প্রজাপতির মৃত্যু
মন প্রজাপতি
প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস
দ্বিতীয় পর্ব
একরত্তি অনির্ণেয়কে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল দীপমালা। বাড়ির পাশের ফাঁকা জমিতে যেন মহোৎসব শুরু হয়ে গেছে। রাজমিস্ত্রীর কোলাহল, ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রোচ্চারণ, শঙ্খ ও ঘন্টাধ্বনি, সব মিলিয়ে আজ ডাক্তারের বাড়িতে সাজো-সাজো রব উঠেছে। মালা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
-বাবা, এসব কী?
অনির্ণেয়কে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দিগম্বর বললেন,
-এদিকে আয়।
ঠাকুরমশাইয়ের হাতের ওপর হাত রেখে একসঙ্গে একটা ইঁট গাঁথল মালা। অনির্ণেয় এবং মালার কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করলেন ঠাকুরমশাই। আজ ভিতপুজোর সঙ্গে একমাত্র নাতির শুভাগমন উপলক্ষ্যে, দিগম্বর গৃহে পুজোর আয়োজন করেছিলেন। মহাসমারোহে ভিতপুজো সম্পন্ন হওয়ার পর বিকেলে রাজমিস্ত্রীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দিগম্বর যখন কথা বলছিলেন; মালা তাকে ডাকল,
-বাবা?
-বল! আমার নাতি কোথায়?
-ফিড করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। এসব তুমি কী করছ বলো তো বাবা? এত প্ল্যানিং, মিস্ত্রী-মজুর। আমি হাসপাতালে যাওয়ার আগে এই প্ল্যান পাস করার জন্য তুমি দৌড়াদৌড়ি করছিলে? অথচ আমাকে জানতেও দাওনি! জিজ্ঞাসা করলে বারবার এড়িয়ে গেছ! এই কী তোমার সেই স্বপ্নের হাসপাতাল?
দিগম্বর একটু হাসলেন। তারপর বললেন,
-না মা। আমার স্বপ্ন দেখার দিন শেষ। এবার তোর আর আমার নাতির দিন শুরু। আমার নাতির যেন কোন অযত্ন না হয় মালা। ওকে মেইডের ভরসায় বাড়িতে ফেলে রেখে, তোকে বাইরে কোথাও চাকরি করতে কোনদিনই যেতে হবে না। এটা তোর স্কুল। আমি যতটা পারছি করে দিয়ে যাচ্ছি। আপাতত সারাদিনে দু'হাজার ছাত্র পড়ানোর মতো ক্লাসরুম হবে। ওদিকে পাশাপাশি স্টুডেন্টদের জন্য পাঁচটা ওয়াশরুম। এদিকে স্টাফ ও টিচারদের ওয়াশরুম। দোতলা বিল্ডিং হবে। কিন্তু ভিত করা রইল চার তলার। এরপর আমি না থাকলে তুই ইঁটের ওপর ইঁট গেঁথে নিতে পারবি না মা? তুই না পারলেও, আমার নাতি ঠিক পারবে। আমি ওর ভবিষ্যৎ গুছিয়ে দিয়ে গেলাম। তোকে আর আমার নাতিকে কোথাও চাকরির জন্য ঘুরতে হবে না। বরং তোরা এই স্কুলে মানুষকে চাকরি দিবি, তাদের অন্নের সংস্থান করবি। আর একদম ছোট দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য প্রতিদিন দুপুরে ওই ফাঁকা জায়গায় ক্যাম্প করে অবৈতনিক স্কুল হবে। যারা পয়সার জন্য স্কুল চত্বর থেকে সাত হাত দূরে থাকে, তাদের প্রাথমিক শিক্ষাদান করবি তুই। প্রকৃতির মাঝে ক্লাস হবে, শরীরচর্চা হবে। আমি মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করতে চেয়েছিলাম মালা। সুস্বাস্থ্য বল কিংবা শিক্ষা, জীবনে তো দুটোরই প্রয়োজন আছে। তুই এইদিকে করবি, আর আমি যে ক'টা দিন বাঁচব, হসপিটালে ডিউটি করব। চেম্বারে ছুটব। পারবি না মা! আমার রঞ্জককে সামলে এই নতুন সংসারের দায়িত্ব নিতে?
সুবিস্তৃত ভিতের ওপর সারি-সারি ইঁট গাঁথা হচ্ছে। মিস্ত্রীদের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কিন্তু মালা আর কিছুই দেখতে পেল না। মুহূর্তেই ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। বাবাকে জড়িয়ে স্বপ্নের স্কুলবাড়ির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দিগম্বরের ম্লান হয়ে যাওয়া মুখটা তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যখন বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে মালা মৃদুস্বরে বলল,
-আমি পারব বাবা!
অবিলম্বে দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীর মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হল স্কুলবাড়ির চত্বরে। বাড়ির সামনে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা হল 'বসুধা শিক্ষা নিকেতন'। একরত্তি অনির্ণেয়কে সামলে উচ্চশিক্ষার জন্য জোরকদমে পড়াশোনা শুরু করল মালা। রামধনুর মতো রংবেরংয়ের প্রচারপত্র বিতরণ করা হল শহরের প্রত্যেকটি জনবহুল জায়গায়। দূর দূরান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের খুঁটিগুলো ঢাকা পড়ল স্কুলবাড়ির সুবৃহৎ ছবির আড়ালে। বছর পাঁচেক পর প্রথম প্রভাতের নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে অসংখ্য ক্ষুদ্র বৃহৎ রঙিন প্রজাপতি প্রথম পাখা মেলে অভিভাবকদের হাত ধরে, কোলে চেপে যখন স্কুলের বড় গেটের সামনে উপস্থিত হল, তখন প্রিন্সিপালের চেয়ার আগলে চোখে চশমা এঁটে বসে রয়েছেন ব্যক্তিত্বময়ী দীপমালা চট্টোপাধ্যায়।
*******
রাস্তার টাইমের কল থেকে তিন বালতি জামাকাপড় কেচে ধুয়ে উঠোনে পা রেখেই বারান্দায় শুয়ে পড়ল পদ্মাবতী। এতবড় পেটটা নিয়ে ও আর চলতে ফিরতে পারে না। ঘর থেকে পিসি শাশুড়ির মুখনিঃসৃত অমৃতের মতো সুমিষ্ট বাণী ভেসে এলো,
-ও বউ, এলি? ও বউ!
-কী হয়েছে কী!
-বলি তোর গতরে কী পোকা ধরল নাকি রে! খেতে দিবিনে? কতখানি বেলা হল। ওই যে, মজ্জিদে সুর করে আযান দেয়। খিদা লাগে রে বউ! এরপর কী সুয্যি ডুবলে ভাত দিবি? দুটো ভাতের জন্য এই আবাগির কাছে দু'বেলা মুখ ঝামটা শুনতে হয়! তাও খাই নিজের ভাই ব্যাটার ভাত। পোড়া কপাল আমার! ও বউ! কোথায় মরলি রে তুই?
-এই দাঁড়াও তো! নিজের শরীরের জ্বালায় জ্বলে মরে যাচ্ছি, এই বুড়ি খাওনের জন্য চারবেলা হা হা করছে। বলি ভাই ব্যাটার ভাত খাও যখন, ঐ ভাই ব্যাটাকেই তো বলতে পারো, সে তিন বেলা তোমার মুখে রান্না করা ভাত তুলে দেবে।
-হ্যাঁ তাই বলব। তোর যত বড় বড় কথা! চোখ খুলে উঠেই ছেনালি করতে বেরিয়ে যাস! সাত বাড়ি চরে না বেড়ালে তোর পেটের ভাত হজম হয় না, সে কী আর আমি জানি না! ঢলানী মেয়েছেলে কোথাকার! কী দেখে যে আমার দুলাল গলেছিল! ওই গতর গতর! তোর গতরের এত জ্বালা, এখনো পেট করে বসে আছিস! ঘরের দিকে নজর আছে? একটা বুড়ি যে এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে শুকিয়ে গেল...
দুর্বলদেহী পদ্মাবতীর মাথা এতটাই ঘুরছে, ও আর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। কিন্তু বাক্যবাণের জ্বালায় উঠতেই হল, ভেজা জামাকাপড়গুলো থেকে একটু জল ঝরলে তবেই ঘরে ঢোকানো যাবে। এদিকে সন্ধ্যা আসন্ন। কাপড়গুলো উঠোনের দড়িতে মেলতে মেলতেই বকবক শুরু করল পদ্মাবতী,
-খালি খাওন আর খাওন! পেট তো নয়, যেন কুয়ো! কত তোমার ভাই ব্যাটার টাকায় খাও তুমি, সে আমার জানা আছে। এবার থেকে একবার বলে দেখো, এ বউ! খিচুড়ির সঙ্গে একটা ডিম ভেজে দিবি? যা না, নাড়ুর দোকান থেকে চারটে ডিম নে আয়। তোর ছেলেপিলেরাও খাক! আমার ভাই ব্যাটা পরে পয়সা দে দেবে। দেখো বলে একবার! জন্মের শোধ খাওয়াব ডিমভাজা! বুড়ি ঘাটে উঠতে চলল, তাও দেখো নোলা একেবারে লকলক করছে। কোনদিন দিয়েছে তোমার ভাই ব্যাটা ঐ ধারের পয়সা? সারাদিন কাজ করবে, বিকেলে কলাটা-মূলোটা নিয়ে রাস্তার কোণে বসবে, আর রাতে ঠেকে মদ গিলে পকেট খালি করে ঘরে ঢুকবে! কী দিয়ে যে সংসার চলে বিছানায় শুয়ে তুমি বুঝবে কী করে বুড়ি! রোজ চোখ খুলে উঠে এই ছিনাল মেয়েছেলে সাত বাড়ি ঐ ছেনালি করতে না বেরোলে, দু'দিনেই শখের খাওন ঘুচে যাবে বুঝলে! আমার কী ইচ্ছা করে না, একটু ঘরে থেকে শুয়ে বসে আরাম করি! গতরে বেশি তেল হয়েছে যেন আমার! যে চোখ খুলে উঠেই লোকের বাড়ি ছুটব! পেটটা নিয়ে নড়তে পারি না। কিন্তু বাবুর বাড়ির কাজগুলো আজ ছাড়লে কালই তারা নতুন লোক রাখবে। বাবুদের সব ননীর শরীল। একবেলা লোক ছাড়া চলে না। একটা দিন কাজে কামাই করলেই মুখের রং ঢং বদলে যায়। টাকা দিয়ে কাজ করায়, মাগনা তো আর না.... আমার শরীলের ভালোমন্দ দেখবে কেন তারা! টাকা ফেললে কাজ করার জন্য লোক বসে আছে। কিন্তু কাজ গেলে আমার ঘরের এতগুলো পেট চলবে কোথা থেকে শুনি! তার ওপর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা.... কী মরতে যে এই হাড় হাভাতে ঘরে এসে পড়েছিলাম মা গো! শরীল ভেঙে খেটে মরো, আবার কথা শুনেও মরো! এর চেয়ে বাপের ঘরে বসে থাকতাম, গতরে খাটতাম পেটে খেতাম, ওই ভালো হতো। একটা পেটের আবার চিন্তা কী? গুচ্ছের ছেলেমেয়ে তো আর বিয়োতে হতো না। শরীলটা আমার একেবারে শেষ হয়ে গেল গো। এতগুলো বছর হয়ে গেল নিজে একটা ভালো কাপড় একটা বেলাউজ কিনে পরতে পারি না, বাবুদের বাড়ি থেকে পাওয়া জামাকাপড় জোড়াতাড়া দিয়ে গোটা জেবনটাই কাটিয়ে দিলাম। ভালোমন্দ কিছু খাবার খেতে ইচ্ছে করলেও জোটে না, সব সংসারেই যায়! শালা সংসার তো নয়, যেন রাবণের চিতে! দিনরাত জ্বলছে! কিছুতেই আর অভাব নেভে না। যত দাও, ততই হাঁ করে আছে! মরণ মরণ! আমার মরণও হয় না ঠাকুর! ওঃ মা গো...
ঘরের ভিতরে মাদুরে বসে থাকা চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধা বহুপূর্বেই চুপ করে গেছে একনাগাড়ে উগড়ে যাওয়া পদ্মাবতীর বাক্যবাণের জ্বালায়। পেটের ছেলেটা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো দুটো ভাতের জন্য ভাই ব্যাটার বউয়ের এত গঞ্জনা সহ্য করতে হতো না। নিজের মা'কে কী আর ছেলে ফেলে দিতে পারত? সধবা কালে মাত্র একটাই ব্যাটা বিইয়েছিল সে। তাকেও আঁতুর ওঠার আগেই ভগবান কোল থেকে কেড়ে নিলেন। তারপর একদিন বরটাও মরে গেলে গাড়ি চাপা পড়ে। তিন ভাসুরঠাকুর আর তাকে শ্বশুরঘরের অন্ন ধ্বংস করার জন্য রাখতে চাইলেন না। অগত্যা দাদার বোঝা হয়ে বাপের ঘরে এসে উঠল সে। দাদা-বৌদি গত হয়েছেন বহু বছর হয়ে গেল। কিন্তু এই পোড়ারমুখী বিধবা বোনটাকে ফেলে গেছে শেষ বয়সে অথর্ব অবস্থায় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করার জন্য। দাদার মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলের হাতে এসে পড়েছে বৃদ্ধা। দাদার বড় ছেলেটা একবারও পিসির খোঁজ রাখে না। অথচ তার ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা আছে। বুড়ো পিসিকে একবেলা দুটো ভাত দিলে কী তার অগাধ ঐশ্বর্য কিছু কমে যেত! খিদের জ্বালায় বিছানায় শুয়ে বৃদ্ধা চোখের জল ফেলছিল। চোখের সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ক'টা মুড়ি আর বাতাসা দিয়ে বাবুর বাড়ির কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল পদ্ম। সেই মুড়ি জলে ভিজিয়ে খিদের জ্বালায় বারকয়েক খেয়েছে বৃদ্ধা। তবুও সব মুড়ি সকালেই শেষ হয়ে গেছে। দন্তহীন বৃদ্ধা একটা বাতাসা চুষে চুষে খাচ্ছিল। তাও পেটের জ্বালা নেভে না। সে এই ঘরের মধ্যে সারাদিন একা পড়ে থাকে। জনমনিষ্যির দেখা পাওয়া যায় না। বুড়ো বয়সে অপ্রাসঙ্গিক আর অতিরিক্ত কথা বলার জন্য তাকে সকলেই সযত্নে এড়িয়ে যায়। জীর্ণ কাঁথার ওপরে দীর্ঘ সময়ব্যাপী একা শুয়ে থাকতে থাকতে খিদের তাড়নায় গুঙিয়ে কেঁদে ফেলে বৃদ্ধা। বিছানায় মল-মূত্র ত্যাগ করলেও, ঐ পদ্মর মুখের দিকে চেয়েই বসে থাকতে হয়, কখন সে বিছানা পরিষ্কার করে দেবে! দুলাল আর পদ্ম সারাদিন পেটের দায়ে দুটো পয়সার জন্য ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েরা সব পড়াশোনা করে। পাড়া বেড়াতে বেরোয়। এর ঘর ওর ঘরে ঘুরে খায়। একমাত্র বৃদ্ধা বাঁধা পড়েছে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। একাকীত্বের জ্বালা, আর সেই সঙ্গে এই পেটের জ্বালা বড় কষ্ট দেয়। সময়ে-অসময়ে খিদের জ্বালায় অনেক কুকথা বেরিয়ে পড়ে বৃদ্ধার মুখ থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে ধাতব বালতির ঝনঝনানির শব্দের সঙ্গেই তীব্র এক আর্তনাদ, আর তারপরই বন্ধ হয়ে গেল বউয়ের বাক্যবাণ! শশব্যস্ত বৃদ্ধা বিছানায় শুয়েই দরজা পিটিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল,
-ও বউ তোর কী হল? পড়ে গেলি নাকি? ও ঠাকুর! আমার পদ্মর কী হল গো! কেউ শিগগির এসো। ভরা মাস! বালতি নিয়ে বউটা পড়ে গেল মনে হয়! ও পদ্ম! রা কাড়িস না কেন রে? ও বউ!
আজ এক বাড়ির বৌদি তাড়াতাড়ি কাজে যেতে বলেছিল। ঐ বাড়ির বাচ্চাটার পাঁচ বছরের জন্মদিন। অগুনতি বাসন মেজে, দোতলা বাড়ির এতগুলো ঘরদোর মুছতে মুছতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘরে শুয়ে থাকা মানুষটার খিদে পাওয়ারই কথা! কিন্তু সাত বাড়ির এঁটো-কাঁটা ঘেঁটে, লোকের পাত কাচিয়ে চিরকালই গা কাপড় ধুয়ে স্নান করার অভ্যাস পদ্মাবতীর। নইলে ঘরে পা রাখতে মন চায় না। আজ ঐ বৌদি বাড়ির সকলের জন্য বিরিয়ানি আর মাংস দিয়েছে। সকলে একসঙ্গে বসে খাবে বলে, তাড়াতাড়ি হাতের কাজ গুছোতে চাইছিল পদ্ম। পরনের জামাকাপড়ের সঙ্গে আরও কয়েকটা জামাকাপড় কেচে স্নান করে ঘরে ঢোকার সময় পিসি শাশুড়ির কথায় মনটা এত খারাপ হয়ে গেল, যে আর সহ্য হল না। খিদেয় ওর নিজেরও পেট জ্বলছিল। বৌদি ওখানে বসেই ওকে খেতে বলেছিল। জানে বাড়িতে নিয়ে এলে ওর কপালে আর কিছুই জুটবে না! কিন্তু ঘরের বুড়িটাকে আর বাচ্ছাগুলোকে ফেলে, বাইরে কোন ভালো খাবার খেতে পদ্মর মন চায় না। স্নান সেরে উঠোনে পা রেখেই বাক্যবাণের জ্বালায় রাগে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে, পিসি শাশুড়ির কথার প্রত্যুত্তরে কথা বলতে ব্যস্ত থাকা পদ্ম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। আর তার ফলেই ঘটে গেল এক চরম দুর্ঘটনা। বালতিটা বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল উঠোনে। ভিজে কাপড়ে পা জড়িয়ে আছাড় খেয়ে অচৈতন্য পদ্ম পড়ে রইল সিঁড়ির ওপরে। প্রতিবেশীর ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো পদ্মর মেয়ে পূর্ণা। সাইকেল নিয়ে ঠিক তখনই টিউশন থেকে ফিরে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে কৈশোরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে। সে পদ্মর জ্যেষ্ঠ পুত্র টুকাই। সাইকেলটা কোনরকমে উঠোনে শুইয়ে রেখে মায়ের কাছে এসে, মাকে টেনে তুলল ছেলে...
কন্যা জন্মের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। হাসপাতালের শয্যায় প্রায় মিশেছিল পদ্ম। একজন নার্সদিদি এসে ওকে জিজ্ঞাসা করল,
-এই আজও তোমার বাড়ি থেকে কেউ এলো না? কাল তো ছুটি। তোমায় নিতে না এলে বাচ্চা নিয়ে তুমি যাবে কী করে?
সরকারি হাসপাতালের একটা শয্যা আঁকড়ে পদ্ম শুয়েছিল। আশেপাশের সবার বাড়ির লোক আসে, গল্প করে। সদ্যোজাত বাচ্চাকে নিয়ে হাসি-মজা করে। বাচ্চা না হলে বাড়ির লোক গর্ভবতী ভীতু মেয়েটার মাথার সামনে বসে থাকে। সাহস জোগায়। কত স্বামীদের পদ্ম দেখল, বউয়ের হাত ধরে বসে আছে। কত সোহাগ করছে! ও কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে। এত যত্ন পদ্ম স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু ঘরের মানুষটা যে একবারও ওকে দেখতে আসবে না, পদ্ম এটা ভাবতেও পারেনি! হয়তো ওকে ছাড়া ঘরে-বাইরে সামলাতে লোকটা অস্থির হচ্ছে! তাই হবে নিশ্চয়ই! একটা হাত আবার অকেজো। কোনদিকে করবে মানুষটা! বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেলল পদ্ম। বলে উঠল,
-এই মেয়েটারে কাউরে দিয়ে দেওয়া যায় দিদি? ওই যাদের বাচ্চাকাচ্চা হয় না, এমন কাউরে? আমি এরে বাড়ি নে যেতে চাই না। কোন টাকাপয়সা লাগবে না। বিককিরি করব না। কেউ নে গেলে মেয়েটা পেটপুরে দুটো খেতে পাবে! যেখানেই থাক, খেয়ে-পরে ভালো থাকলেই হল!
-কী বলছ তুমি?
-আমি আর পারছি না দিদি! আমি ওকে চাইনি। কেউ চায়নি ওকে। কত ওষুধপত্তর করেছি, কত শেকড় বাকড় বেটে খেয়েছি। জানোয়ারের মতো খেটেছি। ভারী জামাকাপড় কেচেছি। পেট চেপে ধরে বাবুদের ঘর মুছেছি। একদিনও বাবুর বাড়ির কাজে কামাই দিইনি। ভেবেছিলাম আপদ এইভাবেই বিদেয় হবে। কিন্তু কোন ওষুধ কাজ করল না। ডাক্তারবাবুর কাছে সে সময় নষ্ট করতে এলাম। দেখে ধমক দিয়ে বলল, এতদিন ঘুমুচ্ছিলে? সময় পেরিয়ে গেছে। আর হবে না। যাও যাও! আসলে আমার শরীল খারাপ ঠিকমতো হত না দিদি। আমি হবে হবে করে বসে আছি। এদিকে যে ভিতরে এসব হয়ে আছে, বুজব কী করে বলো? সবাই বলতে ঘরে টেস করে দেখি এই অবস্তা! শরীল নিয়ে আহা-উহু করলে আমার সংসার চলবে বলো? আর কী করি? নিজের শরীলের ওপর জোর করতাম যাতে বেরিয়ে যায়! কিন্তু এ আবাগি কিছুতেই বেরোল না। সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করে পোড়ারমুখী ঠিক বেঁচে গেল। তখনই আমি বুঝেছি, এ মেয়েমানুষ না হয়ে যায় না! হতভাগীর কই মাছের পেরান!
-বর্ন ফাইটার!
-সে আবার কী দিদি?
-কিছু না! তুমি মা না কী বলো তো? নিজের বাচ্চা বিলিয়ে দেওয়ার কথা একদম বলবে না। আগে ক'টা বাচ্চা?
-তিন ছেলে-মেয়ে। দুই ছেলে এক মেয়ে! টুকাই, ছোটু আর পূর্ণা।
-বর মেয়ে চায় না নাকি? একবারও বাচ্চার মুখ দেখতে এলো না যে!
-না চেয়েছিল। দুই ছেলের পর একটা মেয়েই চেয়েছিল। ওর একটা মেয়ের খুব শখ দিদি।
-শখেরও বলিহারি! তা মেয়ে যখন হয়েই গিয়েছিল, অপারেশন হয়ে যাওনি কেন?
-সেবার পূর্ণার সময় আমার শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল দিদি। ফোরসে করে ডাক্তারবাবু ওকে বের করে। তারপর অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমার ছোটু সে সময় মিত্তিরদের বাড়ি আম চুরি করতে গে, আমগাছ থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে। ক'দিন ওকে নে খুব ঝক্কি গেছে। তখনো আমার লোকটা আসতে পারেনি। অপারেশনের কাগজে কে সই করবে বলো! ছেলেটার কথা ভেবে সেবার আমিও তাড়াতাড়ি ঘরে চলে যাই। তারপর কাজকম্ম শুরু হল। আর আসা হয়নি গো।
-তাই আবার কাজ সেরে একেবারে গুছিয়েই এসেছ? তা অপারেশন হয়েছ এবার? নাকি আসছে বছর আবার...
-না দিদি। এবার মঙ্গলার মা টিপছাপ দিয়েছে। হয়ে গেছি।
-তাও ভালো! দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়েছে।
-ও দিদি, তুমি আমার একটা উপকার করবে? ও দিদি!
-কী? কী করব? ঘ্যানঘ্যান করছ কেন?
-তুমি আমারে ক'টা টাকা ধার দেবে? আমাদের কেউ নিতে আসবে না। মায়ে-ঝিয়ে নিজেই ঘরে যাব। আমার কাছে একটাও টাকা নেই। রিসকা ভাড়াটা দেবে? এখান থেকে আমার ঘর চল্লিশ টাকা ভাড়া। এতদিন আমি ঘরে নেই, ঘরে খাবার কী আছে না আছে! গিয়ে বাজার করতে হবে। তুমি আমারে ওই একশো টাকাই দিও। ও দিদি, আমি ঘরে গিয়ে এক সপ্তা পর থেকেই আবার বাবুর বাড়িতে কাজ শুরু করব। বেশি ছুটি নিয়ে শুয়ে থাকলে আমার সংসারটাও আমার মুখের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকবে গো। তুমি বিশ্বাস করে টাকাটা দাও দিদি, এই মেয়ের দিব্যি বলছি, মাইনে হাতে পেলেই তোমার টাকা তোমারে ফেরত দে যাব।
-যে মেয়েকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে, একটু আগে দান করার কথা বলছিলে, এখন টাকার জন্য তার দিব্যি কেটে কথা বলছ? লজ্জা করে না?
চুপ করে গেল পদ্মাবতী। নার্সদিদি হেলেদুলে চলে গেল অন্য শয্যার দিকে। মায়ের কোলের মধ্যে কেঁদে উঠল একরত্তি শিশুকন্যা। শুষ্ক স্তনবৃন্তটা জোর করে তার মুখে গুঁজে দিল পদ্ম। কিন্তু কন্যার কান্না আর থামে না। নার্সদিদি এসে ছোঁ মেরে পদ্মর কোল থেকে মেয়েকে তুলে, আর এক মায়ের কোলে দিল। সেই মায়ের স্তন্যপান করে একটু শান্ত হল অভাগিনী।
পরের দিন কতগুলো কাপড়চোপড়ে পুঁটুলি করে মেয়েকে জড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে রিক্সাস্ট্যান্ডে এসে পদ্ম বলল,
-মোছলমান পাড়ার আগের মোড়ে যাবে ভাই? ঘরে গে টাকা দেব। একটু দাঁড়াতে হবে।
রিক্সা চালক ইতস্তত করছে দেখে পদ্ম বলল,
-চলো না ভাই। সবেমাত্তর বাচ্চা হয়েছে। শরীলটা কাঁচা। ঘরের লোকটা নিতে আসেনি। বাচ্চা নিয়ে এত পথ হাঁটতে খুব কষ্ট হবে। চলো না একটু!
-নাও ওঠো ওঠো! হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে রিক্সায় ওঠো।
ঘাড় ফিরিয়ে পদ্ম দেখল ওর পিছনে সেই নার্সদিদি দাঁড়িয়ে আছে। ধমক দিয়ে উঠল সে,
-আরে ওঠো তাড়াতাড়ি। আমার মুখের দিকে কী দেখছ?
মেয়েকে কোলে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল পদ্ম। ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে দিদি মৃদুস্বরে বলল,
-দুধ হবে বলে তো মনে হয় না। নিজেরই খাওয়াদাওয়া নেই, তো হবে কী করে! শোন, বাচ্চাকে দুধ কিনে খাওয়াবে। আর নিজেও একটু ভালোমন্দ খাবে। গোটা জীবনটা সংসারের জন্য ঢেলে দিও না। কত দেখলাম তোমার মতো মেয়েমানুষ! একটা কথা মাথায় রাখো, তুমি ভালো না থাকলে, তোমার ঐ সাধের সংসার ভেসে যাবে। তুমি চোখ বুজলে বর আবার বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসবে। তখন তোমার বাচ্চাগুলোর দুর্গতির শেষ থাকবে না। আগে নিজে একটু ভালো থেকে, তারপর সবাইকে ভালো রেখো। বুঝলে? আর এই টাকা ফেরত দিতে এলে তোমার খবর আছে। যাও যাও! এই ভাই, তোমার ভাড়াটা রাখো। রিক্সা একটু আস্তে আস্তে চালাবে বুঝলে! রাস্তার যা অবস্থা! নতুন মা! কষ্ট হবে।
কান্নায় পদ্মর গলা বুজে এসেছিল। রিক্সা চলতে শুরু করামাত্রই তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকটা সরিয়ে পদ্ম দেখল নার্সদিদিকে। সে হাসপাতালের দিকে ছুটছে। চিৎকার করে ডেকে উঠল পদ্ম,
-ও দিদি?
-কী? ও টাকা আর ফেরত চাই না। তুমি যাও। নিজের যত্ন নিও। বাচ্চার কার্ড করিয়ে সময়মতো সব ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে নেবে। মনে করে পোলিও খাওয়াবে!
-টাকার জন্য না দিদি। ওর মা বেঁচে থাকতে, তুমি আমার মেয়ের দুধের টাকা দিলে। শুধু তোমার নামটা বলো গো দিদি? মরণ পর্যন্ত আমি তোমারে ভুলব না গো!
অমায়িক হাসি হেসে নার্স বলে উঠল,
-সুরঞ্জনা!
তারপরই সে ছুটল হাসপাতালের দিকে। রিক্সা পূর্ণ গতি পেয়ে গেছে। অশ্রুসজল পদ্মর দু'চোখ। দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে আগলে রিক্সায় চেপে বসে অঝোরে কাঁদল ও। হাতের মুঠো খুলে দেখল, পাঁচশত টাকা মুঠোবন্দি হয়ে ঘামে ভিজে উঠছে। কোনরকমে ওই টাকাটা আঁচলে মুড়ে মেয়েকে বুকের ভিতর জড়িয়ে রাখল পদ্ম। মায়ের বুকের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে রয়েছে মেয়েটা। যেন কত নিশ্চিন্ত আশ্রয়! অথচ পেটে থাকতে এই জন্মদাত্রী ওকে হত্যা করার জন্য কত যুদ্ধই না করেছে! কিন্তু নিজের গর্ভধারিণীকে পরাস্ত করে একজন যোদ্ধার মতো এই অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছে মেয়েটা। কাপড়ের আঁচলে বাঁধা টাকাটা মুঠো করে ধরল পদ্ম। ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে ধীরকণ্ঠে বলে উঠল,
-সুরঞ্জনা!
রিক্সা এগিয়ে চলল আপন গতিতে। গতরাতে বোধহয় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে শুকিয়ে আসা কাদার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল পদ্ম। রাস্তার কোণে অযত্নে বেড়ে ওঠা রংবেরংয়ের বুনোফুলগুলো বুঝি এখনো সিক্ত। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে বিন্দু বিন্দু জল খসে পড়ছে রুক্ষ মাটিতে। অযত্নে ও অবহেলায় প্রস্ফুটিত বুনোফুলগুলোর ওপর কয়েকটা চঞ্চল প্রজাপতি মহানন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
-বাবা, এসব কী?
অনির্ণেয়কে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দিগম্বর বললেন,
-এদিকে আয়।
ঠাকুরমশাইয়ের হাতের ওপর হাত রেখে একসঙ্গে একটা ইঁট গাঁথল মালা। অনির্ণেয় এবং মালার কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করলেন ঠাকুরমশাই। আজ ভিতপুজোর সঙ্গে একমাত্র নাতির শুভাগমন উপলক্ষ্যে, দিগম্বর গৃহে পুজোর আয়োজন করেছিলেন। মহাসমারোহে ভিতপুজো সম্পন্ন হওয়ার পর বিকেলে রাজমিস্ত্রীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দিগম্বর যখন কথা বলছিলেন; মালা তাকে ডাকল,
-বাবা?
-বল! আমার নাতি কোথায়?
-ফিড করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। এসব তুমি কী করছ বলো তো বাবা? এত প্ল্যানিং, মিস্ত্রী-মজুর। আমি হাসপাতালে যাওয়ার আগে এই প্ল্যান পাস করার জন্য তুমি দৌড়াদৌড়ি করছিলে? অথচ আমাকে জানতেও দাওনি! জিজ্ঞাসা করলে বারবার এড়িয়ে গেছ! এই কী তোমার সেই স্বপ্নের হাসপাতাল?
দিগম্বর একটু হাসলেন। তারপর বললেন,
-না মা। আমার স্বপ্ন দেখার দিন শেষ। এবার তোর আর আমার নাতির দিন শুরু। আমার নাতির যেন কোন অযত্ন না হয় মালা। ওকে মেইডের ভরসায় বাড়িতে ফেলে রেখে, তোকে বাইরে কোথাও চাকরি করতে কোনদিনই যেতে হবে না। এটা তোর স্কুল। আমি যতটা পারছি করে দিয়ে যাচ্ছি। আপাতত সারাদিনে দু'হাজার ছাত্র পড়ানোর মতো ক্লাসরুম হবে। ওদিকে পাশাপাশি স্টুডেন্টদের জন্য পাঁচটা ওয়াশরুম। এদিকে স্টাফ ও টিচারদের ওয়াশরুম। দোতলা বিল্ডিং হবে। কিন্তু ভিত করা রইল চার তলার। এরপর আমি না থাকলে তুই ইঁটের ওপর ইঁট গেঁথে নিতে পারবি না মা? তুই না পারলেও, আমার নাতি ঠিক পারবে। আমি ওর ভবিষ্যৎ গুছিয়ে দিয়ে গেলাম। তোকে আর আমার নাতিকে কোথাও চাকরির জন্য ঘুরতে হবে না। বরং তোরা এই স্কুলে মানুষকে চাকরি দিবি, তাদের অন্নের সংস্থান করবি। আর একদম ছোট দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য প্রতিদিন দুপুরে ওই ফাঁকা জায়গায় ক্যাম্প করে অবৈতনিক স্কুল হবে। যারা পয়সার জন্য স্কুল চত্বর থেকে সাত হাত দূরে থাকে, তাদের প্রাথমিক শিক্ষাদান করবি তুই। প্রকৃতির মাঝে ক্লাস হবে, শরীরচর্চা হবে। আমি মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করতে চেয়েছিলাম মালা। সুস্বাস্থ্য বল কিংবা শিক্ষা, জীবনে তো দুটোরই প্রয়োজন আছে। তুই এইদিকে করবি, আর আমি যে ক'টা দিন বাঁচব, হসপিটালে ডিউটি করব। চেম্বারে ছুটব। পারবি না মা! আমার রঞ্জককে সামলে এই নতুন সংসারের দায়িত্ব নিতে?
সুবিস্তৃত ভিতের ওপর সারি-সারি ইঁট গাঁথা হচ্ছে। মিস্ত্রীদের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কিন্তু মালা আর কিছুই দেখতে পেল না। মুহূর্তেই ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। বাবাকে জড়িয়ে স্বপ্নের স্কুলবাড়ির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দিগম্বরের ম্লান হয়ে যাওয়া মুখটা তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যখন বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে মালা মৃদুস্বরে বলল,
-আমি পারব বাবা!
অবিলম্বে দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীর মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হল স্কুলবাড়ির চত্বরে। বাড়ির সামনে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা হল 'বসুধা শিক্ষা নিকেতন'। একরত্তি অনির্ণেয়কে সামলে উচ্চশিক্ষার জন্য জোরকদমে পড়াশোনা শুরু করল মালা। রামধনুর মতো রংবেরংয়ের প্রচারপত্র বিতরণ করা হল শহরের প্রত্যেকটি জনবহুল জায়গায়। দূর দূরান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের খুঁটিগুলো ঢাকা পড়ল স্কুলবাড়ির সুবৃহৎ ছবির আড়ালে। বছর পাঁচেক পর প্রথম প্রভাতের নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে অসংখ্য ক্ষুদ্র বৃহৎ রঙিন প্রজাপতি প্রথম পাখা মেলে অভিভাবকদের হাত ধরে, কোলে চেপে যখন স্কুলের বড় গেটের সামনে উপস্থিত হল, তখন প্রিন্সিপালের চেয়ার আগলে চোখে চশমা এঁটে বসে রয়েছেন ব্যক্তিত্বময়ী দীপমালা চট্টোপাধ্যায়।
*******
রাস্তার টাইমের কল থেকে তিন বালতি জামাকাপড় কেচে ধুয়ে উঠোনে পা রেখেই বারান্দায় শুয়ে পড়ল পদ্মাবতী। এতবড় পেটটা নিয়ে ও আর চলতে ফিরতে পারে না। ঘর থেকে পিসি শাশুড়ির মুখনিঃসৃত অমৃতের মতো সুমিষ্ট বাণী ভেসে এলো,
-ও বউ, এলি? ও বউ!
-কী হয়েছে কী!
-বলি তোর গতরে কী পোকা ধরল নাকি রে! খেতে দিবিনে? কতখানি বেলা হল। ওই যে, মজ্জিদে সুর করে আযান দেয়। খিদা লাগে রে বউ! এরপর কী সুয্যি ডুবলে ভাত দিবি? দুটো ভাতের জন্য এই আবাগির কাছে দু'বেলা মুখ ঝামটা শুনতে হয়! তাও খাই নিজের ভাই ব্যাটার ভাত। পোড়া কপাল আমার! ও বউ! কোথায় মরলি রে তুই?
-এই দাঁড়াও তো! নিজের শরীরের জ্বালায় জ্বলে মরে যাচ্ছি, এই বুড়ি খাওনের জন্য চারবেলা হা হা করছে। বলি ভাই ব্যাটার ভাত খাও যখন, ঐ ভাই ব্যাটাকেই তো বলতে পারো, সে তিন বেলা তোমার মুখে রান্না করা ভাত তুলে দেবে।
-হ্যাঁ তাই বলব। তোর যত বড় বড় কথা! চোখ খুলে উঠেই ছেনালি করতে বেরিয়ে যাস! সাত বাড়ি চরে না বেড়ালে তোর পেটের ভাত হজম হয় না, সে কী আর আমি জানি না! ঢলানী মেয়েছেলে কোথাকার! কী দেখে যে আমার দুলাল গলেছিল! ওই গতর গতর! তোর গতরের এত জ্বালা, এখনো পেট করে বসে আছিস! ঘরের দিকে নজর আছে? একটা বুড়ি যে এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে শুকিয়ে গেল...
দুর্বলদেহী পদ্মাবতীর মাথা এতটাই ঘুরছে, ও আর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। কিন্তু বাক্যবাণের জ্বালায় উঠতেই হল, ভেজা জামাকাপড়গুলো থেকে একটু জল ঝরলে তবেই ঘরে ঢোকানো যাবে। এদিকে সন্ধ্যা আসন্ন। কাপড়গুলো উঠোনের দড়িতে মেলতে মেলতেই বকবক শুরু করল পদ্মাবতী,
-খালি খাওন আর খাওন! পেট তো নয়, যেন কুয়ো! কত তোমার ভাই ব্যাটার টাকায় খাও তুমি, সে আমার জানা আছে। এবার থেকে একবার বলে দেখো, এ বউ! খিচুড়ির সঙ্গে একটা ডিম ভেজে দিবি? যা না, নাড়ুর দোকান থেকে চারটে ডিম নে আয়। তোর ছেলেপিলেরাও খাক! আমার ভাই ব্যাটা পরে পয়সা দে দেবে। দেখো বলে একবার! জন্মের শোধ খাওয়াব ডিমভাজা! বুড়ি ঘাটে উঠতে চলল, তাও দেখো নোলা একেবারে লকলক করছে। কোনদিন দিয়েছে তোমার ভাই ব্যাটা ঐ ধারের পয়সা? সারাদিন কাজ করবে, বিকেলে কলাটা-মূলোটা নিয়ে রাস্তার কোণে বসবে, আর রাতে ঠেকে মদ গিলে পকেট খালি করে ঘরে ঢুকবে! কী দিয়ে যে সংসার চলে বিছানায় শুয়ে তুমি বুঝবে কী করে বুড়ি! রোজ চোখ খুলে উঠে এই ছিনাল মেয়েছেলে সাত বাড়ি ঐ ছেনালি করতে না বেরোলে, দু'দিনেই শখের খাওন ঘুচে যাবে বুঝলে! আমার কী ইচ্ছা করে না, একটু ঘরে থেকে শুয়ে বসে আরাম করি! গতরে বেশি তেল হয়েছে যেন আমার! যে চোখ খুলে উঠেই লোকের বাড়ি ছুটব! পেটটা নিয়ে নড়তে পারি না। কিন্তু বাবুর বাড়ির কাজগুলো আজ ছাড়লে কালই তারা নতুন লোক রাখবে। বাবুদের সব ননীর শরীল। একবেলা লোক ছাড়া চলে না। একটা দিন কাজে কামাই করলেই মুখের রং ঢং বদলে যায়। টাকা দিয়ে কাজ করায়, মাগনা তো আর না.... আমার শরীলের ভালোমন্দ দেখবে কেন তারা! টাকা ফেললে কাজ করার জন্য লোক বসে আছে। কিন্তু কাজ গেলে আমার ঘরের এতগুলো পেট চলবে কোথা থেকে শুনি! তার ওপর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা.... কী মরতে যে এই হাড় হাভাতে ঘরে এসে পড়েছিলাম মা গো! শরীল ভেঙে খেটে মরো, আবার কথা শুনেও মরো! এর চেয়ে বাপের ঘরে বসে থাকতাম, গতরে খাটতাম পেটে খেতাম, ওই ভালো হতো। একটা পেটের আবার চিন্তা কী? গুচ্ছের ছেলেমেয়ে তো আর বিয়োতে হতো না। শরীলটা আমার একেবারে শেষ হয়ে গেল গো। এতগুলো বছর হয়ে গেল নিজে একটা ভালো কাপড় একটা বেলাউজ কিনে পরতে পারি না, বাবুদের বাড়ি থেকে পাওয়া জামাকাপড় জোড়াতাড়া দিয়ে গোটা জেবনটাই কাটিয়ে দিলাম। ভালোমন্দ কিছু খাবার খেতে ইচ্ছে করলেও জোটে না, সব সংসারেই যায়! শালা সংসার তো নয়, যেন রাবণের চিতে! দিনরাত জ্বলছে! কিছুতেই আর অভাব নেভে না। যত দাও, ততই হাঁ করে আছে! মরণ মরণ! আমার মরণও হয় না ঠাকুর! ওঃ মা গো...
ঘরের ভিতরে মাদুরে বসে থাকা চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধা বহুপূর্বেই চুপ করে গেছে একনাগাড়ে উগড়ে যাওয়া পদ্মাবতীর বাক্যবাণের জ্বালায়। পেটের ছেলেটা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো দুটো ভাতের জন্য ভাই ব্যাটার বউয়ের এত গঞ্জনা সহ্য করতে হতো না। নিজের মা'কে কী আর ছেলে ফেলে দিতে পারত? সধবা কালে মাত্র একটাই ব্যাটা বিইয়েছিল সে। তাকেও আঁতুর ওঠার আগেই ভগবান কোল থেকে কেড়ে নিলেন। তারপর একদিন বরটাও মরে গেলে গাড়ি চাপা পড়ে। তিন ভাসুরঠাকুর আর তাকে শ্বশুরঘরের অন্ন ধ্বংস করার জন্য রাখতে চাইলেন না। অগত্যা দাদার বোঝা হয়ে বাপের ঘরে এসে উঠল সে। দাদা-বৌদি গত হয়েছেন বহু বছর হয়ে গেল। কিন্তু এই পোড়ারমুখী বিধবা বোনটাকে ফেলে গেছে শেষ বয়সে অথর্ব অবস্থায় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করার জন্য। দাদার মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলের হাতে এসে পড়েছে বৃদ্ধা। দাদার বড় ছেলেটা একবারও পিসির খোঁজ রাখে না। অথচ তার ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা আছে। বুড়ো পিসিকে একবেলা দুটো ভাত দিলে কী তার অগাধ ঐশ্বর্য কিছু কমে যেত! খিদের জ্বালায় বিছানায় শুয়ে বৃদ্ধা চোখের জল ফেলছিল। চোখের সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ক'টা মুড়ি আর বাতাসা দিয়ে বাবুর বাড়ির কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল পদ্ম। সেই মুড়ি জলে ভিজিয়ে খিদের জ্বালায় বারকয়েক খেয়েছে বৃদ্ধা। তবুও সব মুড়ি সকালেই শেষ হয়ে গেছে। দন্তহীন বৃদ্ধা একটা বাতাসা চুষে চুষে খাচ্ছিল। তাও পেটের জ্বালা নেভে না। সে এই ঘরের মধ্যে সারাদিন একা পড়ে থাকে। জনমনিষ্যির দেখা পাওয়া যায় না। বুড়ো বয়সে অপ্রাসঙ্গিক আর অতিরিক্ত কথা বলার জন্য তাকে সকলেই সযত্নে এড়িয়ে যায়। জীর্ণ কাঁথার ওপরে দীর্ঘ সময়ব্যাপী একা শুয়ে থাকতে থাকতে খিদের তাড়নায় গুঙিয়ে কেঁদে ফেলে বৃদ্ধা। বিছানায় মল-মূত্র ত্যাগ করলেও, ঐ পদ্মর মুখের দিকে চেয়েই বসে থাকতে হয়, কখন সে বিছানা পরিষ্কার করে দেবে! দুলাল আর পদ্ম সারাদিন পেটের দায়ে দুটো পয়সার জন্য ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েরা সব পড়াশোনা করে। পাড়া বেড়াতে বেরোয়। এর ঘর ওর ঘরে ঘুরে খায়। একমাত্র বৃদ্ধা বাঁধা পড়েছে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। একাকীত্বের জ্বালা, আর সেই সঙ্গে এই পেটের জ্বালা বড় কষ্ট দেয়। সময়ে-অসময়ে খিদের জ্বালায় অনেক কুকথা বেরিয়ে পড়ে বৃদ্ধার মুখ থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে ধাতব বালতির ঝনঝনানির শব্দের সঙ্গেই তীব্র এক আর্তনাদ, আর তারপরই বন্ধ হয়ে গেল বউয়ের বাক্যবাণ! শশব্যস্ত বৃদ্ধা বিছানায় শুয়েই দরজা পিটিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল,
-ও বউ তোর কী হল? পড়ে গেলি নাকি? ও ঠাকুর! আমার পদ্মর কী হল গো! কেউ শিগগির এসো। ভরা মাস! বালতি নিয়ে বউটা পড়ে গেল মনে হয়! ও পদ্ম! রা কাড়িস না কেন রে? ও বউ!
আজ এক বাড়ির বৌদি তাড়াতাড়ি কাজে যেতে বলেছিল। ঐ বাড়ির বাচ্চাটার পাঁচ বছরের জন্মদিন। অগুনতি বাসন মেজে, দোতলা বাড়ির এতগুলো ঘরদোর মুছতে মুছতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘরে শুয়ে থাকা মানুষটার খিদে পাওয়ারই কথা! কিন্তু সাত বাড়ির এঁটো-কাঁটা ঘেঁটে, লোকের পাত কাচিয়ে চিরকালই গা কাপড় ধুয়ে স্নান করার অভ্যাস পদ্মাবতীর। নইলে ঘরে পা রাখতে মন চায় না। আজ ঐ বৌদি বাড়ির সকলের জন্য বিরিয়ানি আর মাংস দিয়েছে। সকলে একসঙ্গে বসে খাবে বলে, তাড়াতাড়ি হাতের কাজ গুছোতে চাইছিল পদ্ম। পরনের জামাকাপড়ের সঙ্গে আরও কয়েকটা জামাকাপড় কেচে স্নান করে ঘরে ঢোকার সময় পিসি শাশুড়ির কথায় মনটা এত খারাপ হয়ে গেল, যে আর সহ্য হল না। খিদেয় ওর নিজেরও পেট জ্বলছিল। বৌদি ওখানে বসেই ওকে খেতে বলেছিল। জানে বাড়িতে নিয়ে এলে ওর কপালে আর কিছুই জুটবে না! কিন্তু ঘরের বুড়িটাকে আর বাচ্ছাগুলোকে ফেলে, বাইরে কোন ভালো খাবার খেতে পদ্মর মন চায় না। স্নান সেরে উঠোনে পা রেখেই বাক্যবাণের জ্বালায় রাগে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে, পিসি শাশুড়ির কথার প্রত্যুত্তরে কথা বলতে ব্যস্ত থাকা পদ্ম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। আর তার ফলেই ঘটে গেল এক চরম দুর্ঘটনা। বালতিটা বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল উঠোনে। ভিজে কাপড়ে পা জড়িয়ে আছাড় খেয়ে অচৈতন্য পদ্ম পড়ে রইল সিঁড়ির ওপরে। প্রতিবেশীর ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো পদ্মর মেয়ে পূর্ণা। সাইকেল নিয়ে ঠিক তখনই টিউশন থেকে ফিরে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে কৈশোরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে। সে পদ্মর জ্যেষ্ঠ পুত্র টুকাই। সাইকেলটা কোনরকমে উঠোনে শুইয়ে রেখে মায়ের কাছে এসে, মাকে টেনে তুলল ছেলে...
কন্যা জন্মের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। হাসপাতালের শয্যায় প্রায় মিশেছিল পদ্ম। একজন নার্সদিদি এসে ওকে জিজ্ঞাসা করল,
-এই আজও তোমার বাড়ি থেকে কেউ এলো না? কাল তো ছুটি। তোমায় নিতে না এলে বাচ্চা নিয়ে তুমি যাবে কী করে?
সরকারি হাসপাতালের একটা শয্যা আঁকড়ে পদ্ম শুয়েছিল। আশেপাশের সবার বাড়ির লোক আসে, গল্প করে। সদ্যোজাত বাচ্চাকে নিয়ে হাসি-মজা করে। বাচ্চা না হলে বাড়ির লোক গর্ভবতী ভীতু মেয়েটার মাথার সামনে বসে থাকে। সাহস জোগায়। কত স্বামীদের পদ্ম দেখল, বউয়ের হাত ধরে বসে আছে। কত সোহাগ করছে! ও কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে। এত যত্ন পদ্ম স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু ঘরের মানুষটা যে একবারও ওকে দেখতে আসবে না, পদ্ম এটা ভাবতেও পারেনি! হয়তো ওকে ছাড়া ঘরে-বাইরে সামলাতে লোকটা অস্থির হচ্ছে! তাই হবে নিশ্চয়ই! একটা হাত আবার অকেজো। কোনদিকে করবে মানুষটা! বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেলল পদ্ম। বলে উঠল,
-এই মেয়েটারে কাউরে দিয়ে দেওয়া যায় দিদি? ওই যাদের বাচ্চাকাচ্চা হয় না, এমন কাউরে? আমি এরে বাড়ি নে যেতে চাই না। কোন টাকাপয়সা লাগবে না। বিককিরি করব না। কেউ নে গেলে মেয়েটা পেটপুরে দুটো খেতে পাবে! যেখানেই থাক, খেয়ে-পরে ভালো থাকলেই হল!
-কী বলছ তুমি?
-আমি আর পারছি না দিদি! আমি ওকে চাইনি। কেউ চায়নি ওকে। কত ওষুধপত্তর করেছি, কত শেকড় বাকড় বেটে খেয়েছি। জানোয়ারের মতো খেটেছি। ভারী জামাকাপড় কেচেছি। পেট চেপে ধরে বাবুদের ঘর মুছেছি। একদিনও বাবুর বাড়ির কাজে কামাই দিইনি। ভেবেছিলাম আপদ এইভাবেই বিদেয় হবে। কিন্তু কোন ওষুধ কাজ করল না। ডাক্তারবাবুর কাছে সে সময় নষ্ট করতে এলাম। দেখে ধমক দিয়ে বলল, এতদিন ঘুমুচ্ছিলে? সময় পেরিয়ে গেছে। আর হবে না। যাও যাও! আসলে আমার শরীল খারাপ ঠিকমতো হত না দিদি। আমি হবে হবে করে বসে আছি। এদিকে যে ভিতরে এসব হয়ে আছে, বুজব কী করে বলো? সবাই বলতে ঘরে টেস করে দেখি এই অবস্তা! শরীল নিয়ে আহা-উহু করলে আমার সংসার চলবে বলো? আর কী করি? নিজের শরীলের ওপর জোর করতাম যাতে বেরিয়ে যায়! কিন্তু এ আবাগি কিছুতেই বেরোল না। সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করে পোড়ারমুখী ঠিক বেঁচে গেল। তখনই আমি বুঝেছি, এ মেয়েমানুষ না হয়ে যায় না! হতভাগীর কই মাছের পেরান!
-বর্ন ফাইটার!
-সে আবার কী দিদি?
-কিছু না! তুমি মা না কী বলো তো? নিজের বাচ্চা বিলিয়ে দেওয়ার কথা একদম বলবে না। আগে ক'টা বাচ্চা?
-তিন ছেলে-মেয়ে। দুই ছেলে এক মেয়ে! টুকাই, ছোটু আর পূর্ণা।
-বর মেয়ে চায় না নাকি? একবারও বাচ্চার মুখ দেখতে এলো না যে!
-না চেয়েছিল। দুই ছেলের পর একটা মেয়েই চেয়েছিল। ওর একটা মেয়ের খুব শখ দিদি।
-শখেরও বলিহারি! তা মেয়ে যখন হয়েই গিয়েছিল, অপারেশন হয়ে যাওনি কেন?
-সেবার পূর্ণার সময় আমার শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল দিদি। ফোরসে করে ডাক্তারবাবু ওকে বের করে। তারপর অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমার ছোটু সে সময় মিত্তিরদের বাড়ি আম চুরি করতে গে, আমগাছ থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে। ক'দিন ওকে নে খুব ঝক্কি গেছে। তখনো আমার লোকটা আসতে পারেনি। অপারেশনের কাগজে কে সই করবে বলো! ছেলেটার কথা ভেবে সেবার আমিও তাড়াতাড়ি ঘরে চলে যাই। তারপর কাজকম্ম শুরু হল। আর আসা হয়নি গো।
-তাই আবার কাজ সেরে একেবারে গুছিয়েই এসেছ? তা অপারেশন হয়েছ এবার? নাকি আসছে বছর আবার...
-না দিদি। এবার মঙ্গলার মা টিপছাপ দিয়েছে। হয়ে গেছি।
-তাও ভালো! দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়েছে।
-ও দিদি, তুমি আমার একটা উপকার করবে? ও দিদি!
-কী? কী করব? ঘ্যানঘ্যান করছ কেন?
-তুমি আমারে ক'টা টাকা ধার দেবে? আমাদের কেউ নিতে আসবে না। মায়ে-ঝিয়ে নিজেই ঘরে যাব। আমার কাছে একটাও টাকা নেই। রিসকা ভাড়াটা দেবে? এখান থেকে আমার ঘর চল্লিশ টাকা ভাড়া। এতদিন আমি ঘরে নেই, ঘরে খাবার কী আছে না আছে! গিয়ে বাজার করতে হবে। তুমি আমারে ওই একশো টাকাই দিও। ও দিদি, আমি ঘরে গিয়ে এক সপ্তা পর থেকেই আবার বাবুর বাড়িতে কাজ শুরু করব। বেশি ছুটি নিয়ে শুয়ে থাকলে আমার সংসারটাও আমার মুখের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকবে গো। তুমি বিশ্বাস করে টাকাটা দাও দিদি, এই মেয়ের দিব্যি বলছি, মাইনে হাতে পেলেই তোমার টাকা তোমারে ফেরত দে যাব।
-যে মেয়েকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে, একটু আগে দান করার কথা বলছিলে, এখন টাকার জন্য তার দিব্যি কেটে কথা বলছ? লজ্জা করে না?
চুপ করে গেল পদ্মাবতী। নার্সদিদি হেলেদুলে চলে গেল অন্য শয্যার দিকে। মায়ের কোলের মধ্যে কেঁদে উঠল একরত্তি শিশুকন্যা। শুষ্ক স্তনবৃন্তটা জোর করে তার মুখে গুঁজে দিল পদ্ম। কিন্তু কন্যার কান্না আর থামে না। নার্সদিদি এসে ছোঁ মেরে পদ্মর কোল থেকে মেয়েকে তুলে, আর এক মায়ের কোলে দিল। সেই মায়ের স্তন্যপান করে একটু শান্ত হল অভাগিনী।
পরের দিন কতগুলো কাপড়চোপড়ে পুঁটুলি করে মেয়েকে জড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে রিক্সাস্ট্যান্ডে এসে পদ্ম বলল,
-মোছলমান পাড়ার আগের মোড়ে যাবে ভাই? ঘরে গে টাকা দেব। একটু দাঁড়াতে হবে।
রিক্সা চালক ইতস্তত করছে দেখে পদ্ম বলল,
-চলো না ভাই। সবেমাত্তর বাচ্চা হয়েছে। শরীলটা কাঁচা। ঘরের লোকটা নিতে আসেনি। বাচ্চা নিয়ে এত পথ হাঁটতে খুব কষ্ট হবে। চলো না একটু!
-নাও ওঠো ওঠো! হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে রিক্সায় ওঠো।
ঘাড় ফিরিয়ে পদ্ম দেখল ওর পিছনে সেই নার্সদিদি দাঁড়িয়ে আছে। ধমক দিয়ে উঠল সে,
-আরে ওঠো তাড়াতাড়ি। আমার মুখের দিকে কী দেখছ?
মেয়েকে কোলে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল পদ্ম। ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে দিদি মৃদুস্বরে বলল,
-দুধ হবে বলে তো মনে হয় না। নিজেরই খাওয়াদাওয়া নেই, তো হবে কী করে! শোন, বাচ্চাকে দুধ কিনে খাওয়াবে। আর নিজেও একটু ভালোমন্দ খাবে। গোটা জীবনটা সংসারের জন্য ঢেলে দিও না। কত দেখলাম তোমার মতো মেয়েমানুষ! একটা কথা মাথায় রাখো, তুমি ভালো না থাকলে, তোমার ঐ সাধের সংসার ভেসে যাবে। তুমি চোখ বুজলে বর আবার বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসবে। তখন তোমার বাচ্চাগুলোর দুর্গতির শেষ থাকবে না। আগে নিজে একটু ভালো থেকে, তারপর সবাইকে ভালো রেখো। বুঝলে? আর এই টাকা ফেরত দিতে এলে তোমার খবর আছে। যাও যাও! এই ভাই, তোমার ভাড়াটা রাখো। রিক্সা একটু আস্তে আস্তে চালাবে বুঝলে! রাস্তার যা অবস্থা! নতুন মা! কষ্ট হবে।
কান্নায় পদ্মর গলা বুজে এসেছিল। রিক্সা চলতে শুরু করামাত্রই তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকটা সরিয়ে পদ্ম দেখল নার্সদিদিকে। সে হাসপাতালের দিকে ছুটছে। চিৎকার করে ডেকে উঠল পদ্ম,
-ও দিদি?
-কী? ও টাকা আর ফেরত চাই না। তুমি যাও। নিজের যত্ন নিও। বাচ্চার কার্ড করিয়ে সময়মতো সব ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে নেবে। মনে করে পোলিও খাওয়াবে!
-টাকার জন্য না দিদি। ওর মা বেঁচে থাকতে, তুমি আমার মেয়ের দুধের টাকা দিলে। শুধু তোমার নামটা বলো গো দিদি? মরণ পর্যন্ত আমি তোমারে ভুলব না গো!
অমায়িক হাসি হেসে নার্স বলে উঠল,
-সুরঞ্জনা!
তারপরই সে ছুটল হাসপাতালের দিকে। রিক্সা পূর্ণ গতি পেয়ে গেছে। অশ্রুসজল পদ্মর দু'চোখ। দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে আগলে রিক্সায় চেপে বসে অঝোরে কাঁদল ও। হাতের মুঠো খুলে দেখল, পাঁচশত টাকা মুঠোবন্দি হয়ে ঘামে ভিজে উঠছে। কোনরকমে ওই টাকাটা আঁচলে মুড়ে মেয়েকে বুকের ভিতর জড়িয়ে রাখল পদ্ম। মায়ের বুকের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে রয়েছে মেয়েটা। যেন কত নিশ্চিন্ত আশ্রয়! অথচ পেটে থাকতে এই জন্মদাত্রী ওকে হত্যা করার জন্য কত যুদ্ধই না করেছে! কিন্তু নিজের গর্ভধারিণীকে পরাস্ত করে একজন যোদ্ধার মতো এই অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছে মেয়েটা। কাপড়ের আঁচলে বাঁধা টাকাটা মুঠো করে ধরল পদ্ম। ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে ধীরকণ্ঠে বলে উঠল,
-সুরঞ্জনা!
রিক্সা এগিয়ে চলল আপন গতিতে। গতরাতে বোধহয় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে শুকিয়ে আসা কাদার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল পদ্ম। রাস্তার কোণে অযত্নে বেড়ে ওঠা রংবেরংয়ের বুনোফুলগুলো বুঝি এখনো সিক্ত। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে বিন্দু বিন্দু জল খসে পড়ছে রুক্ষ মাটিতে। অযত্নে ও অবহেলায় প্রস্ফুটিত বুনোফুলগুলোর ওপর কয়েকটা চঞ্চল প্রজাপতি মহানন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন