অনুসরণকারী

বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

সপ্তপর্ণী (প্রথম খণ্ড) প্রথম পর্ব


 


সপ্তপর্ণী


সাথী দাস


প্রথম খণ্ড

প্রথম পর্ব



দুর্ভেদ্য অরণ্য পেরিয়ে সুউচ্চ পর্বতমালাবেষ্টিত যে মায়ারাজ্য অবস্থান করছে প্রায় পাঁচ শতাধিক বৎসরেরও অধিক সময়কাল ধরে,সেই রাজ্যের বর্তমান নাম মায়াকানন।তিনদিক হতে মায়াকানন দ্বারা বেষ্টিত এই রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত গগনচুম্বী হিমশৈল পর্বতমালা।লোকমুখে বহুল প্রচারিত,পূর্বে মায়াকানন যখন তার স্বাভাবিক সবুজায়ন হারিয়ে,প্রস্তুতি গ্রহণ করতো প্রবল শৈত্যপ্রবাহের জন্য,সেই সময়ে ওই পর্বতের চূড়া সজ্জিত হয়ে উঠতো শীতল শ্বেতশুভ্র হিমকণায়।তবে দীর্ঘ কয়েক বৎসর যাবৎ রাজ্যবাসী প্রবল শৈত্যপ্রবাহ ও তুষারপাতের আনন্দ হতে বঞ্চিত।বাণিজ্যের কারণে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সামান্যতম আলাপচারিতার হেতু,মায়াকাননের অভ্যন্তরভাগে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ সেতু ও কয়েকটি ক্ষুদ্র-বৃহৎ গুপ্তসাঁকো।পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে মায়াকানন আলাপে নিতান্তই অনাগ্রহী।গহীন অরণ্য,পর্বতমালা ও একাধিক দুর্ভেদ্য সবুজের সমারোহ ব্যতীত,মৃতদেহের ন্যায় শীতল প্রস্তরনির্মিত সুবৃহৎ দুর্গ শত্রুপক্ষের দৃষ্টি হতে প্রতিনিয়ত এই রাজ্যকে রক্ষা করে চলেছে।মনুষ্যসৃষ্ট দুর্গের অতীন্দ্রিয় প্রহরা ছাড়াও,উন্মত্ত-খরস্রোতা রুদ্রাণী নদী,পার্বত্য ঝর্ণা ও সুদৃশ্য জলপ্রপাত দ্বারা প্রকৃতি স্বয়ং এই মায়াকাননকে বহিরাগত শত্রুর অনাকাঙ্খিত আক্রমণ থেকে অনন্তকাল ধরে রক্ষা করছে।তবে স্বপ্নসম এই রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও খনিজ সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু সওদাগর,রাজা-যুবরাজ ও রথী-মহারথীরা পূর্বেই এই রাজ্যের অভ্যন্তরে পদার্পন করার বিপুল প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন।বংশপরম্পরায় মহারানীদের কড়া নিরাপত্তা,করজোড়ে অনুরোধ ও নির্দেশ উপেক্ষা করে কোনো পুরুষের পক্ষেই ওই রাজ্যের অন্দরমহলে,রানির অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করা সম্ভবপর হয়নি।হয়েছে ক্ষুদ্র-বৃহৎ মতান্তর, বাকবিতন্ডা ও যুদ্ধবিগ্রহ।কিন্তু বংশানুক্রমে আপন সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন সকল রানিই।সেই হেতু মেঘলোকের আড়ালে চিরকালই অনাবিষ্কৃত মায়ারাজ্য হয়েই রয়ে গেছে মায়াকানন।মাতৃতান্ত্রিক এই রাজ্যের বর্তমান রানি পূর্ণগর্ভা নলিনীদেবী।কিন্তু অত্যধিক ভীতি,অনিচ্ছাকৃত দুশ্চিন্তা ও উত্তেজনার কারণে,নলিনীদেবীর মাতৃত্বের সকল আনন্দ হয়েছে গৌণ।সুউচ্চ প্রাসাদের এক প্রান্তে একাকিনী দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের রক্তিম সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন তিনি।পরিচারিকা এসে দাঁড়ালো অনতিদূরেই....

-মহারানী!আপনি সান্ধ্য ভোজনে....

হাতের অস্থির ইশারায় সর্বক্ষণের সঙ্গিনী প্রিয় পরিচারিকাকে তখনকার মতো বিদায় দিলেন নলিনীদেবী।সমগ্র মায়াকানন সেজে উঠেছে বিদায়কালীন সূর্যের রক্তাভ আভায়।প্রাসাদের কিনারে,দুর্গের চূড়ায়,মায়াকাননকে ঘিরে প্রবাহিত হওয়া পবিত্র রুদ্রাণী নদীর চঞ্চলা ঢেউয়ের ওপরও,নিভে আসা সূর্যের ক্ষীণ ও শান্ত সৌন্দর্য বিরাজমান।অদূরবর্তী মন্দির হতে ভেসে আসছে সন্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি।মহাভৈরবীর করাল কালো হিংস্র উলঙ্গ রূপের আরাধনায় মত্ত মন্দিরের অজস্র পূজারিণী।মন্দিরে বহু ভক্তের সমাগম হয় এই সন্ধ্যারতি কালে।মৃদুমন্দ বাতাস রানিকে স্পর্শ করে পুনরায় প্রস্থান করছে অজানার উদ্দেশ্যে।উষ্ণ বাহুবন্ধনে নলিনী স্পর্শ করলেন আপন গর্ভ।অষ্টম বার গর্ভধারণের পর থেকেই বড় মায়ায় জড়িয়েছেন রানি।আপন হাতে একে-একে সাতটি পুত্রসন্তানকে হত্যা করে,অত্যন্তই ব্যথিত উনি।আপন দুই হস্ত আপনার পুত্রের রক্তেই রাঙা।প্রতিবারই প্রসূতিগৃহের অভ্যন্তরে ওনাকে শুনতে হয়েছে সদ্যোজাত পুত্রসন্তানের ক্রন্দনধ্বনি।মহারানি হওয়ার কারণে,রাজ্য ও রাজ সংবিধানকে অস্বীকার করে,রাজপরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।রাজদ্রোহ তার রক্তে নেই।তাই উনি পাষাণ হৃদয়ে আপন পুত্রদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন।সাতটি মৃতদেহের স্থান হয়েছে সবুজাভ পর্ণশয্যায়।প্রাসাদের অদূরবর্তী মায়াকাননের অভ্যন্তরে,পাথুরে মৃত্তিকার গভীরে চিরঘুম বরণ করেছে সাতটি সদ্যোজাত রাজপুত্র।মহারানির অষ্টম গর্ভের সূচনাকালে এক পূর্ণিমা রাতে কুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে রানি যখন আবিষ্ট,সেই স্পর্শকাতর মুহূর্তেও স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে নলিনীদেবী জানিয়েছিলেন,এই সন্তানও যদি পুত্র হয়,তবে একেও ধরিত্রী পরম সমাদরে স্থান দেবে আপন বুকে।বৃহদাকার সবুজ পর্ণ-আবরণ কীটপতঙ্গের দংশন থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা করবে সদ্যোজাতের প্রাণহীন দেহ।নলিনীর কথা শুনে কিছুকাল স্তব্ধ হয়ে ছিলেন পিতৃমাতৃহীন ওই পুরুষ!এই রাজ্যে ক্রীতদাসের মতোই পুরুষ ক্রয়-বিক্রয় চলে।কখনও গৃহকর্মের কারণে,কখনও সেনাবাহিনীতে বা রাজকার্যে লোকবলের প্রয়োজনে,আবার কখনও বা রাজপরিবারের অন্তর্ভুক্ত রানির বিশেষ পরিচারিকাবৃন্দের কামতৃষ্ণা নিবারণে।মহারানি নলিনীদেবী আপন স্বয়ম্বর সভার একেবারে অন্তিম পর্বে যে তিনজন যুবরাজকে নির্বাচন করেছিলেন,তাঁরা সকলেই বাক্য প্রদানের সময়কালে রানির প্রথম ও প্রধান শর্ত অস্বীকার করেন।রানিকে বারংবার অনুরোধ করেন বিবাহ পরবর্তী সময়ে তাঁদের রাজ্যে সশরীরে গিয়ে নিশ্চিন্ত ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে।মায়াকাননের প্রতি মহারানির সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য সেই রাজ্যে থেকে পালন করার,সমগ্র আয়োজন তাঁরা করতে প্রস্তুত।বুঝেছিলেন নলিনীদেবী,তাঁর মাদকীয় রূপ,যৌবনের আহ্বান ও দৈহিক আবেদনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়েই,যুবরাজ ত্রয়ীর এমন করুণ অনুনয় ও বিনয়।সেই সময় নলিনী আপন মুখাবয়বে বক্র হাসি এঁকে,সম্মানজনক ও সন্তোষজনক বাক্যের ব্যবহারে,প্রত্যাখ্যান করেন ওই তিন যুবরাজকে।এমনকি আপন রাজ্যে প্রস্থানের যাবতীয় সুব্যবস্থা করে দেন ওই তিন পাণিপ্রার্থীর।কিন্তু বিদায়ের প্রাক্কালে এক যুবরাজের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সর্বক্ষণের সঙ্গী,উপদেষ্টা এসে রাজকার্য চলাকালীন জনসমক্ষে নতজানু হয়ে আপন তরবারি নামিয়ে প্রেম নিবেদন করেন মহারানি নলিনীদেবীকে।এমনকি সম্মতি প্রদান করেন রানির সকল প্রকার শর্তে।ওই পুরুষ জানতেন,এই প্রেমে ব্যর্থ হলে এমন ধৃষ্টতা ও দুঃসাহসিকতার কারণে,যুবরাজ মায়াকাননের সর্বশেষ দুর্গদ্বার ত্যাগের পূর্বেই,এই রাজ্যের সীমানার মধ্যেই উন্মত্ত পশুর ন্যায় নির্মমভাবে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করবেন তাকে।কিন্তু পরিণাম অবগত হওয়া সত্ত্বেও,তিনি আপনাকে বিরত রাখতে পারেননি।প্রেম নিবেদনের পর মহারানি নলিনীর পানে আকুল দৃষ্টিপাত করে,উনি অপেক্ষা করছিলেন বহিষ্কারের বা মৃত্যুদণ্ডের আদেশের জন্য।কিন্তু রানির সিদ্ধান্তে যারপরনাই চমৎকৃত হয়েছিলেন ওই পুরুষ।রানি তিন যুবরাজকে আপন রাজ্য অভিমুখে যাত্রা করিয়ে,ওনাকে এক পক্ষকাল ওই প্রাসাদের অতিথিশালায় বিশেষ আমন্ত্রণ রক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন।এই এক পক্ষকাল সময়ে রাজ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সকল বিষয় অবগত হন ওই কুমার।কিন্তু তার পরেও প্রথম যৌবনে পদার্পন করা ওই কুমারের,রানির প্রতি একনিষ্ঠ প্রেমের জোয়ারে কিছুমাত্র ভাঁটা পড়েনি।উপরন্তু উদগ্রীব হয়ে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন, প্রেমের প্রস্তাবে রানির সম্মতির জন্য।সম্মতি প্রদানের পাশাপাশি,সেই শুভলগ্ন এসেছিলো অনতিবিলম্বেই।রাজপুরোহিতের পৌরোহিত্যে কুমার ও নলিনীদেবী বাক্য বিনিময় ও পরস্পরের নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মাধ্যমে,পরস্পরকে আপন নারী-পুরুষ হিসেবে স্বঘোষিত উপমায়,বিবিধ স্বর্ণালঙ্কারে সম্মানিত করেন।রানি নলিনীর জীবনসঙ্গী রূপে নবজীবন পায় কুমার।আপন রাজ্যে রাজপরিবারের দাস হয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ ব্যতীত,কুমারের কাছে ভিন্ন সদুপায় ছিলো না।মায়াকানন বড়ই আপন হয়ে উঠেছিলো কুমারের কাছে।সদ্যবিবাহিত জীবনে রানির প্রেমে ও রাজপ্রাসাদের পার্শ্ববর্তী নিবিড় যে অরণ্য,যার নামেই এই সুদৃশ্য রাজ্যের নামকরণ,সেই মায়াকানন ছিলো কুমারের প্রাণের ও প্রেমের একমাত্র স্থান।দীর্ঘ সময় ওই মায়াকাননের সবুজাভ আভায় ভ্রমণ করে,সিক্ত শিশিরভেজা ঘাসে আপন পদতল ভিজিয়ে,বা কখনও ঘোড়ার পিঠে চেপে ভ্রমণে,কুমার ব্যস্ত থাকতেন।বিবাহ পরবর্তী কয়েক পক্ষকাল অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই,অন্দরমহলে শোনা গেলো কাঙ্খিত সুখ-সংবাদ।সন্তান সম্ভবা মহারানি নলিনী।ভগ্নস্বাস্থ্যের দরুণ রানির মাতৃবিয়োগ হয়েছে বহুকাল পূর্বেই।একাকিনী নলিনী রাজ্যের সকল দায়িত্ব ও দায়ভার সসম্মানে বহন করছেন বহুকাল যাবৎ।শারীরিক দুর্বলতা ও সাময়িক অসুস্থতার কারণে রাজকার্য হলো শিথিল।রাজবৈদ্যের পরামর্শে সামান্য বিশ্রামের অভিপ্রায়ে রানি অন্দরমহলে কিছুকাল যাপনের ফলে,সিংহাসন রইলো শুন্য।রাজ্যবাসী উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো একটি সুদর্শনা ও সুলক্ষণা রাজকন্যাকে স্বাগত জানানোর জন্য।কিন্তু রাজ্যবাসীর অপেক্ষা হলো দীর্ঘতর।রানির গর্ভ সাতটি পুত্র সন্তানের লজ্জায় লজ্জিত হওয়ার পর,অষ্টম বার গর্ভবতী হলেন নলিনী।দৃষ্টির সম্মুখে পাঁচটি সুস্থ নবজাতকের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বাক্যহারা হয়েছিলেন কুমার।কিন্তু যে রাজ্যে রানির মুখনিঃসৃত একটি বাক্য সংবিধানের সমতুল্য,সেই রাজ্যের রানির স্বামী হয়েও,স্ত্রীর পোষ্য হয়েই দিন কাটে কুমারের।বিগত কয় বছরের মধ্যেই কুমার বুঝেছিলেন,এ রাজ্যে পুরুষের প্রয়োজন কেবলমাত্র কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার স্বার্থে।রাজনীতি,অর্থনীতি,কূটনীতি এমনকি যুদ্ধবিগ্রহেও নারীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।স্তব্ধ হয়েছিলেন কুমার।তবে আপন সন্তানদের পরিণতি দেখে,জীবন্ত অবস্থায় মৃত্যুর সমান যাতনা পেয়েছিলেন তিনি।রানির অষ্টম গর্ভাবস্থায় যখন একজন মায়ের মুখে পুনরায় শুনেছিলেন অনাগত সন্তানের ভবিতব্য,কুমার আর সইতে পারেননি।দক্ষ অশ্বারোহীর ন্যায় ঘোড়ার লাগাম ধরে রাতের অন্ধকারেই কুমার অদৃশ্য হয়ে যান দুর্গম মায়াকাননের অভ্যন্তরে।বিস্তর অন্বেষণের পর ফিরে পাওয়া যায় আরোহী বিহীন ঘোড়াটিকে।কিন্তু কুমার হয়ে যান নিরুদ্দেশ।রাজ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তার কারণে সীমানার বাইরে অধিক অন্বেষণ সম্ভবপর না হওয়ায়,অন্বেষণ কার্য কিঞ্চিৎ শিথিল হয়েছিলো।অতঃপর কুমারের জন্য দুশ্চিন্তায় যখন রানীর স্বাস্থ্য অতিশয় ভগ্ন,সেই সময় দুর্গম জঙ্গলের ভিতরভাগ হতে আবিষ্কার করা হয় কুমারের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ।সেই ছিন্নভিন্ন পুরুষদেহ সম্পূর্ণরূপে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।বন্য জন্তুর ক্ষুধা নিবারণের কারণে,দেহের বেশিরভাগ অংশই হয়েছিলো অদৃশ্য।মৃতদেহের বাম হাতের অনামিকায় নলিনীদেবী কর্তৃক প্রদত্ত 'নলিনী' নামাঙ্কিত একটিমাত্র বহুমূল্য অঙ্গুরীয়র কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,এই মানুষই রানির প্রাণপুরুষ।গর্ভাবস্থায় এমন হেন একটি দুঃসংবাদেও ভেঙে পড়েননি নলিনীদেবী।স্বভাবসিদ্ধ চারিত্রিক দৃঢ়তায় আগলে ধরেছিলেন আপনার গর্ভ।দুর্বল মনকে প্রস্তুত করেছিলেন।অন্তরে-অন্তরে ক্রুররূপে হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন আপন অনাগত পিতৃহীন সন্তানের হন্তা।মনের গহীন চলছিলো শতাধিক রাজনীতি ও কূটনীতি।মায়াকাননের সংবিধান অনুসারে রাজরক্ত যে নারীর শরীরে প্রবাহিত হবে,একমাত্র সেই হবে রাজসিংহাসনের উত্তরসূরী।দুর্ভাগ্যবশত রানি যদি কন্যাসন্তান ধারণে অক্ষম হন,বা মৃত সন্তান প্রসব করেন,অথবা কোনো দুর্ঘটনায় রাজকন্যা নিহত বা আহত হন,সেইক্ষেত্রে সেই রাজকন্যা যদি নিজেকে সিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে না পারেন,তবে রাজ্যে শুরু হবে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধ।সিংহাসনের অধিকারের জন্য আপনাকে প্রমাণ করার যুদ্ধ।সাধারণ প্রজার মধ্যে থেকে যে নারী নিজেকে ওই সিংহাসনের উপযুক্ত প্রমাণ করতে সমর্থ হবেন,তিনি এবং বংশপরম্পরায় তাঁর উত্তরসূরীই হবেন মায়াকাননের সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী।এমতাবস্থায় স্বয়ং রাজপরিবারও নতুন রানির আশ্রয়ে জীবনধারণ করবে।চিন্তিত রাজ্যবাসী সাতটি রাজপুত্র জন্মের দুঃসংবাদের সঙ্গে,রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়েও যে মৃদু গুঞ্জন শুরু করেছে,সেই সংবাদ ছদ্মবেশী সংবাদদাতা কর্তৃক নলিনীদেবীর কর্ণকুহরেও প্রবেশ করেছে।গর্ভের অন্তিম সন্তানকে আঁকড়ে ধরে ওই সন্ধ্যায় অজস্র অশ্রু বিসর্জন করলেন নলিনীদেবী।অত্যন্তই ভীত হয়ে পড়লেন শুন্য সিংহাসন ও রাজ্যের চরম অরাজক অবস্থার কথা কল্পনা করে।ইতিহাস মিথ্যে বলে না।যে পারিবারিক লোকগাথা শুনে নলিনীদেবী নিজেও শৈশব ও যৌবনকাল পেরিয়ে এসেছেন,তা অবশ্যই সত্য হবে।অষ্টম গর্ভের এ সন্তান কন্যা না হয়ে যায় না!নতুবা....আর চিন্তা করতে পারেন না রানি।অদ্ভুত এক মানসিক অস্থিরতায় দেহ শিথিল হয়ে পড়ে।ঘনঘোর সন্ধ্যা নামলো মায়াকাননে।দূরের দুর্ভেদ্য অরণ্য থেকে ভেসে আসছে অজানা হিংস্র পশুর কোলাহল ও কর্কশ কেকাধ্বনি।পরিচারিকার বারংবার আহ্বানে আপন বিলাসবহুল কক্ষে প্রবেশ করলেন রানি....

এক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হলে,তীব্র উষ্ণতার পর রাজ্যের আকাশে ভারী মেঘের ঘনঘটা।প্রথম বর্ষার আগমনে প্রকৃতি সজ্জিত অনন্য রূপে।ঘন কালো দৈত্যের ন্যায় মেঘমালা সারি দিয়ে অগ্রসর হয় রাজপ্রাসাদের দিকে।বর্ষার প্রারম্ভে প্রথম বৃষ্টির স্পর্শে উত্তাল রুদ্রাণী নদী।ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে দুর্দমনীয় চোরাস্রোত আছড়ে পড়ছে জলের উপরিভাগে।নদীর দুকূল প্লাবিত।ঝড়ের প্রবল উন্মাদনায় মহাভৈরবীর মন্দিরের ঘন্টা সশব্দে দোদুল্যমান।নগরের উপকণ্ঠে গৃহস্থের লণ্ঠন প্রায় নিভে এসেছে ঝড়ের দাপটে।মৃত্যুপুরীর মতো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে নিমজ্জিত সমগ্র মায়াকানন।সবুজ অরণ্যের সুবিশাল বৃক্ষরাজি উন্মাদ হস্তিনীর ন্যায় প্রবল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে পরস্পরের উপর।বিকট শব্দে সমূলে উৎপাটিত অজস্র প্রাচীন বৃক্ষ।একাধিক নীড়হারা বিহঙ্গ কিঞ্চিৎ আশ্রয়ের সন্ধানে দিশেহারা।ঝড়ের প্রকোপে ও রুদ্ররূপী প্রকৃতির তান্ডবে,মহারানির তীব্র ক্রন্দনধ্বনি বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে মর্মান্তিক প্রসববেদনা সহ্য করে প্রসূতিগৃহের কঠিন শয্যা আঁকড়ে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছেন মহারানি নলিনী।তীব্র যন্ত্রণায় উনি ধরলেন প্রৌঢ়ার শীতল হাত....আর্তস্বরে বললেন,

-মা!আর যে সইতে পারি না।আমার মৃত্যু অবধারিত!
-না মা!আমি নিশ্চিত।এ সেই!উত্তাল প্রকৃতি জানান দিচ্ছে তারই আগমনবার্তা।আপনি তাকেই জন্ম দিচ্ছেন,যে ইতিহাস সৃষ্টি করবে।একটু কষ্ট তো হবেই রানিমা!সব শুভ হবে।আর স্বল্প অপেক্ষা,সামান্যই যাতনা....

উন্মত্ত প্রকৃতির ভয়াল রূপের সঙ্গে পরিচিত হয়ে,মায়াকাননের হিংস্র প্রাণীসকল আশ্রয় নিয়েছে অরণ্যের সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থানে।হিংস্র পশুর সদ্যোজাত শাবকগুলি ক্রীড়াকর্মে দিয়েছে সাময়িক বিরতি।মাতৃদেহের উষ্ণতায় আশ্রয় নিয়ে,ভয়ার্ত চক্ষু মেলে কম্পিত হৃদয়ে দেখছে প্রকৃতির এই তান্ডবলীলা....

-মা গো!
-আর কিছুক্ষণ মা!

বাতাসের দাপটে প্রসূতির কক্ষের সমস্ত আলো প্রায় নিভন্ত।পরিচারিকা একটিমাত্র আলো আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কম্পিত কলেবরে।ছায়াঘেরা পরিবেশে গর্ভযন্ত্রণায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলো ঘর্মাক্ত নলিনীর।অভিজ্ঞ প্রৌঢ়া মায়ের নাড়ি ছুঁয়েই বুঝলেন,দীর্ঘ সময়কাল যাবৎ এ যাতনা রানি সইতে পারবেন না।দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন উনি।অন্তিমবারের মতো আর্ত-চিৎকার ভেসে এলো নলিনীদেবীর কন্ঠ চিরে।অতঃপর কেবল মায়ের গোঙানির শব্দ ও শিশুর ক্রন্দনধ্বনি বিরাজ করলো ওই কক্ষে।সন্তানকে মাতৃগর্ভ হতে পৃথক করতে,ধারালো ক্ষুর হাতে প্রস্তুত হলেন প্রৌঢ়া....

প্রবল রক্তক্ষয় স্বীকার করে,নিতান্ত ভগ্নস্বাস্থ্যেই ওই প্রৌঢ়ার সাহায্যে অষ্টম সন্তানের জন্ম দিলেন মায়াকাননের মহারানি।ইতিমধ্যেই তীব্র যন্ত্রণায় বার দুয়েক মূর্ছা গেলেন রানি।অতঃপর পরিচারিকার তৎপরতায় জ্ঞান ফিরলে ক্ষীণস্বরে জানতে চাইলেন ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত নলিনীদেবী,

-ধাই মা!কি হলো?দেখালে না?এবারও কি পর্ণশয্যা?আবারও মৃত্যু মা?বলো না!সব হারিয়েছি আমি?

রানির জ্ঞান ফিরতেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন সেই প্রৌঢ়া।রাজপ্রাসাদের আনাচে-কানাচে বেজে উঠলো শঙ্খধ্বনি।রক্তেস্নাতা একরত্তি কন্যাসন্তানকে রানির পাশে রাখলেন প্রৌঢ়া।

-রানি!এই সেই কন্যা,যার জীবনের মূল্য সাতটি পুরুষ নিজের জীবন দিয়ে পরিশোধ করেছে।পর্ণশয্যা আর নয় রানি!

দুর্বল দেহে শয্যা থেকে সামান্য উঠে আপন সন্তানকে বক্ষমাঝে জড়িয়ে কেঁদে ভাসালেন নলিনীদেবী।আপন কুমারকে,এমনকি সাতটি পুত্রের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে সবেধন নীলমণি এই একটিমাত্র কন্যাসন্তান লাভ করেছেন উনি।রানি আদরে-সোহাগে ভরিয়ে দিলেন তাকে।রাজকন্যার ক্রন্দনধ্বনিতে তখন মুখরিত প্রাসাদের চতুর্দিক।কন্যার শুষ্ক কণ্ঠে মাতৃসুধা ঢেলে দিলেন রানি।কান্নার রেশ স্তিমিত হলো নবজাতিকার।ঝড়বাদলের রাতের অন্তিম প্রহরে,প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা উপেক্ষা করে ওই সুসংবাদ রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো দাবানলের মতো।নবাগতার ক্রন্দনধ্বনিকে ছাপিয়ে গেলো রাজ্যবাসীর হর্ষধ্বনি।পর্ণশয্যারূপী অভিশপ্ত ভবিতব্যকে পরাজিত করে,সাতটি পুরুষের সমান তেজ সমৃদ্ধ একমাত্র রাজকন্যাকে মহাসমারোহে গ্রহণ করলেন রাজ্যবাসী।জন্মলগ্নের দুই পক্ষকাল পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সেই শিশুকন্যার নামকরণ করা হলো,রাজকন্যা সপ্তপর্ণী।রাজসভার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে কন্যাকে বুকের উষ্ণতায় সগৌরবে জড়িয়ে বসেছিলেন নলিনীদেবী।অনতিবিলম্বেই রানি ও রাজকন্যা দাঁড়িপাল্লায় আরোহণ করলে,একই ওজনের সমান স্বর্ণালঙ্কার ও খাদ্যদ্রব্য রাজকোষ থেকে রাজ্যবাসীদের উদ্দেশ্যে বিতরণ করা হলো।রাজকন্যার আশীর্বাদীস্বরূপ রাজ্যবাসীর উপহারও উপছে পড়তে লাগলো রাজসভার বহির্বিভাগের নির্দিষ্ট স্থানে।কন্যাকে কোলে নিয়ে সিংহাসন অভিমুখে এগোলেন নলিনীদেবী।উন্নত হস্তে প্রজার উৎফুল্ল হর্ষধ্বনি থামাতে অনুরোধ করলেন।অতঃপর বললেন,

-রাজ্যবাসী আমার একমাত্র কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন,আমি অত্যন্তই আনন্দিত।মায়াকানন তার উত্তরসূরী পেয়েছে।রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী আজ আপনাদের সকলের সম্মুখেই রয়েছেন।কিন্তু দেহে,শিরা ও ধমনীতে রাজরক্ত থাকাই এই মায়াকাননের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।তাকে এই সিংহাসনের উপযুক্ত হতে হবে।নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে হবে।তবেই সে এই গুরুদায়িত্ব পালনের অধিকার পাবে।ওই রাজমুকুটের ভার বহন করার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।তার জন্য আজ এই শুভলগ্ন থেকেই শুরু হবে তার প্রথম প্রশিক্ষণ।তার যুদ্ধবিদ্যার জন্য সেনাপ্রধান,পুঁথিগত বিদ্যার জন্য শিক্ষাগুরু,নৃত্যকলার জন্য সুদক্ষ নর্তকী এবং রাজনীতি ও কূটনীতি শিক্ষার জন্য আমি রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও উপদেষ্টাকে এইক্ষণ থেকে নিয়োগ করছি।অবসরে রাজকন্যার মনোরঞ্জনের জন্য বিদূষক রূপে বৃহন্নলা সম্প্রদায়কে নিযুক্ত করা হলো।রাজকার্যে আমি অতিশয় ব্যস্ত থাকার কারণে,রাজকন্যার সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হবেন তার ধাই মা,রাঙা মা।এছাড়াও রাজকন্যার সুরক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন দুজন সশস্ত্র দেহরক্ষী।ঘোড়াশালের সহিস কিছুকাল পর তার সর্বাপেক্ষা তেজী ঘোড়াকে প্রস্তুত করবে রাজকন্যার প্রশিক্ষণ প্রদান হেতু।আজকের এই শুভ মুহূর্ত হতে রাজকন্যা সপ্তপর্ণী যেদিন বালিকা থেকে নারীত্বের সম্মানে উত্তীর্ণ হবেন,সেই শুভক্ষণে এই রাজসভায় রাজ্যের সমস্ত প্রজার সম্মুখে হবে অর্জিত শিক্ষার ভিত্তিতে তার জীবনের সর্বপ্রথম পরীক্ষা।সেই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলে,মায়াকানন পাবে তার যোগ্য মহারানি।সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি,তোমাদের বর্তমান রানি,যাকে তোমরা মা বলেই জানো,দায়িত্বে রইলাম এই সিংহাসন তথা রাজ্যের।রাজ্য অভিভাবকহীনা নয়,সিংহাসনও নয়।রাজ্যবাসীর আশঙ্কার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।আমি আছি সকলের জন্য।সকলে নিঃসঙ্কোচে আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিন।আহারকার্য সমাধাপূর্বক মহানন্দে আপন গৃহে প্রস্থান করুন।সূতীক্ষ্ণ তরবারি হাতে বিনিদ্র রাত্রি জাগরণে অতীন্দ্রিয় প্রহরায় রানি ও রাজকন্যা আপনাদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন।রাজ্যবাসী নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে আমোদ-প্রমোদে জীবন কাটাতে ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন।রাজকন্যা সপ্তপর্ণী এই শুভলগ্নে,সর্বসমক্ষে পবিত্র রাজ-তরবারি স্পর্শ করে রাজধর্ম পালনে নিজেকে উৎসর্গ করবেন।

যুব সেনানায়ক রামেশ্বর সুদৃশ্য রূপার রেকাবিতে লাল মখমলের ওপর শায়িত রাজ-তরবারি নিয়ে গেলেন রানির সম্মুখে।সেই তরবারি স্পর্শ করলো ঘুমন্ত শিশুকন্যার সুকোমল অঙ্গুলি।তরবারির শীতল স্পর্শে সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায় সুতীব্র তেজে কেঁদে উঠলেন রাজকন্যা সপ্তপর্ণী।সেই ক্রন্দনধ্বনিকে ভবিষ্যৎ রানির আদেশস্বরূপ শিরোধার্য মনে করে,প্রবল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়লো মায়াকাননের সুসজ্জিত রাজসভায় উপস্থিত রাজ্যবাসী....

রাজ-তরবারিকে সম্মানপূর্বক যথাস্থানে রাখতে উদ্যত হলেন যুব সেনানায়ক রামেশ্বর।অতঃপর আপন তরবারি কর্তৃক রানিকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে তাকে কোমরবন্ধনীতে রাখতে গেলে,তীব্রভাবে বাধা পেলেন তিনি।উজ্জ্বলতর একটি তরবারি দ্বারা তার তরবারিকে যথাস্থানে রাখা থেকে বিরত করা হচ্ছে....

দীর্ঘ বারো বৎসর সময়কালের সঙ্গে পরিবর্তিত স্থানও।রাজসভার পরিবর্তে রামেশ্বর উপস্থিত হয়েছে অস্ত্রপ্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে...

মৃদু হাসলেন প্রৌঢ় রামেশ্বর।রণাঙ্গনে রাজকন্যার এই আহ্বান পুনরায় স্বীকার করলেন উনি।প্রৌঢ়ের চুলে ও কানের পাশের রূপোলি আভা।তবে রামেশ্বরের ক্ষুরধার দৃষ্টি হতে সশস্ত্র শত্রুবাহিনী আপনাকে আড়াল করতে আজও অসমর্থ হয়।ভরাট ও দীপ্তকণ্ঠে রামেশ্বর বললেন,

-রাজকুমারী!আপনি ক্লান্ত।এবার বুঝি আপনি হেরেই যাবেন।কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিন পর্ণা।
-আমাকে মহারানি পর্ণা সম্বোধন করো রামেশ্বর!আমি এই মায়াকাননের মহারানি,তোমাদের সকলের রানি,সপ্তপর্ণী!

তেজদীপ্ত বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন সপ্তপর্ণী।শিরস্ত্রাণে আবৃত রাজকন্যার মুখশ্রী।পরনে আঁটো পোশাক।সূর্যের রশ্মি তরবারির ফলায় পড়ে বিচ্ছুরিত হয়ে আগুনস্ফুলিঙ্গ ঝরাচ্ছে।দ্বাদশ বর্ষীয়া বালিকার কাছে,স্নেহজড়ানো তীব্র ভর্ৎসনা শুনে মুখমন্ডলে অমলিন হাসি খেলে গেলো প্রৌঢ় সেনানায়কের।সহাস্যে উনি বললেন,

-আপনি তো এখনও রানি নন রাজকন্যা!অধিক অহংকার পতনের কারণ।এ সত্য দরাজ হৃদয়ে স্বীকার করুন,আপনি এখনও রানি হয়ে ওঠেননি।
-হয়ে যাবো।দাঁড়াও না!তখন এই তুমিই আমাকে মাথা নত করে সম্মান জানাবে।তরবারি হাত থেকে পড়ে গেলেও,আর ধিক্কার জানাবে না।
-তরবারি বা তরবারি হাতে আপনার দেহ মাটি স্পর্শ করলে,আপনি তো আর রানি হতেই পারবেন না কন্যা!
-কি!!এতবড় কথা!!
-না!এ বড় সত্য কথা!রামেশ্বর কভু মিথ্যা বলে না।
-তবে হোক যুদ্ধ!দেখা যাক,কে পরাজিত হয়!
-আমি প্রস্তুত রাজকন্যা!

বালিকার তরবারির তীব্র আঘাত প্রতিরোধ করতে লাগলেন সেনানায়ক।দ্বাদশ বর্ষীয়া রাজকন্যার চতুর রণকৌশল প্রতিবারই ভিন্নরূপে মুগ্ধ করে তাকে।কন্যার অসিচালনার প্রতিটি কৌশল বুঝে নিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগে আত্মরক্ষা করে চললেন রামেশ্বর।তারপরই তীব্রতর আঘাতে করে বসলেন প্রতিঘাত।অবলীলায় সেই আঘাত তার দিকেই ফিরিয়ে দিলেন কন্যা।হতবাক রামেশ্বর দেখলেন,কেবলমাত্র শারীরিক শক্তি নয়,তার আদেশানুসারে রাজকুমারী পর্ণা যুদ্ধ করছেন মস্তিষ্কের অপরূপ কৌশলে।প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে তার আঘাত করার কলাকৌশল।রামেশ্বর আপন পরিশ্রম,রক্তবিন্দু ও স্বেদবিন্দু দ্বারা তিলে-তিলে গড়েছেন রাজকুমারী পর্ণাকে।নাতিদীর্ঘ যুদ্ধের পরই রামেশ্বর বুঝলেন,আজ আপন শিষ্যার কাছেই পরাজিত হতে চলেছেন তিনি।যুদ্ধ চলাকালীন তার অসিচালনার যোজনা অনুধাবন করা বড়ই কঠিন।সুতীক্ষ্ণ তরবারির আঘাত কোনদিক হতে ধেয়ে আসবে,তা নির্ণয় করতে পারছিলেন না রামেশ্বর।প্রতিঘাতের সমস্ত আশা জলাঞ্জলি দিয়ে রামেশ্বর করে বসলেন পর্ণার সর্বাধিক দুর্বলতম স্থানে এক তীব্র আঘাত!নিপুণ হস্তে তরবারির শৈল্পিক চালনায় মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে খসে পড়লো পর্ণার দেহের পোশাক।দেহের উপরিভাগে রইলো কেবল স্বল্পবাস।

দুজন দ্বাররক্ষী ও পর্ণার দেহরক্ষী মস্তক ও দৃষ্টি অবনত রেখে,শানিত তরবারি হাতে রাজকন্যার আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন....

পোশাকের পানে অধিক মনোযোগ প্রদানপূর্বক আপন লজ্জা নিবারণকার্যে ব্যস্ত হয়ে,চরম ভুল করে বসলেন পর্ণা।মন সরে গেলো তরবারির আঘাত হতে।রামেশ্বর সেই মুহূর্তেই আপন তরবারির সাহায্যে রাজকন্যার মস্তক হতে ধাতব শিরস্ত্রাণ উপড়ে সশব্দে ছুঁড়ে ফেললেন।মেঘের মতো কৃষ্ণবর্ণ উন্মুক্ত চুলের রাশি আবৃত করলো পর্ণার সমগ্র পৃষ্ঠদেশ।চুলের কিয়দংশ উদ্ভিন্নযৌবনা বালিকার দেহের সম্মুখভাগের সামান্যতম অংশে আছড়ে পড়ে,খানিক লজ্জা নিবারণ করলো।টিকালো নাকের মধ্যভাগের ক্ষুদ্র স্বর্ণালঙ্কার দুলে উঠলো প্রবল তেজে।রাগে স্ফীত হলো বালিকার নাসারন্ধ্র।দু-চোখের দৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রণহীন অগ্নুৎপাত।ভ্রু-যুগলের মধ্যভাগের রাজটিকা সিক্ত হয়ে উঠলো লবণাক্ত স্বেদবিন্দুর স্পর্শে।গর্জে উঠলেন সপ্তপর্ণী....

-রামেশ্বর!!এমন দুঃসাহস!!এমন হেন অশালীন অভব্যতার জন্য আমি তোমাকে এই মুহুর্তেই ক্ষুধার্ত-উন্মত্ত-দাঁতালো বরাহের সম্মুখে নিক্ষেপ করবো!!

সেই মুহূর্তেই তরবারি ত্যাগ করে রাজকন্যার পদতলে আশ্রয় নিলো রামেশ্বর।পর্ণার অগ্নিদৃষ্টির সম্মুখে অবনত দৃষ্টিতে রামেশ্বর বললো,

-ক্ষমা করবেন রাজকুমারী পর্ণা।আমি রাজপরিবারের ভৃত্য,রানিমার এবং আপনার একান্ত অনুগত।মহাভৈরবী সকল সত্য জানেন।মনেপ্রাণে তাকে সাক্ষী মেনেই বলছি,আপনি আমার কন্যাসম এবং আপনার দেহের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র প্রলোভন বা আকর্ষণ নেই।সেইরূপ বিকৃত ও বিরূপ মানসিকতা আমার অন্তরে জন্ম নিলে,সেই মুহূর্তেই শিরচ্ছেদের জন্য আমি আপন মস্তক রানিমার পদতলে সমর্পণ করবো।তবে এই মুহূর্তে আমি আপনার শিক্ষাগুরু।আর আপনি আমার শিক্ষার সেই অধ্যায় বিস্মৃত হয়েছেন।কঠিন শাস্তি আপনার প্রাপ্য পর্ণা,আমার নয়!ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন।
-অর্থাৎ?কি সেই শিক্ষা!
-রণনীতির বিশেষ কয়েকটি অধ্যায়ের শিক্ষা।সংঘাতের বিশেষ মুহূর্তে প্রতিঘাতের অধিক আত্মরক্ষা প্রয়োজন।আঘাত কেবলমাত্র সম্মুখভাগ থেকে নয়,পশ্চাৎভাগ হতেও একইভাবে সম্ভব।সম্মুখ সমরের তুলনায়,পৃষ্ঠদেশে আঘাতের মতো কুটিল রণকৌশল সম্পর্কে আপনাকে অধিক সচেতন হতে হবে।এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই শত্রু থাকে অদৃশ্য অথবা শত্রু আপনার অত্যন্ত প্রিয়জন।ভুলবেন না কন্যা,যুদ্ধক্ষেত্রে পরম বিশ্বস্ত জনও হতে পারে আপনার বিশ্বাসহন্তা।সর্বোপরি,যে ভুলটা আপনি এই মুহূর্তে করলেন,সেই প্রসঙ্গে কথা বলি।যুদ্ধকালে শত্রু আপনার সর্বাপেক্ষা দুর্বলতম স্থানেই আঘাত করবে পর্ণাদেবী।সেই আঘাত প্রতিহত করে,মনোযোগ সহকারে আত্মরক্ষার্থে আপনাকে যুদ্ধরীতি ও কৌশল বজায় রেখে,জীবন পণ করে লড়াই বজায় রাখতে হবে।আপনি বর্তমানে শত্রুর তরবারির প্রতি অমনোযোগী হয়েছেন,এবং আপনার দৈহিক সম্মানকে প্রাধান্য দিয়েছেন।যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারির অধিক প্রাধান্য পেয়েছে আপনার সম্মান!আপনাকে অসম্মানের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিলো না রাজকুমারী।কিন্তু আপনার মতো একজন বিদূষী ও দূরদর্শী নারী,যিনি ভবিষ্যতে এই রাজ্যের রানি হতে চলেছেন,তাঁর এমন গুরুতর ভুল অশোভনীয়।এই ভুল মার্জনার যোগ্য নয়।আপনার সূক্ষ একটি ভুল রাজ্যের ও রাজ্যবাসীর বিপুল ক্ষতিসাধন করতে পারে কন্যা।যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার শত্রুর একটিই পরিচয়,সে কেবলমাত্র শত্রু!যুদ্ধ চলাকালীন সে নারী বা পুরুষ নয়।একইভাবে,আপনিও শুধুমাত্র হন্তা বা আপন রাজ্যবাসীর রক্ষাকর্ত্রী।কোনো অবলা নারী নন,যিনি আপন সম্মান রক্ষার্থে দেহ আড়ালপূর্বক যুদ্ধক্ষেত্রে নিমেষেই অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন।ভুলবেন না কন্যা,আপনি রাজপরিবারের অংশ।আপনার জীবন এই মায়াকাননের জন্য বলিপ্রদত্ত।আপনার যৌবন,আপনার দেহ,লজ্জা-সংকোচ বা সংরক্ষণের জন্য নয়।এমনকি মৃত্যু পরবর্তী আপনার সামান্য দেহাংশও কুটিল রাজনীতির অংশ।প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় শত্রুশিবিরে আত্মরক্ষার তাগিদে পুরুষ শত্রুর বিরুদ্ধে,কলাকৌশলে আপনাকে আপন দেহকেই অস্ত্ররূপে ব্যবহার করতে হবে পর্ণা।নারীদেহ আপনার দুর্বলতা নয়।তাকে কঠিন অস্ত্র করে তুলুন!লজ্জা পরিত্যাগ করুন।যে মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি মনে করবেন,আপনার দেহ কেবলমাত্র মাংসল পিন্ড,ওই দেহ আপনার দুর্বলতার কারণ হবে পর্ণা।কিন্তু যে ক্ষণে আপনি মানসিকভাবে আপনার দুর্বলতা দূর করবেন,সেই মুহূর্তে ওই দুর্বলতাই হয়ে উঠবে আপনার সর্বাধিক শক্তিশালী অস্ত্র।আপন দুর্বলতাকে আপনার শক্তিতে রূপান্তরিত করুন।মহাভৈরবী প্রতিটি নারীকে জন্মলগ্ন হতেই আত্মরক্ষার অস্ত্রসহ এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।আত্ম-অনুসন্ধান করুন,আপন সত্তাকে জানুন।লজ্জা ত্যাগ করুন।যুদ্ধশিক্ষার এই অধ্যায় পাঠ চলাকালীন আমি বহু পূর্বেই অবগত করেছিলাম আপনাকে।কিন্তু যুদ্ধকালে আপনি আমার শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছেন রাজকুমারী পর্ণা।আপন দেহের লজ্জা নিবারণে ব্যস্ত হয়েছেন।শত্রু এই সুযোগ দ্বিতীয়বার দেবে না।মস্তক হতে শিরস্ত্রাণ একাকী নামবে না,সেই সঙ্গে শত্রুর তরবারির এক আঘাতে আপনার মুন্ডখানি ধড় থেকে পৃথক হয়ে যাবে!আপনি ভুল করেছেন।আমার শিক্ষাদান ও আপনার শিক্ষা অসম্পূর্ণ।এ সংবাদ অবগত হওয়ার পর,রানিমা আমাকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না।আমি লজ্জিত!
-রামেশ্বর?
-আদেশ করুন পর্ণা!আমার জীবন মায়াকানন ও আপনার সেবায় নিয়োজিত।
-ওঠো!দৃষ্টি ফেরাও।আপন ভুলস্বীকার পূর্বক আমি পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত!
-আমার দুঃসাহস মার্জনা করুন পর্ণা।আপনি পোশাক পরিবর্তন করে আসুন।আমি এই স্থানেই অপেক্ষা করছি।অতঃপর আমরা অস্ত্রশিক্ষার অনুশীলন পুনরায়....
-তোমার দৃষ্টির সম্মুখে আমি এই স্বল্পবাসেই যুদ্ধ করবো ও জয়ী হবো।তবেই এই শিক্ষা আমার স্মৃতিতে থাকবে।
-না পর্ণা!
-রামেশ্বর!সাহায্য করো আমায়।আপন লজ্জার আবরণ ভাঙতে দাও।পুরুষের চোখে লালসা দেখেও,ক্রোধ ও লজ্জা সংবরণ করে আমাকে স্থির হতে দাও।আর তুমিই আমাকে এই শিক্ষাদানে সাহায্য করতে পারবে।আমি নিরাপদ তোমার দৃষ্টির সম্মুখে।আর আমি যদি তোমার দৃষ্টিতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করি,এই ক্ষণেই তোমার মৃত্যু অবধারিত।ওঠো!দৃষ্টি ফেরাও আমার দিকে।আমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত!দৈহিক বাধার প্রাচীর তুমিই আমায় ভাঙতে শেখাও রামেশ্বর!এ আমার আদেশ!

উঠে দাঁড়িয়ে আপন দৃষ্টি রাজকন্যার পানে ফিরিয়ে,তার উদ্দেশ্যে আরও একটি তরবারি ছুঁড়ে দিলেন রামেশ্বর।দুহাতে দুটি তরবারি শানিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন সপ্তপর্ণী।ধাতব সংঘাতের বারংবার সংঘর্ষের মাধ্যমে,শিষ্যা প্রবল দাপটে প্রতিটা আঘাত ফিরিয়ে দিতে লাগলেন আপন গুরুকে।মৃত্তিকা স্পর্শের পূর্ব মুহূর্তে দুজন সশস্ত্র প্রহরীর উদ্দেশ্যে,রামেশ্বর মৃদু ইঙ্গিতে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন।মুহূর্তেই দুপ্রান্ত হতে দুটি তীর ধেয়ে এলো সপ্তপর্ণীর দিকে।রামেশ্বরের পূর্বশিক্ষার প্রভাবে কন্যার অতিশয় সজাগ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়,বার্তা প্রেরণ করলো শ্রবনেন্দ্রিয়ের উদ্দেশ্যে।বিপদের আগাম বার্তা অনুধাবন করলেন রাজকন্যা।তৎক্ষণাৎ যুদ্ধরীতির আকস্মিক পরিবর্তনে সচেষ্ট হলেন তিনি।প্রতিঘাতের পরিবর্তে করলেন আত্মরক্ষা।দুটি তরবারি আপন দেহের দুপ্রান্তে বিদ্যুৎবেগে চালিয়ে প্রতিহত করলেন ধেয়ে আসা দুটি তীর।তীর দুটির ভগ্নাংশ সশব্দে আছড়ে পড়লো ধরিত্রীর বুকে।সম্মুখের শত্রুকে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে একই সময়ে পর্ণা ব্যবহার করলেন আপন পদযুগল।প্রবল বেগে বুকে পদাঘাত করে ধরাশায়ী করলেন আপন শিক্ষাগুরু রামেশ্বরকে।অতঃপর হাতের দুটি তরবারি একযোগে এনে পদতলে শায়িত রামেশ্বরের কণ্ঠনালী স্পর্শ করলেন।মাত্র একবিন্দু রক্তক্ষরণ হলো গুরুর কন্ঠ হতে....দূরে শোনা গেলো চলমান ঘোড়ার খুরের শব্দ ও হ্রেষাধ্বনি....

দৃষ্টি ফিরিয়ে সপ্তপর্ণী দেখলেন ঘোড়ার পিঠে চেপে ধূলিকণা উড়িয়ে আবাল্য সখী বিনোদিনীর আগমন ঘটেছে।রাজকন্যার হাত ধরেই উঠলেন প্রৌঢ় রামেশ্বর।উঠে দাঁড়ালেন তিনি....

-সই!!
-বলো বৃন্দা?অসময়ে তুমি এই স্থানে?
-রানীমার জরুরি তলব!তোমার অস্ত্রশিক্ষা কতদূর?

অনুমতি প্রার্থনায় রামেশ্বরের পানে দৃষ্টি ফেরালেন পর্ণা।

-আজকের মতো সমাপ্ত।মহারানীর আহ্বান!কোনো গুরুত্বপূর্ণ কার্যে অবশ্যই।আপনি আসুন রাজকন্যা।যুদ্ধরীতি ও নীতির বাকি অধ্যায়ের পাঠ ও অভ্যাস,আগামীকাল পর্যন্ত স্থগিত রইলো।আপনি পোশাক পরিবর্তন....
-প্রয়োজন দেখি না রামেশ্বর!আমি নগরের রাজপথ মাঝে এমন স্বল্প পোশাকেই অবতরণ করবো।এই বালিকা তোমার শিক্ষায় আজ লজ্জাহীনা।তুমি তার নারীসুলভ লজ্জা ভেঙে দিয়েছো।আর রাজ্যবাসী নারীকে অসম্মান করার শিক্ষা গ্রহণ করেনি বলেই,আমার দৃঢ় বিশ্বাস!মহাভৈরবী সহায় হোন!
-মহাভৈরবী সহায় হোন কন্যা!অক্ষত ও শত্রুমুক্ত রাখুন এই মায়াকাননকে।

মাথা নত করে সেনানায়কের অনুমতিক্রমে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র ত্যাগ করে বজ্রসম কন্ঠে আহ্বান করলেন সপ্তপর্ণী....

-অগ্নিসখ!!

অদূরবর্তী ঘোড়াশালে সহিসের তত্ত্বাবধানে মনের উল্লাসে ক্ষুধা নিবারণ করছিলো অগ্নিসখ।দুর্দমনীয় তেজ ও বাতাসের ন্যায় গতির কারণে,পরম স্নেহ ও আদরে তার এইরূপ নামকরণ করেছেন স্বয়ং সপ্তপর্ণী।সহিসের নির্দেশ অমান্য করে,অগ্রভাগের পদযুগল দ্বারা খাদ্য ও জলের পাত্র উপুড় করে তীব্র হ্রেষাধ্বনিকে সঙ্গী করে বায়ুর গতিতে ধেয়ে এলো অগ্নিসখ।স্থির হলো রাজকুমারীর একেবারে সম্মুখে এসে....

-অগ্নি!!তুই শুনেছিস?

দু-পা এগিয়ে রাজকন্যার গ্রীবা আলিঙ্গনের মৃদু প্রচেষ্টা করলো অগ্নি।প্রাণাধিক প্রিয় ঘোড়াকে দুহাতে আলিঙ্গন করলেন পর্ণা...

-সই!রানির কড়া নির্দেশ,অপ্রয়োজনে বিলম্ব নয়।
-মায়ের স্বাস্থ্য?
-অনুকূল বলেই আমার ধারণা।আহ্বানের কারণ অজানা সই।
-চলো বৃন্দা!

অগ্নিসখের কানে ওষ্ঠ ও অধর স্পর্শ করে মৃদুস্বরে পর্ণা বললেন,

-অগ্নি!মায়ের আহ্বান।আমায় উড়িয়ে নিয়ে চল পক্ষীরাজ!!

স্বল্প অলংকারে সুসজ্জিত সম্মুখভাগের দুটি পা তুলে তীব্র হ্রেষাধ্বনির মাধ্যমে অগ্নিসখ জানান দিলো,সে প্রস্তুত!কোমরবন্ধনীর মধ্যে তরবারিকে নীরব আশ্রয় দিয়ে অগ্নির পৃষ্ঠদেশে চড়ে বসলেন সপ্তপর্ণী।

-সই ধীরে!আমিও একই পথের যাত্রী!

অদূরে দন্ডায়মান রামেশ্বর দেখলেন,কোনো আহ্বানে কর্ণপাত না করে,ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিলেন রাজকুমারী।মাতৃআজ্ঞা পালনে অজস্র ধূলিকণা উড়িয়ে বাতাসের গতির ন্যায় দ্রুতবেগে,নগরের পথে প্রস্থান করলেন লজ্জাহীনা স্বল্প পোশাক পরিহিতা রাজকুমারী সপ্তপর্ণী।পশ্চাতে অপর একটি ঘোড়ার পিঠে চেপে বিনোদিনীও ছুটলেন তাঁর সঙ্গে।সপ্তপর্ণীর সুদীর্ঘ উন্মুক্ত চুলের রাশি ক্ষণিকের মধ্যেই মিলিয়ে গেলো ধূলিঝড়ের অন্তরালে।ঘোড়ার খুরের শব্দও হলো ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর....

আপন কণ্ঠের সামান্য ক্ষত স্পর্শ করে অত্যন্তই উৎফুল্ল হলেন রামেশ্বর।ওনার শিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ।অনতিবিলম্বেই রাজকন্যাকে রাজ্যভার বুঝিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেবেন রানি।আর সেই মহাযজ্ঞের আয়োজনে রানিমা সর্বাগ্রে রামেশ্বরকে আহ্বান জানাবেন বলেই,ওনার স্থির বিশ্বাস।মায়াকাননের চতুর্দিকের বিপুল সবুজ সমারোহের দিকে ক্ষণিক চেয়ে,পুলকিত চিত্তে অস্ত্রাগারের দিকে অগ্রসর হলেন রামেশ্বর....

(চলবে)

ছবি : সংগৃহীত






New Video

২০টি মন্তব্য:

  1. Asadharon. . Khub valo laglo golper prothom ta. . . Opekhay roilam 2nd porber💗💗💗💗💗

    উত্তরমুছুন
  2. দিদি তোমার জবাব নেই। মানে মনেই হচ্ছে না রে তোমার কাছ থেকে প্রথম এই ধরনের লেখা পেলাম। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ার যে অনুভূতি তার সঙ্গে মিল পেলাম।দেরীর জন্য সরি🥺

    উত্তরমুছুন
  3. Suru te 1st part ei to topper. Asadharon laglo. Just speechless. Superb hoache suruta

    উত্তরমুছুন
  4. অসাধরন দিদি। এত কঠিন ভাষা,,,, কিন্তু তোমার লেখার জাদুতে পড়তে ও বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।।।।। দারুন লাগলো👌👌👌

    উত্তরমুছুন
  5. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট