অনুসরণকারী

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২২

ত্রিভুজ (নবম পর্ব)


 

ত্রিভুজ

সাথী দাস

নবম পর্ব


-কিরে,সাতটা বেজে গেলো দিয়া!ওঠ-ওঠ!
মায়ের গলা পেয়ে লাফ দিয়ে উঠলো দিয়া।
-কটা বাজে?
-সাতটা বাজতে যায়!
-আমি তো পাঁচটায় এলার্ম দিয়েছিলাম।
-হ্যাঁ,সেই এলার্ম বেজে-বেজে বন্ধ হয়ে গেছে।
-যাঃ!
-ওই মা-এলার্ম ছাড়া তোমার গতি নেই,নাও,ওঠো-ওঠো!
ঘড়ির দিকে দেখলো দিয়া।
-কি মা!ছটা বাজলো সবে!
-এই করতে-করতেই সাতটা বেজে যাবে।অঞ্জলি দিতে যেতে হবে।ওঠ!বলেই ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে বেরিয়ে গেলো নীলিমা।
এবার দিয়ার মনে পড়লো আজ সরস্বতী পুজো,মায়েরও শরীর খারাপ।ঘুমের ঘোর কাটতে ওর একটু সময় লাগলো।তারপরই ও ছুটলো মায়ের কাছে,
-মা,ও মা!তোমার শরীর কেমন আছে এখন?
-আরে একদম ঠিক!বললাম না,একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।এত চিন্তা করিস নাতো আমায় নিয়ে।
আনন্দে চোখে জল এসে গেছে দিয়ার।সারা পৃথিবী উচ্ছন্নে যাক,কিন্তু মায়েদের সবসময় সুস্থ-স্বাভাবিক-হাসিমুখে থাকতেই হবে।নইলে মনে হয়,কেমন যেন গোটা পৃথিবীটাই শূন্য!মাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলো ও।
-নে-নে যা,বাথরুমে গরম জল দেওয়া আছে,স্নানটা সেরে নে!
মনের আনন্দে লাফাতে-লাফাতে বাথরুমে ঢুকলো দিয়া।ব্রাশ করে নিজেকে সম্পূর্ণ অনাবৃত করলো ও।এখনও জলে হাত দিতে গেলে ঠান্ডায় শরীর কাঁপে!একটু জল হাতে নিয়ে গায়ে ছিটালো ও।সারা শরীর কেঁপে উঠলো।এখন ঠান্ডার থেকেও বেশি,আনন্দে কাঁপছে ও।মায়ের শরীর ভালো আছে,মা ঠিক আছে।সকালে মা ওকে ডেকে তুলেছে আজ,রোজকার মতোই।হঠাৎ করেই ঋকের কথা মনে পড়ে গেলো দিয়ার।ঋক গতকালই বলেছিলো,"দেখবে,সকালে তোমার মা-ই আবার চিৎকার করে তোমায় ডেকে তুলবে!"
তাই-ই হয়েছে!ও যা বলে সবসময় তাই হয়।বিকাশ 'সরি' বলেছে,আর কোনোদিনও ওদের কিছু বলতে আসেনি।মা-ও ঠিক হয়ে গেছে।আর ঋককে ভুল করেও কোনোদিন ভুল বুঝবে না দিয়া।ও যা করবে,যা বলবে,তা ওর ভালোর জন্যই বলবে।মৃদু হেসে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো দিয়া।
-কিরে!তোর হলো?এই ঠান্ডায় কি বাথরুমে ঢুকে জলের মধ্যে চুবে বসে আছিস?মার গলা পেলো দিয়া।মা গলা ছেড়ে চেঁচাচ্ছে।
-আসছি-আসছি!এই তো হয়ে গেছে!
বলেই ঝপ করে গায়ে জল ঢেলে নিলো দিয়া...
-নে,শাড়িটা পরিয়ে দিলাম।এবার নিজে একটু সেজে নে দেখি!আমার আবার ওদিকে ডাল ফুটে যাচ্ছে!বলেই রান্নাঘরের দিকে ছুটলো নীলিমা।
আধ-ঘন্টাখানেক পর নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো শারদীয়া।
-মা!দেখো তো,ভালো লাগছে?
নীলিমা কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলো না দিয়াকে দেখে!এ কাকে দেখছে ও!দিয়া নয়,ওর চোখের সামনে যেন সদ্য-যৌবনপ্রাপ্ত নীলিমা এসে দাঁড়িয়েছে!মাথার চুলটা সম্পূর্ণ খোলা,নীলিমার সবুজ রঙের ব্লাউজের সঙ্গে রমার গাঢ় নীল রঙের শাড়ি,কপালে ছোট একটা কালো টিপ,চোখে গভীর কাজল আর ঠোঁটে হালকা ওষ্ঠরঞ্জনী!এইরকম হালকা সাজই তো বরাবর পছন্দ করতো নীলিমা,কারণ রণ এই সাজেই ওকে বারংবার দেখতে চাইতো,যতবার দেখতো,ততবারই পাগল হতো ওর রূপে!দিয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না নীলিমা,শুধু এগিয়ে এসে নিজের ঘরের ড্রয়ার থেকে ঘড়িটা এনে দিয়ার ডানহাতে পরিয়ে দিলো ও।
-মা,বললে না তো আমায় কেমন লাগছে?
-মায়েদের নিজের মুখে সব কথা বলতে নেই রে মা!
-এ আবার কি!
-যা,বেরিয়ে পর!আর দেরি করিস না।রমা আন্টির বাড়ি যাবি তো আগে?
-হুম,কাল ঋক বলছিলো গাড়ি পাঠাবে কিনা!আমিই বারণ করেছি।এইটুকু হেঁটেই চলে যাবো আমি!
-আচ্ছা!সাবধানে আয়।গুঞ্জা,সোমদত্ত ওরা?
-ওরা তো বলেছে রমা আন্টির বাড়িতেই চলে আসবে।তারপর সবাই একসঙ্গে ওদের গাড়ি করেই স্কুলে যাবো!
-আচ্ছা!
-তুমি কিন্তু বললে না মা আমায় কেমন লাগছে!জুতো পরতে-পরতে দিয়া বললো।
মৃদু হেসে নীলিমা বললো,
-টাটা!
-হুম বাই!সাবধানে থাকবে তুমি।আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে!
ছোট্ট একটা ঝোলানো ব্যাগ ডান কাঁধে ফেলে বেরিয়ে পড়লো দিয়া।নীলিমা একভাবে চেয়ে রইলো ওর দিকে,যতক্ষণ পর্যন্ত ও সিঁড়ি দিয়ে না নেমে যায়।একটাই কথা নীলিমা বললো,
"তোর যদি তার দৃষ্টি পড়ার ক্ষমতা থাকে,তাহলে আমায় আর কিছু বলতে হবে না মা,তুই আজ নিজেই বুঝে যাবি,তোকে কেমন লাগছে!!"
একটু হেসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো নীলিমা।
-আন্টি!গুড মর্নিং!গুড মর্নিং আঙ্কেল!
ডাইনিং টেবিলে সৈকত বসেছিলো,রমা সবে খেতে দেবে বলে এসে দাঁড়িয়েছে।সেই সময়ই সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো শারদীয়া।
-পরেছিস আমার শাড়িটা?দেখি-দেখি!কি সুন্দর লাগছে রে তোকে!এই শোনো,ক্যামেরাটা নিয়ে এসো তো,মেয়েটার একটা ছবি...
-আন্টি,সবাই আগে আসুক,তারপর একসঙ্গে ছবি তুলবো!ওরা রেডি তো?
-জানিনা বাবা!সকাল থেকে ছোটটাকে ডেকে-ডেকে আমার গলা বসে গেলো।বড়জন তো একটু আগে উঠলেন!এবার তুমি যাও,গলা ফাটিয়ে ডাকো গে যাও...
-উফফ!আন্টি দশটা থেকে অঞ্জলি!কি যে করে না এরা!আমার আর ভালো লাগে না গো!আমি গিয়ে এবার মেরেই ফেলবো...
-হ্যাঁরে দিয়া!নীলিমার শরীর কেমন আছে রে?নীচ থেকে চেঁচালো রমা।
-ভালো আন্টি!মা-ই তো সকালে আমায় ডেকে তুললো।নইলে আমিই আজ সবার কাছে গালাগালি খেতাম!
হেসে ফেললো রমা।সৈকতকে খেতে দিলো ও...দিয়া ওপরে উঠে গেলো...
কোনোরকমে শাড়ির কুঁচি সামলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলো দিয়া।অন্যদিনের মতো লাফাতে-লাফাতে উঠতে পারছিলো না ও।আস্তে-আস্তে উঠছিল।সিঁড়ি শেষের মুখে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়লো ও।এক মুহূর্তের জন্য ঋক ভুলে গেলো,ও যে অবস্থায় রয়েছে,ওর নিজের ঘরে ঢুকে যাওয়া উচিত।আর দিয়াও ভুলে গেলো ওর ওখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।ঋক তখন আর চোখ সরাতে পারছে না দিয়ার ওপর থেকে,ও ভুলে গেল,যে ও শুধুমাত্র একটা তোয়ালে পরে দিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে...
সবেমাত্র স্নান করে বাথরুম থেকে বেরোচ্ছিলো ঋক।সারা শরীর অনাবৃত।তখনও গা বেয়ে অল্প জল পড়ছে,পরনে একটা তোয়ালে,আর একটা তোয়ালে গলায় ঝোলানো।নিজের ঘরের দিকেই যাচ্ছিলো ও,কিন্তু সেই মুহূর্তেই সিঁড়ি থেকে দিয়া উঠে ওর সামনে দাঁড়ানোয়,ওর পা দুটো ওখানেই আটকে গেছে।আর নড়তে পারছে না ঋক!কি অপূর্ব লাগছে দিয়াকে।এতদিন স্কুলের জামা আর টপ-প্যান্ট পরা অবস্থায় দেখেছে ওকে।কবে যে বালিকা থেকে একজন পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠলো দিয়া,ঋক বুঝতেও পারলো না।আজ শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দিয়াকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো ও।চোখের দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়!!
দিয়া কোনোদিন এর আগে ঋককে এভাবে দেখেনি।একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ও।তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলো।ভাবলো,ঋক হয়তো এর মধ্যেই নিজের ঘরে চলে যাবে!কিন্তু আবার চোখ তুলে দিয়া দেখলো,ঋক তখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে,ওর দিকেই চেয়ে।অস্বস্তিকর পরিস্থিতি একটু সামলানোর জন্য দিয়া কোনোরকমে বলে উঠলো,
-ঋদ্ধি!ঋদ্ধি এখনও ওঠেনি ঋক?
ঘোর কাটলো ঋকের।
-হুম?হুম!না মানে,এখনও তো ওঠেনি মনে হচ্ছে!আমি তো স্নানের আগে ডেকে গিয়েছিলাম।
-আচ্ছা,আমি দেখছি!বলেই ওখান থেকে ঋদ্ধির ঘরের দিকে দৌড়ে পালাতে যায় দিয়া।কিন্তু তখনই পেছন থেকে ডাক পড়ে,
-দিয়া?
ঘুরে দাঁড়ালো দিয়া।
-কিছু বলবে?
-তোমায় আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে!
-থ্যাঙ্কু!তুমিই প্রথম বললে জানো!মাকে জিজ্ঞেস করলাম,মা তো কিছু বললোই না!
-মায়েরা কিছু বলে না!খারাপ কিছু হলে খুব চিৎকার করবে,কিন্তু আমাদের ভালো কিছু হলে,সুন্দর কিছু হলে নিজের মুখে বলবেই না!
-হুম!তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছো!
-আন্টি এখন কেমন আছে দিয়া?
-ভালো!ইনফ্যাক্ট খুবই ভালো।তুমি বলেছিলে,কাল সকালে আন্টিই তোমায় ডেকে তুলবে,তাই হয়েছে!থ্যাঙ্কু...
একটু হাসলো ঋক,তারপর বললো,
-যাও,দেখো ঋদ্ধি উঠলো কিনা!এরপর নইলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে!
-হুম!
দরজা ঠেলে দুম করে ঋদ্ধির ঘরের ভিতরে ঢুকলো দিয়া।ঋক নিজের ঘরে চলে এলো।ঘরে ঢুকেই গলা থেকে টেনে নামালো তোয়ালেটা।মাথাটা ভালো করে মুছে তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেললো চেয়ারে।তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ও,নিজেকে আয়নায় দেখে,মৃদু হেসে নিজেই চোখ নামিয়ে নিলো ঋক...
-কিরে!ঋদ্ধি!গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো দিয়া।
-কি!কে!উফফ!বাপরে!আঁতকে মরেই যাবো তো!এরম শাকচুন্নির মতো চিৎকার করে কেউ?
-কটা বাজে?
-সব ভালো!কিচ্ছু বাজে নেই আমার মধ্যে!
-ওরে ছাগল,ঘড়িতে কটা বাজে!ওঠ-ওঠ!টেনে ঋদ্ধির গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিতে যায় দিয়া!
-ওই-ওই পেত্নী,কম্বল ধরে টানিস না!তাহলে আর আমার মান-সম্মান কিছু থাকবে না!
-মানে!
-মানে আমি যা পরে ঘুমিয়েছি...
-ছোটলোক!কোনোদিনও কি তুই পুরো জামাকাপড় পরে শুবি না?ছুঁড়ে কম্বলটা ঋদ্ধির গায়ের ওপর ফেলে দেয় দিয়া।
-তুইও কি কোনদিন আমার ঘরে নক করে ঢুকবি না?
-তুই উঠবি কিনা!
-এই-এই এক মিনিট দাঁড়া!ওটা কি জড়িয়েছিস তুই?শাড়ি?সেদিন যে বললি,ওই শাড়ি-টাড়ি আমি পরবো না!
চোখ টেনে খুলে উঠে বসতে গেলো ঋদ্ধি।দিয়া হাসিমুখে চুল ঠিক করে বেশ সোজা হয়ে দাঁড়ালো।ঋদ্ধি উঠছে,ওকে দেখবে বলে।কিন্তু পুরোপুরি উঠলো না ও,বিছানা থেকে একটু উঠেই বললো,
-ওই,পিছন ঘুরে দাঁড়া!
-উফফ!!
ঘুরে দাঁড়ালো দিয়া।ঋদ্ধি কোনোরকমে জামাকাপড় পরে নিয়ে কম্বল থেকে বেরোলো।একেবারে দিয়ার সামনে এসে বললো,
-কই,তোকে দেখি-দেখি!
দিয়া হাসিমুখে ওর দিকে চেয়ে কোমরে একটা হাত দিয়ে দাঁড়ালো।
-এই তোকে তো শাড়ি পরে খুব একটা খারাপ দেখাচ্ছে নারে!ওকে দু-হাত দিয়ে ধরে ঋদ্ধি বললো।
ঋদ্ধির কথা শুনে মুখের মিষ্টি হাসিটা সঙ্গে-সঙ্গে মিলিয়ে গেলো দিয়ার।এটা কি রকম কথা হলো!হাঁ হয়ে গেলো ওর মুখটা,
-মানে!মানেটা কি!মানে আমি আজ প্রথমবার শাড়ি পড়লাম,আর আমার বেস্টফ্রেন্ড আমায় বলছে,যে আমায় শাড়ি পরে ততটাও ভালো লাগছে না,তাই তো?দূর হ হনুমান!ছিটকে ঋদ্ধির হাতের মধ্যে থেকে বেরোতে যায় দিয়া।ওকে টেনে ধরে ঋদ্ধি,
-আররে দাঁড়া না!পালাচ্ছিস কোথায়?
-তুই একদম আমার সঙ্গে কথা বলবি না,হনুমান একটা!
-শোন-শোন!
-কি!
-তোকে দারুণ লাগছে!
-সত্যি!
-একদম!ব্যাপক-ব্যাপক!দেখ,আজ কোনো বয়ফ্রেন্ড জুটে যায় কিনা!কোনো পাঞ্জাবী পরা হুঁকো-মুখো-হ্যাংলা আজ বুক ঠুকে তোকে প্রোপোজ করলো বলে!
-এই তোর ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি!ফালতু বকছিস!
-তবে যাই বলিস,লাগছে কিন্তু তোকে একঘর!বলেই আদর করে দিয়ার গাল টিপে দিলো ঋদ্ধি।
-এই মুখের সামনে থেকে সর তো,আগে ব্রাশ কর!নোংরা ছেলে!গুঞ্জা এসে গেলে তোকে গালাগালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দেবে!এখনো হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস তুই!যা-যা!
-আমার বাড়ি-আমার ঘর,আমাকেই ধাক্কা দিয়ে বের কর!ভালো-ভালো!ভগবান সব দেখছে!
-হ্যাঁ,জানি-জানি!তোর ভগবান আর আমার ভগবান আলাদা তো!তাই তোকেই একা দেখছে...এবার স্নানটা করে আমায় উদ্ধার কর!ঋদ্ধিকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে বাথরুমের দিকে পাঠালো দিয়া...
ঋদ্ধির ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শাড়িটা একটু ঠিক করে নিলো দিয়া।তারপর নীচে নামবে বলে সবে ঘর থেকে বেরোতে গেছে,মুখোমুখি দেখা ঋকের সঙ্গে।ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো দিয়া।
-তুমি এটা পরে যাবে?
-হুম!
ঋক একটা আকাশনীল জিন্সের ওপর হালকা সবুজ রঙের শার্ট পড়েছিলো।দিয়ার চোখে আজকের দিনে ব্যাপারটা খুব বেমানান লাগায় ও বলে উঠলো,
-তুমি আজ পাঞ্জাবী পরবে না ঋক?
-মানে আমি ঠিক পাঞ্জাবীতে...
-ঋক প্লিজ!আমি কত রোজ-রোজ শাড়ি পরে উল্টে দিই!!
-নাঃ!আমি আর...
-ফাইন!
আর কথা বাড়ালো না দিয়া।সোজা গিয়ে বাথরুমের দরজায় নক করলো ও,
-ওই,নীচে আছি!তাড়াতাড়ি আয়!
-আন্টি!ঋদ্ধি আর দিয়া...
নীচ থেকে গুঞ্জার গলার আওয়াজ পেলো দিয়া।ঋদ্ধিকে বললো,
-ওই এসে গেছে গুঞ্জা!এবার তুই গালাগালি খাবি,তাড়াতাড়ি করবি বলে দিলাম।আমি নীচে গেলাম।
-হু-হু আসছি...
ব্রাশ করতে-করতে ঋদ্ধি বাথরুমের ভিতর থেকে বললো।
ঋক তখনও একভাবে দিয়ার দিকে চেয়ে নিজের ঘরের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।ওর দিকে আর একবার দেখে নীচে নেমে এলো দিয়া।
ঋক আর নীচে নামলো না।নিজের ঘরে চলে এলো।আজ প্রথমবার দিয়া ওকে কিছু বললো।আর ও দিয়ার কথা রাখবে না সেটা কি হয়!হাসিমুখে শার্টের বোতামগুলো খুলে একটানে শার্টটা শরীর থেকে নামিয়ে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেললো ঋক...
-কি লাগছিস দিয়া!উফফ!দিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামার পর ওর দুটো হাত ধরে গুঞ্জা বললো।
-তুইও কিছু কম লাগছিস না!
দুজনেই হেসে উঠলো।
-এই তোরা একটু দাঁড়া দেখি সবকটা!আমি একটা ফটো তুলে রাখি!এক্ষুণি তো সব ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাবি!আজ আর সারাদিন টিকিটাও পাওয়া যাবে না তোদের!নে-নে চটপট দাঁড়া!ক্যামেরা হাতে নিয়ে রমা বলে উঠলো।
দিয়া আর গুঞ্জা চটপট দাঁত বের করে একে-অপরকে ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়লো।ওদিকে সোমদত্ত চোয়াল ঝুলিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।ওকে কেউ ডাকলোও না।একটা ফটো তোলার পর দিয়া রমার দিকে এগিয়ে বললো,
-আন্টি!দাও দেখি ক্যামেরাটা!এই গুঞ্জা-সোমদত্ত তোরা দাঁড়া দেখি!
এইবার দাঁত বের করে হনুমানের মতো এক লাফে গুঞ্জার পাশে এসে দাঁড়ালো সোমদত্ত।ক্যামেরায় ফোকাস করে সবেমাত্র একটা ফটো তুলেছে দিয়া,তারপরই ওপরে সিঁড়ির দিকে চেয়েই চোখ দাঁড়িয়ে গেলো ওর।সিঁড়ি দিয়ে তখন ঋক নামছে।গাঢ় মেরুন পাঞ্জাবীর ওপর নীল রঙের গলাবন্ধ,বাঁ-হাতে একটা ঘড়ি,মাথা নামিয়ে ডান হাত দিয়ে বাঁ-হাতের পাঞ্জাবীর হাতাটা গোটাতে-গোটাতে নীচে নামছে ও...দিয়া আর চোখ সরাতে পারলো না ঋকের ওপর থেকে।ঘোর কাটলো সোমদত্তর কথায়,
-কি লাগছো প্রান্তিক দা!উফফ!তুমি কি আমাদের সঙ্গেই আসছো নাকি!না মানে,তুমি সঙ্গে এলে,আজ আর আমাদের দিকে কেউ তো ফিরেই তাকাবে না!
-হ্যাঁ-রে,তোর কি এখনও ফিরে তাকানোর দরকার আছে রে!গুঞ্জার বজ্রনিনাদ শোনা গেলো।
-ইয়ে না মানে...
-দাঁড়া তুই...
গুঞ্জা আর সোমদত্ত ততক্ষণে বেশ মিষ্টি একটা ঝগড়া বাধিয়ে ফেললো।দিয়া এক-পা এক -পা করে ঋকের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-বরাবরই পারফেক্ট তুমি!কিন্তু এত্ত যে হ্যান্ডসাম,সেটা জানতাম না তো!
ঋক চোখ তুলে একবার দিয়াকে দেখলো।ও ইচ্ছে করেই মেরুন পাঞ্জাবীর ওপর নীল গলাবন্ধটা পরলো,নীল রঙে বড্ড মানায় দিয়াকে।আজ যে ওকে কি ভীষণ সুন্দর লাগছে!ওকে দেখার পর থেকেই একরাশ মুগ্ধতা ঋকের দু-চোখ জুড়ে রয়েছে।ঋকের চোখের সেই ছায়া কি দিয়া পড়তে পারবে!একটু কি বুঝতে পারবে আজ ওকে!যে ও প্রতিটা দিন,প্রতিটা মুহূর্ত মরছে শুধু ওর জন্যই,ওকে একটু দেখার জন্যই,ওকে একটু ছোঁয়ার জন্যই...কে বলেছে ভালোবাসার রঙ সবসময় লালই হয়!কখনও-কখনও ভালোবাসার রঙ এক-আকাশ নীলও হয়!সেই নীলেই আজ ভীষণভাবে নিজেকে একটু নীলিয়ে নিতে ইচ্ছে করলো ঋকের...
-তাই!বলছো!একটু হেসে মাথা নামিয়ে ঋক বললো।সঙ্গে-সঙ্গে ওর ডান গালের দাড়ির মধ্যে খেলে গেলো একটা টোল।দিয়াও হেসে ঋকের ডান গালটা ধরে আলতো করে টিপে দিলো...
-কিরে!তুই যে বললি,পাঞ্জাবী পরবি না!হঠাৎ করে আবার পরলি?ইস্ত্রি করা ছিল?সব তো আলমারীতে গুঁজে-গুঁজে রাখা স্বভাব তোর!কুঁচকে নেই তো?তখনই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছেলের দিকে এগোলো রমা।
-নানা!ঠিক আছে!আমি করে নিয়েছি ইস্ত্রি!ঋক বললো।
তখন ঋক আর দিয়া দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।পাশাপাশি কি ভীষণ সুন্দর মানিয়েছে ঋক আর দিয়াকে।রমার চোখদুটো জুড়িয়ে গেলো।এইরকম একটা মেয়ের জন্যই তো একদিন মরে যেত ও।আর মাত্র কয়েকটা বছরের অপেক্ষা।তারপর দিয়াকে একেবারে নিজের করে এই বাড়িতে নিয়ে আসবে রমা,ঋকের জন্য!ওই ছেলের দু-চোখে দিয়ার জন্য যে পাগলামো,যে অনন্ত অপেক্ষা দেখে এসেছে রমা,তা ও মিথ্যে হতে দেবে না।এগিয়ে গিয়ে ছেলের পাঞ্জাবী ঠিকঠাক আছে দেখে দিয়ার দিকে চেয়ে রমা বললো,
-কিরে!ক্যামেরাটা কি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য!একটা ছবি তোল আমার ছেলেটার!
-ওঃ হ্যাঁ!ঋক দাঁড়াও!
-নানা!ঠিক আছে!সবার সঙ্গে একসাথে না হয়...ঋক লজ্জায় পড়ে গেলো।
-হ্যাঁ,ঠিক আছে,সবার সঙ্গে তো হবেই!আগে তোমার একটা তুলি!তোমায় আজ যা লাগছে না ঋক,ভালো কথা বলছি,ছবি তুলে রাখো!ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে দিয়া বললো।ঋকের একা একটা ছবি তোলার পর দিয়া বললো,
-ওই গুঞ্জা,ঝগড়া পরে করবি,এদিকে আয়,সবার একসঙ্গে একটা ছবি তুলি!
-না!তোরা তোল!আমি ঐ উজবুকের সঙ্গে কোনো ছবি তুলবো না!সোমদত্তর দিকে চেয়ে গুঞ্জা বললো।
ছেলেমেয়েদের কান্ডকারখানা দেখে রমা হেসে ওখান থেকে সরে গেলো।
-তার চেয়ে বরং তুই দাঁড়া প্রান্তিক দার পাশে,আমি তোদের একটা ছবি তুলে দিচ্ছি!এদিকে ক্যামেরাটা দে!আর ঋদ্ধিটা তো বিয়ে করতে যাচ্ছে,প্রচুর সময় লাগবে সাজুগুজু করতে,এখন নামবেই না!করেটা কি ছেলেটা?এতক্ষণ সময় কোন ছেলের লাগে রে!!
চেঁচিয়ে উঠলো গুঞ্জা।নেহাত সামনে ঋক রয়েছে,তাই আর গালাগালি দিতে পারলো না ও।নইলে মুখ-খারাপ করার ব্যাপারে গুঞ্জার জুড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না।এগিয়ে এসে দিয়ার হাত থেকে খাবলে ক্যামেরাটা নিয়ে নিলো ও,
-নে-যা!প্রান্তিক দার পাশে দাঁড়া দেখি!
দিয়া হাসিমুখে এগিয়ে এসে ঋকের পাশে দাঁড়ালো।ঋকের তখন এত জোরে হৃদস্পন্দন হচ্ছে,মনে হচ্ছে দমটাই বন্ধ হয়ে যাবে।দিয়া একপিঠ খোলা চুলটা ডানদিক দিয়ে বুকের সামনে নিয়ে নিয়েছে,ওর চুল থেকে ভেসে আসছে সেই চিরপরিচিত পাগল করা গন্ধটা,আর তার সঙ্গে আজ ওর শরীর থেকেও ভেসে আসছে নাম-না-জানা কোনো সুগন্ধীর সৌরভ!মাতালের মতো ঘোর লেগে যায় সেই গন্ধে!দিয়া ততক্ষণে এগিয়ে গিয়ে,ডান হাত দিয়ে আলতো করে ঋকের কোমরটা ধরে দাঁড়িয়েছে।ঋক ওর দিকে চেয়ে একটু হেসে বাঁ-হাত দিয়ে ওকে ধরে দাঁড়াতে যাবে,সেই সময় ধুপধাপ করে পড়িমরি করতে-করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো ঋদ্ধি।
হালকা হলুদ একটা পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পরে আজ বেশ মিষ্টি লাগছে ঋদ্ধিকেও।বোঝাই যাচ্ছে বসন্ত-পঞ্চমীর হাত ধরে ধীরে-ধীরে বসন্ত আসতে চলেছে সবার জীবনেই।কৈশোরের খোলস ছেড়ে,কৈশোরকে বিদায় জানিয়ে একটু-একটু পুরুষ হয়ে ওঠার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঋদ্ধিও...
-কিরে!আমাকে ছাড়াই তোরা ছবি তুলতে শুরু করে দিলি?আররে ভাই-ভাই!আমার ভাইকে আজ কি লাগছে!আরে কার ভাই দেখতে হবে তো!
ঋদ্ধির কথায় হেসে ফেললো ঋক।
-তা তুই যদি আদি-অনন্তকাল সময় লাগাস,তো আমরা কি করবো!এরপর সময়কালে দেখবি,তোর দেরি দেখে বিয়ের আসর থেকে তোর বউ-ও কেটে পড়েছে!খেঁকিয়ে উঠলো গুঞ্জা।
-এই বেশি বকিস না তো!নে-নে চল!তোল ফটো!
বলেই দিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ওর কোমরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ঋদ্ধি।
-কিরে পেত্নী!ভালো লাগছে আমায়?দিয়ার দিকে চেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো ঋদ্ধি।
-পাক্কা হনুমান লাগছিস!মুখ বেঁকিয়ে হেসে দিয়া বললো।
-তাই নাকি!এতবড় কথা!দাঁড়া,শুধু একবার স্কুলে পৌঁছতে দে!তারপর দেখবি,আজ স্কুলে আগুন জ্বলবে,আগুন!
-কেন!তোকে দেখে আগুন জ্বলবে বুঝি?!হুহ!মুখ বেঁকিয়ে নিলো দিয়া।
-তোকে দেখে কিন্তু বোঝা যায় না রে পেত্নী!বেশ বোকাসোকাই মনে হয়,কিন্তু মাথায় তো বুদ্ধিটা ভালোই রাখিস!
-ওরে আমি আর কতক্ষণ ক্যামেরা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো!তাহলে এই করি আমরা,আর অঞ্জলি দিতে হবে না আজ!
-ওহ!সরি-সরি!নে-নে!ঝপ করে একটা ফটো তোল দেখি।আমার মতো সেলিব্রিটি মানুষ আবার খুব বেশি সময় পোজ ধরে রাখতে পারে না!ঝটপট তুলবি কিন্তু গুঞ্জা!
ভাইয়ের কথা শুনে দিয়ার সঙ্গে-সঙ্গে হেসে ফেললো ঋকও...
দিয়া তো আগে থেকেই ডান হাত দিয়ে ঋকের কোমর আগলে ধরেই রেখেছিলো,এবার বাঁ-হাত দিয়ে ঋদ্ধির কোমরের পাঞ্জাবীটা খামচে ধরলো।ঋক নিজের কোমরে দিয়ার আলগা স্পর্শে মৃদু হেসে,নিজের বাঁ-হাতটা দিয়ার কোমরে রাখতে গেলো।কিন্তু হাতটা রাখতে গিয়েই ও দেখলো,সেখানে আগে থেকেই হাত দিয়ে দিয়াকে জড়িয়ে রেখেছে ঋদ্ধি!!ভাইয়ের হাতে-হাত পড়ার আগেই ও চমকে তাড়াতাড়ি নিজের হাত-টা সরিয়ে নিলো।তারপর ঋক হাতটা রাখলো দিয়ার কাঁধে!এবার সবাই একসঙ্গে হাসিমুখে তাকালো ক্যামেরার দিকে।ছবিটা তুলেই গুঞ্জা বললো,
-এই ছবিটা কিন্তু দারুণ আসবে রে ঋদ্ধি!বাঁধিয়ে রাখিস পারলে ছবিটা।তোদের তিনজনকেই দারুণ লাগছিলো আজ!বলে হাসিমুখে ক্যামেরাটা ঋদ্ধির হাতে ফিরিয়ে দেয় গুঞ্জা...
তারপরই হইহই করে ওরা সবাই গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লো স্কুলের উদ্দেশ্যে...
অন্যদিকে ঋদ্ধির হাতের ক্যামেরায় বন্দী হয়ে রইলো দুই-ভাইয়ের সঙ্গে দিয়ার জীবনের খুব বিশেষ একটা সুখের মুহূর্ত!
তিনজনের এই নিষ্পাপ হাসিমুখের আড়ালে,যে মর্মান্তিক ঝড় আসতে চলেছে তা বুঝি ওদের তিনজনেরই অজানা!ওরা নিষ্পাপ,ওরা দামাল,ওরা বর্তমানে বাঁচে,অনাগত ভবিষ্যৎ অত বেশি ভাবায় না ওদের!তাই তো ওরা নিজেদের শর্তে মন খুলে বাঁচতে জানে,হাসতে জানে,হাসাতে জানে!কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণের,ওদের ওই সবুজ মনটাকে কোনো দুঃখ স্পর্শও করতে পারে না!হয়তো শুধু সেই জন্যই ওরা নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসতে জানে!প্রথম ভালোবাসার জন্য,প্রথম প্রেমের অনুভূতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিতেও জানে!কিন্তু কত অব্যক্ত ত্রিভুজ যে ওদের দৃষ্টিকোণের বাইরে,ওদের সবার অলক্ষ্যে ধীরে-ধীরে গড়ে উঠছে,তার খবর বোধহয় ওদের কাছে পৌঁছয় না...
-ওই ঋদ্ধি!সোমদত্ত ঋদ্ধিকে ডাকে।
-কি রে!মাথা নীচু করে হাতের ক্যামেরাটা নিয়ে,তখন একমনে খুটখাট করছিল ঋদ্ধি।
-ওই দেখ তিতির!তোকেই দেখছে!
চমকে উঠলো ঋদ্ধি।
-এই খেয়েছে!আমি পালালাম!দিয়া কোথায় রে!ওর সঙ্গে থাকলে আর কথা বলতে আসবে না!
-এভাবে কতদিন পালাবি?
-আজীবন!একদৌড়ে দূরে দিয়ার কাছে ছুটে পালালো ঋদ্ধি।দিয়া তখন গুঞ্জার পাশে দাঁড়িয়ে আরও কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলো।
-এই দিয়া....লাফিয়ে দিয়ার ঘাড়ের ওপর পড়লো ঋদ্ধি।
-কিরে!কি হলো তোর,হাঁপাচ্ছিস কেন?পৃথিবী জয় করে এলি নাকি!
-আররে ধুর!তুই এদিকে আয় তো!প্লিজ এক্সকিউজ আস!সবার মাঝখান থেকে টেনে দিয়াকে বের করে আনলো ঋদ্ধি।
-উফফ!ছাড় না,হাতে লাগছে তো আমার!
-লাগুক!আমায় বাঁচা!
-কি হলো!আগুন লেগেছে নাকি স্কুলে!কিন্তু তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুই নিজেই জ্বলে যাচ্ছিস!
-আরে ধুর!স্কুলে আগুন লাগলে তাও নেভানো যেত,কিন্তু এ তো...
-কি হয়েছে বলবি!নইলে আমি গেলাম।পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে দিয়া।
-তিতির!
-কি!দাঁড়িয়ে পড়লো দিয়া।
-তিতির!স্কুলের গেটের সামনে যেতেই পারছি না,সবার মধ্যে দিয়েও আমার দিকেই চেয়ে আছে!উফফ!!এ তো আচ্ছা ঝামেলা!
-ভালো তো!একটু মুচকি হেসে হাঁটতে শুরু করলো দিয়া।
আবারও ওর হাত ধরে ওকে নিজের কাছে টেনে ধরলো ঋদ্ধি।
-ওই ভালো মানে!তুই আমার সঙ্গে-সঙ্গে থাকবি!
-মানে!!টেনে একটা লাথি মারবো ঋদ্ধি!আমি কি তোর বডিগার্ড!ছাড় আমাকে...
-প্লিজ!প্লিজ!প্লিজ!একটু বাঁচিয়ে দে না,সোনা আমার!তুই সঙ্গে থাকলে ও আর কথা বলতে আসে না,আমি দেখেছি এটা।প্লিজ...
-হুম,আমি তোমার সঙ্গে থাকতে পারবো না,চাইলে তুমি আমার সঙ্গে-সঙ্গে থাকতে পারো!একটু মিথ্যে রাগ দেখিয়েই দিয়া বললো।
-থ্যাঙ্কু-থ্যাঙ্কু!এইজন্যই আমি তোকে এত্ত ভালোবাসি!
-হ্যাঁ-রে ছাগল!ছড়াবে তুমি আর গোছাবো তো আমি!আজীবন তাই করে গেলাম...
একটু হেসে ঋদ্ধি দিয়ার কাঁধে হাত রেখে ওর সঙ্গে স্কুলের মাঠের দিকে চলে গেলো।
-কিরে প্রান্তিক!এখানে একা দাঁড়িয়ে?ঠাকুরের কাছে চল!
স্কুলের দোতলার বারান্দা থেকে ঋদ্ধি আর দিয়ার ছেলেমানুষি দু-চোখ ভরে দেখছিলো ঋক।আজ সকালে যখন থেকে দিয়া ওদের বাড়ি এসেছে,এক মুহূর্তের জন্যও দিয়ার ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না ঋক।কি যে অপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে দেখতে!ওকে প্রাণখোলা হাসি হাসতে দেখে,প্রতিটা মুহূর্তে ওর শরীরী বিভঙ্গ দেখে,মনের সঙ্গে-সঙ্গে এই প্রথমবার শরীরেও আগুন জ্বলে যাচ্ছে ঋকের।অদ্ভুত একটা শিরশিরে ভালোলাগা ওকে সকাল থেকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে!এত ভালো আগে কোনোদিন লাগেনি ওর,এত প্ৰবলভাবে দিয়াকে কাছে পেতে,এর আগে আর কোনোদিনও ওর ইচ্ছে হয়নি।আদিত্যর ডাকে ফিরে চাইলো ঋক।
আদিত্য,ঋকের বেস্টফ্রেন্ড!ঠিক হয়তো বেস্টফ্রেন্ড বলা যায় না,কারণ এমনিতেই ঋক ভীষণ চাপা স্বভাবের।কোনোদিনও কারোর সঙ্গে নিজের মনের সবটুকু উজাড় করতে পারে না,এমনকি আদির সঙ্গেও না।তবে ওর মনের একশ শতাংশের মধ্যে দুই শতাংশ যদি কেউ জেনে থাকে,তবে সে হলো আদিত্য।সবটুকু না হলেও,মাঝে-মধ্যে ওর সঙ্গে কিছুটা কথা ঋক বলে।দিয়াকে একমনে দেখতে গিয়ে আদি যে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে,ঋক খেয়ালও করেনি!
-হ্যাঁ!আসছি!
-এখানে একা-একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?চল,অঞ্জলি তো এক্ষুণি শুরু হয়ে যাবে।ঝিনুক তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলো।তুই এসেছিস কিনা!
দিয়া আজ ঋকের শরীর-মন-মস্তিষ্কের ওপর এতটাই গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে,যে ঝিনুক সম্পর্কিত কোনো কথা,ঠিকমতো ওর কানেও ঢুকলো না।
-চল-চল!বলে আদির কাঁধে হাত রেখে বাইরের বারান্দা থেকে স্কুলের ভিতর দিকে চলে গেলো ঋক...
-কিরে,কতক্ষণ এসেছিস?ঝিনুক জিজ্ঞাসা করলো ঋককে।
হালকা বাসন্তী রঙের স্বচ্ছ জামদানী শাড়িতে ঝিনুকের শরীরটা ঢাকা।কিছুটা স্বচ্ছ হওয়ায়,শাড়িটা ঝিনুকের শরীরী উত্থান-পতন সম্পূর্ণভাবে ঢাকতে অসমর্থ।ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে,একবার ওর দিকে চেয়েই মাথাটা নামিয়ে নিলো ঋক।চোখ নামিয়েই বললো,
-এই তো কিছুক্ষণ!
কয়েক মুহূর্ত ঋকের দিকে চেয়ে বাঁ-হাতের ওপর আলগাভাবে পড়ে থাকা খোলা আঁচলটা বুকের ওপর টেনে নিলো ঝিনুক।
-ওহ!আমি এসে তোকেই খুঁজছিলাম..
-তার মানে আজ তুই যতক্ষণ স্কুলে থাকবি,আমাকে এভাবেই পাহারা দিতে হবে!তাই তো?ঠাকুরের সামনে আসতে-আসতেই দিয়া বলে উঠলো।
দিয়ার গলার শব্দ পাওয়ামাত্রই মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো ঋক।ঋদ্ধির সঙ্গে ও তখন ঘরে ঢুকছে,অঞ্জলি দেওয়ার জন্য।ওদের পিছনেই গুঞ্জা আর সোমদত্ত।ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ঝিনুক দেখলো,ঋক একভাবে শুধু দিয়াকেই দেখছে।ওর দৃষ্টিতে শুধুই অপার মুগ্ধতা!মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে সরস্বতীর মুখের ওপর দৃষ্টি রাখলো ও।আজ আর কিছুতেই কাঁদবে না ঝিনুক।এতবড় হয়ে গেছে,এখনও ও ঠিকমতো নিজের চোখ আঁকতেও পারে না,যতবারই কাজল পরতে যায়,বেঁকে যায়,হাত কেঁপে যায়!সদাসর্বদা বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে রাখা ঝিনুক আজ প্রথমবার অনেক ধৈর্য্য নিয়ে সকাল থেকে নিজের চোখে কাজল পরেছে!নিজের বড়-বড় চোখদুটো দেখে একবার তো নিজেই প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলো।আজ সকালে স্কুলে এসে ওর কাজল-টানা একজোড়া চোখ শুধু একজনকেই খুঁজে বেড়িয়েছে।কিন্তু ঋক কেন দিয়াকেই এতটা গুরুত্ব দেয়!ওর চোখদুটো সবসময় কেন ওকেই খুঁজে বেড়ায়!কোনোদিনও কি দিয়ার ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঋক একবারও দেখবে না,ঝিনুক মরতে বসেছে শুধু ওর জন্যই...
-ভাই,শুরু হয়ে গেছে নাকি অঞ্জলি?ঋদ্ধি ঋককে জিজ্ঞেস করলো।
-নাঃ!এবার শুরু হবে।তোর জন্যই সবাই অপেক্ষা করছিলো।
একটু হেসেই ঋক বললো।ঋদ্ধিও সশব্দে হেসে উঠলো।গুঞ্জা ঋদ্ধির পাশে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলো,দরজা দিয়ে তিতির ঢুকছে!একটু দুস্টুমি করে ও সঙ্গে-সঙ্গে ঋদ্ধির পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে জায়গাটা ফাঁকা করে দিলো।দিয়ার একপাশে ঋক,আর একপাশে ঋদ্ধি দাঁড়িয়ে ছিল।এবার ঋদ্ধির অপর পাশে তিতির এসে দাঁড়ালো।আর ঋকের অপর পাশে ঝিনুক,সবশেষে ঝিনুকের পাশে আদিত্য।পেছনে সোমদত্ত আর গুঞ্জা।বকবক করতে-করতে দিয়ার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে গুঞ্জার দিকে তাকাতে গিয়েই চোখ দাঁড়িয়ে গেলো ঋদ্ধির।ওর পাশে তখন তিতির দাঁড়িয়ে আছে।কোনোরকমে ঢোঁক গিলে চোখ-কান বন্ধ করে মা সরস্বতীর দিকে মনসংযোগের চেষ্টা করলো ও।ঋদ্ধির এইরকম কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখে দিয়া একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেই বুঝতে পারলো কারণটা কি!হাসিটা চাপার অনেক চেষ্টা করেও,শেষ পর্যন্ত মুখ টিপে হেসেই ফেললো ও।দিয়ার পাশে দাঁড়ানো ঋক তখন সম্পূর্ণভাবে দিয়ার ঠোঁটের ওই হাসিটুকুতেই নিজেকে শেষ করছে।আর ঝিনুক!ও আপ্রাণ চেষ্টা করছে,নিজের চোখের জলটাকে আটকানোর।আজ ও চাইছে না,দুকূল ছাপিয়ে চোখে জল এসে,ওর এত সুন্দর করে পরা কাজলটুকুকে নষ্ট করে দিক!আজ অন্তত একবার ঋক ওকে দেখুক,একটিবার ও বুঝুক,যে ঝিনুকের যতটুকু সাজসজ্জা,ওর যতটুকু আমিত্ব,সবটুকুই ওর জন্যই...
ততক্ষণে ঠাকুরমশাই বলতে শুরু করে দিয়েছেন,
"সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে...
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে...."
ওনার সঙ্গে-সঙ্গে মায়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একপাল পড়ুয়াও আউড়ে চললো সেই মন্ত্র....
(চলবে)
তারপর বলো, এতদিনে কতগুলো ত্রিভুজের সন্ধান পেলে? আমি একটু বলি?
রমা-সৈকত-নীলিমা
সৈকত-নীলিমা-রণজয়
রণজয়-নীলিমা-অরণ্য
অরণ্য-নীলিমা-সৈকত
ঝিনুক-ঋক-শারদীয়া
আর? আর? আর?
অঞ্জলি দেওয়ার সময় এক লাইনে ঠিক কতগুলো ত্রিভুজ একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিল বলো দেখি?
আজকের পর্বে ত্রিভুজের খুব বিশেষ একটা মুহূর্ত বন্দি হয়েছে ক্যামেরায়। আজ নবম পর্ব শেষ হল। আগামীকাল দশম পর্ব অর্থাৎ মিস্টার চ্যাটার্জির গ্র্যান্ড এন্ট্রি! কতটা উত্তেজিত সবাই ত্রিভুজকে এভাবে ফিরে পেয়ে? 😍
উপন্যাসটি আংশিকভাবে (প্রথম দশটি পর্ব) পেজে প্রকাশিত হবে। সংগ্রহে রাখতে whatsapp করতে পারো পাঠকবন্ধুর নম্বরে - 7439112665
এছাড়াও পাওয়া যাবে flipkart ও amazon এও।

বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে: Indo Bangla Book Shop - +880 1556-436147 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন