খিল
সাথী দাস
নবম পর্ব
নাগের বাড়ির অন্দরমহলের বর্তমান উত্থান-পতন তিনজন মানুষকে একেবারেই স্পর্শ করতে পারে না। প্রথমজন হল টুয়া। সে মহানন্দে স্কুলে যায়-আসে, ছবি আঁকার ক্লাসে যায়। জীবনের যত রঙ সব ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে খাতায় আঁকা রামধনু কিংবা আকাশের গায়ে। ছাত্রজীবনের যত ব্যস্ততা সব অতিক্রম করার পর, টুয়ার অবসর সময় কাটে আহ্লাদী আর কাম্মার সঙ্গে। সোনাপিসির বিয়ে ভেঙে যাওয়াতে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে টুয়া। পিসি যে আরও কিছুদিনের জন্য নাগের বাড়ির সদস্যা হয়ে থাকতে চলেছে, এটা ভেবেই সে মহা পুলকিত চিত্তে বাড়িময় আস্ফালন করে বেড়ায়। নিভৃতে উত্তরার গলা জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করে, "সোনাপিসির বিয়ে দিতেই হবে কাম্মা?" উত্তরা এ প্রশ্নের কোনো জুতসই উত্তর দিতে পারে না। প্রতিরাতে অঙ্কনের দেহের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সময় ও অনুভব করতে পারে বিবাহের নিদারুণ সুখ।
ভাতৃবিবাদ ও সাংসারিক ডামাডোলের থেকে বহুদূরে উত্তরার অবস্থান। সময়কালে বাক্যের অগ্নিশলাকায় মানুষকে ক্রমাগত বিদ্ধ করার পর, নিতান্তই মূক ও বধির হয়ে যাওয়ার মতো ঐশ্বরিক ক্ষমতা তার মধ্যে বিদ্যমান। শশাঙ্ক উপযাচক হয়ে উত্তরার যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও, নিতান্ত ঠান্ডা লড়াইতে অঙ্কনের সহযোদ্ধা হয়েছিল। মৃগাঙ্কর সঙ্গে দুই ভাইয়ের বাক্যালাপ ও বাদানুবাদ বন্ধ। রান্নাঘরে তৃণার বাক্য নিষ্পেশন বাসনপত্রের ঘর্ষণের চেয়েও অধিক শব্দের জন্ম দেয়। কেবল নিধির মুখে কোনও কথা নেই। মন অত্যন্ত আহ্লাদিত হলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রাণকে ছুঁতে পারে না। একনিষ্ঠভাবে সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে টুয়াকে নিয়ে ঘরের দোরে খিল এঁটে সে বসে থাকে।
তবে যাকে নিয়ে সংসারে এত গোলযোগ, সেই আহ্লাদীর মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে দুটি নেই। চিলেকোঠার ঘরের খাটের তলায় একটা ছোট পাটের ব্যাগে দুটো চুড়িদার ভাঁজ করে রাখা আছে। সেই সঙ্গে প্রতিবার আয়না দেখার সময় কানের দুলজোড়া, গলার ভারি চেন, হিরের নাকফুল আর আঙুলের তিনটে আংটির দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে চেয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়।
বাড়ির লোক নাকি আহ্লাদীর বিয়ে দেবে! নেহাৎ ছোট বৌদিদি এই বিয়ে ভেঙে দিল। অবশ্য বিয়ে ভেঙে না গেলেও আহ্লাদীর বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল না। এই পাত্রের সঙ্গে হোক, অথবা অন্য কোনও পাত্র.... সবাই মনের আনন্দে করুক না বিয়ের আয়োজন! কিন্তু কনে ছাড়া কি বিয়ে হয়! সময়কালে আহ্লাদীকে কেউ খুঁজে পেলে তো বিয়েটা হবে! বাড়ির লোক যখন সুসজ্জিত পিঁড়ি নিয়ে ওর ঘরে ঢুকবে, তখন উপহার পাবে একগাল মাছি! পরনের শাড়ি-গয়না নিয়ে আহ্লাদী ততক্ষণে বর্তমান প্রেমিকের হাত ধরে পাড়ি দিয়েছে তেপান্তরে। চিলেকোঠার অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে বহুবার এই দৃশ্য কল্পনা করে আহ্লাদী অফুরন্ত আনন্দ পেয়ে হেসে উঠেছে নিঃশব্দে।
সময়টা সন্ধেবেলা, নিধির মন বেশ খারাপ। উত্তরার ফিরে যাওয়ার সময় হল। অফিস থেকে আর ছুটি পাওয়া যাবে না। অঙ্কনও ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিকেলবেলা উত্তরা একাই বেরিয়ে পড়েছিল রেলগেট সংলগ্ন বাজারের দিকে। ঘুরে-ঘুরে বাড়ির সকলের জন্য নিজ হাতে অল্পবিস্তর কেনাকাটা করেছে। টুয়াকে আদর করে নতুন জামা ও চকোলেট উপহার দিয়ে খুব খানিক আদর করে দিল উত্তরা। নিধি ধুনুচি হাতে নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে বলল,
-ও মা ছোট! তুই কখন এলি?
-এই তো মেজদিভাই! সবে এলাম।
-মা দেখো.... কাম্মা আমার জন্য কত খেলনা, নতুন জামা, ক্যাডবেরি এনেছে। এই দেখো ছবি আঁকার নতুন খাতা আর রঙ পেন্সিল.... দেখবে এসো না মা...
-দাঁড়া টুয়া, বিছানায় বসে আমাকে ছুঁয়ে দিস না। সন্ধে দিচ্ছি দেখতে পাচ্ছিস না? তুই করেছিস কী ছোট! সারা খাটের ওপর জিনিসপত্র ছড়িয়ে রেখেছিস! এত টাকা নষ্ট করলি!
-ও কিছু না দিদি। সব তোমাদের না। বাড়ির সবার জন্যই কমবেশি জিনিস আছে। তুমি তাড়াতাড়ি সন্ধে দিয়ে এসো। তোমার জন্যও একটা জিনিস আছে। দেখো দেখি, পছন্দ হয় কিনা!
ঘরময় ঘুরে বাতাসে ভাসমান ধোঁয়ার যাত্রাপথ হাত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে নিধি বলল,
-হ্যাঁ রে, ঠাকুরপো তোর সঙ্গে যায়নি? দেখলাম বাইকে চেপে ও বাড়ির অবন দাদাভাইয়ের সঙ্গে ঘুরছে। ভাবলাম তুই মাইমা'র বাড়ি গেছিস বুঝি।
-না, ও যায়নি। আমি একাই গেছি। ও কোথায় গেছে আমি জানি না।
-এ কী কথা!
-কেন একা যেতে পারি না? আমি কি বাচ্চা মেয়ে নাকি? সবসময় সঙ্গ না হলে চলতে পারব না! হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিতে হবে?
-নাঃ! বাচ্চা না, তুই একেবারে বুড়ি। তা বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস ব'লে কি নিজের বুড়োটা কোথায় যাচ্ছে, সেই খবরটুকুও রাখবি না? সে দেখি তোকে একেবারে চোখে হারায়! তা ছোট ঠাকুরপোর দোষ দিই কী করে বল! হাজার হোক পুরুষ মানুষ তো! বৌয়ের অমন মাথা ঘুরোনো রূপ থাকলে, সে বেচারা আর কী করবে!
মুখ ফিরিয়ে ফিক করে মৃদু হাসল উত্তরা। নিধিও হাসিমুখে বলল,
-আচ্ছা তুই বোস। ঘর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে। আমি মায়ের ঘর আর বারান্দায় ধোঁয়া দেখিয়ে শঙ্খতে একটু ফুঁ মেরে আসছি।
-মেজদিভাই চা খাওয়াবে একটু? মাথাটা ধরে আছে। সেই বিকেলে বেরিয়েছি।
-আনছি...
নতুন খাতার ওপর নতুন রঙ পেন্সিল নিয়ে উপুড় হয়ে পড়েছে টুয়া। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উত্তরা জিজ্ঞাসা করল,
-মাকে চা দিয়েছ মেজদিভাই?
-হ্যাঁ রে, দিয়েই ঘরে এলাম। চা নিয়ে বড়দির ঘরের দোরে ধাক্কা দিলাম। খুলল না। এখন সে দরকার ছাড়া নিচে নামে না। কথাও বলে না। দাদাভাই আপিসে যাওয়ার সময় আমাদের মুখ দেখলে ভাবখানা এমন করে, যেন আমরা অযাত্রা! মুখে একটা কথা পর্যন্ত নেই।
-ছাড়ো না.... ক'দিন পর এসব ঠিক হয়ে যাবে। আহ্লাদীর জীবন তো বাঁচল। মেয়েটার জীবন নষ্ট হওয়ার থেকে, এ অনেক ভালো। তুমি চা খাও! এত বেশি ভেবো না।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিধি বলল,
-ভেবো না বললে কি আর ভাবনা আমাকে ছাড়ে রে? এতদিন একরকম ছিল। এবার তুই চলে যাবি, তারপর আবার কোন মূর্তি ধারণ করবে কে জানে বাপু! তুই কিছু মনে করিস না ভাই!
-কী ব্যাপারে বলো তো?
-এই যে, আহ্লাদীর বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে তোকে কত অপমানিত হতে হল! নেহাৎ মা এসে সেদিন কেঁদেকেটে পড়ল ব'লে তাই রক্ষে.... ছোট ঠাকুরপো চিৎকার করে বড়দাভাইয়ের হাত টেনে না ধরলে, বড়দাভাই তো তোর গায়ে হাত তোলার জন্য সিঁড়ি পর্যন্ত দৌড়ে গিয়েছিল। কতবড় সাহস একবার চিন্তা করে দেখ!
-তোমরা বৃথাই এত চিৎকার করলে! আমাকে একবারও ভয় পেতে দেখেছ? আমি তো সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ঐ হাত একটিবার শুধু আমার গালে এসে পড়ত, তারপর বধূ নির্যাতনের দায়ে বাড়িতে পুলিশ ডেকে এনে কোমরে দড়ি পরিয়ে কিভাবে ঘর থেকে টেনে বের করতে হয়, সে আমিও জানি। তাঁকে দাদাভাই ডাকতাম। সেই জায়গা তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন। এখন আমারও তাঁকে সম্মান করার কোনও দায় নেই। ভাইয়ের বৌয়ের গায়ে হাত তোলা! তাঁর সরকারি চাকরি কিভাবে খেতে হয়, সে আমিও খুব ভালো জানি। আমার বাবা যে সে মানুষ নয়! তাঁর মেয়ের গায়ে হাত তুলে কেউ পার পাবে না।
-তোর ভাই নিজের টাকার জোর আছে, বাপের ঘরের জোর আছে। তার ওপর তোরা এখানে থাকিসও না। ছোট ঠাকুরপোর পায়ের তলার মাটি শক্ত। তোরা কারও পরোয়া করিস না। তাও তোদের সঙ্গে কেমনধারা ব্যবহারখানা করল দেখলি! তবেই বুঝে দ্যাখ, আমাদের সঙ্গে কী করে! ঘরে ওঁর বৌ করে আমার সঙ্গে। বাইরে ওঁর বর আমাদের ঘরের লোকটার মাথার ওপর পা তুলে চলে! ভয়ে আমি দিনরাত সিঁটিয়ে থাকি। মেয়েটাকে তো মানুষ করতে হবে বল! সে তার মেজ ভাইকে তাড়িয়ে দিলে মেয়েকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াব আমি?
-উঁহ.... বললেই হল নাকি! তাড়িয়ে দেবে? দেশে আইন-কানুন কিছু নেই? নাগের বাড়িতে বড়দাভাইয়ের যা অধিকার, মেজদাভাইয়ের যা অধিকার, আমার বরেরও তাই অধিকার। চূর্ণী দি আর আহ্লাদীও সেই একই অধিকার দাবি করবে। তাঁর একার কথায় কিছু হবে নাকি? তেমন কিছু বললে আমাকে একটা ফোন করবে। উকিল নিয়ে এসে সব ভাগ করে দেব উঠোনের মধ্যিখানে দেওয়াল তুলে। উচিত কথা ব'লে ছোট বৌ এমনিতেই খারাপ! এবার উচিত কাজ করে সারাজীবনের মতো খারাপ হোক!
-ও বাবা! একবার ঝগড়ার সময় বিষয় ভিন্ন করার কথা উঠতেই বড়দাভাই বলে কিনা, সম্পত্তি তার হাতে রয়েছে বলেই চোখে দেখা যাচ্ছে। ভাগ করলে নাকি বারো ভূতে লুটে খাবে! সবাই সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলবে।
-হ্যাঁ সেই। আপন ভালো পাগলেও বোঝে। একবার ভাগ করেই দেখুক না! কে রাখে আর কে নষ্ট করে! আসলে ভাগ করে দিলে তাঁর দাপট কমে যাবে তো! কেউ তখন এত মান দেবে না! যে যারটা বুঝে নিয়ে সরে পড়বে। সবকিছুর সর্বেসর্বা হয়ে বসে থাকার ফিকির ওসব। আমাকে বোকা বানাবে! মানুষ চেনা হয়ে গেছে এই ক'দিনে। আগে খুব ভালো ভাবতাম! এখন দেখি ও বাবা! নামেই নাগের বাড়ি! নামেই বনেদি বাড়ি! ঐ ওপরেই খালি আভিজাত্যের চাকন-চিকন! ভিতরে সবই আস্তাকুঁড়ের ছুঁচোর কেত্তন!
-এই নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলতে হয় ভাই। আমার বাপের ঘরের অবস্থা তুই সবই জানিস।
তাদেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়! হঠাৎ মাথা গরম করে চারটে ছোট-বড় কথা শুনিয়ে তাড়িয়ে দিলে, আমি তিনটে বাড়তি পেট নিয়ে কোথায় ঠেলে উঠব বল দেখি! সেই ভয়ে মুখ খুলি না। জলে থেকে কি আর কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় রে বোন? তুই আজ বাদে কাল চলে যাবি। ওর কথা শুনতেও আসবি না। কিন্তু আমাকে এখানে থাকতে হবে। তোদের হয়ে আমি আর আমাদের ঘরের লোকটা সেভাবে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারলাম না। তুই যেন রাগ করিস না ভাই।
-কী যে বলো তুমি! সেদিন রাতে আমি বলার আগেও তুমি আমার ঘরে এসে বলেছ। এই বা কম কী? উত্তরার জিভে এখনো মরচে ধরেনি। সে নিজের কথা গুছিয়ে খুব ভালোভাবে বলতে পারে। তুমি বলো দেখি, শাড়িখানা পছন্দ হল? পাঞ্জাবিটা মেজদাভাইয়ের হবে তো? আমি আন্দাজে আনলাম।
-খুব হবে। কী সুন্দর শাড়ির রঙটা। এ আমি এখন তুলে রাখব। ঠাকুর থানে মনসা পুজোর দিন এই নতুন শাড়িখানা ভেঙে পরব।
-আচ্ছা মেজদিভাই, আমি এখন উঠি। রাতে সুটকেস গোছাতে হবে। তার আগে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।
-ও ছোট...
খাট থেকে উঠেও আবার বসে পড়ল উত্তরা। কারণ নিধি স্নেহপূর্ণ বাঁধনে ওর হাত টেনে রেখেছে।
-কী বলো?
-কতদিন আর দেবা-দেবী থাকবি? অনেকদিন হল বিয়ে হয়েছে। ঢের আনন্দ-ফূর্তি হয়েছে। এবার একটা কিছু ভাব। সামনের বার যখন আসবি, তখন যেন শুনি নতুন খবর আছে। আমার টুয়ার খেলার সঙ্গী আসছে। একটা বাচ্চার জন্ম দিলে তোর রূপ-যৌবন একটুও টসকাবে না। ছোট ঠাকুরপো তখনো তোর আঁচলেই বাঁধা থাকবে। তোরা এত দেরি করছিস কেন ছোট? কিছু সমস্যা আছে?
কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে মাথা নামিয়ে উত্তরা বসে রইল। নিধি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
-কিছু মনে করিস না বোন। দিদি হয়েই বললাম। নিজের বোন থাকলে তাকেও এভাবে বলতাম। তোদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নাক গলাচ্ছি না। কিন্তু দেখতেও তো ভালো লাগে বল! ঘরের মধ্যে একটা বাচ্চার কান্না, আধো আধো কথা না থাকলে কি ঘরে মন বসে? ছোট ঠাকুরপো দেখবি তখন আরও বেশি করে তোদের জড়িয়ে থাকবে। এদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে হয়। নইলে এরা সংসারী হয় না। উড়ে উড়ে বেড়ায়। তাছাড়া ওখানে কাছাকাছি তোর মা থাকেন। তিনি এসে বাচ্চাকে দেখবেন। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই বড় হয়ে যাবে। এবার নিয়ে নে ছোট।
-হুম...
-রাগ করলি ভাই?
-রাগ করলে রাগ উগড়ে দেওয়ার জন্য দু-চার কথা শুনিয়ে দিতাম। চুপ করে ভালোমানুষ সেজে মনের ভিতর রাগ পুষে রাখতাম না। তুমি উত্তরাকে চেনো না?
নিশ্চিন্ত হয়ে নিধি বলল,
-তা চিনি। সেই জন্যই তো বললাম। কী ভাবছিস এত?
-ভাবছি আহ্লাদীর কথা। এই মেজদিভাই.... একটা কাজ করব ভাবছি।
-কী কাজ রে?
-দাঁড়াও.... মায়ের ঘর থেকে ঘুরে এসে বলছি। আগে মা কী বলেন দেখি...
মাধবীলতার উপহারখানা বগলদাবা করে উত্তরা যেন চোখের নিমেষে উধাও হয়ে মাধবীলতার ঘরের দরজায় উপস্থিত হল।
-মা আসব?
-কে?
-আমি উত্তরা।
-তা এই ভর সন্ধেবেলা চায়ের আসরের খোশগপ্পো ছেড়ে এই বুড়ির দোরে কী মনে ক'রে?
-কাল চলে যাচ্ছি কিনা! তাই আপনার সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম।
-আর ক'টাদিন থেকে গেলে হয় না?
-আপনার ছেলের ছুটি শেষ। আমারও দু'দিন অফিস কামাই হল। এবার না গেলে একেবারে ছুটি দিয়ে দেবে।
-হুহ! এখানে এতসব জমি-জিরেত, তারা ভিটেছাড়া হয়ে পরের আপিসে চাকরি করছে! উদ্ধার করছে আমায়। সংসার-ধম্ম আর হবে না। মরার আগে বোধহয় ছোট ব্যাটার ঘরে একটা নাতি-পুতির মুখও দেখতে পাব না! কপাল আর কী! মেয়েমানুষের চাকরি করার বাই থাকলে যা হয়! একবার বাইরে বেরিয়ে রঙচঙে দুনিয়ার সোয়াদ পেয়ে গেলে, তার কী আর ঘরে মন বসে! তা ঘরের মধ্যে অমন ঠাকুরের মতো সটান দাঁড়িয়ে রইলে কেন বাছা? বসার জন্য আলতা সিঁদুর পান সুপুরি দিয়ে তোমাকে নেমন্তন্ন করতে হবে নাকি?
-তা নয়। আপনার কথা হজম করছিলাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি পেটে নেমে যাবে কিনা! বসে পড়লে কথা এসে বুকে আটকে গিয়ে মনে ব্যাথা দিতে পারে। আবার বিষমও লাগতে পারে। তাই দাঁড়িয়েছিলাম। সংসারের সব কথা মনে লাগতে দিতে নেই। যেসব কথা ঝটপট হজম করতে হবে, সেগুলো আমি দাঁড়িয়েই শুনি। শক্ত কথা বুকের ভাঁজে জমে গেলে মনখারাপ হতে পারে। তাই...
-উফ! কথার ঝড়ে যেন সংসার উড়ে যাবে...
উত্তরা ধপাস করে খাটে বসে মাধবীলতার গা ঘেঁষে বলল,
-এটা আপনার জন্য এনেছি মা। দেখুন তো, পছন্দ হয়?
-পানের ডিবে? ও মা! কী সুন্দর ঝকঝক করছে গো!
মাধবীলতাকে শিশুর মতো আনন্দ করতে দেখে উত্তরা বলল,
-হ্যাঁ। আগেরটা বহুদিন হয়ে গেল। চুন লেগে কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে। তাই আপনার জন্য নতুন কিনে আনলাম। আর এই রূপোর বেলপাতা প্যাঁচানো সাপ শিব ঠাকুরের জন্য।
-এতসব তুমি কখন কিনলে?
-এই একটু আগে বেরিয়েছিলাম। আপনার পছন্দ হয়েছে?
-এতগুলো টাকা খসিয়ে কিনেছ। পছন্দ হয়নি বললে তো মুখখানা আবার হাঁড়ি হয়ে যাবে! পছন্দ না হয়ে উপায় আছে?
-তা কেন? পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু পছন্দ না হলেও বলবেন, পছন্দ হয়েছে।
-না হলেও হ্যাঁ বলব?
-হ্যাঁ বলবেন। যে জিনিস আনে, সে তার নিজের পছন্দমতো আনে। যার জন্য আনে, তার পছন্দ না-ও হতে পারে। সব মানুষের পছন্দ সমান নয়। মানুষের পছন্দ খারাপ হতেই পারে, কিন্তু উপহারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। একটা জিনিস দিয়ে একটা মানুষের কি সারাজীবন চলে? কিন্তু মানুষের ব্যবহার আর কথাটা আজীবন থেকে যায়। আপনি যদি উপহারের জিনিসটা হাতে নিয়ে একবার মিষ্টি করে হেসে বলেন খুব সুন্দর হয়েছে, তবে দ্বিতীয়বার-তৃতীয়বার উপহার পাওয়ার সুযোগ আরও বেড়ে যায়। বারবার সে যখন আনন্দ করে জিনিস কিনবে, উপহার দেবে, কোনও একবার নিশ্চয়ই আপনার পছন্দ হয়ে যাবে। তখন আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না। কিন্তু আপনি যদি তাকে একবার বলে দেন পছন্দ হয়নি, তবে দ্বিতীয়বার হাতে ধরে কিছু কেনার আগে তার মন খুঁতখুঁত করবে। হয়তো সে আর কিছু কিনবেই না। কিংবা হয়তো কিনবে, তা নেহাৎই দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করতে। ভালোবেসে নয়। টাকা খরচ করলে কতরকম জিনিস বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা পাওয়া যায় কি?
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে উত্তরার দিকে চেয়ে মাধবীলতা বলল,
-আমার ব্যাটা হাতে হ্যারিকেন নিয়ে একটা মেয়েমানুষ খুঁজে বের করেছিল সত্যি! ঠোঁটের আগা সবসময় কথা বলার জন্য সুড়সুড় করে! এরপর তোমার আনা জিনিসকে খারাপ বলে কার বাবার সাধ্যি আছে! খুব সুন্দর হয়েছে গো! শিবশম্ভু! শিব শিব...
কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে শিবালয়ের শিবের উদ্দেশে প্রণাম করে মাধবীলতা বলল,
-কালই আমি নিজের হাতে শিবকে স্নান করিয়ে এই সাপ আর বেলপাতা দিয়ে পুজো দেব। যাওয়ার আগে তোমরা একটু প্রসাদ মুখে দিয়ে যেও। খুশি তো?
চোখে একরাশ দুষ্টুমি এঁকে মিটমিট করে হেসে উত্তরা বলল,
-খুব খুশি। আরও একটা কথা আপনাকে বলার জন্য আমার মুখ সুড়সুড় করছে মা। আপনি না বলতে পারবেন না। আমি চাইব, আপনি দেবেন। কোনও কথা শুনব না।
-তোমার আবার কী চাই? আমার ব্যাটাকেই তো নিয়ে বসে আছ।
-আহ্লাদীকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।
-কী বললে! আহ্লাদীকে?
-হ্যাঁ.... এ বাড়ির যা অবস্থা, ওকে এখন এখানে রাখা ঠিক হবে না। যে মেয়ের বিয়ে ভাঙে, তার ওপরেই মানুষের সবচেয়ে বেশি রাগ থাকে! এমনিতেই সংসারের নিয়ম হল, যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা! এখন ওকে আরও কথা শুনতে হবে। তার চেয়ে আমার সঙ্গে যাক। কিছুদিন দাদার বাড়ি থেকে ঘুরে আসুক। আহ্লাদী সেই যে আমাদের বিয়ের সময় গিয়েছিল, তারপর আর ফ্ল্যাটে যায়নি। আমি আহ্লাদীকে নিয়ে যাই মা? দিনকতক পর আপনার ছেলে এসে ওকে দিয়ে যাবে। আহ্লাদীর যতদিন ইচ্ছে, ততদিন থাকতে পারে। আপনি ভয় পাবেন না। আমার ঘরে আপনার মেয়ের কোনও অযত্ন হবে না। ও খুব আদরেই থাকবে। আমার ওপরে ভরসা রাখুন।
মাথা নামিয়ে চুপ করে বসেছিল মাধবীলতা। উত্তরা মাধবীলতার হাতের ওপর হাত রেখে ডাকল,
-মা?
-ভরসার কথা বলছ তুমি? এ কথা কোন মুখে বলি বলো, পরের মেয়ের ওপর যে ভরসা আছে, নিজের পেটের মেয়ের ওপর তা নেই! আমি জানি তুমি ওর অনাদর করবে না। কিন্তু গৃহপ্রবেশের দিন নারায়ণ পুজোর সময় তোমার ফ্ল্যাট দেখে এসেছিলাম মা। কত বড় জায়গা! আশেপাশে কত বড় বড় ফ্ল্যাট! কত নামী-দামি মানুষের বাস সেখানে! তুমি আমার ঘরের মানুষ। তোমার কাছে আর কী লুকোব? আমার মেয়েটার স্বভাব তোমার অজানা নয়। ওখানে গিয়ে যদি আবার কারও সঙ্গে কিছু করে বসে, লজ্জায় তোমাদের নাক কাটা যাবে! লোকে ছি ছি করবে। আমি আহ্লাদীকে একদম ভরসা করতে পারি না ছোট বৌ...
পাড়া বেরিয়ে টুয়ার খাতায় খোলা আকাশ এঁকে ঘরের বাইরে তখনই পৌঁছেছিল আহ্লাদী। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চুড়িদারের ওড়নাটা হাতের আঙুলের মধ্যে জড়িয়ে দাঁত দিয়ে সুতো কাটতে কাটতে একমনে শুনছিল ঘরের ভিতরের নিভৃত আলাপচারিতা। উত্তরা হেসে বলল,
-কিছুক্ষণ আগে মেজদিভাই আমাকে দায়িত্বের পাঠ পড়াল। সে বলল, দায়িত্ব চাপিয়ে না দিলে ঘরের পুরুষ মানুষরা নাকি উড়ে বেড়ায়। কিন্তু মিথ্যে বলব না মা, আপনার ছোট ছেলের লুকোনো ডানা আমি কোনোকালেও চোখে দেখিনি। তবে মেজদি আমার চেয়ে বেশিদিন সংসার করেছে। তার অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে খানিক বেশি। হয়তো সে ঠিকই বলে থাকবে। তার কথার জের টেনেই বলি, বড় মুখ করে ভরসা না করলে, কেউ ভরসার মর্যাদা দেবে কেন? ভরসার মর্যাদা চাইলে আগে ভরসা করতে হবে। আপনার ইচ্ছে না হলে ভরসা করবেন না। কিন্তু আমি আহ্লাদীর ওপর একবার ভরসা করবই। দেখিই না, সে কেমন তার ছোট বৌদিদির মুখে চুনকালি মাখায়! আবার এমনটাও তো হতে পারে, আমার ওখান থেকে ফেরার পর আপনি আহ্লাদীর মধ্যে একজন নতুন মানুষকে খুঁজে পেলেন, যাকে আগে কোনোদিন দেখেননি.... চেষ্টা করতে ক্ষতি কিছু নেই। ঠিক কিনা বলুন! আপনি আহ্লাদীকে আমার সঙ্গে যেতে দেবেন তো? বড়দাভাইকে আমি জিজ্ঞাসা করতে যাব না। আপনিই আমাদের সকলের অভিভাবক, আহ্লাদীরও মা। আপনি হ্যাঁ বললে, আমি কারও নিষেধ শুনব না।
মাধবীলতার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো কান্নায়। উত্তরার হাত চেপে ধরে সে বলল,
-এখানে দিনরাত টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওখানে যাওয়া মানে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা। তোমরা অফিসে বেরিয়ে যাবে। ওকে সারাদিন দমবন্ধ করে ঘরের মধ্যে একা থাকতে হবে। ও কি যেতে রাজি হবে ছোট বৌ?
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে এক পায়ের আঙুল দিয়ে আর এক পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ একমনে খুঁটতে লাগল আহ্লাদী।
পরের দিন ভোরে ঘটা করে নিজ হাতে শিবালয়ের শিবলিঙ্গকে স্নান করাল মাধবীলতা। প্রসাদ খেয়ে মাধবীলতাকে প্রণাম করে ঘোমটা সামলে উত্তরা হাসিমুখে দাঁড়াল নাগের বাড়ির সামনে। নিজেদের সুটকেস ও আহ্লাদীর ব্যাগ গাড়ির ডিক্কিতে ঢুকিয়ে দিল অঙ্কন। আহ্লাদীর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে খুন হয়ে গেল টুয়া। নিধি চোখের জল মুছে বলল,
-সারারাত মেয়ে ঘুমায়নি। একটু চোখ বুজলেও ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। যখন থেকে শুনেছে, কাম্মার সঙ্গে সোনাপিসিও চলে যাচ্ছে, একনাগাড়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে...
টুয়ার দু'গালে অনেক আদর এঁকে দিয়ে আহ্লাদী রুদ্ধকণ্ঠে বলল,
-আমি আবার আসব তো। তুই এত কাঁদছিস কেন? আমি কি জন্মের মতো চলে যাচ্ছি?
-তোমার বিয়ে হয়ে গেল পিসি? বর কই? তুমি আমাকে ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছ?
টুয়ার কথা শুনে উপস্থিত সকলে হেসে উঠল সমস্বরে। কেবল আহ্লাদী টুয়াকে বুকের ভিতর মিশিয়ে কান্নায় ভেসে বলল,
-তোকে ছেড়ে কোথায় যাব মা আমার? আমি আবার আসব।
-ঠিক তো সোনাপিসি? তুমি আবার আসবে তো?
-ঠিক ঠিক ঠিক! একটু ভরসা রাখ আমার ওপর! আমি ঠিক আসব.... তোকে একা রেখে কোথাও পালাব না।
ঘরের জানলার পর্দা একটু ফাঁকা করে দোতলা থেকে উঁকি মারছিল তৃণা। মুখ বেঁকিয়ে বলল,
-ঢং দেখে গা জ্বলে যায়। যা না, আদর করে নিয়ে যা! রাখ কয়েকটা দিন। তারপর বুঝবি ও কী বিষ! আবার দু'দিন পর ঘাড় থেকে নামানোর জন্য এখানেই ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে। কত দেখলাম অমন আলগা পিরিত! মায়েরও বলিহারি! যত বয়স বাড়ছে, বুদ্দিসুদ্দি যেন লোপ পাচ্ছে। ঐ বেহায়া মেয়েমানুষটাকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই! বাপ-মা দেখেশুনে বিয়ে দেবে, সেই অপেক্ষাও তো করতে পারিসনি হতভাগী! এমনই গতরের জ্বালা, আমার দেওরের গায়ে ঢলাঢলি করে একেবারে নাগের বাড়ির ভিতরে উঠে এসেছিস! তাও যদি একটা ব্যাটা পেটে ধরতিস, না হয় এত দেমাকের কারণ বুঝতাম! বিয়ে হয়েছে কম দিন তো হল না। এখনো কচি সেজে হেলে-দুলে ঘুরে বেড়ায়! একটা বাচ্চা পেটে এলো না। বাঁজা মেয়েছেলে কোথাকার! তাকে নিয়ে ঘর-গুষ্টি সবার ন্যাকামি দেখলে মনে হয় সংসারের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিই।
ঘরের কোণে টেবিলের ওপর রাখা রূপোর সিঁদুরের কৌটোর দিকে চেয়ে মুখ বেঁকিয়ে হাতের চুড়ি ঝনঝনিয়ে তৃণা বলে উঠল,
-বুদ্ধির বলিহারি যাই! শাড়ি দিল না। দিল সিঁদুরের কৌটো! জানে এয়োস্ত্রী মানুষ, এ জিনিস প্রাণে ধরে কাজের লোককে বিলিয়ে দিতে পারবে না। আবার ব্যবহার না করে শুকনো কৌটো ফেলেও রাখবে না...
উত্তরার দেওয়া শূন্য সিঁদুরের কৌটোতে তৃণা খানিক গুঁড়ো সিঁদুর রাখল। তারপর আয়নার দিকে চেয়ে নিজের সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর দিয়ে বলল,
-আমার সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় করো। ঠাকুর ঠাকুর...
হাতের নোয়ায় একফোঁটা সিঁদুরবিন্দু এঁকে কৌটোটাকে কপালে ছুঁইয়ে প্রণাম করে তৃণা মৃগাঙ্কর দীর্ঘায়ু কামনা করল।
গ্রামের পথের আলগা ধুলো উড়িয়ে অঙ্কনের গাড়ি এগিয়ে গেল শহরের পথে...
(চলবে...)
ছবি : সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন