অনুসরণকারী

মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

নির্বাক (দ্বিতীয় পর্ব)


 

নির্বাক


সাথী দাস


দ্বিতীয় পর্ব




বাইরের আধো অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটেনি।ঘরের মধ্যেও প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ডাইংয়ের বড় আলোটা জ্বালিয়ে রাত্রির দিকে একবার চাইলো সে।ওকে অসময়ে ওপরে দেখে একটু অবাক হলেও,সে একটাও কথা বললো না।হয়তো কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না।ফ্রিজ খুলে ডিপ-ফ্রিজ থেকে কিছুটা বরফ একটা কাঁচের গ্লাসে বের করে নিয়ে,ফ্রিজ বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ওপরে চলে গেলো।বরাবরই মণিমা ছাড়া এই বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কাছেই রাত্রি একরকম অস্পৃশ্য,অবহেলিতই বলা চলে।এমনকি বাড়ির ঠিকে কাজের বউ মালতীদি পর্যন্ত,বৌমনির কাছে ওকে নিয়ে মস্করা করে।ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ওকে তৈরী করার সময় দুহাত ভরে রূপ তো দিয়েছে,কিন্তু সেই রূপকে আড়াল করে রেখেছে বর্ষার আকাশের জল ভরা কালো মেঘের মতো রঙ দিয়ে....তার চোখে রাত্রি আজ মেঘবালিকা....এই কি সেই মেঘ,যা এই মুখার্জী বাড়ির খোলা ছাদে একদিন বয়ে আনতো মনকেমনের বৃষ্টি...এই কি সেই বৃষ্টির ধারক,যে বৃষ্টি কচুবনে-কলাবাগানে ঝরতো অঝোর-ধারায়!এই কি সেই বৃষ্টি,যে বৃষ্টিতে সারা শরীর ভিজিয়ে,শুধুমাত্র মাথাটুকু বাঁচানোর জন্য নীল দার সঙ্গে রাত্রি মাথা আড়াল করতো,সুবৃহৎ কচুপাতার আড়ালে!!নাকি এই বৃষ্টিই সেই সর্বনাশা বৃষ্টি,যা মায়ের দেহকে চিতায় দেওয়ার আগেই ভিজিয়ে দিয়েছিলো সেইদিন....

আলোটা নিভিয়ে দিলো রাত্রি।হঠাৎ করেই অসহ্য লাগছে এই আলো।বেলা বেশি হয়নি,সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে।আবার জানলার সামনে চোখ বন্ধ করে বসে,ভোরের শীতলতায় স্নান করে,অতীতে ফিরে গেলো রাত্রি।ফিরে গেলো সেই বারান্দায়,সেই উঠোনে,যেখানে মাকে এনে রাখা হয়েছিলো।বাবাকে তো ওর মনেই পড়ে না।এই বাড়ির একতলায় ওই ঘরটায় মাকে সঙ্গে করে,একরত্তি রাত্রিকে কোলে নিয়ে বাবা সংসার পেতেছিলো।কাজ করতো কোন এক চটকলে।ভাড়া দিতো,বাজার করতো,সামান্য দুটো খেতো,আর ওকে নাকি বুকে করে আগলে মানুষ করতো!এ সবই পরে বড় হয়ে মণিমার থেকে শোনা।রোগ যে বাবার হৃদপিন্ডে চুপিসাড়ে বাসা বেঁধেছিলো,সেটা ওই এটাকটার আগে কেউ বুঝতেই পারেনি।নিত্যদিনের মতোই সেদিনও নাকি বাবা কারখানায় গিয়েছিলো ডাল-ভাত খেয়ে,কিন্তু ফিরেছিলো খাটিয়ায় শুয়ে,চোখ বন্ধ করে।সেদিন নাকি রাত্রির মা একটুও কাঁদেনি।চুপ করে একতলার ওই বারান্দায় রাত্রিকে কোলে নিয়ে বসেছিলো।তিনকূলে ওর কেউ আছে কিনা,আজ আর রাত্রি জানে না।কোনোদিনও ওর জন্য,ওকে দাবী করে এই মুখার্জী বাড়ির দরজায়,কাউকে এসে দাঁড়াতে রাত্রি দেখেনি।সেদিন বাবা যখন ফুলের শয্যায় পরম নিশ্চিন্তে শেষবারের মতো নিদ্রামগ্ন হয়েছিলেন,রাত্রি তখন মায়ের বুক আগলে ঘুমিয়েছিলো বিভোর হয়ে।এরপরই শুরু হয়েছিলো মায়ের জীবন-সংগ্রাম।বড়মা অর্থাৎ মণিমার শাশুড়ি তখন এ সংসারের কর্ত্রী ছিলেন।উনি দীর্ঘদিন ধরে শাপশাপান্ত করে রাত্রির মাকে ঘর ছেড়ে দিতে বলেছিলেন।বাড়ির সকলেই নাকি তাই চাইতো!অভিভাবকহীন অবস্থায়,পরম যত্নে ছাঁচে ফেলে কালো কষ্টিপাথরে গঠিত একজন পূর্ণযৌবনা বিধবা আর তার একমাত্র কন্যাসন্তানের দায়,সেই সময় কেউই নিতে রাজি হননি।সবাই ওদের উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।জ্যেঠুমণিকে ধরে কেঁদে পড়েছিলো মণিমা।এই মণিমার জন্যই সেদিন ওদের আর রাস্তায় নেমে দাঁড়াতে হয়নি।মণিমার একান্ত ইচ্ছেরক্ষার স্বার্থে,জ্যেঠুমণি ওদের মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু কিছুতেই কাউকে কেড়ে নিতে দেননি।আজও আবছা-আবছা মনে পড়ে রাত্রির...রাতে বড়মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি সকলের নজর এড়িয়ে,নিজের খাওয়ার পাত থেকে তুলে রাখা মাছের বড় টুকরোটা,ভাজাভুজি,একটু ডাল,কাপড়ের আঁচলের তলায় কাঁসার থালা-বাটিতে করে লুকিয়ে নিয়ে একতলায় আসতো মণিমা।খিদের জ্বালায় ওর কান্না থামাতে কোনোদিন মুড়ি,কোনোদিন একমুঠো চিঁড়ে ভিজিয়ে রাত্রিকে জোর করে গিলিয়ে রাখতো ওর মা।মণিমা এসেই ঘুম থেকে রাত্রিকে টেনে তুলে,হ্যারিকেনের আলোয় কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিয়ে যেতো।রাত্রি ঘুমচোখে দেখতো,আলোর অভাবে খুব সাবধানে কাঁটা বেছে খাওয়াতো মণিমা।বড়মা বলতো,বিনে-পয়সায় থাকতে দিয়েছে,এই ঢের!অত আলো-বাতাস দিতে পারবে না।তাই সন্ধ্যে নামার পর আলো জ্বলতো না,পাখা চলতো না ওদের ঘরে।হ্যারিকেনের আলোই ছিলো একমাত্র ভরসা।কিন্তু সেই আলোটুকুও সেদিন নিভে গেলো,যেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো।হলুদ রঙের ওপর অজস্র লাল ফুটকি দেওয়া একটা ফ্রক পরে,এলোমেলো জট পাকানো চুলে বারান্দায় এসে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলো রাত্রি।ওর বয়স তখন চার বা পাঁচ!কিন্তু ওর আবছা মনে আছে,সারাদিন অঝোর-ধারায় বৃষ্টি হয়ে,সেই সময় টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো।মায়ের গায়ের সাদা চাদরটা ভিজে যাচ্ছিলো বৃষ্টিতে।বেশিক্ষণ দেখতেই দেওয়া হয়নি ওকে।বাঁশের খাটিয়ায় মাকে বেঁধে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো সবাই।রাত্রি কাঁদেনি সেদিন!কারণ ও বুঝতো না,মৃত্যু কি!!শুধু ঘরে ঢুকে মায়ের সেলাইয়ের বাক্সটাকে খেলনা ভেবে,ওটা খুলে রঙিন সুতোগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেছিলো।সেই টেবিল-ক্লথটা আজও অসম্পূর্ণ অবস্থায় বাক্সে রয়ে গেছে।মা রেশমী সুতো দিয়ে ছুঁচ ফুটিয়ে-ফুটিয়ে,গোলাপী কাপড়টার এককোণে ফুলের নকশা বুনতে শুরু করেছিলো।কাজ পুরোপুরি শেষ হলে হয়তো কিছু টাকা পেতো।কিন্তু সেই কাজ,মা আর শেষ করতে পারেনি।পড়ে রয়েছে কয়েকটা অসম্পূর্ণ কাঁথাও।টেবিল ক্লথের এককোণে ফুলের একটাই মাত্র পাপড়ি ফুটেছিলো।বাকি সব পাপড়ি রোগের প্রকোপে শুকিয়ে ঝরে গেছে।মায়ের কি কঠিন রোগ হয়েছিলো,সেদিন বুঝতে পারতো না রাত্রি।কিন্তু আজ ও বোঝে।ওই মারণ রোগকে কর্কট রোগ বলে,যা মায়ের জরায়ুদ্বারে হয়েছিলো।প্রতিমাসে অবাঞ্ছিত অত্যধিক রক্তস্রোতে ভেসে গিয়ে,প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরণ-যন্ত্রণা সয়ে,রক্তাক্ত মা আজীবনের জন্য ওকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে....মা চলে যেতেই,বড়মা ওকে বাড়িছাড়া করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলো।পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো কোনো অনামী অনাথালয়ে।রাত্রির নাকি ওপরে উঠতে নেই।ওদের সঙ্গে বসে এক টেবিলে খেতে নেই!কিন্তু ওর বাবা বেঁচে থাকতে,বাবার ঘাম ঝরানো কষ্টার্জিত পয়সা তো বেশ নেওয়া যেতো!তখন তো কোথাও বাধতো না।দুচোখে মুক্তোদানার মতো টলটলে জল নিয়ে,জানলার গরাদ ধরে মৃদু হাসলো রাত্রি।বয়সে-অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়ে আজ ও বোঝে,তিনটে জিনিসের কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ হয় না।রক্ত,খিদে আর টাকা!সবাই হেরে যায় এই ত্রয়ীর কাছে।মাথা নত করতে বাধ্য হয়।কতদিন দুপুরবেলা খিদের জ্বালায় কেঁদে অস্থির হয়ে যেতো রাত্রি।বড়মার কড়া হুকুম,বাড়ির সবার খাওয়া হলে রান্নাঘর পরিষ্কার করে,তবে ওকে ওই রান্নাঘরের এককোণে মেঝেতে বসে ভাত খেতে দেওয়া হবে।মণিমা ওপর থেকে কখন খেতে ডাকবে,স্নান করে সেই আশায় বসে থেকে-থেকে এক-একদিন কৌটোর অর্ধেক বিস্কুট,বাতাসা-নকুলদানা সব খেয়ে ফেলতো রাত্রি।তারপর জল খেয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে বসে থাকতে-থাকতে,ঢুলে পড়ে যেতো।কোনো-কোনোদিন হয়তো শুয়ে ঘুমিয়েই পড়তো।সবার খাওয়া হয়ে গেলে,মণিমা যখন ওকে ডাকতো,কোনো সাড়া পেতো না।তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমেই ঘুমন্ত রাত্রিকে বুকে করে তুলে,নিয়ে যেতো ওপরে।ওকে খাওয়াতে-খাওয়াতে প্রায় দিনই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলতো মণিমা।অবুঝ রাত্রি ভাবতো,ওর মতোই বুঝি মণিমারও খিদে পেয়েছে।পেট মুচড়ে ব্যথা করছে,গুড়গুড় করছে পেটের ভিতর,তাই মণিমা কাঁদছে!রাত্রি ওর ছোট্ট-ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে,নিজের থালা থেকে একটুখানি ভাত নিয়ে তুলে দিতো মণিমার মুখে।মণিমা নিঃশব্দে কাঁদতে-কাঁদতে ওই ভাতটুকুই কোনোক্রমে গিলে রাখতো।তারপর ওকে জড়িয়ে ধরতো বুকে।চুমু খেয়ে আদর করে-করে,বাকি ভাতটুকুও মণিমা কত যত্ন করে রাত্রিকে খাইয়ে দিতো!তারপর চোরের মতো চুপিসাড়ে একতলায় এসে,ঘুম পাড়িয়ে দিতো ওকে।আজও ভাবলে অবাক লাগে রাত্রির।সেই সময় ওকে ঘিরে ওপরে মুখার্জী পরিবারে,রীতিমতো ঠান্ডা-লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিলো।শুধুমাত্র রাত্রিকে একতলা থেকে দোতলায় ওঠানোর জন্য,অসম লড়াই শুরু করেছিলো মণিমা।বাড়ির কর্ত্রীর বিরুদ্ধে,ননদের বিরুদ্ধে এক নির্বাক নারীর যুদ্ধ!!যে বলতে পারে না,সে কি চায়!কেন চায়!তার কথা বা ইচ্ছের স্বপক্ষে,কোনো যুক্তি তার কাছে নেই।থাকলেও,তা কাউকে বোঝানোর কোনো ক্ষমতা নেই।কারণ তার ঝুলিতে,জন্ম থেকেই ঈশ্বর কোনো শব্দ দেননি।অথচ ওই একটিমাত্র অস্বাভাবিক ব্যাপারই তাকে স্বতন্ত্র করে দিয়েছে,আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের থেকে।একঘরে করে দিয়েছে।আজীবনই বড়মার সকল বাক্যবাণ একতরফা শুনেই গেছে মণিমা।উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি আর।কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তার অদম্য জেদের কাছে হাত মেনেছিলেন ওই বৃদ্ধাও।আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে মণিমা যখন বিছানায় একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো,তখন একদিন মাতাপুত্রে তুমুল অশান্তির পর জ্যেঠুমণির কোলে চেপে রাত্রি পা রাখলো,ওপরের অচেনা-অজানা পৃথিবীতে।দোতলার ওই স্বপ্নের জগতে রান্নাঘরের মেঝে ছাড়াও যে,আরও অনেক দ্রষ্টব্য বস্তু ও প্রাণী আছে,সেদিনই প্রথম জানলো রাত্রি।বড়মা ঠাকুরঘরের দরজা বন্ধ করে নামগান করছিলেন।গঙ্গাজল ছিটিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে,পবিত্র করছিলেন ঠাকুরঘরের চৌকাঠ।জ্যেঠুমণি রাত্রিকে সন্তপর্ণে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,ওইদিকে কোনোদিনও যেন রাত্রি না যায়।তাহলে বড়মা খুব করে পিট্টি দেবে।ওদিকে ভুল করেও যেতো না রাত্রি।রান্নাঘরেই মণিমার পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়াতো খালি।আর দেখতো মণিমার পাশের ঘরের বিছানার ওপর ছড়ানো-ছিটানো কত্ত বই পড়ে আছে।একদিন ঘরে কেউ নেই দেখে,রাত্রি সাহস করে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে,ঢুকে পড়েছিলো ঘরের ভিতরে।বিছানার ওপর কত রঙচঙে বই,কত রংপেন্সিল...একটা বড় গোল আঁকা ছিলো সাদা খাতার ওপর।কচি-কচি নরম-মসৃণ হাতে রংপেন্সিলের বাক্স থেকে লাল রংটা তুলে নিয়ে,চুপিচুপি ওই লাল বৃত্তের মধ্যে একটু ঘষে দিয়েছিলো রাত্রি।তারপরই হাত কেঁপে উঠেছিলো ওর,

-ওই!তুই এখানে কি করছিস রে?!

প্রচন্ড ভয় পেয়ে খাতা-পেন্সিল সব ফেলে দিয়ে,রান্নাঘরে মণিমার কাছে দৌড় মেরেছিলো রাত্রি....পিছন থেকে চেঁচাচ্ছিলো সে,

-ওই শোন!আমি তোকে বকিনি!তুই কি করছিলি শুধু জানতে চাইলাম তো!পালাচ্ছিস কেন?ওই মেয়ে....

মণিমা সেদিন রাত্রির হাত ধরে খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলো।খুন্তি নেড়েছিলো তার মুখের সামনে।চেয়েছিলো জবাবদিহি....সে বলেছিলো,

-আরে মা!শোনো না!ঘরে ঢুকে দেখলাম ও আমার স্কুলের খাতায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে কি যেন করছে!তাই জানতে চাইলাম,ও এখানে কি করছে!কিছু না বলে,ও দৌড়ে পালিয়ে এলো!

তাকে আর কিছু বলেনি মণিমা।রাত্রির দিকে চেয়ে,ওর গাল টিপে আদর করে হেসে ফেলেছিলো শুধু।তারপরই রান্নাঘর থেকে পোড়া গন্ধ পেয়ে,খুন্তি হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছিলো ওইদিকে....তখনই বড়মা ঠাকুরঘরের দরজা খুলে ডাক দিয়েছিলো,

-নীলু....এদিকে শোন বাবা আমার!
-আসছি ঠাম্মি!
-ও বাছা!সোনা বাবা আমার!স্নান করেছিস বাছা?
-হ্যাঁ ঠাম্মি!এইতো স্নান করেই বেরোলাম।
-এই নে!একটু পেসাদ মুখে দে!ভগবান আমার বাবাকে সব রোগ-বালাই থেকে দূরে.....

রান্নাঘরের দরজার সামনে রাত্রি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো।ওর দিকে চেয়েই চেঁচিয়ে উঠেছিলো বড়মা...

-ও মা!এ কি রে!!তুই স্নান করে শুদ্ধু হয়ে,ওই অজাত-কুজাতের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস?!
-ঠাম্মি আমি প্রসাদ খাবো না!রেখে দাও।তোমার ঠাকুরের প্রসাদ,তুমিই খাও!
-কি!কেন?আহা!অমনি গোসা হয়ে বাবুর গাল ফুলে গেলো!!যেমনি বাপ তার তেমনি ছা!আমার পেটের ছেলেটাকেও ওই মেয়ে পর করে দিলো গো!হয়েছেও ছেলে আমার মোক্তার!একটা কথা বলে পার পাওয়া যাবে না!আমাকে যেন হাইকোর্ট না দেখায়!এ সংসারে আমার কথাই শেষ কথা!সবার বিচার আমিই করবো,এটা যেন মনে থাকে!নিজে তো এক পন্ডিত,আবার বউকে লেখাপড়া শিখিয়ে আরও বিদ্বান করবে!!ছেলের ঢং দেখে বাপু বাঁচি না!বাড়ির বউ হয়েছে,ঘর-সংসার সামলাবে,ঠাকুর-গোপাল সেবা করবে,সোয়ামীকে ভগবান বলে পুজো করবে,আমাকে একটু ভক্তি-ছেদ্দা করবে,তা না....দিনরাত দরজা বন্ধ করে ছেলেকে পড়াচ্ছে,আর নিজেও ফাঁক পেলেই বইতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে।তাও কি ভাগ্যি আমার,ভগবান ওই মেয়ের মুখে বোল ফোটায়নি,নইলে যে কি হতো সে আমার ঠাকুরই জানে!মুখ দিয়ে একটা কথা না বলেও যেভাবে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে,সে লজ্জার কথা আর কাকে বলবো!বুঝলে বাছা,আমরাই এত মুখ চালিয়েও পারলাম না,নিজের সোয়ামীকে হাতের মধ্যে রাখতে!ঠাকুরের মতো আজীবন শুধু স্বামীসেবাই করে গেলাম!আমার একমাত্র বংশ পিদিম,আমার নীলু,আমার নাতিটাকেও রেহাই দিলে না গো!এখন ওটারও মাথা খাচ্ছে!!

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে মণিমা এসে দাঁড়িয়েছিলো ঘরের মাঝে।সে ভয় পেয়ে মায়ের দিকে চেয়েছিলো ভীতু দৃষ্টিতে।মণিমা শুধু জ্বলন্ত চোখ দেখিয়ে,ইশারায় তাকে একবার বলেছিলো নিজের ঘরে যেতে।বাধ্য ছেলের মতো আর কোনোদিকে না চেয়ে,তাই চলে যাচ্ছিলো সে।কিন্তু আবার ফিরতে হয়েছিলো তাকে,

-ওই ছেলে শোন!
-কি!
-এদিকে আয়!এই নে পেসাদ!

সেদিন তার হাতে দুখানা সন্দেশ ধরিয়ে দিয়েছিলো বড়মা।

-দুটো খাবো না আমি!একটা রাখো!একটাই দাও!
-আ মরণ!তোকে দুটো খেতে কে বলেছে!তাকে না দিলে তো আবার তার মণিমার মুখ হাঁড়ির পিছনের কালির মতো কালো হয়ে থাকবে।শোন,ওই মেয়েকেও একটা দিয়ে দিস!নইলে আবার তোর মা তোকেই বড় করে চোখ দেখাবে!তোর থেকেই ভেঙে ওকে সন্দেশ দেওয়াবে...

সেদিন বড়মার কথা শুনে চুপ করে মুখ টিপে হেসেছিলো সে।মণিমাকে,মণিমার জেদকে যে বড়মাও একরকম ভয়ই পেতো,সমীহ করে চলতো,সেটা বুঝি সেও জানতো।কিন্তু মুখে স্বীকার করবেই না।বড়মা সংসারের ওপর থেকে,কিছুতেই তার কর্তৃত্ব হারাতে চাইতেন না।তাই মাঝে-মধ্যে একটু চেষ্টাও করতেন,মণিমার মতো হয়ে চলতে।কিন্তু ওই বয়সে আজীবনের সংস্কার ভেঙে বেরিয়ে আসতে,উনি আর পেরে ওঠেননি....প্রসাদ নিয়ে সে এগিয়ে এসেছিলো রাত্রির দিকে।তাকে এগোতে দেখেই,রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে মণিমার পা জড়িয়ে ধরে,কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলো রাত্রি।সে এসে হাত ধরে টেনে বের করেছিলো ওকে...তারপর টানতে-টানতে তার ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলো...

-ওই!তুই পালাচ্ছিস কেন রে আমাকে দেখে?!আমি বাঘ না সিংহ?যে তোকে খেয়ে ফেলবো?তোর নাম তো রাত্রি?তাই না!ওই মাথা তোল!এটা খা!ভালোলাগে না সন্দেশ খেতে?খেয়ে দেখ,খুব ভালো!কিরে?খাস না?
-হুম!
-তাহলে খা!মাথা নামিয়ে রেখেছিস কেন?ধর!আমি আমারটা খেয়ে নিলাম কিন্তু....তুইও খা!
-খেতে ভালো লাগে।কিন্তু গলায় আটকে যায় তো খেতে গেলেই!তখন বমি পায়!

থেমে-থেমে মৃদুস্বরে রাত্রি বলেছিলো।

-এই রে!দাঁড়া-দাঁড়া!এই যে!এটা আমার জলের বোতল।খেতে গিয়ে গলায় আটকালে,ঢক করে জল খেয়ে নিবি!ঠিক হয়ে যাবে।খা...দে মুখে....

সন্দেশটা সেদিন সে খাইয়েই ছেড়েছিলো।তারপর ওকে নিজের হাতে জল খাইয়ে বলেছিলো,

-সূর্য আঁকছিলি?লাল রং দিয়ে?
-না!ওসব আমি পারি না....ওইটা খুব ভালো লাগলো!তাই...
-ওটা তো লাল রং!রেড বলে ওটাকে!আয় না!বাকিটুকু রং কর!
-করবো?
-হ্যাঁ আয়...কর!বিছানায় উঠে বাবু হয়ে বোস।মা বলে পড়ার সময় সুন্দরভাবে বসতে হয়।তবেই পড়ায় মন বসে।এইরকমভাবে গুছিয়ে বোস।আমার মতো করে...

সে নিজেও সুন্দর করে বসেছিলো।তাকে দেখাদেখি রাত্রিও জোড়াসন করে বসেছিলো তার বিছানায়।সে হাত বাড়িয়ে উরুর ওপর উঠে থাকা রাত্রির জামাটা নিজের হাতে ঠিক করে দিয়ে বলেছিলো,

-এই দেখ,এটা লাল রং,রেড!সূর্যের রং লাল কর।বাইরে যেন না বেরোয়।ওই গোলের মধ্যেই কর।সাবধানে করবি।তারপর এই রেড আর একটু ইয়েলো দিয়ে,মানে হলুদ রং,এই যে....এটা দিয়ে,এই সূর্যের শুঁড় কর,চারদিক দিয়ে....ভেরি গুড!এই তো!দারুণ হচ্ছে!!এগুলো কি বলতো?রোদ!এই যে দিন হচ্ছে,রাত্রি হচ্ছে....
-আমি?
-নানা তুই না,দিন-রাত্রি,আরে আমাদের বইতে একটা চ্যাপ্টার আছে না....
-আমিই তো রাত্রি...
-আচ্ছা নে...তুই রাত্রি!উফ!পড়ানোর সময় মেয়েটা এত্ত বকে না...এই রাত্রি,তুই জানিস...পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে!আমরা ভাবি,এই সূর্য ডুবলো,চাঁদ উঠলো,রাত্রি...এই চাঁদ ডুবলো,সূর্য উঠলো,দিন।সব ভুল রে!তুই মায়ের কাছে চাঁদ উঠেছে,ফুল ফুটেছে শুনিসনি?
-না!মনে নেই!মণিমা হাত দেখিয়ে বলে,মা আর আসবে না।অনেক দূরে বেরু-বেরু গেছে!আমাকে না নিয়েই....

সেদিন কেঁদেই ফেলেছিলো রাত্রি...

-ওই তুই কাঁদিস না।আমার মা-ই তোর মা।মানে মণিমা।একদম কাঁদবি না কিন্তু।তোকে আমি চাঁদমামার গল্প শোনাবো,ঠাকুমার ঝুলি আছে আমার কাছে।ওতে লালকমল আর নীলকমল আছে।রাক্ষস-খোক্ষস আছে।বাঁটুল,বাচ্চু-বিচ্চু,হাঁদা-ভোঁদা,নন্টে-ফন্টে,কেল্টুদা,শুকতারা...কত্ত মজা আছে সব বইতে।তুই শুনবি সেইসব গল্প?
-শুনবো!
-আচ্ছা!আমি রোজ স্কুল থেকে এসে তোকে একপাতা করে গল্প পড়ে শোনাবো!তুই আর কাঁদবি না তো?
-না!
-ভেরি গুড!শোন,যেটা পড়াচ্ছিলাম।সূর্য কিন্তু ওঠেও না,অস্তও যায় না!আমাদের পৃথিবী ঘুরতে-ঘুরতে সূর্যের দিক থেকে ঘুরে যায় বলে,দিন-রাত্রি হয়!
-আমি হই!
-হ্যাঁ-হ্যাঁ তুই!ইস!তুই তো কিচ্ছু জানিস না রে রাত্রি!তুই পড়বি?আমি তোকে পড়াবো!স্কুলে যা শিখে আসবো,বাড়িতে এসে সব তোকে শেখাবো!শিখবি?
-শিখবো!রং করা শেখাবে তোমাদের স্কুলে?সূর্য আঁকা?
-তোর ছবি আঁকতে ভালোলাগে?
-এটা আঁকতে!
-এটাকেই তো ছবি বলে রে পেঁচি!পিকচার-পিকচার!আমাদের স্কুলে পিকচার-কম্পোজিশন আছে।আনসিন ছবি দেখে দশটা সেন্টেন্স লিখতে হয়।আমি তো সেই জন্যই নতুন-নতুন ছবি দেখে,মনে-মনে বাক্য সাজাই।আঁকিও...আঁকাও হলো,আবার পড়াও হলো।এটা আমাকে মা শিখিয়েছে।সবকিছুর মধ্যে থেকে নতুন কিছু শিখে নেওয়া।দাঁড়া তোকে একটা জিনিস দেখাই,আমার কত ছবির বই আছে দেখবি?!সব বাবা কোর্ট থেকে ফেরার সময়,আমাকে এনে দিয়েছে!এই দেখ,এই ছবির বইটা,আর এই গল্পের বইটা আমার গতবছরের জন্মদিনের উপহার।আমার তো এখন অনেক বড় ক্লাস।সারাদিন পড়তে-পড়তে আর এগুলো খুলে দেখার সময়ই হয় না।সব পড়েই থাকে।এই সবগুলো বই তুই নে!রং করবি!

সেদিন মহানন্দে তড়িঘড়ি একটা ছবির বই খুলে ব্যস্ত হাতে রংয়ের বাক্স থেকে,একটা রং উঠিয়ে নিয়েছিলো রাত্রি।সেটা ঘষতে শুরু করেছিলো সাদা জায়গায়....

-ওই কি করছিস?
-কি?রং করছি !তুমিই তো করতে বললে!
-এটা কি রং?
-জানিনা তো!
-এটা সবুজ!গ্রীন!
-ও...
-তুই কি রং করছিস?
-গ্রীন!
-নানা!যেটায় রং করছিস,সেটাকে কি বলে?
-কি বলে?
-আমাদের মাথার ওপর কি আছে?

মাথা তুলে সিলিংয়ের দিকে চেয়েছিলো রাত্রি...

-পাখা!কিন্তু আমার ঘরে পাখা চলে না,আলোও জ্বলে না!
-জানি রে!মা রোজ রাতে বাবার কাছে কাঁদে।
-মণিমা!কেন?
-জানিনা!তোর ঘরে আলো জ্বলে না,পাখা চলে না,ঠাম্মি দিনরাত মায়ের সঙ্গে চেঁচায়...ওই জন্য বোধহয়।নীচে আলো জ্বালাতে পারবে না বলেই তো,মা তোকে ওপরে নিয়ে এলো!চুপিচুপি তোকে বললাম।আর কাউকে বলবি না কিন্তু!তাহলে মা আমাকে খুব মারবে!বড়দের কথার মধ্যে একদম কথা বলতে নেই।বললেই,মা চোখ বড় করে!কিন্তু আমার যখন রাতে ঘুম আসে না,আমি জেগে পাশ ফিরে শুয়ে থাকি....আমি জানি,মা কাঁদে!

আবার আনমনে সবুজ রংটা ঘষতে শুরু করেছিলো রাত্রি....

-ওই পেঁচি!
-কি!
-দেখছিস না,নীচে গাছপালা-ঘরবাড়ি রয়েছে।ওপরের ফাঁকা জায়গাটায় তুই সবুজ রং করছিস কেন?কি বলে ওই ফাঁকা জায়গাটাকে?আমাদের মাথার ওপরে,এই ফ্যানের ওপরে,ছাদের ওপরে কি আছে?
-জানিনা তো!
-সে কি রে!তুই কোনোদিনও স্কাই দেখিসনি?

চুপ করে বসেছিলো রাত্রি!তার অবাক হওয়া মুখটা একভাবে দেখছিলো।তার চেয়েও বেশি হতবাক রাত্রি নিজেই।ওর জীবনে তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন,স্কাই কে?

-চল তোকে স্কাই দেখিয়ে আনি!আয়....

রাত্রির হাত ধরে একটানে ওকে বিছানা থেকে নামিয়েছিলো সে।তখনও তিনতলায় ঘর হয়নি,এমনকি দোতলাও অসম্পূর্ণ।ছাদে নিয়ে যাওয়ার আগে সে পকেটে ভরে নিয়েছিলো কয়েকটা রংপেন্সিল।আর হাতে মুড়ে গোল করে নিয়েছিলো ওই ছবির বইটা।আর এক হাতে রাত্রির হাতটা ধরে,ওকে নিয়ে গিয়েছিলো ছাদে....

-ওই দেখ!মাথার ওপরে দেখ!কি ওটা!
-কি?
-ওটাকেই স্কাই বলে।মহাশূন্য!আকাশ!আকাশের রং কি?
-কি...
-দেখ!এই চারটে রংয়ের মধ্যে কোনটা আকাশের রং?আমি বলবো না।তাহলে তুই নিজে কিছু শিখবি না।তুই একা-একা বল দেখি!

ওপরের সীমাহীন আকাশের দিকে চোখ তুলে চেয়েছিলো রাত্রি!তারপর মাথা নামিয়ে তার হাত থেকে তুলে নিয়েছিলো একটামাত্র রং পেন্সিল!

-একদম ঠিক!কি রং এটা?
-লাল-সবুজ-হলুদ!!নাতো!!কি এটা?
-এইতো!ভেরি ব্রাইট স্টুডেন্ট!একবার বলতেই তিনটে রংয়ের নাম শিখে গেছিস!এবার এটা শিখে নে!এটাকে নীল রং বলে...ব্লু!
-নীল!
-তাহলে কি শিখলি?
-আকাশের রং নীল!
-কারেক্ট!!
-আর আমার নাম কি বলতো?
-নীলু?বড়মা তখন ডাকলো!
-ধুৎ!ও তো ঠাম্মি আদর করে ডাকে,পিসিমনিও।আবার আমাকে গোপাল বলেও ডাকে।ওসব না।এমনিতে বাবা আমাকে ভালোবেসে নীল বলে ডাকে।
-নীল তো রংয়ের নাম!
-সেতো রাত্রিও অন্ধকার রাত্রির নাম!আবার তোর নামও....দুটোই হয়।
-আর কার নাম রাত্রি?!
-উফফ!তোর মাথায় কিচ্ছু নেই রে!আর একটু বড় হ!তারপর বোঝাবো।এখন তোর ওইটুকু মাথায় এতকিছু ঢুকবে না!তুই এখন শুধু আমার নামটা মুখস্ত কর।আমি স্কুলের খাতায় যে নামটা লিখি,ওটাই কিন্তু আমার ভালো নাম।কি বল তো?
-কি?
-স্বপ্ননীল মুখার্জী!তুই আমাকে কি বলে ডাকবি?
-সব...সাপ...কি!!
-থাক!থাক!ওসব সাপ-ব্যাঙ কিছু না।ওইকটা তো দাঁত তোর!আমার নামের যুক্তাক্ষর বলতে গিয়ে,জিভ জড়িয়ে গিয়ে তোর সবকটা দাঁতই খুলে যাবে।তুই আমাকে নীল বলে ডাকবি!কি বলবি?
-নীল!
-একটা চাঁটি মারবো!আমি তোর থেকে কত্ত বড়!সেটা তুই জানিস!দেখছিস...আমার হাত-পা তোর থেকে কত লম্বা!আমি কিন্তু নাইন প্লাস!এবারের জন্মদিনে টেন হবো।তুই?
-জানিনা...
-ও!আচ্ছা মা বলতে পারবে।ও আমি জেনে নেবো।এই তুই জানিস,আমি কিন্তু আবার ক্লাসের মনিটরও!এবার স্পোর্টসে রানে,হাই জাম্পে আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি!ক্লাসের ফার্স্ট বয় আমি।আর তাকে তুই নাম ধরে ডাকছিস?!তোর সাহস তো কম না!দাদা বলবি,দাদা!কি বলবি?
-দাদা!
-হুম!নীল দা বলে ডাকবি!আমাকে ভয় করবি কিন্তু!ডাক আমাকে...
-নীল দা....
-গুড!মনে থাকবে আমার নাম?
-হুম!থাকবে...
-কোনোদিনও ভুলবি না।আচ্ছা শোন!নে এবার এখানে বোস।আকাশ দেখতে-দেখতে বইয়ের আকাশে নীল রং কর দেখি!আমি চেক করে রাইট দেবো।সুন্দর করে রং করলে ভেরি গুড পাবি।যেমন আমি সব ঠিক করলে,ম্যাম আমাকে খাতায় ভেরি গুড দেয়,আমিও তোকে দেবো!আজ থেকে আমি তোর টিচার!আর তুই আমার স্টুডেন্ট,বুঝলি!আমি পড়াবো তোকে...নে,এবার রং কর!

সেদিন একমনে মাথা নীচু করে ছোট্ট-ছোট্ট হাত দিয়ে,নিজের সল্প পরিসরের রঙিন স্বপ্নের আকাশটা, নীল রঙ দিয়ে ভরাট করতে শুরু করেছিলো রাত্রি....নীল দা আবার বলেছিলো,

-তুই জানিস রাত্রি,আকাশ নীল মানে কিন্তু সত্যি-সত্যি নীল নয়!
-মানে?আমি ভুল করছি?আমাকে ভেরি গুড দেবে না?!ভালো হচ্ছে না?!
-নানা!রং করার সময় তো নীল রংই করতে হবে।ওটাই বইতে থাকে।ওটাই আমরা দেখি।কিন্তু আমরা যেটা দেখছি,সবসময় যে সেটাই সত্যি হবে,তা কিন্তু নয়।আকাশ নীল নয়,কিন্তু আকাশকে নীল দেখায়।বুঝলি?

দুদিকে ঘাড় নেড়ে না বলেছিলো রাত্রি....ও বোঝেনি....

-এই দেখ!মন দিয়ে শুনবি।পড়াশোনায় মন না দিলে কিন্তু কিছুই শিখতে পারবি না।তাই মন দিয়ে শোন,আমি কি বলছি!কালই এটা আমি জি.কে. তে পড়েছি।কি যেন মুখস্ত করলাম....হ্যাঁ!

সেদিন দুচোখ বুজে দুলে-দুলে পড়া বলতে শুরু করেছিলো নীল দা...

-কোন কিছুর ওপর আলো পড়লে সে ওই আলোটা চারদিকে ছড়িয়ে দেয়,যাকে আলোর বিক্ষেপণ বলে।যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম,সেই আলোর বিক্ষেপণ তত বেশি হয়।আকাশ রংহীন।কিন্তু এখানে সব রংয়ের মধ্যে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম।তাই এই আলোর বিক্ষেপণ সবচেয়ে বেশি হয়,আর এই রংটাই আমাদের চোখে এসে লাগে।সেই জন্যই আকাশকে নীল দেখায়।বুঝলি?
-না....

হাঁ করে ছোট্ট রাত্রি সেদিন চেয়েছিলো নীল দার দিকে।যেন নীল দার মতো আশ্চর্য প্রাণী,গোটা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ নেই....

-আমিও কিচ্ছু বুঝিনি।শুধু মুখস্ত করে রেখেছি।আজ বিকেলে স্যার এলে বুঝে নিতে হবে।আমি বোধহয় ভুলও বললাম।আরও বায়ুমণ্ডল বলে কিসব যেন ছিলো।অর্ধেক ভুলেই গেছি।যেটুকু মনে ছিলো,তোকে বললাম।আমাকে আরও পড়তে হবে।কাল পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।শুধু পড়েই গেছি।কিচ্ছু মাথায় ঢোকেনি।আজ স্যারের থেকে পড়াটা বুঝে নেবো।মা শুধু পাশে বসে থেকে পড়তেই বলে,কিন্তু বুঝিয়ে দিতে পারে না!তাই স্যার বা বাবার জন্য বসে থাকতে হয়...

-নীল দা!সূর্যে রং থাকে?

-হুম!থাকে মনে হয়।তবে আগুনও থাকে!সবসময় আগুন জ্বলে!

-ওই আগুনে গরম ভাত রান্না হয়?ভাতের সুন্দর গন্ধ বেরোয়?বই পড়া যায়?মাছের কাঁটা বেছে খাওয়া যায়?আলো হয় নীল দা?আমার না অন্ধকারে একা-একা থাকতে খুব ভয় করে।সূর্য থেকে একটু আলো পাওয়া যাবে?হাওয়া লাগবে না...

-ধুস!কিসব যে বলিস না তুই!তবে স্যার বলছিলেন লাইট জ্বলে,পাখাও চলে।

-আমার ঘরে জ্বলবে?

-আচ্ছা দাঁড়া!আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করে বলবো!

-অনেক রং থাকে সূর্যে?তোমার এই সবগুলো রং পেন্সিলের থেকেও বেশি!

-নারে!সাতটা রং...

-কি রং?

-দাঁড়া!এটাও কাল মুখস্ত করেছিলাম।এখন ভুলে গেছি।আমাকেও আরও একবার পড়তে হবে।তোকে কাল বলছি!

-তাহলে আকাশ কি গ্রীনও হতে পারে?!ভুল তো নয়!যদি কোনোদিন নীল ছাড়া,ওটা আমাদের চোখে লাগে।

-না লাগবে না!ওরম হয় না।ম্যাম বলেছে,যেটা বইতে লেখা থাকে,সেটাই হয়।বইতে সব ঠিক লেখা থাকে।নীল ছাড়া কোনোকিছু তুই কোনোদিনও দেখবি না!বুঝেছিস?

-হুম!

-খুব তো ঘাড় নাড়া হচ্ছে!কি বুঝলি?পড়া মুখস্ত বল!

-আমি তোমাকে ছাড়া আর কিছু দেখবো না!

-কি!!এই না!আমি নীল আর আকাশের নীল আলাদা তো!উফ!তোকে বোঝাতে গিয়ে আমিই সব পড়া ভুলে যাবো।তোকে পড়তে হবে।আমাদের জেনারেল নলেজ বইতে অনেক কিছু আছে।যত পড়বি,তত জানবি!ফাঁকি মারলেই ফাঁকে পড়বি!সব অজানা থেকে যাবে।এই তুই ইংরেজি পড়তে পারিস?আমাদের স্কুলের প্রায় সব বই তো ইংরেজিতেই লেখা থাকে।

-আমি পড়তেই পারি না।বই নেই তো আমার...

-ও...তোর কোনো বই নেই?!দাঁড়া!বাবাকে বলবো,তোকে আগে অ-আ বই এনে দিতে।আগে বাংলাটা শেখ।সবার আগে অক্ষর শিখতে হবে।তবে তো বই পড়তে পারবি।সন্ধ্যেবেলা আমাকে স্যার পড়াতে আসে।দেখবি আমি কত্ত মোটা-মোটা বই পড়ি।দু-তিনটে বই তুই একসঙ্গে তুলতেই পারবি না।তোর ওই ছোট্ট হাত ব্যথা করবে।আমার স্কুলের ব্যাগ কত ভারী জানিস?আমি অনেক কিছু জানি।তোকেও শিখতে হবে।মনে রাখবি,পড়াশোনা করে যে,গাড়িঘোড়া চড়ে সে!পড়াশোনা করে না,গাড়িঘোড়া চড়ে না!পড়াশোনা না করলে তোকে কেউ কিন্তু ভালোবাসবে না।সবাই পচা মেয়ে বলবে।

-পড়াশোনা করলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে নীল দা?

-হুম!খুউব ভালোবাসবো!

-আমার মায়ের মতো করে ভালোবাসবে?

-জড়িয়ে ধরে?

-হুম!

-তোকে কেউ ভালোবসে না,নারে?!ঠাম্মি-পিসিমনি তোকে সবসময় বকে!

-মণিমা ভালোবাসে।আমাকে কোলে বসিয়ে কাঁটা বেছে মাছও খাইয়ে দেয়।

-আমিও তোকে ভালোবাসবো!তোর মণিমার চেয়েও অনেক বেশি।তুই আমাকে একদম ভয় পাবি না কিন্তু!হ্যাঁ,পড়ার সময় একটু ভয় পাবি।পড়া না পারলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো!

-আমি পড়বো না তোমার কাছে!

-অমনি রাগ হয়ে গেলো?এখন থেকেই ফাঁকি মারতে শুরু করলি?শোন!তোকে অনেক পড়তে হবে।একদম ফাঁকি মারবি না।রাতে স্যার আমাকে পড়িয়ে চলে গেলে,তুই আমার কাছে হোমওয়ার্ক দেখাতে আসবি।আর আমি যখন সন্ধ্যেবেলা পড়বো,সেই সময় তুই আমার পাশে বসে হাতের লেখা প্র্যাকটিস করবি।একদম সময় নষ্ট করবি না।সিলেবাস অনেক,সময় কিন্তু খুব কম।যত পারবি পড়বি!তারপর আমি স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে এসে,বাড়িতে তোর পরীক্ষা নেবো।আমার পুরনো খাতাগুলো সব তোকে দিয়ে দেবো।পিছনে অনেক ফাঁকা পেজ আছে।তাতে লিখবি!লিখে আমাকে দেখাবি!সব ঠিক হলে রাইট দেবো।ভেরি গুড পাবি।আর ভুল হলে....

-কান ধরে দাঁড়াবো না কিন্তু...


সেদিনই প্রথম মণিমার যত্ন করে বেঁধে দেওয়া বিনুনীটা জোরে করে টেনে ধরেছিলো নীল দা...


-আঃ!!লাগছে তো!

-পড়া না পারলে,এইভাবে আমি তোর চুল টেনে ধরবো!ঝুঁটি ধরে নেড়ে দেবো।এটাই তোর শাস্তি!নে-নে!রং করে আমাকে দেখা দেখি!এই দেখ!আবারও বলছি!মনে রাখবি....এটা লাল,রেড।এটা সবুজ,গ্রীন।এটা হলুদ,ইয়েলো!এটা নীল,ব্লু....

-নীল মানে তুমি...


আবারও হেসে উঠেছিলো নীল দা....ওর গাল টিপে আদর করে দিয়ে বলেছিলো,


-পেঁচি একটা!হ্যাঁ রে!!তোর কাছে নীল মানে তো আমিই...


চোখ বন্ধ করেই অতীতের স্মৃতিচারণ করতে-করতে স্বপ্নসুখে হেসে ফেলেছিলো রাত্রি।কিন্তু ধীরে-ধীরে সেই স্বপ্ন ওদের পুড়িয়ে দিতে শুরু করলো।ওর বন্ধ দুচোখের সামনে রাত্রি দেখলো,ফ্রেমবন্দী দুটো রঙিন শিশু ধীরে-ধীরে বড় হচ্ছে,আর কেমন যেন রংহীন-ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে ওরা!!একসময় ওই রঙিন আকাশে আঁকতে থাকা,সুখী স্বপ্নের সমস্ত নীল রংটুকু কারা যেন শুষে নিলো!রাত্রি দেখলো,বিবর্ণ সাদা-কালো দুটি শিশু মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে...যাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সবটুকু রং....ঘিরে ধরেছে বিবর্ণতা।ওদের ওই বিবর্ণ রূপ রাত্রি আর সহ্য করতে পারলো না।দ্রুত নিজের চোখ খুলে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরতেই ও দেখলো,জানলার বাইরের আকাশের রং আজও একইরকম নীল।প্রকৃতি আজও সবুজ।বাড়ির পাশের জানলার সামনের বেড়ে ওঠা জবাগাছটায় ফুটে রয়েছে লাল-লাল পঞ্চমুখী জবাফুল।নাঃ!কোনো রং জীবন থেকে হারায়নি।সবই আছে।ক্ষণিক নিশ্চিন্ত হলো রাত্রি...বেশ অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে।চাদরটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো ও....চেয়ার ছেড়ে উঠেই রাত্রি দেখলো,ওপরের সিঁড়ি দিয়ে সে নামছে....ওর সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়লো।রাত্রি জিজ্ঞেস করলো,


-তোমার কি হয়েছে?আজ এতবার উঠছো!তাও এত সকালে?

-খিদে পেয়েছে!একটু কিছু খেতে দিবি?

-তখন বললে না কেন?আমি এক্ষুণি করছি।পিসিমনি,মামনি,বৌমনির জন্যও করি?

-পিসিমনির ঘরের দরজা বন্ধ।স্বর্ণও ঘুমোচ্ছে।যা করবি,শুধু আমার জন্যই কর।

-কি খাবে নীল দা?

-তুই যা খাওয়াবি!

-আচ্ছা!একটু ডিম-টোস্ট করে দিই!চেয়ারে বসো!

-চল তোর সঙ্গে রান্নাঘরে যাই।কতদিন ভালো করে তোর একটু খবর নেওয়া হয় না!তোর সঙ্গে কথাও বলা হয় না...

-আচ্ছা,এসো তবে!


-তোর কাজকর্ম কেমন চলছে?

-ভালো!

-তাহলে ওই অসভ্য লোকটাকে তুই বিয়ে করবিই?আমার একটা ভুলের জন্য,আমার ওপর অভিমান করে নিজেকে জলে ভাসিয়ে দিবি রাত্রি?

-ওটা ভুল নয়।তুমি এত সকালে ড্রিঙ্ক করেছো কেন নীল দা?

-তোকে যেটা জিজ্ঞেস করছি,সেটা বল!

-কাল রাতে খাওনি কেন?ওপর থেকে আর নামলেই না!আমি রাতে কতবার ডেকেছিলাম।বৌমনিকেও শাড়ি দেখতে ডাকলাম।কেউ দরজাই খুললে না!

-স্বর্ণ বিশাল ঝামেলা করছিলো।আর ভালো লাগে নারে অশান্তি!আমি চাইনি,তুই ওর মুখের সামনে গিয়ে পড়িস!তাই দরজাই খুলিনি!সরি!

-আমাকে এত শাড়ি-গয়না কিনে দেওয়া নিয়ে,বিয়ের খরচ নিয়ে,তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি হচ্ছে!তাই তো?মানে আমাকে নিয়েই....


চুপ করে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো স্বপ্ননীল....


-তুমি না বললেও,আমি জানি নীল দা!বৌমনি আমাকে একদম পছন্দ করে না!

-এ বিয়ে তুই ভেঙে দে রাত্রি!আমি ওই লোকটার বাড়ি বয়ে ওর মুখে লাথি মেরে,এ বিয়ে ভেঙে দিয়ে আসবো...শুধু তুই একবার না বল!নিজেকে এভাবে শেষ করে দিস না!এত আয়োজন,এত কিছু,সব ওই হতচ্ছাড়া-লম্পটটাকে বিয়ে করার জন্য?!উফফ....অসহ্য!

-নাও!তোমার ব্রেকফাস্ট রেডি!টেবিলে চলো!

-বিয়েটা ভেঙে দে না রাত্রি...প্লিজ!নইলে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি....আমার মনে হচ্ছে তুই আমার জন্য,এ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরোনোর জন্য ওই আপদটাকে... প্লিজ রাত্রি,ভেঙে দে...


টেবিলে এসে খাবারের প্লেটটা নামিয়ে রাখলো রাত্রি।নীল ওর কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।একবার মণিমার ঘরের দিকে চেয়ে দেখলো,তারপর চাইলো ওপরের সিঁড়ির দিকেও।সবশেষে স্বপ্ননীলের একেবারে কাছে এগিয়ে এসে,ওর চোখের দিকে চেয়ে বললো,


-আর কি করবো বিয়েটা ভেঙে দিয়ে?তুমি করবে আমাকে বিয়ে?


হতবাক হয়ে রাত্রির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো স্বপ্ননীল...


সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গিয়েছিলো আন্তরিক।কাল কাঁচের টুকরোগুলো তুলতে গিয়ে হাতটা একটুখানি কেটে,কাজ বাড়িয়ে বসে আছে ও।সামান্য ওষুধ লাগিয়ে নিয়েছিলো তখনই।তবে একটু ব্যথা এখনও আছে।ওই হাত দিয়েই কোনোরকমে চশমাটা মুছে নিলো ও।গতকালই বাড়ির বাজার হয়ে গেছে।আজ আর বাজার যাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই।এখন অপেক্ষা আপা নীচে কখন খেতে ডাকবে!ততক্ষণ একটু বইয়ের সান্নিধ্যে ডুব দিতে চাইলো আন্তরিক....খুলে বসলো ভীষণ পছন্দের "সঞ্চয়িতা"...

পৌঁছে গেলো চিরপরিচিত পংক্তিতে....


"তোমারে পাছে সহজে বুঝি   তাই কি এত লীলার ছল-

বাহিরে যবে হাসির ছটা      ভিতরে থাকে আঁখির জল।

বুঝি গো আমি,বুঝি গো তব       ছলনা-

যে কথা তুমি বলিতে চাও    সে কথা তুমি বল না।।"


বালিশের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছিলো আন্তরিক।কিন্তু প্রথম চার লাইনেই ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।আর এগোতেই পারলো না।চশমার কাঁচে জমা হয়েছে জল।বালিশে মুখ ঠেসে থাকায়,বাষ্পীভূত চশমার কাঁচও...একেবারে আবছা....বইয়ের একেবারে প্রথম পাতায় ফিরে গেলো আন্তরিক।মেয়েলি হাতের সুন্দর গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা,


"ভালোবাসি তোমায় প্রিয়,

মোর হৃদয় জুড়ে তুমিই আছো সখা...

প্রতিরাতের খোলা আকাশে,লালমাটির প্রতিটা কণায়,

আমি পাই তব দেখা!

রইলো আমার ভালোবাসাসহ অনেকটা আদর,

রইলো ভালোবাসার নির্ভেজাল একখানি দিক!

ঝুমুরের জন্মদিনে,আদরের ঝুমের পক্ষ থেকেই,

এই ছোট্ট উপহার গ্রহণ করুক,নির্লজ্জ আন্তরিক....."


ওই লেখাটুকুর ওপর বারংবার চুমু খেয়ে বইয়ের পাতা প্রায় ভিজিয়েই ফেললো আন্তরিক।তাও আজ নিজেকে শান্ত করতে পারলো না।চশমাটা খুলেই ফেললো চোখ থেকে।নোনতা জল জমা হয়েছে চশমার কাঁচের প্রান্তে...

ওই চশমাটার দিকেই একভাবে চেয়ে রইলো আন্তরিক...স্মৃতি হাতড়ে আবার ফিরলো লালমাটিতে ঢাকা রুক্ষ শহরের পথে....


সাপ্তাহিক পরীক্ষার খাতাগুলোর ওপর ঝুঁকে পড়েছিলো আন্তরিক।গত কয়েকদিন ধরে চোখটা ভীষণ অসুবিধে করছে।কাছের কিছু পড়াই যাচ্ছে না,একেবারে ঝাপসা!বইয়ের পোকা ও।কিন্তু বই পড়তে গেলেই চোখ থেকে জল পড়ছে।দূর থেকে ঘাড় সোজা করে চেয়ারে সটান হয়ে বসে কাজ করতে হচ্ছে।বিরক্ত হয়ে গেলো আন্তরিক....খাতার ওপর পেনটা নামিয়ে রেখে উঠে এলো ওপরে....


-বৌদি?

-হ্যাঁ অন্তু,এসো!দরজা খোলাই আছে।

-বলছি একটু বলতে পারবেন এখানে ভালো চোখের ডাক্তার কোথায় বসে?

-এই তোমার দাদা গত মাসেই তো চোখ দেখিয়ে চশমা নিলো।ওই যে পৌর বাজারের ওখানে যে চালের আড়তটা আছে না,তার পাশ দিয়ে গিয়েই...


চুপ করে মন দিয়ে বৌদির কথা শুনে নিচ্ছিলো আন্তরিক।হঠাৎই কথার মধ্যেই ও দুম করার জিজ্ঞেস করে বসলো,


-আচ্ছা!আমি আর স্পন্দন দা এক্সিডেন্টের পর যে হসপিটালে সেদিন গেছিলাম,ওখানে চোখের ডাক্তার বসে না বৌদি?

-হ্যাঁ!নিশ্চয়ই বসে।তবে হসপিটালের ব্যাপার তো!অনেকটা সময় হাতে নিয়ে যেতে হয়।তারপরেও কাজ না হলে,বেকার একটা গোটা দিন নষ্ট!তোমরা কাজের মানুষ,স্কুল আছে।ওখানে গিয়ে সময় নষ্ট করবে কেন!বাইরেই দেখিয়ে নাও না...

-না!আমি ওই হসপিটালেই যাবো।দেখছি বৌদি!থ্যাঙ্কু...দাদা দোকান থেকে কখন ফিরবে?

-এই একটু পরেই!এই অন্তু,চা খাবে?

-না বৌদি!হাতের কাজ ফেলে এসেছি।একভাবে বেশিক্ষণ কাজ করতে পারছি না।মাথা ব্যথা করছে।চোখটা এবার দেখাতেই হবে।আর সেটা ওই হসপিটালে গিয়েই...এলাম বৌদি...


(চলবে.....)


ছবি : সংগৃহীত


ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

নির্বাক (প্রথম পর্ব)


 


নির্বাক


সাথী দাস


প্রথম পর্ব




-এই রাত্রি,দেখ না!এই শাড়িটা বেশি ভালো লাগছে!
-না পিসিমনি!ওইটাই থাক!টমেটো রেডে বিয়ের সাজটা খুলবে,মেরুনে সাজটা কেমন যেন চেপে যায়!মণিমা বারবার করে বলেছে এই লালটার কথা...
-বাব্বা!মণিমা অন্ত প্রাণ যে একেবারে!মণিমা বললো,আর তুইও বুঝে গেলি?
-একদম!আমি মণিমার সব কথা বুঝি পিসিমনি।এমনকি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও পড়তে পারি....
-বেশি বুঝিস তুই আর তোর মণিমা।ওই তো তোর গায়ের রংয়ের ছিরি।ওইরকম ক্যাটকেটে লাল পরলে,তোকে বিয়ের সাজে ওই শাড়ি আরও গিলে খেতে আসবে।যেটা বললাম,সেটাই নে।
-কেন পিসিমনি?এটা কমদামী,তাই এটাই নিতে বলছো?যাতে মণিমার বেশি টাকা খরচ না হয়!
-এই শোন!মুখে-মুখে...
-দোকানের মধ্যে এসব অসভ্যতা বন্ধ করো পিসিমনি।মণিমা লালের যে শেডটা নিতে বলেছে,আমি সেটাই নেবো।
-তা আমাকে ফোন করে ডেকে এনে কেনাকাটা করতে ঠেলে পাঠানো কেন বাপু!নিজের মেয়ের বিয়ের কেনাকাটা তো,সে নিজের হাতেই করতে পারতো!সব যখন মেয়েকে শিখিয়ে-পড়িয়ে পাঠিয়েই দিয়েছে,তবে আমি ওই ধরো লক্ষণ হয়ে থেকে,খামোখা বদনাম কিনবো কেন!যত্তসব ন্যাকামো!বলিহারি বৌদির আক্কেল!কপাল করে একটা মাথামোটা মেয়েছেলেকে বাগে পেয়েছিলি বাপু!বৌদির মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খেলি তুই!এরপর দেখবো,তোর ছেলেমেয়েরা কোনদিন আবার সম্পত্তিরও দাবী করে বসবে...

এমন অভব্য ব্যবহারের আর কোনো উত্তর দিলো না রাত্রি।শাড়িতে মনোযোগ দিলো।মুখ বেঁকিয়ে দোকানদারের দিকে চেয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে,মুখটা ফিরিয়ে মূল্যবান ঢাকাই জামদানীর দিকে ঝুঁকে পড়লো চৈতালী।শাড়ির দিকে লোলুপ দৃষ্টিদান করতে গিয়ে,উদ্ভিন্নাযৌবনা নারীর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেই ভুলে গেছে ও।তাড়াতাড়ি করে চৈতালী শাড়ি ফেলে রেখে বলে উঠলো,

-ওই রাত্রি!মামনি কোথায়?
-দেখো!ওর সঙ্গে আছে হয়তো।সবাই মিলে পাঞ্জাবী দেখছে।বৌমনিকেও তো দেখছি না,শাড়ি পছন্দ করতেও এলো না।ওদিকটায় একসঙ্গেই সবাই আছে!

রাত্রির কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলো না চৈতালী।শাড়ি ফেলে রেখে একমাত্র মেয়ে মামনির সন্ধানে,এগিয়ে গেলো অভিজাত জামাকাপড়ের দোকানের অপর প্রান্তে....

ফোনটা বেজে উঠতেই দৌড়ে গিয়ে রিসিভারটা কানে ধরলেন সৌদামিনী দেবী।কয়েক মুহূর্ত শুনেই,হাসিমুখে রেখে দিলেন ফোনটা....ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলেন,নিজের ঘরের দক্ষিণ দিকের খোলা জানালার দিকে...

-বৌদি,তুমিও পারো বাপু!এত ঘটা করার কোনো দরকার ছিলো কি!!কে?না মুখার্জী পরিবারের সামান্য একজন আশ্রিতা!তাকে এত বচ্ছর ধরে তো খাওয়ালে,পরালে,গুচ্ছের লেখাপড়া শিখিয়ে ব্যাগ বগলে চাকরি করতেও পাঠালে,এবার একটু আদিখ্যেতাটা কম করলে হয় না!বলি এ কি বাড়ির মেয়ের বিয়ে লেগেছে নাকি গো!এত আয়োজন!!মোচ্ছব লাগিয়ে দিলে তো তুমি!দুহাতে খরচ করছো!নিজের ভবিষ্যতের চিন্তাটাও তো করবে নাকি!আমাদের স্বর্ণালী কিন্তু এসব একদম পছন্দ করছে না।বাইরের একটা অজাত-কুজাত মেয়েছেলেকে নিয়ে এত কিসের নাচানাচি বৌদি?রেজিস্ট্রি করে কোনোরকমে পার করে আপদ বিদেয় করতে পারতে তো!আরে বাবা পাত্রপক্ষের তো আর কোনো দাবী নেই।মেয়ের ওই গতর দেখেই ছেলে গলে গেছে।চুপচাপ নিয়ে যাচ্ছে,যাক না! তুমি কেন দুহাতে এমন হরির লুটের মতো টাকা ওড়াচ্ছো?!যত্তসব ন্যাকামি!দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়।মাথার ওপর বলার কেউ নেই তো!আমার মা যদি আজ বেঁচে থাকতো,তবে এইরকমভবে বাড়ির বউকে নিজের গায়ের গয়না খুলে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে দেখলে,সংসারকে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়তো।মা নেই,তাই সবাই এখন স্বাধীন হয়েছেন....

বিছানার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে নতুন শাড়িগুলো।প্রায় অর্ধেক শাড়ির দোকান উঠিয়ে আনা হয়েছে।স্বল্পভাষী রাত্রি শাড়ি দেখার জন্য তিনতলার ঘর থেকে,বৌমনিকে ডাকতে গেছিলো।কিন্তু বৌমনির ঘরের দরজা বন্ধ!বার দুয়েক ডেকেও সাড়া পায়নি রাত্রি।তাই ও ধীরপায়ে নেমে আসছিলো সিঁড়ি দিয়ে।মণিমার ঘরে ঢুকতে গিয়েই পিসিমনির কথাগুলো শুনতে পেয়ে,রাত্রি ওইখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো।আর ঘরের ভিতরে ঢুকলো না।চোখে জল নিয়ে পা টিপে-টিপে নেমে এলো একতলায়,নিজের ঘরে।দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালো আয়নার সামনে।পাশেই তাকের ওপর রাখা একটা ফটো ফ্রেমে বাবা-মা হাসছেন....

রাজ্যের কথা শুনিয়ে ননদ হেলতে-দুলতে তিনতলায় চললেন,সৌদামিনী দেবীর একমাত্র পুত্রবধূর ঘরে।হাসিমুখে সব শাড়িগুলো ভালোভাবে দেখেশুনে একে-একে তুলে নিজের আলমারীতে রাখলেন সৌদামিনী দেবী।হাঁটুর ব্যথাটা গত কয়েকদিন ধরে বড্ড বেড়েছে।সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করতে বড় কষ্ট হয়!তাই সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে রাত্রির ঘরে বড় বিশেষ যাওয়াই হয় না।ফোনের রিসিভারটা হাতে তুলে নিয়ে,রাত্রির নম্বরে একটা ফোন করলেন সৌদামিনী দেবী।মণিমার নম্বরটা নিজের মুঠোফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই,দরজা খুলে তাড়াতাড়িই ওপরে উঠে এলো রাত্রি...তার আগেই অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে,কান্না লুকিয়ে নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে ও...

-বলো মণিমা!তোমার কি লাগবে?

রাত্রির হাত ধরে ওকে নিজের কারুকার্য করা সুশোভিত পালঙ্কের এককোণে বসালেন সৌদামিনী দেবী।মুখে একবার হাত বুলিয়ে একটু হেসে,ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলেন...

-আমিও হাসছি তো মণিমা...

দুদিকে ঘাড় নেড়ে ভ্রূকুটি করে উঠলেন সৌদামিনী দেবী।বকা দিলেন রাত্রিকে....রাত্রি হাসিমুখে মুখ লুকোলো মণিমার বুকে।

-বিশ্বাস করো,আমি সত্যিই খুব ভালো আছি।আমি হাসছি তো...

হাত নেড়ে নিজের ঠোঁটের কাছে হাতটা এনে,এ সংসারের সব কথা ছেড়ে,রাত্রিকে শুধু নিজের মনের মানুষটার কথাই ভাবতে বললেন সৌদামিনী দেবী।হেসে ফেললো রাত্রি।মণিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-আমাকে ছোট্টবেলার মতো করে ভোলাতে চাইছো মণিমা?আমি কিন্তু সব শুনেছি।তবে আমি কিছুই মনে করিনি।পিসিমনি তো সবসময় ওইরকমই বলে।আমি তো জানি।তাই আমি একটুও কষ্ট পাইনি।তবে তুমি কিন্তু এতটা খরচ না করলেই পারতে!এ তোমার বড় বাড়াবাড়ি...

রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু খেলেন সৌদামিনী।তারপর দুহাত নেড়ে ইশারা করে যা বললেন,তার মর্মার্থস্বরূপ রাত্রি যা বুঝলো,তা হলো...

"আমি তো চৈতীকেও সব দিয়েছিলাম।ও গুছিয়ে রাখতে না পারলে,সেই দোষ কি আমার!"

হাত নেড়ে কথা বলতে-বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন নির্বাক সৌদামিনী দেবী...

-মণিমা...শান্ত হও!বুঝেছি আমি।আর বলবো না।ভুল হয়ে গেছে।তোমার যা মন চায়,তুমি তাই করো!

কিন্তু শান্ত হলেন না সৌদামিনী দেবী।ওনার চোখের জল উপছে পড়ছে।নিজের দুচোখ দেখিয়ে চশমার ইঙ্গিত করলেন উনি।রাত্রি বুঝলো,মণিমা রুদ্র আঙ্কেলের কথা বলছেন।সৌদামিনী হাত নেড়ে-নেড়ে বলেই চললেন কত অব্যক্ত কথা...নিজের বুকে হাত রেখে রাত্রিকে বোঝালেন,

"কত ভালোবাসতো ওই মানুষটা চৈতীকে।তুই তো জানিস রাত্রি,চৈতী এইরকম ছিলো না।সংসারের আগুনে পুড়ে গিয়ে,ও এমনটা হয়ে গেছে!আমি বললাম,ওই রুদ্রশেখরের সঙ্গেই চৈতীর বিয়ে দাও।কেউ আমার কথা শুনলো না।আজ দেখ,মেয়েটার কি অবস্থা!আমার ওর ওপর রাগও হয়,আবার ওর জন্য খারাপও লাগে...."

-জানি মণিমা!তুমি এই মুখার্জী পরিবারের কর্ত্রী।তোমার তো সবদিকেই জ্বালা!কাউকেই তুমি ফেলতে পারো না।
এমনকি সেদিন তুমি আমাকেও ফেলতে পারোনি।বড়মার কাছে এত কথা শুনেও,এত লাঞ্চনার পরেও,আমাকে বুকে করে আগলে রেখেছিলে।সেদিন তুমি না থাকলে,আমি কোথায় ভেসে যেতাম...কে জানে!আমি তোমাকে বুঝি গো মণিমা।তুমি একটু শান্ত হয়ে চুপটি করে বসে থাকো দেখি!তোমার খাওয়ার আগের ওষুধটা নিয়ে আসি দাঁড়াও।এভাবে হুটহাট করে মাথা গরম কোরো না।প্রেশারটার কথা যেন মাথায় থাকে....আর একটাও কথা বলবে না তুমি!চুপ!

নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে,ধীরে-ধীরে দুদিকে ঘাড় নাড়লেন সৌদামিনী দেবী।কেঁপে উঠে মণিমাকে জড়িয়ে ধরলো রাত্রি....

-ভুল হয়ে গেছে মণিমা!তুমি এত উত্তেজিত হয়ে গেছিলে,তোমার শরীরের কথা ভেবে,আমি ভুল করে বলে ফেলেছি!ভগবানই তো তোমাকে আজন্ম-নির্বাক করে রেখেছেন!আমি তোমাকে চুপ করতে বলার কে!আমার খুব ভুল হয়ে গেছে গো...

নিজের বুক থেকে টেনে তুলে,রাত্রির হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর ওর মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে,একঢাল কালো চুলের রাশি সরিয়ে ওকে ভালো করে দেখলেন,ওকে আবার জড়িয়ে ধরলেন বুকে....মণিমার বুকে মুখ লুকিয়ে পালঙ্কের পাশের ছোট টেবিলটার দিকে চেয়ে রইলো রাত্রি।ফটো ফ্রেমের মধ্যে একমুখ হাসি নিয়ে জ্বলজ্বল করছে সুপুরুষ স্বপ্ননীল...

রাত্রির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন সৌদামিনী দেবী।তারপর ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন।নীলের ছবির ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে,মাথা নামিয়ে নিলো রাত্রি।চোখের জল আড়াল করতে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো ও...

-আমি আসছি মণিমা।তোমার ওষুধটা কোথায় যেন...

আবার টেনে রাত্রিকে নিজের পাশে বসালেন সৌদামিনী দেবী।বিছানায় একটা হাত রেখে,অপর হাত নেড়ে-নেড়ে ওকে কড়া করে শাসন করে,নিঃশব্দে বললেন,

"আর যে কটাদিন এই বাড়িতে আছিস,তুই আমার কাছেই শুবি!"

চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে,হাসিমুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো রাত্রি....

শহরের অন্য প্রান্তে কানে ফোনটা ধরেই বিছানা আঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আন্তরিক।মধ্যরাত্রির জমাট বাঁধা অন্ধকার বিরাজমান,শহরের আনাচে-কানাচে।মাঝরাতে ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় অন্তুর।মাঘ পেরিয়ে ফাল্গুনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে দেওয়ালে ঝুলতে থাকা বাংলা ক্যালেন্ডারটা।হালকা ঠান্ডায় কম্বলের উষ্ণতা ত্যাগ করে নিজের ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো অন্তু।টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে,জানলাটা খুলে দিলো।উন্মুক্ত জানলা দিয়ে মাঝরাতের শীতল বাতাস ঘরে প্রবেশ করে কাঁপিয়ে দিলো ওকে।একটা সিগারেট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়াকে,অন্তু জানালার বাইরে বের করলো।জানলার সামনে থেকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো পড়ার টেবিলটার দিকে।পোড়ামাটির সুদৃশ্য একটা ঘোড়া সাজানো রয়েছে 'সঞ্চয়িতা'-র পাশেই।সিগারেটটা ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যবর্তী স্থানে বন্দী রেখেই,অন্তু ওই ঘোড়াটা দুহাতে তুলে নিলো।ওটা হাতে নেওয়ামাত্রই ওর গলাটা জড়িয়ে ধরলো দুটো হাত।ওর ডান কানের লতিটা আলগা মেয়েলি কামড়ে জ্বলে উঠলো।পোড়ামাটির ঘোড়াটা হাতে নিয়েই আন্তরিক গোস্বামী স্মৃতি হাতড়ে ফিরে গেলো বছরখানেক আগে,অতীতের পাতায়...ফিরে গেলো লালমাটির দেশ,বাঁকুড়ায়...

-স্পন্দন দা,লাগেনি তো তোমার?ইস!দেখি-দেখি!রক্ত বেরোচ্ছে তো!
-না রে অন্তু!ও ঠিক আছে।তোর হাতটাও তো অনেকখানি কেটে-ছড়ে গেছে।এখন তুই স্কুলে যাবি কি করে?
-আরে আমার কথা ছাড়ো।তুমি আগে হসপিটালে চলো।বাইকটা ঠিক আছে তো?চলবে তো?দাও আমি চালাচ্ছি,তুমি পিছনে বসো।

পকেট থেকে নিজের রুমালটা বের করে স্পন্দনদার হাতে জড়িয়ে ভালো করে বেঁধে দিলো আন্তরিক।নিজের ক্ষতস্থান খোলাই রইলো।ওই রক্তাক্ত হাতেই রাস্তা থেকে স্পন্দনদার বাইকটা আন্তরিক টেনে তুললো...

আন্তরিক গোস্বামী,পেশায় একজন শিক্ষক।সুদীর্ঘ ছাত্রজীবন পেরিয়ে,অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিজের যোগ্যতায় সবেমাত্র স্কুলের চাকরিটা পেয়ে বাড়িছাড়া হয়েছে অন্তু।বাবা সুমন্তকুমার গোস্বামী এককালে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও,বর্তমানে অবসর গ্রহণ করেছেন।কিন্তু তিনি স্কুল ছাড়লেও,সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ছাড়েনি।তাই শিক্ষকতাও মুক্তি দেয়নি তাঁকে।তিনিও শুন্য হাতে ছাত্রছাত্রীদের নিরাশ করে ফেরাননি।গৃহশিক্ষকতার কাজে নিজের বার্ধক্যের একাকী অবসরটুকু মনের আনন্দেই যাপন করছেন।বিপত্নীক সুমন্তবাবু বরাবরই নিজের মতো করে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।তবে একমাত্র পুত্রসন্তান অন্তু চাকরিসূত্রে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ায়,এখন বড্ড একাকীত্বের জ্বালায় ভোগেন তিনি।আজ সকালেও ছেলেটাকে উনি ফোন করেছিলেন,তবে আজ অন্তুটা ফোন ধরলো না।বেশ চিন্তিত মুখেই ওপর থেকে নীচে নামলেন সৌম্যকান্তি সুমন্তবাবু।একবার চাইলেন বড় আদরের স্থান "সুরসঙ্গম"-এর দিকে।আজ সোমবার।তাই সুবৃহৎ একখানা তালা ঝুলছে "সুরসঙ্গম"-এর দরজায়।শনি-রবিবার এখানে কচিকাঁচাদের কোলাহলের শব্দে কান পাতা দায় হয়ে যায়।সারাটা সপ্তাহ বন্ধু-বান্ধবহীন নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে-কাটাতে সপ্তাহান্তের জন্যই মুখিয়ে থাকেন সুমন্তবাবু।নীচের তিনটে ঘরই ভাড়া দেওয়া রয়েছে।কোনো ঘরে খুদে শিল্পীদের আঁকার ক্লাস হয়,কোথাও আবার কোনো দিদিমণি গানের তালিম দেন।আবার দুপুরের পর একজন নাট্যকার ভদ্রলোক আসেন অভিনয় শেখাতে।সন্ধ্যের পর একতলা থেকে ভেসে আসে ঘুঙুরের ঝমঝম শব্দ।নর্তকীর ঘুঙুরের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে,তবলার ওপর হাত আছড়ে পড়ে বাদকের।আট থেকে আশির সমাহারে মুখরিত হয়ে ওঠে বাড়ির সম্মুখভাগ।আট বছরের নাতির হাত ধরে আসেন,আশি বছরের বৃদ্ধ ঠাকুর্দা।যেন একইসঙ্গে একই জীবনের দুটি প্রতিচ্ছবি...মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।দুই প্রজন্ম যখন একসঙ্গে হাত ধরে সামনের ওই বড় রাস্তাটা পেরিয়ে এগিয়ে আসে "সুরসঙ্গম" এর দিকে,মনটা কানায়-কানায় ভরে যায় সুমন্তবাবুর।উনি আনোয়ারের মাকে বলে এক কাপ কড়া করে চা বাগিয়ে,দুপুর তিনটের মধ্যেই বসে পড়েন ওপরের বারান্দায়।দুপুর,বিকেল পেরিয়ে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে যায়,সময়ের আর হিসেবও থাকে না।একেবারে রাতের খাওয়ার আগে বারান্দা ছেড়ে ওঠেন উনি।আজ সকাল থেকে অন্তুর সঙ্গে একবারও কথা হয়নি।চিন্তিত-ভারাক্রান্ত সুমন্তবাবু,বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে নেমে পড়লেন রাস্তায়।তখনই প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা।মনে-মনে একটু খুশিই হলেন উনি।স্থানীয় বাজার পর্যন্ত এতখানি রাস্তা, একা-একা আর যেতে হবে না।একজন সমবয়সী সঙ্গী পাওয়া গেলো।সুমন্তবাবু এগিয়ে গেলেন সুপ্রিয়বাবুর দিকে....সুপ্রিয়বাবু বলে উঠলেন,

-কি হে মাস্টার!খুদে মাস্টারের কি খবর?সে ভালো আছে তো ওখানে?হাত পুড়িয়ে একা আর কতদিন খাবে?ছেলে চাকরি পেলো,এবার একটু জমিয়ে সংসার করুক।আমরা বুড়োরা আর কদিন!মরার আগে দুচোখ ভরে ওদের একটু সংসার করতে দেখে যাই!আমি তো আমার ছেলের বিয়ে খাওয়ালাম!এবার তো তোমার পালা হে মাস্টার...
-দাঁড়াও ডাক্তার!ছেলেটা আজ ফোন ধরেনি,এমনিতেই একটু চিন্তায় আছি।আর বিয়ে!!ছেলে তো নিজে থেকে কিছুই বলে না।সবে তো চাকরি পেলো।যাক কয়েকটা বছর।নিজে কিছু না বললে,তখন তো আমাকেই বলতে হবে।আসলে ওর মা থাকলে,হয়তো মাকে বলতে পারতো!কি জানি!আমার সামনে হয়তো সেভাবে সহজ হতে পারে না!কিন্তু ফোনটা কেন যে ধরলো না....বড় চিন্তা হচ্ছে!
-আরে ধরবে-ধরবে!ছেলেমানুষ,সবে-সবে একা থাকছে।ঘুম থেকে উঠে চোখদুটো খুলে গুছিয়ে সব কাজকর্ম নিজের হাতে করছে,ওকেও একটু সময় দাও।পরে ঠিক ঘুরিয়ে ফোন করবে।এত চিন্তা কোরো না।তা আজ বাজার থেকে কি নেবে?চিংড়ি নাকি পাকা কাতলা?
-নাঃ ডাক্তার!ছেলেটা না থাকলে একা-একা খেয়ে সুখ পাই না!ওই একটু সবজি-ডাল-ভাত খেয়েই দিন কাটিয়ে দিই।রাতে তো খাই খান দুই রুটি!আর এক গ্লাস দুধ।আমার রান্নাঘরে অত ঝামেলা নেই।একবেলায় আনোয়ারের মা যা করে দিয়ে যায়,তাতেই দুবেলা চালিয়ে নিই।অন্তুর মা বেঁচে থাকতে,আমার রান্নাঘর অন্নপূর্ণার হেঁশেল ছিলো।এখন সেসব পাট চুকেছে।কোনোরকমে পেটে দুটো দিয়ে,দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো।আগে তাও রাতে রুটি দিয়ে একটু আধটু মিষ্টি খেতাম।তা আমরা সুস্থ থাকলে,তোমাদের সইবে কেন!তোমাদের চলবে কি করে ডাক্তার!ব্যাস!বাধিয়ে বসলাম ডায়বেটিস!ছেলের কড়া শাসন,মাথার দিব্যি!মিষ্টি বাড়িতে আর ঢুকবেই না।যাও বা আগে দু-চারটে কিনে এনে চুরি করে খেতাম,এখন সেটাও ছাড়তে হয়েছে।আনোয়ারের মা কাজ করতে এসে রোজ ফ্রিজ খুলে দেখে যায়,ফ্রিজে মিষ্টি আছে কিনা!থাকলেই অন্তুদাদাকে ফোন করে দেবে।আর আমিও বুঝি এখন,ছেলেটা আমাকে ছেড়ে বাইরে পড়ে থাকে,হুটহাট আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে,ওকেও তো সব ছেড়েছুড়ে আসতে হবে।ও অসুবিধেয় পড়ে যাবে।তাই যতটা বুঝেশুনে চলা যায় আর কি!তবে আগেরবার আমার ছেলেটা এসে নিজের হাতেই বাজার-হাট করে আমায় খাইয়েছে।এবার আবার স্কুলের ছুটি পড়বে,তারপর আসবে।তখন বাপ-ব্যাটা মিলে জমিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাবো।
-ওখানে তো খুদে-মাস্টার পিজি আছে,তাই না?
-হুম!খুব ভালো ওরা।দাদা-বৌদির গল্প তো অন্তু গালভরে করে।ওদের ওখানেই তো খায়।
-তবে তোমার অত চিন্তা কিসের মাস্টার!?
-কি জানি!বাপের মন তো!ওর মা মারা যাওয়ার পর,নিজের হাতে ধরে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করেছি ছেলেটাকে!এখন ওকে ছাড়া কেমন যেন লাগে!পুরো বাড়িটাই ফাঁকা!কয়েক বছর পর যখন অভ্যাস হয়ে যাবে,তখন হয়তো এতটা খারাপ লাগবে না!এখন আর "অন্তু পড়ছিস তো?" বলে চেঁচাতেও হয় না!একা-একা আর ভালো লাগে না!বার্ধক্যের বড় জ্বালা,বুঝলে ডাক্তার!তোমার কাছে কোনো ওষুধ আছে নাকি!
-না হে মাস্টার!চুলে পাক ধরেছে,চামড়াও ঝুলে পড়ছে,এখন আবার তোমার কি ওষুধ চাই?এই বয়সে তোমার বার্ধক্য কাটিয়ে যৌবন ফেরানোর কোনো ওষুধ কিন্তু,আমার কাছে নেই!আগেই বলে দিলাম!আমি বাপু ডাক্তার!ভগবানও নই,ম্যাজিশিয়ানও নই,যে দুম করে তোমাকে তোমার কুড়ি বছর বয়স ফিরিয়ে দেবো!আবার তুমি বৌদির সঙ্গে ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াবে!বৌদির চোখে চোখ রাখবে...

সজোরে হেসে উঠলেন সুমন্তবাবু...

-আরে নানা!সেসব কিছু না!সেসব দিন তো কবে পেরিয়ে এসেছি।মনে হয় যেন গত জন্মের কথা!ওসব না ডাক্তার!শুধু একটু যদি ঘুমের ওষুধ পাওয়া যেতো,বড় ভালো হতো!সারাদিন তো তেমন কোনো কাজ নেই।ছেলেটা যতদিন না চাকরি পেয়েছে,ওকে তৈরি করার জন্য ওর পিছনে পড়ে ছিলাম।এখন হঠাৎ করেই যেন একদম বেকার-অকর্মণ্য হয়ে গেছি।ছেলেমেয়েগুলো আসে,ওদের পড়াই।ব্যাস!তারপর ছুটি।আর কোনো কাজ নেই।পেপার আর বই পড়ে কত আর সময় কাটানো যায় ডাক্তার!চোখে একটু ঘুমও নেই,যে ঘুমাবো!ঘুমও আমার সঙ্গে আড়ি করেছে বুঝলে তো...
-আরে এখন ওষুধ খেয়েও ঘুম আসবে না।আমরা যখন ঘুমের দেশে যাবো,আর ফিরবো না,বুঝলে!একেবারে চিরঘুমের দেশে।তাই যে কটাদিন বেঁচেবর্তে আছি,জেগেই কাটিয়ে দিই না হয়!তারপর কখন টুপ করে দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসবে,আমরা কেউ কি আগে থেকে বলতে পারি!ওসব ওষুধ-বিষুধ ছাড়ো!বিকেলে আমাদের লাফিং ক্লাবে এসো!একটু শরীরচর্চা-যোগব্যায়ামও হবে,আর সেই সঙ্গে প্রাণখুলে হেসে যাও দেখি....ফ্রিতে খানিক আড্ডাও হবে।তোমায় আজ মোটা করে দুধ দিয়ে,চিনি ছাড়া চা খাওয়াবো।আজ বিকেলে বেরোনোর আগে তোমাকে হাঁক দেবো আমি।বেল বাজাবো,তৈরি হয়ে থেকো...
-এই তোমার চেম্বার নেই?আজকাল দেখি প্রায়ই উড়ে-উড়ে বেড়াও!
-বয়সটা তো নেহাৎ কম হলো না।প্রায় সাতের ঘর ছুঁই-ছুঁই,বুঝলে হে মাস্টার!আর এখন ছুরি-কাঁচি হাতে নিলে,হাত কাঁপে!তাই ওই সপ্তাহে দুদিন একটু চেম্বারে বসি।অপারেশন আর করি না।পেশেন্ট দেখে সব ছাত্রছাত্রীদের হাতেই তুলে দিই চিকিৎসার জন্য।কিন্তু ওরা আমাকে ছাড়ে না।বলে,পুরোনো চাল নাকি আজীবন ভাতে বাড়ে!অভিজ্ঞতার জন্য আমাকে মাথার ওপর রেখেছে...মতামত নেয়,একটু ভক্তিশ্রদ্ধা করে।এই আর কি....
-ওই দেখো ডাক্তার!তুমি বলতে মনে পড়লো,ঘরে চাল বাড়ন্ত।তিনদিন ধরে আনোয়ারের মা বলছে,আজ না নিলেই নয়!নইলে কাল থেকে দুবেলাই রুটি চিবোতে হবে।তুমি কি মাছের বাজারে ঢুকবে ডাক্তার?
-হ্যাঁ মাস্টার!
-আচ্ছা...এসো তবে!আমার আর ওদিকে যাওয়ার ব্যাপার নেই।
-এত চিন্তা কোরো না মাস্টার!খুদে মাস্টার পরে ঠিক তোমাকে ফোন করবে।
-হুম...দেখি...

দুই প্রবীণ বাজারের দুদিকে চলে গেলেন ব্যাগ হাতে।মিশে গেলেন ভিড়ের মধ্যে....

-আরে দাঁড়া না!অন্তু!

ধমকে উঠলো স্পন্দন...

-আমার ইনজেকশনে বিশাল ভয় লাগে স্পন্দন দা!বাথরুমে যাবো আমি!পালাবো...
-অন্তু!!
-স্পন্দনদা!হার্ট ফেল করবো আমি...বিশ্বাস করো!
-দাঁড়ান!অনেকটা কেটে গেছে আপনার হাত!
-হ্যাঁ দিলেন তো ব্যান্ডেজ করে!ওতেই সেরে যাবে।আবার খামোখা ইনজেকশন কেন?

ধমকে উঠলেন একজন জুনিয়র ডাক্তার...

-এটা টিটেনাস!নিতেই হবে!
-অন্তু চুপটি করে বোস!এতবড় লোক...
-আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে!এই....এই আমি লোক নই!একি অত্যাচার!!আমি বাচ্চা ছেলে....
-আচ্ছা বুড়ো তুই!থামবি!?আমিও নিলাম তো!আমি চেঁচিয়েছি?
-আমি নেবো না!এসব জানলে আমি আসতামই না!ওইখান থেকেই স্কুলে পালাতাম...দেখো,এই শীতের মধ্যেও ভয়ে কেমন ঘেমে যাচ্ছি আমি!
-কি ব্যাপার!এত ঝামেলা কেন এমার্জেন্সিতে?এভাবে কে চেঁচাচ্ছে?!

নারীকণ্ঠের আবির্ভাবে আন্তরিক সিরিঞ্জ থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে চাইলো।এই সুযোগে তড়িঘড়ি শার্ট নামিয়ে নিলো ও।

-দেখুন না ম্যাডাম!টিটেনাস।কিছুতেই ইনজেক্ট করতে দিচ্ছে না।পেশেন্ট সুস্থির হয়ে বসছেই না!খালি তিড়িং-বিড়িং করে লাফাচ্ছে....
-আমি দেখছি!আপনি নেক্সট পেশেন্টকে দেখুন প্লিজ।সময় নষ্ট করবেন না।বাইরে লম্বা লাইন।আপনি স্যারের কাছে যান।কাইন্ডলি একবার আউটডোর হয়ে যাবেন।
-থ্যাঙ্কু ম্যাডাম!

ওই নারীর হাতে সিরিঞ্জ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক।নারীর পরনে নার্সের পোশাক।যতই ভয় করুক,একজন মহিলার সামনে হাউহাউ করে শিশুর মতো কাঁদা যায় না!অন্তু প্রাণপনে গলা ছেড়ে কাঁদার ইচ্ছেটাকে দমন করার চেষ্টা করলো।কিন্তু ওই নারীকে সিরিঞ্জ বাগিয়ে ধরতে দেখেই,ভয়ের চোটে আবার ওর জোর বাথরুম পেয়ে গেলো।পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে ডেকে উঠলো....

-শার্টের হাতাটা তুলুন!হাতটা একটু দেখি....
-ওরা তো ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ....
-হাতটা দেখি...

উপায়ান্তর না দেখে,অন্তু আবার নামিয়ে রাখা শার্টের হাতাটা গুটিয়ে দিলো।সেই নারী একবার অন্তুর মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে এগিয়ে গেলেন।অন্তু চেপে ধরলো সেই নারীর হাত,

-সিস্টার!মরে যাবো!প্রচন্ড লাগবে....

আন্তরিকের দিকে চেয়ে উনি মৃদু হেসে বললেন,

-আমরা মানুষকে মারার জন্য ইনজেকশন দিই না,সবসময় বাঁচানোরই চেষ্টা করি।এটাই আমাদের কাজ।তা কি করা হয়?আপনি কাজকর্ম কিছু করেন?
-হুম।স্কুল টিচার!
-ছাত্রছাত্রীরা জানে,স্যার যে এত সাহসী?
-না!আমি খুব রাগী টিচার!আমাকে সবাই ভয় পায়।কথা বলতেই সাহস পায় না।
-আর আপনার এই রাগ,এত অসমসাহসিকতা,একটা ইনজেকশনের কাছেই জব্দ!?

চুপ করে রইলো আন্তরিক...

-বাইকে একসিডেন্ট?
-হুম!

অন্তুর হাতের মধ্যে থেকে উনি নিজের হাতটা ধীরে-ধীরে বের করে নিলেন।কথায়-বার্তায় আন্তরিককে ব্যস্ত রেখে,তুলোটা ওর হাতে ঘষে নিলেন সেই নারী...তারপর বললেন,

-আজ তো বাইরে ভালোই রোদ উঠেছে।ঝকঝকে-চকচকে পরিষ্কার একটা দিন!এইরকম দিনে আছাড় খেলেন কি করে?উড়ছিলেন নাকি!
-না মানে...
-আমি চালাচ্ছিলাম বাইক...

স্পন্দন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।এগিয়ে এলো...

-হঠাৎই স্লিপ করে একপাশে কাত হয়ে গেছে।ব্যালেন্স রাখতে পারিনি...তাই...
-ঠিক আছে!দুদিনের ওষুধ দিয়েছে হয়তো।ওষুধগুলো ঠিকমতো খাবেন।দুজনেই ঠিক হয়ে যাবেন।
-ওষুধের পরেও আবার....উফ!!আমি মরে গেছি!

কথা শোনার জন্য একটু অন্যমনস্কভাবে অন্যদিকে ফিরে স্পন্দনদার মুখের দিকে চেয়েছিলো অন্তু।এর মধ্যেই নিজের কাজ সেরে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সেই নারী...তারপর এগিয়ে গেলেন ডাস্টবিনের দিকে।অবাক হয়ে গেলো আন্তরিক।

-এটুকুতেই আমাকে ছেড়ে দিলেন?সত্যিই দিলেন না!!
-আর কি দেবো?

ঘুরে দাঁড়ালেন সেই নারী...

-ওই যে,আপনার হাতের ছুঁচটা!ঠিকমতো ফোটালেন না?

নির্মল হাসি ঝরে পড়লো সেই নারীর সমগ্র মুখাবয়বে,

-হয়ে গেছে!
-কি!কখন!!বুঝতে পারলাম না তো!সামান্য একটুখানি লাগলো তো!
-তাতেই আপনি আগে থেকে যা প্রাণান্তকর চিৎকার জুড়েছিলেন....
-ঝুমুর দি!স্যার মেটার্নিটি ওয়ার্ডে একবার ডাকছেন।তাড়াতাড়ি এসো।পেশেন্ট রেডি হয়ে গেছে।একটু বিপিটা...
-তুমি যাও মাসি।আমি আসছি....

আবার আন্তরিকের দিকে ফিরলেন সেই নারী।

-শুনুন!এখন তেমন ব্যথা হবে না।কিন্তু টিটেনাস তো!পরে বুঝবেন।বিশেষ কিছুই না।ওই সামান্য একটু ব্যথাই হবে।দুদিনেই ঠিক হয়ে যাবে।আর হাতের ব্যান্ডেজটা দুজনেই একটু ড্রেসিং করিয়ে নেবেন।গেট ওয়েল সুন!
-ঝুমুর দি...
-এইতো,চলো....

সিঙ্কে হাত ধুয়ে বেরিয়ে গেলেন সিস্টার...

-কিরে অন্তু?লাগলো?তখন থেকে ভয়েই ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করছিলি!

আন্তরিক শার্টের হাতা নামাতে-নামাতে দরজার দিকে চেয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো।ওকে ধাক্কা দিলো স্পন্দন।

-কিরে?
-কি!
-লাগলো?
-না ঠিক লাগেনি....তবে বোধহয় বাজলো!
-কি?!কি বাজলো?
-ঝুমুর!ইয়ে স্পন্দন দা,ওষুধগুলো নিয়ে আসি দাঁড়াও...বাবাকেও একটা ফোন করতে হবে।ফোন করেই যাচ্ছে আমাকে....
-এসব আবার মেসোমশাইকে বলিস না!
-মাথা খারাপ নাকি!বাবাকে এসব বললে দিনে দুবারের জায়গায়,কুড়িবার ফোন করবে!আসছি আমি ওষুধ নিয়ে,তুমি এই চেয়ারে একটু বসো!

দুজনেরই বাঁ-হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে,ওষুধ নিয়ে,স্পন্দন দার বাইকের পিছনে বসে যখন হাসপাতাল চত্বর ছাড়লো,তখনও বারংবার বাইরে থেকে দরজার-জানালার দিকে ফিরে-ফিরে চাইলো আন্তরিক।এমনকি ওষুধ নিয়েও স্পন্দন দার চোখ এড়িয়ে,এমার্জেন্সির সামনের লম্বা বারান্দাটা থেকে টুক করে একবার দৌড় মেরে ঘুরে এসেছে ও।কিন্তু আর তার দেখা পায়নি...স্পন্দনদা ওকে স্কুলে ছেড়ে চলে গেলো নিজের কাজে।স্কুলের প্রথম দুটো পিরিয়ড মিস হয়ে গেছে।টিচার্স রুমে গিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলো আন্তরিক।বাঁ হাতের কাটা জায়গাটায় তেমন ব্যথা নেই,কিন্তু সে ইনজেকশনটা যেখানে দিয়েছে,সেখানটা প্রচন্ড ব্যথা করছে।হাত নাড়ানোই যাচ্ছে না।বাথরুমে গিয়ে কয়েকটা বোতাম খুলে শার্টটা একটু খুলে ফেললো আন্তরিক।হাতের দিকে চাইলো।বাঁ হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত নিখুঁতভাবে ব্যান্ডেজ করা,তারপর ওপরে রক্তের চিহ্নমাত্র নেই।কিন্তু হাতের ওপরদিকে প্রবল ব্যথা....

সে সামনে উপস্থিত নেই,তার স্পর্শটুকুও নেই,এমনকি স্পর্শের চিহ্নমাত্র নেই!ইনজেকশনের কোনো সূক্ষ ক্ষতও নেই,তাই ক্ষতের প্রলেপও নেই।কোত্থাও কিচ্ছু নেই।রয়েছে শুধু একটা চিনচিনে তীব্র ব্যথা...কিন্তু শুধু তো হাতে না,বুকটাও যেন একটু ব্যথা করে উঠলো আন্তরিকের।টিটেনাস নিলে কি বুকেও ব্যথা করে নাকি!হেসে ফেললো ও নিজেই।ঘন্টা পড়ে গেলো।তড়িঘড়ি জামার বোতাম আটকে আন্তরিক বাইরে বেরিয়ে এলো....

হাতে ধরে থাকা পোড়ামাটির ঘোড়াটা আন্তরিকের দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে।সিগারেট পুড়ে শেষ হয়েছে অনেক আগেই।ঘোড়াটার শক্ত পিঠে আদর করে চুমু খেয়ে টেবিলের প্রান্তে ওটাকে রাখতে গেলো আন্তরিক।হাতটা সরাতে গিয়েই সামান্য একটু জল থাকা কাঁচের গ্লাসটায়,অসাবধানে হাত লেগে গেলো।ওটাকে বাঁচাতে গিয়ে ঘোড়াটাই পড়ে যাচ্ছিলো টেবিল থেকে।সব ছেড়ে দিয়ে আগে ঘোড়াটাকে আঁকড়ে ধরলো আন্তরিক।ওটাকে বাঁচালো।কাঁচের গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে,জল ছিটকে একেবারে চুরমার হয়ে গেলো....

অতর্কিতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো রাত্রির।মণিমা ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে।একভাবে শুয়ে ঘুমটা বেশ এসে গিয়েছিলো ওর।কিন্তু হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেলো,কোনো কারণ ছাড়াই।প্রায় শেষ রাত তখন।বুকের ওপর থেকে মণিমার হাতটা সরিয়ে পাশ ফিরে শুলো ও।ঘরে সবুজ রঙয়ের হালকা আলো জ্বলছে।বিছানায় শুয়ে-শুয়েই টেবিলের দিকে চোখ রাখলো ও।মণিমার ঘরের নকশা করা গোলাকার কাঠের টেবিলটার ওপর রাখা ছবিতে নীল দা হাসছে,ওর দিকে চেয়েই....কয়েক মুহূর্ত ওই দিকেই চেয়ে রইলো রাত্রি।অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলে গেলো ওর সারাটা শরীর জুড়ে।ভালোলাগার আবেশে দুটো চোখ বুজে ফেললো ও....

-ওই পেঁচি শোন!
-নীল দা!চুলে লাগছে,উফফ!!ছাড়ো!

স্বপ্ননীলের ঘর পেরিয়ে চুপিসাড়ে পালাতে যাচ্ছিলো রাত্রি।কিন্তু ধরা পড়ে গেলো ও।নীলদা ঠিক টের পেয়ে গেছে।আর এসেই ওর কোমর পর্যন্ত দুলতে থাকা বিনুনীটা টেনে ধরেছে....

-বছর শেষে রেজাল্টের দিন আমার কাছ থেকে খালি পালিয়ে বেড়ানো হবে!তাই না!
-এবার আর পালাবো না,সত্যি বলছি!সবার আগে তোমাকেই রেজাল্ট দেখাবো!
-খারাপ হলেই তো পালাবি!
-পালাবো না,আরে খারাপ হবে না।ছাড়ো না আমায়!
-যাতে ভালো হয়,সেই চেষ্টাটা কর।তার জন্য পড়তে বসতে হবে তো।যা,বইপত্র নিয়ে আয়!আমি তোকে পড়াবো!
-তোমাকে কে পড়ায় তার ঠিক নেই,তুমি আবার আমাকে পড়াবে!
-কি বললি!আমার মুখে-মুখে কথা....দাঁড়া...

হাতের মুঠোয় ধরে থাকা রাত্রির বিনুনীটা আরও জোরে টেনে ধরলো স্বপ্ননীল...

-ওরে বাবা!তোমার জ্বালায় আমার সব চুল ছিঁড়ে গিয়ে,আমি কোনদিন ন্যাড়াই হয়ে যাবো!আচ্ছা...আমাকে এবেলা ছেড়ে দাও নীল দা!বিকেলে ঠিক পড়তে বসবো!
-খালি ফাঁকিবাজি তাই না!?ওসব একদম চলবে না!যাও,আগে বই নিয়ে এসে পড়তে বসো!
-এই তুমি সবসময় এত পড়া-পড়া করো কেন গো!মা কালীর দিব্যি বলছি,এবেলা ছেড়ে দাও।আচার খাওয়াবো!চুরি করে আনবো!
-এই কিসের আচার রে?
-কুলের!তোমার পছন্দ তো?বেশি করে নিয়ে দুপুরে চুপিচুপি ছাদে উঠবো।এখন ছেড়ে দাও না আমায়....
-এবার যদি ফেল করিস না...
-আজ পর্যন্ত কোনোদিনও করেছি?
-আমি চেপে না ধরলেই করবি!!তোকে আমি চিনি না!তুই বিশ্ব-ফাঁকিবাজ!আমি চেপে না ধরলে তুই ঠিক...

নীলের হাত ছাড়িয়ে পালালো রাত্রি।

-তুমি পারবেই না আমাকে চেপে ধরতে...আমি ঠিক পালাবো....
-আজ যদি সন্ধ্যেবেলায় পড়তে না বসিস না,দেখবি তোর মণিমাকে বলে দেবো,তোর পড়াশোনায় একটুও মন নেই!স্কুল ছাড়িয়ে ওই ঝগরুটে বুড়ির সঙ্গে ছাদে গয়না বড়ি দিবি,আর ছড়া কেটে-কেটে বরের নাক টেনে তুলবি!

দূর থেকে মুখ ভেঙিয়ে স্বপ্ননীলের সামনে থেকে ছুটে পালালো রাত্রি।হেসে নিজের ঘরে ঢুকে আবার নিজের পড়াশোনায় মন দিলো স্বপ্ননীল....

দুটো চোখ বন্ধ করে লজ্জা আর ভালোলাগার আবেশে,নিজেকে বিছানায় মিশিয়ে দিচ্ছিলো রাত্রি।স্বপ্ননীলের ছবির পাশে রাখা টেবিল ঘড়িটা কেঁপে উঠলো।পাঁচটা বাজলো বোধহয়।রাত্রি দৌড়ে গিয়ে এলার্মটা বন্ধ করে দিলো।এত সকালে এলার্ম দিয়েছে!মণিমা পায়ে এত ব্যথা নিয়ে,এই ভোরবেলা ঠান্ডার মধ্যে উঠে করেটা কি!সৌদামিনী দেবীকে আর ডাকলো না রাত্রি....নিজের হালকা চাদরটা চুড়িদারের ওপরেই ওড়নার মতো করে চাপিয়ে নিলো।মণিমার ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ের বাথরুমে ঢুকেছিলো রাত্রি।ডাইনিংয়ে এসে টেবিলের দিকের দুটো জানলা খুলে একটা চেয়ার টেনে ওখানে চুপটি করে বসলো ও।গতরাতে আর চুল বাঁধতে ইচ্ছে করেনি।খুলেই শুয়েছিলো।জট পাকিয়ে গেছে।জানালার বাইরের কুয়াশা ঘেরা প্রভাতের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে,অন্যমনস্কভাবে নিজের অগোছালো খোলা চুলে হাত চালাচ্ছিলো রাত্রি...হঠাৎই পায়ের শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে চাইলো ও,চমকে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো....

(চলবে.....)

ছবি : সংগৃহীত

ধারাবাহিকটি ভালো লাগলে ব্লগ থেকে নির্দ্বিধায় শেয়ার করুন ও সবাইকে পড়ার সুযোগ করে দিন।😊😊

রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

গল্পের সাথী গ্রুপ ইভেন্ট ২


 

গল্পের সাথী গ্রুপ ইভেন্ট


বিষয়‍‍‌ : "প্রথম স্পর্শ"


প্রথম স্থানাধিকারী


ফ্যালনা

স্বাতী বিশ্বাস

 

 

'তুকে কদ্দিন না কয়েছি ছোঁড়া উয়াদের লগে খেলা করতি যাবিক নাই ! কিছুতেই শুনবি নাই না ?'...বেধড়ক মারের পর বছর সাতেকের ফ্যালনা যখন প্রায় আধমরা, ঘরের বাইরে থেকে দোরটা বন্ধ করে দেয় তার মা 'আজ তোর খাওয়া জুটবেক নাই রে' চিৎকার করে কথাক'টা বলেই রাজ্যের বাসন মাজতে বসে পূর্ণিমা সকাল থেকে কাজের অন্ত নেই, তার ওপরে এসব ঝুটঝামেলা আর ভালো লাগে না...

সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের কোনও এক তস্য গ্রাম -সাহেবগঞ্জ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পার করেও এখানকার মানুষজনের মধ্যে জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ির মত মধ্যযুগীয় প্রথার বাড়বাড়ন্ত বেশ চোখে পড়ার মতো ! আর সেই কারণেই ফ্যালনা আর তাদের মত কয়েকঘর অন্ত্যজ পরিবারের বাস গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে, সেই যেখান থেকে জঙ্গল শুরু হয়েছে.. সেইখানে

গ্রামের একমাত্র দোতলা বাড়িটা ~ চৌধুরীদের পড়ন্ত জমিদারবংশের শেষ রেশটুকু বয়ে নিয়ে চলা দোর্দণ্ডপ্রতাপ চৌধুরীমশাই এই বাড়ি তথা সমগ্র গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা !

রোজ বিকেলে এলাকার কচিকাঁচারা হাজির হয় চৌধুরিবাড়ির বিশাল পাঁচিল ঘেরা উঠোনে কোনদিন কানামাছি, কোনদিন লুকোচুরি কোনদিন আবার গল্পের আসর বসায় বাড়ির বড়ছেলের বউ, মহামায়া বাচ্চারা মুগ্ধ হয়ে শোনে ! এই নতুন কাকিমাটি তাদের বড় প্রিয় ! শোনা যায়, মহামায়াার বাবা ব্রিটিশ আমলে জেল খেটেছিলেন

ভালো তো ফ্যালনারও লাগে ! এইসব খেলাধূলা , নতুন কাকিমা আর গল্পের আসর ! কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে তার ওখানে যাওয়া বারণ, তবু বালকের নিঃসঙ্গ পৃথিবী পাক খায় চৌধুরীবাড়ির উঠোনেটিকে কেন্দ্র করে

অবশ্য আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিলেও বেশিরভাগ দিনই দারোয়ানের নজর পড়ে যায় 'হেই ছোকরা, নিকাল্ ইঁহাসে ' লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসে সজাগ প্রহরী কোনোদিন আবার মা নিয়ে যায় মেরেধরে

আজ সারাটাদুপুর ঘরবন্দি ফ্যালনা বিকেলের ফুরিয়ে আসা আলোটা কমতে কমতে যখন একেবারে নিভে গেল.. মায়ের প্রাণ আর সইতে পারল না দোর খুলে দেখে একরত্তি ছেলেটি তার, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সারা শরীরে কালশিটে চোখ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসা জলের ধারাটা মুছে ডাক দেয়, ' ফ্যালনা, ওঠ্ দিকি, পান্তা এনেছি ' সন্তানের সব অভিমান শেষ হয় মায়ের আঁচলের তলায়। এক ঘুমে রাত কাবার করে দেয় দামাল ছেলেটা...

পরদিন খুব ভোরে উঠোনে এসে দেখে, একদল ছেলেমেয়ে মেঠোপথ ধরে সেজেগুজে চলেছে

'কুথাকে যাস সব ?'

'চৌধুরী বাড়ি যেতেছি আজ স্বাধীনতা দিবস যে ! পতাকা উড়বে, লাড্ডু দিবে ' এগিয়ে যায় দলটা...পরনে পাটভাঙা পোশাক, হাতে ফুলের মালা কেউবা ঝুড়ি ভরে নিয়েছে কুচনো গাঁদাফুল !

'মা, স্বাধীনতা কি বটে ?' ফ্যালনার বাপ্ বললে, 'ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে ! দেশ এখন আমাদের ! এখানে আমরা থাকবো কেউ অত্যাচার করবেক নাই , যেখানে ইচ্ছা যাবো, কেউ বাধা দিবেক নাই এটাই স্বাধীনতা !'

'তো.. চৌধুরীবাড়ী গেলে তুরা কেনে আমায় বকিস ?' উত্তর মেলে না

মন বড়ই অবাধ্য একসময় সকলের চোখ এড়িয়ে ফ্যালনা আবার হাজির হয় চৌধুরীবাড়িতে। ফুল পতাকায় সেজে ওঠা, সে যেন এক স্বপ্নরাজ্য ! কর্তামশাই পতাকা তুলছেন জাতীয় সংগীতে মুখরিত চারদিক ! অনুষ্ঠান শেষে সবার হাতে মিষ্টি আর পতাকা তুলে দিচ্ছেন মহামায়া....পাঁচিলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট মানুষটাকে আজ কেউই সম্ভবতঃ খেয়াল করে না...

নাঃ , এবার ফিরতে হবে সবেমাত্র বাড়ির পথ ধরেছে, হঠাৎই এক কোমল অথচ দৃঢ় হাত তার কাঁধে এসে পড়ল ! 'কিরে লাড্ডু না নিয়ে চলে যাচ্ছিলি যে বড় !' চমকে

পেছনে ফেরে ফ্যালনা !

সামনে দেবী প্রতিমার মত নতুন কাকিমা !'

অন্ততঃ দশজোড়া জ্বলন্ত চোখের নীরব অভিসম্পাতকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অতি যত্নে মিষ্টি আর পতাকা তুলে দ্যান ফ্যালনার ছোট্ট দুই হাতে !

ছেলের খোঁজে আসতে থাকা পূর্ণিমা আঁতকে ওঠে , ' কি করলে ! ওরে ছুঁলে কেনে ? আমরা যে অচ্ছুত্ ! ' দীপ্ত এক কণ্ঠস্বর সামান্য হেসে জানালো, ' কিছু হবেনা ! বিপ্লবীর মেয়ে আমি ! অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্বভাব আমার রক্তে ভয় নেই, বাড়ি যাও আর কতদিন গোলামী করবে?'

বানভাসি চোখের জলে বাকরুদ্ধ মায়ের আর কিছুই বলা হয়ে ওঠেনা বলা হয় না ফ্যালনারও। হয়তো বোঝেও না সবটুকু তবুও বালকের নির্মল মন নিজের মতো করে বুঝে নিল, জ্ঞাতিপরিজন বাদে অন্ততঃ একজন মানুষ তাকে ভালোবেসে স্পর্শ করল - এই প্রথমবার ! আজ মায়ের কোলে চেপে চৌধুরিবাড়ি থেকে ফিরছে সে - এই প্রথমবার , যেখানে পত্পত্ করে উড়তে থাকা জাতীয় পতাকাকে সাক্ষী রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক বিপ্লবীর সন্তান - সাহেবগঞ্জের ইতিহাসে এই প্রথমবার !!



দ্বিতীয় স্থানাধিকারী



রং তুলি ক্যানভাস

মেঘনা মাইতি

 

কাঁধের উপর আলতো হাতের ছোঁয়া পেতেই পিছনে ঘুরে তাকালো প্রিয়ব্রত

---"টুকাই,তোর ছবিটা পঞ্চাশ হাজার টাকায় বিক্রি হলো রে। আদিবাসী মহিলার যে পোর্ট্রেটটা তুই এঁকে ছিলিস, সেই ছবিটা নিয়েও আরও দু-তিনজন তোর ম্যানেজারের সাথে কথা বলছে। "

একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের,গ্যালারির অন্য একটি দেওয়ালে টাঙানো নিজের আঁকা ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ব্রত বলল,

---"সবই তাঁর জন্য মা। তুলির প্রথম স্পর্শের স্বাদ তো তাঁর কাছেই পাওয়া। মনে পড়ে তোমার তাঁর সাথে প্রথম আলাপের দিনটার কথা?? "

মা-ছেলের স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়ল বছর পঁচিশ আগের এক শীতের বিকেলের ঘটনা। প্রিয়ব্রতর তখন বছর তেরো কি চোদ্দ বয়স। ছবি আঁকার ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল তার। ভালোবাসত ছবির প্রদর্শনী দেখতে। ধীমান বসু ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। কিন্তু তাকে কখনো চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে প্রিয়ব্রত তার মা,মৈত্রেয়ী দেবীর সাথে ধীমান বসুর একটি ছবির প্রদর্শনীতে গিয়েছিলো সেই বিকেলে। গ্যালারির মধ্যে তাঁর আঁকা একটি ছবির দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল ছোট্ট প্রিয়ব্রত

হঠাৎ রোগা পাতলা, কালো চশমা পরা এক ভদ্রলোক এসে তাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,

---"এই ছবিটি পছন্দ? নেবে তুমি????"

চমকে পিছনে ফিরে তাকালো সে। সারল্য মাখা মুখে উত্তর দিলো,

---"ছবিটি কেনার টাকা তো নেই আমাদের কাছে। "

ভদ্রলোক হা হা করে হেসে উঠলেন

---"কিনতে হবে না, আমি তোমায়

উপহার দিলাম মনে করো। সব শিল্প বিক্রি করার জন্য তৈরী হয় না।"

এই সময় মৈত্রেয়ী দেবী বললেন,

---আসলে সকলের আঁকা দেখতে খুব ভালোবাসে। ধীমান বসু ওর খুব প্রিয় শিল্পী, সেই জন্যই আজ এখানে আসা। "

একটু অবাক হয়েই অচেনা মানুষটি বললেন,

---"এত ছোট বয়সে তুমি ধীমান বসুর নাম জানো??"

উত্তরে কিশোরটি জানালো সে আর ছোট নেই, ক্লাস সেভেনে পড়ে। ভদ্রলোক আবারও খুব জোরে হেসে উঠলেন। এরপরেই একজনকে হাঁক দিয়ে সেই ক্যানভাসটি নিচে নামিয়ে দিতে বললেন। ছবিটির নীচে করা সাক্ষর প্রিয়ব্রতকে দেখালেন। বেশ টানা টানা অক্ষরে লেখা "ধীমান বসু"....মা ছেলে অপলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে ছিল।

---"ছবি দেখার সাথে সাথে তুমিও নিশ্চয়ই বেশ এই শিল্পে পটু?? তুমি যেদিন এরকম এক্সিবিশন করবে সেদিন আমায় ডাকবে তো?" ধীমান বাবুর ডাকে সম্বিৎ ফিরলো ওদের।কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রিয়ব্রতর মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেল

---"আমি তো স্যার কোনোদিন ছবি আঁকতে পারবো না। "এই বলে মাথা নিচু করলো সে। ধীমান বাবু জানতে চাইলেন কি সমস্যা আছে তার। তখন মৈত্রেয়ী দেবী তার ছেলের গায়ে জড়ানো চাদরখানা সরিয়ে দিল।একি!কাঁধ থেকে কোনো হাত নেই,দুই কাঁধের নীচে সামান্য ঝুলন্ত দুটো মাংসপিন্ড মাত্র। জন্ম থেকেই বিকলাঙ্গ সে। ধীমান বাবু সাময়িকভাবে একটু ধাক্কা খেলেন। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন

---"একজন গুণী শিল্পী শুধুমাত্র শরীরের একটা অঙ্গ থাকবে না বলে তার শিল্পকলা থেকে দূরে থাকবে, এটা আমি মেনে নিতে পারবো না.. শিল্প আসে শিল্পীর কল্পনা থেকে, আসে তাঁর চিন্তাভাবনা থেকে।তাঁর সৃষ্টিশীল মনন থেকে জন্ম নেয় এক-একটা দুরন্ত শিল্পশৈলী। আর তুমি শুধু নিজের অক্ষমতা নিয়ে ভাবতে ভাবতে জীবনটা কাটিয়ে দেবে??? চোখের জলে অন্যের সৃষ্টির তারিফ করার সাথে সাথে নিজের উপায় নিজে খুঁজে বের করো। আমি তোমায় সান্ত্বনা দেবো না... কিন্তু তোমার সৃষ্টি করা প্রতিটা ছবির সমালোচনা করবো... তবেই তুমি আমায় মনে রাখবে

তারপর থেকে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে রং-তুলির সাথে নিবিড় বন্ধন গড়ে উঠেছিল প্রিয়ব্রতর। আজ সে প্রতিষ্ঠিত।শুধুমাত্র ধীমান বসুর জন্য নয়, তার অন্তত কঠিন প্রচেষ্টা তাকে প্রথম স্পর্শ পেতে সাহায্য করেছিল নিজের আঁকা প্রথম ক্যানভাসের সাথে

---"চলো মা, অনেক রাত হয়ে গেল...ঠান্ডাটাও বেশ জমিয়ে পড়েছে আজ। "কাঁধের চাদরখানা ভালো করে টেনে তুলে দিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। মা -ছেলে এগিয়ে চললো বাড়ির পথে



যুগ্ম তৃতীয় স্থানাধিকারী


স্পর্শাতীত

পিয়ালী খাঁ

 

 

"হাই,আমি রাজর্ষি। আপনি আমার বন্ধু হবেন?" সকালে ঘুম ভেঙে ফোনটা হাতে নিতেই মেসেঞ্জারে ঢুকলো মেসেজটা। বিশেষ পাত্তা দিলোনা পৃথা। ধরণের মেসেজে ভর্তি তার ফোনের ইনবক্স। ওই প্রথমে বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হবে, তারপর টুকটাক কথা চালাচালি, শেষে সেই একইরকম ঘ্যানঘ্যানেভাবে প্রেম নিবেদন...কোনো নতুনত্ব নেই। মনে মনে খুব একচোট হেসে নেয় সে

না, রাজর্ষি তার ভালোলাগার কথা জানাতে বেশি দেরি করেনি। পৃথার কাছে একদম অন্যরকম লেগেছিলো। একেবারে ভিন্ন, আলাদা মাত্রার। তাইতো এখনও পর্যন্ত বারোটা প্রেমের প্রস্তাব পাওয়া পৃথা না করতে পারেনি তাকে। মনের কোনো গহীন কোনা থেকে সম্মতি মিলে গিয়েছিল। ভার্চুয়াল প্রেমে বিশ্বাস না থাকলেও কেন জানিনা মনে হয়েছিল এই সেই মানুষ, এই সেই আপনার জন যার জন্য যুগ যুগান্তরের অপেক্ষা। খুব কম সময়ের মধ্যেই অনেকটা নৈকট্যে এসে গেছে তারা, যদিও তাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়নি আজও

সাত মাস পর,

আগামী রবিবার পৃথা আর রাজর্ষি প্রথমবারের জন্য দুজন দুজনের মুখোমুখি হবে। এক অজানা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে আছে পৃথা। কী যেন এক না বলতে পারা ভালোলাগায় মনটা আপ্লুত হয়ে আছে। মনে মনে স্বপ্ন সাজায় সে। রঙ-বেরঙের স্বপ্ন। প্রিয় বান্ধবী মিতালীকে আগেই জানিয়েছিল রাজর্ষির কথা। ছবিও দেখিয়েছিল। মিতালীও খুব এক্সসাইটেড। মিতালী আর সুদীপের তিন বছরের সম্পর্কের কথা পৃথা প্রথম থেকেই জানে।আরও অনেককিছু জানে সে। তাদের প্রথম স্পর্শ, প্রথম চুম্বন সব...সব বলেছে মিতালী তাকে। আর বেশ কিছু টিপসও সে পেয়েছে প্রিয় বান্ধবীর থেকে। ছেলেদের সাথে প্রথম দেখায় কীভাবে কথা বলতে হয়, কেমন আচরণ করতে হয় এইসব আর কী। @পিয়ালী খাঁ

কাল রবিবার। বহু প্রতীক্ষার অবসান। রাজর্ষি বলেছে পৃথার জন্য অপেক্ষা করছে একটি সুন্দর উপহার। আর নাকি এমনই উপহার যা চোখে দেখা যায়না, শুধু চোখ বুজে উপভোগ করতে হয়। এটা নিয়েই ভাবনায় পড়েছে পৃথা। মিতালীর শরণাপন্ন হয়েছে অবশেষে। আর দুষ্টু মেয়েটা বলে কিনা "তোকে রাজর্ষি আদর করে ছোট্ট একটা হামি দেবে রে। সেটাতো তুই চোখে দেখতে পাবিনা, শুধু অনুভব করবি তোর সারা শরীর জুড়ে। আরও কত কী যে হবে, সব এসে আমাকে বলবি কিন্তু। কিচ্ছু লুকাবি না আমার কাছে। কেমন?" কান লাল হয়ে যায় পৃথার। মিতালীর কথা যদি সত্যি হয়! ভাবলেই গায়ে শিহরণ জাগছে। এর আগে কখনো সে প্রেমিক পুরুষের সংস্পর্শে আসেনি। কাল কী যে হবে! @পিয়ালী খাঁ

পূর্বকথা মতো ভিক্টোরিয়াতে দেখা করে তারা। পৃথা আজ পড়েছে রাজর্ষির প্রিয় নীলরঙা হ্যান্ডলুম শাড়ি। আর রাজর্ষির পরনে হালকা হলুদ টি-শার্ট আর ডিপ নেভিব্লু রঙের জিন্স। দুজন গিয়ে বসে নিভৃতে একটা বড় গাছের তলায়। চারিদিকে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতী প্রেমালাপে থুড়ি প্রেমাচরণে মত্ত। অস্বস্তিতে পড়ে পৃথা। লক্ষ্য করে রাজর্ষিও যেন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তবে যে মিতালী বলেছিলো ছেলেরা অত লজ্জার ধার ধারে না। ওরাই প্রথম হাত ধরে, প্রথম চুম্বন করে, প্রথম স্পর্শ.... যাইহোক, কথা এগোয়, এগোয় সময়। পৃথার যেন ঘোর লাগে। একটা মধুর আবেশ ঘিরে থাকে তাকে। দেখতে দেখতে দু'ঘন্টা পেরিয়ে যায়। হঠাৎ পকেট থেকে একটা সুন্দর কলম বের করে রাজর্ষি। পৃথাকে দিয়ে বলে, "আমার ভাগ্য রচনা কোরো। জীবনে শুধু তোমায় পাশে চাই। " আবারও মুগ্ধ হয় পৃথা। কিন্তু সময়ের ঘোড়া আজ বোধহয় একটু বেশিই গতিতে ছুটছে। তার বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। আচ্ছা, রাজর্ষি তো বলেছিলো ওর উপহার চোখে দেখা যাবেনা। কিন্তু কলম তো দেখা যায়। মিতালীর কথায় কত কী কল্পনার জাল বুনেছিল সে। কিন্তু রাজর্ষি তো তার হাতটাও ধরলো না একবার। আশেপাশের কাপলদের দেখে ওর কী কোনো অনুভূতিই আসছেনা? সামনে পৃথার মতো এমন অল্পবয়সী সুন্দরী বসে আছে। নিজেকে সামলাচ্ছে কীভাবে? রাগ হয় পৃথার। রাজর্ষি তার সমস্ত আশায় জল ঢেলে দিচ্ছে। আর ধৈর্য রাখতে না পেরে সে সটান জিজ্ঞেস করে বসে, "আমাকে একটা অনুভবযোগ্য উপহার দেবে বলেছিলে না?" মৃদু হাসে রাজর্ষি, তারপর বলে, "জানো,ফেসবুকে প্রথম যেদিন তোমার ছবিটা দেখেছিলাম, সেদিনই খুব ভালো লেগেছিলো। তোমাকে নিয়ে সারাদিন সারাক্ষণ... " "আচ্ছা, আচ্ছা, সেসব ঠিক আছে। " বেপরোয়া হয়ে ওঠে পৃথা। আজকের এই সুন্দর দিনটা সে এভাবে নষ্ট করতে নারাজ। তাছাড়া সে তো কোনো অন্যায় করছে না। যাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, তার স্পর্শ পেতে ক্ষতি কি? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাজর্ষি বলে, "দেবো তোমায় উপহার। তবে জানিনা তোমার পছন্দ হবে কিনা। তোমাকে নিয়ে একটা গান বেঁধেছি। সুরও দিয়েছি। সবই আমার নিজস্ব অনুভূতি গো। শুনে দেখো।" ধীর গলায় গাইতে থাকে, " তুমি আমার জীবনসাথী/মনের মাঝে আছো... " তার কণ্ঠের সারল্য, লালিত্য ঝরে ঝরে পড়ে গানের প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অক্ষরে। ভিজতে থাকে পৃথা, গানের সুরধারায়। তো দুর্মূল্য উপহার! রাজর্ষি তাকে এতখানি ভালোবাসে! চোখে জল চলে আসে তার। সত্যি, এভাবেও ছোঁয়া যায়! মিতালী ঠিকই বলেছিলো; প্রথম স্পর্শ সত্যিই খুব স্পেশাল হয়



যুগ্ম তৃতীয় স্থানাধিকারী



পরশ পাথর

শ্রাবণী দ্বিবেদী

 

 

সেই স্কুল জীবন থেকে "পরশ পাথর" কথাটা চারু শুনে আসছে। সেটা নাকি লোহাতে লাগালে লোহা সোনা হয়ে যায়। চারু ভাবে এরকম হয় নাকি? তাহলে তো দেশে কোনো দুঃখই থাকত না। অনেককে জিঙ্গেস করেছে সে---- কিন্তু কোন ঠিক--ঠাক উত্তর আজ পর্যন্ত পায় নি। আজ চারু পঞ্চাশোর্ধ। আজও মাঝে মাঝে সে ভাবে "পরশ পাথর"------ বড় দেখার শখ তার

চারু, সাংসারিক জীবনটা এখন কিছুটা গুছিয়ে এনেছে। ছেলেরা একজন পুণে আর অন্যজন রায়পুর। যে যার জায়গায় চাকরিতে। আর অনিমেষ ্যবসার কাজে আজ নাগপুর তো কাল কোচিন। টি.ভি তে সিনেমা দেখে, যোগা করে, সেলাই করে, গাছের পরিচর্যা আর পুজো--অর্চনা করেই চারুর দিন কাটে। বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোনো হয় না। যা কিছু দরকার---- কাজের দিদি মুন্নীকে দিয়ে আনিয়ে নেয়

সেদিন হঠাৎ করেই, কিছু টুকটাক কেনাকাটা করার জন্য চারু নিজেই বেরিয়ে পড়ে। কিছুদূর যাবার পর বাসরাস্তাটার কাছে কিছু লোকের একটা ছোট জটলা দেখতে পায়। চারু এগিয়ে যায় কি হয়েছে দেখার জন্য। চারু দেখে.... একজন বয়স্ক মহিলাকে একটা স্কুটি ধাক্কা মেরে চলে গেছে। মহিলাটি যন্ত্রণায় কাঁদছে। এদিক--ওদিক জিঙ্গেস করে চারু জানতে পারে.... বয়স্ক মহিলার কেউ নেই। প্রতিদিন একই জায়গায় বসে কিছু কাঁচা সব্জী বিক্রি করে। আজও সে তাই করছিল..... আর স্কুটিটা তাকে ধাক্কা মেরে চলে গেছে। চারু দেখে..... পা' টা ধরে সে খুব কাঁদছে। মনে মনে ভাবে... হবে হয়তো, পা' টাই বোধহয় ভেঙ্গে গেছে

চারু অবাক হয়ে দেখে....... সবাই ধীরে ধীরে চলে গেল। কেউ কিছুই করল না---- যেন কোন সাহায্য করার কারুর দায় নেই। চারু চলে যেতে পারে না। এগিয়ে এসে.. একজনের সাহায্যে মহিলাটিকে রিক্সায় বসিয়ে সামনের হাসপাতালে নিয়ে যায়

ডাক্তারবাবু এক্স রে করে বললেন---" পা' তো ভেঙ্গে গেছে.... অপারেশন করতে হবে। আগামীকাল অপারেশন হবে। আপনিই নিয়ে এসেছেন, তাই আপনিই পুরো ফর্ম্যালিটিস্ ফিল্--আপ করে যান।"

ফর্ম্যালিটিস্ পুরো করতে গিয়ে চারু জানতে পারে ওর নাম "বাসন্তী" ওষুধপত্রের ্যবস্থা করে চারু বাড়ি ফিরে আসে। পরদিন আবার চারু হাসপাতালে যায়.... ভালোয় ভালোয় অপারেশনও হয়ে যায়। চারদিন পর হাসপাতাল থেকে ছুটি পায় বাসন্তী

চারু জিঙ্গেস করে --" বাসন্তী, এখন কোথায় যাবে তুমি ?"

বাসন্তী--" বস্তিতে একটা ঘর আছে.... সেখানেই যাবো।"

চারু----" তোমার ছেলে মেয়ে?"

বাসন্তী--" কেউ নেই "

চারু, বাসন্তীর হাতে কিছু টাকা, কিছু ফলও কিনে দেয়

মাসখানেক পর সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে চায়। কি বলে যে চারুকে ধন্যবাদ দেবে তা আর ভেবে পায় না

চারু বলে ---" আমায় ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। তার জায়গায় অন্য কেউ হলেও সে এটাই করতো। চারু তাকে দুখানা শাড়ি কিনে দিয়েছে। বস্তির ঘরটাও সারিয়ে দিয়েছে। এখন বাসন্তী দিব্যু আছে

এই প্রথম চারু অনুভব করল, তার মনটা যেন এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে যাচ্ছে।এরকম তো আগে কখনও হয় নি!!! ছোটবেলায় আম কুড়োতে গেলেও আনন্দ হতো কিন্তু ঠিক এইরকম নয়। স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করলেও আনন্দ হতো কিন্তু ঠিক এইরকম নয়। জীবনে সে অনেক কিছু পেয়েছে, অনেক আনন্দের মুহূর্ত তার এসেছে..... কিন্তু ঠিক এইরকম নয়। এক নতুন আনন্দের প্রথম_স্পর্শ। এই স্বর্গীয় আনন্দের প্রথম_স্পর্শে চারু বিশ্বপ্রেমের অনুভবে নিজেকে বিলিয়ে দিল। সে এই আনন্দ বারবার পেতে চায়। হঠাৎ করেই চারুর.... তার মায়ের কথা মনে পড়ল, মা তো এইরকমই শেখাতেন, বলতেন----" প্রেম বিলোতে থাক্ রে... সংসার প্রেমকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দে। সংসার প্রেমকে বিশ্বপ্রেমে বিলিয়ে দে। অনাথ অসহায়কে ভালোবেসে ্যাখ..... তাদের মধ্যেই মনের মানুষের পরশ পাবি। দেখবি মন কখন আপনা থেকে সোনা হয়ে গেছে, টেরও পাস্ নি

চকিতে চারুর মনে হল "রাধে বোষ্টোম" ..... তার গানে এরকমই কিছু বলতো...." আগে প্রেম বিলোও গো আগে প্রেম বিলোও।"

এক অনাথ আতুরকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর সাহায্য করা তার মনকে এক লহমায় সোনা করে দিল.....তবে এই কি সে "পরশ পাথরের" সন্ধান পেলো। তার হৃদয় মন এক অদ্ভুত শান্তিতে ছেয়ে গেল। মনে মনে সে তার অভীষ্টকে প্রণাম জানালো যে..... সে "পরশ পাথর" খুঁজে পেয়েছে। আজ তার মন সোনা হয়ে গেছে। হে ঈশ্বর..... তুমি সবাইকে "পরশ পাথরের"সন্ধান দাও






অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের  গল্পগুলি







নবদিগন্ত

কাকলী জানা

 

বিমানবাবু পুনায় এসেছেন ছেলের বাড়ীতে। আট বছর আগে, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই ছেলে বিতান আর বৌমা প্রেরনার কাছে উনি মাঝেমধ্যেই আসেন। ওঁনার পাঁচ বছরের নাতি বাপান খুব খুশি হয় উনি এলে। কিন্তু বিমানবাবুর এখানে মন টেকেনা। এক-দুমাস থেকেই উনি নিজের বাড়ী আসানসোলে ফিরে যান

রোজ বিকালবেলায়, বিমানবাবু নাতিকে নিয়ে পার্কে যান, সেখানেই পরিচয় হয় সীমাদেবীর সঙ্গে। উনিও ওঁনার নাতনিকে নিয়ে পার্কে আসেন। তিন বছর আগে স্বামীকে হারানোর পর সীমাদেবী একাই কলকাতায় থাকতেন। কদিন আগে শরীরটা খুব খারাপ হওয়ায়, ওঁনার মেয়ে শ্রিতমা ওঁনাকে পুনায় নিয়ে এসেছে। বাচ্ছাগুলো যখন খেলে, বিমানবাবু আর সীমাদেবী দুজনে কথা বলেন। একদিন শ্রিতমা বিমানবাবুকে নিজের বাড়ী নিয়ে যায় চা খাওয়াতে। শ্রিতমা খুব মিশুকে, বিমানবাবুকে সহজেই আপন করে নেয়। কিছুদিনের মধ্যেই, দুই পরিবারের মধ্যে বেশ হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে, মাঝেমধ্যেই জমিয়ে আড্ডা বসে।একদিন এরকমই এক আড্ডায় শ্রিতমা বলে ওঠে, “আমার তোমাদের কিছু বলার আছে”। সবাই উৎসুকনেত্রে তাকায় ওর দিকে।

.....“মা আর কাকু দুজনেই বড় নিঃসঙ্গ, একা। এই বয়সে, যখন ওঁনাদের সবথেকে বেশি দরকার একজন সঙ্গির, দুর্ভাগ্যবশত তখনই ওঁরা ওঁদের সবথেকে কাছের মানুষকে হারিয়েছেন। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে, আমি চাই ওঁনারা দুজনে দুজনার সঙ্গি হন, একসঙ্গে থাকুন......”

ঘরে পিনড্রপ সাইলেন্স.........নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো প্রেরণা...

...“আমি শ্রিতমার সঙ্গে একমত

......“এটা খুব ভালো হবে,” বিতান উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে। কিন্তু সীমাদেবী চিৎকার করে ওঠেন,

...“এসব কি শুরু করেছ তোমরা ? এই বয়সে মা-বাবাদের নিয়ে একি পাগলামি?”

...“এতে খারাপ কি আছে মা? আপনারা দুজনে একসঙ্গে ভালো থাকলে, আমরাও স্বস্তি পাব জামাইয়ের মুখে একথা শোনার পর সীমাদেবী আর কিছু বলতে পারেন না, কিন্তু সম্পূর্ণটা মেনেও নিতে পারেন না। বিমানবাবু সমস্তটা শুনলেন, কিছুই বললেন না

 

ওঁদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়, কেননা বিয়ে হলে সম্পর্কটা অনেক সহজে মান্যতা পাবে সমাজে। শ্রিতমার বাড়ীতে শুরু হয় ওঁদের ঘরকন্না -রান্না করে, গল্প করে, নাতিনাতনিদের নিয়ে বেশ কাটে দিনগুলো। একদিন বিমানবাবু সীমাদেবীকে বলেন,

...“চলোনা আমরা আসানসোলে যাই। কতদিন ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে বসে থাকব?”

...“কিন্তু, আসানসোলে আপনার পাড়া-প্রতিবেশিরা যদি মেনে না নেয় আমাদের সম্পর্কটা!”

......“আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন মেনে নিয়েছে, তখন বাইরের কে কি বলল, আমি পরোয়া করি না

...“তাহলে চলুন নাতিনাতনি দুটোকেও সঙ্গে নিয়ে যাই, এখানে ক্রেসে ওদের বড্ড কষ্ট হয়

আসানসোলে ওঁদের একটা নতুন সুন্দর সংসার গড়ে ওঠে। প্রথমদিকে পাড়া-প্রতিবেশিরা গা-টেপাটেপি, হাসাহাসি করলেও, ধীরে ধীরে সবাই মেনে নেয়। শুধু সীমাদেবী এখনও নিজের সঙ্কোচটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর রোজ ওঁনারা বারান্দায় বসে গল্প করেন, বেশিরভাগই নিজেদের পুরনোদিনের কথা। সেদিনও গল্প করে বিমানবাবু যখন নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, সীমাদেবীর কেমন একটা লাগল বিমানবাবুকে দেখে। মনে হল উনি কিছু বলতে চাইছেন। কিন্তু, সীমাদেবী কিছুতেই নিজের সংস্কার কাটিয়ে যেতে পারলেন না ওঁনার কাছে।মাঝরাতে একটা গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সীমাদেবীর। ছুটে যান বিমানবাবুর ঘরে, গিয়ে দেখেন বিছানায় কাতরাচ্ছে মানুষটা। গায়ে ধুম জ্বর। বুকটা কেঁপে ওঠে সীমাদেবীর। মনে পড়ে যায়, এমনি একটি রাতে, এরকমই ধুম জ্বরে কাৎরাচ্ছিলেন ওঁনার স্বামী অনিমেষ। ধরা পড়ে ব্লাড ক্যানসার, অ্যাডভান্সড স্টেজ......খুব বেশী সময় ছিল না তখন অনিমেষের হাতে। সীমাদেবী আর কিছু ভাবতে পারেন না, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন ডাক্তারবাবুকে। ডাক্তারবাবু এসে দেখে বললেন “ভয়ের কিছু নেই, সাধারণ ভাইরাল”।ডাক্তারবাবু চলে গেলে, সীমাদেবী বিমানবাবুর কাছে এসে ওঁনার বুকে হাত রাখলেন। এই প্রথম সীমাদেবীর হাতের স্পর্শ পেয়ে বিমানবাবু চমকে, চোখ মেলে তাকালেন। জ্বরের ঘোরে সীমাদেবীকে বিমানবাবুর খুব সুন্দর লাগছিল, উনি ওঁর মধ্যে যেন নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেলেন।

...“কি দেখছ?” এই প্রথম সীমাদেবীর মুখে তুমি সম্বোধন বিমানবাবুর কানে অতি মধুর শোনালো

......“কিছু না,” বলে বিমানবাবু একটু হাসলেন, তারপর বললেন, “অনেক রাত হয়েছে, শুতে যাও, সকালে বাচ্ছাদের স্কুলে পাঠাতে হবে

সীমাদেবী ঘাড় নেড়ে বললেন,....“আমি তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। একজনকে হারিয়েছি, আবার তোমাকে হারাতে পারব না”, বলে উনি বিমানবাবুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিলেন। বিমানবাবু পরম ভরসায় চোখ বুজলেন। দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একে অপরকে অবলম্বন করে, নিজেদের পুরনো স্মৃতি বুকে নিয়ে পা বাড়ালেন এক নতুন জীবনের পথে।

 

 

 

 

 

কলঙ্ক

কমলিকা মুখার্জ্জী


মিষ্টির প্যাকেট আর সার্টিফিকেট টা ঠাকুরের সামনে নামিয়ে হাত পা ধুয়ে এলো সুমি।ফিরে এসে গড় হয়ে প্রণাম করলো

সুমির আজ খুব আনন্দের দিন,আজ সাফল্যের প্রথম ধাপে পা রাখলো

হাজরা কলেজ থেকে পাশ করে বেরোবার পর আলিপুর জজ্ কোর্টে মাস সাতেক সবে যাতায়াত হয়েছে। কাজ শেখার সবে শুরু।এই সাত মাসে খুব বুঝেছে আইনের পড়া আর কাজ বা প্রাকটিস দুটো পুরোপুরি ভিন্ন চরিত্রের।
কলেজে পড়ার সময় পড়েছে অনেক অনেক আইন ,তার অজস্র ধারা,শতসহস্র কেস স্টাডি
আর ওকালতি করতে গিয়ে শিখতে হচ্ছে আইনের ফাঁক....... কোন পথ দিয়ে কেসটাকে বেড় করে আনা যায়......আর হয়তো তাই কলেজে টেনেটুনে পাশ করা ছেলে মেয়ে গুলো প্রাকটিস জগতে বেশি সফল

আজ সুমি ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইন্সীয়োরেন্স কোম্পানী তে অ্যাডভোকেট হিসেবে এমপ্যানেলে্ড্ হলো।নিজ যোগ্যতায় সে এটা অর্জন করেছে।গত পাঁচ বছরের পড়াশোনা আর বিগত কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ ওকে সাহায্য করেছে এই সাফল্য অর্জন করতে

কিন্তু একটা দিনের স্মৃতির কালো ছায়া আজকের এই আনন্দঘন মুহুর্ত গুলো যেন গ্রাস করলো

মনের মধ্যে ভেসে এলো প্রমিতার মুখটা।ওরই ব্যাচমেট, সুরেন্দ্র নাথ কলেজের মেয়ে।কলেজ আলাদা হলেও টিউশন একসাথে হওয়ায় চেনা সুমির।খুব বশি সখ্যতা না থাকলেও মোটের উপর চেনে সুমি প্রমিতাকে।বেশ মিষ্টি মেয়ে, যথেষ্ট মেধাবী, আর চেহারায় একটা চটক আছে।নিজেকে সে বরাবর টিপটপ রাখতে পছন্দ করে...ঠিক কোর্টের ইউনিফর্ম টার মতো.... ধবধবে সাদা... নির্মল সুন্দর

কোর্ট জয়েন করার মাস চারেকের মাথায় রুদ্র সুমিকে ডাকতে এসেছিল, ওর সিনিয়রের সেরেস্তায়।একটা মামলায় অন্য সিনিয়রদের সাথে কেসের সময় দাঁড়াবার জন্য।মামলা তো লড়বেন সিনিয়র এডভোকেট ,সাথে তিন চার জন জুনিয়র দাঁড়ালে ক্লায়েন্টের কাছে জোরদার লাগে।মালদার পার্টি হলে একটু আই ওয়াশ করতে লাগে

সুমিকে আটকে দিলো ওর সিনিওর তপনবাবু।বললেন....তুই যা কোর্টরুমে,দেখ মামলাটা,কে কি বলছেন মন দিয়ে শোন,কিন্তু যেখানে আমি না বলবো সেখানে একদম ইনভলভ্ড হবিনা।
তপনবাবু রুদ্রকে একটু গম্ভীর ভাবেই বলেছিলো,আমার পারমিশন না নিয়েই ওকে ডাকতে চলে এলি।ও যাবে কিন্তু এজলাসের সামনে নয়।
খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সুমির.... বেশ খালি খালি একশোটা টাকা এসে যেতো....কেঁচিয়ে দিলো তপনবাবু

দিন দুয়েক পরেই, রুদ্রর সিনিওর আদ্যনাথ বাবুর সেরেস্তায় ঢুকতে গিয়ে থমকে যায় সুমি.... কয়েকটা কথা কানে এসে গেল

উনি বলছিলেন কাউকে....... বলেছিলাম না বেল টা পাবেনই। আরে পুরোটাং সেটিং মশাই।ঐ ফুটফুটি মালটা দিয়েই কাজ তুলেছি

সুমির পেছনে অরুনদা কখন এসে দাঁড়িয়েছে তা দেখেইনি।অরুনদা আদ্যনাথ বাবুর মহুরী, সুমিকে খুব ভালোবাসে,আদি বাড়ি একজায়গায় কিনা!

সুমিকে কথা গুলো শুনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে...... খুব খারাপ জায়গা বোন।সেদিন বেল পিটিশনে রুদ্র দার সাথে বিজয় বাবুর সেরেস্তার যে মেয়েটা ছিল না?......সুমি বুঝতে পারে অরুনদা প্রমিতার কথা বলছে

জানো কি হয়েছে?

চোয়াল শক্ত করে সুমি বলে,কি হয়েছে অরুনদা?

এই আমার গুরুটি লোকের কাছে দেবতা সাজে.....আসলে একটি পিশাচ।
ভেতরে যে মঙ্কেল আছে ওনাকে বলেছিল মেয়েটাকে দেখিয়ে... " মেয়েটা কে ঘন্টা খানেকের জন্য জজসাহেবের ঘরে পাঠাতে হবে.....বেলটা সুনিশ্চিত করতে।"
আর তাই এক্সট্রা এক লাখ পকেটে পুরেছে।ও বেচারা কিছু জানলোও না.....

হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল সুমির,মনে মনে তপনবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল........"স্যার না থাকলে তো সেদিন আমি ....উফফ্..."

সার্টিফিকেট টা হাতে পেয়ে সফলতার পথকে সুমি প্রথম স্পর্শ করেছিল, আনন্দে আত্মাহারা হয়েছিল,কিন্তু ঐদিনের স্মৃতি......প্রমিতার গায়ে লাগা অচেনা কাদার দাগ.... দুঃখে,লাঞ্ছনায়,লজ্জায় সুমিকে কালো মেঘে নিমজ্জিত করেছিল

সুমি চেষ্টা করেও পারেনি প্রমিতাকে সতর্ক করতে,পারেনি ওকে জানান দিতে ওর চরিত্রে লাগা কলঙ্কের প্রথম স্পর্শ টা

 

 

 

 

 

 

 

বিজয়িনী মা
অন্বেষা মন্ডল

 

অনুপ ছোটো থেকে পড়াশুনায় ভীষণ ভালো,সব সময় ক্লাসে প্রথম হতো একটু নাম্বার কম পেলেই, মা - বাবা কি বকবে! তার আগেই বাড়ি এসে মার কোলে মুখ গুঁজে কান্নাকাটি জুড়ে দিতোমা - বাবার খুব বাধ্য ছিলো আর ছোটো থেকেই ভগবানের প্রতি অসীম ভক্তি
দেখতে দেখতে অনুপ মাধ্যমিক ,উচামাধ্যমিক খুব ভালোভাবে পাশ করলোএরপর জয়েন্ট দিলো, চান্সও পেলো তবে বাড়ি থেকে অনেক দূরে একমাত্র আদরের ছেলেকে অত দূরে পাঠাতে মা - বাবার মন চাইলো নাঅনুপও যাওয়ার জন্য বিশেষ বায়না করলো না,মা - বাবা কে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা ওরও ছিলো না অগত্যা পিওর সাইন্স নিয়ে অনুপ কলেজে ভর্তি হলোপ্রথম বছরটা বন্ধুবান্ধব পড়াশুনা নিয়ে দিব্যি কেটে গেলো, ভালো নাম্বার নিয়েই সেকেন্ড ইয়ারে উঠলো অনুপ
ফার্স্ট ইয়ারের নবীন বরণের দিন প্রথম দেখা হলো ইলার সাথে, আলাপও হলো ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে আসা শান্ত স্বভাবের মিষ্টি মেয়েটাকে অনুপের বেশ লাগলোঘটনাচক্রে দুজনের বাড়িও একই দিকে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলোছুটির পর একসঙ্গে বাড়ি ফেরে দুজনে কখনো আবার পার্কে কিংবা সিনেমা হলেও সিনেমা দেখতে যায়ইলা বাড়িতে লুকিয়ে গেলেও অনুপ কিন্তু তার মাকে সবটা বলে, কারণ মাই যে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মাও সবটা মেনে নেয়
এরপর অনুপ খুব ভালো ভাবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেমাস্টার্সে ভর্তি হয় আর তার সাথে চাকরির জন্য পড়াশুনাও শুরু করে দেয়এইভাবেই একবছর কেটে যায়ইলার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়, বাড়ি থেকে বিয়ের দেখাশুনা শুরু করে দেয়ভয়ে সে বাড়িতে কিছুই বলতে পারে না,অনুপ কে সব জানায়, ভীষণ কান্নাকাটি করতে থাকে, বলে " তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, তুমি একটা কিছু করো অনুপ নইলে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো"
অনুপেরও খুব কান্না পায়, ইলাকে ছাড়া সেও যে বাঁচতে পারবে নাকিন্তু কিই বা করতে পারে সে, এখন যে চাকরিও পায়নি, কিভাবে দাঁড়াবে ইলার বাবা - মার সামনেতাই সব কিছু জানায় তার মাকে, মা ছেলেকে আশ্বস্ত করে
অনুপের মা - বাবা ইলাদের বাড়িতে যায়, সবটা খুলে বলে ইলার বাড়ির লোকেদের এবং বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ করে আসে ইলার বাড়ির লোক অনুপের মা - বাবার ব্যবহারে ভীষণ খুশি হয় আর অনুপের সমন্ধেও খোঁজ খবর নেয়, জানতে পারে ছেলেটি খুবই ভালো আজ না হয় কাল চাকরি পেয়েই যাবে দুজনের সম্পর্কটা তারা মেয়ে নেয়, তবে একটা শর্ত রাখে বিয়েটা এক বছর পর হলেও রেজিস্ট্রি এখনই করতে হবে অনুপের মা - বাবা রাজি হয়ে যায়অনুপও অরাজি হয় না তবে মাথায় একটা চাপ অনুভব করে,ভয় হয় একবছরের মধ্যে যদি চাকরিটা না পায়! দিন রাত এক করে সে পড়াশুনা করতে শুরু করে দেয়বাড়িতে কয়েকজন বন্ধু মিলে গ্রুপ স্টাডিও করতে শুরু করে দেয়অনেকগুলো লেখা পরীক্ষায় সে পাশও করে কিন্তু ইন্টারভিউতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয় এদিকে তার বন্ধুরা কিন্তু একে একে প্রায় সকলেই চাকরি পেয়ে যায়বন্ধুদের পথে হাঁটলে সেও হয়তো এতদিনে চাকরি পেয়ে যেতো,কিন্তু অনুপ কখনোই ঘুষের নোংরা খেলায় নামতে চায়নিওর বিশ্বাস ছিলো সততার জয় একদিন হবেই তা হয়ও বটে, রাজ্য সরকারের একটি চাকরির পরীক্ষায় অনুপ লেখা পরীক্ষা এবং ইন্টারভিউ দুটোতেই পাশ করে এরপর শুধু অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসার অপেক্ষাকিন্তু দুর্ভাগ্য ,মাসের পর মাস কেটে যায় চিঠি আর আসে নাঅনুপ খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারে- প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কেস হয়ে গেছে মিমাংশা না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ স্থগিত থাকবে
এদিকে সময় ক্রমশ এগিয়ে আসে, ইলার বাড়ির লোক ইলাকে চাপ দিতে থাকে, ইলা অনুপকে অনুপের ভয় বাড়তে থাকে, বন্ধুবান্ধবরাও আর তাকে তেমন পাত্তা দেয় না, যে যার নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে পড়েপাড়া -প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কখনো সমবেদনা দেখায়, কখনো আবার ব্যাঙ্গ করেঅনুপের এসব অসহ্য লাগেসে নিজেকে ক্রমশ নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতে শুরু করেমাঝে মাঝেই অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে থাকেঅনুপের মা - বাবা ছেলের পরিবর্তন দেখে চিন্তায় পড়ে যান ডাক্তারও দেখানো হয়, কিন্তু কিছুই লাভ হয় নাঅনুপ ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে শুরু করে
সেদিন ছিলো শনিবার দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর অনুপ দোতলায় নিজের ঘরে যেতে চাইলে অনুপের মা বলে, " দাঁড়ানা সোনা, হাতের কাজটা মিটিয়ে দুজনে এক সঙ্গে উপরে যাবো"
অনুপ বলে, " না মা আমার তাড়া আছে, একটু পড়াশুনা করবো, তুমি সব কাজ মিটিয়ে তবে এসো"
যাওয়ার সময় অনুপ বলে যায়," মা আসছি, বাবা আসছি "
অনুপের মার কিছুতেই মন বসে নাকিছুক্ষন পর থাকতে না পেরে দ্রুত পায় উপরে উঠে যায় - ততক্ষণে সব শেষগলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে অনুপএই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে অনুপের মা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, ছুটে আসে অনুপের বাবা তার সাথে পাড়ার লোক ধরাধরি করে অনুপ কে নামানো হয়অনুপের মা মুখের মধ্যে শ্বাস দিয়ে,বুকের মধ্যে চাপ দিয়ে অনেক রকম ভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করে অনুপকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু কিছুই লাভ হয় না, ডাক্তার অনুপকে মৃত বলে ঘোষণা করেন
এরপর তিন মাস কেটে যায় আত্মীয়-স্বজনরা সবাই চলে যায়অনুপের মা শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকে তবে তার মনটা ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছেলের এভাবে হেরে গিয়ে চলে যাওয়াটা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছিলো না,এযেনো শুধু অনুপের নয় তারও পরাজয়!বেঁচে থাকাটা তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিলোঅনুপের মা মনে মনে ঠিক করে শেষ করে দেবে নিজেকে, চলে যাবে ছেলের কাছে
দুপুরবেলা সবেমাত্র অনুপের বাবার চোখটা একটু লেগেছেসেই সুযোগে অনুপের মা দোতলার ঘরে যাবে বলে সবে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে, তখনই কলিংবেলটা বেজে ওঠেঅনুপের বাবা ধড়পড়িয়ে উঠে পড়ে, চোখ যায় অনুপের মার দিকে - " কি গো কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?" - একথা বলেই হাত ধরে সোফায় নিয়ে এসে বসিয়ে দেয় তাকে কলিংবেলটা অনবরত বাজতে থাকে অনুপের বাবা তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেখে, পিওন দাঁড়িয়ে আছে
পিওনটি বলে ," অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে, মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু!"
ছুটে যায় অনুপের মা, একপ্রকার ছিনিয়ে নেয় চিঠিটা!বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে চিঠিটাকে,পরম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে! ছেলের প্রথম সফলতার স্পর্শে তার বুকটা ভরে ওঠে

 

 



তোমার স্পর্শে
সুহৃদ মণ্ডল

 

কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রুপ। ছাত্র হিসেবে রুপ খুব মেধাবী। এছাড়াও তার একটা বিশেষ গুনআছে সে খুব ভালো সরোদ বাজায়।
দিনটা ছিল বইমেলার শেষদিন।তার প্রিয় কবি হলেন রবীন্দ্রনাথ , সে সেদিন মেলায় গিয়েছিল রবী ঠাকুরের শেষের কবিতা কিনতে। মেলার শেষদিনে যাবার কারণে সে বইটি অনেক খুঁজেও পেলনা , অবশেষে সে বইটি একটি স্টলে পেল। সে বইটি হাতেনিয়ে দেখছিল হঠাৎ একটি মেয়ে এসে বললেন দাদা আমাকেও একটা শেষেরকবিতা দিন। বিক্রেতা করুনভাবে বললেন দুঃখিত বইটি একটিই ছিল যেটা উনি নিয়েছেন। মেয়েটি করুন স্বরে বললো বইটি কী আর কোনভাবেই পাওয়া যবেনা।রুপ তার করুন মুখের দিকে তাকিয়ে বললো আপনি কী রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়তে ভালোবাসেন? মেয়টি বললো রবী ঠাকুর আমার প্রথম ভালোবাসা,তাঁর অনেক সৃষ্টকর্ম আমার একাকিত্বের সঙ্গী। সব শুনে রুপ বললো আপনি চাইলে বইটি নিতে পারেন। মেয়েটি আনন্দের সঙ্গে রুপকে ধন্যবাদ জানায়। সে মেয়েটির চোখের দিকে লক্ষ্য করল আনন্দে বিস্মিত হয়ে তার চোখে প্রায় জল আসার উপক্রম সে যেন তার সবথেকে প্রিয় জিনিস টা হাতে পেয়েছে। রুপ লক্ষ্য করল কী যেন একটা সরলতা কাজকরছে মেয়েটির চোখে। রুপ তার নাম জিঞ্জেস করল মেয়েটি বললো শ্রেয়া রায়। মেয়েটি যাওয়ার সময় তাকে ধন্যবাদ জানায় রুপ আবারও দেখল তার সুন্দর মুখে তার অপুর্ব চোখদুটির দিকে। রুপ অযান্তেই শ্রেয়ার প্রেমে পড়েযায়। দিনরাত তাকেই ভাবে। তার কথাবলার ধরন, তার হাঁসি তার যে জিনিসটা সবথেকে বেশি মন টানে সেটা হল তার চোখ। সুন্দর ছোট্ট দুটিচোখে কুচকুচে কাল অস্থির চোখেরমনি সারাক্ষন যেন কাউকে খুজেচলেছে রুপের মনেমনে ইচ্ছা ওই অস্থির মণি দুটো একদিন ওকেই খুজুক রুপ বন্ধুমহলে উদাসীন হয়ে বসে থাকায় মন অন্যদিকে থাকায় বন্ধুদের আর বুঝতে বাকি থাকলোনা সবাই মিলে চেপে ধরায় রুপ সবকিছু বলতে বাধ্য হয় তার মুখে বর্ণনা শুনে রবীন্দ্রপ্রেমের কথা শুনে তার এক বান্ধবী নিশা বললো সে চেনে শ্রেয়া কে। তার বোনের বান্ধবী অনেকবার তাদের বাড়িতেও এসেছে। রুপ যেন তার মনের মধ্যে আশার আলো খুঁজে পেল নিশার মুখ থেকে সে জানতে পারে তার বোন শ্রেয়া এবছর হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছে, এবং তারা দুজনেই রুপের কলেজে ভর্তির হতে চলেছে। কিছুদিন বাদেই কলেজে নবীনবরন অনুষ্ঠান ,আর এবছরই সে প্রথম কলেজের অনুষ্ঠানে সরোদ বাজাবে সে ভাবলো সব যেন কে আগেথেকেই ঠিক করে রেখেছে। রুপ তার সুরর বাঁধনে তাকে বাঁধতে চায়। অবশেষে সেই ক্ষন এসে উপস্থিত। আজ সে আবার শ্রেয়াকে দেখল ,দেখল তার মায়াভরা দুটি চোখ। আজ যেন তাকে বেশিই সুন্দর লাগছে সরোদে রবীন্দ্রসঙ্গীত বেজে উঠল আমি হৃদয়ের কথা বলতে ্যকুল সুধাইলনা কেহ.... এই গানটা যেন তাকেই উদ্দেশ্য করে বাজাল সামনেই দাড়িয়ে আছে শ্রেয়া নতুন কলেজে পরিচিত মুখ দেখে সে অনেক খুশি হল। রুপ লক্ষ্য করেছে শ্রেয়া আত্মহারা হয়ে শুনছিল তার সুর। আবারও দুজনের আলাপ হওয়ায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় এক নতুন বন্ধুত্ব। শ্রেয়া একেবারেই শান্ত প্রকৃতির আর রুপ ছিল তার বিপরীত। সবসময় বই নিয়ে ্যস্ত থাকায় তার তেমন কোন বন্ধু ছিলনা , বলতে গেলে রুপই তার একমাত্র বন্ধু। প্রায় দিনই তাদের মধ্যে গল্প হতো। এভাবেই কবে আস্তে আস্তে তাদের বন্ধুত্বটা আরো গভীর হয়েগিয়েছিল। শ্রেয়াও রুপকে পছন্দ করতে শুরু করে। রুপের মধ্যে খুঁজেপেল তার যুব রবীন্দ্রনাথকে।
দিনটা ছিলো বসন্ত পঞ্চমী, রুপ কতগুলো গোলাপ নিয়েএসে শ্রয়াকে বললো- আমার এই তমসা ভরা জীবনে তুমি এসেছিলে ভোরের সূর্য হয়ে, তাই জীবনের প্রতিটি ভোরের সূর্য আমি তোমার সঙ্গে দেখতেচাই। শ্রেয়া লজ্জায় তার চোখদুটি দুহাতে ঢাকলো আর তার মুখে মিষ্টি একটা আনন্দের হাসি। আর এদিকে রুপের আর বুঝতে বাকি রইলনা শ্রয়ার উত্তর ্যাঁ। এইভাবেই তাদের মধ্যে তৈরি হয় ছোট্ট একটি ভালোবাসার স্বপ্ন। এইভাবেই তাদের দিনগুলো এসবের মধ্যেদিয়ে কিভাবে কেটেগেল দুটি বছর। হঠাৎ একদিন তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম ভুলবোঝাবুঝির। শ্রেয়া কি কারণে মনে হয়েছিল রুপের জীবনে অন্যকারো আবির্ভাব হয়েছে। আগেও তাদেরমধ্যে মান অভিমান হয়েছে। কিন্তু সে ক্ষনিকের জন্য কিন্তু..... কত স্বপ্নদিয়ে গড়া সাধের ঘর তুচ্ছ কারণে ভেঙে ছারখার হয়ে যায়। রুপকে ছেড়ে শ্রেয়া চলে যাবার সময় রুপ শুধু একটিকথাই বলেছিল- তুমি একদিন তোমার ভুল বুঝতে পারবে আমি ঠিক সেই দিনটার অপক্ষায় থাকব। এভাবেই কেটে গেল চারটি বছর। শ্রেয়া যতই নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করুক রুপের না থাকা প্রতিমুহূর্ত তাকে মনে করিয়ে দেয় সে বড় একা। অবশেষে শ্রয়া তার নিজের ভুল বুঝতে পারে সে রুপের কাছে ফিরেআসে সে ফিরে এসেও রুপকে না খুজেপাওয়ায় সে খুব কষ্ট পায় আর ঠিক তখনই তার মনেপড়ে রুপ তাকে বলেছিল সে প্রতি বছর এই বই মেলার শেষদিনটিতে সে আসবে। বহুদিন অপেক্ষার পর সে শেষদিনটিতে বইমেলায় যায় এবং প্রথম তাদের যে স্টলটিতে দেখাহয়েছিল সেখানে যায়। গিয়ে দেখল স্টলটির সামনে রুপ দাড়িয়ে আছে শ্রেয়ার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল সে ্যথিত কন্ঠে শুধু একটিই কথা বললো - আমার একদম উচিত হয়নি কিছু না জেনেই তোমাকে ভুলবুঝেছি..
রুপ মৃদু হেসে বললো- পৃথিবী কি সেই অপেক্ষাগুলো মনে রাখে যে ছেলেটা অপেক্ষায় ছিল তার প্রেমিকার ফিরে আসার। শ্রেয়া বললো-এখন দুরে দাড়িয়ে থাকবে একটুও জায়গা দেবেনা তোমার বুকে।রুপ জড়িয়ে ধরল শ্রেয়াকে। তার প্রথম স্পর্শে রুপের হৃদয় মহিত হয়েগেল। তার বুকের ভিতরটাতে এমন একটা অনুভূতি হয়েছিল তা প্রকাশ করার মতো নয়। এই তমসাভরা হৃদয়ে বহুদিন বাদে ভোরের আলো ফুটল শুধু তোমার স্পর্শে

 

 

 

মিলন
সঙ্গীতা চৌধুরী

 

ডেলিভারি রুমের মধ্যে কোজাগরীর প্রানঘাতী আর্তনাদে নার্সিংহোমের সেকেন্ড ফ্লোরের প্রতিটি কোনা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ডেলিভারি রুমের বাইরে দুটি পরিবারের কয়েকজন সদস্য সেই আর্তনাদের সঙ্গে যেন ইষ্টনাম জপছে। সকলেরই করুন দৃষ্টি ডেলিভারি রুমের দিকেই। আর যারা ভেতরে রয়েছে তারা কোজাগরীকে তার আসন্ন প্রসবে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। সন্তান ধারনের এই আট মাসে তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল , তবে আজকের যন্ত্রণা সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। হঠাৎ যন্ত্রণার মাত্রা চর্তুগুন বাড়িয়ে তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। কোজাগরীর দুঃসহ কষ্টের লাঘব ঘটে। একটা শান্তি মেলে। কিন্তু সম্বিৎ ফিরতেই সে লক্ষ্য করে তার সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে নার্সদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে , তারা বাচ্চাটিকে কাঁদাবার চেষ্টা করছে কিন্তু তার মধ্যে কোন সাড় পাওয়া যাচ্ছে না। তার বুক কেঁপে ওঠে

মিনিট দশেক কাটবার পর আবার চরম ্যাথা চাগিয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায় কোজাগরীর নরম শরীর। মুখ লাল হয়ে যায় , তবে এবার ্যাথার সঙ্গে ওর মধ্যে একটা চিন্তা মিশে যায়। অন্যদিকে দরজার বাইরে প্রবল উৎকণ্ঠারত কিছু মানুষ। তারা বোঝার চেষ্টা করছে ভেতরের পরিস্থিতি। এই সময়টাতে কেউই বাইরে আসেনি তাই তাদের পক্ষে কিছুই জানা সম্ভব হচ্ছে না। ভেতরে আবার ভীষণ আর্তনাদের সঙ্গে কোজাগরী তার দ্বিতীয় সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়।এবার কিন্তু একটা শিশুর আগমন বার্তা তার চিল চিৎকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোজাগরীর কানেও সেই আওয়াজ পৌঁছায়। নিদারুণ কষ্টের পর আরাম মেলে। কিন্তু প্রথম সন্তানের কি হলো ? কিছুটা শক্তি এনে পাশের দাঁড়ানো সিস্টারের কাছে জানতে চায় , কোজাগরীর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ডাক্তার বাবু স্বয়ং কাছে এসে দাঁড়ান এবং সস্নেহে ষাটোর্ধ্ব ডাক্তার বক্সী তাকে জানান যে, তার প্রথম কন্যা সন্তান মৃত ভূমিষ্ঠ হয়েছে। আর দ্বিতীয় কন্যা সন্তান প্রিম্যাচিউর , সময়ের অনেক আগে জন্মানোর জন্য ওজন খুবই কম হয়েছে। তাই তাকে ইনকিউবেটরে রাখার প্রয়োজন আছে

কোজাগরী নার্সিংহোমের কেবিনে শুয়ে রাতের আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে সারাদিনের ঘটনা মনে করে ওর বুকের ভেতর যেন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। গত আট মাস ধরে যে সন্তানদের অনেক কষ্ট সহ্য করে নিজের শরীরের তিল তিল করে বড় করে তুলেছে ,আর আজ শেষ রক্ষা করতে পারলো না ! নিজের ওপরই খুব রাগ হয় তখন যদি ডাক্তারবাবুর কথা মতো পুরো বেড রেস্ট নিতো তাহলে হয়তো এতো তাড়াতাড়ি ডেলিভারি হতো না , আর সন্তানরা নিরাপদ থাকতো। কিন্তু কোজাগরীরই বা কি করার ছিল ! শ্বশুর বাড়িতে ডাক্তারের পরামর্শ সবাই খুব ভালো করেই জানতো

সদ্য মা হওয়া কোজাগরী এখনও অবধি তার দ্বিতীয় সন্তানকেও দেখে নি। আজ দু' দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ডেলিভারির দিন প্রথম সন্তানের শোকে পাথর হয়ে থাকায় পরের সন্তানকেও তার আর দেখা হয় নি, পরে স্থিতিশীল হলে জানতে পারে ইনকিউবেটরে রাখার জন্য অন্য নার্সিংহোমে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেও সেখানে যেতে চায় কিন্তু সেলাই থাকার কারনে জানানো হয়, দু' দিন পর তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। পরের দিন সকাল সকাল স্বামী অনলের সঙ্গে গিয়ে সেই নার্সিংহোমে ভর্তি হয়। নার্সিংহোমে যাওয়ার পরই সন্তানকে কাছে পেতে চায়, কিন্তু ওখানে গিয়ে জানতে পারে বাচ্চাকে এখন কাছে দেওয়া যাবে না, দূর থেকেই দেখতে হবে ভিজিটিং আওয়ারে। কষ্টে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।তবে সন্তান মায়ের দুধ পান করতে পারবে। তারজন্য তাকে ফিডিং বোতলে দুধ ভরে দিতে হবে।সেদিন দুপুরে নার্সারিতে তার ডাক পড়লে , সিস্টারদের অনুরোধ করে এক ঝলক তার মেয়েকে দেখার সুযোগ মেলে। এরপর শিশুটির জন্য মাতৃদুগ্ধ রেখে ফিরে আসে। বিকেলে অনেকটা সময় ধরে দূর থেকেই সন্তানকে প্রান ভরে দেখে। মনে হয় ছুটে গিয়ে ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটাকে কাচের বাক্স থেকে বার করে বুকে জড়িয়ে ধরে। অতটুকু মেয়ের শরীরে ্যালাইনের ছুঁচ গোজা দেখে শরীরটা কেঁপে ওঠে। একসময় নার্সারিতে আবার পর্দা টৈনে দেওয়া হয়, তবে নার্সারি থেকে আরও বেশ কয়েকবার ডাক আসে বাচ্চার খাবারের জন্য। শুধু কোজাগরী একাই নয়, ওর মতো আর অনেক মা- ওর সঙ্গে ভর্তি আছে শুধু বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য। মায়েরা নিজেদের মধ্যে সুখ- দুঃখের গল্প বিনিময় করে। এইভাবে দিন গড়িয়ে যায়, কিন্তু সন্তানকে কাছে পাওয়া হয় না। রোজই আশায় বুক বাঁধে। তাদের বন্ধুদের মধ্যে যখন কেউ হাসি মুখে সন্তান কোলে ছুটি পায় তখন অন্যরা হাসি মুখে বিদায় জানালেও মনে মনে তারা অস্থির হয়ে পড়ে

টানা একুশ দিন কেটে যায়, মাঝে বাচ্চার শারীরিক অবস্থার একটু অবনতি হওয়াতে তার থাকা আরও দীর্ঘায়িত হয়ে যায়। সেদিন মধ্য রাতে নার্সারি থেকে তার ডাক এলে বুঁক কেঁপে ওঠে, কোন দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে না তো, তার জন্য ! ঘুম চোখে ছুটে যায়, ভিতরে গিয়ে দেখে বাচ্চার ডাক্তার অপেক্ষা করছে হাসি মুখে তিনি জানান, " কালই বাচ্চাকে নিয়ে যেতে পারবে " কোজাগরীর শুধু বলে , "কালই ওকে কোলে নিতে পারবো ! " "অবশ্যই , তবে খুব সাবধানে রাখতে হবে যাতে কোন রকম ইনফেকশন না হয় "

সেদিন বাকী রাতটা উত্তেজনায় আর ঘুম আসে না রোজকার মতো ভোর 'টায় নার্সারিতে হাজির হয়ে যায়।তফাৎ শুধু সেদিন আর ডাকতে হয় না। কোজাগরীকে দেখে নাইট ডিউটির এক সিস্টার হাসি মুখে বাচ্চাকে এনে সাবধানে ওর কোলে দেয়। সূর্যের রক্তিম আভা নার্সারির জানলা ভেদ করে এসে মা সন্তানকে রাঙিয়ে দেয়। প্রকৃতির আবির খেলার মাঝে কোজাগরী তার আত্মজাকে প্রথম স্পর্শ করে এক স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করে


 

 

 

 

অনুভূতি
সমীরণ সেন

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি, আমারমনের ভিতরে……… কতরাত তাইতো জে……

আরে কোন মূর্খর ফোনের রিংটোন এটা? দেখতে পাচ্ছ না শুট্চলছে। এই নিয়ে তিন বার বাজলো বিচ্ছিরি একটা গান!” – ক্যামেরা টা নামিয়ে বিরক্তির সাথে বললো সান্নিত।
করছেন শিল্প আর শিল্পের জাদুগরের গানে এত বিরক্ত” – ফোন টা কেটে দিয়ে বললো ঝুমুর।
অপু এই জন্যই তোকে বলেছিলাম এসব আল বাল জায়গায় শুট করার কি দরকার! কিন্তু না, শুধুমাত্র শর্ট ফিল্মে আঁতেলামী দেখাতে আমাকে এখানে নিয়ে এলি। সোনাগাছি ছাড়া কি শর্ট ফিল্ম সম্পূর্ণ হয়না? চল এখুনি এখান থেকে” –এই বলে অপু কে নিয়ে সান্নিত বেরিয়ে গেল

সান্নিত রায়, - সুব্রত রায় এবং অনিমা দেবীর একমাত্র সন্তান। সান্নিত যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন অনিমা দেবী ক্যান্সারে মারা যান। ব্যাবসার কাজে ব্যাস্ত সুব্রত বাবু সান্নিতের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ করেন রমিলা দাসের সাথে। রমিলা দেবী কলকাতার একটি নামী বারে গান করতেন, যদিও সেটা বিয়ের আগে। প্রতিদিন বাড়িতে নিয়ম করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন আর খেলাঘর গানটা তো থাকতোই তাঁর লিস্টে। একদিন সান্নিত তার স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারে তার মায়ের বারে গান গাওয়ার কথা। স্কুল, কোচিং, খেলার মাঠ সব জায়গায় সকলে সান্নিতকে ইশারা করে যা তা বলতে থাকে। স্বভাবতই ধীরে ধীরে সান্নিত তার মাকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে, কোনো কথাই বলেনা, মা পাশে বসতে গেলে বসতেও দেয়না। সুব্রত বাবু কে সব জানানোর পরেও তিনি বলেনএখন ছোটো আছে তাই, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে এদিকে ব্যাস্ত তিনি দ্বিতীয় সন্তান নেবারও পক্ষপাতি নন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কেটে যায়, কিন্তু রমিলা দেবী তার ছেলের স্নেহের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত থাকেন

সান্নিতের এখন ২৭ বছর বয়স। বাবার বড় ব্যাবসা ছেড়ে বন্ধু অর্পণের সাথে শর্ট ফিল্ম বানানোর খুব সখ তার। চাইলেই সে তার বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে পারতো, কিন্তু ওই যে আত্মসম্মাননিজে কিছু করতে হবে। অনেক বলে কয়ে একটা প্রোডিউসার পেয়েছে, কিন্তু তার দাবী যে নিষিদ্ধপল্লীতে শুট করতেই হবে। অগত্যা গত দুদিন হোলো তারা সোনাগাছিতে শুট শুরু করেছে

অপু হোলো সান্নিতের একেবারে ছোটবেলার বন্ধু তাই সে খুব ভালো করেই জানে সান্নিতের রবীন্দ্রসঙ্গীতে অ্যালার্জির কারন। বহুবার বোঝালেও সান্নিত বোঝেনি। কিন্তু আজ ওভাবে শুট থেকে বেরিয়ে আসা টা একেবারেই পছন্দ হয়নি অপুর, সে কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস। কিছুদুর যাবার পরে সান্নিত তার ভুল বুঝতে পেরে অপু কে বলেমুখ টা ওরকম পাঁচের মতো না করে দুটো গালাগালি দিতে পারতিস আমাকে, চল গাড়ি ঘোরা, শুট টা শেষ করতে হবে।

এরকমই একদিন শুটের মাঝে চা খেতে খেতে সান্নিত শুনতে পায় পাশের ঘরে কে একটা যেন খুব মিষ্টি গলায় গান করছে। গিয়ে দেখে একটি বছর বাইশের মেয়ে একটা সাদা পাতায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকতে আঁকতে গান করছে। অবাক হয়ে জিগ্যেস করে
"
এত সুন্দর গান গাও, এতো ভালো আঁকো, কবে শিখলে? কি নাম তোমার?”--
ঝুমুর! কিন্তু যে রবীন্দ্রনাথের গানের রিংটোন শুনে সেটাকে মূর্খের কাজ বলে সে কি করে বুঝবে? আপনাদের মতো কত লোক এখানে আসে, আমাদের দুঃখের কথা শোনে, রেকর্ড করে, তারপর লিখে বা ছবি করে কত নাম করে, কিন্তু আমরা যেখানকার সেখানেই থেকে যাই। জন্ম থেকেই আমি এই নরকে। ছোটবেলায় এখানে বিমলা মাসির কাছ থেকেই গান শোনা, সেখান থেকেই শেখা। আর আঁকতে আমার ভাললাগে তাই সময় সুযোগ হলেই বসে পড়ি। শিল্পের কোন জাত হয়না, বড় ছোটো ভালো খারাপ পতিতা ভদ্র সবার এতে অধিকার আছে।
কথাগুলো বুকে লাগলো সান্নিতের। তার মাও যে একজন শিল্পী সেটা সেদিন বুঝলো সান্নিত

এরপর শুটিং শেষ হয়ে গেলেও আস্তে আস্তে ঝুমুরের সাথে তার একটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। সে যেন সব বাঁধনহারা এক সম্পর্ক, সমাজের তথাকথিত নিয়মের বাইরে একসাথে মাথা তুলে বাঁচার এক দৃঢ় প্রত্যয়। বাড়িতে প্রথমে বাবা না মানলেও, সান্নিতের মায়ের ঝুমুর কে গ্রহন করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি

আজ দুজনের বিয়ে ধুমধাম করে হচ্ছে। সান্নিত কুনকে দিয়ে ঝুমুরের সিঁথিটা রাঙিয়ে দিতেই তার চোখ দুটো থেকে অঝোরে জল পড়তে লাগলো, অবশেষে এতদিন পর সে সত্যি ভালবাসার স্পর্শ পেল

বিয়ে শেষে দুজনে রমিলা দেবীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। সান্নিত নমস্কার করতেই তার কপালে এতদিনের জমে থাকা স্নেহের চুম্বন করলেন রমিলা দেবী। চোখ দুটো জলে ভরে এলো তার, অবশেষে মাতৃত্তের স্বাদ পেলেন তিনিও

 



রক্তের চেয়েও গাঢ়

 সম্প্রীতি তিতির রায়



মুঠোফোনের কর্কশ অ্যালার্ম টোনের শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায় মোহরের, বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছে,
শ্রাবণের অঝোর ধারায় ধূসরিত সমগ্র বিশ্ব চরাচর,অলস হাতটা বাড়িয়ে অ্যালার্মটা বন্ধ করে চোখটা বোলায় মুঠোফোনের ডিজিটাল অক্ষরে,
নাহ্, ইমরানের হসপিটালাইজেশনের খবর পাওয়ার পরেও মা বাবার তরফ থেকে কোনো ফোনকল আসেনি, ভবিতব্য ভেবে মনের অস্থিরতা গিলে নেয় নিজের মধ্যে,
বাইরের বাদলায় দৃষ্টি মেলে মোহর ডুব দেয় স্মৃতির মুকুরে
ইমরানের সাথে আলাপ নেহাতই কাকতালীয় তার, জয়েন্ট এন্ট্রান্স এক্সামিনেশনের অ্যাস্পির্যান্ট হওয়ার সুবাদে বইপাড়ায় ছিল মোহরের অবাধ আনাগোনা, অন্যদিকে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পাঠরত ইমরানের কাছেও বইপড়া ছিল একমুঠো অক্সিজেন,
এমনই এক বর্ষণমুখর দিনে প্রয়োজনীয় বইপত্র কিনে বকেয়া টাকা না নিয়েই মোহর হাঁটা লাগিয়েছিল তার গন্তব্যে,
ভুলোমনা হওয়ার স্বভাবদোষ তার মেয়েবেলা থেকেই, সে কোন বিশেষ দিন হোক বা অন্য কিছু,

যদিও পিছন থেকে আসা সুতীব্র পুরুষালি কণ্ঠস্বরে তার গতিরোধ হয়েছিল অচিরেই,
বকেয়া টাকাটা হাতের মুঠোয় গুঁজে দেওয়ার পর মৃদু ভৎসনাও জুটেছিল তার কপালে,

সেই যে শুরু......

এরপর মোহরের নিকটাত্মীয়ের ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে হসপিটালাইজেশনের সুবাদে দুজনের আরো কাছে আসা,
প্রাথমিকভাবে দুজনের মনেই সংকীর্ণতার দ্বন্দ্ব থাকলেও দুটি মনের মিল হতে বেশি দেরী হয়নি,
প্রগাঢ় বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়েছিল দুটো প্রাণ,
এরপর সমসাময়িক যুগলদের মতই তরতরিয়ে এগিয়ে চলে তাদের সম্পর্কের তরী,
ক্লাস কেটে সিনেমা থিয়েটার, গঙ্গার পাড়ে বসে নিভৃত অভিসার, সবই চলতে থাকে নিজস্ব ছন্দে,
দুজনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর পরিবারকে জানাতেই মোহরের মা-বাবার তরফ থেকে অপ্রত্যাশিত বাধা আসে,
ইমরানকে মেয়ের বন্ধু হিসেবে মেনে নিলেও জামাতা হওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেননি মোটেই,বেজাতের ছেলে হওয়ার অপরাধে মোহরের মা-বাবা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সম্পর্কের এই বাঁধনকে,
স্বাধীনচেতা হলেও তাদের মনের গহীন অন্তরালে গোঁড়ামির সূক্ষ্ম আঁচড় ছিল বর্তমান,তাই এই মহামারীর আকালে একমাত্র জামাতার কোভিড পজিটিভ আক্রান্ত হওয়ার খবর জেনেও খোঁজ নিতে বেঁধেছিল তাদের,
যদিও মোহর ইগোর স্বচ্ছ কাচের দেওয়াল টা ভাঙতে চেষ্টার কসুর করেনি..

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে,
ইদানিং ইমরানের সাথে সম্পর্কটাও আগের সেই সমে নেই,পারস্পরিক সন্দেহ তিক্ততার বেড়াজালে দাম্পত্যে শৈত্য এসেছিল ভালোমতোই..
পেশায় ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ব্যস্ততার চক্রব্যূহ পেরিয়ে মোহরের চাহিদামত সময় দেওয়াতেও ইমরান ছিল অপারগ, দিলখোলা স্বভাবজাত হওয়ার সুবাদে ইমরানের ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে বন্ধু সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট..
তবে কি অন্যান্যদের মত সেও লিপ্ত হল পরকিয়া নামক নবপ্রেমের সংজ্ঞা রচনায়,নাকি সবটুকুই তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ..
দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রেখে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মোহর,
কাজের ফাঁকেই বিয়ের পরপর স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে তার মানসপটে,
বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে সারপ্রাইজ গিফট,লং ড্রাইভ, ক্যান্ডেল লাইট ডিনার...কিচ্ছু বাকি রাখতোনা ইমরান, বরং স্বভাবদোষে মোহরই ভুলে যেত সব,
তবে কি মা-বাবার ভবিষ্যৎবাণীই সত্যি হয়ে গেল শেষমেশ! ইমরানের সাথে সম্পর্কের বাঁধন কি এতটাই ঠুনকো!

ওয়ার্ক ফ্রম হোম এমপ্লয়ীদের মধ্যে মোহরের নাম এনলিস্টেড থাকার সুবাদে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোতে হচ্ছিল না তেমন, তবুও স্বামী কোভিড পজেটিভ হওয়ার জন্যে প্রতিবেশীদের বাঁকা চাহনি,কটুক্তি তাকে ঠেলে দিচ্ছিলো একাকিত্বের বেড়াজালে,সরাসরি মন্তব্য কর্ণগোচর না হলেও বুদ্ধিমতি মোহর বুঝতে পারে সবটাই,
ফ্রন্টলাইন কোভিড ওরিয়রদের প্রতি ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে জনতার সমবেদনা উপচে পড়লেও বাস্তবিকে তাদের অবস্থান কোথায়, তা বলাই বাহুল্য,

এমন সময় কলিংবেলের কর্কশ শব্দে আজগুবি চিন্তার জাল ছিড়ে মোহর ফিরে এল বাস্তবের মাটিতে, এই অসময়ে আবার কে!
মসলামাখা হাতটা কোনমতে ধুয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই আনন্দে উত্তেজনায় কেঁপে উঠল সে,

মা-বাবা! তার বাড়ির আঙিনায়!
কাঁপা হাতে কোনমতে দরজাটা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের বাহুবন্ধনে,
সুদীর্ঘ দুই বছরের চেপে রাখা নোনতা তরলের বাঁধভাঙা ধারাটা সিক্ত করছে গালদুটো,

~"আমাদের ক্ষমা করিস মা,"মোহরের হাতটা ধরে গুঙ্গিয়ে উঠলেন সুপ্রিয়া দেবী,"হীরের মালিকানা পেয়েও কাচের সন্ধান করে চলছিলাম নির্বোধের মতো, আর ভুল বুঝিস না মা আমাদের,"

~"কিন্তু এই বাড়ির এড্রেস তোমরা পেলে কি করে! তোমাদের.." কথাটা শেষ করতে পারেনা মোহর, চোখটা তুলে সামনে চাইতেই মিটিমিটি হাসিতে ভরা ইমরানের মুখটা নজরে পড়ে এতক্ষণে,
"
তুমি!ডিসচার্জ করে দিয়েছে হসপিটাল থেকে.. কই কেউ কিছু জানালো.." বাঁধভাঙ্গা খুশির প্লাবনে মোহরের বাকশক্তি রোধ হয়ে গেলো প্রায়,
এত সৌভাগ্যও তার অদৃষ্টে ছিল,
কোভিড স্টেজ'টু তে থাকার সুবাদে চিরাচরিত অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগগুলো যে কাজ করছিল না,তা ইমরানই জানিয়েছিল,
মোহরের সপ্রশ্ন দৃষ্টি নজর এড়ালো না তার,
~"
প্লাজমা থেরাপিতে সুফল মিলছে,.. তারপর ডিসচার্জের পর সোজা তোমার মায়ের বাড়ি,কেমন সারপ্রাইজ দিলাম বলো,
বাই দ্যা ওয়ে হ্যাপি বার্থডে মিসেস মোহর চ্যাটার্জী !
জন্মদিনে এবারের এটাই তোমার সারপ্রাইজ গিফট..নিজের জন্মদিনটাও ভুলে গিয়েছো তাইনা!"

খুশির চোরাস্রোতে ভাসতে ভাসতে পরম আশ্লেষে ইমরানকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে,
এই স্পর্শ যে পরম নির্ভরতার ......
লুপ্ত বিশ্বাস-ভরসার পুনর্জাগরণের সঙ্কেত,
যেনো ঠিক সেই প্রথম স্পর্শের মতো,যেদিন পরিবারের অমতে গিয়ে মোহর ইমরানের হাত ধরেছিলো,
যেমনটি দয়িতা আঁকড়ে বাঁচে দয়িতকে নিয়ে,

কিছু সম্পর্ক যে রক্তের চেয়েও গাঢ়!






আশ্রয়
সহেলী হাজরা


ভোরের দিকে ট্রেনটা সশব্দে চলে যেতেই বাড়িঘর, চারপাশ সব কেঁপে উঠল। রাস্তায় জলের লাইন নিয়ে ঝগড়া লেগেছে আজও, অশ্রাব্য ভাষায় চলছে গালি-গালাজ।উনিশ বছর আগেও এসবে একেবারেই অভ্যস্ত ছিলনা রাজন্যা,কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে এইসব ব্যাপারকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা! ব্যাস তারপর এসব থেকে মুক্তি! ঘুমন্ত মেয়ের দিকে একবার স্নেহভরে চেয়ে দেখল সে,একেবারে বাবার মত দেখতে হয়েছে।
কলেজ জীবন শেষে তিনবছর এর ভালোবাসার পূর্ণতা প্রাপ্তি শুধু চেয়েছিল সে,তবে রাস্তা সহজ ছিল না। শৌনক তখন হন্যে হয়ে একটা চাকরি খুঁজছে, 'যোগ্য' স্বামী হয়ে ওঠার জন্য, রাজন্যার বাবা-মার দাবি মেটানোর জন্য। কিন্তু পারলনা সেভাবে।হাওড়ার দিকের কোনো এক গ্রামে থাকত শৌনক,খুব ছোটোবেলায় মা বাবা দুজনেই মারা যাওয়ায় কলকাতায় এক দূরসম্পর্কের জ্যেঠু তাকে ঠাঁই দেয় নিজের বাড়িতে। দুবেলা খাওয়ার বিনিময়ে করতে হত বাড়ির যাবতীয় কাজ, ফলে লেখাপড়াটা সেভাবে এগোতে পারেনি আর। কলেজের ক্যান্টিনে কাজ করত শৌনক, সেখান থেকেই আলাপ রাজন্যার সাথে....শুরু হল এক অসম প্রেম। রাজন্যার পরিবার বিশাল উচ্চবিত্ত না হলেও, অভাবের জ্বালা কী, সেটা সে কোনোদিনই বোঝেনি সেভাবে। অনেক চেষ্টা করেও যখন শৌনক একটা কারখানার কাজ ছাড়া আর কিছুই জোগাড় করতে পারলনা, তখন বাবা মার আদেশ অনুযায়ী বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর সাথে যোগাযোগের রাস্তা টাও বন্ধ হয়ে গেল। অনেক আশা নিয়ে বাবা আর মা কে মানিয়েছিল রাজন্যা, বুঝেওছিল যে সে নিজে ঠিক মানিয়ে নেবে। কিন্তু ওনারা মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হলেন না, উল্টে আরো কঠোর আচরণ করতে শুরু করলেন। রাজন্যার জন্য পাত্র দেখা শুরু হল। একদিকে মা বাবার এতবছরের স্নেহ-ভালোবাসা, অপরদিকে শৌনকের সেই মায়াময় দুটো চোখ, যা ছোটোবেলা থেকে কিচ্ছু পায়নি, একটু আশ্রয় খুঁজেছে কেবল। আর থাকতে পারেনি রাজন্যা, বাড়ির অমতে পালিয়ে গিয়ে দুজনে বিয়ে করেছিল। মুহূর্তের মধ্যে আজন্ম পরিচিত সেই নিজের বাড়ির দরজা তার জন্য চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে যায়...
একটা ভাড়াবাড়ি নিয়ে ওরা নবদম্পতি থাকতে শুরু করে। প্রথম প্রথম ভালোবাসার খুনসুটিতে সব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, কিছুদিনের মধ্যেই রাজন্যা বুঝেছিল দারিদ্র্যের জ্বালা কি! বিয়ের দু'বছর পর তুতুল হলো, সংসারে চাহিদা আরো বেড়ে গেল। শৌনক তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অ্যাসবেস্টার এর কারখানায় ওভারটাইম শুরু করেছে একটু অর্থিক উন্নতির আশায়। মাসে দু হাজার করে ভাড়া, কারেন্টের টাকা, মেয়ের খাবার সব জোগাড়ের পর নিজেদের জন্য বাঁচত সামান্যই। তার উপর ছিল বাড়িওয়ালা দের অত্যাচার, এগারো মাসের বেশি থাকা যাবেনা, জল বেশি খরচ করা যাবেনা, বাথরুম তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে-এরকম আরো কত কি! ছোট্ট তুতুল একবার চক দিয়ে ঘরের দেওয়ালে এঁকেছিল বলে সেকি অশান্তি! এক ভাড়াবাড়ি ছেড়ে সব জিনিসপত্র নিয়ে অন্য বাড়ি যাওয়ার সময় নিজেকে কেমন উদ্বাস্তু, যাযাবর মনে হত। শৌনক একদিন রাজন্যার কোলে মাথা রেখে হাসতে হাসতে বলেছিল-

-'আমাদেরও একদিন নিজের বাড়ি হবে দেখো, , একদম নিজের, কেউ উঠে যেতে বলবেনা। আমি ছুঁয়ে দেখব সে ঘর। আমিও বাবুদের মত বিছানায় বসে রবিবারে কাগজ পড়ব'

আজ এতবছর সেই মানুষটার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! মানুষটাই আর সশরীরে বেঁচে রইল না। ওভারটাইম কাজ করে, অনিয়মিত খাবার খেয়ে যক্ষ্মা রোগের কবলে পড়ল শৌনক। দিশেহারা হয়ে পড়েছিল রাজন্যা, মা বাবার কাছে গিয়েছিল একবার তুতুল কে রাখতে.. কিন্তু ওরাও মুখ ফিরিয়ে নিল, ভাবটা এমন দেখাল যেন বলছে- ' কীরে বলেছিলাম না? সুখী হবি না, মিলল তো?
কী নিষ্ঠুর লেগেছিল সেদিন পরিচিত মানুষগুলোকে, আভিমান জেদের বশে আর বাড়িতে যায়নি সে।কিন্তু বিপদ অপেক্ষা করছিল অলক্ষ্যে।বছর খানেক ভোগার পর রাজন্যাকে আরো দিশেহারা, একা করে দিয়ে মারা গেল শৌনক। টিউশন পড়িয়ে, লোকের বাড়ি বাসন মেজে দিন চলতে লাগল। দু হাজার টাকার ভাড়াবাড়ি টানতে না পেরে এই বস্তিতে ঘর ভাড়া নেয় রাজন্যা। মুখে রক্ত তুলে খাটতে আরম্ভ করল, অল্প বয়সে স্বামীহীন একজন মেয়ে কে দেখে অনেক কুপ্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু রাজন্যা সেসবে কান দিল না, ওর লক্ষ্য ছিল-'একটা আশ্রয়' এতদিনের পরিশ্রম আজকে সার্থক হচ্ছে, তিলতিল করে লাখ চারেক জমিয়েছে রাজন্যা।মনিবদের বাড়ির একজন বড়ো প্রমোটার, ভালো মানুষও বটে, ওনার কৃপাতেই ফ্ল্যাটের একটা ছোট্ট কামরা কিনেছে সে, এখনো লাখ দেড়েক বাকি আছে দিতে। রাজন্যা কথা দিয়েছে টাকা আস্তে আস্তে কাজ করে শোধ করে দেবে

বিকেল হয়ে এসেছে, টেম্পো করে ঘরের বাকি জিনিস গুলো আসছে। কিশোরী তুতুল বিস্ময় ভরে নতুন ঘরটাকে দেখতে লাগল। জন্ম অবধি নিজের ঘর বলতে কিছুই বোঝেনি সে, কতবার বদলেছে স্কুলের খাতায় ঠিকানা। আজ এই ছোট্ট সাদা রং করা ঘরটা তার পুরো নিজের? এখানে রং দিয়ে আঁকলেও কেউ বকবে না! কেউ বলবে না যে উঠে যাও। প্রতিবার প্রতিটা বাড়ি ছাড়ার সময় কত কেঁদেছে সে, আর কাঁদতে হবেনা।আলতো হাতে দেওয়ালের গা টা স্পর্শ করল তুতুল। মা কী ভীষণ কষ্ট করেছে এই ঘরটার জন্য, বাবার নাকি খুব ইচ্ছে ছিল এই বাড়ির।বাবা তো সেই কোন ছোট বেলায় চলে গেছে আকাশে,আর ফেরেনি। নিমেষে মন টা খারাপ হয়ে গেল তার, হঠাৎ খট্ করে আওয়াজ পেয়ে, পাশে তাকিয়ে দেখে, মা ঘরে ঢুকে বাবার একটা ছবি দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে। একভাবে সেদিকে রইল তুতুল।আবছা ভাবে যেন সে দেখতে পেল, সামনে জানালার কাছে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে, ছুঁয়ে দেখছে তার প্রথম নিজের বাড়ি।মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে রাজন্যার, আজ আর কারো প্রতি রাগ-অভিমান নেই। কষ্টে তারা ছিল ঠিকই কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। জীবনের প্রথম ধাপের লড়াইয়ে জিতেছে রাজন্যা,এখনো আরেক লড়াই বাকি-তুতুল।খুব শান্তি লাগছে তার মন টা, পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের লালচে আভায় সে দেখল, তুতুলের মধ্যে দিয়েই শৌনক স্পর্শ করছে এই ঘর, দেওয়ালে ঝোলানো ছবিতে ফুটে উঠল একটা তৃপ্তির হাসি। শুরু হল নতুন জীবনযুদ্ধ, বাড়ির প্রতিটা ইট-পাথরে লেগে রইল শৌনকের ইচ্ছের প্রথম স্পর্শ

 

 

 

স্নেহের পরশ
রাই সেন


আমি রাই। না না বিনোদিনী রাই নয়,এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা মায়ের আদরে বড়ো হয়ে ওঠা এক রাজকন্যা।ছোট থেকে অনেক অভাবের সাথে আমার পরিচয় হলেও আদর ভালোবাসার অভাব কোনোদিন হয়নি।আমি ছোট থেকেই কুকুর- বিড়াল জাতীয় প্রাণীদের ভয় পেতাম।কারন আমাকে একবার কুকুরে কামড় দিয়েছিল আর অনেকগুলো ইনজেকশন নিতে হয়েছিলতাই আমি সর্বদা এসব প্রাণীদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম।কিন্তু সেই আমার জীবনে আমি পেলাম এক অভাবনীয় অনুভূতি,এক ঘটনার মাধ্যমে।কিছুদিন আগে সন্ধেবেলা আমি যাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।কিছুক্ষণ পর বাড়িতে ফিরে দেখি একটা ছোট বিড়াল ছানা আমাদের ঘরে বসে।দেখেই ভয়ে মায়ের উপর চিল-চিৎকার করি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য, কারোর কোনো কথা না শুনেই।তারপর বাবা আমায় ঘরে নিয়ে গিয়ে শ্রান্ত হতে বলে,আর সাথে এটাও বলে কেন বিড়াল ছানাটিকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।বাবা বলে যে,বাবার দোকানে একটি বিড়াল দুটি ছোট ছোট বাচ্চা দেয়,বাবার দোকানের পাশেই রেললাইন,বাচ্চাদের জন্য খাবার খুঁজতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় বিড়ালটি।বিকালে বাবা দোকানে গিয়ে দেখে ওই দুটো ছানার একটিকে বেজি তে ধরে নিয়ে গেছে,আর কোনোক্রমে বরাত জোরে বেঁচে গেছে।তাই বাবা আর রিস্ক না নিয়ে ওকে বাড়িতে নিয়ে আসে।বাবার কাছে সবটা শোনার পর ওর জন্য খুব মায়া হল কিন্তু ভয় টা তো যাওয়ার নয়।তাই বললাম বাড়িতে থাকুক কিন্তু আমার কাছে যেন না আসে।তারপর বহাল তবিয়তে তিনি আমার বাড়িতে থাকতে লাগলেন আর মায়ের আদর খেতে লাগলেন, এতটাই ছোট ছিল যে নিজে থেকে খেতে পারতো না,মা আমূল দুধ গুলে ফিডিং বোতলে ভরে ওকে খাওয়াত।আমার আদরে ভাগ বসানোর জন্য একটু একটু রাগ হচ্ছিল কিন্তু এতটাই মিষ্টি ছিল যে রাগ ,ভয় চলে গিয়ে ধীরে ধীরে আমি ওকে ভালোবাসতে শুরু করলাম।আর একটা নাম দিলাম "কুচু"ওর খিদে পেলেই ওকে ফিডিং বোতলের সামনে গিয়ে বসে থাকতে দেখে মায়া হতো আর হাসি পেত।আর কুচু তেমনি পরম আনন্দে সবার ভালোবাসায় বড়ো হতে লাগল।কারোর পায়ের আওয়াজ পেলেই দৌড়ে আসত।সেরকমই একদিন আমি টিউশন থেকে বাড়ি ফিরেছি সন্ধ্যেবেলা, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না,সেইসময় আমার পায়ের আওয়াজে কুচু দৌড়ে আসে আর আমি বুঝতে না পেরে ওর উপরেই পা তুলে দিই।আলো জ্বালাতেই দেখি ছটফট করছে,আমি খুব ভয় পেয়ে যাই আর কেঁদে ভাসাতে থাকি।মা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়,ওষুধ খেয়ে ভলিনি স্প্রে করে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়।বুঝতে পারি আমাদের সাথে থাকতে থাকতে আমাদেরই একজন হয়ে গেছে এবং আমার খুব কাছের।ওই ঘটনার পর ওর সাথে আমার সখ্যতা আরো বাড়তে থাকে,সারাক্ষন আমার সাথে খেলা করা,খাওয়া,কোলে নিয়ে আদর করা, আমার পাশে ঘুমানো সমস্তকিছু।আমাকে দেখতে না পেলে ওর মন খারাপ করে বসে থাকা ,সমস্ত কথা যেন বুঝতে পারতো।সেই প্রথম বুঝতে পারি প্রাণীদের ভালোবাসলে অনেক ভালোবাসা পাওয়া যায়।আমার ভয় কাটিয়ে দিয়ে আমার থেকে স্নেহের পরশ টুকু আদায় করে নিয়েছে।এখন আমি আর কুচু কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারি না, বলা ভালো স্নেহের পরশ টুকু খুব মিস করি কুচুর থেকে দূরে থাকলে

 

 

নতুন ভোর
তৃষা আচার্য


আজ শ্রেয়সীর জীবনে এক অন্যতম দিন, আজ ওর আর রনিতের ফুলশয্যা। সব মেয়ের কাছেই এই দিনটা বিশেষ হলেও শ্রেয়সীর কাছে যেন একটু বেশী তাৎপর্যপূর্ণ।
বউভাতের রাতের সমস্ত আচার অনুষ্ঠান মিটে যেতে রনিতের মা সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।কিছুক্ষণ পরে ঘরে আসে রণিত। শ্রেয়সী বসেছিল খাটের এক কোনায়। রনিত ওর পাশে এসে বসলো একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে বললউফফকি ঝামেলাটাই না গেলো এই তিনদিন ধরে বল???... যা বুঝলাম, বিয়ে মানেই যেন দুটো মানুষকে সাজিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মত পুতুল নাচ করানো।শ্রেয়সীর থেকে কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে রনিত বুঝতে পারলো এই ঘরে এক খাটে ওর পাশে শ্রেয়সী বসে থাকলেও ওর মনটা হারিয়ে গেছে বছরখানেক আগের কোন এক দুঃস্বপ্নের রাতে।
শ্রেয়সী, এইই কিগো কি হল কি এত ভাবছ বলত?”, রনিতের ডাকে সম্বিত ফেরে শ্রেয়সীর। ওর দিকে তাকিয়ে হঠাত ডুকরে কেঁদে উঠলো শ্রেয়সী, দীর্ঘক্ষণ ধরে নিজের মনের সাথে লড়াই করতে করতে হেরে গেছে মেয়েটা। করুণ মুখে চেয়ে আছে রনিতের দিকে, ওর দুই গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা। রনিতের বুকটা যেন কষ্টে ফেটে যাচ্ছে, ওর শ্রেয়সী, এত কাছে বসে এমনভাবে কাঁদছে!!! তাড়াতাড়ি শ্রেয়সীর গালে হাত দিয়ে জলটা মোছাতেই চিৎকার করে ছিটকে ভয়ে দূরে সরে গেলো শ্রেয়সী।
দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পরে শ্রেয়সী। চোখের সামনে ভেসে উঠলো, কতগুলো নোংরা পিশাচ এগিয়ে আসছে ওর দিকে, ওদের চাহুনি তে আরও গুটিয়ে যাচ্ছে একাকি, অসহায়, ভীত, শ্রেয়সী। চিৎকার করছে, বারণ করছে ওই মানুষরুপী রাক্ষসগুলোকে, আর ততই ওরা এগিয়ে এসে ওদের নোংরা হাতে শ্রেয়সীর দুর্বল শরীর গ্রাস করছেমেরে ফেলছে ওকে আঘাতে আঘাতে।
জলের ঝাপটায় সম্বিত ফিরে পায় সে, চোখ খুলতেই রনিতের স্নিগ্ধ হাতের স্পর্শ অনুভব করে শ্রেয়সী। উদবিঘ্ন দৃষ্টিতে রণিত জিজ্ঞেস করে, “এখন তোমার শরীর ঠিক লাগছে তো?” মাথা নেড়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে শ্রেয়সী। “I am sorry রণিত, আসলে খুব………” শ্রেয়সী কে থামিয়ে রণিত বলে, “আমি তোমাকে বুঝি শ্রেয়সী, থাক ওসব কথা, চল আজ আমরা আমাদের পুরনো দিনে ফিরে যাই
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা অনুভব করে শ্রেয়সী, যেমনটা করেছিল সেই রাতের ঘটনার পরে, তফাত শুধু একটাই, “স্পর্শের
রণিতের আজকের স্পর্শ টা শ্রেয়সীর কাছে যেন সেই প্রথম স্পর্শের মত আবেগ জড়ানো। নিরাপত্তার, ভালোবাসার, এই স্পর্শ তার শরীরে শিহরন জাগিয়ে তোলে, যার অনুভুতি এতদিন চাপা পরেছিল কিছু নোংরা স্পর্শের ক্ষতর আড়ালে।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো দুজনের সেই সুখস্মৃতির দিনগুলো, নতুন করে শিহরিত করল অনেক পুরনো স্পর্শ। আজকের রাত টা ওদের নতুন জীবনের, নতুন ভোরের সাক্ষী হয়ে থাকল।আর সাক্ষী হয়ে থাকল ওদের Bluetooth speaker, যেখানে বাজছে কবির সুমন এর-
।।।অমরত্তের প্রত্যাশা নেই, নেই কোন দাবি দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে, শুধু তোমাকেই চাওয়া
।।।

 

 

অন্নপূর্ণার আশীষ
রূপাঞ্জনা রায়

 


তুমি চোখির জল আর ফেলো নাগো. দেখো একদিন ঠিক এই জমিতি ফসল হবে.তুই আর মন ভোলানো কথা কস না রে ছায়া. জমি যে একেবারে নিষ্ফলা. বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে দেখি আসতিছি ওই জমি আমাদের সাথে বেইমানি করতিছে. কত গায়ের ঘাম ঝরাইছি রে ছায়া. এক গ্লাস জল দে দেখি. খেয়ে আবার বড়ো কত্তার জমিতি একটু জল দে আসি. আজ যদি এই জমি খানে ফসল হতো তোরে এট্টু সোনার হার গড়ি দিতি পারতাম. পরের জমিতি চাষ করে সংসার টাই তো চলতিছে না রে. মনের চাপা কষ্ট নিয়ে চলে গেলো হরেন. ছায়া এক দৃষ্টিতে হরেনের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো
হরেন একজন ভাগ চাষী. অন্যের জমি সারা বছর চাষ করে ফসল ফলানো তার কাজ.
আজ হরেন যাওয়ার পর ছায়া ভাবতে বসলো কীভাবে ওই জমিতে ফসল ফলানো যায়. অনেক বেলা হয়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে পুকুর থেকে একটা ডুব দিয়ে এসেই বাড়ীর ছোট্ট মাটির মন্দিরে পুজো দিতে বসলো. বারো মাস মা অন্নপূর্ণার পুজো হয় এই বাড়িতে জল বাতাসা দিয়েই মায়ের আরাধনা করা হয়. ফল মিষ্টির যোগান কে দেবে? কখনো কখনো তাও জোটে না. রান্না ঘর থেকে একটু একটু জিনিস সরিয়ে রাখা অভ্যেস ছায়ার, অভাবের সংসারে কখন প্রয়োজন পড়ে. সেইখান থেকেই একটু চিনি এনে মাকে চোখের জল দিয়ে নিবেদন করে ছায়া. আজ মায়ের সামনে গলায় আঁচল দিয়ে ছায়া কাঁদছে. তার কোলেও ফসল
দেয় নি ভগবান আর জমি টাও নিষ্ফলা.

গোয়ালের পাশে বহু পুরোনো গোবর জমা আছে. ছায়ার কি মনে হলো কোদাল দিয়ে সেই জমির বেশ খানিকটা খুঁড়ে গোবর সার দিলো ছড়িয়ে. দু দিন পড়ে বৃষ্টি হলো ভীষণ.. আজ হরেন বাড়িতে. সারাদিন তো খেটে খেটেই যায়. আজ এট্টু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বৃষ্টি থামলি বৌটার জন্যি গুরুর দোকান থেকে কয়খান তেলিভাজা আনি দিবো,খেতি বড্ড ভালোবাসে ছায়া.
বৃষ্টি পড়লে ছায়া চোখে কাজল দিতে ভালোবাসে. স্নান সেরে ভাত বাড়লো দুজনের. প্রত্যেক দিনের ক্লান্তির শরীর টা আর সাথ দেয় না রাতে. আজ ছায়া কে বহু দিন পরে হরেন আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো. শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের বুক ঢাকতে ঢাকতে ছায়া বললো হ্যাঁগো তুমি আরেকখান বে করো. আমি সতীনির ছেলে পুলে নিয়েই ঘর করবো. তবুও তো তুমি বাপ হতি পারবা. হরেনের মুখ মেঘলা হলো.
মাস খানেক পরে ছায়া রাতে স্বপ্ন দেখছে মা অন্নপূর্ণা যেন সারা জমিতে সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে. আর সেই জমিতে মা যেন ছোট্ট এক মেয়ে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে. ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে ছায়া দেখে সেই কোদাল দিয়ে খোঁড়া জায়গায় ওর ছড়ানো বীজেরা বিকশিত হয়েছে. ভেন্ডি আর ঝিঙের গাছ বেরিয়েছে.. আনন্দে আত্মহারা হয়ে হরেন কে ঘুম থেকে ডেকে তুললো ছায়া.

দুই বছরে ধান আর বাদাম লাগিয়ে বেশ টাকা সঞ্চয় হয়েছে. সোনার হার হয়নি ঠিকই কিন্তু ছোট্ট দুটো কানের দুল হয়েছে. জীবনে প্রথম ছায়া সোনা ছুঁয়ে দেখলো. রাতে কানের দুল পড়িয়ে দিচ্ছিলো বৌ কে হরেন. হরেন এর গলা জড়িয়ে ধরে ছায়া কানে ফিসফিস করে বললো আগের মাসখানে আমার হয়নিকো. কাল রাতি খেতি বসে বড্ড বমি আসতিছিলো. হরেন মুখে দুস্টুমি মাখানো হাসি নিয়ে বললো তবে যে সতীন নে ঘর করবি বলিছিলি. হরেনের লোমে ভরা চওরা বুক টায় আদুরে কিল বসায় ছায়া.. দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ছায়া কে হরেন. মুখে লাজুক হাসি ছায়ার.
বৌয়ের পেটে হাত দিয়ে হরেন বললো মা অন্নপূর্ণা এবার আমাদের আশীব্বাদ করিছে রে ছায়া আশীব্বাদ
.





ভাগ্যের পরিহাস
সৌমেন মন্ডল

 

চারিদিকে তখন দাঙ্গা, গোবিন্দ ছুটে পালাচ্ছে পুলিশের তাড়া খেয়ে।ও নিজের আত্মরক্ষার জন্য এক দাঙ্গাকারীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। দাঙ্গাতে গোবিন্দর বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সঙ্গে তার বৃদ্ধ মা মারা গেছেন।
গোবিন্দ ছুটতে ছুটতে প্রায় চল্লিশ মাইল চলে এসেছে, তখন প্রায় রাত এক'টা , গোবিন্দ একটা অচেনা গ্রামে প্রবেশ করে, চারিদিকে লন্ঠন মিট মিট করে জ্বলছে, গোবিন্দ একা গ্রামের সরু এবড়ো খেবড়ো রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। রাস্তার দুই পাশে গভীর জঙ্গল, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, জোনাকির আলো টিম টিম করে জ্বলছে।
কিছুটা গিয়ে গোবিন্দ একটা মাটির বাড়ি দেখতে পেল, বাড়ির দরজার কাছে এসে অনেকবার ধাক্কা মারার পর এক ভদ্রলোক লন্ঠন হাতে বেড়িয়ে আসেন। গোবিন্দ ভদ্রলোকটিকে অনেক অনুরোধ করে বললো, "আমি খুব ক্লান্ত, আমাকে একটা রাত থাকতে দিন না।"ভদ্রলোক না বলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
এইভাবে গোবিন্দ প্রায় দুইঘন্টা ধরে অনেক গুলো বাড়ির দরজা ধাক্কা মেরে আকুতি মিনতি করলেও কেউ তাকে একরাত থাকতে দিল না।
অবশেষে , গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা বাড়ি থেকে এক কিশোরী বছর আঠারো হবে, হাতে মোমবাতি নিয়ে বেরিয়ে এলো। গোবিন্দর অসহায় অবস্থা দেখে বাড়িতে আশ্রয় দিলো।
গোবিন্দ বললো ,"আপনার নাম কি?"
কিশোরী শান্ত গলায় বললো ,"আমি রাধা।"
বাড়িতে ঢুকে গোবিন্দ বললো ," যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক শুয়ে আছেন উনি কি আপনার বাবা!"
রাধা --" হ্যাঁ। বাবার খুব অসুখ, বেশিদিন বাঁচবে না।"
গোবিন্দ-- "কেন !কি হয়েছে?"
রাধা-- "ব্লাড ক্যান্সার ওসব কথা এখন থাক, আপনি বরং ছাদে চলে যান ,ছাদের ঘরে আজকের রাতটা কাটিয়ে দিন। এতো রাতে আপনার জন্য কোন খাবার জোগাড় করতে পারবো না, খাবার সব শেষ।"
গোবিন্দ-- "আমার খিদে নেই। থাকতে দিয়েছেন আমাকে, এতেই আমি আপনাদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ।"
পরেরদিন সকালে গোবিন্দ যখন নীচে নেমে আসে , রাধা বললো, "এই নিন আপনার চা।" রাধা আগেভাগেই তার বাবাকে সমস্তকিছু খুলে বলে দিয়েছে।
রাধার বাবা অমলবাবু গোবিন্দকে বললেন, "দুপুরের খাবার খেয়ে যাবে।"
অমলবাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, পেনশনের টাকায় তাদের সংসার চলে। এছাড়া ওদের অনেক জমিজমা আছে, লোক দিয়ে চাষবাস করায়।
অমলবাবু-- "গোবিন্দ তুমি কি করো?বয়স তো অল্প মনে হয় , বছর একুশে হবে না? তোমার বাবা-মা বেঁচে আছেন?"
গোবিন্দ--"অন্যের জমিতে চাষবাস করে দিন চলতো। আমি এখন বাইশে পড়েছি। কেবল মাত্র বৃদ্ধা মা ছিল ,সেও দাঙ্গাতে চলে গেল।"
অমলবাবু--", খুব দুঃখজনক! গোবিন্দ তুমি বরং আমাদের জমি চাষবাস করো, এখানে খাওয়া দাওয়া আর থাকার কোন সমস্যা হবে না। "
গোবিন্দও পুলিশের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে অমলবাবুর বাড়িতে রয়ে গেল। গোবিন্দ ধীরে ধীরে ওদের কাছের মানুষ হয়ে উঠলো।
তারপর হঠাৎ পনেরো দিনের মাথায় অমলবাবু মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে তিনি গোবিন্দকে রাধার দেখাশোনার ভার দিয়ে যান
একদিন গোবিন্দ ছাদের ঘরে একা শুয়ে আছে রাত তখন এগারোটা হবে। দরজায় খট খট আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দেখলো রাধা এক হাতে খাবারের থালা অন্য হাতে লন্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গোবিন্দ--"কি ব্যপার রাধা তুমি এখন ?'
রাধা-- "আপনার খাবার, টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে গেলাম।"
গোবিন্দ--"আরে বসো,একটু বসো। তুমি খেয়েছ?"
রাধা-"না, আপনি খেয়ে নিন, আমি পরে খাচ্ছি। বাইরে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, নীচে ঘরের জানালাগুলো থেকে প্রচণ্ড আওয়াজ আসছে, শ্রীঘ্রই বন্ধ করতে হবে।একি আপনি ঘরের জানালাটা বন্ধ করেন নি, বৃষ্টি ঢুকছে যে!"
গোবিন্দ -" ঠিক আছে আমি বন্ধ করে দিচ্ছি" এই কথা বলেই, রাধার মুখে আচমকা একটুকরো রুটি ডালে ডুবিয়ে দিতে যাওয়ায় রাধা চমকে গিয়ে দূরে সরে যেতে গেলে হাত থেকে লন্ঠনটা মেঝেতে পড়ে নিভে যায়।ঔ সময় অন্ধকার মুহূর্তে প্রচণ্ড মেঘের গর্জনে রাধা ভয় পেয়ে গোবিন্দকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। গোবিন্দ আগে থেকেই রাধাকে তার সুন্দর মুখশ্রী আর নিটোল শরীর আর নম্রতার জন্য ভালোবেসে ফেলেছিল, কিন্তু কোন দিন বহিঃ প্রকাশ করে নি।রাধাও গোবিন্দর পেশিবহুল দেহ, সাহসিকতা,কর্তব্য পরায়নতা দেখে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছিল তা বুঝতেও পারেনি।
গোবিন্দ এই প্রথম একজন নারীর স্পর্শ পেল।রাধার নিঃশ্বাসের গরম হাওয়া গোবিন্দর ঘাড়ে লাগতে তার শরীরে শিহরন জেগে উঠলো, অনুভব করলো জীবনের সবচেয়ে বেশী সুখ যা কখনো পায়নি।
কিছু দিন পর তারা বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়।বহু ডাক্তার আর ঠাকুরে কাছে প্রার্থনা করে দশ বছরের মাথায় তাদের কন্যা সন্তান কৃষ্ণকলি জন্ম নেয়।কৃষ্ণকলি ছোট থেকে বাবা-মার আদরে বড় হয়। কৃষ্ণকলির বয়স যখন ছয় বছর তখন রাধা- গোবিন্দর সংসারে আরও একটা পুত্র সন্তান জন্ম নিলো, নাম রাখা হলো ঝিনুক। ঝিনুক জন্ম থেকেই অন্ধ ছিল। বহু ডাক্তার দেখানো হয়, সবাই অপারেশন করার কথাই বলেন।ডাক্তার আরো বলেন, তাদেরকে ছয় লাখ টাকা সঙ্গে দুটি চোখ ডোনেট করতে হবে। কিন্তু তাদের এতো টাকা দেওয়ার মত সামর্থ ছিলো না,তাই তারা ছেলের অন্ধত্বকে ভাগ্যের পরিহাস ভেবে দিন যাপন করতে থাকে।
এই ভাবে আরো ছয় বছর কেটে গেলো, কৃষ্ণকলি এখন বারো বছরের, ক্লাস ফাইভে পড়ে।এই দিকে কৃষ্ণকলির ভাই ছোট্ট ঝিনুক তার বাবা মাকে না দেখতে পারায় খুব দুঃখের মধ্যে থাকে।মা রাধা তাকে বারেবারে সান্ত্বনা দিয়ে বলতো," বাবা তুই আর একটু বড় ঠিক দেখতে পাবি।"
ছোট্ট ঝিনুক তার মাকে স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করে মা কেমন দেখতে হয়।
এইদিকে কৃষ্ণকলিকে গ্রাম পেরিয়ে শহরের একটা স্কুলে পড়তে যেতে হত। স্কুল থেকে ফিরে এসে তার ছোট্ট ভাইকে নিয়ে খেলা করতো, ভাইকে জড়িয়ে ধরে আদর করতো, ভাইয়ের নরম হাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্যে প্রতিদিন স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরত। তার কাছে তার ভাইয়ের স্পর্শ জীবনের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ ছিলো।
একদিন যখন কৃষ্ণকলি স্কুল থেকে ফিরছিলো, হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে ওকে ধাক্কা মারে, কারের মালিক খুব ধনী ক্ষমতাবান ছিলেন।উনি ছোট্ট কৃষ্ণকলিকে নার্সিংহোমে নিয়ে যান কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, ছোট্ট কৃষ্ণকলি বড় অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়।
খবরটা শুনে কৃষ্ণকলি বাবা -মা' মাথায় যেন বজ্রপাত পড়লো। কৃষ্ণকলি মা রাধা তার একমাত্র কন্যাকে হারিয়ে প্রায় পাগল হয়ে যায়।
এই দিকে গাড়ির মালিক কৃষ্ণকলির বাবা মাকে অনুরোধ করেন কোন কেস না করতে,উনি রাধা গোবিন্দকে তাদের ছেলের চোখ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ‌, প্রশাসনকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখেন। ভদ্রলোকের প্রচেষ্টায় ছোট্ট ঝিনুকের অপারেশন হয়। মৃত কৃষ্ণকলির চোখ দুটো তাকে দেওয়া হয়।
অপারেশনের পর ছোট্ট ঝিনুক তার মাকে দেখতে পেয়ে খুব আনন্দিত হয়,মাকে জড়িয়ে ধরে।এই প্রথমবার তার চোখ দুটো মাকে স্পর্শ করে।মা রাধাও ছোট্ট ঝিনুকের চোখে তার আদরের কৃষ্ণকলিকে অনুভব করে

 

 

 

 

ফুলেল স্পর্শ
অরুন্ধতী নন্দী

মেয়ের যেন সবই অদ্ভুত ! যে বয়সে মেয়েরা সাজে গোজে , বয়ফ্রেন্ড নিয়ে স্টাইল মেরে ঘুরে বেড়ায় ! সেই বয়সের কলেজ পড়া মেয়ে , যেন মেয়েই নয় ! পড়াশোনার ফাঁকে যেটুকু অবসর সারাদিন গাছ নিয়ে পড়ে থাকে ! রবিবার হলে তো কথাই নেই ! ফুলও ফোটায় খুব সুন্দর গতবার স্থানীয় এক ফুল মেলায় তার তৈরী ডালিয়া আর গাঁদা প্রাইজ পেয়েছে সেখান থেকেই তার আর এক পাগলামি শুরু হয়েছে ফুল মেলায় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল একটা টুকটুকে লাল রঙের বিশাল ডালিয়া জীবনে অনেক রঙের ডালিয়া দেখেছে কিন্তু এমন মনভোলানো লাল রঙ দেখেনি

বাড়ির পিছনে একচিলতে বাগান আর ছাদ ভর্তি টব। এই নিয়েই পড়ে থাকে অথচ ফর্সা টকটকে গায়ের রঙ একঢাল কালো চুল কাটা কাটা চোখ নাক মুখ এককথায় সুন্দরী মুখে একটা অদ্ভুত সারল্য আছে অথচ কোন যত্নই নেই !
মা তো সব সময় এই নিয়ে বকবক করে শুধু বাবাই একটু মেয়েকে বোঝে আর সাপোর্ট করে
তাই নিয়েও বাবার সঙ্গে মায়ের গন্ডগোল বেঁধে যায়।
মা রেগে বলে মেয়ের বয়স হচ্ছে ! বিয়ে থাওয়া দিতে হবে গাছের সঙ্গে তো আর বিয়ে দেওয়া যাবেনা !! বাবাই বলেন মায়ের আমার হাতে জাদু আছে এমন সুন্দর ফুল সবাই তো ফোটাতে পারে না আর এমন কি বয়স হয়েছে যে এখন থেকেই বিয়ের চিন্তা করতে হবে !
মা গজগজ করতে করতে চলে যান

তো সেই মেয়ে এখন ফুলমেলায় লাল ডালিয়া দেখে লাল ডালিয়া ফোটাতে মরিয়া বছর শীতে টব বাগান ভর্তি করে শুধু ডালিয়া আর ডালিয়া লাগিয়েছে রোজ সকাল বিকাল জল দেয় পরিচর্যা করে আর গাছের কানে কানে বলে একটা অন্তত লাল ডালিয়া ফুটিস
দেখতে দেখতে তিতলির , হ্যাঁ মেয়েটার নামটাই তো বলা হয় নি ওর নাম তিতলি , বাগান আর টবের সব গাছে কুঁড়ি আসতে শুরু করে তিতলির আনন্দ দেখে কে !! এতগুলো গাছের মধ্যে একটা না একটা তো লাল হবেই ! কিন্তু দুর্ভাগ্য যখন কুঁড়িগুলো ফুটতে শুরু করে দেখা যায় কোনটাই ঠিক লাল নয় হয় বাই কালার নয়তো অন্য রঙ

মেয়ে কদিন ধরেই মনমরা তাই দেখে বাবা জিজ্ঞেস করেন -- তোর কি হয়েছে মা ? কদিন থেকেই মনমরা দেখছি
দেখ না আমি এতগুলো ডালিয়া লাগালাম কিন্তু একটাও লাল হল না সব অন্য রঙ
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বলেন তাতে কি হয়েছে মা , কি সুন্দর বাগান আলো হয়ে আছে তোর ফুলে
না আমার লাল ডালিয়াই চাই বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফোলায় তিতলি
বিকেল বেলা বাবাকে বাগান ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে যায় তিতলি বাগান জুড়ে অজস্র রঙিন ডালিয়া মুগ্ধ হয়ে যান তিতলির বাবা কতো রঙ !
দেখতে দেখতে দেখেন একেবারে বাগানের কোণের দিকে একটা গাছ তখনও ফুল ফোটে নি কুঁড়ি থেকে অল্প যেন রঙের আভাস পাওয়া যাচ্ছে ! লাল রঙ তিনি তাড়াতাড়ি মেয়েকে দেখান তিতলি তো লাফিয়ে ওঠে !! শুরু হয় প্রতীক্ষা যত দিন যায় লাল রঙের প্রকাশ তত বাড়তে থাকে
তারপর একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রোজের মত বাগানে ঘুরতে এসে তিতলি দেখে সেই কোণের ডালিয়াটা সম্পূর্ণ পাপড়ি মেলেছে টুকটুকে লাল রঙ আনন্দে বোবা হয়ে যায় তিতলি। আস্তে আস্তে দুহাত দিয়ে স্পর্শ করে তার চির আকাঙ্খিত লাল ডালিয়া রানীকে
প্রথম স্পর্শ !! ফুলেল স্পর্শ !! আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে ফুলের বুকে একটা গভীর চুমু এঁকে দেয়

কি প্রেমালাপ শেষ হল -- হঠাৎ কথার শব্দে পিছন ফিরে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে হাসছে বাবা হেসে বলে তোর মার তো তোর বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তা ! তা ভাবছি গাছের সঙ্গেই তোর বিয়েটা দিয়ে দেব হোহো করে হেসে ওঠে বাবা , সঙ্গে তিতলিও !

 

 

অশ্রুমোচন
নির্মল কুমার সরকার

 

#

অর্পিতা জানালা দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা কাঁচ বেয়ে নীরব অশ্রুধারা হয়ে বেয়ে চলেছে। জানালার ওপাশের সেই অশ্রু কণা মুছে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। নিজের অজান্তেই জানালার এপারে হাত বুলিয়ে যেন নিজেই নিজের অশ্রুমোচনের বৃথা চেষ্টায় ব্যস্ত সে। ঈশ্বর যেন মানুষের দুটো চোখ দিয়েছে শুধু মাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্য্য পরিমাপের জন্য। গহীন হৃদয়ের ভালোবাসা পরিমাপের যন্ত্র স্বয়ং ঈশ্বরও মানব দেহে প্রতিস্থাপন করতে অপারগ। সেই স্কুল জীবন থেকেই অর্নবকে পছন্দ করে সে। অর্নবদের বাড়িতে ওরা ভাড়া থাকে। ওরা বলতে অর্পিতা এবং তার বাবা মা। অর্পিতা এবং অর্নবের বাবা ছোটবেলার বন্ধু। গ্রামে একই স্কুলে পড়াশোনা। পরবর্তী কালে অর্নবের বাবা সরকারী চাকরী পেয়ে শহরে চলে আসে। অর্পিতার বাবার গ্ৰামেই ছোটখাটো কাজ করে দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সেটা তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কে কখনো ফাটল ধরায়নি। সরকারী অফিসার হওয়ার সুবাদে অর্নবের বাবা একটা প্রাইভেট ফার্মে অর্পিতার বাবার চাকরির বন্দোবস্ত করে দেয়। এরপর নিজের বাড়িতে থাকার আয়োজনও করে। বাড়ির ভাড়া নেওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু অর্পিতার বাবা বন্ধুকে আর বেশি ঋণী করতে চান না বলেই অনেকটা জোড় করেই বাড়ি ভাড়া নিতে বাধ্য করেন। এসব কারণেই নিজের অজান্তেই ভালোলাগা থেকে অর্পিতার মনে অর্নবের প্রতি ভালোবাসার জন্ম নেয়। অর্পিতা পড়াশোনায় খুব ভালো। অর্নবের হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে তার স্কুলের প্রজেক্টও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করে দিত। অনেকবার অর্নব অর্পিতাকে বলেছে-
-
তোকে ছাড়া তো আমি পুরোপুরি অন্ধ। আমার পাশে সারাজীবন এভাবে থাকবি তো?
অর্পিতা তার হাত স্পর্শ করে বলতে চেয়েছে আমি ছাড়া আর কেই বা তোকে আগলে রাখবে। কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে গেছে। স্কুল জীবন কাটিয়ে দুজনে ভিন্ন পথে নিজেদের পড়াশোনার রাস্তা বেছে নেয়। প্রথম প্রথম ভেবেছিল অর্নব হয়তো তাকে ভালোবাসে। কিন্তু কলেজে পাশ করার সাথে সাথে অর্পিতার সেই ভুল ভাঙল। সেই কলেজ জীবনেই অর্নব প্রেমে পরে চৈতালির। অর্নব কোনদিন সেকথা বুঝতে দেয় নি অর্পিতাকে। অর্নবের সাথে চৈতালির একবার ভুল বোঝাবুঝি হলে অর্নব সেই অর্পিতার আশ্রয় নেয় চৈতালির ভুল দূর করার জন্য। চৈতালির সাথে কথা বলে অর্পিতা বুঝতে পারে ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত তাকে নিয়ে। অর্নবের সাথে অর্পিতার শুধুমাত্র বন্ধুত্ব ছাড়া যে আর কোন সম্পর্ক নেই চৈতালিকে সেটা বলতে হয় অর্পিতার। কথাটা বলে অর্পিতা ফোনটা অর্নবের হাতে দিয়ে নিজেকে কোনভাবে সামলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পায় চৈতালিকে অর্নব বলছে, ' অর্পিতাকে দেখেছো? কোথায় তুমি আর কোথায় অর্পিতা?' সেদিন অর্পিতা প্রথমবার চৈতালির কথা জেনেছে আর প্রথমবার আয়নায় নিজের কাজল কালো চেহারায় চোখের কাজল মলিন হতে দেখেছে। অর্নবের মা অর্পিতাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসে। অর্নবের বিয়ের কথা তিনি অর্পিতাকে কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে। তাই তো সে বিষণ্ণ মেঘমালার অশ্রুধারায় নিজের আশ্রয় আজ খুঁজে নিয়েছে

অর্নবের বিয়ে উপলক্ষে পুরো বাড়িতে সাজসাজ রব। বিয়ের বাজার করা থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর সব দায়িত্ব অর্নবের মা অর্পিতাকেই অর্পণ করেছে। অর্নব কাল যাচ্ছে বন্ধুদের সাথে শেষ ব্যাচেলর পার্টির জন্য তাজপুর। অর্নবের বাবা মাকে বোঝানোর জন্য অর্পিতাকেই কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এক সপ্তাহ বাদে বিয়ে। এই সময় বাড়ি থেকে দূরে যাওয়া কারোরই পছন্দ ছিল না। কিন্তু অর্নব এমনভাবে অর্পিতাকে অনুরোধ করলো বাবা মাকে বোঝানোর জন্য যে সে আর না করতে পারেনি। সেই ছোটবেলা থেকেই তো অর্নবের সব আবদার সে পালন করে আসছে। কিন্তু তার এই আবদারের ফল যে এমন হবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহের এক বৃষ্টির দিনে অর্নব আর তার জনা পাঁচেক বন্ধু মিলে কলকাতা থেকে তাজপুরের পথে বেরিয়ে পড়ে। ঘন্টাদুয়েক পরে অর্নবের বাবার কাছে একটা ফোন আসে যে অর্নব হাসপাতালে ভর্তি। হাইরোডে অনির্বানদের গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গেছে। বাকিরা আহত হলেও অর্নবের মাথায় চোট লাগার কারনে অবস্থা সংকটজনক। কথাটা শোনামাত্র পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। অর্নব আর অর্পিতার বাবা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে যায়। কিছুদিন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থান করে অর্নব জীবন ফিরে পায় কিন্তু সারাজীবনের জন্য দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলে। অর্নবের বিয়ের দিনটাতে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। চৈতালি অর্নবকে দুই একবার দেখতে এলেও দৃষ্টিশক্তিহীন অর্নবকে বিয়ে করতে আর রাজি হয়নি।
আজও বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। অর্নব জানালার ধারে একা একা বসে আছে। তার দু'চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আজ সবকিছুই তার চোখে কালো অন্ধকার। এমন সময় অর্পিতা ঘরে ঢোকে। অর্নবের চোখের অশ্রবিন্দুতে আজ নিজের অধিকার চাক্ষুষ করে। হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দেয়। অর্নব অর্পিতাকে বলে - তোকে ছাড়া আজ আমি সত্যি অন্ধ। আমার পাশে সারাজীবন এভাবে থাকবি তো?
এতদিন অনধিকার চর্চা ভেবে যাকে স্পর্শ করেনি আজ প্রথমবার তার হাতটি স্পর্শ করে নিজের বুকে নিয়ে বলে- 'আমি ছাড়া আর কেই বা তোকে আগলে রাখবে।
'

 

 

আবিষ্কার
আশিস দত্ত


শিলি তার ্যর কে খুব পছন্দ করেস্কুলে নয় বাড়ীতে তিনি সপ্তাহে তিন দিন অংক দেখাতে আসেনশিলির দুই দিদি তার আগে অংক শিখত,এখন তারা কলেজে পড়েকেউ অংকে তেমন ভালো নয় বলে আর্টস পড়ছেশিলি কিন্তু সায়েন্স পড়বেই পড়বেঅংক তার প্রিয় বিষয় কিন্তু ্যর আরো বেশি প্রিয়
্যর তার থেকে বেশ বড়োপ্রথম যখন তাদের বাড়ীতে বুলিদিকে অংক কষাতে এলেন সে তখন সবে ক্লাস ফাইভতুলিদি সেভেনেদুবছর পর তুলিদি আর সে ্যরের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করল তুলিদির আড়ালে বসে সে ্যর কেই দেখে যেতবাবা কাকাদের বাইরে ্যর একমাত্র লোক যাকে তার ভালো লাগেএখন তার ক্লাস নাইন সে একা ্যারের সামনে বসেঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে মা না হয় তুলিদি চা দিয়ে যায় বাকি সময় শুধু সে আর ্যরঅংকের অনুশীলনের ফাঁকে দু চারটে ঘরোয়া কথা আগেও হতকখনো ্যারের পরিবার,গাছ পালা,সিনেমা নানা বিষয়েএলোমেলো প্রশ্নোত্তর দু পাঁচ মিনিটের বেশী স্থায়ী হতনাএখন সেটা একটু বেশী সময় ধরে চলেসেদিন যেমন অন লাইনে বুলিদির কেনা সুগন্ধী মেখে পড়তে বসেছিল সে্যর নিশ্চই গন্ধ পেয়েছিলেনতবু তুলিদি চা দিয়ে চলে যাবার পর শিলি বলল--্যর গন্ধটা কেমন!ভালো না!
্যাঁ,খুব ভালো -বলে চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিলেন তিনি
না না ঠিক করে গন্ধ নিয়ে বলুন-বলে টেবিল ঘুরে কিশোরীর উন্নত সম্পদ দুটি নিয়ে ্যারের একেবারে ঠোঁটের সামনে হাজিরচায়ের কাপ সামলে ্যর তার ছেলেমানুষী কে প্রশ্রয় দিয়ে বললেন --সুগন্ধী অবশ্যই ভালো কিন্তু তুমি আরো ভালোসে আনন্দে দুলে উঠলকথাটা হয়ত নেহাত প্রশ্রয় দিয়ে বলা, সেটাকে সত্যি ধরে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু হল
এর পরের পর্বে যেটা করল সেটা সে আগে থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলসিনেমা পত্রিকা গুলোয় অভিনেতা অভিনেত্রী দের ঘনিষ্ঠ ছবি,দূরদর্শনের পর্দায় সিনেমার দৃশ্য গুলো তাকে জীবন সম্পর্কে,শরীর কে জানবার এক অদম্য আকাঙ্খা দিয়েছিলরক্ষণশীল এই পরিবারে নিকট আত্মীয় ছাড়াঅপরিচিত অনাত্মীয় ছেলেদের ভিতর বাড়ীতে প্রবেশ নিষেধ মেয়েরাও যত্রতত্র যখন তখন যেতে পারেনাসঙ্গে অভিভাবকরা কেউ না কেউ থাকেন সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে নায়িকার অভিব্যাক্তি উদ্বেলতার দৃশ্য দেখে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সে উন্মুখ হয়ে উঠেছিল হাফ ইয়ারলিতে অংকে একশোয় একশো পাওয়ার পরদিন ্যার পড়াতে এলেনখুব আনন্দের সাথে লাফাতে লাফাতে ্যার কে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেল্যার এটাও ছেলে মানুষী ভেবে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু প্রথম কোন পুরুষ স্পর্শে তার তখন নেশা ধরে গেছেহিসহিসে গলায় বলল--্যর এত ভালো রেজাল্ট করলাম পুরষ্কার দিলেন না
তিনি বললেন --ঠিক ঠিকপুরষ্কার দেওয়া অবশ্যই উচিত কি চাও বল?
সে নিজের ঠোঁট দুটো একেবারে তাঁর মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে একই গলায় বলল-এখানে একটা চুমা
্যারের ইতস্তত ভাব উপেক্ষা করে নিজের ঠোঁটটা তার ঠোঁটের ওপর চেপে ধরল,যেমনটা সিনেমায় অনেক অনেক বার দেখা শরীরে মধ্যে একটা অদ্ভূত শিরশিরানি বয়ে গেলকি আনন্দ কিসের আনন্দ তা জানা নেই,অথচ ভালো লাগছে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ্যারের পুরুষত্ব বোধহয় কিছুক্ষনের জন্য জেগে উঠলতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে জামার তলা দিয়ে কিশোরীরর অশান্ত পেলব বুকে নিজের হাতকে খেলাতে থাকলেনপর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন--অনেক আদর খেয়েছএবার অংক কর
তার তখনও আশ মেটে নি--আর একটুক্ষণ,আদরে গলে যেতে যেতে আবদার ্যার নিজেকে মুক্ত করে ঠোঁটে আর একবার ঠোঁট ঠেকিয়ে বললেন --বেশী আদর খাওয়া ভালো নয়

মাধ্যমিকে দারুন ফল করার সুবাদে আরো বেশী আদর আদায় করতে অসুবিধা হয়নি্যরেরও তাকে পাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল এরপর জীবন অনেক চেনা অচেনা বন্দর হয়ে সতত বহমানসেই কিশোর বয়সের আবেগ তাকে এখন আর তাড়িয়ে বেড়ায় না তবু অন্তর্লিন স্রোতস্বীনির মত সেই অজানা আনন্দ সুখানুভব স্পর্শ আজো অনুভূত হয় প্রতিটি রক্তকনায়নিজের দেহে তারুন্য কে আবিষ্কারের তাগিদে যা করেছিল সেটা এক কিশোরীর নিজেকে বিকিয়ে নিস্ব হবার আনন্দ,অচেনা পুরুষ স্পর্শের সেই সুখানুভূতি সে আজ মনের মনিকোঠায় সযত্নে ধরে রেখেছে

 

 

 

 

স্পর্শ

পারমিতা দে রায়

 

দীপায়ন বসে বসে ্যাপটপে কাজ করছিল, এমন সময় শর্মিষ্ঠা ঘরে এল। দীপায়নকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে দেখে ফিরে যাচ্ছিল। দীপায়ন পিছু ডাকল...

-- কি হল শর্মি চলে যাচ্ছ কেন, কিছু বলবে ?

-- ্যাঁ বলব বলেই তো এসেছিলাম, দেখো মিষ্টিকে কি সুন্দর সাজিয়েছি, কি সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে

--হুমম্ খুব সুন্দর লাগছে। তুমি একটু মিষ্টির সাথে খেলা কর, আমি একটু কাজ করেনিই ?

-- ঠিক আছে তুমি কাজ কর। আমি যাই, মিষ্টির খাওয়ার সময় হল

◆◆◆◆◆◆

পাঁচ বছর হল বিয়ে হয়েছে বিয়ে হয়েছে দীপায়ন আর শর্মিষ্ঠার। ওদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীর দিন শর্মিষ্ঠা জানায় সন্তানসম্ভবা। শর্মির খুব ইচ্ছা ওদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে। শর্মি আর দীপায়ন ওদের অনাগত সন্তানের জন্য কত কিছু পরিকল্পনা করে রাখে। ওদের সন্তান আসতে আসতে শীত পরে যাবে, তাই শর্মি নিজে হাতে, ছোট ছোট সোয়েটার, মোজা, টুপি, বোনে। কত খেলনা কিনে রাখে, ওদের আনন্দের কোন সীমা থাকেনা। কিন্তু ওদের আনন্দ যে এই ভাবে নিরানন্দে পরিণত হবে, সেটা কি ওরা আগে থেকে ভাবতে পেরেছিল।

সেদিন শর্মি বই পড়ছিল। বাইরে ডোরবেলের আওয়াজ পেয়ে, দরজা খুলতে যায়। মেঝেতে সম্ভবত জল পড়েছিল, শর্মি খেয়াল করেনি। তাড়াতাড়ি করে যেতে গিয়ে শর্মি পা পিছলে পড়ে যায়।

দীপায়ন বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর যখন শর্মি দরজা খুলতে এলনা, তখন দীপ ভাবল শর্মি হয়ত বাড়িতে নেই। কিন্তু শর্মি তো না বলে কোথাও যায় না। ওদের একটা ডুপ্লিকেট চাবি বাইরে এক জায়গায় লুকানো থাকে। সেখান থেকে চাবিটা বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে দীপ। ভেতরে ঢুকে দেখে শর্মি মেঝেতে পরে গোঙাচ্ছে, আর চারিদিকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। দীপ আর দেরী না করে শর্মিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

শর্মি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও ওদের বাচ্চাটাকে আর বাচানো যায়নি। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতে শর্মি আর মা হতে পারবে না। একেই অনাগত সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, তার উপর নতুন করে সন্তান ধারণের অক্ষমতা, শর্মির মনের ওপর ্রচন্ড চাপ পড়ে। এতটা মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারেনি। প্রথম প্রথম ওকে খুব স্বাভাবিক দেখাত, দীপকে সান্ত্বনা দিত, কিন্তু আস্তে আস্তে শর্মি কিরকম একটা হয়ে যেতে থাকল। এমনিতে দেখলে ওকে মনে হয় খুব স্বাভাবিক, কিন্তু সারাদিন একটা পুতুলকে নিয়ে কি যে ওর পাগলামি! পুতুলটাকে সাজাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে, স্নান করাচ্ছে, ওই পুতুলটাকে নিয়েই নিজের জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। পুতুলটার মধ্যেই নিজের অনাগত সন্তানকে খুঁজে পেয়েছে

তবে দীপ একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, পুতুলটা নিয়ে শর্মির পাগলামি দিন দিন বাড়ছে। দীপ ছাড়া অন্য কাওকে পুতুলটা ধরতে দেয়না। অন্য কেউ পুতুলটা ধরতে গেলে কেমন একটা করে ওঠে। এক বন্ধুর পরামর্শে দীপ মনোবিদের সাথে কথা বলেছে। উনি বলেছেন একটা বাচ্চা নিজের কাছে পেলে শর্মি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।

◆◆◆◆◆◆◆◆◆

দীপ অফিস থেকে ফিরছিল। রাস্তায় এক জায়গায় ভিড় দেখে গাড়ি দাঁড় করাল, লোকজনের কথা শুনে বুঝল কেউ একটা বাচ্চা মেয়েকে ফেলে দিয়ে গেছে। দীপ গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়, দেখে পুলিশ এসেছে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাবার জন্য। দীপ অফিসারের সাথে কথা বলে জানতে পারে, ওনারা বাচ্চাটাকে অনাথ আশ্রমে পাঠাবে।

--অফিসার আমি যদি বাচ্চাটাকে দত্তক নিই

-- দেখুন এভাবে হয়না, কিছু ফর্মালিটি আছে

-- সব ফর্মালিটি পূরণ করব, আপাদত বাচ্চাটাকে আমার সাথে নিয়ে যাই। আমার স্ত্রী মানসিক ভাবে অসুস্থ, বাচ্চাটা পেলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে

-- মানসিক ভাবে অসুস্থ কেউ তো, বাচ্চা দত্তক নিতে পারেননা। এতে বাচ্চার জীবনের ঝুঁকি থেকে যায়

-- সেই জন্যেই তো আমরা দত্তক নিতে পারছিনা। প্লীজ্ অফিসার মানবিকতার খাতিরে বাচ্চাটা আমাকে দিন, এই বাচ্চাটা তো এখনো আপনাদের খাতায় রেজিস্ট্রার হয়নি। আমার স্ত্রী সুস্থ হলে আমরা আইনত দত্তক নেব

-- ঠিক আছে নিয়ে যান। আপনার ফোন নম্বর আর ঠিকানা দিয়ে যান, আমাদের নজর আপনার উপর থাকবে

-- ধন্যবাদ অফিসার। আপনি আমার অনেক বড় উপকার করলেন

◆◆◆◆◆◆◆◆

দীপ বাড়ি ফিরে আজ আর ডোরবেল বাজায় না। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে, ঘরে গিয়ে দেখে শর্মি অঘোরে ঘুমাচ্ছে। পুতুলটা ওর কোলের কাছে শোয়ানো, ঠিক যেন একটা বাচ্চা শোয়ানো আছে। দীপ আস্তে করে পুতুলটা সরিয়ে, বাচ্চাটাকে শর্মির কোলের কাছে শুইয়ে দেয়। বাচ্চাটার স্পর্শ পেয়ে শর্মির ঘুম ভেঙে যায়। বাচ্চাটার ছোয়াতে যেন ্যাজিক ছিল, শর্মির কথাগুলো অনেক স্বাভাবিক লাগে। শর্মি বলে........ কে দীপ?

-- আমাদের মিষ্টি

-- তুমি মিষ্টিকে কোথায় পেলে?

-- যে আমাদের কাছ থেকে মিষ্টিকে কেড়ে নিয়েছিল, সেই আবার ফিরিয়ে দিয়েছে

মিষ্টিকে পেয়ে শর্মি আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। শর্মি পুরোপুরি সুস্থ হলে ওরা বাচ্চাটাকে আইনত দত্তক নেয়।

সন্তানের প্রথম স্পর্শ একটা মানুষকে মানসিক রোগী থেকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে এল

 

 

 

 

অগ্নিস্ফুলিঙ্গ

অমৃতা ব্যানার্জী

 

 

পুষ্প দ্বারা সুসজ্জিত শয্যার উপর লাল রঙের বেনারসী শাড়ী ভারী আভূষণ পরিহিতা নববধূ সরলা বসে আছে। ফুলশয্যার এই রাতে মেয়েরা সাধারণত স্বামীর অপেক্ষায় প্রহর গোণে, তাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। কিন্তু সরলার সঙ্গে এইরকম কিছুই ঘটছে না। সে জানে তার ভবিতব্য।

অভিজাত বংশের কন্যা সরলা, তিন ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ। বাবা আজীবন সমাজের সমক্ষে প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত। অন্দরের সঙ্গে ওনার যোগাযোগ বলতে কিছু রাতে মা কে ভোগ করা। মাও সারাজীবন আকণ্ঠ ঘোমটা টেনে স্বামীর পদসেবা করে এসেছেন। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। দাদা দেশের জন্য বহুকাল আগে গৃহত্যাগী। সরলা খানিক লেখাপড়া শিখেছে। তারও শখ ছিল দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সে সুযোগ হল আর কোথায়। পিরালী ব্রাহ্মণ উপরন্তু বড় দাদা স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ায় সুপাত্র পেতে অসুবিধা হয়েছিল। অবশেষে এক দয়াবান, সমাজের নজরে সুপাত্র পাওয়ায় সপ্তদশী সরলার গাঁটছড়া বাঁধা হয় বিবাহের খবর জানার পর থেকে সরলা পাথর হয়ে গেছে। শেষে বাবা কিনা উপাধি পাওয়ার লালসায় ব্রিটিশের পাদুকা লেহনকারী এক ভারতীয় অফিসার কে নিজের জামাতা নির্বাচন করেছেন!

নারী দেশ কে এক নজরে দেখে সরলা, উভয়ে পরাধীন। সরলার জীবনও আর পাঁচটা মেয়ের মত হেঁশেল সামলে আর বছর বছর আঁতুড় ঘরে গিয়ে কেটে যাবে। আচ্ছা যেসব নারীরা মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা নিশ্চয়ই অতিমানবী। সরলা কেন পারল না তাদের মত সংসারের গতানুগতিক বন্ধন ছিন্ন করতে?

এরপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। ব্রিটিশের তোষামোদি করে সরলার স্বামীর পদোন্নতি হয়েছে। অবশ্য সরলার নিজের ষড়যন্ত্রে তাকে এখনও পর্যন্ত আঁতুড় ঘরের চৌকাঠ পেরোতে হয়নি। পাশের বাড়ীর ধাই মা এর কাছ থেকে পাওয়া কিছু জরিবুটির প্রভাব। সরলা চায় না একজন মেরুদন্ডহীন, ক্লীবের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে যে কিনা নিজের মা কে শত্রুর কাছে বিক্রি করে দেয়। শাশুড়ী যখন বাঁজা বলে কথা শোনায় তখন সরলার বলতে ইচ্ছা করে ওনার মত ক্লীব সন্তান প্রসব করার থেকে বন্ধ্যা হওয়া সৌভাগ্য। ধাই মা একদিন বলেছিলেন " ওরে মেয়ে, তোর মা হতে ইচ্ছা করে না?" সরলা তখন বলেছিল "মেয়ে হয়ে আগে মায়ের জন্য লড়ে দায়িত্ব পালন করি। তারপর মাতৃত্বের ভার নেব।" জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যা কাণ্ডের কথা জানে সরলা। ভাবে যদি ওই উদ্যানে থেকে প্রাণাহুতি দিতে পারত তাহলে জীবন সার্থক হত

সরলার স্বামী বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য বলে " নিমকহারাম, যার খাস যার পরিস তার দিকেই বন্দুক তুলিস।" সরলার তখন বলতে ইচ্ছা করে " ওরা অকৃতজ্ঞ নয়। তুমি কুপুত্র।"

দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন লেলিহান রূপ ধারণ করছে। দেশবরেণ্য নেতারা মৃত্যুবরণ কারাবরণ কে জীবনের মূলমন্ত্র করেছেন। ছাত্র সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই যজ্ঞে। সরলা তখন হেঁশেলের আগুনে নিজেকে অল্প করে করে রোজ দাহ করছে। ওই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা যে সাহস দেখাতে পারছে, সরলা তার এক কণাও পারেনি

একদিন সরলার স্বামী মধ্যরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ী ফেরে। সে এক ব্রিটিশ পদাধিকারীর বাড়ীতে গিয়েছিল, সেখানে মজলিস, খানাপিনার আয়োজন ছিল। অতিরিক্ত নেশার ঘোরে সরলার স্বামী কয়েকটি কথা বলে যা শুনে সরলার শরীর দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। সরলার শ্বশুর বাড়ীর নিকটবর্তী এক স্থানে কয়েকজন বিপ্লবী যুবক আত্মগোপন করেছে। পরেরদিন সরলার স্বামী অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমণ চালাবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় সরলা কে মদ্যপ, কামাতুর স্বামী নিজের দিকে টানতে থাকে। এমতাবস্থায় সরলার হাত পড়ে স্বামীর কোমরে বাঁধা পিস্তলের উপর। অস্ত্রের প্রথম স্পর্শে সরলার শরীর, মনে অদ্ভূত উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সে ভাবে দেশমাতৃকা সরলার জীবনের মুক্তি পথের সরঞ্জাম তার হাতে তুলে দিয়েছে।

অস্ত্রের প্রথম প্রয়োগ সরলা তার স্বামীর উপর করে। তারপর সবাই জানার আগে অন্ধকারে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যায়। আজ সরলা মুক্ত। হয় সে মারবে নয় মরবে। সন্তানধর্ম পালন করবে সরলা



সেদিন ছিলো বৃষ্টিভেজা

মুসকান ডালিয়া

 

----

তখন আমার নবম শ্রেণি। অগাস্টের মাঝামাঝি। সারাদিন অবিরাম বৃষ্টির পর বিকাল বেলা আকাশ হল মেঘমুক্ত। যাবোনা ভেবেও অনেকটা দ্বিধা নিয়েই টিউশন পড়তে চলে গেলাম পলাশ স্যারের বাংলা, ইংরেজি ব্যাচে। স্যার শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের " নববর্ষা".."হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচেরে, হৃদয় নাচেরে।"

আমরা তো অভিভূত। বাঃ দারুন সিচুয়েশনে দারুন কবিতা। যাইহোক বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ আগেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। তখন এতো দোকানপাট, এতো আলো কোথায়? বৃষ্টি হলেই কারেন্ট অফ। হায়রে, বাড়ি ফিরবো কিভাবে? ছাতা এনেছি যদিও, কিন্তু এই এলোমেলো হাওয়ার দাপটে ছাতার অস্তিত্ব যে বিপন্ন। তবুও কোনক্রমে মাথা বাঁচিয়ে চললাম বাড়ির পথে। সাথে প্রিয় বান্ধবী ঝুমা। তখন রাত আটটা বেজেছে। দুর থেকেই দেখতে পেলাম বুড়ো অশত্থ তলার কাছাকাছি বাইশ বছরের সে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাইকেল নিয়ে। এই তুমুল বৃষ্টিতেও আমাকে একঝলক দেখার জন্য অপেক্ষায়। রোজই দেখি। তাকে দেখামাত্রই আমার বুকের ভিতর লাবডুব শব্দ। ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছি। চারপাশ বৃষ্টির জন্য শুনশান। আর ঝুমাটা করলো কি, একাকি আমায় ছেড়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটা বন্ধ দোকানের সামনে। সেখানে আরও কয়েক জন আশ্রয় নিয়েছে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। বাকি সবটুকু ফাঁকা। ঝুম বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়ার দাপট, আর থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি ছাড়া সব কিছু শুনশান। বাড়ি মাত্র দশ মিনিটের পথ। আমিও যতটা পারি এগুতে গিয়ে শুনতে পেলাম তার ভরাট কণ্ঠস্বর।

-- দাঁড়াও। কথা আছে

আমার পা আর সরে না। কোনক্রমে ছাতাটা আগলে রেখেছি মাথায়। সে আচমকা সাইকেল হাতে ধরে ঢুকে এলো আমার ছাতার তলায়। তার বৃষ্টিভেজা হাতে ছুঁয়ে গেলো আমার হাত। শরীরের মধ্যে কি বাদ্যযন্ত্র থাকে? হয়তোবা। নাহলে কিভাবে একসাথে বেজে উঠলো এত সুরের ঝংকার? আমি তখন আর নিজের মধ্যেই নেই। জীবনের প্রথম স্পর্শ বিহ্বল করে দিল আমায়। সে এক অবর্ননীয় অনুভূতি। কি যে সে বলছিল- কিছুই কানে গেলোনা আমার। আমি চুপ করেই রইলাম। সে হয়তো বুঝলো কিছু ঢুকছে না আমার মাথায়। তাই বাধ্য হয়েই আমার মুখটা তুলে ধরলো তার দু'হাতের পাতায়। আমি তাকালাম। বৃষ্টির ফোঁটা চুঁয়ে পড়ছে তার সারা শরীর বেয়ে। তার চুল বেয়ে জল ঝরে পড়লো আমার মুখের উপর। শুধু কানে এলো -- তোমাকে খুব ভালবাসি। আমি জানিনা কিভাবে এক ঝটকায় তৎক্ষনাৎ তাকে ঠেলে দিয়ে ছাতা রেখেই প্রায় দৌড়ে এলাম বন্ধুর কাছে। সে আরও কিছু বলছিল। কানে না নিয়ে আরও দ্রুত পা চালালাম। ভিজে চুপ্পুস হয়ে বাড়ি ঢোকার আগে তাকিয়ে দেখলাম সে তখনো দেখছে আমায়। তারপর এগিয়ে গেল নিজের পথে। সেরাতে ঘুম এলো না সারারাত। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল বাইরে আর আমার মনের ভিতরেও। অদ্ভুত এক ভাললাগার অনুভূতি ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমার কিশোরী জগত। এক লহমায় মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীটা সত্যি কত রঙিন, কত সুন্দর, বর্নময়। বারবার অজানা কোন শিহরণ জাগিয়ে তুলছিল আমায়

এরপর তার অগুনিত স্পর্শ আমার সর্বত্র জুড়ে আমি আজ তার স্ত্রী, তার দুই সন্তানের মা। কিন্তু সেই প্রথম বার বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যার জীবনে প্রথম পুরুষের স্পর্শ আজও অমলিন। আজও যখন ঝুম বৃষ্টি নামে সন্ধ্যার আকাশ বেয়ে। ব্যালকনিতে বসে দুজনে লম্বা একটা কফিমগে চুমুক দিয়ে রোমন্থন করি সেদিনের। অনুভব করি সেই প্রথম স্পর্শ



 

 

খুঁত

স্বরবী দাস

 

 

রৌরকেল্লা পার হবার পর থেকেই হাওড়া কোরাপুট সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস এর গতি মন্তর হয়ে এল। মিতালীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া ঘুম এবার পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল। নীচের বার্থে সে শুয়েছিল। কোনোরকমে উঠে ওপরে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখলো মিডিল বার্থে সন্দীপও জেগেই আছে। মিতালীকে দেখে সন্দীপ হেসে বলল,'ট্রেনটা ঝোলাবে মনে হচ্ছে। এক কাপ চা খেলে হয় না?'

মিতালী ব্যাজার মুখে সম্মতি দিল। সন্দীপ নেমে এল। বালিশ বিছানা গুছিয়ে মিতালীকে ভাল ভাবে বসার জায়গা করে দিল। মিতালী উসখুশ করছে দেখে সন্দীপ বললো

--'কি হল? বাথরুমে যাবে?'

---'হ্যাঁ একটু ফ্রেশ হতে পারলে ভালো হত....'

---'চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি..'

মিতালী কটমট করে তাকিয়ে বললো, 'আমি একাই পারবো।'

---'বেশ তাই যাও।'

সন্দীপ বোঝে মিতালীর চোখের ভাষা আসলে মিতালী ওর শরীরের ওই খুঁতটুকুর জন্যে হীনমন্যতায় ভোগে। ছোট ছোট কাজে সন্দীপের সাহায্য নিতে ওর সন্মানে লাগে খুব। যদিও সন্দীপ সাহায্য করার জন্যে এখন মিতালীকে ওয়াশরুম পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চায়নি। মিতালীর বদলে অন্য কেউ যদি ওর বউ হত সেক্ষেত্রেও নতুন বউকে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে একা ছেড়ে দিত না। কিন্তু মিতালীকে সে কথা বোঝানো সম্ভব না। যদি বোঝার হত তবে ফুলশয্যার রাতেই সে বুঝতো। সরাসরি প্রশ্ন করেছিল মিতালী,' আপনি তো সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ তবে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?'

---'তুমি তো অসুস্থ নও..'

---'বড়রকমের খুঁত আছে আমার শরীরে। জেনেশুনে এভাবে খুঁতওলা মেয়েকে..'

---' খুঁত কার নেই বলোতো? কারো শরীরে খুঁত তো কারো মনে খুঁত। জগতে নিখুঁত তো কিছুই হয় না। আমার মনে হয়নি তোমার ওই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমাদের সাংসারিক জীবনে বা দাম্পত্য জীবনে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া মিতালী তুমি তো শুধু শরীর নও, তুমি একটা মনও। সব মিলিয়ে তোমাকে আমার ভালো লেগেছে...খুব ভালো লেগেছে..'

সেই মধুরাতে মিতালী আর কিছু বলেনি। ওর চোখে সামান্য অশ্রু টলটল করছিল সে অশ্রু চুম্বনে মুছিয়ে দিয়েছিল সন্দীপ। সন্দীপ ভেবেছিল মিতালীর মনে আর কোনো সংশয় রইলো না কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মিতালীর অস্বস্তি ওদের মধ্যে দূরত্ব তৈরী করে রেখেছে। বিশেষ করে এবারে নিজের বাপের বাড়ি গিয়ে মিতালী অদ্ভুতরকমের আপসেট হয়ে ছিল। সন্দীপ অনেকটাই আন্দাজ করতে পারছে। যে প্রশ্ন ফুলশয্যার রাতে মিতালী সন্দীপকে করেছিল তা ওর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের মনেও আছে। একটি সুস্থ সবল রোজগেরে ছেলে কি করে মিতালীর মতো মেয়েকে দেখেশুনে বিয়ে করতে পারে! করলেও নিশ্চিত এর পেছনে কোনো বড়রকমের স্বার্থ লুকিয়ে আছে অথবা গোপন কোনো অভিসন্ধি। নিজেদের কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্যে তারা মিতালীকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এমন কথা বলে ফেলে যে মিতালী অপমানিত বোধ করে। সন্দীপ মনে মনে বিরক্ত হয়। একটা সহজ ব্যাপারকে মানুষ সহজ ভাবে হজম করতে পারছে না দেখে অবাক হয়। অথচ প্রথমদিন মিতালীকে দেখে সন্দীপের মনে হয়েছিল তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে ছাপিয়ে যায় তার ব্যক্তিত্ব একটা কাঁচা হলুদ রঙের শালোয়ার কামিজ পরে মিতালী এসেছিল তার স্যার কে শিক্ষক দিবসের উপহার দিতে

মিতালীর স্যার অর্থাৎ সন্দীপের কাকা। সন্দীপ চাকরী সূত্রে কোরাপুটে থাকে। বাবা মা গত হয়েছেন বছর দুয়েক হল। কলকাতার বাড়িতে এক অবিবাহিত কাকা ছাড়া তেমন কেউ নেই। সন্দীপের বিয়ের জন্যে কাকাই উদ্যোগ নিয়ে মেয়ে দেখছিলেন। মেয়ে দেখতেই ছুটি নিয়ে কোলকাতা এসেছিল সন্দীপ। সেদিন ছিল রবিবার। শনিবার মেয়ের বাড়ী থেকে ঘুরে এসে বিষন্ন মুখে জানলার পাশে বসেছিল সে। মেয়ে পছন্দ হয়নি। কেমন যেন ভোঁতা সুন্দরী মেকি। কাকা বললেন ,

'অত খুঁতখুঁতে হলে তোকেও আমার মতো আইবুড়ো কার্তিক হয়ে থাকতে হবে...'

ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে উঁকি দিয়েছিল ঝকঝকে একটা মুখ

---'স্যার আছেন?'

--- কে ? মিতালী ? আমি তাই ভাবি ছুটির দিনে কে আবার আমায় খোঁজে।

--- আজকের দিনে আপনাকে কি করে ভুলি..

মিতালী কাকার পায়ের ধুলো নেওয়ার জন্যে সামান্য ঝোঁকার চেষ্টা করতেই কাকা ওকে বাধা দিয়ে বলেছিল ' থাক মা থাক। তোমাকে প্রণাম করতে হবে না। আমি জানি তুমি আমায় কতটা শ্রদ্ধা কর।'

কাকা মিতালীর সাথে সন্দীপের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। মিতালী একবার নমস্কার বলেই চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। সন্দীপের মনে হয়েছিল ঠিক এমনই মেয়ে সে চায় জীবনসঙ্গী হিসেবে-- ভাসা ভাসা চোখ,লজ্জা পাওয়া মুখ কিন্তু পায়ের দিকে নজর পড়তে একটু থমকে গেছল

মিতালী চলে গেলে কাকার কাছে সন্দীপ জেনেছিল খুবই দুর্ভাগা মেয়ে সে। মাত্র চার বছর বয়সে একটা অ্যাক্সিডেন্টে তার বাঁদিকের হাঁটুর তলা থেকে বাকিটা কেটে বাদ দিতে হয়। মিতালীর বাবার অর্থের অভাব নেই। চিকিৎসার ত্রুটি করেন নি। ছোটো থেকেই আর্টিফিসিয়াল কাঠের পা নিয়ে সে বড় হচ্ছে। ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে কাকার কলেজেই সে পড়াশোনা করছে। সাহিত্যের প্রতি তার প্রগাঢ় অনুরাগ। তাছাড়া এখনকার দিনের আর পাঁচটি মেয়ের থেকে আচার ব্যবহারেও অনেক আলাদা। কাকা তাই মিতালীকে বিশেষ ভাবেই স্নেহ করেন

সন্দীপ একরাতেই ডিসিশন নিয়েছিল মিতালীকেই বিয়ে করবে। ইতস্ততঃ করে সে কথা কাকাকে জানাতেই তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। সন্দীপের পিঠ চাপড়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। এরপর সবকিছুই খুব সহজে হয়ে যায়। বিয়ের পর মিতালীকে নিয়ে সংসার করার দুমাস হয়ে গেল। এর মধ্যে শ্বশুরবাড়ীর আমন্ত্রণে এক সপ্তাহের জন্যে কোলকাতা এসেছিল। সন্দীপ ভেবেছিল বাপেরবাড়ি ঘুরে মিতালীর মন ভালো হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানে এসেও বোধহয় একরাশ খারাপ লাগা নিয়ে সে বাড়ি ফিরছে।

মিতালী ফ্রেশ হয়ে এলে সন্দীপ বলে ,'ট্রেন খুব লেটে যাচ্ছে কখন বাড়ি পৌঁছাবোকে জানে! কাল থেকে আবার অফিসে জয়েন করতেই হবে। অনেকগুলো ছুটি চলে গেল..'

--- 'তোমায় তো আগেই বলেছিলাম। শুধু শুধু ছুটি নিয়ে কোলকাতা যেতে হবে না

--- আহা তা বললে কি হয়! তোমার বাবা অত করে ডাকলেন..আচ্ছা তুমি বোসো। আমি একটু ওয়াশ রুম হয়ে আসি তাছাড়া একটু চা পাওয়া যায় কি দেখি..

সন্দীপ চলে গেলে মিতালী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো সবাই কেন ডাকছিল তা তুমি জানো না সন্দীপ ! সবাই দেখতে চাইছিল আমি আদৌ ভাল আছি তো! জেঠিমণি তো বলেই ফেললো.. ' তোর সৌভাগ্য বটে! আমরা কেউ ভাবতেই পারি নি তোর এমন বিয়ে হবে বলি দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে ভালোই আছিস। ভেতরে অন্য কোনো ব্যাপার নেই তো?'

--- অন্য আবার কি ব্যাপার থাকবে জেঠিমণি?

--- না না আমরা সবাই মানে তোর বাবা মাও চিন্তা করছিল যে বড় মন দেখিয়ে আমাদের অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে গেল। আদৌ মান সন্মান দেবে তো? নাকি মেয়ের বাপের পয়সা দেখে নিয়ে গেল...ওখানে গিয়ে খোঁটা দেবে ... যন্ত্রণা দেবে...কিছুই তো অসম্ভব নয়...আজকালকার যুগ ...এমন কত হয়

আরো অবাক হয়েছিল মিতালী তার দিদির কথা শুনে 'হ্যাঁ রে বোন তোদের মধ্যে সবরকম সম্পর্ক ঠিকঠাক হয়েছে তো ? না মানে আমার বন্ধু লিপিকার কথা শুনেছিস তো। দেখতে মন্দ বলে বিয়ে হচ্ছিল না। তারপর এক সুদর্শন পাত্রের সাথে বিয়ে হল। এখন শুনছি ছেলেটা শারীরিক ভাবে

অক্ষম।..'

সন্দীপের কলিগ অশোকদার বউও তো বলেছিল 'তোমার মত ভাগ্যবতী কজন হয় মিতালী?'

লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে যায় মিতালী। একটা খুঁতওলা মেয়ে কি করে নিখুঁত স্বামী পেয়ে গেল!

এটা যেন কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু সন্দীপ কি ভেবে বিয়েটা করলো! বড় সাজতে! নাকি দয়া হয়েছিল!

কাঠের পা টার দিকে তাকিয়ে খুব রাগ হল মিতালীর। পা বাদ দিয়ে ওকে বাঁচিয়ে না রাখতেই পারতো ভগবান

সন্দীপ চা নিয়ে হাজির। মিতালী লুকিয়ে চোখের জল মুছলো। সন্দীপের সাথে সম্পর্কের মাঝে এই দ্বিধার প্রাচীর কবে ভাঙতে পারবে জানে না

ট্রেন প্রায় ঘন্টা লেটে কোরাপুট পৌঁছালো। রাত্রি হয়েছে। রিক্সা পাওয়া গেল না। মিতালী বললো 'এইটুকু পথ হেঁটেই চলে যাব।'

সত্যিই পথ বেশী নয়। তবু সন্দীপ চিন্তা করছিল

এতখানি ট্রেন জার্নির পর মিতালীর পক্ষে হাঁটা সম্ভব হবে কিনা।

ওদের কোয়াটারের প্রায় কাছাকাছি এসেই গেছিল।

গাছগাছালিতে ঘেরা অঞ্চল। ঝোপের আড়ালে ওৎ পেতে ছিল বিপদ। দুটো মাতাল আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো মিতালীর দিকে। সন্দীপের পিঠে ব্যাগ, হাতে ট্রলি। সে ট্রলি ফেলে ছেলেদুটোকে বাধা দিতে উদ্যত হল। তিনজনের হাতাহাতি লেগে গেল। সন্দীপ একটি ছেলেকে কোনরকমে শায়েস্তা করে মেঝেতে শুইয়ে দিতে পারলো। কিন্তু অপরজন পকেট থেকে একটা চাকু বার করে পেছন থেকে সন্দীপের দিকে তেড়ে গেল। প্রবল একটা চিৎকারে সন্দীপ পেছন ফিরে তাকালো। দেখলো চাকু ফেলে ছেলেটি নিজের মাথা দুহাতে চেপে ধরে লুটিয়ে পড়লো। মিতালী তার নকল কাঠের পা খুলে নিয়ে সেটা দিয়েই আঘাত করেছে বদমাসটাকে। নিজের শরীরটাকে একটা বড় গাছে ঠেসিয়ে কোনোরকমে একপায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে মিতালী। সন্দীপ তাড়াতাড়ি গিয়ে মিতালীকে ধরে মাটিতে বসিয়ে দেয়। মাতাল দুটো মার খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। সন্দীপ কাঠের পা টা এনে মিতালীকে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,' আজ থেকে আর এই পা নিয়ে লজ্জা পাবে না। এই নকল পা আজ বড় সর্বনাশ থেকে বাঁচালো আমাদের। '

আজ মিতালী নিজের শরীরে প্রথমবার পেল তার বাঁ পায়ের স্পর্শ , নকল পা নয়-- ওটা আজ ওর কাছে সত্যিকারের পা।

মিতালী ফুপিয়ে উঠে সন্দীপকে জড়িয়ে ধরলো। সন্দীপের মনে হল দুমাসের বিবাহিত জীবনে প্রথমবার সে মিতালীর হৃদয়ের স্পর্শ পেল



সমাপ্ত