অনুসরণকারী

শুক্রবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২২

সূর্যোদয়ের আগে (চতুর্থ পর্ব)


সূর্যোদয়ের আগে
সাথী দাস
চতুর্থ পর্ব


-আন্টি...গুড মর্নিং!
আজ বেরোনোর আগে সবুজ রঙের একটা ফুলহাতা কুর্তি,আর সাদা রঙের একটা প্যান্ট পরে প্রিয়মের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো ঝোরা।অপর্ণাই দরজা খুলে বেরোলো।প্রিয়ম তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে ওর নিজের ঘরে...
-মর্নিং!!
-আন্টি প্রিয়ম...
-একটু ঠিক আছে এখন।এসো,ভিতরে এসো না।
-না আন্টি!আমার দেরি হয়ে যাবে।এমনিতেই স্কুটিটা নেই,বাসে করে যেতে হবে।আর দেরি করলে হবে না।প্রিয়ম এমনি ঠিক আছে তো?
-হুম!ঠিক আছে।
-ওকে!এটুকুই জানার ছিলো।আমি আসছি আন্টি...
আজ ছেলেটাকে ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করছিলো না অপর্ণার।কিন্তু চাকরির বড় জ্বালা।ছেলের খাবার তৈরী করে,সবটুকু ওষুধ ওর হাতের সামনে গুছিয়ে রেখে,নিজের খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অপর্ণা...
সকালে মা বেরোনোর সময় একবার উঠেছিলো প্রিয়ম।তারপর আবার গিয়ে শুয়ে পড়েছিলো বিছানা আঁকড়ে।বেলা যখন এগারোটা,তখন ওর ঘুমটা ভাঙলো তীর্থর ফোন পেয়ে।মরদেহ দাহ হয়ে গেছে গতকালই।একমাত্র ছেলেকে চিতায় তুলে দিয়ে এসে শোকস্তব্ধ ওর মামা-মামীমা।তীর্থর গলাও ভেঙে বসে গেছে।এত সবের মধ্যেও নিজের পাপাইদার খবর নিতে ভোলেনি ও।প্রিয়মের ভীষণই খারাপ লাগলো।এই চরম পারিবারিক বিপর্যয়ের দিনে ও একটু ছেলেটার পাশে থাকবে ভেবেছিলো।কিন্তু কাল এমন একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে গেলো,ও আর নিজেকে ঠিক রাখতেই পারলো না।সামলাতেই পারছিলো না নিজেকে।রক্ত দেখলেই শুধু ঘুরে-ফিরে দুষ্টুর মুখটা মনে পড়ে যায় ওর।আজ এত বছর পরেও মনে হয়,দুষ্টু যেন চোখ উলটে ওকেই একভাবে দেখছে।তখনই আর স্নায়ুকে নিজের আয়ত্তে রাখতে পারে না প্রিয়ম।শরীর অবশ হয়ে আসে।গা গুলিয়ে ওঠে বীভৎসভাবে।নাঃ!!আর ওইসব কথা ভাববে না প্রিয়ম।একটু ভোলার চেষ্টা করবে।ও জানে,রাতে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাবে দুষ্টুর ধড় থেকে আলাদা হওয়া মুন্ডুটা,আর কানে বাজবে ওর শেষ মুহূর্তের মর্মান্তিক গগনবিদারী আর্তনাদ।তবুও ভোলার চেষ্টা করবে প্রিয়ম।বিছানায় উঠে বসে দুহাতে চুল চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলো প্রিয়ম।তারপর চোখটা মুছে নিয়ে ঢুকলো বাথরুমে...
বাথরুম থেকে বেরিয়েই একটু কড়া করে চা করে খেলো।টেবিলের প্রত্যেকটা ঢাকনা তুলে-তুলে দেখলো,মা ওর দুপুরের খাবার একেবারে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখে গেছে।সকালের হালকা খাবারও কিছু ছিলো।কিন্তু সেসব খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে।এখন হালকা কিছু খেলেও আর দুপুরে ভাত খাওয়া যাবে না।দুটো বিস্কুট দিয়ে চা-টা খেলো প্রিয়ম।গতকালের কথা মনে পড়ছিলো প্রিয়মের,কানে বাজছিলো বেশ কয়েকটা বাক্য,
"মুখ খোলো প্রিয়ম!নইলে কিন্তু বাঁচতে পারবে না!!"
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চা খেতে-খেতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রিয়ম।দেখলো,অভ্র-দার বছর পাঁচেকের মিষ্টি মেয়ে কুর্চি,বৌদির সঙ্গে আসছে।স্কুল ছুটি হয়ে গেছে মনে হয়।এবার কিছুতেই আর বাড়ি ঢুকবে না,এই ভরদুপুরে পার্কের দোলনায় গিয়ে চড়ে বসেছে।ওকে নামাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে বৌদি আর কাকা।যাও বা কাকার জোরাজুরিতে দোলনা থেকে নামলো,আবার দৌড়োলো স্লিপের দিকে।প্রিয়ম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মা-মেয়ের দৌড়াদৌড়ি দেখলো।মনটাই ভালো হয়ে গেলো ওর।হাসিমুখে সবে ঘরের দিকে ঘুরেছে প্রিয়ম,সেই সময়ই ওর ফোনটা বেজে উঠলো,ও দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলো।
-বলো মা?
-উঠেছিস?না শুয়েই আছিস?
-না উঠেছি!চা খেলাম একটু।
-আর কিছু খাবি না?টেবিলে তো টিফিন করে...
-না-মা!একটু পরে স্নান করে ভাত খেয়ে নেবো।এখন আর কিছু খাবো না।
-তাহলে খাবারটা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিস।
-কি হবে ফ্রিজে ঢুকিয়ে?ঠান্ডা হচ্ছে তোমার ফ্রিজ?পচে থাকবে ভিতরে!দেখি আমি,এবার একটা ফ্রিজ আর গিজারের ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবো।
-নানা!এখন আর টাকা-পয়সা...
-উফফ!মা!ঠিক আছে,বাড়ি আসো।তারপর কথা হবে।
-আচ্ছা!রাখছি।
-হুম!
-খেয়ে নিস কিন্তু।খেয়ে ওষুধ খেয়ে নিবি!জ্বরটা আর এসেছে?
-নাঃ!
-তাহলে আর শুধু-শুধু জ্বরের ওষুধ খাস না।আর শোন?
-বলো?
-ঘুমের ওষুধটা আর খাস না বাবা!একটু চেষ্টা করলেই ছাড়তে পারবি!অভ্যেস করে ফেলিস না!
-হুম!ঠিক আছে,রাখছি!!
-রাখ!
মায়ের ফোনটা রেখে দেয় প্রিয়ম।চায়ের কাপ-টা সিঙ্কে নামিয়ে দেয়।তারপর আবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।কেউ কোত্থাও নেই।ফাঁকা পার্ক।একেবারে সামনের দরজায় কাকা একটা টুলে বসে অল্পবিস্তর ঢুলছে।আর দোলনাটা তখনও অল্প-অল্প দুলছে...প্রিয়মের কানে তখন একটা কথাই বাজছে...একমাথা চুল নিয়ে একটা মেয়ে ওর দিকে চেয়েই ভ্রুকুটি করে বলছে,
"আচ্ছা উদগান্ডু ছেলে তো!!"
মাথা নীচু করে হেসে ফেললো প্রিয়ম।মৃদু হেসে কামড়ে ধরলো নিজের নীচের ঠোঁটটা।তারপর নিজের মনেই বললো,
"বারো তলা!ঝোরা,নানা,শ্রীময়ী,কিন্তু শ্রীময়ী কি?ঘোষ-বোস-চ্যাটার্জী-ব্যানার্জী কি!!সালা তাও তো জানে না প্রিয়ম।ধুর,কি দরকার,শ্রীময়ী,শুধুই শ্রীময়ী...শ্রী!!কিন্তু যাবো কিভাবে?হঠাৎ করে গিয়ে বলবোই বা কি?!তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিলো।তাই দেখতে এলাম!"
বাপরে!!এসব বললে তো খিস্তি দিয়ে প্রিয়মের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে দেবে!মেয়ের যা মুখ চলে...আচ্ছা,অফিসে গেছে না ফ্ল্যাটেই আছে!ধুর!যেখানেই থাকুক।একবার তো গিয়ে দেখতেই হবে...
চুপ করে একভাবে কিছুক্ষণ ভাবলো প্রিয়ম।তারপর জামাটা গায়ে গলিয়ে কিছু টাকা বুক-পকেটে নিয়ে নিলো।দরজা লক করে এসে দাঁড়ালো বাইরে।লিফট নেই...নীচে রয়েছে।আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করলো না প্রিয়মের।মনটা বড্ড বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।ও দুর্বল শরীরেই ধীরে-ধীরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলো...
বারো তলায় পৌঁছেই মাথাটা একটু ঘুরে গেলো ওর।শরীরটা দুর্বল ভীষণ।কাল বমি করে-করে শরীর অর্ধেক হয়ে গেছে।তার ওপরে সারারাত কতবার যে ঘুম ভেঙেছে,তার ইয়ত্তা নেই।কেঁপে-কেঁপে উঠে বসেছে ও।কানে প্রতিধ্বনিত হয়েছে অবলা প্রাণীটার সেই মর্মান্তিক অন্তিম চিৎকার।মা কাল রাতে ওর সঙ্গেই শুয়েছিলো।শেষ পর্যন্ত মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভোররাতে একটু চোখদুটো বন্ধ করেছে প্রিয়ম।সকাল থেকে তেমন কিছু খাওয়াও হয়নি,একটু চা ছাড়া।এতটা সিঁড়ি ভেঙে উঠে ওর শরীরটা কাঁপতে লাগলো।একটুখানি দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিলো ও।তারপর দরজার নেমপ্লেটগুলো দেখতে-দেখতে এগোতে লাগলো ধীরপায়ে...
বেশ অবাকই হলো প্রিয়ম।সবকটা ফ্ল্যাটই ফাঁকা।বাপরে!!জায়গাটা যেন মনুষ্যবর্জিত মনে হচ্ছে,যেন এই জায়গাটুকুর অবস্থান পৃথিবীর বাইরে কোথাও।কি ভীষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে গোটা বারোতলা জুড়ে।তিনটে ফ্ল্যাটের দরজার নেমপ্লেট শুন্য।একেবারে শেষে গিয়ে প্রিয়ম দাঁড়ালো সেই নেমপ্লেটের সামনে যার প্রথম দুটো নাম ওর অচেনা,শুধু তৃতীয় নামটা ছাড়া।
"শ্রীময়ী সেন!"
মনে-মনে আউড়ে নিলো প্রিয়ম।
কিন্তু কেউ নেই ফ্ল্যাটে।তালা দেওয়া রয়েছে।আর কিছু করার নেই।ফিরেই যেতে হবে।শেষ একবার নেমপ্লেটের দিকে চাইলো প্রিয়ম।ওর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো একটাই নাম,
"শ্রীময়ী সেন!"
ধীরপায়ে লিফটের দিকে এগোলো প্রিয়ম।আর সিঁড়ি দিয়ে নামার ক্ষমতা নেই।তাহলে মাঝপথেই সিঁড়ির মধ্যে অজ্ঞান হয়ে উল্টে পড়ে থাকবে।আর যা জনবহুল রামধনু এপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা তলা,সেতো কের বলার মতো নয়।লোকে মরে থাকলেও কেউ জানতেই পারবে না।লিফটে উঠে দাঁড়ালো প্রিয়ম।লিফটের দরজাটা ধীরে-ধীরে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলো।আজ আর কেউ শেষ মুহূর্তে দৌড়ে এসে বললো না,
"আচ্ছা উদগান্ডু ছেলে তো!"
মাথা নীচু করে নীচের পুরু ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে,হেসেই ফেললো প্রিয়ম।উফফ!!প্রথম দিন থেকেই এতবার ওই একটা বাক্য কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,সত্যিই এবার ওর নিজেকে কিরকম একটা উদগান্ডু-উদগান্ডুই মনে হচ্ছে বটে...
-এখন থাক না এসব!পরেরবার না হয়...
-না,যেটা বলছি শোনো।এবারই ফ্রিজ আর গিজারটা লাগিয়ে দিই,পরেরবার অন্য কিছু কেনা যাবে।আমি এখন গেলে তো আর সহজে আসবো না।দেরিই হবে আসতে...
-দোলপূর্ণিমায় আসবি না?একটু নারায়ণ পুজো করবো ভাবছিলাম।নতুন বাড়িতে আসার পর তো...
-দেখছি মা,আমি সেই সময় জানাবো।এত আগে থেকে বলি কি করে বলো তো!
-তুই এখন অনলাইন বুক করবি,তারপর আমি থাকি না সারা সপ্তাহ বাড়িতে।ওই ফ্রিজ আর গিজার এসে দেখবি দরজার বাইরে ফেলে রেখে যাবে।ভালো হবে তখন...
-আমি অনলাইন নেবো না মা,সেসব আমার ভাবা হয়ে গেছে।লোকাল কোনো দোকান থেকে নেবো।আজ যদি বুকিং করে আসি,ওরা কাল-পরশুর মধ্যেই দিয়ে দেবে।আমি থাকতে-থাকতেই সব ব্যবস্থা করে যাবো।তুমি এত ভেবো না তো...
-এখানকার লোকাল দোকান তুই কিছু চিনিস?স্কুল এখান থেকে কাছে হবে বলে একেবারে গন্ডগ্রামে এনে ফেললি।উফফ!!আটটা বাজলেই যেন নিশুতি রাত!!শ্মশান হয়ে যায়...
-আরএ কয়েকটা বছর যেতে দাও না।এরপর এই জায়গাতেই আর হাত দেওয়া যাবে না,বুঝলে?আর দোকান-পাট চিনতে কতক্ষণ?সবে এলাম।চিনে যাবো সব আস্তে-আস্তে।আমি তো ব্র্যান্ডেড জিনিসই কিনবো।দোকান তো ডিলারের।দোকান দিয়ে আমার কি হবে?এবার কোথায় আছে,সেটা একটু শুধু জানতে হবে।ও আমি খোঁজ নিয়ে নেবো।তুমি যাও,পড়াতে বসো।ওরা বসে আছে ওঘরে...
কথা বলতে-বলতেই গায়ে জামাটা গলিয়ে নিলো প্রিয়ম।
-যা ভালো বুঝিস কর!তুই আবার এই অসুস্থ শরীরে জামা পরে কোথায় চললি?ওই পাড়ায় নাকি?আজকের দিনটা না বেরোলে হতো না!!বাইক চালাস না কিন্তু।হাওয়াটা লেগে যাবে,আবার রাতে জ্বর আসবে।
-না,বাইক লাগবে না।আমি বাইরে যাচ্ছি না মা।এপার্টমেন্টের মধ্যেই আছি।
-ও পার্কে...যা-যা!সেই বরং ভালো।একটু বাইরে গিয়ে বস।কাকার সঙ্গে গল্প কর।মনটা ভালো লাগবে।ঘরে একা-একা পড়ে থাকিস না...আমি তো এখন পড়াতে বসবো।
-হুম!!
প্রিয়ম বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাটের বাইরে।ঘড়িতে দেখলো সন্ধ্যে সাড়ে-সাতটা।মায়ের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আসতে শুরু করেছে।এখন থেকে ন-টা পর্যন্ত মা ওদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।প্রিয়ম একা-একা ঘরে থেকে কি করবে!তার চেয়ে সকালের অপূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করবে ও।মা স্কুল থেকে ফিরে বললো,সকালে বেরোবার আগেই ঝোরা ওর খবর নিতে এসেছিলো।এবার বোধহয় ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোই যায়।আর নইলে অজুহাত তো ওর বুক-পকেটে গচ্ছিত আছেই।মা বললো,কাকার সঙ্গে গল্প করতে,মন ভালো থাকবে।কিন্তু লিফটে উঠে বারো নম্বরে আলতো করে চাপ দিলো প্রিয়ম...নীচে নয়,ওকে তো ওপরে যেতে হবে...
-কাকে চাই?
প্রিয়ম বেল বাজানোর পর,একজন মিষ্টি দেখতে মহিলা এসে ফ্ল্যাটের দরজা খুললো।সিঁথিতে একবিন্দু সিঁদুর।পরনে ঘরোয়া পোশাক...
-শ্রী,মানে ঝোরা আছে?
-না,ঝোরা তো এখনও আসেনি!আপনি কে?
-আমি প্রিয়ম!প্রিয়ম সমাদ্দার!আটতলায় নতুন এসেছি।কাল...
-আপনিই প্রিয়ম?ঝোরার মুখে কালই আপনার কথা শুনেছি।আসুন না,ভিতরে আসুন!
-নানা থাক!ঝোরা যখন নেই,আমি বরং পরেই...
-আরে নানা,দরজার সামনে থেকে কেউ ফিরে যায় নাকি!!আসুন-আসুন...
মহিলার জোরাজুরিতেই প্রিয়ম ভিতরে ঢুকলো।
-একটু দাঁড়ান,আমার গ্যাস জ্বলছে!!
দৌড়ে রান্নাঘরে ঢোকেন সেই মহিলা।
বেশ ছিমছাম একটা ফ্ল্যাট।প্রচুর বৈভবের প্রাচুর্য না থাকলেও,বেশ একটা স্নিগ্ধ-ঘরোয়া-পরিপাটি ব্যাপার আছে।মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।ঘরের ভিতর প্রথমে একটা ছোট আলো জ্বলছিলো।রান্নাঘরে বড় আলো জ্বলছে।প্রিয়ম ভিতরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই বড় আলোটা জ্বালিয়ে দিলেন ওই মহিলা।প্রিয়ম বুঝলো,রান্নাঘরে কাজ চলার দরুন,বিদ্যুৎ বাঁচাতে ডাইনিংয়ের বড়-আলো বন্ধ রাখা হয়েছে।একসময় ওর মা-ও এইরকম করতো।হয়তো এখনও অভ্যাসবশত তাই করে।তবে বর্তমানে প্রিয়ম নিজে উপার্জন করার পর একটু হাতখোলা হয়েছে।নিজের জন্য প্রচুর পয়সা না ওড়ালেও,একটু শৌখিনতা মাঝে-মধ্যেই করে বসে ও।অকারণেই নিজেকে একটা শার্ট কিংবা সুগন্ধী কিনে উপহার দেওয়া,বা একদিন একা-একাই রেস্তোরায় খেতে চলে যাওয়ার মতো ছোটখাটো বিলাসিতা করা।প্রিয়ম ওখানে মাঝে-মধ্যেই এসব করে থাকে।আগে যখন ওর জীবনে সানন্দা ছিলো,তখন সবসময়-সবজায়গায় ওই থাকতো সঙ্গে।মেনুকার্ড নিয়ে বিস্তর চেঁচামেচি করতো মেয়েটা।কিন্তু তবুও ওকে কোনোদিনও একটুও মাংস খাওয়াতে পারেনি মেয়েটা।সব মেনে নিয়েছিলো মেয়েটা।মানতে পারেনি ওর ভয়টাকে।রাতের পর রাত ওর পাগলামোকে।ছেড়ে দিয়েছে।প্রিয়মও আর ওকে বাধা দেয়নি।তারপর থেকে ও একাই আছে।মা মাঝে-মধ্যে বিয়ের কথা বলার চেষ্টা করে।করবেই,সেটাই তো স্বাভাবিক!ছেলে উপযুক্ত হলে সব মা-ই তার পরবর্তী জীবনের কথা ভাববে।কিন্তু সানন্দার পর এমন কাউকে প্রিয়ম এখনও পায়নি,যাকে নিজের খুব কাছের জন ভাবা যেতে পারে!বা যার সঙ্গে থাকতে,সময় কাটাতে ভীষণভাবে ইচ্ছে করে...
দুচোখ মেলে ডাইনিংটা দেখছিলো প্রিয়ম।
অনেককিছু একসঙ্গে ভাবতে-ভাবতেই ওর দৃষ্টি পড়লো টেবিলে রাখা ফ্রেমবন্দী ঝোরার ছবিটার ওপরে।বোধহয় ওর জন্মদিনে তোলা।কারণ ওর সারা মুখে কেক মাখা রয়েছে।প্রিয়ম ছবিটা হাতে তুলে নিলো।ফ্রেমে একদিকে ঝোরার ছবি।আর একদিকে কাঁচের ভিতরে একটা হাতে লেখা কার্ড।ওই কার্ডটার দিকে চেয়েই চমকে উঠলো প্রিয়ম।ওখানে গোটা-গোটা ইংরেজি হরফে লেখা রয়েছে "On your 30th birthday!!"
-ওমা!আপনি এখনও দাঁড়িয়ে?বসুন!
চমকে উঠে প্রিয়ম ছবিটা জায়গামতো রেখে দিলো।এগিয়ে এলো সেই মহিলার দিকে,
-না,মানে ঠিক আছে!
-আরে,বসুন-বসুন!
বলে উনি নিজেই বসে পড়লেন প্রিয়মের উল্টোদিকের সোফায়...এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকা চলে না।অগত্যা,প্রিয়মও বসে পড়লো ওনার মুখোমুখি...উনি বলতে শুরু করলেন।
-আপনি তো বললেনই আপনি প্রিয়ম।আমি একটু আমার পরিচয় দিই!আমি প্রিয়দর্শিনী,ঝোরার বৌদি।
-আচ্ছা-আচ্ছা!!
প্রিয়ম একটু হাসলো।কিন্তু মনটা তখন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে ওর...বৌদি একভাবে কলকল করে বলে যাচ্ছে,
-ভীষণই লজ্জাজনক একটা ব্যাপার জানি,কিন্তু কি যে বলি!মানে সারাটা সপ্তাহ অফিস নিয়ে আমরা তিনজনই এত ব্যস্ত থাকি,তারপর উইকএন্ডে একটু রান্নাবান্না,ঘরের কাজকর্ম,কাচা-ধোওয়ার পর্ব চলতেই থাকে।তারপর আর সত্যিই নিজেদের বৃত্তের বাইরে আর কারোর কোনো খোঁজ-খবর নেওয়াই হয় না!আটতলায় নতুন কেউ এসেছে শুনেছিলাম,কিন্তু সেইভাবে আর...
-নানা,ওটা কোনো ব্যাপারই না।আমি নিজেও একা থাকি তো!তাই আমি ব্যাপারটা খুব ভালো মতোই জানি।একহাতে সংসারের সবদিক সামলে অফিস যাওয়া,সারা সপ্তাহ অফিস করার পর,সত্যিই আর সপ্তাহ শেষে শরীর দেয় না।
-তুমি মানে আপনি...
-কোনো ব্যাপার না বৌদি,আমাকে তুমিই বলতে পারেন।
-বেশ-বেশ!তুমি এখানে একা থাকো?
-না!এখানে মা থাকে।মা স্কুল-টিচার।আমি একা বাইরে থাকি,চাকরিসূত্রে...
-আর বাবা?
-উনি নেই!
-ও আচ্ছা!!ভেরি সরি ভাই!
-নাঃ,ঠিক আছে!
-তুমি একটু বসো।আমি আসছি!
দৌড়ে আবার রান্নাঘরে চলে গেলো বৌদি।প্রিয়ম সেই মুহূর্তেই আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো টেবিলের ওপর রাখা ছবিটাকে।সবুজ রংয়ের একটা জামা পরে রয়েছে ঝোরা।একমুখ হাসি!দুগালে কেক মাখা...চোখ দুটো যেন প্রিয়মের দিকে চেয়েই হাসছে...
-এই নাও!একটু খাও!
-এই নানা!এসব কি বৌদি?বাপরে...
লাফিয়ে উঠলো প্রিয়ম।
-না ভাই!না বললে তো আমি শুনবো না।প্রথমবার এলে আমাদের বাড়ি।এটুকু মিষ্টি তো খেতেই হবে।প্রতিবেশী বলে কথা...চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসো।ঝটপট খেয়ে নাও...
-বৌদি প্লিজ একটু কমান!
-আচ্ছা,একটা মিষ্টি কমাচ্ছি...নাও,ওটুকু খেয়ে নাও!
আবার রান্নাঘরের দিকে গেলো প্রিয়া।প্রিয়ম শুনতে পেলো রান্নাঘর থেকে টুংটাং বাসনের শব্দ আসছে।রাতের রান্না চেপেছে বোধহয়।
প্রিয়ম চামচ দিয়ে প্রথম মিষ্টিটা কাটলো।কিভাবে জানা যায়...কিভাবে...একটু-একটু করে কথা শুরু করলো প্রিয়ম...
-বৌদি?
-হুম ভাই,বলো...
-এখানে ভালো ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান কোথায় আছে? একটু গাইড করতে পারবেন?আমার বাড়ির ফ্রিজটা এক্সচেঞ্জ করতে হবে।
-এসব ব্যাপার তোমার দাদা আর ঝোরা জানে গো!আমি এখনও এখানকার কিছুই ঠিকমতো চিনে উঠতে পারিনি।ঝোরা এখানে এসে প্রথম কদিন স্কুটি নিয়ে-নিয়ে দিনরাত ঘুরে বেরিয়েছে।ও অনেককিছু চেনে গো।আমাকে বলে লাভ নেই।আমি ওই অফিস আর বাড়ি,এর বাইরে খুব একটা কিছু চিনিই না।তোমার দাদা আর ঝোরাই তো সব বাজার-হাট করে!
-ও আচ্ছা!!ঠিক আছে।
কাঁটা চামচ দিয়ে প্লেটের মিষ্টিটা অন্যমনস্কভাবে নাড়তে-নাড়তে নিজের নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো প্রিয়ম।কপালে ভাঁজ ওর।কিভাবে জানবে ও?বৌদিকে বিন্দুমাত্রও কিছু জানতে-বুঝতে না দিয়ে,ঝোরার ব্যাপারটা কিভাবে জানা যাবে?কিভাবে কথা বের করে নেওয়া যাবে?কয়েক মুহূর্ত ভেবেই ওর ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি খেলে গেলো...প্রিয়ম ধীরে-ধীরে ডাকলো,
-বৌদি?
-হুম বলো!
হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রিয়া এসে বসলো প্রিয়মের উল্টোদিকে।রান্নাঘরের আলো নেভানো।ওদিকের কাজ বুঝি সম্পূর্ণ হলো...
-এখানে ভালো গিফ্ট-শপ কোথায় আছে বৌদি?মানে আমার একটা বন্ধুর জন্মদিন।এইরকম ফটো-ফ্রেম আমি কিনতে চাইছিলাম।এই ছবিটা খুব সুন্দর!মানে ফ্রেমটা খুবই সুন্দর!!দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে...ইনোভেটিভ কাজ!
-এটা?আরে এটা তো আমি এইবার জন্মদিনেই ঝোরাকে গিফ্ট করেছি!!কিন্তু এটা তো এখানের নয় ভাই।আমি আমার অফিসের ওখান থেকে কিনেছিলাম!
মনে-মনে হাসলো প্রিয়ম।ব্যাস!!এটাই তো জানতে চাইছিলো ও।ছবিটা ঠিক কত বছর আগের?বেরিয়ে গেছে কথা!!ওর কাজ হয়ে গেছে।এই বছর জন্মদিনেই বৌদি এটা ওকে দিয়েছে।তার মানে ঝোরা থার্টি প্লাস!বাপরে!!বোঝাই তো যায় না!!
-ও আচ্ছা!ঠিক আছে বৌদি!
-তুমি বললে আমি তোমায় একটা এনে দিতে পারি!
-নানা এখন থাক!আমি আগে এখানে দেখে নিই।তারপর না হয় আপনাকে বলবো...
-আচ্ছা ঠিক আছে!দাঁড়াও ভাই,তোমায় একটু জল দিই!
জল আনতে উঠছিলো প্রিয়া।সেই সময় বেলটা বেজে উঠতেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো ও...
-আয়!এত দেরি তোর?
-অফিসের পর একজনের সঙ্গে একটু বেরিয়েছিলাম।একটু টুকটাক কয়েকটা শাড়ি উনি কিনলেন।আমায় যেতে বললেন সঙ্গে...
-ও আচ্ছা!দেখ,আমাদের বাড়ি নতুন প্রতিবেশী এসেছে!তুই গলায় এমন স্কার্ফ জড়িয়েছিস কেন?কিনলি নাকি এটা?
-আরে গলাটা ভেঙে যাচ্ছিলো মনে হলো।ব্যথা-ব্যথা করছিলো।পছন্দ হলো তাই কিনলাম,আর একেবারে গলায়ও জড়িয়ে নিলাম।কিন্তু কে এসেছে?কোন প্রতিবেশী?
জুতো খুলতে-খুলতে বললো ঝোরা...ঘরে ঢুকেই দেখলো সোফায় প্রিয়ম বসে আছে।
-তুমি?
-হুম!ভাবলাম কালকের জন্য একটা থ্যাঙ্কু বলে যাই।কাল এমন অবস্থা হয়েছিলো আমার,যে আমি সেই সময় আর কথা বলার মতো পরিস্থিতিতেই ছিলাম না।তাই আজ...
-না ঠিক আছে!ওটা কোনো ব্যাপার না...কিন্তু সামান্য একটা...না,মানছি আমি,অফ কোর্স ব্যাপারটা ডিস্টার্বিং!তবু এতটা অসুস্থ হয়ে গেছিলে তুমি,আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম!
-সরি ফর বদারিং ইউ!!কাল তুমি বোধহয় তোমার কাজ ক্যানসেল করে...
-তোরা কথা বল!আমি কফি করি।তোর দাদার আজ দেরি হবে আসতে।আপাতত তিনজনেই খাই...প্রিয়ম কফি না চা?
-বৌদি চা!ও আপনারা কি কফি নিচ্ছেন?তাহলে আর আলাদা করে করতে হবে না।কফিই করুন।
-আচ্ছা বেশ!
-প্রিয়ম একটু বসবে?আমি চেঞ্জ করে আসি?ভীষণ টায়ার্ড লাগছে...
ঝোরা বললো।
-শিওর!!প্লিজ!
প্রিয়মের সামনে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো ঝোরা।প্রিয়ম ঘাড় ঘুরিয়ে আবার চেয়ে রইলো ফ্রেমবন্দী ছবিটার দিকে...
সামান্য কিছু মিষ্টি-কফি সহযোগে মজায়-গল্পে-আলাপচারিতায় সন্ধ্যেটা ভালোই কাটলো প্রিয়মের।ঝোরা ওর সঙ্গে বেরিয়ে এলো লিফট পর্যন্ত।ঘড়িতে তখন সাড়ে-নটা।
-কবে যে পুরো এপার্টমেন্ট ভরবে কে জানে?তোমাদের ফ্লোর তো পুরো ফাঁকা ঝোরা?!
-হুম!তার জন্য আমাদের কিন্তু কোনো অসুবিধে হয়না প্রিয়ম।সবাই থাকলেই বা কি?না থাকলেই বা কি?দরজা বন্ধ করলেই যে যার বৃত্তে আবদ্ধ।কেউ থাকলো কি গেলো,তাতে কি যায়-আসে!!
-হুম!তা অবশ্য!তবু সুবিধে-অসুবিধে-প্রয়োজনে তো মানুষ-মানুষকেই ডাকবে।তাই না!?
-হুম!সেতো একটা ফোন করে দিলেই কাকা বা রাজু দা চলে আসবে...
-হুম!তা ঠিক!আচ্ছা ঝোরা...এটা রাখো!আসলে এটার জন্যই আজ আসা...
নিজের বুক-পকেট থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করে ঝোরার দিকে এগিয়ে দিলো প্রিয়ম।
-কি করবো টাকা দিয়ে?কিসের জন্য এটা?
-কাল তুমি আমায় ডাক্তার দেখিয়ে,মেডিসিন কিনে...
-হ্যাঁ তো?তাতে কি হয়েছে?ওটা বরং তুমিই রেখে দাও প্রিয়ম।আমি রাস্তায় যদি কোনোদিন ড্রিংক করে একসিডেন্ট করে উল্টে পড়ে থাকি,তখন না হয় তুমি আমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও।শোধ হয়ে যাবে!!
ঝোরার কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলো প্রিয়ম।
-নানা!তবু তুমি টাকাটা রাখো!!
-এই ধুর!ওসব ছাড়ো তো!কাজের কথা বলো!বৌদির সামনে আমি তোমাকে বেশি ফোর্স করলাম না প্রিয়ম।তুমিও দেখলাম প্রসঙ্গ বদলে দিলে,তাই আমিও আর ঘাঁটালাম না।কি ব্যাপার গো?মানে তুমি বলতে না চাইলে,আমি জোর করবো না।আসলে আমার কাল একটু অদ্ভুত লাগলো।তুমি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লে...
মাথা নীচু করে নিলো প্রিয়ম।তারপর মাথা তুলে ঝোরার চোখে-চোখ রেখে বললো,
-কোনোদিনও খুন হতে দেখেছো ঝোরা?
তিরতির করে কেঁপে উঠলো ঝোরা!ও কি উত্তর দেবে এই প্রশ্নের?!খুন হতে আর কি দেখবে?!এ আর এমন কি বড় কথা?!ও নিজেই তো খুন করে বসে আছে!!উফফ!কত রক্ত!!ভগবান!!
-উফফ!!কত রক্ত ঝোরা!!আর সেই সঙ্গে অসহ্য কষ্ট!!একেবারে শেষ মুহূর্তের,সে কি যে চিৎকার...
কেঁপে উঠলো প্রিয়ম।যন্ত্রণায় কুঁচকে গেলো ওর চোখমুখ!মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো প্রিয়ম।ঝোরা এগিয়ে গেলো প্রিয়মের দিকে।
-ইটস...ইটস ওকে!আই এম সরি প্রিয়ম!ওকে...ওকে...তোমায় আর কিছু বলতে হবে না।আমি কিচ্ছু জানতে চাই না।প্লিজ!!আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না!!সো সরি!!
-আমার দুষ্টু!!আমার দুষ্টুকে খুন করে ফেলেছে ওরা।না,আজ আমি বলবো!মা সব জানে...কিন্তু তবুও মায়ের সঙ্গে এসব কথা বললে,মা আরও কষ্ট পায় জানো তো।আমি জানি,আমার এই জীবনের জন্য মা আজও নিজেকেই অপরাধী ভাবে।কাউকে এসব বলতে পারি না ঝোরা।সবাই এসব শুনলে হাসে।হয়তো কেউ আমায় পাগল বলে,কেউ আবার পিঠ চাপড়ে বলে,"গ্রো আপ ম্যান!" এসব কোনো ব্যাপার নাকি!!খাচ্ছিস না?কিন্তু আমি পারি না জানো তো!!আমি তো খেতেও পারি না ঝোরা!তুমি শুনবে?
-তোমার যদি বলতে কষ্ট না হয় তো...
-কিচ্ছু হবে না আমার...তোমায় বলবো...
-এখানে....এভাবে?
-বেশ।বলো তুমি কবে?কোথায়?আমি তো আর মাত্র তিনদিন আছি।তার মধ্যে বাড়ির কতগুলো কাজও আছে...তোমারও অফিস...এর মধ্যে তুমি তোমার সময়মতো যখন বলবে,যেখানে বলবে আমি পৌঁছে যাবো!বলো...
-প্রিয়ম?
-বলো?
-এই জায়গাটা ফাঁকা ঠিকই।তবে ফাঁকা জায়গার একটা এডভান্টেজ আছে কিন্তু।
-কি?
-ফাঁকা জায়গায় ব্যস্ততায়-সভ্যতায়-আধুনিকতায় আকাশ ঢাকা পড়ে না।মানুষ নিজের জীবনের বাইরেও একটু সময় বের করে,মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়।আর জানো তো,রাতের আকাশ দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর লাগে...দেখতে যাবে?
-মানে?আকাশ দেখতে এই এত রাতে কোথায় যাবো?
-দেখো প্রিয়ম।সবে তিনদিন হয়েছে তোমরা এখানে এসেছো।পরশুদিন আমায় সিগারেট কিনে দিয়ে আমার সঙ্গেই এপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে,আর কাল তো ছেড়েই দাও।বুঝতেই পারছি,কালকের দিনটা তোমার জন্য বীভৎস একটা দিন গেছে।আর আজ?আজ এখনও আমার একসঙ্গেই দাঁড়িয়ে আছো!নীচে নেমে যাবে বলে তুমি লিফটের দিকে যাচ্ছ!
-হ্যাঁ... কিন্তু কি বলতে চাইছো,সেটাই তো বুঝতে পারছি না ঝোরা।খোলা আকাশের সঙ্গে আমার গত তিনদিনের কি সম্পর্ক?
-এপার্টমেন্টের খোলা আকাশ দেখেছো প্রিয়ম?
বলেই হাসিমুখে ঝোরা চাইলো প্রিয়মের দিকে।
সেই মুহূর্তেই সমস্ত ধাঁধার সমাধান হয়ে গেলো প্রিয়মের মস্তিষ্কে।ঝোরা তো ছাদের কথা বলছে...
-চলো!এখনই...কাল নয়,পরশু নয়...আজই...চলো!
-হুম চলো!!তারপর তো বৌদির কাছে খিস্তি খাবোই।আর কি?!তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে হবে।কাল আবার অফিস!
-সেতো,"কিরে!কোথায় ছিলি এতক্ষণ!!" বলে আমিও মার কাছে খিস্তি খাবো।মারও তো সকালে স্কুল আছে।তাড়াতাড়ি ডিনার করে মাকে ছেড়ে দিতে হবে।কিন্তু আজ সব চলবে।চলো...
বলেই লিফটের দিকে পা বাড়ায় প্রিয়ম...
-এত আনফিট তুমি?
-মানে?
-একটাই তো ফ্লোর?সিঁড়ি দিয়েই চলো।
-ওকে,এসো!!
বলেই প্রিয়ম একটা হাত বাড়ালো ঝোরার দিকে...কয়েক মুহূর্ত ঝোরা থমকে গেলো।ও একভাবে চেয়ে রইলো ওর ওই হাতটার দিকেই।তারপর দেখলো প্রিয়মের মুখের দিকে।ও হাসিমুখে ওর দিকেই চেয়ে চেয়ে আছে।ঝোরার বুকের ভিতরটা সাংঘাতিক রকম কাঁপছে...
-কি হলো ঝোরা!চলো?!
ঝোরার গলার কাছটা স্কার্ফের ঘষা লেগে মাঝে-মাঝেই জ্বালা করে উঠছে।কাল দেখা না হওয়ার সমস্তটুকু রাগ-অভিমান,আজ অফিসের পর অরিত্র কড়ায়-গন্ডায় শোধ করে নিয়েছে।ছিঁড়ে ফেলেছে ঝোরাকে।তার জন্য অবশ্য ঝোরা নিজেও কম তৃপ্ত নয়।কিন্তু ওর গলায় দাঁত বসিয়ে দিয়েছে অরি।তাই স্কার্ফ ছাড়া গতি নেই আর।নতুন কাপড়ের ঘষায় ক্ষতস্থান জ্বলে উঠছে।কিন্তু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত,ওটা গলা থেকে নামাতেই পারবে না ঝোরা।প্রিয়মের এগিয়ে দেওয়া হাতটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে,একটু হেসে ও নিজের সংকোচ কাটিয়ে উঠলো।নিজের ওপর থেকে এত বছরের জমিয়ে রাখা ভরসা-আত্মবিশ্বাস,সমস্ত কিছু এক মুহূর্তেই হারিয়ে ফেললো ও।কোনো পুরুষের দিকে নিজেকে এগিয়ে দিতে,ওর মুহূর্তমাত্র সময়ও লাগে না।তবে প্রিয়মের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ও ধরতে পারছে না কেন!!কোথায় বাধছে ওর!!কিসের এত সংকোচ!!
-চলো!!
প্রিয়মের বারংবার ডাক উপেক্ষা করতে পারলো না ঝোরা।ও অবাক হয়ে দেখলো,ও না এগোনো পর্যন্ত প্রিয়ম নিজে থেকে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরলো না।এবার ঝোরা নিজেই এগিয়ে গিয়ে হাতটা রাখলো প্রিয়মের হাতে।প্রিয়ম এবার শক্ত করে ধরলো ওর হাতটা।তারপর দুজনেই এক-একটা করে সিঁড়ি টপকে দ্রুতগতিতে উঠে গেলো ওপরে...
ঘড়িতে তখন প্রায় রাত দশটা...-বারোটা বেজে গেছে!!
ছাদে পা রেখেই হাঁপাতে-হাঁপাতে বললো ঝোরা।
-কিসের?
-ফুসফুসের!উফফ!!সত্যিই আর পারি না প্রিয়ম।একটুতেই হাঁপিয়ে যাই।এই জন্যই তো কাজের সময় লিফট হাতের সামনে না পেলে বেধড়ক খিস্তি মারি।
-সিগারেটটা আস্তে-আস্তে কমিয়ে দাও একটু...
হেসে ফেললো ঝোরা।
-কে কাকে বলছে!!
-তা অবশ্য!!
-হুম,এবার বলো তো,সালা কেসটা কি?এদিকে এসো।
ছাদের কার্নিশে গিয়ে দাঁড়ালো দুজন।ছাদ থেকে প্রিয়ম দেখলো,মায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সব একে-একে বেরিয়ে যাচ্ছে....রাজেশ দা দরজা বন্ধ করে দিলো।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো প্রিয়ম।একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো ঝোরার দিকে...
খোলা আকাশের দিকে চেয়ে থেকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো,
-দুষ্টু!!আমার প্রাণ ছিলো।অথচ,আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য,আমার মঙ্গল কামনায় ওকেই খুন করা হয়েছে।আমারই চোখের সামনে।রোগে ভুগে নয়,বয়সের ভারে নয়।একেবারে সদ্য তাজা একটা প্রাণকে মেরে ফেলেছে ওরা।তারপর সেই রক্ত দিয়ে আমার কপালে একে দিয়েছে মঙ্গলটিকা!আচ্ছা ঝোরা,কোনো অবলা প্রাণীর রক্তে কি কারও মঙ্গল হতে পারে?হওয়াটা সম্ভব?
গুমরে কেঁদে উঠলো প্রিয়ম।ঝোরা চমকে এগিয়ে এলো প্রিয়মের দিকে...কাঁধে হাত রেখে বললো,
-প্রিয়ম,এসব থাক না হয়....
-নাঃ!!লোকে আমাকে পাগল ভাবে ঝোরা।হয়তো আজকের পর থেকে তুমিও ভাববে।কিন্তু যাকে আমি জন্মাতে দেখেছি,যার সঙ্গে খেলা করে বড় হয়েছি,হঠাৎ করেই নিজের চোখের সামনে,তার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুটা কি মেনে নেওয়া যায় ঝোরা!!অন্তত আমি তো পারিনি।সেদিন এতসব কিছুই বুঝিনি।আজ বুঝি,কতটা সেন্সিটিভ আমি!!
-আমি কিন্তু কিছুই....
-এসব মা নিজের মুখে কোনোদিনও আমায় বলেনি।মামী পরে আমায় বলেছে।তাদের ওই খুনকে আমার চোখে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্য,সবরকম চেষ্টা করেছে ওরা।আমার আগে আমার মায়ের দুটো মিসক্যারেজ ছিলো।এসব ব্যাপার যদিও আমি ঠিক বুঝি না,কিন্তু স্যাকে কিসব সমস্যা ছিলো,তাই বেবি একটু বড় হলে নিজে-নিজেই এবর্ট হয়ে যেতো।থাকতো না।আর তারপর আমার আগে একটা মেয়ে হয়েছিলো,কিন্তু মৃত!
-হোয়াট!!
-হুম!মা অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো ধীরে-ধীরে।তারপর আমার জন্মের সময় দাদু মানসিক করেছিলো,আমার জন্ম যদি ভালোভাবে হয়,আমি যদি সুস্থ-স্বাভাবিক হই,আর পৃথিবীর বুকে যদি কোনোরকমে পাঁচটা বছর টিকে যেতে পারি,তাহলে ওদের বাড়ির বাৎসরিক কালীপুজোয় দাদু জোড়া-পাঁঠা বলি দেবে!!দাদুর পাশের বাড়িতেই জন্মেছিলো ছাগলটা।যেদিন জন্মেছিলো আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সামনে।আমি কিচ্ছু ভুলিনি ঝোরা,আমি কিচ্ছু ভুলিনি,কিচ্ছু না।সব মনে আছে আমার!!ওর মা আদর করে ওর গা চেটে দিচ্ছিলো।আমি দাদুর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।তারপর দুদিনের মধ্যেই দেখি,ও একটু-একটু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলো।উঠছিলো,আবার পা মুড়ে পড়ে যাচ্ছিলো।টুকটুক করে নাড়তে ছোট্ট একটুখানি লেজ।আর আমি হাততালি দিয়ে উঠতাম।পুরো কালো রংয়ের মধ্যে,ঠিক দুটো চোখের মাঝে সাদা একটা ডোরা দাগ ছিলো।তারপর থেকে যতবার মামাবাড়ি গেছি,আগে ছুটেছি ওই পাশের বাড়ি।দুস্টুমি করে ছোট্ট ছাগলটা আমার পায়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠতো,চেটে দিতো আমার গাল-হাত-পা!আমিই ওর নাম দিয়েছিলাম দুষ্টু!ওই নামে একবার ডাকলেই বন-বাদার ভেঙে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়তো।আমি দুহাতে কোলে তুলে নিতাম ওকে।ওর গায়ের ওই বন্য গন্ধটা আমার যে কি ভালো লাগতো ঝোরা,তোমায় কি বলবো!!ওর গলায় দড়ি পরিয়ে ওকে খুঁটিতে বেঁধে রাখলে,আমি গিয়েই দড়ি খুলে দিতাম।সবাই বলতো,এমন দৌড় মারবে,তুই আর ধরতেও পারবি না ওকে!!দৌড়তো না,বিশ্বাস করো।আমার পায়ে-পায়েই ঘুরতো।আমায় ছেড়ে এগিয়ে যায়নি কোনোদিনও।দিদা বলতো,"এক ছাগল আর এক ছাগলকে চিনেছে!ওই জন্যই সঙ্গ ছাড়ে না!" সবাই কত হাসতো!!প্রতিবার গিয়েই দেখতাম,একটু-একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে আমার দুষ্টু।তারপর একদিন দেখলাম,মামাবাড়িতে একেবারে হুড়োহুড়ি কান্ড।তখন আর আমাকে পায় কে!!এমনিতেই মা দুবেলা খাইয়ে চেপে ধরে ঘুম পাড়াতো বলে,আমি বরাবরই বিরক্ত হতাম।কেন?মামাবাড়ি ছুটিতে এসে আবার ঘুমানো কিসের!সেই আমাকেই যখন বলা হলো,সারারাত জেগে পুজো হবে,আর আমাকেও জেগে থাকতে হবে,আনন্দে তখন আমি দিশেহারা!!কিন্তু সেই ঘুমিয়েই পড়েছিলাম একটা সময় পর...তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি,দাদু আমাকে কোলে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।ভালোভাবে চোখ খুলে কি দেখলাম জানো...
-প্রিয়ম...
-শোনো ঝোরা!প্লিজ...ওই বয়সে ঘটে যাওয়া এত ঘটনা আমার হয়তো মনে থাকতো না।কিন্তু ওই রাতটা আমি আর জীবনেও ভুলতে পারবো না!কিছুতেই না।আমাকে দাদু কোলে নিয়ে গিয়ে ঠাকুরের সামনে দাঁড়ালো।ঠাকুরমশাই আমার মাথায় হাত দিয়ে কিসব বললেন,পরে শুনেছি ওটাই নাকি আশীর্বাদ!!তারপর দেখলাম,খুঁটিতে অন্য একটা অচেনা ছাগলের সঙ্গে আমার দুষ্টু বাঁধা।আমার দিকেই চুপ করে চেয়ে আছে।আমি দাদুর কোল থেকে নেমে এগিয়ে গিয়েছিলাম দুষ্টুর দিকে।কিচ্ছু বলেনি দুষ্টু।শুধু মাথা নীচু করে আমার পা একটু চেটে দিয়েছিলো।আমি তখনও কিচ্ছু বুঝতে পারিনি জানো ঝোরা!!পরে দেখলাম দাদু আমাকে হেঁচড়ে কোলে তুলে নিলো।সরিয়ে নিয়ে গেলো আমার দুষ্টুর কাছ থেকে।তখনই ও চিৎকার করতে শুরু করলো।আমাকে আর নামতেই দিলো না দাদু।আমি দাদুর এই ব্যবহারে সেদিন অবাক হয়ে গেলাম।দাদুর কাছেই আমার সব আবদার ছিলো।ছাগলছানা দেখতে যাবো বললে,দাদুই আমাকে কোলে করে নিয়ে ওদের বাড়ি যেতো।সেই দাদুই ওইদিন আমাকে দুষ্টুর কাছে কিছুতেই যেতে দিলো না।আমি দাদুর কোল থেকে দেখলাম,সেই অচেনা ছাগলটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা কাঠের মধ্যে ওর গলা ঢুকিয়ে দিলো।আর তারপর উফফ...
সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিলো,খেয়ালই করেনি প্রিয়ম।আঙুলে একটু আগুন লাগতেই ছুঁড়ে ফেলে দিলো ও...
-বুঝতে পারছি প্রিয়ম,আর বলতে হবে না!!
-ঝোরা ওই ছাগলটা চিৎকার করে উঠেছিলো।কিন্তু আমার দুষ্টু সেদিন একটুও কাঁদেনি।ও কি জানতো,যে আমার জন্যই ওর প্রাণ নেওয়া হচ্ছে।আমার মঙ্গল কামনায়!!তাই কি ও আমায় ভালোবেসে স্বেচ্ছায় প্রাণ দিয়েছিলো!কতরাত ভেবেছি ঝোরা!!উফফ!আর তো পারি না!!ওকে একটু বাঁচতেও দিলো না।কি চাহিদা ছিল ওর!একটু জীবন!তাও কিভাবে মৃত্যু?না,আমার দীর্ঘায়ু কামনায়!!এটা সম্ভব ঝোরা?কারোর মৃত্যু কি কাউকে দীর্ঘায়ু প্রদান করতে পারে!!ওই অচেনা ছাগলটার পরিণতি দেখে আমি নিজেই তখন চিৎকার করে দাদুর কোলে দাপাচ্ছিলাম,দাদু তাই আমাকে নিয়ে ওখান থেকে সরে যায়!প্যান্ডেল থেকে বেরোনোর মুখেই দেখলাম,একেবারে শেষ মুহূর্তে দুষ্টু একবার মাত্র চিৎকার করে উঠলো,কিন্তু কাঁসর-ঘন্টায় সেই মর্মান্তিক অন্তিম আর্তনাদ বোধহয়,আমি ছাড়া আর কেউই শুনতে পায়নি।তারপরই এক কোপে সব শেষ।দুষ্টুর সঙ্গে-সঙ্গে আমিও একবার শেষ চিৎকার করে চুপ করে গেছিলাম দাদুর কোলে।আমি চুপ করার পর দাদু আমাকে নিয়ে প্যান্ডেলে আসে।আমি দেখেছি ঝোরা,আমি নিজের চোখে দেখেছি,দুষ্টুর ধড়হীন মুন্ডুটা পড়ে রয়েছে।চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে,উল্টে রয়েছে।জল গড়িয়ে পড়েছে খোলা চোখদুটো থেকে।আর দুটো চোখের মাঝে সেই সাদা ডোরা দাগটা....ঠিক যেন সাদা নয়,লাল!!উফফ!!বুঝতে পারিনি আর,ওটা সিঁদুরের লাল নাকি রক্তের লাল!!আর পারি না...কত রক্ত!কত-কত-রক্ত!!ওই রক্ত দিয়েই আবার আমার কপালে টিপ পরিয়ে দিলো আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা।দুষ্টুর রক্তের মঙ্গলটিকা আমার কপালে।গা গুলিয়ে ঘিনঘিন করে ওঠে ভাবলেই।কি ভীষণ নারকীয় দৃশ্য...সেদিন আমার চোখের সামনে অকারণে একটা,না দুটো খুন হয়ে গেলো ঝোরা।আমি আর কিচ্ছু বলিনি,একটুও কাঁদিনি আর ।চুপ করে গেছিলাম একদম...তারপর শুনেছি আমি জ্বরে অজ্ঞান ছিলাম চার-পাঁচদিন।অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে আমায়।কিন্তু আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি।এখনও পারি না।মাঝে-মাঝেই কানে বাজে দুষ্টুর ওই অন্তিম মৃত্যুকালীন আর্তনাদ।মাছ খাই না,রক্ত দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে।মাংস খাই না,মনে হয় দুষ্টুকেই হয়তো কেটে রান্না করে আমার থালায় এনে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।আগে মা জোর করে-করে খাওয়াতো,খেয়েই বমি করে-জ্বর এসে অসুস্থ হয়ে পড়তাম।তাই এখন মা আর কিছু বলে না!আজও প্রতিরাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দুষ্টুর ওই মৃত্যুকালীন অন্তিম চিৎকার বেজে ওঠে আমার কানে।প্রায় দিনই-প্রতিদিনই...ঘুমের ওষুধ ছাড়া কিছুতেই ঘুমোতে পারি না।ছোটবেলার কত-কিছুই তো ভুলে গেছি ঝোরা।কিন্তু এটা তো আর ভুলতেই পারলাম না গো...আমাকে আজীবন তাড়া করে বেড়াবে!রক্ত দেখলেই শরীর অবশ হয়ে,গা গুলিয়ে হড়হড় করে বমি হয়ে যায়।মনে হয় আমাকেই বুঝি রক্ত দিয়ে স্নান করিয়ে দিলো কেউ!কপালে এঁকে দিলো রক্তের মঙ্গলটিকা!কিছুতেই আর নিজেকে আটকাতে পারি না!!মরে যাচ্ছি আমি...একটু হাত কাটলে বা দাড়ি কাটতে গিয়ে রক্ত বেরোলেও গা গুলিয়ে ওঠে!আর তো পারছি না!!
-প্রিয়ম!সব ঠিক হয়ে যাবে।
-হবে না ঝোরা!কিচ্ছু ঠিক হবে না।আমি কোনদিনও আর এই ট্রমা থেকে বেরোতেই পারবো না।
-আমি বলছি পারবে।আর সবার মতো আমি তোমাকে পাগল বলবো না।কারণ আমি জানি এতে ঠিক কতটা কষ্ট!তুমি একদিন ঠিক পারবে প্রিয়ম।মিলিয়ে নিও।হয়তো আমিই পারবো না!!কারণ,তুমি চোখের সামনে খুন হতে দেখেছো।আর আমি?আমি খুন করেছি!
-কি?মানে!!
ঝোরা একভাবে চেয়ে রইলো প্রিয়মের দিকে...সেই মুহূর্তেই প্রিয়মের ফোনটা বেজে উঠলো।
-বলো!
-তুই কোথায় রে?কটা বাজে?ঘরে ঢুকবি না?খাওয়া-দাওয়া...
-আসছি-আসছি!!এখানেই আছি।দু-মিনিটে আসছি!
বলেই ফোনটা রেখে দিলো প্রিয়ম।
-কি হয়েছে ঝোরা?
প্রিয়মের প্রশ্ন শুনে ঝোরা হেসে ফেললো।
-এতটাও সহজ নয় প্রিয়ম।আমার লাইফটা আরও অনেক-অনেক বেশি কমপ্লিকেটেড!!তোমারটা তাও বলা যায়,হ্যাঁ লোকে হয়তো এখন শুনে হাসবে।তোমাকে পাগলও বলতে পারে।কিন্তু আমি বুঝি,এটা ছোট একটা ব্যাপার হলেও,তা তোমার শিশুমনে এত গভীরভাবে আঘাত করেছে,যে তুমি ওটা আর কাটাতে পারছো না।কিন্তু তাও তোমারটা বলা যায়,আর আমারটা?আমারটা তো বলাও যায় না।
-কেন?ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি!
-হোয়াট-হোয়াট-হোয়াট!!ট্রাস্ট!!তোমাদের!!হুহ!
-এক্সকিউজ মি?আমাদের নয়,আমাকে!
-ওই একই হলো!তুমি আর তোমরা,সবই তো পুরুষ!
-না!!একই হলো না ঝোরা!!সব পুরুষ সমান নয়!
-ওহ প্লিজ!!আমার মাথা গরম হয়ে যাবে প্রিয়ম।মুখ থেকে গালাগালি বেরিয়ে আসবে।তোমার ভালো লাগবে না।চেঞ্জ দিস টপিক!
-ফাইন!!আমি জানি না তোমার ব্যাপারে কিছুই,শুধু এটুকুই আবারও বলবো,সব পুরুষ সমান নয়।পুরুষাঙ্গ থাকলেই পুরুষও হওয়া যায়,আবার ধর্ষকও হওয়া যায়।পার্থক্যটা শুধু শিরদাঁড়ায়...
প্রিয়মের মৃদু ধমকানিতে প্রথমে একটু দমে গেলো ঝোরা।পরমুহূর্তেই আবার তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলো,
-ওসব বালের কথা অনেক শুনেছি প্রিয়ম!তোমার মত উদগান্ডু আমার অনেক দেখা আছে।তোমার ওই দু-লাইনের ভাষণে আমার জীবন-দর্শন বদলাবে না প্রিয়ম।তাই তোমার ভাষণ,নিজের কাছেই রাখো।জীবনটা অনেক কঠিন।তুমি বড্ড বেশিই সেনসিটিভ!একটা অবলা প্রাণীর মৃত্যু সহ্য করতে পারো না,আর এ তো....ছাড়ো!বাদ দাও!এই মুহূর্তটাকে নষ্ট করতে চাইলে চালিয়ে যাও তোমার এসব গালভারী ভাষণ,নয়তো টপিক চেঞ্জ করো।সব পুরুষকে সালা আমার জানা আছে...
ধিকিধিকি জ্বলতে লাগলো ঝোরা।প্রিয়ম অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলো।
-এত পুরুষ-বিদ্বেষ?কেন ঝোরা?
-বিকজ এট দা এন্ড অফ দা ডে,মেন ডোন্ট ডিসার্ভ লয়ালটি!
-হোয়াট!মেন!!অল মেন?
-ইয়েস!!অল মেন!
-শিট!আর তোমার এই ধারণার কারণ?
-রাত হয়ে গেছে।তোমারও মা ফোন করছে,আমিও যাই।
-ঝোরা...
-কি?
-ওকে-ওকে!আর জিজ্ঞেস করবো না।সরি!!সরি!!প্লিজ!বেগ ইয়োর পার্ডন!
-হুম!
-ওকে!!রাইট!মুহূর্তটাকে রুইন করবো না।চলো সব ভুলে যাই।তোমার বৌদি বললো,তুমি এখানকার সবকিছু খুব ভালোভাবে চেনো!ফ্রিজ আর গিজার কিনবো।দোকান চিনি না।আমায় নিয়ে যাবে?
-কাল?আমার অফিসের পর?তখন স্কুটিও থাকবে।কাল দেবে বলেছে।
-ওকে!ডান।বেরিয়ে আমায় একটা ফোন করে দিও।
-শিওর!কিন্তু তোমার নম্বারটা দাও প্রিয়ম।আমার কাছে তো এখন ফোনও নেই।তোমায় লিফট পর্যন্ত ছাড়তে গিয়ে,ছাদে উঠে এলাম।
-তোমার নম্বর বলো।আমি কল করে দিচ্ছি...
-হুম!
ঝোরার ব্যাগের মধ্যে সাইলেন্ট করে রাখা ফোনে ভেসে উঠলো থার্টি-ফাইভ মিসড কল ফ্রম অরিত্র,ওয়ান মিসড কল ফ্রম আননোন নম্বর!
-করে দিয়েছি!
-আমি গিয়ে সেভ করে নিচ্ছি!কাল বেরিয়ে ফোন করবো!
-ওকে!চলো।
-হুম চলো।আচ্ছা প্রিয়ম,তুমি যে মাছও খাও না,মাংসও খাও না,তো কোনো রেস্টুরেন্টে গেলে কি করো?
-ভেজ-কিছু!সফট ড্রিংক বা হার্ড ড্রিংক!সাল্যাড!ডেজার্ট!
-মানে টাকা-পয়সা খরচ করে ওইসব ঘাসপাতা খেয়ে আসো?!
নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে হেসে ফেললো প্রিয়ম।দুজনেই একসঙ্গে লিফটে গিয়ে উঠলো।
-তোমার বিয়ের পরও তোমার সঙ্গে-সঙ্গে বউও ওই ঘাসপাতা খেতে বাধ্য হবে?
একটু চমকে উঠে ঝোরার দিকে চাইলো প্রিয়ম।তারপর মাথা নামিয়ে বললো,
-তা কেন?সে তার ইচ্ছেমতো চলবে।তার যা মন চাইবে,সে সেটাই খাবে।আমি খাচ্ছি না বলে,ইনফ্যাক্ট খেতে পারছি না বলাটাই বেটার,খেতে পারছি না বলে,তার খাওয়া কেন নষ্ট করবো!!
-সেটাই তো,ওই শাকপাতা-ঘাস....
-এই এক মিনিট ঝোরা!হোয়াট ইজ ঘাসপাতা?!আমার হাতের ধোঁকার ডালনা,পোস্ত একবার খেয়ে দেখো,তুমি তোমাদের নন-ভেজ ভুলে যাবে!
-রিয়েলি?তা নেমন্তন্ন করো একদিন?
-ওকে!এনিটাইম!
-কদিন আছো?
-বেশিদিন না!তাই তো ফ্রিজ আর গিজারটা আমি থাকতে-থাকতেই...
-কালই হয়ে যাবে...ডোন্ট ওয়ারি!ঝোরা আছে তো!তোমার গাইড!বাই!!
-হুম,বাই!গুডনাইট!
-গুডনাইট!!
লিফট থেকে বেরিয়ে গেলো ঝোরা।দরজা বন্ধ হয়ে গিয়ে আবার প্রিয়ম নামতে শুরু করলো।
-কিরে?লিফট পর্যন্ত ছাড়তে গিয়ে কি,ঘর পর্যন্ত ছেড়ে এলি নাকি?
ঝোরাকে বলে উঠলো প্রিয়া।
-আরে না বৌদি,ওই কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে একটু কথাবার্তা...নতুন এসেছে তো...
-হুম...সেতো দেখতেই পাচ্ছি!!বেশ অনেকক্ষণ ধরেই একটু কথাবার্তা হলো।একটু...একদম একটু...
-ধুর বাবা!
বলেই হেসে ফেললো ঝোরা...
ঘরে এসে আয়নায় চোখ রেখে নিজের দিকে চাইলো ঝোরা।স্কার্ফটা খুলে ফেললো গলা থেকে।দগদগে হয়ে রয়েছে জায়গাটা।
-উফ!ছিঁড়ে খেয়েছে একেবারে!কতদিন এখন গলায় কাপড় জড়িয়ে ঘুরতে হবে কে জানে!!সালা গান্ডু!!
মুখ থেকে চিরকালীন অভ্যাসবশত গালাগালি বেরিয়ে এলো ঝোরার।চমকে উঠলো ও নিজেই।যতক্ষণ ও প্রিয়মের সঙ্গে ছিলো,একবারও তো সেভাবে মুখ-খারাপ করেনি।সেভাবে খুব একটা প্রয়োজনও পড়েনি।যতক্ষণ ওর সঙ্গে থাকে,কেমন যেন সবকিছুই ঠিক থাকে।আবার যেন ভরসা করতে ইচ্ছে করে...আবার...আবারও...
কেঁপে উঠলো ঝোরা...
অস্থির লাগছে প্রিয়মের শরীরটা...
"মেন ডোন্ট ডিসার্ভ লয়ালটি!!"
কেন এই ধারণা ঝোরার।এত কঠিন কেন ও!সেদিন কি সুন্দর ঝরঝর করে পাহাড়ী নদীর মতো বললো...
"আচ্ছা উদগান্ডু ছেলে তো!"
সেই মেয়েই আজ আবার সাংঘাতিক রূঢ়ভাবে বজ্রকঠিন স্বরে বলছে,
"মেন ডোন্ট ডিসার্ভ লয়ালটি!"
কোনটা প্রকৃত ঝোরা,কোনটা ওর মুখোশ!!কোনটা দুঃস্বপ্ন,কোনটা বাস্তব!!ওর মুখ থেকে নির্গত দুটো বাক্য দুরকমভাবে প্রিয়মকে ভাবাতে শুরু করলো।অজান্তেই নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো ও।কপালে ভাঁজ!!
তবে হ্যাঁ,একটা ব্যাপার!যখন থেকে এই এপার্টমেন্টে প্রিয়ম এসেছে,একটা দিনও ঝোরাকে ছাড়া কাটায়নি।সারাটা সন্ধ্যে জলের মতো কিভাবে সময় বয়ে গেলো,প্রিয়ম তো বুঝতেও পারলো না।একটু হেসে দরজার বেলটা বাজলো ও।একবার ফোনে দেখলো,রাত সাড়ে এগারোটা...আজ কপালে দুঃখ আছে।মা সাংঘাতিক চিৎকার করবে...শুনেই নেবে প্রিয়ম...ঝোরার সঙ্গে কাটানো একটা সুন্দর সন্ধ্যের বিনিময়ে এটুকু তো করাই যায়...
(চলবে....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 


 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন