অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২

প্রজাপতির মৃত্যু (তৃতীয় পর্ব)


 

প্রজাপতির মৃত্যু

মন প্রজাপতি

প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস

তৃতীয় পর্ব



ঘরে ঢুকে পদ্ম দেখল, দুই ছেলে-মেয়ের জ্বর। পদ্মর সাময়িক অনুপস্থিতিতে বড় ছেলে টুকাই আর ওদের বাবা একেবারে দিশেহারা। দুটো মাত্র ঘর আর একটা বারান্দা সম্বল পদ্মর। কলঘর উঠোনের এককোণে। মাথার ওপর টালির চাল দিয়ে প্রতি বর্ষায় জল পড়ে। যতবার ভেবেছে চালটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, ততবারই সর্বভূক সংসার গিলে খেয়েছে জমানো সব টাকা। দুটো ঘর একেবারে লণ্ডভণ্ড। ঘরণীর অনুপস্থিতিতে সংসার করতে গিয়ে রান্নার স্টোভ থেকে শুরু করে বালিশ বিছানা, বাসনপত্র সব ছড়িয়ে ফেলেছে দুলাল। ভাঙাচোরা ঘরের একপ্রান্তে ইঁট ঠেকিয়ে রাখা তক্তপোষের ওপর নিজের জন্য একটু জায়গা আদায় করে নিল সুরঞ্জনা। পূর্ণা একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। দেহে ভীষণ রকম তাপপ্রবাহের কারণে ছোটুর চোখে ঘুম নেই। একটুকরো কাপড় ভিজিয়ে ওর কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল দুলাল। ও একটু পর উঠে এসে বসল পদ্মর পাশে। ট্রাঙ্ক থেকে কিছু টাকা বের করে পদ্মর হাতে গুঁজে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিয়ে ও বলল,

-এটা দিয়ে ক'দিন টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নিও। এখন কাজের বাড়ি যেতে হবে না।
-কোথায় পেলে টাকা?
-মনসুরের থেকে সুদে ধার নিয়েছি।
-আবার দেনা? বলি শোধ করবে কে শুনি?

ভারী হয়ে এলো পদ্মর গলা। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গালে। মৃদুস্বরে ও বলল,

-না খেয়ে পেটে দড়ি দে থাকলেও আর দেনা করতে মন করে না। দেনার দায়ে আমার গোটা জেবনটাই শেষ হয়ে গেল। এর থেকে টাকা নিয়ে ওরে দাও, ওর থেকে নিয়ে এরে! আমি আর পারি না গো!

-মা রাতে কী রান্না হবে? চাল নেই! ডাল অল্প রয়েছে। চুপড়িতে তিনটে আলু পড়ে রয়েছে। ঠাকমা বলছে খিদা লাগে।

দরজার দিকে চেয়ে পদ্ম দেখল, বড় ছেলে টুকাই এসে হাজির হয়েছে। এই কয়েকদিনে কী বড় বেশি লম্বা হয়ে গেছে টুকাই! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ছেলের মাথা প্রায় দরজার ওপর প্রান্তে ঠেকে গেছে। গলা ভাঙতে শুরু করেছে টুকাইয়ের। কোন এক সুনিপুণ চিত্রশিল্পী তুলির নিখুঁত টানে বালকের ঠোঁটের ওপর গোঁফের সূক্ষ্ণ রেখা টেনে ঘোষণা করছেন শৈশবের সমাপ্তি। পদ্ম ঘরে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। দুই ছেলে মেয়ে জ্বরে কাহিল। পিসি শাশুড়িও বিছানা হাতড়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে ছোট মেয়ের গায়ে মাথায় কম্পিত হাত বুলিয়ে তার দীর্ঘায়ু কামনা করেছে। দুলাল এখন মেয়েকেই কোলে নিয়ে বসে আছে। কিন্তু টুকাই একবারও বোনের ধারেকাছে এগোয়নি। উঁকি মেরে বোনের মুখটাও দেখতে আসেনি। পদ্ম বলে উঠল,

-শুধু নেই আর নেই!
-তা না থাকলে কী বলব মা? আছে!
-টুকাই এমনধারা কথা বলছিস কেন তুই? বোনকে একবারও কোলে নিয়েছিস?
-রাতে কী রান্না হবে বলো? ঘরে কিছু খাবার জুটবে নাকি খাবার লোক বেড়ে যাওয়ার জন্য আমরা না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে নতুন মানুষকে খাওয়াব?

ছেলের কথা শুনে বাক্যহারা হল পদ্ম। দুলাল বড় নির্বিবাদী শান্ত স্বভাবের মানুষ। সাংসারিক কোন জটিলতার উত্তর সে দিতে পারে না। সে কেবল জানে এই ছেলের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবনটাও শেষ করতে হবে। টুকাই সরকারি স্কুলে পড়ে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব অনেকটাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য কোথা থেকে কার একটা ভাঙা সাইকেল জুটিয়ে নিয়েছে সে। দুলাল নতুন সাইকেল কেনার জন্য ছেলেকে টাকা দিতে পারেনি। ছেলের অনেক প্রয়োজনই মেটাতে অক্ষম সে। স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষকের মুখে মুখে ফেরে টুকাইয়ের মেধা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা। কত শিক্ষক বেতনের আশা না করেই স্বেচ্ছায় পড়ান টুকাইকে। ছেলেটা বড় কম কথা বলে। সারাদিন কেবল পড়াশোনা করে। প্রাণপণে এই ছেলেটিকে তৈরি করার চেষ্টা করছে দুলাল ও পদ্ম। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো টুকাই। সেই কারণে দুলাল বড় ছেলেকে সমীহ ও অপার শ্রদ্ধার চোখে দেখে। প্রত্যেক বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর ওর স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলে, তারা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে দুলালের সঙ্গে কত সম্মান দিয়ে কথা বলে। বাবার এই যে বিরাট সম্মান প্রাপ্তি, সকলই তো টুকাইয়ের জন্য। দুলাল প্রায় লেখাপড়া জানে না বললেই চলে। সেই কারণে ছেলের এই উন্নতি দেখে আনন্দে দুলালের দু'চোখ ভাসে। ছেলের এমন কথায় একটু কষ্ট পেলেও দুলাল অস্বীকার করতে পারল না, যে সত্যিই এতবড় পরিবারের অন্ন সংস্থানের ক্ষমতা তার নেই। ছেলের কথায় অক্ষম জন্মদাতা আঘাত পেলেও, চোখে জল নিয়ে চুপ করে রইল। পদ্ম আঁচল থেকে নার্সদিদির দেওয়া টাকা থেকে কিছু টাকা বের করে ছেলের হাতে দিয়ে বলল,

-ডিম, চাল আর আলু নে আয়। ডিমের ঝোল ভাত করে দিচ্ছি। পেটপুরে খাবি তুই। আমি বেঁচে থাকতে তোর ভাগেরটা বোন খেয়ে নেবে না। যতদিন আমার গতর আছে, আমি আমার অক্ত বিককিরি করে তোদের ভরপেট ভাত খাওয়াব।
-মা আমি...
-যা! আর কিছু শুনতে চাই না। দূর হয়ে যা!

টুকাই বেরিয়ে গেলে কাঁদতে কাঁদতে পদ্ম বলল,

-শুনলে ছেলের কথা? এই বয়সে এসে মেয়ে বিয়োলাম! তোমার জন্য নিজের পেটের ব্যাটার কাছে আমাকে এটাও শুনতে হল। এখনো গতর আছে, হাতে পা চলছে। খেটে খাচ্ছি। তাতেই ছেলের মুখের বুলি এই! এই ছেলে আমাদের বুড়ো বয়সে ভাত দেবে, তুমি সেই চিন্তা করো?
-টুকাই কত পড়ালেখা করে! ও বড়মানুষ হবে! সারাদিন খালি পেটে পড়ে। ওকে একটু ভালো কিছু খেতে দিতে পারি না আমরা। ছোটু আর পূর্ণার জন্য কত করল এই ক'দিন। তুমি তো সেটা চোখে দেখোনি! খিদের জন্য এখন ওর মাথা ঠিক নেই পদ্ম। ভুল করে বলে ফেলেছে। ব্যাটার কথা মনে নিয়ে কষ্ট পেতে নেই।
-নিজেদেরই খাওয়া জোটে না। তাও এই আকালের সংসারে রেখে তোমার পিসিরে ভাত দিচ্ছি। ঠাকুর তুমি দেখছ তো সব? একটা পেরানীরেও খালি পেটে ঘুমুতে দিই না! আমি নিজে না খেয়ে সবারে করছি। জেবনের শেষটায় যেন এই দুই বুড়ো বুড়ি খিদার জ্বালায় পথেঘাটে না মরি! দুটো ব্যাটা বিয়েছি। দুই ব্যাটার বউ যেন দু'বেলা দুটো ভাত দেয়।

একদৃষ্টে ঘুমন্ত সুরঞ্জনার দিকে চেয়ে কপাল চাপড়ে পদ্ম বলে উঠল,

-সব এই আবাগির জন্য! এর জন্যই এত কথা শুনতে হল আমারে...

ততক্ষণে বাবার কোলের উষ্ণতায় আবিষ্ট হয়ে গভীর ঘুমের দেশে হারিয়ে গেছে সুরঞ্জনা। মায়ের কুকথা তাকে স্পর্শও করতে পারল না।

সুরঞ্জনার জন্মের পর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। টুকাই ছোট বোনকে পছন্দ না করলেও, ছোটু সারাদিন বোনকে নিয়েই আহ্লাদে আটখানা। পড়াশোনায় একেবারে মন নেই পদ্মর ছোট ছেলের। মেয়েটা সেই তুলনায় লেখাপড়ায় ভালো। টুকাই আর পূর্ণাকে নিয়ে দুলালের অনেক আশা, তারা একদিন অনেক বড় হবে। বড় ছেলের জন্য প্রাণপাত করে সে। পদ্মর শরীরটাও ভাঙছে। এবার হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ঐ লোহার মতো নীরোগ শরীরে একের পর এক রোগ বালাই লেগেই আছে। সুরঞ্জনার জন্মের ধকল এই বয়সে এসে পদ্ম আর নিতে পারেনি। বাবুদের বাড়ির কাজে প্রায়ই কামাই হয়ে যায়। তিনটে বাড়ির কাজ ইতিমধ্যেই চলে গেছে। তারা করিৎকর্মা নতুন লোক পেয়ে গেছে। ফলে পদ্মর সংসার প্রায় অচল বলা চলে। সংসারের ভাবগতিক দেখে বৃদ্ধা পিসি শাশুড়িরও আজকাল আর খিদে লাগে না। বেশ কয়েকদিন বাড়িতে বসে থাকার পর একদিন সকালে দুলাল হন্তদন্ত হয়ে এসে উঠোনে পা রেখে বলে উঠল,

-ও পদ্ম, পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে তাড়াতাড়ি দুটো পষ্টিভাত দাও দিকিনি! একটা কাজের খবর আছে।

এখন পদ্ম সকালে কাজে বেরোয় না। বিকেলে দুটো ফ্ল্যাটে রান্নার কাজে যায়। তারা সবাই অফিস বাবু। খুব সকালে স্বামী-স্ত্রী অফিসে বেরিয়ে যায়। তাই রান্নার যাবতীয় কাজ রাতেই করতে হয়। আর একটা ফ্ল্যাটে রাতের রুটি তরকারি করে সকালের রান্নার জোগাড়টা করে আসতে হয়। দুই ফ্ল্যাটেই সপ্তাহান্তে শনি আর রবিবার গিয়ে ঘর মোছা, সারা সপ্তাহব্যাপী ব্যবহৃত যাবতীয় জামাকাপড় কাচা-ধোয়া করে আসে পদ্ম। বৌদিরা বড় অফিসে চাকরি করে বলে নিজেরা সংসারে তেমন সময় দিতে পারে না। তাই এই ফ্ল্যাট দুটোতে পদ্ম অনেক বাড়তি কাজ পায়। ফলে ওর মাইনে ছাড়াও কিছু উপরি পাওনা আছে। বকশিশও কিছু কম নয়। কিন্তু ওর একার ওপর তো গোটা সংসার আর চলে না। টাকা-পয়সার জন্য দুশ্চিন্তা করে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে পদ্ম। খুব ক্লান্ত লাগে আজকাল। দুলালের ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে ও বলল,

-কোথায় কাজ গো?
-ওই যে গো, নবীন পল্লীতে ডাক্তারবাবুর যে ইস্কুলবাড়ি আছে, ওখেনে। ইস্কুলের সামনে অনেকটা বাড়তি জমি আছে না? দিদিমণি মনসুরকে ওই জমিটা পরিষ্কার করতে ডেকেছে। বিড়ি টানতে টানতে মনসুর বলল, মন করে দিদিমণি ওই জমিতে নতুন স্কুলঘর করবে। আমি বললাম, আমারেও নে চল ভাই। হাতে একদম টাকা নাই। অত বড়লোক মানুষ। তোরে টাকা দিলে আমাকেও ক'টা টাকা দিতে পারবে। দু'জন যাব। ঝপ করে দুটো ভাত দাও তো। সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে যাই। কাজ করলে তবে তো দুটো টাকা আসবে। টুকাইয়ের টেস পেপার না কি বই যেন কিনতে হবে, কতদিন ধরে ছেলেটা বলছে! আজ টাকা পেলে আগে ওর হাতে বই কেনার টাকা দেব।

ভাতগুলো নরম হয়ে বেশ গলে গেছে। ভাতের ওপর একটু লবণ আর কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল ছড়িয়ে ওগুলো গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল দুলাল। পিঁড়ির ওপর বসে পদ্ম বলে উঠল,

-হ্যাঁ গো, আমার জন্য ওই ইস্কুলে কোন কাজ পাওয়া যায়? খবর নাও না একটু! অনেক বড় ইস্কুল শুনেছি। দুটো ফেলাটের কাজের টাকা দে তো আর চলছে না।
-মঙ্গলার মাকে সেদিন কাজ দেখে দেওয়ার কথা বললে যে, তার কী হল?
-কেউ নিজে কাজ না করে আমাকে দেবে? খিদে সবার পেটেই আছে তো নাকি! আমি কাউর পেটে লাথি মেরে কাজ ভাঙিয়ে নিজে ঢুকতে চাই না। তারপর বাড়ি বয়ে কোমর বেঁধে কোঁদল করতে আসবে। টুকাই এসব পছন্দ করে না, জানোই তো!
-আমি আজ কাজে যাই। দেখছি। পিসির শরীল এখন কেমন? সকালে শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল তো।
-ঠিক আছে। ও বাড়ি থেকে তোমার দাদা এসেছিল একটু আগে!
-কী বলছে?
-ওই দাওয়ায় বসে মুখ লচানো আলগা পিরিত দেখালো। গলা ছেড়ে ডাক দিল, ও পিসি ভালো আছ? এক বাস্ক সন্দেশ দিয়ে গেছে। নাও আর কী! কাল থেকে পেটে ভাত নাই, খালি পেটে বসে বসে এবার দাদার আনা দামি সন্দেশই গেলো তোমরা!
-ও পিসিই খাক! ধরার দরকার নেই।
-দাদা চলে যাওয়ার পর পিসি ও সন্দেশের বাস্ক ছুঁড়ে ফেলেছে।
-কী বলছ?
-হু! আমিই কুড়িয়ে আনলাম। সন্ধেকালে দেব মুড়ি দে। ক'টাদিন আর বাঁচবে! খাক। আমরা তো আর ভালোমন্দ কিনে দিতে পারি না। তোমাকে আর দুটো ভাত দেব?
-না। টুকাই খেয়ে ইস্কুলে যাবে তো! ওর জন্য ভাত আলাদা করে তুলে রাখো। ছোটু আর পূর্ণা ইস্কুলে খেয়ে নেবে। কিন্তু তুমি আর পিসি কী খাবে?
-আমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমরা মেয়েমানুষ, আমাদের আবার খাওয়া! এবেলা কিছু একটু ফুটিয়ে নেব। বিকেলে বৌদির ফেলাট থেকে খাবার আনব তো! ওবেলা খাব।

চোখের জল চেপে দুলাল বলল,

-আমার খিদেটা ঐ একটু মরলেই হবে। বেশি লাগবে না। টুকাইকে আমার ভাগের ভাতটা দিও।

থালাটা তুলে নিয়ে কলঘরে চলে গেল ব্রজদুলাল। সুন্দর একটি সকাল। মনসুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লুঙ্গিটা কোমরে বেঁধে রোদে পুড়ে ঘর্মাক্ত দেহে কাজ করছিল দুলাল। একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় কানে গোঁজা বিড়িটা নামিয়ে মনসুর দুটো সুখটান দিচ্ছিল, এমন সময় একজন মহিলা হন্তদন্ত হয়ে একটি ছেলের হাত ধরে স্কুলে এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে প্রবেশদ্বারের দারোয়ান থেকে শুরু করে সকলেই কেমন যেন সমীহ করে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মনসুরের দিকে চাইল দুলাল। মনসুর বলল,

-ইস্কুলের সবচে বড় দিদিমণি আর তার একমাত্তর ছেলে। এ হল ডাক্তারবাবুর নাতি। সবাই একডাকে চেনে এরে। বড় ভালো ছেলে।
-এটাই বড় দিদিমণি?
-হ্যাঁ, দাঁড়াও দুলালদা, তোমার কথা দিদিমণিরে একটু বলে আসি।

জ্বলন্ত বিড়িটা দুলালের হাতে ধরিয়ে মনসুর ছুটল দীপমালার কাছে। বলল,

-দিদিমণি, ভালো আছেন?
-হ্যাঁ মনসুর। তুমি ভালো ভাই?
-হ্যাঁ দিদিমণি। অনেকটা বড় জায়গা তো। তাই একজনরে সঙ্গে নে এসেছি। আমার একটু সুবিধা হবে।
-ওহ আচ্ছা। তা ঠিক আছে, ভালোই তো! কাজ করো তোমরা। কাজ হয়ে গেলে দু'জনেই আমার অফিসে দেখা করে যেও। কেমন!
-আচ্ছা দিদিমণি।
-দিদিমণি?
-হ্যাঁ বলুন?
-আপনের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?

দুলাল এসে দাঁড়িয়েছে মনসুরের পিছনে। ডানহাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে চেয়ে দীপমালা বলে উঠল,

-কী ব্যাপারে বলুন তো?
-এই ইস্কুলে মেয়েমানুষের জন্য কোন কাজ, মানে কতরকম তো কাজ থাকে। আমার বউয়ের জন্য...
-এখন আমার একটু তাড়া আছে দাদা। অনির ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। আপনি বরং কাজ সেরে নিন। তারপর আমার অফিসে বসে ধীরেসুস্থে কথা হবে।
-আচ্ছা দিদিমণি।

স্কুলের ঘন্টার শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ছেলের হাত ধরে চলে গেল দীপমালা। বিকেলে যখন দীপমালা নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল, অনির্ণেয় অফিসের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসে বইয়ের পাতা উল্টে রূপকথার জগতে ডুব দিয়েছে। দুলাল আর মনসুর পৌঁছল দীপমালার অফিসে। মনসুর নিজের প্রাপ্য টাকা বুঝে নিয়ে চলে গেলেও, দুলাল বাইরে বসে রইল। অফিস ঘরে তালা দিয়ে কয়েকটা ফাইল সঙ্গে নিয়ে অনির হাত ধরে বেরোল দীপমালা। দুলাল উঠে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে বলল,

-দিদিমণি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন? আপনি তখন কী যেন বলছিলেন!
-আমার বউয়ের জন্য এই ইস্কুলবাড়িতে যদি কোন কাজ থাকে.... ছোট কাজ হলেও চলবে।
-আপনি কী কাজ করেন? কোথায় থাকেন?
-আমার বাড়ি মোছলমান পাড়ার কাছেই। মনসুরের তিনটে বাড়ি পর। আমি আগে চটকলে কাজ করতাম দিদিমণি। ওখেনে কাজের সময় হাতে চোট পেয়েছিলাম। তারপর মালিক কিছু টাকা দে বসিয়ে দিল। পরে রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে হয়ে কাজ করেছিলাম কয়েক মাস। কিন্তু সিমেন্ট বালির বস্তা চাগাতে পারি নে। হাতটায় কেমন যেন জোর পাই না। ইঁট বইতে গেলে ইঁট পড়ে যায়। এখন মোছলমান পাড়ার মোড়ে যে বাজার আছে, ওখেনে ফল পাকুড় বেচি। আর যদি কেউ এদিক ওদিক কাজে ডাকে, ছুটে যাই। বউটা বাবুর বাড়ি কাজ করত। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর কাজগুলো ছেড়ে যায়। আমার সংসার চলে না দিদিমণি। চারটে ছেলেমেয়ে। একটা বুড়ি পিসি আছে। পেটপুরে সবকটারে দুটো ভাত দিতে পারি না। আপনার ইস্কুলে যদি...
-আমি একটা বিল্ডিং করছি। ঐদিকের মাঠে। যেটা আপনারা পরিষ্কার করছেন। এখন প্রি প্রাইমারি সেকশন থেকে টেন পর্যন্ত আছে। এবার একবারে টুয়েলভ পর্যন্ত করছি। দেখুন দাদা, আপনার নামটা কী?
-দুলাল দিদিমণি! ব্রজদুলাল সর্দার।
-দেখুন দুলাল দা...
-আমাকে আপনি বলবেন না দিদিমণি। আপনি কত বড় মানুষ, আমি খুব ছোট...
-শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে বড় ছোট বিচার করা যায় না। আপনিও খেটে খাচ্ছেন। আমিও। যার যার জীবনযুদ্ধে সেই যোদ্ধা। যাইহোক, আপনি চাইছেন না যখন ঠিক আছে। দেখো দুলাল দা, আমি সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত থাকি। এ আমার ছেলে, অনির্ণেয়। আমি ওকেও ঠিকমতো টাইম দিতে পারি না। কখন ওর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, এখানেই আমার অফিসে ইউনিফর্ম পরে বসে আছে। আমি বেরোব, তারপর আমার সঙ্গে ও বাড়ি যাবে। আমার কাজের লোকটা প্রায়ই কামাই করে। ছেলের জন্য ওকে ভরসা করতে পারি না। তুমি মনসুরের সঙ্গে এসেছ, তাই তোমাকে বা তোমার পরিবারকে বিশ্বাস করতে পারি। এই পুরনো বিল্ডিং হওয়ার আগে থেকে আমি ওকে চিনি। মনসুরের বাবা আমার বাবার পেশেন্ট ছিলেন। তা তোমার বউ কী আমার ছেলেকে একটু দেখাশোনা করতে পারবে? এই ধরো, স্কুল থেকে ফেরার পর অনি একটু ফ্রেশ হলে ওকে কিছু খেতে দেওয়া, আমি বাড়ি ফেরার পর ভীষণ টায়ার্ড হয়ে থাকি। তাই ওর রাতের খাবারটা করে রাখা। আর যদি সকালের রান্নাটাও একটু করে দিত, আমি আর একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আসতে পারতাম। স্কুলের পাশে ওটাই আমার বাড়ি। তোমার বউ রাজি থাকলে আজ সন্ধেবেলা তাকে নিয়ে তুমি আমার বাড়ি এসো। সে কাজকর্ম সব দেখেশুনে বুঝে নেবে। টাকা পয়সা নিয়েও কথা বলে যাক। তারপর কাল থেকেই না হয় শুরু করুক। এই ভাঙা মাসটার জন্য আমি অর্ধেক টাকাই দেব।

দুর্বলদেহী দুলালের একটু আগেও খিদের জন্য পেটটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। এখন ও খিদে তৃষ্ণা সব ভুলে গেল। আনন্দে ওর বুকের মধ্যে শত শত প্রজাপতি উড়তে শুরু করল। কিন্তু ও বাক্যহারা তখন হয়ে গেল, যখন দীপমালা দু'পা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে এসে বলল,

-দুলাল দা, নতুন বিল্ডিংয়ের ওদিকে আর একটা এক্সিট হবে। ছুটির সময় একটা গেটের ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তোমার হাতে তেমন জোর নেই বলছ, কাজকর্ম করতে পারো না! নতুন গেটে দারোয়ানের কাজটা করতে পারবে তো? ইউনিফর্ম স্কুল থেকেই দেওয়া হবে। যদিও ওটাতে একটু টাইম লাগবে। নতুন বিল্ডিং হবে, তারপর...

পদ্মকে এতগুলো সুসংবাদ দেওয়ার সময় বারংবার দু'চোখ মুছতে শুরু করল দুলাল। ছোট মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

-আমার ছোট মা বড় লোককি পদ্ম। এবার আমাদের দিন ফিরবে। সবাই ভরপেট ভাত খাব। গরম রুটি খাব। সব আমার এই ছোট মায়ের জন্য! ওর জন্যই আমার কপাল খুলল! মন করে এবার টালির চালটা খুলে ঘরটা এলবেসটার দে ছাইতে পারব। দু'জন মিলে খুব খাটব পদ্ম। সংসারটা আবার নতুন করে শুরু করব।

সুরঞ্জনার কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিল দুলাল।

বছর ঘোরে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তৈরি হল দীপমালার নতুন স্কুলবাড়ি। দারোয়ানের পোশাক পরিহিত দুলাল স্কুল ছুটির শেষে অনির্ণেয়কে পৌঁছে দিল তার বাড়িতে। পদ্ম এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল,

-এসো এসো।

অনির্ণেয়র কাঁধ থেকে ভারী স্কুলব্যাগটা খুলে নিল পদ্ম। ঘরে ঢুকেই একটা বাচ্চা মেয়েকে তুরতুর করে ঘুরে বেড়াতে দেখে হতবাক অনি। ও পদ্মকে জিজ্ঞাসা করল,

-এ কে আন্টি?
-ও আমার মেয়ে অনি। রঞ্জা। কাল রাত থেকে মেয়েটার খুব জ্বর গো। আজ কাজে বেরোনোর সময় আমারে ছাড়তেই চাইছিল না। খুব কাঁদছিল, ওর ঠাকমার শরীলটাও ভালো না। আমি ঘরে না থাকলে কোথায় কোথায় কার ঘরে জ্বর গায়ে ঘুরে বেড়াবে! তাই আজ ওরে সঙ্গে নে এলাম।
-ওর জ্বর তো এভাবে খালি পায়ে মেঝেতে হাঁটছে কেন? ঠান্ডা লেগে আবার জ্বর এসে যাবে তো! জুতো ছাড়া মেঝেতে পা রাখতে মা আমাকে বারণ করে। দাঁড়াও, ঘর থেকে আমার জুতোটা নিয়ে আসি। ওটা পরে ঘুরুক।

অনির্ণেয় একজোড়া বড় বড় জুতো এনে সুরঞ্জনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ওর পায়ের সামনে রাখল। ওটাতে ছোট দুটো পা গলিয়ে সুরঞ্জনা অনির্ণেয়র গলায় বাঁধা টাইটা একটু টেনে দেখল। অনির্ণেয় হেসে ফেলল। একটু আগেই বোধহয় কাঁদছিল রঞ্জা। দু'গালে কাজল লেপ্টে রয়েছে। কপালে বড় একটা কাজলের টিপ ঘেঁটে গেছে। হাড়গিলে চেহারা! গলায় কালো রংয়ের সুতোয় বাঁধা রয়েছে একটা তামার মাদুলি। বড় বড় দুটো চোখে এখনো জল টলটল করছে। অনি হেসে রঞ্জার চোখ মুছিয়ে দু'গাল টিপে আদর করে বলল,

-তুমি খুব সুইট! কাঁদবে না একদম। এটা... এটা টাই রঞ্জা। তুমি পরবে? চাই এটা? আচ্ছা তুমি যখন স্কুলে যাবে, তখন তোমাকেও তো টাই পরতে হবে। তখন আমি আমার মাকে বলব। মা তোমাকে আমার মতো টাই কিনে দেবে!

অনির্ণেয়র টাইটা টেনে মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখল রঞ্জা। একমনে ঝুলতে থাকা ওই বস্তুটা দেখতে লাগল সে। অনি বলল,

-এটাই চাই? এক্ষুণি? আচ্ছা দাঁড়াও!

নিজের গলা থেকে টাইটা খুলে সুরঞ্জনার গলায় পরিয়ে দিল অনি। সঙ্গে সঙ্গে ওটার স্বাদ গ্রহণের জন্য মুখের ভিতর চালান করে মনের সুখে চিবোতে শুরু করল রঞ্জা। পদ্ম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অনির খাবারটা টেবিলে রেখে চিৎকার করে উঠল,

-ওরে কাল অনিদাদার স্কুল আছে রে মেয়ে। মুখ থেকে ওটা বের কর। কেচে শুকিয়ে দিই আমি। যা পাচ্ছে, তাই নিয়ে মুখে দিচ্ছে! উফ!

টাই নিয়ে মা-মেয়েতে রীতিমতো দড়ি টানাটানির খেলা শুরু হয়ে গেল। অনিদাদার নিজের গলা থেকে খুলে দেওয়া প্রথম উপহারটা হাত থেকে কেড়ে নিতে গেলেই, পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দেয় রঞ্জা। খেতে বসে এই দৃশ্য দেখে অনির্ণেয় হেসেই অস্থির। শেষ পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সুরঞ্জনাকে কোলে তুলে নিল অনির্ণেয়।

***********

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

প্রজাপতির মৃত্যু (দ্বিতীয় পর্ব)


 


প্রজাপতির মৃত্যু

মন প্রজাপতি

প্রথম অধ্যায়
সাথী দাস

দ্বিতীয় পর্ব




একরত্তি অনির্ণেয়কে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল দীপমালা। বাড়ির পাশের ফাঁকা জমিতে যেন মহোৎসব শুরু হয়ে গেছে। রাজমিস্ত্রীর কোলাহল, ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্রোচ্চারণ, শঙ্খ ও ঘন্টাধ্বনি, সব মিলিয়ে আজ ডাক্তারের বাড়িতে সাজো-সাজো রব উঠেছে। মালা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-বাবা, এসব কী?

অনির্ণেয়কে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দিগম্বর বললেন,

-এদিকে আয়।

ঠাকুরমশাইয়ের হাতের ওপর হাত রেখে একসঙ্গে একটা ইঁট গাঁথল মালা। অনির্ণেয় এবং মালার কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করলেন ঠাকুরমশাই। আজ ভিতপুজোর সঙ্গে একমাত্র নাতির শুভাগমন উপলক্ষ্যে, দিগম্বর গৃহে পুজোর আয়োজন করেছিলেন। মহাসমারোহে ভিতপুজো সম্পন্ন হওয়ার পর বিকেলে রাজমিস্ত্রীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দিগম্বর যখন কথা বলছিলেন; মালা তাকে ডাকল,

-বাবা?
-বল! আমার নাতি কোথায়?
-ফিড করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। এসব তুমি কী করছ বলো তো বাবা? এত প্ল্যানিং, মিস্ত্রী-মজুর। আমি হাসপাতালে যাওয়ার আগে এই প্ল্যান পাস করার জন্য তুমি দৌড়াদৌড়ি করছিলে? অথচ আমাকে জানতেও দাওনি! জিজ্ঞাসা করলে বারবার এড়িয়ে গেছ! এই কী তোমার সেই স্বপ্নের হাসপাতাল?

দিগম্বর একটু হাসলেন। তারপর বললেন,

-না মা। আমার স্বপ্ন দেখার দিন শেষ। এবার তোর আর আমার নাতির দিন শুরু। আমার নাতির যেন কোন অযত্ন না হয় মালা। ওকে মেইডের ভরসায় বাড়িতে ফেলে রেখে, তোকে বাইরে কোথাও চাকরি করতে কোনদিনই যেতে হবে না। এটা তোর স্কুল। আমি যতটা পারছি করে দিয়ে যাচ্ছি। আপাতত সারাদিনে দু'হাজার ছাত্র পড়ানোর মতো ক্লাসরুম হবে। ওদিকে পাশাপাশি স্টুডেন্টদের জন্য পাঁচটা ওয়াশরুম। এদিকে স্টাফ ও টিচারদের ওয়াশরুম। দোতলা বিল্ডিং হবে। কিন্তু ভিত করা রইল চার তলার। এরপর আমি না থাকলে তুই ইঁটের ওপর ইঁট গেঁথে নিতে পারবি না মা? তুই না পারলেও, আমার নাতি ঠিক পারবে। আমি ওর ভবিষ্যৎ গুছিয়ে দিয়ে গেলাম। তোকে আর আমার নাতিকে কোথাও চাকরির জন্য ঘুরতে হবে না। বরং তোরা এই স্কুলে মানুষকে চাকরি দিবি, তাদের অন্নের সংস্থান করবি। আর একদম ছোট দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য প্রতিদিন দুপুরে ওই ফাঁকা জায়গায় ক্যাম্প করে অবৈতনিক স্কুল হবে। যারা পয়সার জন্য স্কুল চত্বর থেকে সাত হাত দূরে থাকে, তাদের প্রাথমিক শিক্ষাদান করবি তুই। প্রকৃতির মাঝে ক্লাস হবে, শরীরচর্চা হবে। আমি মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করতে চেয়েছিলাম মালা। সুস্বাস্থ্য বল কিংবা শিক্ষা, জীবনে তো দুটোরই প্রয়োজন আছে। তুই এইদিকে করবি, আর আমি যে ক'টা দিন বাঁচব, হসপিটালে ডিউটি করব। চেম্বারে ছুটব। পারবি না মা! আমার রঞ্জককে সামলে এই নতুন সংসারের দায়িত্ব নিতে?

সুবিস্তৃত ভিতের ওপর সারি-সারি ইঁট গাঁথা হচ্ছে। মিস্ত্রীদের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কিন্তু মালা আর কিছুই দেখতে পেল না। মুহূর্তেই ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। বাবাকে জড়িয়ে স্বপ্নের স্কুলবাড়ির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় দিগম্বরের ম্লান হয়ে যাওয়া মুখটা তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যখন বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে মালা মৃদুস্বরে বলল,

-আমি পারব বাবা!

অবিলম্বে দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রীর মর্মরমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হল স্কুলবাড়ির চত্বরে। বাড়ির সামনে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা হল 'বসুধা শিক্ষা নিকেতন'। একরত্তি অনির্ণেয়কে সামলে উচ্চশিক্ষার জন্য জোরকদমে পড়াশোনা শুরু করল মালা। রামধনুর মতো রংবেরংয়ের প্রচারপত্র বিতরণ করা হল শহরের প্রত্যেকটি জনবহুল জায়গায়। দূর দূরান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের খুঁটিগুলো ঢাকা পড়ল স্কুলবাড়ির সুবৃহৎ ছবির আড়ালে। বছর পাঁচেক পর প্রথম প্রভাতের নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে অসংখ্য ক্ষুদ্র বৃহৎ রঙিন প্রজাপতি প্রথম পাখা মেলে অভিভাবকদের হাত ধরে, কোলে চেপে যখন স্কুলের বড় গেটের সামনে উপস্থিত হল, তখন প্রিন্সিপালের চেয়ার আগলে চোখে চশমা এঁটে বসে রয়েছেন ব্যক্তিত্বময়ী দীপমালা চট্টোপাধ্যায়।

*******

রাস্তার টাইমের কল থেকে তিন বালতি জামাকাপড় কেচে ধুয়ে উঠোনে পা রেখেই বারান্দায় শুয়ে পড়ল পদ্মাবতী। এতবড় পেটটা নিয়ে ও আর চলতে ফিরতে পারে না। ঘর থেকে পিসি শাশুড়ির মুখনিঃসৃত অমৃতের মতো সুমিষ্ট বাণী ভেসে এলো,

-ও বউ, এলি? ও বউ!
-কী হয়েছে কী!
-বলি তোর গতরে কী পোকা ধরল নাকি রে! খেতে দিবিনে? কতখানি বেলা হল। ওই যে, মজ্জিদে সুর করে আযান দেয়। খিদা লাগে রে বউ! এরপর কী সুয্যি ডুবলে ভাত দিবি? দুটো ভাতের জন্য এই আবাগির কাছে দু'বেলা মুখ ঝামটা শুনতে হয়! তাও খাই নিজের ভাই ব্যাটার ভাত। পোড়া কপাল আমার! ও বউ! কোথায় মরলি রে তুই?
-এই দাঁড়াও তো! নিজের শরীরের জ্বালায় জ্বলে মরে যাচ্ছি, এই বুড়ি খাওনের জন্য চারবেলা হা হা করছে। বলি ভাই ব্যাটার ভাত খাও যখন, ঐ ভাই ব্যাটাকেই তো বলতে পারো, সে তিন বেলা তোমার মুখে রান্না করা ভাত তুলে দেবে।
-হ্যাঁ তাই বলব। তোর যত বড় বড় কথা! চোখ খুলে উঠেই ছেনালি করতে বেরিয়ে যাস! সাত বাড়ি চরে না বেড়ালে তোর পেটের ভাত হজম হয় না, সে কী আর আমি জানি না! ঢলানী মেয়েছেলে কোথাকার! কী দেখে যে আমার দুলাল গলেছিল! ওই গতর গতর! তোর গতরের এত জ্বালা, এখনো পেট করে বসে আছিস! ঘরের দিকে নজর আছে? একটা বুড়ি যে এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে শুকিয়ে গেল...

দুর্বলদেহী পদ্মাবতীর মাথা এতটাই ঘুরছে, ও আর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। কিন্তু বাক্যবাণের জ্বালায় উঠতেই হল, ভেজা জামাকাপড়গুলো থেকে একটু জল ঝরলে তবেই ঘরে ঢোকানো যাবে। এদিকে সন্ধ্যা আসন্ন। কাপড়গুলো উঠোনের দড়িতে মেলতে মেলতেই বকবক শুরু করল পদ্মাবতী,

-খালি খাওন আর খাওন! পেট তো নয়, যেন কুয়ো! কত তোমার ভাই ব্যাটার টাকায় খাও তুমি, সে আমার জানা আছে। এবার থেকে একবার বলে দেখো, এ বউ! খিচুড়ির সঙ্গে একটা ডিম ভেজে দিবি? যা না, নাড়ুর দোকান থেকে চারটে ডিম নে আয়। তোর ছেলেপিলেরাও খাক! আমার ভাই ব্যাটা পরে পয়সা দে দেবে। দেখো বলে একবার! জন্মের শোধ খাওয়াব ডিমভাজা! বুড়ি ঘাটে উঠতে চলল, তাও দেখো নোলা একেবারে লকলক করছে। কোনদিন দিয়েছে তোমার ভাই ব্যাটা ঐ ধারের পয়সা? সারাদিন কাজ করবে, বিকেলে কলাটা-মূলোটা নিয়ে রাস্তার কোণে বসবে, আর রাতে ঠেকে মদ গিলে পকেট খালি করে ঘরে ঢুকবে! কী দিয়ে যে সংসার চলে বিছানায় শুয়ে তুমি বুঝবে কী করে বুড়ি! রোজ চোখ খুলে উঠে এই ছিনাল মেয়েছেলে সাত বাড়ি ঐ ছেনালি করতে না বেরোলে, দু'দিনেই শখের খাওন ঘুচে যাবে বুঝলে! আমার কী ইচ্ছা করে না, একটু ঘরে থেকে শুয়ে বসে আরাম করি! গতরে বেশি তেল হয়েছে যেন আমার! যে চোখ খুলে উঠেই লোকের বাড়ি ছুটব! পেটটা নিয়ে নড়তে পারি না। কিন্তু বাবুর বাড়ির কাজগুলো আজ ছাড়লে কালই তারা নতুন লোক রাখবে। বাবুদের সব ননীর শরীল। একবেলা লোক ছাড়া চলে না। একটা দিন কাজে কামাই করলেই মুখের রং ঢং বদলে যায়। টাকা দিয়ে কাজ করায়, মাগনা তো আর না.... আমার শরীলের ভালোমন্দ দেখবে কেন তারা! টাকা ফেললে কাজ করার জন্য লোক বসে আছে। কিন্তু কাজ গেলে আমার ঘরের এতগুলো পেট চলবে কোথা থেকে শুনি! তার ওপর ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা.... কী মরতে যে এই হাড় হাভাতে ঘরে এসে পড়েছিলাম মা গো! শরীল ভেঙে খেটে মরো, আবার কথা শুনেও মরো! এর চেয়ে বাপের ঘরে বসে থাকতাম, গতরে খাটতাম পেটে খেতাম, ওই ভালো হতো। একটা পেটের আবার চিন্তা কী? গুচ্ছের ছেলেমেয়ে তো আর বিয়োতে হতো না। শরীলটা আমার একেবারে শেষ হয়ে গেল গো। এতগুলো বছর হয়ে গেল নিজে একটা ভালো কাপড় একটা বেলাউজ কিনে পরতে পারি না, বাবুদের বাড়ি থেকে পাওয়া জামাকাপড় জোড়াতাড়া দিয়ে গোটা জেবনটাই কাটিয়ে দিলাম। ভালোমন্দ কিছু খাবার খেতে ইচ্ছে করলেও জোটে না, সব সংসারেই যায়! শালা সংসার তো নয়, যেন রাবণের চিতে! দিনরাত জ্বলছে! কিছুতেই আর অভাব নেভে না। যত দাও, ততই হাঁ করে আছে! মরণ মরণ! আমার মরণও হয় না ঠাকুর! ওঃ মা গো...

ঘরের ভিতরে মাদুরে বসে থাকা চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধা বহুপূর্বেই চুপ করে গেছে একনাগাড়ে উগড়ে যাওয়া পদ্মাবতীর বাক্যবাণের জ্বালায়। পেটের ছেলেটা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো দুটো ভাতের জন্য ভাই ব্যাটার বউয়ের এত গঞ্জনা সহ্য করতে হতো না। নিজের মা'কে কী আর ছেলে ফেলে দিতে পারত? সধবা কালে মাত্র একটাই ব্যাটা বিইয়েছিল সে। তাকেও আঁতুর ওঠার আগেই ভগবান কোল থেকে কেড়ে নিলেন। তারপর একদিন বরটাও মরে গেলে গাড়ি চাপা পড়ে। তিন ভাসুরঠাকুর আর তাকে শ্বশুরঘরের অন্ন ধ্বংস করার জন্য রাখতে চাইলেন না। অগত্যা দাদার বোঝা হয়ে বাপের ঘরে এসে উঠল সে। দাদা-বৌদি গত হয়েছেন বহু বছর হয়ে গেল। কিন্তু এই পোড়ারমুখী বিধবা বোনটাকে ফেলে গেছে শেষ বয়সে অথর্ব অবস্থায় লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করার জন্য। দাদার মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলের হাতে এসে পড়েছে বৃদ্ধা। দাদার বড় ছেলেটা একবারও পিসির খোঁজ রাখে না। অথচ তার ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা আছে। বুড়ো পিসিকে একবেলা দুটো ভাত দিলে কী তার অগাধ ঐশ্বর্য কিছু কমে যেত! খিদের জ্বালায় বিছানায় শুয়ে বৃদ্ধা চোখের জল ফেলছিল। চোখের সামনে একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে ক'টা মুড়ি আর বাতাসা দিয়ে বাবুর বাড়ির কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল পদ্ম। সেই মুড়ি জলে ভিজিয়ে খিদের জ্বালায় বারকয়েক খেয়েছে বৃদ্ধা। তবুও সব মুড়ি সকালেই শেষ হয়ে গেছে। দন্তহীন বৃদ্ধা একটা বাতাসা চুষে চুষে খাচ্ছিল। তাও পেটের জ্বালা নেভে না। সে এই ঘরের মধ্যে সারাদিন একা পড়ে থাকে। জনমনিষ্যির দেখা পাওয়া যায় না। বুড়ো বয়সে অপ্রাসঙ্গিক আর অতিরিক্ত কথা বলার জন্য তাকে সকলেই সযত্নে এড়িয়ে যায়। জীর্ণ কাঁথার ওপরে দীর্ঘ সময়ব্যাপী একা শুয়ে থাকতে থাকতে খিদের তাড়নায় গুঙিয়ে কেঁদে ফেলে বৃদ্ধা। বিছানায় মল-মূত্র ত্যাগ করলেও, ঐ পদ্মর মুখের দিকে চেয়েই বসে থাকতে হয়, কখন সে বিছানা পরিষ্কার করে দেবে! দুলাল আর পদ্ম সারাদিন পেটের দায়ে দুটো পয়সার জন্য ঘুরে বেড়ায়। ছেলেমেয়েরা সব পড়াশোনা করে। পাড়া বেড়াতে বেরোয়। এর ঘর ওর ঘরে ঘুরে খায়। একমাত্র বৃদ্ধা বাঁধা পড়েছে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। একাকীত্বের জ্বালা, আর সেই সঙ্গে এই পেটের জ্বালা বড় কষ্ট দেয়। সময়ে-অসময়ে খিদের জ্বালায় অনেক কুকথা বেরিয়ে পড়ে বৃদ্ধার মুখ থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে ধাতব বালতির ঝনঝনানির শব্দের সঙ্গেই তীব্র এক আর্তনাদ, আর তারপরই বন্ধ হয়ে গেল বউয়ের বাক্যবাণ! শশব্যস্ত বৃদ্ধা বিছানায় শুয়েই দরজা পিটিয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল,

-ও বউ তোর কী হল? পড়ে গেলি নাকি? ও ঠাকুর! আমার পদ্মর কী হল গো! কেউ শিগগির এসো। ভরা মাস! বালতি নিয়ে বউটা পড়ে গেল মনে হয়! ও পদ্ম! রা কাড়িস না কেন রে? ও বউ!

আজ এক বাড়ির বৌদি তাড়াতাড়ি কাজে যেতে বলেছিল। ঐ বাড়ির বাচ্চাটার পাঁচ বছরের জন্মদিন। অগুনতি বাসন মেজে, দোতলা বাড়ির এতগুলো ঘরদোর মুছতে মুছতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘরে শুয়ে থাকা মানুষটার খিদে পাওয়ারই কথা! কিন্তু সাত বাড়ির এঁটো-কাঁটা ঘেঁটে, লোকের পাত কাচিয়ে চিরকালই গা কাপড় ধুয়ে স্নান করার অভ্যাস পদ্মাবতীর। নইলে ঘরে পা রাখতে মন চায় না। আজ ঐ বৌদি বাড়ির সকলের জন্য বিরিয়ানি আর মাংস দিয়েছে। সকলে একসঙ্গে বসে খাবে বলে, তাড়াতাড়ি হাতের কাজ গুছোতে চাইছিল পদ্ম। পরনের জামাকাপড়ের সঙ্গে আরও কয়েকটা জামাকাপড় কেচে স্নান করে ঘরে ঢোকার সময় পিসি শাশুড়ির কথায় মনটা এত খারাপ হয়ে গেল, যে আর সহ্য হল না। খিদেয় ওর নিজেরও পেট জ্বলছিল। বৌদি ওখানে বসেই ওকে খেতে বলেছিল। জানে বাড়িতে নিয়ে এলে ওর কপালে আর কিছুই জুটবে না! কিন্তু ঘরের বুড়িটাকে আর বাচ্ছাগুলোকে ফেলে, বাইরে কোন ভালো খাবার খেতে পদ্মর মন চায় না। স্নান সেরে উঠোনে পা রেখেই বাক্যবাণের জ্বালায় রাগে মাথা ঠিক রাখতে না পেরে, পিসি শাশুড়ির কথার প্রত্যুত্তরে কথা বলতে ব্যস্ত থাকা পদ্ম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। আর তার ফলেই ঘটে গেল এক চরম দুর্ঘটনা। বালতিটা বারান্দা থেকে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল উঠোনে। ভিজে কাপড়ে পা জড়িয়ে আছাড় খেয়ে অচৈতন্য পদ্ম পড়ে রইল সিঁড়ির ওপরে। প্রতিবেশীর ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো পদ্মর মেয়ে পূর্ণা। সাইকেল নিয়ে ঠিক তখনই টিউশন থেকে ফিরে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে কৈশোরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে। সে পদ্মর জ্যেষ্ঠ পুত্র টুকাই। সাইকেলটা কোনরকমে উঠোনে শুইয়ে রেখে মায়ের কাছে এসে, মাকে টেনে তুলল ছেলে...

কন্যা জন্মের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। হাসপাতালের শয্যায় প্রায় মিশেছিল পদ্ম। একজন নার্সদিদি এসে ওকে জিজ্ঞাসা করল,

-এই আজও তোমার বাড়ি থেকে কেউ এলো না? কাল তো ছুটি। তোমায় নিতে না এলে বাচ্চা নিয়ে তুমি যাবে কী করে?

সরকারি হাসপাতালের একটা শয্যা আঁকড়ে পদ্ম শুয়েছিল। আশেপাশের সবার বাড়ির লোক আসে, গল্প করে। সদ্যোজাত বাচ্চাকে নিয়ে হাসি-মজা করে। বাচ্চা না হলে বাড়ির লোক গর্ভবতী ভীতু মেয়েটার মাথার সামনে বসে থাকে। সাহস জোগায়। কত স্বামীদের পদ্ম দেখল, বউয়ের হাত ধরে বসে আছে। কত সোহাগ করছে! ও কেবল চেয়ে চেয়ে দেখে। এত যত্ন পদ্ম স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না। কিন্তু ঘরের মানুষটা যে একবারও ওকে দেখতে আসবে না, পদ্ম এটা ভাবতেও পারেনি! হয়তো ওকে ছাড়া ঘরে-বাইরে সামলাতে লোকটা অস্থির হচ্ছে! তাই হবে নিশ্চয়ই! একটা হাত আবার অকেজো। কোনদিকে করবে মানুষটা! বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেলল পদ্ম। বলে উঠল,

-এই মেয়েটারে কাউরে দিয়ে দেওয়া যায় দিদি? ওই যাদের বাচ্চাকাচ্চা হয় না, এমন কাউরে? আমি এরে বাড়ি নে যেতে চাই না। কোন টাকাপয়সা লাগবে না। বিককিরি করব না। কেউ নে গেলে মেয়েটা পেটপুরে দুটো খেতে পাবে! যেখানেই থাক, খেয়ে-পরে ভালো থাকলেই হল!
-কী বলছ তুমি?
-আমি আর পারছি না দিদি! আমি ওকে চাইনি। কেউ চায়নি ওকে। কত ওষুধপত্তর করেছি, কত শেকড় বাকড় বেটে খেয়েছি। জানোয়ারের মতো খেটেছি। ভারী জামাকাপড় কেচেছি। পেট চেপে ধরে বাবুদের ঘর মুছেছি। একদিনও বাবুর বাড়ির কাজে কামাই দিইনি। ভেবেছিলাম আপদ এইভাবেই বিদেয় হবে। কিন্তু কোন ওষুধ কাজ করল না। ডাক্তারবাবুর কাছে সে সময় নষ্ট করতে এলাম। দেখে ধমক দিয়ে বলল, এতদিন ঘুমুচ্ছিলে? সময় পেরিয়ে গেছে। আর হবে না। যাও যাও! আসলে আমার শরীল খারাপ ঠিকমতো হত না দিদি। আমি হবে হবে করে বসে আছি। এদিকে যে ভিতরে এসব হয়ে আছে, বুজব কী করে বলো? সবাই বলতে ঘরে টেস করে দেখি এই অবস্তা! শরীল নিয়ে আহা-উহু করলে আমার সংসার চলবে বলো? আর কী করি? নিজের শরীলের ওপর জোর করতাম যাতে বেরিয়ে যায়! কিন্তু এ আবাগি কিছুতেই বেরোল না। সবকিছুর সঙ্গে যুদ্ধ করে পোড়ারমুখী ঠিক বেঁচে গেল। তখনই আমি বুঝেছি, এ মেয়েমানুষ না হয়ে যায় না! হতভাগীর কই মাছের পেরান!
-বর্ন ফাইটার!
-সে আবার কী দিদি?
-কিছু না! তুমি মা না কী বলো তো? নিজের বাচ্চা বিলিয়ে দেওয়ার কথা একদম বলবে না। আগে ক'টা বাচ্চা?
-তিন ছেলে-মেয়ে। দুই ছেলে এক মেয়ে! টুকাই, ছোটু আর পূর্ণা।
-বর মেয়ে চায় না নাকি? একবারও বাচ্চার মুখ দেখতে এলো না যে!
-না চেয়েছিল। দুই ছেলের পর একটা মেয়েই চেয়েছিল। ওর একটা মেয়ের খুব শখ দিদি।
-শখেরও বলিহারি! তা মেয়ে যখন হয়েই গিয়েছিল, অপারেশন হয়ে যাওনি কেন?
-সেবার পূর্ণার সময় আমার শরীলটা খুব খারাপ হয়েছিল দিদি। ফোরসে করে ডাক্তারবাবু ওকে বের করে। তারপর অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমার ছোটু সে সময় মিত্তিরদের বাড়ি আম চুরি করতে গে, আমগাছ থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলে। ক'দিন ওকে নে খুব ঝক্কি গেছে। তখনো আমার লোকটা আসতে পারেনি। অপারেশনের কাগজে কে সই করবে বলো! ছেলেটার কথা ভেবে সেবার আমিও তাড়াতাড়ি ঘরে চলে যাই। তারপর কাজকম্ম শুরু হল। আর আসা হয়নি গো।
-তাই আবার কাজ সেরে একেবারে গুছিয়েই এসেছ? তা অপারেশন হয়েছ এবার? নাকি আসছে বছর আবার...
-না দিদি। এবার মঙ্গলার মা টিপছাপ দিয়েছে। হয়ে গেছি।
-তাও ভালো! দেরিতে হলেও বোধোদয় হয়েছে।
-ও দিদি, তুমি আমার একটা উপকার করবে? ও দিদি!
-কী? কী করব? ঘ্যানঘ্যান করছ কেন?
-তুমি আমারে ক'টা টাকা ধার দেবে? আমাদের কেউ নিতে আসবে না। মায়ে-ঝিয়ে নিজেই ঘরে যাব। আমার কাছে একটাও টাকা নেই। রিসকা ভাড়াটা দেবে? এখান থেকে আমার ঘর চল্লিশ টাকা ভাড়া। এতদিন আমি ঘরে নেই, ঘরে খাবার কী আছে না আছে! গিয়ে বাজার করতে হবে। তুমি আমারে ওই একশো টাকাই দিও। ও দিদি, আমি ঘরে গিয়ে এক সপ্তা পর থেকেই আবার বাবুর বাড়িতে কাজ শুরু করব। বেশি ছুটি নিয়ে শুয়ে থাকলে আমার সংসারটাও আমার মুখের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকবে গো। তুমি বিশ্বাস করে টাকাটা দাও দিদি, এই মেয়ের দিব্যি বলছি, মাইনে হাতে পেলেই তোমার টাকা তোমারে ফেরত দে যাব।
-যে মেয়েকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে, একটু আগে দান করার কথা বলছিলে, এখন টাকার জন্য তার দিব্যি কেটে কথা বলছ? লজ্জা করে না?

চুপ করে গেল পদ্মাবতী। নার্সদিদি হেলেদুলে চলে গেল অন্য শয্যার দিকে। মায়ের কোলের মধ্যে কেঁদে উঠল একরত্তি শিশুকন্যা। শুষ্ক স্তনবৃন্তটা জোর করে তার মুখে গুঁজে দিল পদ্ম। কিন্তু কন্যার কান্না আর থামে না। নার্সদিদি এসে ছোঁ মেরে পদ্মর কোল থেকে মেয়েকে তুলে, আর এক মায়ের কোলে দিল। সেই মায়ের স্তন্যপান করে একটু শান্ত হল অভাগিনী।

পরের দিন কতগুলো কাপড়চোপড়ে পুঁটুলি করে মেয়েকে জড়িয়ে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে রিক্সাস্ট্যান্ডে এসে পদ্ম বলল,

-মোছলমান পাড়ার আগের মোড়ে যাবে ভাই? ঘরে গে টাকা দেব। একটু দাঁড়াতে হবে।

রিক্সা চালক ইতস্তত করছে দেখে পদ্ম বলল,

-চলো না ভাই। সবেমাত্তর বাচ্চা হয়েছে। শরীলটা কাঁচা। ঘরের লোকটা নিতে আসেনি। বাচ্চা নিয়ে এত পথ হাঁটতে খুব কষ্ট হবে। চলো না একটু!
-নাও ওঠো ওঠো! হাঁ করে দাঁড়িয়ে না থেকে রিক্সায় ওঠো।

ঘাড় ফিরিয়ে পদ্ম দেখল ওর পিছনে সেই নার্সদিদি দাঁড়িয়ে আছে। ধমক দিয়ে উঠল সে,

-আরে ওঠো তাড়াতাড়ি। আমার মুখের দিকে কী দেখছ?

মেয়েকে কোলে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল পদ্ম। ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে দিদি মৃদুস্বরে বলল,

-দুধ হবে বলে তো মনে হয় না। নিজেরই খাওয়াদাওয়া নেই, তো হবে কী করে! শোন, বাচ্চাকে দুধ কিনে খাওয়াবে। আর নিজেও একটু ভালোমন্দ খাবে। গোটা জীবনটা সংসারের জন্য ঢেলে দিও না। কত দেখলাম তোমার মতো মেয়েমানুষ! একটা কথা মাথায় রাখো, তুমি ভালো না থাকলে, তোমার ঐ সাধের সংসার ভেসে যাবে। তুমি চোখ বুজলে বর আবার বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসবে। তখন তোমার বাচ্চাগুলোর দুর্গতির শেষ থাকবে না। আগে নিজে একটু ভালো থেকে, তারপর সবাইকে ভালো রেখো। বুঝলে? আর এই টাকা ফেরত দিতে এলে তোমার খবর আছে। যাও যাও! এই ভাই, তোমার ভাড়াটা রাখো। রিক্সা একটু আস্তে আস্তে চালাবে বুঝলে! রাস্তার যা অবস্থা! নতুন মা! কষ্ট হবে।

কান্নায় পদ্মর গলা বুজে এসেছিল। রিক্সা চলতে শুরু করামাত্রই তাড়াতাড়ি প্লাস্টিকটা সরিয়ে পদ্ম দেখল নার্সদিদিকে। সে হাসপাতালের দিকে ছুটছে। চিৎকার করে ডেকে উঠল পদ্ম,

-ও দিদি?
-কী? ও টাকা আর ফেরত চাই না। তুমি যাও। নিজের যত্ন নিও। বাচ্চার কার্ড করিয়ে সময়মতো সব ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে নেবে। মনে করে পোলিও খাওয়াবে!
-টাকার জন্য না দিদি। ওর মা বেঁচে থাকতে, তুমি আমার মেয়ের দুধের টাকা দিলে। শুধু তোমার নামটা বলো গো দিদি? মরণ পর্যন্ত আমি তোমারে ভুলব না গো!

অমায়িক হাসি হেসে নার্স বলে উঠল,

-সুরঞ্জনা!

তারপরই সে ছুটল হাসপাতালের দিকে। রিক্সা পূর্ণ গতি পেয়ে গেছে। অশ্রুসজল পদ্মর দু'চোখ। দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে আগলে রিক্সায় চেপে বসে অঝোরে কাঁদল ও। হাতের মুঠো খুলে দেখল, পাঁচশত টাকা মুঠোবন্দি হয়ে ঘামে ভিজে উঠছে। কোনরকমে ওই টাকাটা আঁচলে মুড়ে মেয়েকে বুকের ভিতর জড়িয়ে রাখল পদ্ম। মায়ের বুকের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে রয়েছে মেয়েটা। যেন কত নিশ্চিন্ত আশ্রয়! অথচ পেটে থাকতে এই জন্মদাত্রী ওকে হত্যা করার জন্য কত যুদ্ধই না করেছে! কিন্তু নিজের গর্ভধারিণীকে পরাস্ত করে একজন যোদ্ধার মতো এই অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছে মেয়েটা। কাপড়ের আঁচলে বাঁধা টাকাটা মুঠো করে ধরল পদ্ম। ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে ধীরকণ্ঠে বলে উঠল,

-সুরঞ্জনা!

রিক্সা এগিয়ে চলল আপন গতিতে। গতরাতে বোধহয় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তার দু'পাশে শুকিয়ে আসা কাদার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল পদ্ম। রাস্তার কোণে অযত্নে বেড়ে ওঠা রংবেরংয়ের বুনোফুলগুলো বুঝি এখনো সিক্ত। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে বিন্দু বিন্দু জল খসে পড়ছে রুক্ষ মাটিতে। অযত্নে ও অবহেলায় প্রস্ফুটিত বুনোফুলগুলোর ওপর কয়েকটা চঞ্চল প্রজাপতি মহানন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে...

(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট