অনুসরণকারী

বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২২

সপ্তপর্ণী (দ্বিতীয় খণ্ড) (তৃতীয় পর্ব)




সপ্তপর্ণী

সাথী দাস

দ্বিতীয় খণ্ড

তৃতীয় পর্ব




মৃদুহাস্যে পর্ণা বললেন,
-মহাভৈরবীর নিকট পূজার্চনা হেতু এই পথ ধরে মন্দিরে যাওয়ার কালে রথ হতে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলাম, শৈল ও বীরদত্ত প্রশিক্ষণকার্যে ব্যস্ত, চিত্রার অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে...
-মহারানি! অস্ত্রশিক্ষা ও অনুশীলনে রাজকুমারী বড় অমনোযোগী। কোনরূপ অনুশাসনের পরোয়া তিনি করেন না। বড়ই অবাধ্য। তুলনামূলকভাবে শৈল সুনিপুণ তিরন্দাজ। তার তরবারি চালনা, বর্শা নিক্ষেপের কৌশল ও রণকৌশলে আমি যারপরনাই অভিভূত রানি।
পরিশ্রমী শৈলজা হাসিমুখে সামান্য উৎসাহব্যঞ্জক বাক্যের আশায় পর্ণার মুখপানে চাইলেন। কিন্তু চিত্রার অমনোযোগ এবং অনুশীলনকার্যে উদাসীনতার বৃত্তান্ত বীরদত্ত কর্তৃক শ্রবণমাত্র পর্ণা বললেন,
-অমরাবতীর ভবিষ্যৎ রানির এমন অমনোযোগ ক্ষমার অযোগ্য চিত্রা।
মুহূর্তেই শৈলজার মুখমণ্ডল হতে সকল হাসি অদৃশ্য হল। তুমুল গাত্রদাহ সহ্যপূর্বক পর্ণার সম্মুখে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে। আপনাকে রক্ষার্থে রাজকন্যা চিত্রা সোহাগী কণ্ঠে পর্ণাকে আলিঙ্গন করে বললেন,
-মা! বীরদত্ত সঠিক কথা বলছে না! মাত্র আজই নিদ্রাভঙ্গে আমার সামান্য বিলম্ব...
-এক পক্ষকাল পূর্বে আপনি দুইদিন বিলম্ব ছিলেন রাজকুমারী। প্রহরী ও পরিচারিকা কর্তৃক আহ্বানপূর্বক আপনার সুখনিদ্রাভঙ্গ...
-না মা! সকল বাক্য মিথ্যা, মনগড়া!
মৃদুহাস্যে পর্ণা চিত্রার ললাটে স্নেহচুম্বন অঙ্কনপূর্বক বললেন,
-বীরদত্ত তোমার শিক্ষাগুরু চিত্রা। সে কোন অভিপ্রায়ে মিথ্যার আশ্রয় নেবে? যে ক্ষণে তুমি তাকে পরাজিত করতে সমর্থ হবে, সেই ক্ষণে তোমার সকল অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হবে। প্রতিক্ষণে আমার শিক্ষাগুরু রামেশ্বরের স্মৃতি আমার মনকে বড় পীড়া দেয়। আমার সুকোমল দেহের উপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারপূর্বক, চরম মানসিক নিপীড়নের মাধ্যমে একদা সে আমার মন এবং সম্মানকেও ছিন্নভিন্ন করেছিল। এক সামান্য কিশোরী জ্বলন্ত অঙ্গারে পরিণত হয়েছিল শুধুমাত্র তাঁরই শিক্ষায়। তোমাকেও অনুরূপভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে চিত্রা। পৃথিবী বড় রূঢ় ও নির্দয়। সর্বক্ষেত্রে, সবস্থানে অস্ত্র তোমার সহায়তা করবে না। নিজেকেই সর্বাপেক্ষা কঠিনতম অস্ত্ররূপে প্রস্তুত করতে হবে। আর নিয়মানুবর্তিতা, কঠোর পরিশ্রম এবং অনুশীলন ব্যতীত তা সম্ভব নয়। অযথা বাক্যালাপে কালবিলম্ব অনভিপ্রেত। বীর?
-আজ্ঞা করুন রানি?
-লজ্জা নারীর ভূষণ নয়, অহংকার! সেই অহংকারের উপর সামান্যতম অসন্তোষজনক দৃষ্টিও কাঙ্খিত নয়। চিত্রা প্রয়োজনে ওই অহংকারকেই আপন অস্ত্রজ্ঞানে ব্যবহার করবে। এই শিক্ষা চিত্রাকে সঠিক সময়ে তুমি প্রদান করবে।
-যথা আজ্ঞা রানি।
-চিত্রাকে ভবিষ্যতের পর্ণারূপে প্রস্তুত করো। অগ্নিস্ফুলিঙ্গরূপে সে ধরা দেবে আপন ও বহির্বিশ্বের সকল প্রজার দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টিতে ভীতি ও সম্ভ্রম একই সময়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করবে।
-আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। কেবল রাজকুমারী পাঠাভ্যাস ও অনুশীলনে যদি সামান্য একটু মনোযোগী হয়...
-অবশ্য হবে। চিত্রা?
-মা?
-তুমি কে?
-অমরাবতী, কাঞ্চনগড় এবং মায়াকাননের ভবিষ্যৎ অধিশ্বরী, পৃথ্বীশবর্মন এবং মহারানি সপ্তপর্ণীর একমাত্র কন্যা...
-চিত্রা! আমার রাজ্যে নির্বোধ পথশিশুও আপন পরিচয়ের পূর্বে পিতার নাম স্মরণ ও উচ্চারণ করে না। তুমি এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রাজ্যেশ্বরী হয়ে এমনতর ভুল...
-ক্ষমাপ্রার্থী মা। আমি মহারানি সপ্তপর্ণীর একমাত্র কন্যাসন্তান চিত্রাঙ্গদা।
-তোমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?
-প্রজার কল্যানসাধন, দুষ্টের দমন এবং রাজ্যবিস্তারপূর্বক একাধিক রাজ্যব্যাপী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
-আর...
-মা?!
পর্ণার অক্ষিকোটর হতে একবিন্দু অবাধ্য লবণাক্ত বারিধারা বিনা বাধায় গন্ডদেশে নেমে এলো। শশব্যস্ত চিত্রা পর্ণাকে বারংবার আহ্বানে উত্যক্ত করে তোলার পূর্বেই কম্পিত স্বরে অবনত দৃষ্টিতে পর্ণা কন্যার উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,
-বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী চিত্রা?
-মৃত্যু মা!
-যথার্থই...
-মা তোমাকে এমনতর বিবর্ণ দেখাচ্ছে কেন? আপন কক্ষে...
-রানি আমি আপনাকে কক্ষে পৌঁছে...
-না বীর! আমি এই ক্ষণে চিত্রার মঙ্গল কামনা হেতু মহাভৈরবীর নিকট প্রার্থনা করতে আগ্রহী। কক্ষে গমন সম্ভব নয়। চিত্রা?
-মা?
-আপন অনুশীলনে মনোযোগী হও। অবিলম্বে তোমার রাজ্যাভিষেকের আয়োজন করা হবে। প্রজার সম্মুখে সকল ক্ষেত্রে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক। তবেই তোমাকে তিন রাজ্যের রাজসিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারিণীরূপে গণ্য করা হবে। অন্যথায়...
-অন্যথায়?
-অনুশীলনে মনোযোগী হও। আমি পূজার্চনা সমাধাপূর্বক রাজকার্যে কিঞ্চিৎ ব্যস্ত থাকব। আগামী এক পক্ষকাল পশ্চাতে পুনরায় এই প্রশিক্ষণক্ষেত্রে আমি সশরীরে উপস্থিত হওয়ার ইচ্ছা আপন মনে পোষণ করি। আশা রাখি, সেই ক্ষণে তুমি বীরদত্তকে অভিযোগের কোনপ্রকার সুযোগ দেবে না! মহাভৈরবী তোমার মঙ্গল করুন রাজকন্যা।
-মায়াকানন, কাঞ্চনগড় ও পবিত্র অমরাবতী শত্রুমুক্ত থাকুক মা!
আপন কন্যাকে আলিঙ্গনপূর্বক, শৈলজার মস্তকে হস্তখানি মাত্র স্পর্শ করলেন পর্ণা। অতঃপর পূজার রৌপ্যনির্মিত রেকাবি, মঙ্গলঘট এবং উপাচারসহ পুনরায় আপন রথে চড়লেন। দুইটি অশ্ব সগৌরবে অমরাবতীর রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন অঞ্চল ও নগর পেরিয়ে মহাভৈরবীর মন্দির পানে অগ্রসর হল। পর্ণার প্রস্থানের পরই চিত্রা অবিলম্বে আপন কোমরবন্ধনী হতে তরবারি মুক্ত করে বীরদত্তকে আক্রমণ করলেন। সহসা ধেয়ে আসা কিশোরীর সেই আক্রমণ আপন তরবারি কর্তৃক অট্টহাস্যে প্রতিরোধ করল বীরদত্ত,
-আরে রাজকুমারী! প্রাণে মারবেন নাকি!
-আমি অমনোযোগী? মায়ের নিকট অভিযোগ জানানো হচ্ছে! এই তুমি আমার পরম মিত্র? মিত্রসুলভ কোন কর্তব্য পালন করলে তুমি?
-আপনি অবশ্যই অমনোযোগী। আপনার শিক্ষাগুরুর দায়িত্বজ্ঞানে সেই সংবাদ আপনার মাকে জানানো আমার অবশ্য কর্তব্য। আর আমি অবশ্যই আপনার পরম বিশ্বস্ত মিত্র! আপনি আমাকে এই ক্ষণে ধন্যবাদ জানাবেন এই মর্মে যে, সারঙ্গীর পৃষ্ঠদেশে চেপে গতরাত্রির তৃতীয় প্রহরে আপনি মায়াকাননের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন, সেই কারণে আজ প্রাতকালে আপনার নিদ্রাভঙ্গ সম্ভব হয়নি, আপনার সঙ্গে গভীর সখ্যতা হেতু এই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আমি মহারানির নিকট গোপন রেখেছি! ধন্যবাদের পরিবর্তে আপনি আমার কন্ঠনালী তরবারি দ্বারা দ্বিখণ্ডিত করার প্রচেষ্টায় মগ্ন হয়েছেন কন্যা?
-তুমি এ সংবাদ অবগত হলে কীরূপে?
চমৎকৃত চিত্রার হস্ত হতে তরবারি খসে পড়ল। দরাজ হাসি উপহারস্বরূপ আপন ওষ্ঠ ও অধরে অঙ্কনপূর্বক বীরদত্ত ধূলিধূসরিত ভূমি হতে তরবারিটি তুলে চিত্রার হাতে দিয়ে বলল,
-এই অমরাবতী রাজ্যে একটি মৃগশাবকও আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে প্রবেশ বা প্রস্থান করতে অসমর্থ কন্যা। আপনি পারবেন, কোনকালেই এমন আশা করবেন না।
-আমি একদিন তোমার ঐ সতর্ক দৃষ্টিপথ পেরিয়ে মায়াকাননে পাড়ি দেব। মা-ও আমাকে নিষেধ করার সুযোগ পাবে না।
-এই ক্ষণে নিজেকে প্রস্তুত করুন রাজকন্যা। এই অমূল্য সময় হেলায় হারালে রাজসিংহাসন ও রাজ্যভার হতে চিরতরে বঞ্চিত হবেন। আমার শিক্ষা, মহারানির এতকালের আশা-ভরসা সকলই বিফলে যাবে। দেশভ্রমণের হেতু সমগ্র জীবনকালব্যাপী বিস্তর সময় পাবেন। এই ক্ষণে সর্বাগ্রে নিজেকে প্রস্তুত করুন। অস্ত্রশিক্ষার পূর্বে মনসংযোগ অত্যন্ত প্রয়োজন। আসুন, আপনি ওই প্রান্তে যোগাভ্যাস করুন, আমি শৈলকে তির ও ধনুকের... শৈল?
পিতৃসম রাজসেনাধ্যক্ষ তথা পরমপ্রিয় মিত্র বীরদত্তের সঙ্গে অম্লমধুর বাক্যালাপকালে চিত্রা শৈলর অবস্থান বিস্মৃত হয়েছিল। তরবারিটিকে কোমরবন্ধনীর মধ্যে স্থান দিয়ে চিত্রা বললেন,
-শৈল কোথায়?
-আমি দেখছি রাজকন্যা। আপনি আপন কার্যে মনোনিবেশ করুন। যোগাভ্যাস করুন।
-বেশ!
আপন তরবারি কোমরবন্ধনীতে রেখে বীরদত্ত প্রশিক্ষণক্ষেত্র হতে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ঘোড়াশালে পৌঁছল। শৈলজার অশ্ব মহানন্দে সবুজ উদ্যানে ভ্রমণপূর্বক আপন প্রাতরাশ সম্পন্নকার্যে মগ্ন। উদ্যান পেরিয়ে সেনা ছাউনির অগভীর দীঘির কাছে পৌঁছল বীরদত্ত। একেবারে অন্তিম সোপানে অবনত মস্তকে বসে রয়েছে একাকিনী শৈলজা। স্থির জলের উপরিভাগে তার মনমরা প্রতিবিম্ব তাকে রূঢ়ভাবে উপহাস করছে। মৃদুস্বরে আহ্বান করল বীরদত্ত,
-শৈল?
আপনার মাঝে হারিয়ে যাওয়া শৈলজা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পশ্চাতে মুখ ফেরাল।
-বীরদত্ত, আপনি! এই স্থানে?
-তোমাকে অন্বেষণ হেতু...
-কী প্রয়োজন?
-প্রশিক্ষণের সময় বয়ে যায় কন্যা...
স্নেহ ঝরে পড়ল বীরদত্তর দরাজ কন্ঠ হতে। কিন্তু অভিমানী শৈলজা দৃঢ়কন্ঠে বলল,
-যাক!
-এ শিশুসুলভ অভিমান নিতান্তই অযৌক্তিক মা!
-বীরদত্ত, আপনিও এ বিষয় অবগত আছেন, চিত্রা অপেক্ষা আমি অধিকতর জ্ঞানী, পরিশ্রমী ও মনোযোগী। কিন্তু পর্ণা-মা কোনকালেই আমাকে বিন্দুমাত্র স্নেহের যোগ্য মনে করল না! কেন?
অন্তিম সোপানে শৈলজার নিকটে এসে বসল বীরদত্ত। ধীরকণ্ঠে বলল,
-চিত্রা তাঁর আপন গর্ভজাত সন্তান শৈল।
-আর আমি পালিতা কন্যা, সেই কারণে আমার প্রতি এ হেন বিরূপ মনোভাব? সেই ক্ষণে মৃত্যুবরণ করার জন্য, পর্ণা-মা আমাকেও ওই রক্তাক্ত ক্ষেত্রে একাকী রেখে আসতে পারত! কেন কন্যাজ্ঞানে গ্রহণ করল! এই মাতৃতান্ত্রিক রাজ্যের রাজ সংবিধান আমিও অবগত আছি বীরদত্ত! সংবিধান কেবলমাত্র যোগ্য নারীকেই রাজ সিংহাসনে স্থান দেয়। সেইক্ষেত্রে নারীকে রাজ ঘরানার ক্ষত্রিয় কন্যা হতেই হবে, এইরূপ কোন বাধ্যবাধকতা সংবিধানে লিখিত নেই। চিত্রার ন্যায় অবোধ, অমনোযোগী, মূর্খ নারীর স্থান আমার পদতলে, রাজ সিংহাসনে নয়!
-শৈল! তুমি আমারই সম্মুখে অসহনীয় অপশব্দের মাধ্যমে পবিত্র অমরাবতীর মহারানি ও রাজকন্যার অসম্মান করছ। এমন অবমাননার কারণে আমি এই ক্ষণে তোমার দেহ দ্বিখণ্ডিত করলেও, মহারানির নিকট কোনরূপ জবাবদিহি নিষ্প্রয়োজন...
-আপনি তো কেবলমাত্র রাজভৃত্য বীরদত্ত! পর্ণা-মায়ের প্রত্যেকটি অন্যায় আচরণকে আড়াল করার প্রচেষ্টায় প্রাণপাত করেন কোন গোপন উদ্দেশ্যে? আপনি তো প্রতিপদে আমার প্রতি তার উদাসীনতার জ্বলন্ত সাক্ষী! তা সত্ত্বেও তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন? নতমস্তকে কেবলমাত্র ভৃত্যের ন্যায় তার প্রত্যেকটি আদেশ পালনের পূর্বে, তার প্রতিটি অপকর্মের সমালোচনা করুন। আপনি রাজভৃত্য, এ বাক্য সত্য। সেই সঙ্গে আপনি এই মহান অমরাবতী রাজ্যের একজন দায়িত্বশীল প্রজা। অন্তত সেই দায়িত্বের কথা স্মরণপূর্বক মহারানির কর্মকাণ্ডের যথাযথ সমালোচনা করুন। সেই কার্যে যে কিঞ্চিৎ পৌরুষ প্রয়োজন, বোধ করি তা এখনো আপনি আপনার মহামান্য রানির পদতলে বিসর্জন...
-শৈলজা! আমি তোমার শিক্ষাগুরু! এমন তোমার স্পর্ধা! আমার সঙ্গে বার্তালাভকালে তোমার এমন নিম্নরুচিকর বাচনভঙ্গি...
-চিত্রা রানি হওয়ার যোগ্য নয় বীরদত্ত। এ সত্য বাক্য স্বীকার করার সৎ সাহস আপনার নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সে এই মহান অমরাবতীর রাজসিংহাসন লাভ করতে পারবে না। আমার সঙ্গে তাকে সম্মুখ সমরে উপনীত হতেই হবে।
-যদি তাও হয়, চিত্রা জয়লাভ করবেই! আমি তোমার শুভাকাঙ্খী শৈল। এ অন্যায় চিন্তা মন হতে পরিত্যাগ করো...
তীক্ষ্ণ হাসি গোপন করে শৈলজা বলল,
-রাজপরিবারের নিকট আপন মস্তক আপনি বহুকাল পূর্বেই বিসর্জন দিয়েছেন, এ বাক্য আমি বহুপূর্বেই অবগত। তবে সেই সঙ্গে আপন মেরুদণ্ডখানিই যে রাজদরবারে গচ্ছিত রেখেছেন, এ সত্য আজ উপলব্ধি করলাম বীরদত্ত! শুভ্রকে শুভ্র এবং ধূসরকে ধূসর চিহ্নিত করার ন্যায় সৎ সাহসও আপনি হারিয়েছেন দেখছি। জীবন হতে ষোল বৎসরকাল হেলায় হারিয়েছে ওই নারী। আমিই এই রাজসিংহাসনের যোগ্য। নিজেকে সেইরূপে এ যাবৎকাল প্রস্তুত করেছি আমি। রাজসিংহাসন লাভের জন্য আমি আপন প্রাণত্যাগ করতে পারি, আবার একইরূপে নৃশংসভাবে মৃত্যুলীলায় মেতে উঠতে পারি। যথাসময়ে আপনিও তার প্রমাণ পাবেন বীরদত্ত। আপনি যথার্থই বলেছেন। আপনি কেবলমাত্র আমার শিক্ষাগুরু। তবে পরম মিত্র এবং হিতৈষী চিত্রার। তাই আমি কেবলমাত্র শিক্ষাপ্রদানের জন্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আপনি আমার জীবনের ন্যায়-অন্যায়ের পথপ্রদর্শক হওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেন না। করলেও, আপনার সকল প্রকার প্রচেষ্টা বিফলে যাবে। এক অবোধ বালিকার ন্যায় সরল চিত্রার মন। তার মনে রাজনীতি, কূটনীতি ও প্রখর রণনীতির কোন স্থান নেই। রাজ অন্দরমহলে সংগীতচর্চা ও নৃত্যকলা পরিবেশনপূর্বক সকলের মনোরঞ্জনের কার্য রূপসী চিত্রা কর্তৃক সম্পন্ন হতে পারে, তবে রাজতন্ত্র পরিচালনা একপ্রকার অসম্ভব! সেইরূপ দূরদৃষ্টিলাভের শিক্ষা ও প্রচেষ্টা, দুটির কোনোটিই তার নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ রাজ্য আমার!
-তোমার মনে মহারানি ও রাজকন্যার প্রতি যে বিদ্বেষ, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এমতাবস্থায় যদি রানি ও রাজকন্যার কোনরূপ বিপদ তোমার দিক হতে ধেয়ে আসে, তবে সর্বাগ্রে আমার তরবারির সঙ্গেই তোমার সাক্ষাৎ ও তীব্র সংঘাত ঘটবে শৈল।
-অসম্ভব নয়, আর আপনিও এ সত্য জানেন বীরদত্ত, প্রশিক্ষণকালে আপনার রণকৌশল সম্পর্কে আমি উত্তমরূপে অবগত হয়েছি। পর্ণা মায়ের বক্তব্য কি আপনি অনুধাবনে অক্ষম? আপনাকে পরাস্তপূর্বক আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে।
-রাজপরিবার তোমাকে নবজীবন প্রদান করেছে শৈল। তোমার অভিধান হতে কি কৃতজ্ঞতা নামক শব্দ চিরতরে অদৃশ্য হয়েছে? আপন মনে এতখানি বিদ্বেষ...
-মৃত্যুর যে করাল থাবা শৈশবেই আমার সুকোমল দেহকে ছিন্নভিন্ন করেছে, যে মরণ যাতনা আমি সহ্য করেছি, পারবে আপনার সুখী রাজকন্যা তেমন যন্ত্রণা সহ্য করতে?
প্রবল তেজে আপন দেহের উপরিভাগ হতে বস্ত্র টেনে নামিয়ে ফেলল শৈল। তার দক্ষিণ হস্তে জ্বলজ্বল করছে তরবারির গভীর আঘাতের চিহ্ন। ক্ষত উপশমের পর দীর্ঘকাল অতীত হলেও, ক্ষতচিহ্ন আজও একইভাবে বিরাজ করছে ওই নারীর দেহে। অবনত মস্তকে শৈলজার দেহ বস্ত্র দ্বারা আবৃতপূর্বক, ওই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হল বীরদত্ত। শৈলজার দুই চক্ষু হতে অবিরাম বারিধারা নিঃসৃত হল। কম্পিত কণ্ঠে শৈলজা বলল,
-কঠিন সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নেবেন বীরদত্ত?
-তোমাকে দর্শনপূর্বক ইতিপূর্বে আমার মনে স্নেহের যে গোপন ফল্গুধারা প্রবাহিত হত, এখন সেই স্থানে ভীতির সঞ্চার হয় শৈল। আমি ভীত মহারানি পর্ণা ও রাজকন্যা চিত্রার কারণে। যে বিষবৃক্ষ মহারানি আপন হস্তে লালন করেছেন, সে তাঁরই পশ্চাতে ও অজান্তে বিষ উদ্গীরণকার্য শুরু করেছে। কিন্তু তোমার প্রতি স্নেহ ও ভরসার কারণে, তিনি আমার একটিও বাক্য বিশ্বাস করবেন না। এ রাজপরিবারের ভাঙ্গন অনভিপ্রেত শৈল, সকল অভিমান মন হতে দূর করো। চিত্রার রাজ্যাভিষেকের জন্য মনের অন্তঃস্থল হতে আনন্দ করো কন্যা!
-চিত্রা রাজপরিবারের যোগ্য উত্তরাধিকারিণী নয়, এই সহজ সত্য আপনিও রানির কর্ণকুহরে প্রবেশপূর্বক, আমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করুন বীরদত্ত। কেবলমাত্র চিত্রা রানির আপন গর্ভজাত সন্তান, সেই কারণে কোন অযোগ্যের ছায়া ও স্পর্শ পবিত্র অমরাবতীর রাজসিংহাসনের উপর কাম্য নয়।
বীরদত্ত কোন কঠিন বাক্য প্রকাশের কারণে আপন ওষ্ঠ ও অধর চালনার পূর্বেই দূর হতে অত্যন্ত সোহাগী ও মধুর কন্ঠ ভেসে এলো,
-শৈল! ও সই লো! বীরদত্ত? এই প্রকাশ্য দিবালোকে কোন স্থানে আত্মগোপন করলে তোমরা?
চিত্রার আন্তরিক আহ্বানে সিক্ত হল বীরদত্তর হৃদয়। মুখাবয়বের ক্রুর হাসি গোপনপূর্বক শৈলজা বলল,
-সই! আমি এই স্থানে! বীরদত্ত আপন অতীতের স্মৃতিচারণায় কিঞ্চিৎ ব্যস্ত ছিলেন সই। তার সঙ্গে আমিও গল্পকথায় মগ্ন হয়ে, এই ক্ষণে বেলা বয়ে যায়। আমাদের স্নানঘরে প্রবেশের সময় হল, আসছি সই!
মুখে মৃদুহাসি অঙ্কনপূর্বক প্রতিটি সোপান দ্রুতগতিতে পেরিয়ে বীরের দৃষ্টিপথ হতে অদৃশ্য হয়ে গেল শৈলজা। দুই অভিন্নহৃদয় সখীর নির্ভেজাল হাস্যরস ও আলাপচারিতা বীরদত্তের কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও, মনে বিন্দুমাত্র আনন্দের উদ্রেক করল না। সহজাত ও সদাহস্যময় বীরদত্ত এই ক্ষণে অমরাবতীর ভবিষ্যৎ কল্পনাপূর্বক দুশ্চিন্তা ও গাম্ভীর্যের আবরণে বিলীন হয়ে গেল।
সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আপন কক্ষমধ্যে রক্তিম তরল দ্বারা একাগ্রচিত্তে আপনার পদযুগল রাঙিয়ে তুলতে ব্যস্ত ছিলেন চিত্রা। পূর্ব পরিকল্পনানুসারে প্রহরী ও শৈলর গোপন অভিসন্ধি কর্তৃক শৈল আচম্বিতে প্রবেশ করল চিত্রার কক্ষে।
-সই লো?
-মা মহাভৈরবী!! শৈল তুমি? উফ! আমার কম্পিত হস্তের আকস্মিক স্পর্শে পাত্র বুঝি এই ক্ষণে ভূমিতে গড়িয়ে যায়!
-এতখানি একাগ্রতা কোন কার্য হেতু?
-এসো এসো। প্রহরী তোমার আগমনবার্তা জানান দিল না যে! নিদ্রামগ্ন বুঝি?
-তাকে আমিই নিষেধ করেছি। তোমার এই ভীত মুখখানি দেখার বাসনা চরিতার্থ করার স্বার্থেই... বিপদকালে রাজকুমারীর হস্তমধ্যে সর্বাগ্রে অস্ত্র শোভা পায় সই, এইসকল সাধারণ প্রসাধনী নয়!
-তুমি বড়ই দুষ্ট শৈল! তোমার হাতে তো সর্বদা তরবারি প্রস্তুত! তুমি-আমি পৃথক নই। আমরা এক এবং অভিন্ন! তুমি সর্বদা আমাকে সকল বিপদ হতে রক্ষা করবে, এ আমি ঠিক জানি। আমি অন্ধভাবে তোমাকে ভরসা করি। ও... সই লো, আমার রাঙা পা দু'খানি দেখ! সুন্দর?
-অতীব সুন্দর! কোন সুদর্শন রাজপুত্তুরের জন্য সন্ধ্যাকালে এমন শৃঙ্গার সই?
-মা মহাভৈরবীই জানেন, সে কোন রাজ্যের রাজপুত্তুর! কোন শুভলগ্নে এ রাজ্যে পদার্পন করবেন! মন বড় ব্যাকুল তার দর্শন হেতু!
চিত্রার একঢাল অবিন্যস্ত কেশরাশি পরিচর্যাপূর্বক শৈল বলল,
-রাজ্যাভিষেকের অব্যবহিত পরই কোন সুদর্শন রাজপুত্তুর এসে তোমাকে বিবাহপূর্বক এ রাজ্যে আশ্রয় নেবে। তোমার এই মনোলোভা রূপের কাহিনি দিকে-দিকে প্রসারিত। সকল রাজপুত্তুর তোমাকে বিবাহের স্বার্থে কেবল আপন রাজ্য-রাজপাটই নয়, আপনার প্রাণও জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হবেন।
-তা হবেন!
-তোমার রূপের বড় অহংকার সই!
-যে মানুষের যা আছে, সে তো তার উপর অহংকার করবেই। এ তো অনায্য কিছু নয়। তুমি এমন রূপের অধিকারিণী হলে, তবে বুঝতে!
রাজকন্যার পদযুগল বড় যত্ন ও আন্তরিকতার সঙ্গে সুসজ্জিত করে দিল শৈল। স্বর্ণনির্মিত নূপুর ও রক্তিম তরলের স্পর্শে ওই দু'খানি চরণ সত্যই মনোলোভা হয়ে উঠেছে। এই চরণে না জানি কতশত রাজপুত্র আপনাকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হবেন! পর্ণা কর্তৃক প্রেরিত যাবতীয় স্বর্ণালংকারের সিংহভাগ আপন দেহে ধারণ করার পর, উচ্ছিষ্টের কিয়দংশ শৈলর পানে এগিয়ে দিলেন চিত্রা। আপন হস্তে প্রাণপ্রিয় সখীকে মনের মতো করে চিত্রা সাজালেন। অতঃপর শৈলজার চিবুক আপন হস্তদ্বারা স্পর্শপূর্বক বললেন,
-কে বলেছে তোমার রূপ নেই? এমন দু'খানি চক্ষু, পেলব গন্ডদেশ...
-আমি কোনকালেই এমন চিন্তা মনে ঠাঁই দিই না চিত্রা, যে আমার রূপ নেই! আমার বাহ্যিক রূপ নেই, আমি শ্রীহীন! এ বাক্য অবশ্যই সত্য! তবে আমার শিক্ষাদীক্ষা প্রতিনিয়ত আমার অন্তরের রূপকে জাগ্রত করে। কেবলমাত্র হৃদয়ের অন্তঃস্থল দর্শন হেতু, সত্য অনুসন্ধানের ন্যায় দৃষ্টি আবশ্যক।
-এ বড় সহজ সত্য কথা! তুমি বড় সুন্দর! আমার মন পূর্বরাত হতে বড় উদাস শৈল! তুমি জানো, আমি পূর্বরাতের তৃতীয় প্রহরে মায়াকাননের পথে পাড়ি দিয়েছিলাম।
আপন কক্ষ হতে অন্ধকারের আবরণে নিমজ্জিত মায়াকাননের পানে দৃষ্টিপাত করলেন চিত্রা। ভীত শৈল সেই স্থানে পৌঁছে চমৎকৃত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-পর্ণা-মা জানেন এ সংবাদ?
-না। তবে বীরদত্ত সকলই অবগত। আমার মন মায়াকাননের গভীর সৌন্দর্যে বারংবার অবগাহন করতে চায় শৈল। কিন্তু মা আপন রাজ্যে কেন যে আমাকে প্রবেশাধিকার দিতে চরমতম আপত্তি করেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি আজও অসমর্থ। বীরদত্ত হতে কত গল্পকথা শুনেছি। ওই মায়াকাননের শ্বাপদসংকুল চিরহরিৎ বনানীর কথা, অসংখ্য অপরিচিত বৃক্ষরাজির মাঝে জলে পরিপূর্ণ টলটলে চিত্রের ন্যায় সুন্দর এক দীঘির কথা। দীঘির উপরিভাগে অজস্র শতদল কি আজও প্রস্ফুটিত হয় শৈল? আমি ঐ দৃশ্য চর্মচক্ষে অবলোকন করতে ইচ্ছুক! আমার এ সমগ্র জীবনকাল বুঝি অসূর্যম্পশ্যারূপে অতিবাহিত হত। তবে যে কয় বৎসরকাল যাবৎ আমি সূর্যালোক ব্যতীত জীবনযাপন করেছি, সেই সময়কালের কথা সময়ে-অসময়ে স্মৃতিতে ভিড় করে শৈল। বৃন্দা-মা, উত্তরা-মা, ফাল্গুনী-মা, সকলের সঙ্গে পুনর্মিলনের বড় সাধ জাগে মনে। তোমার স্মৃতিপটে মায়াকাননের সৌন্দর্যের ছবি ভেসে ওঠে না শৈল?
-শৈশবের সকল স্মৃতি বড় অস্পষ্ট চিত্রা। সূর্যালোকের ভয়ে ভীত তুমি তখন মায়াকাননের রাজপ্রাসাদে বন্দিনি। আমি উত্তরা-মায়ের কোলে চেপে শম্বর দম্পতি পরিদর্শনে সেনা ছাউনি প্রান্তে পৌঁছে যেতাম। ফাল্গুনী-মা সেই ক্ষণে তোমার ক্রন্দনধ্বনি নিয়ন্ত্রণ হেতু, সুগন্ধী পুষ্পমাল্য দ্বারা তোমাকে নবরূপে সজ্জিত করে তুলতেন। ফাল্গুনী-মা সমস্ত দিবস ব্যাপী আমাদের সঙ্গেই অবসর যাপন করতেন। কাঞ্চনগড় হতে বৃন্দা-মায়ের আগমনে আমরা খেলার সঙ্গী পেয়ে, সীমাহীন আনন্দে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় অন্দরমহলের সবস্থানে অবাধ বিচরণ করতাম।
-যথার্থই শৈল! সই লো, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের সর্বাপেক্ষা সুন্দর সময় ওই দশ বৎসরকাল, যা আমি মায়াকাননে যাপন করেছি। কিন্তু পূর্বশ্রুত মায়াকাননের ওই অপার্থিব সৌন্দর্যে আকণ্ঠ অবগাহন করা হল না যে! এই ক্ষণে আমার নিকট পার্শ্ববর্তী রাজ্য মায়াকাননও যে দুরতিক্রম্য সই...
প্রহরী কর্তৃক বীরদত্তের আগমনের সংবাদ ভেসে এলো চিত্রার কক্ষদ্বার হতে। দুই সখীর সান্ধ্য বার্তালাভ ওই ক্ষণে স্থগিত রইল। তারা পরস্পরের হাত ধরে ফিরলেন কক্ষমধ্যে।
-বলো বীরদত্ত? কী সংবাদ?
-মহারানি পর্ণার নির্দেশ, রাজ্যাভিষেকের পুণ্যলগ্নের পূর্বে আপনি এই ক্ষণে আপনার তরবারি স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে পারেন। সেই পুণ্যকার্য হেতু...
-বীরদত্ত?
-বলুন চিত্রা?
-আমি পিতার তরবারিকে আপন ব্যক্তিগত ব্যবহার হেতু গ্রহণ করতে পারি না? ওই যে, মায়ের কক্ষে পিতার সুবৃহৎ তৈলচিত্রের সম্মুখে রক্তিম মখমলের উপর সিঁদুর-চন্দনচর্চিত যে সুবিশাল তরবারি মায়ের কক্ষের শোভা বহুলাংশে বর্ধন করছে, অসংখ্য রাত্রি মা ওই তরবারির পানে চেয়ে বিনিদ্র নিশিযাপন করছে... ওই তরবারিটিকে আমি আপন ললাটে স্পর্শপূর্বক আপনার নিকটে রাখার ইচ্ছা পোষণ করি বীরদত্ত। ওই তরবারিই আমার চাই।
-না কন্যা! আমি যদি মহারানি পর্ণা ও তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অবগত হয়ে থাকি, আর আমার ধারণার মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকে, তবে এই অমরাবতী রাজ্য এবং ওই প্রাণপ্রিয় তরবারিটি, রানি আপন জীবদ্দশায় দান করবেন না। রাজ্যের উত্তরসূরী আপনি। সেই হেতু রাজসিংহাসন ভবিষ্যতে আপনার নিকটেই আসবে। তবে ওই তরবারি?
মৃদুহাস্যে বীরদত্ত বলল,
-না! আপনাকেও না। এমন অসম্ভব ইচ্ছা এই ক্ষণে পরিত্যাগ করুন কন্যা!
কপট অভিমান প্রদর্শনকালে বীরদত্ত হতে মুখ ফেরালেন চিত্রা। বললেন,
-শৈলর ন্যায় তুমিও বড় দুষ্ট বীরদত্ত! তোমার সঙ্গে তিন দিবসকালব্যাপী বার্তালাভ বন্ধ! আমার দৃষ্টির সম্মুখ হতে দূর হয়ে যাও!
-বেশ! এই পরম প্রিয় মিত্রের কিঞ্চিৎ বেয়াদপি মার্জনা করবেন। বার্তালাভের বড় বিশেষ প্রয়োজন নেই, তবে মহারানির নির্দেশ যে পালন করতেই হবে কন্যা!
-কী নির্দেশ?
-এই ক্ষণে আপনি আমার সঙ্গে মায়াকানন ও অমরাবতীর সীমান্তে অস্ত্রাগারের যে বিপুল সম্ভার রয়েছে, সেই স্থান হতে সর্বসেরা তরবারিটি নিজের জন্য পছন্দ করবেন। আর ক্ষত্রিয় কন্যার তরবারি নির্বাচনের ন্যায় সেই পবিত্র কার্যে আমি আপনার সহায়তা করব। এ আমার পরম সৌভাগ্য! আপনি প্রস্তুত হয়ে নিন কন্যা। আমি কিছু সময় পরে...
-মায়াকাননের সীমান্তে? অর্থাৎ যে স্থানে সকল যাযাবর গোষ্ঠী, স্থানীয় প্রজা, পরিযায়ী শ্রমিক এবং উদ্বাস্তুদের মেলা বসে! ওই সুবিশাল প্রাঙ্গনে?
-আমাদের গন্তব্য ওই প্রাঙ্গন পেরিয়ে। তবে ওই প্রাঙ্গনের মধ্য হতেই আমাদের পথ।
-আমি মৃত্তিকা নির্মিত অলংকার ক্রয়ের ইচ্ছা রাখি। সই চলো...
-না! শৈল যাবে না। কেবল আপনি ও আমি। তরবারি নির্বাচনকালে কেবলমাত্র সেনানায়ক আপনার সঙ্গে থাকবে, মহারানির এমনই ইচ্ছা!
চিত্রার সকল উৎসাহ মুহূর্তে অস্তমিত হল মলিন মুখাবয়বের অন্তরালে। মৃদুস্বরে ও আহ্বান করল,
-সই লো! মায়ের আদেশ!
-তুমি সানন্দে যাও চিত্রা। আমি এই স্থানে তোমার নূতন তরবারি দর্শন হেতু অপেক্ষায় রইলাম। সম্ভব হলে ওই মিলনমেলা প্রাঙ্গন হতে আমার জন্য একখানি ঝুটো গজমোতির অলংকার উপহারস্বরূপ অবশ্যই এনো। আমার বড় ভালো লাগবে।
-কিঞ্চিৎ উপহারেই তুমি সন্তুষ্ট! এই কারণেই তোমাকে আমি এত ভালোবাসি সই।
-তুমি প্রস্তুত হও, আমি এই ক্ষণে আপন কক্ষে প্রস্থান করি।
চিত্রার কক্ষ হতে শৈলজার প্রস্থানের পর বীরদত্ত মৃদুহাস্যে চিত্রাকে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় গ্রহণ করল। দেহ হতে কিছু স্বর্ণালংকারের ভার লাঘবপূর্বক, সামান্য প্রসাধন ও অলংকারে নিজেকে সজ্জিত করে, একটি উত্তরীয় হতে কিছু অংশ ছিন্ন করে আপন মুখমণ্ডলের কিয়দংশ আবৃত করলেন চিত্রা। কেবল দীঘল দুই চক্ষু রইল অবগুণ্ঠনমুক্ত। বীরদত্ত চিত্রার কক্ষ হতে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মৃদু নারীকণ্ঠের আহ্বানে থমকে দাঁড়াল। অন্দরমহলের আলো-ছায়াঘেরা পরিবেশে বীরদত্ত দেখল, শৈলজা একটি প্রস্তরমূর্তির আড়াল হতে বেরিয়ে বীরদত্তর সম্মুখে উপস্থিত হল। প্রবল শ্লেষমিশ্রিত বাক্য নির্গত হল শৈলজার কন্ঠ হতে,
-আপনি মিথ্যা বলছেন বীরদত্ত। পর্ণা-মা আমাকে চিত্রার সহগামিনী হতে কখনোই নিষেধ করেননি। এ সকলই আপনার মনগড়া মিথ্যা বাক্য! আপনি চিত্রা হতে আমার দূরত্ব বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে এই মিথ্যা কথার আশ্রয় নিয়েছেন। এইরূপে আপনি আমার ষড়যন্ত্র হতে চিত্রাকে রক্ষা করবেন!!
-আমরণ!
বীরদত্ত দ্বিতীয় কোন কটু বাক্যের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। আপন মনে অন্দরমহল হতে প্রস্থান করে চিত্রাঙ্গদার প্রাণপ্রিয় অশ্ব সারঙ্গীকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করল।
(ক্রমশ....)
চিত্র : সংগৃহীত



 

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০২২

সপ্তপর্ণী (দ্বিতীয় খণ্ড) (দ্বিতীয় পর্ব)


 


সপ্তপর্ণী

সাথী দাস

দ্বিতীয় খণ্ড

দ্বিতীয় পর্ব


মায়াকানন রাজ্যে রাজপ্রাসাদের সম্মুখভাগে যে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, সেই প্রাঙ্গণে পর্ণার আপন হস্তনির্মিত কৃত্রিম মায়াকানন অযত্নে ও পরিচর্যার অভাবে বর্তমানে মৃতপ্রায়। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে রুক্ষ ধূলিধূসরিত পথমাঝে আপন উদাস দৃষ্টিপাতপূর্বক প্রাসাদের উন্মুক্ত অংশে রানি বসেছিলেন। গর্ভ মধ্যস্থিত ক্ষুদ্র প্রাণটি মুহূর্মুহু হস্ত ও পদ সঞ্চালনার মাধ্যমে আপন অস্তিত্ব জানান দেয়। সুবৃহৎ উদরের কারণে আপন কক্ষমাঝে পর্ণা প্রায় বন্দি জীবনযাপন করেন। অদূরে উত্তরা ও ফাল্গুনী একাধিক বিহঙ্গ পরিবারকে শস্যদানা প্রদানে ব্যস্ত। ময়ূর দম্পতির কর্কশ কেকাধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র মায়াকাননের দিক হতে দৃষ্টি ফেরালেন পর্ণা। প্রহরী বীরদত্তের আগমনবার্তা জানান দিলে উত্তরা ও ফাল্গুনীর সাহায্যে আপন সুবিশাল বপু ও উদর বয়ে নিয়ে, সপ্তপর্ণী কক্ষমধ্যে গমন করলেন।

-শুভ সন্ধ্যা রানি।
-শুভ সন্ধ্যা বীরদত্ত। দূত কর্তৃক প্রাপ্ত দুঃসংবাদ অবগত আছ তুমি?
-আছি মহারানি। অমরাবতীর রাজধানীতে কোন এক অজানা রোগের প্রকোপে একাধিক প্রাণহানির সংবাদ আমার মনকে যারপরনাই ব্যস্ত করে তুলেছে। প্রজার সম্পত্তি, গবাদি পশুর প্রাণ, এই ক্ষণে সকলই একপ্রকার বিপন্ন। আমি অতিশয় ভীত। তবে গর্ভাবস্থার অন্তিমকালে এই সংবাদ আপনার নিকট প্রকাশ করতে আমি অসম্মত ছিলাম। সেই কারণেই...
-রোগের বিস্তারিত বিবরণ দাও বীর।
-রোগীর বমন ইচ্ছা দমন করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে বিষ্ঠা পরিত্যাগকালে রোগীর প্রাণান্তকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রক্তবমি ও ভেদবমির প্রাদুর্ভাব রাজধানীর একাধিক নগরে বিস্তার লাভ করেছে। রাজপ্রাসাদ হতে প্রাপ্ত তাঁবুর কাপড় দ্বারা একাধিক ছাউনি নির্মাণ করে, বৃদ্ধ রোগীদের পৃথকভাবে রাখা হয়েছে। শিশু, যুবক ও স্ত্রীলোকদের সেবায় নগরের প্রায় প্রত্যেক বৈদ্য প্রাণপাত করছেন।
-চিকিৎসার প্রয়োজনে এই ক্ষণে রাজকোষ হতে অর্থ সাহায্য...
-আপনার সীলমোহর ব্যতীত অমরাবতীর রাজকোষ উন্মুক্ত করা কোনপ্রকারেই সম্ভব নয় রানি।
-সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রস্তুত করো। দূতকে আমার কক্ষে...
-না!

বীরদত্তের দরাজ কণ্ঠে কম্পিত হয় পর্ণার অন্তরাত্মা। অন্দরমহলের অপর অংশ হতে উত্তরা এসে পৌঁছয় পর্ণার নিকট। পর্ণা অত্যন্ত রূঢ়কণ্ঠে বলেন,

-আমার সম্মুখে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার? তোমার স্পর্ধা তো বড় কম নয় বীর!
-ক্ষমা করবেন। আমার দেহে প্রাণ থাকতে রাজধানীর দূতকে এই কক্ষে প্রবেশাধিকার আমি দেব না। আপনি উত্তরা হতে সে দুঃসংবাদ অবগত হয়েছেন, বিশেষ কোন বক্তব্য দূতের নিকট পৌঁছনোর প্রয়োজন হলে, সে পৌঁছে দেবে। আমিও সশরীরে বর্তমান। কিন্তু দূত এই কক্ষে প্রবেশ করবে না।
-আমার অনুমতি ব্যতীত আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তুমি হস্তক্ষেপ করবে! এতখানি স্পর্ধা...
-পর্ণা, উত্তেজনা আপনার দেহের পক্ষে কদাচ সুখদায়ক নয়। শান্ত হোন!
-স্তব্ধ হও উত্তরা! এই মূর্খের এতখানি স্পর্ধা...
-বীরদত্ত! আপনি এই কক্ষ হতে এই ক্ষণে প্রস্থান করুন।
-আমি কক্ষদ্বার আগলে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করব। তবুও এই কক্ষে দূতের প্রবেশাধিকার...
-বীরদত্ত!!
-পর্ণা!

বীরদত্তর দুই চক্ষু হতে যে তীব্র রোষানল নির্গত হল, সেই ক্ষণে পর্ণার মনে হল, ওই রোষানলে তিনি অবলীলায় ভস্মীভূত হয়ে যাবেন। পর্ণার দেহ কম্পিত, শ্বাসগ্রহণও ক্রমে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। আপন উদর আলিঙ্গন করে শয্যাপ্রান্তে উপবেশন করলেন তিনি। উত্তরা পর্ণার শিথিল দেহে স্নেহমিশ্রিত হস্তচালনা করামাত্রই, সেই মুহূর্তে পর্ণার পদতলে স্থানগ্রহণ করে বীরদত্ত বলল,

-রাজধানী হতে দূত এসেছে। নগরে মারণ রোগের প্রকোপ ক্রমবর্ধমান রানি। মড়ক লেগেছে। নগর হতে মায়াকাননের উদ্দেশে দুইজন যাত্রা করেছিল। কিন্তু পথমধ্যে ওই সংক্রামক মারণ রোগের কারণে এক দূতের মৃত্যু হয়। দূতের হতভাগ্য অশ্বটিও পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে। এমন মহামারীর রাজ্য হতে যে মানুষের আগমন, তার সম্মুখে আপনি যাবেন না। ওই দূতের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আপনার ও এই সন্তানের জন্য সমূহ বিপদ বয়ে আনতে পারে। আপনার এই রাজ্যের সকল প্রজার নিরাপত্তার জন্যই আমি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি রানি। তাকে পৃথক স্থানে রেখেছি। আমি এবং উত্তরা ওই দূত হতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। অমরাবতীর রাজদূতের এই মায়াকাননে কোনরূপ অসম্মান হবে না। আমি নিজ উদ্যোগ ও কর্তব্যজ্ঞানে সকল বিষয় সজাগ দৃষ্টিপাত করছি। আহার্য খাদ্য পানীয় সকলই তার কক্ষে যথাসময়ে প্রেরণপূর্বক, তাকে রাজ অতিথির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আমার জীবদ্দশায় আপনার কক্ষে সে প্রবেশাধিকার পাবে না। গর্ভাবস্থার অন্তিম ক্ষণে নিজের অমূল্য জীবনে, আপন সন্তানের জীবনে কোনরূপ অযাচিত বিপদ ডেকে আনবেন না। বিনীত অনুরোধ! আমাকে ভুল বুঝবেন না রানি! আমি আপনার সকল সিদ্ধান্তকে আপন ধর্ম জ্ঞানে নতমস্তকে মান্যতা দিয়ে থাকি। সর্বদা প্রাণপাত করি আপনার জন্য, কিন্তু আপনার ব্যক্তি-সিদ্ধান্তে যদি আপনারই সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা পরিলক্ষিত হয়, তবে তেমন সিদ্ধান্তে আমি আমরণ আপনারই বিরুদ্ধাচরণ করব মহারানি পর্ণা।

শয্যা হতেই স্থির দৃষ্টিতে পর্ণা বীরদত্তর পানে চেয়ে রইলেন। উত্তরা পর্ণাকে আলিঙ্গনপূর্বক মৃদুভাষে বলল,

-রাজসেনাপতির আশঙ্কা নেহাৎ অমূলক নয় রানি। তিনি আপনার স্বাস্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং উদ্বিগ্ন। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও আপন স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিচার করে আপনি অচিরেই সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রদানপূর্বক দূতকে অমরাবতী রাজ্যে ফিরিয়ে দিন। এই স্থানে দূতের দীর্ঘক্ষণ যাপন, মায়াকাননের পক্ষে যথেষ্ট বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

শয্যা হতে পর্ণা বীরদত্তের পানে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিবিনিময় করে বলল,

-ওঠো বীর! সীলমোহর ও অনুমতিপত্র প্রস্তুত করে পুনরায় আমার কক্ষে ফিরে এসো।
-যথা আজ্ঞা রানি!

পর্ণাকে অভিবাদনপূর্বক কক্ষ হতে প্রস্থানকালে পুনরায় পর্ণার কাতর আহ্বানে বীরদত্ত ফিরল,

-তুমি আপন রাজ্যে ফিরবে না বীর? রাজ্যের এমন সংকটকালে...
-রাজ্যে শত্রু আক্রমণকালে রাজসেনাপতির কিছু অবশ্য কর্তব্য থাকে। কিন্তু এ যুদ্ধে যে মৃত্যু মিছিলের পরিসংখ্যান প্রতিনিয়িত ঘোষিত হচ্ছে, বৈদ্য ব্যতীত আমি এবং অমরাবতীর অস্ত্রাগার সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে অক্ষম রানি। আমি আশাবাদী, অভিজ্ঞ রাজবৈদ্যের নির্দেশে অবিলম্বে এই যুদ্ধজয় সম্ভব। আগামী এক পক্ষকালের পূর্বেই আপনি সন্তান জন্ম দেবেন। আপনি এবং অমরাবতীর ভবিষ্যৎ রানি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সম্পূর্ণরূপে বিপদমুক্ত, এই সংবাদ পরিপূর্ণরূপে অবগত হওয়ার অব্যবহিত পরই আমি এই রাজ্য হতে বিদায় গ্রহণ করব। অতঃপর আপনার ইচ্ছানুসারে নির্দিষ্ট সময়ে মহাসমারোহে আপনাকে এবং অমরাবতীর উত্তরাধিকারণীকে রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাব ওই মায়াকাননের পথ ধরে... আপনি বিশ্রাম গ্রহণ করুন রানি। আমি অমরাবতীর সীলমোহর ও অনুমতিপত্র সহ এই কক্ষে ফিরে আসছি।

ক্লান্ত পর্ণা আপনার কক্ষ হতে বিহ্বল দৃষ্টিপাত করলেন মায়াকাননের পানে। সেই নিকষ কালরাত্রির অন্তিম প্রহরে উত্তরা ও ফাল্গুনী কর্তৃক পর্ণা সংবাদ পেলেন, অমরাবতীর ওই রাজদূত কিছু পূর্বেই বারকয়েক ভেদবমি হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। রাত্রি প্রভাত হওয়ার পূর্বেই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বনপূর্বক ওই দূতের পার্থিব দেহ ও তার ব্যবহার্য সকল পোশাক এবং বিষ্ঠায় আবৃত উত্তরীয়টি স্বহস্তে আগুনে ভস্মীভূত করল বীরদত্ত। নিজ পরনের অন্তিম পোশাকটিও ওই ক্ষুদ্র
অগ্নিকুণ্ডে প্রদানপূর্বক নষ্ট করে মায়াকানন রাজ্যকে জীবাণু হতে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে বীরদত্ত সচেষ্ট হল। প্রথম প্রভাতে পর্ণার কক্ষ হতে অদূরে অবস্থিত জলাশয়টিতে আকণ্ঠ ডুবে যখন বীর নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখার সর্বোত প্রচেষ্টায় স্নানাদি কার্যে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তে আপন কক্ষ হতে বীরদত্তের পানে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন সদ্য নিদ্রাভঙ্গপূর্বক শয্যাত্যাগী পর্ণা। আপন উদরে পরম স্নেহে হস্তচালনাপূর্বক মনে মনে বারংবার বীরকে ধন্যবাদ জানানোর আকুল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আবেগে ও কৃতজ্ঞতায় সপ্তপর্ণী প্রথমবার ভাষাহীন হলেন। আপন গন্ডদেশে হস্তচালনাকালে বীরদত্তের সিক্ত পৃষ্ঠদেশের পানে দৃষ্টিপাত করে চমৎকৃত হলেন পর্ণা। বীরের পৃষ্ঠদেশে একাধিক ক্ষুদ্র বৃহৎ গভীর ক্ষতচিহ্ন। এই সকল চিহ্নই কি অমরাবতী রাজ্যের প্রতি তার গভীর বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরিচয় বহন করছে! ক্ষার, সর্জিকা চূর্ণ ও ধূসর মৃত্তিকাতে আবৃত বীরের সুঠাম দেহের ঊর্ধ্বভাগের কিয়দংশ। নিম্নভাগ জলাশয়ের গভীরে বিলীন হয়েছে। অবিন্যস্ত সুদীর্ঘ সিক্ত কেশগুচ্ছ গ্রীবা হতে প্রসারিত হয়ে পৃষ্ঠদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পর্ণা মুগ্ধ দৃষ্টিতে বীরের পানে চেয়ে রইলেন। সেই ক্ষণেই সবুজাভ জলাশয়ের গভীরে একাধিকবার বিলীন হয়ে, ক্ষুদ্র তরঙ্গের অভ্যন্তরভাগ হতে বীর আপন উত্তরীয় ব্যতীত উঠে আসতে সচেষ্ট হল। সেই দৃশ্য অবলোকনমাত্রই মুহূর্তে আপন কক্ষের উন্মুক্ত স্থান হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলেন পর্ণা। তবে অন্তিম ক্ষণে এক লজ্জাহীন ময়ূর আপন নয়নাভিরাম পুচ্ছ প্রসারিতপূর্বক কর্কশধ্বনির মাধ্যমে নবপ্রভাতের সূচনাকাল ঘোষণা করল। সচকিত বীরদত্ত ওই অবোধ জীবের প্রতি সদয় দৃষ্টিপাত করার মুহূর্তে আপন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার দ্বারা এই বিষয় সহজেই অবগত হল, সেই ক্ষণে ওই স্থানে স্বচ্ছ উত্তরীয়র অন্তরাল হতে কোন মানুষ এইদিক পানেই সজাগ দৃষ্টি প্রদান করছিল। বীরদত্তর দৃষ্টি সম্মুখে রাজপ্রাসাদের ওই সুদৃশ্য কক্ষ মহারানি পর্ণার। এ বাক্য স্মরণে আসামাত্রই দৃষ্টি অবনত হল কুণ্ঠিত বীরদত্তর। জলাশয়ের প্রান্ত হতে প্রস্তরনির্মিত নিম্নগামী প্রতিটি সোপান অতিক্রম করে ধীর পদক্ষেপে বীরদত্ত জলের গভীরতায় পুনরায় বিলীন হল। প্রহরী কর্তৃক প্রেরিত উত্তরীয় দ্বারা আপন দেহের নিম্নভাগ আচ্ছাদিত করল বীরদত্ত। অতঃপর সেই স্থান পরিত্যাগ করে আপন কক্ষে প্রস্থান করল। মারণ রোগ ও জীবাণুর কারণে ভীত বীরদত্ত কিছুকাল স্বেচ্ছায় নিভৃতাবাসে থাকা মনস্থির করল। আপন কক্ষমাঝে পৌঁছে রুদ্ধদ্বারের অন্তরালে যে ক্ষণে উত্তরীয় পরিত্যাগ করে সুদীর্ঘ দর্পণে বীরদত্ত আপন সুঠাম প্রতিবিম্ব পানে দৃষ্টিপাত করল, মহারানি পর্ণা সেই ক্ষণে অগ্রসর হয়েছেন স্নানঘরের উদ্দেশে।

কিছুকাল পর অমরাবতী রাজ্যে রোগের প্রকোপ খানিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও পর্ণার প্রসববেদনা সহ্যশক্তির সকল সীমারেখা অতিক্রম করল। প্রসূতিগৃহ হতে পর্ণার গগনবিদারী চিৎকার ও ক্রন্দনধ্বনি বীরদত্তের কর্ণকুহরে প্রতিক্ষণে অগ্নি বর্ষণ করছিল। তীব্র শারীরিক যাতনায় জ্বরাক্রান্ত বীরদত্ত নিজেও পরিশ্রান্ত। নাড়ি অত্যধিক মাত্রায় চঞ্চল। হস্ত ও পদযুগল হিমের ন্যায় শীতল। রাত্রির প্রথম প্রহরে আপন শয্যায় উপবিষ্ট বীরদত্ত, পর্ণার তীব্র ক্রন্দনধ্বনি সহ্য করতে না পেরে দুই চক্ষু মুদলেন। পর্ণার প্রসব যন্ত্রণা প্রারম্ভের কিছু পূর্বেই নবজাতিকার আগমনলগ্নে সশরীরে উপস্থিত থাকার অভিপ্রায়ে কাঞ্চনগড় হতে মায়াকাননে এসে উপস্থিত হয়েছেন বিনোদিনী। কুলুঙ্গি মধ্যস্থিত দীপের কম্পিত আলোকবৃত্ত ও কক্ষের আলোছায়াঘেরা পরিবেশ, বীরদত্তের মন এবং দৃষ্টিপথে চরম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করল। স্বল্প আলোয় বীরদত্ত উপলব্ধি করল, স্বয়ং পর্ণা তার উষ্ণ ললাটে আপন শীতল ও কোমল হস্তখানি স্পর্শপূর্বক দৈহিক উষ্ণতার তীব্রতা খানিক প্রশমিত করছেন। সেই ক্ষণেই প্রসূতিগৃহ হতে তড়িৎগতিতে ধেয়ে আসা বৃন্দা ও আরও কয়েকজন পরিচারিকার সম্মিলিত নুপূরধ্বনি কর্তৃক, বীরদত্তের সুখস্বপ্নের অবসান হল। কর্ণকুহরে পুনরায় প্রবেশ করল পর্ণার কাতর আর্তনাদ! যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহেই শয্যাত্যাগ করতে তৎপর হল বীরদত্ত। প্রহরীর সকল বাধা অস্বীকারপূর্বক কক্ষ হতে নির্গত হয়ে কাতর কণ্ঠে আহ্বান করল,

-বৃন্দা?

উষ্ণ জলের পাত্রখানির দায়িত্ব পরিচারিকার উপর অর্পণ করে বৃন্দা শীঘ্র ফিরল বীরদত্তর কাছে।

-বীরদত্ত! আপনি আহত! রক্তাক্ত! তাপপ্রবাহে দেহ শিথিল। এমতাবস্থায় শয্যাত্যাগ করলেন কেন?
-আমি সম্পূর্ণ সুস্থ! দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত বৃন্দা। শিশুর ক্রন্দনধ্বনি আমার মনকে এই ক্ষণেও শীতলতা প্রদান করতে পারেনি। পর্ণার তীব্র বেদনা ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠছে! আর কতক্ষণ বৃন্দা? আপনি জানেন কোন সংবাদ? আর কত সময় পর্ণা এমন কষ্ট সহ্য করবেন?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শ্রবণমাত্র হতবাক বৃন্দা বিস্ফারিত নেত্রে বীরদত্তের পানে বহুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বীরদত্তের গ্রীবাদেশে রক্তের শুষ্ক চিহ্ন। গভীর ক্ষতস্থানের উপরিভাগে অজস্র ভেষজ জড়িবুটি কর্তৃক রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও অত্যন্ত দুর্বল বীরদত্ত। বৃন্দা বীরদত্তের দৈহিক অবস্থা অবলোকনপূর্বক চিৎকার করে আহ্বান জানালেন,

-প্রহরী!
-বৃন্দা! প্রহরীকে আহ্বান নিষ্প্রয়োজন। আমি এই ক্ষণে প্রস্থান করব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর?

পর্ণার করুণ ক্রন্দনধ্বনি প্রসূতিগৃহ হতে অন্দরমহল পেরিয়ে ভেসে এলো। সেই আর্তনাদ বৃন্দা ও ভয়ার্ত বীরদত্তের হৃদয়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। ধীরকণ্ঠে বৃন্দা বললেন,

-আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমার নিকট নেই বীরদত্ত! তার পূর্বনির্ধারিত সময়েই সে এই পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করবে। কিঞ্চিৎ পূর্বে অথবা পশ্চাতে নয়। সেই ক্ষণ পর্যন্ত এই গর্ভযন্ত্রণার অবসান বা উপশম, কোনপ্রকারেই সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চিন্তে আপন কক্ষে বিশ্রাম গ্রহণ করুন। সুসংবাদ যথাসময়ে আপনার নিকট অবশ্যই পৌঁছে দেওয়া হবে।

বৃন্দার নিক্কনধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র, বীরদত্তের নিকট এই অস্থিরতা অত্যন্ত অসহ্য হয়ে উঠল। দ্রুতগতিতে প্রসূতিগৃহে প্রবেশপূর্বক কক্ষদ্বার রুদ্ধ করল বিনোদিনী। নারীকণ্ঠের এক অন্তিম আর্তনাদ অবিলম্বে বীরদত্তের নিকট পৌঁছল। গর্ভযন্ত্রণা হতে মুক্তির জন্য পাগলিনি পর্ণার উদভ্রান্ত দৃষ্টির সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন রাজমাতা নলিনীদেবী। গভীর সোহাগে স্নেহচুম্বন দ্বারা স্পর্শ করলেন আপন কন্যার ঘর্মাক্ত ললাট। অতঃপর পর্ণার সুতীব্র ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে সমগ্র অন্দরমহলে একটিমাত্র শব্দের প্রতিধ্বনি, "মা...!" এই শব্দের পরই প্রসূতিগৃহ হতে নির্গত শিশুর ক্রন্দনধ্বনিতে মুখরিত হল সমগ্র মায়াকানন। বীরদত্ত দ্রুত শয্যা ত্যাগপূর্বক পৌঁছলেন আপন কক্ষের বাইরে। প্রসূতিগৃহের দ্বার অবরুদ্ধ। ভিতরে পর্ণা জ্ঞান হারিয়েছেন। সদ্য জন্মগ্রহণ করা একটি ক্ষুদ্র প্রাণের মাতৃসুধার সন্ধান অব্যাহত। দুই চক্ষু উন্মোচন করে পৃথিবীর রূপ প্রত্যক্ষ করতে বদ্ধপরিকর পৃথ্বীশ ও পর্ণার গভীর প্রেমের সদ্য প্রস্ফুটিত মুকুল.... শয্যাপ্রান্তে দুটি চক্ষু উন্মোচনপূর্বক দেহের আলস্য পরিত্যাগ করে উঠে বসলেন ষোড়শী চিত্রাঙ্গদা। প্রথম প্রভাতের আলো শয্যাপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আপন কক্ষের জানালা হতে অমরাবতীর নীলাভ নভোমণ্ডলের পানে চিত্রাঙ্গদা দৃষ্টিপাত করলেন। কক্ষপ্রান্তে একটি রূপোর পাত্রে অজস্র সুগন্ধী পুষ্প আপন সৌরভ কর্তৃক চিত্রার প্রভাতের শুভ সূচনা করতে সচেষ্ট। পুষ্পলতার পানে ক্ষণিক দৃষ্টিদান করে জানালার উপর উপবেশন করলেন চিত্রা। সেই ক্ষণে প্রশিক্ষণের ধূলিধূসরিত ক্ষেত্রে বীরদত্তকে অস্ত্রশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে দেখে, দ্রুতগতিতে আপন দেহ হতে সামান্য স্বর্ণালংকার ও স্বচ্ছ কঞ্চুলিকা পরিত্যাগ করে চিত্রাঙ্গদা প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে উপনীত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। চিত্রাঙ্গদা যে সময় আপন প্রাণাধিক প্রিয় অশ্ব সারঙ্গীর পৃষ্ঠে চড়ে প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে পৌঁছলেন, সেই সময়ে বীরদত্ত তির ও ধনুক সহযোগে বহু যত্নে শৈলজাকে প্রশিক্ষণ প্রদানকার্যে ব্যস্ত ছিল। সকলকে যারপরনাই চমৎকৃত করে সর্বসমক্ষে উপস্থিত হলেন সদাহাস্যময়ী মহারানি সপ্তপর্ণী। অস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক বীরদত্ত নতমস্তকে পর্ণাকে প্রভাতী অভিবাদন জানাল। শৈলজা তির ধনুক ত্যাগ করে ও চিত্রাঙ্গদা অশ্ব হতে অবতরণপূর্বক দ্রুতগতিতে পর্ণার পদযুগল স্পর্শ করল। চিত্রাঙ্গদা ও শৈলজা একত্রে বললেন,

-মা তুমি! আমাদের প্রশিক্ষণক্ষেত্রে?

(ক্রমশ....)
চিত্র : সংগৃহীত

সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২২

সপ্তপর্ণী (দ্বিতীয় খণ্ড) (প্রথম পর্ব)


 


সপ্তপর্ণী

সাথী দাস

দ্বিতীয় খণ্ড

প্রথম পর্ব 



লেলিহান চিতার আগুনে ও যুদ্ধ পরবর্তীকালে প্রায় ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া অমরাবতী রাজ্যের মধ্যভাগে অবস্থিত গগনচুম্বী রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদের অভ্যন্তরভাগে পৃথ্বীশের শয্যায় অবসন্নদেহী পর্ণা গভীরভাবে নিদ্রামগ্ন। অমরাবতীর সুবিস্তৃত নভোমণ্ডলে দর্শন মেলে না কোন বিহঙ্গ পরিবারের। সমগ্র আকাশব্যাপী কেবল বিধ্বংসী আগুনের শিখা, ধুম্রজাল ও চতুর্দিকে স্বজন হারানোর মর্মান্তিক আর্তি। অদূরে আপন উদ্যোগে ও স্বহস্তে অসংখ্য অস্থায়ী সেনা ছাউনি নির্মাণ করেছেন অমরাবতীর রাজসেনাধ্যক্ষ বীরদত্ত। প্রাথমিক চিকিৎসা চলাকালীন আহত ও অঙ্গহারা অজস্র সৈন্যদের যে প্রচণ্ড আর্তনাদ, তা পর্ণার কর্ণকুহরে প্রবেশমাত্র, তাঁর গভীর নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটল। চক্ষুদ্বয় উন্মোচনপূর্বক তিনি আপন প্রেমাস্পদের শয্যা আলিঙ্গন করে, দীর্ঘক্ষণ মৃতবৎ স্থবির হয়ে রইলেন। অতঃপর বীরদত্তের ব্যস্ত ও উদাত্ত কন্ঠ রানির কক্ষে প্রবেশমাত্র, রাজ্যের প্রয়োজনজ্ঞানে সুখশয্যা ত্যাগ করলেন মহারানি সপ্তপর্ণী। আপন রাত্রিবাস পরিত্যাগপূর্বক সবুজাভ আবরণ ও স্বল্প স্বর্ণালংকারে সজ্জিতা রানি আপন কক্ষদ্বার উন্মোচন করে রণসজ্জায় সজ্জিত বীরদত্তের সম্মুখে হাজির হলেন। দীর্ঘ অনিদ্রা ও অনাহারের কারণে হতচকিত পর্ণার দৃষ্টির সম্মুখে একাধিক বীরদত্তের মুখমণ্ডল নৃত্য করতে শুরু করল। প্রস্তরভূমির পানে ক্ষণিক দৃষ্টিপাত করে নিজেকে স্থির রাখার ব্যর্থ প্রয়াসে বিফল হয়ে মৃদুভাষে পর্ণা বললেন, 


-যুদ্ধশেষেও এমন রণসজ্জার কারণ বীরদত্ত? হাতে অস্ত্র! কী তোমার অভিপ্রায়? আপন রাজ্যের উদ্ধারকার্য কী এখনও অব্যাহত? আমার সঙ্গে সম্মুখ সমরে উপনীত হতে চাও? অমরাবতীর সিংহাসনের প্রতি লুব্ধ তুমি! দেহে প্রাণ থাকতে আমি এই অমরাবতী রাজ্য পরিত্যাগ করব না। জটিল রাজনীতি তোমার মনের অভ্যন্তরে চলাকালীন, আমি তা অনুভবে সক্ষম বীরদত্ত।


অকারণ উত্তেজনা ও অস্থির বাক্যব্যয়ের কারণে পর্ণার দুর্বল দেহ ক্রমে শিথিল হয়ে এলো। কক্ষদ্বার মুষ্টিবদ্ধপূর্বক আপ্রাণ প্রচেষ্টায় নিজের অনিবার্য পতন রোধ করলেন তিনি। পর্ণার পদতলে বসে অবনত মস্তকে বীরদত্ত বলল, 


-ক্ষমা করুন রানি। আমার এমন কোন অভিপ্রায় নেই। আপনার বিরুদ্ধাচরণের ন্যায় এইরূপ দুঃসাহসিক চিন্তা এই অমরাবতী রাজ্যে যে প্রজা আপন মনে পোষণ করবে, আমি স্বহস্তে তাকে নৃশংসভাবে বধ করব। আমি মহাসমাদরে আপনাকে এই রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রীরূপে মনে স্থান দিয়েছি মহারানি সপ্তপর্ণী। আপন মনে এমন নীচ ভাবনা জন্ম নেওয়ার আগে, আমি সেই ভাবনাকে সমূলে উৎপাটন...

-তুমি রাজদ্রোহী বীরদত্ত! তোমার এ অতীত আমি বিস্মৃত হব না কোনোকালেই। আমার পশ্চাতে আমার সঙ্গেও যে অনুরূপভাবে... 

-আমি রাজদ্রোহী, সত্য এ বাক্য! তবে আমি ধর্মত ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছি। অমরাবতীর সকল প্রজাকে জীবনদান করেছি আমি। প্রভাকরবর্মন ও পরমেশবর্মনের অকথ্য অত্যাচার হতে মুক্তি প্রদান করেছি। আমিই এ রাজ্যের পরিত্রাতা। এই পুণ্যকার্য কি আমার রাজদ্রোহের ন্যায় পাপের স্খলন...

-কিছুমাত্র না! তুমি রাজদ্রোহী! তোমার পরনে রণসজ্জা, হাতে অস্ত্র! লোভী তুমি! তোমার পরবর্তী উদ্দেশ্য অমরাবতীর রাজসিংহাসন লাভ। আর সেই লোভ চরিতার্থ করতে, তুমি আমাকে হত্যার অভিপ্রায়ে...

-রানি মিথ্যা এ বাক্য! সমগ্র অমরাবতীর আরাধ্য দেবতা কালভৈরব ও প্রথম প্রভাতের সূর্যদেবের নামে শপথ করে আমি এই বাক্য... রানি! 


অস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক ভূপতিতা সপ্তপর্ণীর অচৈতন্য দেহ আপন বাহুডোরে তুলে চিৎকার করে উঠল বীরদত্ত,


-প্রহরী! 


জনশূন্য অন্দরমহলের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হল বীরদত্তের কন্ঠ। অনতিবিলম্বে বৃন্দার সাহায্যে রাজশয্যায় আশ্রয় নিলেন পর্ণা। রাজবৈদ্যের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে যখন কক্ষ মধ্যস্থিত সকলের মুখাবয়বে দুশ্চিন্তার মলিন ছায়া, তখন বৈদ্যের অনুরোধ ও আহ্বানে কক্ষ পরিত্যাগপূর্বক একান্তে গেল বৃন্দা। রাজবৈদ্য বিদায় গ্রহণের কিঞ্চিৎ পরই বৃন্দার সম্মুখে হাজির হয়ে বীরদত্ত বলল,


-মহারানি পর্ণা কী কোন কঠিন অসুখে আক্রান্ত বৃন্দা? এত গোপনীয়তা কেন? কোন বিলুপ্তপ্রায় মহৌষধি, কোন জড়িবুটি যদি...

-এ বড় কঠিন অসুখ বীরদত্ত। এই রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় একপ্রকার অসম্ভব! নির্দিষ্ট সময়ে এই রোগ নারীদেহ পরিত্যাগপূর্বক, দীর্ঘকালব্যাপী অপরিবর্তিত এক স্থায়ী চিহ্ন উপহারস্বরূপ রেখে যায়। 

-মহারানি পর্ণার জীবন বিপন্ন? আমি কীরূপে সাহায্য করতে পারি বৃন্দা? কোনভাবে নিরাময়...

-সম্ভব নয় বীরদত্ত। পুরুষ দ্বারা এই রোগের সূত্রপাত নারীদেহে ঘটলেও, কোন পুরুষ এই রোগের প্রকোপ হতে নারীকে উদ্ধার করতে অক্ষম। প্রকৃতির নিয়মানুসারে সঠিক সময়ে নারী নিজেকে মুক্তিপ্রদান করবে। বীরদত্ত, এই রোগের নাম মাতৃত্ব। আজ জ্বলন্ত অমরাবতীর অগণিত গণচিতা দর্শনের পর এই বাক্য বলতে মন বড় ব্যথিত হয়, যে এমন সুখবর প্রাপ্তিতে খানিক আনন্দ করুন! সমস্ত রাজ্যে আগামী এক পক্ষকালব্যাপী আনন্দ উৎসবের কথা ঘোষণা করুন। সম্ভব নয়! স্বজনের বিয়োগব্যথায় কাতর অজস্র প্রজা। এমতাবস্থায় আমি দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করতে পারি না নতুন অতিথির আগমনবার্তা। তবে অভিজ্ঞ রাজবৈদ্য এমনই সুখবরের আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করা যায়, কিছুকালের মধ্যে আমাদের মহারানি আপন দেহের অভ্যন্তরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করতে সক্ষম হবেন। বীরদত্ত, আপনি এই মুহূর্তে অন্দরমহল পরিত্যাগ করুন, আমি আপনাকে জোড়হস্তে অনুরোধ করছি। রানির স্বাস্থ্যের বিষয় চিন্তা করে আমি কিছুকালব্যাপী রাজকার্য স্থগিত রাখার নির্দেশ দিলাম। যথাসময়ে আপনাকে আহ্বানপূর্বক রাজ্য ও রাজকার্য বিষয়ক প্রয়োজনীয় আলোচনাসভার আয়োজন, এই অন্দরমহলেই করা হবে। এখন পর্ণার বিশ্রামের প্রয়োজন। পর্ণার সুসংবাদ এই মুহূর্তে প্রজার দরবারে ঘোষণার প্রয়োজন নেই। পর্ণার নির্দেশানুসারে যথাসময়ে ঘোষণা করা হবে। সেই ক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে এই সংবাদ জনসমক্ষে গোপন রাখার বিনীত অনুরোধ করছি। 


অবনত মস্তকে পর্ণার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী বৃন্দাকে নীরব অভিবাদন জানিয়ে সেই স্থান শীঘ্রই পরিত্যাগ করল বীরদত্ত। পর্ণার অন্দরমহল হতে নির্গত হয়ে অস্থিরচিত্তে তিনি অগ্রসর হলেন সেনা ছাউনির উদ্দেশে... 


কিছুকাল পর পুনরায় পরস্পরের সম্মুখীন হলেন পর্ণা ও বীরদত্ত। সামান্য বৈষয়িক আলাপ আলোচনার পর কক্ষ হতে সকলকে বিদায় করলেন পর্ণা। বৃন্দাও কক্ষ পরিত্যাগ করলে, পর্ণা আপন শয্যাপ্রান্তে বীরকে আহ্বান জানালেন। পর্ণার পানে অগ্রসর হয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখল বীর। সচকিত পর্ণা বীরদত্তের পানে স্থির দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক বললেন,


-আজ এমন পোশাক?

-পূর্বদিন আপনি আমার পোশাক দর্শনমাত্র উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। মূর্ছা গিয়েছিলেন। 

-সেই কারণেই পোশাকের পরিবর্তন?

-আমার কারণে আপনার বিন্দুমাত্র অসুবিধা অনভিপ্রেত রানি। সেইক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনার মতো কিঞ্চিৎ সময়ও আমার নাগালে ছিল না। এই ক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক আপনাকে অবগত করতে চাই, মহান অমরাবতী রাজ্যের রাজ সেনাধ্যক্ষের পোশাকই পূর্বদিন আমার দেহে ছিল। কাঞ্চনগড় ও অমরাবতীর ক্রমাগত এবং ক্রমবর্ধমান বিবাদ-যুদ্ধবিগ্রহের কারণে আমাদের ও প্রথম শ্রেণীর সেনা ছাউনির সকল সৈন্যদের সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকার নির্দেশ ছিল। যুদ্ধে পারদর্শী অশ্ব ও মাতঙ্গবাহিনী প্রস্তুতপূর্বক আমরা সারাবছরব্যাপী সমর নামক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হতাম। এই অমরাবতী রাজ্যের সুবিস্তৃত প্রাঙ্গনে বহু নিষ্পাপের রক্তক্ষয় ও জীবনহানি ইতিপূর্বে হয়েছে রানি। কিন্তু সেই সকল বিষয়ে অতিরিক্ত বার্তালাভ এইক্ষণে অনুচিত। 

-কেন? 

-আপনার দেহ ও মনকে এই সুসময়ে আমি যুদ্ধের গল্পকথা বলে অকারণে বিচলিত করতে অসম্মত রানি! আপনি উদ্বিগ্ন হবেন। আপনার ও আপনার অনাগত সন্তানের ক্ষতি হতে পারে। আমার দেহে প্রাণ থাকতে, আপনাকে ও আপনার সন্তানকে আমি সকল বিঘ্ন ও বিপত্তি হতে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর। শুধু একটিমাত্র আর্জি! 

-বলো? 


অবনত মস্তক বীরদত্ত বলল,


-পূর্বদিন আমি আপনার নিকট একটি বিষয়ে আলোচনা করতেই...

-কী বিষয়?

-মহান অমরাবতী রাজ্য পরমেশবর্মনের একাধিপত্য ও অত্যাচার হতে চিরমুক্তি লাভ করেছে। নিপীড়িত প্রজা আজ আপনার ছত্রছায়ায় সুখে দিন যাপন করছে। আমি সামান্য রাজভৃত্য। এই ক্ষণে আমার দায়িত্ব কী রানি? আপনি কী আমায় পদচ্যুত করবেন? অমরাবতীর সকল সভাসদ আপনার কথানুসারে নবরূপে অলংকৃত করবেন রাজদরবার। তাদের পদ বা পদোন্নতি... 

-তুমি এই সুবিশাল অমরাবতী রাজ্যের রাজসেনাধ্যক্ষ। সেই পদ সম্মানের সঙ্গে শুধুমাত্র তোমারই থাকবে। আর সেই সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত দায়িত্বভার আমি তোমার ওপর অর্পণ করতে ইচ্ছুক বীরদত্ত। 

-আপনার অর্পণ করা সকল ভার সানন্দে গৃহীত হবে রানি। কেবলমাত্র ইচ্ছেপ্রকাশ নয়, আপনি আদেশ করুন! আপনার মুখনিঃসৃত প্রত্যেক বাক্য আমার নিকট কালভৈরবের স্বপ্নাদেশের ন্যায় অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। আদেশ করুন! 

-আজ এই ক্ষণ হতে, তুমি আমার দেহরক্ষী পদে নিযুক্ত হলে। সম্মত? 

-আপনার দেহরক্ষী? সর্বক্ষণ আপনারই সঙ্গে থাকার অনুমতি...

-তুমি অসম্মত বীর? 


অশ্রুসজল দৃষ্টি গোপন করে বিগলিত কণ্ঠে বীরদত্ত বলল, 


-এই সম্মান ও এই গুরুদায়িত্ব আমি আজীবন বহন করতে ইচ্ছুক মহারানি পর্ণা। 

-বেশ! 


মৃদুহাস্যে পর্ণা বীরদত্তের পানে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন। প্রভাতী সূর্যালোক পর্ণার মলিন রোগক্লিষ্ট দেহকে অপরূপ রূপদানপূর্বক বীরের দৃষ্টিপথে, একটি সতেজ পদ্মফুলের ন্যায় প্রস্ফুটিত করেছে। বীরদত্ত সামান্য বাক্য বিনিময়ের ইচ্ছায় আপন ওষ্ঠ ও অধর চালনামাত্রই স্থির হয়ে গেলেন। সতর্ক পর্ণা সহজেই বীরের ওষ্ঠের অস্থির কম্পন অনুধাবন করলেন। সেই ক্ষণে পর্ণা বললেন,


-কিছু বলতে চাও? 

-আপনার মুখনিঃসৃত সকল বাক্য বড় মধুর। কেবল একটিমাত্র শব্দ আমার মনকে বড় পীড়া দেয় রানি। রাজদ্রোহী নই আমি! 

-আমি এই ক্ষণে সমগ্র অমরাবতীর মহারানি, তা তোমার রাজদ্রোহের কারণেই বীরদত্ত। যে ইতিহাস তুমি স্বহস্তে রচনা করেছ, সেই ইতিহাসকে তুমি আর কোনোকালেই অস্বীকার করতে পারবে না। বীরদত্ত রাজদ্রোহী, এ বাক্য চন্দ্র সূর্যের ন্যায় সত্য! 

-এই রাজতন্ত্রের প্রতি গভীর আনুগত্য আমার দেহের প্রতিটি প্রান্তে খোদাই করা করা রয়েছে রানি! আমি এই রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় ইতিপূর্বে একাধিকবার আপন জীবন বিপন্ন করেছি। 

-তোমার বীরত্বের কথা অবশ্যই ইতিহাস স্মরণে রাখবে। তুমি এখন এসো বীরদত্ত। আমি অবিলম্বে স্নানঘরে প্রবেশ করব। 

-কালভৈরব...

-না। আরাধ্যা দেবী মহাভৈরবী অমরাবতীর সকল প্রজার সহায় হোন। অমরাবতী থাকুক শত্রুমুক্ত। মাতৃতান্ত্রিক রাজ্য কোন পুরুষের আরাধনা করবে না বীরদত্ত। মায়াকানন, কাঞ্চনগড় এবং অমরাবতী, এই তিন রাজ্যে পূজিতা হবেন দেবী মহাভৈরবী। অবিলম্বে মাতার সুউচ্চ ও নয়নাভিরাম প্রস্তরমূর্তি নির্মাণ করার নির্দেশ দিলাম। 

-যথা আজ্ঞা রানি। 

-কালভৈরবের অস্তিত্ব সকল প্রজার স্মৃতি হতে বিলুপ্তির দায়িত্ব তোমার। 

-আমি আমার কর্তব্য অবিলম্বে পালন করতে বদ্ধপরিকর। মহাভৈরবী সহায় হোন। 

-অমরাবতী থাকুক শত্রুমুক্ত। 


কয়েক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর, আপন কক্ষের প্রস্তরনির্মিত দেওয়ালে পৃথ্বীশের সুবৃহৎ তৈলচিত্রের পানে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন পর্ণা। সন্ধ্যার প্রাক্কালে অমরাবতীর আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সমগ্র নভোমণ্ডল জুড়ে কেবল মুহুর্মুহু বিদ্যুতের চমক। পর্ণা আপন দুই চক্ষু মুদলেন। ফিরে গেলেন আপন রাজ্য মায়াকাননে। আয়তনে ও ক্ষমতায় অমরাবতী রাজ্য মায়াকানন অপেক্ষা সুবিশাল। তবে প্রকৃতির অপার কৃপায় মায়াকাননের নৈসর্গিক দৃশ্যের নিকট অমরাবতী অত্যন্ত ক্ষুদ্র। পর্ণার আপন কর্ণকুহরে মহাভৈরবী মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি যেন বারংবার প্রতিধ্বনিত হল। স্ফীত উদরে নতুন প্রাণ আপন স্বস্তিত্ব জানান দেয় প্রতিক্ষণে। রাতের প্রতি প্রহরে গর্ভ মধ্যস্থিত ওই শিশুটিকে আলিঙ্গন করে পর্ণা প্রত্যেকটি কালরাত্রি একাকিনী যাপন করেন। আপন সিক্ত গন্ডদেশ দক্ষিণ হস্ত দ্বারা স্পর্শ করামাত্র কক্ষের বাইরে প্রহরী উচ্চৈঃস্বরে জানান দিল বীরদত্তের আগমনবার্তা। দেহ হতে খসে পড়া অবিন্যস্ত উত্তরীয় দ্বারা আপনাকে আচ্ছাদিত করে কক্ষের সম্মুখ দ্বারের পানে পর্ণা ফিরলেন। বীরদত্ত এসে নতমস্তকে পর্ণাকে সান্ধ্য অভিবাদন জানালেন। 


-প্রহরী মুখে এই সংবাদ অবগত হলাম, বড় জরুরি তলব! আজ্ঞা করুন রানি! 

-আমি মায়াকাননে ফিরে যেতে চাই বীরদত্ত। আমার প্রস্থানের সকল ব্যবস্থার ভার... 

-আপনি অমরাবতী পরিত্যাগ করবেন পর্ণা! ক্ষমা করবেন, মহারানি পর্ণা! 

-না। আমি কেবল আপন রাজপ্রাসাদে রাজমাতা নলিনীদেবীর প্রসূতিগৃহে এই সন্তানকে জন্ম দেওয়ার একান্ত ইচ্ছে মনের গভীরে পোষণ করি। এই শুভক্ষণে রাজমাতা জীবিত থাকলে, তিনি এমন গর্ভাবস্থায় আমাকে কত সোহাগ করতেন! আমি তার প্রসূতিগৃহে পৌঁছে প্রসববেদনা উপভোগ করতে ইচ্ছুক। রাঙা মা গত হয়েছেন। উত্তরা ও ফাল্গুনী মাতৃস্নেহে আমার কন্যাকে আপন করে নেবে। এই স্থানে আমার আপনজন, আমার প্রিয়পাত্রবৃন্দের বড় অভাববোধ করি বীরদত্ত। তুমি আমার যাত্রার আয়োজন করো। 

-অমরাবতীর রাজসিংহাসন শূন্য হয়ে যাবে রানি। অভিভাবকহীন অবস্থায় এই সুবৃহৎ রাজ্য... 

-আমি শীঘ্রই অমরাবতীর উত্তরাধিকারিণীকে নিয়ে এই রাজ্যে ফিরব। 

-এই যদি আপনার সদিচ্ছা হয়, তবে আমাকেও আপনার সঙ্গে মায়াকাননে গমন করার অনুমতি প্রদান করুন রানি। আমি আপনার দেহরক্ষী। এমন অবস্থায় আপনার নিকট সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকা ও আপনাকে রক্ষা করা আমার একমাত্র কর্তব্য। 

-আর অমরাবতী রাজ্য?

-আমার এক বিশ্বস্তের হস্তে অর্পণ করে যাব। প্রতি এক পক্ষকাল অন্তর এই রাজ্যে আমি ফিরে ফিরে আসব। আপনি ও অমরাবতীর ভবিষ্যৎ রানিকে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত অবস্থায় দর্শন করে, প্রফুল্লচিত্তে আমি অমরাবতী রাজ্যে পুনরায় পদার্পন করব রানি। আপনার আগমনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত, এ রাজ্যকে শত্রুপক্ষের দৃষ্টি হতে রক্ষা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার। কিন্তু কোনরূপ দায়িত্ব ও কর্তব্যের কারণে, নিজ হতে আমাকে বিচ্ছিন্ন করবেন না। রাজভৃত্যের এই সামান্য অনুরোধ অগ্রাহ্য করবেন না মহারানি। অধমকে আপনার সঙ্গে গমনের অনুমতি প্রদান করুন। 


কিঞ্চিৎ চিন্তান্বিত পর্ণা বললেন,


-কাঞ্চনগড়? 

-বৃন্দার অধীনে থাকবে। আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী রানি। অবশ্যই এই বিষয় অবগত আছেন, অমরাবতীর অভ্যন্তরভাগে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে অবস্থানপূর্বক এই সুবৃহৎ সাম্রাজ্য আপনি একাকী সুচারুভাবে পরিচালনা করতে অক্ষম। আপনার দৈহিক অবস্থা সঙ্গীন। ক্রমে আপনার স্বাস্থ্যের অবনতি আসন্ন। এমতাবস্থায় আপন বিশ্বস্ত হস্তে এক একটি রাজ্যের গুরুভার অর্পণ করাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। বৃন্দা ব্যতীত দ্বিতীয় কে আছেন আপনার প্রাণাধিক প্রিয় ও বিশ্বস্ত সঙ্গী! মন্ত্রণালয়ে উপস্থিতি এই ক্ষণে অনাবশ্যক। আপনার ভগ্নস্বাস্থ্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিশ্রম সইতে পারবে না। আগামীকাল রাজকার্য সমাধাপূর্বক, আপনার কক্ষে একটি গোপন আলোচনাসভার অনুমতি দিন রানি। আমি এক মূর্খ সেনাধ্যক্ষ। তরবারি শিক্ষা ও অস্ত্রচালনা ব্যতীত দ্বিতীয় কোন বিষয়ে মতামত প্রকাশের স্পর্ধা আমার ন্যায় মূর্খের কল্পনাতীত। আপনাকে উপদেশ দেওয়ার মতো পুঁথিগত বিদ্যা আমার নেই। রাজ্যের রাজমন্ত্রী ও উপদেষ্টা আপনাকে সকল বিষয়ে বিস্তারিত পরামর্শ প্রদান করবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দেহ ভেঙে পড়ার পূর্বে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার রাজকার্যের সমাপ্তি প্রয়োজন মহারানি পর্ণা। পর্ণা? 


হিমশৈল পর্বতমালার পানে অপলক দৃষ্টিপাত করেছিলেন পর্ণা। জোয়ারের সময়কাল ব্যতীত সমুদ্রদয়িতা রুদ্রাণীর প্রবল জলোচ্ছ্বাস পৃথ্বীশের কক্ষের অভ্যন্তরভাগে অবস্থিত পর্ণার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। রাত্রির অন্তিম প্রহরে সমগ্র নভোমণ্ডল যখন চন্দ্রালোকে নিশ্চুপে অবগাহন করে, বিনিদ্র রাত্রি যাপনকালে আপন সঙ্গীকে মুহুর্মুহু আহ্বানের পর যে মুহূর্তে নিশাচর খেচর দম্পতির চক্ষুদ্বয় ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে যায়, বিশ্ব চরাচর স্তব্ধ হয় রাত্রির অন্তিম প্রহরে, সেই মুহূর্তে রাজশয্যায় একাকিনী পূর্ণযৌবনা পর্ণা আরও একটি অভিশপ্ত রাত্রিযাপন করেন। অদূরে প্রায় নিদ্রামগ্ন প্রহরীর সাড়া পেয়ে পর্ণা অবগত হয়, প্রথম প্রভাতের আর বড় বেশি বিলম্ব নেই। রাত্রির অন্তিম ক্ষণের নিশ্চিদ্র অন্ধকারে নিমজ্জিত অমরাবতী রাজ্যে কান পাতলে শোনা যায়, বাতাসে ভর করে ভেসে আসা সমুদ্রকান্তা রুন্দ্রাণীর নিদারুণ আস্ফালন। পর্ণার অবাধ্য মনটা সেই ক্ষণে পাড়ি দেয় মায়াকাননের সর্বাধিক গভীরতর অংশে। জলাশয়ের উপরিভাগে শতদলের ন্যায় প্রস্ফুটিত হয়ে আপন সর্বস্ব প্রেমাস্পদের চরণে অর্পণ করতে মরিয়া হয়ে পড়ে রাজ-ভিখারিনি পর্ণার দেহ। উদ্বেলিত নারীমন তীব্র যৌবনজ্বালার কারণে আপন প্রেমাস্পদের স্পর্শ সন্ধানে বড় কাতর হয়। পুরুষের বলিষ্ঠ ও নিবিড় আলিঙ্গনে শত-সহস্রবার আপন মরণসুখ কামনা করেন মহারানি পর্ণা। কিন্তু চক্ষু উন্মোচনপূর্বক পুনরায় শূন্য শয্যায় আপনাকে আবিষ্কার করেন রানি। ললাটের একাধিক রেখা ক্রমে বক্র হয়ে উঠল। মনে হল বহুদূর হতে এক উদাত্ত কন্ঠস্বর তার নাম উচ্চারণ করছেন বারংবার। কম্পিত দেহে নিকষ কালো মেঘে আবৃত হিমশৈল পর্বতমালার পাদদেশ হতে দৃষ্টি ফেরালেন পর্ণা। বিস্ফারিত নেত্রে উপলব্ধি করলেন বীরদত্ত একাধিকবার তার নাম ধরে আহ্বান করছেন। সম্বিৎ ফিরে পেতেই পর্ণা বললেন,


-বীরদত্ত! 

-আপনার স্বাস্থ্য বুঝি অনুকূল নয় রানি! অতিরিক্ত বাক্যব্যয়ে আপনি ক্লান্ত। এই ক্ষণে বিশ্রাম গ্রহণ করুন। 

-রাজ্যের সকল দায় দায়িত্ব অগ্রাহ্য করে, নিতান্ত সাধারণ প্রজা হয়ে ওই মায়াকাননে বিচরণ করতে তোমার মন চায় না বীরদত্ত? 

-না। আমি পরম ধার্মিক রানি। 

-তবে আমার একটিমাত্র আদেশে আপন আরাধ্য দেবতা কালভৈরবের মূর্তি ধূলিস্যাৎ করে ফেললে যে! 

-আমার ধর্ম কোন নির্দিষ্ট পুরুষ বা নারীর মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নয় মহারানি পর্ণা। আমার ধর্ম নিরাকার। রাজকার্য আমার জীবনের একমাত্র কর্ম। আর আমার নিকট কর্মই পরম ধর্ম! আপনার সেবার নিজ ক্ষুদ্র জীবন উৎসর্গ করেছি আমি। আপনার ও আপনার গর্ভজাত সন্তানের জন্য আমার জীবন বলিপ্রদত্ত। এই কর্মেই আমার স্বস্তি, এই কর্মেই আমার মুক্তি! আপনার সঙ্গ ব্যতীত কেবল অমরাবতী ও মায়াকানন কেন, এই ত্রিভুবনের কোন প্রান্তে পৌঁছে, চরম বিলাসিতা ও রাজসুখেও আমি স্বস্তি পাব না। আপনার সঙ্গলাভেই আমার কর্মসুখ। আপনি আমার ধর্ম! আপনার সঙ্গত্যাগের অধিক যন্ত্রণা, আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই। জীবনের অন্তিম ক্ষণ পর্যন্ত এই কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে এই ভৃত্য বদ্ধপরিকর মহারানি পর্ণা। এই ভৃত্যকে কোনোকালেই আপনি পরিত্যাগ করবেন না, এ বাক্য একটিবার আপন ওষ্ঠ হতে উচ্চারণ করুন রানি! নিজ হতে আমাকে পৃথক করবেন না! 

-মায়াকাননে আজও বৃষ্টি হয় বীরদত্ত?

-অবশ্যই হয় রানি। আপনি মায়াকানন যেতে আগ্রহী, আমি অবগত এই বিষয়ে। আমি সকল প্রকার আয়োজন করছি। রথ নয়, আপনি বেহারাকর্তৃক পালকিতে গমন করবেন। পথশ্রমে আপনি কিছুমাত্র ক্লান্তি অনুভব করবেন না। 


আকস্মিক বিদ্যুতের দ্যুতি সমগ্র অমরাবতীকে প্রভাতের ন্যায় আলোকিত করে তুলল। শশব্যস্ত বীরদত্ত পর্ণার সম্মুখে পৌঁছে তার হাত ধরে বলল,


-রানি, এই স্থান পরিত্যাগ করুন। কক্ষে ফিরে চলুন। বৃষ্টি আসন্ন।  


গভীর দৃষ্টি বীরদত্তের পানে নিবদ্ধ রেখে পর্ণা বললেন,


-ওই বিদ্যুতের নাম ত্রিযামা। আর ওই স্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছ বীরদত্ত?

-পাচ্ছি পর্ণা!

-ওই স্রোতের নাম রুদ্রাণী! মধ্যরাতে যে নিশাচর বিহঙ্গ দম্পতি আপন অস্তিত্ব জানান দেয়, তুমি কখনো শুনেছ তাদের প্রেমালাপ? 

-আমি প্রতিটি রাত্রি আপনার কক্ষদ্বারের বাইরে বিনিদ্র অবস্থায় যাপন করি রানি। আপনি রাত্রির যে সকল সৌন্দর্য উপভোগ করেন, আমিও সেই একই সৌন্দর্যে অবগাহন করি পর্ণা। 

-ওই দম্পতির নাম কুমার ও নলিনী। আর আমি? আমি মহারানি সপ্তপর্ণী। তিন রাজ্যের রানি।


পর্ণার চাপা ক্রন্দনধ্বনিতে ব্যথিত হল বীরদত্তের হৃদয়। উদ্বেলিত কণ্ঠে বীর বলল,


-আপনার মনোরঞ্জনের জন্য আমি আগামীকালই অন্দরমহলে এক বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন... 

-তুমি কী এ বিষয় অবগত বীরদত্ত, একটি কিশোরী কন্যা বহুপূর্বে তার মাতার নিকট রাজ্যবিস্তারের ইচ্ছা পোষণ করেছিল। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওই মূর্খ কিশোরী এই বাক্য অবগত ছিল না, যে এই রাজ্যবিস্তারের জন্য, মিথ্যা ক্ষমতায়নের জন্য তাকে সুবৃহৎ মূল্য পরিশোধ করতে হবে! আমি, আমি কে বলো তো বীর? 


অক্ষিকোটরে আগত অশ্রু গোপন করে বীরদত্ত বলল,


-আমার... এই রাজ্যের সকলের সম্মানীয়া মহারানি, পর্ণা! 

-হ্যাঁ আমি পর্ণা, আমি সপ্তপর্ণী। আমি সশরীরে আছি। ক্ষমতায়নের শীর্ষে আমি আছি বীর। কিন্তু সে নেই। সে হারিয়ে গেছে মায়াকাননের গভীর অরণ্যে, হিমশৈল পর্বতের উচ্চতায়, রুদ্রাণীর গভীরতায়। তার এই কঙ্কালসার রাজ্য আগলে আমি একাকিনী যক্ষের ন্যায় এক একটি বিরহী রাত্রিযাপন করি। তুমি জানো?

-না! আপনার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমি অবগত নই। আমি জানি না, জানতে কিছুমাত্র আগ্রহী নই। তবে আমার মনে এই ভাবনার উদয় হয়েছে, এই ক্ষণে এই স্থান পরিত্যাগ করা আমার অবশ্য কর্তব্য। আমি বৃন্দাকে আপনার নিকট প্রেরণ করছি রানি। আমার ধারণা, তিনিই আপনার ব্যথিত হৃদয়কে কিঞ্চিৎ প্রশান্তি প্রদান করতে পারবেন। 


কন্ঠ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ বীরদত্তর। আপন হস্তমধ্যে অবস্থিত পর্ণার দুটি কম্পিত হস্ত, বীর সর্বশক্তিদ্বারা করায়ত্ত করল। রুদ্ধকণ্ঠে বলল,


-আপনার মন বড় ব্যাকুল রানি। সামান্য রাজকার্য সমাধাপূর্বক আপনি এ রাজ্য হতে প্রফুল্লচিত্তে মায়াকানন গমন করবেন। আমি আপনার ছায়াসঙ্গী হয়ে আপনাকে পৌঁছে দেব। কিন্তু সর্বাগ্রে কাঞ্চনগড়ের দায়িত্ব তুলে দিতে হবে আপনার আবাল্য সই বৃন্দার হাতে। অবিলম্বে আমি আলোচনাসভার আয়োজন করছি। অতঃপর আপনি ও আমি একত্রে, মায়াকাননের চিরহরিৎ সৌন্দর্যে অবগাহন করব রানি। 


অতঃপর পৃথ্বীশের শয্যায় আরও একটি সঙ্গীহীন কালরাত্রি যাপন করলেন সপ্তপর্ণী। তার কক্ষদ্বারের সম্মুখে বিনিদ্র রাত্রিযাপন করল রাজভৃত্য বীরদত্ত। 


(ক্রমশ....)

চিত্র : সংগৃহীত

সেই তো এলে ভালোবাসা দ্বিতীয় পর্ব

  সেই তো এলে ভালোবাসা সাথী দাস দ্বিতীয়  পর্ব মধ্যরাতের এমন কত শুভ্র অপ্রাপ্তি ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে আলগোছে ভূমি স্পর্শ করে। যা মনকে যাতনা দে...

পপুলার পোস্ট