প্রজাপতির মৃত্যু
মন প্রজাপতি
প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস
চতুর্থ পর্ব
কয়েক বছর পর...
-ধ্যাৎ! যেদিন থেকে বাড়িতে ডিভিডি প্লেয়ারটা এসেছে, সেদিন থেকে কাল্ট ক্লাসিক বলে মা আর মানু আমার মাথাটা জাস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই পড়াশোনার চাপ। তার ওপর আর্ট ফিল্মের এত ঘ্যানঘ্যানানি আমার মাথায় ঢোকে না বুঝলে! পড়া থেকে দু'দিন ছুটি পেয়েছি, কোথায় মনে ঝড় তোলা কিছু দেখব, তা না! এই শোনো...
পাহাড়ি পথ অতিক্রম করার পর একটি খরস্রোতা নদী যখন সাগরে মিলিত হয়, মোহনায় পৌঁছে সে তার তীব্র গতি ও সুদীর্ঘ যাত্রাপথ ভুলে হয়ে যায় শান্ত ও শীতল। কিন্তু এই মোহনার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণার উন্মাদনা। স্বমহিমায় দিবারাত্র প্রবহমান মোহনা সারাদিন কলকল করে কথা বলে চলে। রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়। এই বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল সে। ওর পরীক্ষার পর বাড়িতে নতুন ডিভিডি প্লেয়ার এসেছে। এখন কয়েকদিন দাপিয়ে সিনেমা দেখা চলছে, যেন গোটা বৈঠকখানাটাই একটা প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু মা আর মাসির পছন্দের ছবি দেখতে দেখতে মোহনা ক্লান্ত হয়ে গেছে। আজ দোকানে এসে হুড়মুড় করে মনের ভিতরে জমে থাকা সব ক্ষোভ উগড়ে, টেবিলে একটা কষে থাপ্পড় মেরে ক্যাসেটের দোকানের ছেলেটির দিকে নিজের তর্জনী নাচিয়ে মোহনা বলল,
-এই, বুঝলে তুমি? নাকি আমি আবার বলব? বুঝতে পারছ তো আমি কী চাইছি?
-না!
ছেলেটির বয়স খুব বেশি নয়। কলেজের প্রথম বর্ষে পাঠরত ছেলেটি কলেজ, টিউশন আর পড়াশোনার ফাঁকে সময় পেলে বাবার দোকানে বসে। এর আগে যতবারই আবিষ্কার আর মোহনা এই দোকানে ক্যাসেট ভাড়া নিতে বা ফেরত দিতে এসেছে, প্রতিবারই কাকু ছিলেন দোকানে। আজ ছেলেটি রয়েছে। মোহনা টেবিলের ওপর আরও একটা থাপ্পড় মেরে বলল,
-এবার একটা ভালো ভূতের সিনেমা দেখব বুঝলে! যেটাতে রাতের বেলায় বিশাল মজা হবে! বেশ ভয় ভয়, গা শিরশির! আমি অন্ধকার ঘরে ভয় পেয়ে ও মা গো করে চিৎকার করব, ঠিক সেইরকম চাই। আছে?
-বিশাল মজা হবে? গা শিরশির! সিনেমা দেখে তুমি আবার মা গো করে চিৎকারও করবে, সব একসঙ্গে চাই তোমার? আচ্ছা দাঁড়াও! এটা নিয়ে যাও। দেখার পর তুমি ফেরত দিয়ে যেও।
পিছন থেকে আবিষ্কার তিড়িং করে সিঁড়ির এক ধাপ ওপরে উঠে এসে সিডিটা মোহনার হাত থেকে ছিনিয়ে এক নজর দেখেই ফেরত দিয়ে বলল,
-বাচ্চা মেয়ে দেখে ইয়ার্কি পেয়েছ তুমি! এই তিতলি, রাখ এসব!
-কেন তাতাই? এই তো ভূতের মুখ। জঙ্গলের মধ্যে একটা মন্দির মনে হচ্ছে, এটা দেখেই তো ভয়ঙ্কর লাগছে। আমি এটাই দেখব! আর আমি বাচ্চা তোকে কোন শালা বলল?
-এই ভাই এসব রাখো। আমি যেগুলো বলছি, সেগুলো দাও। সরাও এসব।
-না সরাবে না। এই দাও, আমি এটাই দেখব!
-তিতলি আমি তোর থেকে বড়, বড়দের কথা শুনতে হয়। আমার কথাটা একবার অন্তত শোন। জীবনে কোনদিন কারোর কথা কী তুই শুনবি না?
-এহ! মাত্র সাড়ে তিন দিনের বড়। তাতেই নাকি উনি বড়! কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে! আমি এটাই দেখব। এই ভয় পাব তো এটা দেখে?
ঠোঁট টিপে ছেলেটি বলল,
-বিশাল! এটা দেখার পর রাতে একা শুতে গেলেই অজানা অনুভূতিতে গা শিরশির করে উঠবে। ঠিক যেমনটা তুমি চাইছ! এটা তোমার সমস্ত ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করবে আই প্রমিস!
-ফাইন! আর ভয় না পেলে...
-টাকা দিতে হবে না। সিডিটা তোমার কাছেই রেখে দিও। বাবা থাকলে এটা ফেরত দিও না। আমি যখন দোকানে থাকব, তখন আমার হাতে দেবে। তাহলে আর টাকা দিতে হবে না।
মোহনার হাত থেকে ওই সিডি কেড়ে নিয়ে আবিষ্কার কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই মোহনা সিডিটা নিয়ে দৌড় দিয়েছে স্কুটির দিকে। ছেলেটি মুখ টিপে হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। অসহায় আবিষ্কার সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলে উঠল,
-মেয়েটা যে কী করে না! আবার আমার সঙ্গে বসে দেখবে! শুধু একা আমার সঙ্গে নয়। সবার সঙ্গে!
ছেলেটি হাসি আর থামাতেই পারে না। অতিকষ্টে সে বলল,
-বিশাল মজা হবে।
-হ্যাঁ সেই তো। আজ আমার কপালে গ্রহরাজ একা নন, দেবতাদের পুরো ফ্যামিলি তা ধিন ধিন নাচছেন, বেশ বুঝতে পারছি। সলিড কেস খাব। কী আর করা যায়! পার্টনার ইন ক্রাইম যখন, ধোলাইটাও একসঙ্গেই খেয়ে নেব। টোটাল পার্টনারশিপে... আমি আর কিচ্ছু বলব না। ঝাড় খেয়েই শিখুক। একটু বুঝুক ওই মেয়ে! বড়দের কথা না শোনার ফল কী!
দোকান থেকে বেরিয়ে মোহনার স্কুটির পিছনে উঠে বসলো আবিষ্কার। চেঁচিয়ে উঠল মোহনা,
-তাতাই নাম স্কুটি থেকে।
-না। তোর কিছু হলে মা আমার পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে।
-তুই নামবি কিনা! এভাবে তোর ভরসায় চালালে জীবনেও আমার কনফিডেন্স আসবে না। আর আমি ঠিকমতো চালাতে না পারলে, কলেজে যাওয়ার আগে মা স্কুটিও কিনে দেবে না। পিছনে সাপোর্ট হয়ে বসে থাকবি না, সর! এটুকু হেঁটে চলে যা।
-আমি নামব না। তোর হাত এখনো কাঁপে!
-তুই নামবি! নাকি স্কুটি কাত করে ফেলে দেব তোকে?
-যা খুশি কর তুই!
একলাফে স্কুটি থেকে নেমে পড়ল আবিষ্কার। মোহনা স্কুটি চালাতে শুরু করলে আবিষ্কার ওর পিছনে প্রায় দৌড়তে শুরু করল। নিমেষের মধ্যেই বীভৎস শব্দ! নর্দমার ঠিক পাশে স্কুটি কাত হয়ে পড়েছে। আর মোহনা সটান কাদার আলিঙ্গনে লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসতে হাসতে মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়ল আবিষ্কার। চিৎকার করে উঠল মোহনা,
-আসবি এদিকে?
-না!
-আসবি? নইলে তোর মাকে বলে দেব কিন্তু!
-আসছি তো! সব ব্যাপারে মায়ের ভয় দেখাস কেন?
-তুই খুব সাহসী তাই...
স্কুটি আর কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া মোহনাকে টেনে তুলে খিক খিক করে হেসেই চলল আবিষ্কার। সারাটা রাস্তা মোহনা আর একটাও কথা বলেনি। বাড়িতে এসে স্নান সেরে যখন ঘর থেকে সিডি হাতে নিয়ে মোহনা বেরোল, তখন আবিষ্কার বলল,
-বোরোলীন লাগিয়েছিস কনুইতে?
-এ যা তো! বেশি ঢং করতে হবে না। তখন তো খুব দাঁত বের করে হাসছিলি! এখন কেন? সর! একহাত দূরে বসবি তুই! ওরা কোথায়?
-যেখানে থাকে!
-খেতে আসেনি এখনো? আজ দুপুরে খেতে খেতে সিনেমা দেখবে না?
-দরকার নেই। ওরা দোকানে আছে থাক। তাড়াতাড়ি খানিকটা দেখে ফেরত দিয়ে আসি চল। একটু পরেই ওরা খেতে চলে আসবে।
-তুই এত হুড়োহুড়ি করছিস কেন তাতাই? আর একটুখানি দেখব মানে? আমি পুরো সিনেমা দেখব। তুই ভীতু মানুষ জানি! তুই বরং কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি একা দেখব, তবুও পুরোটা দেখব।
-তা হলেই হয়েছে!
-মানে?
রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালিয়ে দিল মোহনা। বৈঠকখানার সব জানালা বন্ধ। দরজাটা আলগা কেবল। আবিষ্কার সোফা কাম বেডে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-মানে তুই আমার সঙ্গে বসে পুরো সিনেমা দেখতে পারলে, আজ আমার তরফ থেকে ফুচকা ট্রিট কনফার্ম! আনলিমিটেড! যত ইচ্ছে খাবি।
সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আবিষ্কারের দিকে চাইল মোহনা। যে ছেলে মোহনার ঝেড়ে খেতে পারলে নিজের জীবনটা ধন্য মনে করে, সেই ছেলে হঠাৎ এমন দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করছে খাওয়ানোর কথা! এত উদারতা কেন? ততক্ষণে টিভির পর্দায় শুরু হয়েছে শিহরণ জাগানো এক ভয়ের সিনেমা।
পাশবালিশটা কোলের ওপর টেনে গুছিয়ে বসে উৎসুক দৃষ্টিতে মোহনা টিভির পর্দার দিকে চাইল। মিনিট কুড়ি সময় বেশ নির্বিঘ্নেই কাটল। অস্বস্তি শুরু হল তখন থেকে যখন সিনেমার নায়ক এবং নায়িকা প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। আড়চোখে আবিষ্কারের দিকে চাইল মোহনা। একদম সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো স্থির ও শান্ত ওর দৃষ্টি। শিরদাঁড়া টানটান করে বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে ধ্যানে বসে আছে। মোহনা সিলিংয়ের দিকে চাইল। ড্রইংরুমের পাখাটা ঘোরার সময় যে এইরকম ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়, আগে তো কখনো খেয়াল করে দেখা হয়নি। পাখাটা ঠিক করার জন্য লোক ডাকতে হবে। দেওয়ালে ঝুল পড়েছে। ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সেবার মেলা থেকে কেনা ছোট-বড় প্রজাপতিগুলো সারি দিয়ে দেওয়ালে সেঁটে রয়েছে। মাঝে একটা প্রজাপতি কই গেল? ওই জায়গাটা ফাঁকা কেন? ঘরের যত অসঙ্গতি, সব এখনই মোহনার চোখে পড়ল। টিভির দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। ওদিকে টিভির পর্দায় নায়ক নায়িকার চরম ঘনিষ্ঠতার মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। মোহনা কুলকুল করে ঘামছে, নায়ক-নায়িকা ভিজছে। ঢোঁক গিলে একটু কেশে মোহনা গলাটা পরিষ্কার করে নিল। আবিষ্কার সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল,
-এবার বৃষ্টিভেজা অবস্থায় একটা সাদা রংয়ের ট্রান্সপারেন্ট নাইটি পরে হি হি করে হাসতে হাসতে আকাশপথ বেয়ে মাদুরে বসে একটা পেত্নী ভেসে আসবে। আমরা ভয় পাব তো! তুই আশা ছাড়িস না তিতলি, আমরা ভয় পাবই। এই তো, আর একটু অপেক্ষা। তারপর পেত্নী আসবে। আর তারপরই....
মোহনার অস্বস্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নায়ক নায়িকার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল, যে নায়িকার ঐ তীব্র শীৎকারে চাপা পড়ে গেল দরজা খোলার মৃদু শব্দ। আবিষ্কার তখনো ক্রিকেটের মাঠের একজন সুনিপুণ ধারাভাষ্যকারের মতোই একনাগাড়ে বকবক করে চলেছে। মোহনা মনে মনে ঐ সিডির দোকানের ছেলেটির মুণ্ডপাত করছে। একদৌড়ে উঠে মোহনা টিভিটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল। পেত্নীর বদলে দু'পায়ের দুটো চটি হাওয়ায় ভেসে উড়ে এলো মোহনা আর আবিষ্কারের দিকে। চন্দ্রাণী লাফিয়ে পড়ে সোফা কাম বেডে উঠে আবিষ্কারের চুলের মুঠি টেনে ধরে বলল,
-দুটোকেই মেরে ফেলব আজ। দুই ভাই বোনের মাথা দাম করে ঠুকে দেব। আমার ছেলেটা বেশি পাজি। কী দেখছিস তোরা? এক থাপ্পড় মেরে তোর কান গরম করে দেব তাতাই! পড়াশোনার নামগন্ধ নেই। এই বেড়ে পাকামির জন্যই তুই পরীক্ষার খাতায় লাড্ডু পাস।
-আমি কিছু জানি না মা! তিতলি আমাকে বলল ভালো ভূতের সিনেমা তাতাই। দেখবি আয়। ও এনেছে। আমি কিছু জানি না। ও আমাকে দেখতে ডাকল।
মোহনা ততক্ষণে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে দোতলায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপটি করে বসে আছে। একটু পরেই দরজা পেটানোর প্রবল শব্দ। চন্দ্রাণী চিৎকার করে উঠল,
-তিতলি দরজা খোল!
বারকয়েক দরজা পেটানোর পর দরজা খুলে দিল মোহনা। তাতাইয়ের কান টেনে ধরে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার গাল কান সব টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। ধমকে উঠল চন্দ্রাণী,
-কে এনেছে ওইসব সিনেমা? তাতাই তো? আজই এটাকে বাড়িছাড়া করব।
কানে ভালোরকম মোচড় দিতেই কঁকিয়ে উঠল আবিষ্কার। মোহনার দিকে চেয়ে চোখ টিপে ইশারা করল তাতাই। যার অর্থ, "আমার ওপর ছেড়ে দে। সামলে নেব।"
মোহনার বুকের ভিতরটা কাঁপছিল। চন্দ্রাণীর হাতটা টেনে আবিষ্কারের কান থেকে নামিয়ে ও বলল,
-তাতাইকে ছেড়ে দাও মানু। আমরা কেউ জেনেশুনে এসব সিনেমা আনিনি। আমি ভূতের সিনেমা দেখতে চেয়েছিলাম। দোকানের ছেলেটা ইচ্ছে করে আমার হাতে এটা ধরিয়ে দিয়েছে। তাতাই এটা নিতে বারণ করেছিল। আমিই বেশি সাহস দেখিয়ে এনেছি। তোমাদের সবার সঙ্গে বসেই তো টিভি দেখি বলো! তোমার কী মনে হয় মানু, জেনেশুনে এসব আমি বাড়িতে আনব? তাও আবার দিনদুপুরে দরজা খুলে চালিয়ে বসে থাকব? সরি মানু! আমি জানতাম না! তাতাইকে ছেড়ে দাও।
মোহনার মুখের দিকে চেয়ে, নিজের ছেলের মাথায় সজোরে একটা চাঁটি মেরে আর একবার ভালো করে কানটা নেড়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল চন্দ্রাণী। মোহনা ডাক দিল,
-মানু?
চন্দ্রাণী সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মোহনার কণ্ঠে কাতর আর্তি,
-মাকে এসব বোলো না প্লিজ!
মায়ের হাতে চাঁটি খেয়ে কানে হাত বোলাতে বোলাতে মোহনার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল তাতাই। কিন্তু তার আগেই মোহনা ঘরের দরজাটা সজোরে বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল তাতাই,
-ওফ! এই এক মেয়ে! একটু কিছু হলেই ঘরে খিল দিয়ে গাল ভারী করে বসে থাকতে জানে! আমার খিদে পাচ্ছে। তুই বেরোবি কিনা বোন! দরজা খোল না! ওই তিতলি?
সন্ধে নেমেছে বাড়ির ছাদে। কার্নিশে চুপ করে বসে রয়েছে মোহনা। ছাদের ওপর থেকে বাড়ির গেটটা দেখা যাচ্ছে। এই গেটটা মোহনার খুবই পরিচিত। কত ছোট বয়স থেকেই যে ওই গেট পেরিয়ে মোহনা এই বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে, সেটা আজ আর ওর মনে পড়ে না। মোহনার মায়েরা দুই বোন। বড় বোন চন্দ্রাণী, অর্থাৎ তাতাইয়ের মা। আর ছোট বোন ইন্দ্রাণী, তিতলির মা। বাড়িভাড়া দিয়ে ও সংসার চালিয়ে, দুই বোনের উচ্চশিক্ষার খরচ বহনের মতো আর্থিক ক্ষমতা তিতলির দাদুর ছিল না। তিনি একটি ছোট মুদি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তবুও মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে অতিকষ্টে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে চন্দ্রাণী। কিন্তু ইন্দ্রাণীর পড়াশোনার দৌড় নবম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপরই শুরু হয় বাবার শারীরিক অসুস্থতা। প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণে প্রায় শয্যাশায়ী তিনি। চিকিৎসার জন্য পরিমিত অর্থ বাবার সঞ্চয়ে ছিল না। সেই সময়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর দুই মেয়ে, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কাজকর্ম শুরু করতে হয় দুই বোনকে। ভাগ্য খানিক সহায় হয়, যখন দুই জামাই এই পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়। সুখের সাগরে ভেসে যায় ঐ পরিবার, যখন প্রায় একইসঙ্গে দুই বোনের গর্ভে নতুন অতিথির আগমন ঘটে। কিন্তু ভাগ্যে সুখ দীর্ঘস্থায়ী না হলে শত পরিশ্রম শেষে, ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই লাভ করা সম্ভব হয় না। বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যায় তাতাইয়ের বাবা। মেসোমশাইকে তিতলির সেভাবে মনে পড়ে না। তাঁর সঙ্গে পরিচয় কেবল ছবির মাধ্যমে। আর তিতলির বাবা? মৃদু হাসে তিতলি! চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জলটা মুছে নেয় হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। দাদু-দিম্মার মৃত্যু, অভাব-অনটন, আশ্রয়হীনতা, অনিশ্চয়তা.... টানাপোড়েনের সেই অভিশপ্ত দিনগুলো কাটিয়ে উঠেছে দুই বোন। আজ বাজারের ভিতর তাতাইয়ের মায়ের একটা ছোট বুটিক, আর তার সঙ্গে টেলারিং হাউজও রয়েছে। আর ওই বুটিকের সঙ্গেই লাগোয়া একটা লেডিস পার্লার করে নিয়েছে তিতলির মা। দুই বোন একত্রে সারা জীবনব্যাপী যুদ্ধ করে আজ এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। তাতাই আর তিতলিকে বড় করেছে, পড়াশোনা শেখাচ্ছে। তাতাইকে মানু গত বছর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটিও কিনে দিয়েছে। কলেজে উঠলে তিতলিকেও কিনে দেবে, এমনটাই কথা হয়েছে। এই দোতলা বাড়ির ওপর তলাতেই আগে ভাড়া থাকত তাতাইয়ের বাবা-মা আর তাতাই। এখন এই দোতলাটা ওরা পুরোটাই কিনে নিয়েছে। বাড়িওলা যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন, তাই একতলাটাও ওরা ভাড়া নিয়েছে। তবে মা আর মানুর ইচ্ছে আছে বাড়িওলা তিন বছর পর দেশে ফিরলে একতলাটাও ওরা কিনে নেবে। এখন থেকেই বাড়ি কেনার জন্য প্রাণপণে টাকা জমাচ্ছে দুই বোন। সারাদিনই দুই বোন টাকার জন্য দোকানে পড়ে থাকে। বেশ কয়েকজন কর্মচারী কাজ করে ওদের দোকানে। খুব ছোট থেকেই খিদের তাড়নায় হাত পুড়িয়ে কাজ করতে করতে, কবে যেন সবরকম রান্নাবান্না শিখে গিয়েছিল তিতলি আর তাতাই। ভাইবোন স্কুলে বেরিয়ে গেলে গোটা বাড়ি জনমানবহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। আর ছুটির দিনে আবিষ্কার আর মোহনা বাড়ি থাকলে, ওরাই মা আর মানুকে নিয়ে হৈ-হল্লা করে মাতিয়ে রাখে গোটা বাড়ি। দুটো মানুষ সারাজীবন অতিবাহিত করে ফেলেছে শুধুমাত্র সন্তান আর সংসারের জন্য। বিন্দুমাত্র সাধ-আহ্লাদ কিংবা আত্মসুখের কথা চিন্তা করার অবকাশ তারা পায়নি। খুব ছোট থেকেই তাতাই আর তিতলি বুঝে গিয়েছিল ওদের সংগ্রাম। সেই কারণে একটু খুশির সুযোগ পেলে, ওরা আর কোনমতেই সেটা হাতছাড়া করতে চায় না। সবসময় হেসেখেলে জীবনের কষ্টগুলোকে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়িয়ে, মনটাকে হালকা রাখতে চায়। একটু মনখারাপ হলেই তিতলির কথা একদম বন্ধ হয়ে যায়। কেমন যেন একটা আতঙ্ক এসে চেপে বসে ওর বুকে। মনে হয় পৃথিবীর কেউ ওকে ভালোবাসে না। শৈশবের ঐ অভিশপ্ত দিনগুলো বারংবার স্মৃতিতে ফিরে আসে। গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে কান্না জমে থাকে। তখন ও একা ছাদে এসে চুপ করে বসে থাকে। কথা বলে নিজের সঙ্গে। সেই অভিমানী মেয়েটার সঙ্গে, যার খবর কেউ জানে না। তাতাইও না। কাব্যও না। বাবা-মাকে ছোট থেকে কাছে না পাওয়ার জন্য ওর মনের ভিতরে একটা জেদি আর অভিমানী মেয়ের জন্ম হয়েছে। যাকে ও খুব সযত্নে আজও লালন পালন করে। সময়বিশেষে ওই অভিমানী মেয়েটা আত্মপ্রকাশ করে। এমনি সময়ে মোহনা ঘুম পাড়িয়ে রাখে তাকে। তিতলির জীবনের একমাত্র বন্ধু তাতাই। তিতলির থেকে তাতাই সামান্য বড় হলেও, ও দাদাকে নাম ধরেই ডাকে। দুই ভাই-বোন যেন হরিহর আত্মা। ওদের মধ্যে দিনরাত যতটা মারপিট-চুলোচুলি-ঝগড়া, ঠিক ততটাই ভালোবাসা ও প্রগাঢ় হৃদ্যতা লক্ষ্য করা যায়। ওরা পরস্পরের জীবন যুদ্ধটা এত কাছ থেকে দেখেছে, যে দু'জন দু'জনকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না। একটা ইচ্ছাকৃত কাশির শব্দে তিতলির ভাবনার ঘোর কাটল। অদূরে তাতাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিতলিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাতাই বলল,
-কী রে? একা একা বসে আছিস যে! মন খারাপ?
-মা খেতে আসেনি দুপুরে?
-না। মা বলল পার্লারে অনেক কাস্টোমার ছিল। মানু আসতে পারবে না। মা নিজে খেয়ে মানুর খাবারটা প্যাক করে নিয়ে গেছে।
-তুই খেয়েছিস?
-তুই বাড়িতে থাকলে তোকে ছাড়া খেয়েছি কখনো?
-হতভাগা সন্ধে হয়ে গেল। এখনো খাসনি তুই?
-চেল্লাস কেন? কানের পর্দা ফেটে গেল। এমনিতেই কানমলা খেয়ে আমার পেট ভরে গেছে। খিদে নেই আর।
-একটুও জায়গা নেই পেটে? ফুচকা খেতে পারবি না?
হেসে ফেলল তাতাই। তিতলি ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলল,
-সরি দা! আমার জন্য তুই মানুর হাতে মার খেলি!
-এহ! দাদা নাকি! সম্মান শ্রদ্ধা কিছু করিস তুই আমায়? খালি কান্নার সময় দাদা বলে জড়িয়ে ধরবি, আর বাকি সময় আমার পিছনে খ্যাকশিয়ালের মতো খ্যাক খ্যাক করবি! ছাড় ছাড়! খেতে দে, খিদে পেয়েছে।
-চল!
-সাহিত্য ফোন করেছিল তিতলি।
-আবার?
-হ্যাঁ।
-কী বলছে?
-এই তুই কেমন আছিস? পরীক্ষার পর তোর আর কোন খবর নেই। একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছিস! তোর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে কিনা! এইসবই...
-এই মানু তখন কোথায় ছিল?
-বেরিয়ে গেছিল।
-তুই কী বললি?
-আমি বললাম, রাজকন্যা এখন গোঁসা ঘরে খিল দিয়েছেন। তুই পরে ফোন করিস ভাই! আচ্ছা তিতলি, তুই ছেলেটাকে পাত্তা দিস না কেন রে?
-সিডিটা বের করেছিস? ফেরত দিতে হবে। আমি যাব। ওই ছেলেটার মাথায় সিডি ভাঙব।
-এই না। আমি যাব। তুই গেলে ছেলেটার মাথা তো দূর, দোকানও ভাঙচুর করে ফেলতে পারিস।
হেসে ফেলল দুই ভাই বোন। তিতলির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে ঘেঁটে তাতাই বলল,
-বড়দের কথা শুনতে হয়, বুঝলি?
-হু! আমি খুব খারাপ বোন, তাই না তাতাই?
-কোন শালা বলে? ফুলো কা তারো কা, সবকা ক্যাহনা হ্যায়... এক হাজারো মে... উঁহু! আমার বোন কোটিতে একটা!
-তাই নাকি? তোর জন্যও একটা গান আছে। করি?
-প্লিজ!
-স্রোতস্বিনী! তুমি নাহি...
-ওই!
সন্ধের আবছা অন্ধকারের মধ্যেও তিতলি বুঝতে পারল,
স্রোতস্বিনীর নামেই তাতাইয়ের হাসিতে লজ্জা স্পষ্ট! তিতলি বলে উঠল,
-থাক থাক! আর লজ্জা পেতে হবে না। স্রোত কেমন আছে?
-মামারবাড়ি থেকে কাল ফিরেছে। আজ দেখা করার কথা বলছিল। এদিকে শুভটা মাসিরবাড়ি গিয়ে বসে আছে, রাহুল সিমলা। কার নাম নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোই বল তো? বন্ধুরা শুনলে হাসে। এতবড় ছেলে হয়ে গেলাম, রেজাল্ট বেরোলে দু'দিন পর কলেজে যাব, এখনো কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কখন বাড়ি ঢুকব, মাকে সবকিছুর কৈফিয়ৎ দিতে হয়। আমার মা তো মনে করে আমি বাড়ি থেকে বেরোলেই পৃথিবীর সব মেয়েরা রাস্তাঘাটে বিপদে পড়বে! আমি যেন সবাইকে টিজ করে বেড়াব! তুই জানিস তো আমাকে বুনু! আমি ওইরকম করি?
-আমার কথা ভাব তো তাতাই! আজ তোর মতো দাদা আছে বলে, আমি রাস্তায় একা বেরোতে ভরসা পাই। মানু তোকে যেভাবে মানুষ করছে, তুই চাইলেও কোনদিন ভুলভাল কাজ করতেই পারবি না। তোর মন সায় দেবে না। আমার তো রাস্তায় বেরোলে মনে হয়, সব ছেলেরাই তোর মতো ভালো। তাদের সবাইকে তাদের মায়েরা ঠিক তোর মতো করেই মানুষ করেছে, তাই নিজেকে সেফ লাগে। মানু ঠিক বলে তাতাই। মেয়ে সন্তান মানুষ করার থেকে ছেলে সন্তান মানুষ করা অনেক বেশি কঠিন। অনেক বেশি দায়িত্বের। ছেলে কুসঙ্গে পড়ল কিনা, কোন বন্ধুর সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, মানুর সব হিসেব চাই। আমার তো বেশ ভালো লাগে এটা! তোকে মানু এমনভাবে তৈরি করেছে, শুধু আমি কেন তাতাই? পৃথিবীর যে কোন মেয়েই তোর সঙ্গে একটা বন্ধ ঘরেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। অবশ্য স্রোতের কথা আলাদা! ওর সঙ্গে তোকে এক ঘরে রাখলে, তুই যে ওকে কী করে ফেলবি...
-মার খাবি তিতলি! দাদার সঙ্গে কথা বলছিস! ভুলে যাস নাকি! লজ্জা করে না?
-এহ! কী আমার দাদা এলেন রে! সর সর খিদে পেয়েছে।
-স্রোতের সঙ্গে একটু বেরোব বোন। মাকে ম্যানেজ করে দিবি? প্লিজ!
-আমি একটু পর কাব্যর সঙ্গে বেরোব। মানুকে বলে যাচ্ছি, তুই আমাকে আনতে যাবি। আমাকে আনতে যাওয়ার নাম করে দোকানে বলে বেরিয়ে যা, দেখা করে নে বউয়ের সঙ্গে।
-কাব্যর সঙ্গে বেরোবি, না সাহিত্য?
কোন উত্তর দিল না মোহনা। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে এলো। ওর পিছনে নামতে নামতে আবিষ্কার বলল,
-বুঝে গেছি। যে ছেলে এক বছর ধরে ঘুরছে, তার দিকে তুই ফিরেও চাইবি না। দেখবি একদিন এমন দিন আসবে, যে ছেলে তোকে জম্পেশ ইগনোর করবে, তুই তার জন্যই মরবি!
টেবিলে খেতে বসেও তাতাইয়ের বকবকানি অব্যাহত রয়েছে। মোহনা দুপুরের খাওয়া সন্ধেবেলা সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একজোড়া ঝোলানো কানের দুল পরছিল। একটা সুগন্ধীর বোতল উপুড় করে দিল নিজের দেহে। তাতাই মোহনার সমস্ত কথা জানে। সমস্ত বন্ধুদেরও চেনে। যেখানে যা হয়, ওরা ভাই বোন পরস্পরকে সবই বলে। কেবল একটা কথা কোনদিনই বলা হয়নি ওকে। হয়তো এই গোপন সত্য তাতাইকে কোনদিনই বলা হবে না। ও জানে এই কৃত্রিম সুগন্ধীটা ওকে ওর প্রিয় বান্ধবী কাব্যাঞ্জলি উপহার দিয়েছে, যে এইবার মোহনার সঙ্গেই পরীক্ষা দিল। ওরা একই স্কুলে পড়ে। পড়াশোনার সূত্রে ওরা একে অপরের বাড়িতেও যাতায়াত করে। পরীক্ষার আগে নাইট স্টাডির জন্য কাব্যর বাড়িতে মোহনা একাধিক রাতও কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু পৃথিবীর কেউ এটা জানে না, যে এই সুগন্ধী নিজের দেহে মেখে মোহনার দৃষ্টির সম্মুখে একাধিকবার নিজেকে মেলে ধরেছিল কাব্য। আর মোহনাও হারিয়ে গিয়েছিল কাব্যর কোমল ঠোঁটের অতলে। কাব্যর দেহের ঐ পরিচিত সৌরভটুকু নিজের দেহে মেখে নিল মোহনা। প্রিয় নারীর দেহের সৌরভে আবিষ্ট হয়ে গেল ও। কাব্যর সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করে মোহনার মনের আকাশে ডানা মেলে উড়তে লাগল শত শত রঙিন প্রজাপতি।
**********
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
-ধ্যাৎ! যেদিন থেকে বাড়িতে ডিভিডি প্লেয়ারটা এসেছে, সেদিন থেকে কাল্ট ক্লাসিক বলে মা আর মানু আমার মাথাটা জাস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই পড়াশোনার চাপ। তার ওপর আর্ট ফিল্মের এত ঘ্যানঘ্যানানি আমার মাথায় ঢোকে না বুঝলে! পড়া থেকে দু'দিন ছুটি পেয়েছি, কোথায় মনে ঝড় তোলা কিছু দেখব, তা না! এই শোনো...
পাহাড়ি পথ অতিক্রম করার পর একটি খরস্রোতা নদী যখন সাগরে মিলিত হয়, মোহনায় পৌঁছে সে তার তীব্র গতি ও সুদীর্ঘ যাত্রাপথ ভুলে হয়ে যায় শান্ত ও শীতল। কিন্তু এই মোহনার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণার উন্মাদনা। স্বমহিমায় দিবারাত্র প্রবহমান মোহনা সারাদিন কলকল করে কথা বলে চলে। রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়। এই বছরই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল সে। ওর পরীক্ষার পর বাড়িতে নতুন ডিভিডি প্লেয়ার এসেছে। এখন কয়েকদিন দাপিয়ে সিনেমা দেখা চলছে, যেন গোটা বৈঠকখানাটাই একটা প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু মা আর মাসির পছন্দের ছবি দেখতে দেখতে মোহনা ক্লান্ত হয়ে গেছে। আজ দোকানে এসে হুড়মুড় করে মনের ভিতরে জমে থাকা সব ক্ষোভ উগড়ে, টেবিলে একটা কষে থাপ্পড় মেরে ক্যাসেটের দোকানের ছেলেটির দিকে নিজের তর্জনী নাচিয়ে মোহনা বলল,
-এই, বুঝলে তুমি? নাকি আমি আবার বলব? বুঝতে পারছ তো আমি কী চাইছি?
-না!
ছেলেটির বয়স খুব বেশি নয়। কলেজের প্রথম বর্ষে পাঠরত ছেলেটি কলেজ, টিউশন আর পড়াশোনার ফাঁকে সময় পেলে বাবার দোকানে বসে। এর আগে যতবারই আবিষ্কার আর মোহনা এই দোকানে ক্যাসেট ভাড়া নিতে বা ফেরত দিতে এসেছে, প্রতিবারই কাকু ছিলেন দোকানে। আজ ছেলেটি রয়েছে। মোহনা টেবিলের ওপর আরও একটা থাপ্পড় মেরে বলল,
-এবার একটা ভালো ভূতের সিনেমা দেখব বুঝলে! যেটাতে রাতের বেলায় বিশাল মজা হবে! বেশ ভয় ভয়, গা শিরশির! আমি অন্ধকার ঘরে ভয় পেয়ে ও মা গো করে চিৎকার করব, ঠিক সেইরকম চাই। আছে?
-বিশাল মজা হবে? গা শিরশির! সিনেমা দেখে তুমি আবার মা গো করে চিৎকারও করবে, সব একসঙ্গে চাই তোমার? আচ্ছা দাঁড়াও! এটা নিয়ে যাও। দেখার পর তুমি ফেরত দিয়ে যেও।
পিছন থেকে আবিষ্কার তিড়িং করে সিঁড়ির এক ধাপ ওপরে উঠে এসে সিডিটা মোহনার হাত থেকে ছিনিয়ে এক নজর দেখেই ফেরত দিয়ে বলল,
-বাচ্চা মেয়ে দেখে ইয়ার্কি পেয়েছ তুমি! এই তিতলি, রাখ এসব!
-কেন তাতাই? এই তো ভূতের মুখ। জঙ্গলের মধ্যে একটা মন্দির মনে হচ্ছে, এটা দেখেই তো ভয়ঙ্কর লাগছে। আমি এটাই দেখব! আর আমি বাচ্চা তোকে কোন শালা বলল?
-এই ভাই এসব রাখো। আমি যেগুলো বলছি, সেগুলো দাও। সরাও এসব।
-না সরাবে না। এই দাও, আমি এটাই দেখব!
-তিতলি আমি তোর থেকে বড়, বড়দের কথা শুনতে হয়। আমার কথাটা একবার অন্তত শোন। জীবনে কোনদিন কারোর কথা কী তুই শুনবি না?
-এহ! মাত্র সাড়ে তিন দিনের বড়। তাতেই নাকি উনি বড়! কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে! আমি এটাই দেখব। এই ভয় পাব তো এটা দেখে?
ঠোঁট টিপে ছেলেটি বলল,
-বিশাল! এটা দেখার পর রাতে একা শুতে গেলেই অজানা অনুভূতিতে গা শিরশির করে উঠবে। ঠিক যেমনটা তুমি চাইছ! এটা তোমার সমস্ত ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করবে আই প্রমিস!
-ফাইন! আর ভয় না পেলে...
-টাকা দিতে হবে না। সিডিটা তোমার কাছেই রেখে দিও। বাবা থাকলে এটা ফেরত দিও না। আমি যখন দোকানে থাকব, তখন আমার হাতে দেবে। তাহলে আর টাকা দিতে হবে না।
মোহনার হাত থেকে ওই সিডি কেড়ে নিয়ে আবিষ্কার কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই মোহনা সিডিটা নিয়ে দৌড় দিয়েছে স্কুটির দিকে। ছেলেটি মুখ টিপে হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল অট্টহাসিতে। অসহায় আবিষ্কার সেই হাসিতে যোগ দিয়ে বলে উঠল,
-মেয়েটা যে কী করে না! আবার আমার সঙ্গে বসে দেখবে! শুধু একা আমার সঙ্গে নয়। সবার সঙ্গে!
ছেলেটি হাসি আর থামাতেই পারে না। অতিকষ্টে সে বলল,
-বিশাল মজা হবে।
-হ্যাঁ সেই তো। আজ আমার কপালে গ্রহরাজ একা নন, দেবতাদের পুরো ফ্যামিলি তা ধিন ধিন নাচছেন, বেশ বুঝতে পারছি। সলিড কেস খাব। কী আর করা যায়! পার্টনার ইন ক্রাইম যখন, ধোলাইটাও একসঙ্গেই খেয়ে নেব। টোটাল পার্টনারশিপে... আমি আর কিচ্ছু বলব না। ঝাড় খেয়েই শিখুক। একটু বুঝুক ওই মেয়ে! বড়দের কথা না শোনার ফল কী!
দোকান থেকে বেরিয়ে মোহনার স্কুটির পিছনে উঠে বসলো আবিষ্কার। চেঁচিয়ে উঠল মোহনা,
-তাতাই নাম স্কুটি থেকে।
-না। তোর কিছু হলে মা আমার পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেবে।
-তুই নামবি কিনা! এভাবে তোর ভরসায় চালালে জীবনেও আমার কনফিডেন্স আসবে না। আর আমি ঠিকমতো চালাতে না পারলে, কলেজে যাওয়ার আগে মা স্কুটিও কিনে দেবে না। পিছনে সাপোর্ট হয়ে বসে থাকবি না, সর! এটুকু হেঁটে চলে যা।
-আমি নামব না। তোর হাত এখনো কাঁপে!
-তুই নামবি! নাকি স্কুটি কাত করে ফেলে দেব তোকে?
-যা খুশি কর তুই!
একলাফে স্কুটি থেকে নেমে পড়ল আবিষ্কার। মোহনা স্কুটি চালাতে শুরু করলে আবিষ্কার ওর পিছনে প্রায় দৌড়তে শুরু করল। নিমেষের মধ্যেই বীভৎস শব্দ! নর্দমার ঠিক পাশে স্কুটি কাত হয়ে পড়েছে। আর মোহনা সটান কাদার আলিঙ্গনে লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসতে হাসতে মাথায় হাত দিয়ে রাস্তায় বসে পড়ল আবিষ্কার। চিৎকার করে উঠল মোহনা,
-আসবি এদিকে?
-না!
-আসবি? নইলে তোর মাকে বলে দেব কিন্তু!
-আসছি তো! সব ব্যাপারে মায়ের ভয় দেখাস কেন?
-তুই খুব সাহসী তাই...
স্কুটি আর কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া মোহনাকে টেনে তুলে খিক খিক করে হেসেই চলল আবিষ্কার। সারাটা রাস্তা মোহনা আর একটাও কথা বলেনি। বাড়িতে এসে স্নান সেরে যখন ঘর থেকে সিডি হাতে নিয়ে মোহনা বেরোল, তখন আবিষ্কার বলল,
-বোরোলীন লাগিয়েছিস কনুইতে?
-এ যা তো! বেশি ঢং করতে হবে না। তখন তো খুব দাঁত বের করে হাসছিলি! এখন কেন? সর! একহাত দূরে বসবি তুই! ওরা কোথায়?
-যেখানে থাকে!
-খেতে আসেনি এখনো? আজ দুপুরে খেতে খেতে সিনেমা দেখবে না?
-দরকার নেই। ওরা দোকানে আছে থাক। তাড়াতাড়ি খানিকটা দেখে ফেরত দিয়ে আসি চল। একটু পরেই ওরা খেতে চলে আসবে।
-তুই এত হুড়োহুড়ি করছিস কেন তাতাই? আর একটুখানি দেখব মানে? আমি পুরো সিনেমা দেখব। তুই ভীতু মানুষ জানি! তুই বরং কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি একা দেখব, তবুও পুরোটা দেখব।
-তা হলেই হয়েছে!
-মানে?
রিমোটটা হাতে নিয়ে টিভি চালিয়ে দিল মোহনা। বৈঠকখানার সব জানালা বন্ধ। দরজাটা আলগা কেবল। আবিষ্কার সোফা কাম বেডে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
-মানে তুই আমার সঙ্গে বসে পুরো সিনেমা দেখতে পারলে, আজ আমার তরফ থেকে ফুচকা ট্রিট কনফার্ম! আনলিমিটেড! যত ইচ্ছে খাবি।
সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আবিষ্কারের দিকে চাইল মোহনা। যে ছেলে মোহনার ঝেড়ে খেতে পারলে নিজের জীবনটা ধন্য মনে করে, সেই ছেলে হঠাৎ এমন দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করছে খাওয়ানোর কথা! এত উদারতা কেন? ততক্ষণে টিভির পর্দায় শুরু হয়েছে শিহরণ জাগানো এক ভয়ের সিনেমা।
পাশবালিশটা কোলের ওপর টেনে গুছিয়ে বসে উৎসুক দৃষ্টিতে মোহনা টিভির পর্দার দিকে চাইল। মিনিট কুড়ি সময় বেশ নির্বিঘ্নেই কাটল। অস্বস্তি শুরু হল তখন থেকে যখন সিনেমার নায়ক এবং নায়িকা প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করল। আড়চোখে আবিষ্কারের দিকে চাইল মোহনা। একদম সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো স্থির ও শান্ত ওর দৃষ্টি। শিরদাঁড়া টানটান করে বুক চিতিয়ে সোজা হয়ে ধ্যানে বসে আছে। মোহনা সিলিংয়ের দিকে চাইল। ড্রইংরুমের পাখাটা ঘোরার সময় যে এইরকম ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়, আগে তো কখনো খেয়াল করে দেখা হয়নি। পাখাটা ঠিক করার জন্য লোক ডাকতে হবে। দেওয়ালে ঝুল পড়েছে। ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। সেবার মেলা থেকে কেনা ছোট-বড় প্রজাপতিগুলো সারি দিয়ে দেওয়ালে সেঁটে রয়েছে। মাঝে একটা প্রজাপতি কই গেল? ওই জায়গাটা ফাঁকা কেন? ঘরের যত অসঙ্গতি, সব এখনই মোহনার চোখে পড়ল। টিভির দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না। ওদিকে টিভির পর্দায় নায়ক নায়িকার চরম ঘনিষ্ঠতার মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। মোহনা কুলকুল করে ঘামছে, নায়ক-নায়িকা ভিজছে। ঢোঁক গিলে একটু কেশে মোহনা গলাটা পরিষ্কার করে নিল। আবিষ্কার সুরেলা কণ্ঠে বলে উঠল,
-এবার বৃষ্টিভেজা অবস্থায় একটা সাদা রংয়ের ট্রান্সপারেন্ট নাইটি পরে হি হি করে হাসতে হাসতে আকাশপথ বেয়ে মাদুরে বসে একটা পেত্নী ভেসে আসবে। আমরা ভয় পাব তো! তুই আশা ছাড়িস না তিতলি, আমরা ভয় পাবই। এই তো, আর একটু অপেক্ষা। তারপর পেত্নী আসবে। আর তারপরই....
মোহনার অস্বস্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নায়ক নায়িকার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল, যে নায়িকার ঐ তীব্র শীৎকারে চাপা পড়ে গেল দরজা খোলার মৃদু শব্দ। আবিষ্কার তখনো ক্রিকেটের মাঠের একজন সুনিপুণ ধারাভাষ্যকারের মতোই একনাগাড়ে বকবক করে চলেছে। মোহনা মনে মনে ঐ সিডির দোকানের ছেলেটির মুণ্ডপাত করছে। একদৌড়ে উঠে মোহনা টিভিটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় ঘরের আলো জ্বলে উঠল। পেত্নীর বদলে দু'পায়ের দুটো চটি হাওয়ায় ভেসে উড়ে এলো মোহনা আর আবিষ্কারের দিকে। চন্দ্রাণী লাফিয়ে পড়ে সোফা কাম বেডে উঠে আবিষ্কারের চুলের মুঠি টেনে ধরে বলল,
-দুটোকেই মেরে ফেলব আজ। দুই ভাই বোনের মাথা দাম করে ঠুকে দেব। আমার ছেলেটা বেশি পাজি। কী দেখছিস তোরা? এক থাপ্পড় মেরে তোর কান গরম করে দেব তাতাই! পড়াশোনার নামগন্ধ নেই। এই বেড়ে পাকামির জন্যই তুই পরীক্ষার খাতায় লাড্ডু পাস।
-আমি কিছু জানি না মা! তিতলি আমাকে বলল ভালো ভূতের সিনেমা তাতাই। দেখবি আয়। ও এনেছে। আমি কিছু জানি না। ও আমাকে দেখতে ডাকল।
মোহনা ততক্ষণে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে দোতলায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপটি করে বসে আছে। একটু পরেই দরজা পেটানোর প্রবল শব্দ। চন্দ্রাণী চিৎকার করে উঠল,
-তিতলি দরজা খোল!
বারকয়েক দরজা পেটানোর পর দরজা খুলে দিল মোহনা। তাতাইয়ের কান টেনে ধরে ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার গাল কান সব টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। ধমকে উঠল চন্দ্রাণী,
-কে এনেছে ওইসব সিনেমা? তাতাই তো? আজই এটাকে বাড়িছাড়া করব।
কানে ভালোরকম মোচড় দিতেই কঁকিয়ে উঠল আবিষ্কার। মোহনার দিকে চেয়ে চোখ টিপে ইশারা করল তাতাই। যার অর্থ, "আমার ওপর ছেড়ে দে। সামলে নেব।"
মোহনার বুকের ভিতরটা কাঁপছিল। চন্দ্রাণীর হাতটা টেনে আবিষ্কারের কান থেকে নামিয়ে ও বলল,
-তাতাইকে ছেড়ে দাও মানু। আমরা কেউ জেনেশুনে এসব সিনেমা আনিনি। আমি ভূতের সিনেমা দেখতে চেয়েছিলাম। দোকানের ছেলেটা ইচ্ছে করে আমার হাতে এটা ধরিয়ে দিয়েছে। তাতাই এটা নিতে বারণ করেছিল। আমিই বেশি সাহস দেখিয়ে এনেছি। তোমাদের সবার সঙ্গে বসেই তো টিভি দেখি বলো! তোমার কী মনে হয় মানু, জেনেশুনে এসব আমি বাড়িতে আনব? তাও আবার দিনদুপুরে দরজা খুলে চালিয়ে বসে থাকব? সরি মানু! আমি জানতাম না! তাতাইকে ছেড়ে দাও।
মোহনার মুখের দিকে চেয়ে, নিজের ছেলের মাথায় সজোরে একটা চাঁটি মেরে আর একবার ভালো করে কানটা নেড়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল চন্দ্রাণী। মোহনা ডাক দিল,
-মানু?
চন্দ্রাণী সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মোহনার কণ্ঠে কাতর আর্তি,
-মাকে এসব বোলো না প্লিজ!
মায়ের হাতে চাঁটি খেয়ে কানে হাত বোলাতে বোলাতে মোহনার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল তাতাই। কিন্তু তার আগেই মোহনা ঘরের দরজাটা সজোরে বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল তাতাই,
-ওফ! এই এক মেয়ে! একটু কিছু হলেই ঘরে খিল দিয়ে গাল ভারী করে বসে থাকতে জানে! আমার খিদে পাচ্ছে। তুই বেরোবি কিনা বোন! দরজা খোল না! ওই তিতলি?
সন্ধে নেমেছে বাড়ির ছাদে। কার্নিশে চুপ করে বসে রয়েছে মোহনা। ছাদের ওপর থেকে বাড়ির গেটটা দেখা যাচ্ছে। এই গেটটা মোহনার খুবই পরিচিত। কত ছোট বয়স থেকেই যে ওই গেট পেরিয়ে মোহনা এই বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে, সেটা আজ আর ওর মনে পড়ে না। মোহনার মায়েরা দুই বোন। বড় বোন চন্দ্রাণী, অর্থাৎ তাতাইয়ের মা। আর ছোট বোন ইন্দ্রাণী, তিতলির মা। বাড়িভাড়া দিয়ে ও সংসার চালিয়ে, দুই বোনের উচ্চশিক্ষার খরচ বহনের মতো আর্থিক ক্ষমতা তিতলির দাদুর ছিল না। তিনি একটি ছোট মুদি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। তবুও মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছেন। দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে অতিকষ্টে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে চন্দ্রাণী। কিন্তু ইন্দ্রাণীর পড়াশোনার দৌড় নবম শ্রেণী পর্যন্ত। তারপরই শুরু হয় বাবার শারীরিক অসুস্থতা। প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণে প্রায় শয্যাশায়ী তিনি। চিকিৎসার জন্য পরিমিত অর্থ বাবার সঞ্চয়ে ছিল না। সেই সময়ে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বাবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য বদ্ধপরিকর দুই মেয়ে, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কাজকর্ম শুরু করতে হয় দুই বোনকে। ভাগ্য খানিক সহায় হয়, যখন দুই জামাই এই পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়। সুখের সাগরে ভেসে যায় ঐ পরিবার, যখন প্রায় একইসঙ্গে দুই বোনের গর্ভে নতুন অতিথির আগমন ঘটে। কিন্তু ভাগ্যে সুখ দীর্ঘস্থায়ী না হলে শত পরিশ্রম শেষে, ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই লাভ করা সম্ভব হয় না। বিয়ের কয়েক বছর পরই মারা যায় তাতাইয়ের বাবা। মেসোমশাইকে তিতলির সেভাবে মনে পড়ে না। তাঁর সঙ্গে পরিচয় কেবল ছবির মাধ্যমে। আর তিতলির বাবা? মৃদু হাসে তিতলি! চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জলটা মুছে নেয় হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে। দাদু-দিম্মার মৃত্যু, অভাব-অনটন, আশ্রয়হীনতা, অনিশ্চয়তা.... টানাপোড়েনের সেই অভিশপ্ত দিনগুলো কাটিয়ে উঠেছে দুই বোন। আজ বাজারের ভিতর তাতাইয়ের মায়ের একটা ছোট বুটিক, আর তার সঙ্গে টেলারিং হাউজও রয়েছে। আর ওই বুটিকের সঙ্গেই লাগোয়া একটা লেডিস পার্লার করে নিয়েছে তিতলির মা। দুই বোন একত্রে সারা জীবনব্যাপী যুদ্ধ করে আজ এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। তাতাই আর তিতলিকে বড় করেছে, পড়াশোনা শেখাচ্ছে। তাতাইকে মানু গত বছর একটা সেকেন্ড হ্যান্ড স্কুটিও কিনে দিয়েছে। কলেজে উঠলে তিতলিকেও কিনে দেবে, এমনটাই কথা হয়েছে। এই দোতলা বাড়ির ওপর তলাতেই আগে ভাড়া থাকত তাতাইয়ের বাবা-মা আর তাতাই। এখন এই দোতলাটা ওরা পুরোটাই কিনে নিয়েছে। বাড়িওলা যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন, তাই একতলাটাও ওরা ভাড়া নিয়েছে। তবে মা আর মানুর ইচ্ছে আছে বাড়িওলা তিন বছর পর দেশে ফিরলে একতলাটাও ওরা কিনে নেবে। এখন থেকেই বাড়ি কেনার জন্য প্রাণপণে টাকা জমাচ্ছে দুই বোন। সারাদিনই দুই বোন টাকার জন্য দোকানে পড়ে থাকে। বেশ কয়েকজন কর্মচারী কাজ করে ওদের দোকানে। খুব ছোট থেকেই খিদের তাড়নায় হাত পুড়িয়ে কাজ করতে করতে, কবে যেন সবরকম রান্নাবান্না শিখে গিয়েছিল তিতলি আর তাতাই। ভাইবোন স্কুলে বেরিয়ে গেলে গোটা বাড়ি জনমানবহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। আর ছুটির দিনে আবিষ্কার আর মোহনা বাড়ি থাকলে, ওরাই মা আর মানুকে নিয়ে হৈ-হল্লা করে মাতিয়ে রাখে গোটা বাড়ি। দুটো মানুষ সারাজীবন অতিবাহিত করে ফেলেছে শুধুমাত্র সন্তান আর সংসারের জন্য। বিন্দুমাত্র সাধ-আহ্লাদ কিংবা আত্মসুখের কথা চিন্তা করার অবকাশ তারা পায়নি। খুব ছোট থেকেই তাতাই আর তিতলি বুঝে গিয়েছিল ওদের সংগ্রাম। সেই কারণে একটু খুশির সুযোগ পেলে, ওরা আর কোনমতেই সেটা হাতছাড়া করতে চায় না। সবসময় হেসেখেলে জীবনের কষ্টগুলোকে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়িয়ে, মনটাকে হালকা রাখতে চায়। একটু মনখারাপ হলেই তিতলির কথা একদম বন্ধ হয়ে যায়। কেমন যেন একটা আতঙ্ক এসে চেপে বসে ওর বুকে। মনে হয় পৃথিবীর কেউ ওকে ভালোবাসে না। শৈশবের ঐ অভিশপ্ত দিনগুলো বারংবার স্মৃতিতে ফিরে আসে। গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে কান্না জমে থাকে। তখন ও একা ছাদে এসে চুপ করে বসে থাকে। কথা বলে নিজের সঙ্গে। সেই অভিমানী মেয়েটার সঙ্গে, যার খবর কেউ জানে না। তাতাইও না। কাব্যও না। বাবা-মাকে ছোট থেকে কাছে না পাওয়ার জন্য ওর মনের ভিতরে একটা জেদি আর অভিমানী মেয়ের জন্ম হয়েছে। যাকে ও খুব সযত্নে আজও লালন পালন করে। সময়বিশেষে ওই অভিমানী মেয়েটা আত্মপ্রকাশ করে। এমনি সময়ে মোহনা ঘুম পাড়িয়ে রাখে তাকে। তিতলির জীবনের একমাত্র বন্ধু তাতাই। তিতলির থেকে তাতাই সামান্য বড় হলেও, ও দাদাকে নাম ধরেই ডাকে। দুই ভাই-বোন যেন হরিহর আত্মা। ওদের মধ্যে দিনরাত যতটা মারপিট-চুলোচুলি-ঝগড়া, ঠিক ততটাই ভালোবাসা ও প্রগাঢ় হৃদ্যতা লক্ষ্য করা যায়। ওরা পরস্পরের জীবন যুদ্ধটা এত কাছ থেকে দেখেছে, যে দু'জন দু'জনকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না। একটা ইচ্ছাকৃত কাশির শব্দে তিতলির ভাবনার ঘোর কাটল। অদূরে তাতাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিতলিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাতাই বলল,
-কী রে? একা একা বসে আছিস যে! মন খারাপ?
-মা খেতে আসেনি দুপুরে?
-না। মা বলল পার্লারে অনেক কাস্টোমার ছিল। মানু আসতে পারবে না। মা নিজে খেয়ে মানুর খাবারটা প্যাক করে নিয়ে গেছে।
-তুই খেয়েছিস?
-তুই বাড়িতে থাকলে তোকে ছাড়া খেয়েছি কখনো?
-হতভাগা সন্ধে হয়ে গেল। এখনো খাসনি তুই?
-চেল্লাস কেন? কানের পর্দা ফেটে গেল। এমনিতেই কানমলা খেয়ে আমার পেট ভরে গেছে। খিদে নেই আর।
-একটুও জায়গা নেই পেটে? ফুচকা খেতে পারবি না?
হেসে ফেলল তাতাই। তিতলি ওকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় বলল,
-সরি দা! আমার জন্য তুই মানুর হাতে মার খেলি!
-এহ! দাদা নাকি! সম্মান শ্রদ্ধা কিছু করিস তুই আমায়? খালি কান্নার সময় দাদা বলে জড়িয়ে ধরবি, আর বাকি সময় আমার পিছনে খ্যাকশিয়ালের মতো খ্যাক খ্যাক করবি! ছাড় ছাড়! খেতে দে, খিদে পেয়েছে।
-চল!
-সাহিত্য ফোন করেছিল তিতলি।
-আবার?
-হ্যাঁ।
-কী বলছে?
-এই তুই কেমন আছিস? পরীক্ষার পর তোর আর কোন খবর নেই। একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছিস! তোর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে কিনা! এইসবই...
-এই মানু তখন কোথায় ছিল?
-বেরিয়ে গেছিল।
-তুই কী বললি?
-আমি বললাম, রাজকন্যা এখন গোঁসা ঘরে খিল দিয়েছেন। তুই পরে ফোন করিস ভাই! আচ্ছা তিতলি, তুই ছেলেটাকে পাত্তা দিস না কেন রে?
-সিডিটা বের করেছিস? ফেরত দিতে হবে। আমি যাব। ওই ছেলেটার মাথায় সিডি ভাঙব।
-এই না। আমি যাব। তুই গেলে ছেলেটার মাথা তো দূর, দোকানও ভাঙচুর করে ফেলতে পারিস।
হেসে ফেলল দুই ভাই বোন। তিতলির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে ঘেঁটে তাতাই বলল,
-বড়দের কথা শুনতে হয়, বুঝলি?
-হু! আমি খুব খারাপ বোন, তাই না তাতাই?
-কোন শালা বলে? ফুলো কা তারো কা, সবকা ক্যাহনা হ্যায়... এক হাজারো মে... উঁহু! আমার বোন কোটিতে একটা!
-তাই নাকি? তোর জন্যও একটা গান আছে। করি?
-প্লিজ!
-স্রোতস্বিনী! তুমি নাহি...
-ওই!
সন্ধের আবছা অন্ধকারের মধ্যেও তিতলি বুঝতে পারল,
স্রোতস্বিনীর নামেই তাতাইয়ের হাসিতে লজ্জা স্পষ্ট! তিতলি বলে উঠল,
-থাক থাক! আর লজ্জা পেতে হবে না। স্রোত কেমন আছে?
-মামারবাড়ি থেকে কাল ফিরেছে। আজ দেখা করার কথা বলছিল। এদিকে শুভটা মাসিরবাড়ি গিয়ে বসে আছে, রাহুল সিমলা। কার নাম নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোই বল তো? বন্ধুরা শুনলে হাসে। এতবড় ছেলে হয়ে গেলাম, রেজাল্ট বেরোলে দু'দিন পর কলেজে যাব, এখনো কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি, কখন বাড়ি ঢুকব, মাকে সবকিছুর কৈফিয়ৎ দিতে হয়। আমার মা তো মনে করে আমি বাড়ি থেকে বেরোলেই পৃথিবীর সব মেয়েরা রাস্তাঘাটে বিপদে পড়বে! আমি যেন সবাইকে টিজ করে বেড়াব! তুই জানিস তো আমাকে বুনু! আমি ওইরকম করি?
-আমার কথা ভাব তো তাতাই! আজ তোর মতো দাদা আছে বলে, আমি রাস্তায় একা বেরোতে ভরসা পাই। মানু তোকে যেভাবে মানুষ করছে, তুই চাইলেও কোনদিন ভুলভাল কাজ করতেই পারবি না। তোর মন সায় দেবে না। আমার তো রাস্তায় বেরোলে মনে হয়, সব ছেলেরাই তোর মতো ভালো। তাদের সবাইকে তাদের মায়েরা ঠিক তোর মতো করেই মানুষ করেছে, তাই নিজেকে সেফ লাগে। মানু ঠিক বলে তাতাই। মেয়ে সন্তান মানুষ করার থেকে ছেলে সন্তান মানুষ করা অনেক বেশি কঠিন। অনেক বেশি দায়িত্বের। ছেলে কুসঙ্গে পড়ল কিনা, কোন বন্ধুর সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, মানুর সব হিসেব চাই। আমার তো বেশ ভালো লাগে এটা! তোকে মানু এমনভাবে তৈরি করেছে, শুধু আমি কেন তাতাই? পৃথিবীর যে কোন মেয়েই তোর সঙ্গে একটা বন্ধ ঘরেও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। অবশ্য স্রোতের কথা আলাদা! ওর সঙ্গে তোকে এক ঘরে রাখলে, তুই যে ওকে কী করে ফেলবি...
-মার খাবি তিতলি! দাদার সঙ্গে কথা বলছিস! ভুলে যাস নাকি! লজ্জা করে না?
-এহ! কী আমার দাদা এলেন রে! সর সর খিদে পেয়েছে।
-স্রোতের সঙ্গে একটু বেরোব বোন। মাকে ম্যানেজ করে দিবি? প্লিজ!
-আমি একটু পর কাব্যর সঙ্গে বেরোব। মানুকে বলে যাচ্ছি, তুই আমাকে আনতে যাবি। আমাকে আনতে যাওয়ার নাম করে দোকানে বলে বেরিয়ে যা, দেখা করে নে বউয়ের সঙ্গে।
-কাব্যর সঙ্গে বেরোবি, না সাহিত্য?
কোন উত্তর দিল না মোহনা। সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে এলো। ওর পিছনে নামতে নামতে আবিষ্কার বলল,
-বুঝে গেছি। যে ছেলে এক বছর ধরে ঘুরছে, তার দিকে তুই ফিরেও চাইবি না। দেখবি একদিন এমন দিন আসবে, যে ছেলে তোকে জম্পেশ ইগনোর করবে, তুই তার জন্যই মরবি!
টেবিলে খেতে বসেও তাতাইয়ের বকবকানি অব্যাহত রয়েছে। মোহনা দুপুরের খাওয়া সন্ধেবেলা সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একজোড়া ঝোলানো কানের দুল পরছিল। একটা সুগন্ধীর বোতল উপুড় করে দিল নিজের দেহে। তাতাই মোহনার সমস্ত কথা জানে। সমস্ত বন্ধুদেরও চেনে। যেখানে যা হয়, ওরা ভাই বোন পরস্পরকে সবই বলে। কেবল একটা কথা কোনদিনই বলা হয়নি ওকে। হয়তো এই গোপন সত্য তাতাইকে কোনদিনই বলা হবে না। ও জানে এই কৃত্রিম সুগন্ধীটা ওকে ওর প্রিয় বান্ধবী কাব্যাঞ্জলি উপহার দিয়েছে, যে এইবার মোহনার সঙ্গেই পরীক্ষা দিল। ওরা একই স্কুলে পড়ে। পড়াশোনার সূত্রে ওরা একে অপরের বাড়িতেও যাতায়াত করে। পরীক্ষার আগে নাইট স্টাডির জন্য কাব্যর বাড়িতে মোহনা একাধিক রাতও কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু পৃথিবীর কেউ এটা জানে না, যে এই সুগন্ধী নিজের দেহে মেখে মোহনার দৃষ্টির সম্মুখে একাধিকবার নিজেকে মেলে ধরেছিল কাব্য। আর মোহনাও হারিয়ে গিয়েছিল কাব্যর কোমল ঠোঁটের অতলে। কাব্যর দেহের ঐ পরিচিত সৌরভটুকু নিজের দেহে মেখে নিল মোহনা। প্রিয় নারীর দেহের সৌরভে আবিষ্ট হয়ে গেল ও। কাব্যর সঙ্গে নিজেকে কল্পনা করে মোহনার মনের আকাশে ডানা মেলে উড়তে লাগল শত শত রঙিন প্রজাপতি।
**********
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
Apnar golpo taa pore khub bhalo legeche
উত্তরমুছুনvalo laglo. post korte thakun. vromon, golpo, kobita, technology and health related post porte tripretreatBD blog visit korun. valo lagle share korun.
উত্তরমুছুন