সপ্তপর্ণী
সাথী দাস
দ্বিতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় পর্ব
মায়াকানন রাজ্যে রাজপ্রাসাদের সম্মুখভাগে যে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, সেই প্রাঙ্গণে পর্ণার আপন হস্তনির্মিত কৃত্রিম মায়াকানন অযত্নে ও পরিচর্যার অভাবে বর্তমানে মৃতপ্রায়। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে রুক্ষ ধূলিধূসরিত পথমাঝে আপন উদাস দৃষ্টিপাতপূর্বক প্রাসাদের উন্মুক্ত অংশে রানি বসেছিলেন। গর্ভ মধ্যস্থিত ক্ষুদ্র প্রাণটি মুহূর্মুহু হস্ত ও পদ সঞ্চালনার মাধ্যমে আপন অস্তিত্ব জানান দেয়। সুবৃহৎ উদরের কারণে আপন কক্ষমাঝে পর্ণা প্রায় বন্দি জীবনযাপন করেন। অদূরে উত্তরা ও ফাল্গুনী একাধিক বিহঙ্গ পরিবারকে শস্যদানা প্রদানে ব্যস্ত। ময়ূর দম্পতির কর্কশ কেকাধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র মায়াকাননের দিক হতে দৃষ্টি ফেরালেন পর্ণা। প্রহরী বীরদত্তের আগমনবার্তা জানান দিলে উত্তরা ও ফাল্গুনীর সাহায্যে আপন সুবিশাল বপু ও উদর বয়ে নিয়ে, সপ্তপর্ণী কক্ষমধ্যে গমন করলেন।
-শুভ সন্ধ্যা রানি।
-শুভ সন্ধ্যা বীরদত্ত। দূত কর্তৃক প্রাপ্ত দুঃসংবাদ অবগত আছ তুমি?
-আছি মহারানি। অমরাবতীর রাজধানীতে কোন এক অজানা রোগের প্রকোপে একাধিক প্রাণহানির সংবাদ আমার মনকে যারপরনাই ব্যস্ত করে তুলেছে। প্রজার সম্পত্তি, গবাদি পশুর প্রাণ, এই ক্ষণে সকলই একপ্রকার বিপন্ন। আমি অতিশয় ভীত। তবে গর্ভাবস্থার অন্তিমকালে এই সংবাদ আপনার নিকট প্রকাশ করতে আমি অসম্মত ছিলাম। সেই কারণেই...
-রোগের বিস্তারিত বিবরণ দাও বীর।
-রোগীর বমন ইচ্ছা দমন করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে বিষ্ঠা পরিত্যাগকালে রোগীর প্রাণান্তকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রক্তবমি ও ভেদবমির প্রাদুর্ভাব রাজধানীর একাধিক নগরে বিস্তার লাভ করেছে। রাজপ্রাসাদ হতে প্রাপ্ত তাঁবুর কাপড় দ্বারা একাধিক ছাউনি নির্মাণ করে, বৃদ্ধ রোগীদের পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। শিশু, যুবক ও স্ত্রীলোকদের সেবায় নগরের প্রায় প্রত্যেক বৈদ্য প্রাণপাত করছেন।
-চিকিৎসার প্রয়োজনে এই ক্ষণে রাজকোষ হতে অর্থ সাহায্য...
-আপনার সীলমোহর ব্যতীত অমরাবতীর রাজকোষ উন্মুক্ত করা কোনপ্রকারেই সম্ভব নয় রানি।
-সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রস্তুত করো। দূতকে আমার কক্ষে...
-না!
বীরদত্তের দরাজ কণ্ঠে কম্পিত হয় পর্ণার অন্তরাত্মা। অন্দরমহলের অপর অংশ হতে উত্তরা এসে পৌঁছয় পর্ণার নিকট। পর্ণা অত্যন্ত রূঢ়কণ্ঠে বলেন,
-আমার সম্মুখে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার? তোমার স্পর্ধা তো বড় কম নয় বীর!
-ক্ষমা করবেন। আমার দেহে প্রাণ থাকতে রাজধানীর দূতকে এই কক্ষে প্রবেশাধিকার আমি দেব না। আপনি উত্তরা হতে সে দুঃসংবাদ অবগত হয়েছেন, বিশেষ কোন বক্তব্য দূতের নিকট পৌঁছনোর প্রয়োজন হলে, সে পৌঁছে দেবে। আমিও সশরীরে বর্তমান। কিন্তু দূত এই কক্ষে প্রবেশ করবে না।
-আমার অনুমতি ব্যতীত আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তুমি হস্তক্ষেপ করবে! এতখানি স্পর্ধা...
-পর্ণা, উত্তেজনা আপনার দেহের পক্ষে কদাচ সুখদায়ক নয়। শান্ত হোন!
-স্তব্ধ হও উত্তরা! এই মূর্খের এতখানি স্পর্ধা...
-বীরদত্ত! আপনি এই কক্ষ হতে এই ক্ষণে প্রস্থান করুন।
-আমি কক্ষদ্বার আগলে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করব। তবুও এই কক্ষে দূতের প্রবেশাধিকার...
-বীরদত্ত!!
-পর্ণা!
বীরদত্তর দুই চক্ষু হতে যে তীব্র রোষানল নির্গত হল, সেই ক্ষণে পর্ণার মনে হল, ওই রোষানলে তিনি অবলীলায় ভস্মীভূত হয়ে যাবেন। পর্ণার দেহ কম্পিত, শ্বাসগ্রহণও ক্রমে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। আপন উদর আলিঙ্গন করে শয্যাপ্রান্তে উপবেশন করলেন তিনি। উত্তরা পর্ণার শিথিল দেহে স্নেহমিশ্রিত হস্তচালনা করামাত্রই, সেই মুহূর্তে পর্ণার পদতলে স্থানগ্রহণ করে বীরদত্ত বলল,
-রাজধানী হতে দূত এসেছে। নগরে মারণ রোগের প্রকোপ ক্রমবর্ধমান রানি। মড়ক লেগেছে। নগর হতে মায়াকাননের উদ্দেশে দুইজন যাত্রা করেছিল। কিন্তু পথমধ্যে ওই সংক্রামক মারণ রোগের কারণে এক দূতের মৃত্যু হয়। দূতের হতভাগ্য অশ্বটিও পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে। এমন মহামারীর রাজ্য হতে যে মানুষের আগমন, তার সম্মুখে আপনি যাবেন না। ওই দূতের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আপনার ও এই সন্তানের জন্য সমূহ বিপদ বয়ে আনতে পারে। আপনার এই রাজ্যের সকল প্রজার নিরাপত্তার জন্যই আমি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি রানি। তাকে পৃথক স্থানে রেখেছি। আমি এবং উত্তরা ওই দূত হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অমরাবতীর রাজদূতের এই মায়াকাননে কোনরূপ অসম্মান হবে না। আমি নিজ উদ্যোগ ও কর্তব্যজ্ঞানে সকল বিষয় সজাগ দৃষ্টিপাত করছি। আহার্য খাদ্য পানীয় সকলই তার কক্ষে যথাসময়ে প্রেরণপূর্বক, তাকে রাজ অতিথির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আমার জীবদ্দশায় আপনার কক্ষে সে প্রবেশাধিকার পাবে না। গর্ভাবস্থার অন্তিম ক্ষণে নিজের অমূল্য জীবনে, আপন সন্তানের জীবনে কোনরূপ অযাচিত বিপদ ডেকে আনবেন না। বিনীত অনুরোধ! আমাকে ভুল বুঝবেন না রানি! আমি আপনার সকল সিদ্ধান্তকে আপন ধর্ম জ্ঞানে নতমস্তকে মান্যতা দিয়ে থাকি। সর্বদা প্রাণপাত করি আপনার জন্য, কিন্তু আপনার ব্যক্তি-সিদ্ধান্তে যদি আপনারই সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা পরিলক্ষিত হয়, তবে তেমন সিদ্ধান্তে আমি আমরণ আপনারই বিরুদ্ধাচরণ করব মহারানি পর্ণা।
শয্যা হতেই স্থির দৃষ্টিতে পর্ণা বীরদত্তর পানে চেয়ে রইলেন। উত্তরা পর্ণাকে আলিঙ্গনপূর্বক মৃদুভাষে বলল,
-রাজসেনাপতির আশঙ্কা নেহাৎ অমূলক নয় রানি। তিনি আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং উদ্বিগ্ন। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও আপন স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিচার করে আপনি অচিরেই সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রদানপূর্বক দূতকে অমরাবতী রাজ্যে ফিরিয়ে দিন। এই স্থানে দূতের দীর্ঘক্ষণ যাপন, মায়াকাননের পক্ষে যথেষ্ট বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
শয্যা হতে পর্ণা বীরদত্তের পানে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিবিনিময় করে বলল,
-ওঠো বীর! সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রস্তুত করে পুনরায় আমার কক্ষে ফিরে এসো।
-যথা আজ্ঞা রানি!
পর্ণাকে অভিবাদনপূর্বক কক্ষ হতে প্রস্থানকালে পুনরায় পর্ণার কাতর আহ্বানে বীরদত্ত ফিরল,
-তুমি আপন রাজ্যে ফিরবে না বীর? রাজ্যের এমন সংকটকালে...
-রাজ্যে শত্রু আক্রমণকালে রাজসেনাপতির কিছু অবশ্য কর্তব্য থাকে। কিন্তু এ যুদ্ধে যে মৃত্যু মিছিলের পরিসংখ্যান প্রতিনিয়িত ঘোষিত হচ্ছে, বৈদ্য ব্যতীত আমি এবং অমরাবতীর অস্ত্রাগার সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে অক্ষম রানি। আমি আশাবাদী, অভিজ্ঞ রাজবৈদ্যের নির্দেশে অবিলম্বে এই যুদ্ধজয় সম্ভব। আগামী এক পক্ষকালের পূর্বেই আপনি সন্তান জন্ম দেবেন। আপনি এবং অমরাবতীর ভবিষ্যৎ রানি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত, এই সংবাদ পরিপূর্ণরূপে অবগত হওয়ার অব্যবহিত পরই আমি এই রাজ্য হতে বিদায় গ্রহণ করব। অতঃপর আপনার ইচ্ছানুসারে নির্দিষ্ট সময়ে মহাসমারোহে আপনাকে এবং অমরাবতীর উত্তরাধিকারণীকে রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাব ওই মায়াকাননের পথ ধরে... আপনি বিশ্রাম গ্রহণ করুন রানি। আমি অমরাবতীর সীলমোহর ও অনুমতিপত্র সহ এই কক্ষে ফিরে আসছি।
ক্লান্ত পর্ণা আপনার কক্ষ হতে বিহ্বল দৃষ্টিপাত করলেন মায়াকাননের পানে। সেই নিকষ কালরাত্রির অন্তিম প্রহরে উত্তরা ও ফাল্গুনী কর্তৃক পর্ণা সংবাদ পেলেন, অমরাবতীর ওই রাজদূত কিছু পূর্বেই বারকয়েক ভেদবমি হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পূর্বেই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বনপূর্বক ওই দূতের পার্থিব দেহ ও তার ব্যবহার্য সকল পোশাক এবং বিষ্ঠায় আবৃত উত্তরীয়টি স্বহস্তে আগুনে ভস্মীভূত করল বীরদত্ত। নিজ পরনের অন্তিম পোশাকটিও ওই ক্ষুদ্র
অগ্নিকুণ্ডে প্রদানপূর্বক নষ্ট করে মায়াকানন রাজ্যকে জীবাণু হতে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে বীরদত্ত সচেষ্ট হল। প্রথম প্রভাতে পর্ণার কক্ষ হতে অদূরে অবস্থিত জলাশয়টিতে আকণ্ঠ ডুবে যখন বীর নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখার সর্বোত প্রচেষ্টায় স্নানাদি কার্যে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তে আপন কক্ষ হতে বীরদত্তের পানে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন সদ্য নিদ্রাভঙ্গপূর্বক শয্যাত্যাগী পর্ণা। আপন উদরে পরম স্নেহে হস্তচালনাপূর্বক মনে মনে বারংবার বীরকে ধন্যবাদ জানানোর আকুল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আবেগে ও কৃতজ্ঞতায় সপ্তপর্ণী প্রথমবার ভাষাহীন হলেন। আপন গন্ডদেশে হস্তচালনাকালে বীরদত্তের সিক্ত পৃষ্ঠদেশের পানে দৃষ্টিপাত করে চমৎকৃত হলেন পর্ণা। বীরের পৃষ্ঠদেশে একাধিক ক্ষুদ্র বৃহৎ গভীর ক্ষতচিহ্ন। এই সকল চিহ্নই কি অমরাবতী রাজ্যের প্রতি তার গভীর বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরিচয় বহন করছে! ক্ষার, সর্জিকা চূর্ণ ও ধূসর মৃত্তিকাতে আবৃত বীরের সুঠাম দেহের ঊর্ধ্বভাগের কিয়দংশ। নিম্নভাগ জলাশয়ের গভীরে বিলীন হয়েছে। অবিন্যস্ত সুদীর্ঘ সিক্ত কেশগুচ্ছ গ্রীবা হতে প্রসারিত হয়ে পৃষ্ঠদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পর্ণা মুগ্ধ দৃষ্টিতে বীরের পানে চেয়ে রইলেন। সেই ক্ষণেই সবুজাভ জলাশয়ের গভীরে একাধিকবার বিলীন হয়ে, ক্ষুদ্র তরঙ্গের অভ্যন্তরভাগ হতে বীর আপন উত্তরীয় ব্যতীত উঠে আসতে সচেষ্ট হল। সেই দৃশ্য অবলোকনমাত্রই মুহূর্তে আপন কক্ষের উন্মুক্ত স্থান হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলেন পর্ণা। তবে অন্তিম ক্ষণে এক লজ্জাহীন ময়ূর আপন নয়নাভিরাম পুচ্ছ প্রসারিতপূর্বক কর্কশধ্বনির মাধ্যমে নবপ্রভাতের সূচনাকাল ঘোষণা করল। সচকিত বীরদত্ত ওই অবোধ জীবের প্রতি সদয় দৃষ্টিপাত করার মুহূর্তে আপন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এই বিষয় সহজেই অবগত হল, সেই ক্ষণে ওই স্থানে স্বচ্ছ উত্তরীয়র অন্তরাল হতে কোন মানুষ এইদিক পানেই সজাগ দৃষ্টি প্রদান করছিল। বীরদত্তর দৃষ্টি সম্মুখে রাজপ্রাসাদের ওই সুদৃশ্য কক্ষ মহারানি পর্ণার। এ বাক্য স্মরণে আসামাত্রই দৃষ্টি অবনত হল কুণ্ঠিত বীরদত্তর। জলাশয়ের প্রান্ত হতে প্রস্তরনির্মিত নিম্নগামী প্রতিটি সোপান অতিক্রম করে ধীর পদক্ষেপে বীরদত্ত জলের গভীরতায় পুনরায় বিলীন হল। প্রহরী কর্তৃক প্রেরিত উত্তরীয় দ্বারা আপন দেহের নিম্নভাগ আচ্ছাদিত করল বীরদত্ত। অতঃপর সেই স্থান পরিত্যাগ করে আপন কক্ষে প্রস্থান করল। মারণ রোগ ও জীবাণুর কারণে ভীত বীরদত্ত কিছুকাল স্বেচ্ছায় নিভৃতাবাসে থাকা মনস্থির করল। আপন কক্ষমাঝে পৌঁছে রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে যে ক্ষণে উত্তরীয় পরিত্যাগ করে সুদীর্ঘ দর্পণে বীরদত্ত আপন সুঠাম প্রতিবিম্ব পানে দৃষ্টিপাত করল, মহারানি পর্ণা সেই ক্ষণে অগ্রসর হয়েছেন স্নানঘরের উদ্দেশে।
কিছুকাল পর অমরাবতী রাজ্যে রোগের প্রকোপ খানিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও পর্ণার প্রসববেদনা সহ্যশক্তির সকল সীমারেখা অতিক্রম করল। প্রসূতিগৃহ হতে পর্ণার গগনবিদারী চিৎকার ও ক্রন্দনধ্বনি বীরদত্তের কর্ণকুহরে প্রতিক্ষণে অগ্নি বর্ষণ করছিল। তীব্র শারীরিক যাতনায় জ্বরাক্রান্ত বীরদত্ত নিজেও পরিশ্রান্ত। নাড়ি অত্যধিক মাত্রায় চঞ্চল। হস্ত ও পদযুগল হিমের ন্যায় শীতল। রাত্রির প্রথম প্রহরে আপন শয্যায় উপবিষ্ট বীরদত্ত, পর্ণার তীব্র ক্রন্দনধ্বনি সহ্য করতে না পেরে দুই চক্ষু মুদলেন। পর্ণার প্রসব যন্ত্রণা প্রারম্ভের কিছু পূর্বেই নবজাতিকার আগমনলগ্নে সশরীরে উপস্থিত থাকার অভিপ্রায়ে কাঞ্চনগড় হতে মায়াকাননে এসে উপস্থিত হয়েছেন বিনোদিনী। কুলুঙ্গি মধ্যস্থিত দীপের কম্পিত আলোকবৃত্ত ও কক্ষের আলোছায়াঘেরা পরিবেশ, বীরদত্তের মন এবং দৃষ্টিপথে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করল। স্বল্প আলোয় বীরদত্ত উপলব্ধি করল, স্বয়ং পর্ণা তার উষ্ণ ললাটে আপন শীতল ও কোমল হস্তখানি স্পর্শপূর্বক দৈহিক উষ্ণতার তীব্রতা খানিক প্রশমিত করছেন। সেই ক্ষণেই প্রসূতিগৃহ হতে তড়িৎগতিতে ধেয়ে আসা বৃন্দা ও আরও কয়েকজন পরিচারিকার সম্মিলিত নুপূরধ্বনি কর্তৃক, বীরদত্তের সুখস্বপ্নের অবসান হল। কর্ণকুহরে পুনরায় প্রবেশ করল পর্ণার কাতর আর্তনাদ! যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহেই শয্যাত্যাগ করতে তৎপর হল বীরদত্ত। প্রহরীর সকল বাধা অস্বীকারপূর্বক কক্ষ হতে নির্গত হয়ে কাতর কণ্ঠে আহ্বান করল,
-বৃন্দা?
উষ্ণ জলের পাত্রখানির দায়িত্ব পরিচারিকার উপর অর্পণ করে বৃন্দা শীঘ্র ফিরল বীরদত্তর কাছে।
-বীরদত্ত! আপনি আহত! রক্তাক্ত! তাপপ্রবাহে দেহ শিথিল। এমতাবস্থায় শয্যাত্যাগ করলেন কেন?
-আমি সম্পূর্ণ সুস্থ! দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত বৃন্দা। শিশুর ক্রন্দনধ্বনি আমার মনকে এই ক্ষণেও শীতলতা প্রদান করতে পারেনি। পর্ণার তীব্র বেদনা ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠছে! আর কতক্ষণ বৃন্দা? আপনি জানেন কোন সংবাদ? আর কত সময় পর্ণা এমন কষ্ট সহ্য করবেন?
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শ্রবণমাত্র হতবাক বৃন্দা বিস্ফারিত নেত্রে বীরদত্তের পানে বহুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বীরদত্তের গ্রীবাদেশে রক্তের শুষ্ক চিহ্ন। গভীর ক্ষতস্থানের উপরিভাগে অজস্র ভেষজ জড়িবুটি কর্তৃক রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও অত্যন্ত দুর্বল বীরদত্ত। বৃন্দা বীরদত্তের দৈহিক অবস্থা অবলোকনপূর্বক চিৎকার করে আহ্বান জানালেন,
-প্রহরী!
-বৃন্দা! প্রহরীকে আহ্বান নিষ্প্রয়োজন। আমি এই ক্ষণে প্রস্থান করব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর?
পর্ণার করুণ ক্রন্দনধ্বনি প্রসূতিগৃহ হতে অন্দরমহল পেরিয়ে ভেসে এলো। সেই আর্তনাদ বৃন্দা ও ভয়ার্ত বীরদত্তের হৃদয়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। ধীরকণ্ঠে বৃন্দা বললেন,
-আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমার নিকট নেই বীরদত্ত! তার পূর্বনির্ধারিত সময়েই সে এই পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করবে। কিঞ্চিৎ পূর্বে অথবা পশ্চাতে নয়। সেই ক্ষণ পর্যন্ত এই গর্ভযন্ত্রণার অবসান বা উপশম, কোনপ্রকারেই সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চিন্তে আপন কক্ষে বিশ্রাম গ্রহণ করুন। সুসংবাদ যথাসময়ে আপনার নিকট অবশ্যই পৌঁছে দেওয়া হবে।
বৃন্দার নিক্কনধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র, বীরদত্তের নিকট এই অস্থিরতা অত্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল। দ্রুতগতিতে প্রসূতিগৃহে প্রবেশপূর্বক কক্ষদ্বার রুদ্ধ করল বিনোদিনী। নারীকণ্ঠের এক অন্তিম আর্তনাদ অবিলম্বে বীরদত্তের নিকট পৌঁছল। গর্ভযন্ত্রণা হতে মুক্তির জন্য পাগলিনি পর্ণার উদভ্রান্ত দৃষ্টির সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন রাজমাতা নলিনীদেবী। গভীর সোহাগে স্নেহচুম্বন দ্বারা স্পর্শ করলেন আপন কন্যার ঘর্মাক্ত ললাট। অতঃপর পর্ণার সুতীব্র ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে সমগ্র অন্দরমহলে একটিমাত্র শব্দের প্রতিধ্বনি, "মা...!" এই শব্দের পরই প্রসূতিগৃহ হতে নির্গত শিশুর ক্রন্দনধ্বনিতে মুখরিত হল সমগ্র মায়াকানন। বীরদত্ত দ্রুত শয্যা ত্যাগপূর্বক পৌঁছলেন আপন কক্ষের বাইরে। প্রসূতিগৃহের দ্বার অবরুদ্ধ। ভিতরে পর্ণা জ্ঞান হারিয়েছেন। সদ্য জন্মগ্রহণ করা একটি ক্ষুদ্র প্রাণের মাতৃসুধার সন্ধান অব্যাহত। দুই চক্ষু উন্মোচন করে পৃথিবীর রূপ প্রত্যক্ষ করতে বদ্ধপরিকর পৃথ্বীশ ও পর্ণার গভীর প্রেমের সদ্য প্রস্ফুটিত মুকুল.... শয্যাপ্রান্তে দুটি চক্ষু উন্মোচনপূর্বক দেহের আলস্য পরিত্যাগ করে উঠে বসলেন ষোড়শী চিত্রাঙ্গদা। প্রথম প্রভাতের আলো শয্যাপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আপন কক্ষের জানালা হতে অমরাবতীর নীলাভ নভোমণ্ডলের পানে চিত্রাঙ্গদা দৃষ্টিপাত করলেন। কক্ষপ্রান্তে একটি রূপোর পাত্রে অজস্র সুগন্ধী পুষ্প আপন সৌরভ কর্তৃক চিত্রার প্রভাতের শুভ সূচনা করতে সচেষ্ট। পুষ্পলতার পানে ক্ষণিক দৃষ্টিদান করে জানালার উপর উপবেশন করলেন চিত্রা। সেই ক্ষণে প্রশিক্ষণের ধূলিধূসরিত ক্ষেত্রে বীরদত্তকে অস্ত্রশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখে, দ্রুতগতিতে আপন দেহ হতে সামান্য স্বর্ণালংকার ও স্বচ্ছ কঞ্চুলিকা পরিত্যাগ করে চিত্রাঙ্গদা প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে উপনীত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। চিত্রাঙ্গদা যে সময় আপন প্রাণাধিক প্রিয় অশ্ব সারঙ্গীর পৃষ্ঠে চড়ে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে পৌঁছলেন, সেই সময়ে বীরদত্ত তির ও ধনুক সহযোগে বহু যত্নে শৈলজাকে প্রশিক্ষণ প্রদানকার্যে ব্যস্ত ছিল। সকলকে যারপরনাই চমৎকৃত করে সর্বসমক্ষে উপস্থিত হলেন সদাহাস্যময়ী মহারানি সপ্তপর্ণী। অস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক বীরদত্ত নতমস্তকে পর্ণাকে প্রভাতী অভিবাদন জানাল। শৈলজা তির ধনুক ত্যাগ করে ও চিত্রাঙ্গদা অশ্ব হতে অবতরণপূর্বক দ্রুতগতিতে পর্ণার পদযুগল স্পর্শ করল। চিত্রাঙ্গদা ও শৈলজা একত্রে বললেন,
-মা তুমি! আমাদের প্রশিক্ষণক্ষেত্রে?
(ক্রমশ....)
চিত্র : সংগৃহীত
-শুভ সন্ধ্যা রানি।
-শুভ সন্ধ্যা বীরদত্ত। দূত কর্তৃক প্রাপ্ত দুঃসংবাদ অবগত আছ তুমি?
-আছি মহারানি। অমরাবতীর রাজধানীতে কোন এক অজানা রোগের প্রকোপে একাধিক প্রাণহানির সংবাদ আমার মনকে যারপরনাই ব্যস্ত করে তুলেছে। প্রজার সম্পত্তি, গবাদি পশুর প্রাণ, এই ক্ষণে সকলই একপ্রকার বিপন্ন। আমি অতিশয় ভীত। তবে গর্ভাবস্থার অন্তিমকালে এই সংবাদ আপনার নিকট প্রকাশ করতে আমি অসম্মত ছিলাম। সেই কারণেই...
-রোগের বিস্তারিত বিবরণ দাও বীর।
-রোগীর বমন ইচ্ছা দমন করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে বিষ্ঠা পরিত্যাগকালে রোগীর প্রাণান্তকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রক্তবমি ও ভেদবমির প্রাদুর্ভাব রাজধানীর একাধিক নগরে বিস্তার লাভ করেছে। রাজপ্রাসাদ হতে প্রাপ্ত তাঁবুর কাপড় দ্বারা একাধিক ছাউনি নির্মাণ করে, বৃদ্ধ রোগীদের পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। শিশু, যুবক ও স্ত্রীলোকদের সেবায় নগরের প্রায় প্রত্যেক বৈদ্য প্রাণপাত করছেন।
-চিকিৎসার প্রয়োজনে এই ক্ষণে রাজকোষ হতে অর্থ সাহায্য...
-আপনার সীলমোহর ব্যতীত অমরাবতীর রাজকোষ উন্মুক্ত করা কোনপ্রকারেই সম্ভব নয় রানি।
-সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রস্তুত করো। দূতকে আমার কক্ষে...
-না!
বীরদত্তের দরাজ কণ্ঠে কম্পিত হয় পর্ণার অন্তরাত্মা। অন্দরমহলের অপর অংশ হতে উত্তরা এসে পৌঁছয় পর্ণার নিকট। পর্ণা অত্যন্ত রূঢ়কণ্ঠে বলেন,
-আমার সম্মুখে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার? তোমার স্পর্ধা তো বড় কম নয় বীর!
-ক্ষমা করবেন। আমার দেহে প্রাণ থাকতে রাজধানীর দূতকে এই কক্ষে প্রবেশাধিকার আমি দেব না। আপনি উত্তরা হতে সে দুঃসংবাদ অবগত হয়েছেন, বিশেষ কোন বক্তব্য দূতের নিকট পৌঁছনোর প্রয়োজন হলে, সে পৌঁছে দেবে। আমিও সশরীরে বর্তমান। কিন্তু দূত এই কক্ষে প্রবেশ করবে না।
-আমার অনুমতি ব্যতীত আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তুমি হস্তক্ষেপ করবে! এতখানি স্পর্ধা...
-পর্ণা, উত্তেজনা আপনার দেহের পক্ষে কদাচ সুখদায়ক নয়। শান্ত হোন!
-স্তব্ধ হও উত্তরা! এই মূর্খের এতখানি স্পর্ধা...
-বীরদত্ত! আপনি এই কক্ষ হতে এই ক্ষণে প্রস্থান করুন।
-আমি কক্ষদ্বার আগলে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করব। তবুও এই কক্ষে দূতের প্রবেশাধিকার...
-বীরদত্ত!!
-পর্ণা!
বীরদত্তর দুই চক্ষু হতে যে তীব্র রোষানল নির্গত হল, সেই ক্ষণে পর্ণার মনে হল, ওই রোষানলে তিনি অবলীলায় ভস্মীভূত হয়ে যাবেন। পর্ণার দেহ কম্পিত, শ্বাসগ্রহণও ক্রমে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। আপন উদর আলিঙ্গন করে শয্যাপ্রান্তে উপবেশন করলেন তিনি। উত্তরা পর্ণার শিথিল দেহে স্নেহমিশ্রিত হস্তচালনা করামাত্রই, সেই মুহূর্তে পর্ণার পদতলে স্থানগ্রহণ করে বীরদত্ত বলল,
-রাজধানী হতে দূত এসেছে। নগরে মারণ রোগের প্রকোপ ক্রমবর্ধমান রানি। মড়ক লেগেছে। নগর হতে মায়াকাননের উদ্দেশে দুইজন যাত্রা করেছিল। কিন্তু পথমধ্যে ওই সংক্রামক মারণ রোগের কারণে এক দূতের মৃত্যু হয়। দূতের হতভাগ্য অশ্বটিও পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে। এমন মহামারীর রাজ্য হতে যে মানুষের আগমন, তার সম্মুখে আপনি যাবেন না। ওই দূতের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আপনার ও এই সন্তানের জন্য সমূহ বিপদ বয়ে আনতে পারে। আপনার এই রাজ্যের সকল প্রজার নিরাপত্তার জন্যই আমি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি রানি। তাকে পৃথক স্থানে রেখেছি। আমি এবং উত্তরা ওই দূত হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অমরাবতীর রাজদূতের এই মায়াকাননে কোনরূপ অসম্মান হবে না। আমি নিজ উদ্যোগ ও কর্তব্যজ্ঞানে সকল বিষয় সজাগ দৃষ্টিপাত করছি। আহার্য খাদ্য পানীয় সকলই তার কক্ষে যথাসময়ে প্রেরণপূর্বক, তাকে রাজ অতিথির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আমার জীবদ্দশায় আপনার কক্ষে সে প্রবেশাধিকার পাবে না। গর্ভাবস্থার অন্তিম ক্ষণে নিজের অমূল্য জীবনে, আপন সন্তানের জীবনে কোনরূপ অযাচিত বিপদ ডেকে আনবেন না। বিনীত অনুরোধ! আমাকে ভুল বুঝবেন না রানি! আমি আপনার সকল সিদ্ধান্তকে আপন ধর্ম জ্ঞানে নতমস্তকে মান্যতা দিয়ে থাকি। সর্বদা প্রাণপাত করি আপনার জন্য, কিন্তু আপনার ব্যক্তি-সিদ্ধান্তে যদি আপনারই সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা পরিলক্ষিত হয়, তবে তেমন সিদ্ধান্তে আমি আমরণ আপনারই বিরুদ্ধাচরণ করব মহারানি পর্ণা।
শয্যা হতেই স্থির দৃষ্টিতে পর্ণা বীরদত্তর পানে চেয়ে রইলেন। উত্তরা পর্ণাকে আলিঙ্গনপূর্বক মৃদুভাষে বলল,
-রাজসেনাপতির আশঙ্কা নেহাৎ অমূলক নয় রানি। তিনি আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং উদ্বিগ্ন। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও আপন স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিচার করে আপনি অচিরেই সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রদানপূর্বক দূতকে অমরাবতী রাজ্যে ফিরিয়ে দিন। এই স্থানে দূতের দীর্ঘক্ষণ যাপন, মায়াকাননের পক্ষে যথেষ্ট বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
শয্যা হতে পর্ণা বীরদত্তের পানে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিবিনিময় করে বলল,
-ওঠো বীর! সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রস্তুত করে পুনরায় আমার কক্ষে ফিরে এসো।
-যথা আজ্ঞা রানি!
পর্ণাকে অভিবাদনপূর্বক কক্ষ হতে প্রস্থানকালে পুনরায় পর্ণার কাতর আহ্বানে বীরদত্ত ফিরল,
-তুমি আপন রাজ্যে ফিরবে না বীর? রাজ্যের এমন সংকটকালে...
-রাজ্যে শত্রু আক্রমণকালে রাজসেনাপতির কিছু অবশ্য কর্তব্য থাকে। কিন্তু এ যুদ্ধে যে মৃত্যু মিছিলের পরিসংখ্যান প্রতিনিয়িত ঘোষিত হচ্ছে, বৈদ্য ব্যতীত আমি এবং অমরাবতীর অস্ত্রাগার সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে অক্ষম রানি। আমি আশাবাদী, অভিজ্ঞ রাজবৈদ্যের নির্দেশে অবিলম্বে এই যুদ্ধজয় সম্ভব। আগামী এক পক্ষকালের পূর্বেই আপনি সন্তান জন্ম দেবেন। আপনি এবং অমরাবতীর ভবিষ্যৎ রানি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত, এই সংবাদ পরিপূর্ণরূপে অবগত হওয়ার অব্যবহিত পরই আমি এই রাজ্য হতে বিদায় গ্রহণ করব। অতঃপর আপনার ইচ্ছানুসারে নির্দিষ্ট সময়ে মহাসমারোহে আপনাকে এবং অমরাবতীর উত্তরাধিকারণীকে রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাব ওই মায়াকাননের পথ ধরে... আপনি বিশ্রাম গ্রহণ করুন রানি। আমি অমরাবতীর সীলমোহর ও অনুমতিপত্র সহ এই কক্ষে ফিরে আসছি।
ক্লান্ত পর্ণা আপনার কক্ষ হতে বিহ্বল দৃষ্টিপাত করলেন মায়াকাননের পানে। সেই নিকষ কালরাত্রির অন্তিম প্রহরে উত্তরা ও ফাল্গুনী কর্তৃক পর্ণা সংবাদ পেলেন, অমরাবতীর ওই রাজদূত কিছু পূর্বেই বারকয়েক ভেদবমি হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পূর্বেই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বনপূর্বক ওই দূতের পার্থিব দেহ ও তার ব্যবহার্য সকল পোশাক এবং বিষ্ঠায় আবৃত উত্তরীয়টি স্বহস্তে আগুনে ভস্মীভূত করল বীরদত্ত। নিজ পরনের অন্তিম পোশাকটিও ওই ক্ষুদ্র
অগ্নিকুণ্ডে প্রদানপূর্বক নষ্ট করে মায়াকানন রাজ্যকে জীবাণু হতে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে বীরদত্ত সচেষ্ট হল। প্রথম প্রভাতে পর্ণার কক্ষ হতে অদূরে অবস্থিত জলাশয়টিতে আকণ্ঠ ডুবে যখন বীর নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখার সর্বোত প্রচেষ্টায় স্নানাদি কার্যে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তে আপন কক্ষ হতে বীরদত্তের পানে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন সদ্য নিদ্রাভঙ্গপূর্বক শয্যাত্যাগী পর্ণা। আপন উদরে পরম স্নেহে হস্তচালনাপূর্বক মনে মনে বারংবার বীরকে ধন্যবাদ জানানোর আকুল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আবেগে ও কৃতজ্ঞতায় সপ্তপর্ণী প্রথমবার ভাষাহীন হলেন। আপন গন্ডদেশে হস্তচালনাকালে বীরদত্তের সিক্ত পৃষ্ঠদেশের পানে দৃষ্টিপাত করে চমৎকৃত হলেন পর্ণা। বীরের পৃষ্ঠদেশে একাধিক ক্ষুদ্র বৃহৎ গভীর ক্ষতচিহ্ন। এই সকল চিহ্নই কি অমরাবতী রাজ্যের প্রতি তার গভীর বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরিচয় বহন করছে! ক্ষার, সর্জিকা চূর্ণ ও ধূসর মৃত্তিকাতে আবৃত বীরের সুঠাম দেহের ঊর্ধ্বভাগের কিয়দংশ। নিম্নভাগ জলাশয়ের গভীরে বিলীন হয়েছে। অবিন্যস্ত সুদীর্ঘ সিক্ত কেশগুচ্ছ গ্রীবা হতে প্রসারিত হয়ে পৃষ্ঠদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পর্ণা মুগ্ধ দৃষ্টিতে বীরের পানে চেয়ে রইলেন। সেই ক্ষণেই সবুজাভ জলাশয়ের গভীরে একাধিকবার বিলীন হয়ে, ক্ষুদ্র তরঙ্গের অভ্যন্তরভাগ হতে বীর আপন উত্তরীয় ব্যতীত উঠে আসতে সচেষ্ট হল। সেই দৃশ্য অবলোকনমাত্রই মুহূর্তে আপন কক্ষের উন্মুক্ত স্থান হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলেন পর্ণা। তবে অন্তিম ক্ষণে এক লজ্জাহীন ময়ূর আপন নয়নাভিরাম পুচ্ছ প্রসারিতপূর্বক কর্কশধ্বনির মাধ্যমে নবপ্রভাতের সূচনাকাল ঘোষণা করল। সচকিত বীরদত্ত ওই অবোধ জীবের প্রতি সদয় দৃষ্টিপাত করার মুহূর্তে আপন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এই বিষয় সহজেই অবগত হল, সেই ক্ষণে ওই স্থানে স্বচ্ছ উত্তরীয়র অন্তরাল হতে কোন মানুষ এইদিক পানেই সজাগ দৃষ্টি প্রদান করছিল। বীরদত্তর দৃষ্টি সম্মুখে রাজপ্রাসাদের ওই সুদৃশ্য কক্ষ মহারানি পর্ণার। এ বাক্য স্মরণে আসামাত্রই দৃষ্টি অবনত হল কুণ্ঠিত বীরদত্তর। জলাশয়ের প্রান্ত হতে প্রস্তরনির্মিত নিম্নগামী প্রতিটি সোপান অতিক্রম করে ধীর পদক্ষেপে বীরদত্ত জলের গভীরতায় পুনরায় বিলীন হল। প্রহরী কর্তৃক প্রেরিত উত্তরীয় দ্বারা আপন দেহের নিম্নভাগ আচ্ছাদিত করল বীরদত্ত। অতঃপর সেই স্থান পরিত্যাগ করে আপন কক্ষে প্রস্থান করল। মারণ রোগ ও জীবাণুর কারণে ভীত বীরদত্ত কিছুকাল স্বেচ্ছায় নিভৃতাবাসে থাকা মনস্থির করল। আপন কক্ষমাঝে পৌঁছে রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে যে ক্ষণে উত্তরীয় পরিত্যাগ করে সুদীর্ঘ দর্পণে বীরদত্ত আপন সুঠাম প্রতিবিম্ব পানে দৃষ্টিপাত করল, মহারানি পর্ণা সেই ক্ষণে অগ্রসর হয়েছেন স্নানঘরের উদ্দেশে।
কিছুকাল পর অমরাবতী রাজ্যে রোগের প্রকোপ খানিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও পর্ণার প্রসববেদনা সহ্যশক্তির সকল সীমারেখা অতিক্রম করল। প্রসূতিগৃহ হতে পর্ণার গগনবিদারী চিৎকার ও ক্রন্দনধ্বনি বীরদত্তের কর্ণকুহরে প্রতিক্ষণে অগ্নি বর্ষণ করছিল। তীব্র শারীরিক যাতনায় জ্বরাক্রান্ত বীরদত্ত নিজেও পরিশ্রান্ত। নাড়ি অত্যধিক মাত্রায় চঞ্চল। হস্ত ও পদযুগল হিমের ন্যায় শীতল। রাত্রির প্রথম প্রহরে আপন শয্যায় উপবিষ্ট বীরদত্ত, পর্ণার তীব্র ক্রন্দনধ্বনি সহ্য করতে না পেরে দুই চক্ষু মুদলেন। পর্ণার প্রসব যন্ত্রণা প্রারম্ভের কিছু পূর্বেই নবজাতিকার আগমনলগ্নে সশরীরে উপস্থিত থাকার অভিপ্রায়ে কাঞ্চনগড় হতে মায়াকাননে এসে উপস্থিত হয়েছেন বিনোদিনী। কুলুঙ্গি মধ্যস্থিত দীপের কম্পিত আলোকবৃত্ত ও কক্ষের আলোছায়াঘেরা পরিবেশ, বীরদত্তের মন এবং দৃষ্টিপথে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করল। স্বল্প আলোয় বীরদত্ত উপলব্ধি করল, স্বয়ং পর্ণা তার উষ্ণ ললাটে আপন শীতল ও কোমল হস্তখানি স্পর্শপূর্বক দৈহিক উষ্ণতার তীব্রতা খানিক প্রশমিত করছেন। সেই ক্ষণেই প্রসূতিগৃহ হতে তড়িৎগতিতে ধেয়ে আসা বৃন্দা ও আরও কয়েকজন পরিচারিকার সম্মিলিত নুপূরধ্বনি কর্তৃক, বীরদত্তের সুখস্বপ্নের অবসান হল। কর্ণকুহরে পুনরায় প্রবেশ করল পর্ণার কাতর আর্তনাদ! যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহেই শয্যাত্যাগ করতে তৎপর হল বীরদত্ত। প্রহরীর সকল বাধা অস্বীকারপূর্বক কক্ষ হতে নির্গত হয়ে কাতর কণ্ঠে আহ্বান করল,
-বৃন্দা?
উষ্ণ জলের পাত্রখানির দায়িত্ব পরিচারিকার উপর অর্পণ করে বৃন্দা শীঘ্র ফিরল বীরদত্তর কাছে।
-বীরদত্ত! আপনি আহত! রক্তাক্ত! তাপপ্রবাহে দেহ শিথিল। এমতাবস্থায় শয্যাত্যাগ করলেন কেন?
-আমি সম্পূর্ণ সুস্থ! দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত বৃন্দা। শিশুর ক্রন্দনধ্বনি আমার মনকে এই ক্ষণেও শীতলতা প্রদান করতে পারেনি। পর্ণার তীব্র বেদনা ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠছে! আর কতক্ষণ বৃন্দা? আপনি জানেন কোন সংবাদ? আর কত সময় পর্ণা এমন কষ্ট সহ্য করবেন?
এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শ্রবণমাত্র হতবাক বৃন্দা বিস্ফারিত নেত্রে বীরদত্তের পানে বহুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বীরদত্তের গ্রীবাদেশে রক্তের শুষ্ক চিহ্ন। গভীর ক্ষতস্থানের উপরিভাগে অজস্র ভেষজ জড়িবুটি কর্তৃক রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও অত্যন্ত দুর্বল বীরদত্ত। বৃন্দা বীরদত্তের দৈহিক অবস্থা অবলোকনপূর্বক চিৎকার করে আহ্বান জানালেন,
-প্রহরী!
-বৃন্দা! প্রহরীকে আহ্বান নিষ্প্রয়োজন। আমি এই ক্ষণে প্রস্থান করব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর?
পর্ণার করুণ ক্রন্দনধ্বনি প্রসূতিগৃহ হতে অন্দরমহল পেরিয়ে ভেসে এলো। সেই আর্তনাদ বৃন্দা ও ভয়ার্ত বীরদত্তের হৃদয়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। ধীরকণ্ঠে বৃন্দা বললেন,
-আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমার নিকট নেই বীরদত্ত! তার পূর্বনির্ধারিত সময়েই সে এই পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করবে। কিঞ্চিৎ পূর্বে অথবা পশ্চাতে নয়। সেই ক্ষণ পর্যন্ত এই গর্ভযন্ত্রণার অবসান বা উপশম, কোনপ্রকারেই সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চিন্তে আপন কক্ষে বিশ্রাম গ্রহণ করুন। সুসংবাদ যথাসময়ে আপনার নিকট অবশ্যই পৌঁছে দেওয়া হবে।
বৃন্দার নিক্কনধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র, বীরদত্তের নিকট এই অস্থিরতা অত্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল। দ্রুতগতিতে প্রসূতিগৃহে প্রবেশপূর্বক কক্ষদ্বার রুদ্ধ করল বিনোদিনী। নারীকণ্ঠের এক অন্তিম আর্তনাদ অবিলম্বে বীরদত্তের নিকট পৌঁছল। গর্ভযন্ত্রণা হতে মুক্তির জন্য পাগলিনি পর্ণার উদভ্রান্ত দৃষ্টির সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন রাজমাতা নলিনীদেবী। গভীর সোহাগে স্নেহচুম্বন দ্বারা স্পর্শ করলেন আপন কন্যার ঘর্মাক্ত ললাট। অতঃপর পর্ণার সুতীব্র ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে সমগ্র অন্দরমহলে একটিমাত্র শব্দের প্রতিধ্বনি, "মা...!" এই শব্দের পরই প্রসূতিগৃহ হতে নির্গত শিশুর ক্রন্দনধ্বনিতে মুখরিত হল সমগ্র মায়াকানন। বীরদত্ত দ্রুত শয্যা ত্যাগপূর্বক পৌঁছলেন আপন কক্ষের বাইরে। প্রসূতিগৃহের দ্বার অবরুদ্ধ। ভিতরে পর্ণা জ্ঞান হারিয়েছেন। সদ্য জন্মগ্রহণ করা একটি ক্ষুদ্র প্রাণের মাতৃসুধার সন্ধান অব্যাহত। দুই চক্ষু উন্মোচন করে পৃথিবীর রূপ প্রত্যক্ষ করতে বদ্ধপরিকর পৃথ্বীশ ও পর্ণার গভীর প্রেমের সদ্য প্রস্ফুটিত মুকুল.... শয্যাপ্রান্তে দুটি চক্ষু উন্মোচনপূর্বক দেহের আলস্য পরিত্যাগ করে উঠে বসলেন ষোড়শী চিত্রাঙ্গদা। প্রথম প্রভাতের আলো শয্যাপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আপন কক্ষের জানালা হতে অমরাবতীর নীলাভ নভোমণ্ডলের পানে চিত্রাঙ্গদা দৃষ্টিপাত করলেন। কক্ষপ্রান্তে একটি রূপোর পাত্রে অজস্র সুগন্ধী পুষ্প আপন সৌরভ কর্তৃক চিত্রার প্রভাতের শুভ সূচনা করতে সচেষ্ট। পুষ্পলতার পানে ক্ষণিক দৃষ্টিদান করে জানালার উপর উপবেশন করলেন চিত্রা। সেই ক্ষণে প্রশিক্ষণের ধূলিধূসরিত ক্ষেত্রে বীরদত্তকে অস্ত্রশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখে, দ্রুতগতিতে আপন দেহ হতে সামান্য স্বর্ণালংকার ও স্বচ্ছ কঞ্চুলিকা পরিত্যাগ করে চিত্রাঙ্গদা প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে উপনীত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। চিত্রাঙ্গদা যে সময় আপন প্রাণাধিক প্রিয় অশ্ব সারঙ্গীর পৃষ্ঠে চড়ে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে পৌঁছলেন, সেই সময়ে বীরদত্ত তির ও ধনুক সহযোগে বহু যত্নে শৈলজাকে প্রশিক্ষণ প্রদানকার্যে ব্যস্ত ছিল। সকলকে যারপরনাই চমৎকৃত করে সর্বসমক্ষে উপস্থিত হলেন সদাহাস্যময়ী মহারানি সপ্তপর্ণী। অস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক বীরদত্ত নতমস্তকে পর্ণাকে প্রভাতী অভিবাদন জানাল। শৈলজা তির ধনুক ত্যাগ করে ও চিত্রাঙ্গদা অশ্ব হতে অবতরণপূর্বক দ্রুতগতিতে পর্ণার পদযুগল স্পর্শ করল। চিত্রাঙ্গদা ও শৈলজা একত্রে বললেন,
-মা তুমি! আমাদের প্রশিক্ষণক্ষেত্রে?
(ক্রমশ....)
চিত্র : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন