অনুসরণকারী

রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ছবিতে ছায়া (প্রথম পর্ব)





ছবিতে ছায়া

সাথী দাস

প্রথম পর্ব





।। এক ।।
।। প্রথমা ।।
অনেক টানাপোড়েনের পর তিস্তার বিবাহ বিচ্ছেদটা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেল। তিস্তা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও, মায়ের সামনে স্থির থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। এই কঠিন সময়ে দূরে থেকেও মানসিকভাবে তিস্তার পাশে ছিল ওর প্রিয় বান্ধবী বৃষ্টি। একেবারে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ওরা দুজন হরিহর আত্মা। একে-অপরকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। এদিকে তিস্তা নিজের সহকর্মীকে বিয়ে করে সংসারী হল, আর অন্যদিকে বৃষ্টি কর্মসূত্রে চলে গেল শহরের বাইরে। দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও দুই নারীর বন্ধুত্বে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। পরস্পরের সঙ্গে মনের তাগিদে ওরা আজও একইভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে। তিস্তার ওপর মানসিক অত্যাচারের খবরটা শোনার পরও বৃষ্টি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, ওর সম্পর্কটা জুড়ে রাখার। বিয়েটাকে বাঁচানোর। কিন্তু যে মুহূর্তে ও শুনলো, পরমেশ দা'র বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের কথা, রাতের পর রাত তিস্তাকে অবহেলার কথা, তখনই ও তিস্তাকে বললো, ওখানে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। পরিবারের সঙ্গে মতবিরোধ হলে তাও যুদ্ধ করা যায়, কিন্তু ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে কখনই নয়। নিজের সম্মান হারিয়ে স্বামী কবে আবার ঘরমুখো হবে সেই আশায়, স্বামী-শ্বশুরবাড়ি আগলে পড়ে থাকাটাই একজন নারীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বৃষ্টির উষ্ণ সাহচর্যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা একাকী কাটিয়ে উঠেছে তিস্তা। জীবনের সর্বাপেক্ষা কঠিন সময়ে পাশে থাকার জন্য, প্রিয় বন্ধুর প্রতি তিস্তার মনে অনেকখানি ভালোবাসা জমা হয়েছিল। তিস্তা মনস্থির করলো, নিজের মনটাকে শান্ত রাখতে ও সাময়িক পরিবর্তনের জন্য নিজের প্রিয় বান্ধবীর কাছে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে যাবে। বৃষ্টিকে না জানিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, বেশ কয়েকদিনের জন্য মায়ের ওষুধপত্র কিনে, বাজার করে ঘরে গুছিয়ে, পিঠে রুকস্যাক চাপিয়ে একাকী বেরিয়ে পড়ল তিস্তা।
-বাবু তোমার ফোন বাজছে।
শাওনের চিৎকারে বৃষ্টির ঘুমটা ভেঙে গেল। সারারাত ধরে প্যাকিং করে শেষ রাতে শাওনের বুকে মাথা রেখে বৃষ্টি একটুখানি চোখ বন্ধ করেছিল। চোখ খুলে বৃষ্টি দেখলো ওয়াশরুমের দরজা খুলে ভিজে গায়ে উঁকি মারছে শাওন। বৃষ্টিকে উঠতে দেখে একটু উড়ন্ত আদর ছুঁড়ে শাওন বললো,
-গুড মর্নিং! দেখো কাকিমার ফোন বোধহয়। আমি একদম চুপ। বাথরুমে ঢুকে বসে থাকলাম।
প্রায় এক বছর যাবৎ সহকর্মী শাওনের সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে আছে বৃষ্টি। দু'দিকের দুই পরিবার এখনও এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছে। তাই বৃষ্টির বাড়ি থেকে ফোন এলে বা শাওনের বাড়ি থেকে ফোন এলে, অপরপক্ষ মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে ফেলে। একটুও শব্দ তখন করা যায় না। ওদের এই একসঙ্গে থাকার ব্যাপারটা অফিসের জনাকয়েক সহকর্মী জানে, আর বন্ধুমহলে একমাত্র তিস্তা জানে। বৃষ্টিকে মাঝে রেখে তিস্তার সঙ্গে শাওনের আলাপ ফোনের মাধ্যমেই। বৃষ্টির প্রেমিকের সঙ্গে তিস্তার নির্ভেজাল সখ্যতা ও হৃদ্যতা বড়ই দৃষ্টিনন্দন। শাওন বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিলে, হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রূ-যুগল বাঁকা হয়ে গেল বৃষ্টির। তারপরই ফোন ধরে হেসে ও বলে উঠলো,
-গুড মর্নিং কাজরীদি। কেমন আছো বলো? কতদিন পর তুমি ফোন করলে।
-এই তো বৃষ্টি, ভালো আছি। তবে একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। তোমার সাহায্য চাই।
-হ্যাঁ বলো না, কী হয়েছে? গলা শুনে তোমাকে খুব টেন্সড লাগছে।
-একটু টেনশনেই আছি বৃষ্টি। কয়েকটা লিগ্যাল কাজের জন্য আমি আর অর্পণ কল্যাণীর বাড়িতে যাব। প্রপার্টি ইস্যু। না গেলে প্রপার্টিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। এদিকে বনির পরীক্ষা চলছে। ওকে নিয়ে যেতে পারছি না। তুমি যদি দু'দিনের জন্য ছুটি নিয়ে ওর কাছে একটু থাকতে, খুব ভালো হত বৃষ্টি। দেখো বোঝোই তো, সবাইকে তো আর বিশ্বাস করে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া যায় না। তোমার দাদা আগেই তোমার কথা বললো। আর তোমাকে বনিও খুব ভালোবাসে...
-দি...
-প্লিজ বৃষ্টি... কোনো না শুনবো না। এটুকু তোমাকে আমার জন্য করতেই হবে।
স্নান সেরে সামনে এসে হাজির হয়েছে শাওন। নীরব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-আচ্ছা কাজরীদি, আমি দেখছি। তোমাকে কিছুক্ষণ পর ফোন করছি।
ফোনটা রাখার পর শাওন জিজ্ঞেস করলো,
-কী হল?
-কাজরীদি দিন দুয়েকের জন্য বনির কাছে থাকতে বলছে শাওন।
-তুমি বলোনি আমরা বেড়াতে যাচ্ছি?
-না। এমনভাবে বলছে, আমি বলতে পারলাম না।
-বৃষ্টি তুমি পাগল? আমরা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বসে আছি। প্যাকিং কমপ্লিট। কিভাবে তুমি এই ট্রিপটা লাস্ট মোমেন্টে ক্যানসেল করতে পারো?
-শোনো না প্লিজ!
-না শুনবো না। এতদিন ধরে প্ল্যানিং করে, অফিসে যুদ্ধ করে দুজন একসাথে ছুটি নিলাম, এবার তুমি সব ক্যানসেল করে একটা বাচ্চার গভর্নেস হতে ছুটবে! কেন কাজরীদি এখানে আর কাউকে চেনে না? তোমাকেই লাগবে?
শাওন জামা পরতে পরতে বললো,
-আমি আর কোনোদিনও কিচ্ছু প্ল্যান করব না। তুমি মানুষকে মুখের ওপর না বলতে কবে শিখবে বৃষ্টি? না বলতে শিখতে হয়। এতটাও সহজলভ্য হয়ে যেও না, যে তোমার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, সেটাও মানুষ সময়বিশেষে ভুলে যায়!
-কাজরীদিকে আমি না বলতে পারি না শাওন। অফিস পলিটিক্স, তার ওপর স্যারের নোংরা ইঙ্গিত পেয়ে জবটা যখন ছেড়ে দিলাম, হাতে তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। তখন কাজরীদিই নিজের বোনকে বলে প্লে-স্কুলের চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছিল। তারপর দিদির বাড়িতে যাতায়াত করতে করতে, বনির সঙ্গে বন্ধুত্ব। স্কুলের থেকেও কাজরীদি বেশি টাকা দিত। তাই বনির গভর্নেস হয়ে কয়েক মাস ওই বাড়িতেই ছিলাম। জবলেস অবস্থায় বাড়িভাড়া দেওয়ার মতো টাকাও হাতে থাকতো না। বাড়িতে বাবা-মাকে কী জানাতাম বলো? ভাইবোনের পড়াশোনা, ঠাম-দাদুর অসুখ-বিসুখ! ওই সময়টায় কাজরীদি আর অর্পণদা আমার জন্য অনেক করেছে। এখন আমার দিন ফিরেছে। তুমি আছো আমার জীবনে। জব আছে, হাতে টাকা আছে, সুখে আছি। কিন্তু ওই সময়টা ভুলে যাই কী করে? খুব দরকার না থাকলে কাজরীদি এভাবে হঠাৎ করে...
বৃষ্টির সামনে এসে ওর মুখটা দু'হাতে তুলে ধরে শাওন বললো,
-তার মানে আমাদের ট্রিপ ক্যানসেল। তুমি বনির কাছে যাচ্ছ, তাই তো? এই দু'দিন ছুটি আমি কী করব? ঘরের মধ্যে একা একা বসে থাকবো?
শাওনের প্রশ্নের উত্তরে নীরব বৃষ্টির দু'চোখে অকাল শ্রাবণ নেমে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরলো শাওন। সেই সময়ই হঠাৎ করে বেজে উঠলো ওদের ছোট্ট ফ্ল্যাটের ডোরবেল। দরজা খুলে খানিকক্ষণ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকে তিস্তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো বৃষ্টি।
-তিস্তা তুই!
-আসতে নেই?
-কোনো খবর না দিয়ে?
-এতদিন ধরে ডাকছিলি, আজ চলেই এলাম।
-আরে আয় আয়... ভিতরে আয়!
।। দ্বিতীয়া ।।
ফ্ল্যাটে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো কথাকলি। খুব ক্লান্ত লাগছে। ধ্রুব বাড়িতে ফিরে দৌড়াদৌড়ি করে রাতের রান্না সেরেছে। রান্নাঘরে গিয়ে কথাকলি ওকে একটু সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু গত তিনদিনের ঘোরাঘুরিতে শরীরটা ভীষণ দুর্বল লাগছিলো। কথাকলি বিছানায় গা দিতেই গর্ভের ভিতরে থাকা ছোট্ট প্রাণটা নড়েচড়ে উঠলো। পেটে আলতো করে চাপড় মেরে কথাকলি বললো,
-আমি একটু শুতে এলেই তোর নাচানাচি শুরু হয়ে যায় বল? সারাদিন তোকে নিয়ে হেঁটে চলে বেড়াতে হবে? আর তুই দোলনায় দুলবি আর ঘুমোবি? একটু দাঁড়ালে বসলেই পেটের ভিতর তোর দাপাদাপি শুরু হয়ে যায়?
-কী বলছে আমার জুনিয়র?
প্লেটে খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে ধ্রুব এসে বিছানায় বসলো। ধ্রুব পেশায় ডাকসাইটে প্রোমোটার, কথাকলি সেবিকা। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে শেষের কয়েকটা দিন কথাকলি বেশ আনন্দে আরামে ঘরেই কাটিয়েছে। কলির একাকীত্ব কাটাতে ওকে নিয়ে দিনকয়েকের জন্য বেরিয়েও এসেছে ধ্রুব। আজই ওরা ফিরেছে ফ্ল্যাটে। চতুর্দিকে জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কথাকলির শরীর আর বইছে না। ধ্রুব যতটা পারছে, নিজের হাতেই করছে। ধ্রুবর আনন্দে উজ্জ্বল মুখটা দেখে কথাকলি বললো,
-জুনিয়র বলছে, ঠাম্মি দাদুন এই সময়ে কাছে থাকলে, ওর খুব ভালো লাগতো।
মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে গেল ধ্রুবর মুখ। প্লেট নামিয়ে রেখে ভারী কণ্ঠে ও বললো,
-কলি আমি তোমায় সব দিতে পারি। শুধু এটা দিতে পারবো না। ওরা তোমাকে কোনোদিন মানবে না। কেন বুঝতে চাইছ না তুমি? সেই কবে থেকে এক জেদ ধরে বসে আছো!
-আমি প্রেগন্যান্ট, তাঁরা জানেন? একবার অন্তত তাদের বলো যে তুমি বাবা হতে চলেছ, তাঁরা ঠাম্মি আর দাদান! একবার খবরটা দাও... পরিবারে নতুন একটা মানুষ আসছে শুনলে...
-কলি ওরা আমার বাবা-মা। আমার থেকে তুমি তাদের বেশি চেনো? মানবে না। আমি চাই না, এই সময় বা পরেও তোমার মনের ওপর কোনোরকম চাপ পড়ুক। অযথা কথা কাটাকাটি, চিৎকার, আজেবাজে কথা শুনতে তোমার ভালো লাগবে? আজ নয় কাল তুমি আমার পরিবারের সামনে যাবেই। তখন তাদের সঙ্গে একবার কথা বললেই বুঝবে, আজ নিজের পরিবারের কাছ থেকে তোমাকে এই দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটা কতটা সঠিক। সেদিন তুমি নিজেই আমাকে ধন্যবাদ বলবে, যে আমি তোমাকে ওই টক্সিক ফ্যামিলি থেকে বরাবরই দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমি জানি কলি, তুমি জয়েন্ট ফ্যামিলির মেয়ে। সবাইকে নিয়ে জড়িয়ে থাকতে, হৈ-হুল্লোড় করতে ভালোবাসো। আমি মাঝে মধ্যেই সাইটে বেরিয়ে যাই। এই অবস্থায় একা থাকতে তোমার ভালো লাগে না। বুঝি আমি। মন ভালো রাখার জন্য ঘুরিয়ে আনলাম তো তোমায়। আমার বাড়িতে যাওয়ার জেদ তুমি আর কোরো না কলি, প্লিজ! ওখানে তুমি থাকতে পারবে না। ওখানে গেলে তুমি একদম দম আটকে মরে যাবে। আমি কী তোমার জন্য যথেষ্ট নই? আমার ভালোবাসায়, যত্নে, কোথাও কী কোনো খামতি আছে?
-তা নয়। তোমার চোখে বরাবরই একটা চাপা কষ্ট দেখেছি। আমাকে বিয়ে করার পর থেকে পরিবার হারিয়েছ তুমি।
-নতুন পরিবার তৈরি করে নিচ্ছি তো। আর তাছাড়া এমনিতেও আধি ঘরওয়ালিকে দেখলে আমার মনের ভিতর সারি সারি প্রজাপতি ওড়ে। তা কখন আসছে আমার শালীজি? আমি বেরোনোর আগে আসবে তো?
একটু হেসে কলি বললো,
-লিলি একটু পরেই এসে যাবে। বেরিয়ে পড়েছে। রাস্তায় আছে। কল করেছিল। ওর জন্য ওয়েট করতে বললো। তোমার সঙ্গে ডিনার করবে।
-ওকে। ও এলেই আমি খাবো। লিলি এখানে থাকলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি। তোমাকে এই অবস্থায় রেখে সাইটে যেতে একদম মন চাইছে না। কিন্তু...
-কিসের কিন্তু? কাজ তো করতেই হবে ধ্রুব। ফ্যামিলির জন্যই। আমি ঠিক থাকবো, বোন তো আসছেই।
-তিনদিন পর ফিরবো। লাস্ট চেক আপে আমাকে ছাড়াই যেতে হবে। লিলিকে সব বুঝিয়ে রেখেছি আমি। ও বুঝদার মেয়ে। বড় হয়ে যাচ্ছে, দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমি এসে যেন তোমাকে এইরকমই দেখি। জুনিয়রকে বলবে, ড্যাডা ফিরে না আসা পর্যন্ত ও যেন ওয়েট করে। হুড়মুড় করে আবার যেন বেরিয়ে না পড়ে! আমি ওটির বাইরে দাঁড়িয়ে ওর প্রথম কান্না শুনতে চাই।
-তোমার লাগেজ গুছিয়ে দিই?
-সামান্য দু-চারটে জামাকাপড় তো, ও আমিই ট্রলিতে ফেলে নেব। তুমি খেয়ে রেস্ট নাও।
ডোরবেলের শব্দে উঠে দাঁড়ালো ধ্রুব।
-লিলি এলো বোধহয়। দরজা খুলে আসি। তুমি খেয়ে নাও কলি। তোমাকে ওষুধ খেতে হবে। আমরা পরে খাচ্ছি।
কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ুয়া শালী ও জামাইবাবুর আলাপচারিতা এবং কৌতুক সম্ভাষণ কানে পৌঁছনোমাত্র, বিছানায় শুয়েও মৃদু হেসে ফেললো কলি।
।। তৃতীয়া ।।
এক কানে লাগানো ব্লুটুথে একনাগাড়ে কথা বলছিল বহ্নিশিখা। সিগন্যালের দিকে একবার চেয়ে হাতঘড়িটার ওপর দৃষ্টিপাত করলো। প্রথমে খানিক অভিমান, কান্না, তারপরই লাইনটা কেটে গেল। একটু হেসে হেলমেটের কাঁচটা তুলে দিল বহ্নি। পাশের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলো, ব্ল্যাক পালসারে বসে একজন পুরুষ সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে। পুরুষের সপ্রশংস দৃষ্টি ওর ঝকঝকে রয়্যাল এনফিল্ড থেকে শুরু করে সরু কোমরে নিবদ্ধ। মুহূর্তেই বুঝে গেল বহ্নি, বাইক ও রাইডার দুটিই তার কাছে সমান আকর্ষণের বিষয়। কারণ দুটিতেই যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। মৃদু হেসে হাত নাড়লো বহ্নি। হকচকিয়ে গেল সেই পুরুষ। প্রত্যুত্তরে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাতেও ভুলে গেল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে যখন সে বহ্নির দিকে চেয়ে হাসিমুখে হাত নাড়লো, অমনি বহ্নি হাতের ইশারায় দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালো, 'ধুর আপনাকে না মশাই!' বহ্নির দৃষ্টি লক্ষ্য করে সে দেখল, তার অপর পাশে স্কুটিতে বসে থাকা একটি মেয়ের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে বহ্নি। বহ্নির চোখের মৃদু ইশারায় সেই মেয়েটি হেসে ফেললে, পুরুষটি এদিক ফিরে দেখলো বহ্নির মুখাবয়বেও প্রশস্ত হাসি। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো মাঝখানের বাইকে বসে থাকা পুরুষ। বহ্নি সশব্দে হেসে হেলমেটের কাঁচ নামিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল...
শপিং মলের সামনে বাইকটা রেখে বহ্নি দৌড়ে ভিতরে ঢুকলো। দ্বিতীয় ফ্লোরে উঠে জামাকাপড়ের আড়াল থেকে দেখতে পেল তাকে। কতগুলো কুর্তির আড়ালে আত্মগোপন করে একমনে শপিংয়ে ব্যস্ত। সুদীর্ঘ চুলে ঢাকা পড়েছে তার পৃষ্ঠদেশ। দুটো কুর্তি হাতে তুলে নিয়ে মেয়েটিকে একটানে ট্রায়াল রুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল বহ্নি। ট্রায়াল রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি জামাকাপড়গুলো গোনার সময়টুকু পর্যন্ত পেল না। দরজা বন্ধ হতেই ঠাস করে একটা থাপ্পড় এসে পড়লো বহ্নির গালে। ওর চুল ধরে টেনে ছিঁড়ে দিতে গেলে অভিমানী মেয়েটির ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে ধরলো বহ্নি। জামাকাপড়গুলো ট্রায়াল রুমের মেঝের ওপর অবিন্যস্তভাবে পড়ে রইল। বহ্নির অতর্কিত আদর থেকে মুক্তি পেয়ে চিৎকার করে উঠলো অলকানন্দা,
-তবে আসবি না বললি যে?
-আরে তুই ডেকেছিস, আন্টি ডেকেছে। না এসে পারি?
-মিথ্যে কথা বলে কষ্ট দিস কেন আমাকে? বলতেই পারতিস, হ্যাঁ তোর কাছেই আসছি।
-অভিমান জমে থাকার পর তোকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে, তোর অভিমান ভাঙাতে ভালো লাগে তো!
-বহ্নি আর করবি না এ রকম!
-হাজারবার করবো, তারপর এভাবে আদর করে দেব। তোকে কাঁদাতে খুব ভালোলাগে।
-তাই?
-হুম! আর ভালোবাসতেও...
ট্রায়াল রুমের আয়নায় অলকা দেখলো ওর আর বহ্নির প্রতিবিম্ব। বহ্নি ওকে নিজের সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে নিয়েছে।
ওর চোখের একপাশ প্রায় ঢেকে দিয়েছে আলগা কতগুলো চুল। মাঝে মাঝে কয়েকটা চুল উজ্জ্বল সোনালী রং দিয়ে হাইলাইট করা। ঘাড় পর্যন্ত ছোট করে ছাঁটা চুলগুলো অলকার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে এলোমেলো হয়ে গেছে। বহ্নির লাজ-লজ্জার বালাই কোনোকালেই নেই। অলকা বহ্নির তীক্ষ্ণ চিবুকে নিজের সলজ্জ ঠোঁটটা মাত্র একবার ছুঁয়ে বললো,
-আর যদি আমাকে না পাস? আমার বাড়ি থেকে কোনোদিনও এই সম্পর্ক মানবে না বহ্নি। আমার আমিত্বকেই মানবে না। তোর সঙ্গে থাকতে দেবে না।বিয়ের জন্য পাগল করে দিচ্ছে। মায়ের সঙ্গে দু'বেলা ঝামেলা হয়। বারবার জিজ্ঞেস করছে, কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা! নিজেই দেখেশুনে রেখেছি কিনা! আমি সাহস করে বলতেই পারছি না, বয়ফ্রেন্ড নয়, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। ওর নাম বহ্নিশিখা। আর আমি বহ্নিকে খুব ভালোবাসি। বিয়ে বিয়ে করে মা যা শুরু করেছে...
-ওই জন্যই তো এই সুযোগে আন্টিকে একটু দেখতে এলাম। ডোন্ট ওয়ারি অলকা! উই উইল মেক ইট!
-আর তাও যদি না পাস আমাকে?
স্থির দৃষ্টিতে অলকানন্দার দিকে চেয়ে বহ্নিশিখা বলে দিল,
-আমরা কোনো ভুল করিনি।
-কাকে বোঝাবি বল? আমার মা শুনবেই না কোনো কথা!
-ভুল করছি জানার পর, বোঝার পরেও মানুষ ভুল করে অলকা। প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়ে যা নয় তাই করে ফেলে। আর আমরা তো দেখতে গেলে কিছুই করিনি, শুধু ভালোবেসেছি। আন্টিকে আমি বোঝাবো।
-বুঝবে না। আমাকে এত চাপ দিচ্ছে...
-শোন?
-কী?
-তোকে আমার চাই, মানে চাই! আর কোনোদিন এসব কথা বলবি না অলকা। তোকে না পেলে এইসব প্রেম, ভালোবাসা, সংসারের বুকে লাথি মেরে আমি নিজেও হারিয়ে যাব! একদম নিখোঁজ হয়ে যাব। কেউ খুঁজে পাবে না আমায়... তুইও না!
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বহ্নির দু'চোখে জ্বলতে থাকা আগুনের আঁচে শুকিয়ে গেল অলকার চোখের জল। মেঝেতে পড়ে থাকা হ্যাঙার আর জামাকাপড়ের স্তুপ পেরিয়ে বহ্নির বুকের উষ্ণতায় হারিয়ে গেল অলকানন্দা।

ছবি : সংগৃহীত

 

1 টি মন্তব্য:

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট