সপ্তপর্ণী
সাথী দাস
প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় পর্ব
-মা?
-এসো পর্ণা!একি!তুমি এমন স্বল্প পোশাকে?
-এ পোশাক যুদ্ধশিক্ষারই একটি অধ্যায় মা।রামেশ্বর আজ আমায় আপন লজ্জাকে জয় করার শিক্ষা প্রদান করেছে।আমি জয়ী হয়েছি।
-বেশ।রামেশ্বর আমার বিশ্বস্ত।সে কোনো সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এমন কর্ম করেছে বলেই আমার বিশ্বাস।তার দ্বারা তোমার ক্ষতিসাধন অসম্ভব পর্ণা!
-তোমার এমন ধারণা ভ্রান্ত মা!
-বিস্তারিত সংবাদ ও ঘটনার বিবরণ শুনতে আগ্রহী।তার আচরণে কি তুমি অসন্তুষ্ট?তুমি কি শিক্ষা প্রদানকালে এমন কোনো বিরূপ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছো,যা তোমার মনে এই ধারণার জন্ম দিয়েছে,যে রামেশ্বর তোমার ক্ষতি করতে পারে।মনে কোনো কুণ্ঠা রেখো না পর্ণা।বলো আমায়!
-রামেশ্বর যা করেছে,তা সৎ উদ্দেশ্যেই করেছে।আমি তার কোনোরূপ ব্যবহারে অপমানিত নই।তবে তার দ্বারা আমার ক্ষতিসাধন অসম্ভব,তোমার এ ধারণা ভ্রান্ত।আমার বক্তব্য পরিষ্কার।
-এমন বক্তব্যের কারণ?
-রামেশ্বরের শিক্ষা আমাকে সর্বদা বলে,যুদ্ধক্ষেত্রে পরম আত্মীয় ও বিশ্বস্ত জনই হয়ে উঠতে পারে বিশ্বাসহন্তা।একজন রানির সর্ববৃহৎ ভুল হলো,আপন ছায়াসঙ্গীকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা।সামান্য অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে আপন ছায়াও সঙ্গী হয় না মা।তাই রামেশ্বর দ্বারা আমার ক্ষতিসাধন অসম্ভব,এ ধারণাকে মনে আশ্রয় দেওয়া একেবারেই অনুচিত।বরং আমার মনে এ কথা কিছুটা মান্যতা পেতে পারে,রামেশ্বর দ্বারা আমার ক্ষতিসাধন একপ্রকার অসম্ভব।
-রামেশ্বর আমার অনুগামী ও মায়াকাননের বিশ্বস্ত।তার শিক্ষায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত।সে তোমায় সঠিক পথেই পরিচালনা করেছে।
-আমি তার দেওয়া শিক্ষা আয়ত্ত করার যথাসাধ্য প্রয়াস,অবিরত করে চলেছি।
-সে সংবাদ আমার অজানা নয় পর্ণা।অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার কারণে,তোমাকে অসময়ে এত জরুরি তলব করেছি।পোশাক পরিবর্তনের পর বিশ্রাম গ্রহণ করো।রাজকার্য সমাধার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে,আমি তোমার কক্ষে উপস্থিত হবো।মন্ত্রী তোমার সাক্ষাৎপ্রার্থী।রাজ্য ও তোমার ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত কিছু সুদীর্ঘ আলোচনার জন্য তুমি প্রস্তুত থাকবে।
-মায়াকাননের মহারানির আদেশ পালনে আমি সর্বদা...
-না পর্ণা।তুমি ভবিষ্যতে এই রাজ্যের রানি হলেও,সর্বাগ্রে আমার কন্যা।তোমার জন্য আমি মা,মহারানি নই।অকারণ কালবিলম্ব না করে,বিশ্রাম নাও।আমি মন্ত্রীকে নিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যেই তোমার সাক্ষাতে আগ্রহী।
নলিনীকে গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক আপন কক্ষ অভিমুখে প্রস্থান করলেন পর্ণা।একাধিক দুশ্চিন্তা রাজকন্যার মস্তিষ্কের গোপন প্রকোষ্ঠের আনাচে-কানাচে উঁকি দিয়ে যায়।মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বেই কৈশোরের বেড়াজাল ভঙ্গ করে যৌবনের রক্তিম সীমানায় পদার্পণ করেছেন সপ্তপর্ণী।রাজ্যের দায়িত্ব কি এবার নিশ্চিতরূপে ন্যস্ত হতে চলেছে পর্ণার ওপরেই!নাকি কোনো বহিরাগত শত্রুর আক্রমণের গোপন সংবাদ গুপ্তচর কর্তৃক মায়ের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে!স্নানাদি সম্পন্ন হওয়ার পর আপন কক্ষ সংলগ্ন উপরিভাগের উন্মুক্ত স্থানে ইতস্তত বিচরণ করছিলেন পর্ণা।অদূরেই তার স্বপ্নের একটুকরো মায়াকানন।আপন পরিচর্যায় নিজহস্তে নির্মিত শৌখিন একফালি বাগান।দুর্ভেদ্য নিবিড় অরণ্যানীর প্রতি,বরাবরই এক অমোঘ আকর্ষণ মনের গোপনে প্রতিপালন করেন পর্ণা।কিন্তু পিতার অপমৃত্যুর কারণে মায়ের কঠিন নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে,ওই অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করার স্বপ্নপূরণ সম্ভব হয়নি।সেই যন্ত্রণা স্তিমিত করার অভিপ্রায়ে,মায়ের কাছে আপন হস্তনির্মিত একটি ক্ষুদ্র বাগানের আবদার রেখেছিলেন বালিকা।অনতিবিলম্বেই পেয়ে যান কাঙ্খিত সেই উপহার।রং-বেরংয়ের ক্ষুদ্র লতানো গাছগাছালি হতে সুবৃহৎ মহীরূহ,সকলেই পর্ণার ওই সবুজ সংসারে নির্বিরোধে সহাবস্থান করছে।তবে পর্ণা মনপ্রাণ উৎসর্গ করেছেন ওই দুর্ভেদ্য মায়াকাননকে।সুউচ্চ হিমশৈল পর্বতের পানে চেয়েছিলেন পর্ণা।সমুদ্রদয়িতা রুদ্রাণীর বক্ষমাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রবল আশায়,অবাধ্য মন বৃথা আস্ফালন করে।কল্লোলিনীর পার্শ্ববর্তী অরণ্যপথ ধরে ওই পর্বতের পাদদেশে পৌঁছতে বড় সাধ জাগে।ওই যাত্রাপথে অগ্রসর হতে গেলে বুঝি হিংস্র পশু,বিষাক্ত কীটপতঙ্গ ও অজানা অসুখের সঙ্গে সখ্যতা আবশ্যক।না জানি কতশত আশ্চর্য রহস্যে আবৃত ওই মায়াকানন!!ওই নিবিড় বনানীর সর্বাপেক্ষা গভীরতম অংশে হয়তো,
কোনোকালেই প্রবেশ করেনি সূর্যালোক।লোকমুখে প্রচারিত সহস্রাধিক উপমায় কলুষিত ওই অভিশপ্ত অরণ্য।পর্ণা জানেন,এ সকল গল্পকথাই মনুষ্যসৃষ্ট।রাজ্যবাসীকে ওই অঞ্চল থেকে দূরে রাখার অভিপ্রায়ে রাজপরিবারের কুটিল চক্রান্তের ফল,এইসকল মনগড়া অলীক কাহিনী।হয়তো ওই মায়াকাননের আড়ালে আপনাকে অনাবিষ্কৃত রেখেছে,কোনকালে সূর্যরশ্মির সান্নিধ্য না পাওয়া কোনো অদ্ভুতদর্শন প্রাণী,কিম্ভুতকিমাকার পতঙ্গ,প্রাণীখাদক লতানো বৃহদাকার সুদর্শন উদ্ভিদ।পৃথিবীর সেইসকল অদ্ভুত সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছে,তাদের অজানা কাহিনী স্বচক্ষে দর্শনের হেতু আকুল হয় পর্ণার অত্যুৎসাহী চঞ্চল মন।সাধ জাগে পাহাড়ি ঝর্ণায় অবগাহন করে সিক্ত হৃদয়ে ছুটে যেতে ওই প্রতিবেশী রাজ্যে।জানতে বড় ইচ্ছে হয় দূরে ওই পর্বতের পাদদেশে যে অজানা রাজ্য অবস্থিত,কেমন তাদের জীবনযাত্রা!কেমন তাদের বাচনভঙ্গি!তারাও কি পর্ণার মতোই রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজপরিবারের কারণে,কর্তব্য নামক সোনার শৃঙ্খলে বন্দী!!রহস্যবিমুখ এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রানি ভ্রমণপিপাসু পর্ণা মনের গহীনে প্রতি মুহূর্তে প্রতিপালন করতে থাকেন মায়াকাননের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করার,এক অদম্য লিপ্সা....
-রাজকন্যা!রানিমা আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।আপনাকে কক্ষে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।সঙ্গে মন্ত্রীবর উপস্থিত।সেনাপ্রধান রামেশ্বর মহাশয়ও।জরুরি তলব!
-এই ক্ষণে আসছি!
মায়াকানন ও হিমশৈলর প্রতি অন্তিমবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করে,আপন কক্ষ অভিমুখে যাত্রা করলেন পর্ণা....
-পর্ণা!তোমার শিক্ষাগুরু,মন্ত্রী ও রামেশ্বরের সঙ্গে সামান্য আলোচনার মাধ্যমে আমি এ বিষয় পূর্বেই অবগত হয়েছি,তুমি এ রাজ্যের দায় ও দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত হয়েছো।তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ।যে সামান্য বিঘ্ন ছিলো,তাও এক পক্ষকাল পূর্বেই অতিক্রান্ত।ভগ্নস্বাস্থ্যের বিবিধ কারণে আমার দ্বারা নিয়মিতভাবে রাজকার্য চলাকালীন রাজসভায় উপস্থিত থাকা সম্ভবপর হচ্ছে না।এমতাবস্থায় আমি চাই,মায়াকাননের যাবতীয় দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিয়ে দায়মুক্ত হতে।পরবর্তীতে আমি তোমার জন্য বিশিষ্ট কয়েকটি রাজ্য হতে,সমস্ত শর্ত প্রদানপূর্বক সম্মানীয় রাজপুত্রদের স্বয়ম্বরের কারণে এ মায়াকাননে আমন্ত্রণ জানাতে ইচ্ছুক।এ বিষয়ে তোমার কোনো বক্তব্য থাকলে,কালবিলম্ব না করে এই মুহূর্তেই উত্থাপন করার নির্দেশ দিলাম।
-তুমি যদি আমাকে রাজ সিংহাসনের উপযুক্ত মনে করো,শিক্ষা,রাজনীতি,কূটনীতি,নৃত্যকলা ও রণনীতি বিষয়ক সকল প্রকার পরীক্ষায় আমি যদি সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারি,তবে এ গুরুদায়িত্ব আপন কাঁধে বহন করতে আমি প্রস্তুত।পরীক্ষার শুভদিন স্থিরপূর্বক,অগ্রিম সংবাদ প্রেরণের আর্জি সকলের সম্মুখে রাখছি।
-এমনটাই আশা করেছিলাম আমি।
মাথা নত করে মাকে সম্মান জানালেন পর্ণা।
-মন্ত্রী?
-আদেশ করুন রানি!
-এক পক্ষকাল পর মহাভৈরবীর পূজাকেন্দ্রিক পবিত্র উৎসবের আয়োজন করুন।রাজ্যবাসীকে এ বিষয় অবগত করুন,তারা শীঘ্রই পর্ণাকে আপন রানিরূপে রাজ সিংহাসনে পেতে চলেছেন।এ আনন্দ সংবাদ রাজ্যের সমগ্র প্রান্তে অবিলম্বে প্রেরণ করুন।রামেশ্বর,রাজকন্যার পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে যাবতীয় কার্যকলাপের দায়িত্ব তোমার।নিখুঁতভাবে আয়োজন করার নির্দেশ রইলো।
মাথা নত করে চলে গেলেন রাজমন্ত্রী ও রামেশ্বর।নলিনী এগিয়ে এসে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন আপন আত্মজাকে।মায়ের উষ্ণ সাহচর্যে নিজেকে বিলীন করেও,দুর্গম মায়াকাননের দিকে আকুল দৃষ্টিতে চেয়ে নীরব অশ্রু বিসর্জন করলেন পর্ণা....
-সই!বিষণ্ণ কেন?
-রাজ্যভার আসছে।
-তবে আর কি তোমায় সই বলে ডাকা চলবে না!ওই আদুরে সম্বোধনে কি রানিমা নিষেধাজ্ঞা জারি করবেন?এবার তো তবে তুমি আমাদের মহারানি!
কৃত্রিম মায়াকাননের একটি সুবৃহৎ মহীরূহের ছায়াতলে পর্ণা বসেছিলেন বৃন্দার সঙ্গে।দুই সখীর আলাপচারিতার প্রারম্ভেই কলকাকলির নিখাদ প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলো,শাখা-প্রশাখায় বসবাসকারী অসংখ্য বিহঙ্গ পরিবার।একটি অনামী পুষ্পকে পর্ণা আপন হস্তে তুলে নিলে,সেই ফুলটিকে বৃন্দা সযত্নে স্থান দিলো রাজকুমারীর অম্বুদসদৃশ একঢাল মসৃণ চুলের ভাঁজে।হতাশ পর্ণা বললেন,
-একদিন আমি পালাবো বৃন্দা।ওই মায়াকাননের অচেনা গলিপথে।তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
অদূরেই দন্ডায়মান রাজকন্যার দুই দেহরক্ষী।আতঙ্কে শিউরে উঠলো পর্ণার আবাল্য সহচরী বৃন্দা।মাতৃপিতৃহীন এই বালিকা শিশুকাল হতেই রাজপরিবারের বিশ্বস্ত।বিনোদিনী মা নলিনীর বিশেষ পরিচারিকা হওয়ার সুবাদে,মায়ের মৃত্যুর পর এই রাজপ্রাসাদেরই সুদৃশ্য একটি কক্ষে আশ্রয় নেওয়ার সৌভাগ্য হয় বৃন্দার।পরবর্তীতে বৃন্দার পিতাও রানির কাছে আপন একমাত্র বালিকাকে গচ্ছিত রেখে,মৃত্যুর আহ্বানে সাড়া দেন।প্রায় সমবয়সী হওয়ার কারণে,পর্ণা ও বিনোদিনীর মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর সখ্যতা।একইরকমভাবে শিক্ষাপ্রদান করা হয় বৃন্দাকেও।অভিন্নহৃদয় দুই সখী আপন সুখ-দুঃখ পরস্পরের কাছে প্রকাশ করে,কিঞ্চিৎ স্বস্তিলাভ করে।কিন্তু পর্ণার মনের এমন হেন নিষিদ্ধ ও গোপন ইচ্ছা হৃদয়ঙ্গম করে,যারপরনাই ভীত হলো বিনোদিনী।
-ধীরে বলো!তোমার দেহরক্ষীর কানে প্রবেশ করলে রানিমা কানে এ সংবাদ পৌঁছতে....
-যাবে তুমি?আমি যাবো সই!
-না পর্ণা!অনেক অভিশপ্ত ইতিহাস আছে ওই মায়াকানন ঘিরে,যা আমার মনে ভীতিসঞ্চারের জন্য যথেষ্ট।এই অসময়ে আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে কিছুমাত্র উৎসাহিত নই সখী।রানিমা বলেছেন,তোমার রাজ্যাভিষেক ও বিবাহের পর আমার জন্যও যোগ্য রাজপুত্তুর অন্বেষণ করবেন!এখন ওই বনে-জঙ্গলে প্রবেশ করে,দাঁতালো হাতি বা বন্য জন্তুর কবলে পড়ে,বেঘোরে মরি কি ভাবে বলো তো!এ বড়ই অনুচিত!
মৃদু হাসি ওষ্ঠের কোণে সযত্নে এঁকে পর্ণা বললেন,
-আমি যাবোই।অগ্নির পিঠে চেপে নিঃশব্দে হারিয়ে যাবো মায়াকাননে....
-এমন ইচ্ছা মন হতে একেবারে দূর করো পর্ণা।ওই জঙ্গলে নাকি এক ধূর্ত মায়াবিনীর বাস!তার কবলে পড়লে....
-তোমার মাথা!
-তুমি রাজকার্যে মনঃসংযোগ করো।অন্যথায় রানিমা রুষ্ট হবেন।
-হ্যাঁ!এমন ইচ্ছার কথা অবগত হলে মা কষ্ট পাবেন।এ বাক্য সত্য!আমি রাজকার্যেই মনোনিবেশ করবো সই।যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।এক পক্ষকাল পরেই আমার পরীক্ষা।আসন্ন এ পরীক্ষায়...
-তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ হবে।মহাভৈরবী তোমায় সহায় হোন।মায়াকানন থাকুক শত্রুমুক্ত!
কোনো প্রত্যুত্তর এলো না।অপরাহ্নের নিভে আসা সূর্যালোক স্পর্শ করলো পর্ণার চিবুক।দেহরক্ষীর বারংবার আহ্বানে রাজপ্রাসাদে ফিরলেন পর্ণা,সঙ্গে সর্বক্ষণের সঙ্গী বৃন্দা....
পূর্বনির্ধারিত শুভদিনে আয়োজিত সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভরা রাজসভায় নলিনীদেবীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন সপ্তপর্ণী।অদূরবর্তী মন্দিরে খড়্গহস্তে মহাভৈরবী রক্তচক্ষু মেলে কৃপাদৃষ্টি দান করছেন সমগ্র মায়াকাননের উপর।রানির সম্মুখে পৌঁছতেই প্রজার হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হলো রাজসভা।নলিনীদেবী সিংহাসন ত্যাগ করে দাঁড়ালেন পর্ণার অনতিদূরেই....
-রাজ্যের সকল প্রজার সম্মুখে প্রতিটি পরীক্ষায় তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ রাজকুমারী।এই রাজ সিংহাসনের যোগ্য তুমি।রাজ্যবাসী কি এই সিদ্ধান্তে কোনো দ্বিমত পোষণ করে?
নলিনীদেবীর প্রশ্নের প্রত্ত্যুতরে কেবল ভেসে এলো হর্ষধ্বনি ও পর্ণার স্তব-স্তুতি।মহানন্দে পর্ণার পানে চেয়ে রানি বললেন,
-তোমার প্রজা সাদরে গ্রহণ করেছে তোমায়।এ বিশেষ মুহূর্ত অতীতে আমার জীবনেও এসেছিলো।প্রজার এই সমাদর ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ।এর অসম্মান কাম্য নয় পর্ণা।
-আমার এ জীবন রাজ্যের জন্য সমর্পিত।
-রাজ্যাভিষেকের শুভলগ্নের পূর্বে আমি তোমার উদ্দেশ্যে অন্তিম কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই।তার যথাযথ উত্তর প্রদানপূর্বক,তুমি এই সিংহাসনে আরোহণের অধিকার অর্জন করবে।
-বেশ!
রাজপুরোহিত,মন্ত্রীবর,উপদেষ্টা,সেনাপ্রধান,রামেশ্বর,
প্রজা ও বৃন্দা কিঞ্চিৎ হতবাক হলেন নলিনীদেবীর এমন সিদ্ধান্তে।তবে মহারানি নলিনীদেবীর সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে কোনো বাক্য বলার অবকাশ বা ধৃষ্টতা কারোর মধ্যেই অবশিষ্ট নেই।শুভ সময় বয়ে যায়,তবুও রানির প্রশ্নের উত্তরের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন সকলেই....
-যুদ্ধক্ষেত্রে আপন আত্মার কাছে তোমার সর্বপ্রধান প্রতিশ্রুতি কি পর্ণা?
-আমরণ লড়াই!
-যুদ্ধক্ষেত্রে বা রাজকার্যে,কিংবা জীবনের কোন জটিল মুহূর্তে সাহায্যকারীর উদ্দেশ্যে তোমার বিচার কি?
-যুদ্ধক্ষেত্রে আমি আমার সাহায্যকারীর কাছে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত কৃতজ্ঞ,যে মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তার সাহায্যের উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করতে না পারছি।সেই মূল্য পরিশোধের পরবর্তী সময়ে,আমি তার কাছে আর ঋণী নই।ঋণশোধের পর সে আমার সাহায্যকারী নয়,পরিত্রাতাও নয়।নিতান্তই সাধারণ একজন মনুষ্যমাত্র!তার প্রতি আমার হৃদয়ে যেমন উপযুক্ত কারণ ছাড়া কোনো বিরূপ মনোভাবের জায়গা নেই,তেমনই দুর্বলতারও কোনো স্থান নেই।
-যথার্থ তোমার শিক্ষা!আমি আনন্দিত!
-আমি সম্মানিত!
-অস্ত্রাগারের অস্ত্রবল,রাজনীতি,কূটনীতি,রাষ্ট্রনীতি ও লোকবল যে স্থানে পৌঁছতে অসমর্থ,সেই ক্ষেত্রে শত্রুর বিরুদ্ধে তোমার সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র কি?
-নিরস্ত্র সপ্তপর্ণী নিজেই!
-তার কার্যকারিতা?বিস্তারিত ব্যাখ্যা আবশ্যক।
-রামেশ্বরের শিক্ষা অনুযায়ী জন্মকাল হতেই আপন অস্ত্রসহ এ পৃথিবীতে একজন নারীর আগমন ঘটে।প্রয়োজন শুধু দৈহিক লজ্জা জলাঞ্জলি দেওয়ার....দেহ আমার দুর্বলতা নয় মা,শক্তি!আর সেই....
নলিনীদেবীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে দীপ্তকণ্ঠে সমগ্র প্রশ্নের জবাবদিহি করছিলেন রাজকুমারী পর্ণা।কন্যার সামান্য অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়েই,অদূরে মেয়ের পশ্চাতে দন্ডায়মান প্রহরীর উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করলেন নলিনীদেবী।সেই মুহূর্তেই পর্ণার দিকে ধেয়ে এলো একটি সুতীক্ষ্ণ বর্শা।জাগ্রত হলো পর্ণার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।স্থান পরিবর্তনপূর্বক আত্মরক্ষা করে,নলিনীদেবীর বক্ষদিকে ধেয়ে আসা ওই বর্শা ডান হাতে ধরে,নিমেষেই বাম হাতেই আবার ফিরিয়ে দিলেন প্রহরীর উদ্দেশ্যে।প্রহরী আত্মরক্ষায় সমর্থ হলে,তার কেশাগ্র স্পর্শ করে ওই বর্শা সুনিপুণভাবে প্রোথিত হলো ধরিত্রীর বুকে।যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পশ্চাৎ হতে ধেয়ে আসা শত্রুর অনাকাঙ্খিত আক্রমণকালে কন্যার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অকস্মাৎ জাগরণ,তাদের সুনিপুণ ব্যবহার ও পর্ণার সব্যসাচী রূপ দেখে যারপরনাই আল্লাদিত হলেন নলিনীদেবী।স্মিতহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
-অন্তিম প্রশ্ন!তোমার বিচারে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি পর্ণা?
অতর্কিত বর্শা নিক্ষেপ হতে আত্মরক্ষা করে,সেই মুহূর্তে অতিকষ্টে ক্রোধ সংবরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন পর্ণা।কিন্তু মহারানির অন্তিম প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে,আগ্নেয়গিরির সহসা অগ্নুৎপাত ঘটলো।প্রবল তেজে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় কোমরবন্ধ হতে ছুরিকা উন্মুক্ত করে রণহুঙ্কার দিয়ে উঠলেন সপ্তপর্ণী,
-মৃত্যু!!বিশ্বাসঘাতকতার একটাই শাস্তি!সমগ্র রাজ্যবাসী,আমার পরম বিশ্বস্ত,আমার প্রাণাধিক প্রিয় সঙ্গী বৃন্দাসহ,মায়াকাননের সকলে জেনে রাখুন,মহারানি সপ্তপর্ণীর বিচারে বিশ্বাসঘাতকতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু!!বিশ্বাসঘাতকের কোনো ক্ষমা নেই!
রাজকন্যার এমনতর হুঙ্কারে স্তব্ধ সমগ্র রাজসভা।পর্ণা আপনার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালে,রামেশ্বর অতিশয় আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।বাক্যহারা নলিনীদেবীও।তারপরই সহসা সেইরূপ কঠোর বাক্য রানির মুখ হতে নির্গত হলো,যা কল্পনা করেই রামেশ্বরের মনে ভীতিসঞ্চার হয়েছিলো....
-পর্ণা!!মহারানি সপ্তপর্ণী কে?মহারানি কে পর্ণা?!রাজমুকুট তো এই ক্ষণেও আমার মাথার শোভাবর্ধন করছে।
-ক্ষমাপ্রার্থী মা।ক্রোধের বশে....
-অন্ধ ক্রোধ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অহংকার পতনের কারণ পর্ণা।স্বাধীন রাজ্যের একজন মহারানির এমনতর সূক্ষ মুহূর্তে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানো অনভিপ্রেত ও অত্যন্ত লজ্জাজনক।এইরূপ রূঢ়বাক্য ব্যবহারের পর ক্ষমার কোনো অবকাশই নেই।ক্রোধের বশে নেওয়া সিদ্ধান্ত কিংবা আবেগের বশে ঘটিয়ে ফেলা কোনো ঘটনার প্রভাব কেবলমাত্র তোমার ব্যক্তিজীবনের ওপর নয়,সমগ্র রাজ্যের পক্ষেই আগামী দিনে অমঙ্গলজনক হয়ে উঠতে পারে।রাজ্যের রানি স্থির মস্তিষ্কে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসমর্থ হলে,রাজ্য মুহূর্তেই হবে পরাধীন।পড়বে শত্রুর কবলে।অনতিবিলম্বেই মায়াকাননের স্বকীয়তা ধ্বংস হবে।সেই হেতু সমস্ত বিষয় বিচারপূর্বক,আমি তোমাকে এই শুভলগ্নেই রাজ সিংহাসনের অধিকার হতে বঞ্চিত করলাম।সিংহাসনের অধিকার হতে তুমি এই ক্ষণে বিচ্যুত হলে পর্ণা....
-মা!!
-মহারানি নলিনী বলে সম্ভোধন করো আমায়!আমি এ রাজ্যের রানি!!
অবনত মস্তিষ্কে নীরবতাকে আশ্রয় করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সপ্তপর্ণী।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৎপর হলেন রামেশ্বর....
-কন্যাকে ক্ষমা করুন মহারানি।কিন্তু এতবড় সিদ্ধান্ত সহসা গ্রহণ করবেন না।
-শাস্তি তোমারও প্রাপ্য রামেশ্বর।যুদ্ধশাস্ত্র পাঠ ও অনুশীলন একজন প্রকৃত রানি হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।মতি স্থির হওয়া আবশ্যক।আপন আবেগ,অহংকার,
ক্রোধ,কাম,ইচ্ছা,প্রেম,এই সমস্ত বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।পর্ণার শিক্ষার সেই অধ্যায় এখনও অসম্পূর্ণ।অপরিণত পর্ণার ওপর এই মুহূর্তে রাজ্যভার প্রদান করা সমীচীন নয়।এমন চরম মূর্খামি আমার দ্বারা অসম্ভব।এ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত!
-তবে কি রাজকুমারী পর্ণা আর এই সিংহাসনের উপযুক্ত করে নিজেকে প্রমাণ করার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ....
-অবশ্যই পাবে।আগামী দুই বৎসরকাল সময় ব্যাপী তাকে নিয়মিত যোগাভ্যাস করতে হবে।আপন মস্তিষ্কের ওপর,আপন সিদ্ধান্তের ওপর,আপন ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।উপযুক্ত সময়ে,রাজ্যের প্রয়োজনে,যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি,এমনকি শত্রুশিবিরে চতুর্দিক হতে শত্রুর ঘেরাটোপে বন্দিনী থেকেও,শীতল মস্তিষ্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রভূত ক্ষমতা তাকে অর্জন করতে হবে।অস্থিরমতি,অহংকারী অবোধ বালিকার অধীনে মায়াকাননের এই রাজ সিংহাসন কলুষিত হোক,এমনটা কাম্য নয়।দুই বৎসর সময়কাল অতীত হওয়ার পর,পুনরায় পরীক্ষাপূর্বক,পর্ণা যদি নিজেকে এই সিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে পারেন,তবেই রাজমুকুট তার মাথায় জ্বলজ্বল করবে।অন্যথায় আমি পরবর্তী রানি নির্ধারণের জন্য প্রজার কাছে উন্মুক্ত আবেদন জানাতে আগ্রহী।পর্ণা?
-আদেশ করুন মহারানি!
-মাত্র দুটি বছর সময় আছে।প্রস্তুত করো নিজেকে।
-আপনার এই সিদ্ধান্ত আমি নতমস্তকে গ্রহণ করলাম।আপনার আদেশ শিরোধার্য!
মৃদু গুঞ্জন ও বিপুল হতাশার মধ্যে দিয়ে মনক্ষুণ্ণ হয়ে,রাজসভা পরিত্যাগ করে সকল প্রজা প্রস্থান করলো আপন গৃহে।উৎসবমুখর আমেজ হলো ম্লান।পর্ণা একরাশ অভিমানকে আপন হৃদয়ে প্রোথিত করে,মায়ের আদেশপূর্বক অগ্নির পিঠে চেপে বসলেন....বৃন্দা তার সঙ্গে অগ্রসর হতে চাইলে,বাধা দিলেন পর্ণা....একাকী হারিয়ে গেলেন ধূলিঝড়ের আঁধারে....
অন্ধকার রজনী।কক্ষের উপরিভাগের উন্মুক্ত অংশে একাকিনী দাঁড়িয়েছিলেন সপ্তপর্ণী।দিগন্তবিস্তৃত নভোমণ্ডলে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলছে।সেই নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য পর্ণার শীতল অভিমানী দেহকে উষ্ণ রাখতে অক্ষম হলেও,বড়ই দৃষ্টিনন্দন।নিরালোক অন্তরীক্ষের প্রতি দুর্বল দৃষ্টি মেলে চেয়েছিলেন পর্ণা।আপন হস্ত প্রসারিত করে প্রতিটি নক্ষত্রকে কাল্পনিক রেখায় সংযোজিত করে,প্রাণদান করার বৃথা প্রয়াস করতে লাগলেন রাজকুমারী।কাল্পনিক রেখা কখনও জন্ম দিলো একটি নিষ্পাপ বানরশিশুর,কখনও বা বৃহদাকার মহীরূহের,কখনও এক রাজনর্তকীর।স্মিতহাস্যে সজল চক্ষে মহাশূন্যের চিত্রপটে আঁক কেটে,পর্ণা নিখুঁতভাবে অঙ্কন করলেন রাজ তরবারির সুতীক্ষ্ণ ফলা।পরক্ষণেই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নক্ষত্ররা জন্ম দিলো রত্নখচিত রাজমুকুটের।কল্পনার জগতে ভেসে দুই চক্ষু মুদে ওই রাজমুকুট মাথায় পরিধান করলেন রাজকন্যা।আপন ভুল সংশোধনের বৃথা প্রচেষ্টা করতে লাগলেন।অশ্রুসজল নেত্র চরম অবাধ্যতা করতে লাগলো।ক্ষীণকণ্ঠে কেঁদে উঠলেন পর্ণা।সেই চাপা ক্রন্দনধ্বনি উপলব্ধি করার জন্য,সম্মুখে একজন প্রিয়জনকেও পর্ণা পেলেন না।তিনি শূন্যদৃষ্টিতে একাকী চেয়ে রইলেন তিমির ছায়ালোকের পানে।অদূরেই মায়াকাননের সীমানায় সুবিশাল গম্বুজাকৃতি অন্তিম দুর্গসীমা দৃশ্যমান।রাত্রি জাগরণে প্রহরীদ্বয় ক্লান্ত।প্রহরী পরিবর্তনের সময় হলো বুঝি!সেনাছাউনি হতে বর্শাসম্বলিত দুটি ছায়াশরীর অগ্রসর হলো দুর্গদ্বারের পানে।দুর্গদ্বার অতিক্রম করে সুদূর দিগন্তরেখায় দৃষ্টিপাত করলেন কন্যা।নিবিড় অরণ্য যেথায় অন্তরীক্ষ স্পর্শ করেছে।গগনচুম্বী হিমশৈল পর্বতমালা ও তার পাদদেশ বেষ্টিত তমসাবৃত বনস্পতির রাত্রিকালীন সৌন্দর্য,পর্ণাকে অতিশয় মুগ্ধ করলো।মনে জাগলো একাধিক প্রশ্ন।কেন এই মায়াকাননের মায়াজালে আবদ্ধ তারা?এই রাজ্য ব্যতীত বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কেন রাজপরিবারের ঘোরতর আপত্তি!এই সামান্য পরিসরের রাজ্যের অন্দরে,বংশপরম্পরায় কেন আপনাকে বন্দিনী রাখেন মায়াকাননের রানিরা?এ রাজ্যের শিক্ষায়,শাস্ত্রপাঠে,
অভ্যাসে,অনুশীলনে...সর্বত্রই আত্মরক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন?রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার কোনো সুযোগ নেই কেন?রাজ্যবিস্তারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয় না কেন?আজ একটিমাত্র ব্যর্থতার পর শতশত ভাবনারা মস্তিষ্কের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসছিলো বাইরে।অস্থির মনে সেই সকল প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন পর্ণা।মৃদুমন্দ বাতাস পর্ণার দেহ ও উন্মুক্ত কেশাগ্র স্পর্শ করে সুদূর মায়াকাননের দুর্ভেদ্য বনানীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলো....পর্ণার উদ্বেলিত হৃদয় ওই বাতাসের পিছু-পিছু ছুটলো অজানার উদ্দেশ্যে....
-পর্ণা!
মায়ের আহ্বানে তৎক্ষণাৎ অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয়ের ওপর আপন হস্ত সঞ্চালন করে,ফিরলো পর্ণা।
-মা!
-মন অস্থির?হৃদয় অবাধ্য?আমার সিদ্ধান্তে কি তুমি আহত পর্ণা?
-না!রাজ্যের মঙ্গলের কারণে যা সঠিক,তাই গ্রহণীয়।আমি তোমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্মত।আমার কিছুটা সময় প্রয়োজন।আত্ম নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা প্রয়োজন।
-যথার্থই।মানসিক দৃঢ়তার অভাব থাকলে,রাজকার্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে।সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তোমার দুর্বল মন বিচলিত হতে পারে।এই সাময়িক ব্যর্থতাকে দুর্বলতা নয় পর্ণা,আপন শক্তি হিসেবে বিবেচনা করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।নিজেকে পুনরায় প্রস্তুত করো।আপনার মন ও রাজ্য সম্পর্কিত সকল বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়াটা....
-মা!থাক না রাজ্যের কথা।রাজপরিবারের কথা!রাজ মুকুটের কথা!প্রকৃতি কেমন সুন্দররূপে সজ্জিত দেখো!আঁধার রাতের এমন মনোরম চোখজুড়ানো রূপ আমি পূর্বে দেখিনি মা!ও কি!শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও কি প্রাণী?
দুর্গদ্বারে দৃষ্টিপাত করে রানি দেখলেন,একজন প্রহরী বলপূর্বক দুটি জীবকে সেনাছাউনির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।ব্যস্ত না হয়ে ধীরকণ্ঠে নলিনীদেবী বললেন,
-ও কোনো শম্বর দম্পতি বুঝি!ক্ষুধার্ত সেনাবাহিনীর আহারাদির উপলক্ষ্যে বন্দী!আগামীকালই ছাউনিতে নৃত্যগীতের বড় উৎসব হবে!আগুনে ঝলসানো সুস্বাদু মাংস,সৈনিকদের উদরে প্রবেশ করবে।
-মৃগ দম্পতি!!
-পথভুলে মায়াকানন ছেড়ে লোকালয়ে এসে পড়ায় এই বিপত্তি।তোমার ভাবনার কোনো কারণ নেই!অকারণে মন ও মস্তিষ্কের ওপর নির্যাতন অপ্রয়োজনীয়।
বহিরঙ্গে নির্দয়-কঠিন,অন্তরে কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী পর্ণার ব্যথিত মন,ওই অসহায় মৃগ দম্পতির মর্মান্তিক পরিণতির কথা কল্পনা করে বড়ই অস্থির হয়ে উঠলো।সেই অনুভূতি আপন হৃদয়ে গোপন রেখে,প্রসঙ্গ পরিবর্তনে সচেষ্ট পর্ণা অতিশয় কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-মা!গত কয়েক প্রহর যাবৎ কয়েকটা প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তুলছে।
-আমাকে জিজ্ঞেস করো।সম্ভব হলে আমিই তোমার কৌতূহল নিবারণের কারণে সেই প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করবো।
-ওই মায়াকাননের অভ্যন্তরে মনুষ্যবসতি নেই কেন?ওই অরণ্য কি সত্যিই অভিশপ্ত?নাকি এ কেবল লোকমুখে প্রচারিত!মা আমরা রাজ্যবিস্তারের কথা কখনও ভাবি না কেন?কূপমন্ডুকের মতো একটিমাত্র রাজ্যে....
-এই সমস্ত প্রশ্নের একটাই মাত্র উত্তর কন্যা!
-কি!
-সপ্তপর্ণী!
-আমি এইসকল প্রশ্নের উত্তর!অর্থাৎ?
-মাত্র দুশো বছর আগেও এ রাজ্যের রূপ সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ছিলো।সেই সময় পর্যন্ত মায়াকাননের রাজ সিংহাসন কোনো নারীর স্পর্শ লাভ করেনি।কিন্তু আমাদের রাজপরিবারের এক পূর্বপুরুষের অনাবশ্যক জেদের কারণে ধ্বংস হয়ে যায় মোহরকুঞ্জ।
-মোহরকুঞ্জ?
-এই মায়াকাননের পূর্বনামই মোহরকুঞ্জ!
-মোহরকুঞ্জ মায়াকাননে রূপান্তরিত হলো কিরূপে?
-দীর্ঘ সে কাহিনী!
-আমি জানতে আগ্রহী মা....
কৃষ্ণকায় দুর্ভেদ্য মায়াকাননের পানে ভীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মহারানি নলিনীদেবী শুরু করলেন,মোহরকুঞ্জের অতীত বৃত্তান্ত....
(চলবে)
ছবি : সংগৃহীত
দিদি তোমাকে যা বলব কম পরে যাবে। সপ্তপর্নীর রহস্য জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ
উত্তরমুছুনDarun
উত্তরমুছুন......
Darun
উত্তরমুছুনKhub valo lagche....khoma korben tobe aapnar onnyo golpogulor theke beshi valo lagche...chaliye jan....aapnar ebong aapnar kolomer sustho dirghayu kamona kori...
উত্তরমুছুনকি টাইমিং গো। একেবারে ক্লাইম্যাক্সে এসে কলম থামাও।
উত্তরমুছুনAsadharon di...
উত্তরমুছুনApurbo
উত্তরমুছুনKal porte pari ni sarir kharap chilo. Ei pora sesh korlam. Mon bhore gelo pore. Apurbo r Asadharon laglo.
উত্তরমুছুনWow
উত্তরমুছুনDarun....🖤✨
উত্তরমুছুনBhison sundor...
উত্তরমুছুন