অনুসরণকারী

শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

কুহেলিকায় রাত্রিযাপন (প্রথম পর্ব )

 





কুহেলিকায় রাত্রিযাপন

সাথী দাস

প্রথম পর্ব 




বৃষ্টির কাছাকাছি আজও তোমাকে খুঁজি, খুঁজি,

মেঘের কানাগলিতে, ঠিকানা হারিয়েছ বুঝি! তাই বুঝি!

তিন রাস্তার মোড়ে, নিভে আসা আলোয়, তোমায় ভেবেছি আপন... আপন!

রোদের কিনারে, ফিরে চেয়ে দেখি, বৃথাই রাত্রিযাপন.... 

বৃথা এই... রাত্রিযাপন!


আজ শুটিংয়ের শেষ দিন ছিল। সামনের বছরের প্রথমার্ধেই হয়ত মুক্তি পাবে সিনেমাটা। মাত্র দুটো দৃশ্য আর বৃষ্টির মাঝে গানের শুটিং শেষ করে প্যাক আপের পর গাড়িতে উঠে বসেছিল কুহু। মেকআপ তুলে ফেললেও ওর চুলটা এখনও ভিজে। মনটা ভিতরে-ভিতরে অস্থির হলেও, কুহু ওপরে সেটা প্রকাশ করছিল না। নিজের গানটাই কুহু চোখ বন্ধ করে গুনগুন করছিল। সহ অভিনেতা পীযূষকান্তি সাহা মানুষটা বড় ভালো। চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও, এখনও মনে-প্রাণে-শরীরে বেশ ঝকঝকে সুপুরুষ। পীযূষ ও কুহেলীর জুটিতে এটা তৃতীয় ছবি। টলিউডের একেবারে শীর্ষস্থানে না থাকলেও, ইতিমধ্যেই অনেকের রাতের ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ হয়ে উঠেছে বছর ত্রিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লাস্যময়ী কুহেলী বর্মন। আর এই নতুন জুটি বক্স-অফিসে বেশ সাড়া ফেলেছে। তার ফলে প্রযোজকরাও একটু নড়েচড়ে বসে তড়িঘড়ি খোঁজ করছেন নবাগতা কুহুর। তবে এই সমস্তটাই সম্ভব হয়েছে পীযূষের জন্য। বড় একটা প্রজেক্টে প্রথম সুযোগটা উনিই দিয়েছিলেন কিনা! যদিও ভালমানুষির মুখোশটা এখনও পীযূষ খোলেননি, কিন্তু উনি কবে যে কি প্রস্তাব দিয়ে বসবেন, এখন সেই অপেক্ষায় দিন গুনছে কুহু। মনের অস্থিরতা কাটাতে গান করতে করতে ভিজে কাঁচের দিকে চোখ খুলে চাইল কুহু। সল্টলেকে ওর দু-কামরার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের দিকে গাড়িটা ঢিমে গতিতে এগোচ্ছিল। এলাকাটা একটু নির্জন হলেও সারাদিন দমবন্ধ করা কর্মজগতে ব্যস্ত থেকে, রাতে নিজের একাকীত্বের সঙ্গে নির্জনে সময় কাটানো যায়। তুমুল বৃষ্টি না হলেও, বেশ ঝিরঝির করে হচ্ছে। গাড়ি থেকে বেরোলে ভিজতে হবে। পরের মোড়ে বাঁক নিয়ে গলির মধ্যে ঢুকবে গাড়িটা। হঠাৎ কুহু গাড়িতে বসেই দেখল রাস্তার ধারে পিছন ফিরে বর্ষাতিতে ঢাকা রয়েছে সে। গাড়িটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও, কুহু লাফিয়ে উঠল,


-দাদা, গাড়ি থামান।

-কি হল ম্যাডাম? 

-আমি এখানেই নামব। কাল কোথাও বেরোনোর নেই। আপনি গাড়িটা গ্যারাজে নিয়ে চলে যান। কোথাও হঠাৎ করে বেরোতে হলে, আমি ক্যাব নিয়ে নেব। আপনার কাল ছুটি।

-আচ্ছা ম্যাডাম! 


কুহু বেরোতেই গাড়ির চালকও একলাফে বেরিয়ে ছাতা ধরলো কুহুর মাথায়। কুহু বলল,


-ছাতাটা আমাকে দিন। আপনি বেরিয়ে যান! 

-এইটুকু রাস্তা আবার হেঁটে ফিরবেন? একেবারে ফ্ল্যাটে ঢুকে যেতে পারতেন ম্যাডাম। একদম নির্জন রাস্তাটা। বৃষ্টি পড়ছে। রাতও অনেক...

-গুড নাইট দাদা। আসুন আপনি।

-ওকে ম্যাডাম! 


গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কুহু। একেবারে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে হনহনিয়ে ও এগোল আপাদমস্তক বর্ষাতিতে আবৃত ওই মানুষটার দিকে। ছাতাটা নিজের মাথায় ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ও। রাস্তার ভিজে ল্যাম্পপোস্টের ঝাপসা আলোয় কুহুর সুদীর্ঘ ছায়া ওই মানুষটার ছায়ার ওপর গিয়ে পড়ল। মৃদুস্বরে ডাক দিল কুহু, 


-কাজ হয়ে গেছে? 


কুহুর দিকে ফিরে দাঁড়াল বর্ষাতি। চাপাস্বরে বললো, 


-একদম খতম। স্পটডেড! 


বাঁকা হাসি হেসে উঠল কুহু। ফিসফিসিয়ে বললো,


-এখানে কথা বলা ঠিক হবে না। মরার খবরটা ছড়িয়ে পড়লে, টিকটিকি সবার আগে আমার পিছনেই পড়বে। বাকি সব কথা ফ্ল্যাটে গিয়ে...


পরদিন প্রত্যেকটি সংবাদমাধ্যমে চিৎকার করতে শুরু করলো অসংখ্য পরিচিত মুখ, 


"আপনারা সরাসরি সম্প্রচার দেখতে পাচ্ছেন, আমরা এখন রয়েছি সল্টলেকের সেই ফ্ল্যাটের নীচে, যেখানে গতকাল রাতেই খুন হয়েছেন অভিনেত্রী কুহেলী বর্মন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। কেরিয়ারের মধ্যগগনে থাকাকালীন কেন এভাবে খুন হতে হল তাকে? প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, শ্বাসরোধ করে তাকে খুন করা হয়েছে। নিজের ফ্ল্যাটের বেডরুম থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। দরজা ভাঙার কোনো চিহ্ন নেই, অর্থাৎ কোনো ফোর্স এন্ট্রি নেই। তবে কি আততায়ী অভিনেত্রীর বিশেষ পরিচিত? উঠে আসছে অনেক অনেক প্রশ্ন... সেই সঙ্গে আপনাদের আগেই জানিয়েছি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর, আজ শহরের বুকে একটি নয়, ঘটে গেছে দুটি অনাকাঙ্খিত মৃত্যু। এই দুটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কিনা, জানতে হলে চোখ রাখুন আমাদের চ্যানেলে... আমি পল্লবী সাহা, সারাদিন প্রতিদিন..." 


বিস্মৃত অতীতের অধ্যায়ে.... 


                                ।। এক ।।


বিছানার ওপর মা শুয়ে রয়েছে। জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। কাল রাতের সামান্য একটু ডাল আর ভাত বেঁচে গিয়েছিলো। খেতে বসে কুহু দেখলো, ডালটা একটু গন্ধ হয়ে গেছে। ভাত থেকেও কেমন যেন জল ছেড়ে গেছে। বাবা ভোরবেলা কিভাবে যে এই ভাতগুলো খেলো, কুহু ভেবেই পেলো না। দুদিন ধরেই মায়ের খুব জ্বর। গতকাল বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলো, মাকে দেখে গেছে। বিশেষ আশার কথা শোনাতে পারেনি। কাল সারারাত মায়ের মাথার কাছে বাবা বসেছিলো। জলপট্টি দিয়েছে, মাকে ওষুধ খাইয়েছে। কুহু পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়ছিল। আজ সকালে বাবাকে দোকানে বেরোতেই হবে, তাই বাবা নাকে-মুখে দুটো পচা ভাত গুঁজেই বেরিয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে কুহেলী। বাবা সজল বর্মন স্থানীয় বাজারে একটা জামাকাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কর্মরত। মা গৃহবধূ, যার বছরের বেশিরভাগ সময়টাই কাটে সরকারি হাসপাতালের বিছানায়, বা ঘরের বিছানায় শয্যাশায়ী অবস্থায়। মফঃস্বলের সামান্য খানিকটা জমির ওপর মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে, ঠাকুরদার তদারকিতে ইঁটের পর ইঁট গেঁথে যাওয়া দুটো ঘর সজলের একমাত্র সম্বল। ওই বসতবাড়িখানা ছাড়া কুহুর ঠাকুরদা আর তেমন কিছুই করে রেখে যেতে পারেননি। নিজেদের পেটের ভাতের যোগাড়, কুহুর পড়াশোনা, কুহুর জন্মের পর থেকেই কঠিন স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়া মায়ের ঘনঘন অসুস্থতা সামলাতে গিয়ে বাবা নাজেহাল হয়ে পড়ে। তাও মুখ বন্ধ করে ওই মানুষটা দিনরাত খেটে যায়। মুখে কোনো সাড়া পর্যন্ত নেই। একটা মানুষ বিছানার সঙ্গে মিশে থাকা নিজের অসুস্থ স্ত্রী-কে যে কিভাবে এতখানি ভালোবাসতে পারে, কুহু তার উত্তর জানে না। রুগ্ন মা তিনদিন যদি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে একটু রান্না করে, তারপরেই আবার সাতদিন বিছানা আঁকড়ে শুয়ে থাকে। কলঘরের শ্যাওলা ধরা মেঝেতে রক্তিম বন্যার প্রকোপ বাড়তেই কুহু বুঝতে পারে, আবার মা বিছানায় আশ্রয় নেবে। মায়ের এই দীর্ঘকালীন অসুস্থতার জন্যই, বড় তাড়াতাড়ি সংসারী হয়ে উঠেছিল কুহু। শৈশব পেরোতে না পেরোতে পেটের জ্বালায় ও পা রেখেছিল রান্নাঘরে। কলমের পাশাপাশি হাতে তুলে নিয়েছিল খুন্তিটাও। তিনজনের ক্ষুদ্র সংসার নিতান্ত সচ্ছল না হলেও, কুহুর কর্মঠ বাবা কোনোদিন সামান্যতম অভাবটুকুও কুহুকে বুঝতে দেননি। আজ বাবা দোকানে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাশের বাড়ির কাকিমাকে ডেকে আনলো কুহু। মায়ের জ্বরটা এখন একটু কম হলেও, শরীর বড় দুর্বল। কাকিমা বরাবরই ওদের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন। প্রয়োজনে কুহুকে ডেকে দু'গ্রাস গরম ভাতও নিজের হাতে খাইয়ে দেন। কাকিমা মায়ের মাথার কাছে বসে-বসে বলছিলো, 


-পরীক্ষাটা ভালো করে দিস কুহু। মায়ের চিন্তা করতে হবে না। আমি বৌদিকে এসে এসে দেখে যাবো। দুপুরে রান্নাও করে দিয়ে যাবো। তুই শুধু মন দিয়ে পরীক্ষাটা দিস! এদিকের চিন্তা তোকে করতে হবে না। 


সাদা ব্লাউজের ওপর দিয়ে নীল শাড়ির আঁচলটা বুকের ওপর ফেলে, সেফটিপিনটা দাঁতের ফাঁকে চেপে ধরেছিলো কুহু। ওটা দিয়ে আঁচল আটকে চুলে বেণী করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠলো। যৌবন ছুঁয়েছে ওকে। তবে ওর দেহে কুহুর কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই। সবটাই যেন ওর মা! ও মাতৃমুখী জন্ম থেকেই। এখন আয়নার সামনে দাঁড়ালে, ওর প্রায়ই মনে হয়, কুহু নয়, যেন ওর নিজের মা এসে দাঁড়িয়েছে আয়নার সামনে। নীরোগ মা! হাসিখুশি মা! চোখের জল চেপে বিছানার কাছে এসে কুহু মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,


-ও মা! একটু তাকাও। এই যে আমি! এইদিকে। আমি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। কাকিমা আজ রান্না করে দেবে বলেছে। তুমি বিছানা থেকে একদম উঠবে না। আমি তোমার মাথার কাছে জলের বোতল ভরে রেখে দিয়েছি। বেডপ্যান আছে। দরকার হলে ব্যবহার করবে। আমি এসে পরিষ্কার করবো। তুমি একা একা কলঘরে যাবে না মা! 


বিছানা থেকে একটু উঠে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ফেললেন কুহুর মা। একটু আগেই কুহু নিজের মধ্যে দেখেছে মায়ের নীরোগ প্রতিবিম্ব। মাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে খুব কষ্ট হয় ওর। কিন্তু পরীক্ষার আগে একদম কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো না। আজই শেষ পরীক্ষা। কোনোমতে দিয়ে বাড়িতে ঢুকে সারাদিন মায়ের কাছে বসে থাকতে পারবে। কয়েকদিন আর পড়াশোনার বড় বিশেষ চাপ নেই। মায়ের মাথার চুলগুলো উঠে একেবারে টাক পড়ে গেছে। রোগিনীর কাঁধ থেকে নেমে আসা মলিন রংচটা নাইটিটা তুলে মায়ের মাথাটা আঁচড়ে, গুটিকয় চুল পেঁচিয়ে বেঁধে দিলো কুহু। চিরুনি দিয়ে সিঁদুরের কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে চওড়া করে পরিয়ে দিলো মায়ের সিঁথিতে। তারপর মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বললো,


-এই তো! কত সুন্দর দেখতে তুমি!


গাল ভেঙে বসে যাওয়া রোগিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো নিজের মেয়ের দিকে। মায়ের সামনেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলার ভয়ে 'মা আসছি' বলে পালানোর চেষ্টা করলো কুহু। অন্যদিনের মতো ক্ষীণ নিস্তেজ কণ্ঠে মা সেদিন আর বললো না, "কুহু ভালো করে পরীক্ষা দিস। সাবধানে যাস মা!" জানালার বাইরে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু শুনতে পেলো না কুহু। বাঁ হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও আর অপেক্ষা করতে পারলো না। এগারোটা বাজতে মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। চোখের জল মুছে সাইকেলটা নিয়ে কুহু দ্রুতগতিতে স্কুলের দিকে এগোলো। স্কুলে পৌঁছে মাথা নীচু করে সাইকেল লক করার সময় একটা উড়ন্ত চাঁটি এসে পড়লো কুহুর মাথায়... 


-উফ!

-কি উফ? কতবার বেল বাজালাম, শুনতে পাসনি? কালা নাকি তুই? ওই! কিরে কুহু? মুখটা ওইরকম করে আছিস কেন? 


একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ছাত্র-ছাত্রী একত্রে পড়ার সুবাদে বালিকা বিদ্যালয় ছেড়ে এই স্কুলে আসার পর কুহুর সঙ্গে পরিচয় হয় সীমান্ত মহাপাত্র নামক এই সুবোধ ছাত্রের। কুহুর বেশিরভাগ বন্ধুরা আগের স্কুলেই রয়ে গেছে। তাই এই স্কুলে ওর বন্ধু সংখ্যা খুবই কম। হাতেগোনা কয়েক জনের সঙ্গে সখ্যতা থাকলেও, হৃদ্যতা বেশি একমাত্র সীমান্তর সঙ্গেই। এই স্কুল সীমান্তর কাছে নতুন হলেও, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কুহুর সঙ্গে ওর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। বারকয়েক খাতাপত্র আদানপ্রদানের জন্য সীমান্তর বাড়িতে এখন কুহুর অবাধ যাতায়াত। সীমান্তর বাবা একজন নামজাদা উকিল। রাশভারী বাবার সঙ্গে কথা বলতে সীমান্ত নিজেই বড় ভয় পায়। কুহু তো আজ পর্যন্ত কাকুর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। সেই তুলনায় সীমান্তর মা বড় অমায়িক-হাসিখুশি, দরাজ মনের একজন মানুষ। স্কুলে পৌঁছে সাইকেলের চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে কুহুর মুখের দিকে এক নজর দেখেই সীমান্ত বুঝলো, ওর মন আজ ভীষণ খারাপ। সীমান্তর প্রশ্নের উত্তর কুহু বললো,


-মায়ের শরীরটা আজ একটু বেশিই খারাপ রে সন্তু! কাকিমাকে বসিয়ে এসেছি। কয়েক ঘন্টার পরীক্ষাও যেন কয়েক যুগ মনে হচ্ছে। পরীক্ষা না থাকলে, আজ আমি বাড়ি থেকে বেরোতামই না। কী যে পরীক্ষা দেবো, সে একমাত্র ভগবানই জানে! 

-ঠিক আছে! কাকিমা সুস্থ হয়ে যাবে। সারা বছরই তো কাকিমার কমবেশি শরীর খারাপ থাকে। তুই এক্সামে ফোকাস কর। 


ঘন্টার শব্দে কেঁপে উঠলো দুজনেই। সীমান্ত কুহুর হাতটা চেপে ধরে বললো,


-চল-চল! সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠতে হবে। ফার্স্ট বেল পড়ে গেছে। 


শাড়ির কুঁচিটা কোনোরকমে সামলে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেণী দুলিয়ে সীমান্তর সঙ্গে স্কুলের ভিতরদিকে ছুটলো কুহু। 


                                  ।। দুই ।। 


পরীক্ষার তখন প্রায় শেষের দিকে। অন্তিম ঘন্টা পড়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই কাকু এসে দাঁড়িয়েছে দরজার বাইরে। কুহুর সারা শরীর ভয়ে কাঁপছে। প্রধান শিক্ষক পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে ভিতরে এসে কুহুর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,


-তোমার কি লেখা হয়ে গেছে?

-হ্যাঁ স্যার! হয়েই তো এসেছে। কেন?

-ঠিক আছে। খাতা জমা দিয়ে বাড়ি চলে যাও।

-কেন স্যার? সময়ের আগেই.... আর তো একটুখানি... 

-সুতো ঠিক করে বেঁধেছ তো? দাও, খাতা জমা দিয়ে দাও। বাড়ি যাও! 


বেরোনোর আগে একবার পিছনদিকে চাইলো কুহু। সীমান্ত লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। অস্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিলো ওর দিকেই। কুহু আর কিছু বললো না। মাথা নামিয়ে বেরিয়ে গেলো। কুহু বেরোতেই সীমান্ত ডেকে উঠলো,


-স্যার!

-বলো? তোমার আবার কি সমস্যা?

-হয়ে গেছে!

-পেজ চাইলে যে? 

-লাগবে না। আপনি আমার খাতা জমা নিয়ে নিন। 


খাতা জমা দেবার পরই ডাক পড়লো পিছন থেকে। 


-এই ছেলে? এই পৃষ্ঠায় নাম, রোল নম্বর লিখিসনি? 

-সরি স্যার! ভুলে গেছি। 

-আগে লেখ! 


বাড়তি পৃষ্ঠায় নাম, রোল নম্বর লিখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সীমান্ত। সিঁড়ি ভেঙে নীচে যখন ও পৌঁছলো, তখন প্রতিবেশী কাকুর বাইকে চেপে কুহু বেরিয়ে গেছে। পিঠে ব্যাগ নিয়ে সাইকেলটা টেনে বের করে সীমান্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাডেল করতে শুরু করলো। 


রাস্তার মধ্যেই কাঁদতে শুরু করেছিল কুহু। বাড়িতে পৌঁছে ও দেখলো, মায়ের মাথার কাছে বাবা একেবারে বোবা হয়ে বসে আছে। মায়ের শীর্ণ দেহটা বিছানার সঙ্গে মিশে রয়েছে। কাকিমা কাঁদতে-কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে জড়িয়ে ধরলো কুহুকে। চিৎকার করে মড়াকান্না কেঁদে উঠলো কাকিমা,


-ও কুহু! তোর মা চলে গেলো রে! তুই স্কুলে বেরোনোর পরই সব ছেড়ে চলে গেলো রে! যাওয়ার আগে তোকে কত খুঁজলো... 


কাঁদতে ভুলে গেলো কুহু। তুলসীমঞ্চের পাশেই বসে পড়লো ও। বারান্দায় একটা খাটিয়ায় মাকে শুইয়ে রেখেছে। মামারবাড়ি থেকেও জনাকয়েক মানুষ বুঝি এসে গেছে। কিচ্ছু মাথায় ঢুকলো না কুহুর। ও তুলসী গাছটার দিকে চেয়ে দেখলো, গাছটা একেবারে শুকিয়ে মরে গেছে। একটাও সবুজ পাতা নেই। মা ঠাকুর পুজো দিতে পারে না। সেটাও কুহুর দায়িত্ব ছিল। বেশ কয়েকদিন পড়াশোনার চাপে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ঠাকুরকে জল-বাতাসা দিয়েই দায় সেরেছিলো কুহু। তুলসীকে আর জল-ফুল দেওয়া হয়নি। তুলসীতলায় ধূপ-দীপটুকুও দেখানো হয়নি। আজ পরীক্ষার পর এদিকে চোখ পড়তেই কুহু দেখলো প্রাণহীন শুকনো গাছটাকে। টব থেকে শুকনো গাছটাকে একটানে তুলে, কুহু ওটাকে উঠোনের মধ্যিখানে ছুঁড়ে ফেললো। চুপ করে বসে রইলো বাইরেই। আর ঘরে ঢুকলো না। তক্ষুণি সাইকেল নিয়ে ঘেমেনেয়ে অস্থির হয়ে ওর বাড়ির সামনে পৌঁছলো সীমান্ত। পিছন ঘুরে বসেছিলো কুহু। ঘরের ভিতরে একঘেয়ে গোঙানির শব্দ। কাকিমা কেঁদেই চলেছে অনবরত। মৃত্যু পরবর্তী বাড়ির পরিবেশ থমথমে। সীমান্ত এসে হাত রাখলো কুহুর কাঁধে। ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালো কুহু। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না সীমান্ত। কুহু একটা শব্দও খরচ করলো না। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও বেরোলো না। দুই কিশোর-কিশোরী পরস্পরের সঙ্গে নিভৃত দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমেই খুঁজে নিলো সান্ত্বনা ও আশ্রয়। কুহুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শক্ত করে ধরলো সীমান্ত.... 


                               ।। তিন ।। 


মা মারা যাওয়ার পর থেকেই কুহুর বাবার মধ্যে এক নিদারুণ পরিবর্তন এসে গেছে। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে সজল। অভাবের সংসারে খাবার নষ্ট হলে বড় কষ্ট হয়। পচা ভাত হাঁড়ি উল্টে নর্দমায় ফেলে দিতে খুব খারাপ লাগে কুহুর। বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতেই মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে। গত কয়েকদিন রাতে তো বাড়িতে ফেরেও নি। ঘরের প্রতি আর কোনো টান নেই সজলের। আজ মাঝরাতে কাকুর সঙ্গে গিয়ে মদের দোকানের সামনে থেকে অচৈতন্য বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে কুহু। কাকু নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর দরজায় খিল তুলে দিয়েছে। একটু পরে বাবার জ্ঞান ফিরতে, কুহুকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে-করতে কেঁদে ফেলে সজল। রান্নাঘরের এককোণে বসে কুহু নীরবে কাঁদতে শুরু করে। ও নিজেও ওই রাতে ভাত মুখে তুলতে পারলো না। মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবা ওকেই দায়ী করছে। ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মা এক কঠিন স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হয়েছিলো। বাবার ধারণা ওই রোগের কারণেই মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাই এই মৃত্যুর সকল দায় কুহুর একার। ওকে জন্ম দেওয়াটাই সজলের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। কাঁদতে-কাঁদতে কুহু কখন যে রান্নাঘরের সিমেন্টের মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিলো, সে ওর নিজেরও মনে নেই। ঘুম ভাঙতেই ও ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। ঘরে আলো জ্বলছে। বাবা খাটের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। খিদেয় কারণে মাথা ঘুরে উঠলো কুহুর। কিন্তু বাবাও তো রাতে না খেয়েই রয়েছে। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়িয়ে একটা থালায় ভাত, একটু ডাল আর সবজি নিয়ে ও বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বারকয়েক ধাক্কা দিতেই সজলের ঘুম ভেঙে গেলো। কুহু খাওয়ার কথা বলতেই মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো সজল। কুহু ধীরকণ্ঠে বললো,


-তুমি না খেলে মা ফিরবে বাবা? শরীরটা দেখো নিজের। রোজ রোজ খাবারগুলো নষ্ট হয়। আমি একা কত খাবো? বাবা... 


কোনো উত্তর আসে না উপুড় হয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকা দেহটা থেকে। ধরা কণ্ঠে কুহু বলে ওঠে,


-খেয়ে নাও না বাবা! আমিও কিছু খাইনি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। তুমি খাওয়ার পর আমি খাবো। একটু খাও! 


থালাটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে বাবাকে টেনে তুললো কুহু। ওকে দেখেই সজলের চোখে মুখে একরাশ বিরক্তির উদ্রেক হলো। কুহু ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। কোনোমতে বললো,


-আমি চাইনি বাবা, আমার জন্য মায়ের এইরকম একটা অসুখ হোক। আমি তো আসতেই চাইনি পৃথিবীতে। আমার দোষ কোথায় বলো?! মা চলে গেছে, তুমিও এইরকম করলে আমি কি করবো বলো তো? তোমার কিছু হয়ে গেলে, আমি কোথায় যাবো বাবা? সারাদিন ধরে এত পরিশ্রম করো, এদিকে খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছো। এভাবে বাঁচা যায়? একটু খেয়ে নাও না বাবা! 


মদের বিকট গন্ধে বমি পেয়ে যাচ্ছিলো কুহুর। পরিশ্রান্ত বাবার গায়ে ঘামের উৎকট গন্ধ। জামাটা একেবারে ভিজে গেছে ঘামে। তাও কুহু বাবাকে ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদেই চললো। মেয়ের মাথায় একটা হাত রাখলো সজল। সামান্য একটু স্নেহের ছোঁয়ায় কুহু বাবার বুক থেকে মুখ তুলে বড়-বড় দুটো চোখ মেলে চাইলো সজলের দিকে। সজল দেখলো, কুহুর ভাসা-ভাসা দুটো চোখে জল টলটল করছে। অবিকল ইন্দুর মুখ কেটে বসানো রয়েছে। বিয়ের আগে ইন্দুকে সজল যখন প্রথমবার দেখেছিলো, তখন ঠিক এইরকমই দেখতে ছিল ওকে। ভরাট-নিষ্পাপ একটা মুখ। মাথায় একঢাল চুল আর বড় বড় দুটো চোখ। নাকের মাঝে ছোট্ট একটা ঝুটো মুক্তোর নথ ছিলো। ওই নথ নেড়ে ওর চোখদুটো পাকিয়ে শাসনটা সজল খুব উপভোগ করতো। আবার যখন ওই দুটো চোখে অভিমানের শ্রাবণ নেমে আসতো, তখন সজল যত্ন করে নিজের হাতে মুছিয়ে দিতো ইন্দুর ভরাট নরম তুলতুলে দুটো গাল। নিঃশব্দে কেঁদে কুহুর গালে হাত রাখলো সজল। রগচটা বাবার কাছে সামান্য একটু স্নেহের প্রশ্রয় পেয়ে কুহু ক্ষীণস্বরে ডাকলো,


-বাবা! 


কুহুর গালে হাত রাখা অবস্থাতেই অতর্কিতে ওর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখলো সজল। মদের গন্ধে কুহুর গা গুলিয়ে উঠলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কেঁপে উঠে ও বাবাকে ছেড়ে ছিটকে সরে গেলো খাটের এককোণে। সজল কুহুর হাত ধরে টেনে ওকে শুইয়ে দিলো মলিন বিছানায়। অনুন্নত বুকের ওপর বাবার স্পর্শ অনুভব করেই লজ্জায় আর্তনাদ করে উঠলো কুহু! 


-বাবা! ছেড়ে দাও। আমি আর কোনোদিনও তোমার সামনে আসবো না। বাবা... 


কুহুর একঢাল চুলের মধ্যে হস্ত সঞ্চালন করে ওকে আদর করতে শুরু করলো সজল। ঘেন্নায় কুহু হামাগুড়ি দিয়ে খাট থেকে নামার চেষ্টা করলে, সজোরে একটা থাপ্পড় এসে পড়লো ওর গালে। হঠাৎ আঘাতে মাথা ঘুরে কুহুর পৃথিবী দুলে উঠলো। ও বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে গেলো। মুখের ওপর চেপে বসলো সজলের বলিষ্ঠ হাত। জন্মদাতার দীর্ঘকালীন সুপ্ত কামজ্বালা মেটানোর পর ছিন্নভিন্ন অবস্থায় বিছানায় পড়ে রইলো কুহু। বাবা তখনও ওর উলঙ্গ দেহটাকে তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে চলেছে। কুহুর অনাবৃত দেহের ফুটে ওঠা যৌবনচিহ্নগুলো নিয়ে সজল মেতে উঠেছে কামলীলায়। কুহুর দুটো চোখ একেবারে শুষ্ক। দেহ অবশ। বাবার নগ্ন দেহ ও উত্থিত পুরুষাঙ্গ চোখে পড়ামাত্র প্রবল ঘৃণায় মুখটা ফিরিয়ে নিলো কুহু। মানসিক যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে গেছে ও। চিৎকার করে কাঁদতে গেলেও গলা থেকে কেবল গোঙানি বেরিয়ে আসছে। ওর দেহের একান্ত গোপনীয় স্থানে তখনও বাবার অবাধ বিচরণ। টেবিলের ওপর ভাত জুড়িয়ে গেলো। ওই রাতেই কুহুর পেটের জ্বালা মরে গেলো চিরতরে। সজল তখন কুহুর উরুসন্ধিতে ঈষদুষ্ণ জিভ স্পর্শ করে তীব্র লেহনক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের কাম উত্তেজনা প্রশমনে সচেষ্ট.... 


                                 ।। চার ।। 


-কথা বলছিস না কেন? ওই কুহু! 


টিউশন থেকে বেরিয়ে সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে সীমান্তর সঙ্গে বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটেই ফিরছিলো কুহু। নিজের বাড়িতেই ওর প্রতিটা রাত এখন বিভীষিকার মতো কাটে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কানের সামনে সীমান্ত অনর্গল বকবক করে যাচ্ছে। কিন্তু কুহু সেসব কিছুই কানে তুলছে না। ওর সারা গায়ে তখন বিষের মতো ব্যথা। বোধহয় কাঁপুনি দিয়ে জ্বরও আসছে। গত রাতে বাবাকে সঙ্গ দিতে আপত্তি করায় বাবা ওকে এত মার মেরেছে, উরু ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। চুড়িদারটা তুললেই শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন চোখে পড়বে। ভোরবেলা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলো কুহু। এই লজ্জার কথা ও কাউকে বলতে পারে না। ওই মানুষটাকে এখন বাবা বলে ডাকতেও লজ্জা করে। নরকের কীটেরও অধম ওই জানোয়ারটা। কিন্তু বাবার কথার অবাধ্য হলেই, বাবা দিনের পর দিন খেতে দেয় না। বেল্ট দিয়ে বেধড়ক মার মারে। অবলা জন্তুর মতো পড়ে-পড়ে মার খায় ও। পৃথিবীর যত রাগ সব সজল উগড়ে দেয় কুহুর ওপরেই। বাবার কথামতো না চললে স্কুলটাও ছাড়িয়ে দেবে বলেছে। গত কয়েকদিন ধরে সন্ধ্যের পর বাড়িতে কতগুলো লোক আসছে। ওই লোকগুলোও বাবার মতোই আকণ্ঠ মদ খেয়ে থাকে। লোকগুলোর হিংস্র লোলুপ দৃষ্টিকে ভয় পায় কুহু। বাবার অবাধ্য হতেও ভয় পায় ও। বাবা খেতে না দিলে, পড়াশোনা করতে না দিলে, বাড়ি থেকে বের করে দিলে, এতবড় পৃথিবীতে ও একা-একা কোথায় যাবে?! আজ কুহু একটা ফুলহাতা চুড়িদার পরে টিউশনে এসেছে। ওড়না দিয়ে পিঠ-বুক ভালোভাবে ঢেকে রেখেছে। কাল রাতের বেল্টের মারের দগদগে দাগটা যেন কারোর চোখে না পড়ে,তার জন্যই এত লুকোচুরি। হঠাৎই একটা হ্যাঁচকা টানে পাশের মানুষটার অস্তিত্ব সম্পর্কে হুঁশ ফিরলো কুহুর...


-কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? সন্তু? 

-আয় এদিকে। 


রাস্তার এককোণে দুটো সাইকেল পড়ে রইলো। কুহুর হাত ধরে সীমান্ত ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসলো লাল সিমেন্টে বাঁধানো ঘাটের ওপর। সামনেই সুবিশাল পুকুর। শ্যাওলা আর কচুরিপানায় গোটা পুকুরটাই সবুজ হয়ে রয়েছে। দূরে একটা গাছের ডাল একেবারে নুইয়ে জলে এসে পড়েছে। কুহুর কাঁধ থেকে ব্যাগটা সিঁড়ির ওপর নামিয়ে রেখে, সীমান্ত ওর পাশে বসে ওকে জিজ্ঞেস করলো,


-তোর কি হয়েছে? আমাকে বল কুহু! দিদি পড়া ধরলে পড়া পারছিস না। আমি ডাকলেও আমার বাড়িতে আসছিস না। প্রায় দিনই স্কুল কামাই করছিস। কাকিমা চলে গিয়ে তোর জীবনের অনেকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে গেছে জানি, কিন্তু তাই বলে তুই নিজের জীবন, নিজের পড়াশোনা একেবারে শেষ করে দিলে তো... 


নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো কুহেলী। এ এমনই লজ্জার কথা, ও কাউকে বলতেও পারে না। গতরাতে বাবার তুমুল শারীরিক অত্যাচারের পর, আজ সকালের পর থেকে রক্তস্রোতে ভেসে যাচ্ছে ওর যোনিপথ। তীব্র যন্ত্রণায় ও ঘরের কাজকর্মও করতে পারছে না। অন্যদিন বাবা ঠিকমতো খেতে দেয় না, মারধর করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুহুর পেটে খিদের আগুন জ্বলে। আজ সারাটা দিন কিচ্ছু খায়নি কুহু। মাকে মনে করে শুধু কেঁদেই চলেছে। প্রায় দেড় মাস যাবৎ সজল কর্তৃক এইরকম অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার সহ্য করার পর, হঠাৎই কুহু একদিন খেয়াল করে দেখলো, নির্দিষ্ট সময়ে মাসিকের দেখা নেই। ভয়ে-ভয়ে বাবাকে সে কথা জানাতেই, বাবা কিসব ওষুধ এনে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। তারপরেও গতরাতে নৃশংস সঙ্গমরূপী ধর্ষণের পর, আজ ভোরবেলা থেকে অতিরিক্ত রক্তপাতে প্রায় আধমরা হয়ে গেছে কুহু। দুপুর পর্যন্ত ব্যথায় প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলো ও। কিন্তু বিকেলের দিকে ও ঠিক করে, আজ পড়তে যাবেই। বাড়িতে থাকলেই ওই জানোয়ারটা সন্ধ্যের পর বাড়িতে আসবে। আবার জবরদস্তি শুরু করবে। তার চেয়ে বাড়িতে না থাকাই ভালো। যতক্ষণ এই বাড়ির বাইরে থাকা যায়, ততক্ষণই মুক্তি! যদি বাবা মদ খেয়ে এসে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, তবে আজকের মতো ছাড় পেয়ে যাবে কুহু। সীমান্তর শত প্রশ্নেও কুহু মুখ খুলতে পারলো না। মূক নারীর মতো কেবল কেঁদেই চললো। রাস্তার বড় আলোগুলো জ্বলে গেছে। ওই নরম হলদেটে আলো গাছগাছালি ভেদ করে কুহুর শুকনো মুখের ওপর এসে পড়েছে। ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে সীমান্ত বললো,

-তোর কি হয়েছে? বলবি না আমায়? 


তীব্র কান্না আটকাতে না পেরে কুহু সশব্দে কেঁদে বলে ফেললো,


-আমিও মায়ের কাছে চলে যেতে চাই সন্তু। আর বাঁচতে চাই না। মরে যেতে চাই।

-এইরকম বলতে নেই কুহু। তুই এত ভেঙে পড়লে হয়! কাকুকে তো তোকেই দেখতে হবে। তাই না? কাকু তোর জন্য এত পরিশ্রম করে। তোর পড়াশোনা.... 

-আমি মরে যেতে চাই। 

-আর আমাদের বন্ধুত্বটা? 


চুপ করে গেলো কুহু।


-আমাদের মধ্যে তো খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব আছে। সেটাকেও ভুলে যাবি তুই? সব ভুলে গিয়ে মরার কথা বলবি? আমাকেও ভুলে যাবি?

-না!

-তবে? 

-আমি আর পারছি না সন্তু।

-কি হয়েছে তোর?

-কিছু হয়নি। মায়ের জন্য কষ্ট হয় খুব।

-তোর জ্বর হয়েছে?

-ওই একটু! 

-আমাদের বাড়িতে চল। তোকে দারুণ একটা জিনিস রান্না করে খাওয়াবো। এক্সপেরিমেন্ট করতে করতে সদ্য শিখেছি। মাকেও শিখিয়ে দিয়েছি। 

-রান্না করতে তোর এত ভালোলাগে সন্তু?

-দুর্দান্ত লাগে। ছুটির দিনে মাকে ঠেলে সরিয়ে আমি রান্নাঘরে ঢুকে যাই। চল চল, ওঠ!

-আজ না রে। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। এরপর বাড়ি ঢুকতে দেরি হলে বাবা খুব মারবে। বাবা হয়তো এতক্ষণে বাড়ি এসে ঘুমিয়েও পড়েছে। 

-কাকু তোকে মারে নাকি? আগে কোনোদিন বলিসনি তো!

-নানা, ওই আর কি! খুব বকবে। মারে না। উঠি আমি। 

-তুই ঠিক বলছিস তো কুহু, তোর কিছু হয়নি?

-সত্যিই রে, কিচ্ছু হয়নি। 

-কাল স্কুলে যাবি তো?

-হ্যাঁ। 

-কিছু খাবি কুহু?

-মোমো খাওয়াবি সন্তু? আমার খিদে পেয়েছে।

-চল! আগে বলবি তো, তোর খিদে পেয়েছে!


প্যাডেল করতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো কুহুর। তলপেটে বড় ব্যথা। কোমরের ব্যথায় পা দুটো একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই সাইকেল হাঁটিয়ে ওরা এগিয়ে গেলো বড় রাস্তার দিকে...


(চলবে.....)


ছবি : সংগৃহীত

শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১

মুহূর্তেরা বন্দী প্রিবুকিং














 



শুরু হয়ে গেলো বহু প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্ত। শুরু হল "মুহূর্তেরা বন্দী"-র প্রিবুকিং।

মুদ্রিত  মূল্য-৪০০

প্রিবুকিং স্পেশাল ২৫ শতাংশ  ছাড় পাবেন পাঠকরা প্রিবুক করলে, সাথে থাকছে বিশেষ বুকমার্ক ও সই।

পাঠকদের সুবিধার্থে ওয়েবসাইট ও হোয়াটসঅ্যাপ দুই মাধ্যমেই প্রিবুক করা যাবে—( পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে প্রিবুক করতে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমেই প্রিবুক করতে হবে)

হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বুক করতে হোয়াটসঅ্যাপ করুন—7439112665

ওয়েবসাইটে প্রিবুক করতে 

১।  লিঙ্ক এ ক্লিক করুন।  Click Here

২।আপনার পিনকোডটি দিন সার্ভিস অ্যাভেলেবিলিটি যাচাই করতে

৩। Buy অপশনে ক্লিক করুন

৪।  নাম ঠিকানা যথাযথ ভাবে পূরণ করুন ও পেমেন্টের মাধ্যমে প্রিবুকিং নিশ্চিত করুন।

** বুকিং করতে যে কোনো সমস্যাতে হোয়াটসঅ্যাপ করুন—7439112665

রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১










 


                    

 প্রি-বুক করতে  ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপ করুন এই নম্বরে: 9433320612



অনলাইন বুক করতে পারেন পালকের Website থেকে  - Click here











শনিবার, ৫ জুন, ২০২১

মুহূর্তেরা বন্দী (চতুর্থ পর্ব)





মুহূর্তেরা বন্দী


সাথী দাস


চতুর্থ পর্ব




-কি বললেন আপনি? ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড! আপনি জানেন আপনি কাকে কি বলছেন? কার সম্পর্কে কি বলছেন? আপনি চেনেন ওনাকে?
 
একটু আগেও একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে সোফাতে বসেছিলো উজ্জয়িনী। এখন ঘুরে-ঘুরে থোকা-থোকা করে সাজানো লাল বেলুনগুলো দেখছিল। উজ্জয়িনীকে একবার ভালো করে দেখে ম্যানেজার বললেন,

-না স্যার! আমি ওনাকে চিনি না। চেনার দরকারও নেই। উনি আমাদের একজন সম্মানীয় অতিথি, ওটাই ওনার একমাত্র পরিচয়। কিন্তু কলাম ফাঁকা রাখা যাবে না। কিছু লিখতেই হবে। ওনাকেও চেক ইন টাইম লিখে সই করতেই হবে। 
-আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমাকে শাসাচ্ছেন? আমাকে অর্ডার করছেন আপনি? 
-না স্যার! রিকুয়েস্ট করছি। প্লিজ!
-দেখুন উনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। শি ইজ হাংরি! আমাদের দুজনের ব্রেকফাস্ট রুমে পাঠান। আর এক্ষুণি আমার রুমের চাবি দিন। আমি সই করে দিয়েছি। 
-স্যার আপনি কি বলছেন, আপনি জানেন? একটা জলজ্যান্ত গোটা মানুষ এই হোটেলে থাকবেন, খাবেন, আর তার কোনো রেকর্ডই থাকবে না! কেউ জানতে চাইলে....
-কেউ জানতে চাইবে না। আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না উনি এভাবে আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করছেন। এসব বাইরে জানাজানি হলে ওনার ইমেজ নষ্ট হবে। আপনি না চিনলে কি হবে, মিডিয়ায় উনি একজন পরিচিত মুখ। আপনার মাথায় কি আছে বলুন তো? পাপা তো আমার কাছে মাই ডিয়ার! আমি তাকেই জানাতে বারণ করছি, আর অন্য যে কেউ জানতে জানলে আমি তাকে বলে দেবো?
-ইচ্ছাকৃতভাবে না হোক, চাপে পড়লে অনেক কিছু বলতে হয় স্যার! আপনার বয়স অনেক কম। অভিজ্ঞতাও কম। আমার ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স কিন্তু অন্য কথা বলছে। উনি এখানে এসেছেন, আমাদের পক্ষ থেকে আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি হবে না। উনি থাকবেন, আনন্দ করবেন, ছবি তুলবেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করবেন। সব ঠিক আছে। কিন্তু এরপর উনি চেক আউটের পর যদি ভগবান না করুন রাস্তাঘাটে কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়, বা উনি মার্ডার হয়ে যান, তখন ওনার ছবিগুলো দেখে সবার আগে পুলিশ এসে হোটেল কর্তৃপক্ষকেই চেপে ধরবে স্যার। আমরা তখন পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেবো ওনার চেক ইন আর চেক আউটের টাইম, সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ। ব্যাস আমাদের দায় শেষ। উনি হোটেলের বাইরে পা রাখার পর ওনার সঙ্গে যা খুশি হোক, আমাদের আর জানার দরকার নেই। এই কারণেই তো রেকর্ড রাখা হয় স্যার। আমি এই ধরনের কেস আগে ডিল করেছি। কোনোরকম ঝামেলা হলে হোটেলের ম্যানেজার বলে, পুলিশ সবার আগে আমার জামার কলার টেনে ধরবে। তারপর একে-একে আপনি, বস! আমি আপনাকে অর্ডার করছি না স্যার। আমি শুধু রিকুয়েস্ট করছি, আর সেই সঙ্গে আমার ডিউটি করছি! যার জন্য আপনারা আমাকে মাস গেলে মোটা টাকা দেন। এই হোটেলের, বসের, আপনার সিকিউরিটি আমার দায়িত্ব। ওনাকে সই করতেই হবে। 
-দেখুন, আজ এখানে একটা প্রোগ্রাম আছে। আমার সঙ্গে একজন গেস্ট রয়েছেন। আপনার কথাবার্তা শুনে আমার মাথায় আগুন জ্বলছে! অহেতুক ঝামেলা বাড়াবেন না। চাবি দিন!
-তাহলে আগে আপনার পাপাকে একটা ফোন করুন!
-হোয়াট! পাপাকে কি বলবো আমি?

ঝামেলা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সৌজন্যর গলার স্বর সপ্তমে চড়ছিল। চমকে উঠে সুবিশাল হলের অন্যপ্রান্ত থেকে উজ্জয়িনী ফিরে চাইলো। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ম্যানেজারের দিকে চেয়ে গলা খাদে নামিয়ে বললো,

-নিলয়দা, ছেড়ে দিন না! উনি আমাদের স্যার....ওনাকে এত কথা....
-না উনি ভুল করছেন। কি বয়স ওনার? ব্যবসার তেমন কিছু বোঝেন উনি? ওনার গেস্ট, ওনার পার্সোনাল স্পেস, উনি কিভাবে সময় কাটাবেন সেটা ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। উনি কোনো রেকর্ড রাখবেন না সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু ওপরতলার কাউকে তো জানিয়ে রাখুক। ওনার পাপাকে অন্তত বিষয়টা একটু বলুক। পাপাকে সব খুলে বলতে না পারলে, বন্ধুর সঙ্গে আছে বলুক। পরিচিত কারোর সঙ্গে আছে বলুক। কিছু একটু বলে রাখুক। তাতে আমার পিঠটা বাঁচে! এটা আমার ওয়ার্কপ্লেস, আমার ওয়ার্কিং আওয়ার। এর মধ্যে হোটেলের রুমের ভিতর কিছু হলে, পুরো চাপটা আমার একার ওপর এসে পড়বে। চাকরী বাঁচানো পরের কথা, এসব কেসে জীবন নিয়ে টানাটানি হয়, মান-সম্মান খুইয়ে জেলের ভাত খেয়ে আসতে হয়, তুই জানিস সেসব! আমার একটা পরিবার আছে। বাড়িতে ছোট একটা বাচ্চা আছে। আমি ফেঁসে গেলে, এসব হ্যাপা কে সামলাবে? তুই চুপ করে থাক একদম! 

সাংঘাতিক ধমক খেয়ে চুপ করে গেল অল্পবয়সী মেয়েটি। সৌজন্য আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। ধমকে উঠলো,

-ইউ আর ফায়ার্ড! 

চোখ নামিয়ে নিলয় বললো,

-সরি স্যার! আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে আপনার পাপার সই ছিলো। উনি আমার কোয়ালিফিকেশন, প্রিভিয়াস ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স, ডেডিকেশন, বিশ্বাসযোগ্যতা দেখেই আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন। উনি নিজে টার্মিনেশন লেটার না দিলে তো, শুধুমাত্র আপনার কথায় কিছু হবে না। আমি বসকে ফোন করছি। উনি বললে আমি নিজেই রিজাইন...
-এই না! পাপাকে কি বলবেন আপনি?

-সৌজন্য!! 

রিসেপশনের সকলে একসঙ্গে উজ্জয়িনীর দিকে ফিরলো। যাকে নিয়ে এত গন্ডগোলের সূত্রপাত, সে হঠাৎ করেই মাঝে এসে পড়ায়, ফোন থেকে হাত সরিয়ে ফেললো নিলয়। সৌজন্য একলাফে সরে এসে উজ্জয়িনীর দুটো হাত ধরে বললো,

-ম্যাম প্লিজ আপনি একটু ওদিকে যান!
-কি হয়েছে? তুমি চেঁচাচ্ছ কেন? 
-কিছু না ম্যাম। আপনি প্লিজ এসব কিছু শুনবেন না। একটু ওদিকে যান প্লিজ! 
-আমাকে নিয়ে কি কোনো সমস্যা? তাহলে বলো আমাকে?
-ম্যাম প্লিজ! আচ্ছা আমি চিৎকার করবো না। প্রমিস! কিন্তু আপনি প্লিজ একটু ওদিকটায় যান। প্লিজ গিভ মি সাম প্রাইভেট স্পেস! 
-শিওর...বাট...
-ম্যাম সব ঠিক আছে। আমারই ফল্ট! আমি সামলে নিচ্ছি সব। আপনি প্লিজ একটু লন থেকে ঘুরে আসুন! 

রিসেপশনে সবার মুখের দিকে একবার চাইলো উজ্জয়িনী। ঝামেলাটা যে ওকে নিয়েই, তাতে ওর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না আর। কিন্তু সৌজন্য এমনভাবে ওকে এখান থেকে সরাতে চাইছে, আর ওর পক্ষে ওখানে থাকা সম্ভব না। একটু বিরক্ত হলো উজ্জয়িনী। এর চেয়ে না এলেই মনে হয় ভালো হতো। নিজের মতো করে একটু সময় কাটানো যেত! হঠাৎ করে কেন যে রাজি হতে গেলো! মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ এঁকে হল থেকে বেরিয়ে লনের দিকে চলে গেলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য আবার রিসেপশনে ফিরে শান্ত স্বরে নিলয়কে বললো,

-ওকে! তার সামনে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার হয়ে গেলো। আমার আর কিছু বলার নেই। এবার আপনি বলুন, কি করলে আপনি চাবি দেবেন? সত্যিই ওনার পক্ষে এভাবে আমার সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে কোনো রেকর্ড রাখা সম্ভব না। আমি তাকে বলতেও পারি না। আলাদা রুম হলে উনি অবশ্যই সই করতেন। কিন্তু একসঙ্গে এভাবে পারবেন না। এসব কোনোভাবে বাইরে এলে, ওনার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে! আমি না হয় টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে দেব। এক মুহূর্তে সবকিছু থেকে নিজেকে বের করে ফেলবো। কিন্তু ওনার গায়ে কাদা ছিটবে। সেটা আমি হতে দিতে পারি না। আর আমার পক্ষে পাপাকে যে এসব জানানো সম্ভব না, সেটা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে বোঝাতে হবে না। সো প্লিজ....

নিরুত্তর নিলয়...সৌজন্য আবার বলতে শুরু করলো,

-ফাইন! আমি আপনার স্যার হিসেবে অর্ডার করছি না। আপনার ছোট ভাই হিসেবে অনুরোধ করছি নিলয়দা। প্লিজ, এটা আমার সম্মানের ব্যাপার। আমি ওনাকে ইনভাইট করেছি। আমার কপাল ভালো উনি নিজেই খোলা মনে সমস্যাটার এত সহজ একটা সমাধান বের করেছেন। নইলে আমি কি করতাম জানি না। বিকল্প কিছু? প্লিজ নিলয়দা। অন্তত আমার মুখের দিকে চেয়ে একটা সুস্থ মধ্যস্থতায় আসুন...

নিলয় চেয়ে রইলো সৌজন্যর মুখের দিকে। সৌজন্যর অসহায়তাটা যেন উপলব্ধি করতে পারলো ও। একটা রাইটিং প্যাড এগিয়ে দিয়ে বললো,

-হোটেলে একজন মধ্যবয়স্কা নারী আপনার সঙ্গে আপনার রুমেই থাকছেন। এই হোটেলে থাকাকালীন তার সব দায়িত্ব আপনার। তার কিছু হলে সব দায় আপনার একার। আপনি নিজেই তার গ্যারেন্টার! ব্ল্যাংক পেপারে এটা লিখে সই করুন। আজকের তারিখ আর চেক ইনের সময়টাও লিখে দেবেন। ওনার নাম লিখতে হবে না। ওনার পরিচয় গোপনই থাক। কোনো রেকর্ড রাখতে হবে না। আপনি একটা সই করে দিন। এটা আমার কাছেই থাকবে। আপনারা যেদিন চেক আউট করবেন, এটা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব, যাওয়ার আগে নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলবেন! বস কিছু জানবে না! 

দীর্ঘশ্বাস ফেলে খসখস করে লিখতে শুরু করলো সৌজন্য। নিলয়ের কথামতো সবটা লিখে সই করে দিলো। ফরফর করে কাগজটা ছিঁড়ে নিলয়ের হাতে দিয়ে বললো,

-ধরুন! পাপা বুঝেশুনেই অ্যাপয়েন্ট করেছে! নিয়মের ফাঁক দিয়ে কেউ গলে পালাতে পারবে না! এমনকি তার নিজের ছেলেও না! উফ!!

হাড় জ্বালানো মুচকি হাসি হেসে, কাগজটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো নিলয়। তারপর বললো,

-এটা কিন্তু আপনি এখন রাগ করে, মনে-মনে আমাকে খুব করে গাল দিয়েই বলছেন! তবে আমি এটাকে কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই নেবো! থ্যাঙ্কু স্যার!

নিলয় রুমের চাবিটা একজন কর্মচারীর হাতে ধরিয়ে দিলো,

-স্যার আর ম্যাডামের লাগেজ রুমে পৌঁছে দাও। 

নিশ্চিন্ত হয়ে সৌজন্য বললো,

-থ্যাঙ্কু! পাঁচ মিনিট! জাস্ট পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুজনের ব্রেকফাস্ট আমার রুমে পৌঁছনো চাই! আর কোনো কথা নয়।
-শিওর স্যার! 

সৌজন্য আর দাঁড়ালো না। সোজা দৌড় মারলো লনের দিকে। নিলয় মৃদু হেসে মজা করে সৌজন্যকে নকল করে ওখানে উপস্থিত সকলকে বললো,

-শুনলে তো? পাঁচ মিনিট! জাস্ট পাঁচ মিনিটে দুজনের ব্রেকফাস্ট ওনার রুমে পৌঁছনো চাই!
-আপনি পারেন বটে নিলয়দা! আমরা ওনাকে দেখলেই ভয়ে কাঁপি! আপনি তো বসের ছেলেকেও ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে একেবারে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলেন!

হেসে নিলয় বললো,

-আগে কোনোদিন ওনার সঙ্গে এভাবে কথা বলার প্রয়োজন হয়নি, বলিনি। উনি অন্যায় আবদার করছিলেন। তাই আজ দরকার ছিলো। নইলে ভালোমন্দ কিছু হলে ওনার পাপা আমার কাছেই কৈফিয়ৎ চাইবেন। তখন ওনার পাপাকে কি জবাব দিতাম! নে-নে! পাঁচ মিনিট! অলরেডি এক মিনিট দাঁত বের করে কাটিয়ে দিলি তোরা....এভরিবডি! ব্যাক টু ওয়ার্ক! যার পেটে যত গ্যাস আছে, সব আজ ফুঁ দিয়ে বেলুনে ভরে দাও! রাতে পার্টির পর গলা পর্যন্ত মদ গিলে, সব বেলুন আমি একাই ফাটাবো! তারপর সুগন্ধে অজ্ঞান হয়ে সারারাত উল্টে পড়ে থাকবো! 

নিলয়ের হালকা রসিকতায় হাসির ফোয়ারা উঠলো রয় গেস্ট হাউজের সকল কর্মীদের মধ্যে....

লন পেরিয়ে হোটেলের একটু পিছন দিকে গেলেই হুগলী নদীর দেখা মেলে। দূর থেকে নদীর দিকেই চেয়েছিলো উজ্জয়িনী। ভাবছিল নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। কি ছিলো জীবনটা! আর কোথায় কিভাবে এসে পড়লো ও!! এখানে তো ওর থাকার কথাও ছিল না। নিজের অতীত ভাবলেই গাল বেয়ে নেমে আসে লবণাক্ত জলের ধারা। এই গালেই বাবা সেদিন চড়টা মেরেছিলো না?! সবার সব কথা শুনে নেওয়া যায়। কিন্তু বাবার গায়ে হাত তোলাটা আজও যেন মেনে নেওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারে না উজ্জয়িনী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো....

-ম্যাম আপনি এদিকে চলে এসেছেন? আমি আপনাকে সারা লন খুঁজে মরছি!

সৌজন্যর ডাকে হুঁশ ফেরে উজ্জয়িনীর। পিছন ঘুরেই চোখ মুছে রোদ চশমাটা তাড়াতাড়ি চোখে পরে নিলো ও। তারপর সৌজন্যর দিকে ফিরে বললো, 

-হ্যাঁ এই একটু ঘুরতে ঘুরতে এদিকটায় চলে এলাম। জায়গাটা কি শান্ত, নিরিবিলি! দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো। 
-আচ্ছা আগে ব্রেকফাস্ট করে নিন। তারপর বেড়াবেন। আপনি অনেকক্ষণ আগে বলেছিলেন খিদে পেয়েছে। প্লিজ রুমে আসুন! 
-তোমাদের ঝামেলা মিটলো?
-তেমন কিছু না ম্যাম। সব মিটে গেছে!
-কি ব্যাপার? আমাকে নিয়েই ঝামেলা তো? আমাকে বলা যাবে?
-একদমই বলা যাবে না। ওসব বাদ দিন। আপনি আসুন!

সৌজন্যর সঙ্গে বকতে-বকতে লন পেরিয়ে, হল পেরিয়ে লিফটে উঠলো উজ্জয়িনী। রুমে পৌঁছেই উজ্জয়িনী দেখলো, ঘরের এককোণে কয়েক জোড়া জুতো রাখার মতো ছোট একটা শো-কেস, দেওয়ালে টিভি, ড্রিঙ্কস রাখার জন্য মিনি ফ্রিজ, আর একটা টেবিলের ওপর কফি মেকার আর দুটো কফি মগ, আর কয়েকটা কাঁচের গ্লাস রয়েছে। টেবিলের পাশে দুটো বেতের চেয়ার। একটা দেওয়াল আঁটা ওয়ার্ডরোবের সঙ্গে বড় আয়না লাগানো রয়েছে। ঘরে একটামাত্র বিছানা। ধপধপে সাদা চাদরের ওপর দুটো বালিশ সাজানো রয়েছে। গোটা ঘরে একটা সোফা পর্যন্ত নেই। বিছানার ওপর নিজের হ্যান্ডব্যাগটা রাখলো উজ্জয়িনী। ওরা রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার অবকাশটুকুও পেলো না। তার আগেই হাজির হয়ে গেলো ব্রেকফাস্ট। খাবারের ট্রলিটা টেনে রুমের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলো সৌজন্য। তারপর বললো,

-ম্যাম! আমি বাইরে যাবো? আপনি কি আগে চেঞ্জ করবেন? নাকি আগে খেয়ে নেওয়া যাক? আমার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে!
-আমারও!
-ওকে! আমি সার্ভ করে দিচ্ছি। আপনি হাত ধুয়ে ঝটপট চলে আসুন।

নিজে তড়িঘড়ি হাত ধুয়ে একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে, নিজের কাজে বসে পড়লো সৌজন্য। ওর এই তৎপরতায় বেশ মজা লাগলো উজ্জয়িনীর। বহুদিন হয়ে গেছে ওকে হাতে ধরে এভাবে সামনে বসিয়ে, একটু ভালোবেসে কেউ খেতে দেয়নি। মা রান্না করলেও, ও নিজে নিয়ে খায়। নিজে রান্না করলেও, নিজেই নিয়ে খায়। কি খায়, কতটা খায়, নিজে নিয়ে খেলে পেট ভরে কিনা, ও নিজেও জানে না। বাঁচতে গেলে খেতে হয়, তাই খায়। আজকাল তো খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া নিজের ঘর থেকে বেরও হয় না উজ্জয়িনী। তাতেও কথা থেকে নিস্তার নেই। খেতে বসে মায়ের মুখ থেকে এতরকম কথা শোনে, বিষিয়ে যায় মুখের সামনের খাবারটুকু। কোনোরকমে গিলে টেবিল থেকে উঠে যায় ও। বহুদিন পর এত যত্ন করে কেউ নিজের হাতে ওকে খাবার বেড়ে খেতে দিচ্ছে। তাও ওর জন্য এটুকু করতে পেরে, সেই মানুষটা মন থেকে কত আনন্দ পাচ্ছে! সৌজন্যর চঞ্চলতা, চটপটে সারল্য বড় মুগ্ধ করলো উজ্জয়িনীকে। কিছুক্ষণ আগেই সৌজন্য দরজাটা বন্ধ করে রুমের এসিটা চালিয়ে দিয়েছে। ঘরটা বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। হাত ধুয়ে বিছানার এককোণে এসে বসলো উজ্জয়িনী। ব্রেড, টোস্ট, বয়েলড এগ, ফ্রুট জুস, কাঁচের গ্লাসে রাখা দুধ, আর কেটে বিটনুন আর গোলমরিচ ছড়িয়ে দেওয়া কয়েক টুকরো আপেল সুন্দরভাবে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে সৌজন্য। উজ্জয়িনী এসে বসতেই ওর দিকে ছোট টেবিলটা এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে সৌজন্য বললো,

-অ্যাট ইয়োর সার্ভিস ম্যাম!

হেসে ফেললো উজ্জয়িনী।

-বসো। তুমিও শুরু করো। 
-এই তো এক্ষুণি শুরু করবো। খিদের চোটে পেটের মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ চলছে!

এক টুকরো ব্রেডে কামড় বসাতেই সৌজন্যর ফোনটা বেজে উঠলো সশব্দে। ফোন বের করেই ও বললো,

-এই রে! ফাদার ইন্ডিয়া! পৌঁছে ফোন করতে ভুলে গেছি। এবার চেঁচাবে। ম্যাম?
-হুম?
-পাপার ফোন ধরছি। প্লিজ আপনি কথা বলবেন না। মানে পাপা জানে না তো....
-ধরো-ধরো! আমার মুখ সেলাই...এই চুপ করে খেতে পারবো তো?

হাসিমুখে সম্মতি দিয়ে খেতে খেতেই ফোন ধরলো সৌজন্য,

-আরে এই তো পৌঁছলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রিসোর্টে। বেরোতেই দেরি হয়ে গেছে। জাস্ট তোমাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম, তখনই তুমিও ফোন করলে। হ্যাঁ... হ্যাঁ... সব ঠিক আছে। তুমি যা জাঁদরেল ম্যানেজার রেখেছো, ঠিক ছাড়া বেঠিক কিছু হতে দেবে নাকি! হ্যাঁ আমি সব দেখেশুনে রাখবো। পাপা তুমি এত টেনশন কোরো না।নিজের শরীরের খেয়াল রাখো। মাকে দেখে রাখো। বাই... বাই...খাচ্ছি আমি। রাখছি! হ্যাঁ রাতে ফোন করে সব রিপোর্ট দেবো। বাই...

ফোন রেখে সৌজন্য বললো,

-ম্যাম, আমি এখন কয়েক ঘন্টা একটু ব্যস্ত থাকবো। নীচে সুপারভাইজ করতে ছুটতে হবে। ফোনে প্রতি মুহুর্তের আপডেট না দিলে, পাপা ওখানে বসে বসেই টেনশনে প্রেশার বাড়িয়ে ফেলবে। তবে ফাঁক পেলেই রুমে এসে আপনাকে টাইম দিয়ে যাবো। বা আপনি চাইলে, আমার সঙ্গেই পুরো সময়টা থাকতে পারেন। এদিক ওদিক ঘুরতে পারেন। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি, একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসুন না হয়। যেটা আপনার মন চাইবে, আপনি সেটাই করুন ম্যাম। এটা আপনারই বাড়ি। আচ্ছা একটা ব্যাপার! আপনাকে তো আমি হঠাৎ করেই এখানে নিয়ে এলাম। পার্টির কোনো প্ল্যান ছিলো না নিশ্চয়ই...
-আমার এই ট্রিপটারই কোনো প্ল্যান ছিলো না সৌজন্য। এটাও হঠাৎ করে হয়ে গেছে। 
-ভালোই হয়েছে। বেশ হয়েছে। হঠাৎ করে ট্রিপটা হয়ে গেছে বলেই তো, আমরা এত সুন্দর একটা মুহূর্ত কাটাচ্ছি। জীবনে হঠাৎ-হঠাৎ কিছু হয়ে যাওয়া ভালো, বুঝলেন তো ম্যাম! ভালোভাবে বাঁচার জন্য খুব বেশি প্ল্যান করলে দেখবেন, ভালোভাবে তো দূরের কথা, আপনি বাঁচতেই ভুলে গেছেন। এত প্ল্যান করে কিছু হয় না। বেরিয়ে পড়বেন এইরকম হুটহাট করে। নইলে আমাদের হোটেলগুলো চলবে কি করে?
-টিপিক্যাল বিজনেসম্যান! 

হেসে ফেলে ফ্রুট জুসের গ্লাসে ঠোঁট ঠেকালো উজ্জয়িনী। 

-হ্যাঁ ম্যাম যেটা বলছিলাম, সন্ধ্যেবেলা পরার মতো পার্টিওয়্যার আছে তো আপনার? নাকি সব ক্যাজুয়াল ওয়্যার? আপনি চাইলে আমরা কিন্তু একফাঁকে একটু শপিংও করে আসতে পারি!
-আমার সঙ্গে এখন যা আছে, আমি তাই পরবো সৌজন্য। অতিরিক্ত পোশাক-প্রসাধনের শৃঙ্খল আজকাল আর ভালো লাগছে না।
-ওকে ম্যাম! আমার ব্রেকফাস্ট ডান। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। নীচে রুম সার্ভিসকে বলে দিচ্ছি, ওরা এগুলো নিয়ে যাবে। আপনি চাইলে চেঞ্জ করুন, ওপরে থাকুন, নীচে আসুন, নদীর পাড়ে যান। যা খুশি করুন। আপনি নীচে না নামলে আমি আধঘন্টার মধ্যেই আবার ওপরে আসছি। আপনার সঙ্গে এখনও অনেক গল্প করা, আড্ডা দেওয়া বাকি আছে।
-হুম!
-বেরোলাম ম্যাম। ডোর লক করে রাখুন। কেউ বেল বাজালে খুলবেন। 

সৌজন্য বেরিয়ে গেলে নিজের খাওয়াটা আস্তে-ধীরে শেষ করলো উজ্জয়িনী। তারপর হাত ধুয়ে ফোন হাতে নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। জামাটাও ওর আর বদলাতে ইচ্ছে করলো না। মাকে একটা ফোন করলো। তারপর মাম্মামকে। মাম্মামের সঙ্গে কথা হলো না ঠিকই, তবে ওর প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা হলো। ওখানে ভালোই আছে মাম্মাম। অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়েছে। পড়াশোনাও মন দিয়ে করছে। সারাদিনই ভালো থাকে। শুধু রাতে ঘুমানোর সময় নাকি শুধু উজ্জয়িনীর কোল হাতড়ে বেড়ায়। এটুকু শুনেই কান্না পেয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। ও আর একটা-দুটো কথা বলেই রেখে দিলো ফোনটা। বেল বাজছে। রুম সার্ভিস থেকেই হয়তো। ভালো করে চোখ মুছে উঠে দরজা খুলে দিলো উজ্জয়িনী। খাবারের ট্রলিটা নিয়ে যাবার সময় উনি জিজ্ঞেস করলেন, লন্ড্রির কোনো জামাকাপড় আছে কিনা! না বলে তাকে বিদায় জানালো উজ্জয়িনী। তারপর আবার গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ফোনটা আবার বেজে উঠতেই বেজায় বিরক্ত হলো ও। প্রকাশকের ফোন....

-হ্যালো!
-ম্যাডাম বলছিলাম কি....
-বলবেন না। আগামী দু-তিনদিন আমি একটু ব্যস্ত আছি। এর মধ্যে কিছু বলবেন না। আমি শহরের বাইরে আছি। ফিরে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। কেমন? রাখছি!

ফোন রেখেই উজ্জয়িনী আগে হোয়্যাটসঅ্যাপের ব্লু-টিক অফ করলো। তারপর ফেসবুক আনইন্সটল করতে গিয়েই মনে পড়লো শৌনকের কথা। গতকাল সন্ধ্যে থেকে নানান ব্যস্ততায় ওর ছবি একবারও দেখা হয়নি। এখনও তো আর সেভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে না। এমন নয় যে, না দেখলে থাকতেই পারছে না, এক্ষুণি চোখের সামনে ওর ছবি চাই, মন থেকে এমন কিছু অনুভব হচ্ছে না তো! শৌনকের প্রোফাইলে আর ঢুকলো না উজ্জয়িনী। সেই টানটা, সেই মায়াটা কি তবে একটু হলেও কমলো? নাকি কষ্টটা কমলো? গত দুমাস ধরে মৃত্যুর মতো মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে একাই যুঝছিলো উজ্জয়িনী। হঠাৎ করে সেই যন্ত্রণাটা কমে গেলো কি করে? সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতে ফেসবুকে ঢুকে সৌজন্যর প্রোফাইল থেকে উজ্জয়িনী একবার ঘুরে এলো। কাল রাতেও একবার দেখে এসেছে। সৌজন্যর গুটিকয় ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই। আট বছর আগের প্রোফাইল। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র ছবি রয়েছে।
রিলেশনশিপ স্টেটাস সিঙ্গেল। এত বড়মাপের একজন মানুষ, অথচ প্রোফাইলে বিশেষ কিচ্ছু নেই। হয়তো তেমনভাবে অ্যাকটিভ না। বা হয়তো ওর বাকি পোস্টগুলো পাবলিক করা নেই। তাই উজ্জয়িনীকে দেখাচ্ছে না। সৌজন্যকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও, আঙুল সরিয়ে নিলো উজ্জয়িনী। কোনোদিনও কাউকে এভাবে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়নি ও। এমনিতেই তো ওকে সৌজন্য অফিসিয়াল পেজে আর প্রোফাইলে ফলো করে রেখেছে। থাক! ফলোয়ার হয়েই দূরে থাক। বন্ধুবৃত্তে ঢোকালে আজীবনের জন্য চোখের সামনে থেকে যাবে। ওর নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলবে। কি দরকার ওসবের? দুদিন পর যে যার রাস্তায় চলে যাবে। সব শেষ! ভাবতে-ভাবতে মাথাটা ভারী হয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। এতকিছু যে ও কেন ভাবছে, সেটার উত্তরও ভেবে পাচ্ছে না। নিজের ফেসবুকের সার্চ লিস্ট দেখে হঠাৎ করেই চমকে উঠলো উজ্জয়িনী। এতদিন যাবৎ ওর সার্চ লিস্টের প্রথম নাম থাকতো, শৌনক চট্টোপাধ্যায়। আর আজ শৌনকের মাথার ওপর বসে রয়েছে সৌজন্য রায়। এসব মেসেজ, ইনবক্স, সত্যি বড্ড ঝামেলার বিষয়। তার চেয়ে এই বেড়াতে আসা, কিছুটা মুহূর্ত একসঙ্গে কাটানো, তারপর হারিয়ে যাওয়া ঢের ভালো। নেহাৎ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এখন সেল্ফ-প্রোমোশনের একটা বড় জায়গা, তাই নিজের কাজের জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে উজ্জয়িনীকে এখানে থাকতেই হয়। কিন্তু কদিনের জন্য তো এই অন্তর্জাল থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়াই যায়। তাড়াতাড়ি করে ফেসবুক আনইন্সটল করে ফেললো উজ্জয়িনী। এই কটাদিন ও একদম একা থাকতে চায়। মুহূর্তগুলোকে নিজের মতো করে, প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে চায়। মন চাইলে সৌজন্য নীচে যেতে বলেছিলো। নাহলে আবার আধঘন্টা পর ছেলেটা কাজকর্ম সব ফেলে ওকে সময় দেওয়ার জন্য ওপরে চলে আসবে। তার চেয়ে নীচে যাওয়াই ভালো। ওর সঙ্গ উজ্জয়িনীর বড় ভালো লাগে। ছেলেটা কি সুন্দর তরতর করে দৌড়োয়! কলকল করে কথা বলে! মনে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। জীবনে কোন জটিলতা নেই। জীবনে কোন কিছুর অভাবও নেই। কোনো স্ট্রাগল নেই। ঝরঝরে বুদ্ধিদীপ্ত একজন যুবক। কিন্তু ওই ছেলের চোখদুটো অমন কেন? ওপরে যতই ছটফট করে ঘুরে বেড়াক, উজ্জয়িনীর চোখকে তো ও ফাঁকি দিতে পারবে না। অনেক অব্যক্ত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে, ওই দুটো চোখেই। কোনোদিন কি সৌজন্য সেই যন্ত্রণার কথা বলবে উজ্জয়িনীকে? কেন বলবে? আর উজ্জয়িনী জানতে চাইবেই বা কেন? সে তো নিজের বই পড়া, কফি খাওয়া, সামান্য কিছু আবদার, আড্ডা আর আতিথেয়তার বাইরে একটাও বাড়তি কথা উজ্জয়িনীর কাছে জানতে চায়নি। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, উজ্জয়িনীকে উপযুক্ত সম্মান দিয়েই, একসঙ্গে কয়েক মুহূর্ত বেড়ানোর আনন্দটা, সে উপভোগ করতে চায় মাত্র। সৌজন্য শুধুমাত্র উজ্জয়িনীর সান্নিধ্য চায়। উজ্জয়িনীর মতো আলোর বৃত্তে অবস্থিত একজন ভাবুক-আবেগী মানুষের সঙ্গে, একটু ভালো সময় কাটানোটা ওর কাছে যে সারাজীবনের সুন্দর স্মৃতি হবে, সেই স্মৃতিটুকুই চায় সৌজন্য। ওই কারণেই বারবার বলে, আমি আপনার অগণিত পাঠকের ভিড়ে হারিয়ে যেতে রাজি নই ম্যাম! মৃদু হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো উজ্জয়িনী। নীচে যাওয়ার আগে চোখ থেকে চশমাটা খুলে আরও একবার দাঁড়ালো আয়নার সামনে....

সারাটাদিন ধরে হুড়োহুড়ি, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, বেলুন ফাটানো, নদীর ধারে চরে বেড়ানো, নৌকাবিহার, মন খুলে গল্পগুজব শেষে সন্ধ্যেবেলা নিজেদের রুমে তৈরি হচ্ছিলো উজ্জয়িনী। ট্রলি থেকে নিজের জামাকাপড় বের করে নিয়ে, সৌজন্য অনেকক্ষণ আগেই উজ্জয়িনীর জন্য ঘর ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ও নীচে স্টাফরুমেই তৈরি হয়ে নেবে বললো। এদিকে উজ্জয়িনী তৈরি হয়ে বসেছিলো বিছানার ওপর। একটা ফুলহাতা পোশাকে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে নিয়েছে সে। এটাও পালিয়ে আসার আগে শপিং মল থেকেই কেনা। তখন হাতের সামনে যা পেয়েছে, সব উঠিয়ে নিয়েছিল উজ্জয়িনী। আজ পরে দেখলো, বেশ ভালোই লাগছে দেখতে। খুব হালকা সাজে নিজেকে সাজালো রাখলো উজ্জয়িনী। নিজেকে আজ খানিকটা এলোমেলো রাখতেই মন চাইলো ওর। বেল বাজতেই উঠে দরজা খুলে দেখলো সৌজন্য পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘন নীল ব্লেজারটা দুর্দান্ত মানিয়েছে ওকে। উজ্জয়িনী দরজা খুলেই বলে উঠলো,

-আরে তোমাকে দারুণ লাগছে সৌজন্য! 
-থ্যাঙ্কু ম্যাম। থ্যাঙ্কু! আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে।  রেডি?
-একদম! এই সৌজন্য, তোমার গা থেকে ক্রিমের গন্ধ বেরোচ্ছে কেন? 
-এখনও বেরোচ্ছে? বডি স্প্রে মেরে ফাঁকা করে দিলাম যে, তাও বেরোচ্ছে?
-কি করছিলে তুমি?
-আরে কেকটা সাজাতে ওদের একটু হেল্প করছিলাম। 
-হোটেলের কেক?
-নানা। ম্যাম একটু ওয়াশরুম ইউজ করছি।
-হ্যাঁ যাও!

মুখচোখ ভালো করে ধুয়ে এসে নিজের ট্রলি খুলে বসলো সৌজন্য। উজ্জয়িনী দেখলো, অগোছালো জামাকাপড়ের ওপর দুটো ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে ওর একটা বই রয়েছে। সৌজন্য ট্রলি হাতড়ে নিজের কয়েকটা বডি স্প্রে বের করলো।

-আমি বাইরে আছি সৌজন্য। 
-না ম্যাম আপনি থাকুন। কোনো অসুবিধে নেই। আমি ওয়াশরুমে চলে যাচ্ছি। 

ওয়াশরুমের দরজা খোলাই রইলো। উজ্জয়িনী ওয়াশরুমের দিকে পিছন ঘুরে বসে বললো,

-সৌজন্য বললে নাতো কিসের কেক?
-হোটেলের কেকটা তো ম্যাম আগেই অর্ডার দেওয়া ছিল। আমাদের একজন ট্যুরিস্ট এর আজ আঠের বছরের জন্মদিন ম্যাম। সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে। খবরটা কানে যখন এলোই, তার জন্মদিনটাকে আরো একটু স্পেশাল করার জন্য ছোট একটা কেক ওদের বানাতে বললাম। ফ্রিতে কেক পেয়ে কাস্টোমার খুশি হয়ে যাবে। মনে রাখবে আমাদের। ওরা ফিরে গিয়ে আবার অন্য কাউকে রেকমেন্ট করবে এখানে আসার জন্য। ব্যাস! আমরা লালে লাল! 
-হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট! তাই না?
-হ্যাঁ ম্যাম। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন?

হতবাক সৌজন্য বাথরুম থেকে মুখ বাড়ালো। উজ্জয়িনী হেসে বললো,

-পড়াশোনাটা বেশ মন দিয়েই করেছ দেখছি। কাস্টোমার পটাতে ওস্তাদ! 
-ঐটুকুই তো হোটেল ব্যবসার মূলধন ম্যাম।
-হুম বুঝলাম! তা আঠের বছর যার হচ্ছে, সে কি অষ্টাদশ, নাকি অষ্টাদশী?

ব্লেজারের পর জামাটাও একটানে খুলে ফেললো সৌজন্য। ওয়াশরুম থেকে কৃত্রিম পুরুষালী সুবাস ভেসে আসতে লাগলো বেডরুমেও। জামাটা আবার ভিজে গায়ে গলিয়ে চুল ঠিক করতে করতে সজোরে হেসে সৌজন্য বললো,

-অষ্টাদশী ম্যাম! অষ্টাদশী!
-তার জন্য তোমার যা বিশেষ-বিশেষ আয়োজনের বহর দেখছি, ওই অষ্টাদশী কিন্তু আজ তোমার হাতে পটে যাবে! মিলিয়ে নিও তুমি!

হাসতে হাসতে ওয়াশরুম থেকে বেরোলো সৌজন্য। 

-ম্যাম এবার আর ক্রিমের গন্ধ পাচ্ছেন? এবারও পেলে গোবর জলে চুবে আসতে হবে।
-নানা। স্মেলস গুড!
-ওকে। চলুন তবে? যাওয়া যাক। 

ট্রলিতে বডি স্প্রে ফেলে রেখে ট্রলি বন্ধ করে ফেললো সৌজন্য। 

-ম্যাম আপনি বেরোন। আমি ডোর লক করে আসছি! 

সৌজন্যর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত গলিয়ে লিফটে উঠলো উজ্জয়িনী....

হোটেলের সুবিশাল কেকটা কাটার সময় সৌজন্যর পাশেই দাঁড়িয়েছিলো উজ্জয়িনী। তারপর ওদিকের হুড়োহুড়ি, নাচানাচি, লাফালাফি, মিউজিকের অতিরিক্ত অত্যাচারে, রকমারি উষ্ণ পানীয়র কড়া গন্ধে মাথা ধরে গেছে ওর। সৌজন্য ব্যস্ত রয়েছে দেখে, ও সৌজন্যকে না বলেই সরে এসেছে ওখান থেকে। সেই অষ্টাদশীর জন্মদিনের কেক কাটা হচ্ছে এখন। মেয়েটা সৌজন্যর পাশ থেকে আর নড়ছেই না। একটু দূরে একটা টেবিলে একা বসেছিলো উজ্জয়িনী। সামনে উষ্ণ পানীয়র গ্লাস আর কিছু স্ন্যাকস! বেশ লাগছিলো ওদিকে চেয়ে থাকতে। দুটিকে পাশাপাশি মানাচ্ছেও বেশ। একদিকে উজ্জয়িনী দেখলো, স্বামী-স্ত্রীর কোনো বিষয় নিয়ে বেশ তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। ওদিকে আবার সুটেড-বুটেড দুজন পুরুষ মদের গ্লাস হাতে নিয়ে জোরতার ঝগড়া করছে। অদূরে একটা লেডিস গ্রুপ কি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে কে জানে! দিকে-দিকে কেবল আলাপ-আলোচনা, ভ্রু কুঁচকে কথাবার্তা....এসব দৃশ্যই চোখে পড়লো উজ্জয়িনীর। এত আলোর মধ্যে, এত আনন্দের মধ্যেও সুখী নয় কেউ! সবার জীবনের সমস্যার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তাদের মুখমন্ডলে। গলায় আবার একটু উষ্ণ পানীয় ঢেলে নিলো উজ্জয়িনী। গ্লাসের দিকে চেয়ে একটু অন্যমনস্ক হতেই সৌজন্যকে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেললো ও। একটু এদিক ওদিক চেয়ে সৌজন্যকে উজ্জয়িনী আর খুঁজেই পেলো না। অস্থিরভাবে ও চাইলো ওই মেয়েটির দিকে। কিন্তু ওই অষ্টাদশীর ত্রিসীমানায়ও, উজ্জয়িনী সৌজন্যর টিকি খুঁজে পেলো না। 

-ম্যাম! এইতো আমি! একা বসে কেন এখানে?

চমকে উঠলো উজ্জয়িনী। এত জোরে গান বাজছে, আর হলে এত হৈ-হল্লা, উজ্জয়িনী সৌজন্যর কথা কিছুই শুনতে পেলো না। উষ্ণ পানীয়র প্রভাবে উজ্জয়িনীর মাথাটাও ভারী হতে শুরু করেছে। ও বললো,

-কি বললে?

সৌজন্য উজ্জয়িনীর কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বললো,

-বলছি আপনি এখানে একা-একা বসে আছেন কেন? ওদিকে চলুন একটু? 
-না। এখানেই ঠিক আছি আমি। 
-আরে চলুন, উঠুন। আপনি এভাবে এককোণে একা বসে থাকলে, আমার ওখানে ভালো লাগবে না। 
-সদ্যযৌবনা অষ্টাদশীকে ছেড়ে এই বিগতযৌবনার খোঁজে কেন সৌজন্য? যাও, পার্টি এনজয় করো। 
-ধ্যের! কেক কাটা হয়ে গেছে। দু-লাইন বক্তব্য রেখে দিয়েছি, মেয়েটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কেক কেটেছি, আমার কাজ শেষ। বাকিটা ম্যানেজমেন্ট বুঝে নেবে। 
-কি বলছো? শুনতেই পাচ্ছি না। 
-বলছি ম্যাম, বাকি কাজ নিলয়দা আছে, স্টাফরা আছে। ওরা যা পারে করুক। আমার কাজ শেষ। আপনি কি ওদিকে যাবেন? চলুন একবার। উঠুন, আমি ধরে-ধরে নিয়ে যাচ্ছি। ডিনার করে রুমে চলুন বরং। আর ভালো লাগছে না এখানে। আমি ধরছি আপনাকে...

চিৎকার করে মিউজিকের শব্দের ঊর্ধ্বে উঠে সৌজন্য বললো...

-আরে সৌজন্য আমি স্টেবল আছি। ধরতে হবে না।
-তাহলে চলুন। 

তাও উঠতে গিয়ে একটু টাল খেলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য তাড়াতাড়ি ওকে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলো। লজ্জায় পড়ে উজ্জয়িনী বললো,

-থাক আমি একটু পরে যাচ্ছি।
-আমি নিয়ে যাচ্ছি, চলুন!

সৌজন্য উজ্জয়িনীর হাত ধরে ওর কোমরে হাত রাখতেই, উজ্জয়িনী চোখের সামনে দেখলো সান্দাকফু....ফালুট.....ট্রেকিং....হোটেলের বিছানায় উদ্দাম যৌনতা....শৌনক ওর কোমর জড়িয়ে ধরে হোটেলের রুম থেকে দূরে পাহাড়ের দিকে চেয়ে রয়েছে।সারারাতের সীমাহীন শরীরী মিলনের পর পরদিন সকালে ঠিক এভাবেই শৌনক ওর কোমরটা চেপে জড়িয়ে ধরেছিল না! যেভাবে এখন সৌজন্য ধরে রেখেছে! মৃদু ধাক্কা মেরে সৌজন্যকে সরিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। আবার ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। 

-ম্যাম! কি হলো?
-যাবো না। প্লিজ! তুমি যাও! আমাকে একটু একা থাকতে দাও সৌজন্য!
-ম্যাম আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? রুমে যাবেন? ঘুমোবেন একটু? আমি রুমে ডিনার সার্ভ করতে বলি?
-তুমি যাও না এখান থেকে! প্লিজ!

কথা বলতে-বলতেই কান্নায় গলা কেঁপে উঠলো উজ্জয়িনীর। শৌনক আছে। কিছুতেই ভোলা যায় না ওকে। সৌজন্য ওর অবস্থা দেখে ওখান থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না দেখে, গ্লাসের অবশিষ্ট মদটুকু গলায় ঢেলে নিলো উজ্জয়িনী। তারপর টেবিল থেকে ফোনটা তুলে সৌজন্যকে পাশ কাটিয়ে টলতে-টলতে হলের বদ্ধ পরিবেশ ছেড়ে, দেওয়াল ধরে-ধরে বেরিয়ে গেলো খোলা হাওয়ায়। সাহায্য ছাড়া একা খুব বেশিদূর যেতে পারলো না উজ্জয়িনী। হলের বাইরে বেরিয়ে লনের মধ্যে কয়েক পা গিয়েই, আবার ঘাসের ওপর বসে পড়লো ও। তারপর চুপ করে বসেই রইলো। আর উঠতে পারলো না....

এত আলো,এত ভিড় অসহ্য লাগে সৌজন্যর। একটা মদের ভরা বোতল আর একটা গ্লাস টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে, উজ্জয়িনীর পিছন-পিছন হল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো ও নিজেও....শত কাজের মধ্যে ব্যস্ত থেকেও, নিলয় দূর থেকে দেখলো, দুজনই পরপর হলের বাইরে বেরোলো। 

-ম্যাম! একি আপনি বাইরে এসে মাটির মধ্যে বসে আছেন? উঠুন-উঠুন! ওদিকে পার্কে বসার জায়গা আছে। ওখানে বসবেন চলুন। 
-এখানেই ভালো লাগছে সৌজন্য। 
-আচ্ছা এখানেই বসবেন তবে?
-হুঁ! 

চারিদিকটা একবার দেখে নিলো সৌজন্য। গেট বেশ খানিকটা দূরে থাকায় ওদিকের আলো এদিকে এসে বড় বিশেষ পৌঁছচ্ছে না। ওদিকে হালকা আলো থাকলেও, লনের পিছনদিকের এই জায়গাটা বেশ অন্ধকারই বলা চলে। তবে অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই সৌজন্য দেখলো, দূরে নদীর দিক থেকে উত্তাল হাওয়া পাক খেয়ে এদিকে আসছে। উজ্জয়িনীর মাথার চুলগুলো মনের আনন্দে উড়ছে। খালি কাঁচের গ্লাস আর বোতলটা পাশে রেখে, নিজের জুতো-মোজা খুলে ফোনটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে ঘাসের ওপর রেখে, সৌজন্যও বসে পড়লো উজ্জয়িনীর পাশে। 

-আপেলটা ঘাসের ওপর ফেলে রাখলে যে?
-কিসের আপেল? নিয়ে আসবো ভিতর থেকে? খাবেন?
-না। তোমার দামী আপেল!
-ওহ আইফোন! ও পাপা গিফ্ট করেছে। একদিন জেদ করে পাপার কাছ থেকে এসব আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুক সব আদায় করতাম। জীবনের প্রথম আইফোন আমি রাস্তায় ছুঁড়ে ভেঙে ফেলেছি। তারপর থেকে আর কোনোদিনও কিছু চাই না ম্যাম। চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না, এটা যেদিন থেকে বুঝেছি, সেদিন থেকে আমার সব চাহিদা মরে গেছে। এটা অনেক পরে পাপা নিজেই গিফ্ট করেছে। কোনো কিছুর প্রতি আমার আর কোনো মোহ নেই। কেটে গেছে সব! ও পড়ে থাকলে থাক, হারিয়ে গেলে যাক। আবার কম দামী কাজ চলার মতো কিছু একটা কিনে নেবো। ফোন আমি কাজ ছাড়া খুব বেশি ব্যবহার করি না। কাজের বাইরে সারাদিনে একবার আপনার পেজ বা প্রোফাইল ভিজিট করি, অনলাইন কিছু টাকাপয়সার লেনদেন করি। ব্যাস!
-জীবনের প্রতি এত অনীহা কেন সৌজন্য?
-একাকীত্বকে যে মন থেকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাকে আপনি আর জীবনে ফেরাতে পারবেন না ম্যাম! কি দারুণ হাওয়া দিচ্ছে না নদীর দিক থেকে!?
-হুম!
-ভিতরের দমবন্ধকর পরিবেশের থেকে বাইরেটা অনেক ভালো। হাজারটা এসির বিনিময়েও এই পরিবেশ পাওয়া যায় না। খালি পায়ের তলায় সবুজ ঘাসের সুড়সুড়ি, মাথার ওপর খোলা আকাশ, ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের আড়ালে উঁকি দেওয়া চাঁদ, সামনে নদী, আপনি-আমি, আর আড্ডা....
-তুমি বাইরে বেরিয়ে এলে যে! তোমার অষ্টাদশীকে ছেড়ে। 
-ধুর! আমার এত আলো, এত শব্দে বিরক্ত লাগে। কি করবো? কাজের জায়গা। থাকতেই হয়। পাপা বকবে নইলে!
-তুমি পাপাকে খুব ভয় পাও, তাই না?
-না ম্যাম। পাপা আমার মাই ডিয়ার। এটা ভয় নয়। ওদের ইচ্ছেকে সসম্মানে মান্যতা দেওয়া। আমি বাবা-মাকে মানি খুব। 
-এককালে আমিও মানতাম। 
-মানতাম কেন? এখন মানেন না?

চুপ করে গেলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো, কথার পৃষ্ঠে ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলেও, প্রশ্নটা বড় ব্যক্তিগত হয়ে গেছে। এর উত্তর পাওয়া যাবে না। আশা করাও উচিত নয়। ও প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে উঠলো,

-ম্যাম উইথ ইয়োর পারমিশন, আমি কিন্তু এবার একটু ড্রিঙ্ক করছি। সন্ধ্যে থেকে গেস্টদের সামনে স্টেবল থাকার জন্য একটুও খাইনি। তবে আপনি আর পাবেন না।
-কেন না?
-নিজের অবস্থা দেখুন।
-দিব্যি তো তোমার সঙ্গে কথা বলছি।
-আমি একটাই গ্লাস এনেছি। হবে না।
-মদ আবার এঁটো হয় নাকি?

হেসে উঠলো সৌজন্য। 

-আচ্ছা অল্প একদম। নইলে এরপর আপনাকে ওঠাতে জেসিবি লাগবে। 
-আনবে!

গ্লাসটা উজ্জয়িনীর দিকে এগিয়ে দিলো সৌজন্য। তারপর সবুজ গালিচার মতো ঘাসের উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। মাথার তলায় একটা হাত রেখে নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,

-ম্যাম একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-বলো?
-যেদিন আপনার গল্পের সব প্লট ফুরিয়ে যাবে, আপনি সেদিন কি করবেন? মানে রিটায়ারমেন্টের কথা বলছি। ধরুন, যখন আপনার ভাবনায় জং ধরবে, কল্পনারা ডানা মেলে আকাশে উড়বে না, আপনি সেদিন কি করবেন ম্যাম?
-তখন কল্পনা না করে, যা চোখের সামনে দেখবো, তাই নিয়েই লিখবো।

গ্লাসটা সৌজন্যর হাতে ফিরিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য গ্লাসে উষ্ণ পানীয় ঢেলে প্রথম চুমুক দিয়ে বললো,

-তেমনটা আবার হয় নাকি? বাস্তব বলুন বা কল্পনা, একদিন তো ফুরোবেই।
-আমার তো উল্টোটা মনে হয় সৌজন্য। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, লেখার মতো আমার কাছে এতকিছু আছে, যে এক জীবনে আমি বোধহয় সব লিখে শেষ করতে পারবো না।
-বাপরে! এত প্লট? এত ভাবতে পারেন কি করে?
-ভাবতে হবে কেন? চোখ কান খোলা রাখলেই নিজের  আশেপাশে কতকিছু দেখা যায়, শোনা যায়। শুধু দেখার চোখ থাকা চাই। বেশি ভাবার দরকার নেই তো!
-আপনার আশেপাশে গল্পরা ঘুরে বেড়ায়? চরিত্ররা?
-অবশ্যই। আজ তোমার পার্টিতেই তো কতগুলো গল্প দেখলাম। অসুখী স্বামী-স্ত্রীর গল্প, একটা লেডিজ গ্রুপের পি.এন.পি.সির গল্প, আবার তোমার আর তোমার অষ্টাদশীর গল্প। 
-আরে কি যে বলেন ম্যাম! বাচ্চা একটা মেয়ে। 
-ও বাচ্চা? আর তুমি বুড়ো হয়ে গেছ বুঝি?

হেসে গ্লাসটা গলায় উপুড় করলো সৌজন্য। আবার শূন্য গ্লাস পূর্ণ করতে করতে শুনলো উজ্জয়িনী বলছে,

-শোনো সৌজন্য, তোমাকে একটা কথা বলে রাখি। তোমার এই পার্টিতে যারা-যারা উপস্থিত আছেন, তারা সবাই ডিপ্রেসড। সবার জীবনে সমস্যা আছে। কেউ সুখী নয়। বসে বসে দেখলাম তো, ওই একটুখানি সময়টাতেও কেউ প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না। সবাই নিজেদের ওই খারাপ থাকাগুলোর সঙ্গে ডিল করছে। আর ওই খারাপ থাকার গল্পগুলোই এক একটা আস্ত উপন্যাস। বুঝলে? যত চোখের জল, তত গল্প। এবার তুমি আমাকে একটা কথা বলো, একজন পরিণত মানুষ জীবনে ঠিক কতবার কাঁদেন? 
-জানিনা ম্যাম। নিজে তো সবেমাত্র পঁচিশটা বছর পেরিয়েছি। বাকি গোটা জীবন তো পড়েই আছে। তাও এত চোখের জল খরচ করে ফেলেছি, যে সেসব হিসেবের বাইরে! এরপর সারাজীবন ধরে আর কত কাঁদতে হবে, জানিনা ম্যাম!
-তাহলে? এবার তুমি আমাকে বলো, প্রতিবার কি একই কারণে কাঁদো?
-নানা। একই কারণে বারবার কান্না আসে নাকি? তখন তো যন্ত্রণায় মানুষ পাথর হয়ে যায়। কান্নারাও মরে যায়। কান্নার কারণেরও রকমফের আছে।
-রাইট! আর ওই প্রতিবার চোখের জলের বিভিন্ন কারণগুলো হলো এক-একটা গল্প। এবার তুমি হিসেব করো, একটা মানুষ এক জীবনে যতবার চোখের জল ফেলছে, প্রতিবার সে নিজেই এক-একটা নতুন গল্প সৃষ্টি করছে। তাহলে একটা মানুষের সারা জীবনের সব গল্প কি আমি লিপিবদ্ধ করে উঠতে পারবো? সম্ভব কখনো? তাহলে বাকিদেরগুলো কি হবে? আর সবার গল্প লিখতে গেলে, আমার এই একটা জীবন কম হবে কিনা! এবার তুমিই বলো?

নিরুত্তর সৌজন্য। আকাশে হঠাৎ করেই লক্ষ-লক্ষ তারা জ্বলে উঠলো। কত বাজি ফাটছে! বাজির আলোর চকচক করে উঠলো সৌজন্য আর উজ্জয়িনীর চোখমুখ।

-নিলয়দা!

গ্লাস আবার ফাঁকা করে আকাশের দিকে চেয়ে সৌজন্য বললো। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের ওপর থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে, মনের আনন্দে ছবি তুলতে গেলো উজ্জয়িনী। ঘাসের ওপর আধশোয়া অবস্থায় পড়েছিলো সৌজন্য। একলাফে উঠে এসে উজ্জয়িনীর হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো ও। 

-ওই! আমার ফোন দাও। ফটো তুলছিলাম তো! 
-না তুলবেন না। 
-ওমা! কেন? যাঃ! বাজির আলো শেষ হয়ে গেলো....

হঠাৎ করে যেমন আলো হয়ে গিয়েছিল, তেমনই হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেলো সৌজন্য আর উজ্জয়িনীর চোখমুখ। আকাশের গায়ে ভাসতে থাকা শেষ আগুনের ফুলকিটাও নিভে গেলো। উজ্জয়িনীকে ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সৌজন্য বলে উঠলো,

-কিছু কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত ফোনে নয় ম্যাম, মনে বন্দী করে রাখা উচিত। নইলে মুহূর্তগুলোকে অপমান করা হয়। সব মুহূর্তের এভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি তুলে রাখবেন না! এতটা যান্ত্রিক হবেন না। মুহূর্তগুলো মন দিয়ে উপভোগ করুন। ওদের মনে রাখুন, ফোনে নয়! ক্যামেরায় ফোকাস করতে গিয়ে, আপনি নিজেই মুহূর্তগুলো মিস করে যাবেন। করবেন না এটা! এখন ফোন কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে, আমরা একসঙ্গে আতসবাজির আলোটা দেখতে পেলাম না। নইলে দুজন একসঙ্গে দেখতাম। দুজনের স্মৃতিতে এই মুহূর্তটা চিরকাল বেঁচে থাকতো....

ফোনটা ফিরিয়ে দিলো সৌজন্য। 

-আমার গলা শুকিয়ে গেছে।

সৌজন্য নিজের গলায় গ্লাসটা সবে উপুড় করতে যাচ্ছিলো। ঠোঁটে ঠেকানো গ্লাসটা আবার ঠোঁট থেকে নামিয়ে এগিয়ে দিলো উজ্জয়িনীর দিকে। 

-আচ্ছা সৌজন্য?
-বলুন?
-তুমি আমার সম্পর্কে এখন কি ভাবছো?
-কি ভাববো ম্যাম?
-এই যে তুমি একবার অ্যাপ্রোচ করতেই আমি তোমার সঙ্গে এককথায় এখানে চলে এলাম, হোটেলের রুম শেয়ার করার প্রস্তাবটাও আমিই দিলাম, আবার এখন একটা গ্লাস শেয়ার করে তোমার সঙ্গে ড্রিঙ্কও করছি। কতটা চিনি আমি তোমাকে? তাও তো এসব করছি। এগুলো দেখে তুমি কি ভাবছো আমার সম্পর্কে? আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?
-আপনি খুব তাড়াতাড়ি মানুষকে বিশ্বাস করেন। আমাকেও করেছেন। যে বিশ্বাসের মর্যাদা আমাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাখতে হবে। অনেক বড় দায়িত্ব আমার কাঁধের ওপর এসে পড়েছে। এটাই ভাবছি! 
-তোমার মনে হচ্ছে না, আমার চরিত্র ভালো না!
-ছি-ছি! একদমই না। এসব ভাবার সাহস নেই আমার। ভাবতেও চাই না। 
-জানো সৌজন্য, লেখক-লেখিকারা নাকি ব্যক্তিগত জীবনে কোনোদিন সুখী হতে পারে না! তাদের সংসারে সবসময় আগুন জ্বলে! 
-প্রেমের আগুন?
-মজা করছো?
-না! মজা কেন করবো? আপনার লেখা পড়ে আমার চারপাশে দাউদাউ করে প্রেমের আগুন জ্বলে। তাই বলছি। চরিত্রহীন আপনাকে হতেই হবে ম্যাম। বারবার প্রেমে না পড়লে চরিত্রহীন হওয়া যায় না। আর নিজে বারবার প্রেমে না পড়লে সৃষ্টি করা যায় না। আমি নিজেই কতবার আপনার সৃষ্টি করা চরিত্রের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছি! তখনই কল্পনায় আপনার সঙ্গে কত কথা বলেছি, ঝগড়া করেছি। আপনি প্রেমে পড়ুন ম্যাম! বারবার পড়ুন। নাহলে আমরা প্রেমে পড়বো কি করে! 
-এ প্রেম সে প্রেম নয় সৌজন্য। তুমি ঠিক বুঝবে না।
-বুঝবো নাই তো! আপনার মত করে বুঝতে পারলে, ভাবতে পারলে, আপনার-আমার কোনো পার্থক্যই থাকবে না যে! আমি শুধু পড়বো, অনুভব করবো। ভালো লাগলে ভালো বলবো, খারাপ লাগলে খারাপ বলবো। এর বেশি বুঝতে গেলে ভারী সমস্যায় পড়ে যেতে হবে যে! গ্লাসটা দিন ম্যাম। হাওয়াটা লেগে আমার তো ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আর রুমে গিয়ে কাজ নেই। ম্যাম?
-উম?
-আপনার কাছে একটা আবদার করি?
-কি?
-আপনার চারপাশে প্রতিনিয়ত গল্প ঘুরে বেড়ায় বললেন যে, সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে একটা অনুরোধ করবো, রাখতে হবে কিন্তু!
-বলো?
-এক্ষুণি আমাকে একটা গল্প বলুন না? আপনার লেখা? না মানে ভাবা! এখন লিখবেন কোথায়? যাহোক কিছু একটা ভেবেই বলুন। বলুন না ম্যাম?
-এ কি আবদার?
-প্লিজ ম্যাম? লেখিকাকে নিজের এত কাছে পেয়ে তার মুখ থেকে গল্প শোনার লোভ সংবরণ করা বড় কষ্টকর যে! কিছু একটা বলুন না!
-আরে আমি কি গায়িকা নাকি, যে গাইতে বললে দু-কলি গেয়ে শোনাবো? এভাবে হয় নাকি?
-আপনিই তো বললেন এভাবেই গল্প হয়। বলুন না প্লিজ!ম্যাম!!

অমায়িক হাসি হেসে উঠলো উজ্জয়িনী। ছেলেটার এই অবদারের সুরে "ম্যাম" বলে আদুরে ডাকটা বড় মিষ্টি লাগে শুনতে। গত দুদিন ধরে উজ্জয়িনী এই ডাকটাই শুনছে। তবুও যেন শুনে-শুনে মন ভরে না। সারাক্ষণ ধরে শুধু শুনেই যেতে ইচ্ছে করে। উজ্জয়িনীর বাঁধভাঙা হাসির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সৌজন্য। একরাশ অবাধ্য চুল ম্যামের মুখের ওপর এসে পড়েছে। মার্জিত কণ্ঠে সৌজন্য আবারও বললো,

-বলুন না ম্যাম!
-কি গল্প শুনতে চাও বলো?

লাফিয়ে উঠে উজ্জয়িনীর একেবারে মুখোমুখি বসলো সৌজন্য। 

-আপনার যা খুশি!
-সেভাবে যদি ভাবতেই হয় সৌজন্য, তবে আমি কিন্তু এখন এইখানে একটা দুর্দান্ত গল্পের প্লট পেয়ে যাচ্ছি। 
-কোথায়? কোনখানে?
-এই যে, তোমার-আমার মাঝখানে! তোমাকে-আমাকে ঘিরে!
-আমাদের ঘিরে? বুঝলাম না তো ঠিক!
-দুজন মানুষ, সম্পূর্ণ দু-প্রান্ত থেকে এসে একজায়গায় হঠাৎ মিলিত হয়। তারপর তাদের আলাপ হয়, তারপর তাদের মধ্যে একটা অসমবয়সী বন্ধুত্বও হয়। তারপর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। আর তারপর....
-তারপর কি ম্যাম?
-জানিনা সৌজন্য। আপাতত তো এতটাই হয়েছে। তারপর তাদের দুজনের জীবন কোন খাতে প্রবাহিত হবে, আমি কি করে জানবো বলো? যে কয়েকটা মুহূর্ত তারা এখন একসঙ্গে কাটাচ্ছে, ভবিষ্যতে এই মুহূর্তগুলো তাদের জীবনে গভীর কতটা প্রভাব ফেলবে, তা তো এখন আমারও অজানা সৌজন্যবাবু!
-এই সব অজানার মধ্যে কি, আপনার জানা কিচ্ছু নেই ম্যাম?
-আছে তো!
-কি আছে?
-এই মুহূর্তটুকু! যেটা আমরা এখন বাঁচছি। চলো সৌজন্য, এই আনন্দে হাই-ফাইভ! দাও তালি!

নিজের ডান হাতটা সৌজন্যর দিকে হাসিমুখে এগিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য ওই হাতে তালি দিলো না। বরং ধীরে-ধীরে নিজের বাঁ হাতটা উজ্জয়িনীর ডান হাতের ওপর আলতো করে ছুঁইয়ে রাখলো। উজ্জয়িনী হাত সরিয়ে নিলো না। সৌজন্যর হাতের তালুর উষ্ণতা, স্পর্শ করলো উজ্জয়িনীকে। ওর আঙুলগুলোও পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি করলো। ওর আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে, উজ্জয়িনীর আঙুলগুলো নিয়ে পিয়ানোর মতো খেলতে-খেলতে, সৌজন্য সজোরে ওর হাতটাই চেপে ধরলো। 

-এটা কি হলো সৌজন্য?
-ম্যাম আপনিও আমার হাতটা চেপে ধরুন!
-কেন ধরবো?
-ধরুন না। এটা একটা খেলা!
-সৌজন্য তুমি বড্ড ছেলেমানুষ!
-ধরুন না ম্যাম!

একটু হেসে সৌজন্যর হাতটা চেপে ধরলো উজ্জয়িনী। দুজনের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে চেয়ে উজ্জয়িনী বলে উঠলো,

-কি খেলা এটা?
-দেখুন-দেখুন ম্যাম! কাল থেকে একসঙ্গে কাটানো আমাদের সব মুহূর্তগুলো, দুজনের হাতের মুঠোর মধ্যে বন্দী! ওরা আর কোনোদিনও হারাবে না। আমরা হারাতে দেবো না। 
-মুহূর্তেরা বন্দী? তাই না সৌজন্য?

উজ্জয়িনীর হাতটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ওর দিকে চেয়ে সৌজন্য বলে উঠলো, 

-হ্যাঁ ম্যাম! মুহূর্তেরা বন্দী!

(চলবে....)

ছবি : সংগৃহীত
শুরু হচ্ছে লালমাটি থেকে প্রকাশিত আমার বই 'ত্রিভুজ' 'সূর্যোদয়ের আগে' এবং 'নির্বাক' এ বিশেষ ছাড়। আগামী ৮ জুন পর্যন্ত লালমাটির বই ঘরে বসে ২২-২৫ শতাংশ ছাড়ে হাতে পান শুধুমাত্র
পাঠকবন্ধুতে। হোয়াটসঅ্যাপ করুন 7439112665 নম্বরে বা ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে—

লিঙ্ক - Click to buy




 

বৃহস্পতিবার, ৩ জুন, ২০২১

মুহূর্তেরা বন্দী (তৃতীয় পর্ব)


 



মুহূর্তেরা বন্দী


সাথী দাস


তৃতীয় পর্ব







বহুদিন পর সারাটা দুপুর ভাতঘুম দিয়ে কাটিয়ে দিলো উজ্জয়িনী। ঘুম থেকে উঠে ও কিছুক্ষণের জন্য সকাল না বিকেল, ভোর না সন্ধ্যে, কিছুই বুঝতে পারছিলো না। শেষ পর্যন্ত ঘড়ি দেখে বুঝলো, জীবনের অমূল্য কিছু মুহূর্ত ও ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। দুপুরে মাম্মামের সঙ্গে একবার কথা হয়েছে। তারপর ফোন অন ছিলো। কাল সারারাত একমাত্র মেয়ে বাড়ি ফেরেনি। মা ফোন করে এত কান্নাকাটি করছিলো, যে নিজের এই হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্য উজ্জয়িনীর একটু খারাপই লাগছিলো। মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ও সেই যে ঘুমিয়ে গেছে, একেবারে সন্ধ্যে পার করে উঠলো। বিকেলে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়া, একটু প্রকৃতির মাঝে বেড়ানো, কিছুই হলো না। রিসিভারটা কানে তুলেও নামিয়ে রাখলো উজ্জয়িনী। চা-স্ন্যাকস আর কটেজে আনিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক, খেয়েও আসা যাক। ঢিলে পোশাক ছেড়ে, একটা স্কার্ট আর টপ পরলো উজ্জয়িনী। অনেকদিন পর খুব যত্ন সহকারে মনের মতো করে নিজেকে সাজালো। কাজল দিয়ে চোখ আঁকলো বহুক্ষণ ধরে। পছন্দের লিপশেডে রাঙিয়ে নিলো নিজের ঠোঁটদুটো। সবশেষে চুলগুলোতে আর চিরুনিই ছোঁয়ালো না। স্বাধীনভাবে মনের আনন্দে মাথার ওপর বিচরণ করার জন্য ওদের সম্পূর্ণ খুলে এলোমেলো করে দিলো। সবশেষে চোখে চশমা পরে, ভালোভাবে দেখলো আয়নার দিকে। এতটা সাজার পরিশ্রম বিফলে যেতে দেওয়া উচিত নয়। বরাবরের অভ্যেসমত সঙ্গে-সঙ্গে নিজের একটা ছবি তুলে, মন ভালো থাকার বিশেষ মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখলো উজ্জয়িনী। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, বেশ কয়েকটা মেইল এসে জমা হয়েছে। উজ্জয়িনী ঠিক করেছে, এই কটাদিন শুধু নিজের সঙ্গে সময় কাটাবে। আর কোনো কাজ নয়। সমস্ত প্রকাশনীর মেইলগুলো স্ক্রোল করে গিয়ে, একটা মেইলে ও এসে থমকে গেলো। দীপ্ত পাঠিয়েছে। এই ছেলেটার কাজগুলো একটু দেখতে হবে। ফোনটা হাতে নিয়ে কটেজের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো উজ্জয়িনী। হলঘরের টেবিলের এককোণে বসে সপ্রশংস দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে ও চেয়েছিল। দীপ্তর এক-একটা কাজ দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়। ঠিক কতটা যত্ন আর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে একজন শিল্পী এভাবে কল্পনার বাস্তবায়ন ঘটায়, ওই ছেলেটিকে সামনে বসিয়ে একটু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো! কফির মগটা ঠোঁটে ছুঁয়ে চশমার ওপর দিয়ে হঠাৎই উজ্জয়িনী দেখলো, রিসেপশন থেকে একজন পুরুষ ওর দিকেই চেয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি নামিয়ে নিলো উজ্জয়িনী। আবার ফোনের স্ক্রিনে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু ওর মন বললো, ওই মানুষটা দু-পা এগিয়ে যাবার তিন পা পিছিয়ে গেলো। কিছু কি বলতে চায় ওকে! আশেপাশের টেবিলগুলো বেশিরভাগই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। একেবারে কোণের দিকে দুটো টেবিলে মানুষজন বসে রয়েছে। একটা ছোট বাচ্চা কান্নাকাটিও করছে। হলের ভিতরে প্রবেশ করলো ওই পুরুষটি। স্ক্রিনের ছবিতে দীপ্তর একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট দেখছিলো উজ্জয়িনী। ও মনে-মনে গুনতে শুরু করলো,

"এক-দুই....."

-গুড এভনিং ম্যাম! 

"এসেই গেলো তবে!"

কফি মগটা হাত থেকে নামিয়ে রাখলো উজ্জয়িনী।  একবার চোখ তুলে দেখে নিলো তাকে। বয়স বড়জোর ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। মানুষটা শৌখিন ও বিত্তবান। নিজের যে বিশেষ যত্ন নেয় সেটা গালের পরিপাটি করে ট্রিম করা দাড়ি থেকে শুরু করে, হাতের মূল্যবান ঘড়িটা দেখলেই বোঝা যায়। ছেলেটির পরনে একটা টি শার্ট, হাফপ্যান্ট, গলায় মস্ত বড়-বড় কানওলা একটা হেডফোন ঝুলছে। মুখে চাপা উত্তেজনামিশ্রিত একটা হাসি। দৃষ্টি চঞ্চল হলেও বেশ মার্জিত। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উজ্জয়িনী চেয়ে রইলো তার দিকে। সহাস্যবদনে সে বললো,

-আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি কি এই চেয়ারে একটু....
-না।

উজ্জয়িনীর শান্ত উত্তর।

-এক্সকিউজ মি?

হতভম্ব হয়ে সেই পুরুষটি বলে ফেললেন।

-না! এত চেয়ার-টেবিল আশেপাশে ফাঁকা পড়ে রয়েছে। আপনি এই চেয়ারেই কেন বসবেন? না। আমি অনুমতি দিলাম না।

আত্মপ্রত্যয়ী উজ্জয়িনীর দৃঢ় কণ্ঠস্বর। বিন্দুমাত্র না দমে সেই পুরুষ বললেন,

-আপনি জানেন আমি কে?
-জানতে আগ্রহী নই!
-ম্যাম! আমি এই গোটা রিসোর্টের ওনার সৌজন্য রায়। এই রিসোর্ট, প্রত্যেকটা কটেজ, এমনকি এই চেয়ার টেবিলগুলো সব আমার।

ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে হাসিমুখে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো উজ্জয়িনী। সৌজন্য ওর হাতে হাত রাখতেই উজ্জয়িনী বলে উঠলো,

-হ্যালো মিস্টার রয়! আরে আমি তো আপনাকেই খুঁজছিলাম। নাইস টু মিট ইউ! বসুন-বসুন। কয়েকটা কথা আপনাকে জানিয়ে রাখি। একবার গিজার চালালে সারাদিন ধরে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ছে। জল ঠিকমতো গরমও হচ্ছে না। ওয়াশরুমের আলোটা কিছুটা সিসিটিভি ক্যামেরার মতো কাজ করছে। টুয়েন্টিফোর আওয়ার সার্ভেলিয়েন্স! কিন্তু চব্বিশ ঘন্টাই নিভে রয়েছে। সুইচ টিপলেও আলো জ্বলে না। নেহাৎ আমি সোলো ট্রিপে আছি, তাই দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন পড়ছে না। কিন্তু আপনি এই বিষয়গুলো একটু দেখে নেবেন। আপনার ব্যবসার উন্নতির স্বার্থেই বলছি!

চেয়ারে হাত রেখে সবে বসতে যাচ্ছিলো সৌজন্য। ভুরি ভুরি অভিযোগের তালিকা শুনে লাফিয়ে উঠে বললো, 

-সরি!! মানে আমি এখানকার কর্মচারী! এগুলো ম্যানেজার বা স্যারকে গিয়ে বলতে হবে!

আলাপ করতে আসা পুরুষটির স্বতঃস্ফূর্ত উজ্জ্বল মুখমন্ডল দপ করে নিভে যাওয়ায়, বেজায় হাসি পেয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। ও এবার সত্যিই হেসে ফেললো। 

-আরে ভয় পেয়ে গেলেন নাকি? নিজেকে এত তাড়াতাড়ি তালগাছ থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে হবে না। বসুন-বসুন! 
-থ্যাঙ্কু ম্যাম। সত্যিই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বৈকি! প্রথম আলাপেই আমার পরিচয় পেয়ে, আপনি যেভাবে বকে-ধমকে অভিযোগ জানাতে শুরু করলেন....

চেয়ারটা টেনে নিয়ে উজ্জয়িনীর মুখোমুখি বসে পড়লো সৌজন্য। 

-ম্যাম আর একটা কফি প্লিজ! আমার সঙ্গে? আমার বাড়িতে আপনি এসেছেন, সামান্য একটু আপ্যায়ন করার সুযোগ দিন!
-বেশি আপ্যায়নের জন্য আবার চড়া মূল্য দাবী করে বসবেন যে!
-আরে নানা, কি যে বলেন! আসছি একটু....

তরতর করে উঠে গিয়ে কিসব যেন অর্ডার দিয়ে আবার ফিরে এলো সৌজন্য। হাসিমুখে বললো,

-এভাবে আপনার মুখোমুখি বসে যে কোনোদিনও কথা বলবো, চা-কফি খাবো, আমি তো ভাবতেই পারিনি। কল্পনায় তো কত কি....
-আপনি আমাকে চেনেন? এমনভাবে কথা বলছেন, যেন....
-উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত! "ফিরে চাই তোমাকে" , "হলুদ পাখিটা হারিয়ে গেছে" , "আবর্ত", "গোধূলিবেলায়"....
-হুম বুঝেছি! থামুন!
-কি হলো ম্যাম?
-কিছু না।
-বলুন না?
-আসলে আমি এইসব কাজ, লেখালেখি, বুক ক্রিটিকস, রিভিউয়ার, প্রোমোশন, পাবলিশারের প্রেশার, রিডার বেস, ফ্যানপেজ, পাইরেটেড পিডিএফ, রয়্যালটি, পার্সেন্টেজ, রাইটার্স ফোরাম, পাবলিশার্স গিল্ড, প্রোডাকশন কপিরাইট, কন্টেন্ট কপিরাইট, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, কন্ট্রাক্ট, গাদাখানেক ক্লজ, এগ্রিমেন্ট...
-এতকিছু? একটা বইয়ের জন্য? ওরে বাপরে!
-হুম! এতকিছুই। একটা বই মানে শুধুমাত্র লেখক বা লেখিকা কতগুলো রাত জেগে পড়াশোনা করে মাথা-ঘাড় যন্ত্রণায় ছিঁড়ে গিয়ে টাইপ করে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা নয়, প্রেসে সেটা ছেপে দেওয়াও নয়, পাতার পর পাতা উল্টানোও নয়। বরং আরও অনেক কিছু। তার অক্ষরবিন্যাস, সম্পাদনা, প্রচ্ছদ! এক একটা বই রিলিজের আগে একটা গোটা টিম দিনরাত এক করে কাজ করে। এসব ছাড়াও বইবাজারের কম্পিটিশন আর পলিটিক্স তো ছেড়েই দিলাম। এসবের স্ট্রেস আপনার হোটেলের ব্যবসার থেকে কোনো অংশে কম নয় সৌজন্য। যদিও এই স্ট্রেসটাই পার্ট অফ মাই প্রফেশন। তবুও, মানুষের তো ছুটি নিতে ইচ্ছে করে। একটু সময় বের করে নিজের জন্যও ভাবতে ইচ্ছে করে। তাই আমি এই সবকিছু থেকে নিজেকে কিছুদিনের জন্য একটু দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। সে যাক গে! তারপর বলুন, আপনি আমার কি কি লেখা পড়েছেন? আর কোন লেখা সবচেয়ে ভালো লাগলো আর কেন? খারাপ লাগলেও কেন?
-এত ফর্মালিটিজের দরকার নেই ম্যাম! আমি বুঝেছি। 
-থ্যাঙ্কু সৌজন্য। আসলে খুবই ভালোলাগে কেউ এসে আমার কাজ সম্পর্কে আমার সঙ্গে কথা বললে! কিন্তু জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত এমন থাকে, এতটাই স্পর্শকাতর....
-যে মুহূর্তে ভালো কিছুও আর ভালো লাগে না। 
-রাইট!
-আপনি অহেতুক মনের ওপর এত চাপ নেবেন না ম্যাম! আমি আপনার অফিসিয়াল পেজের ব্লাইন্ড ফলোয়ার হলেও, আপনার অন্যান্য রিডারের সঙ্গে আমার কিন্তু অনেকটাই পার্থক্য আছে। আমি আপনাকে বুঝবো।
-তাই বুঝি? তা কিরকম পার্থক্য? সবাই চোখ খুলে পড়েন। বই, পিডিএফ যেটাই হোক। আর আপনি বুঝি চোখ বন্ধ করে পড়েন?
-কি যে বলেন না ম্যাম! 
-নয়? তাহলে আপনি লেখা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখিকাকে নিজের সামনে কল্পনা করে, তার সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথন করে থাকেন নিশ্চয়ই। সে কেন এমনটা করলো? তাকে সামনে পেলে খুব করে ঝগড়া করতেন!

মাথা নামিয়ে হেসে ফেললো সৌজন্য....

-সত্যি নাকি এগুলো? এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আপনি শুধু লেখাই নয়, সঙ্গে লেখিকাকেও অ্যাডমায়ার করেন বলতে হয়। 
-এই রে!! এটা বুঝলেন কি করে? ম্যাডাম! প্লিজ আমার মাইন্ড রিড করা বন্ধ করুন।
-ইচ্ছেও নেই। বড় আবর্জনা সেখানে।
-কি করবো বলুন! আপনার মতো পরিণতমনস্কা তো আর নই। একজন পঁচিশ বছরের যুবকের মাথায় আপনার মত চিন্তাধারা কাজ করবে, এটা তো আশা করাই উচিত না। 
-বয়সের খোঁটা দিচ্ছেন?
-ধুর না! আপনি নিজেকে যেভাবে মেইনটেইন করছেন, কে বলবে আপনি চল্লিশ পেরিয়েছেন!! আপনার প্রশংসাই তো করছি। আপনি এখনো সুইট সিক্সটিন!
-প্রশংসা বা সমালোচনা, দুটোই যৌক্তিক হওয়া প্রয়োজন সৌজন্য। এটা বাড়াবাড়ি রকমের অযৌক্তিক কমপ্লিমেন্ট! একদমই নেওয়া গেলো না।
-সত্যি!
-কিভাবে জানলেন আমি চল্লিশ পেরিয়েছি?
-বিগত পাঁচ বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো জোঁকের মতো স্টক করছি আপনাকে। একটা পোস্টও মিস করি না! কিন্তু কোনোদিনও কোনো পোস্টে আমার রিয়্যাক্ট নেই। এমনকি আপনার জন্মদিনে একটা উইশও করিনি! হা হা হা!! তবে স্বপ্ন দেখতাম জানেন, আপনার মতো লেখিকার মুখোমুখি কোনো একদিন দাঁড়াবোই। তবে সেটা অবশ্যই কোনো বইমেলার ভিড়ে নয়, নিভৃতে... একান্তে! একেবারে ব্যক্তিগত পরিসরে। আমাদের দেখা হবে একদম অন্যরকমভাবে, যেটা সারাজীবন আমার মনে থাকবে। আমি আপনার হাজার হাজার পাঠকের ভিড়ে হারিয়ে যেতে রাজি নই। 

হেসে ফেললো উজ্জয়িনী।

-ম্যাম! প্লিজ প্লিজ! আপনি আমার মাইন্ড রিড করবেন না!! নইলে কিন্তু আমাকে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে।

কথাবার্তার মধ্যেই একগাদা স্ন্যাকস আর কফি এসে যাওয়াতে উজ্জয়িনী ও সৌজন্য দুজনেই বকবক করতে-করতে, ডান হাতের কাজ শুরু করলো। 

-জানেন ম্যাম, আমি কিন্তু আপনার একটা বইও কিনে পড়িনি। সব বন্ধুদের থেকে ধার করে। 
-তাই নাকি!
-ধার করে পড়ার মজাই আলাদা। তবে প্রতিবারই ফেরত দিয়ে দিয়েছি। বই নিয়েছি আর ফেরত দিইনি, এটা আমার শত্রুও বলতে পারবে না। 
-আচ্ছা আপনি বললেন না তো, অন্যান্য রিডারের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কি?
-বড় কিছু ভাবলে, বড় কিছু সত্যিই হয়। যখনই আপনার লেখা পড়ে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেলতাম, তখনই কল্পনায় আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতাম। আর ভাবতাম, আপনি বড় নিষ্ঠুর। কিছুতেই কোনো বইমেলায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে ছুটে যাবো না। চাই না আপনার সই। কিনবো না আপনার বই! আপনার সঙ্গে অনেক হিসেব-নিকেশ তুলে রাখা আছে। সেটা একান্তে মিটিয়ে নেব। আর আজ যখন আপনাকে সকালে সুইমিং পুল থেকে....
-থামলেন কেন?
-না মানে সকালে যখন চাবি নিয়ে আপনি রুমে গেলেন, তখন থেকেই আমার হাত-পা কাঁপছিলো।
-সেকি! কেন? 
-আপনার সঙ্গে কথা বলবো কি বলবো না, ভেবেই পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করে আশাতীত কিছুর সামনে পড়ে গেলে, চট করে নিজেকে সামলানো যায় না। কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না ঠিক!
-কিন্তু আমি তো জানতাম আপনি কথা বলবেন। 
-আপনি জানতেন?
-অফ কোর্স! কথা বলার জন্য ছটফট করছিলেন তো আপনি। কিন্তু আমি যে আপনার পূর্বপরিচিতা, এটা জানতাম না।
-আপনি আমাকে নোটিশ করেছেন? আমি মোটেও ছটফট করিনি!

কফির কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে চেয়ারে নিজেকে হেলিয়ে, সৌজন্যর দিকে স্থির দৃষ্টিপাত করে উজ্জয়িনী বললো,

-সে আপনি এখন অস্বীকার করতেই পারেন। 
-সরি! হ্যাঁ। অস্থির লাগছিলো কথা বলার জন্য। আপনি জানলেন কি করে?
-অবজারভেশন পাওয়ার। হেব্বি স্ট্রং বুঝলেন তো! আপনার ভাবনারও ঊর্ধ্বে। 
-মানতেই হবে! 
-নিশ্চয়ই। একজন আমাকে দেখলে আমি জানবো না?
-তাহলে আমাদের ওই অপবাদটা কি ঘুচলো?
-কোনটা?
-শুধুমাত্র ছেলেরাই মেয়ে দেখে!?
-ছেলেদের থেকে অনেক বেশি মেয়েরা ছেলে দেখে। কোন যুগে পড়ে আছেন বলুন তো আপনি? আসলে ওসব ছেলে-মেয়ে কিছু না সৌজন্য। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সুন্দর কিছু দেখতে সবারই ভালোলাগে। এটাই ভীষণ স্বাভাবিক! সৌন্দর্য দেখে আপনি যদি সাময়িকভাবে মুগ্ধ না হন, তবে ধরে নিতে হবে আপনার অনুভূতির মৃত্যু হয়েছে। কি হলো? কি ভাবছেন? তাকিয়ে আছেন কেন?
-তবে আমার অনুভূতির মৃত্যু হয়নি বলছেন? আমি সুন্দর কিছু দেখে এই মুহূর্তে মুগ্ধ! 
-এই কফি মগটা ঠাঁই করে ছুঁড়ে মারবো!
-সে মারুন। তবে ভাঙলে দাম দিতে হবে। কফি মগের নয়, আমার ভাঙা মাথার দাম! আমার কিছু হলে, আমার পাপা কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না!

সৌজন্য আর উজ্জয়িনীর সম্মিলিত হাসিতে গোটা হলঘর মুখরিত হলো। উজ্জয়িনী অতিকষ্টে নিজের হাসি থামিয়ে বললো,

-সাংঘাতিক বিচ্ছু তো আপনি! এক মুহূর্তের মধ্যে আমার মুখের কথাটা প্রয়োগও করে ফেললেন?
-এই মুহূর্তটুকুই তো সব ম্যাম!
-হুম! ট্রু!!
-আপনাকে দূর থেকে দেখলে খুব রাশভারী, ব্যক্তিত্বময়ী মনে হয়। কিন্তু গাম্ভীর্যের বেড়াজাল টপকে একটু কাছ থেকে দেখলে....
-কি বলছেন? আমার ইমেজের আলগা মুখোশটা আপনার সামনে খুলে গেছে বলছেন? মেন্টেইন করতে পারছি না?
-আমি অন্তত আলাপের প্রথম থেকে কোনো মুখোশ দেখিনি ম্যাম। যতটুকু মুহুর্ত আপনার সঙ্গে কাটিয়েছি, লেখিকা উজ্জয়িনী সেনগুপ্তর চেয়েও, মানুষ উজ্জয়িনী সেনগুপ্তর সান্নিধ্য বেশি উপভোগ করেছি।

কয়েক মুহূর্তের অপার নিস্তব্ধতার পর উজ্জয়িনী বলে উঠলো,

-আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
-ব্যক্তিগত?
-নানা। আপনার একেবারে ব্যক্তিগত পরিসরে আমার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু আপনি একটা বিষয় একটু খোলাখুলি বলুন দেখি। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে এতবড় বিজনেসম্যান? বলি ইনভেস্টমেন্টের জন্য ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছেন নাকি?
-আপনি সৌগত রায়ের নাম শুনেছেন ম্যাম?
-বিজনেস টাইকুন সৌগত রায়? রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের....
-ইয়াপ! ফার্স্ট রয় ইজ সৌগত রায়। সেকেন্ড ওয়ান ইজ...
-কি বলছেন আপনি!!
-ইয়েস! আমি সৌগত রায়ের একমাত্র উত্তরাধিকারী...
-সৌজন্য রায়?!
-হ্যাঁ! এ সবই পাপার ব্যবসা। লোক আছে। তবুও আমি একটু দেখেশুনে রাখি! পাপার জন্য বেরোতেই হয়। পাপার বয়স হচ্ছে। হার্টেও কিছু সমস্যা আছে। তাই দূরে কোনো কাজ থাকলে আমিই বেরিয়ে পড়ি। পড়াশোনা শেষ করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। পাপা কান ধরে বিজনেসে ঢুকিয়ে দিলো। এখনও সেভাবে মাথা ঘামাই না। ওই ওপর-ওপর একটু দেখি। সেই কারণে মিডিয়ার চোখে পড়িনি। নইলে এতদিনে পরিচিত মুখ হয়ে যেতাম। যতদিন পালিয়ে থাকা যায় আর কি!
-আরে বাপরে! বিশাল ব্যাপার তো! আমি এত গণ্যমান্য একজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছি, আগে জানলে....
-প্লিজ ম্যাম! আপনার কাছে আমি শুধু একজন পাঠক। এর বেশি আমার নিজের কোনো পরিচয় নেই। বাবার ব্যবসা, বাবার পরিচয় ভাঙিয়েই খাই। আসলে আমার বাড়িতে ঠিক পড়ার পরিবেশ নেই। শুধু টাকা আর টাকা। লক্ষ্মী আর সরস্বতীর চিরকালীন বিবাদ আমার বাড়িতে। বইয়ের পাতা থেকে মনকে টেনে বের করে শেয়ার মার্কেটের খবরে বসাতে হয়, শুধুমাত্র পাপার জন্য। তার মধ্যেও ছোটবেলা থেকেই মাকে একটু আধটু বই পড়তে দেখতাম। সেই থেকেই কেমন যেন একটা নেশা চেপে ধরেছে। এটা মায়ের দিক থেকেই এসেছে। ট্রলিতেও বই নিয়ে ঘুরি এখন। ক্লাসিক লেখা বেশ কিছু পড়েছি। আর এখনকার লেখার মধ্যে আপনার বেস্ট সেলার লেখাগুলোই পড়েছি। সত্যি বলছি ম্যাম, আপনার লেখাও সব পড়া হয়ে ওঠেনি। তাই যেটুকু পড়েছি, সেই সিলেবাসের বাইরে পড়া ধরলে কিচ্ছু পারবো না। কারণ বিশাল কিছু পড়ুয়া নই আমি। সাহিত্যের বেশি কিছু বুঝিও না। সামান্য ভালোলাগা থেকেই পড়ি।
-বাঃ! ভালো তো। তা সৌজন্য, আপনাদের এতরকম ব্যবসা ছেড়ে, শেষ পর্যন্ত হোটেলের ব্যবসাই কেন? তাও এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায়? এটা তো সেরকম কোনো ট্যুরিস্ট স্পটও না। বেসিক রিসোর্সেস....
-দেখুন ম্যাম। পাণ্ডববর্জিত জায়গা বলবেন না। আজ যেটা মরুভূমি, কঠিন পরিশ্রম করলে কাল সেখানেই জনবসতি গড়ে তোলা যাবে। আর এটাই তো আমার প্লাস পয়েন্ট। যে এখানে তেমন কোনো জমকালো হোটেল নেই। তাই কম্পিটিশনও কম। প্রথম থেকে পুরো ব্যবসাটা আমি একাই পেয়ে যাবো। 
-ব্রিলিয়ান্ট! 
-ক্রেডিটটা আমার পাপার ম্যাম! কারণ কথাটা আমার পাপার। আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। আর যদি হোটেলের ব্যবসার কথাই বলেন, আপনি বাঙালির বেড়ানো বন্ধ করতে পারবেন? মরতে মরতে হলেও বছরে একবার বাঙালির ঘুরতে বেরোনো চাই। রিফ্রেশমেন্টের জন্য!
-বা হয়তো জীবনে ফেরার জন্য!
-তাও ঠিক। আসলে মাছ-ভাত আর ভ্রমণ, এই তিনটে না থাকলে, বাঙালির জীবনটাই তেজপাতা!
-আমি ধনেপাতাটাই বেশি শুনেছি।
-আরে না! তেজপাতার ফ্লেভারটুকু পেয়ে যাওয়ার পর, তাকে জাস্ট রান্না থেকে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। চিবিয়ে তো আর খাওয়া হয় না। তাও তো ধনেপাতার আগামুড়ো সবটাই কাজে লাগে। তাই তেজপাতা! 
-পয়েন্ট!
-ম্যাম আপনি এখানে কতদিনের জন্য এসেছেন?

মুখের চওড়া হাসি মিলিয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। সামান্য হেসে ও বললো,

-জানিনা। দেখা যাক। যতদিন মন টানবে, ততদিন থেকে যাবো মুহূর্তগুলোকে আঁকড়ে!
-ম্যাম, আপনি কি আপসেট কোনো কারণে?
-উঠলাম!
-এই কেন?
-একি! আপনার সঙ্গে বসে বসে আড্ডা দেবো নাকি? এমনিতেই আজ সারা দুপুর ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। একটু আশেপাশে ঘুরে দেখি, ফলতা আপনাকে ঠিক কতটা ব্যবসা দিতে পারবে! তার সান্ধ্য সৌন্দর্য কেমন!
-ম্যাম একটা আবদার আছে। আপনি না করতে পারবেন না।
-আমি অভ্যস্ত এসবে। সেলফি তো?
-একদমই না। আপনার সঙ্গে কাটানো এত সুন্দর একটা মুহূর্ত, এটাকে ফোনে বন্দী করে রাখলে এই মুহূর্তটাকে অপমান করা হয়। এটাকে তো আমি আমার মনে বন্দী করে রাখবো। সেসব নয়।
-তবে? 
-আসলে আমি ফলতা এসেছি অন্য একটা কাজে। বিজনেসের ব্যাপারেই। তবে আমার ডেস্টিনেশন আলাদা জায়গায়। এখানে একটুখানি এগিয়ে একটা বাড়িতে পাপার পরিচিত এক আঙ্কেল-আন্টি থাকেন। ওনারা এই রিসোর্টের প্রজেক্টটার সময় পাপাকে খুব হেল্প করেছিলেন। তাদের সঙ্গে একটু দেখা করার জন্য আমি আজকের দিনটা এই কটেজে স্টে করলাম। ভালোই হলো, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। লাঞ্চের পরেই আঙ্কেলের বাড়ি থেকে আমি ঘুরে এসেছি। এখানকার কাজ শেষ। কাল সকালে আমি আমার মেইন ডেস্টিনেশনে বেরিয়ে যাবো ম্যাম।
-ওকে। হ্যাপি জার্নি সৌজন্য!
-না। আমার অনুরোধটা হলো, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন।
-কোথায় যাবো আমি?
-প্লিজ ম্যাম! চলুন না! এই কটেজটা রিভারসাইড থেকে বেশ অনেকটা দূরে। আর আমাদের রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের ড্রিম প্রজেক্ট "রয় গেস্ট হাউজ" একেবারে রিভারসাইডে ম্যাম। আপনি রুমের জানলা থেকেই নদী দেখতে পাবেন। কাল সন্ধ্যেবেলা ওই হোটেলের ওপেনিং পার্টি আছে। পাপার বিহাফে ওটা অ্যাটেন্ড করতেই আমি ফলতা এসেছি। আপনি তো বেড়াতেই এসেছেন। একাই আছেন। তাহলে এখানে কটেজে থাকুন, বা রয় গেস্ট হাউজে, ব্যাপারটা তো একই। আপনার ঘোরা-বেড়ানো নিয়ে কথা! প্লিজ আমার স্পেশাল গেস্ট হয়ে আমার সঙ্গে ওখানে আসুন। কালকের পার্টি অ্যাটেন্ড করুন।এটা আমার অনুরোধ!
-দেখুন সৌজন্য, আমি একরকম মাইন্ডসেট নিয়ে এখানে এসেছি, এভাবে হঠাৎ করে শেষ মুহূর্তে বললে তো....
-মুহূর্তরা তো হঠাৎ করে শেষ মুহূর্তেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যায় ম্যাম। আমরা আনন্দ করে, সুন্দর মুহূর্তগুলোতে বেঁচে, তাদের আবার ভুলেও যাই! ম্যাম আই প্রমিস ইউ, আপনি এই ট্রিপটা জীবনেও ভুলবেন না। প্লিজ কাম উইথ মি! আমার গেস্ট হয়ে আপনি থাকবেন। প্লিজ!
-লেট মি থিঙ্ক সৌজন্য। আচ্ছা এখন আমাকে উঠতে হবে। একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি! প্লিজ এক্সকিউজ মি!

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো উজ্জয়িনী। ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো...

-ম্যাম অন্ধকার হয়ে গেছে অনেক আগেই। অচেনা অজানা জায়গা। আমি আসতে পারি আপনার সঙ্গে?
-না। আমি সোলো ট্রিপে এসেছি। আপনার সঙ্গে তো দেখা হওয়ার কথা ছিলো না সৌজন্য, ওটা জাস্ট হয়ে গেছে। না হলে কি হতো? আমি একাই তো বেড়াতাম। প্লিজ আমার পার্সোনাল স্পেসে ঢোকার চেষ্টা করবেন না।
-এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম। আমি এভাবে ব্যাপারটা ভাবিনি। আপনার সিকিউরিটির জন্যই বলছিলাম। একা-একা বেড়াবেন? তাই....সো সরি!
-হুম! বাই....

কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরোনোর আগে চেয়ার ছেড়ে উঠে সৌজন্য বললো,

-ম্যাম আমি কাল সকালে ব্রেকফাস্টের আগেই বেরিয়ে যাবো। আপনি ভাবতে কতটা সময় নেবেন? 

একটু হেসে ফিরলো উজ্জয়িনী। সৌজন্যর সামনে এসে বললো,

-ভাবলাম বুঝলেন তো! ভেবে ভেবে ভাবলাম...
-কি ভাবলেন?
-আপনার মত একজন নামী-দামী বিশিষ্ট মানুষের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করা উচিত হবে কিনা! করলে সেই রাগে যদি আপনি শহরের সবকটা প্রেস কিনে নিয়ে বলে বসেন, বয়কট উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত!! তার কোনো পাণ্ডুলিপি আর ছাপা হবে না। তখন আমার কি হবে? রুজি-রোজগার বলে কথা! চাকরী তো আর করি না। একেবারে না খেতে পেয়ে মারা পড়বো তো! তাই ভাবলাম...
-উফ! আপনি কি যে বলেন না ম্যাম! থ্যাঙ্কু সো মাচ! আমার সত্যি ভীষণ ভালো লাগছে! আমি ভাবতেই পারছি না! উফ! 
-আসছি! 
-ম্যাম রুম সার্ভিসকে বলে আপনার ওয়াশরুমের আলো আর গিজারটা....
-কাল সকালে তো চেক আউট করেই যাচ্ছি। তারপরই সারিয়ে নেবেন না হয়! একটা রাত কোনোমতে কাটিয়ে দিই! 
-ওকে ম্যাম। আসলে এই কটেজগুলো অনেক পুরোনো তো। তাই আর কি....
-এক রাতে ওদের বয়স খুব বেশি বেড়ে যাবে না। আসছি আমি। আচ্ছা কাল কটার সময় বেরোবেন?
-আটটা! আর ম্যাম একটা অনুরোধ আছে। আমি আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট। প্রায় অর্ধেকই বলা চলে। হাঁটুর বয়সী!
-মানে? আমার সঙ্গেই তো আমার হাঁটুজোড়াও পৃথিবীতে এসেছে। নাকি ওদের দশ-বিশ বছর পরে এনেছি? আমার যা বয়স, আমার হাঁটুরও তো একই বয়স। আপনি আমার হাঁটুর বয়সী মানেটা কি? 
-আরে সবাই বলে না?! আমার মায়ের মুখেও তো কথাটা শুনেছি।
-কিন্তু কথাটা তো টেকনিক্যালি ভুল!
-ওকে! হাঁটু ক্যানসেল! আমি যেটা বলতে চাইছিলাম, আমি অনেক ছোট আপনার থেকে। প্লিজ আমাকে আপনি বলবেন না। তুমি বলবেন।
-দিলে তো আমাকে আমার বয়সটা মনে করিয়ে!!
-নানা। তা নয়....
-আমি আমার রুমে ক্যালেন্ডার রাখি না। আমার কোনো তারিখ মনে থাকে না। কেন জানো?
-কেন ম্যাম?
-দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, বয়সের হিসেব, এসব আমি মনে রাখতেই চাই না। আমার বয়স যদি তোমার দ্বিগুণও হয়, সেটা ওই ক্যালেন্ডারে হবে সৌজন্য। কিন্তু মনে নয়। কবি-লেখক-লেখিকাদের, শিল্পীদের কোনোদিন বয়স হয় না। দে আর এভারগ্রিন! শোননি ওই কথাটা? ওকে বাই! কাল সকালে দেখা হবে। 
-কেন আজ রাতে? ডিনার টেবিলে?
-না। আমি কটেজেই ডিনার নিয়ে নেবো। 
-ওকে ম্যাম! তাহলে গুড নাইট!
-গুড নাইট সৌজন্য!

কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে পড়লো উজ্জয়িনী। অন্ধকারের চাদরে পৃথিবী নিজেকে ঢেকে নিয়েছে। ওর মনটা হঠাৎ করেই একদম হালকা হয়ে গেছে। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলো ও। লোকাল মার্কেটের খোঁজ করতে হবে। পাওয়ার ব্যাঙ্ক, চার্জার কিনতে হবে। ফোনের ব্যাটারি বক্স প্রায় ফাঁকা। বড় রাস্তা বরাবর তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলো উজ্জয়িনী। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশে, মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একফালি চাঁদ....

নতুন চার্জারের সাহায্যে ফোনটা ফুল চার্জ হলো। রাতে ডিনারের পর মাম্মামের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, মায়ের কান্নাকাটি, বকাঝকা একটু শুনে বিছানায় চুপ করে শুয়েছিলো উজ্জয়িনী। আজ কোন এক অজানা কারণে, ওর মনে কোনো উদ্বেগ নেই। একেবারে যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছে ও। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর আর মনেই নেই। ঘুম ভাঙলো একেবারে ভোরবেলা। উঠেই মনে পড়লো সৌজন্যর মুখটা। তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়লো উজ্জয়িনী....

কোল্ড কফিটা হোটেলের ম্যানেজার উজ্জয়িনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলো। ওটাতেই মনোনিবেশ করে উজ্জয়িনী দেখলো, ড্রাইভার ওর আর সৌজন্যর ট্রলিটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। নিজের হ্যান্ডব্যাগটা কিছুতেই কাছছাড়া করেনি উজ্জয়িনী। ওটা নিজের কাছেই রেখেছে। বিল পেমেন্ট করে ম্যানেজারকে আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে উজ্জয়িনী সৌজন্যর গাড়ির দিকে এগোলো। ওকে রিসোর্ট থেকে বেরোতে দেখেই গাড়ি ছেড়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে এলো সৌজন্য। দুজনেরই চোখ রোদ চশমার আড়ালে থাকায়, পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় সম্ভব না হলেও সৌজন্য হাসিমুখে বললো,

-গুড মর্নিং ম্যাম।
-মর্নিং সৌজন্য।

-স্যার। ম্যাডাম তো এসে গেছেন। এবার বেরোবেন তো?
-ওহ ওয়েট! আই উইল ড্রাইভ! আপনাকে আর আসতে হবে না। থ্যাঙ্কু! 

ড্রাইভারের হাতে বকশিশ গুঁজে দিয়ে গাড়ির সামনের দরজাটা খুলে দিলো সৌজন্য। উজ্জয়িনী উঠে বসলে, গাড়ির দরজা সশব্দে বন্ধ করে নিজে চালকের আসনে বসে ও সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। 

-ম্যাম যদিও আমি ভালোই গাড়ি চালাই। তবুও আপনি চাইলে সিটবেল্টটা....
-থাক না! 
-ওকে! লাইট মিউজিক? আমার মনে হয় প্রথম সকালে ধিকচিক ধিকচিক আপনার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না।
-ধিকচিক ধিকচিক বা মেলোডি, এখন কিছুই ভালো লাগবে না সৌজন্য। লেটস টক! কথা বলতে বলতে যাওয়া যাক?
-শিওর ম্যাম!

গাড়িটা কিছুটা রাস্তা চলার পরই উজ্জয়িনী দেখলো প্রকৃতি কত যত্ন করে নিজের হাতে পৃথিবীকে সাজিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। এত সবুজ দেখে, মনটাই ভালো হয়ে গেলো উজ্জয়িনীর। হঠাৎ ফাঁকা জমিতে একটা ল্যান্ডমার্ক দেখে কৌতূহলী উজ্জয়িনী জিজ্ঞেস করলো,

-সৌজন্য?
-বলুন ম্যাম?
-ওখানে রয় গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ লেখা কেন? আমরা কি এসে গেছি?
-প্রায় এসে গেছি। এখান থেকেই আমাদের রয় গেস্ট হাউজের সীমানা শুরু ম্যাম। গেস্ট হাউজের প্রজেক্টে অনেক প্ল্যানিং আছে। আসলে পুরোনো রিসোর্টটাকে শুধুমাত্র কটেজ, ট্রি-হাউজ আর টেন্ট হিসেবে রাখা হবে। আর এদিকে এটা থ্রি স্টার হোটেল হবে। ট্যুরিস্টদের যার যেমন সামর্থ্য, যেমন বাজেট, তারা তেমন জায়গাতেই থাকবে। বা কেউ যদি ট্রি-হাউজে বা টেন্টে থাকার এক্সপিরিয়েন্স চায় তো, সবরকম ব্যবস্থাই রাখা হবে। 
-মানে এখানে অন্য কাউকে আর তোমরা করে খেতেই দেবে না? ঢুকতেই দেবে না? পুরোটাই তোমাদের থাকবে। তাই তো?
-পাপার প্ল্যানিং তো সেইরকমই আছে ম্যাম। দেখা যাক! অনেকটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রজেক্ট অনুযায়ী কাজ করতে বছর দুই-তিন লেগে যাবে। পার্ক, পুল, জিম, বার কাম রেস্টুরেন্ট তো থাকছেই, তাছাড়া হোটেলের ব্যাকইয়ার্ডে নদীটাও পেয়ে যাচ্ছি আমরা! তাই হোটেল থেকেই টিকিট কেটে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও থাকবে। ওদিকে একটা জেটিঘাটও করার কথা আছে। রয় গেস্ট হাউজের মধ্যে পাপা একটা অন্যরকম জগৎ তৈরি করে ফেলবে বলেছে। যাতে উইকেন্ডে ফলতা বেড়াতে এসে রিল্যাক্স করার সময়, রিভারসাইডে যাওয়া ছাড়া ট্যুরিস্টকে আর হোটেলের বাইরে বেরোতেই না হয়। ছোট একটা মার্কেট, স্ট্রীট ফুডের দোকান, ম্যাসাজ পার্লার, স্পা, তাছাড়া কেউ যদি সময়ের অভাবে কলকাতা থেকে কাছাকাছি কোথাও ডেস্টিনেশন ওয়েডিং এর কথা ভাবে, তার জন্যও এখানে একটা এক্সট্রা কমিউনিটি হল করা হবে! রয় গেস্ট হাউজ! বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন হবে...স্বপ্ন যখন হাতের নাগালের মধ্যে....ভালো না ম্যাম?
-দারুণ!
-এটা আমি বলেছি। 
-বিশাল প্ল্যান তো সৌজন্য! 

গাড়ির গতি একটু কমালো সৌজন্য। উজ্জয়িনীকে নিজেদের জায়গার পরিসর দেখাতে-দেখাতে বললো,

-হ্যাঁ ম্যাম। আগামী পাঁচ বছরে ফলতার চেহারাই পাল্টে দেব আমরা। এখন তো ধূ-ধূ করছে ফাঁকা জমি। আস্তে আস্তে সব হবে। তবে ঘর থেকে টাকা দিয়ে তো আর হবে না। ব্যবসার টাকা দিয়েই ব্যবসা হবে। তাই বাবা আগে হোটেলের একটা অংশ দাঁড় করিয়ে দিলো। বললো, ওটা আপাতত চলুক। তাতেও কিছুটা টাকা উঠে আসবে।
অ্যামিনিটিস পরে হবে। হোটেল রমরম করে চলতে চলতেই ওদিকের কাজগুলো হবে। কিছু ট্র্যাভেল এজেন্সিকে টাকা দেওয়া হয়েছে ম্যাম। সোশ্যাল মিডিয়া তো এখন প্রোমোশনের খুব ভালো একটা প্ল্যাটফর্ম। আমাদের অফিসিয়াল পেজ আর ওয়েবসাইট থেকে ট্র্যাভেল গ্রুপগুলোতে পেইড প্রোমোশন করানোর জন্য বলা আছে। ওপেনিং এর জন্য পাপা কিছু অফারও দেবে শুনেছিলাম। শুনেছিলাম তো বিজ্ঞাপনের ভালো রেসপন্স আসছে। আজ গিয়ে দেখবো কি অবস্থা! যারা আসবে, তারা এখান থেকে ঘুরে গিয়ে পজিটিভ রিভিউ দিলে আমাদের হোটেলেরই তো প্রোমোশন হয়ে যাবে। 
-এই সব জমি তোমাদের সৌজন্য?

গাড়ি চালাতে চালাতে সৌজন্য বললো,

-হ্যাঁ ম্যাম! এসে গেছি আমরা। চলুন! 

গেট থেকে দুজন ওয়াচম্যান দৌড়ে এলো সৌজন্যর গাড়ির দিকে। ওদের একজনের হাতে চাবি দিয়ে গাড়ি থেকে ট্রলিগুলো বের করে গাড়ি পার্কিং জোনে ঢুকিয়ে দিতে বললো সৌজন্য। তারপর উজ্জয়িনীর দিকে চেয়ে বললো,

-ওয়েলকাম টু রয় গেস্ট হাউজ ম্যাম! প্লিজ আসুন!

লনে পা রেখেই হতভম্ব সৌজন্য। এত ট্যুরিস্ট! এই অফ সিজনেও! বেশ খুশিই হলো ও। সকলকে পেরিয়ে উজ্জয়িনীর সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করলো। হোটেলের সাজসজ্জা, আয়োজন দেখে উজ্জয়িনীর ভীষণই ভালো লাগলো। বাইরে কত রংবেরঙের ফুলের বাগান। কি সুন্দর পরিবেশ। ভিতরেও বেলুন দিয়ে সাজানো হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলার পার্টির প্রস্তুতির চিহ্ন দিকে-দিকে....

-ম্যাম আপনি একটু ঘুরে দেখতে পারেন। আমি রিসেপশনে কথা বলে আসছি। 
-ওকে!

সুবৃহৎ হলের মধ্যেই ঘুরতে লাগলো উজ্জয়িনী। একটু দূরে একটা সোফায় গিয়ে বসলো। 

-স্যার! গুড মর্নিং! বস বলেছিলেন, আপনি আজ সকালেই আসবেন।

বয়স বড় বেশি না ম্যানেজারের। তিরিশের আশেপাশেই হবে। মুখে চওড়া হাসি টেনে সৌজন্যকে উনি স্বাগত জানালেন। রোদ চশমা খুলে রিসেপশনে উপস্থিত সকল কর্মচারীর দিকে চেয়ে সৌজন্য বললো,

-ভেরি গুড মর্নিং টু অল অফ ইউ! প্রচুর ট্যুরিস্ট এসেছেন তো! 
-ইয়েস স্যার! আরে আজকের বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে বস তো ব্রেকফাস্ট, ডিনার, লাঞ্চ, ড্রিঙ্কস সব ফ্রি করে দিয়েছেন। 
-পাপা?
-হুম! এটাই তো বসের বিজনেজ স্ট্র্যাটেজি! যত বেশি গ্যাদারিং, তত হোটেলেরই প্রোমোশন স্যার। আজ সবকিছু আমি নিজের হাতে দেখেশুনে করছি। তাও বস সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছেন। আপনি যে পৌঁছে গেছেন, একটা ফোন করে একটু জানিয়ে দেবেন স্যার। তাহলে বস একটু নিশ্চিন্ত হবেন।
-শিওর-শিওর! বলছি শুনুন, আমার রুম রেডি তো?
-একদম স্যার। এই যে চাবি! এখানে একটা সই করে চেক ইন টাইম, মোটামুটি কতক্ষণ থাকবেন অ্যাপ্রক্সিমেট কিছু একটা বসিয়ে রাখুন। আপনি রুলস  জানেনই তো স্যার...আপনারই তো হোটেল, জাস্ট ফর্মালিটিজ। আসলে বস বলেন, রুলস সবার জন্যই এক যেহেতু....
-সেসব পরে হবে। আপনি আগে আমার কথা শুনুন। ঠিক আমার রুমের পাশের রুমটাই আমার চাই। আমার সঙ্গে একজন গেস্ট এসেছেন। উনি থাকবেন। আমার পাশের রুমটাই কিন্তু....
-সরি স্যার! আজ তো টোটাল হোটেলে আর একটাও রুম ফাঁকা নেই!!

স্তম্ভিত হয়ে গেলো সৌজন্য। তারপর বললো,

-হোয়াট! এটা কিভাবে সম্ভব?
-স্যার বসের বিজ্ঞাপনটা সোশ্যাল মিডিয়ার ট্র্যাভেল গ্রুপগুলোতে রীতিমতো ভাইরাল হয়ে ট্রেন্ডিংয়ে আছে। আর 'হুজুগে বাঙালি' কথাটা আপনি জানেনই তো! ব্যাস! পুরো হোটেল ভর্তি! আপনার রুমটাও পারলে দিয়ে দিলে ভালো হয় এমন অবস্থা! কেমন ভিড় দেখছেন না! তাও আমরা কাল রাত আটটার পর থেকে আর কোনো ফোন রিসিভ করছি না। কারণ আর রুম দেওয়া সম্ভব নয় স্যার!
-শিট! 
-স্যার?
-দিস ইজ সো এমব্যারাসিং! এবার আমি তাকে কি বলবো? আচ্ছা শুনুন, হোটেলে এমন কোনো রুম আছে, মানে ছোটখাটো, যেমনই হোক। ম্যাডামকে আমার রুমটা দিয়ে আমি ওখানে থেকে যাবো, এমন কোনো রুম? ছোটখাটো....যাহোক কিছু!
-সরি স্যার! ওই গোডাউনে সব মাল স্টোর করা আছে, ওটা ছাড়া তো আর....হোটেলটা তো ছোটই স্যার। রুম তো খুব বেশি না। আন্ডার কনস্ট্রাকশনে আপনি বিজনেস শুরু করলে তো...
-ওয়ার্স্ট ফিলিং এভার! 
-স্যার আপনার রুমের চাবি আর...
-রাখুন তো! দাঁড়ান আমি আসছি....কি বাজে পরিস্থিতি!

উজ্জয়িনীর দিকে এগোলো সৌজন্য....

-ম্যাম! ভেরি অকোয়ার্ড সিচুয়েশন। আই অ্যাম সো সরি!
-কি হয়েছে সৌজন্য?
-কিভাবে বলি?
-মাইক্রোফোন লাগবে?
-মজা নয় ম্যাম। আমার মান-সম্মান সব শেষ। কত বড় মুখ করে আপনাকে কাল ইনভাইট করলাম। কাল আমার একবার অন্তত এখানে ফোন করে নেওয়া উচিত ছিলো!
-কি হয়েছে বলো তো?
-ম্যাম পুরো হোটেলে একটাই রুম ফাঁকা আছে। আই 
অ্যাম সো সরি। আমার বলতে এতটাই বাজে লাগছে...

অসহায়ভাবে সৌজন্য চাইলো উজ্জয়িনীর দিকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সৌজন্যর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে উজ্জয়িনী বললো,

-হুম! বুঝলাম। তাহলে এখন কি করণীয়?
-আপনি এখানে থেকে যান। আমি রিসোর্টে ফিরে যাচ্ছি। লাঞ্চ করেই চলে আসব। দুপুরের মধ্যেই ঢুকছি। পার্টি তো সন্ধ্যেবেলায়।
-বয়স কত যেন?
-কার ম্যাম?
-তোমার?
-পঁচিশ। কেন?
-তুমি আমার কি যেন, হাঁটুর বয়সী বলছিলে না! তার মানে চিন্তায়-ভাবনায় আমার থেকে তোমার তো আরও আধুনিকমনস্ক হওয়া উচিত!
-বুঝতে পারছি না। কি বলতে চাইছেন ম্যাম?
-এই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু অপশন আছে। পরপর বলছি। প্রথম, তোমার কোনো অসুবিধে না থাকলে, নিজের ওপর কনফিডেন্স থাকলে, তুমি-আমি স্বচ্ছন্দেই একটা রুম শেয়ার করতে পারি। 

হাঁ করে সৌজন্য চেয়ে রইলো উজ্জয়িনীর দিকে....

-কি? প্রবলেম আছে কোনো?

সৌজন্য নিরুত্তর।

-বুঝেছি। এই অপশনের আবার কয়েকটা দিক আছে। সেগুলোও বলছি। তুমি এখনই ফোন করো তোমার গার্লফ্রেন্ডকে। তাকে সিচুয়েশন বোঝাও। সে পারমিট করলে তবেই আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করো। যদিও না করার চান্সটাই বেশি। আর একটা দিক হলো, গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যাও। কারণ এক্ষেত্রে তার তোমাকে ভুল বোঝার সম্ভবনাই বেশি। অ্যান্ড লাস্ট অপশন, রিসোর্টের রুম সার্ভিসকে ফোন করে কটেজের গিজার আর ওয়াশরুমের আলো ঠিক করতে বলো। আমি রিসোর্টে ফিরে যাব। তুমি নও। কারণ আজ এখানে তোমাকে প্রয়োজন। তোমার হোটেল, তোমার পার্টি, ইউ আর দা হোস্ট! অনেককিছু দেখেশুনে রাখতে হবে তোমাকে। এটা তোমার কাজের জায়গা। পাপার অনুপস্থিতিতে তুমিই এদের স্যার। দায়িত্বও অনেক। তাই তুমি এখান থেকে যাবে না! বলো? কোনটা করবে?

সৌজন্য নিরুত্তর।

-বলো সৌজন্য? আমার খিদে পাচ্ছে তো! এখানে কিছু খেতে দেবে না রিসোর্টে ফিরবো আমাকে জানাও...
-ওকে ম্যাম। ডান!
-কি? কোনটা? আরে কোন অপশনটা নিলে সৌজন্য? আমাকেও বলো? 

হলঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা হৃদয় আকৃতির একাধিক লাল বেলুন পেরিয়ে দৌড়ে রিসেপশনের দিকে যেতে যেতে হাসিমুখে সৌজন্য বললো,

-ওই অপশনটা কোনো কাজের না ম্যাম!
-কোনটা?
-আমি একা!
-মানে? তুমি একা থাকছো? আমি কটেজে ফিরছি?
-নানা। ওই গার্লফ্রেন্ডওলা অপশন। আমি সিঙ্গেল! সিঙ্গেল মানুষকেই তো আপনারা একা বলে থাকেন, তাই না? তাহলে আমার চেয়ে একা এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই! একাকীত্ব কি আমি খুব ভালো করে জানি ম্যাম!

সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে সৌজন্য রিসেপশনে ছুটলো। উজ্জয়িনীর মন মুহূর্তেই ওই সুন্দর হাসির আড়ালে, এক দারুণ যন্ত্রণার ছায়া দুলতে দেখলো সৌজন্যর দুচোখে। একেবারে চুপ করে গেলো ও। সৌজন্যর শেষ কথাটুকুর অনুরণন তখন ওর কানে,

"তাহলে আমার চেয়ে একা এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই! একাকীত্ব কি আমি খুব ভালো করে জানি ম্যাম!"

"হুম! এজ, স্টেটাস, লুক, ম্যানার্স....পারফেক্ট! যে বয়সে ডানহাতে বাঁ-হাতে গন্ডাখানেক গার্লফ্রেন্ড থাকার কথা, সেই বয়সে জুনিয়র রয়বাবু সিঙ্গেল! কিন্তু হ্যাপিলি কি? ভাবার বিষয় উজ্জয়িনী! মুখে এত সুন্দর হাসি, এত চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল, কিন্তু চোখ যে অন্য কথা বলছে!"

সামান্য স্বগোতোক্তির পর মৃদু হেসে বেতের সুদৃশ্য টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন উঠিয়ে নিলো উজ্জয়িনী সেনগুপ্ত....

-আচ্ছা শুনুন, এক্সট্রা রুম লাগবে না। আমি আমার গেস্টের সঙ্গেই রুম শেয়ার করবো। কোথায় সই করতে হবে, দিন! নিজেদের করা রুল নিজেই ভাঙলে, পাপা আবার ফোন করে চেঁচাবে তো! 
-এই যে স্যার, এখানে সই করুন। ম্যাডামকেও একটা সই করতে হবে, আর মানে এই কলামটা....মানে একসঙ্গে থাকছেন যেহেতু....ম্যাডামের সঙ্গে আপনার রিলেশনটা স্যার...
-ওসব লাগবে না। ম্যাডাম এখানে সই করবে না। আর শুনুন, পাপার কানে যেন এই খবরটা না যায়, যে আমার সঙ্গে আমার রুমে কোনো ফিমেল গেস্ট রয়েছেন। একদম বলবেন না। ওকে? আমি একাই সই করে দিচ্ছি!
-স্যার....না মানে....এটা তো রুলস....কতক্ষণ কি....থাকবেন? কতক্ষণের জন্য বুকিং? একটু ডিটেলস....মানে এটা কি ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড? ম্যাডাম কি একটা রাতই আপনার সঙ্গে....কলাম তো ফাঁকা রাখা যাবে না স্যার....মানে কিছু একটা তো....

ঘাড় নীচু করে সই করে তারিখটা লিখছিলো সৌজন্য। "ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড" কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই, ওর হাতের কলমটা কেঁপে উঠে একদম স্থির হয়ে গেলো। মাথা তুলে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে সৌজন্য চাইলো ম্যানেজারের দিকে....

(চলবে....)
ছবি : সংগৃহীত

"ত্রিভুজ" সহ লালমাটি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত "নির্বাক" ও "সূর্যোদয়ের আগে" পাওয়া যাচ্ছে চক্রবর্তী এন্ড সন্স থেকে 26% ছাড়ে। আগ্রহীরা যোগাযোগ করতে পারো এই নম্বরে 6290381169.

এছাড়া পাঠকবন্ধু - 7439112665 থেকেও বিশেষ ছাড়ে উপলব্ধ ,
যোগাযোগ করুন ফোন অথবা Whatsapp এ।