে চাইল, দিগম্বর বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। মেয়ের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও স্বাধীনতাকে সর্বদাই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। কিন্তু আজ তিনি মালার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। স্নাতকোত্তর বিবাহযোগ্যা মালার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে দিগম্বর বলে উঠলেন,
-তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটা উচ্চারণ করলে কী করে মালা? এই বাড়ি, গাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, তোমার মা আর ঠাম্মির এত গয়না.... এইসব দিয়ে বিয়ে দেওয়ার পর একটা বেকার ছেলেকে নিজের জামাই...
-এসব আমার চাই না বাবা।
-তুমি উচ্চশিক্ষিতা মালা। নিজের ভালোমন্দ বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এটা বোঝার পরই আমি তোমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছ। তুমি ভাবলে কী করে একটা ভিখারি ভ্যাগাবন্ড বেকার ছেলের সঙ্গে আমি আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেব? নিজের শিক্ষা, বংশপরিচয়, ক্লাস.... সব ভুলে তুমি একটা রাস্তার ছেলের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছ!
-ও রাস্তার ছেলে নয় বাবা! উচ্চবংশের ছেলে। বাবা নেই। মা ওকে জন্ম দিয়েই মারা গেছেন। কাকার সংসারে আশ্রিত। পরিমিত টাকার অভাবে এত বছর ধরে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। অর্থাভাবে এখনো ছাত্র পড়ায়। একটা চাকরির জন্য দিনরাত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-বিয়ের পর ও কোথায় রাখবে তোমাকে? মেসে? নাকি ওই কানাগলি পেরিয়ে অন্ধকার বস্তির ঘরে? যেখানে সাক্ষরতার নামে সে সারারাত সমাজসেবা করে বেড়ায়!
-ও ঐ নিষিদ্ধ পল্লীতে যায় ওদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে পড়াতে, অন্ধকার গলিতে একটু শিক্ষার আলো জ্বালাতে যায়। নিষিদ্ধ পল্লীর অস্পৃশ্য মানুষগুলো ওকে দেবতার মতো পুজো করে বাবা। মাস্টারদা বলে ডাকে। ওর সামনে কোনরকম কটুকথা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারে না, ওকে এতটাই সম্মান করে। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। আমি তোমার মেয়ে বাবা। আমি কী কোন ভুল করতে পারি? তুমিই বলো!
-তুমি ওইসব জায়গায় গেছ? এত অবনতি তোমার!
-হ্যাঁ গেছি। তো কী হয়েছে? মানুষের রোগ হলে তুমি কী চিকিৎসা করার আগে রোগীর পরিচয় জেনে চিকিৎসা করো? রোগিনীর অবস্থান যদি নিষিদ্ধ পল্লীতে হয়, তার প্রাণ বাঁচাতে তুমি ওই অন্ধকার গলিতে যাবে না?
-এতদিনের শিক্ষা তোমাকে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে শিখিয়েছে? এতখানি ঔদ্ধত্য!
-না। তুমি আমাকে এতদিন ধরে যে শিক্ষা দিয়েছ, সেই শিক্ষা আমাকে শিরদাঁড়া সোজা রেখে সঠিক কথা বলতে শিখিয়েছে। সেটা আলাদা বিষয়, যে তুমি আমার স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে আজ ঔদ্ধত্য খুঁজে পাচ্ছ.... অথচ, এটা তোমারই শিক্ষা!
-আমি ঐ ছেলেকে মানব না।
-আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
-বেশ। তবে সিদ্ধান্ত নাও, আমি.... নাকি ওই ছেলে? দু'জনকে একসঙ্গে তুমি নিজের জীবনে রাখতে পারবে না। কোন ভদ্রসমাজে আমি তাকে নিজের জামাই বলে পরিচয় দেব না।
মালা আর মাথা তুলতে পারল না। অশ্রুভারে অবনত ওর দু'চোখ। শৈশব হতে এ যাবৎকাল পর্যন্ত পিতৃগৃহে যাপন করা সুখ-দুঃখের সকল মুহূর্তগুলো ছায়াছবির মতো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু যৌবনে প্রেমের দাবিও বড় কম নয়। মালার দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলো। কম্পিত শীতল হাতটা সে বাবার পায়ের ওপর রেখে মাথায় ছুঁয়ে নিল। দিগম্বর স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলেন, সর্বক্ষণের ব্যবহৃত দুটি সোনার আংটি, কানের দুল ও গলার সরু চেনটা খুলে টেবিলের ওপর রেখে, শিক্ষাজীবনের যাবতীয় শংসাপত্রের ফাইলগুলো সম্বল করে, তাঁর একমাত্র মেয়ে এক কাপড়ে বিনা বাক্যব্যয়ে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে গেল। বাবার দিকে আর ফিরেও চাইল না। অসহায় প্রৌঢ় তীব্র মনোকষ্টকে সঙ্গী করে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন খোলা দরজার দিকে।
পাড়ার সর্বাধিক প্রাচীন ও অভিজাত পরিবারের একমাত্র ঠিকানা এই চাটুজ্যে আবাসন। বড় সাধ করে দীপমালার ঠাকুরদা বাড়ির নামকরণ করেছিলেন 'স্মৃতিমেদুর'। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রভাবশালী দিগম্বর চাটুজ্যের অসামান্য প্রতিভা ও পসারের কারণে বর্তমানে এই বাড়ি 'ডাক্তারের বাড়ি' নামেই পরিচিত। বাড়ির পার্শ্ববর্তী স্থানে কয়েক বিঘা জমি পড়ে রয়েছে নিতান্তই অযত্নে। জংলী ঘাস আর হাতেগোনা কয়েকটা গাছগাছালি নিয়ে দিগম্বর বাবুর সংসার। বুনো ফুলের রূপ ও গন্ধে অসংখ্য প্রজাপতির দেখা পাওয়া যায়। দিনের বেলা বাড়িতে থাকলে স্টাডি টেবিলে বসে, ওই রঙিন প্রজাপতিগুলোর দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকেন তিনি। যেন উড়ন্ত রামধনু! অজস্র রঙের সমাহার তার চোখের সামনে। কিন্তু তাঁর নিজের জীবন বড়ই বিবর্ণ। যেদিন সন্ধেবেলা চেম্বার থেকে ডাক্তারবাবু একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন, সেদিন মনটা বড় ব্যাকুল হয়। মালা চলে গেছে প্রায় তিন মাস সময় অতিক্রান্ত। প্রতিদিন সকালে দুধ দেয় যে ছেলেটি, ডাক্তারবাবু তার কাছ থেকে উড়ো খবর পেয়েছেন, যে মালা ঐ ছেলেকেই বিয়ে করে একটা এক কামরার ঘরে ভাড়া আছে। পরদিনই ওই ছেলেটির প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে, তাকে বিদায় করেন তিনি। শৈশব ও আপনজনের সকল স্মৃতি আঁকড়ে বাড়ির এককোণে একাকী পড়ে রইলেন ডক্টর দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। সুবিশাল তিনতলা বাড়ি প্রায় জনমানবহীন। হাসপাতাল, চেম্বার আর বাড়ি, এই তিন জায়গায় দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ডাক্তারবাবু। কথা বলার মতো একটা মানুষও তাঁর জীবনে নেই। প্রেতপুরীর মতো খাঁ খাঁ করে তাঁর জগৎ। আজ সকালে তিনি একটা লোককে ডেকেছেন। বাড়ির চতুর্দিকের আগাছাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া বাড়ির আরও কিছু কাজের জন্য সকাল থেকে একজন মানুষ ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে নেমে পড়েছে বাড়ির প্রাঙ্গনে। তাকে এক কাপ চা দিয়ে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেও চা পান করছিলেন ডাক্তারবাবু। এমন সময় ড্রইংরুমের ফোনটা বেজে উঠল। ডাক্তার আজ ছুটির মেজাজে রয়েছেন। তাঁকে আর অসময়ে কে ফোন করবে? বড়জোর চেম্বার অথবা হাসপাতাল থেকে। আজ কোন ফোনই ধরতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু একবার লাইনটা কেটে যাওয়ার পরেও গৃহকর্তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে বেয়াড়া ফোনটা আবার বেজে উঠল। চায়ের ব্যাপারে বরাবরই শৌখিন ডাক্তারবাবু। আয়েশ করে তিনি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। অবেলায় চায়ের সুগন্ধে আবিষ্ট হতে বেশ ভালো লাগছিল তাঁর। কিন্তু সেই আমেজে ছেদ পড়ল ফোনের কারণে। একরাশ বিরক্তির উদ্রেক হল। একটি বিরক্তিসূচক শব্দ বের হল তার মুখ থেকে। চায়ের কাপ প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে ফোন ধরলেন তিনি। ডাক্তারবাবুর কানের পার্শ্ববর্তী পক্ককেশ বেয়ে স্বেদবিন্দু নেমে এলো। কপালে একাধিক ভাঁজ! উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হয়ে গেল। শরীরটা হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ফোন রেখে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বাড়ির দরজা আটকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পরনে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি, এলো গায়ে ঘর্মাক্ত লোকটা কোদাল কাস্তে আর একমুঠো ঘাস হাতে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে ডাক্তারবাবুর গাড়িটা তীব্র গতিতে বড় গেট পেরিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।
সতীর্থর ফোনটা পেয়েই সরকারি হাসপাতালে এসে হাজির হয়েছেন ডাক্তারবাবু। তাঁর সমগ্র দেহ কাঁপছিল। বন্ধু তাঁর কাঁধের ওপর হাত রাখার পর একটু শান্ত হলেন তিনি। একটা নির্দিষ্ট শয্যার সামনে পৌঁছে ডাক্তারবাবু আর চোখে জল ধরে রাখতে পারলেন না। রুগ্নকায় দীপমালা হাসপাতালের শয্যার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। সুন্দরী বিদূষী মালার দেহ প্রায় কঙ্কালসার। নারীদেহ বহু পূর্বেই স্বাভাবিক জৌলুস হারিয়েছে। দেহে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে মুখের বিভিন্ন জায়গায়। রোগ জর্জরিত ক্লান্ত দেহে চোখ বন্ধ করে পড়ে রয়েছে ডাক্তারবাবুর একমাত্র কন্যা। দিগম্বরের বন্ধু কন্যাস্নেহে মালার মাথায় হাত রাখল। কোটরাগত দুটি চোখ ধীরে ধীরে মেলল মালা। মাত্র এক হাত দূরে ভেঙেচুরে যাওয়া একজন শীর্ণকায় মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মানুষটা আজন্মকালের পরিচিত হলেও, তাঁর এইপ্রকার ভগ্নস্বাস্থ্য, কঙ্কালসদৃশ দেহ মালার কাছে অচেনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মালা। দিগম্বর বাবু মালার কাছে দাঁড়ানোমাত্রই নীরব কান্নায় ভেসে গেল সে।
ছাত্রজীবন হতেই কুসঙ্গে পড়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত সূত্রে এক মধ্যবয়সী নারীর সঙ্গে বহু বছর যাবৎ গোপন সম্পর্কে আবদ্ধ দীপমালার স্বামী। কিন্তু প্রবল অর্থাভাবের কারণে ওই অন্ধকার গলি পরিত্যাগ করে নিজের মনের মানুষের সঙ্গে বেরিয়ে আসা মহিলাটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। ঐ মহিলার দুই সন্তানসহ নিষিদ্ধ পল্লীর আরও কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করে সে। সেই সঙ্গে সকলের অগোচরে চলতে থাকে ঐ নারীর সঙ্গে প্রগাঢ় প্রেম। ইতিমধ্যেই কিছু সমাজ সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত দীপমালা ঐ পুরুষের প্রখর ব্যক্তিত্ব ও কথার জালে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে উন্মাদিনী হয়ে পড়ে। পুরুষটি মালার সেই দুর্বলতা অবগত হওয়ামাত্রই জানান দেয় আপন প্রেমিকাকে। সেই মধ্যবয়সী মহিলার পরামর্শে মালাকে প্রেম নিবেদন করে ঐ পুরুষ। তারপর কয়েক মাস ব্যাপী চলে তাদের প্রগাঢ় প্রেম এবং সবশেষে বিবাহের প্রস্তুতি! কিন্তু প্রবলভাবে বাধা আসে দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষ হতে। এখানেই ঐ মধ্যবয়স্কা প্রেমিকার সকল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। দীপমালাকে বিয়ে করে তার যাবতীয় ঐশ্বর্য হস্তগত করার পর তাকে কোন অনামী অন্ধকার গলিতে ছুঁড়ে ফেলার যে পরিকল্পনা তারা যৌথভাবে করেছিল, ডাক্তারবাবুর কঠিন বাক্যের প্রভাবে মালার হঠকারী সিদ্ধান্তে সকল পরিকল্পনা তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে। মালা কপর্দকহীন অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসায়, সেই মুহূর্ত হতে নিজের অজান্তেই প্রেমিকের গলার কাঁটা হয়ে যায় সে। কিন্তু পূর্ব প্রেমিকার পরামর্শে নিতান্তই অনাড়ম্বর এক বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর থেকেই অবর্ণনীয় মানসিক নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় দীপমালা। ততদিনে স্বামীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মনোবল হারিয়েছে সে। অবিলম্বে মালা জানতে পারে, তার স্বামী সম্প্রতি কিছু অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং বহু টাকার দেনা তার মাথায় রয়েছে। সেই দেনা শোধের জন্য দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায়ের প্রস্তাব মাত্রই, মালা সেই প্রস্তাব তীব্রভাবে অস্বীকার করে। ততদিনে স্বামীর পূর্ব প্রেমিকা ও তার পিতৃ পরিচয়হীন দুই সন্তান সম্পর্কে অবগত হয়েছে মালা। অশান্তি যখন চরমে ওঠে, একদিন রাতে মালাকে তুমুল প্রহার করে তার স্বামী। অত্যাচারে জর্জরিত মালা জ্ঞান হারালে তাকে মৃত ভেবে গা ঢাকা দেয় সেই পুরুষ। আট ঘণ্টা পর জনাকয়েক সহৃদয় প্রতিবেশীর কল্যাণে ঘরের দরজা ভেঙে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় ডাক্তারবাবুর একমাত্র কন্যাকে। সেই সময় হাসপাতালের ওয়ার্ডে কর্তব্যরত ডাক্তার দিগম্বর ও দীপমালার পূর্বপরিচিত হওয়ায়, সহজেই বাবার কাছে মেয়ের এই দুরবস্থার সংবাদ পৌঁছয়। হতভাগ্য কঙ্কালসার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ডাক্তারবাবু।
মালার অবনত দৃষ্টি বাড়ির চৌকাঠের ওপর নিবদ্ধ। নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করে, একবুক বিশ্বাস নিয়ে একদিন এই চৌকাঠ পেরিয়েছিল সে। আজ বাবার হাতের ওপর দুর্বলদেহের সকল ভার অর্পণ করে, আবার ফিরে আসতে হল সেই চৌকাঠেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল মালা। দিগম্বর মেয়ের মনোকষ্ট অনুভব করে বলে উঠলেন,
-বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের ফেরার রাস্তা কোনদিন বন্ধ হয় না মা! সারা পৃথিবী তোকে ছেড়ে দিলেও, তুই জানবি বাবা সবসময় তোর পাশে আছে। পিছন ফিরলেই আমাকে দেখতে পাবি তুই! ঘরে আয়। আমার লক্ষ্মী মাকে ছাড়া বাড়িটা এতদিন শ্মশান হয়ে গিয়েছিল।
সেই কান্না বাবার সান্ত্বনাবাক্যে বন্ধ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মাঝরাত থেকে তীব্র অসুস্থতা ও বমির প্রভাবে মালা প্রায় মরতে বসল। গ্রানাইট পাথরে মোড়া ঝকঝকে বাথরুমের সুবৃহৎ আয়নাটাও যেন বিদ্রুপ করছে ওকে। আয়নার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দিল মালা। সারা শরীর কেঁপে উঠল ওর। আয়নায় যে নারীর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে, তার পেটের দিকে মালা একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
একটা অচেনা লোক বাগানের আগাছাগুলো পরিষ্কার করছে। কত প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে তার আশেপাশে। অন্যমনস্কভাবে ওদিকে চেয়েছিল মালা। চোখ থেকে অবিরাম জল ঝরছে। বাবা আজ বাড়িতেই আছেন। মাথায় বাবার স্নেহস্পর্শ অনুভব করামাত্রই মালা চোখের জলটুকু মুছে ফেলল। দিগম্বর সস্নেহে বললেন,
-এভাবে একা একা ঘরে বসে আছিস কেন মা? কাজকর্ম কিছু কর। কাজ করলে মন ভালো থাকবে। সব ভুলে থাকতে পারবি। তুই যে বলেছিলি, তোর স্কুলে চাকরি করার খুব শখ। দেখ না একটু চেষ্টা করে.... আমি দেখব? আমার চেনা পরিচিতর মধ্যে...
-ভুলতে পারব না বাবা। এখন তো আর চাইলেও ভুলতে পারব না। মানুষ চিনতে কী করে এতবড় ভুল করলাম আমি? ভদ্র-সভ্য, কত মার্জিত, শিক্ষিত, লেখাপড়া জানা একটা মানুষ.... সে কিনা ক্রিমিনাল! নূন্যতম মনুষ্যত্ববোধটুকুও নেই তার! গায়ে হাত তোলে...
-একটা কথা সারাজীবন মনে রাখিস মালা, শিক্ষার সঙ্গে মনুষ্যত্বের কোন বিবাদ নেই। মনুষ্যত্বের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দু'পাতা বই পড়ে ফেলা কোন শিক্ষিত মানুষ যদি একবার মনুষ্যত্ব হারায়, তখন সে ঠান্ডা মাথায় মানুষও খুন করে ফেলতে পারে। শিক্ষার এমনই মহিমা! মনুষ্যত্ববোধ আছে এমন মানুষ শিক্ষিত না হয়ে, যে কেউ দু-চার পাতা পড়ে ফেলে যদি নিজেকে শিক্ষিত ভাবতে শুরু করে, তবে ঐ ক্ষেত্রে শিক্ষারও অপব্যবহার হয়। আর তার মূল্য তোদের মতো নির্বোধ মেয়েদের গোটা জীবন দিয়ে শোধ করতে হয় মা!
বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল মালা।
-বাবা এবার কী করব আমি?
-চাকরি কর। ছাত্র পড়াবি তোর কতদিনের ইচ্ছা। নিজের সেই স্বপ্নগুলো পূরণ কর। জীবনে বিয়েটাই কী সব নাকি! আমার কথা একবারও ভাববি না তুই? তোকে এভাবে দেখতে পারি না আমি! বুঝিস না কেন তুই! ওসব দুর্ঘটনা ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে দেখি...
-পারব না বাবা! আর পারব না। কী করব আমি এবার! আমি বোধহয় ঐ জানোয়ারের একটা অংশ নিজের মধ্যে বহন করে চলেছি। জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি বাবা। কী করব আমি?
বাক্যহারা হয়ে গেলেন দিগম্বর। মালা বাবার বুকের ওপর দাপাতে শুরু করল। মেয়েকে চেয়ারের ওপর জোর করে বসিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। ধীরকণ্ঠে বললেন,
-যদি সত্যিই তাই হয়, তবে এ সিদ্ধান্ত তোমার মালা। তাকে রাখবে না ত্যাগ করবে, এ ব্যাপারে তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি সব ক্ষেত্রেই তোমার পাশে আছি। কিন্তু এই কঠিন সিদ্ধান্তের নির্ণায়ক আমি হতে পারব না। তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। আমি আর কত বছর বাঁচব মা? দশ বছর! বড়জোর কুড়ি বছর! তারপর এই সন্তানকে তোমাকে একাই সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে। সুতরাং ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও! তার ভবিতব্য নির্ণয় করার দায়িত্ব আমি তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।
-আমার পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয় বাবা! আমি ঐ মানুষের কোন কিছুই নিজের জীবনের সঙ্গে নতুন করে জড়াতে চাই না।
-বেশ। ভালো কথা। নতুন করে জড়াতে হবে না। কিন্তু যে ইতিমধ্যে জড়িয়ে গেছে, তাকে তুই কী করে অস্বীকার করবি মা?
-বাবা তুমি সত্যিই চাও আমি এই সন্তানকে জন্ম দিই?
-আমি ডাক্তার! মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি রোগীর জীবনের জন্যই লড়াই করি। সেখানে নিজের মেয়েকে খুন করার পরামর্শ দিতে বিবেকে বাধছে। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। তুমি মা। নিজের সন্তানের ভাগ্য নির্ধারণ তুমিই করবে!
বাবা নিজের ঘরে চলে গেছে দীর্ঘক্ষণ আগে। কিন্তু বাবার ঐ একটা কথার অনুরণন মালার মনের মধ্যে এখনো অব্যাহত। বমি করতে করতে অস্থির হয়ে গেল মালা। বমন ইচ্ছা দমন করার প্রবল চেষ্টায় ওর বুক-পেট ব্যথা হয়ে গেল, তবুও ভুলতে পারল না ওই একটা ক্ষুদ্র বাক্য "তুমি মা!" ঐ ক্ষুদ্র বাক্যের মধ্যেই যেন পৃথিবীর সকল মায়া একত্রে জড়িয়ে রয়েছে। সমগ্র রাত্রিব্যাপী অজস্র চোখের জল বিসর্জন দিয়ে, নিজের পেটের ওপর পরম স্নেহে হাত রাখল দীপমালা।
হাসিমুখে মালার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। নরম তোয়ালে জড়ানো সদ্যোজাত শিশুটি গভীর ঘুমে মগ্ন। ক্লান্ত মালার চোখেমুখে পরম প্রশান্তির স্পর্শ। এক সময় এই সন্তানকে পৃথিবীতে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে মনস্থির করতে পারেনি সে। তবে আজ মনের সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মালা বিজয়িনী।
দিগম্বর বাবু নিজের নাতিকে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিলেন। যে মানসিক দোলচালের মধ্যে দিয়ে এই পথ মালা অতিক্রম করেছে, সেই সময়কালের যন্ত্রণা মাথায় রেখে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করল সে,
-অনির্ণেয়!
-রঞ্জক!
বাবার মুখে নবজাতকের নাম শুনে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মালা ক্ষীণস্বরে বলল,
-রঞ্জক! ভারী সুন্দর নাম বাবা।
-অনির্ণেয় কেন? সিদ্ধান্ত নিতে তার গর্ভধারিণী বড় বেশি মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, সেইজন্য?
নিরুত্তর দীপমালা। মায়ের কোলের কাছে শিশুটিকে রেখে দিগম্বর বললেন,
-তোর জীবনের সমস্ত রং দিয়ে তোর অনির্ণেয়, আর আমার রঞ্জককে তুই বড় করবি মা। মনুষ্যত্ববোধ আছে, এমন মানুষ তৈরি করবি। আমি আশীর্বাদ করছি, অনির্ণেয় অনেক বড় হবে। সবার থেকে আলাদা হবে ঠিকই, কিন্তু সবার ভালোবাসার মানুষ হয়ে ও ভালোবাসা আদায় করে নেবে...
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে জানালার বাইরের দিকে চাইল দীপমালা। প্রায় শুকিয়ে আসা গুল্মজাতীয় গাছগুলোতে অগুনতি গোলাপ ফুল ফুটেছে। আর তাতে মহানন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে কতগুলো রঙিন প্রজাপতি...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
-তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটা উচ্চারণ করলে কী করে মালা? এই বাড়ি, গাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি, তোমার মা আর ঠাম্মির এত গয়না.... এইসব দিয়ে বিয়ে দেওয়ার পর একটা বেকার ছেলেকে নিজের জামাই...
-এসব আমার চাই না বাবা।
-তুমি উচ্চশিক্ষিতা মালা। নিজের ভালোমন্দ বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এটা বোঝার পরই আমি তোমাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছ। তুমি ভাবলে কী করে একটা ভিখারি ভ্যাগাবন্ড বেকার ছেলের সঙ্গে আমি আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেব? নিজের শিক্ষা, বংশপরিচয়, ক্লাস.... সব ভুলে তুমি একটা রাস্তার ছেলের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছ!
-ও রাস্তার ছেলে নয় বাবা! উচ্চবংশের ছেলে। বাবা নেই। মা ওকে জন্ম দিয়েই মারা গেছেন। কাকার সংসারে আশ্রিত। পরিমিত টাকার অভাবে এত বছর ধরে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। অর্থাভাবে এখনো ছাত্র পড়ায়। একটা চাকরির জন্য দিনরাত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-বিয়ের পর ও কোথায় রাখবে তোমাকে? মেসে? নাকি ওই কানাগলি পেরিয়ে অন্ধকার বস্তির ঘরে? যেখানে সাক্ষরতার নামে সে সারারাত সমাজসেবা করে বেড়ায়!
-ও ঐ নিষিদ্ধ পল্লীতে যায় ওদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে পড়াতে, অন্ধকার গলিতে একটু শিক্ষার আলো জ্বালাতে যায়। নিষিদ্ধ পল্লীর অস্পৃশ্য মানুষগুলো ওকে দেবতার মতো পুজো করে বাবা। মাস্টারদা বলে ডাকে। ওর সামনে কোনরকম কটুকথা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারে না, ওকে এতটাই সম্মান করে। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। আমি তোমার মেয়ে বাবা। আমি কী কোন ভুল করতে পারি? তুমিই বলো!
-তুমি ওইসব জায়গায় গেছ? এত অবনতি তোমার!
-হ্যাঁ গেছি। তো কী হয়েছে? মানুষের রোগ হলে তুমি কী চিকিৎসা করার আগে রোগীর পরিচয় জেনে চিকিৎসা করো? রোগিনীর অবস্থান যদি নিষিদ্ধ পল্লীতে হয়, তার প্রাণ বাঁচাতে তুমি ওই অন্ধকার গলিতে যাবে না?
-এতদিনের শিক্ষা তোমাকে বাবার মুখের ওপর কথা বলতে শিখিয়েছে? এতখানি ঔদ্ধত্য!
-না। তুমি আমাকে এতদিন ধরে যে শিক্ষা দিয়েছ, সেই শিক্ষা আমাকে শিরদাঁড়া সোজা রেখে সঠিক কথা বলতে শিখিয়েছে। সেটা আলাদা বিষয়, যে তুমি আমার স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে আজ ঔদ্ধত্য খুঁজে পাচ্ছ.... অথচ, এটা তোমারই শিক্ষা!
-আমি ঐ ছেলেকে মানব না।
-আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
-বেশ। তবে সিদ্ধান্ত নাও, আমি.... নাকি ওই ছেলে? দু'জনকে একসঙ্গে তুমি নিজের জীবনে রাখতে পারবে না। কোন ভদ্রসমাজে আমি তাকে নিজের জামাই বলে পরিচয় দেব না।
মালা আর মাথা তুলতে পারল না। অশ্রুভারে অবনত ওর দু'চোখ। শৈশব হতে এ যাবৎকাল পর্যন্ত পিতৃগৃহে যাপন করা সুখ-দুঃখের সকল মুহূর্তগুলো ছায়াছবির মতো ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু যৌবনে প্রেমের দাবিও বড় কম নয়। মালার দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলো। কম্পিত শীতল হাতটা সে বাবার পায়ের ওপর রেখে মাথায় ছুঁয়ে নিল। দিগম্বর স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলেন, সর্বক্ষণের ব্যবহৃত দুটি সোনার আংটি, কানের দুল ও গলার সরু চেনটা খুলে টেবিলের ওপর রেখে, শিক্ষাজীবনের যাবতীয় শংসাপত্রের ফাইলগুলো সম্বল করে, তাঁর একমাত্র মেয়ে এক কাপড়ে বিনা বাক্যব্যয়ে বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে গেল। বাবার দিকে আর ফিরেও চাইল না। অসহায় প্রৌঢ় তীব্র মনোকষ্টকে সঙ্গী করে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন খোলা দরজার দিকে।
পাড়ার সর্বাধিক প্রাচীন ও অভিজাত পরিবারের একমাত্র ঠিকানা এই চাটুজ্যে আবাসন। বড় সাধ করে দীপমালার ঠাকুরদা বাড়ির নামকরণ করেছিলেন 'স্মৃতিমেদুর'। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রভাবশালী দিগম্বর চাটুজ্যের অসামান্য প্রতিভা ও পসারের কারণে বর্তমানে এই বাড়ি 'ডাক্তারের বাড়ি' নামেই পরিচিত। বাড়ির পার্শ্ববর্তী স্থানে কয়েক বিঘা জমি পড়ে রয়েছে নিতান্তই অযত্নে। জংলী ঘাস আর হাতেগোনা কয়েকটা গাছগাছালি নিয়ে দিগম্বর বাবুর সংসার। বুনো ফুলের রূপ ও গন্ধে অসংখ্য প্রজাপতির দেখা পাওয়া যায়। দিনের বেলা বাড়িতে থাকলে স্টাডি টেবিলে বসে, ওই রঙিন প্রজাপতিগুলোর দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকেন তিনি। যেন উড়ন্ত রামধনু! অজস্র রঙের সমাহার তার চোখের সামনে। কিন্তু তাঁর নিজের জীবন বড়ই বিবর্ণ। যেদিন সন্ধেবেলা চেম্বার থেকে ডাক্তারবাবু একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন, সেদিন মনটা বড় ব্যাকুল হয়। মালা চলে গেছে প্রায় তিন মাস সময় অতিক্রান্ত। প্রতিদিন সকালে দুধ দেয় যে ছেলেটি, ডাক্তারবাবু তার কাছ থেকে উড়ো খবর পেয়েছেন, যে মালা ঐ ছেলেকেই বিয়ে করে একটা এক কামরার ঘরে ভাড়া আছে। পরদিনই ওই ছেলেটির প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে, তাকে বিদায় করেন তিনি। শৈশব ও আপনজনের সকল স্মৃতি আঁকড়ে বাড়ির এককোণে একাকী পড়ে রইলেন ডক্টর দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। সুবিশাল তিনতলা বাড়ি প্রায় জনমানবহীন। হাসপাতাল, চেম্বার আর বাড়ি, এই তিন জায়গায় দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ডাক্তারবাবু। কথা বলার মতো একটা মানুষও তাঁর জীবনে নেই। প্রেতপুরীর মতো খাঁ খাঁ করে তাঁর জগৎ। আজ সকালে তিনি একটা লোককে ডেকেছেন। বাড়ির চতুর্দিকের আগাছাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া বাড়ির আরও কিছু কাজের জন্য সকাল থেকে একজন মানুষ ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে নেমে পড়েছে বাড়ির প্রাঙ্গনে। তাকে এক কাপ চা দিয়ে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেও চা পান করছিলেন ডাক্তারবাবু। এমন সময় ড্রইংরুমের ফোনটা বেজে উঠল। ডাক্তার আজ ছুটির মেজাজে রয়েছেন। তাঁকে আর অসময়ে কে ফোন করবে? বড়জোর চেম্বার অথবা হাসপাতাল থেকে। আজ কোন ফোনই ধরতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু একবার লাইনটা কেটে যাওয়ার পরেও গৃহকর্তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে বেয়াড়া ফোনটা আবার বেজে উঠল। চায়ের ব্যাপারে বরাবরই শৌখিন ডাক্তারবাবু। আয়েশ করে তিনি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। অবেলায় চায়ের সুগন্ধে আবিষ্ট হতে বেশ ভালো লাগছিল তাঁর। কিন্তু সেই আমেজে ছেদ পড়ল ফোনের কারণে। একরাশ বিরক্তির উদ্রেক হল। একটি বিরক্তিসূচক শব্দ বের হল তার মুখ থেকে। চায়ের কাপ প্লেট টেবিলে নামিয়ে রেখে ফোন ধরলেন তিনি। ডাক্তারবাবুর কানের পার্শ্ববর্তী পক্ককেশ বেয়ে স্বেদবিন্দু নেমে এলো। কপালে একাধিক ভাঁজ! উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হয়ে গেল। শরীরটা হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে শুরু করেছে। ফোন রেখে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বাড়ির দরজা আটকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। পরনে হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি, এলো গায়ে ঘর্মাক্ত লোকটা কোদাল কাস্তে আর একমুঠো ঘাস হাতে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে ডাক্তারবাবুর গাড়িটা তীব্র গতিতে বড় গেট পেরিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।
সতীর্থর ফোনটা পেয়েই সরকারি হাসপাতালে এসে হাজির হয়েছেন ডাক্তারবাবু। তাঁর সমগ্র দেহ কাঁপছিল। বন্ধু তাঁর কাঁধের ওপর হাত রাখার পর একটু শান্ত হলেন তিনি। একটা নির্দিষ্ট শয্যার সামনে পৌঁছে ডাক্তারবাবু আর চোখে জল ধরে রাখতে পারলেন না। রুগ্নকায় দীপমালা হাসপাতালের শয্যার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। সুন্দরী বিদূষী মালার দেহ প্রায় কঙ্কালসার। নারীদেহ বহু পূর্বেই স্বাভাবিক জৌলুস হারিয়েছে। দেহে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে মুখের বিভিন্ন জায়গায়। রোগ জর্জরিত ক্লান্ত দেহে চোখ বন্ধ করে পড়ে রয়েছে ডাক্তারবাবুর একমাত্র কন্যা। দিগম্বরের বন্ধু কন্যাস্নেহে মালার মাথায় হাত রাখল। কোটরাগত দুটি চোখ ধীরে ধীরে মেলল মালা। মাত্র এক হাত দূরে ভেঙেচুরে যাওয়া একজন শীর্ণকায় মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মানুষটা আজন্মকালের পরিচিত হলেও, তাঁর এইপ্রকার ভগ্নস্বাস্থ্য, কঙ্কালসদৃশ দেহ মালার কাছে অচেনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মালা। দিগম্বর বাবু মালার কাছে দাঁড়ানোমাত্রই নীরব কান্নায় ভেসে গেল সে।
ছাত্রজীবন হতেই কুসঙ্গে পড়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত সূত্রে এক মধ্যবয়সী নারীর সঙ্গে বহু বছর যাবৎ গোপন সম্পর্কে আবদ্ধ দীপমালার স্বামী। কিন্তু প্রবল অর্থাভাবের কারণে ওই অন্ধকার গলি পরিত্যাগ করে নিজের মনের মানুষের সঙ্গে বেরিয়ে আসা মহিলাটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। ঐ মহিলার দুই সন্তানসহ নিষিদ্ধ পল্লীর আরও কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করে সে। সেই সঙ্গে সকলের অগোচরে চলতে থাকে ঐ নারীর সঙ্গে প্রগাঢ় প্রেম। ইতিমধ্যেই কিছু সমাজ সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত দীপমালা ঐ পুরুষের প্রখর ব্যক্তিত্ব ও কথার জালে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে উন্মাদিনী হয়ে পড়ে। পুরুষটি মালার সেই দুর্বলতা অবগত হওয়ামাত্রই জানান দেয় আপন প্রেমিকাকে। সেই মধ্যবয়সী মহিলার পরামর্শে মালাকে প্রেম নিবেদন করে ঐ পুরুষ। তারপর কয়েক মাস ব্যাপী চলে তাদের প্রগাঢ় প্রেম এবং সবশেষে বিবাহের প্রস্তুতি! কিন্তু প্রবলভাবে বাধা আসে দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের পক্ষ হতে। এখানেই ঐ মধ্যবয়স্কা প্রেমিকার সকল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। দীপমালাকে বিয়ে করে তার যাবতীয় ঐশ্বর্য হস্তগত করার পর তাকে কোন অনামী অন্ধকার গলিতে ছুঁড়ে ফেলার যে পরিকল্পনা তারা যৌথভাবে করেছিল, ডাক্তারবাবুর কঠিন বাক্যের প্রভাবে মালার হঠকারী সিদ্ধান্তে সকল পরিকল্পনা তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে। মালা কপর্দকহীন অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসায়, সেই মুহূর্ত হতে নিজের অজান্তেই প্রেমিকের গলার কাঁটা হয়ে যায় সে। কিন্তু পূর্ব প্রেমিকার পরামর্শে নিতান্তই অনাড়ম্বর এক বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর থেকেই অবর্ণনীয় মানসিক নির্যাতন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় দীপমালা। ততদিনে স্বামীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মনোবল হারিয়েছে সে। অবিলম্বে মালা জানতে পারে, তার স্বামী সম্প্রতি কিছু অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং বহু টাকার দেনা তার মাথায় রয়েছে। সেই দেনা শোধের জন্য দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায়ের প্রস্তাব মাত্রই, মালা সেই প্রস্তাব তীব্রভাবে অস্বীকার করে। ততদিনে স্বামীর পূর্ব প্রেমিকা ও তার পিতৃ পরিচয়হীন দুই সন্তান সম্পর্কে অবগত হয়েছে মালা। অশান্তি যখন চরমে ওঠে, একদিন রাতে মালাকে তুমুল প্রহার করে তার স্বামী। অত্যাচারে জর্জরিত মালা জ্ঞান হারালে তাকে মৃত ভেবে গা ঢাকা দেয় সেই পুরুষ। আট ঘণ্টা পর জনাকয়েক সহৃদয় প্রতিবেশীর কল্যাণে ঘরের দরজা ভেঙে প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় ডাক্তারবাবুর একমাত্র কন্যাকে। সেই সময় হাসপাতালের ওয়ার্ডে কর্তব্যরত ডাক্তার দিগম্বর ও দীপমালার পূর্বপরিচিত হওয়ায়, সহজেই বাবার কাছে মেয়ের এই দুরবস্থার সংবাদ পৌঁছয়। হতভাগ্য কঙ্কালসার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ডাক্তারবাবু।
মালার অবনত দৃষ্টি বাড়ির চৌকাঠের ওপর নিবদ্ধ। নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করে, একবুক বিশ্বাস নিয়ে একদিন এই চৌকাঠ পেরিয়েছিল সে। আজ বাবার হাতের ওপর দুর্বলদেহের সকল ভার অর্পণ করে, আবার ফিরে আসতে হল সেই চৌকাঠেই। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল মালা। দিগম্বর মেয়ের মনোকষ্ট অনুভব করে বলে উঠলেন,
-বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের ফেরার রাস্তা কোনদিন বন্ধ হয় না মা! সারা পৃথিবী তোকে ছেড়ে দিলেও, তুই জানবি বাবা সবসময় তোর পাশে আছে। পিছন ফিরলেই আমাকে দেখতে পাবি তুই! ঘরে আয়। আমার লক্ষ্মী মাকে ছাড়া বাড়িটা এতদিন শ্মশান হয়ে গিয়েছিল।
সেই কান্না বাবার সান্ত্বনাবাক্যে বন্ধ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মাঝরাত থেকে তীব্র অসুস্থতা ও বমির প্রভাবে মালা প্রায় মরতে বসল। গ্রানাইট পাথরে মোড়া ঝকঝকে বাথরুমের সুবৃহৎ আয়নাটাও যেন বিদ্রুপ করছে ওকে। আয়নার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই বমি করে বেসিন ভাসিয়ে দিল মালা। সারা শরীর কেঁপে উঠল ওর। আয়নায় যে নারীর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে, তার পেটের দিকে মালা একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
একটা অচেনা লোক বাগানের আগাছাগুলো পরিষ্কার করছে। কত প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে তার আশেপাশে। অন্যমনস্কভাবে ওদিকে চেয়েছিল মালা। চোখ থেকে অবিরাম জল ঝরছে। বাবা আজ বাড়িতেই আছেন। মাথায় বাবার স্নেহস্পর্শ অনুভব করামাত্রই মালা চোখের জলটুকু মুছে ফেলল। দিগম্বর সস্নেহে বললেন,
-এভাবে একা একা ঘরে বসে আছিস কেন মা? কাজকর্ম কিছু কর। কাজ করলে মন ভালো থাকবে। সব ভুলে থাকতে পারবি। তুই যে বলেছিলি, তোর স্কুলে চাকরি করার খুব শখ। দেখ না একটু চেষ্টা করে.... আমি দেখব? আমার চেনা পরিচিতর মধ্যে...
-ভুলতে পারব না বাবা। এখন তো আর চাইলেও ভুলতে পারব না। মানুষ চিনতে কী করে এতবড় ভুল করলাম আমি? ভদ্র-সভ্য, কত মার্জিত, শিক্ষিত, লেখাপড়া জানা একটা মানুষ.... সে কিনা ক্রিমিনাল! নূন্যতম মনুষ্যত্ববোধটুকুও নেই তার! গায়ে হাত তোলে...
-একটা কথা সারাজীবন মনে রাখিস মালা, শিক্ষার সঙ্গে মনুষ্যত্বের কোন বিবাদ নেই। মনুষ্যত্বের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু দু'পাতা বই পড়ে ফেলা কোন শিক্ষিত মানুষ যদি একবার মনুষ্যত্ব হারায়, তখন সে ঠান্ডা মাথায় মানুষও খুন করে ফেলতে পারে। শিক্ষার এমনই মহিমা! মনুষ্যত্ববোধ আছে এমন মানুষ শিক্ষিত না হয়ে, যে কেউ দু-চার পাতা পড়ে ফেলে যদি নিজেকে শিক্ষিত ভাবতে শুরু করে, তবে ঐ ক্ষেত্রে শিক্ষারও অপব্যবহার হয়। আর তার মূল্য তোদের মতো নির্বোধ মেয়েদের গোটা জীবন দিয়ে শোধ করতে হয় মা!
বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল মালা।
-বাবা এবার কী করব আমি?
-চাকরি কর। ছাত্র পড়াবি তোর কতদিনের ইচ্ছা। নিজের সেই স্বপ্নগুলো পূরণ কর। জীবনে বিয়েটাই কী সব নাকি! আমার কথা একবারও ভাববি না তুই? তোকে এভাবে দেখতে পারি না আমি! বুঝিস না কেন তুই! ওসব দুর্ঘটনা ভেবে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে দেখি...
-পারব না বাবা! আর পারব না। কী করব আমি এবার! আমি বোধহয় ঐ জানোয়ারের একটা অংশ নিজের মধ্যে বহন করে চলেছি। জীবনে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি বাবা। কী করব আমি?
বাক্যহারা হয়ে গেলেন দিগম্বর। মালা বাবার বুকের ওপর দাপাতে শুরু করল। মেয়েকে চেয়ারের ওপর জোর করে বসিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবু। ধীরকণ্ঠে বললেন,
-যদি সত্যিই তাই হয়, তবে এ সিদ্ধান্ত তোমার মালা। তাকে রাখবে না ত্যাগ করবে, এ ব্যাপারে তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমি সব ক্ষেত্রেই তোমার পাশে আছি। কিন্তু এই কঠিন সিদ্ধান্তের নির্ণায়ক আমি হতে পারব না। তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। আমি আর কত বছর বাঁচব মা? দশ বছর! বড়জোর কুড়ি বছর! তারপর এই সন্তানকে তোমাকে একাই সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে। সুতরাং ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও! তার ভবিতব্য নির্ণয় করার দায়িত্ব আমি তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।
-আমার পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয় বাবা! আমি ঐ মানুষের কোন কিছুই নিজের জীবনের সঙ্গে নতুন করে জড়াতে চাই না।
-বেশ। ভালো কথা। নতুন করে জড়াতে হবে না। কিন্তু যে ইতিমধ্যে জড়িয়ে গেছে, তাকে তুই কী করে অস্বীকার করবি মা?
-বাবা তুমি সত্যিই চাও আমি এই সন্তানকে জন্ম দিই?
-আমি ডাক্তার! মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি রোগীর জীবনের জন্যই লড়াই করি। সেখানে নিজের মেয়েকে খুন করার পরামর্শ দিতে বিবেকে বাধছে। আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। তুমি মা। নিজের সন্তানের ভাগ্য নির্ধারণ তুমিই করবে!
বাবা নিজের ঘরে চলে গেছে দীর্ঘক্ষণ আগে। কিন্তু বাবার ঐ একটা কথার অনুরণন মালার মনের মধ্যে এখনো অব্যাহত। বমি করতে করতে অস্থির হয়ে গেল মালা। বমন ইচ্ছা দমন করার প্রবল চেষ্টায় ওর বুক-পেট ব্যথা হয়ে গেল, তবুও ভুলতে পারল না ওই একটা ক্ষুদ্র বাক্য "তুমি মা!" ঐ ক্ষুদ্র বাক্যের মধ্যেই যেন পৃথিবীর সকল মায়া একত্রে জড়িয়ে রয়েছে। সমগ্র রাত্রিব্যাপী অজস্র চোখের জল বিসর্জন দিয়ে, নিজের পেটের ওপর পরম স্নেহে হাত রাখল দীপমালা।
হাসিমুখে মালার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। নরম তোয়ালে জড়ানো সদ্যোজাত শিশুটি গভীর ঘুমে মগ্ন। ক্লান্ত মালার চোখেমুখে পরম প্রশান্তির স্পর্শ। এক সময় এই সন্তানকে পৃথিবীতে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে মনস্থির করতে পারেনি সে। তবে আজ মনের সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মালা বিজয়িনী।
দিগম্বর বাবু নিজের নাতিকে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিলেন। যে মানসিক দোলচালের মধ্যে দিয়ে এই পথ মালা অতিক্রম করেছে, সেই সময়কালের যন্ত্রণা মাথায় রেখে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করল সে,
-অনির্ণেয়!
-রঞ্জক!
বাবার মুখে নবজাতকের নাম শুনে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মালা ক্ষীণস্বরে বলল,
-রঞ্জক! ভারী সুন্দর নাম বাবা।
-অনির্ণেয় কেন? সিদ্ধান্ত নিতে তার গর্ভধারিণী বড় বেশি মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছে, সেইজন্য?
নিরুত্তর দীপমালা। মায়ের কোলের কাছে শিশুটিকে রেখে দিগম্বর বললেন,
-তোর জীবনের সমস্ত রং দিয়ে তোর অনির্ণেয়, আর আমার রঞ্জককে তুই বড় করবি মা। মনুষ্যত্ববোধ আছে, এমন মানুষ তৈরি করবি। আমি আশীর্বাদ করছি, অনির্ণেয় অনেক বড় হবে। সবার থেকে আলাদা হবে ঠিকই, কিন্তু সবার ভালোবাসার মানুষ হয়ে ও ভালোবাসা আদায় করে নেবে...
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে জানালার বাইরের দিকে চাইল দীপমালা। প্রায় শুকিয়ে আসা গুল্মজাতীয় গাছগুলোতে অগুনতি গোলাপ ফুল ফুটেছে। আর তাতে মহানন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে কতগুলো রঙিন প্রজাপতি...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন