অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২২

ত্রিভুজ (ষষ্ঠ পর্ব)


 


ত্রিভুজ

সাথী দাস

ষষ্ঠ পর্ব




পরদিন ঘুম থেকে উঠে শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছিলো দিয়ার।আজ মিনিট পনেরো দেরি করেই উঠেছে ও।এই পনেরো মিনিট সময় ওদিক থেকে বের করতে জীবন বেরিয়ে যাবে।উঠেই দিয়া দেখে,মা স্কুল-ব্যাগ টিফিন-বক্স সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছে,এমনকি টিউশনের ব্যাগও।ওই ব্যাগটা স্কুল যাওয়ার সময় রমা আন্টির বাড়িতে রেখে দেবে ও,তারপর স্কুল থেকে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে কিছু খেয়ে ঋদ্ধির সঙ্গে টিউশন বেরিয়ে যাবে।ঘড়ির দিকে একবার তাকালো দিয়া,আর দেরি করা যাবে না।বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো ও।
নীলিমা আর শারদীয়া তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেলো একইসঙ্গে।নীলিমা দিয়াকে রমার কাছে ছেড়ে দিয়ে অফিস বেরিয়ে যাবে।দিয়ার মুখের দিকে একবার চাইলো নীলিমা,মেয়েটার মুখটা ভীষণ শুকনো-শুকনো লাগছে আজ।এটা তো হওয়ার কথা নয়,কাল রাত থেকে একভাবে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে ও।তাহলে!তাছাড়া অন্যদিন এটুকু রাস্তা নীলিমার সঙ্গে যেতে-যেতে একনাগাড়ে বকতেই থাকে দিয়া।কিন্তু আজ একেবারে চুপচাপ ও,মুখ বন্ধ করে ব্যাগটা পিঠে নিয়ে হাঁটছে।নীলিমা জিজ্ঞেস করলো,
-কিরে দিয়া?শরীর খারাপ লাগছে?
-কই,নাতো!
-তাহলে আজ আমার সঙ্গে একটুও কথা বলছিস না যে?
-নানা,মা!কিছু হয়নি তো!
-আচ্ছা!টেনশন করছিস তো?
-কিসের টেনশন?
-এই কাল পড়তে বসিসনি,হয়তো হোমওয়ার্কও হয়নি,তাই...
হেসে ফেললো দিয়া।রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতেই নীলিমা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো মেয়ের দিকে।হাসলে আজকাল কি ভীষণ সুন্দর দেখায় দিয়াকে।একটু-একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা,হাসির চোটে কপালের ওপরে আসা চুলগুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে নিলো দিয়া,তারপর বললো,
-নানা,সে স্কুলে গিয়ে গুঞ্জার দেখে চটপট করে নেবো।ওটা কোনো ব্যাপার না!
-যাক,ঠিক আছিস তো তুই?অফিস যাওয়ার সময় তোর এইরকম গোমড়া মুখটা দেখে যেতে ইচ্ছে করে না।এই তো একটু হাসলি,এবার ঠিক আছে...
জানে তো দিয়া,এমনিতেই মা ওকে নিয়ে সবসময় ভীষণ চিন্তা করে।স্কুল থেকে সময়মতো রমা আন্টির বাড়ি ঢুকলো কিনা,টিউশন বেরোলো কিনা,আবার বাড়িতে ফিরলো কিনা,বারবার অফিস থেকে আন্টিকে ফোন করে।তার ওপর যদি এখন দিয়া বলে,যে ওর শরীরটা ভালো না,তাহলে মা আরও চিন্তা করবে,অফিসে বসে-বসেই সুগার-প্রেশার সব বাড়িয়ে ফেলবে হয়তো।আজ নিজেকেই নিজে প্রমিস করেছে দিয়া,কারোর টিফিন খাবে না,সে যতই যা লোভনীয় খাবার আনুক না কেন!শুধু নিজের খাবারটাই খাবে।কাল বড্ড কষ্ট হয়েছে ওইসব খাবার খেয়ে....মা-মেয়ে কথা বলতে-বলতেই রমা আন্টির বাড়িতে চলে এসেছে,বাড়ির বাইরে গোবিন্দ কাকা গাড়ি মুছছিলো,এগিয়ে এসে দিয়াকে বললো,
-গুড মর্নিং দিদিমণি!
-গুড মর্নিং কাকা!
একটু হেসে মেয়ের হাত ছেড়ে দিলো নীলিমা,তারপর গোবিন্দদার দিকে চেয়ে বললো,
-দাদা,রমাকে একটু বলে দিও,আজ আমার বড্ড দেরি হয়ে গেছে,দিয়াও আজ উঠতে একটু দেরি করেছে,আমারও বেরোতে দেরি হয়ে গেছে,আমি তাই আজ আর ঢুকছি না।অফিস বেরিয়ে গেলাম।
-আচ্ছা বৌদিমনি,আমি বলে দেবো!
-কাকা আমি আসি তবে!টাটা দিয়া!
-বাই...
মাকে "বাই" করে দিয়া গুটিগুটি পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলো,সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওপরে।টেবিলে বসে তখন ব্রেকফাস্ট করছিলো ঋক,স্কুলের পোশাক পরা।কিন্তু ঋদ্ধির চেয়ারটা ফাঁকা!আন্টি খেতে দিচ্ছিলো ঋককে।দিয়াকে আসতে দেখেই হাসিমুখে ঋক বলে উঠলো,
-গুড মর্নিং দিয়া!
-গুড মর্নিং!
-কিরে,নীলিমা কোথায়?আমি চা করলাম,দুজনে একসঙ্গে খাবো!
-মার আজ দেরি হয়ে গেছে আন্টি,মা বাইরে থেকেই চলে গেছে।গোবিন্দ কাকাকে বলে গেছে।
-ও,নীলিমা চলে গেছে?
-হুম!
ডাইনিং টেবিলে ঋকের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো দিয়া।রমা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো,তারপর দিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-এই দিয়া ঘুগনি খাবি একটু?
-না আন্টি,দুধ খেয়ে এসেছি!আর কিছু খাবো না এখন!
-আমি ঘুগনি করেছি,নিজের হাতে!খাবি না!!তুই খাবারে না বলছিস?সেকি রে!
-এখন আর কিছু খাবো না আন্টি!রেখে দাও,স্কুল থেকে এসে খাবো!
-বাবা তোর হলো কি!অন্যদিন তো একটু গন্ধ বেরোলে একেবারে রান্নাঘরেই ঢুকে যাস!
একটু হাসলো দিয়া।ঋক টেবিলের অন্যদিক থেকে খেতে-খেতে মাঝে-মধ্যে দেখছে দিয়াকে।দিয়া ওর দিকে দেখতেই একটু হাসলো ও।দিয়াও একটু হেসে রমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-ঋদ্ধি কোথায় আন্টি?
-ঋদ্ধির শরীরটা খুব একটা ভালো না রে মা!কাল রাতে একটু জ্বর এসেছিলো,সকালেও দেখলাম গা-টা গরম!উঠতেই চাইছে না,তাই আর ডাকলাম না।থাক,আজকের দিনটা,শরীরটা ঠিক থাকলে একেবারে সোমবার থেকেই স্কুল যাবে রে...
-ও,ঋদ্ধির জ্বর?আমি একটু ওকে দেখে আসি আন্টি?
-হ্যাঁ,যা না!দেখ ঘুমোচ্ছে না উঠেছে?ঝর্ণাদি,চা হলো?দাও,আমি দাদাবাবুকে দিয়ে আসি!
-যা,ঋদ্ধিকে দেখে আয় দিয়া!বলে রমা চা নিয়ে সৈকতকে দেওয়ার জন্য নিজের ঘরের দিকে গেলো।
-হুম,দেখি গিয়ে!
উঠে দাঁড়িয়ে পিঠ থেকে ভারী স্কুলব্যাগটা চেয়ারে নামিয়ে রাখলো দিয়া।তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গেলো ও,সিঁড়ির একটা ধাপে পা রাখা মাত্রই বীভৎস ভাবে পেটে যন্ত্রণা করে উঠলো ওর,আর একটা পা ও আর কিছুতেই বাড়াতে পারছে না।দাঁতে-দাঁত চেপে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো দিয়া।ঋক টেবিল থেকে বসে দেখছিলো ওকে,খাওয়া ফেলে চেয়ার সরিয়ে দৌড়ে এগিয়ে এলো দিয়ার দিকে,
-কি হয়েছে তোমার দিয়া?
-নানা,কিছু না!আবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গেলো ও।ঋক পিছন থেকে টেনে ধরলো ওর একটা হাত,
-দাঁড়াও,তোমার পেটব্যথা কমেনি,তাই না?ওই জন্য মা ঘুগনি খেতে বললো,তুমি না বললে!
-কমেছে,তবে অল্প আছে!
-তো যেও না আজ স্কুলে!বাড়িতেই থাকো।
-নাঃ!ধুর!তেমন কিছু না,ও একটা দিন বুঝেশুনে খাওয়া-দাওয়া করলেই ঠিক হয়ে যাবে!তাছাড়া আজ শনিবার,তাড়াতাড়ি ছুটিও হয়ে যাবে।কয়েক ঘন্টার তো ব্যাপার!অসুবিধা হবে না!
-শিওর?
-হুম,একদম!মিষ্টি হেসে দিয়া বললো।
-ওকে,যাও,তাড়াতাড়ি দেখে এসো ঋদ্ধিকে,স্কুলের সময় হয়ে গেছে,আমিও খেয়ে নিই..
-হুম!
বলে ঋকের দিকে চেয়ে রইলো দিয়া!ঋক বুঝতে পারছে না,দিয়া এভাবে চেয়ে রয়েছে কেন ওর দিকে!!
-ঋক?
-উম!
-আমার হাত!
-ওহ!সো সরি!
তাড়াতাড়ি দিয়ার হাতটা ছেড়ে দিলো ঋক।দিয়া ওপরে চলে গেলো।ঋদ্ধির ঘরের দরজা ভেজানো।ঠেলে ঢুকে দিয়া দেখলো,ঋদ্ধি খালি গায়ে উপুড় হয়ে,বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।কোমর পর্যন্ত চাদরে ঢাকা!ওর খোলা পিঠে হাত রেখে দিয়া দেখলো,বেশ গরম গা-টা!আর ডাকলো না ওকে।খোলা পিঠটা চাদরে ঢেকে দিয়ে,দরজা ভেজিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ও।
-ঋক শোন!
স্কুলে বেরোনোর আগে ঋককে ডাকলো রমা।দিয়া ততক্ষণে গাড়িতে গিয়ে বসেছে।
-হ্যাঁ মা বলো।
-আজ যদি আমি ভাইকে নিয়ে বেরোই,তুই আর দিয়া একটু অটো করে বাড়ি চলে আসতে পারবি বাবা?ভাইয়ের জ্বরটা তো বারবার আসছে।এদিকে বাবাও আজ দাদুকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবে!ওরা একটা গাড়ি নিয়ে যাবে,আর আমি যদি এদিকে ভাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই,আমিও তো একটা গাড়ি নিয়ে....
-আরে হ্যাঁ,এত চিন্তা করছো কেন তুমি!তুমি ভাইকে দেখে রাখো।তেমন হলে আগে ওকে নিয়ে যাও ডাক্তারের কাছে।আমরা চলে আসবো,আমাদের নিয়ে তুমি একদম চিন্তা কোরো না।
-ঠিক আছে,ঠিক আছে!সাবধানে আয়।টাকাপয়সা সঙ্গে আছে তো রে?
-হ্যাঁ-হ্যাঁ!আসছি মা!
-আয় বাবা আয়!
-মাঝে একবার আমি যাবো তোমাদের ক্লাসে!গাড়িতে বসে ঋক দিয়াকে বললো।
-আমাদের ক্লাসে?কেন?
-আজ তো ঋদ্ধি স্কুলে যাচ্ছে না!তুমি কেমন থাকো...
-আরে ধুর!তার কোনো দরকারই নেই।এই তো এখন অনেকটাই ভালো লাগছে।তাছাড়া গুঞ্জা তো থাকবেই।একটু হাসলো দিয়া।
-আচ্ছা!নিজের খেয়াল রেখো।
-একদম,ডোন্ট ওয়ারি!
-হুম!
দিয়া গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।সকালের মৃদু হাওয়ায় ওর কপালের আর কানের পাশের কাটা চুলগুলো অল্প-অল্প উড়ছে।ঋক একভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ওর দিকে,তারপর একরকম জোর করেই চোখটা ফিরিয়ে নিলো...
গাড়ি থেকে নেমে দুজনেই 'বাই' করে চলে গেল যার-যার ক্লাসের দিকে।ক্লাসে ঢুকেই দিয়া দেখলো গুঞ্জার ডেস্ক ফাঁকা!একটু অবাক হলো ও।কালও তো গুঞ্জা বলেছিলো,যে আজ আসবে।একটু এগিয়ে গিয়ে সোমদত্তকে জিজ্ঞেস করলো দিয়া,ওরা একসঙ্গেই বাসে আসে যেহেতু,
-কিরে,গুঞ্জা কোথায়?
-ও তো আসবে না আজ।বাস তো চলে এলো ওর বাড়ির সামনে থেকে।ওর বাবা বলে গেলো।
-কেন?
-আমি কি করে জানবো!
-তাও ঠিক!আচ্ছা,চল গেলাম আমার জায়গায়!
-ওকে!
নিজের ডেস্কের ওপর ধপাস করে ব্যাগটা রাখলো দিয়া।মেজাজটাই বিগড়ে গেলো ওর।গুঞ্জন আর ঋদ্ধি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড,দুজনেই আজ এলো না,গুঞ্জারও পাত্তা নেই,ঋদ্ধিটাও বাড়িতে জ্বর বাধিয়ে বসে আছে।এবার ও একা-একা কি করবে!ব্যাগ থেকে খাতা বের করে,না করা হোমওয়ার্কগুলো করতে বসলো দিয়া...
তখন লাস্ট পিরিয়ড সবে শুরু হয়েছে।চল্লিশ মিনিটের ক্লাস!সবে দশ মিনিট হয়েছে।বিরক্ত লাগছে দিয়ার।কারও সঙ্গে একটুও কথা বলতে পারছে না।গুঞ্জা আর ঋদ্ধির সঙ্গে সবসময় এত গুজগুজ করতে থাকে ও,যে ওদের বাইরে আর খুব একটা কারোর সঙ্গে সেভাবে কথাও হয় না।আজ সোমা ম্যাম পর্যন্ত এসে বললেন,
"কিরে!বাকি দুজন কোথায় আজ?"
হেসে ফেলেছিলো দিয়া।যেখানেই থাকে,গুঞ্জা-ঋদ্ধি আর দিয়া একসঙ্গেই থাকে।ক্লাসের সবাই সেটা জানে।আজ ওরা স্কুলে না আসাতে কি ভীষণ অসহায় লাগছে দিয়ার,সময়ই কাটছে না যেন...
হঠাৎ করে সাংঘাতিক পেটব্যথা শুরু হয়ে গেলো ওর।চিনচিন করে ব্যথা তো সকাল থেকেই হচ্ছিলো,কিন্তু তাও সহ্য করা যাচ্ছিলো,এবার আর সহ্য করতে পারছে না ও।হাত-পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে আসছে।কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে দিয়া বললো,
-ম্যাম!মে আই গো টু টয়লেট?
-শিওর!
-থ্যাঙ্কু!
ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো দিয়া।এক পা-ও এগোতে পারছে না ও।তলপেট থেকে পা পর্যন্ত যন্ত্রণায় অবশ হয়ে যাচ্ছে।কোনোরকমে নিজেকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো ও।বাথরুমে ঢুকে নিজের দিকে চেয়েই মাথাটা ঘুরে গেলো দিয়ার।উরুসন্ধি থেকে বেরিয়ে আসছে টকটকে লাল রক্ত!!দাঁড়াতেই পারছে না ও।এই কি তবে সেই রক্ত,যার কথা গুঞ্জা সেদিন বলেছিলো,যে ওর দিদির হয়েছে!যা সবসময় দিয়া টিভিতে দেখছে!!আতঙ্কে সারা শরীর অবশ হয়ে গেলো ওর।এবার ও কি করবে!কি মনে হতেই নিজের হাঁটু পর্যন্ত স্কার্টের পিছন দিকটা টেনে সামনে ধরলো ও,রক্তের দাগ লেগে রয়েছে সেখানেও।কান্না পেয়ে গেলো দিয়ার।অসহ্য যন্ত্রণার থেকেও বড় কথা,লজ্জায় ও শেষ হয়ে গেলো!এবার বাথরুম থেকে বেরোবে কি করে!কার কাছে যাবে!কাকে কি বলবে!ভীষণ ভয় করছে ওর।গুঞ্জাও আসেনি আজ।কেন যে আজ ঋকের কথা শুনলো না ও,না আসলেই ভালো হতো আজ স্কুলে।ঋকের কথা মনে পড়তেই চমকে উঠলো দিয়া।ঋককে বলবে!!কিন্তু কি বলবে ওকে!আবার না বলেই বা কোথায় যাবে,বাড়ি তো সেই ওর সঙ্গেই ফিরতে হবে।আর দাঁড়াতে পারছে না দিয়া,উরুসন্ধি ছেড়ে এবার দিয়ার ফর্সা উরু বেয়ে গড়িয়ে আসছে রক্তপ্রবাহ!আর দাঁড়ানো যাবে না,এবার কিছু একটা করতেই হবে।মাথায় কিচ্ছু আসছে না ওর।বাথরুমের কল খুলে কোনোরকমে নিজেকে কিছুটা পরিষ্কার করে বেরিয়ে এলো ও।স্কার্টটা ঘুরিয়ে নিলো দিয়া,সামনের দিকটা দিলো পিছন দিকে,আর পিছনের রক্তাক্ত অংশটা টেনে নিলো সামনের দিকে,তারপর হাত দিয়ে মুড়ে চেপে ধরলো ওই জায়গাটা।তাড়াতাড়ি করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে গেলো ও।প্রচন্ড পেটব্যথায়,কোমর-পা-যন্ত্রণায়,আর সর্বোপরি লজ্জায় তখন দিশেহারা দিয়া।দু-চোখে জল এসে গেছে ওর।একবার ভয়ে কেঁদেই ফেললো ও...
-ম্যাম!
-হুম,কাম ইন!
তাও ক্লাসের বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দিয়া।ম্যাম আবার বললেন,
-প্লিজ কাম!
-ম্যাম!প্লিজ ম্যাম,আই নিড টু টক!ইফ ইউ...
একটু অদ্ভুত লাগলো ওনার।হাতের চকটা টেবিলে রেখে,তাড়াতাড়ি ক্লাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন উনি!
-ইজ এভরিথিং ওকে শারদীয়া?
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো দিয়া।
-কি হয়েছে তোমার?কাঁদছো কেন!
আস্তে-আস্তে করে নিজের মুঠোর মধ্যে ধরে থাকা স্কার্টটা খুলে ম্যামের সামনে মেলে ধরলো দিয়া।ওনার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।উনি এগিয়ে এসে শারদীয়ার কাঁধে হাত রাখলো,
-ইটস ওকে!ডেট ফিক্সট ছিলো না?ফার্স্ট টাইম?
ঘাড় নেড়ে "হ্যাঁ" বললো দিয়া।
-ওকে,এখানেই দাঁড়াও তুমি।
ঘড়ির দিকে চেয়ে ম্যাম দেখলেন আরও বেশ কিছুক্ষণ বাকি আছে ছুটি হতে,উনি ক্লাসে গিয়ে জানিয়ে দিলেন আজ এতটুকুই থাক,এরপর পরদিন আবার এখান থেকেই পড়ানো হবে।তারপর দিয়ার ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ক্লাস থেকে।দিয়ার হাতে ব্যাগটা দিয়ে বললেন,স্টাফরুমের বাইরে দাঁড়াতে।দিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো ওখানেই,ওর আর নড়ারও ক্ষমতাও নেই।একটু নড়লে-চড়লেই উরু বেয়ে বেরিয়ে আসছে উষ্ণ-রক্তস্রোত!আর সেই সঙ্গে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা।আর সহ্য করতে পারলো না দিয়া।স্টাফরুমের বাইরে যে বসার জায়গা ছিল,সেখানে বসে পড়লো ও।সেই মুহূর্তেই সজোরে ছুটির ঘন্টা বেজে উঠলো...
প্রায় পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে,ঋক হলঘরের বাইরে দিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।আর একবার ঘড়ির দিকে দেখে ও এগিয়ে গেলো দিয়ার ক্লাসের দিকে।কিন্তু সেখানে পৌঁছে চমকে গেলো ও,পুরো ক্লাস তো ফাঁকা!দিয়া কোথায় গেলো!
যতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল,একরকম ছিল,বসা মাত্রই দিয়ার পিছন দিকের পোশাক একটু-একটু করে ভিজে উঠলো।ব্যাগটা বুকে চেপে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ফেললো ও।সেই মুহূর্তেই ম্যাম স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
-আমার সঙ্গে এসো শারদীয়া।
দিয়া ব্যাগটা ওইখানে রেখেই ম্যামের সঙ্গে গেলো।দিয়াকে নিয়ে উনি ওনাদের ব্যবহারকৃত বাথরুমে ঢুকলেন।
ঋক দিয়াকে খুঁজতে-খুঁজতে ওঠার সময় হলঘরের দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলো,নামার সময় তাড়াতাড়ি করে লাইব্রেরির পাশ দিয়ে স্টাফরুমের সামনে দিয়ে আসছিলো।সারা স্কুল প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল,কিন্তু মেয়েটা গেলো কোথায়!
তরতর করে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে,চমকে আবার পিছন দিকে গেলো ঋক।স্টাফরুমের বাইরে বেঞ্চের ওপর একটা স্কুলব্যাগ পড়ে রয়েছে,অনেকটা দিয়ার ব্যাগের মতোই দেখতে।এমনকি ব্যাগের একটা চেন থেকে দিয়ার পছন্দের ছোট্ট মিনি মাউসটা পর্যন্ত ঝুলছে।একটু এদিক-ওদিক চেয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে একটানে একটা চেন খুলে ফেললো ঋক।একটা বই বের করেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো ওর।বইয়ের ওপরে গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে,"শারদীয়া মজুমদার!"
দিয়ার ব্যাগ এখানে কেন!ও কোথায়!!নিজের হৃদপিন্ড এত জোরে লাফাচ্ছে,যে তার শব্দ ঋকের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
ওই ব্যাগটার পাশেই বসে পড়লো ঋক।
মিনিট পাঁচেক পরেই দিয়া এগিয়ে এলো ওদিকে,ওর সঙ্গে রয়েছেন অরুন্ধতী ম্যাম।দিয়ার চোখমুখ একেবারে ফুলে গেছে,ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না ও,কি হয়েছে ওর!ওদের দেখামাত্রই উঠে দাঁড়ালো ঋক।এগিয়ে গিয়ে বললো,
-গুড আফটারনুন ম্যাম!
স্কুলের প্রথম সারির ছাত্র হওয়ার সূত্রে ঋক সকলের কাছেই পরিচিত এবং প্রিয় মুখ।ঋককে দেখেই অরুন্ধতী ম্যাম বলে উঠলেন,
-গুড আফটারনুন প্রান্তিক!তুমি এখানে?এনিথিং আর্জেন্ট?
ঋক কিছু বলার আগে দিয়া বলে উঠলো,
-ম্যাম,আমরা একসঙ্গে,এক গাড়িতেই বাড়ি ফিরি!ইনফ্যাক্ট আমি দিয়ার জন্য ওয়েট করে-করে ওকে খুঁজতেই...
-ওহ,ওকে!প্রান্তিক,লিসেন টু মি!তুমি ওর সঙ্গে থাকবে যখন তোমাকেই বলছি,ওকে একটু কেয়ারফুলি নিয়ে যাও,এজ সুন এজ পসিবল!পারলে আজ একটু শারদীয়াকে ওর বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিও।
ঋক কিছু বললো না আর,দিয়া তো এখন ওদের বাড়িতেই যাবে,কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কিসের জন্য!আর এত সাবধানতাই বা কেন!দিয়ার দিকে একবার ভালো করে তাকালো ঋক,তারপর বললো,
-ওকে ম্যাম!
-গুড!
-শারদীয়া!সাবধানে যাও,আর যেটা বললাম মনে রাখবে,একটুও ভয় পাবে না,একদম কাঁদবে না!ওকে ডিয়ার!আমি সোমবার স্কুলে এসে আবার তোমার খোঁজ নেবো।ঠিক আছে?
মাথা তো নামিয়েই রেখেছিলো দিয়া।আর তুললো না,মাথা নাড়িয়ে একটু 'হ্যাঁ' বললো শুধু।
-ওকে!টাটা!
একটু অদ্ভুত লাগলো ঋকের।তবে কি...
অরুন্ধতী ম্যাম চলে গেলেন স্টাফরুমের ভিতরে।ঋক দিয়ার দিকে একবার ভালোভাবে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি ঠিক আছো?
-হুম!
-ওকে,চলো তাহলে?
-তুমি এগোও,আমি আসছি!
সারাটা শরীর থরথর করে কাঁপছে দিয়ার।তলপেট থেকে শুরু করে কোমর ছাড়িয়ে পা পর্যন্ত যন্ত্রণায় অসাড়।ব্যাগটা তুলে নিলো ও।ঋক এগোতে গিয়েও পিছিয়ে এলো।দিয়ার দিকে চেয়ে দেখলো,বাঁ হাত দিয়ে স্কার্টটা চেপে ধরে রয়েছে ও,ঋক বললো,
-তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও দিয়া।
একটাও কথা না বলে ব্যাগটা ঋকের হাতে দিয়ে দিলো দিয়া।সত্যিই ও আর ভারী ব্যাগটা বইতে পারছিলো না।সিঁড়ি দিয়ে নেমে হলঘর পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো ওরা।দিয়ার স্কার্টের পিছন দিকটা সম্পূর্ণ ভেজা।সামনের দিকটাও চেপে ধরে আছে ও।ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না।ঋকের এইসব ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানা না থাকলেও,সামগ্রিক একটা ধারণা আছে।আর সে ধারণা থেকেই ততক্ষণে ওর সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বোঝা হয়ে গেছে।যেখানে গোবিন্দ কাকু গাড়ি নিয়ে দাঁড়ায়,সেদিকটায় একবার চেয়ে দেখলো ঋক।ওদের গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই।আগেও গাড়ি ছাড়া বহুবার অটো বা বাসে করে যাতায়াত করেছে ঋক।কোনো-কোনো সময় স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হলে,ঋদ্ধি আর দিয়া গাড়ি করে বেরিয়ে গেছে।ঋক পরে বাসে বা অটো করে ফিরেছে।ওর কোনো অসুবিধাই হয়নি।কিন্তু এই প্রথম গাড়ি ছাড়া ভীষণ অসহায় লাগলো ঋকের।নিজের জন্য নয়,দিয়ার জন্য।মেয়েটা ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না।দিয়ার দিকে এগোলো ঋক,
-দিয়া!আজ গোবিন্দ কাকু আসবে না,তুমি একটু কষ্ট করে অটোতে যেতে পারবে?
মাথা আর তুলছেই না দিয়া।ঋকের দিকেও তাকাচ্ছে না পর্যন্ত।মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বললো শুধু।কিন্তু কখন অটো আসবে,আদৌ দুজনের জায়গা একসঙ্গে পাওয়া যাবে কিনা,তার তো ঠিক নেই।এই অবস্থায় ঋক কিছুতেই দিয়াকে একা ছাড়তে পারবে না।ও আরও একবার দিয়ার দিকে চেয়ে বললো,
-আচ্ছা,তুমি একটু দাঁড়াও,আমি দেখছি!
একটু এগিয়ে গেলো ঋক।দিয়া আর দাঁড়াতেই পারছে না।তলপেট যেন ভারী হয়ে ফেটে পড়ছে নীচের দিকে।দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই ব্যথায় কেঁদেই ফেললো ও।কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি দিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো।ঋক ট্যাক্সি থেকে মুখ বাড়িয়ে বললো,
-দিয়া,উঠে এসো!
দিয়া দেখলো,ঋক ট্যাক্সির ভিতর থেকে দরজা খুলে দিয়েছে।ও কোনোরকমে নিজের শরীরটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসলো,দরজাটা টেনে দিলো ঋক।তারপর সামনের দিকে চেয়ে বললো,
-দাদা!একটু তাড়াতাড়ি যাবেন!
-বি.কে.ম্যানসন তো?শর্টকাট নিয়ে নিচ্ছি!
-আচ্ছা!তাড়াতাড়ি চলুন!
ট্যাক্সির সিটে বসামাত্রই ভেজা স্কার্টটা গায়ে লেগে সারা শরীর শিরশির করে উঠলো দিয়ার।রক্তপ্রবাহ এতটুকুও বিরতি দেয়নি,একনাগাড়ে হয়েই চলেছে।হাত-পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে দিয়ার।অস্থির লাগছে ঋকেরও।বাড়িতে না পৌঁছনো পর্যন্ত স্বস্তি নেই...আবার দিয়ার দিকে দেখলো ও,গুটিসুটি মেরে কুঁকড়ে বসে আছে মেয়েটা,মুখে একটাও কথা নেই।দুহাতে আঁকড়ে ধরে রয়েছে স্কার্টটাকে।ঋক ডাকলো,
-দিয়া?
-হুম!
আর কিছু বলতে পারলো না ঋক।কি জিজ্ঞেস করবে ও!!শুধু ওকে একবার ডেকেই চুপ করে গেলো!এবার দিয়াই বলে উঠলো,
-ঋক,আমার খুব কষ্ট হচ্ছে,আর পারছি না আমি!
ধরা গলায় এটুকুই দিয়া বললো।এবার ওর দিকে ভালো করে চাইলো ঋক।ওর মনে হলো,এখন একটু জড়িয়ে ধরলেই হয়তো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে মেয়েটা।ঋক দিয়ার হাতের ওপর একটা হাত রাখলো।বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে রয়েছে হাতটা।দিয়ার আঙুলের মধ্যে নিজের আঙুলগুলো দিয়ে শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরলো ঋক।দিয়াও আঁকড়ে ধরলো ঋকের হাত।ঋক বললো,
-বুঝতে পারছি!এসে গেছি প্রায় দাঁড়াও!আর একটুখানি...
ট্যাক্সিটাকে আর গেটের বাইরে দাঁড় করালো না ঋক,একেবারে দরজার সামনে নিয়ে গেলো।ভাড়া দিয়েই হাত ধরে টেনে নামালো দিয়াকে।ওর ভেজা স্কার্টের জন্য ট্যাক্সির সিট অনেকটাই ভিজে গেছে।দুটো ব্যাগ নিয়ে বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার করে মাকে ডাকলো ঋক,
-মা!
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার মতোও আর ক্ষমতা নেই দিয়ার।দুটো পা যন্ত্রণায় কাঁপছে ওর।স্কুলব্যাগ দুটো সিঁড়ির গোড়াতেই ফেলে রাখলো ঋক,দিয়াকে হাত ধরে টেনে তুললো দোতলায়।ওপরে উঠেই চিৎকার করলো,
-মা কোথায় গো ঝর্ণা মাসি??
এইভাবে চিৎকার করে বড়দাদাবাবুকে কথা বলতে, আগে কখনো দেখেননি ঝর্ণা দি।রান্নাঘর থেকে হাতের কাজ ফেলে ছুটে এলেন উনি।তারপর বললেন,
-বৌমনি তো ছোট দাদাকে নিয়ে এক্ষুণি ডাক্তারখানা থেকে এলো,দাদাকে দুধ খাওয়াতে গেছে ওপরে।
-তুমি ওপরে ভাইয়ের কাছে যাও,মাকে নীচে নামতে বলো,এক্ষুণি!আগে যাও!
একবার দিয়ার দিকে চেয়ে দৌড়ে ওপরে চলে গেলেন ঝর্ণা দি।
-দিয়া,এখানে বসো!
ডাইনিংয়ে টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে দিলো ঋক।তারপর দিয়ার হাত ধরে ওকে বসাতে গেলো।কিন্তু দিয়া বসলো না।স্কুল থেকে বেরোনোর পর এই প্রথম ঋকের মুখের দিকে চেয়ে কথা বললো দিয়া,সোজা মুখ তুলে ওর চোখের দিকে চেয়ে বললো,
-আমি বসতে পারবো না ঋক!
বলেই নামিয়ে নিলো মাথাটা!
ঋকও দিয়ার শুকনো মুখটার দিকে একবার চেয়ে,নামিয়ে নিলো চোখ।তারপর বললো,
-ওহ!ওকে!
একছুটে নীচে নামছে রমা।
-কিরে ঋক,কি হয়েছে রে?তোর কি হয়েছে দিয়া?
ঋক তখনও দিয়ার একটা হাত ধরে ছিল,মাকে সিঁড়ি দিয়ে আসতে দেখে দিয়ার হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটে দুটো হাত রাখলো ও।মা সামনে এসে দাঁড়ানোর পর,ঋক মাকে আর কিছু বলতে পারলো না।শুধু এটুকুই বললো,
-দিয়াকে একটু দেখো মা!
বলেই নীচে নেমে গেলো ঋক, সিঁড়ির ওখানে রাখা ব্যাগদুটো তুলে আনতে।
রমা ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ছেলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে দিয়ার দিকে তাকালো।দিয়াকে দেখামাত্রই রমার অভিজ্ঞ চোখ এক মুহূর্তেই বুঝতে পেরে গেলো ঘটনাটা কি!!দিয়ার সামনে এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো রমা।যন্ত্রণার চোটে এতক্ষণ শুধু মায়ের কাছেই যেতে ইচ্ছে করছিলো ওর।রমা ওকে জড়িয়ে ধরামাত্রই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো দিয়া,কাঁদতে-কাঁদতেই বললো,
-আমার খুব পেটব্যথা করছে আন্টি!আমি আর সহ্য করতে পারছি না!
-আচ্ছা মা,বুঝেছি!একটু দাঁড়া,সব ঠিক করে দিচ্ছি আমি।তুই আগে এদিকে আয় তো!জামাকাপড় ছাড়,ভিজে জামাকাপড় পরে এভাবে...দিয়াকে জড়িয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো রমা।
সিঁড়ি থেকে ব্যাগদুটো নিয়ে ওঠার সময় দিয়ার ওই একটা কথা শুনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো ঋক!কতটা কষ্ট পেয়ে দিয়া কেঁদে ফেলেছে ওর মাকে বলছে,"আমি আর সহ্য করতে পারছি না আন্টি!"সিঁড়িতেই পা-টা আটকে গিয়েছিলো ঋকের।ঝর্ণা মাসি ততক্ষণে ভাইকে দুধ খাইয়ে নীচে নেমে এসেছে,বাথরুমের দরজাটা একটু খুলে মা ঝর্ণামাসিকে ডাকলো,তারপর বললো,
-ঝর্ণাদি,আমার আলনা থেকে দিয়ার একসেট জামা-প্যান্ট এনে দাও তো,তাড়াতাড়ি দাও।কাঁপছে মেয়েটা!
নীচেই রইলো ঋক।আর ওপরে উঠলো না।দিয়া হয়তো এক্ষুণি বাথরুম থেকে বেরিয়ে মায়ের ঘরে যাবে,মায়ের ঘরে ঢুকে যাক ও,তারপর ঋক ওপরে উঠবে।এখন বেরিয়ে ঋকের মুখোমুখি হতে হয়তো দিয়া ঠিক স্বচ্ছন্দ বোধ করবে না।সিঁড়িতেই বসে রইলো ঋক।আবার ও মায়ের গলা পেলো,মা বলছে,
-এই জামাকাপড়গুলো নীচে নিয়ে গিয়ে একটু সাবানে ভিজিয়ে দাও তো ঝর্ণাদি।এই বাথরুমে দরকার নেই,তোমার দাদা এসেই আবার ঢুকবে!নীচে যাও।আচ্ছা শোনো,আগে একটু দুধ গরম করো তো,আর একটু জল গরম করে হট ওয়াটার ব্যাগে ঢোকাও।তারপর নীচে যাও...
দিয়াকে জামাকাপড় পরিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে ঢুকে গেলো রমা,ঢুকেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো।ঝর্ণা মাসিও ততক্ষণে রান্নাঘরে ঢুকে গেছে।
ঋক এবার উঠে এলো ব্যাগদুটো হাতে নিয়ে,ডাইনিংয়ে কেউ নেই।বাথরুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গা-টা শিউরে উঠলো ঋকের।দিয়ার স্কুলের জামাকাপড়গুলো একটা বালতির মধ্যে জড়ো করা রয়েছে,আর ওর হালকা ধূসর রঙের স্কার্টটার জায়গায়-জায়গায় রক্তের দাগ!!কিছুটা বইতে পড়ে,কিছুটা শুনে,এই ব্যাপারটা সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ধারণা আছে ঋকের।একেবারে অজানা নয়।কিন্তু নিজের চোখে এই রকম একটা রক্তারক্তি ব্যাপার,এই প্রথম দেখলো ও।ব্যাগ দুটো বগলদাবা করে একদৌড়ে ওপরে চলে এলো ঋক।নিজের ঘরে ব্যাগ দুটো রেখে আগে বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলো।তারপর স্কুলের শার্টটা খুলে চেয়ারের ওপর রাখলো।হাতের ঘড়িটাও খুলে পড়ার টেবিলে রাখলো।প্যান্ট খোলার আগে দরজা বন্ধ করতে যাবে বলে ঋক দরজার দিকে এগিয়েছে,সেই সময় দেখলো ঋদ্ধি ওর ঘর থেকে বেরিয়ে ঋকের ঘরের দিকেই আসছে।পরনে একটা হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি।চুলগুলো এলোমেলো।দুদিনের জ্বরেই ঋদ্ধির চোখমুখ একেবারে বসে গেছে।ও সোজা এসে ঋকের ঘরে ঢুকলো,জ্বরটা এখন না থাকলেও শরীরটা খুব দুর্বল ওর।বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলো না ঋদ্ধি,ঋকের বিছানায় বালিশের ওপর গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো।ঋক ওর গায়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-কিরে!এখন শরীর ঠিক আছে?
-হুম,আমি তো এখন ঠিকই আছি,এই ভাই,দিয়ার কি হয়েছে রে?
একটু অস্বস্তিতে পড়লো ঋক।ভাইকে কি বলবে ও!তবু বললো,
-কি আবার হবে?
-না,ওই যে ঝর্ণা মাসি দৌড়ে এসে বললো,"বৌমনি,তুমি আগে নীচে যাও,বড়দাদা ডাকছে।এক্ষুণি যাও,দিয়া দিদিমণির মনে হয় শরীরটা ভালো না!"কি হয়েছে রে দিয়ার?
-ওই একটু জ্বর আর কি!তোর মতোই।
-ওহ!ওকে!একটু যেন নিশ্চিন্ত হয় ঋদ্ধি।
-তোকে ডাক্তার কি বললো?ঋক জিজ্ঞাসা করলো।
-ওই দুদিনের ওষুধ দিলো,ভাইরাল ফিভার!তিন-চার দিন লাগবে পুরোপুরি কমতে।আমি বরং একটু আস্তে-আস্তে নীচে যাই,দিয়াকে একটু দেখে আসি।
-শোন,এখন যাস না।পরে যাস!
-কেন?
-না মানে,সবে এলো,চেঞ্জ করে একটু ঘুমাবে বললো।
-আচ্ছা!
ঋক দরজাটা ভেজিয়ে জামাকাপড় বদলে নিলো।তারপর ভাইকে বললো,
-খাটে উঠে ঠিক করে শো না!
-নাঃ,ঠিক আছি!
একটু হেসে ভাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরোলো ঋক।তারপর ওপরের বাথরুমে ঢুকলো ও।ঋদ্ধি দাদার খাটেই আবার উল্টে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
দুপুর তখন তিনটে..
রমার ঘরে শুয়ে,বিছানায় হট-ওয়াটার-ব্যাগ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো দিয়া।ঋক সেই যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দোতলায় খেতে এসেছে,আর ওপরে নিজের ঘরে যায়নি।রমা কয়েকবার ওকে ওপরে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে থাকতে বলেছিলো,কিন্তু ও যায়নি,একদম আস্তে করে টিভি চালিয়ে সোফার ওপরেই আধশোয়া হয়ে রয়েছে ও।বেশ অবাক হয়েছিল রমা,যে ছেলে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া আর খুব একটা নীচে থাকে না,যে কিনা দিনের বেশিরভাগ সময় যতটুকু বাড়িতে থাকে,ওপরে নিজের ঘরে,হয় বই নয়তো কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকে,সেই ছেলে আজ সোফার ওপর থেকে নড়ছে না।ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ওর,কিন্তু তাও রিমোর্ট হাতে সোফার ওপরেই শুয়ে আছে...নিজের মনেই একটু হেসে ফেললো রমা।ঋক কেন এটা করছে,রমার আর বুঝতে বাকি নেই।সত্যি!ছেলেটা ওর বড় হয়েই গেলো!যাক,এটাই তো ও চেয়েছিলো...
একটু পরেই ঋকের ঘর থেকে চোখ ডলতে-ডলতে নীচে নামলো ঋদ্ধি।ডাইনিং টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে বললো,
-ও মা,খিদে পেয়েছে,খেতে দাও!
রান্নাঘরে ঝর্ণাদির সঙ্গে বিকেলের জলখাবারের আয়োজন করছিলো রমা।ছোট ছেলের গলা পেয়ে বেরিয়ে এলো ও,ঋদ্ধির কপালে হাত দিয়ে দেখে রমা বললো,
-যাক বাবা!জ্বরটা আর নেই!একটু ঘুগনি খাবি?গরম-গরম কটা লুচি ভেজে দিই?সেই থেকে তো এক গ্লাস দুধ খেয়েই রয়েছিস!খেতে ইচ্ছে করছে না বলে দুপুরেও কিছু খাসনি!
-দাও!জোর খিদে পেয়েছে!
-একটু দাঁড়া বাবা!ঝর্ণাদি...
রান্নাঘরে চলে গেলো রমা।
-দিয়া এখনও ওঠেনি মা?চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ঋদ্ধি।
-না রে বাবা!থাক,ডাকিস না ওকে।
-বাব্বা!!কত ঘুমাবে!গুজগুজ করে ঋদ্ধি বললো।
উঠে রমার ঘরের দিকে গেলো ঋদ্ধি।দরজাটা ভেজানোই ছিল,ঠেলে ঘরে ঢুকলো।ঋক সোফায় শুয়ে-শুয়ে দেখছিলো ভাইকে,বারণ করতে গিয়েও চুপ করে গেলো ও।কি বলে বারণ করবে ওকে....
ঋদ্ধি মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলো দিয়া দরজার দিকে পিছন ফিরে শুয়ে আছে,দেওয়ালের দিকে মুখ করা।পিঠ পর্যন্ত চাদরে ঢাকা,খোলা চুলগুলো বালিশের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।একটু এগিয়ে আলতো করে দিয়ার কপালে হাত দিয়ে দেখলো ও,না!জ্বর তো নেই।দিয়ার মুখের ওপরে আসা চুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে দিলো ঋদ্ধি।তারপর ওর কানে ফুঁ দিলো।
ঘুমটা ভেঙে গেলো দিয়ার।ভীষণ বিরক্ত হলো ও,ঘুমচোখেই ঋদ্ধির দিকে তাকিয়ে বললো,
-উফফ!জ্বালাস না তো!শুতে দে একটু!
-কিরে পেঁচি!আর কত ঘুমোবি?ওঠ!দিনরাত খালি খাওয়া আর ঘুমোনো!ওঠ-ওঠ-ওঠ!একটানে দিয়ার গা থেকে চাদর টেনে সরিয়ে দেয় ঋদ্ধি।
-উফফ!বলছি না,শুতে দে একটু!সর তো,জ্বালাস না ঋদ্ধি!সবসময় ভালো লাগে না কিন্তু!!
এবার বেশ জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো দিয়া।আবার টেনে চাদরটা মুড়ি দিয়ে ঋদ্ধির দিকে পিছন ঘুরে শুয়ে পড়লো ও।
ঋদ্ধিও দিয়ার পিঠের ওপর মাথা রেখে ধপাস করে ওর গায়ের ওপর শুয়ে পড়লো।তারপর বললো,
-যতক্ষণ শুয়ে থাকবি,ততক্ষণ জ্বালাবো কিন্তু তোকে!ওঠ না,ওঠ না,ওঠ না!!ঋদ্ধি সমানে মাথা দিয়ে ঠেলতে থাকে দিয়াকে।
-উফফ!ঋদ্ধি!!সর না রে!লাগছে তো আমার!মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবো কিন্তু এবার!
-ওঠ তাহলে!ওঠ!
ঋদ্ধি টেনে-হেঁচড়ে তুলে দিলো দিয়াকে।দিয়া বিছানায় চাদর গায়ে জড়িয়েই উঠে বসলো,তারপর বললো,
-উফফ!বড্ড জ্বালাস রে তুই!
-দিনদিন তো শুধু খেয়ে আর ঘুমিয়ে কুমড়ো হয়ে যাচ্ছিস!ওঠ-ওঠ!খাট থেকে টেনে দিয়াকে নামাতে গেলো ঋদ্ধি।
-চল!ঝর্ণা মাসি লুচি ভাজছে,আর তার সঙ্গে মায়ের হাতের ঘুগনি!!আহ!ফ্যান্টাস্টিক কম্বিনেশন!আমি কি ওগুলো টেবিলে বসে একা-একা গিলবো?চল-চল!একহাতে দিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে,ওকে ঘর থেকে টেনে বের করতে গেলো ঋদ্ধি।
-উফফ!ছাড় না!লাগছে তো!
-লাগুক,এত খাচ্ছিস,সব যাচ্ছে কোথায়!!
-উফফ!বাবারে!দাঁড়া না!যাচ্ছি তো,আমাকে এভাবে টানিস না ঋদ্ধি...তোর জ্বর কমেছে?
-না কমলে তোর সঙ্গে এত যুদ্ধ করতে পারি!
-হুম,তা অবশ্য!পালোয়ানের মতো তো শক্তি গায়ে!তুই যা,আমি আসছি!
-উঁহু!তোকে নিয়েই যাবো!আমি চলে গেলেই তো আবার তুই বিছানায় উল্টে পড়বি!চল-চল!
ঋদ্ধির টানাটানিতে খাট থেকে নেমে ওর ঘরে-পড়ার জুতোটা পায়ে গলালো দিয়া।তারপর ঘর থেকে বেরোলো ও,ঋদ্ধিও ওর কাঁধে একটা হাত রেখে ওর সঙ্গেই ঘর থেকে বেরোলো।হট-ওয়াটার-ব্যাগটা তখনও এলোমেলো চাদরের তলায় পড়ে রইলো।ওর ভিতরকার জলটা তখন তার উষ্ণতা,বেশ অনেকটাই হারিয়েছে....
(চলবে.....)
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন