অনুসরণকারী

শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩

স্বপ্ন হলেও সত্যি (প্রথম পর্ব)


 

স্বপ্ন হলেও সত্যি

সাথী দাস

প্রথম পর্ব



নিজেকে আয়নায় একবার দেখে নিল জাহ্নবী। নিয়ম মেনে প্রথাগতভাবে বিয়ে করার ইচ্ছে ওর কোনোদিনই ছিল না। ও নিজেও জানে, বাঙালি ঘরের বিয়ের কনে হিসেবে এই সাধারণ সাজ যথেষ্ট নয়। সোনালী রঙয়ের ইঞ্চি পাড় বসানো হাজার বুটির লাল সিল্কের শাড়ি, নীল ব্লাউজ, মাথায় বাহারি অর্কিড আর সামান্য প্রসাধনীর মাধ্যমে বিয়ের সাজে ইতি টেনেছে সে। মায়ের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে পরতে বাধ্য হয়েছে কয়েকটা স্বল্প ওজনের স্বর্ণালংকার, যা বড়ই অনুজ্জ্বল। কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টিপথে প্রায় ধরা দেয় না বললেই চলে। এমন নয় যে ও সোনার গহনা পছন্দ করে না। কিন্তু বিয়ের সময় সকলের আলোচনা ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে স্বর্ণশৃঙ্খলাবদ্ধ বন্দিনি হিসেবে নিজেকে মনোরঞ্জনের সামগ্রীরূপে জনসমক্ষে পরিবেশন করার মতো নিন্দনীয় বিষয়ে ওর ভীষণ রকম আপত্তি বরাবরই ছিল, নিজের বিয়েও তার ব্যতিক্রম নয়। গহনা, শাড়ি, অর্থ, প্রাচুর্য, কিংবা যেগুলো একান্তই নিজের ভালোলাগার বস্তু, সেগুলো একটা বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে সকলের সম্মুখে ভাগ করে নেওয়া কেন? এ কী কেবল দৃষ্টিসুখ? নাকি এর আড়ালে রয়েছে সমাজে আপনার স্থান, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও নিজস্ব বৈভব প্রদর্শনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত! এ প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজতে যাওয়ার মতো সময় জাহ্নবীর হাতে নেই। আজ ওর বিয়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে মোহিত হয়ে গেল ও। নিজের চোখে এই স্বল্প সাজেও অপরূপা লাগছে ওকে। মৃদু হাসল সলজ্জ জাহ্নবী। নববধূর দিক থেকে চয়ন কি আজ চোখ ফেরাতে পারবে!

জাহ্নবীর বাবার নাম পরমানন্দ। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ছিলেন, বছর তিনেক আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন। জাহ্নবীর মা অর্থাৎ ভারতী টেলিফোন বিভাগে চাকরি করেন। আগামী বছর অবসর গ্রহণ করবেন। বরাবরই আর্থিক স্বচ্ছলতায় প্রতিপালিত হয়েছে জাহ্নবী। পড়াশোনায় মনোযোগী। ওর মেধার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর সকলেই ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী ছিল। স্বভাবে ভীষণ রকম শান্ত ও স্বল্পবাক জাহ্নবীর মনের তল না পেয়ে একবার পরমানন্দ ও ভারতী ওকে শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাতে একটা চকোলেট নিয়ে ডাক্তার আন্টির কাছ থেকে গল্প শুনছিল জাহ্নবী। বাইরে বাবা-মা অত্যন্ত শঙ্কিত এবং চিন্তিত। ডাক্তার আন্টির মুখে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প শুনতে শুনতে টেবিলের ওপরে রাখা গ্লোবটা একমনে দেখছিল জাহ্নবী। ওটা বারকয়েক ঘুরিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিল, "ঐ কথা বলা পাখি কোথায় পাওয়া যায়? এই নীলে.... মানে সমুদ্রে? না এই সবুজ জঙ্গলে? আমি দেখতে যাব! তুমি আমাকে নিয়ে যাবে আন্টি? আমাকে না দেখালে আমি কী করে বুঝব, তুমি সত্যি বলছ কিনা! মা বলেছে, মিথ্যে কথা বলতে নেই। তুমি আমায় মিথ্যে গল্প বলছ না তো? রাজপুত্র রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলে, এমন পাখির বাড়ি কোথায়? আর রাক্ষসের দেশ? আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে? আমি বেড়াতে যাব।"

সেদিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে স্তব্ধ হয়েছিলেন জাহ্নবীর বাবা-মা। ওঁরা বুঝেছিলেন, জাহ্নবী কোনোভাবেই অসুস্থ নয়। কিন্তু ওর শিশুমনে বুঝি কল্পনার কোনও স্থান নেই। যে বয়সে তার কল্পনাবিলাসী মনের বিকাশ ঘটানোর জন্য রসদের প্রয়োজন, সেই বয়স থেকে সে ভয়ানক রকম বাস্তববাদী। রূপকথার চরিত্রদের স্বচক্ষে দর্শনের মাধ্যমে চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে ইচ্ছুক। পরবর্তীকালে বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার পর বোঝা যায়; জাহ্নবী কেবল বাস্তববাদী নয়, অবিশ্বাস্য রকম হিসেবীও বটে! এমন মেয়ের জন্য পরমানন্দ কোনোকালেই চিন্তিত ছিলেন না। পরমানন্দ একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, বাস্তবের কাঠিন্য তাঁর কন্যাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ তার অন্তর লৌহশৃঙ্খলের ভিতরে আবদ্ধ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া শেষ করে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা জাহ্নবী যখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন তার জন্মদাতা। কন্যার বিবেচনার ওপর অতিরিক্ত ভরসার কারণে সুযোগ্য পাত্র নির্বাচনের গুরুভার কন্যার ওপর অর্পণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভারতী কন্যার বিবাহের প্রসঙ্গ একাধিকবার উত্থাপন করেন এবং পরিচিত সূত্রে কয়েকজন পাত্রকে জাহ্নবীর জন্য মনোনীত করেন। জাহ্নবী মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না। নিতান্তই বধির মানুষের মতো উদাসীনতার প্রাচীরের অন্তরালে নির্বিবাদে আত্মগোপন করে থাকে।

পরমানন্দের মৃত্যুর এক বছর পর ভারতীর নিরন্তর অনুরোধে বিরক্ত হয়ে একটি ম্যাট্রিমনি সাইটে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় জাহ্নবী। সেখান থেকে চয়নের সঙ্গে জাহ্নবীর আলাপ হয়। দীর্ঘ চার বছরব্যাপী ম্যাট্রিমনি সাইটে থেকেও চৌত্রিশ বছর বয়সী অবিবাহিত চয়নের প্রতি জাহ্নবী ঈষৎ কৌতূহলী হয়েছিল। মধ্য একত্রিশের জাহ্নবী ততদিনে পৃথিবীর সকল ভালো-মন্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। নিজের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ এবং অনড় সে। চয়নের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের দিকে এগোতে থাকে। পূর্বে তিনবার হৃদয়ভঙ্গের যন্ত্রণা, যা জাহ্নবী নিজের মায়ের কাছেও গোপন করেছে, নিজের মনের ভিতরে পুষে রাখা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো ও অবলীলায় চয়নকে জানায়। নিজের স্বপ্নের কথাও গোপন করে না। জাহ্নবী আশা করেছিল, সেদিনই এই আলাপ শেষ হবে। কফি শপে বসে নিজের স্বপ্নপূরণের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখার সুখবরটাও চয়নের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল ও। সেই সঙ্গে বলেছিল,

-জেদি, বাস্তববাদী আর নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য লড়ে যাওয়া মেয়েদের দেখতে বেশ লাগে চয়ন। বন্ধুর মতো পাশে থেকে তাদের সাফল্য উপভোগ করা যায়। হাতে হাত রেখে অভিনন্দন জানানো যায়। কিন্তু নিজের সংসারে তাদের ঠাঁই দেওয়া যায় না। তখন একজন কমনীয় নারীকে প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে মাতৃসুলভ ব্যাপার আছে। মায়া-মমতা আছে। যে সংসারে এফর্ট দেওয়ার সময় কোনও হিসেব রাখবে না, তেমন বেহিসেবী মেয়েই সবাই চায়। যে নারী নিজের ক্ষমতায় সংসারে পুরুষের জায়গা দখল করে নেয় বা সমকক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তাকে কি কোনও পুরুষ ভালোবাসতে পারে? হয়তো ভালোবাসতে পারে, কিন্তু ঘরে তুলতে পারে না। ঘরে তোলার জন্য সবাই চায় পারফেক্ট ওয়াইফ মেটিরিয়াল!
-তাই কি?
-হ্যাঁ। আমার লাস্ট তিনটে সম্পর্ক আমাকে বারবার তাই শিখিয়েছে। হয়তো তোমাদের মেল ইগো হার্ট হয়! কী জানি! দেখো চয়ন আমরা দু'জনেই জানি আমরা কেন দেখা করছি, কথা বলছি! আমি মায়ের জন্য এই ম্যাট্রিমনি সাইটে এসেছিলাম। তবে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ, দেখা করা, এসব মা জানে না। সবটা নিজের মনের তাগিদে হয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছি না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। কলেজের প্রথম প্রেমের মতো অনুভূতি, সেই পাগলামিগুলো আমার মধ্যে আবার যেন ফিরে আসছে। এটা বোধহয় এখানে থামানো উচিত।

লজ্জাহীনা জাহ্নবীর এমন অকপট স্বীকারোক্তিতে চয়নের মনের সমুদ্রে যে ঢেউ উঠেছিল, তার আভাস ওর মুখের রেখায় বিন্দুমাত্র পড়ল না। নিজের সমস্ত আবেগ গোপন করে ও বলেছিল,

-কেন? যা ভালো লাগছে, তা হতে দেওয়া উচিত। জোর করে থামাতে চাইছ কেন?
-তুমি জানলে আমার জীবনের চাহিদাগুলো। এইমাত্র বললাম তোমাকে। তারপর কি আর এগোনো উচিত?
-আমি কেন এত বছর ধরে বিয়ে করিনি জানো? নিজের মনের মতো মেয়ে পাচ্ছিলাম না। আমি সরকারী চাকুরে, নিশ্চিন্ত জীবন। বেতন ভালো। কর্মসূত্রে রুরাল এরিয়ায় আমাকে একা থাকতে হয়। পাত্র হিসেবে আমার বাজারদর যে তুঙ্গে, সেটা কন্যাদায়গ্রস্ত বাবারা আমার মাকে বারবার জানান দিয়েছে। মায়ের জোরাজুরিতে গিয়েছিলাম কয়েকটা মেয়ে দেখতে। মেয়ের সঙ্গে একান্তে কথা বলার মানসিকতা হয়নি। প্রথম দর্শনে এসে গেছে মারাত্মক অভক্তি!
-কেন?
-মেয়ের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন যেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। জীবন-মরণ পণ করে হলেও এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। আমাদের দিক থেকে তারা না শুনতে নারাজ। নিঃসন্দেহে তারা ভদ্রলোক। কিন্তু এত আদর, এত দেখনদারি প্রথম আলাপে আমি নিতে পারি না জাহ্নবী। আমার তীব্র অস্বস্তি হয়। আর মেয়ে? সে নিজে একতাল প্রাণহীন মাংসপিণ্ডের মতো আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলে যাচ্ছে। নিজের কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। আমার কাছে তার কোনও দাবি পর্যন্ত নেই। জাহ্নবী ঐ মেয়েগুলো আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। তাদের ভালোবাসা এই মানুষটার প্রতি নয়। তারা সিকিউরিটি চায়। একজনকে আমি বিয়ের পর চাকরি করতে বারণ করেছিলাম। আমার সঙ্গে থাকতে বলেছিলাম। এককথায় সব ছেড়েছুড়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়। সেদিন আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সে আমাকে চেনে না। তার কাছে আমি সম্পূর্ণ অচেনা একটা লোক। আমাকে ভালোবাসার প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর অজানা জায়গা। প্রথম দিন দেখা হয়েছে। সেইদিনই সে আমার কথায় নিজের অস্তিত্ব, নিজের সমস্ত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেল। ওখানে তার কাজের কোনও সম্ভবনা আছে কিনা সেটা একবারও জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করল না। সে কি আমাকে ভালোবেসে আমার সঙ্গে থাকতে চাইছে? না! তার ভালোবাসা আমার প্রতি নয়, আমার চাকরির প্রতি। একটা নিশ্চিন্ত জীবনের প্রতি।
-নিশ্চিন্ত জীবন চাওয়াটা কি ভুল চয়ন?
-অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে নিশ্চিন্ত জীবন চাওয়াটা ভুল। নিজের ক্ষমতায় নিশ্চিন্ত জীবন গড়ে নেওয়াটা সম্মানের। তোমার অভিধানে যেটা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠা বা সংসারে পুরুষের জায়গা নিয়ে নেওয়া, আমি তাকে বলি ওয়ান ম্যান আর্মি। আমার সেটাই চাই। না পেলে সারাজীবন একা কাটিয়ে দেব। কিন্তু আমার চাহিদা অনুযায়ী মেয়েই আমার চাই। এটা সারাজীবনের ব্যাপার। আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউ আমাদের হয়ে সংসারটা করে দেবে না। ওটা আমাদেরই করতে হবে। এই একটা সিদ্ধান্ত খুব বুঝেশুনে নেওয়া দরকার। আমি ভুল মানুষকে বিয়ে করে বিয়েটা ভাঙতে চাই না। তার চেয়ে জীবনভর সঠিক মানুষের অপেক্ষা করতে রাজি আছি। যে মেয়ে আমার ওপর সম্পূর্ণ ডিপেন্ড করবে, আমাকে ছাড়া কিছু বুঝবে না, এমন পরজীবীকে নিয়ে সারাজীবন বোঝার মতো আমি বয়ে বেড়াতে পারব না। আমিও বাড়ির একমাত্র ছেলে। মা মাথা খারাপ করে দেয় বিয়ে করার জন্য, কিন্তু আমি এতদিন এমন কাউকে পাইনি যার কাছে নিজের স্বপ্ন এতটা গুরুত্বপূর্ণ। যার মধ্যে এই স্পার্কটা আছে! যে নিজেই একটা গোটা নভেল! আমি তোমাকে সারা জীবন ধরে পড়তে চাই জাহ্নবী। উইল ইউ ম্যারি মি ইজ সো বোরিং! তোমার স্বপ্ন, মানে নিজের নামে যে ফ্ল্যাটটা তুমি নিয়েছ, তার মান্থলি ইএমআইতে আমাকে পার্টিসিপেট করার পারমিশন দেবে জানু?

চয়ন স্পষ্ট দেখেছিল জাহ্নবীর হাতের কোল্ড কফির পাত্রটা কেঁপে উঠেছিল। বেশ কিছুক্ষণ ও চয়নের দিকে চাইতে পারেনি। "জানু" নামের অনুরণন ছড়িয়ে পড়েছিল ওর সর্বাঙ্গে। জড়তা কাটিয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে জাহ্নবী বলেছিল,

-তুমি এমন মেয়ে চাও না, যে তোমার ওপর ডিপেন্ড করবে! বুঝলাম। দেখো চয়ন, আমি আর্থিকভাবে তোমার কোনও সাহায্য চাই না। নিজের এবং মায়ের দায়িত্ব আমি খুব ভালোভাবে নিতে পারব। কিন্তু ইমোশনাল সাপোর্টটা না পেলে আমার খুব সমস্যা হয়ে যাবে। একদম চলবে না। ওটার জন্যই আমি একজন পার্টনার খুঁজছি। যেটা আমার পাস্ট রিলেশনশিপগুলোয় একটা সময় পর আর পাইনি। ওটার জন্য আমি পার্টনারের ওপর অন্ধভাবে ভরসা করব। আমি সবার সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। নিজের ইমোশন জাহির করতেও পারি না। কথা বলতে না পেরে চুপ করে যাই। এখন এমন একজন মানুষ আমার চাই, যাকে আমি সারাদিনের হিসেব দিতে পারব। ঘুমোতে যাওয়ার আগে বকবক করতে পারব। যার সঙ্গে কথা বলে একটু মানসিক শান্তি পাব।
-তুমি একত্রিশ, আমি চৌত্রিশ। আশা করি জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর আমরা নিজেদের সামলাতে শিখে গেছি। সময়ই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে। আমাদের মধ্যে বাড়তি বা অকেজো আবেগের কোনও জায়গা নেই। আমারও দুটো সম্পর্ক ছিল। বেশ কিছুটা রাস্তা একসঙ্গে পেরিয়ে আসার পর দেখেছি, দু'জনের মানসিকতা মিলছে না। তার চাহিদার সঙ্গে আমার চাহিদার বিস্তর ফারাক। আমরা দু'জনেই সুস্থভাবে নিজেদের মুক্ত করে সরে এসেছি। কোনও কিছুকে অহেতুক এত টানবে না জানু। যেটা যেখানে শেষ হতে চাইছে, সেটাকে সেখানেই ছেড়ে দাও। ভুল দু'পক্ষেরই থাকে। আমাদের কাজ হল ঐ ভুল থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো মাথায় রেখে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে ঐ ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা। এই পৃথিবীতে এটা না পেলে বা ওটা না পেলে আমার চলবে না, এমনটা হয় না। জীবনে ভালোবাসা থাকা ভালো, কিন্তু তার জন্য মরে যাওয়াটা ঠিক নয়। প্রাক্তনকে জীবনভর বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাতে অতীত আর বর্তমানের ব্যালেন্স নষ্ট হয়। এই ব্যালেন্সটা ভীষণভাবে দরকার। অতীত থেকে বেরোতে পেরেছ বলেই তুমি আবার নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবতে পারছ। ঠিক তো?
-হ্যাঁ।
-আমি তোমাকে যতদূর বুঝেছি, তুমি হিসেবী মানুষ। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। দুটো মানুষকে ঘিরে যখন স্বাভাবিকভাবে একটা ভালোবাসার বৃত্ত তৈরি হয়, তাকে আমরা সংসার বলি। ভালোবাসার জন্যই আমরা সংসার করি। সংসার করার জন্য ভালোবাসতে বাধ্য হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। তাই ব্যালেন্স করে সংসার করার জন্য ভালোবাসাটাও ব্যালেন্সড হওয়া দরকার। অতিরিক্ত কিছু ভালো না। অন্তত এই বয়সে পৌঁছে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না, আমার এক মুহূর্ত তুমি ছাড়া চলবে না....এগুলো আমার কাছে বড্ড বোকা-বোকা লাগে।
-আমি একরোখা। বেশি কথা বলতে পারি না। মানুষের সঙ্গে মিশতে পারি না। কারও মন রাখার জন্য নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে পারি না। খুব কম মানুষকে নিয়ে আমার জীবন। আমি অসামাজিক। পারফেক্ট নই।
-সেতো আমিও নই, আমাদের সম্পর্কও পারফেক্ট হবে না।
-হবে না?
-না। বিয়ের পরেও আমাদের সম্পর্কটা পারফেক্ট হবে না। একই মায়ের গর্ভে জন্মানো দুই ভাই-বোনের মতের মিল হয় না। সেখানে আমরা আলাদা পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা সম্পূর্ণ আলাদা দুটো মানুষ হয়ে কীভাবে পারফেক্ট হওয়ার দাবি করব? আমি পারফেক্ট স্বামী হতে পারব না, তুমিও পারফেক্ট স্ত্রী হতে পারবে না। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, দিনের শেষে এমন কিছু ভুল করে বসব, যার ফলে পারফেক্ট তকমাটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই পারফেক্ট হওয়ার নয়, সুখী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পারফেক্ট রিলেশন, পারফেক্ট কাপল, বাস্তবে এগুলোর কোনও অস্তিত্ব নেই। যেটার অস্তিত্ব আছে, সেটা হল বিশ্বাস। একজন মানুষ, যার সামনে জাজড হওয়ার ভয় থাকে না, নিজেকে প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা থাকে না, যাকে বিশ্বাস করে তার সামনে আমরা আমাদের ইমপারফেকশনগুলো তুলে ধরতে পারি, ম্যাচুওর হয়ে যাওয়ার পর তেমন একটা মানুষই আমরা জীবনে পেতে চাই। ভালোবাসায় থাকার চেয়েও ভালো থাকাটা জীবনে বেশি প্রয়োজন জানু। একটু ভালো থাকব বলেই তো আমরা বিয়ের কথা ভাবছি নাকি?
-হুম!
-আমরা দু'জন দু'জনের খামতিগুলো জানব। সেগুলো কিছুটা শুধরে, কিছুটা মানিয়ে নিয়ে, কিছুটা খামতিগুলোকে ভালোবাসার চেষ্টা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। এটাই একটা সফল বিয়ের সিক্রেট! যারা সেটা পারে, তাদের বাইরে থেকে দেখে পারফেক্ট কাপল মনে হয়। আর কিচ্ছু না! বিয়েটা কোনও ফেয়ারি টেল নয় যে শেষে এসে সবকিছু পারফেক্ট হয়ে যাবে। বাস্তবে তারা কতটা ইমপারফেক্ট, সেটা কেবল তারাই জানবে। বাইরের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানবে না। সেই বোঝাপড়াটা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। আমার মনে হয় তুমিই সেই মানুষ, যার কাছে আমি আমার সমস্ত বদ অভ্যাস, সমস্ত খামতিগুলো বলতে পারব। নিজের ভুলগুলো স্বীকার করে হালকা হতে পারব। তোমাকে ভরসা করতে পারব। তোমার ভালোবাসা যদি কোনোদিন কমেও যায়, আমার বিশ্বাস তুমি আমাকে ভালো রাখতে পারবে। আমি তোমার কাছে এসে স্বস্তি পাব। আমি ঐ মানসিক স্বস্তিটাই খুঁজছি। একটা সম্পর্ককে একা ড্রাইভ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো খুব বেশি এনার্জি আমার মধ্যে নেই। আমি নিজেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য নিজের সবটা দিতে পারব না, তোমার থেকেও চাইব না। আমার একজন পরিণত সঙ্গী প্রয়োজন। যে আমার খারাপ দিনগুলোতে মেন্টাল সাপোর্টের জন্য আমার পাশে থাকবে। আর তোমার প্রয়োজনে আমি তোমার জন্য আছি, এটুকু বলতে পারি। এর চেয়ে খুব বেশি কিছু করে ভালোবাসা বোঝানোর বয়স অনেক আগেই আমি পেরিয়ে এসেছি। বলো, আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি কী ভাবছ?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার এবং নিজেরা একটু কাছাকাছি আসার জন্য জাহ্নবী ও চয়ন নিয়েছিল আরও একটি বছর। জাহ্নবীর দু'কামরার ফ্ল্যাটের একটা কোণ ওর বড় প্রিয়। সেই কোণে আজ দুটো সুসজ্জিত চেয়ার রয়েছে। বিয়ের পরও স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকবে, সপ্তাহান্তে কিংবা মাসে দু-একবার পরস্পরের কাছে যাতায়াত করবে, বৌ নিজের কেনা ফ্ল্যাটে একা থাকবে, এটা চয়নের মা প্রথমে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু একমাত্র ছেলে শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হয়েছে, সেই আনন্দে তিনি বিশেষ কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। জেলার বাইরে কর্মরত একটি মানুষকে একমাত্র জামাতা হিসেবে ভারতী মন থেকে মেনে নেননি। কিন্তু জাহ্নবীর জেদের কাছে তিনিও পরাস্ত হয়েছেন।

স্বপ্ন সত্যি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার সময়টা যেন সুখস্বপ্নের মতোই কেটে যাচ্ছিল। পাশাপাশি ছিল নতুন জীবন শুরু করার জন্য কিঞ্চিৎ সুখ এবং উৎকন্ঠা! বাইরে কোলাহল শুনে নিজের কপালের টিপটা ঠিক করে আয়নার দিকে চাইল জাহ্নবী। চয়ন এসেছে।

রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। বিবাহের আয়োজন বড় স্বল্প। বরপক্ষ ও কনেপক্ষ মিলিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সর্বমোট চল্লিশ জনের মধ্যে বর ও নববধূকে পৃথক করা যায় না, এতটাই সাধারণ তাদের সাজ ও পোশাক। দায়িত্ব নিয়ে একা সমস্ত আয়োজন সামলে নিয়েছে জাহ্নবী। চয়ন ফিরেছে বিয়ের মাত্র একদিন আগে। কর্মব্যস্ততার কারণে সারা ফ্ল্যাটে ছুটে বেড়ানোর সময় জাহ্নবীর রক্তিম সিঁথির দিকে চয়ন অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। সেই মধুরাতে জনমানবহীন ফ্ল্যাটের পুষ্পশোভিত শয্যায় বিবসনা জাহ্নবীর সিঁদুর-রাঙা কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল চয়ন। ঘরের জানলা দিয়ে প্রবেশ করছিল মৃদুমন্দ বাতাস। কিন্তু সেই বাতাস দুটি কামাসক্ত তপ্ত দেহের উষ্ণতা প্রশমিত করতে অক্ষম। দৈহিক ক্লান্তির কারণে জাহ্নবী ঘুমিয়ে পড়ার পরও চয়নের চোখে ঘুম নেই। ও দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল জাহ্নবীর ঘুমন্ত মুখের দিকে।

*****************

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট